বাবেতের রোগা রোগা চেহারাটা বিশালবপু গুয়েলেমারের একেবারে বিপরীত। বাবেত ছিল যেমন শীর্ণদেহ তেমনি চতুর। তাকে দেখতে খুব সরলমনা মনে হলেও আসলে তার প্রকৃতিটা ছিল যেমন গম্ভীর তেমনি দুর্বোধ্য। তার শীর্ণদেহের হাড়গুলোতে যেন উজ্জ্বল দিবালোকের ঢেউ খেলে যেত, কিন্তু সে আলোর কিছুমাত্র দেখা যেত না তার চোখে। সে বলত সে একজন কেমিস্ট বা ওষুধ প্রস্তুতকারক। কিন্তু আসলে সে মদের দোকানে কাজ করেছে আগে এবং বথিনোর সার্কাসে ভড়ের কাজ করে। সে খুব তাড়াতাড়ি কথা বলতে পারত এবং কথায় মানুষকে বশ করতে পারত। সে অনেক সময় মেলায় সঙু দেখাত। সে আবার পথে পথে ঘুরে দাঁত তোলার কাজও করে। সে ঘুরে ঘুরে। নিজের প্রচার নিজেই করে। তার গলার জোর খুব বেশি। তাছাড়া একটা গাড়ির উপর একটা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে সে প্রচার করে বেড়ায়। সে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, দন্তশিল্পী বাবেত ধাতু এবং ধাতুজাত দ্রব্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকার্যে রত আছেন। তিনি দাঁত তোলেন এবং আগে ভোলা দাঁতের কোনও অবশিষ্টাংশ লেগে থাকলে সেটাও তুলে দেন। একটা দাঁত ভোলার জন্য ১.৫০ ফ্রাঁ, দুটি দাঁত তোলার জন্য ২.০০ স্ট্রা এবং তিনটি দাঁত তোলার জন্য ২.৫০ ফ্ৰাঁ লাগবে। এই সুযোগ হারাবেন না (তার মানে যে যত পারেন দাঁত তুলে নিন)। সে বিয়ে করেছিল এবং তার ছেলেপুলে ছিল। কিন্তু তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা কোথায় আছে, তা সে জানে না। একটা রুমালের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। তাদের। একটা রুমাল যেমন মানুষ যেখানে-সেখানে ফেলে রেখে আসে তেমনি বাবেতও তার স্ত্রী ও সন্তানদের কোথায় ফেলে রাখে, তা সে নিজেই জানে না। সে খবরের কাগজের যতসব আজেবাজে খবরের ওপর জোর দিত। একবার মেসেঞ্জার নামে একটা সংবাদপত্রে সে একটা খবর পড়ে। কোথায় নাকি একজন মহিলা একটি গরুর বাছুরের মাথা প্রসব করেছে। খবরটা পড়ে সে বলে, এটা তো ভাগ্যের কথা। আমার স্ত্রীও এমনি এক সন্তান প্রসব করতে পারত। এরপর প্যারিসে চলে আসে বাবেত।
ক্লাকেসাস ছিল অন্ধকারের জীব। সে রাত্রির অন্ধকার নেমে না আসা পর্যন্ত তার আস্তানায় অপেক্ষা করত এবং অন্ধকার হলেই আস্তানা থেকে বেরিয়ে যেত এবং দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই সে ফিরে আসত তার আস্তানায়। রাত্রিবেলায় সে কোথায় যেত, কোথায় থাকত বা কী করত এবং তার আস্তানাই-বা কোথায় ছিল, তা কেউ জানত না। তার নামটাই আসলে ক্লাকেসাস ছিল কি না, তারও কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। একজন তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে রাগের সঙ্গে বলেছিল, আমার নাম যা-ই হোক তোমার কী? তুমি নিজের চরকায় তেল দাও। সে তার রাতের সহচরদেরও তার আসল নামটা কী, তা বলত না। বাবেত বলত, ক্লাকেসাসের দু রকম গলার স্বর