এবার আসুন একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা এই পরিচ্ছেদের আলোচনা সমাপ্ত করি। প্রাচীন সমাজে এমন বিশ্বাস করা হতো যে আচরণ বিধিগুলোর উৎস অতীন্দ্রিয়লোক। আমি এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে বলে মনে করি না। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, এর ফলে সমাজে শক্তির ভারসাম্য বিরাজ করে। দেবতারা মনে করেন যে ক্ষমতাবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করা কর্তব্য; কিন্তু ক্ষমতাবানরা এত নিষ্ঠুর হবে না যে তা বিদ্রোহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নবী ও জ্ঞানী মানুষের প্রভাবে নতুন নৈতিক বিধি দেখা দেয়। কখনও নৈতিক বিধিগুলো পুরাতনের পাশাপাশি চলে আবার কখনও তা পুরাতনের স্থান দখল করে নেয়। নবী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা ক্ষমতার ঊর্ধ্বে জ্ঞান, ন্যায়বিচার ও বিশ্বজনীন প্রেমের স্থান দিয়েছেন। এইভাবে তারা দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তিগত সফলতার চেয়ে এই লক্ষ্যগুলো অধিক মুল্যবান। সমাজ পদ্ধতির যে অংশ বিশেষের জন্য মানুষ দুঃখভোগ করে থাকে নবী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত কারণেই এর পরিবর্তনের প্রত্যাশা করে থাকেন। বিপ্লবী আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত কারণের সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের সমন্বিত রূপদানের ফলেই।
আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি সমাজ জীবনে বিপ্লবের স্থান চিহ্নিতকরণে। বিপ্লব দুধরনের : তা শুধু ব্যক্তিগত হতে পারে অথবা হতে পারে ভিন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তার আশা-আকাঙ্ক্ষায় অন্যের অংশ থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ ছাড়া সবাই অংশগ্রহণ করে থাকে। (যারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় নিজের স্বার্থসিদ্ধি লাভ করে তারাই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী লোক)। এ ধরনের বিপ্লব গঠনমূলক, ধ্বংসাত্মক নয়। এমনকি প্রথম দিকে ধ্বংসাত্মক দেখা গেলেও পরিণামে তা স্থিতিশীল নতুন সমাজের জন্ম দেয়। এর নৈর্ব্যক্তিক উদ্দেশ্যই একে নৈরাজ্যিক বিপ্লব থেকে আলাদা করে দেখায়। শুধু ঘটনা প্রবাহ থেকে এর বৈধতা যাচাই করা সম্ভব। কর্তৃপক্ষের বোষধাদয় হলে একে প্রতিরোধ না করেই প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন। ব্যক্তিবিশেষ মানুষের জন্য উপকারী জীবন পদ্ধতি উপলব্ধি করতে পারেন। যে জীবন পদ্ধতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অধিক পরিমাণে চরিতার্থ করতে সমর্থ। তিনি কে তা অন্য লোকের কাছে বোধগম্য করে তুলতে পারেন। বিপ্লব ছাড়া মানবজাতি পশ্চাৎপদ থেকে যাবে এবং অন্যায় দূর হবে না সমাজ থেকে।
১৬. ক্ষমতার দর্শন
এই অধ্যায়ে আমি আলোচনা করতে চাই ক্ষমতাপ্রীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত দর্শন সম্বন্ধে। আমি বলছি না যে ক্ষমতাই এর বিষয়বস্তু। তবে অধিবিদ্যা ও নৈতিক বিচার-বিবেচনায় এটিই দার্শনিকদের সচেতন বা অবচেতন ইচ্ছা।
আমাদের বিশ্বাস জন্ম নেয় বিভিন্ন মাত্রায় ইচ্ছার সঙ্গে দর্শনের মিলনের ফলেই। কোনো ক্ষেত্রে একটি উৎপাদকের কার্যকরী অংশ খুবই কম থাকে এবং অন্য ক্ষেত্রে অন্য উৎপাদকের। অভিজ্ঞতার সাহায্যে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে এমন কিছু যৎসামান্যই হয়ে থাকে। যখন আমাদের বিশ্বাস তা অতিক্রম করে যায় তখন ইচ্ছাই এগুলোর সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে। অপরপক্ষে অল্প বিশ্বাসই চূড়ান্তভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও দীর্ঘদিন টিকে থাকে। তাছাড়া পক্ষে বা বিপক্ষে তা যুগ যুগ ধরে টিকে থাকতে পারে প্রমাণের অভাব হলেও।
দর্শন জীবনের চেয়ে অধিকতর সমন্বিত। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে আমাদের জীবনে। কিন্তু একটি দর্শন সাধারণত কোনো প্রভাবশালী ইচ্ছার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন রকম আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রভাবিত করেছে দার্শনিকের কাজকে। জানার আকাক্ষা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বকে যে জানা সম্ভব এটা প্রমাণের আকাক্ষার মতো তা এক হতে পারে না। সুখের আকাক্ষা রয়েছে, সদগুণের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এবং এ দুয়ের মিলনে সৃষ্ট মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলনের আকাক্ষা রয়েছে, সৌন্দর্যের আকাক্ষা রয়েছে এবং সর্বোপরি রয়েছে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা।
সদগুণের লক্ষ্য স্থির করে বড় বড় ধর্মগুলো। খ্রিস্ট ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম মুক্তির পথ অন্বেষণ করে। অধিকতর রহস্যরূপে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলনের পথ অন্বেষণ করে। অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন সত্য অন্বেষণ করে। আবার আদর্শবাদী দর্শন (ডেকার্তে থেকে কান্ট পর্যন্ত) নিশ্চয়তার অন্বেষণ করে। বাস্তবে কান্ট পর্যন্ত বড় বড় দার্শনিক মানব স্বভাবের জ্ঞাত অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত আকাক্ষার সঙ্গে তাদের চর্চা সীমাবদ্ধ রাখেন। বেনথাম ও মানচেষ্টার স্কুলের দর্শন সম্পদকে প্রধান। উপায় ও আনন্দকে উদ্দেশ্য হিসেবে স্থির করে। আধুনিককালের ক্ষমতা দর্শন প্রধান মানচেস্টরিসমাস-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আবির্ভূত হয়। জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধারাবাহিক আনন্দলাভ–এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে তা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ।
ইচ্ছাশক্তি ও অনিয়ন্ত্রিত বাস্তবতার ভেতর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক হচ্ছে মানবজীবন। যে দার্শনিক ক্ষমতা তাড়না দ্বারা পরিচালিত হন তিনি বাস্তবতার ভূমিকাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করেন। আমি এ মুহূর্তে শুধু মেকিয়াভেলি ও রিপাবলিক গ্রন্থে বর্ণিত নগ্ন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন ব্যক্তিদের কথাই চিন্তা করছি; আমি ভাবছি ওইসব মানুষের কথা যারা অধিবিদ্যা ও নীতিবিজ্ঞানের আচ্ছাদনের নিচে তাদের ক্ষমতাপ্রীতি লুকিয়ে রাখার তত্ত্ব উঘাটন করেন। ফিকট হলেন আধুনিককালের এমন দার্শনিকের ভেতর প্রথম ব্যক্তি।