এমন সময় দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল। জনদ্ৰেত্তে ছুটে খুলতে গেল দরজাটা। সে যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, হে আমার প্রিয় মহাশয়, আমার মহান উপকারী, দয়া করে আসুন।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এবং একজন সুন্দরী তরুণী দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। মেরিয়াস সেই ফুটো দিয়ে তা দেখতে দেখতে বিস্মিত হয়ে গেল। সে বিস্ময় বর্ণনাতীত।
সেই তরুণীই তার সেই প্রেমাস্পদ। যে জীবনে একবার ভালোবেসেছে সে প্রেমাস্পদ এই কথাটার কত বড় শক্তি তা জানে। যে উজ্জ্বল কুয়াশা সেই মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সে কুয়াশার ভেতর দিয়ে মেয়েটির চেহারাটাকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিল না তার যে চোখ, তার কপাল আর তার সুন্দর মুখ তার জীবনকে ছয় মাস ধরে আলোকিত করে সহসা তাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। আজ এই ঘৃণ্য পরিবেশে আবার সে আবির্ভূত হয়েছে।
মেরিয়াসের সারা শরীর কাঁপতে লাগল। তার হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে স্পন্দিত হতে লাগল যে তার চোখের দৃষ্টি ব্যাহত এবং তার চোখে জল আসার উপক্রম হল। এতদিন ধরে যাকে খুঁজে চলেছিল তাকে আবার সে দেখতে পেল। তার মনে হল তার হারানো আত্মাকে আবার সে খুঁজে পেয়েছে।
তার মুখখানাকে শুধু ম্লান দেখাচ্ছিল। এ ছাড়া তার চেহারাটা ঠিক ছিল। তার মাথায় ছিল নীলচে রঙের মখমলের একটা ওড়না। তার গায়ে ছিল কালো সাটিনের পোশাক যার নিচে তার হাঁটু দুটো দেখা যাচ্ছিল। এবারও তার একমাত্র সঙ্গী ছিল মঁসিয়ে লেবলাঁ। সে ঘরের ভেতর ঢুকে টেবিলের উপর একটা বড় প্যাকেট নামিয়ে রাখল।
জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী মেয়েটির ওড়না, পোশাক আর সুন্দর মুখপানে অপলক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
.
৯.
বাইরে থেকে আগত কোনও আগন্তুকের কাছে ঘরখানা বেশি অন্ধকার দেখায়। মনে হয় তারা যেন কোনও গুহায় প্রবেশ করেছে। যারা বাইরে থেকে ঘরের মধ্যে অনিশ্চয়তার সঙ্গে পা রেখে তারা তাদের চারপাশের ঘরখানার মধ্যে কোথায় কী আছে, তা দেখতে পায় না। অথচ ঘরের বাসিন্দারা তাদের স্পষ্ট দেখতে পায়, কারণ চোখের দৃষ্টি এ অন্ধকারে অভ্যস্ত।
মঁসিয়ে লেবলাঁ তার স্বভাবসুলভ বিষণ্ণ ও করুণাভরা দৃষ্টিতে জনদ্ৰেত্তে’র পানে তাকিয়ে বলল, মঁসিয়ে, আপনি এই প্যাকেটটার মধ্যে কিছু গরম মোজা, কম্বল আর এই ধরনের কিছু শীতবস্ত্র পাবেন।
জনদ্ৰেত্তে নত হয়ে বলল, হে উদারহৃদয় মহান, আপনার দয়া আমাকে অভিভূত করে দিচ্ছে।
কিন্তু আগন্তুকরা যখন ঘরের পরিবেশটাকে খুঁটিয়ে দেখায় ব্যস্ত ছিল জনদ্ৰেত্তে তখন আড়ালে তার বড় মেয়েকে বলল, আমি তোমাকে কী বলেছিলাম? শুধু এক পুঁটলি পোশাক, কোনও টাকা-পয়সা নেই। ওরা সবাই এক ধরনের। যাই হোক, যে চিঠিটি তুমি ওঁকে দিয়েছিলে তাতে কোনও নামের স্বাক্ষর ছিল?
ফাবান্ত।
তা হলে নাট্যাভিনেতা।
কথাটা সে ঠিক সময়েই জিজ্ঞাসা করেছিল তার মেয়েকে। কারণ ঠিক এই সময়েই মঁসিয়ে লেবলাঁ তার দিকে ঘুরে বলল, আপনি সত্যিই করুণার পাত্র মঁসিয়ে–
এই বলে সে থামল।
জনদ্ৰেত্তে তার অসম্পূর্ণ কথাটা বলে দিল–ফাবান্ত।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে ফাবান্ত।
একজন অভিনেতা মঁসিয়ে, যে একদিন বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছিল।
জনদ্ৰেত্তে যখন দেখল নিজেকে আগন্তুকের সামনে প্রতিষ্ঠিত করার সময় এসেছে তখন সে একই সঙ্গে একজন সফল অভিনেতা আর পথের ভিখারির ভাব নিয়ে কথা বলতে লাগল। সে বলল, স্বয়ং ভালমার শিষ্য মঁসিয়ে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছিল আমার ওপর। কিন্তু আজ আমি দুর্ভাগ্যের দ্বারা প্রপীড়িত। আজ আমার খাদ্য নেই, ঘরে তাপ নেই। আমার হতভাগ্য সন্তানরা শীতে কাঁপছে। ঘরে একটা চেয়ারও নেই। জানালার কাঁচ ভাঙা। আমার স্ত্রী শয্যাগত।
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আহা বেচারি মহিলা।
জনদ্ৰেত্তে বলল, আর আমার ছোট মেয়ে আহত।
ছোট মেয়েটি আগন্তুকদের দেখে এতদূর অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে তার কান্না থেমে গিয়েছিল।
জনদ্ৰেত্তে চাপা গলায় বলল, কী, দেখাতে পারছ না?
