আমি দুঃখ ভোগ করতে পারি অথবা আনন্দ উপভোগ করতে পারি। আমাকে সেটা বেছে নিতে হবে। এই দুঃখভোগের শেষ পরিণতি কী? এর পরিণতি হচ্ছে বিস্মৃতি। তবু আমাকে দুঃখভোগ করে যেতেই হবে। আনন্দ উপভোগেরই-বা পরিণতি কোথায়? বিস্মৃতিতে। তবু আমি আনন্দ উপভোগ করেই যাব। আমি এটা স্থির করে ফেলেছি, এটা আমি বেছে নিয়েছি। মানুষ হয় খাবে, অথবা কারও দ্বারা খাদিত হবে। আমি খেয়েই যাব। ঘাসের থেকে দাঁত থাকা ভালো। আপনি যা কিছুই করুন-না কেন, পরিণামে মৃত্যু আপনার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুর পর তাদের উজ্জ্বল কীর্তির সমাধিস্তম্ভ লাভ করবে, কিন্তু সবাইকেই নরকে যেতে হবে। মৃত্যুতেই সবার সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। এক সম্পূর্ণ সর্বভূতে বিলুপ্তি, সবাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার মৃত্যুর পর কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে এবং আমাকে কিছু বলবে এই কথা শুনলে আমার হাসি পায়। এটা বুড়িদের এক অবান্তর অর্থহীন রূপকথা। শিশুদের জন্য আছে শয়তান আর বয়স্ক লোকদের জন্য আছে জেহোভা। না, আমাদের মৃত্যুর পর সব কিছুই অন্ধকার। আপনি সাধু বা শয়তান। সার্দানাপেলাম বা ভিনসেন্ট পল যাই হোন না কেন, সমাধির ওপারে সকলের জন্যই বিরাজ করছে নরকের অন্ধকার। এইটাই হল সত্যি কথা। মানবজীবনের একমাত্র কাজ হল বাঁচার মতো বাঁচা। যতদূর সম্ভব জীবনের সদ্ব্যবহার করুন। আমার এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে, আমার বাছাই করা একজন দার্শনিকও আছে। তবে আমি যতসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করে বোকা বানাতে চাই না নিজেকে। তবে আমি একথা বলতে চাই না যে এ বিশ্বাসের কারও কোনও প্রয়োজন নেই একেবারে। যারা নিঃস্ব, দরিদ্র, যারা পেট ভরে খেতে পায় না, যাদের কোনও ঘরবাড়ি নেই, যারা অধঃপতিত বা নিজে নেমে গেছে, তাদের বাঁচার জন্য একটা বিশ্বাস চাই। আমরা তাদের পুরাণ ও গল্পকথা শোনাই, আত্মা, অমরত্ব, স্বর্গ, ভাগ্য এইসব কিছুর কথা বলে সান্ত্বনা দিই এবং তারা এই কথাগুলো গোগ্রাসে গিলে খায়। তারা মাখনের পরিবর্তে এইসব কথার অমৃত তাদের শুকনো রুটিগুলোতে মাখিয়ে নেয়। যাদের কিছুই নেই, একেবারে নিঃস্ব, তাদের ঈশ্বর আছে। কিছু না থাকার থেকে এটা ভালো এবং আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমার কথা স্বতন্ত্র। আমি চাই বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরে থাকতে। ঈশ্বর থাক সাধারণ মানুষদের জন্য।
বিশপ হাততালি দিয়ে উঠলেন।
তিনি আবেগের সঙ্গে বললেন, চমঙ্কার কথা। এ ধরনের বস্তুবাদ কী চমৎকার জিনিস! সকলেই এ বস্তুবাদ লাভ করতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তি তা লাভ করে সে তো আর নিজেকে বোকা বানাতে পারে না। সে তো আর কেটোর মতো নির্বাসিত করতে পারে না নিজেকে। স্টিফেনের মতো পাথরের আঘাত খেয়ে মরতে পারে না অথবা জোয়ান অব আর্কের মতো জীবন্ত দগ্ধ হতে পারে না। একজন দায়িত্বহীন মানুষের সব আনন্দ সে লাভ করতে পারে, সে তার সহজ অতিসরল মন নিয়ে সারা পৃথিবীটাকে পরিক্রমা করতে পারে–এই ধরনের একটা আত্মপ্রসাদও সে অনুভব করতে পারে–অনেক সম্মান ও শক্তি সে লাভ করতে পারে, লাভজনক নাস্তিকতা, বিশ্বাসঘাতকতা, বিবেকের সঙ্গে সুবিধাজনক আপোস এইসব কিছুকেই সে প্রশ্রয় দিতে পারে। এইসব কিছুই উদরস্থ করে সে তার সমাধিতে যেতে পারে। কত আনন্দের কথা! আমি আপনাকে তিরস্কার করছি না মঁসিয়ে সিনেটর। আমি আপনাকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারছি না। আপনি বলেছেন, আপনারা যারা সমাজের উপরতলার মানুষ তাদের এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে। যে দর্শন সূক্ষ্ম, মার্জিত, যে দর্শন শুধু ধনীদের ক্ষেত্রেই থাকে, সব অবস্থাতেই যা খাপ খায় সে দর্শন জীবনের যত কিছু আনন্দলাভের পক্ষে নিঃসন্দেহে এক চমৎকার হাতিয়ার। যারা এ বিষয়ে সিদ্ধ তাদের অন্তরের গম্ভীর হতে এ দর্শন উৎসারিত। কিন্তু আপনি সহৃদয় ব্যক্তি, যেসব সাধারণ মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাদের প্রতি আপনার কোনও ঈর্ষা বা ক্ষোভ নেই।
.
৯
দিগনের বিশপ কিভাবে তাঁর পারিবারিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন এবং তাঁর বাড়ির দু জন মহিলা তাদের কর্ম, চিন্তা, প্রবৃত্তি ও জীবনের উদ্দেশ্যকে বিশপের কর্ম ও চিন্তার অনুগত করেছিল তা লিখে প্রকাশ না করে তার সারা জীবনের বান্ধবী ভিকেঁতেসি দ্য বয়শেনকে লেখা একখানি চিঠি উদ্ধৃত করব।
দিগনে, ১৬ ডিসেম্বর
প্রিয় মাদাম,
তোমার কথা না বলে আমাদের একটা দিনও কাটে না। এটা যেন আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে তোমাকে চিঠি লেখার আর একটা কারণ আছে। এখানে আসার পর আমাদের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ম্যাদময়জেল ম্যাগলোরি দেয়ালে একটা জিনিস দেখতে পায়। কাগজের তলায় কিছু দেয়ালচিত্র দেখতে পাই আমরা। একটা চিত্রে দেখা যায় টলেমা মিনার্ভার কাছ থেকে নাইট উপাধি গ্রহণ করছেন। তাতে সন তারিখ সব লেখা আছে। আর একটি চিত্র উলেমার বাগানবাড়ির, যে বাগানে একটি রাত রোমের মহিলারা কাটান। ম্যাগলোরি ঘরটা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে এবং সেটা এখন জাদুঘরের মতো দেখাচ্ছে। ছবিগুলো রঙ করতে ছয় ফ্রাঁ খরচ হবে। কিন্তু টাকাটা গরিব-দুঃখীদের দান করাই ভালো। তার থেকে আমার ঘরের জন্য একটা গোল মেহগনি কাঠের টেবিল কিনব।