কিন্তু আবার একদল আছে সমাজের নিচের তলায় যাদের চোখে কোনও আলোই নেই। যারা চোখে কিছু দেখতে পায় না। তাদের প্রতি আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। তাদের সামনে গিয়ে ভয়ে আমাদের কাঁপতে হয়। সব সমাজেরই নিচের তলায় এই ধরনের অনেক অন্ধ ছুঁচো আছে।
কিন্তু সমাজের নিচের তলার যত স্তরের কথা বলছি আমরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে গম্ভীর হচ্ছে তথাকথিত প্রগতি বা অবান্তর চিন্তাধারার গোপন সুড়ঙ্গপথ। মারাত, বাবুফ কেউ সে স্তরের তল খুঁজে পায় না। সমাজের সর্বনিম্ন সেই স্তর বা তলদেশই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। আসলে সেটা এক অন্ধকার গহ্বর যেখানে থাকে সেইসব মানুষ যারা মনের দিক থেকে একেবারে অন্ধ, যারা সত্যকে কোনওদিন দেখেনি এবং দেখতে চায়ও না।
.
২.
সমাজের সেই সর্বনিম্ন অন্ধকার গহ্বরের তলদেশে বিরাজ করে এক অন্তহীন অরাজকতা। সেখানে যত সব অন্ধ রাক্ষসগুলো ঝগড়া-মারামারি করে আর গর্জন করে ভয়ঙ্করভাবে। বিশ্বের অগ্রগতি সম্বন্ধে কোনও খবর রাখে না তারা। এ বিষয়ে কোনও চিন্তা করে না বা কোনও কথা বলে না। নিজেদের কামনাপূরণ ছাড়া আর কিছুই জানে না তারা। তাদের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর শূন্যতা আছে তা তারা জানে না। তাদের দুটি মাতা আছে; তা হল অজ্ঞতা আর দারিদ্র্য। তাদের জীবনে শুধু একটা নীতি আছে যার দ্বারা তারা সব সময় পরিচালিত হয়। সে নীতি হল দেহগত প্রয়োজন পরিতৃপ্তি। বাঘের মতোই ভয়ঙ্কর তাদের ক্ষুধা। দুঃখ-দারিদ্র্যের মাঝে লালিত-পালিত শিশু অন্ধকার জগতের এক অমোঘ নিয়মানুসারে একদিন পরিণত হয় এক পাকা অপরাধীতে। সমাজের সেই সর্বনিম্ন অন্ধকার স্তরে পরম সত্যের জন্য কোনও অনুসন্ধিৎসা নেই, আছে শুধু জড়বস্তুর প্রতি এক অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। মানুষ সেখানে পরিণত হয় পশুর শিকারে। ক্ষুধা আর তৃষ্ণা কেন্দ্রচ্যুত করে নিয়ে বেড়ায় তাদের। শয়তান হওয়াই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই অন্ধকার গহ্বর হতেই একদিন কবি ও নরঘাতক লামেনেয়ারের উদ্ভব হয়।
আগের অধ্যায়গুলোতে আমরা সমাজের উপরতলার স্তরে রাজনীতি, বিপ্লব আর ছাত্রদের দার্শনিক জগতের কথা বলেছি। সেখানে যারা থাকে স্বভাবতই তারা উচ্চমনা। তারা ভুল করে, দোষ করে ঠিক, কিন্তু তবু তারা শ্রদ্ধার পাত্র, কারণ তাদের ভুলের মধ্যেও এক ধরনের বীরত্ব আছে। তাদের শুধু জীবনে একটাই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আছে এবং তা হল প্রগতি। কিন্তু এই প্রগতির গভীরে একবার উঁকি মেরে আমরা দেখব কী ধরনের বিভীষিকা আছে সেখানে।