আছে। কাউকে সে তার মুখটাও দেখাতে চাইত না। কেউ তার সামনে আলো নিয়ে এলে সে মুখোশ পরত সঙ্গে সঙ্গে। তার চালচলন সত্যিই বড় রহস্যময় ছিল। রহস্যময়ভাবে ঘুরে বেড়াত সে। সে কথাও বেশি বলত। কথা বলার থেকে খেত বেশি। সে ভূতের মতো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেত কোথায়, আবার হঠাৎ কোথা হতে এসে হাজির হত। মনে হত যেন সে মাটির ভেতর থেকে হঠাৎ উঠে এসেছে।
বেচারা মঁতপার্নেসির জন্য দুঃখ হয়। এদের সবার থেকে ছেলেমানুষ সে। তার বয়স কুড়িরও কম। সুন্দর মুখ। চেরি ফলের মতো লাল ঠোঁট, কালো চুল এবং চোখে ছিল বসন্তদিনের উজ্জ্বলতা। কিন্তু সব রকম পাপকাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত সে। সে ছেলেবেলা থেকেই ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াত এবং ক্রমে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। চেহারাটা তার মেয়েলি ধরনের এবং সুন্দর হলেও বেশ বলিষ্ঠ ছিল। সে তার মাথায় টুপিটা বাঁ দিকে বাঁকিয়ে পরত বলে ডান দিকের চুলগুলো দেখা যেত। টেলকোটটা বেশ সুন্দর ছিল। সে-ও যখন-তখন মানুষ খুন করত এবং তার অপরাধের একমাত্র কারণ ছিল ভালো ভালো পোশাক পরার ইচ্ছা। যে মেয়ে প্রথম তার সুন্দর চোখের মোহে মুগ্ধ হয়ে সে-ই তার মধ্যে কামনার আগুন জ্বেলে দেয়। তার চেহারাটা সুন্দর বলে সে ভালো ভালো পোশাক পরে নিজেকে সাজাতে চাইত। কিন্তু রুজি-রোজগারের কোনও চেষ্টা ছিল না বলে টাকার জন্য তাকে অপরাধ করতে হত। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই কয়েকটা খুন করার কৃতিত্ব অর্জন করে। তার মাথায় ছিল ঢেউখেলানো চুল, কোমরটা সরু, বুক এবং কাঁধ প্রুশিয়ার সামরিক অফিসারদের মতো। তার গলবন্ধনীটা সুন্দর করে লাগানো থাকত। কোটের বোতামে একটা ফুল লাগানো থাকত। মেয়েরা তার প্রশংসা করত। মঁতপার্নেসি ছিল যেন এক অন্ধকার জগতের ফোঁটা ফুল।
.
৪.
এই চারজনে মিলে একটা দল করেছিল। তারা আইনকে ফাঁকি দিয়ে ছদ্মবেশে বনে-পাহাড়ে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াত। তারা যে কোনও সময়ে নিজেদের নামগুলো পাল্টে ফেলত এবং পোশাক পরিবর্তন করে পুলিশের চোখে ধুলো দিত। এক একসময় এক একরকম কৌশল অবলম্বন করত। তারা কখনও একা একা থাকত, আবার কখনও বা একসঙ্গে থাকত। যেন একই রাক্ষসের চারটে মুখ।
বাবেত, গুয়েতেমার, ক্লাকেসাস আর তপার্নেসি–এই চারজনে মিলে নানারকম অপরাধের এক প্রধান কার্যালয় গড়ে তুলেছিল। যারা তাদের মতো অপরাধ করে তাদের কুটিল উচ্চাভিলাষ পূরণ করে পারদর্শিতা দেখাত, তারাই ছিল তাদের কাছে আদর্শ মানুষ। তারা নানাভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলত অথবা পেছন থেকে ছুরি মারত। তারা একবার কোনও অপরাধের পরিকল্পনা করলে তা যেমন করে তোক কার্যকরী করে তুলঁত। কোনও কাজে কোনও বেশি লোকের দরকার হলে সে তোক জোগাড় করে ফেলত। কিছু বাড়তি লোক সব সময়ই তাদের হাতের কাছে থাকত।