শিক্ষা প্রসঙ্গ

০১. আধুনিক শিক্ষাতত্ত্ব

আগের দিনের লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক রচনা পাঠ করিলেও বোঝা যায় যে বর্তমানের শিক্ষাতত্ত্বের মধ্যে এমন কিছু নূতনত্ব আসিয়াছে যাহা পূর্বেকার প্রামাণিক গ্রন্থের মধ্যেও ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেকার দুইজন বড় শিক্ষা সংস্কারক লক্ [Locke] ও রুশো [Rousseau]। ইহারা উভয়েই খ্যাতির অধিকারী হইয়াছিলেন, কেননা তাহারা তকালে প্রচলিত শিক্ষা-সংক্রান্ত অনেক ভ্রম দূর করিয়াছিলেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদ যতদূর অগ্রসর হইয়াছেন, তাঁহাদের কেহই ততদূর যান নাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাহারা উভয়েই উদারতা ও গণতন্ত্রের পক্ষপাতী ছিলেন, তথাপি উভয়েই কেবল অভিজাত শিশুর শিক্ষাই বিবেচনা করিয়াছেন। তাঁহাদের পরিকল্পনায় একটি শিশুর শিক্ষার জন্য একজন বয়স্ক ব্যক্তি সর্বক্ষণ নিয়োজিত হইবে। ইহার ফল যতই উৎকৃষ্ট হোক না কেন, আধুনিক যুগের দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন কোনো লোকই এ পরিকল্পনা বিবেচনার যোগ্য মনে করিবেন না, কারণ এক-একটি শিশুর জন্য একজন করিয়া সর্বক্ষণস্থায়ী গৃহ-শিক্ষকের ব্যবস্থা করা গাণিতিক দিক দিয়া অসম্ভব। আধুনিক মানুষ নিজের ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধার খোঁজ করিতে পারে কিন্তু যে শিক্ষা-ব্যবস্থা সকলের জন্য উন্মুক্ত নয়, অনন্তপক্ষে যাহাদের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিলে তাহারা উপকৃত হইতে পারে এমন সকলের জন্যও উন্মুক্ত নয়–সে শিক্ষাপ্রণালীকে কেহ শিক্ষা বিস্তার সমস্যার সমাধান করিতে সক্ষম বলিয়া মনে করিবে না। অবশ্য এ কথা আমি বলি না যে, যে সুযোগ-সুবিধা সকলের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয় তাহা সচ্ছল লোকেরাও পরিহার করুক। ইহা করিলে ন্যায়ের কাছে সভ্যতাকে বিসর্জন দিতে হয়। আমি ইহাই বলিতে চাই যে, আমরা ভবিষ্যতের জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়িয়া তুলিব যাহা প্রত্যেকটি বালক-বালিকাকে আত্মবিকাশের জন্য পূর্ণ সুযোগ দান করিবে। আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হইতে হইবে, যদিও এ আদর্শ অবস্থা লাভ করা সময় সাপেক্ষ। বর্তমান যুগে এ ব্যবস্থা সকলেই স্বীকার করিবেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলিতে আমি ইহাই বুঝাইতেছি। আমি এমন ব্যবস্থাই সমর্থন করিব যাহা সর্বজনীন হইতে পারে, যদিও কেহ ব্যক্তিগতভাবে নিজের সন্তানসন্ততির জন্য অধিকতর সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিতে পারিলে আমার আপত্তি করার কোনো হেতু নাই। এইরূপ সঙ্কুচিত গণতান্ত্রিক প্রণালী লক্ ও রুশোর শিক্ষাবিষয়ক রচনাতে নাই। রুশো যদিও আভিজাত্যে বিশ্বাস করিতেন না, তাহার শিক্ষাপ্রণালীর মধ্যে কিন্তু এই বিশ্বাসহীনতার পরিচয় মেলে না।

গণতন্ত্র ও শিক্ষা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। গণতন্ত্র বলিতে যদি ইহাই বুঝায় যে সকলের জন্য একই স্তর সুনির্দিষ্ট থাকিবে, তবে তাহার ফল হইবে মারাত্মক। কতক বালক-বালিকার বুদ্ধি অপরের চেয়ে বেশি এবং তাহারা উচ্চ শিক্ষা হইতে অন্যের তুলনায় অধিকতর সুফল লাভ করিতে পারে। কতক শিক্ষক উৎকৃষ্টতর শিক্ষা লাভ করিয়াছেন, কাহারও-বা স্বাভাবিক শিক্ষাক্ষমতা অপরের চেয়ে বেশি। কিন্তু সকলের পক্ষেই উত্তম শিক্ষকের নিকট শিক্ষা লাভ করা অসম্ভব। সর্বোচ্চ শিক্ষাও সকলের জন্যই অপপ্রয়োগ করিয়া বলা চলে, যেহেতু উচ্চশিক্ষা লাভ সকলের পক্ষে সম্ভবপর নহে অতএব কাহাকেও ইহা দেওয়া উচিত নয়! এইরূপ নীতি গৃহীত হইলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি রুদ্ধ হইয়া যাইবে এবং শত বৎসরের জন্য শিক্ষার সাধারণ স্তর নিচে নামিয়া যাইবে। বর্তমান মুহূর্তে Mechanical equality-র বা যান্ত্রিক সমতার জন্য অগ্রগতি ব্যাহত করা উচিত হইবে না। সামাজিক অবিচারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকিলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবান সুফল ও সম্ভাব্যতা যথাসম্ভব কম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকতা আনয়ন করিতে হইবে। অত্যন্ত সতর্কতার সহিত এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক।

শিক্ষাব্যবস্থা যদি সর্বজনীন অর্থাৎ সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য না হয়। তবে তাহাকে সন্তোষজনক বলা চলে না। অর্থশালী লোকের ছেলেদের পরিচর্যার জন্য তাহাদের জননী ছাড়া ধাত্রী, পরিচারিকা ও অন্যান্য ভৃত্য থাকিতে পারে। কিন্তু যে কোনো রূপ সমাজব্যবস্থাতেই সকল ছেলেমেয়ের প্রতি এইরূপ যত্ন ও পরিচর্যার বিধান করা অসম্ভব। অতিরিক্ত আদর ও তত্ত্বাবধানের ফলে শিশুকে যে কোনো সামান্য কাজের জন্য পরমুখাপেক্ষী করিলে ইহার ফল ভাল হয় কি না সে বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ আছে। কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি ক্ষীণমনা [Feeble minded] কিংবা অসাধারণ প্রতিভাবান এই দুই শ্রেণির অস্বাভাবিক বালক বালিকা ছাড়া অন্যের জন্য এরূপ পরিচর্যার ব্যবস্থা অনুমোদন করিবেন না। বর্তমান যুগে বিজ্ঞ পিতা তাঁহার ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য সর্বজনীন নয় এমন কোনো শিক্ষণ-পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে অবলম্বন করিতে পারেন। এইরূপ পরীক্ষা সত্যই বাঞ্ছনীয়, তবে ইহা এরূপ হওয়া চাই যাহাতে সে-পদ্ধতি ফলপ্রদ হইলে যেন সকলের জন্য প্রয়োগ করা সম্ভবপর হয়; ইহা যেন কেবল অল্পসংখ্যক ভাগ্যবানের জন্যই সীমাবদ্ধ না রাখিতে হয়। সৌভাগ্যের কথা এই যে, বর্তমান যুগের শিক্ষাতত্ত্ব ও প্রণালীর কতক উৎকৃষ্ট উপাদান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হইতে পাওয়া গিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ম্যাডাম মন্তেসরি বস্তি অঞ্চলের শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাহার পরীক্ষামূলক কাজ আরম্ভ করিয়াছিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণ প্রতিভাবান ছাত্রের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করিতেই হইবে কিন্তু যেরূপ শিক্ষা সকল ছাত্রই গ্রহণ করিতে পারে, তাহা হইতে কাহাকেও বঞ্চিত করার কোনো সঙ্গত কারণ থাকিতে পারে না।

আধুনিক শিক্ষার আরও একটি বিতর্কমূলক প্রবণতা আছে; ইহাও গণতন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি হইল শিক্ষাকে আলঙ্কারিক করার চেয়ে কার্যকরি করার আন্দোলন। ভেবেলেনের Theory of the Leisure Class পুস্তকে আলঙ্কারিক [Ornamental] শিক্ষার সঙ্গে আভিজাত্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয় সুস্পষ্টভাবে দেখানো হইয়াছে। শিক্ষার উপর এই সম্বন্ধের প্রভাব পড়িয়াছে, শুধু তাহাই আমাদের বিবেচ্য। বালকদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিতর্কের বিষয় হইল প্রাচীন সাহিত্যিক শিক্ষা না আধুনিক কার্যকরি এবং কোনটি গৃহীত হওয়া উচিত? বালিকাদের শিক্ষায় ভদ্রমহিলার আদর্শ এবং বালিকাদিগকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা–এই দুইটির মধ্যে আদর্শগত সংঘর্ষ চলিতেছে। কিন্তু যেখানেই শিক্ষার সঙ্গে বালিকাদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সেখানেই স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে সমতা [Sex equal ity] বিধানের চেষ্টা দ্বারা সমগ্র শিক্ষার সমস্যাকে বিকৃত করা হইয়াছে। বালকদিগকে যে শিক্ষা দেওয়া হইতেছে তাহা সন্তোষজনক নয় ইহা বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও বালিকাদিগকেও বালকদের অনুরূপ শিক্ষাদানের চেষ্টা হইতেছে। ফল হইতেছে এই যে, স্ত্রী-শিক্ষাবিদগণ বালকদের শিক্ষার মতো অকেজো শিক্ষাও বালিকাদিগকে দিতে চেষ্টিত এবং বালিকাদের যে মাতৃত্বের জন্য বিশেষ টেকনিক্যাল শিক্ষার দরকার আছে এ ধারণার ঘোরতর বিরোধী হইয়া উঠিয়াছেন। শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে এইরূপ আন্তঃপ্রবাহী বিপরীতমুখি স্রোত সমস্যাকে জটিলতার করিয়া তুলিয়াছে; তবে একটি শুভ লক্ষণ এই যে দ্রমহিলা তৈয়ারি করা সময়ে স্ত্রী-শিক্ষার যে আদর্শ ছিল তাহা এখন পরিত্যক্ত হইয়াছে। পরস্পরের সঙ্গে জড়াইয়া ফেলিয়া সমস্যাটিকে জটিলতর না করিবার উদ্দেশ্যেই এখন আলোচনা শুধু বালকদের শিক্ষাক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখা হইতেছে।

নানা প্রশ্নসঙ্কুল অনেক বিতর্কমূলক বিষয় বর্তমান প্রশ্নের উপর নির্ভর করিতেছে। বালকেরা কি কেবল প্রাচীন সাহিত্যই অধ্যয়ন করিবে অথবা কেবল বিজ্ঞান অধ্যয়ন করিবে? এ প্রসঙ্গে বিবেচ্য এই যে, প্রাচীন সাহিত্য আলঙ্কারিক শিক্ষার অঙ্গ এবং বিজ্ঞান প্রয়োজনীয় বিষয়। কোনো ব্যবসা বা বৃত্তি অবলম্বনের জন্য কি যথাশীঘ্র সম্ভব বালককে টেকনিক্যাল শিক্ষা দিতে হইবে? এখানেও প্রয়োজনীয় এবং আলঙ্কারিক শিক্ষার কথা ওঠে। বালকদিগকে কি বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও মনোজ্ঞ আচরণে অভ্যস্ত করিতে হইবে, না এগুলি কেবল আভিজাত্যের চিহ্ন বলিয়া বিবেচিত হইবে? শিল্পী ভিন্ন অন্যের নিকট শিল্পের রসবোধের কোনো মূল্য আছে কি? উচ্চারণ অনুসারে কি ইংরাজি বানান ঠিক করা উচিত? আলঙ্কারিক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্বন্ধে বিতর্কে এইরূপ বহু বিতণ্ডার অবতারণা করা চলে।

তথাপি এই সমগ্র বিতর্কই আমার নিকট অবাস্তব বলিয়া মনে হয়। সংজ্ঞাগুলি নির্ধারণ করিতে গেলেই বিতর্ক হাওয়ায় মিলাইয়া যায়। যদি প্রয়োজনীয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে এবং আলঙ্কারিক শব্দ সংকীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা করা যায় তবে এক পক্ষ প্রাধান্য লাভ করে, আবার বিপরীতভাবে ব্যাখ্যা করিলে অন্যপক্ষ প্রধান মনে হয়। ব্যাপক এবং প্রকৃত অর্থে একটি কাজ তখনই প্রয়োজনীয় বলা চলে যখন ইহাতে সুফল পাওয়া যায়। এই সুফলগুলি শুধু প্রয়োজনীয় বা কার্যকরি বলিয়াই নয়, অন্যান্য দিক হইতে বিবেচনা করিলেও ভালো বলিয়া বিবেচিত হওয়া চাই। নতুবা ইহার যথার্থ সংজ্ঞা নির্দেশ করা যায় না। আমরা এ কথা বলিতে পারি না যে, প্রয়োজনীয় কাজ তাহাকেই বলা চলে যাহার ফল হয় কার্যকরি। কার্যকরি বা প্রয়োজনীয় কাজের সারকথা হইল ইহাই যে, ইহার ফল শুধু কার্যকরিই নয়। শেষ পর্যন্ত কাজের ফল ভাল হইল কি না তাহা জানিবার জন্য পরপর সাজানো কতকগুলি কাজ ও তাহার ফল লক্ষ্য করিতে হইবে। লাঙল প্রয়োজনীয়, কেননা ইহা দ্বারা মাঠ চাষ করা হয়। শুধু মাটি ভাঙার জন্যই চাষ করার কোনো সার্থকতা নাই। ইহা উপকারী এ জন্য যে, ইহার ফলে জমি বীজ বুনিবার যোগ্য হয়। বীজ বপন করা প্রয়োজনীয় কাজ, যেহেতু ইহার ফলে শস্য উৎপন্ন হয়। শস্য প্রয়োজনীয়, কারণ ইহা হইতে প্রস্তুত হয় খাদ্য। খাদ্য প্রয়োজনীয়। কারণ ইহা জীবন রক্ষা করে, কিন্তু জীবনের নিজস্ব মূল্য থাকা উচিত। জীবন যদি কেবল অন্য জীবনের উপায় স্বরূপ হয় তবে ইহাকে মোটেই প্রয়োজনীয় বলা যায় না। অবস্থাভেদে জীবন ভালো এবং মন্দ হইতে পারে; কাজেই ভালো জীবনের উপায়স্বরূপ হইল প্রয়োজনীয় কোন কাজ কি জন্য প্রয়োজনীয় ইহা অনুসরণ করিতে করিতে শেষ পর্যন্ত একটি স্থানে উপনীত হইতে হয় যেখান হইতে কার্য পরম্পরার সমগ্র শৃঙ্খলটি লম্বিত। প্রয়োজনীয় কথাটিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করিলে শিক্ষা প্রয়োজনীয় মনে করিতে হইবে কি-না সে প্রশ্ন উঠে না। শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজনীয় বিবেচিত হইবে, কেননা শিক্ষাদান ব্যাপারটি কাম্য উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্যলাভের উপায় মাত্র। প্রয়োজনীয় [Useful] বা কার্যকরি শিক্ষার সমর্থকগণ কিন্তু ঠিক এভাবে চিন্তা করিতেছেন না। তাহারা চাহিতেছেন শিক্ষার ফলও কার্যকরি হউক। কথাটিকে স্থূলভাবে প্রকাশ করিলে এইরূপ দাঁড়ায় : তাঁহারা (কার্যকরি শিক্ষার সমর্থকগণ) বলিবেন, যে যন্ত্র তৈরি করিতে পারে সেই শিক্ষিত লোক। যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যন্ত্রের প্রয়োজন কি? উত্তর হইবে ইহা দ্বারা মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। এবং দেহের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জিনিসপত্র প্রস্তুত করা যায়–যেমন খাদ্য, বস্ত্র, গৃহ ইত্যাদি। কাজেই দেখা যায় এইরকম কার্যকরি শিক্ষার পক্ষপাতী ব্যক্তি কেবল দেহের সন্তোষ সম্পাদনের উপর মূল্য দেন; যাহা দেহের প্রয়োজন ও অভিলাষ মিটাইতে পারে কেবল তাহাই তাঁহার নিকট প্রয়োজনীয়।

