তার মানে এই নয় যে তিনি আসছেন।
আমি তাঁদের গাড়িটাকে র্যু দু পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরে দেখেছি। দেখেই আমি ছুটতে শুরু করেছি।
কী করে তুমি জানলে সেই গাড়িটা তাঁদেরই?
আমি তাঁদের গাড়ির নম্বরটা দেখে নিয়েছিলাম। নম্বরটা হল ৪৪০।
ভালো, তুমি দেখছি বুদ্ধিমতী মেয়ে।
মেয়েটি তার বাবার দিকে উদ্ধতভাবে তাকিয়ে তার পা-টা একবার দেখে নিয়ে বলল, আমি বুদ্ধিমতী হতে পারি, কিন্তু এই ছেঁড়া নোংরা জুতোটা পরে আর কোথাও যাব না। প্রতিটি পদক্ষেপে ছেঁড়া জুতোটা থেকে শব্দ হয়। এ জুতো পরার থেকে আমি খালি পায়ে যাব।
তার বাবা গলার স্বরটা নরম করে বলল। আমি তোমাকে এর জন্য কোনও দোষ দিচ্ছি না বাছা। কিন্তু জুতো পরে না গেলে চার্চে ঢুকতে দেবে না। গরিবদেরও জুতো পরতে হবেই। খালি পায়ে কেউ ঈশ্বরদর্শনে যেতে পারে না। কিন্তু উনি যে আসছেন এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?
উনি আমার পেছনেই আসছেন।
জনদেত্তে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, কি আমার স্ত্রী, শুনতে পাচ্ছ? পরোপকারী ভদ্রলোক আসছেন। আগুন নিবিয়ে দাও।
তার স্ত্রী তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল। এক পা-ও নড়ল না। জনদ্ৰেত্তে তাক থেকে জল নিয়ে চুল্লির জ্বলন্ত আগুনে জল ঢেলে দিল। তার পর তার বড় মেয়েকে বলল, ওই চেয়ারটাকে ছিঁড়ে ফেল।
তার মেয়েটি কথাটা বুঝতে পারল না। সে তখন নিজেই আলগা সিটটার উপর লাথি মেরে সেটা ভেঙে দিল।
এরপর সে তার বড় মেয়েকে বলল, বাইরে কি খুব ঠাণ্ডা?
খুব ঠাণ্ডা, বরফ পড়ছে।
এরপর জনদ্ৰেত্তে তার ছোট মেয়েকে বলল, একটু নড়াচড়া করো কুঁড়ে মেয়ে কোথাকার! তুমি কিছু করতে পার না? জানালার কাছে গিয়ে একটা কাঁচের সার্সি ভেঙে ফেল।
মেয়েটি বিছানায় বসে ছিল। সে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জানালার ধারে গেল। বলল, জানালার কাঁচ ভাঙব?
আমি কী বললাম শুনতে পেলে না?
মেয়েটি বিছানার উপর উঠে দাঁড়াল। এক সন্ত্রস্ত আনুগত্যে সে তার হাতের একটা ঘুষি মেরে একটা কাঁচ ভেঙে দিল। কাঁচটা মেঝের উপর পড়ে গেল।
জনদ্ৰেত্তে বলল, ভালো। এই বলে সে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করারত এক সেনাপতির মতো সমস্ত ঘরখানা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তার স্ত্রী এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। সে এবার বলল, এ সব কী হচ্ছে প্রিয়তম?
তার যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল।
জনদ্ৰেত্তে বলল, যাও, বিছানায় শুয়ে পড়গে।
তার এই হুকুমের ভঙ্গিমা আর কণ্ঠস্বর শুনে প্রতিবাদ করার সাহস পেল না তার স্ত্রী। সে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এমন সময় কে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
জনদ্ৰেত্তে বলল, কে কাঁদছে?
ছোট মেয়েটি তার মার কাছে বিছানার এক কোণে শুয়ে তার রক্তাক্ত হাতটা দেখাল। সে কাঁদছিল।
তার মা তার বাবাকে বলল, এই দেখ, ও জানালার কাঁচ ভাঙতে গিয়ে হাতটা কেটে ফেলেছে।
তার বাবা বলল, ভালো। আমি আগেই ভেবেছিলাম ওর হাত কাটবে।
ভালো–তার মানে?
