বিশপ মাথা নত করে একটি প্রার্থনাস্তোত্রের একটি ছত্র উদ্ধৃত করে বললেন, আমি একটি কীটমাত্র, মানুষ নই।
মুমূর্ষ বিপ্লবী যত কঠোর ভাব ধারণ করল বিশপ ততই বিস্ত্র হয়ে উঠলেন। তিনি শান্তভাবে বললেন, মনে করুন আপনি যা বললেন তা সব সত্য। আমার আয়, আমার ঐশ্বর্য, আমার গাড়ি, আমার খাওয়া-দাওয়ার যেসব কথা বললেন তা সব সত্য হলেও একটা কথা আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে করুণা কেন মানবজীবনের একটা প্রধান গুণ নয়? মার্জনা কেন মানবজীবনের প্রধান কর্তব্য নয় এবং ১৭৯৩ সালটি কেন ক্ষমার অযোগ্য নয়?
বৃদ্ধ বিপ্লবী কপালে হাত দিয়ে কিছু মুছল। তার পর বলল, আপনার কথার উত্তর দেওয়ার আগে প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি মঁসিয়ে। আপনি আমার অতিথি এবং যথাযোগ্য সৌজন্য দেখাতে পারিনি। আমরা আমাদের আপন আপন ভাবধারার কথা আলোচনা করছি এবং এক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে সব কথা বলতে হবে; আপনার সম্পদ আর সুযোগ-সুবিধাভোগ তর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি সুবিধার জন্য, কিন্তু এটা সুরুচির পরিচায়ক নয়। কিন্তু এগুলো আর আমি উল্লেখ করব না।
বিশপ বললেন, এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে।
আপনি আমাকে একটা জিনিস ব্যাখ্যা করতে বলেছেন। আপনি বললেন ১৭৯৩ সাল ক্ষমার অতীত।
বিশপ বললেন, হ্যাঁ। মারাও যে গিলোটিন নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সে বিষয়ে কী বলতে চান আপনি?
সৈন্যরা যখন প্রোটেস্ট্যান্টদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল কানে বুসতে তখন ‘তে দিউম’ গানের অনুষ্ঠান করেছিল সে বিষয়েই বা আপনি কী বলতে চান?
উত্তরটা খুবই কড়া। তীক্ষ্ণ তরবারির মতো এ উত্তরটা বিদ্ধ করল বিশপকে। বিশপ কেঁপে উঠলেন। তিনি কোনও উত্তর খুঁজে পেলেন না। তবে বুসেতের উল্লেখ করায় তিনি রেগে গেলেন। যারা মহান ব্যক্তি তাদের কিছু না কিছু দুর্বলতা হয়তো থাকে, কিন্তু তর্কের খাতির তাঁদের অশ্রদ্ধা করাটা সত্যিই রাগের কথা।
বৃদ্ধ বিপ্লবী হাঁপাতে লাগল। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে তাতে একটুও ম্লান হয়নি তার দৃষ্টির স্বচ্ছতা। সে বলতে লাগল, আমরা আর একটু এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পারি। সমগ্রভাবে বিচার করলে দেখা যাবে বিপ্লব মানবতার এক বিরাট স্বীকৃতি, শুধু ১৭৯৩ সালটাই তার ব্যতিক্রম। আপনি এ সালটাকে ক্ষমা করতে পারেন না। কিন্তু মঁসিয়ে, সমগ্রভাবে বিচার করলে রাজতন্ত্রই কি ক্ষমার যোগ্য? স্বীকার করি ফ্যারিয়ার অপরাধী, কিন্তু মন্ত্রী ভানকে কী বলবেন? ফুকিয়ের তিনভিল একজন শয়তান ছিল ঠিক, কিন্তু লাময়গনান বেতিলকে কী বলবেন? ম্যালিয়ার্দ ঘৃণ্য হতে পারেন, কিন্তু সয়তানে কী? জের্দে কুপ তেতির থেকে মার্কুই দ্য লুভয় কি বেশি ভয়ঙ্কর মঁসিয়ে, আমি রানি মেরি আঁতানোতের মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করি ঠিক, কিন্তু হুগোমত নারীর জন্যও কম দুঃখ বোধ করি না। রাজা লুই-এর আমলে সেই নারীকে একটা খুঁটিতে কোমর পর্যন্ত অনাবৃত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় আর তার শিশুসন্তানকে তার সামনে ধরে রাখা হয়। শিশুটি তার স্তনদুধ খাবার জন্য জোরে কাঁদতে থাকে। তখন মেয়েটিকে বলা হয় তার শিশুসন্তানের জীবন আর তার শালীনতা–এই দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে তাকে। একটি মাতার ওপর এই অত্যাচারকে আপনি কী বলবেন মঁসিয়ে? আপনাকে একটা কথা মনে রাখতে হবে। বিপ্লবের অবশ্যই কতকগুলি কারণ আছে। এর যা কিছু ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের মানুষ তা ভুলে গিয়ে এর কারণগুলো বুঝতে পারবে। এর একমাত্র ফল এক নতুন জগতের উদ্ভব। এই বিপ্লবের মধ্যে অনেক ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক কাজ অনুষ্ঠিত হলেও তার থেকে একটা ভালো জিনিস বেরিয়ে আসে–সেটা হল মানবতার প্রতি অকুণ্ঠ আলিঙ্গন। যাই হোক, এ বিষয়ে আর আমি কিছু বলব না। আমার বলার আরও কিছু আছে। তাছাড়া আমার মৃত্যু আসন্ন।
বিশপের দিকে না তাকিয়েই বৃদ্ধ বলতে লাগল, অগ্রগতির পথে যেসব নিষ্ঠুরতা দেখা দেয় তাকে আমরা বিপ্লব বলি। বিপ্লবের শেষে আমরা দেখি অনেক মারামারি কাটাকাটি ও অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে ঠিক, কিন্তু মানবজাতি তা সত্ত্বেও কিছুটা এগিয়ে গেছে।
কথাগুলো বলে বৃদ্ধ আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও সে বুঝতে পারেনি, তুকের পথে সে বিশপের আত্মরক্ষার অনেকগুলো বেড়া একে একে ভেঙে ফেললেও একটা প্রধান বেড়া তার শক্তির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ তখনও অজেয় রয়ে গেছে।
বিশপ এবার কিছুটা কড়াভাবেই বললেন, সব প্রগতিরই উচিত ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলা। অধর্মাচরণের দ্বারা কোনও মঙ্গলই সাধিত হতে পারে না। কোনও নাস্তিক কখনও মানবজাতির ভালো নেতা হতে পারে না।
বৃদ্ধ এ কথার উত্তর দিল না। তার দেহটা একবার কেঁপে উঠল। সে আকাশের পানে একবার তাকাল। তার চোখ থেকে একবিন্দু জল গালের উপর গড়িয়ে পড়ল। সে আকাশের দিকে মুখ করেই আমতা আমতা করে বলতে লাগল, তুমি হচ্ছ পূর্ণ! তুমিই একমাত্র সত্য।
একটু থেমে বৃদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, অনন্তের একটা অস্তিত্ব আছে এবং সে অস্তিত্ব একমাত্র ওখানেই আছে! এই অনন্তের যদি আত্মা না থাকে তা হলে কোনও জিনিসই থাকবে না। কিন্তু আত্ম আছে। অনন্তের আত্মাই হল ঈশ্বর।