বিশপ বললেন, কিন্তু সে আনন্দ অনাবিল আনন্দ নয় নিশ্চয়।
বিপ্লবী বলল, আপনি বলতে পারেন এটা অনিশ্চিত আনন্দ, কারণ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অতীত আবার ফিরে আসায় সে আনন্দ বিলীন হয়ে যায়। হায়, আমার কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেল। আমরা পুরনো রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামোটাকে ধ্বংস করেছিলাম, ভেঙে দিয়েছিলাম, তার ভাবধারাকে ধ্বংস করতে পারিনি। শুধু অত্যাচারের উচ্ছেদ ঘটালেই চলবে না, যুগ-যুগান্তব্যাপী প্রথাগুলোরও পরিবর্তন দরকার। আমরা কারখানাটাকে ভেঙে ফেলেছিলাম কিন্তু তার যন্ত্রটা আজও চলছে।
আপনারা ধ্বংস করেছিলেন; ধ্বংসেরও প্রয়োজন আছে ঠিক। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে ধ্বংসকার্য ক্রোধের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় সে ধ্বংসকার্য কোনও শুভ ফল দান করতে পারে না।
হে আমার লর্ড বিশপ, ন্যায়পরায়ণতার এক নিজস্ব ক্রোধ আছে। সেই ক্রোধই হল অগ্রগতির বা প্রগতির এক উপাদান। ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে যা-ই বলা হোক না কেন, খ্রিস্টের আবির্ভাবের পর থেকে এ বিপ্লব মানবজাতির পক্ষে অগ্রগতির পথে এক বিরাট পদক্ষেপ। অসমাপ্ত রয়ে গেলেও এ বিপ্লব মহান। সমাজের অবরুদ্ধ আবেগকে এ বিপ্লব মুক্ত করে দেয়। অনেক বিক্ষুব্ধ অন্তরকে শান্ত করে, সারা বিশ্বে সভ্যতার এক নবজোয়ার এনে দেয়। অন্ধকারে আলো দেখায় অজস্র মানুষকে। ফরাসি বিপ্লব যেন মানবজাতির পবিত্র তৈলাভিষেক।
বিশপ গুঞ্জনধ্বনির মতো বলে উঠলেন, কিন্তু ১৭৯৩ সালের বিভীষিকা?
বিপ্লব কনভেনশনের সেই ভূতপূর্ব সদস্য চেয়ারে সোজা হয়ে বসে গম্ভীরভাবে গলার স্বর উঁচু করে বলল, হ্যাঁ, ১৭৯৩ সালের কথায় আসছি। পনেরশো বছর ধরে মেঘ ঘন হয়ে উঠছিল, অবশেষে ১৭৯৩ সালে ঝড় ওঠে। আপনারা এই ঝড়কেই বজ্র বলে ধিক্কার দিচ্ছেন।
বিশপ কথাটার মানে বুঝতে পারলেন। তবু প্রতিবাদের সুরে বললেন, বিচারক যা কিছু বলেন বা করেন তা সব ন্যায়বিচারের নামে চালিয়ে দেন। যাজক বলেন করুণার কথা যে করুণা ন্যায়বিচারের এক ঊর্ধ্বতন স্তর। বজ্র কখনও ভুল করে না। আর ষোড়শ লুই?
মুমূর্ষ বিপ্লবী হাত বাড়িয়ে বিশপের একটি হাত ধরে বলল, আপনি কি ষোড়শ লুই-এর জন্য শোকে বিলাপ করছেন? তিনি যদি এক নিষ্পাপ শিশু হতেন তা হলে আমিও আপনার সঙ্গে কাঁদব। আমার কাছে রাজপরিবারের দুটি শিশু হত্যা খুবই দুঃখজনক। শুধু কাশের ভাই হওয়ার জন্য একটি নির্দোষ শিশুকে প্লেস দ্য গ্রেভে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং পঞ্চদশ লুই-এর পৌত্রকে শুধু রাজার পৌত্র বলেই হত্যা করা হয়।
বিশপ বললেন, অতশত নাম আমার জানার দরকার নেই। কাত্রুশ না পঞ্চদশ লুই? কার নামে আপনার আপত্তি?
