এতক্ষণে কথা বলল মেরিয়াস। সে স্বাভাবিক নীরস গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, আমার কাছে তোমার একটা জিনিস আছে ম্যাদময়জেল। তুমি বললে সেটা দিতে পারি।
চারটে চিঠিওয়ালা সেই মোড়কটা মেয়েটির হাতে দিয়ে দিল মেরিয়াস। মেয়েটি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল, এটা আমরা কত খুঁজে বেড়িয়েছি।
মোড়কটা খুলতে খুলতে মেয়েটি বলতে লাগল, হা ভগবান, আমি আর আমার বোন এটা কত খুঁজেছি। আপনি তা হলে এটা বুলভার্দে পেয়েছেন। আমরা যখন ছুটছিলাম তখন আমার বোনের হাত থেকে এটা পড়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে দেখি এটা নেই। আমরা মার খাবার ভয়ে বলেছি চিঠিগুলো আমরা দিয়ে দিয়েছি। এখন দেখছি চিঠিগুলো আপনার কাছে রয়েছে। আপনি কী করে জানলেন এগুলো আমাদের চিঠি? অবশ্য হাতের লেখা দেখে। গতকাল সন্ধ্যায় তা হলে আপনার সঙ্গেই আমাদের ধাক্কা লাগে। আমার বোনকে বলেছিলাম, একজন ভদ্রলোক না? আমার বোন বলল, আমারও তাই মনে হয়।
এবার মেয়েটি চিঠিগুলোর থেকে এক পরোপকারী ভদ্রলোককে লেখা চিঠিখানি বার করে বলল, এটি বৃদ্ধকে লেখা যিনি নিয়মিত সমবেত প্রার্থনায় যোগদান করতে যান। এখন সময় হয়ে গেছে। ছুটে গিয়ে তাকে ধরতে হবে। হয়তো তিনি আমাকে যা দেবেন তাতে আমাদের খাওয়া হয়ে যাবে। তার মানে কী আপনি জানেন? গতকাল ও আগের দিন আমাদের কিছুই খাওয়া হয়নি। গতকালকার প্রাতরাশ এবং দুপুরের খাওয়া সব হয়ে যাবে। তার মানে তিন দিনের মধ্যে আজ প্রথম খাব।
মেয়েটির এই কথায় হুঁশ হল মেরিয়াসের। সে বুঝল মেয়েটি কেন এসেছে তার কাছে। মেয়েটি যখন সমানে কথা বলে যেতে লাগল মেরিয়াস তখন তার পকেটটা হাতড়াতে লাগল।
মেয়েটি বলে যেতে লাগল, এক একদিন রাত্রিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর আমি ফিরি না। গত বছর শীতকালে এ বাড়িতে আসার আগে আমরা একটা পুলের তলায় থাকতাম। শীতে এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে থাকতাম। শীতে আমার বোন কাঁদতে থাকত। ঠাণ্ডা জল কত ভয়ঙ্কর। তাই নয় কি? এক একবার ভাবি, জলে ডুবে মরব। কিন্তু ঠাণ্ডা জলের ভয়ে তা পারি না। যখন আমি রাত্রিকালে বুলভার্দ অঞ্চল দিয়ে হেঁটে যাই তখন দু পাশের গাছগুলো সঁচলো বর্শার মতো আমার দিকে যেন তাকিয়ে থাকে। দু পাশের বাড়িগুলোকে নোতার দ্যাম গির্জার মতো উঁচু দেখায়। তখন আকাশের তারাগুলো কুয়াশায় ধূমায়িত পথের আলোর মতো মিটমিট করে। এক একসময় মনে হয় লোকে যেন আমার উপর পাথর ছুঁড়ছে। মনে হয় একটা ঘোড়া যেন আমায় তাড়া করছে। আমি তখন ভয়ে ছুটে পালাতে থাকি। তখন সবকিছু ঘুরতে থাকে আমার চারদিকে। খাবার কিছু না থাকলে সব কিছু বড় অদ্ভুত লাগে।
এই বলে মেরিয়াসের দিকে তাকাল সে। মেরিয়াস ততক্ষণে পকেট হাতড়ে পাঁচ ফ্রাঁ ষোলো স্যু পেল। তখন তার কাছে এই টাকাটা ছিল। সে বুঝল আজকের খাওয়া তার এতেই হয়ে যাবে। কাল যা হয় হবে। সে তার থেকে মাত্র ষোলো স্যু রেখে দিয়ে মেয়েটিকে পাঁচ ঐ দিয়ে দিল।
টাকাটা নিয়ে মেয়েটি বলল, অবশেষে সূর্যের আলো দেখা দিয়েছে। এতেই আমাদের দু দিনের খাওয়া হয়ে যাবে। আপনি সত্যিই মহান। এতেই দু দিনের মতো সবকিছু কেনা হয়ে যাবে।
তার শেমিজটা ঠিক করে নিয়ে মেরিয়াসকে হাত নেড়ে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে সে চলে যাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেল। যাবার পথে ড্রয়ারের উপর একটুকরো বাসি। রুটি দেখতে পেয়ে সে সেটা তুলে নিয়ে খেতে লাগল। এটা শক্ত হলেও চিবুনো যাবে।
এই বলে সে চলে গেল।
.
