সেখানে গিয়ে মেরিয়াস তার বন্ধুদের ছেড়ে দিয়ে পথের গাড়িঘোড়া আর মানুষের ভিড় এড়িয়ে গাছপালায় ঘেরা এক নির্জন জায়গায় চলে যায়। এইভাবে তার তপ্ত আবেগকে শীতল করতে চায় সে।
এরপর থেকে সে শুধু নির্জন জায়গা বেছে নিয়ে নিজের দুঃখের কথাটাই ভাবতে লাগল। খাঁচাবন্দি নেকড়ের মতো দুঃখের প্রাচীরঘেরা একটা ঘরের মধ্যে যেন নিবিড় যন্ত্রণার আঘাতে মুচড়ে উঠতে লাগল। তবে মাঝে মাঝে সে তার আকাঙ্ক্ষিত প্রেমাস্পদের খোঁজ করে বেড়াতে লাগল।
একদিন একটি ঘটনায় চমকে উঠল সে। বুলভার্দ দু লুক্সেমবুর্গ অঞ্চলে একদিন সে শ্রমিকের পোশাকপরা একটা প্রৌঢ় লোককে দেখতে পেল। তার টুপির তলায় মাথায় পাকা চুলগুলো বেরিয়েছিল। লোকটি ধীর পায়ে পথ হাঁটছিল। হয়তো সে কোনও বেদনার্ত চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছিল। মেরিয়াসের মনে হল লোকটি মঁসিয়ে লেবলাঁ। সেই চুল আর চেহারা ঠিকই আছে। শুধু মুখখানা আরও বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকের পোশাক পরে আছে কেন? এটা কি ছদ্মবেশ? মেরিয়াস আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল। কিন্তু সে বুঝল এখন তাকে বিস্ময়ের সব ঘোর কাটিয়ে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ভদ্রলোকের পিছু পিছু গিয়ে সে কোথায় থাকে তা দেখতে হবে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সে দেখল মঁসিয়ে। লেবলাঁ একটা পাশের গলিপথ দিয়ে চলে গেছে। কোনদিকে গেছে তা বুঝতে পারল না। সে। এই ঘটনার কথাটা কয়েকদিন তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ছিল। তার পর সে চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলল মন থেকে। ভাবল সে হয়তো ভুল দেখেছে।
.
২.
মেরিয়াস তখনও গর্বে অঞ্চলের সেই বাড়িটাতেই ছিল। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটের সম্বন্ধে তার কোনও খেয়াল বা হুঁশ ছিল না। সেই সময় গোটা বাড়িটার মধ্যে সে আর জনদ্ৰেত্তে ছাড়া আর কোনও ভাড়াটে ছিল না। জনদ্ৰেত্তে ছিল সেই দুস্থ পরিবারের কর্তা যে পরিবারে ছিল বাবা-মা আর দুটি মেয়ে, কিছুদিন আগে সে যে পরিবারকে বাড়িভাড়া মেটানোর জন্য তিরিশ ফ্রাঁ দিয়ে সাহায্য করেছিল এবং যে পরিবারের লোকদের সঙ্গে সে কোনওদিন কথা বলেনি। বাড়ির অন্য ভাড়াটেরা ভাড়া না দিতে পারার জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র উঠে গেছে।
তখন ছিল শীতকাল। ফেব্রুয়ারির একটি দিন। সেদিন সকাল থেকে সূর্য লুকোচুরি খেলছিল আকাশে। সূর্যের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছিল এরপর কয়েক সপ্তা ধরে আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা থাকবে। সেদিন ছিল প্রাচীন ক্যান্ডলমাস উৎসবের দিন।
সন্ধে হতেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল মেরিয়াস। আর কোনও কাজ না থাকায় সন্ধে হলেই হোটেলে রাতের খাওয়াটা সারতে যায় সে। যাবার সময় মাদাম বুগনল ঘর ঝাঁট দিতে দিতে তাকে বলল, আজকালকার দিনে একটা জিনিসই সস্তা পাওয়া যায়। সেটা হল মানুষের শ্রম আর দুঃখকষ্ট। এটা তুমি বিনা পয়সাতেই পেতে পার।
মেরিয়াস ধীর পায়ে ব্যারিয়ের অঞ্চলে অবস্থিত র্যু সেন্ট জাক হোটেলের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিষণ্ণ চিন্তার ভারে মাথাটা নত ছিল তার। হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে দুটি মেয়ে তাড়াহুড়ো করে এসে তাকে দেখতে না পেয়ে ছুটে এসে তার উপর পড়ল। তার গায়ে ধাক্কা লাগল। মনে হল কিছু একটার ভয়ে মেয়ে দুটি এস্ত হয়ে ছুটে আসছিল। তাদের পোশাক-আশাক বড় মলিন ছিল। তাদের মধ্যে একটি লম্বা রোগা এবং আর একটি মেয়ে তার থেকে ছোট। তাদের দিকে তাকিয়ে মেরিয়াস দেখল, তাদের মুখগুলো। ম্লান, চুলগুলো আলুথালু, জামাগুলো ছেঁড়া এবং বোতাম খোলা, পায়ে জুতো নেই। তাদের কথাবার্তার কিছু শুনতে পেল সে।
বড় মেয়েটি বলছিল, ওরা আমাদের খুব কাছে এসে পড়েছিল। আর একটু হলেই ধরে ফেলত।
ছোট মেয়েটি বলল, আমি তো দেখতেই পাইনি এবং মোটেই ছুটিনি।
তাদের কথা থেকে মেরিয়াস বুঝল পুলিশ তাদের ধরতে এসেছিল এবং তারা কোনওক্রমে পালিয়ে এসেছে।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে মেয়ে দুটির চলে যাওয়ার পথপানে তাকিয়ে রইল। তার পর সেখান থেকে তার পথে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই একটা কাগজের মোড়ক পথের উপর দেখতে পেয়ে সেটা তুলে নিল। তার মনে হল তার মধ্যে কাগজ আছে।
দুটি মেয়ের মধ্যে একজনের হাত থেকে পড়ে গেছে কাগজটা। মেরিয়াস তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের ডাকতে ডাকতে ছুটে গেল। কিন্তু তারা শুনতে পেল না। তখন সে কাগজের মোড়কটা তার পকেটে ভরে রাখল। কিছুদূর গিয়ে সে দেখল একটি শিশুর মৃতদেহভরা একটি কফিন তিনটি চেয়ারের উপর পথের ধারে নামানো রয়েছে। পাশে একটা বাতি জ্বলছে। এ দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার মেয়ে দুটির কথা মনে পড়ল।
সে ভাবল, হায় দুঃখী মায়েরা! যে মায়েরা নিজের মৃত সন্তানকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যায় তারা কত দুঃখী! তারা কী ভয়ঙ্কর জীবনই-না যাপন করে।
এরপর সে এইসব চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে এবং এই ঘটনার কথা আর না ভেবে নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল আবার। সে ভাবতে লাগল তার ছয় মাস ধরে চলতে থাকা প্রেমের ব্যাপারটার কথা। যে লুক্সেমবুর্গ বাগানে কত সূর্যালোকিত দিনে গাছের তলায় প্রেমের কত আনন্দোজ্জ্বল অনুভূতি সে উপভোগ করেছে তার কথা সে ভাবতে লাগল।
সে ভাবতে লাগল কত দুঃখময় হয়ে উঠেছে তার জীবন। আমি একদিন যুবতী মেয়েদের দেবদূত ভেবে ছুটে গিয়েছি। একদিন তাদের দেবদূত বলে ভাবতাম। কিন্তু আজ দেখছি তারা আসলে অন্ধকারের জীব।