কিছুক্ষণ দু জনেই চুপ করে রইলেন। এখানে আসার জন্য অনুশোচনা বোধ করতে লাগলেন বিশপ। তবু তিনি বেশ কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠলেন। কেন তা তিনি বুঝতে পারলেন না।
মুমূর্ষ বলল, শুনুন মঁসিয়ে, আপনি সত্যের স্থূল দিকটা গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু খ্রিস্ট তা করেন, সুদখোর উত্তমবর্ণের মন্দির থেকে বিতাড়িত করেন। তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের দ্বারা অনেক সত্যকে তুলে ধরতেন। তিনি বলতেন, যারাই আমার কাছে আসবে তাকেই কষ্টভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি শিশু-বৃদ্ধের মধ্যে কোনও পার্থক্য মানতেন না। হেরদের পুত্রের সঙ্গে বারাব্বাসের পুত্রের মেলামেশাটাকে তিনি খারাপ ভাবতেন না। নির্দোষিতার একটি নিজস্ব মর্যাদা আছে; বাইরের কোনও পৃথক মান-মর্যাদার প্রয়োজন হয় না। ছেঁড়া কাপড়ে ও রাজপোশাকে নির্দোষিতা সমান মর্যাদাজনক, তার মহত্ত্ব সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে থাকে অম্লান আর উজ্জ্বল।
বিশপ শান্ত নিচু গলায় বললেন, তা অবশ্য বটে।
বিপ্লবী বলল, আপনি সপ্তদশ লুই-এর নাম করেছেন। আমাদের পরস্পরের বক্তব্য ভালো করে বোঝা দরকার। আপনি কি অভিজাত, নীচজাত, ছোট-বড় নির্বিশেষে সব নির্দোষ, আর শহিদ, সব শিশুর জন্য চোখের জল ফেলতে বলছেন? তা হলে আমিও আপনার সঙ্গে কাঁদব তাদের জন্য। কিন্তু আমাদের ৯৩ সাল ও সপ্তদশ লুই-এর আগে চলে যেতে হবে। আপনি যদি শিশুদের জন্য অশ্রুপাত করেন তা হলে আমিও রাজপরিবারের শিশুদের জন্য অশ্রুপাত করব।
বিশপ বললেন, আমি সকলের জন্যই অশ্রুপাত করব।
কিন্তু সকলের জন্য সমানভাবে অশ্রুপাত করতে হবে। তবে তুলনামূলকভাবে সাধারণ জনগণের শিশুদের দাবিই বেশি কারণ তারাই দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগ করে এসেছে।
কিছুক্ষণ আবার দু জনেই চুপ করে রইল। বিপ্লবী এবার কনুই-এর উপর ভর দিয়ে তার এক দিকের গালে আঙুল দিয়ে একটা চিমটি কেটে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুমূর্ষ জীবনের স্তিমিতপ্রায় প্রাণশক্তির একটা জ্বলন্ত আগুন জ্বলতে লাগল তার দুচোখে। তার কথাগুলো বিস্ফোরণের মতো জ্বালাময় শব্দ করে উঠল বিশপের কানে।
বিপ্লবী বলতে লাগল, জনগণ বহুদিন ধরে বহু দুঃখকষ্ট ভোগ করে এসেছে মঁসিয়ে। সেইটাই সব নয়। আমাকে প্রশ্ন করার এবং সপ্তদশ লুই সম্বন্ধে আমার সঙ্গে কথা বলার আপনি কে? আমি আপনাকে চিনি না। এখানে আসার পর থেকে আমি কাউকে দেখিনি, কেউ আমার কাছে আসেনি, আমি কোথাও যাইনি। শুধু এই ছেলেটা আমার কাছে কাজ করে এবং একেই আমি দেখি। অবশ্য আপনার নাম আমার কানে এসেছে এবং এটাও শুনেছি যে লোকে আপনাকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তাতে কিছু বোঝা যায় না। চতুর লোকেরা নানা উপায়ে সাধারণ লোকের মন জয় করে, তাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। আমি আপনার গাড়ির চাকার শব্দ কোনওদিন শুনিনি। আপনি নিশ্চয় গাড়িটা দূরে কোথাও রেখে এসেছেন। আমি আবার বলছি আমি আপনাকে চিনি না। আপনি বলছেন আপনি বিশপ। কিন্তু তাতে আপনার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ পায় না। আমি আবার আপনাকে প্রশ্ন করছি, আপনি কে? আপনি বিশপ, চার্চের রাজা, প্রভূত ঐশ্বর্য ভোগের অধিকারী এক ব্যক্তি। দিগনের বিশপের মাইনে বছরে পনেরো হাজার ফ্রা, দশ হাজার ফ্রাঁ তার পেছনে খরচ। সব মিলিয়ে বছরে পঁচিশ হাজার ফ্রাঁ। আপনি এক বিরাট প্রাসাদে বাস করেন, অনেক চাকরবাকর আছে সে প্রাসাদে, আপনার রান্নাঘরে অনেক খাবারের প্রাচুর্য। প্রতি শুক্রবার মুরগির মাংস পরিবেশন করা হয় খাবার টেবিলে। খ্রিস্টের নামে আপনি গাড়ি চড়ে বেড়ান অথচ খ্রিস্ট নিজে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতেন, উচ্চপদস্থ যাজক হিসেবে প্রচুর ভোগ-সুখ ও আরাম-স্বাচ্ছন্দের উপকরণ আপনি ভোগ করেন। কিন্তু এতে আপনার আসল স্বরূপ বা সত্তার পরিচয় পাওয়া যায় না। আপনি তা হলে আমাকে জ্ঞানের কথা শোনাতে এসেছেন মনে হয়। কিন্তু কার সঙ্গে আমি কথা বলছি? কে আপনি?