কার্যকরি শিক্ষা বলিতে কেহ যদি এইরূই মনে করেন এবং এই অভিমত প্রচার করেন তবে তাহাকে নিশ্চয়ই ভ্রান্ত বলিতে হইবে। তবে যখন অনাহারে লোক মরিতেছে, তখন রাজনীতিক হিসাবে তাঁহার অভিমত ঠিক হইতে পারে কেননা বর্তমান মূহুর্তে জীবনধারণণাপযোগী জিনিসের প্রয়োজন অন্য যে কোনো জিনিস অপেক্ষা বেশি।

এই বিতর্কের অপর দিক আলোচনা করিতেও অনুরূপ বিস্তৃত দরকার। এই দিকটিকে আলঙ্কারিক বলিলে প্রয়োজনীয় শিক্ষার সমর্থকদিগের অভিমত এই রকম মানিয়া লওয়া হয়। কারণ আলঙ্কারিক বলিতে কমবেশি তুচ্ছ জিনিসকেই বোঝায়। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা বলিতে মধ্যযুগীয় ধারণার প্রতি আলঙ্কারিক সংজ্ঞা প্রয়োগ করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ভদ্রলোক বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলিতেন, উপযুক্ত ক্ষেত্রে কথাপ্রসঙ্গে প্রাচীন সাহিত্য হইতে কোন্ কোন্ অংশ উদ্ধৃত করিতেন, ফ্যাশন করিয়া পোশাক পরিতেন, আদবকায়দা ভালোমতো বুঝিতেন এবং প্রশংসা অর্জনের জন্য কখন দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করা উচিত তাহা জানিতে।

অতি সংকীর্ণ অর্থে তাঁহার শিক্ষা আলঙ্কারিক হইয়াছিল কিন্তু আমাদের যুগে কোনো ধনবান ব্যক্তিই তাঁহার মতো ভব্যতায় সন্তুষ্ট হইবেন না। প্রাচীন অর্থে আলঙ্কারিক শিক্ষার আদর্শ হইল অভিজাত [Aristocratic]। ইহা বলিতে এমন এক শ্রেণির লোক বুঝায় যাহাদের অর্থ আছে প্রচুর, কাজ করার প্রয়োজন নাই। ভদ্রলোক এবং চমৎকার ভদ্রমহিলাদের কাহিনী ইতিহাসের মনোজ্ঞ বিষয়বস্তু বটে; তাদের আত্মচরিত এবং পল্লির বাসভবন আমাদিগকে আনন্দ দান করে অথচ আমরা তাহা আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য রাখিয়া যাইতে পারিলাম না। কিন্তু তাহাদের চমৎকারিত্ব চরম ছিল বলিয়া মনে করিবার কোনো কারণ নাই, তথাপি ইহার জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণে খরচ করিতে হইত। হগার্থের Ginlane পুস্তক পাঠে আলঙ্কারিক শিক্ষার জন্য কিরূপ খরচ করিতে হইত যে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যায়। বর্তমান যুগে এই সংকীর্ণ অর্থে কেহই আলঙ্কারিক শিক্ষার সমর্থন করিবেন না।

কিন্তু প্রকৃত সমস্যা তাহা নয়। আসল প্রশ্ন হইলঃ সাক্ষাত্তাবে কার্যকরি হয় এমন জ্ঞানদানই কি আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হইবে, না ছাত্রদিগকে মানসিক সম্পদ দানের চেষ্টা করিতে হইবে? বারো ইঞ্চিতে এক ফুট এবং তিন ফুটে এক গজ ইহা জানা প্রয়োজনীয় কিন্তু এই জ্ঞানের কোনো অন্তঃস্থিত মূল্য [Intrinsic value) নাই। যেখানে মেট্রিক প্রণালী প্রচলিত সেখানে তো তাহা একেবারেই অকেজো। পক্ষান্তরে (কাহারও পক্ষে তাহার খুল্লতাতকে হত্যা করার বিরল ঘটনা ছাড়া) হ্যামলেট নাটকের রস উপলব্ধি করার ক্ষমতা দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের কোনো কাজে লাগিবে না। কিন্তু ইহা মানুষকে এমন মানসিক সম্পদ দান করে যাহা হইতে বঞ্চিত হওয়া তাহার পক্ষে আপসোসের বিষয়। এই মানসিক সম্পদই তাহাকে একজন চমৎকার মানুষে পরিণত করিতে পারে। যিনি মনে করেন কার্যকরি জ্ঞানই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তিনি এই ধরনের মানসিক সম্পদ বা ক্ষমতার পক্ষপাতী।

কার্যকরি শিক্ষার সমর্থক ও তাহাদের বিরুদ্ধপক্ষে বিতর্কের তিনটি মূল সমস্যা জড়িত আছে। প্রথমত, অভিজাত ও গণতন্ত্রবাদীদের মধ্যে বিরোধে অভিজাতগণ মনে করেন যে, অধিকারপ্রাপ্ত [Priviledged] শ্রেণির জন্য শিক্ষা এমন হইবে যেন তাহারা অবসর সময় আরামে বিলাস যাপন করিতে শিক্ষা পায় এবং নিম্নশ্রেণির লোকদিগকে এমন শিক্ষা দিতে হইবে যেন তাহারা অন্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় কাজে তাহাদের দৈহিক শ্রম নিয়োজিত করিতে পারে। এই মতের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রবাদীরা যে অভিমত পোষণ করেন তাহা কতকটা অস্পষ্ট এবং ঘোলাকে। অভিজাতদের পক্ষে অকেজো শিক্ষা তাহারা অপছন্দ করেন কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে, দিনমজুরদের শিক্ষা যেন কেবল কার্যকরি শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা না হয়। কাজেই বিলাতের পাবলিক স্কুলে প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রদত্ত সাহিত্য প্রধান শিক্ষার বিরোধিতা দেখিতে পাই; আবার সেই সঙ্গে এ দাবিও উত্থাপিত হইয়াছে যে, মজুরদের গ্রিক ও ল্যাটিন শিক্ষার জন্য যেন সুযোগ দান করা হয়। এই নীতির মধ্যে সামান্য অস্পষ্টতা থাকিলেও মূলে সত্য আছে। গণতন্ত্রবাদীরা সমাজকে একটি প্রয়োজনীয় এবং অন্যটি আলঙ্কারিক বা প্রয়োজনীয় এই দুই ভাগে ভাগ করিতে চান না। কাজেই তাঁহারা আলঙ্কারিক শ্রেণিকে অধিক পরিমাণে কেবল কার্যকরি শিক্ষা এবং এ যাবৎ প্রয়োজনীয় শ্রেণিকে অধিক পরিমাণে কেবল আনন্দদায়ক শিক্ষার দিবার পক্ষপাতী। এই দুইটি উপাদান-কার্যকরি শিক্ষা ও আলঙ্কারিক শিক্ষা–কি পরিমাণে মিশাইতে হইবে গণতন্ত্র তাহা নির্ধারণ করিবে।

দ্বিতীয় সমস্যা হইল দু দল লোকের মধ্যে মতবিরোধ। ইহাদের একদল মনে করেন কেবল সংসারের প্রয়োজন মিটানোই শিক্ষার উদ্দেশ্য, অন্য দল শিক্ষার মারফত কেবল মানসিক আনন্দলাভেই পক্ষপাতী। যদি ধনশালী আধুনিক ইংরাজ ও আমেরিকাবাসীদিগকে কোনো জাদুবিদ্যার সাহায্যে এলিজাবেথের যুগে লইয়া যাওয়া যায় তবে স্যার ফিলিপ সিডনির সমাজ, চিত্তহারী সঙ্গীত এবং স্থাপত্যের সৌন্দর্য বর্তমানকালের বাথরুম, চা, কফি, মোটরগাড়ি এবং অন্যান্য বিলাসের উপকরণের অভাব মিটাইতে পারিবে না। নেহাত গোঁড়া সংস্কারে দ্বারা প্রভাবান্বিত না হইলে এরূপ লোকের অধিকাংশের ধারণা এই যে, উৎপাদিত জিনিসের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য বাড়ানোই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। তাহারা ঔষধ এবং স্বাস্থ্যবিদ্যা শিক্ষার অন্তর্গত করিতে পারেন কিন্তু সাহিত্য, শিল্প বা দর্শন সম্বন্ধে তাহাদের কোনো উৎসাহ নাই। রেনেসাঁ যুগে যে সাহিত্যপ্রধান পাঠ্য তালিকা প্রবর্তিত হইয়াছিল তাহার উপর আক্রমণ চালাইতে এরূপ লোকই অগ্রণী হইয়াছেন।

দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য অপেক্ষা মানসিক সম্পদেরই যে মূল্য বেশি শুধু একথা দ্বারা এ দাবি ঠেকানো যাইবে না। এ কথার ভিতর সত্যতা আছে কিন্তু ইহাই সবখানি সত্য নয়। কারণ দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্যের মূল খুব বেশি না হইলেও ইহার অভাব দেহধারণের জন্য যাহা প্রয়োজন তাহার অভাব–মানুষের মানসিক গুণরাশি নষ্ট করিয়া ফেলিতে পারে। যখন হইতে মানুষ দূরদৃষ্টি লাভ করিয়াছেন, তখন হইতেই খাদ্যাভাব, রোগ এবং ইহাদের চিরজাগরুক ভীতি বহু মানুষের উপর আশঙ্কার ছায়াপাত করিয়াছে। খাদ্যের অভাবে বহু পাখি মরিয়া যায় কিন্তু ইহাদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা নাই বলিয়া যখন খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে তখন ইহারা সুখি। যে সকল কৃষক একবার দুর্ভিক্ষ কাটাইয়া উঠিয়াছে তাহারা খাদ্যাভাবের ভীতিজনক-স্মৃতি কিছুতেই মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারে না।

মৃত্যুবরণ করার চেয়ে মানুষ বরং সামান্য অর্থের জন্যও বহুক্ষণ পরিশ্রম করিতে ইচ্ছুক কিন্তু ইতর প্রাণী কোনো সাময়িক সুখের মূল্যস্বরূপ মৃত্যুবরণ করিতে হইলেও ক্ষণস্থায়ী সুখই পছন্দ করে। তাই দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই প্রায় নিরানন্দ জীবন-যাপন করে; কারণ সুখের আশায় অন্য কোনো প্রকারে জীবন-যাপন করিতে গেলে জীবনকাল হইবে সংক্ষিপ্ত। শিল্পবিপ্লবের দৌলতে বর্তমান যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সকল মানুষের জন্য অনন্ত কিছু পরিমাণে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিধান করা সম্ভবপর। আমরা ইচ্ছা করিলে মানুষের দৈহিক দুঃখের কিছুটা লাঘব করিতে পারি। বিজ্ঞানের সাহায্যে এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা দ্বারা পৃথিবীর সকল মানুষের খাদ্য এবং বাসগৃহের বন্দোবস্ত করিয়া বিলাসিতার মধ্যে না হউক, মোটামুটিভাবে বাঁচিবার ব্যবস্থা করা যায়। রোগ নিবারণ করা এবং স্বাস্থ্যহীনতা দূর করা সম্ভব হইতে পারে; জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা রাখিয়া খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেশি করা চলিতে পারে; মানুষের অবচেতন মন হইতে নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার এবং যুদ্ধের ভীতি দূর করা যাইতে পারে। মানুষের জীবনে এ সবের এত প্রয়োজন যে, যে-শিক্ষার দ্বারা ইহা লাভ করা সম্ভবপর তাহার বিরোধিতা করা চলে না। এরূপ শিক্ষার ফলিত বিজ্ঞান প্রাধান্য লাভ করিবে। পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা এবং মনোবিজ্ঞান ছাড়া আমরা নূতন জগৎ গড়িতে পারি না; বরং ল্যাটিন ও গ্রিক সাহিত্য দান্তে এবং শেক্সপিয়র, ব্যাক এবং মোজার্ট ছাড়া চলিতে পারে। কার্যকরি শিক্ষার স্বপক্ষে ইহাই একটি বড় যুক্তি। বিশেষভাবে অনুভব করি বলিয়াই আমি ইহা জোরের সঙ্গে উল্লেখ করিতেছি। তথাপি এ প্রশ্নের অন্য একটি দিকও আছে। যদি অবসর এবং স্বাস্থ্য ভালোভাবে কাজে লাগানোর উপায় জানা না থাকে তবে এগুলি অর্জনের সার্থকতা কোথায়? অন্যান্য ক্ষেত্রে যুদ্ধের মতোই মানুষের দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে অভিযান এমন কঠোরভাবে চালানো উচিত নয় যাহাতে শান্তির সময় অবসর বিনোদনের শিক্ষা ব্যাহত হয়, জগতের কল্যাণকর সামর্থ্যটুকু যেন সবখানিই কেবল দুঃখ-কষ্ট জয় করার সংগ্রামে ব্যয়িত না হয়।