৫.
মেরিয়াস পাঁচ বছর ধরে অর্থাভাবে দারুণ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখার আগে আসল দারিদ্র কাকে বলে তা সে জানতে পারেনি। শুধু মানুষের কষ্ট দেখলেই হবে না, নারীদের দুঃখকষ্ট সে স্বচক্ষে দেখল।
মানুষ যখন তীব্র প্রয়োজন আর অভাবের শেষ প্রান্তে চলে যায়, যখন তারা সব দিক দিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে তখন কাজ আর বেতন, খাদ্য আর তাপ, সাহস ও শুভেচ্ছা এইসব কিছুর কোনও অর্থ থাকে না তাদের কাছে। তখন তাদের কাছে দিনের আলো ছায়াচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। সব সময় একটা অন্ধকার গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে তাদের অন্তরকে। সেই অন্ধকারের মাঝে তারা সব বোধ হারিয়ে ফেলে। তখন তারা নারী ও শিশুদের জোর করে অপমানের পথে ঠেলে দেয়। তখন তারা মরিয়া হয়ে যে কোনও পাপ ও অপরাধের আশ্রয় গ্রহণ করে।
স্বাস্থ্য, যৌবন, সম্মান, সতীত্ব, অন্তরের সততা, কুমারীত্ব প্রভৃতি যেসব গুণ আত্মার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে সেসব গুণকে তারা অস্তিত্ব রক্ষার এক কৃষ্ণকুটিল সংগ্রামে নিয়োজিত করে। যে কোনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে তারা। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, সব সম্পর্ক, সব পাপ-পুণ্য ধাতুর সঙ্গে মেশানো খাদের মতো মিলে মিশে এক হয়ে যায়। তারা তখন সকলে মিলে জড়োসড়ো হয়ে এক জায়গায় থাকে, একে অন্যের পানে ম্লান সকরুণ দৃষ্টিতে তাকায়। তাদের দেহগুলো কত স্নান কত হিমশীতল হয়ে ওঠে! সেইসব হতভাগ্যদের দেখে মনে হয় তারা যেন পৃথিবী ও সূর্য থেকে বহু দূরের এক গ্রহান্তরের জীব।
মেরিয়াসের মনে হল যে মেয়েটি তার কাছে একটু আগে এসেছিল সে যেন অন্ধকার জগতের এক দূত। সেই ভয়ঙ্কর জগতের একটা দিক উদ্ঘাটিত করে গেল তার কাছে। এতদিন সে প্রেমের ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে রেখে তার প্রতিবেশীদের পানে একবারও তাকায়নি। এজন্য তিরস্কার করতে লাগল নিজেকে। এর আগে সে তাদের বাড়িভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু সেটা এমন কিছু নয়, আবেগের বশে সে এটা করে ফেলেছে যান্ত্রিকভাবে, এটা যে কেউ করতে পারবে। তাদের জন্য তার আরও কিছু ভালো করা উচিত ছিল। তার পাশের ঘরেই তারা থাকে, মাঝখানে শুধু একটা ক্ষীণ আবরণ। সেই আবরণের অন্তরালে কয়েকটি অসহায় আত্মা সমগ্র জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে, তাদের সে সংগ্রামের কিছু কিছু শব্দ সে শুনেছে। তবু তাদের দিকে কোনও মনোযোগ দেয়নি। প্রতিদিন দেয়ালের ওপার থেকে তাদের যাওয়া-আসার পদশব্দ শুনেছে, তাদের কথাবার্তার আওয়াজ তার কানে এসেছে, কিন্তু সে কথা শুনতে চায়নি। তাদের কথাবার্তার সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু সে তাতে কান দেয়নি। এইসব মানুষগুলো তারই ধর্মভ্রাতা, তারা যখন এক নিবিড় যন্ত্রণায় অসহায়ভাবে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল, তার সব চিন্তা তখন প্রেমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। তার মনে হল সে তাদের দুঃখ আর দুর্ভাগ্যকে কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। তার পরিবর্তে এখানে অন্য কোনও সহৃদয় প্রতিবেশী থাকলে সে তার স্বাভাবিক পরোপকার প্রবৃত্তির বশে আত্মচিন্তায় মগ্ন না হয়ে তাদের দুঃখকষ্টের দিকে নজর দিত এবং তাদের দুরবস্থার লক্ষণ দেখে এতদিনে হয়তো তার একটা প্রতিকার করে ফেলত। অবশ্য তাদের দেখে অসৎ এবং দুর্নীতিপরায়ণ মনে হয়, কিন্তু যারা পতনের শেষ সীমায় নেমে যায় তাদের কাছে নীতি-দুর্নীতির কোনো অর্থ থাকে কি? দুর্ভাগ্য আর দুর্নীতি এক হয়ে মিশে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র জগতে পরিণত হয়। যারা সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে নেমে গেছে, যারা পথের মানুষ তারা হয়তো এদের থেকে কম দুঃখী। এর জন্য দায়ী কে?