বাপতিস্তিনে জানত এবং মুখে বলত তার দাদার মৃত্যু মানেই তাদের মৃত্যু। ম্যাগলোরি মুখে এ কথা না বললেও মনে মনে তা জানত।
.
১০
বাপতিস্তিনে তার বান্ধবীকে চিঠিটা লেখার পর অল্প দিনের মধ্যেই এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করেন বিশপ, যা দস্যু-অধ্যুষিত সেই পার্বত্য এলাকায় যাওয়ার থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক। দিগনের অনতিদূরে একজন লোক নিভৃতে আত্মগোপন করে ছিল। লোকটি বিপ্লবী কনভেনশনের একজন ভূতপূর্ব সদস্য ছিল।
দিগনের সমস্ত লোক লোকটার নাম শুনলেই ভয়ে শিউরে উঠত। লোকটা যেন এক রাক্ষস। কনভেনশনের সদস্য–যেন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যদিও সে রাজার মৃত্যুর সপক্ষে ভোট দান করেনি তথাপি নীতিগতভাবে সে তাই চেয়েছিল। তাই রাজহত্যায় তার হাত ছিল বলে একটা কুখ্যাতি ছিল তার। তা যদি হয় তা হলে বৈধ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তার বিচার হল না কেন? তারা তার মাথা কাটতে পারত, আবার সে জীবন ভিক্ষা চাইলে তাকে মার্জনা করা হত। আবার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তাকে নির্বাসিত করাও হত। আর সব বিপ্লবীর মতো সে আবার নাস্তিক ছিল। তাই শকুনির চারদিকে ভিড় করা সন্ত্রস্ত রাজহাঁসের দলের মতো শহরের লোকটার ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে দেখত তাকে।
কিন্তু লোকটা কি সত্যিই একটা ভয়ঙ্কর শকুনি ছিল? সে তো নির্জনে নিভৃতে এক জায়গায় বাস করত।
রাজার মৃত্যুর ব্যাপারে সে ভোট না দেওয়ায় নির্বাসনদণ্ডে দণ্ডিতদের তালিকায় তার নাম ছিল না। তাই সে ফ্রান্সে থাকতে পেরেছিল। শহর থেকে কিছু দূরে এমন একটা নির্জন উপত্যকায় বাস করত যেখানে যাওয়ার কোনও রাস্তাঘাট ছিল না। লোকে বলত সে নাকি একটুকরো জমি চাষ করত এবং নিজের থাকার জন্য আদিম কালের মতো একটা কুঁড়ে তৈরি করে ছিল, যেটাকে একটা পশুর গুহা বলা যেতে পারে। কেউ তার কাছে যেত না। লোকে বলত সেটা ঘাতকের ঘর। সেই উপত্যকায় যাওয়ার যে একটা পথ ছিল লোকটা সেখানে বাস করতে যাওয়ার পর থেকে কেউ সেখানে যাতায়াত না করায় পথটায় বন গজিয়ে ওঠে।
একমাত্র বিশপ সেই উপত্যকা দিয়ে যেতে যেতে তার শেষ প্রান্তে গাছপালাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে ভাবতেন, ওখানে এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি বাস করে। তার পরই মনে ভাবতেন, তার কাছে একবার আমার যাওয়া উচিত।
তবে কথাটা প্রথমে স্বাভাবিক এবং সরল মনে হলেও কিছুটা ভাবনা-চিন্তা করার পর সেটা অদ্ভুত আর অসম্ভব মনে হল তার। কিছুটা বিতৃষ্ণা জাগল তাঁর মনে। কারণ সাধারণ লোকে যা ভাবত তা তিনিও ভাবতেন। একজন ভূতপূর্ব নাস্তিক বিপ্লবী তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবেই যে বিতৃষ্ণা জাগায় তা ক্রমে ঘৃণায় পরিণত হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটাও ভাবতেন যে রাখাল কি কখনও ভেড়াকে ভয় বা ঘৃণা করে সরে যায় তার থেকে কখনই না। কিন্তু এ ভেড়াটা তো শয়তান। বিশপ একটা অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন। তিনি কয়েকবার লোকটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন।
একদিন শহরে একটা কথা শোনা গেল। যে একটা গ্রাম্য ছেলে লোকটার কাছে কাজ করত, সে হঠাৎ শহরে ডাক্তারের খোঁজে আসে। লোকটার নাকি খুব অসুখ। জানা গেল তার শরীরের একটা অঙ্গ পক্ষাঘাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। শহরের লোকেরা। বলাবলি করতে লাগল, বুড়ো রাক্ষসটা মরতে বসেছে, কেউ কেউ আবার বলতে লাগল, ভালোই হয়েছে।
সেদিন বিকালের দিকে তার ছেঁড়া আলখাল্লাটা ঢাকার জন্য একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে ছড়ি হাতে বেরিয়ে পড়লেন বিশপ।
তিনি যখন পশুর গুহার মতো বুড়ো লোকটার কুঁড়েতে পৌঁছলেন তখন দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। একটা খাল পার হয়ে একটা ঝোঁপের পাশ দিয়ে একটা ছোটখাটো বাগানের বেড়া ঠেলে এগিয়ে গিয়ে কুঁড়েটা দেখতে পেলেন বিশপ। একটু দূর থেকে দেখতে পেলেন তিনি, বৃদ্ধ পাকা চুলওয়ালা লোকটি সেই কুঁড়ের দরজার কাছে একটা সাদাসিধে ইজি চেয়ারের উপর বসে সূর্যাস্ত দেখছে আর যে ছেলেটা তার ফাইফরমাশ খাটত সেই ছেলেটা তার হাতে একটা বাটি দুধ দিচ্ছে।
দুধটা খেয়ে লোকটা ছেলেটার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ! এখন এটাই আমি চাইছিলাম।
বিশপের পায়ের শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাল লোকটা। দীর্ঘকাল পর একজন মানুষকে তার কাছে আসতে দেখায় সীমাহীন বিস্ময়ের এক অনুভূতি তার চোখেমুখে ফুটে উঠল।
লোকটা বিশপকে বলল, আমি এখানে আসার পর থেকে একমাত্র আপনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আমার কাছে এলেন। আপনি কে মঁসিয়ে?
বিশপ উত্তর করলেন, আমার নাম বিয়েনভেনু মিরিয়েল।
বিয়েনভেনু মিরিয়েল! এ নাম আমি তো কখনও শুনিনি। তবে লোকে যাকে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু বলে আপনি কি সেই?
হ্যাঁ, তাই।
লোকটি হাসিমুখে বলল, তা হলে আপনি তো আমারও বিশপ।
অল্পবিস্তর তাই।
করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল লোকটি। কিন্তু বিশপ তা ধরলেন না। তিনি শুধু বললেন, তা হলে কি আমি ভুল খবর পেয়েছি? আপনাকে তো খুব একটা অসুস্থ দেখাচ্ছে না।
বৃদ্ধ লোকটি বলল, আমার সব কষ্টের অবসান হতে চলেছে।
একটু থেমে সে আবার বলল, তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমি মারা যাব। আমি চিকিৎসাবিদ্যার কিছুটা জানি। আমি জানি আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। গতকাল শুধু আমার পা দুটো অসাড় হয়ে যায়। আজ সকালবেলায় সেই অসাড় ভাবটা হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসে, এখন আবার দেখছি সেটা কোমর পর্যন্ত উঠে এসেছে। এই পক্ষাঘাত রোগটা আমার হৃৎপিণ্ডটাকে আক্রমণ করলেই আমি আর বাঁচব না। সূর্যাস্তটা সত্যিই খুব সুন্দর। তাই না কি? আমি ছেলেটাকে চেয়ারের চাকাটাকে ঘুরিয়ে এই দিকে আনতে বললাম যাতে আমি শেষবারের মতো পৃথিবীটা দেখতে পারি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন, আমি বিরক্তবোধ করব না। আপনি একজন মুমূর্ষ লোককে দেখতে এসে ভালোই করেছেন। এই সময় একজন সাক্ষী দরকার। সব লোকেরই এক একটা খেয়ালখুশি থাকে। আমি চেয়েছিলাম আগামীকাল সকাল পর্যন্ত বাঁচতে, কিন্তু আমি জানি আমার জীবন আর মাত্র তিন ঘণ্টা আছে। দিনের আলোর আর প্রয়োজন নেই, আমি নক্ষত্রের আলোয় মরব।