আমরা এখন বিতর্কের বিষয়ীভূত তৃতীয় পক্ষে উপনীত হইয়াছি। ইহা কি সত্য যে কেবল অকেজো শিক্ষাই প্রকৃতপক্ষে মূল্যবান? ইহা কি সত্য যে যে কোনো মূল্যবান শিক্ষাই অকেজো? আমার নিজের কথা বলিতে পারি, আমি যৌবনের অনেকখানি সময় ল্যাটিন ও গ্রিক শিক্ষায় অতিবাহিত করিয়াছি। এখন মনে হয় সে-সময়ের অপচয় হইয়াছে। পরবর্তী জীবনে আমি যে-সব সমস্যার সম্মুখিন হইয়াছি গ্রিক ও ল্যাটিন শিক্ষা আমাকে তাহা সমাধান করিতে কোনো হায়তা করে নাই। যাহারা প্রাচীন-সাহিত্য পড়ে তাহাদের শতকরা ৯৯ জনের মতোই আমি ওইসব ভাষায় এমন যোগ্যতা অর্জন করি নাই যাহাতে সে-ভাষায় সাহিত্য পাঠ করিয়া আনন্দ লাভ করিতে পারি।

পক্ষান্তরে গণিত ও বিজ্ঞানের যাহা কিছু আমি শিখিয়াছিলাম তাহা কেবল অবশেষ কাজেই লাগে নাই, চিন্তার বিষয়বস্তু এবং এই প্রবঞ্চনাময় সংসারে সত্যের কষ্টিপাথর হিসাবেও তাহাদের মূল্য অপরিসীম। ইহা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত খেয়াল হইতে পারে কিন্তু আমার বিশ্বাস এই যে, প্রাচীন সাহিত্য পাঠ দ্বারা উপকৃত হইতে পারেন এরূপ খেয়ালযুক্ত লোকের সংখ্যা আধুনিকদের মধ্যে খুবই কম। ফ্রান্স ও জার্মানিরও উন্নত সাহিত্য আছে; তাহাদের ভাষা সহজেই শিক্ষা করা যায় এবং অনেক প্রকারে ব্যবহারিক কাজেও লাগে। কাজেই ল্যাটিন ও গ্রিক সাহিত্যের চেয়ে ফরাসি ও জার্মানি সাহিত্যের পক্ষে বলিবার অনেক কিছু আছে। যাহা কিছু, সাক্ষাভাবে কার্যকরি নয়, এরূপ শিক্ষার গুরুত্ব না কমাইয়াও দাবি করা চলে যে, বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যদের বেলায় ব্যাকরণের খুঁটিনাটি ও মারপ্যাঁচ বাদ দিয়া শিক্ষা দেওয়া উচিত। মানুষের জ্ঞানের পরিমাণ এবং মানবীয় সমস্যার জটিলতা দিন-দিনই বাড়িতেছে। কাজেই নূতনকে গ্রহণ করিতে হইলে প্রত্যেক প্রজন্মেই [Generation-এ] শিক্ষাব্যবস্থা ঢালিয়া সাজাইতে হইবে। নূতন এবং পুরাতনের মধ্যে বোঝাঁপড়া ও সামঞ্জস্যের সাহায্যে সমতা রক্ষা করিতে হইবে। সাহিত্য সম্বন্ধীয় উপাদান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই থাকিবে তবে তাহাদের জটিলতা কমাইয়া এমন করিতে হইবে যেন আধুনিক যুগ সৃষ্টি করিয়াছে যে-বিজ্ঞান তাহা শিক্ষার জন্য যথেষ্ট সময় ও সুযোগ থাকে।

আমার অভিমত ইহা নয় যে, সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক শিক্ষা কার্যকরি শিক্ষা অপেক্ষা কম মূল্যবান। শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান, বিশ্বের ইতিহাস, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান, কল্পনাশক্তি বাড়াইবার জন্য একান্ত আবশ্যক। কেবল কল্পনাশক্তির সাহায্যেই মানুষ ভবিষ্যতের জগৎ কেমন করিয়া গড়িতে হইবে তাহার পরিকল্পনা করিতে পারে; ইহা বাদ দিলে উন্নতি কেবল যান্ত্রিকভাবে অকিঞ্চিৎকর হইয়া পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞানও কল্পনার উদ্রেক করিতে পারে। বাল্যকালে কোনোরকম রস উপলব্ধি করিতে না পারিলেও আমাকে বাধ্য হইয়া ইংল্যান্ড, ফান্স ও জার্মানির অনেক উৎকৃষ্ট সাহিত্য পাঠ করিতে হইয়াছে; কিন্তু ইহার চেয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূতত্ত্বই এ বিষয়ে আমার খোরাক জোগাইয়াছে। ইহা ব্যক্তিগত ব্যাপার; একজন বালক-বালিকা এক বিষয় হইতে অনুপ্রেরণা লাভ করিবে, অন্যে হয়তো অন্য বিষয় হইতে তাহা পাইবে। আমার বক্তব্য এই যে, যাহারা বিশেষজ্ঞ হইতে চায় তাহাদের কথা বাদ দিলে যেখানে কোনো বিষয় জানিতে হইলে কঠিন কৌশল আয়ত্ত করিতে হয় সেখানে শিক্ষণীয় বিষয়টি কার্যকরি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। রেনেসাঁসের যুগে আধুনিক ভাষায় খুব কম সাহিত্য ছিল। এখন হইয়াছে অনেক। যাহারা গ্রিক ভাষা জানে না তাহাদের নিকটও গ্রিক ঐতিহ্য পৌঁছাইয়া দেওয়া যায়। ল্যাটিন ঐতিহ্যের মূল্য খুব বেশি নয়। কাজেই বালক-বালিকার সাহিত্যের প্রতি বিশেষ ঝোঁক না থাকিলে সেক্ষেত্রে তাদের সংস্কৃতিমূলক শিক্ষা সংক্ষিপ্ত আকারে সহজভাবে দেওয়াই আমার ইচ্ছা; পরবর্তী বয়সে শিক্ষার কঠিন অংশটুকু আমি গণিত ও বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিতে চাই। তবে কাহারও অন্য বিষয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখা গেলে তাহার পক্ষে ওই অবস্থার ব্যতিক্রম করা হইবে। সর্বোপরি, ছাঁচে ঢালা নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থা বর্জন করিতে হইবে! কি ধরনের জ্ঞানদান করিতে হইবে এতক্ষণ আমরা এই আলোচনা করিতেছি। নৈতিক শিক্ষা এবং চরিত্রের শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যা লইয়া এখন আলোচনা শুরু করিব। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সংস্রব নাই, মনোবিদ্যা এবং নীতিতত্ত্বই আমাদের বিবেচ্য। অল্প কিছুদিন পূর্বেও মনোবিদ্যা কেবল পুঁথিগত বিদ্যা বলিয়া বিবেচিত হইত। এ ক্ষেত্রে ইহার কোনো প্রয়োগ ছিল না। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। এখন শিল্প, মনোবিজ্ঞান, রোগীর মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আমাদের বিশেষ বাস্তবক্ষেত্রে কাজে লাগিতেছে। আমরা আশা করিতে পারি যে, অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যায়তনে মনোবিজ্ঞান যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিবে। ইতোমধ্যেই শিক্ষার ক্ষেত্রে অনন্ত ইহা ব্যাপক এবং সুফল দান করিয়াছে।

প্রথমে শৃঙ্খলার প্রশ্নটি বিবেচনা করা যায়। শৃঙ্খলা সম্বন্ধে পুরনো ধারণা ছিল সরল ও সহজ। বালক যাহা অপছন্দ করিত তাহা তাহাকে করিতে হুকুম করা হইত কিংবা সে যাহা ভালোবাসিত তাহা হইতে বিরত হইতে আদেশ দেওয়া হইত। আদেশ অমান্য করিলে দৈহিক শাস্তি এবং গুরুতর ক্ষেত্রে কেবল জলরুটি দিয়া নির্জন কুঠুরিতে বন্দি করিয়া রাখা হইত। উদাহরণস্বরূপ The Fairchild Family পুস্তকে ছোট বালক হেনরিকে কিভাবে ল্যাটিন শিখানো হইয়াছিল তাহার বিবরণ দেখিতে পারেন। তাহাকে বলা হইয়াছিল ল্যাটিন না শিখিলে কিছুতেই ভালো ধর্মযাজক হইতে পারিবে না। কিন্তু কিছুতেই সে তাহার পিতার আগ্রহ অনুযায়ী মনোযোগ দেয় নাই। ফলে তাহাকে ছোট্ট একটি কুঠুরিতে আটক করিয়া রাখা হইল। দেওয়া হইল শুধু জল আর রুটি। তাহার ভগিনীদিগের সহিত তাহার কথা বলা নিষিদ্ধ হইল। তাহাদিগকে বলা হইল যে হেনরি ভগবানের নিকট অপরাধী হইয়াছে। ইহা সত্ত্বেও এক ভগিনী হেনরিকে গোপনে খাবার দিয়াছিল। ধরা পড়িয়া সে-ও শান্তি পাইল। কিছুকাল বন্দি থাকার পর নাকি ল্যাটিনের প্রতি হেনরির অনুরাগ জন্মে এবং ইহার পরেও অধ্যবসায় সহকারে কাজ করিতে থাকে।

ইহার বিপরীত একটি গল্প শেহর বলিয়াছেন। তাঁহার কাকা একটি বিড়ালের বাচ্চাকে ইঁদুর ধরা শিখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহারই গল্প। যেখানে বিড়ালের বাচ্চাটি ছিল সেখানে একটি ইঁদুর লইয়া আসা হয়। কিন্তু তখনও বিড়ালের শিকার করার প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় নাই, কাজেই সেই ইঁদুরের দিকে মনোযোগ দেয় না। ইহাতে শেহরের কাকা বিড়াল বাচ্চাটিকে প্রহার করেন। পরের দিন এই একই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইল। ক্রমাগত অনেক কয়দিন এইরূপ চলিতে লাগিল। অবশেষে অধ্যাপক মনে করিলেন বিড়ালটি অত্যন্ত বোকা এবং শিক্ষাদানের সম্পূর্ণ অযোগ্য। পরবর্তীকালে বিড়াল অন্যান্য বিষয়ে স্বাভাবিক হইলেও ইঁদুর দেখিলে ভয়ে কাঁপিতে থাকিত এবং ছুটিয়া পলাইত। শেহর বলিয়াছেন– বিড়াল-বাচ্চাটির মতোই আমারও কাকার নিকট হইতে ল্যাটিন শিখিবার ভাগ্য হইয়াছিল। এই দুইটি গল্প হইতে শাসনের প্রাচীন পদ্ধতি এবং ইহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিচয় পাওয়া যায়।

কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদ শৃঙ্খলা বর্জন করেন না; নূতন প্রণালীর সাহায্যে তিনি ইহা প্রবর্তন করেন। এ সম্বন্ধে যাঁহারা নূতন প্রণালীর বিষয় পড়েন নাই তাঁহারা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করিতে পারেন। পূর্বে আমার ধারণা ছিল মাদাম মন্তেসরি শৃঙ্খলার বালাই তুলিয়া দিয়াছেন। কিভাবে তিনি ঘরভরা ছেলেমেয়ে লইলা কাজ করেন ভাবিয়া আমি বিস্মিত হইতাম। তাঁহার নিজের লেখা পুস্তক পড়িয়া আমি বুঝিতে পারি শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা তিনি বিসর্জন দেন নাই, ইহা বরং তাঁহার শিক্ষাপ্রণালীর একটি বিশিষ্ট অংশ। আমার তিন বৎসর বয়স্ক ছেলেকে সকালবেলা করিয়া মন্তেসরি স্কুলে পাঠাইয়া বুঝিতে পারিলাম সে অল্প সময়ের মধ্যে নিয়মানুবর্তী হইয়া পড়িয়াছে, স্কুলের নিয়মকানুন সে হৃষ্টচিত্তেই মানিয়া চলিতেছে। ইহার জন্য কোনোরূপ বাহিরে তাগিদ বা তাড়না ছিল না; নিয়মকানুনগুলি খেলার নিয়মের; নিজেরা ইচ্ছা করিয়া কিছু শিখিতে চাহে না, ভয় দেখাইয়া জোর করিয়া তাহাদের শিখাইতে হয়। প্রমাণিত হইয়াছে যে শিক্ষাদান ব্যাপারে কৌশলের অভাবই ইহার কারণ। শিক্ষণীয় বিষয়টিকে যেমন পড়া ও লেখা–কয়েকটি সুবিধাজনক পর্যায়ে ভাগ করিয়া লইয়া প্রত্যেকটি পর্যায় শিশুর নিকট আকর্ষণীয় করা যায়। শিশুরা যখন নিজেদের পছন্দমতো কাজ করিতে সুযোগ পায়, তখন বাহির হইতে শৃঙখলা চাপাইয়া দেওয়া প্রয়োজন হয় না। কয়েকটি সরল নিয়ম সকলেই বুঝিতে পারে এবং ন্যায্য বলিয়া স্বীকার করিয়া মানিয়া চলে ইহা হইল—কোনো শিশু অন্যের খেলায় বা কাজে বাধা দিবে না। কোনো শিশুই এক সঙ্গে এক প্রস্তের বেশি খেলার সরঞ্জাম রাখিবে না। শিশু এইভাবে সদভ্যাসে অভ্যস্ত হয় এবং বুঝিতে পারে যে কোনো ভালো ফল লাভ করিতে হইলে অনেক সময়ে প্রবৃত্তিকে দমন করা আবশ্যক। এইভাবে শিশু আত্মসংযম বা আত্মশৃঙ্খলা অর্জন করে।

