আমি সুখেই আছি। আমার দাদা খুব ভালো লোক। তিনি তার যথাসর্বস্ব আর্ত ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের দান করেন। আমাদের সংসারে কখনই সচ্ছলতা থাকে না। এ অঞ্চলে শীত খুব বেশি এবং এ অঞ্চলের অভাবগ্রস্ত শীতার্ত ব্যক্তিদের শীত নিবারণের জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হয়। যাই হোক, কোনও রকমে আমরা নিজেদের গরম রাখার ব্যবস্থা করি এবং অন্ধকারে আলো জ্বালি না, এটাই আমাদের বড় যন্ত্রণার কথা।
আমার দাদার কিছু দোষও আছে। কিন্তু উনি বলেন এ দোষ বিশপের থাকা উচিত। তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, আমাদের ঘরে কখনও তালাচাবি দেওয়া হয় না। যে কোনও লোক ইচ্ছা করলেই আমার দাদার ঘরে সোজা ঢুকে পড়তে পারে। তিনি কোনও কিছুই ভয় করেন না, রাত্রিতেও ভয় করেন না। তিনি বলেন, এটা তার এক ধরনের সাহস।
তিনি আমাকে বা ম্যাগলোরিকে তার সম্বন্ধে কোনও কথা ভাবতে দেন না। তিনি যত সব বিপদের ঝুঁকি নেবেন, অথচ আমাদের তা নির্বাক দর্শকের মতো দেখে যেতে হবে। তাকে বুঝতে, শিখতে হবে। তিনি বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যান, কাদার উপর দিয়ে যাতায়াত করেন, দারুণ শীতকেও গ্রাহ্য করেন না। তিনি অন্ধকার, দুর্গম পথ বা পথের বিপদ-আপদ কোনও কিছুই ভয় করেন না।
গত বছর তিনি এমন এক অঞ্চলে একা যান যে অঞ্চলটা ভয়ঙ্কর দস্যুদের দ্বারা অধ্যুষিত। আমাদের কাউকে তিনি সঙ্গে নিয়ে গেলেন না। তিনি সেখানে একপক্ষকাল ছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি মারা গেছেন দস্যুদের হাতে। কিন্তু তিনি অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসে বললেন, ‘আমি তোমাদের দেখাব আমি কিভাবে অপহৃত হয়েছি।’ এই বলে তিনি একটি বাক্স খুলে সেইসব ধনরত্ন বার করলেন, যা কিছুদিন আগে এমব্রাস গির্জা থেকে চুরি যায় এবং সেগুলো ডাকাতরা তাকে ফিরিয়ে দেয়। তিনি যখন সেখান থেকে ফিরে আসেন আমি তখন অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। তাকে কিছুটা তিরস্কারও করেছিলাম, কিন্তু এমনভাবে তিরস্কারের কথাগুলো বলেছিলাম যাতে কেউ তা শুনতে না পায়।
ক্রমে আমি ভাবতে থাকি, কোনও বিপদ তাঁকে কোনও কাজে বাধা দিতে পারবে না, তিনি নির্ভীক, দুর্জয়। এইভাবে তাঁর জীবনযাত্রা প্রণালীর সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠি আমি। ম্যাগলোরি যাতে তাঁকে বিরক্ত না করে তার জন্য নিষেধ করি আমি। তিনি ইচ্ছামতো যত সব বিপদের ঝুঁকি নেন। আমি রোজ রাতে ম্যাগলোরিকে তার ঘরে শুতে পাঠিয়ে আমি আমার ঘরে তার জন্য প্রার্থনা করি, তার পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। ভাবি, তার যদি কোনও বিপদ ঘটে তা হলে আমাদেরও তাঁর সঙ্গে মরতে হবে। তা হলে আমার ভাই এবং বিশপের সঙ্গে আমাদেরও মৃত্যুপুরীতে যেতে হবে। তাঁর এই হঠকারিতা আমার যেতে ম্যাগলোরির পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এখন সে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং শোবার আগে সে-ও আমার সঙ্গে প্রার্থনা করে। শয়তান যদি তার ঘরে ঢোকে কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কোনও কিছু হারাবারই-বা কি আছে? আমাদের সঙ্গে এমন একজন সব সময় আছেন যিনি সবার থেকে শক্তিমান। শয়তান আমাদের বাড়িতে আসতে পারে, কিন্তু সেই সর্বশক্তিমান আমাদের বাড়িতে বাস করেন।
