এরপর ছেলেটার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, যাও তুমি শোওগে। তুমি গতকাল সারারাত জেগেছ, এখন ক্লান্ত।
ছেলেটা ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। লোকটি তখন নিজের মনে বলতে লাগল, ও যখন ঘুমোবে তখনই আমার মৃত্যু হবে। দুটি ঘুম পাশাপাশি চলবে।
রুগণ মুমূর্ষ লোকটির অবস্থা দেখে বিশপ যতটা বিচলিত হবেন ভেবেছিলেন ততটা বিচলিত তিনি হলেন না। এই ধরনের লোকের মধ্যে ঈশ্বরের কোনও উপস্থিতি অনুভব করতে পারলেন না তিনি। তাঁর প্রতি লোকটার ভাবভঙ্গি ভালো লাগল না। সাধারণ মানুষের মতো মহান ব্যক্তিদের স্বভাবে কতকগুলি অসংগতি থাকে। সে বিশপ সাধারণত কারও কাছ থেকে কোনও সম্মান চান না, তাঁকে মহান বিশপ’ বলে সম্বোধন করলে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিতেন, বিরক্ত বোধ করতেন। আজ এই ভূতপূর্ব বিপ্লবী তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখানোয় এবং তাঁকে মঁসিয়ে হিসেবে সম্বোধন না করায় তিনি ক্ষুণ্ণ না হয়ে পারলেন না। সাধারণ যাজক আর ডাক্তাররা অবশ্য সর্বত্র যথাযোগ্য সম্মানের প্রত্যাশা করে এবং তা না পেলে ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু বিশপ তো সে ধরনের লোক নন। কারও কাছ থেকে কোনও সম্মান প্রত্যাশা করা তাঁর স্বভাব নয়, এটা তাঁর অভ্যাসের বাইরে। বিপ্লবী কনভেনশনের ভূতপূর্ব সদস্য, জনগণের প্রতিনিধি এই বৃদ্ধ লোকটি একদিন সত্যিই খুব সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন।
লোকটা বিশপকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখালেও তার কথাবার্তায় একটা অন্তরঙ্গতার ভাব আর একটা নম্রতা ছিল, যে নম্রতা সব মুমূর্ষ লোকের মধ্যে দেখা যায়।
বিশপ লোকটির প্রতি কোনও অযথা বা অসংযত কৌতূহল না দেখালেও সহানুভূতিমিশ্রিত এক মনোযাগে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তাকে। সেই সহানুভূতির বশে অন্য কেউ হলে তিনি তাকে তিরস্কার করতেন। কিন্তু বিপ্লবীদের অন্য চোখে দেখতেন। তাঁর মতে বিপ্লবীরা হল পলাতক দস্যুদের থেকে একটু উপরে এবং দানশীলতার পরিসীমার বাইরে।
লোকটি অল্প সময়ের মধ্যে মরবে বললেও তখনও সে শান্তভাবে খাড়া হয়ে বসেছিল। তার স্পষ্ট পরিষ্কার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছিল চারদিকে। এই অশীতিপর মুমূর্ষ লোকটি যেকোনও মনোবিজ্ঞানীকে তাক লাগিয়ে দেবে। বিপ্লবের সময়ে এই ধরনের সহিষ্ণু ও শক্তিমান লোক অনেক দেখা গেছে। কিন্তু লোকটার সহ্য করার শক্তি সত্যিই অসাধারণ। ঠিক এই মুহূর্তে মৃত্যু তার এত কাছে ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও তাকে দেখে সুস্থ ও সবল বলে মনে হচ্ছে। তার দৃষ্টির স্বচ্ছতায়, তার কণ্ঠের দৃঢ়তায়, তার কাঁধ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বলিষ্ঠ সঞ্চালনে এমন একটা উদ্ধত অনমনীয় ভাব দেখা যায় যা মৃত্যুকে অস্বীকার করছে, যা। কখনই মাথা নত করতে চায় না মৃত্যুর কাছে। মুসলমানদের মৃত্যুদূত আজরাইল আজ তার আত্মাকে এই সময় নিতে এলে সে নিজে নিজেই ফিরে যাবে, ভাববে সে ভুল করে এ দরজায় ঢুকে