সকলেই জানেন যে, খেলার ভিতর দিয়া এইরূপ শৃঙ্খলা আয়ত্ত করা সহজ কিন্তু কেহ অনুমান করিতে পারেন নাই যে, জ্ঞান অর্জন ব্যাপারটিকেই এমন আনন্দপ্রদ করা যায় যে ইহার মধ্যেও সে ভাব সঞ্চারিত হয়। আমরা জানি যে, ইহা সম্ভব এবং কেবল শিশুর শিক্ষার বেলায় সম্ভব নয়, সকল স্তরের শিক্ষাতেই সম্ভব। আমি বলিতে চাই না যে কাজটি সহজ। নূতন প্রণালীর উদ্ভাবন করিতে প্রতিভার প্রয়োজন হইয়াছে কিন্তু সাধারণ শিক্ষকগণই ইহার প্রয়োগ করিতে পারে। ইহার জন্য প্রয়োজন সহানুভূতি, ধৈর্য এবং শিক্ষাদানের জন্য যথোপযুক্ত ট্রেনিং। মূলগত ভাবটি সরলঃ বাহির হইতে তাড়না বা জবরদস্তি করিয়া প্রকৃত শৃঙ্খলা গড়িয়া তোলা যায় না। প্রকৃত শৃঙ্খলা হইল মনের এমন একটি অভ্যাস যাহা স্বভাবতই অবাঞ্ছনীয় কার্যকলাপের দিকে না ঝুঁকিয়া বাঞ্ছনীয় কাজ ও আচরণের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শিক্ষাদান ব্যাপারে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ সত্যিই বিস্ময়কর। ইহার জন্য সবখানি প্রশংসা মাদাম মন্তেসরির প্রাপ্য।

মূল পাপ [Original sin] সম্বন্ধে বিশ্বাস লোপ পাওয়ার ফলে শিক্ষা প্রণালীর বহুলাংশে প্রভাবান্বিত হইয়াছে। পুরাতন ধারণা ছিল শিশুমাত্রই পাপ হইতে উদ্ভূত। এরা স্বভাবতই দুষ্ট; তাহার ভিতর সদগুণের সঞ্চার করিতে ঘন ঘন শাস্তি বিধান করিতে হইবে। আমাদের পূর্বপুরুষের শিক্ষা এই ধারণা দ্বারা কিরূপ প্রভাবিত হইয়াছিল তাহা অধিকাংশ আধুনিকগণ বিশ্বাস করিতে পারিবেন না। ডিন স্ট্যানলি [Dean Stanley] লিখিত Dr. Amold-এর জীবনী হইতে উদ্ধৃত দুইটি অংশ তাহাদের ভ্রম দেখাইয়া দিবে।

ডিন স্ট্যানলি ডক্টর আর্নল্ডের প্রিয় ছাত্র ছিলেন Tom Browns School Days পুস্তকের তিনি সুবোধ বালক আর্থার। তিনি বর্তমান লেখকের খুল্লতাত ভ্রাতা; বাল্যকালে তিনি লেখককে Westminster Abbey ঘুরিয়া দেখাইয়াছিলেন। ডক্টর আর্নল্ড ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলগুলির একজন বড় সংস্কারক। এই স্কুলগুলি ইংল্যান্ডের গৌরব এবং এখনও পর্যন্ত তাহার নীতি অনুসারেই পরিচালিত হইতেছে। কাজেই ডক্টর আর্নল্ডের আলোচনা করিতে গিয়া বহু অতীতের কোনো প্রণালী বর্ণনা করিতেছি না, বর্তমানে উচ্চশ্রেণির ইংরেজদের গড়িয়া তুলিতেছে যে শিক্ষাপ্রণালী তাহারই আলোচনা করিতেছি। ডক্টর আর্নল্ড বেত মারার প্রথা হ্রাস করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবনীকারের কথায় মিথ্যা কথা বলা, পানদোষ এবং স্বভাবত কুঁড়েমির জন্য অল্পবয়স্ক ছেলেদের মধ্যে বেত্রাঘাত প্রথা সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিলেন। কোনো উদারনৈতিক পত্রিকা যখন মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, বেত্রাঘাত অবনতিকর শাস্তি এবং ইহা একেবারে বন্ধ করা উচিত, তখন ডক্টর আর্নল্ড অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি লিখিতভাবে উত্তর দিয়াছিলেন :

ইহা কোন ভাবের পরিচায়ক তাহা আমি জানি; ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের গর্ববোধ হইতে ইহা উদ্ভূত; ইহা যুক্তিসঙ্গত নয়, কোনো খ্রিস্টানের পক্ষে উপযুক্ত নয়, ইহা একান্তই বর্বর। শিভালরির যুগের অভিসম্পাতসহ ইহা ইউরোপে এক সময় সংক্রামিত হইয়াছিল; এখন জ্যাকোবিনিজিমের অভিসম্পাত স্বরূপ ইহা আমাদের দেশে উপস্থিত হইয়াছে।

…. যে বয়সে দোষ বা অপরাধের দরুন অপমান বোধ করিবার পুরুষোচিত অনুভূতির সন্ধান পাওয়া প্রায় অসম্ভব, তখন ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টাকে শিশুর আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর এইরূপ অযৌক্তিক ও হাস্যকর ধারণাকে উৎসাহ দিয়া বাড়াইয়া তোলার মধ্যে জ্ঞানের পরিচয় কোথায়? যুবকের পক্ষে যাহা অলঙ্কারস্বরূপ এবং মনুষ্যত্ব গঠনের সম্ভাবনায় যাহা পূর্ণ সরলতা, সংযম এবং মানসিক নম্রতার পক্ষে ইহার চেয়ে আর কি বেশি অপরাধী এবং প্রতিকূল হইতে পারে?

ভারতের অধিবাসীরা যদি এই মানসিক নম্রতা দেখাইতে না পারে তবে যে ডক্টর আর্নল্ডের শিষ্যের ছাত্ররা তাহাদিগকে ঠেঙাইতে উৎসাহী হইবে তাহাতে অস্বাভাবিকতা নাই।

মিঃ স্ট্রাচি Eminent Victorians পুস্তকে আরও একটি অংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেটি উল্লেখ করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না। ডক্টর আর্নল্ড কোনো হ্রদের তীরে ছুটি যাপন করিতে গিয়াছিলেন। সেখানকার সৌন্দর্য দেখিয়া তাহার মনের আনন্দ কি ভাবের উদ্রেক করিয়াছিল সে সম্বন্ধে তিনি পত্নিকে বলিয়াছিলেন।

আমার চতুর্দিকে মনোরম প্রাকৃতিক শোভা দেখিয়া এবং নৈতিক অপরাধের কথা চিন্তা করিয়া স্তম্ভিত হইতে হয়। মনে হয় স্বর্গ এবং নরক যেন পরস্পর হইতে বহু দূরে নয়; যেন পাশাপাশি আমাদেরই চারিদিকে আসিয়া মিশিয়াছে। সৌন্দর্য দেখিযা মনে যেমন উল্লাস জাগিয়াছে; নৈতিক অপরাধ সম্বন্ধেও তেমনি তীব্র ভাব যদি মনে জাগিত! কেননা অন্য সব কিছুর চেয়ে নৈতিক অপরাধ সম্বন্ধেও তীব্র মনোভাবেই প্রাতকি উদ্ধারকারী ঐশ্বরিক জ্ঞান বিরাজ করে। নৈতিক সদকার্যের প্রশংসা করাই বড় কথা নয়; কিন্তু ঐরূপ কাজ না করিয়াও আমরা প্রশংসা করিতে পারি। আমরা যদি পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা করি, বিশেষ করিয়া আমাদের অন্তরস্থিত পাপকে ঘৃণা করি তবেই যিশু এবং ঈশ্বরের অনুভূতি লাভ করিতে পারি ইহাই ঈশ্বরলাভের পন্থা। হায়, ইহা দেখা এবং বলা কত সহজ এবং কাজে পালন করা এবং অনুভব করা কত কঠিন। ইহার যোগ্য কে? যে নিজের অপূর্ণতা সম্বন্ধে সচেতন এবং ইহার জন্য দুঃখ করে সে ছাড়া আর কেহ নয়। ঈশ্বর তোমাকে এবং আমাদের প্রিয় সন্তানদিগকে আশীর্বাদ করুন।

এই সহানুভূতিশীল ভদ্রলোকে আত্মশোচনার কশাঘাতে জর্জরিত হইতে দেখিয়া সত্যই দুঃখ হয়। প্রেমধর্মের নীতি অনুসারেই কাজ করিতেছেন এই ধারণার বশে তিন নির্বিকার চিত্তে শিশুদের উপর বেত্রচালনা করিয়াছেন। এই ভ্রান্ত ব্যক্তির কথা চিন্তা করিলে মনে ব্যথা অনুভব করিতে হয়। কিন্তু নৈতিক অপরাধের প্রতি ঘৃণা জাগাইয়া তুলিয়া তিনি যে কত নির্দয় লোক তৈয়ার করিয়াছিলেন তাহা চিন্তা করিলে মর্মাহত হইতে হয়; মনে রাখিতে হইবে শিশুদের স্বভাবগত আলস্যও তাহার মতে নৈতিক অপরাধের অন্তর্গত। নৈতিক অন্যায়ের শাস্তিবিধানের সদিচ্ছার বশবর্তী হইয়া কত সৎ প্রকৃতির লোক যে যুদ্ধ এবং অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী হইয়াছেন তাহা চিন্তা করিয়া শিহরিয়া উঠিতে হয়। সৌভাগ্যের কথা এই যে শিক্ষাবিদগণ এখন আর শিশুকে শয়তানের অংশ বলিয়া মনে করেন না। বয়স্ক ব্যক্তি সম্বন্ধে বিশেষত অপরাধীর শাস্তিদানকালে এই ধারণার প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু শিশু-নিকেতন এবং বিদ্যালয় হইতে ইহা প্রায় অন্তর্হিত হইয়াছে।

ডক্টর আর্নল্ড যে ভুল করিয়াছিলেন তাহার বিপরীত একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। ইহা কম হানিকর হইলেও বৈজ্ঞানিক দিক হইতে বিচার করিলে ভুল বটেই। ইহা হইল এই ধারণা যে শিশুরা স্বভাবত নিষ্পাপ, তাহারা কেবল তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের পাপাঁচরণ দেখিয়া দূষিত হয়। রুশোর নামের সঙ্গে এই অভিমত জড়িত। হয়তো তিনি ইহা সূত্রাকারে প্রচার করিয়াছিলেন কিন্তু তাহার এমিল [Emole] পাঠ করিলে জানা যায় যে অনেক রকমে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার পর ছাত্রটি আদর্শ শিক্ষা পদ্ধতির অভিপ্রেত সর্বগুণে ভূষিত হয়। প্রকৃত কথা হইল যে, শিশু স্বভাবতই ভালো বা মন্দ নয়। তাহারা কতকগুলি প্রতিবর্তী [Reflex] এবং প্রবৃত্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করে। পরিবেশের ফলে ইহা হইতেই স্বভাব গঠিত হয়। স্বভাব [Habit] সুস্থও হইতে পারে, অসুস্থও হইতে পারে। কিরূপ স্বভাব হইবে তাহা প্রধানত নির্ভর করে জননী অথবা ধাত্রীর জ্ঞানের উপর, কারণ শিশুর স্বভাব প্রথম অবস্থায় অত্যন্ত নমনীয় থাকে। অধিকাংশ শিশুর মধ্যেই সৎ নাগরিকের উপাদান থাকে, আবার অপরাধীর উপাদানও থাকে। বৈজ্ঞানিক মনোবিদ্যা প্রমাণ করে যে, সপ্তাহের মধ্যে ছয়দিন চাবুক এবং রবিবারের ধর্মোপদেশ প্রয়োগ করা সগুণ বিকাশের আদর্শ প্রক্রিয়া নয়। কিন্তু ইহা অনুমান করা ঠিক হইবে না যে, গুণ বিকাশের কোনো উপায় বা প্রণালী নাই। পূর্ববর্তী শিক্ষাবিদগণ শিশুদিগের উপর অত্যাচার করিয়া আনন্দ পাইতেন। সামুয়েল বাটলারের এই অভিমত উড়াইয়া দেওয়া যায় না। অন্যথায় তাহাদের অনুষ্ঠিত এইরূপ নিরর্থক অত্যাচারের সার্থকতা দেখা যায় না। একটি সুস্থ শিশুকে সুখি করা কঠিন নয়। দেহ এবং মনের যত্ন লইলে বেশিরভাগ শিশুরই সুখস্বাচ্ছন্দ্য একান্ত আবশ্যক। শিশুর যে স্বভাবগত আলস্যকে ডক্টর আর্নল্ড নৈতিক অপরাধ বলিয়া গণ্য করিতেন তাহা মোটেই থাকিবে না যদি শিশু বুঝিতে পারে যে যাহা তাহাকে শিখানো হইতেছে তাহা সত্যই এবং যাহারা শিক্ষা দিবেন তাঁহারা যদি হন নিষ্ঠুর অত্যাচারী তবে শিশু স্বভাবতই শহরের বিড়ালছানার মতো আচরণ করিবে। সুস্থ শিশুর হাঁটিবার এবং কথা বলিবার প্রয়াস হইতে বোঝা যায় তাহাদের শেখার জন্য একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা আছে। এই ইচ্ছাটাকে শিক্ষার কাজে লাগাইতে হইবে। চাবুকের স্থলে শিশুর এই স্বাভাবিক ইচ্ছার প্রবর্তন যুগের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি পরিচায়ক।

