পরের দিনও বাগানে এল না মঁসিয়ে লেবলাঁ। মেরিয়াসও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলে গিয়ে তেমনিভাবে পায়চারি করতে লাগল আর তাদের জানালাটার পানে তাকাতে লাগল। রাত্রি দশটার সময় আলোটা নিবে যেতেই মেরিয়াস চলে গেল। জ্বর যেমন রুগ্ণ ব্যক্তিকে ছাড়তে চায় না তেমনি প্রেম একবার ধরলে প্রেমিককে ছাড়তে চায় না।
একটা সপ্তা কেটে গেল এইভাবে। লেবলাঁ আর তার মেয়ে আর লুক্সেমবুর্গ বাগানে আসত না। তারা কেন আর আসছে না, তা নিয়ে বিষণ্ণভাবে ভাবতে লাগল মেরিয়াস। নানারকম অনুমান করতে লাগল। কিন্তু দিনের বেলায় হোটেলের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে ভয় হল তার। তাই সন্ধ্যার পর হোটেলের সামনে গিয়ে তাদের জানালার আলোটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল ঘরের মধ্যে জ্বলন্ত বাতিটার সামনে দিয়ে একটা ছায়া যাওয়া-আসা করছে।
এইভাবে সাত দিন কেটে যাবার পর আট দিনের দিন সন্ধের পর সে জানালায় আর কোনও আলো দেখতে পেল না মেরিয়াস। তাদের ঘর অন্ধকার। সে ভাবল ওরা হয়তো সন্ধের সময় বাইরে কোথাও আছে। শুধু রাত দশটা নয়, রাতদুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করল মেরিয়াস। তবু আলো জ্বলল না সে ঘরে। অপরিসীম বিষাদ বুকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল মেরিয়াস।
একদিন পর আবার লুক্সেমবুর্গ বাগানে গেল মেরিয়াস। কিন্তু সেদিন মঁসিয়ে লেবলাঁদের দেখতে পেল না সে। সন্ধের পর সে হোটেলে গেল। কিন্তু সেদিনও তাদের জানালায় আলো দেখতে পেল না। জানালাটার সার্সি বন্ধ।
মেরিয়াস হোটেলের দারোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, চারতলার ভদ্রলোক কোথায়?
দারোয়ান বলল, তিনি চলে গেছেন।
মেরিয়াসের মাথাটা ঘুরতে লাগল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কবে চলে গেছেন?
গতকাল।
কোথায় গেছেন?
আমি তা জানি না।
কোনও ঠিকানা রেখে গেছেন?
না।
দারোয়ান এবার মেরিয়াসকে চিনতে পারল। ও আরও একদিন দারোয়ানকে ভদ্রলোকের কথা জিজ্ঞাসা করে। সে বলল, আপনি আবার এসেছেন, আপনি নিশ্চয় পুলিশের কোনও চর।
৩.৭ নিচের তলায় স্তর
সপ্তম পরিচ্ছেদ
১.
সব সমাজেরই নিচের তলায় একটা করে স্তর থাকে। সেই স্তরে ভালো ও মন্দ দিকে অনেক সুড়ঙ্গ থাকে। জটিল গোলকধাঁধার মতো কত সুড়ঙ্গপথ! ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিপ্লব কত সব তত্ত্ব ও নীতির সুড়ঙ্গপথ দেশের বিভিন্ন দিক ও অঞ্চলে প্রসারিত থাকে। যত সব অবান্তর চিন্তার এইসব সুড়ঙ্গপথেই জন্ম হয় এবং ক্রমে তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেইসব চিন্তার প্রভাবে কত বৈপ্লবিক কাজকর্ম চলে সমাজের নিচের তলায়। আর সেই কাজের ফলে উপরতলাতে আসে এক পরিবর্তন।
উপরতলার সমাজ অনেক সময় তার নিচের তলায় কী সব কাজকর্ম হচ্ছে, তার কথা জানতেই পারে না। রুশো ভায়োজেনেসের হাতে এক ধারালো কুঠার তুলে দেন, ভায়োজেনেস তার পরিবর্তে তুলে দেন লণ্ঠন। ক্যালভিন ইতালীয় নাস্তিক হোসিনের সঙ্গে ঝগড়া করেন। সমাজের নিচের তলায় গোপনে যে প্রবল আলোড়ন চলবে তার আঘাতে সমাজের উপরতলায় এক রূপান্তর সংঘটিত হয়। এই আলোড়ন সমাজের উপরতলাটাকে প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ না করলেও তলায় তলায় গোপনে সমাজের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে থাকে।
সমাজস্তরের গভীরে কেউ যদি নেমে যায় তা হলে সেখানে দেখবে শুধু শ্রমিক। যে স্তরে সমাজদর্শন কাজ করে সে স্তরে কাজকর্ম ভালোই হয়। কিন্তু তার নিচের স্তরে সব কিছুই সংশয়াত্মক, সব কিছুই ভয়ঙ্কর। সেই স্তরে সভ্যতার আলো প্রবেশ করতে পারে না। সেখানকার হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে পারে না মানুষ। সেখানে যত সব রাক্ষসের জন্ম হয়। যে মই দিয়ে নিচের তলার স্তরে নেমে যাওয়া হয় তার এক একটি আংটায় এক-একটি দর্শন, এক একটি তত্ত্ব দাঁড়িয়ে থাকে। এক একটি তত্ত্ব অনুসারে এক একজন লোক কাজ করে। হুসের তলায় লুথার, লুথারের তলায় দেকার্তে, দেখাতের তলায় ভলতেয়ার, ভলতেয়ারের তলায় কনভরসেত, কনভরসেতের তলায় রোবোসপিয়ার, রোবোসপিয়ারের তলায় মারাত, মারাতের তলায় বাবুফ… এইভাবে উপর থেকে নিচে নেমে গেছে। তার পর আর কিছু দেখা যায় না। শুধু কতকগুলি ছায়াচ্ছন্ন প্রেমূর্তি যাদের শুধু মনের চোখ দিয়ে দেখা যায় অস্পষ্টভাবে। তাদের মধ্যেই আছে ভবিষ্যতের প্রাণ। ভবিষ্যতের এক আকারহীন ভাবমূর্তি শুধু দার্শনিকের কল্পনায় ভাসতে থাকে। সেইসব ভাবমূর্তির আকারগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যায়।
সেই নিচের তলায় বিভিন্ন গ্যালারিতে সেন্ট সাইমন, ওয়েন, ফুরিয়েও আছেন। এক অদৃশ্য বন্ধনের দ্বারা তারা পরস্পরের সঙ্গে আবব্ধ হয়ে আছেন, যে বন্ধনের কথা তারা নিজেরাই জানেন না। তারা নিজেদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন। একজনের আলো অন্যজনের আলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়ে পরে মিশে যায়। তাঁদের জীবন ও কর্ম উন্নত হলেও তার পরিণতি ছিল বড় মর্মান্তিক। তাঁদের মধ্যে যত পার্থক্যই থাক তাদের একটা মিল ছিল। তাঁরা সকলেই ছিলেন নিরাসক্ত। তবে তাদের শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল। সে লক্ষ্য হল সত্যের সন্ধান। তাঁদের মধ্যে যারা বড় তারা হয়তো স্বর্গ বা অনন্তলোকের সন্ধান পেয়েছেন, কিন্তু যারা বড় হতে পারেননি, তাঁদের চোখে থাকে শুধু অস্পষ্ট এক আলো।