জনদ্ৰেত্তে বলল, চুপ কর। আমি সাংবাদিকদের স্বাধীনতা উচ্ছেদ করেছি।
এই বলে যে শেমিজটা সে পরে ছিল তার থেকে কিছুটা ছিঁড়ে তাই দিয়ে মেয়েটির কাটা হাতটা বেঁধে দিল। তার পর বলল, খুব ভালো হল, আমার জামাটাও ছেঁড়া রইল।
কাঁচভাঙা সার্সিটা দিয়ে বাইরের হিমেল বাতাস আর একরাশ কুয়াশা এসে ঘরে ঢুকল। ওরা তার ভেতর দিয়ে দেখতে পেল বাইরে তখন বরফ পড়ছে।
ক্যান্ডলমাস উৎসবের আগে যে দারুণ ঠাণ্ডা পড়ে সেই ঠাণ্ডা এখন তাদের ঘরখানায় এসে তার বুক চেপে বসল। জনদ্ৰেত্তে ঘরখানার চারদিকে তাকিয়ে দেখল প্রস্তুতির ব্যাপারে কোনও কিছু বাদ গেছে কি না। এবার সে কিছু শুকনো ছাই নিয়ে ভিজে কাঠগুলোর উপর ছড়িয়ে দিল। এরপর সে নিবে যাওয়া চুল্লির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এবার আমরা সেই পরোপকারী ভদ্রলোকের জন্য প্রস্তুত।
.
৮.
বড় মেয়েটি তার একটা হাত তার বাবার দিকে বাড়িয়ে বলল, দেখ আমার গা-টা কীরকম হিম হয়ে গেছে।
তার বাবা বলল, যত সব বাজে কথা। আমার গা-টা আরও হিম।
তার স্ত্রী তখন বলল, সব দিক দিয়ে সবার থেকে তোমার অবস্থাটা খারাপ।
জনদ্ৰেত্তে ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর।
এই বলে এমনভাবে সে তাকাল যাতে তার স্ত্রী একেবারে চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল। বড় মেয়েটি তার পোশাক থেকে ধুলো-কাদাগুলো ঝাড়তে লাগল। ছোট মেয়েটি কেঁদে যেতে লাগল। তার মা তার মাথাটা ধরে তাকে চুম্বন করে বলল, কেঁদো না বাছা, তোমার বাবা রাগ করবে।
কিন্তু তার বাবা বলল, না, মোটেই রাগব না আমি। যত পার কেঁদে যাও।
এরপর সে তার বড় মেয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, সব ঠিক আছে। কিন্তু মনে কর যদি উনি না আসেন। এখনও উনি এলেন না। অথচ আমি ঘরের আগুন নিবিয়ে। দিয়েছি, জানালার কাঁচ ভেঙেছি, চেয়ার ফুটো করেছি, আমার জামা ছিঁড়েছি।
মা বলল, তাছাড়া তোমার মেয়ের হাত কেটেছে।
জনদ্ৰেত্তে বলে যেতে লাগল, ঘরটা বরফ ঘরের মতো ঠাণ্ডা। উনি যদি একেবারেই আসেন। আমরা অপেক্ষা করে থাকলে তার কিছু যায়-আসে না। তিনি কিছু মনে করেন না, ভাবেন, ওরা অপেক্ষা করারই যোগ্য। হে ঈশ্বর, আমি ওদের কত ঘৃণা করি। ওই সব ধনী, তথাকথিত দানশীল ধনী যারা প্রাচুর্যের মধ্যে জীবনযাপন করে আর গির্জায় প্রার্থনা করতে যায়। তাদের গলাটা টিপে যদি মারতে পারতাম। তারা মনে মনে ভাবে তারা আমাদের প্রভু, সর্বময় কর্তা, তারা আমাদের দুঃখে সহানুভূতি দেখাতে এসে কিছু ছাড়া পোশাক আর কিছু খাবারের টুকরো দিয়ে যায়। কিন্তু কোথা থেকে কী করে ধনী হয় তারা? যত সব চোরের দল। চোর না হলে তারা ধনী হতে পারত না। আমার ইচ্ছা হয় আমি সমাজের সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে সেই ভস্মস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে থাকি। বোধ হয় একদিন সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে এবং সমাজের সব মানুষ সমান হয়ে যাবে।… কিন্তু তোমার পরোপকারী ভদ্রলোক কী করছেন? উনি কি আসছেন? বোধ হয় বৃদ্ধ অকর্মণ্য লোকটা আমাদের ঠিকানাটাই ভুলে গেছে।