বিশপ মিরিয়েল যখন প্রথম গিলোটিন দেখেন তখন এই কথাই তার মনে হয়। গিলোটিনে কোনও এক লোকের এই প্রথম ফাঁসি দেখে দুঃখে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। বাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে সেই ভয়ঙ্কর প্রশান্তিটা মিলিয়ে গেল। তার মনের মধ্যে সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার কথাটা ভূতের মতো আনাগোনা করছিল বারবার। সাধারণত তিনি কোনও কর্তব্য পালন করে বাড়ি ফিরলে এক তৃপ্তির অনুভূতি তাঁর চোখে-মুখে ফুটে থাকে। কিন্তু এবার তৃপ্তির পরিবর্তে তাঁর মন ছিল এক পাপচেতনার দ্বারা ভারাক্রান্ত। সাধারণত তিনি বাড়িতে অনেক সময় আপন মনে বিড় বিড় করে কথা বলতেন। সেদিনও তিনি এমনি করে এক একাত্মক সংলাপে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন আর তার বোন সে সংলাপ মন দিয়ে শুনছিল।
বিশপ বলেছিলেন, আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এত ভয়ঙ্কর। মানবজগতের বিধিনিষেধ ও নিয়মকানুনের প্রতি এভাবে উদাসীন থেকে শুধু ঐশ্বরিক বিধি নিয়ে এতখানি মগ্ন থাকা আমার উচিত হয়নি। মৃত্যু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ঈশ্বরের হাতে। মৃত্যুর মতো এমন একটা অজ্ঞাত ও রহস্যময় ব্যাপারের ওপর খবরদারি করার কোনও অধিকার নেই মানুষের।
এইসব চিন্তা-ভাবনা কমে একে একে মিলিয়ে গেল বিশপের মন থেকে। তবে সেদিন থেকে বধ্যভূমির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথটা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যেতেন তিনি।
বিশপ মিরিয়েলকে যে কোনও সময়ে ডাকলেই তিনি যে কোনও রুগ্ণ ও মুমূর্ষ ব্যক্তির শয্যাপাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। এটা যে তার জীবনের এক প্রধান আর মহান কর্তব্য একথা ভুলে যেতেন না তিনি। কোনও অনাথ বা বিধবার বাড়ি যাওয়ার জন্য তাঁকে ডেকে পাঠাবার কোনও প্রয়োজন হত না। কোনও মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই চলে যেতেন। যে ব্যক্তি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছে অথবা যে মাতা সন্তানহারা হয়েছে তার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নীরবে বসে থাকতেন। তার শোকে সান্ত্বনা দিতেন। কখন কথা বলতে হবে বা কখন চুপ করে থাকতে হবে, তা তিনি বুঝতেন। তাঁর সান্ত্বনা দানের পদ্ধতিটা ছিল উন্নত ধরনের। তিনি কখনও শোকার্ত ব্যক্তিকে বিস্মৃতির অতলগর্ভে তার শোক-দুঃখকে বিলীন করে দেওয়ার উপদেশ দিতেন না, তিনি চাইতেন শোকার্ত ব্যক্তি এক নতুন আশা ও ঈশ্বরবিশ্বাসের সাহায্যে তার সব শোকদুঃখকে এক বিরল মহত্ত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তুলুক। তিনি শোকসন্তপ্ত ব্যক্তিদের বলতেন, মৃতের প্রতি তোমারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কর। পচনশীল এক মানবদেহের জন্য শোক-দুঃখ করে কোনও লাভ নেই। তোমরা যদি স্থিরভাবে ভেবে দেখ তা হলে দেখবে তোমারে মৃত প্রিয়তমের অমর আত্মার আলো ঈশ্বরের বুকের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে।
তিনি জানতেন বিশ্বাসই মানুষকে শক্তি দেয়। শোকার্ত ব্যক্তিকে তিনি সব সময় ঈশ্বরের প্রতি নিবিড় আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শান্তি পেতে বলতেন। যে দুঃখ শুধু মৃত্যুর অন্ধকার গহ্বরটাকে বড় করে দেখে সে দুঃখকে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো হিসেবে দেখতে শেখাতেন।
.
৫
মঁসিয়ে মিরিয়েলের ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিক জীবনের মধ্যে কোনও ভেদ ছিল না। দুটি জীবন সমান্তরালভাবে এক ধারায় চলত। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখত তারা তাঁর সে জীবনের কঠোরতা আর আত্মনিগ্রহ দেখে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে যেত।
বেশির ভাগ বৃদ্ধ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মতো মিরিয়েল খুব কম ঘুমোতেন। কিন্তু যতটুকু সময় ঘুমোতেন তার ঘুমটা গম্ভীর হত। সকালবেলায় তিনি এক ঘণ্টা ধ্যান করতেন। তার পর তিনি বড় গির্জায় অথবা তার নিজস্ব বক্তৃতামঞ্চ থেকে সমবেত উপাসনাসভা পরিচালনা করতেন। সভার কাজ শেষে তিনি তাঁর নিজের গরুর দুধ আর রুটি খেয়ে তার কাজ শুরু করতেন।
একজন বিশপকে অনেক কাজ করতে হয়। সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তার অধীনস্থ নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন চার্চের যাজকদের সঙ্গে দেখা করতে হয় প্রতিদিন। অনেক ধর্মীয় সভায় তাঁকে সভাপতিত্ব করতে হয়, বিধান দান করতে হয়, বিভিন্ন গির্জা থেকে প্রকাশিত কাগজপত্র দেখতে হয়, এই ধরনের অজস্র ধর্মীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন গ্রাম্য গরিব যাজকদের কাছে চিঠি দিয়ে পাঠাতে হয়, যাজকদের নীতি-উপদেশমূলক বক্তৃতার লিপিগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় মেয়র ও যাজকদের মধ্যে কোনও বিরোধ বাধলে তার মীমাংসা করতে হয়। তার পর পোপ ও সরকার-সংক্রান্ত চিঠিপত্রগুলো দেখে তার জবাব লিখতে হয়। মোট কথা, তাঁকে হাজার রকমের কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হয়।
এইসব কাজকর্ম সম্পাদনা করে যেটুকু সময় পেতেন মিরিয়েল সেই সময় তিনি গরিব-দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের কাজে ব্যয় করতেন। এর পরেও যদি কিছু অবসর পেতেন তা হলে তিনি তার বাগানে গিয়ে গাছপালার যত্ন করতেন, অথবা ব্যক্তিগত লেখাপড়ার কাজ করতেন। পড়ালেখার কাজ আর বাগানের কাজ একই জাতীয় বলে তিনি মনে করতেন। তিনি বলতেন মানুষের মন বা আত্মাটাও এক বাগান। পড়াশোনা বা জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যে বাগান পরিমার্জিত হয়।
দুপুরবেলায় তিনি যা খেতেন তা প্রাতরাশের থেকে সামান্য কিছু বেশি। বেলা দুটোর সময় আবহাওয়া ভালো থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন তিনি। হয় তিনি গ্রামাঞ্চলে চলে যেতেন হাঁটতে হাঁটতে অথবা শহরের রাস্তা দিয়ে গরিব-দুঃখীদের বাড়ি যেতেন। একটা লম্বা ছড়ি হাতে মাথাটা নিচু করে চিন্তাষিতভাবে পথ হাঁটতেন তিনি। তাঁর জুতোজোড়া ছিল ভারী এবং মোজা দুটো ছিল নীলচে রঙের। মাথায় থাকত ঝালর দেওয়া বিশপের টুপি।