পড়েছে। মনে হচ্ছে লোকটা যেন ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিচ্ছে। সে মরতে চাইছে বলেই সে মরছে। মৃত্যু জোর করে ধরে নিয়ে যেতে পারছে না তাকে। রোগযন্ত্রণার মধ্যে একটা মুক্তির আনন্দ তাকে আচ্ছন্ন করে আছে যেন। তার একটা পা গতি হারিয়ে ফেলেছে আর তাই মৃত্যুর অন্ধকার একমাত্র সেই জায়গাটাতেই এসে চেপে ধরেছে। তার একটা পা শুধু মরে গেছে, কিন্তু তার মাথাটা পরিপূর্ণভাবে বেঁচে আছে। এখনও এবং মনে হচ্ছিল তার সমস্ত প্রাণশক্তি এখনও তার আয়ত্তেই আছে। এই বিরল মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন প্রাচ্যের এক রূপকথার নায়ক রাজা, যার দেহের উপর দিকটায় মাংস আছে আর নিচের দিকটা মর্মর প্রস্তরে গাঁথা।
কুঁড়েটার সামনে যে একটা পাথর ছিল তার উপরে বসলেন বিশপ। বসেই কোনও ভূমিকা না করেই তার ধর্মীয় উপদেশ দানের কাজ শুরু করলেন। তিনি প্রথমে বললেন, একটা বিষয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনাকে। আপনি অন্তত রাজার মৃত্যুর জন্য ভোট দেননি।
‘অন্তত’ কথাটার যে একটা ঝাঁঝ ছিল তা লক্ষ করে কড়াভাবে লোকটি বলল, আমাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে কিন্তু খুব একটা বেশি দূর যাবেন না মঁসিয়ে। আমি এক অত্যাচারীর উচ্ছেদের জন্য ভোট দিয়েছিলাম।
তার মানে? বিশপ জিজ্ঞাসা করলেন।
তার মানে এই যে মানুষ আসলে শাসিত হয় এক অত্যাচারীর দ্বারা, যার নাম হল অজ্ঞতা। এই অত্যাচারীরই উচ্ছেদ আমি চেয়েছিলাম। এই অত্যাচারীই রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়। রাজতন্ত্রের যা কিছু শক্তি ও প্রভুত্ব তা মিথ্যার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু জ্ঞানের যা কিছু শক্তি তা সত্যের ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষ শাসিত হবে জ্ঞানের দ্বারা।
বিশপ বললেন, জ্ঞান আর বিবেক।
ও দুটো এক জিনিস। বিবেক হচ্ছে জ্ঞানেরই অন্তর্নিহিত এক শক্তি।
আশ্চর্য হয়ে এই কথাগুলো শুনতে লাগলেন বিশপ। তাঁর মনে হল এটা যেন। জীবনকে দেখার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। বিপ্লবী আবার বলতে লাগল, রাজা ষোড়শ লুইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধে আমি ভোট দিয়েছিলাম। আমি মনে করি না কোনও মানুষকে হত্যা করার অধিকার আমার আছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, অন্যায়কে উচ্ছেদ করা আমার কর্তব্য। আমি নারীদের বেশ্যাগিরি, ক্রীতদাসপ্রথা, শিশুদের ওপর অবিচার প্রভৃতি অত্যাচারগুলোর উচ্ছেদের জন্য ভোট দিয়েছিলাম। প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়ে আমি আসলে এইসব অত্যাচারের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলাম। আমি সৌভ্রাতৃত্ব, ঐক্য আর এক নতুন যুগের প্রভাতের জন্য ভোট দিয়েছিলাম। সমস্ত রকমের কুসংস্কার আর মিথ্যাচারের পতন ঘটাতে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এগুলোর ধ্বংস। হলেই সব অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর যুগ আসবে। দুঃখের পৃথিবী অনাবিল আনন্দের আধারে পরিণত হবে।