এই পুস্তকে যে আধুনিক ভাবধারার আলোচনা করিতে চাই তাহার শেষ প্রশ্নে উপনীত হইয়াছি–অধুনা বাল্যকালের উপর অধিকতর মনোযোগ দেওয়া হইতেছে আমি তাহারই উল্লেখ করিতেছি। চরিত্রের শিক্ষা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পরিবর্তনের সঙ্গে ইহার নিবিড় যোগ আছে। প্রাচীন ধারণা ছিল ইচ্ছার উপর গুণ নির্ভর করে; মনে করা হইত যে শিশুর মন কু-ইচ্ছা দ্বারা পূর্ণ, কেবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সে ইহাদিগকে দমন করিয়া রাখে। সকল কু-ইচ্ছা সমূলে দূর করা অসম্ভব বলিয়া মনে করা হইত; শিশু কেবল ইহাদিগকে সংযত রাখিতে পারে মাত্র। এই অবস্থাকে ঠিক অপরাধী ও পুলিশের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা চলে। ভাবী অপরাধী ছাড়া যে-সমাজ চলিতে পারে তাহা কেহ অনুমান করিতে পারিত না; অধিকাংশ লোক যাহাতে শাস্তির ভয়ে অপরাধ না করে এবং অপরাধীরা ধরা পড়ে এবং শাস্তি পায় এমন গোছের তৎপর পুলিশ দল রাখিতে পারিলেই যথেষ্ট মনে করিত। বর্তমানের মনস্তাত্ত্বিক অপরাধবিজ্ঞানী কিন্তু ইহাতে সন্তুষ্ট নন। তিনি মনে করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষা দ্বারা অপরাধ করার প্রবণতা দূর করা সম্ভবপর। সমাজের পক্ষে যাহা প্রযোজ্য, ব্যক্তির কাছেও তাহা প্রযোজ্য। শিশুরা বিশেষ করিয়া তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সঙ্গীদের প্রশংসা পাইতে ইচ্ছুক হয়; তাহারা যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বাড়িয়া ওঠে সেই পরিবেশ অনুসারে তাহাদের প্রবৃত্তিগুলিকে ভালো বা মন্দ দিকে চালিত করা যায়। অধিকন্তু তাহাদের বয়সে অভ্যাস-গঠন করা সহজ এবং সদভ্যাস দ্বারা অনেক গুণ স্বভাবে পরিণত হইতে পারে। পক্ষান্তরে, মনের শক্তি দ্বারা কু-ইচ্ছা (অসৎ বাসনা) দমন করিয়া অসৎ আচরণ কমাইবার যে প্রক্রিয়া পূর্বে প্রচলিত ছিল তাহা মোটেই সন্তোষজনক নয়। বাঁধ দেওয়া নদীর জলের মতো অসৎ বাসনা ইচ্ছা শক্তির অজ্ঞাতসারে কোনো প্রকারে আত্মপ্রকাশ করে। যৌবনে যে যুবক পিতাকে হত্যা করার বাসনা মনে পোষণ করিত, পুত্রকে নৈতিক অন্যায়ের শাস্তি দিতেছে মনে করিয়া সে তাহাকে বেত্রাঘাত করিয়া তৃপ্তি অনুভব করে। যে সকল মতবাদ নিষ্ঠুরতা সমর্থন করে তাহাদের মূল অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে, কোনো বাসনা ইচ্ছা শক্তি দ্বারা নিপীড়িত হইয়া লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল কিন্তু অবশেষে ইহাই পাপের প্রতি ঘৃণা কিংবা এমনই কোনো ভদ্র-রূপ ধারণা করিয়া সম্পূর্ণভাবে অচেনারূপে বাহির হইয়াছে। কাজেই ক্ষেত্রবিশেষে ইচ্ছাশক্তি দ্বারা পাপ-ইচ্ছার দমন প্রয়োজনীয় হইলেও গুণবিকাশের প্রণালী হিসাবে ইহা কার্যকরি নয়।

এই প্রসঙ্গ আমাদিগকে মনঃসমীক্ষার ক্ষেত্রে লইয়া আসে। মনঃসমীক্ষার মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যাহা অযৌক্তিক এবং প্রমাণসহ নয়। কিন্তু ইহার সাধারণ প্রণালী আমার নিকট বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে হয়। নৈতিক শিক্ষার সঠিক পদ্ধতি রচনায় ইহা একান্ত আবশ্যক। অনেক মনঃসমীক্ষক শৈশবের প্রথম অবস্থার উপর যতখানি গুরুত্ব আরোপ করেন তাহা আমার নিকট অতিরিক্ত বলিয়া মনে হয়; তাহার অনেক সময়ে বলেন শিশুর বয়স তিন বৎসর হইতে হইতেই তাহার চরিত্র কেমন হইবে তাহা পাকাপাকিভাবে স্থির হইয়া যায়। আমার বিশ্বাস এরূপ কখনও হইতে পারে না। তবে মনঃসমীক্ষকের অভিমতের এই যে মাত্রাধিক্য তাহা ভুল হইলেও যাহা সত্য তাহার দিকেই। অতীতে মনোবিজ্ঞান উপেক্ষিত হইয়াছিল; কার্যত বুদ্ধিবৃত্তি প্রধান [Intellectualist] যে প্রণালী তৎকার্যে প্রচলিত ছিল তাহার কল্যাণে ইহার প্রসার সম্ভবও ছিল না। ঘুমের কথাটি ধরা যাক। সকল মাতাই চান তাহাদের শিশুরা ঘুমাইয়া থাকুক কারণ ইহা তাহাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী এবং মেয়েদের পক্ষেও সুবিধাজনক। ইহার জন্য তাঁহারা এক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করিয়াছিলেন–দোলনায় দোল দেওয়া এবং ঘুমপাড়ানি গান গাওয়া। পুরুষেরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করিয়া আবিষ্কার করিয়াছেন যে, এই প্রণালী আদর্শের দিক দিয়া অপকারী; কারণ কোনো একদিন ইহার ফল পাওয়া গেলেও ইহা খারাপ অভ্যাস গঠন করে। প্রত্যেক শিশুই চায় তাহাকে সবাই খুব সমাদর করুক, কারণ ইহা দ্বারা তাহার অহমিকার ভাব তৃপ্ত হয়। যদি সে বুঝিতে পারে যে, না ঘুমাইলেই সে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখন সে এই পন্থাই অবলম্বন করিবে। ইহার ফলে তাহার স্বাস্থ্য ও চরিত্রের পক্ষে হানিকর হইবে। এখানে প্রধান বিষয় হইল অভ্যাস গঠন–বিছানার সঙ্গে ঘুমের সহযোগ [Association] স্থাপন। এই সহযোগ যথার্থভাবে স্থাপিত হইলে রুগ্ন কিংবা যন্ত্রণাবোধ করিতে না থাকিলে শিশু জাগিয়া থাকিবে না। কিন্তু এই সহযোগ স্থাপন করিতে হইলে কিছু শৃঙ্খলাবিধানের প্রয়োজন; কেবল আদর দিয়া ইহা গড়িয়া তোলা যাইবে না; কেননা তাহা জাগিয়া থাকিতেই উৎসাহ দেয়। অন্য ভাল এবং মন্দ অভ্যাস গঠনের ব্যাপারেও এই বিষয়ে বিবেচনা করিতে হইবে। মনোবিজ্ঞানের এই দিকটির এখনও শৈশব অবস্থা কিন্তু ইহার গুরুত্ব ইতোমধ্যে যথেষ্ট বাড়িয়াছে এবং আরও সঙ্গেই আরম্ভ হইবে; ধাত্রী এবং অজ্ঞ জননীদের অনেক কার্যকলাপ এবং অভ্যাসের পরিবর্তন আবশ্যক। ইহাও স্পষ্ট যে, পূর্বে যে-সময়ে শিক্ষাদানের উপযুক্ত কাল বিবেচিত হইত, তাহা অপেক্ষা আগেই শিক্ষা আরম্ভ করা চলে; কারণ এই শিক্ষা আনন্দপ্রদ হইলে শিশুকে মনোযোগ-শক্তির উপর জুলুম করিতে হইবে না। এই বিষয়ে আধুনিক যুগে শিক্ষাতত্ত্বে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে, ইহার যে সুফল পাওয়া গিয়াছে তাহা দিন-দিন বাড়িয়াই চলিবে। কাজেই পরের অধ্যায়ে শিশুর পরবর্তীকালীন শিক্ষা কিরূপ হইবে তাহা আলোচনা করার পূর্বে বাল্যকালে শিশুর চরিত্র গঠনের শিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব।

০২. শিক্ষার লক্ষ্য

কিভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তাহা আলোচনা করিবার পূর্বে বরং শিক্ষা হইতে কিরূপ ফল আশা করি সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। ডক্টর আর্নল্ড চাহিয়াছিলেন মনের নম্রতা; অ্যারিস্টটলের মহানুভব মানবের [Mag nanimous man] মধ্যে কিন্তু এ গুণ দেখা যায় না। নিসের আদর্শ আর খ্রিস্টধর্মের আদর্শ এক নয়; ক্যান্টের আদর্শের সঙ্গেও ইহার মিল নাই; খ্রিস্টধর্মের প্রেমধর্মের উপর জোর দিয়াছেন; ক্যান্ট বলেন, যে কাজের মূল উৎস প্রেম তাহা কখনও সাধু কাজ হইতে পারে না। ভালো চরিত্রগঠনে কি কী উপাদান প্রয়োজন সে বিষয়ে একমত হইলেও কোন উপাদান কি পরিমাণে থাকা দরকার সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে। একজন হয়তো সাহসকে প্রাধান্য দিবেন, অন্য একজন জ্ঞানার্জনের উপর জোর দিবেন; অপর কেহ দয়া এবং কেহ বা সত্যবাদিতাকেই প্রধান মনে করিবেন। প্রথম ব্রুটাসের মত কেহ হয়তো পারিবারিক স্নেহ-প্রীতি অপেক্ষা দেশের প্রতি কর্তব্যকেই সর্বপ্রধান কাম্য বলিয়া মনে করিবেন; আবার কেহ হয়তো কনফুসিয়াসের [Confucius] মতো পরিবারের প্রতি স্নেহপ্রীতিকেই সকলের উপর স্থান দিবেন। এই সব পার্থক্যের দরুন শিক্ষার মধ্যেও পার্থক্য ঘটিবে। কোন ধরনের শিক্ষা সর্বোৎকৃষ্ট তাহা স্থির করিবার পূর্বে শিক্ষাদীক্ষা দিয়া আমরা কি রকম মানুষ প্রস্তুত করিতে চাই সে সম্বন্ধে আমাদের ধারণা থাকা একান্ত আবশ্যক।

অবশ্য শিক্ষাবি যেরূপ লোক প্রস্তুত করিতে ইচ্ছা করেন সব সময়েই যে সেরূপ পারেন তাহা নয়। কখনও বা হয়তো আদর্শের বিপরীত লোক প্রস্তুত হয়; যেমন চ্যারিটি স্কুলে [Charity School] বিনয় শিক্ষার ফলে Uriah Heep-এর মতো লোক তৈয়ারি হইয়াছিল। কিন্তু মোটের উপর সক্ষম শিক্ষাবিদগণ তাঁহাদের উদ্দেশ্য সাধনে বহুল পরিমাণে কৃতকার্য হইয়াছে; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চীনের শিক্ষাবিদগণ, আধুনিক জাপানের শিক্ষাব্রতীবৃন্দ, জেসুইটগণ, ডক্টর আর্নল্ড এবং মার্কিন শিক্ষার পরিচালকগণ। ইহারা সকলেই ইঁহাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করিয়াছেন। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ইহাদের কাম্য লক্ষ্য অপরের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হইতে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল, তবু ফললাভ করিয়াছেন সকলেই। শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য কি হওয়া উচিত তাহা স্থির করিবার পূর্বে এই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রণালী আলোচনা করিলে আমরা লাভবান হইবে পারিব।

চীনের চিরাচরিত শিক্ষাপদ্ধতি কোনো কোনো বিষয়ে এথেন্সের গৌরবময় যুগের শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ অনুরূপ। এথেন্সবাসী বালকদিগকে হোমারের কবিতা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করিতে হইত। চীনা বালকদিগকে দেবদেবিকে শ্রদ্ধা করিতে শিখিত। এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন কতকগুলি আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিত, তাহাদের বুদ্ধিমূলক উচ্চ-চিন্তায় কোনো প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিত না। ঠিক এমনিভাবে চীনারা তাহাদের পূর্বপুরুষের পূজা [Ancestor-worship] সংক্রান্ত কতকগুলি রীতিনীতি শিক্ষা করিত; কিন্তু শিক্ষিত বয়স্ক যে ইহা বিশ্বাস করিবে এরূপ আশা করা হইত না : যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করা চলিতে পারে কিন্তু কোনো স্থির নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া হীন কাজ বলিয়াই বিবেচনা করা হইত। অভিমত বা মতবাদ এমন হওয়া চাই যেন তাহা লইয়া ভোজের আসরে মনোজ্ঞ আলোচনা করা চলে, যেরূপ মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষ যুদ্ধ করতে কুণ্ঠিত হয় না সেরূপ হওয়ার দরকার নাই। কার্লাইল [Carlyle] প্লেটোকে বলিয়াছেন তিনি জিয়নে আরামে বিরামে আসীন একজন সম্ভ্রান্ত এথেনীয়ন ভদ্রলোক। এই আরাম এবং বিলাসের মধ্যে আসীন থাকার বৈশিষ্ট্য চীন ঋষিদের মধ্যেও বিদ্যমান কিন্তু খ্রিস্টান জ্ঞানীদের মধ্যে এই ভাব দেখা যায় না। অবশ্য গেটের মতো গ্রিক সভ্যতা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত লোকদের মধ্যে ইহার ব্যতিক্রম হইয়াছে। এথেন্সবাসী এবং চীনাদেশবাসী উভয়েই জীবনকে উপভোগ করিতে চাহিয়াছিল; তাহাদের জীবনে উপভোগের ধারণা শোভন সৌন্দর্যবোধ দ্বারা মণ্ডিত হইয়াছিল।

এই দুইটি সভ্যতার মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। তাহার প্রধান কারণ-গ্রিকরা উদ্যমশীল এবং সকল কাজে উৎসাহী আর চীনারা অলস। গ্রিকরা তাহাদের শক্তি, শিল্প, বিজ্ঞান এবং আত্মধ্বংসী কলহে নিয়োজিত করিয়াছিল। এ সকল ক্ষেত্রেই তাহারা অপূর্ব সাফল্য লাভ করিয়াছিল। রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম অবলম্বন করিয়া গ্রিকদের শৌর্য আত্মপ্রকাশ করিত : স্বদেশ হইতে বিতাড়িত হইলে রাজনৈতিক নেতারা নির্বাসিত লোকদের লইয়া দল গঠন করিয়া নিজেদের দেশ আক্রমণ করিত। চীনা কর্মচারী কর্মচ্যুত হইলে পাহাড় অঞ্চলে নির্জনবাস করিতে যাইত এবং পল্লীর সুখসৌন্দর্য সম্বন্ধে কবিতা লিখিত। এইভাবে গ্রিক সভ্যতা আত্মঘাতী হইয়াছিল, কিন্তু চীনা সভ্যতা কেবল বাহিরের শত্রু কর্তৃকই ধ্বংস হইতে পারে। অবশ্য এই পার্থক্যের জন্য, কেবল শিক্ষাকেই দায়ী করা চলে না; কেননা কনফুসিয়াসের মতবাদ জাপানে প্রবর্তিত হইলেও সেখানে শুধু কিয়াটোদের অভিজাত সম্প্রদায় ছাড়া অন্যদের মধ্যে চীনাদের মতো শিক্ষিত, সভ্য এবং অলস তার্কিকদল সৃষ্টি করে নাই।

