আপনি হয়তো এই বিষয়ে একমত হবেন যে নির্মম প্রয়োজনের খাতিরে মানুষকে দুঃখের সঙ্গে কোনও সদাশয় ব্যক্তির দয়ার প্রত্যাশী হতে হয়। আমাদের চরমতম দুরবস্থার কালে অপরের সাহায্য প্রত্যাশা না করে নির্দ্বিধায় অনাহারে মরতে পারি না। নিয়তি কারও প্রতি নিষ্ঠুর এবং কারও প্রতি সদয়–এইটাই দুনিয়ার নিয়ম।
আমি আপনার আগমন অথবা দানের প্রতীক্ষায় আছি। আপনি যদি দয়া করে আপনার প্রতি নিবেদিত আমার গভীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করেন তা হলে বিশেষ বাধিত হব।
আপনার একান্ত বিনয়াবত ও অনুগত ভৃত্য
পি ফাবান্ত, নাট্যশিল্পী
চারটি চিঠি পড়ার পর মেরিয়াস দেখল সে যা খুঁজছিল তা পেল না। এই চিঠিগুলোর কোনওটিতে পত্রপ্রেরকদের ঠিকানা নেই। তবু বিভিন্ন দিক দিয়ে চিঠিগুলো আগ্রহজনক এবং কৌতূহলদ্দীপক। যদিও চারটি চিঠি পৃথক চারজন লোকের জবানিতে লেখা তবু হাতের লেখা এবং একই হলদে মোটা কাগজে লেখা। চারটে চিঠি হতেই তামাকের গন্ধ আসছিল। যদিও বিভিন্ন চিঠিতে বিভিন্ন লেখার ভঙ্গিমা ব্যবহৃত হয়েছে তথাপি সব চিঠিতে একই ধরনের বানান ভুল দেখা যায়। সব দেখে মনে হয় চিঠিগুলো একই লোকের লেখা।
মেরিয়াস দেখল, এইসব চিঠির রহস্যটা তুচ্ছ এবং এ নিয়ে মাথা ঘামানো বৃথা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মন-মেজাজ এমনই বিষাদগ্রস্ত হয়ে ছিল যে প্যারিসের কোনও এক পথে কুড়িয়ে পাওয়া এই রসিকতায় যেন মন ভুলল না। গতকাল সন্ধ্যায় পথে যে মেয়ে দুটি ব্যস্ত হয়ে তার কাছে এসে পড়ে এই চিঠিগুলো যে তাদের তার কোনও প্রমাণ নেই। আসলে এই চিঠিগুলোর কোনও মূল্য বা তাৎপর্যই নেই। সে তাই চিঠিগুলো সেই মোড়কের মধ্যে ভরে রেখে ঘরের কোণে ফেলে রেখে বিছানায় শুতে চলে গেল।
পরদিন সকাল সাতটার সময় যখন সে পোশাক পরে প্রাতরাশ খেতে খেতে তার কাজের কথা ভাবছিল তখন হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে কে টোকা দিল। দরজায় খিল ছিল না। ঘরে কোনও দামি জিনিস বা বেশি টাকাকড়ি নেই বলে সে ঘরে খিল না দিয়েই শুত। এজন্য মাদাম বুগনল একবার প্রতিবাদ করে এবং তার পর তার এক জোড়া নতুন জুতো চুরি যায়।
দ্বিতীয়বার তার দরজায় টোকা পড়ল। মেরিয়াস ভাবল, মাদাম বুগনল ডাকছে। তাকে। সে তাই ঘরের ভেতর থেকে বলল, ভেতরে এস।
বাইরে থেকে এক নারীকণ্ঠ বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে।
মেরিয়াস বুঝল এ কণ্ঠস্বর মাদাম কুগনলের নয়। এ কণ্ঠস্বর যেন কোনও ব্রঙ্কাইটিসের রোগীর।
সে চোখ তুলে দেখল একটি মেয়ে তাকে ডাকছে।
.
