মেয়র বললেন, কিন্তু মঁসিয়ে, আপনি যদি দস্যুদের কবলে পড়েন?
বিশপ বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই পড়তে পারি। আপনি যখন বললেন তখন আমি অবশ্যই দেখা করব তাদের সঙ্গে। ঈশ্বরের কথা তাদের বলার জন্য তাদেরও নিশ্চয় একজন লোকের দরকার।
কিন্তু তারা তো একদল নেকড়ের মতো।
আর সেইজন্যই হয়তো যিশু আমাকে তাদের রাখাল হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। ঈশ্বরের বিধানের কথা কে বুঝতে পারে?
তারা আপনার সব কিছু অপহরণ করবে।
আমার কিছুই নেই।
ওরা আপনাকে হত্যা করতে পারে।
মন্ত্র উচ্চারণরত একজন বৃদ্ধ যাজককে কেন তারা মারবে?
আপনি যদি তাদের সঙ্গে দেখা করেন ঈশ্বর যেন আপনার মঙ্গল করেন।
আমি আমার গরিবদের জন্য তাদের কাছে ভিক্ষা চাইব।
মঁসিয়ে, আমার অনুরোধ, যাবেন না। শুধু শুধু আপনার জীবন বিপন্ন করবেন না।
বিশপ তার উত্তরে বললেন, আপনার সব কিছু বলা শেষ হয়েছে মঁসিয়ে মেয়র? আমার জীবন রক্ষার জন্য আমাকে কিন্তু এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি। আমাকে পাঠানো হয়েছে মানুষের আত্মাকে রক্ষা করার জন্য।
সুতরাং কারও কোনও নিষেধ বা অনুরোধ বাধা দিতে পারল না বিশপকে। তিনি চলে গেলেন। বিশপের এই অনমনীয় জেদের কথাটা ক্রমে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। সকলে তার কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেল।
তার বোন ও ম্যাগলোরিকে সঙ্গে নিলেন না বিশপ। শুধু পথ দেখাবার জন্য এক স্থানীয় ছেলেকে সঙ্গে নিলেন। তারা টাটু ঘোড়ায় চেপে গেলেন। পথে কারও সঙ্গে দেখা হল না। নিরাপদেই তারা সে পার্বত্য আদিবাসীদের গাঁয়ে পৌঁছলেন। সেখানে পুরো একপক্ষকাল রয়ে গেলেন বিশপ। তাদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করলেন, ধর্মে দীক্ষা দিলেন, অনেক নীতি শিক্ষা দিলেন।
অবশেষে গাঁ ছেড়ে আসার আগে একদিন প্রার্থনাসভার শেষে ‘তে দিউম’ বা ‘হে ঈশ্বর, তোমার প্রতি’ নামে এক স্তোত্রগানের অনুষ্ঠান করতে বললেন স্থানীয় যাজককে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে একটা সমস্যা দেখা গেল। সেই গ্রাম্য গির্জায়
এই অনুষ্ঠানের উপযুক্ত ধর্মীয় পোশাক পাওয়া গেল না।
বিশপ তবু বললেন, যাই হোক, তোমরা ঘোষণা করে দাও নীতি উপদেশ দানের পরই ‘তে দিউম’ অনুষ্ঠিত হবে। কিছু না কিছু একটা উপায় হবেই।
আশপাশের গির্জাগুলোতে পোশাকের জন্য লোক পাঠানো হল। বিভিন্ন গির্জা ঘুরে যা কিছু পাওয়া গেল তাতে দেখা গেল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে না।
এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ দু জন অশ্বারোহী এসে একটা বড় সিন্দুক বিশপের কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। সিন্দুকটা নামিয়ে দিয়েই অশ্বারোহী দু জন চলে গেল। সেটা খুলে দেখা গেল কিছুদিন আগে এমব্রাসের গির্জা থেকে যেসব মূল্যবান সোনা ও হীরের জরি বসানো ধর্মীয় পোশাক চুরি গিয়েছিল সেইসব পোশাক সিন্দুকটাতে গুছিয়ে রাখা আছে। তার সঙ্গে একটা কাগজে লেখা ছিল, ক্রাভেত্তে এগুলো মঁসিয়ে বিয়েনভেনু’র হাতে তুলে দিল।
বিশপ বললেন, দেখলে তো? আমি আগেই বলেছিলাম কিছু একটা উপায় হবে। যে সামান্য ফুলে বা গ্রাম্য যাজকের পোশাকে সন্তুষ্ট থাকে ঈশ্বর তাকে একদিন আর্কবিশপের পোশাক দান করেন।
গ্রাম্য যাজক বলল, কিন্তু যে লোকটি এ পোশাক দিয়ে গেল সে ঈশ্বর না শয়তান?
