রাত্রি হলে সালপেত্রিয়েরের একটা পোড়ো পতিত জমিতে চারজনে জড়ো হয়ে তারা। কী করবে না-করবে তা ঠিক করত। রাত্রিকালই ছিল তাদের কর্মকাল। দিন হলেই যেমন ভূতপ্রেত আর চোরেরা অদৃশ্য হয়ে যায় তেমনি তারাও অদৃশ্য হয়ে যেত দিনের বেলায়। এই চারজনের দলকে এককথায় বলা হত “পেনমিনেত্তে। একবার জেলে অ্যাসাইজ কোর্টের প্রেসিডেন্ট লামেনেয়ারকে একটা অপরাধের কথা জিজ্ঞাসা করেন। লামেনেয়ার বলে, এ অপরাধ সে করেনি। তখন প্রেসিডেন্ট তাকে জিজ্ঞাসা করেন, এ অপরাধ তা হলে কে করেছে? লামেনেয়ার তখন বলে, তা হলে পেনমিনেত্তে করে থাকবে। তার এক কথা ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে না পারলেও পুলিশ বুঝতে পারে। কারণ পুলিশ জানত পেনমিনেত্তে কী এবং তার সদস্য কারা। এই দলের লোকদের নামগুলো আজও পুলিশের খাতায় লেখা আছে। তারা সভ্যতার নিচের তলায় এক অন্ধকার জগতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে। তাদের কারও কোনও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বলে কিছু নেই। তারা সবাই মিলে একটা শ্রেণিকে গড়ে তুলেছে। তাই তাদের সকলের মধ্যে শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকটিত দেখা যায়। সারারাত চুরি, জুয়েচুরি, খুন প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে সকাল থেকে প্রায় সারাদিন ঘুমোয় তারা, ফলে দিনের বেলায় পথে কেউ তাদের দেখতে পায় না। তারা প্রেতের মতো ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন নাম নিয়ে। তারা আছে এবং যতদিন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন না হবে ততদিন তারা থাকবে। তাদের একটা দল চলে গেলে আর একটা দল আসবে তাদের জায়গায়। পকেট মারা ও গলা কাটার কাজে সমান দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের। কার কোন পকেটে টাকা আছে তা তারা আগে ঠিক করে নেয়। সোনা-রুপো থাকলে যেন তার গন্ধ পায় তারা। শহরের নিরীহ লোকদের দেখলেই তারা চিনতে পারে এবং তাদের পিছু নেয়। কোনও বিদেশি অথবা গ্রাম থেকে আসা কোনও লোক দেখলেই শিকার দর্শনে উল্লসিত মাকড়সার মতো কাঁপতে থাকে তারা।
যেসব লোক তাদের গভীর রাত্রিতে কোনও নির্জন জায়গায় দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়। তারা সত্যিই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তারা যেন সত্যিকারের মানুষ নয়, অন্ধকারের জীব। ছায়াশরীর। অন্ধকার থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে দানবিক জীবনযাপন করতে এসেছে।
এইসব অশুভ প্রেতাত্মার কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করার উপায় কী? এর একমাত্র উপায় আলো, আরও আলো। কোনও বাদুড় কখনও সকালের আলোর সামনে দাঁড়াতে পারে না। সমাজের নিচের তলার সেই অন্ধকার স্তরগুলোকে এক বিরাট আলোকবন্যার দ্বারা আমরা প্লাবিত করে দিতে পারব যেদিন একমাত্র সেইদিন ওই সব অন্ধকারের অবাঞ্ছিত জীবগুলো চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যাবে নিঃশেষে ও নিশ্চিহ্নভাবে।
৩.৮ গ্রীষ্ম ও শরৎ কেটে গিয়ে বসন্ত এল
অষ্টম পরিচ্ছেদ
১.
দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম ও শরৎ কেটে গিয়ে বসন্ত এল। কিন্তু মঁসিয়ে লেবলাঁ বা তার মেয়ে কেউ একটি দিনের জন্যও লুক্সেমবুর্গ বাগানে এল না। মেরিয়াসের মনে তখন শুধু একটা চিন্তাই ছিল। কখন এবং কী করে মেয়েটির সুন্দর মুখখানা আবার দেখতে পাবে। সে বহু জায়গায় খোঁজ করে, তার খোঁজে অনেক অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও খোঁজ পায়নি তাদের। ভাগ্যের সঙ্গে সগ্রাম করার মতো সাহস তার ছিল না, নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার মতো যৌবনসুলভ শক্তিও ছিল না তার। তার মন শুধু আকাশকুসুম কল্পনা করাতেই নিরত ছিল সব সময়। হতাশমগ্ন পথকুকুরের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল। তার জীবন হয়ে উঠল অর্থহীন। যে কোনও কাজ তার কাছে হয়ে উঠল বিতৃষ্ণাজনক, পথ হাঁটা হয়ে উঠল বিরক্তিকর। বিস্তৃত উদার দিগন্তসমন্বিত যে বিরাট প্রকৃতিজগৎ একদিন আলো ও অর্থে পরিপূর্ণ ছিল তার কাছে, আজ তা সব অর্থ হারিয়ে শূন্য হয়ে উঠল। জগৎ ও জীবনের সব কিছু থেকে যেন সব অর্থ উবে গেছে।
তবু সে ভাবত। নির্জন চিন্তায় মগ্ন হয়ে উঠত মাঝে মাঝে। কারণ না ভেবে পারত না। কিন্তু চিন্তা-ভাবনায় আর কোনও আনন্দ পেত না সে। কোনও চিন্তা বা পরিকল্পনা তার মনে এলেই শুধু তার মনে হত, কী হবে তাতে।
নিজেকে নিজে প্রায়ই ভর্ৎসনা করত। মেয়েটিকে চোখে দেখেই যখন আনন্দ পেত তখন কেন তাকে অনুসরণ করতে গেল? মেয়েটিও যখন তার দিকে তাকিয়েছিল তখন সেইটাই কি যথেষ্ট ছিল না? তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে-ও তাকে ভালোবাসে, আবার কী চায় সে? সে ভুল করেছে, নিজেকে সে হাস্যাস্পদ করে তুলেছে। আজকের এ দুঃখ তারই সৃষ্ট। কুরফেরাককে সে কিছু না বললেও কুরফেরাক তার এই ব্যাপারটা কিছু জানতে পেরেছে অনুমানের মাধ্যমে। কারণ এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে তার। প্রথমে কুরফেরাক এজন্য অভিনন্দন জানায় তাকে। তার প্রেমে পড়ার ব্যাপারে সে অবশ্য কিছুটা আশ্চর্য হয়ে যায়। পরে তার দুঃখ দেখে সে দমে যায়। সে বলে, তুমিও তো আমাদের মতো মানুষ। চল, আমরা একবার শমিয়ের দিয়ে বেড়িয়ে আসি।
একবার কোনও এক শরতের উজ্জ্বল দিন দেখে সে বাল দ্য স্কিও দিয়ে কুরফেরাক, বোসেত আর গ্রান্তেয়ারের সঙ্গে বেড়াতে যায়। তার প্রবল আশা ছিল সে হয়তো সেখানে দেখতে পাবে মেয়েটিকে। গ্রান্তেয়ার একবার তার বন্ধুদের কাছে বলেছিল, ওখানে অনেক হারানো মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায়।