৪.
এক তরুণী দরজার উপর এসে দাঁড়িয়েছিল। দরজার উল্টোদিকের জানালা দিয়ে আসা একঝলক আলো এসে পড়েছিল তার মুখের উপর। তার চেহারাটা খুব রোগা। একটা শেমিজ আর স্কার্ট ছাড়া তার গায়ে আর কিছু ছিল না। সে শীতে কাঁপছিল। তার কোমরে একটা দড়ি বাঁধা ছিল; আর একটা দড়িতে তার মাথার চুলগুলো বাঁধা ছিল। শেমিজের ফাঁক দিয়ে তার কাঁধের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। তার হাত দুটো আলোর ছটায় লালচে দেখাচ্ছিল। তার মুখে কয়েকটা দাঁত ছিল না। চোখ দুটো কোটরাগত আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বয়সে সে একজন বালিকা হলেও তার চোখ দুটো ছিল বয়স্ক মহিলার মতো। পনেরো আর পঞ্চাশ বছরের সব পার্থক্য যেন লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে। তার শীর্ণ চেহারাটা যে একবার দেখবে সে-ই কেঁপে উঠবে।
মেরিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল মেয়েটি যেন স্বপ্নে দেখা অন্ধকারের এক প্রেতমূর্তি। মেয়েটি সম্বন্ধে সবচেয়ে মর্মান্তিক এই যে তাকে এমন কুৎসিত দেখালেও সে কুৎসিত হয়ে জন্মায়নি। শৈশবে সে হয়তো সুন্দরী ছিল। কিন্তু বর্তমানে নিঃসীম দারিদ্র্য আর দুরবস্থার ক্রমাগত আঘাতে তার চেহারাটা এখন অকালবৃদ্ধ ও কুৎসিত হয়ে উঠেছে। তার মোলো বছরের মুখখানায় অবশিষ্ট সৌন্দর্যের একটা ছাপ তখনও ফুটে ছিল যেন কোনও শীতের সকালে মেঘের আড়ালে এক বিরল সূর্যরশ্মি উঁকি মারে।
মুখখানা চেনা চেনা মনে হল মেরিয়াসের। আগে যেন কোথায় দেখেছে তাকে।
মেরিয়াস বলল, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি ম্যাদময়জেল?
মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনার জন্য একটা চিঠি আছে মঁসিয়ে।
তা হলে মেয়েটি তার নাম জানে। কিন্তু তা হলে কী করে তার নাম জানল?
কোনও আহ্বানের অপেক্ষা না করেই মেয়েটি ঘরে ঢুকে পড়ল। তার ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে হাঁটুটা দেখা যাচ্ছিল। শীতে কাঁপছিল সে।
তার হাত থেকে চিঠিটা নিল মেরিয়াস। তাতে লেখা ছিল,
আমার সদয় সহৃদয় প্রতিবেশী, পরম শ্রদ্ধেয় যুবক!
আজ থেকে ছয় মাস আগে আপনি আমার বাকি বাড়িভাড়া দয়া করে মিটিয়ে দিয়ে আমার যে উপকার করেছিলেন সে কথা আমি শুনেছি। এর জন্য আমি আপনাকে আশীর্বাদ করছি। আমার বড় মেয়ের মুখ থেকে শুনবেন আজ দুদিন আমাদের খাওয়া হয়নি। আমার রুগণ স্ত্রীকে নিয়ে আমরা চারজন। মানবতার প্রতি বিশ্বাস করে আমি যদি কোনও ভুল না করে থাকি তা হলে ধরে নেব আপনার উদার অন্তঃকরণ অবশ্যই আমাদের এই দুরবস্থার দ্বারা বিচলিত হবে এবং আপনি অবশ্যই আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন।
আপনার মানবতাবোধে আমার বিশ্বাস জানিয়ে এইখানেই চিঠি শেষ করছি আমি।
আপনার একান্ত বিশ্বস্ত
জনদ্ৰেত্তে