বিশপ তার পানে কড়াভাবে তাকিয়ে বললেন, ঈশ্বর।
বিশপ চাস্তেলারে ফিরে দেখলেন তাঁকে দেখার জন্য পথের দু পাশে শহরের সব লোক সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের গির্জায় তার জন্য বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি অপেক্ষা করছিল। বিশপ তাদের বললেন, আমি ঠিক বলিনি? একজন গরিব যাজক গরিব পার্বত্য উপজাতিদের কাছে গিয়েছিল শূন্য হাতে, ফিরে এল হাত ভর্তি করে। আমি গিয়েছিলাম একমাত্র ঈশ্বরবিশ্বাসকে সম্বল করে। কিন্তু ফিরে এসেছি একটি গির্জার হারানো ধনসম্পদ নিয়ে।
সে রাতে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে বিশপ বললেন, দস্যু ও নরঘাতকদের কখনই আমাদের ভয় করা উচিত নয়। এরা যেসব বিপদের সৃষ্টি করে তা বাইরের ব্যাপার, সে বিপদ তুচ্ছ। আমরা নিজেরাই হচ্ছি নিজেদের ভয়ের বস্তু। কুসংস্কার হচ্ছে প্রকৃত দস্যু আর হিংসা হচ্ছে প্রকৃত খুনি। আমাদের দেহের উপর আঘাত হানার বা অর্থহানি ঘটাবার কেউ যদি ভয় দেখায় তা হলে কেন আমরা ভয় পাব বা বিব্রত বোধ করব? আসলে আমাদের আত্মার নিরাপত্তা সম্পর্কে, দেখতে হবে আমাদের আত্মাকে কেউ যেন ভয় না দেখায় বা তার কোনও বিঘ্ন না ঘটে।
এবার বিশপ তার বোনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, একজন যাজক কখনও আর পাঁচজনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার কথা ভাববে না। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া কোনও কাজ হতে পারে না। ঈশ্বর মানুষকে যে কাজ করার অনুমতি দেন মানুষ সেই কাজই করতে পারে। আমরা শুধু বিপদে পড়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি। কিন্তু আমাদের নিজেদের জন্য কোনও কিছু প্রার্থনা করা উচিত নয়, আমরা প্রার্থনা করব যাতে আমাদের জন্য আমাদের ভাইরা যেন কোনও পাপকর্মে জড়িয়ে না পড়ে।
এই ধরনের ঘটনা অবশ্য খুব একটা বেশি ঘটত না। আমরা শুধু যেসব ঘটনার কথা জানি সেইসব ঘটনার কথা বলতাম। তবে এই ধরনের কাজ জীবনে অনেক করে যেতেন মিরিয়েল।
এমব্রাস গির্জার হারানো ধনগুলো নিয়ে বিশপ কী করেছিলেন সে কথা আমরা ঠিক জানি না। সেগুলো সত্যিই বড় মূল্যবান বস্তু, বড় লোভনীয়। গরিবদের মঙ্গলের জন্য সেগুলো সত্যিই খুব উপযুক্ত, সেগুলো আগেই অপহৃত হয়েছিল। এবার সেই অপহৃত দ্রব্যগুলো অন্য পথে পরিচালিত করে সেগুলোর একটা সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে! তবে আমরা কোনও মন্তব্য করতে চাই না এ বিষয়ে। এ বিষয়ে আমরা বিশপের একচ্ছত্র লেখা পেয়েছিলাম এক জায়গায়। তিনি লিখেছিলেন, এবার আমাকে স্থির করতে হবে এগুলো আমি গির্জাকে ফেরত দেব, না হাসপাতালে নিয়ে যাব।