যে পথ দিয়ে তিনি যেতেন সে পথের দু’ধারে একটা আলোড়ন পড়ে যেত। যত সব শিশু আর বৃদ্ধরা তাদের বাড়ির দরজার কাছে বেরিয়ে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানাত তাঁকে, শীতার্ত ব্যক্তিরা যেমন প্রতপ্ত সূর্যালোককে অভ্যর্থনা জানায়। যারা অভাবগ্রস্ত তাদের তিনি তাদের বাসায় গিয়ে দেখতেন। তিনি সকলকে আশীর্বাদ করে তাদের ধন্য করতেন এবং নিজেও ধন্য হতেন। পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝে থেমে অনেক শিশু আর তাদের মায়েদের সঙ্গে হেসে কথা বলতেন। যখন তার হাতে টাকা থাকত তখন তিনি গরিবদের বাড়ি যেতেন আর যখন টাকা থাকত না তখন তিনি ধনীদের বাড়ি যেতেন।
বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় বিশপের আলখাল্লাটি তিনি পরে যেতেন। সেটি একেবারে অচল না হওয়া পর্যন্ত পরতেন। সেটা দু-এক জায়গায় ছিঁড়ে গেলেও তা গ্রাহ্য করতেন না। তবে গরমকালে সেটা পরে বাইরে বেরোতে কষ্ট হত।
সন্ধে সাড়ে আটটার সময় তিনি বাড়িতে তার বোনের সঙ্গে রাতের খাওয়া খেতেন। ম্যাগলোরি পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। তাঁর নৈশভোজনের মধ্যে থাকত শাকসবজির ঝোল আর শুকনো রুটি। এর থেকে কম খরচের খাওয়া আর হতে পারে না। যদি কোনও যাজক নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকত তা হলে ম্যাগলোরি সেই সুযোগে কিছু মাছ বা। মাংসের ব্যবস্থা করত। যাজকরা তাঁর বাড়িতে খেতে ভালোবাসত আর বিশপও তা সমর্থন করতেন।
নৈশভোজনের পর আধ ঘণ্টা তার বোন আর ম্যাগলোলারির সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন মিরিয়েল। তার পর নিজের শোবার ঘরে চলে যেতেন। তাঁর শোবার ঘরটা ছিল নিচের তলায়। বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি উপরতলায় তাদের শোবার ঘরে চলে যেত। শোবার ঘরে গিয়ে পড়ালেখার কাজ করতেন মিরিয়েল অনেক রাত পর্যন্ত। তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা এবং পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি বাইবেলের ‘জেনেসিস’ বা সৃষ্টিতত্ত্বের একটি পঙক্তির ওপর একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সেই পঙক্তিটাতে ছিল ‘জেনেসিস’ সৃষ্টির আগে শুধু ছিল জল এবং ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর ঘুরে বেড়াত। তিনি এই পঙক্তিটির সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের উল্লিখিত অনুরূপ পঙক্তিগুলো মিলিয়ে দেখেন। আরবি শাস্ত্রে লিখিত একটি পঙক্তিতে আছে, ‘ঈশ্বরের বাতাস বইতে লাগল।’ ফ্লোবিয়াস জোসেফ লিখেছেন, স্বর্গ থেকে বাতাস নেমে এল মর্তে। চ্যালভিনয় অনূদিত রব্বি অঙ্কেলোতে আছে, ঈশ্বরপ্রেরিত বাতাসের রাশি জলের উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল।