এই হল তাঁর কথা। আমার দাদা আমাকে আর কোনও কথা বলেন না। তিনি কিছু বললেও তার সব কথা আমি বুঝি এবং ঈশ্বরের বিধানে আস্থা রাখি। এক মহান আত্মার সঙ্গে এইভাবে আমরা বাস করি।
ফক্স পরিবারের যেসব কথা তুমি জানতে চেয়েছ সেসব কথা তাঁকে জিগ্যেস করেছিলাম আমি। তুমি জান তিনি এই ব্যাপারে সব কিছুই জানেন এবং সব কিছুই তাঁর মনে আছে। তিনি এখনও মনে-প্রাণে রাজতন্ত্রবাদীই রয়ে গেছেন। ফক্স পরিবার কেন অঞ্চলের এক প্রাচীন নর্মান পরিবার। ওই পরিবারের রুল দ্য ফক্স, আঁ দ্য ফক্স, টমাস দ্য ফক্সের পাঁচশো বছরের পুরনো অনেক নথিপত্র আছে। এরা সবাই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। এই পরিবারের সেনার দ্য বশেফোর্ট নামে এক ভদ্রলোক বড়দরের একজন সামন্ত ছিলেন। এই পরিবারের শেষ বংশধর লি এতিয়েন আলেকজান্দার সামরিক বিভাগের একজন কর্নেল ছিলেন এবং তিনি তোর ছোটখাটো এক অশ্বারোহী দলের সেনাপতিত্ব। করেন। তাঁর কন্যা মেরি লুই ফরাসি বাহিনীর এক বড় সামরিক অফিসার, দাক লুই দ্য গ্রেদ্রতের পুত্র আমিয়েঁ শার্লসকে বিবাহ করেন। এই পরিবারের নাম ফক্স বা ফক।
আশা করি মাদাম, তুমি তোমার সাধুপ্রকৃতির আত্মীয় কার্ডিনালকে আমাদের কথা বলবে। তোমার প্রিয় সিলভানি তোমার কাছে সব সময় থাকে এবং তোমাকে চিঠি লিখতে দেয় না। কিন্তু সে ভালো আছে জেনে সুখী হলাম। সে আমাকে আজও ভালোবাসে জেনে খুশি হলাম। আমার শরীর ভালোই আছে, তবে দিন দিন চেহারাটা রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার কাগজ ফুরিয়ে আসছে। প্রীতি নিও। ইতি।
বাপতিস্তিনে।
তোমার বউদি এখন এখানেই আছে তাঁর ছোট সংসার নিয়ে। তোমার ভাইপোর ছেলেটি বেশ সুন্দর। সে পাঁচ বছরে পড়েছে। সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
এই চিঠিটি থেকে বোঝা যাবে এই দু জন মহিলা তাদের সহজাত নারীসুলভ বুদ্ধির দ্বারা একজন মানুষকে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছিল এবং বিশপের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। বিশপ ইচ্ছামতো তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন। অনেক সময় তিনি অনেক দুঃসাহসিক কাজ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে করতেন। তা দেখে তাঁর বোন শিউরে উঠত ভয়ে। ম্যাগলোরি প্রতিবাদ করতে যেত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠত না। কোনও কিছুই তাঁকে তাঁর কর্তব্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারত না। তারা বুঝতে পারত তারা বিশপের ছায়া মাত্র; বিশপের কোনও কাজের ব্যাপারে বাধা দেওয়ার মতো কোনও ক্ষমতাই তাদের নেই। তারা শুধু সময়মতো চেষ্টা করে যেত। ক্রমে বিশপের ব্যাপারটা ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দেয়।