পুনশ্চ: আমার কন্যা আপনার সেবাদানে সতত প্রস্তুত মঁসিয়ে।
যে সমস্যার দ্বারা বিব্রত হয়ে পড়েছিল মেরিয়াস এই ঘটনা সেই সমস্যার ওপর আলোকপাত করল। এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল তার কাছে। এই চিঠিখানি অন্য চিঠিগুলোর উৎস–সেই এক হাতের লেখা, এক আবেদন, এক কাগজ, এক তামাকের গন্ধ। মোট পাঁচখানি চিঠি একই লোকের লেখা। যে চারটি লোকের জবানিতে চারখানি চিঠি লেখা হয়েছিল সেই চারটি লোকই হল জনদ্ৰেত্তে।
আমরা আগেই বলেছি মেরিয়াস তার বাসার আশপাশের অন্য ভাড়াটেদের প্রতি কোনওদিন কোনও মনোযোগ দেয়নি। তার চিন্তা সব সময় অন্যত্র কেন্দ্রীভূত ছিল। যদিও সে বারান্দায় জনদ্ৰেত্তের পরিবারের মেয়েদের এর আগে দেখেছে তথাপি সে তাদের কখনও ভালো করে দেখেনি। ফলে গত সন্ধ্যায় তাদের রাস্তায় দেখে চিনতে পারেনি। আজও যখন একটি মেয়ে তার ঘরে এসে চিঠিটি দিল তখনও সে তাকে চিনতে পারল না।
এখন সে সবকিছু বুঝতে পারল। সে বুঝল জনদ্ৰেত্তের কাজই হল ধনী লোকদের ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি লিখে তার মেয়েদের তাদের কাছে পাঠানো। জীবনের সঙ্গে জুয়াখেলায় সে তার মেয়েদের এইভাবে ব্যবহার করত। গতকাল সন্ধ্যায় তার মেয়ে দুটি চিঠিগুলো নিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের সমাজের মধ্যে এই দুটি দুস্থ মেয়ে গত সন্ধ্যায় সব স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত হয়ে নারীসুলভ সব শালীনতা ও দায়িত্ববোধ হারিয়ে দুটি দানবীতে পরিণত হয় যাদের বালিকা বা পূর্ণবয়স্কা মহিলা, ভালো বা মন্দ, নির্দোষ বা দুষ্ট প্রকৃতির কোনওটাই বলা যায় না। তাদের আত্মাগুলো ফুলের মতো ফুটে উঠে একদিনের মধ্যেই পথের উপর ম্লান হয়ে ঝরে পড়ে।
ইতোমধ্যে মেরিয়াস যখন মেয়েটিকে এক বেদনার্ত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছিল, মেয়েটি তখন এক উদ্ধত প্রেতের মতো তার দীনহীন অবস্থার কথা সম্পূর্ণ বিস্তৃত হয়ে ঘরখানা খুঁটিয়ে দেখছিল। চেয়ারগুলো সরিয়ে মেরিয়াসের পোশাকগুলো আঙুল দিয়ে টিপে, ড্রয়ারের উপর রাখা প্রসাধদ্রব্যগুলোয় চোখ বুলিয়ে কী সব দেখছিল। সে একসময় বলল, আমি দেখছি, আপনার একটা আয়না রয়েছে।
বাজে গলায় সে বাজারের চলতি গানের দু একটা লাইন গুনগুন করে গাইছিল। যেন সে সব ঘরখানার মধ্যে একা আছে। তার গলা মিষ্টি না হওয়ার জন্য সে গান ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল। কিন্তু তার এই নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের অন্তরালে একটা গোপন লজ্জা আর অস্বস্তি লুকিয়ে ছিল। তাছাড়া ঔদ্ধত্য একদিক দিয়ে লজ্জার বিকৃত অভিপ্রকাশমাত্র। মেয়েটি যখন হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা-লাগা ভগ্নপক্ষ এক পাখির মতো সমস্ত ঘরখানা জুড়ে সকরুণভাবে উড়ে বেড়াচ্ছিল তখন তাকে দেখতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল মেরিয়াসের। পরিবেশ যদি ভিন্ন হত এবং তার যদি শিক্ষাদীক্ষা কিছু থাকত তা হলে তার সহজ সরল আনন্দোচ্ছলতা সত্যিই বড় মধুর এবং মনোহর হয়ে উঠত।
মেরিয়াস যখন বসে বসে এইসব ভাবছিল আর মেয়েটিকে দেখছিল সে তখন তার কাছে সরে এসে বলল, বই!
