.
৩.
সেদিন রাত্রিতে বাসায় ফিরে পোশাক ছাড়তে গেলে তার জামার পকেটে সেই কাগজের মোড়কটাতে হাত পড়ল। মেয়েটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। এবার ভাবল এই কাগজের মধ্যেই হয়তো মেয়েটির ঠিকানা লেখা আছে। এ কাগজ যদি তাদের না হয় তা হলে এর যে মালিক নিশ্চয় তার ঠিকানা আছে।
মোড়কটা আঁটা ছিল না বলে সে খুলে ফেলল সেটা। দেখল তার মধ্যে চারটে চিঠি রয়েছে এবং তাতে প্রাপকের ঠিকানা রয়েছে। চিঠিগুলোর থেকে কড়া সস্তা তামাকের গন্ধ আসছিল।
প্রথম চিঠিটা মাদাম লা মার্কুই প্রশেরেকে লেখা। তার ঠিকানাটা হল শাস্ত্রে দে দেপুতের পেছন দিকে। চিঠিগুলোর মধ্যে সে যাদের খুঁজছে তাদের কোনও হদিশ পাওয়া যেতে পারে এই আশায় প্রথম চিঠিটা পড়তে লাগল সে।
মাদাম লা মার্কুই,
মমতা এবং করুণার বন্ধন হচ্ছে এমনই এক বন্ধন, যা মানুষের সমাজকে বেঁধে রেখেছে। আমার অনুরোধ, আপনি আপনার মমতাসুন্দর খ্রিস্টীয় চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একবার এক হতভাগ্য স্পেনিয়ার্ডকে দেখুন, সে এক বৈধ আদর্শের প্রতি তার নিবিড় আসক্তি আর অনুরাগের খাতিরে দেহের বহু রক্তপাত করেছে এবং বহু অর্থ ব্যয় করে আজ নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে তার কোনও সন্দেহ নেই। যে আপনার মহান আত্মা এমনই এক হতভাগ্য সৈনিকের অসহায় অসুখী জীবনকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসবে, যার যথেষ্ট শিক্ষাদীক্ষা আছে এবং যে দেশের স্বার্থে অনেক আঘাত সহ্য করে সম্মান অর্জন করেছে। মাদাম লা মার্কুই তাঁর দেশবাসীর জন্য যে মানবতা ও সহানুভূতি অনুভব করেন এবং যার কথা সুবিদিত সারা দেশে, তার ওপর এই সৈনিকের প্রভূত আস্থা আছে। তার একান্ত আশা তার এই আবেদন ব্যর্থ হবে না এবং মাদামের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত তাঁর স্মৃতি চিরদিন পোষণ করে যাবে তার অন্তরে।
আপনার প্রতি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি নিজে এ পত্রে স্বাক্ষর করলাম।
ডন আলভার্তেজ,
স্পেনীয় অশ্বারোহী বাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন, দেশের স্বার্থে যে রাজতন্ত্রী শরণার্থী হিসেবে বর্তমানে ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, কিন্তু অর্থাভাবে সে আর বেশি অগ্রসর হতে পারছে না।
স্বাক্ষরের তলায় কোনও ঠিকানা নেই।
এবার দ্বিতীয় চিঠিখানি পড়তে লাগল মেরিয়াস। দ্বিতীয় চিঠিখানি মাদাম লা কোঁতেসি দ্য আঁতভানেতকে লেখা। প্রাপকের ঠিকানা হল ৯, র্যু কাসেত্তে।
মাদাম লা কোঁতেসি,
আমি ছয়টি সন্তানের জননী। আমার শেষ সন্তানটির বয়স হল মাত্র আট মাস। সে এখন অসুস্থ। পাঁচ মাস আগে আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করে চলে যায়। বর্তমানে আমি ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছি, হাতে একটি পয়সাও নেই। মাদাম লা কোঁতেসির বদান্যতার নিকট আমি কাতর আবেদন জানাচ্ছি।
প্রথম দুটি চিঠির মতো তৃতীয়টিও এক ভিক্ষাপত্র।
