লোকটি লিখতে লিখতে আপন মনে কথা বলে যাচ্ছিল। সে বলছিল, সাম্য! তুমি মরে গেলেও সাম্য বলে কোনও বস্তুর দেখা পাবে না। যাদের টাকা আছে তারাই সব সময় সমাজের উপরতলায় থাকে। গরিবদের কবর দেখতে যেতে হলে হাঁটুভোর কাদা ভেঙে যেতে হবে। আমার মনে হয় আমি সবাইকে খেয়ে ফেলি।
একজন মহিলা আগুনের কাছে খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করছিল। তার বয়স চল্লিশ বা একশোও হতে পারে। তার গায়েও একটা শেমিজ আর ছেঁড়া তালি লাগানো স্কার্ট ছিল, তার চেহারাটা তার স্বামীর তুলঁনায় খুব লম্বা ছিল। সে তার লম্বা লম্বা আঙুলওয়ালা ময়লা হাত দিয়ে তার মাথার লাল চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। তার পাশে মেঝের উপর টেবিলের উপর রাখা বইটার মতো একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল।
একটা বিছানায় একটা শীর্ণ মেয়ে পা মেলে বসে ছিল। যে মেয়েটি মেরিয়াসের ঘরে এসেছিল ওই শিশুটি হয়তো তারই ছোট বোন। তাকে প্রথমে দেখেই দশ-বারো বছরের মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার বয়স খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে পনেরো’র কম হবে না। ওই মেয়েটিও গতকাল সন্ধ্যায় পথে তার দিদির সঙ্গে ছিল এবং সে বলেছিল, আমি মোটেই ছুটতে পারিনি। সে এমনই এক মেয়ে যে দারিদ্র্য আর অভাবের মধ্যে লালিত হতে হতে দেহের দিক থেকে অপরিণত এবং অপুষ্ট থেকে গেলেও মনের দিক থেকে পরিণত হয়ে ওঠে তাড়াতাড়ি। তারা বাল্য, কৈশোর বা যৌবনের মধ্যে কোনও পার্থক্যই বুঝতে পারে না। তাদের পনেরো বারো বছরের মতো দেখায়। ষোলো বছর বয়সে তাদের কুড়ি বছরের বলে মনে হয়। জীবনটাকে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার জন্য তারা যেন উড়ে চলেছে।
মেরিয়াস ঘরটার মধ্যে এমন কোনও বস্তু দেখতে পেল না যার থেকে তারা কোনও কোনও কাজ করছে। শুধু কতকগুলি ধাতববস্তু পড়ে রয়েছে মেঝের উপর। হতাশা থেকে যে অকর্মণ্যতা আর এক ধরনের ঔদাসীন্য ও নিস্পৃহতার উদ্ভব হয় এবং যা কালক্রমে মৃত্যুযন্ত্রণায় পরিণত হয় সেই মৃত্যুযন্ত্রণা বিরাজ করছিল যেন সারা ঘরখানায়। মেরিয়াসের মনে হল ঘরখানা কবরখানার থেকেও ভয়ঙ্কর, কারণ সে ঘরে যেন একই সঙ্গে কয়েকটি জীবন এবং জীবন্ত মৃত্যু বাস করছে অর্থাৎ সেখানে জীবন্ত অবস্থায় বাস করছে কয়েকটি মানুষ। ঘরখানা কোনও সমাধিস্তম্ভ না হলেও সেটা যেন জীবনের প্রান্তঃসীমা এবং মৃত্যুপুরীর প্রবেশপথ। ধনীরা যেমন তাদের প্রাসাদের প্রবেশপথে অনেক ঐশ্বর্যের উপকরণ সাজিয়ে রাখে, তেমনি মৃত্যু এখানে তার অনেক বিভীষিকা ছড়িয়ে রেখেছে।
লোকটি তখন চুপ করে ছিল। মহিলাটি একটিও কথা বলেনি। মেয়েরাও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ছিল। সমস্ত ঘরখানা স্তব্ধ হয়ে ছিল। সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কাগজের উপর লেখার শব্দ ক্ষীণভাবে ঝাঁকিয়ে উঠছিল। হঠাৎ লোকটি লিখতে লিখতেই বলে উঠল, নোংরা, নোংরা, সবকিছু নোংরা।
মহিলাটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
সে বলল, বিচলিত হয়ো না প্রিয়তম। তোমার জবানিতেই এই চিঠিগুলো লিখতে হবে।
তীব্র শীতে যেমন শীতার্ত মানুষরা একসঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে থাকে তেমনি নিবিড় দারিদ্রের মধ্যেও তারা পরস্পরে জড়াজড়ি করে থাকে। কিন্তু দেহগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে খুব কাছাকাছি থাকলেও তাদের অন্তরগুলো দূরে চলে যায়। দেখে মনে হয় এই মহিলাটি একদিন তার অন্তরের সব ভালোবাসা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে তার স্বামীর ওপর। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের এই দুরবস্থা আর ঘৃণ্য পরিবেশের মধ্যে তার প্রেমের সব আগুন নিভে গেছে এবং শুধু ছাই পড়ে আছে তার জায়গায়। তবু সাধারণত যা হয়ে থাকে পুরনো প্রেমের বহিরঙ্গের আকাশটা তখনও অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। তাই সে তার স্বামীকে প্রিয়তম বলে সম্বোধন করল। কিন্তু কথাটা শুধু তার মুখের কথা, অন্তর থেকে উৎসারিত নয়।
লোকটি অর্থাৎ জনদ্ৰেত্তে লিখে চলল।
.
৭.
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে টেবিল থেকে নেমে আসছিল মেরিয়াস। হঠাৎ একটা শব্দে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। দেখল হঠাৎ ঘরের দরজা ঠেলে ব্যস্ত হয়ে জনদ্ৰেত্তের বড় মেয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকেই তার পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, উনি আসছেন।
তার বাবা-মা দু জনেই তার মুখপানে তাকিয়ে বলে উঠল, কে আসছেন?
মেয়েটি বলল, ওই সেই বৃদ্ধ পরোপকারী ভদ্রলোক যিনি সেন্ট জ্যাক গির্জায় প্রার্থনা করতে যান।
উনি কি সত্যিই আসছেন?
উনি আমার পিছু পিছু আসছেন।
তুই ঠিক বলছিস?
হ্যাঁ অবশ্যই ঠিক বলছি। উনি একটা গাড়িতে করে আসছেন।
জনদ্ৰেত্তে উঠে দাঁড়াল। বলল, উনি যদি গাড়িতে করে আসেন তা হলে তুমি কী করে তার আগেই এসে পড়লে? ওঁকে ঠিকভাবে ঠিকানাটা দেওয়া হয়েছে তো? বলে দিয়েছ তত বারান্দার শেষ প্রান্তে শেষের ঘরটা? উনি যেন ভুল না করেন। তুমি কি ওঁকে চার্চেই পেয়ে গিয়েছিলে? আমার চিঠিটা উনি পড়েছিলেন? উনি কী বললেন?
আমি ওঁকে চার্চের সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে পাই। আমি তাকে তোমার চিঠিটা দিই এবং তিনি চিঠিটা পড়ে বললেন, তুমি কোথায় থাক বাছা?’ আমি বললাম, আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যাব মঁসিয়ে। উনি তখন বললেন, তাঁর মেয়ে কিছু কেনাকাটা করবে। তাকে আমাদের ঠিকানাটা দিলে তিনি একটা গাড়ি ভাড়া করে যথাসময়ে আসবেন। আমি ঠিকানাটা বললে তিনি কিছুটা বিস্মিত হলেন, তার পর বললেন, তিনি ঠিক আসবেন। আমি দেখলাম তিনি আর তাঁর মেয়ে চার্চ থেকে বেরিয়ে একটা গাড়িতে উঠলেন। আমি তাকে বলেছি বারান্দার শেষ প্রান্তের ঘরটা।