তার মেঘাচ্ছন্ন ম্লান চোখে যেন একটা আলোর তরঙ্গ খেলে গেল। সে কিছুটা গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করল, আমি পড়তে জানি।
টেবিলের উপর থেকে একটা বই তুলে নিয়ে সে সহজভাবে পড়তে লাগল, ‘ওয়াটারলু’র রণক্ষেত্রের মধ্যস্থলে অবস্থিত শ্যাতো দ্য হুগোমঁত বাহিনীর পাঁচটি দল নিয়ে শত্রুঘাটি আক্রমণ ও দখল করার জন্য জেনারেল বদিনকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
হঠাৎ পড়া থামিয়ে সে বলে উঠল, ওয়াটারলু! আমি জানি, এটা এক যুদ্ধের নাম। আমার বাবা সৈন্যদলে কাজ করতেন এবং ওই যুদ্ধে ছিলেন। আমরা হচ্ছি আসল বোনাপার্টপন্থী। ওয়াটারলুতে ফরাসিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
এবার সে বইটা নামিয়ে কলমটা তুলে নিয়ে বলল, আমি লিখতেও জানি। আপনি দেখবেন?
মেরিয়াস কিছু বলার আগেই সে লিখল, বাইরে তাকিয়ে দেখ, তোমার চারদিকে পুলিশবাহিনী রয়েছে।
এরপর কলমটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলল, কোনও বানান ভুল নেই। আপনি দেখতে পারেন। আমি আর আমার বোন কিছুদিন স্কুলে পড়াশুনো করেছি। এখনকার মতো আমরা ছিলাম না।
হঠাৎ সে থেমে গিয়ে মেরিয়াসের দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, নরক। তার সে কণ্ঠে তীব্র বেদনার ঊর্ধ্বে এক তীব্র হতাশা ফুলে ফুলে উঠছিল।
মেয়েটি আবার বলতে লাগল, আপনি থিয়েটারে যান মঁসিয়ে মেরিয়াস? আমি যাই। আমার এক ছোট ভাই আছে। তার সঙ্গে দু একজন অভিনেতার আলাপ পরিচয় আছে। সে আমাকে টিকিট এনে দেয়। আমার গ্যালারিতে বসতে মোটেই ভালো লাগে না। সেখানে লোকের বড় ভিড়। তাদের গা থেকে দুর্গন্ধ বার হয়।
মেরিয়াসের দিকে লজ্জামদির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, জানেন মঁসিয়ে মেরিয়াস, আপনি খুব সুন্দর।
কথাটা বলে সে হাসতে লাগল আর মেরিয়াস লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। সে মেরিয়াসের আরও কাছে সরে এসে তার কাঁধের উপর একটা হাত দিয়ে বলল, আপনি কখনও আমার দিকে তাকান না। কিন্তু আমি আপনাকে সিঁড়িতে উঠতে প্রায়ই দেখি। অস্টারলিস অঞ্চলে পিয়ের মেবুফ নামে এক বৃদ্ধের সঙ্গে আপনাকে বেড়াতে দেখেছি। আপনার চুলটা অবিন্যস্ত ও অপরিচ্ছন্ন থাকলে আপনাকে ভালো দেখায়, এটা হয়তো আপনি জানেন!
সে তার গলার স্বরটাকে যথাসম্ভব নরম করার চেষ্টা করলেও তার সব দাঁত না থাকার জন্য সব কথা শোনা যাচ্ছিল না।