.
৮
যে সিনেটর ভদ্রলোকের নাম আমরা আগেই উল্লেখ করেছি সে সিনেটর ছিল এমনই একজন লোক যে এক দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ করে যেত, যে তার স্বার্থপূরণের পথে বিবেক, ঈশ্বরবিশ্বাস, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যপরায়ণতা প্রভৃতি কোনও কিছুর দ্বিধা বা বাধা মানত না বা তার আপন লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হত না। এই সিনেটর আগে ছিল এক দক্ষ সরকারি অ্যাটর্নি যে তার ছেলে, জামাই ও আত্মীয়-বন্ধুদের স্বার্থটা সব সময় বেশি করে দেখত এবং তার লাভের পথে পাওয়া যে কোনও সুযোগ হাতছাড়া করত না। কারণ এ সুযোগ হাতছাড়া করাটাকে সে বোকামি এবং অবান্তর বলে ভাবত। সে ছিল বুদ্ধিমান এবং সুশিক্ষিত। সে নিজেকে দার্শনিক এপিকিউরাসের শিষ্য বলে ভাবত, যদিও পিগল্ট ব্রোনের মতো নিচু স্তরের লেখকদের নীতিই সে বেশি মেনে চলত। সে চিরপ্রতিষ্ঠিত চিরন্তর সত্যের কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিত এবং আমাদের মহান বিশপের কাজকর্মকে বাতুলতা বলে তার সাক্ষাতে-অসাক্ষাতে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত।
একবার আধা-সরকারি অনুষ্ঠানে এই সিনেটর মঁসিয়ে মিরিয়েল আর পুলিশের এক বড়কর্তার সঙ্গে এক ভোজসভায় মিলিত হয়। খাওয়ার পর সে মদের ঘোরে বলতে থাকে, আসুন মঁসিয়ে, এবার কিছু কথা বলা যাক। একজন সিনেটর আর বিশপের মধ্যে নীতির দিক থেকে খুব একটা মিল হতে পারে না। আমরা দু জনেই ঈশ্বরের অনুগৃহীত ব্যক্তি। তবে আমি স্বীকার করছি আমার এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে।
বিশপ বললেন, তা তো বটেই। কোনও মানুষের জীবনদর্শন হচ্ছে তার বিছানার মতো, যার উপর সে শোয় প্রতিদিন। আপনার সে জীবনদর্শনের শয্যা হচ্ছে কুসুমশয্যা।
সিনেটর বলল, এখন কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের মতো কথা বলব।
সাধারণ শয়তান বলতে পারেন।
আমি একথাও স্বীকার করি যে মার্কুই দ্য আর্গেনস, পাইরো, হবস, মঁসিয়ে নাইজিওন প্রমুখ দার্শনিকদের ভণ্ড পাণ্ডিত্যাভিমানী বলে মনে করি না। তবে আমার বইয়ের তাকে আরও অনেক দার্শনিকের বই আছে।
যাদের দর্শন আপনার নিজস্ব দর্শনের মতো।
সিনেটর বলল, আমি দিদেরোকে মোটেই পছন্দ করি না। তিনি হচ্ছেন ভাববাদী, বাগাড়ম্বরসর্বস্ব বাগ্মী, এমন একজন বিপ্লবী যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। তিনি ভলতেয়ারের থেকে আরও গোড়া। ভলতেয়ার বলতেন, নিডহ্যাম স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের কল্পনা আর বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে স্বতঃস্ফূর্ততার নীতি এই দুটি পরস্পরবিরুদ্ধ বিষয়কে তলিয়ে ফেলেছেন। এই নিয়ে বিদ্রূপ করেছেন নিডহ্যামকে নিয়ে। কিন্তু ভলতেয়ারের এটা অন্যায়। কারণ নিডহ্যাম যে পাঁকাল মাছের কথা বলেছেন তাতে এই কথাই প্রমাণ হয় ঈশ্বরের কোনও প্রয়োজন নেই সৃষ্টির ব্যাপারে। পাকাল মাছের মতো জগৎ ও জীবনের সৃষ্টির ব্যাপারেও পরম পিতার কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে না। হে আমার প্রিয় বিশপ, এ বিষয়ে জেহোভা তত্ত্বও আমি বুঝতে পারি না। এ তত্ত্ব থেকে শুধু শীর্ণ আর রিক্তমস্তিষ্ক মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। আমি মহান সর্বস্ব থেকে মহান শূন্যতা বেশি পছন্দ করি। স্বীকারোক্তি হিসেবে আমি আপনার কাছে সরলভাবে স্বীকার করছি, আমি একজন সরল সাদাসিধে মানুষ। আপনাদের যিশুর প্রতি আমার কোনও ভালোবাসা নেই। তিনি শুধু বৈরাগ্য আর আত্মত্যাগ প্রচার করে গেছেন, যা ভিক্ষুকদের প্রতি কৃপণের উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বৈরাগ্য এ ত্যাগ কিসের জন্য? একটি নেকড়ে কখনও অন্য নেকড়ের মঙ্গলের জন্য কিছু ত্যাগ করেছে একথা আমি কখনও শুনিনি। প্রকৃতিকে অনুসরণ করা উচিত আমাদের। যেহেতু মানুষ হিসেবে আমরা সব জীবের ঊর্ধ্বে, আমাদের এক উন্নততর জীবনদর্শন থাকা উচিত। আপনি মানুষ হয়ে যদি অন্য কোনও মানুষের নাকের ডগা ছাড়া আর কিছু দেখতে না পান তা হলে সব কিছু বিষয়ে মাতব্বরি করে লাভ কী? যে জীবন আমরা পেয়েছি সে জীবন যতদূর পারি সুখে কাটানো উচিত! এ জীবনের পর স্বর্গ বা নরক বলে কিছু আছে, একথা আমি পরিষ্কার অবিশ্বাস করি। আপনি শুধু ত্যাগ করে বৈরাগ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা আমাকে বলবেন। আমাকে প্রতিটি কাজ চিন্তা-ভাবনা করে করতে হবে, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ নিয়ে আমার মস্তিষ্ককে বিব্রত থাকতে হবে সব সময়। কিন্তু কেন? কারণ পরে তার বিচার হবে, সব কর্মাকর্মের জন্য আমাকে জবাব দিতে হবে। কখন? না, আমার মৃত্যুর পরে। আমার মৃত্যুর পর আমাকে ধরার জন্য নিশ্চয় এক চতুর বিচারকের প্রয়োজন হবে। কারণ তখন আমার প্রেতাত্মার হাতে একমুঠো ধুলো ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। কী উদ্ভট কল্পনা! আমরা বাস্তব সত্যকে স্বীকার না করে যারা আইসিসের আঁচলের তলায় উঁকিঝুঁকি মারে তাদের নিয়ে মাতামাতি করি। আসলে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। চাই উন্নতি সব কিছু বাদ দিয়ে একমাত্র বাস্তব সত্যকে আমাদের খোঁজা উচিত। সব কিছু তলিয়ে দেখতে হবে, বস্তুর স্বরূপকে দেখতে হবে। তাই নয় কি? সত্যকে ধরার জন্য দরকার হলে পৃথিবীর তলদেশের শেষ প্রান্তে যেতে হবে। বলিষ্ঠ হয়ে গড়ে উঠে আনন্দ উপভোগ করাটাই গৌরবের। আমি যদি বলিষ্ঠতার সঙ্গে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারি এটাই যথেষ্ট। মানুষের অমরত্ব একটা বিশ্বাস মাত্র, এক মধুর প্রতিশ্রুতির মিথ্যা সান্ত্বনা–আপনি ইচ্ছা করলে তা বিশ্বাস করতে পারেন। আদম হতে পারাটা কত আনন্দের কথা অথবা কোনও বিদেহী আত্মা অথবা পিঠে নীল ডানাওয়ালা কোনও দেবদূত হবে মানুষ? তার্তুলিয়া না কে যেন বলছিল না ঈশ্বরের অনুগৃহীত বা আশীর্বাদধন্য মানুষ একদিন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করে বেড়াবে। আমরা হব আকাশের ফড়িং। আমরা ঈশ্বরকে দেখব। যত সব বাজে কথা। ঈশ্বর হচ্ছে এক অদ্ভুত ধরনের ভণ্ড প্রতারক। একথা আমি অবশ্য লিখব না, একথা আমি শুধু মদ্যপানের সময় আমার বন্ধুদের কাছে চুপি চুপি বলব। স্বর্গের লোভে এ জগতের সব কিছু ত্যাগ করা হল বস্তুকে ফেলে ছায়াকে ধরতে যাওয়ার মতোই এক বাতুলতামাত্র। অনন্তের হাতের পুতুল হওয়া আমার ধাতে সইবে না, আমার দ্বারা তা হবে না। আমি কে? কিছুই না। আমি একজন সিনেটর। কিন্তু জন্মের আগে কি আমার কোনও অস্তিত্ব ছিল? না। মৃত্যুর পর কি আমার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। আমি শুধু একমুঠো মাটির দ্বারা গঠিত এক বস্তু। আমি পৃথিবীতে কী করব? আমাকে সেটা ঠিক করে নিতে হবে।