এই বলে সে তার হাতের ক্ষতটার উপর চাপ দিতেই সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল এবং তাতে মেরিয়াস একদিন যার নাম দিয়েছিল আরসুলা সেই মেয়েটি আবেগের সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, আহা বেচারি।
জনদ্ৰেত্তে বলল, আপনি স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন তার হাত থেকে রক্ত বার হচ্ছে। ও যে কারখানায় ঘন্টায় ছয় স্যু বেতনে কাজ করে সেখানে এক অ্যাকসিডেন্টে ওর হাতটা কেটে যায়। হয়তো ওর হাতটা বাদ দিতে হবে।
মঁসিয়ে লেবলাঁ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, তাই নাকি?
হাতটা কেটে বাদ দিতে হবে এই কথাটা সত্যি ভেবে ছোট মেয়েটি আরও জোরে কাঁদতে লাগল।
জনদ্ৰেত্তে বলল, আমার তাই মনে হয়।
মঁসিয়ে লেবলাঁর পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে জনদ্ৰেত্তে কী দেখছিল। সে যেন কিছু একটা স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। আগন্তুকেরা যখন তার ছোট মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল তখন সেই সুযোগে জনদ্ৰেত্তে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে চুপি চুপি বলল, লোকটিকে ভালো করে দেখ তো।
এবার সে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ঘুরে তার দুঃখের কাহিনী আবার শোনাতে লাগল। সে বলল, দেখুন মঁসিয়ে, এই দারুণ শীতে আমার একমাত্র পোশাক হল আমার স্ত্রীর এই শেমিজটা। একটা কোটের অভাবে আমি বাইরে যেতে পারি না। একটা কোট থাকলে আমি একবার ম্যাদময়জেল মার্সের কাছে যেতাম। সে আমার পুরনো বন্ধু। সে কি এখনও র্যু দ্য লা দে দ্যাম অঞ্চলে বাস করছে? আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছিলাম এবং তার সাফল্যে আমার অবদান ছিল। সেলিমেনে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। মঁসিয়ে এলমিরা তার বেনিসারিসসকে ঠিক সাহায্য করবে। কিন্তু আমার এখন পরার কিছু নেই, ঘরে একটা স্যুও নেই। আমার স্ত্রী রুগ্ণ এবং আমার মেয়ে আহত। তবু একটা পয়সা নেই। আমার স্ত্রী স্নায়ুদৌর্বল্যে ভুগছে। তার এবং মেয়ের এখন চিকিৎসা দরকার। কিন্তু কে ডাক্তার এবং ওষুধের টাকার দেবে? আজ আমি একটা পেনির জন্য নতজানু হতে পারি। জানেন মঁসিয়ে, আমি আমার মেয়েদের ধর্ম এবং নীতিশিক্ষা দিয়েছি বলে তাদের মঞ্চে পাঠাইনি। তারা খুব কড়া শাসনের মধ্যে মানুষ হয়েছে। কতবার আমি তাদের নীতি এবং গুণাবলি সম্বন্ধে কত বুঝিয়েছি। আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। মানুষের সঙ্গে কিভাবে ভদ্র ব্যবহার করতে হয় তা তারা জানে। তারা সেইসব হতভাগ্যদের মতো নয় যারা অভাবের তাড়নায় বাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়ে যায়। ফাবান্ত পরিবারে এমন একজনকেও পাবেন না। তারা সদগুণ, সততা, ধর্ম, ঈশ্বরবিশ্বাস কাকে বলে তা শিখেছে। কিন্তু কাল আমাদের কী ঘটবে, তা জানি না স্যার। কাল ৪ ফেব্রুয়ারি, বাড়িওয়ালা আমাদের আর থাকতে দেবে না। আজ সন্ধের মধ্যে যদি আমরা সব ভাড়া মিটিয়ে না দিই তা হলে আমাদের উঠে যেতে হবে। তা হলে আমার রুগ্ণ স্ত্রী ও মেয়েদের হাত ধরে পথে বেরিয়ে যেতে হবে আমাকে। বরফ আর বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচবার মতো কোনও আশ্রয়ই থাকবে না আমাদের। এই হল আমাদের অবস্থা মঁসিয়ে। আমার বাড়িভাড়া বাকি আছে চার কোয়ার্টারের অর্থাৎ পুরো এক বছরের। তার মানে মোট ষাট ফ্রাঁ।