তৃতীয় চিঠিখানি মঁসিয়ে পাবুরগতকে লেখা। তার ঠিকানা র্যু সেন্ট ভেনিস। তাতে লেখা আছে–
আমি এমনই একজন সাহিত্যিকের পক্ষ থেকে আপনার নিকট এই আবেদনপত্র পাঠাচ্ছি যিনি থিয়েটার শোয়াতে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য উপস্থাপিত করেছেন। এই নাটকটি ঐতিহাসিক এবং এর ঘটনাস্থল হচ্ছে সম্রাটের শাসনাধীন অভার্নে। আমার মতে নাটকটির আঙ্গিক হচ্ছে বাস্তবানুগ এবং এর মধ্যে বস্তু আছে। নাটকের চারটি জায়গায় গান আছে। হাস্যরস, নাটকীয়তা এবং বিস্ময় বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে মিশে আছে। পটভূমিকা ও আঙ্গিকের মধ্যে রোমান্টিকতার সুবাস আছে। কয়েকটি দৃশ্যে বিস্ময়ের চমক সৃষ্টি করে নাটকটি পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে।
যেসব কামনা-বাসনা আপনাদের এই শতকের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে সেই কামনাকে পরিতৃপ্ত করাই হল আমার প্রধান উদ্দেশ্য। সমাজের যেসব রীতিনীতি যখন-তখন বদলায় সেই সতত পরিবর্তনশীল রীতিনীতিকে তুলে ধরতে চেয়েছি আমি। কিন্তু আমার নাটকে এইসব গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও আমার ভয় হয় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ঈর্ষা ও লোভের জন্য আমার নাটকটি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। নবাগতদের সঙ্গে তারা কেমন ব্যবহার করে, তাদের কিভাবে দেখে তা আমার জানা আছে।
শিল্পকর্মের প্রতি আপনার অনুরাগের কথা জেনে আমি আমার মেয়েকে আপনার নিকট পাঠালাম। সে আমাদের দুরবস্থার কথা সব জানাবে। এই শীতে খাদ্য এবং তাপ নেই আমাদের। আমার প্রার্থনা আপনি আমাকে আমার এই নাটকটি আপনাকে উৎসর্গ করার অনুমতি দান করবেন। আমার অন্য নাটকগুলো আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবশত আপনার জন্যই রচনা করব। এর দ্বারা বোঝা যাবে আমি আপনার সাহায্যের কতখানি প্রত্যাশা করি এবং আমার লেখার সঙ্গে আপনার নামটিকেও অলঙ্কৃত করে রাখতে চাই। আপনি যদি আমাকে কিছু সাহায্য করেন তা হলে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত আমি আপনার জন্য একটি প্রশস্তিমূলক কবিতা রচনা করব। কবিতাটি নাটকের প্রথমেই সংযোজিত হবে এবং সেটি মঞ্চে আবৃত্তি হবে।
পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে
সাহিত্যিক জেনফ্লট
পুনশ্চ:–অন্তত চল্লিশ ব্যু দয়া করে দেবেন।
আমি নিজে যেতে না পারার জন্য ক্ষমা করবেন। উপযুক্ত পোশাক না থাকার জন্য আমি যেতে না পেরে আমার মেয়েকে পাঠালাম।
চতুর্থ চিঠিখানি এক পরোপকারী ব্যক্তিকে লেখা।
পরোপকারী মহানুভব মহাশয়,
আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার মেয়ের সঙ্গে আসেন তা হলে এক বিপর্যস্ত জীবনের চিত্র দেখতে পাবেন স্বচক্ষে। আমি আমার পরিচয়পত্র আপনাকে দেখাব। আমি জানি এই চিঠিখানি আপনার উদার আত্মাকে পরোপকারে অনুপ্রাণিত করবে। কারণ দার্শনিক প্রকৃতির মানুষরা সহজেই প্রবল আবেগে বিচলিত হন।