মেরিয়াস এবার সরে গেল মেয়েটির কাছে। নিমজ্জমান ব্যক্তি একটা খড়কুটোকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার জন্য। সে বলল, ঠিক আছে, একটা কথা শোন–
সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেয়েটির চোখ দুটো। সে মাঝপথে মেরিয়াসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনি খুব সুন্দরভাবে কথা বলছেন। এটাই ভালো।
তুমি যে ভদ্রলোক আর তার মেয়েকে তোমাদের বাড়িতে এনেছিলে তাদের ঠিকানাটা জান?
না।
ঠিকানাটা জোগাড় করে দিতে পার?
মেয়েটি চোখ থেকে আলোটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে গেল।
আপনি শুধু এইটাই চান?
হ্যাঁ।
আপনি তাদের চেনেন?
না।
মেয়েটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে এবং কিছুটা তিক্তভাবে বলল, তার মানে আপনি মেয়েটিকে চেনেন না আর তার সঙ্গে পরিচিত হতে চান।
মেরিয়াস বলল, তুমি তার ঠিকানাটা জোগাড় করে দিতে পার?
সুন্দরী মেয়েটির ঠিকানা জোগাড় করে দেব।
তার কণ্ঠে দ্বেষের ভাব দেখে রেগে গেল মেরিয়াস। সে বলল, তার ঠিকানা সেটা বড় কথা নয়। ঠিকানাটা বাপ এবং মেয়ের দু জনেরই। তাদের ঠিকানা।
মেয়েটি কড়াভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল, কী দেবে তুমি?
তুমি যা চাইবে তাই দেব।
যা চাইব?
হ্যাঁ।
তা হলে আমি জোগাড় করে দেব।
এই বলেই সে দরজা বন্ধ দিয়ে চলে গেল।
মেরিয়াস একটা চেয়ারে বসে দু হাতের মধ্যে মাথাটা রেখে ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ আগে যা সব ঘটে গেছে অর্থাৎ মেয়েটির আকস্মিক আবির্ভাব, জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়ের প্রতিশ্রুতি তাকে ভাবিয়ে তুলঁল। তবে এই প্রতিশ্রুতির মাঝে সে একটা আশার আলো দেখতে পেল।
এমন সময় হঠাৎ পাশের ঘরে জনদ্ৰেত্তে’র কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল সে।
জনদেত্তে বলছে, আমি তোমাকে বলছি তাকে আমি ঠিক চিনতে পেরেছি।
মেরিয়াস ভাবল মঁসিয়ে লেবলাঁ ছাড়া আর কার কথা বলবে সে। তার এই ক্রুদ্ধ কর্কশ কথা বলার ভঙ্গির মধ্যেই কি পিতা-কন্যার কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে আর কিছু না ভেবে সে লাফ দিয়ে আবার সেই টেবিলটার উপর উঠে সেই ফুটো দিয়ে ওদের মধ্যে তার দৃষ্টি চালিয়ে দিল।
.
১২.
মেরিয়াস দেখল, ঘরখানার মধ্যে যেখানে যা ছিল সেখানে সব ঠিকই আছে। শুধু জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী আর দুই মেয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিয়ে যাওয়া গরম মোজাগুলো ছিল। কম্বল দুটো বিছানায় নামানো আছে।
বাইরে থেকে জনদ্ৰেত্তে এসে ঠাণ্ডা লাগার জন্য হাঁপাচ্ছিল। মেয়ে দুটি আগুনের ধারে বসে ছিল। বড় মেয়ে ছোট মেয়ের হাতের ক্ষত জায়গাটা বেঁধে যাচ্ছিল। তাদের মা একটা বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে ছিল। সে বিস্ময়ের সঙ্গে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিল। তার স্বামী তখন চোখে এক অস্বাভাবিক আলো নিয়ে ঘরের ভেতর পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল। তার কথা শুনে তার স্ত্রী হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, সত্যি বলছ? এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত।
অবশ্যই আমি নিশ্চিত। আট বছর হয়ে গেল। তবু আমি তাকে একনজরেই চিনতে পেরেছি। তুমি কী বলছ, তুমি তাকে চিনতে পারনি?
না।
কিন্তু আমি তো তোমাকে বললাম লোকটাকে ভালো করে দেখ। তার চেহারা, তার মুখ আট বছরের মধ্যে মোটেই বদলায়নি। এক ধরনের লোক আছে যাদের বয়স বেড়েছে বলে মনেই হয় না। কিভাবে যে ওরা দেহটাকে ঠিক রাখে তা আমি বুঝতে পারি না। ওর গলার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে ওর পোশাকটা এখন ভালো, এই যা। কিন্তু ঈশ্বরের নামে বলছি, ওকে আমি হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেছি।
এরপর সে তার মেয়েদের বলল, তোমরা এখন বেরিয়ে যাও। তুমি তাকে চিনতে পারলে না দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।
মেয়ে দুটি নীরবে উঠে পড়ল। তাদের মা মৃদু অনুযোগের সুরে বলল, ওর কাটা হাত নিয়ে বেরিয়ে যাবে?
জনদ্ৰেত্তে বলল, ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভালো থাকবে। যাও, চলে যাও।
জনদ্ৰেত্তে এমনই লোক যার কথার কোনও প্রতিবাদ করা চলে না। মেয়েরা তার কথা পালন করল। তারা ঘরের দরজার কাছে যেতেই জনদ্ৰেত্তে বলল, তোমরা দু জনেই ঠিক পাঁচটার সময় চলে আসবে। দরকার আছে।
মেরিয়াসের আগ্রহ বেড়ে গেল।
মেয়েরা চলে গেলে জনদ্ৰেত্তে আবার পায়চারি করে বেড়াতে লাগল ঘরের মধ্যে। হঠাৎ থেমে তার শেমিজটা তার কোমরের কাছে পায়জামার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, আর একটা কথা বলব তোমায়। ওই মেয়েটা…
তার স্ত্রী বলল, মেয়েটা? কী ব্যাপার?
কাদের সম্বন্ধে তারা কথা বলছে এ কথা বুঝতে আর বাকি রইল না মেরিয়াসের। এক উত্তপ্ত প্রত্যাশায় তার সমস্ত সত্তা কানের মধ্যে এসে কেন্দ্রীভূত হল। কিন্তু জনদ্ৰেত্তে এবার তার স্ত্রীর কানের কাছে মুখটা এনে চুপি চুপি কী বলতে লাগল। শেষে সে বলল, ও হচ্ছে সেই মেয়েটা।
স্ত্রী বলল, সেই মেয়েটা!
হ্যাঁ, সেই মেয়েটা।
এবার তার স্ত্রীর মধ্যে একই সঙ্গে বিস্ময়, ঘৃণা আর ক্রোধ ফুটে উঠল ভয়ঙ্করভাবে। তার স্বামী তার কানে কানে বলল তাতে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখা গেল তার মধ্যে। উদাসীন থেকে সে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।
সে বলল, অসম্ভব! আমাদের মেয়েরা খালি পায়ে এবং তাদের গায়ে কোনও পোশাক নেই। অথচ ওই মেয়েটার গায়ে দুশো ফ্রা’র পোশাক এবং ওকে এক সম্ভ্রান্ত মহিলার মতো দেখাচ্ছে। তোমার কথা ঠিক নয়। একটা কথা, সেই মেয়েটা তো দেখতে কুৎসিত ছিল, কিন্তু এই মেয়েটা তো দেখতে মোটেই খারাপ নয়। এ কখনও সেই মেয়ে নয়।