এইসব কথা যখন ভাবছিল মেরিয়াস, যখন নিজেকে এইভাবে বোঝাচ্ছিল তখন যে দেয়ালটা জনদেত্তের ঘর থেকে তার ঘরটাকে পৃথক করে রেখেছিল সেই দেয়ালের দিকে তাকাল, যেন সে তার সহানুভূতিশীল দৃষ্টির উত্তাপ আর নিবিড়তা দিয়ে তাদের দুঃখে সান্তনা দেবার চেষ্টা করতে লাগল। ক’টা খুঁটির সঙ্গে ইট দিয়ে গাঁথা দেয়ালটা পাতলা এবং ওপাশের সব গতিবিধি বোঝা যায় এবং সব কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যায়। মেরিয়াস স্বপ্নালু প্রকৃতির মানুষ বলেই এতদিন সে তা শোনেনি।
সহসা মেরিয়াস দাঁড়িয়ে দেখল মাঝখানের দেয়ালটার উপর দিকে ছাদের কাছে তিনকোনা একটা ফুটো রয়েছে। সেখানটায় চুন-বালি খসে গেছে। ড্রয়ারের উপরে উঠে দাঁড়ালেই সেই ফুটো দিয়ে ওপাশের ঘরটার সব কিছু দেখা যাবে। কৌতূহল যেন করুণারই অংশবিশেষ। কারও দুঃখের প্রতিকার করতে হলে সে দুঃখ নিজের চোখে দেখা উচিত। ফুটোটা যেন জুডাসের জানালা। মেরিয়াস মনে মনে বলল, ওরা কী ধরনের লোক এবং কী ধরনের দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, তা দেখি একবার।
সে ড্রয়ারের উপর দাঁড়িয়ে ফুটোর কাছে চোখ রেখে ওপাশের ঘরটার দিকে তাকাল।
.
৬.
অরণ্যে যেমন হিংস্র প্রাণীদের কতকগুলি গোপন জায়গা বা গুহা থাকে, নগরের তেমনি কিছু হিংস্র প্রকৃতির লোকদের থাকার জন্য কতকগুলি গোপন আস্তানা থাকে। অরণ্যের গুহাগুলো মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে, কিন্তু নগরের ওই সব আস্তানাগুলো যত সব নোংরা পরিবেশে অবস্থিত এবং দেখতে সেগুলো খুবই কুৎসিত। শহরের নোংরা বস্তির থেকে অরণ্যগুহা অনেক ভালো।
মেরিয়াস তখন ওই বস্তিরই কথা ভাবছিল।
মেরিয়াস ছিল অবস্থার দিক থেকে গরিব এবং তার ঘরখানাও ভালো পরিবেশের মধ্যে ছিল না। কিন্তু তার দারিদ্র্যের মধ্যে যেমন একটা উদারতা আর সততা ছিল, তেমনি তার ঘরখানার পরিবেশ-প্রতিবেশ নোংরা হলেও সে ঘরখানা মোটের উপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত।
মেরিয়াস জনদ্ৰেত্তে’র যে বাসা-ঘরটার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে ঘরটা ছিল নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধময় এবং সব সময় গোলমালের শব্দে ভরা। সে ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটা অশক্ত নড়বড়ে চেয়ার আর একটা টেবিল, কয়েকটা ফাটা ডিশ, দরজার উল্টো দিকে দুটো বিছানা। একটা মাত্র ছোট জানালার কাঁচের অস্বচ্ছ সার্সি দিয়ে যে আলো আসে তা এত অস্পষ্ট যে সে আলোয় কোনও মানুষের মুখটাকে ভূতের মতো দেখায়। চুনবালিখসা দেয়ালগুলো আহত ও ক্ষতবিক্ষত মানুষের মুখের মতো দেখাচ্ছে। ক্ষত জায়গাগুলো স্যাঁতস্যাঁত করছে। তার ওপর আবার কয়লা দিয়ে কে কতকগুলি অশ্লীল ছবি এঁকেছে। দেয়ালগুলো কুষ্ঠরোগীর মতো ক্ষতবিক্ষত দেখাচ্ছিল।