সমাজের এই স্তরে থাকে যত সব তথাকথিত বিপ্লবীরা। সেখানে বিরাজ করে এক অজ্ঞতার অন্ধকার। তারা নিজেদের দার্শনিক বললেও কোনও দর্শনচিন্তার ধার ধারে না, তারা নিজেদের বিপ্লবী বললেও তাদের ছুরি কোনওদিন একটা কলমও কাটেনি। তারা কোনও বই বা খবরের কাগজের পাতা খোলে না কোনওদিন। অভিজাত শোষকদের মতো তারা মানুষকে ভুল তত্ত্ব ও নীতির দ্বারা প্রভাবিত করে। তাদের জীবনের লক্ষ্য শুধু একটাই এবং তা হল সব কিছু ধ্বংস করা।
তারা সব কিছুই ধ্বংস করতে চায়। তারা শুধু বর্তমান সমাজব্যবস্থার সবকিছু ধ্বংস করতে চায় না, সব বিজ্ঞান, দর্শন, নিয়ম-কানুন, চিন্তা-আদর্শ, সভ্যতা, প্রগতি এবং বিপ্লবকেও ধ্বংস করে আর নরহত্যাই তাদের একমাত্র কাজ। অজ্ঞতার প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত সেই অন্ধকার জগতের মধ্যে তারা চায় শুধু বিশৃঙ্খলা। সমাজের অন্য স্তরগুলো এইসব বিপ্লবীকে উচ্ছেদ করতে চায়। তাদের প্রগতির দর্শন, পরম সত্যের সন্ধান, সকল ভাবনাচিন্তা এবং প্রচেষ্টার এই হল ফলশ্রুতি। যে অজ্ঞতার অন্ধকার। সমাজের প্রকৃত শত্ৰু, সেই শত্রুকে নাশ করতে হবে।
সব মানুষই সমান। সব মানুষই একই মাটি হতে উদ্ভূত। একই ভাগ্যের শরিক সব মানুষ। একই শূন্যতা থেকে জন্মলাভ করি আমরা। আমাদের সকলের দেহে থাকে একই মাংস এবং মৃত্যুর পর একই ভস্মে পরিণত হই আমরা। কিন্তু যে অজ্ঞতার অন্ধকার দুরারোগ্য ব্যাধির মতো প্রতিটি আত্মাকে সংক্রমিত করে, তা নিঃসন্দেহে এক অশুভ অভিশাপ।
.
৩.
১৮৩০-৩৫ সাল পর্যন্ত চারটি শয়তান প্যারিসের সমাজজীবনের নিচের তলায় প্রভুত্ব করত। তাদের নাম হল ক্লাকেসাস, গুয়েলেমার, বাবেত আর মতপার্নোস।
গুয়েতেমার ছিল আধুনিক হাকিউলেস যে আর্কে মেরিয়ত আব্বনে বাস করত। তার চেহারাটা ছিল সাত ফুট লম্বা, হাতের পেশিগুলো ছিল ইস্পাতের মতো কঠিন, প্রশস্ত বক্ষস্থল –দেখতে দৈত্যের মতো, কিন্তু মস্তিষ্কটা পাখির মতো হালকা। তাকে দেখলেই মনে হত সে যেন সুতির পায়জামা আর মখমলের জ্যাকেটপরা এক আধুনিক যুগের হার্কিউলেস। তার বিশাল দেহের অমিত শক্তি দিয়ে সে যত সব মানুষরূপী দৈত্য-দানবদের জব্দ করতে পারত, কিন্তু তা না করে সে নিজেই একজন দানব হয়ে ওঠে এবং এইটাই হয়তো সহজ হয়ে ওঠে তার পক্ষে। বয়স তার চল্লিশের কিছু কমই হবে। মুখে ছিল অল্প। একটু দাড়ি, মাথার চুলগুলো ছোট করে ছাটা তার চেহারাটা চিত্রিত করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তার হাতের পেশিগুলো কাজ চাইত, কিন্তু তার নির্বুদ্ধিতার জন্য সে কোনও কাজ করতে চাইত না। সে ছিল এক লক্ষ্যহীন কর্মহীন শক্তির মানুষ। মাঝে মাঝে সে মানুষ খুন করত। সে ছিল ক্রিওল উপজাতির লোক। ১৮৫৫ সালে সে মার্শাল ক্রনের অধীনে অভিযানে শ্রমিকের কাজ করত। এরপর সে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।