চীনা শিক্ষার ফল হইয়াছে পরিবর্তনবিমুখতা [Stadility] এবং শিল্পের প্রসার। ইহা প্রগতি কিংবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুফল প্রদান করে নাই। অলস তার্কিকতা যেখানে প্রাধান্য লাভ করে সেখানে ফলাফল বোধহয় এইরূপই হইয়া থাকে। দৃঢ় জীবন্ত বিশ্বাস উন্নতির পথে লইয়া যায়, আর না হয় বিপদ টানিয়া আনে, অচলায়তনের মধ্যে জাতিকে বদ্ধ রাখে না। মানুষের বিশ্বাস যেখানে শিথিল সেখানে বিজ্ঞান প্রসার লাভ করিতে পারে না, কারণ বিজ্ঞান প্রচলিত কুসংস্কারের মূলে আঘাত করে বটে কিন্তু ইহার উপরও তো দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রাখা চাই! আধুনিক বিজ্ঞান পৃথিবীর দেশগুলিকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনিয়াছে; যুদ্ধসঙ্কুল বিশ্বের জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শক্তি ও শৌর্যের প্রয়োজন আছে; এবং বিজ্ঞান ছাড়া গণতন্ত্র অসম্ভব। চীন সভ্যতা অল্পসংখ্যক শিক্ষিত লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; গ্রিক সভ্যতা দাস প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এইজন্য, চীনদেশের চিরাচরিত শিক্ষা বর্তমান যুগের উপযোগী নয় বলিয়া চীনগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াছে। এই একই কারণে অষ্টাদশ শতাব্দীর চীনা সংস্কৃতিবান অভিজাতগণও অপ্রয়োজনীয় হইয়া পড়িয়াছেন।

বিশ্বের সকল বৃহৎ শক্তির মধ্যে যে-ভাবের প্রাধান্য দেখা যায় আধুনিক জাপানে তাহার সুস্পষ্ট উদাহরণ মিলিবে। এভাবে হইল জাতীয় উন্নতিকে শিক্ষার সর্বপ্রধান লক্ষ্য বলিয়া গ্রহণ করা। জাপানি শিক্ষার উদ্দেশ্য হইল অধিবাসীদের প্রবৃত্তিগুলিকে যথাযথভাবে ট্রেনিং দিয়া রাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত নাগরিক তৈয়ার করা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে লাগে এমন জ্ঞান দান করা। যেরূপ কৌশলে এই দুইটি উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা হইয়াছে তাহার প্রশংসা করিয়া শেষ করা যায় না। কমোডোর পেরি যখন যুদ্ধজাহাজ লইয়া জাপানের উপকূলে উপনীত হইয়াছিলেন তখন হইতে জাপানে আত্মরক্ষার সমস্যাটি বড় এবং কঠিন হইয়া রহিয়াছে। এ বিষয়ে জাপানিদের সাফল্য তাহাদের শিক্ষাব্যবস্থারই সাফল্য প্রমাণ করে; নতুবা আত্মরক্ষাকে অপরাধ বলিয়া গণ্য করিতে হয়। জাতি যেখানে আসন্ন বিপদের সম্মুখিন, সেখানেই কেবল এইরূপ শিক্ষাব্যবস্থা সমর্থন করা যায়, অন্যত্র ইহা অচল। শিন্টো ধর্ম এমনভাবে রক্ষিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পর্যন্ত ইহার সমালোচনা করার বা প্রশ্ন করার অধিকার নাই; ইহার ইতিহাস বাইবেলের জেনেসিস [Genesis] অধ্যায়ের মতোই সংশয়জনক। জাপানে ধর্মের নামে যে অত্যাচার হইয়াছে তাহার পাশে ডেটন [Day ton]-এর বিচার ম্লান হইয়া পড়ে। সেখানে নীতিগত অত্যাচারও চলিয়াছে অনুরূপভাবে। জাতীয়তা, সন্তানবাৎসল্য, মিকোডো পূজা প্রভৃতি সম্বন্ধে কাহারও কোনোরূপ বিরূপ সমালোচনা করার উপায় নাই। কাজেই নানা বিষয়ে উন্নতির পথও রুদ্ধ। এইরূপ লৌহঘঁচে-ঢালা ব্যবস্থার বিপদ এই যে উন্নতির পন্থা হিসাবে ইহা বিপ্লব জাগাইয়া তোলে। ইহাই সত্যিকারের বিপদ এবং দ্রত না হইলেও শিক্ষাব্যবস্থাই ইহা ঘটায়।

এইভাবে দেখা যাইতেছে যে, প্রাচীন চীনে যে ত্রুটি ছিল আধুনিক জাপানে ঠিক তাহার বিপরীত ত্রুটি রহিয়াছে। চীনের শিক্ষাভিমানী ব্যক্তিরা ছিলেন অবিশ্বাসী এবং অলস; শিক্ষিত জাপানিরা নিজেদের অভিমতকে একেবারে অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস করে, কাজেও তাহাদের আদম্য উৎসাহে। সব কিছু সম্বন্ধেই অবিশ্বাসের ভাব পোষণ করা কিংবা সব কিছুতেই নিজের মত অভ্রান্ত বলিয়া মনে করা–ইহার কোনোটিই প্রকৃত শিক্ষার ফল হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। শিক্ষাকে এইরূপ বিশ্বাস উৎপাদন করিতে হইবে যে, কষ্টকর হইলেই কিছু পরিমাণ জ্ঞান অর্জন সম্ভবপর; এক সময় যাহা জ্ঞান বলিয়া মনে করা হয় অন্য সময় তাহা হয়তো কিছুটা ভুল হইতে পারে, কিন্তু ওই ভুল যত্ন ও পরিশ্রম দ্বারা সংশোধন করা যায়। যেখানে সামান্য একটু ভুলের ফলে বিপদ ঘটিতে পারে সেখানে। বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়াই আমাদিগকে কাজ করিতে হইবে। মনের এইরূপ অবস্থাপ্রাপ্তি কঠিন ব্যাপার; ইহার জন্য চাই ভাবাবেগ এবং উচ্চস্তরের বুদ্ধি প্রয়োগ! কঠিন হইলেও ইহা অসম্ভব নয়; কার্যত ইহাই বৈজ্ঞানিক স্বভাব বা মেজাজ। অন্যান্য ভালো জিনিসের মতোই জ্ঞানলাভ কঠিন; কিন্তু অসম্ভব নয়। অভ্রান্তবাদীরা ইহা মোটেই কঠিন মনে করে না, অবিশ্বাসীরা ইহার, সম্ভাব্যতাই বিশ্বাস করে না। এই দুই পক্ষই ভ্রান্ত; ইহাদের ভুল ব্যাপক হইলেই শুরু হয় সামাজিক বিপদাপদ।

আধুনিক জাপানিদের মতো জেসুইটগণও শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের জন্য নিয়োজিত করিয়া ভুল করিয়াছিলেন। তাঁহাদের এই প্রতিষ্ঠান ছিল ক্যাথলিক ধর্মসংঘ। তাহারা কোনো ছাত্রের ব্যক্তিগত কল্যাণ কামনা করিতেন না; ধর্মসংঘের প্রয়োজনে লাগে এমনভাবে তাহাকে গড়িয়া তোলাই ছিল তাঁহাদের উদ্দেশ্য। আমরা যদি তাঁহাদের মতবাদ গ্রহণ করি তবে তাহাদিগকে দোষ দিতে পারি না। তাহাদের ধর্মনীতি হইল–নরক হইতে একটি আত্মাকে উদ্ধার করা যে কোনো জাগতিক কাজ হতে শ্রেষ্ঠ এবং এই কাজ কেবল ক্যাথলিক ধর্মসংঘই করিতে পারে। যাহারা জেসুইটদের এই মতবাদ মানেন না, তাহারা ফলাফল দেখিয়া জেসুইট শিক্ষার বিচার করিবেন। এই শিক্ষার ফলে অনেক সময় Uriah Heep-এর মতো অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তৈয়ারি হইয়াছে। ভল্টেয়ারও জেসুইট শিক্ষার ফলস্বরূপ। মোটের উপর অনেক কাল ধরিয়া জেসুইট শিক্ষার ফল পাওয়া গিয়াছিল। বিরুদ্ধ সংস্কার আন্দোলন (Counter Reformation] এবং ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের বিলোপ জেসুইটদের শিক্ষার ফলেই সম্ভব হইয়াছিল। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁহারা শিল্পকে করিয়াছিলেন ভাবপ্রবণ, চিন্তাধারাকে করিয়াছিলেন ভাসা ভাসা, অগভীর এবং নীতিবোধকে করিয়াছিলেন শিথিল। অবশেষে তাঁহাদের এই কুফলের আবর্জনা ভাসাইয়া লইবার জন্য ফরাসিবিপ্লবের প্রয়োজন হইয়াছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে তাহাদের অপরাধ ছিল এই যে, ছাত্রের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা নয়, নিজেদের স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তাঁহারা পরিচালিত হইতেন।

ডক্টর আর্নল্ডের শিক্ষাপ্রণালী অদ্যাবধি ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলসমূহে প্রচলিত রহিয়াছে; ইহার একটি দোষ হইল যে ইহা আভিজাত্য গর্বে গর্বিত। এ শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল, কি স্বদেশের, কি সুদূর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক অংশে যাহারা উচ্চপদ ও ক্ষমতায় অধিকারী হইবেন এমন লোক তৈয়ার করা। অভিজাত সম্প্রদায়কে টিকিয়া থাকিতে হইলে কতকগুলি গুণের বিকাশ ঘটাইতে হয়; এইগুলি স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হইত। ফলে গড়িয়া উঠিল উদ্যমশীল, দৈহিক এবং নৈতিক শক্তিতে শক্তিমান, ধৈর্যশীল এবং অভিজাত সম্প্রদায়। তাহাদের মনে এমন এক ধারণা বদ্ধমূল হইল যে, তাহারা যাহা জানে তাহাই সত্য, তাহার কোনো পরিবর্তণ হইতে পারে না এবং তাহারা বিশ্বে কোনো মহৎ কার্য সম্পাদন করিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে! বিস্ময়করভাবে এই ফল ফলিয়াছিল। ইহার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকে বিসর্জন দিতে হইয়াছিল, কেননা বুদ্ধি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি করিতে পারে; তথাকথিত নিকৃষ্ট শ্রেণির বা জাতির লোকদের উপর শাসন করিতে গেলে সহানুভূতি প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিতে পারে। কাজেই সহানুভূতি বিসর্জন দেওয়া হইল, দ্র আচরণের পরিবর্তে দৃঢ়তার উপর জোর দেওয়া হইল। ইহাই হইল এ অভিজাত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য। জগৎ যদি পরিবর্তনশীল হইত তবে ব্রিটিশ অভিজাত সম্প্রদায়ে স্পাটার্নদের দোষগুণের অধিকারী হইয়া স্থায়িত্ব লাভ করিত। কিন্তু আভিজাত্যের দিন চলিয়া গিয়াছে, কোনো শাসিত জাতিই বিজ্ঞ এবং গুণশালী শাসককেও আর মানিতে চাহিবে না। ইহার ফলে শাসকগণ অত্যাচারী হইয়া ওঠেন; অত্যাচার বিদ্রোহের পথই সুগম করিয়া দেয়। বর্তমান বিশ্বের জটিল সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য ক্রমেই বেশি পরিমাণে বুদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু ডক্টর আর্নল্ড বুদ্ধিবৃত্তি বিসর্জন দিয়া তাহার ছাত্রদের মধ্যে কতকগুলি গুণের বিকাশ ঘটাইয়াছিলেন। ইটনের খেলার মাঠে যুদ্ধ জয় সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হারানোর সূচনাও হইয়াছিল ওইখানেই। বর্তমানে জগৎ অন্য ধরনের লোক চায়; এখন দরকার উদার কল্পনা ও সহানুভূতি, দরকার বুদ্ধিশক্তির নমনীয়তা; বুলডগের মতো একগুঁয়ে সাহসের পরিবর্তে যন্ত্র বিজ্ঞানের উপর বেশি আস্থার প্রয়োজন। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপরিচালককে স্বাধীন নাগরিকের সেবক হইতে হইবে, প্রশংসমান প্রজাবৃন্দের শাসক হইলে চলিবে না। ব্রিটিশ উচ্চশিক্ষার মধ্যে যে আভিজাত্যের ধারা বদ্ধমূল রহিয়াছে তাহাই হইয়াছে ইহার ধ্বংসের কারণ। হয়তো এই ঐতিহ্য ক্রমে ক্রমে দূর করা সম্ভব; হয়তো বা প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমানের প্রয়োজনের সঙ্গে নিজদিগকে খাপ খাওয়াইতে পারিবে না। এ সম্বন্ধে আমি কোনো অভিমত দিতে চাই না।