মেরিয়াসের ঘরের মেঝেটায় টালিগুলোর রঙ চটে গিয়েছিল। কিন্তু জনদ্ৰেত্তেদের ঘরটার কোনও টালিই ছিল না। উপরে টালি বা সিমেন্টের প্রলেপ না থাকায় মেঝেটায় এবড়ো-খেবড়ো ইটের কুচো দেখা যাচ্ছিল আর পায়ের ধুলোয় কালো হয়ে গিয়েছিল সেটা। ঘরখানায় কোনওদিন ঝাট দেওয়া হয় না। তার ওপর এখানে-সেখানে ছেঁড়া অব্যবহৃত কিছু পোশাক পড়ে ছিল। ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালার একটা জায়গা ছিল এবং তার জন্য বছরে চল্লিশ ট্র্য বাড়তি দিতে হত। চুল্লিটাতে অল্প একটু আগুনে কিছু কাঠ দেওয়া ছিল এবং তার থেকে ধোঁয়া বার হচ্ছিল। চুল্লিটার আশেপাশে একটা স্টোভ, একটা ঝোল রান্নার প্যান, কিছু কাঠ, একটা পাখির খাঁচা আর কিছু ছাই ছিল।
ঘরখানার আকার বড় হওয়ার জন্য আরও খারাপ লাগছিল। তার অন্ধকার কোণগুলোতে বড় বড় মাকড়সা আর আরশোলা বাসা বেঁধেছিল। আগুনের চুল্লিটার দু পাশে দুটো বিছানা পাতা ছিল। মেরিয়াস দেখতে পেল একদিকের দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা রঙিন ছবি ছিল। তার তলায় ‘স্বপ্ন’ এই কথাটা লেখা ছিল। ছবিটাকে একটি ঘুমন্ত নারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার কোলে একটি শিশু ঘুমোচ্ছে। তাদের মাথার উপরে একটা ঈগল তার ঠোঁটে করে একটা মুকুট নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেই নারীটি তার ছেলের মাথা থেকে মুকুটটা সরিয়ে দিচ্ছিল। ছবিটার পটভূমিতে নেপোলিয়নের এক উজ্জ্বল মূর্তি শোভা পাচ্ছিল। নেপোলিয়নের তলায় মেরিঙ্গো, অস্টারলিৎস, আয়েনা, ওয়াগ্রাম আর এলট এই কথাগুলো লেখা ছিল।
টেবিলের পাশের চেয়ারটাতে প্রায় ষাট বছরের একটি লোক বসেছিল। তার চেহারাটা ছিল বেঁটেখাটো আর রোগা। তার চোখ-মুখের ওপর অশান্ত ও এক বিষাক্ত চাতুর্যের ভাব ফুটে উঠেছিল। লাভেতারের মতো কোনও শরীরতত্ত্ববিদ তার চেহারাটা দেখলে দেখত এক শকুনি আর এক অ্যাটর্নির মিশ্রণ ঘটেছে তার মধ্যে। আইনগত ছলনার দিক থেকে তার শকুনির মতো শিকারি পাখিকেও হার মানাবার ক্ষমতা আছে। তবে তার পরনে ছিল কাদামাখা একটা পায়জামা আর গায়ে ছিল একটা মেয়েদের শেমিজ। তার মুখে ছিল লম্বা পাকা দাড়ি। তার পায়ের ছেঁড়া জুতোর ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুলগুলো দেখা যাচ্ছিল। টেবিলের উপর তার সামনে কিছু কাগজ, একটা কলম আর কালি ছিল। সে তখন পাইপ খাচ্ছিল (খাবার না জুটলেও তামাক ঠিক জোটে) এবং কী লিখছিল। নিশ্চয় সে ধরনের কোনও আবেদনপত্র। টেবিলের উপর একটা লাইব্রেরির বই নামানো ছিল। বইটা কোনও জনপ্রিয় উপন্যাস। দুক্রে দুমিউলের লেখা।