আর একটি প্রবন্ধে তিনি টলেমার ভূতপূর্ব বিশপ শার্লস লুই হুগোর ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। এই রচনাগুলো আগের শতাব্দীতে কয়েকটি পুস্তিকা ও প্রচারপত্রে প্রকাশিত হয়।
কখনও কখনও কোনও গভীর বিষয় পড়তে পড়তে দিবাস্বপ্নের মধ্যে মগ্ন হয়ে পড়তেন। তার মাঝে মাঝে সেই দিবাস্বপ্নের গম্ভীর হতে উঠে এসে দু একটা পঙুক্তি লিখতেন। যে বই তাঁর হাতে থাকত, সেই বই-এর কোনও না কোনও পাতার উপর পর্ভূক্তিগুলো লিখতেন। এই লেখাগুলোর সঙ্গে তাঁর হাতের বই-এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমরা একটি বইয়ের উপর তাঁর লেখা কয়েকটি ছত্র পাই। তাতে এক জায়গায় লেখা ছিল, তুমি হচ্ছ এই :
যাজক সম্প্রদায় তোমাকে বলে ‘সর্বশক্তিমান’, ম্যাকারিরা তোমাকে বলে ‘স্রষ্টা’, একেসীয়দের কাছে লিখিত পত্রাবলিতে তোমাকে ‘স্বাধীনতা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, বারুক তোমাকে বলেছেন ‘অনন্ত’, বাইবেলের প্রার্থনাস্তোত্রে তোমাকে বলা হয়েছে ‘প্রজ্ঞা আর সত্য’, দ্য বুক অব কিংস, তোমাকে বলেছেন “লর্ড’ বা প্রভু, ওল্ড টেস্টামেন্টের কাজোড়াসে বলা হয়েছে তুমিই ‘ঐশ্বরিক বিধান’, লেভিটিকাস বলেছেন, তুমিই ‘পবিত্রতা’, এসড্রাস তোমাকে বলেছেন, ন্যায়পরায়ণতা, সৃষ্টিতত্ত্বে তোমাকে বলা হয়েছে ‘ঈশ্বর’, মানুষ তোমাকে বলে ‘পরম পিতা’; কিন্তু সলোমন বলেছেন তুমি ‘পরম করুণা’ এবং এইটিই তোমার সবচেয়ে সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ নাম।
রাত্রি নটা বাজতেই বাড়ির মহিলা দু জন উপরতলায় তাদের শোবার ঘরে চলে যেত। এবার দিগনের বিশপ যে বাড়িতে বাস করতেন সে বাড়ির একটি বিবরণ দান করা উচিত।
.
৬
যে বাড়িতে বিশপ বাস করতেন তার দুটি তলা ছিল। প্রত্যেক তলাতে ছিল তিনটি করে ঘর। এছাড়া ছাদের উপর একটি ঘর ছিল। বাড়িটির পেছন দিকে এক একর সমান একটি বাগান ছিল। বাড়ির মেয়েরা উপরতলায় আর বিশপ নিচের তলায় থাকতেন। বিশপের যে তিনটি ঘর ছিল তার মধ্যে রাস্তার দিকের ঘরটি খাবার ঘররূপে ব্যবহৃত হত। দ্বিতীয় ঘরটি শোবার ঘর ও পড়ার ঘররূপে ব্যবহার করতেন। তৃতীয় ঘরটি তাঁর বক্তৃতার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। বক্তৃতার ঘরের এক প্রান্তে একটি বিছানা পাতা থাকত অতিথিদের জন্য। বিছানাটির পাশে পর্দা ফেলা থাকত। গির্জা-সংক্রান্ত ব্যাপারে গ্রাম্য যাজকদের প্রায়ই বিশপের কাছে আসতে হত। পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা হত বিছানাটা; যেন মনে হত একটা শোবার ঘর।
বিশপের এই বাড়িটি আগে ছিল হাসপাতাল। হাসপাতালের যে ঘরটিতে ওষুধ দেওয়া হত রোগীদের সেই ঘরটিকে দু’ভাগ করে ভাঁড়ার ঘর ও রান্নাঘরে পরিণত করা হয়। বাগানের একটি অংশে একটি গোয়ালঘর তৈরি করে সেখানে দুটি গরু রাখা হত। গরুতে যা দুধ দিত তার অর্ধেক বিশপ বাড়িতে রেখে অর্ধেক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতেন।