বিশপের শোবার ঘরটি ছিল বড়। শীতকালে ঘরটাকে উত্তপ্ত করার জন্য অনেক কাঠের দরকার। দিগনেতে কাঠের দাম খুব বেশি হওয়ার জন্য শীতকালে প্রয়োজনমতো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে পারতেন না। শীতকালে রাত্রির দিকে শীতে খুব কষ্ট হওয়ায় বিশপ গোয়ালঘরের একটি দিক ঘিরে সন্ধ্যার সময় সেইখানে বসে পড়াশোনা করতেন। তিনি বলতেন, ‘এটি আমার শীতের বিশ্রামাগার।’ কিন্তু তার সেই শীতের বিশ্রামাগারে একটি কাঠের টেবিল আর চারটি চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাব ছিল না। একটি কাঠের বোর্ডকে বক্তৃতার ঘরে বেদি হিসেবে সাজিয়ে রাখা হত।
দিগনের ধনী ধার্মিক ও ভক্ত মহিলারা বক্তৃতাকক্ষে একটি ভালো বেদি তৈরির জন্য কয়েকবার চাঁদা তুলে টাকা দিয়েছিল বিশপের হাতে। কিন্তু সে টাকা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন বিশপ। তিনি বলেন, যে সব হতভাগ্য নিরুপায় হয়ে ঈশ্বরের কাছে অন্তরের সঙ্গে সান্ত্বনা চায় তাদের আত্মাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বেদি।
বসার ঘরে বেশি চেয়ার ছিল না। দুটি মাত্র বসার টুল ছিল। তাঁর শোবার ঘরে মাত্র একটি আমচেয়ার ছিল। যখন বিশপের বসার ঘরে ছ সাতজন অথবা দশ-এগারো জন্য অতিথি আসত, বিভিন্ন ঘর থেকে চেয়ার আনতে হত। এগারো জনের বেশি অতিথি এলে বিশপকে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হত। আর গ্রীষ্মকাল হলে চেয়ারের অভাবে তিনি অতিথিদের বাগানে নিয়ে গিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কথা বলতেন।
অতিথিদের বিছানার পাশে যে একটা চেয়ার ছিল তার একটা পা ভাঙা থাকায় সেটা দেয়ালের গাঁ ঘেঁষে সেঁটে রাখা হয়েছিল। সুতরাং সেটা বার করে ব্যবহার করা চলত না। বাপতিস্তিনের ঘরে ইজি চেয়ার ছিল, কিন্তু সিঁড়িগুলো সরু থাকায় জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকানোর সময় ভেঙে যায়। তার ফলে সেটাও ব্যবহার করা চলত না। বাপতিস্তিনের অনেক দিনের ইচ্ছা মেহগনি কাঠের আর হলুদ ভেলভেটের গদিওয়ালা একটা আর্মচেয়ার কিনবে। কিন্তু তার দাম পাঁচশো ফ্রাঁ। অথচ গত পাঁচ বছরের মধ্যে সে মাত্র বিয়াল্লিশ ফ্রাঁ দশ সু জমাতে পেরেছে। ফলে সেই দামি আর্মচেয়ার কেনার আশাটা ত্যাগ করতে হয় বাপতিস্তিনকে। এমনি করে অনেক স্বপ্নই সফল হয় না আমাদের।
