ভাড়া কত?
চল্লিশ স্যু।
কিন্তু মেরিয়াসের কাছে তখন মাত্র ছিল মোলো স্যু। সে তাই বলল, তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনার পর তোমার ভাড়া দেব।
গাড়িচালক জোরে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।
মেরিয়াস বিষণ্ণ দৃষ্টিতে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাত্র চল্লিশ স্যু’র অভাবে সে তার প্রেমাস্পদকে এবং তার জীবনের সুখ হারাতে বসেছে এবং তার ফলে সে আবার অন্ধকারে ডুবে যাবে। ক্ষণিকের জন্য একবার এক চকিত আলো দেখার পর আবার সে অন্ধ হয়ে উঠল। এই ভেবে সে অনুশোচনা করতে লাগল যে সে বোকার মতো পাঁচ ফ্রাঁ সেই দুস্থ মেয়েটিকে দিয়েছে। সেই পাঁচ ফ্রাঁ তাকে না দিলে এই হতাশা, লক্ষ্যহীনতা এবং নিঃসঙ্গতা হতে উদ্ধার করতে পারত নিজেকে। তা না হয়ে তার সৌভাগ্যের হারানো সুতোটা আবার ছিঁড়ে গেল। আবার সেই হতাশার অন্ধকারটা বুকচেপে বসল তার। সে নিবিড় হতাশার সঙ্গে বাসায় ফিরে গেল।
একথা ভেবে সে কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারত যে মঁসিয়ে লেবলাঁ কথা দিয়ে গেছে। সন্ধ্যার সময় সে আবার আসবে এবং তখন সে সাফল্যের সঙ্গে তাদের অনুসরণ করতে পারবে। কিন্তু সে এমনই বিষাদে মগ্ন হয়ে ছিল যে সে কথা তার মনেই এল না।
বাসাবাড়িতে ঢোকার মুখে সে দেখল জনদ্ৰেত্তে মঁসিয়ে লেবলাঁর দেওয়া কোটটা পরে বাইরে একজন নামকরা অপরাধীর সঙ্গে কথা বলছে। জনদ্ৰেত্তে এমনই একজন লোকের সাথে কথা বলছিল যার চোখ-মুখ দেখলে এবং যার কথা শুনলেই সন্দেহ জাগে, সে লোক সারাদিন ঘুমিয়ে রাতের বেলায় যতসব অপকর্ম করে বেড়ায়। তাদের দু জনের এই নির্জন আলাপ এবং কথাবার্তা সমাজের আইনশৃঙ্খলার অভিভাবকের পক্ষে বিশেষ আগ্রহের বস্তু। কিন্তু মেরিয়াস তা লক্ষ করেও করল না।
বিষণ্ণ চিন্তায় মেরিয়াসের মনটা আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও একটা কথা সে বেশ বুঝল জনদ্ৰেত্তে কথা বলছে পানশাদ ওরফে ব্রিগেনেলের মতো একজন কুখ্যাত লোকের সঙ্গে, যাকে একদিন কুরুফেরাক তাকে দেখিয়ে দেয় এবং সে একজন বিপজ্জনক রাতপাখি হিসেবে চিহ্নিত। তার নাম আগেই আমরা উল্লেখ করেছি এবং সে এর পরে কতকগুলি অপরাধে জড়িয়ে আদালতের বিচারাধীন আসামি হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করবে। বর্তমানে সে একজন অন্ধকার জগতের নায়ক এবং অপরাধীরা তাদের আড্ডায় ফিসফিস করে তার কথা প্রায়ই বলে। এমনকি লা কোর্স নামক জেলখানাতেও তার নাম কয়েদিদের মধ্যে আলোচিত হয়। ১৮৪৩ সালে যে তিরিশজন কয়েদি জেলখানার এক প্রস্রাবাগারের পাইপ বেয়ে আশ্চর্যভাবে পালিয়ে যায় তার মধ্যে পানশাদও ছিল। অবশ্য ১৮৩২ সাল থেকে তার ওপর নজর রাখতে থাকে পুলিশ। কিন্তু সে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি।
.
১১.
সিঁড়িতে ওঠার সময় মেরিয়াস দেখল তার পিছু পিছু জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়ে আসছে। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে উঠল তার। কারণ তাকে সে পাঁচ ফ্রাঁ আগেই দিয়ে দিয়েছে এবং তার জন্য তাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। এখন আর পাঁচ ফ্রাঁ ফিরে চাওয়ার কোনও অর্থ হয় না। কারণ তাদের গাড়িটা এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাছাড়া এখন চাইলে সে তা ফিরিয়ে দিতেও পারবে না। মঁসিয়ে লেবলাঁদের ঠিকানাটা চেয়েও কোনও লাভ নেই। কারণ মেয়েটি তা জানে না। চিঠিটা দেওয়া হয়েছিল চার্চের ঠিকানায়। মেরিয়াস তার ঘরের মধ্যে ঢুকে তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
কিন্তু বন্ধ হল না দরজাটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে মেরিয়াস দেখল একটা হাত দরজার একটা কপাট ধরে কে সেটা খুলে রেখেছে। দেখল, জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সে কড়াভাবে বলল, তুমি? আবার কী চাও তুমি।
মেয়েটি উত্তর দিল না এ কথার। সে মেরিয়াসকে লক্ষ্য করে কী ভাবতে লাগল। সে ঘরের ভেতর ঢোকেনি। বারান্দার আধো-আলো আধো-অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে আছে।
মেরিয়াস বলল, কী, কথার উত্তর দিতে পারছ না? কী চাও তুমি আমার কাছ থেকে?
মেয়েটি সকরুণ দৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়ে রইল মেরিয়াসের দিকে। তার চোখে বিষাদের কালো ছায়ার মধ্যে একটা ক্ষীণ আলোও ছিল। সে বলল, মঁসিয়ে মেরিয়াস,
আপনাকে বিচলিত দেখাচ্ছে। কী হয়েছে আপনার?
মেরিয়াস বলল, আমার?
হ্যাঁ।
আমার কিছুই হয়নি।
না, কিছু নিশ্চয় হয়েছে।
আমাকে একা থাকতে দাও।
এই বলে দরজাটা আবার বন্ধ করতে গেল মেরিয়াস। কিন্তু দরজার একটা কপাট ধরে মেয়েটি তবু দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি বলল, আপনি ভুল করছেন। আপনি ধনী নন। কিন্তু আজ সকালে আপনি যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন সদয় ব্যবহার করুন। আপনি আমাকে আমাদের খাওয়ার জন্য টাকা দিয়েছেন। এখন আপনার সমস্যাটা কী তা বলুন। আমি দেখছি আপনি কোনও কারণে দুঃখী এবং আমি সেটা চাই না। আমি কি আপনার জন্য কিছুই করতে পারি না? আপনি শুধু আপনার দুঃখের কথাটা বলুন। আমি আপনার গোপন কথা জানতে চাই না, আমাকে আপনার সব কথা বলতে হবে না। তবে আমি আপনার কোনও না কোনও কাজে লাগতে পারি। আমি আমার বাবাকে সাহায্য করে থাকি, সুতরাং আপনাকেও সাহায্য করতে পারব। কারও হাতে চিঠি দেওয়া, কারও বাড়ি যাওয়া, কারও ঠিকানা জোগাড় করা এবং কারও অনুসরণ করা–এইগুলোই হল আমার কাজ। এখন আপনি বলুন আপনি কী চান? দরকার হলে আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি। আপনি শুধু বলুন কী আপনার দরকার।