- বইয়ের নামঃ সক্রেটিসের আগে
- লেখকের নামঃ বার্ট্রান্ড রাসেল
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, দর্শন
সক্রেটিসের আগে
০১. গ্রিক সভ্যতার অভ্যুদয়
পুরো ইতিহাসে গ্রিক সভ্যতার আকস্মিক অভ্যুদয়ের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার মতো কঠিন বিষয় আর নেই। সভ্যতা গঠনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার অধিকাংশই ইতোমধ্যে মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় বিদ্যমান ছিল হাজার বছর ধরে এবং সেখান থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের অভাব তত দিন পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল যত দিন গ্রিকদের কাছ থেকে তা পাওয়া বাকি ছিল। শিল্প ও সাহিত্যে গ্রিকদের অর্জন সম্পর্কে সবাই অবগত, কিন্তু বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে তারা যা করেছে তা বেশ ব্যতিক্রমী। গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শন তাদেরই আবিষ্কার। নিছক ঘটনাপঞ্জির বদলে ইতিহাস রচনা করে তারাই প্রথম। উত্তরাধিকার-সূত্রে চলে আসা গোঁড়ামির বেড়াজালে আবদ্ধ না থেকে তারা স্বাধীনভাবে বিশ্বজগতের প্রকৃতি ও জীবনের পরিণতি সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করত। গ্রিসে যা কিছু ঘটেছে তা এতই বিস্ময়কর যে খুব সাম্প্রতিককাল আগেও গ্রিক মনীষা সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে গিয়ে লোকজনকে বিমূঢ় আর হতবুদ্ধি হতে হয়েছে। কিন্তু গ্রিসের ঘটনাবলি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব, আর তা করার কাজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ উপযোগীও বটে।
থেলিসকে দিয়ে দর্শনের শুরু। একটি ঘটনা থেকে সৌভাগ্যক্রমে থেলিসের সময়কাল নির্দেশ করা যায়। সেটি হচ্ছে, তিনি একটি সূর্য/চন্দ্রগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জ্যোতির্বিদদের মতে তা ঘটেছিল ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তাহলে, দর্শন ও বিজ্ঞান-যা শুরুতে পরস্পর থেকে পৃথক ছিল না-তার সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে। কিন্তু সে সময়ের আগে গ্রিসে ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে কী ঘটেছিল? এই প্রশ্নের যেকোনো উত্তর আংশিকভাবে অনুমাননির্ভর হতে বাধ্য। তবে সুখের কথা, বর্তমান শতাব্দীতে প্রত্নতত্ত্ব থেকে আমাদের অনেক বেশি জ্ঞান লাভ হয়েছে, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের ছিল না।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালের দিকে মিসরে লেখার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে মেসোপটেমিয়াতেও তা ঘটে। প্রত্যেক দেশেই লেখা শুরু হয় কোনো লক্ষ্যবস্তুর ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। ছবিগুগলো দ্রুত পরিচিত ও রীতিসিদ্ধ হয়ে ওঠে এবং একটি সময়ে শব্দ বোঝাতে আইডিওগ্রাম ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠে, যেটা চীন দেশে এখনো প্রচলিত আছে। হাজার হাজার বছরে এই কষ্টসাধ্য পদ্ধতিটি উন্নীত হয় বর্ণমালার ব্যবহারে লেখার পদ্ধতিতে।
মিসর ও মেসোপটেমিয়ার প্রাথমিক উন্নতি সাধিত হয় নীল, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর বদৌলতে। নদীগুলোর কারণে সেখানে কৃষিকাজ ছিল খুব সহজ ও উৎপাদনশীল। স্পেনীয়, মেক্সিকো এবং পেরুতে যা দেখতে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে প্রাচীন মিসরীয় এবং মেসোপটেমীয় সভ্যতার অনেক সাদৃশ্য লক্ষ করা যাবে। ঈশ্বরসুলভ একজন রাজা থাকত, তার ক্ষমতা হতো একচ্ছত্র ও অসীম। মিসরে সেই ছিল সব ভূমির মালিক। বহু-ঈশ্বরবাদী একটি ধর্ম ছিল। সে ধর্মে ছিল একজন সর্বোচ্চ দেবতা অর্থাৎ সর্বেশ্বর। সর্বেশ্বরের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক হতো বেশ ঘনিষ্ঠ। একটি সামরিক আর একটি পুরোহিত সম্প্রদায় থাকত। রাজা যদি দুর্বল হতো বা কোনো কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ত, তাহলে পুরোহিত সম্প্রদায় প্রাইই রাজক্ষমতা দখল করে নিত। যারা ভূমি চাষ করত তারা ছিল রাজা, অভিজাত সম্প্রদায় বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের অধীনস্ত দাস।
মিসরীয় ধর্মতত্ত্ব ও ব্যাবিলনীয় ধর্মতত্ত্বের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল। মিসরীয়দের মধ্যে মৃত্যুচিন্তাই ছিল প্রধান ও প্রকট। তারা বিশ্বাস করত, মৃত ব্যক্তির আত্মা পাতালপুরীতে নেমে যায়, সেখানে ওসিরিস তাদের ইহজাগতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে বিচার করে। তারা মনে করত আত্মা শেষ পর্যন্ত আবার দেহের মধ্যে ফিরে আসে। এই বিশ্বাস থেকে তারা মৃতদেহকে নষ্ট না করে মমি বানিয়ে সুন্দর সুন্দর কবরের মধ্যে রেখে দিত। বিভিন্ন রাজার উদ্যোগে অনেক পিরামিড তৈরি হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ ও তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে। ওই সময়ের পর থেকে মিসরীয় সভ্যতা ক্রমশই গাধা হয়ে পড়ে এবং ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ভবিষ্যৎ প্রগতিকে অসম্ভব করে তোলে। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালে হিকসোস নামক সেমিটীয়রা মিসর অধিকার করে নেয়। তারা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে মিসর শাসন করে। মিসরে তারা কোনো স্থায়ী চিহ্ন রেখে যায়নি, কিন্তু সেখানে তাদের উপস্থিতি সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে মিসরীয় সভ্যতার প্রসারে নিশ্চয়ই সহায়ক হয়ে থাকবে।
মিসরের চেয়ে ব্যাবিলনিয়া ছিল অধিকতর সামরিকসুলভ। প্রথম দিকে সেখানকার শাসকরা সেমিটীয় ছিল না, ছিল সুমেরীয়। সুমেরীয়দের আদি পরিচয় অজানা। তারা লেখার কীলকাকার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। বিজয়ী সেমিটীয়রা সেটা তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল। একটি সময় ছিল যখন অনেক স্বাধীন নগরী ছিল, আর তারা সব সময় পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকত। কিন্তু একটি সময় আসে যখন ব্যাবিলন হয়ে ওঠে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য নগরীর দেবতারা হয়ে পড়ে ব্যাবিলনের দেবতা মারডকের অধীন। মারডক এমন একটি অবস্থান অর্জন করে যা পরবর্তীকালে গ্রিক দেবমণ্ডলীতে জিউসের অবস্থানের মতো। একই ধরনের ব্যাপার ঘটে মিসরেও, তবে তা আরো বেশ কিছু সময় আগে। অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের মতো মিসর এবং ব্যাবিলনিয়ার ধর্মগুলোও ছিল মূলত উর্বরতা পূজা।