কথাটা একেবারে মিথ্যা। প্রথমত তার এক বছরের বাড়িভাড়া হল মোট চল্লিশ ফ্রাঁ, ষাট ফ্রাঁ নয়। তাছাড়া মাস ছয় আগে মেরিয়াস দু কোয়ার্টারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে।
মঁসিয়ে লেবলাঁ তার পকেট হাতড়ে পাঁচ ফ্ৰাঁ বার করে টেবিলের উপর রাখল। তা দেখে জনদ্ৰেত্তে তার বড় মেয়ের কানে কানে বলল। দেখলে বুড়োর কাণ্ডটা? পাঁচ ফ্রাঁতে কী হবে? চেয়ার আর কাঁচের দামও হবে না।
মঁসিয়ে লেবলাঁ তখন তার বাদামি রঙের ওভারকোটটা খুলে চেয়ারের পিঠের উপর ঝুলিয়ে রেখে দিল। তার পর বলল, শুনুন মঁসিয়ে ফাবান্ত, আমার কাছে এখন আর টাকা নেই, যা ছিল দিলাম। তবে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, সন্ধের সময় আবার আসব। আপনার তো আজকের সন্ধের মধ্যে ভাড়া দিতে হবে।
সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল জনদ্ৰেত্তে’র মুখখানা। সে বলল, হ্যাঁ মঁসিয়ে। আপনি ঠিক বলেছেন। আমাকে বাড়িওয়ালার বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে হবে আটটার সময়।
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, ঠিক আছে, আমি দুটোর সময় এসে আপনাকে ষাট ফ্রাঁ দিয়ে যাব।
জনদ্ৰেত্তে বলল, সত্যিই আপনি মহান স্যার।
এরপর সে তার স্ত্রীকে আড়ালে চুপি চুপি বলল, লোকটাকে দেখছ?
মঁসিয়ে লেবলাঁ এবার তার মেয়ের হাত ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, তা হলে সন্ধের আগে আমাদের আর দেখা হবে না।
জনদ্ৰেত্তে বলল, সন্ধে ছটা।
যা ঠিক ছটায়।
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বড় মেয়েটি তাদের পেছনে পেছনে গিয়ে বলল, মঁসিয়ে, আপনি আপনার ওভারকোটটা ভুলে রেখে যাচ্ছেন।
জনদ্ৰেত্তে তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে একবার তাকাল। মঁসিয়ে লেবলাঁ হাসিমুখে বলল, আমি ভুলে যাইনি; আমি ওটা ইচ্ছা করেই রেখে এসেছি।
জনদ্ৰেত্তে বলল, হে আমার রক্ষাকর্তা, আমার চোখে জল আসছে। দয়া করে আপনার গাড়ি পর্যন্ত আমাকে সঙ্গে যাবার অনুমতি দিন।
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, তা হলে আপনি কোটটা পরুন। বড় ঠাণ্ডা।
জনদ্ৰেত্তেকে আর বলতে হল না। সে সঙ্গে সঙ্গে কোটটা পরে নিল। সে আগন্তুকদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
.
১০.
মেরিয়াস একটু আগে ঘরখানায় যা যা ঘটেছে তা সব দেখেছে। কিন্তু আবার একদিক দিয়ে কিছুই দেখেনি। মেয়েটি ঘরে প্রবেশ করার পরমুহূর্ত থেকে তার চোখ মেয়েটির ওপর সর্বক্ষণ নিবদ্ধ ছিল। তার পর যতক্ষণ সে ঘরের মধ্যে ছিল ততক্ষণ এক গভীর আনন্দের আবেগ তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে ছিল। তার সমস্ত সত্তা, সমস্ত মনোযোগ একটি মাত্র বিষয়ের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। সে যেন একটি মেয়েকে দেখছিল না, সাটিন পোশাকে আবৃত এক আলোর প্রতিমূর্তিকে দেখছিল। যদি কোনও দেবদূত এসে সেই ঘরে ঢুকত তা হলে সে এর থেকে বেশি বিস্ময়ে অভিভূত হত না।
মেয়েটি যখন কাপড়ের প্যাকেটটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে তখন তার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করে, সে যখন রুগ্ণ মা ও আহত মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে তখন তার প্রতিটি কথা শোনে পরম আগ্রহের সঙ্গে। এর থেকে সে তার মুখচোখ ও প্রতিটি গতিভঙ্গি লক্ষ করেছে, কিন্তু কথা খুব কম শুনেছে। শুধু লুক্সেমবুর্গ বাগানে একদিন তাকে তার বাবার সঙ্গে কিছু কথা বলতে শুনেছে। তার কথা শোনা এবং তার কথার সুর অন্তরে বহন করার জন্য সারাজীবন সে অতিবাহিত করতে পারত। কিন্তু জনদ্ৰেত্তের হইচই ও গোলমাল করার জন্য তার কোনও কথা শুনতে পায়নি। সে শুধু তার ক্ষুধিত চোখের দৃষ্টি দিয়ে তার চেহারাটা গ্রাস করেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি তার মতো সুন্দরী মেয়ে অবর্ণনীয়ভাবে নোংরা পরিবেশ আর মানুষের মধ্যে কী করে এল।
মেয়েটি ঘর থেকে চলে যাবার পর তার খেয়াল হল তাদের পিছু পিছু গিয়ে তারা কোথায় থাকে, তা দেখে আসা উচিত। তা না হলে এতদিন পর আশ্চর্যভাবে অকস্মাৎ দেখতে পেয়েও আবার তাকে হারাতে হবে। টেবিল থেকে তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে নেমে সে তার মাথায় টুপিটা চাপিয়ে নিল। কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে ইতস্তত করতে লাগল। সে ভাবল তারা এখনও গাড়িতে চাপেনি এবং বাঁচাল জনদ্ৰেত্তে এখনও হয়তো কথা বলছে তাদের সঙ্গে। মঁসিয়ে লেবলাঁ যদি তাকে দেখে ফেলে তা হলে সে হয়তো ভয় পেয়ে যাবে এবং তাকে কৌশলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে।
তা হলে কী করবে সে? সে কি অপেক্ষা করবে কিছুক্ষণ? কিন্তু তা যদি করে তা হলে দেরি হয়ে গেলে এবং তাদের গাড়িটা ছেড়ে দিলে তারা কোথায় যাবে, তা আর দেখতে পাবে না। সুতরাং তাকে তারা দেখে ফেললেও তাকে যেতেই হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল মেরিয়াস।
বারান্দাটা এবং সিঁড়িগুলো ফাঁকা। তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে সে বুলভার্দে গিয়ে দেখল একটি গাড়ি পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরের দিকে প্যারিসের পথে এগিয়ে চলেছে। সে গাড়িটাকে লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল। দেখল গাড়িটা মুফেতার্দের ঢালু পথটা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। দেখল গাড়িটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর ধরা সম্ভব নয়। পায়ে হেঁটে বা ছুটে গিয়ে তার নাগাল পাওয়া যাবে না। তাই অবিলম্বে একটা গাড়ি ভাড়া করে গাড়িটার অনুসরণ করা উচিত। তাছাড়া গাড়িটাকে লক্ষ্য করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলে গাড়ির আরোহীদের সন্দেহ হতে পারে। এমন সময় একটা খালি ঘোড়ার গাড়িকে আসতে দেখে মেরিয়াস সেটা ভাড়া করার জন্য গাড়োয়ানকে ডাকল। তার ময়লা ও কিছুটা ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক দেখে গাড়োয়ান আগাম ভাড়া চাইল।