শেষের কথাগুলো সে বলল স্পষ্ট ভাষায়, আবেগকম্পিত সুরে। তার পর সে চোখ বন্ধ করল। কথাগুলো বলতে পরিশ্রম হয়েছে তার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যেন কয়েকটা বছর পার হয়ে গেছে। সে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আগের থেকে আর এই ক্লান্তিই যেন মৃত্যুর আরও কাছে এনে দিয়েছে তাকে।
বিশপ দেখলেন নষ্ট করার মতো সময় নেই। তিনি যাজক হিসেবে এখানে এসেছিলেন। তাঁর সকল ঔদাসীন্য ক্রমে পরিণত হল এক গভীর আবেগে। বৃদ্ধের মুদিত চোখ দুটির পানে তাকিয়ে তার হিম হয়ে যাওয়া রুগ্ণ হাতটি ধরে তার উপর ঝুঁকে বললেন তিনি, এখন এই মুহূর্তটি ঈশ্বরের। এ মুহূর্তের যথাযথ সদ্ব্যবহার করতে না পারাটা সত্যিই কত দুঃখজনক, সেটা আপনি মনে করেন না?
বৃদ্ধ চোখ খুলে তাকাল। এক ছায়াচ্ছন্ন গাম্ভীর্য ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। দুর্বলতার জন্য সে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, হে আমার লর্ড বিশপ, পড়াশোনা, চিন্তা আর ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমি জীবনযাপন করেছি। আমার বয়স যখন ষাট তখন দেশের কাজের জন্য আমাকে ডাকা হয়। আমি সে ডাকে সাড়া দিই। দেশের মধ্যে অনেক কুপ্রথা এবং কুসংস্কার ছিল, আমি তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলাম, অনেক অত্যাচার-অবিচার আমি ধ্বংস করেছিলাম, অনেক মানবিক অবিচার এবং নীতিকে আমি প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমার দেশ যখন আক্রান্ত হয় তখন আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম। ফ্রান্সকে বিদেশিরা আক্রমণের ভয় দেখালে আমি দেশের জন্য প্রাণ-মন উৎসর্গ করি। আমি কখনই ধনী ছিলাম না, এখনও আমি গরিব। রাষ্ট্রের কর্তাদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। আমাদের রাজকোষ এত বেশি ধনরত্নে পূর্ণ ছিল যে সোনা-রুপোর চাপে দেয়ালগুলো ভেঙে যাওয়ার ভয়ে দেয়ালগুলোর বাইরে থাম গেঁথে সেগুলোকে ঠেকা দিয়ে জোরালো করতে হয়। তবু আমি পভার্টি স্ট্রিটের একটা হোটেলে বাইশ স্যুতে খেতাম। আমি উৎপীড়িতদের দুঃখমোচন করি এবং আর্তদের সান্ত্বনা দিই। আমি বেদির কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিলাম তা ঠিক, কিন্তু দেশের ক্ষতস্থান বেঁধে দেওয়ার জন্যই তা করেছিলাম। আলোকোজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের পানে মানবজাতির অগ্রগতির জন্যই আমি সংগ্রাম করেছিলাম। ক্ষমাহীন অত্যাচারের অগ্রগতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। বহুক্ষেত্রে আমি আপনাদের বিরুদ্ধবাদী হলেও অনেক যাজককে রক্ষা করেছিলাম। ফ্ল্যান্ডার্সের অন্তর্গত পিথেঘেমে যেখানে একদিন মেরো-ভিঙ্গিয়ান রাজাদের গ্রীষ্মকাল ছিল তার কাছাকাছি একটা চার্চ ছিল। ১৭৯৩ সালে ধ্বংসের কবল থেকে সে চার্চকে রক্ষা করেছিলাম। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, আমার যথাশক্তি মানুষের মঙ্গল সাধন করেছি। এতে আমার যশের হানি হয়, আমাকে পীড়ন সহ্য করতে হয়, আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়, আমাকে বিজ্ৰপ করা হয়। আমি জানি এখনও পর্যন্ত অনেক লোকে বিশ্বাস করে আমাকে ঘৃণ্য করার তাদের অধিকার আছে। বহুলোকের কাছে আমি ধিকৃত। আমি তাই ঘৃণার বস্তুরূপে নির্জনে বাস করে আসছি, অথচ আমি কাউকে ঘৃণা করি না; এখন আপনি আমার কাছে কী চান?
সঙ্গে সঙ্গে নতজানু হয়ে বিশপ বললেন, আপনার আশীর্বাদ।
বিশপ যখন মুখ তুলে তাকালেন তখন দেখলেন বৃদ্ধ লোকটির চোখেমুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশপ দেখলেন তার মৃত্যু হয়েছে।
সেদিন রাতে চিন্তামগ্ন অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন বিশপ। সারারাত তিনি প্রার্থনা করে কাটালেন। পরদিন কিছু কৌতূহলী লোক বিশপকে সেই জনপ্রতিনিধির কথা জিজ্ঞাসা করায় বিশপ শুধু নীরবে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে কী দেখালেন। তার পর থেকে দুস্থ ও আর্তদের প্রতি বিশপের মায়ামমতা আরও বেড়ে যায়।
এরপর কেউ যদি বুড়ো শয়তান বলে অভিহিত করত সেই বিপ্লবীকে তা হলে বিশপ চুপ করে কী ভাবতেন। তিনি ভাবতেন যে লোকটি তার সামনে মারা গেল, তার উন্নত বিবেক তাঁর নিজের পূর্ণতার প্রতি সংগ্রামকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।
তবে সেই বিপ্লবী বৃদ্ধটির মৃত্যুকালে তার কাছে যাওয়ার জন্য শহরের অনেকেই সমালোচনা করতে থাকে বিশপের। যখন সব বিপ্লবীই নাস্তিক, যেখানে তাদের কাউকেই ধর্মান্তরিতকরণের কোনও আশা নেই সেখানে কেন গিয়েছিলেন বিশপ? তার আত্মাটাকে শয়তানে কিভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখার জন্যই কি গিয়েছিলেন তার শয্যাপাশে?
মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী এক বিধবা মহিলা ঔদ্ধত্যকে বুদ্ধি বলে ভাবত। সে একদিন বিশপকে বলল, আমরা আশ্চর্য হয়ে সবাই ভাবছি মঁসিয়ে, আপনি হয়তো একদিন বিপ্লবীদের মতো মাথায় লাল ফিতে ব্যবহার করবেন।
বিশপ বললেন, লাল রংটা এমনই যে তা সব ক্ষেত্রেই চলে। আশ্চর্য এই যে যারা বিপ্লবীদের লাল ফিতেকে ঘৃণার চোখে দেখে তারাই আবার লাল টুপি পরে।
.
১১
এর থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ভুল হবে যে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু একজন দার্শনিক যাজক ছিলেন। সেই জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের পর থেকে তার মনে যে বিস্ময় জাগে সে বিস্ময় তাকে আরও শান্ত করে তোলে।
যদিও রাজনীতি নিয়ে তিনি কখনও মাথা ঘামাতেন না তথাপি সেকালে দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব কী ছিল সে বিষয়ে কিছু বিবরণ দান করা উচিত। আর তার জন্য কয়েক বছর পেছনে যেতে হবে আমাদের।