প্রতিদিন বাগানে দু-এক ঘণ্টা করে কাটাতেন বিশপ। ফুলগাছগুলোর যত্ন করতেন। কখনও তিনি গাছের গোড়া থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতেন, কখনও মাটি খোঁচাতেন, কখনও বা নতুন গাছ বসাতেন। কিন্তু মালীর দক্ষতা তাঁর ছিল না। গাছগুলোর কিভাবে ক্ষতি বা বৃদ্ধি হয় সে জ্ঞানও তাঁর ছিল না। উদ্ভিদধিদ্যায় কোনও আগ্রহ ছিল না তার। যেসব পোকামাকড় গাছের চারাগুলোর ক্ষতি করে সেগুলোকে ওষুধ দিয়ে মারার কোনও ব্যবস্থা করতেন না তিনি। তার একমাত্র আগ্রহ ছিল ফুলের প্রতি। তিনি ফুল ভালোবাসতেন। পণ্ডিত লোকদের শ্রদ্ধা করতেন তিনি। গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি নিজের হাতে জলপাত্র হাতে বাগানের গাছগুলোতে জল দিতেন।
বাড়ির কোনও দরজায় তালাচাবি দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করেননি বিশপ। বাপতিস্তিনে ও ম্যাগলোরি বিশপকে অনেক করে তার শোবার ঘরের দরজায় খিল দিতে বলেন রাত্রিতে। কিন্তু বিশপ তা শোনেননি। তার দেখাদেখি তারাও আর খিল দিত না। ম্যাগলোরি অবশ্য মাঝে মাঝে ক্ষোভ প্রকাশ করত এ ব্যাপারে।
মিরিয়েল এ ব্যাপারে তাঁর নীতির কথাটি একদিন বাইবেলের একটি পাতার উপর লিখে রাখেন, ‘ডাক্তারের সঙ্গে যাজকের এখানেই তফাৎ। ডাক্তারের বাড়ির দরজা কখনও বন্ধ করা চলবে না। যাজকের বাড়িও সব সময় খোলা রাখতে হবে।’ ‘অ্যা ফিলজফি অব মেডিক্যাল সায়েন্স’ নামে একখানি বইয়ের উপর একদিন তার একটা লেখা পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিল, আমিও কি একজন ডাক্তার নই? আমারও রোগী। আছে। রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা হতভাগ্য, যারা দীন-দুঃখী তারাও তো মনের দিক থেকে রুগুণ এবং সেই রোগ প্রতিকারের জন্যই তারা আসে আমার কাছে।
আর একটি বইয়ে তিনি একবার লেখেন, রাত্রিকালে যদিও কোনও লোক বাড়িতে আশ্রয় চাইতে আসে তা হলে তার নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করো না। যে ব্যক্তি দেখবে তার নাম-ধাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক তারই আশ্রয়ের বেশি দরকার।
একদিন এক যাজক বিশপের সঙ্গে দেখা করতে এসে ম্যাগলোরির অনুরোধে বিশপকে প্রশ্ন করেন, কেন আপনি সব সময় সব ঘরের দরজা খুলে রাখেন? তালা বা খিল কিছুই দেন না। এতে বিপদ ঘটতে পারে একসময়।
বিশপ মিরিয়েল তখন যাজকের কাঁধের উপর একটি হাত রেখে একটি প্রার্থনাস্তোত্র থেকে একটি ছত্র উদ্ধৃত করে বলেন, ঈশ্বর যদি কোনও নগর রক্ষা করতে না চান তা হলে প্রহরীর দৃষ্টি যতই সজাগ থোক তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
এই থেকে তিনি বলেন, কোনও সেনাদলের কর্নেলের মতো একজন যাজকেরও সমান পরিমাণ সাহস আছে। তবে সে সাহস বড় শান্ত এবং নিরুচ্চার।
.
৭
এই সময় একদিন আর একটি ঘটনা ঘটে, যা বিশপের চরিত্রের ওপর বেশ কিছুটা আলোকসম্পাত করে। সুতরাং ঘটনাটির উল্লেখ না করে পারা যাবে না।
একসময় গাসপার্দ বে’র মতো ভয়ঙ্কর দস্যুদল অলিউনের পার্বত্য অঞ্চলের আশপাশের গাগুলো লুটপাট করে তাণ্ডব চালাতে থাকে। ক্রাভাত্তে নামে এই দস্যুদলের এক নেতা পুলিশের ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। যেসব দস্যু বেঁচে ছিল এবং যারা ধরা পড়েনি তাদের নিয়ে প্রথমে সে বিলেতে ও পরে পিদমতে কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পরে প্যারিসের বার্মিলোনেত্তে অঞ্চলে এসে ওঠে।
ক্রাভাত্তের সাঙ্গপাঙ্গদের প্রথমে জঞ্জিয়ারে ও পরে তুলেতে দেখা যায়। পরে তারা জুং দেল এগলে পাহাড়ের গুহায় পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। রাত্রিকালে গুহার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে তারা পার্শ্ববর্তী গাঁগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা পারত লুটপাট করে পালাত।
কোনও এক রাতে ক্রাভাত্তে তার দলবল নিয়ে এমব্রাসের একটি বড় গির্জায় ঢুকে ধর্মীয় জিনিসপত্র সব চুরি করে নিয়ে যায়। তার অত্যাচারে গ্রামবাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ তাদের অনুসরণ করে ধরার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু সব বারেই তারা পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। কখনও কখনও আবার পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে পালিয়ে যায়। সত্যিই ক্রাভাত্তে ছিল এক দুর্ধর্ষ দুর্বৃত্ত।
এইভাবে যখন এই অঞ্চলে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছিল তখন সেখানে একদিন পরিদর্শনের কাজে এসে পড়েনে বিশপ মিরিয়েল। আসার পথে চাস্তেলার নামে এক জায়গায় সেখানকার মেয়রের সঙ্গে তার দেখা হয়। মেয়র ফিরে যেতে বলেন বিশপকে। লার্কে পর্যন্ত সমস্ত পার্বত্য এলাকাটা তখন একরকম ক্রাভাত্তের দখলে। তার ওপারেও তার আধিপত্য বিস্তৃত। সঙ্গে রক্ষী নিয়েও ওদিকে যাওয়া যাবে না। ওদিকে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক, শুধু শুধু তিন-চারজন রক্ষীর প্রাণ যাবে।
তা শুনে বিশপ বললেন, সত্যিই তাই? আমি রক্ষী সঙ্গে না নিয়েই যাব।
মেয়র আবার বললেন, মঁসিয়ে, ওখানে যাওয়ার কথা মনেও ভাববেন না।
বিশপ মিরিয়েল বললেন, আমি এই কথাই ভাবছি যে ওখানে আমি কোনও রক্ষী ছাড়াই যাব এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমি রওনা হব।
একা যাবেন?
হ্যাঁ একা।
না মঁসিয়ে, যাবেন না।
বিশপ তখন বললেন, ওই পাহাড় অঞ্চলে আদিবাসীদের একটি গাঁ আছে। আমি সেখানে তিন বছর যাইনি। ওইসব আদিবাসী বন্ধু। তারা বড় শান্তিপ্রিয়। উপত্যকায় ছাগল চরায় আর বাঁশি বাজায়। মাঝে মাঝে ঈশ্বর সম্বন্ধে তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন লোকের দরকার। একজন বিশপ যদি দস্যুর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের কাছে না যায়, তা হলে কী ভাববে তারা? আমি যদি না যাই হলে আমার সম্বন্ধেই-বা কী ভাববে?