বিশপের শোবার ঘরের মতো এমন সাদাসিধে ঘর দেখাই যায় না। এ ঘরে ছিল বাগানের দিকে একটি জানালা আর দুটি দরজা –একটি দরজা খাবার ঘরে যাওয়ার জন্য আর একটি বক্তৃতার ঘরে যাবার জন্য। একটি লোহার খাটে বিছানা পাতা থাকত, তার উপরে ছিল সবুজ সার্জের এক চাঁদোয়া। খাবার ঘরে যাওয়ার দরজাটার পাশে ছিল বইয়ের তাক। তাকগুলো বইয়ে ভর্তি ছিল। আগুন রাখার জায়গাটার ছিল কাঠের, কিন্তু দেখে মনে হত মার্বেল পাথরের। তার সামনের দুটো ফুলদানিতে দুটো কুকুরের মূর্তি ছিল। দেয়ালের গাঁয়ে যেখানে আগুন জ্বালানো হয় তার উপর যে তাক ছিল তার মাথায় আয়নার পরিবর্তে চারকোনা একখণ্ড ভেলভেটের উপর একটা তামার ক্রস ঝোলানো ছিল। জানালার পাশে একটা বড় টেবিলে অনেক কাগজপত্র ছড়ানো ছিল আর তাতে একটা দোয়াত ছিল। টেবিলের পাশে ছিল একটা কমদামি আর্মচেয়ার আর বিছানায় খাটের পাশে প্রার্থনা করার জন্য একটা টুল ছিল। এই টুলটা আসলে বক্তৃতার ঘরে থাকত এবং দরকারের সময় আনা হত।
বিছানার দু’পাশে দুটি ফ্রেম আঁটা ছবি ছিল। ছবি দুটি ভূতপূর্ব এক বিশপ ও কয়েকজন যাজকের। ছবি দুটি ছিল আগেকার হাসপাতালে। হাসপাতালের এই বাড়িটাতে আসার পর থেকে বিশপ এগুলো উত্তরাধিকারসূত্র পেয়ে যান যেন। ছবিগুলো
এ বাড়িতে আসার পর ম্যাগলোরি যখন ঝাড়ামোছা করছিল তখন তা দেখতে পেয়ে যান বিশপ। দেখেন ছবিতে আঁকা বিশপ ও যাজকরা সবাই ১৭৮৫ সালের এপ্রিল মাসে কাজে নিযুক্ত হন। জানালায় যে পর্দাটা ছিল তার অনেকটা ছিঁড়ে যায় এবং ম্যাগলোরি বাধ্য হয়ে সেই ছেঁড়াটা ঢাকার জন্য তালি দিয়ে দেয়। তালিটা দেওয়া হয় ক্রসের আকারে। তা দেখে খুশি হন বিশপ। গোটা বাড়িটাকে ব্যারাক বাড়ি বা হাসপাতালের মতই রঙ করা হয়েছিল।
খাবার ঘরের টেবিলে ছয়টা রুপোর কাঁটা-চামচ চকচক করত আর দুটো রুপোর ভারী বাতিদান ছিল। বিশপের নিজস্ব ধনসম্পদ বলতে এছাড়া আর কিছু ছিল না। এই রুপোর জন্য গর্ব অনুভব করত ম্যাগলোরি। কোনও সম্মানিত অতিথি খেতে এলে সেই বাতিদানে মোমবাতি রেখে তা জ্বালত। বিশপ একদিন রুপোর কাঁটা-চামচগুলো সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, এই রুপোর জিনিসগুলোর সাহায্য ছাড়া খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারছি না আমি।
বাগানটা চারদিকে একটা সাদা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। বাগানের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটায় বর্গক্ষেত্রাকার চার টুকরো জমি ছিল। তার তিনটেতে ম্যাগলোরি শাকসবজি লাগাত আর একটাতে ফুলগাছ বসিয়েছিলেন বিশপ। বাগানে কিছু ফলের গাছও ছিল। একদিন ম্যাগলোরি রাগের সঙ্গে বিশপকে বলেছিল, মঁসিয়ে, আপনি আমাদের সবকিছুর সদ্ব্যবহার করার জন্য উপদেশ দেন। কিন্তু আপনি ফুলগাছ বসিয়ে জমিটা নষ্ট করছেন। ফুলের থেকে চাটনির দরকার বেশি। তাই ওখানে ফুলের বদলে চাটনির জন্য কিছু সবজি লাগালে ভালো হত।
বিশপ তার উত্তরে বলেন, ভুল করছ তুমি। সংসারের প্রয়োজনীয় বস্তুর মতো সুন্দরেরও প্রয়োজন আছে। বোধ হয় সুন্দর যে কোনও বস্তুর থেকে বেশি প্রয়োজনীয়।