- বইয়ের নামঃ শক্তি
- লেখকের নামঃ বার্ট্রান্ড রাসেল
- প্রকাশনাঃ ঐশী পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, দর্শন
শক্তি
০১. ক্ষমতার শাসন
মানুষ ও পশুর মাঝে নানা রকম পার্থক্য। আর এই পার্থক্যগুলোর কতগুলো বৃত্তিবৃত্তিক, কতগুলো আবার আবেগপ্রসূত। মানবীয় আকাঙ্ক্ষা যে পশুর আকাক্ষার মতো না তা আবেগপ্রসূত একটি প্রধান পার্থক্য থেকে বোঝা যায়। আকাঙ্ক্ষাগুলো মুখ্যত সীমাহীন ও পূর্ণ তৃপ্তিলাভে ব্যর্থ। খাদ্য গ্রহণের পর অজগর যেমন পুনরায় ক্ষুধা না লাগা পর্যন্ত সুখে নিদ্রা যায় তেমনি অন্য কোনো পশুর ভেতর এর ব্যতিক্রম ঘটলে ধরে নিতে হবে যে প্রয়োজনের তুলনায় তাদের খাদ্য প্রাপ্তি কম কিংবা তারা শত্রুর ভয়ে ভীত। পশুপাখির সার্বিক কার্যকলাপ গুটি কয়েক ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও বংশবৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার মৌলিক প্রয়োজনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং এগুলোর কার্যকলাপ ওইসব মৌলিক প্রয়োজনের দ্বারা চিহ্নিত সীমা অতিক্রম করে না।
তবে মানুষের বেলায় বিষয়টি ভিন্নধর্মী। এ কথা সত্য যে, মানবকুলের বৃহৎ অংশ জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য বস্তু অর্জনের লক্ষ্যে এতটাই কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয় যে অন্যান্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে খুব কম কর্মশক্তিই তাদের মাঝে বিদ্যমান থাকে। তাই বলে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুর প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হওয়ায় তারা কর্মতৎপরতা বন্ধ করে দেয় না। এথেন্স অভিডানে যখন জেরক্স অবতীর্ণ হন তখন তার খাদ্য, পোশাক ও স্ত্রীর অভাব ছিল না। নিউটন ট্রিনিটিতে ফেলোশিপ লাভের পর ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশের নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে প্রিন্সিপিয়া লিখেছিলেন নিউটন। ইগনেসিয়ায় লায়লার অভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজে বের করার প্রয়োজনও ছিল না সেন্ট ফ্রান্সিসের। আলস্যপরায়ণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছাড়া অন্য সব লোকের ভেতর কিন্তু এ ধরনের বৈশিষ্ট্য বা গুণ কমবেশি অস্বাভাবিকভাবে দেখতে পাওয়া যায়। মিসেস এ-যিনি তার স্বামীর ব্যবসায়িক সফলতায় সন্দেহাতীতভাবে প্রত্যয় পোষণ করতেন এবং যার কাজের ঘর সম্পর্কে কোনো ভয় ছিল না, তিনি মিসেস বি-এর চেয়ে ভালো পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। যদিও তিনি অপেক্ষাকৃত কম খরচে নিউমোনিয়াজতিন বিপদ এড়াতে পারতেন। যদি মি. একে উপাধিতে ভূষিত করা হতো বা সংসদে সদস্য নির্বাচিত করা হতো তাহলে তিনি এবং মিসেস এ উভয়েই খুশি হতেন। সাফল্যের কোনো শেষ নেই, হোক না তা অলীক কল্পনাপ্রসূত, সম্ভব মনে হলে তা অর্জনের চেষ্টা করা হয়।
কল্পনা হলো এক ধরনের আঁকশির মতো; এজন্য সব মৌলিক চাহিদা মিটে গেলেও এটি মানুষকে বিরতিহীন প্রচেষ্টায় উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের ভেতর অধিকাংশ মানুষ খুব অল্প সময়কেই জেনেছেন যখন আমরা বলতে পারতাম
If it were now to die,
There now to be most happy, for I fear
My soul hath her content as absolute
That not another comfort like to this
Succeeds in unknown fate.
আমরা জানি যে সুখ দীর্ঘস্থায়ী নয় তাই আমাদের পূর্ণাঙ্গ সুখের ক্ষণে অথেলোর মতো মৃত্যু কামনা করাই স্বাভাবিক। মানুষের পক্ষে পরম সুখের জন্য যা প্রয়োজন তা অর্জন করা অসম্ভব। স্বর্গসুখ শুধু ঈশ্বরই পেতে পারেন, যেহেতু সাম্রাজ্য এবং ক্ষমতা ও গৌরব একমাত্র তাঁরই। মৃত্যুর ফলে পার্থিব ক্ষমতা সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, এ কারণে পার্থিব রাজ্য অন্যান্য রাজ্য দ্বারা সীমিত হয়ে যায় এবং পার্থিব গৌরব শতাব্দীর প্রবাহে বিলীন হয়ে যায়। তারপরও আমরা তৈরি করি পিরামিড এবং অবতারণা করি সুন্দর অমর গাথার। খুব সামান্য ক্ষমতা ও গৌরব যাদের আছে তারা মনে করে আরেকটু পেলেই তারা পরিতৃপ্তি পাবে, তাদের এ ধারণা ভুল। সীমাহীন এসব আকাক্ষা এবং এতে কেউ কিছুই পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেতে পারে না। খোদার আনন্দ বিস্তৃতির মধ্যেই তারা শুধু সুখের সন্ধান পেতে পারে।
জীবজন্তু যখন তাদের অস্তিত্ব ও বংশবিস্তার নিয়েই সন্তুষ্ট, মানুষ তখন তাদের পরিবৃত্তির জন্য মশগুল। এ অবস্থায় কল্পনায় রায়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা অঙ্কিত সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না। সব মানুষই সম্ভব হলে ঈশ্বর হতে চাইত। এর অবাস্তবতাকে গুটিকয়েক মানুষ স্বীকার করে নিতে পারে না। মিলটনের শয়তানের ছাঁচে গড়া এসব মানুষ। মহত্ত্ব ও অধার্মিকতার মিশ্রণ দেখা যায় তাদের মাঝে। মানবীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল নয়–আমি অধার্মিকতা বলতে এমন কিছু বোঝাতে চাই। বড় বড় বিজয়ী নেতার ভেতর মহত্ত্ব ও অধার্মিকতার অদ্ভুত মিশ্রণ সুস্পষ্ট। অবশ্য মানুষের ভেতর এর কিছু কিছু উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। সামাজিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এগুলো সংকট সৃষ্টি করে। প্রত্যেকেই আমরা নিজেকে ঈশ্বরের সমতুল্য মনে করি এবং তা খোদা ও উপাস্যের মধ্যকার সহযোগিতার স্বরূপ অনুসারে বুঝতে চাই। এজন্যই সরকার ও আপোষ মীমাংসার প্রয়োজন স্বরূপ প্রতিযোগিতা, অস্থিতিশীলতা ও পর্যায়বৃত্ত হিংস্রতার সঙ্গে বিদ্রোহের তাড়না। এ কারণে নৈতিকতার প্রয়োজন অরাজকতাপূর্ণ স্বাধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা রহিতকরণে।