আমেরিকার পাবলিক স্কুল সাফল্যের সঙ্গে যে কাজ সম্পন্ন করিয়াছে তাহা পূর্বে কোথাও বিরাট আকারে করার চেষ্টা করা হয় নাই। ইহা বিভিন্ন জাতির কতক মানবগোষ্ঠীকে এক মহান জাতিতে পরিণত করা। আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপের নানা জাতির লোক এখানে উপনিবেশ স্থাপন করিতে আসে। নানা ভাষা, নানা জাতি, নানারূপ জাতীয় বৈশিষ্ট্য; ইহা সত্ত্বেও এই সকল লোকগোষ্ঠীকে এমন সুষ্ঠুভাবে এক জাতিতে পরিণত করা হইয়াছে যে, যাহারা ইহা করিয়াছেন তাহাদের কৃতিত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিতে হয়। কিন্তু জাপানের মতো আমেরিকার অবস্থাও স্বতন্ত্র, কাজেই অস্বাভাবিক অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করার ফলে কোনো নীতি কার্যকরি হইয়াছে বলিয়াই তাহা যে সর্বত্র সুফলপ্রদ এবং উপযোগী হইবে এমন কোনো কথা নাই। আমেরিকার কতকগুলি সুবিধা আছে, অসুবিধাও আছে। সুবিধাগুলি হইল ও অর্থের প্রাচুর্য, যুদ্ধে পরাজয় আশঙ্কা না থাকা, মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের হাত হইতে অব্যাহতি। বিভিন্ন দেশ হইতে উপনিবেশ স্থাপন করিতে যাহারা আসিয়াছিল তাহারা মার্কিন মুল্লুক জনসাধারণের মধ্যে গণতন্ত্রে অনুকূল মনোভাব এবং যান্ত্রিক সভ্যতার অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থা দেখিতে পায়, এই দুইটিই মনে হয় প্রধান কারণ যে জন্য প্রায় সকলেই নিজেদের জন্মভূমি অপেক্ষা আমেরিকার প্রশংসায় মুখর হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু নবাগত স্বদেশপ্রেম হইয়াছিল দ্বিমুখি: ইউরোপে যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে তাহারা ডিনজেদের আসল জন্মভূমির সমর্থক হইয়া পড়িত। পক্ষান্তরে তাহাদের সন্তানসন্ততির তাহাদের পূর্বপুরুষের মাতৃভূমির প্রতি কোনো দরদ নাই, তাহারা আমেরিকার অধিবাসীরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ইহাদের পিতামাতার যে মনোভাব তাহা মার্কিন মুলুকের সাধারণ গুণের ফলেই সম্ভব হইয়াছে; সন্তানসন্ততিবর্গের মনোভাব গড়িয়া তুলিয়াছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার ফলে কি হইয়াছে তাহাই আমাদের বিবেচনার বিষয়।

মার্কিন দেশের যে সব গুণ আছে তাহা শিক্ষার ভিতর দিয়া নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হইয়াছে। এক্ষেত্রে স্বদেশ ও প্রেমকে কোনো ভ্রান্ত আদর্শের সঙ্গে জড়িত করিয়া শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয় নাই। কিন্তু যেখানে প্রাচীন মহাদেশ ইউরোপ নূতন মহাদেশ আমেরিকা হইতে শ্রেষ্ঠ, সেখানে প্রকৃত ভালো জিনিসের প্রতিও অবজ্ঞার ভাব ছাত্রদের মনে গড়িয়া তোলা হয়। পশ্চিম ইউরোপে জ্ঞান ও শিক্ষার মান এবং পূর্ব ইউরোপের শিল্পের মান মোটের উপর আমেরিকার মান অপেক্ষা উচ্চ। স্পেন ও পর্তুগাল ছাড়া সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে ধর্ম সম্বন্ধীয় কুসংস্কার মার্কিন দেশ অপেক্ষা অনেক কম। ইউরোপের প্রায় সকল দেশেই ব্যক্তির উপর গোষ্ঠীর প্রভাব যেমন, মার্কিন দেশে তেমন বেশি নয়; এমনকি যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কম সেখানেও তাহার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা অনেক বেশি। এই বিষয়ে মার্কিন পাবলিক স্কুলগুলি বিশেষ ক্ষতিসাধন করে। অন্য সব কিছু বাদ দিয়া কেবল মার্কিনি স্বদেশপ্রেম শিক্ষা দেওয়াতেই ইহার উদ্ভব। জাপানি এবং জেসুইটদের মতোই এই অপকারের আসল কারণ হইল ছাত্রদের মঙ্গলের জন্যই তাহাদের শিক্ষা না দিয়া কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায়স্বরূপ তাহাদিগকে গড়িয়া তোলা। শিক্ষক তাঁহার রাষ্ট্র কিংবা ধর্মপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে ছাত্রকে বেশি ভালোবাসিবেন; তাহা না হইলে তিনি আদর্শ শিক্ষকই নহেন।

আমরা যদি বলি ছাত্র অর্থাৎ ছাত্রের কল্যাণই শিক্ষার চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত, ছাত্রকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায়রূপে ব্যবহার শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় তবে কেহ প্রত্যুত্তরে বলিতে পারেন কোনো উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই প্রত্যেকের প্রয়োজন, নতুবা তাহার সার্থকতা কি? একজন মানুষই যদি লক্ষ্য হয়, তবে তাহার মৃত্যুর সঙ্গেই সব লোপ পাইল কিন্তু উপায়স্বরূপ হইয়া সে যাহা কিছু উৎপন্ন করে তাহা তো টিকিয়া থাকে। এ তর্ক আমরা অস্বীকার করিতে পারি না। উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হিসাবে একজন মানুষ ভালো কাজে বা মন্দ কাজে লাগিতে পারে। মানুষের কাজের বহুদূরপ্রসারী শেষফল এত অনিশ্চিত যে, বিজ্ঞ লোকমাত্রই তাহা লইয়া মাথা ঘামাইতে চাহিবেন না। মোটামুটি বলিতে গেলে ভালো লোকের কাজ ভাল, খারাপ লোকের কাজ খারাপ, তবে ইহাও অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম নহে। একজন খারাপ লোক একজন অত্যাচারীকে হত্যা করিতে পারে; কারণ সে হয়তো এমন অপরাধ করিয়াছে যেজন্য অত্যাচারী শাসক তাহাকে শাস্তি দিতে চায়। যদিও সে নিজে এবং তাহার কাজ ভাল নয় তথাপি তাহার কাজের ফল ভালো হইতেও পারে। কিন্তু সাধারণ নিয়মে ইহাই দেখা যায় যে, যেখানে জনসাধারণ অজ্ঞ এবং অপকারী সেখানকার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট নরনারী সমন্বয়ে গঠিত মানব-সমাজে সুফল বেশি। ইহা ছাড়া কাহারা ছাত্রদের মঙ্গল কামনা করে, কাহারাই বা তাহাদিগকে কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায় বা কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে তাহা শিশু, কিশোর ও যুবকগণ সহজেই বুঝিতে পারে। শিক্ষক যদি ছাত্রের প্রতি মমতাহীন হন, তবে ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তি বা চরিত্র কোনোটিই সম্যক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে পারে না; একমাত্র শিশুর মঙ্গল কামনার মধ্যেই এরূপ মমতা নিহিত থাকে। আমাদের সকলেরই নিজের সম্বন্ধে এরূপ মমতা আছে; আমরা নিজের জন্য ভালো জিনিস কামনা করি কিন্তু ইহার দ্বারা যে কোন মহৎ কাজ সম্পন্ন হইবে এরূপ কোনো প্রমাণও আগে দেখিতে চাই না। প্রত্যেক স্নেহশীল জনক বা জননী তাহার সন্তানের জন্য এরূপই ভাবেন। তাহারা নিজেরা যেমন নিজেদের মঙ্গল কামনা করেন, তেমনি চান তাহাদের সন্তান সবল এবং স্বাস্থ্যবান হইয়া গড়িয়া উঠুক, স্কুলে পড়াশুনায়। ভালো করুক ইত্যাদি; কাম্য অবস্থা বা জিনিস শেষ পর্যন্ত ভালো কি মন্দ ফল দিবে, ইহার দ্বারা ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষিত হইবে কিনা কেহ এসব চুলচেরা বিচার করিয়া দেখে না। জনক-জননীর হৃদয়ে যে সন্তানের জন্য স্বাভাবিক মঙ্গল কামনা রহিয়াছে তাহা সর্বদা কেবল নিজের সন্তানের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকে না। শিশুদের শিক্ষক যিনি হইবেন তাঁহার অন্তরে এই কামনা থাকা চাই। শিশুদের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইহা কতকটা শিথিল হইয়া আসে। কিন্তু যাহারা শিশুদের প্রতি মমতা এবং তাদের কল্যাণচিন্তা পোষণ করেন কেবল তাহারাই শিক্ষাপ্রণালী রচনার অধিকারী হইতে পারেন। যাহারা মনে করেন যুদ্ধ করিতে এবং যুদ্ধে প্রাণ দিতে ইচ্ছুক ও সক্ষম পুরুষ তৈয়ার করাই বালকদের শিক্ষার উদ্দেশ্য তাঁহাদের মনে পিতৃহৃদয়ের মমতা নাই; তথাপি এইরূপ লোকই ডেনমার্ক এবং চীনদেশ ছাড়া সর্বত্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করিতেছেন।

শিক্ষাবিদগণ যে ছাত্রকে ভালোবাসিবেন ইহাই যথেষ্ট নয়; কি কি গুণে ভূষিত হইলে মানুষের উৎকর্ষতা বাড়ে সে সম্বন্ধেও তাহাদের সঠিক ধারণা থাকা চাই। বিড়াল তাহার ছানার সঙ্গে খেলা করে এবং ইঁদুর ধরা শিখায়, যুদ্ধবাদীগণ [Mil itarists] অনুরূপভাবে মানব শিশুকে শিক্ষা দেন। বিড়াল তাহার নিজের ছানাকে ভালবাসে কিন্তু ইঁদুর ছানাকে ভালোবাসে না, যুদ্ধবাদী সন্তানদিগকে ভালোবাসে না। যাহারা সমগ্র মানবজাতিকে ভালোবাসেন তাহারাও উৎকৃষ্ট জীবনের উপাদান কী সে সম্বন্ধে ভুল ধারণা পোষণ করার ফলে ভুল পথে চলিতে পারেন। কাজেই কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া কিংবা কোনো গুণ অধিগত করা (ইহা আদৌ) সম্ভবপর কিনা তাহা চিন্তা না করিয়া, মানবজীবনে চরম উৎকর্ষলাভের জন্য কিসের প্রয়োজন তাহাই প্রথমে আলোচনা করিব। পরে, যখন আমরা শিক্ষার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব, তখন ইহা কাজে লাগিবে; তখন বুঝিতে পারিব কোন্ লক্ষ্য অভিমুখে আমরা চলিতে চাই।

আমরা প্রথমেই একটা পার্থক্যের কথা স্বীকার করিয়া লই :–এমন কিছু গুণ আছে যাহা সকলের মধ্যে না হোক কিছুসংখ্যক লোকের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়, আবার কতকগুলি গুণ সর্বজনীন হওয়া উচিত। আমরা শিল্পী চাই কিন্তু বৈজ্ঞানিকও আমরা চাই। আমরা রাষ্ট্র পরিচালক ও শাসক চাই, আবার কৃষক, মজুর, ব্যবসায়ীও তো চাই। যে গুণাবলি একজন লোকের জীবনে বিরাট প্রতিভারূপে প্রকাশ পায় তাহাই সর্বসাধারণের মধ্যে বিকশিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। শেলি একজন কবির দিনের কাজের বর্ণনা দিয়াছেন এইরূপ :

প্রভাত সময় হতে প্রদোষ অবধি।
দেখিবে সে হ্রদতীরে বসি
রৌদ্রকরে উল্লসিত মৌমাছির মেলা
ফুলে ফুলে। বস্তুপুঞ্জে নাহি আকর্ষণ,
নিমগ্ন সুন্দরের ধ্যানে।

কবির পক্ষে এই অভ্যাস প্রশংসনীয় কিন্তু ডাকপিওনের পক্ষে নয়। কাজেই সকলের মধ্যেই স্বভাব বা মনোভাব গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্যে আমরা কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে পারি না। কিন্তু কতকগুলি গুণ সকলের মধ্যেই বিকশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়; কেবল এইগুলিই এখানে বিবেচনা করিব।

এই গুণসমূহের কোনগুলি পুরুষের পক্ষে প্রযোজ্য, কোন্‌গুলি স্ত্রীলোকের পক্ষে প্রযোজ্য সে সম্বন্ধে কোনো পার্থক্য করিতে চাই না। যে সকল স্ত্রীলোককে শিশুর যত্ন পরিচর্যা করিতে হয় তাঁহাদের জন্য পেশামূলক কিছু শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা উচিত, একজন কৃষক ও একজন মিলচালক বা মজুরের মধ্যে শিক্ষার যা পার্থক্য এ ক্ষেত্রেও পার্থক্য প্রায় সেইরূপ। এ পার্থক্য মূলনীতিগত নয় এবং ইহা লইয়া এ পর্যায়ে আলোচনারও প্রয়োজন নাই।

যে চারিটি বৈশিষ্ট্য একত্র মিলিত হইয়া আদর্শ চরিত্র গঠন করিতে পারে প্রথমে তাহারই উল্লেখ করা হইতেছে : উৎসাহ-উদ্দীপনা (উদ্যম), সাহস, অনুভূতিশীলতা এবং বুদ্ধি। মানব চরিত্রে গুণাবলির পক্ষে এই তালিকাই যে সম্পূর্ণ, তাহা বলি না কিন্তু ইহার মধ্যে অনেকগুলি অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। অধিকন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে যথোপযুক্তভাবে দেহমনের যত্ন লইলে এইগুলি প্রায় সকলের মধ্যেই বিকশিত করা যায়। একে একে ইহাদের আলোচনা করা যাক।

.

উদ্যম : উদ্যমকে মানসিক বৈশিষ্ট্য না বলিয়া বরং দৈহিক বৈশিষ্ট্য বলা যায়। যেখানেই ভালো স্বাস্থ্য সেখানেই উদ্যম বিদ্যমান; বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইহা কমিতে থাকে এবং বার্ধক্যে শেষ হইয়া যায়। স্বাস্থ্যবান শিশুদের বেলায় তাহাদের স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগেই ইহা পূর্ণমাত্রায় বিকাশ লাভ করে, শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে ক্রমে কমিতে থাকে। দেহের সবল, সুস্থভাবে বাঁচিয়া থাকার আনন্দ বাড়াইয়া দেয়, কষ্টবোধ হ্রাস করে। উদ্যমশীল শিশু যাহা দেখে সবকিছুতে কৌতূহল বোধ করে এবং নানা জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হয়। বহির্জগতে নানা বিষয়ের সংস্পর্শে আসিয়াই শিশু তাহার বিচারবুদ্ধির পরিচয় দেয়। মানুষ তাহার চতুর্দিকে যাহা কিছু দেখে বা শেখে তাহাতে যদি কোনো প্রকার আনন্দ না পায়, তবে স্বভাবতই সে (নিজের ভিতরেই ইহার সন্ধানে ডুবিয়া যায়) আত্মস্থ হইয়া পড়ে। ইহা দুভার্গের কারণ হইয়া পড়ে কেননা বহির্জগতের আনন্দ উপভোগে অসমর্থ, নিরানন্দ লোকের জীবনে প্রথমে আসে অবসাদ; ইহাই ক্রমে বিষণ্ণতা ও মানসিক রোগে পরিণত হয়। অতি অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মানসিক বিষণ্ণতা জীবনকে অকেজো করিয়া ফেলে। উদ্যম বহির্জগতের প্রতি মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে; ইহা কাজের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। উদ্যম মানুষের জীবনকে আনন্দময় করে; ইহা ঈষার বড় প্রতিষেধক। মানুষের মনঃকষ্টের একটি বড় কারণ পরশ্রীকারতা। এই পরশ্রীকাতরতা উদ্যমশীল লোকের আনন্দময় জীবনে ঘেঁসিতে পারে না। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহের উদ্যমের সঙ্গে অনেক দোষ যুক্ত থাকিতে পারে; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটি সরল সুস্থ বাঘের কথা। আবার উজ্জ্বল স্বাস্থ্যের অভাব থাকিলেও লোকের অনেক গুণ থাকিতে পারে। উদাহরণ দেওয়া যায়–নিউটন [Newton] এবং লক [Locke] উভয়েরই স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। এ দুজনেই ছিল খিটখিটে মেজাজসম্পন্ন এবং ঈর্ষাপরায়ণ। ইহারা স্বাস্থ্যবান হইলে হয়তো দোষ হইতে মুক্ত থাকিতে পারিতেন। নিউটন যদি স্বাস্থ্যবান হইতেন এবং জীবনের সাধারণ সুখ উপভোগ করিতে পারিতেন তবে হয়তো লিবিনিজের [Leibiniz] সঙ্গে তাহার যে বাকবিতণ্ডার ফলে ইংল্যাণ্ডের গণিতবিদ্যা একশত বৎসরের জন্য ধ্বংস হইয়াছিল তাহা সংগঠিতই হইত না। দৈহিক পূর্ণস্বাস্থ্যের কিছু কিছু দোষ থাকা সত্ত্বেও উদ্যমকে আমি মানুষের পক্ষে একান্ত কাম্য গুণ বলিয়া মনে করি।

.

সাহস : সাহসের কয়েকটি প্রকার আছে এবং সব কয়টিই জটিল। ভয়শূন্যতা এক জিনিস এবং ভয় দমন করিবার ক্ষমতা অন্য জিনিস। বাস্তব এবং যুক্তিসঙ্গত ভয় হইতে মুক্ত থাকা এক কথা, অবাস্তব বা অযৌক্তিক ভয় হইতে মুক্ত থাকা অন্য কথা। অবাস্তব ভয় না থাকা খুবই ভালো; ভয়কে দমন করার শক্তিও প্রশংসনীয়। কিন্তু ভয় যেখানে যুক্তিসঙ্গত সেখানেও যদি ভয়শূন্যতা থাকে তবে তাহা কিসের দ্যোতক, তাহার ফলাফলই বা কি হইতে পারে সে সম্বন্ধে তর্ক চলিতে পারে। যাহা হউক, আপাতত: এ তর্ক স্থগিত রাখিয়া সাহসের অন্য স্বরূপ সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক।

বেশিরভাগ লোকের ভাব-জীবনে [Emotional life] অবাস্তব ভীতি একটি প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে। অকারণ উৎপীড়নের আশঙ্কা, বিনা কারণে অমূলক উৎকৃষ্ঠা বোধ করা প্রভৃতি উৎকট মানসিক রোগের প্রকৃতি নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য উন্মুদ রোগীর চিকিৎসকের প্রয়োজন। এগুলি যাহাদের মধ্যে তীব্র আকারে প্রকাশ পায় তাহারা উন্মাদের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু মৃদু আকারে এরূপ ভাব অনেক সুস্থ ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যায়। কাহারও এরূপ বোধ হইতে পারে যে, তাহার চারিদিকে বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে; হঠাৎ কোনো কিছু ঘটিতে পারে; ইহাকেই বলা চলে উৎকণ্ঠা, কাহারও বা হয়তো কোনো কিছু ভয়ের ভাব বদ্ধমূল হইয়াছে, অথচ প্রকৃতই তাহাতে ভয়ের কিছু নাই, যেমন ইঁদুর বা মাকড়সা দেখিয়া ভয় পাওয়া। আগে মনে করা হইত যে, ভয় মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি অর্থাৎ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কতকগুলি প্রবৃত্তির মতো ভয়ও সে লাভ করে কিন্তু বর্তমান গবেষকগণের অধিকাংশই এখন ইহা মানেন না। বাহ্যত জন্মগত কয়েকটি ভয় আছে, যেমন উচ্চ শব্দ শুনিয়া ভয়; কিন্তু বেশিরভাগ ভয়ের উৎপত্তি হয় অভিজ্ঞতা হইতে আর না হয় অন্যের সংস্পর্শ হইতে। অন্ধকার দেখিয়া ভীত হওয়া সম্পূর্ণরূপে অন্যের কাছে পাওয়া। এরূপ মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের স্বভাব শত্রু সম্বন্ধে তাহাদের কোনো ভীতিবোধ থাকে না; ইহা তাহারা তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে লাভ করে। মানুষ যখন ইহাদিগকে হাতে করিয়া লালন-পালন করে তখন ইহাদের গোষ্ঠীর অন্যান্যদের মধ্যে যে ভয় স্বাভাবিক তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইহা অত্যন্ত সংক্রামক। শিশুরা তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে ইহা পায়, এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠরা হয়তো জানিতেই পারিলেন না কখন কিভাবে তাহারা ভীতির ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। জননী বা ধাত্রীর ভীরুতা শিশু অতি শীঘ্র অনুকরণ করে। এতদিন পুরুষেরা মনে করিয়াছেন যে অবাস্তব ভয়ে ভীত থাকিলে স্ত্রীলোকের আকর্ষণ বাড়ে কেননা ইহার ফলে তাহারা প্রকৃত কোনো বিপদের সম্মুখিন না হইয়াও বিপন্ন মহিলাদের রক্ষক সাজিবার সুযোগ পাইতেন, কিন্তু ইহাদের পুত্রগণ তাহাদের জননীর নিকট হইতে ভয় অর্জন করিয়াছে। অথচ পুরুষগণ যদি স্ত্রীলোকদিগকে এভাবে অশ্রদ্ধা না করিত তবে তাহাদের সন্তানগণ ভীত হইয়া পড়িয়া উঠিত না। [শিক্ষার ভিতর দিয়া তাহাদের ভয় দূর করিয়া সাহসী করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে হয়। স্ত্রীলোকদিগকে অধীন করিয়া রাখা অপরিসীম ক্ষতির কারণ হইয়াছে; সন্তানের মনে ভয়সঞ্চার ইহার কেবল একটি উদাহরণ মাত্র।

কি উপায়ে ভয় এবং উৎকণ্ঠা কামানো যায় এখন তাহার আলোচনা করিতেছি; পরে এ বিষয়ে আলোচনা হইবে। এখন একটি প্রশ্ন উঠে: ভয় চাপিয়া রাখিয়াই কি আমরা সন্তুষ্ট থাকিব, না ইহার কারণেই মূলোচ্ছেদ করিতে হইবে? ঐতিহ্য এইভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে যে, অভিজাত সম্প্রদায় কোনো প্রকার ভয় ভীত হইবে না; পরাধীন জাতির লোকজন, সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ এবং স্ত্রীলোকদিগের ভীরু হইয়া থাকিতে উৎসাহিত করা হইয়াছে। বাহিরের আচরণ দ্বারা এর সাহসের প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে–সাহসী ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পালাইবে না; পুরুষোচিত খেলাধুলায় সে পারদর্শী হইবে; অগ্নিকাণ্ড, জাহাজডুবি, ভূমিকম্প প্রভৃতির সময় সে আত্মসংযম হারাইয়া ফেলিবে না। সাহসের পরিচয় দিতে গিয়া যখন যাহা করা দরকার সে শুধু তাহাই করিবে না, ভয়ের কোনোরূপ চিহ্ন যেন যাহাতে তাহার আচরণে বা দেহে প্রকাশ না পায় যেমন বিবর্ণ হইয়া যাওয়া, কাপিতে থাকা, ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলা প্রভৃতি–তাহাই করিতে হইবে। এ সমস্ত খুবই প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান; পৃথিবীর সকল জাতির, সকল শ্রেণির পুরুষ ও নারী সকলের মধ্যেই সাহসের উদ্বোধন ঘটুক ইহাই আমি দেখিতে চাই। কিন্তু যখন ভয় দমন করিয়া বা চাপিয়া রাখিয়া সাহসের ভাব দেখানো হয় তখন দমন করার দরুন কুফলের হাত এড়ানো যায় না। লজ্জা ও অপমান সর্বদা সাহস উৎপাদনের প্রধান উপায় আছে; কার্যত কিন্তু ইহা দুইটি ভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব মাত্র–ভয় এবং ভয়ে ভীত হইলে অন্যের নিকট হইতে লজ্জা পাওয়ার ভয়; এই দুই ভয়ের দ্বন্দ্বে সাধারণের নিকট অপমানিত হওয়ার ভয়ই প্রবল হয়। এবং অপমানের হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে সাহস প্রদর্শন করে। বাল্যকালে আমাকে শিখানো হইত যখন তোমাকে কোনো কিছু ভয় দেখায় তখন ছাড়া অন্য সব সময় সত্য কথা বলিবে। সময় সময় যে সত্যকথার ব্যতিক্রম করা উচিত তাহা মানি না! ভয়কে জয় করিতে হইবে, শুধু কাজে নয়, চিন্তাতেও। কেবল সজ্ঞান চিন্তাতে নয়, নিজ্ঞান [Unconscious] চিন্তাতেও। [ভয়ের সম্মুখিন হইয়াও অনেক সময় মানুষ লোকলজ্জার ভয়ে সাহসের পরিচয় দেয়। এক্ষেত্রে লোকভয় তাহার প্রাথমিক ভয়কে জয় করিয়াছে; সাহসীর মতো আচরণের মধ্যে এই জয়ের অভিব্যক্তি দেখা দেয়। অভিজাতের রীতি অনুযায়ী ভয়কে বাহ্যত জয় করা হইল বটে, কিন্তু আসল ভাবটির মনের গহনে প্রবেশ এমন নূতন আকারে আত্মপ্রকাশ করে যে, সেটি যে ভয় হইতেই সঞ্জাত তাহা বুঝিবার উপায় থাকে না। কামানের গোলার ভীতির কথা বলিতেছি না; সেক্ষেত্রে ভয় সুস্পষ্ট। প্রতিপত্তিশালী জাতিসমূহ যে অত্যাচার এবং নিষ্ঠুরতার সাহায্যে তাহাদের প্রাধান্য বজায় রাখে–আমি তাহার কথাই চিন্তা করিতেছি। কিছুদিন আগে একজন ব্রিটিশ কর্মচারী সাংহাইতে একদল নিরস্ত্র চীনা ছাত্রকে সতর্ক করিয়া না দিয়া পিঠের দিক হইতে গুলি করিয়া মারিবার নির্দেশ দিয়াছিল। যেরূপ ভীত হইলে একজন সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করে, তখন সেই কর্মচারীটিও নিশ্চয়ই ঠিক তেমনি ভীত হইয়াছিল। কিন্তু যোদ্ধার অভিজাত সম্প্রদায়ের এতখানি বুদ্ধি নাই যে, এইরূপ ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক কারণ নির্ণয় করিতে পারে; তাহারা বরং ইহাকে দৃঢ় এবং উপযুক্ত মনোভাব প্রদর্শন বলিয়াই মনে করে।

মনস্তত্ত্ব ও শারীরবিজ্ঞানের দিক দিয়া ভয় এবং ক্রোধ একই জাতীয় প্রক্ষোভ [Emotion]; ক্রুদ্ধ ব্যক্তি উন্নত ধরনের সাহস প্রদর্শন করিতে পারে না। নিগ্রো বিদ্রোহ দমনে, কমিউনিস্ট বিপ্লব দমনে এবং আভিজাত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল রকম আন্দোলন দমন করিতে যে নিষ্ঠুরতা দেখানো হইয়াছে তাহা কাপুরুষতা হইতেই উৎপন্ন। কাপুরুষতা স্কুল প্রকাশ যেরূপ ঘৃণার যোগ্য, এ আচরণ তেমনি নিন্দনীয়। আমি বিশ্বাস করি যে, সাধারণ স্ত্রী পুরুষকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া যায় যাহাতে তাহারা ভয়শূন্য হইয়া জীবনযাপন করিতে পারে। এ পর্যন্ত কেবল বড় বড় ঋষিরাই এরূপ জীবনযাপন করিয়াছেন; কিন্তু উপায় দেখাইয়া দিলে সাধারণ লোকেও নির্ভীকতা লাভ করিতে পারে।

যে সাহসের অর্থ কেবল দমন করা নয়, সেরূপ প্রকৃত সাহস অর্জন করিতে হইলে কতকগুলি বিষয় দরকার। প্রথমেই বলা যায় স্বাস্থ্য এবং উদ্যম। এ-দুইটি সম্পূর্ণ অপরিহার্য না হইলেও বিশেষ সহায়ক। বিপদজ্জনক অবস্থা হইতে উদ্ধার হওয়ার অভ্যাস এবং কৌশলও বিশেষ বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা যখন কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রদর্শিত সাহস নয়, সাধারণ সাহসের কথা বিবেচনা করি তখন আরও মৌলিক [fundamental] কতকগুলি গুণের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ইহা সকল আত্মসম্মান এবং জীবনের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক [impersonal] দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণ। প্রথমে আত্মসম্মানের কথা আলোচনা করি :–কতক লোক নিজেদের অন্তরের মধ্যে বাস করেন এবং নিজেদের বিচার বুদ্ধি এবং বিবেক দ্বারা পরিচালিত হন, আর কতক লোক তাহাদের প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবের দর্পণস্বরূপ, অপরের অনুভূতি এবং অভিমত দ্বারা পরিচালিত হন। এরূপ লোকের সত্যকারের সাহস থাকিতে পারে না। ইহারা প্রশংসার কাঙাল, প্রশংসা নষ্ট হইবে এই ভয়ে ইহারা ভীত। বিনয়, নম্রতা, শিক্ষা এক সময় বাঞ্চনীয় মনে করা হইত; ইহার কুফল ফলিয়াছে। নম্রতা অর্জন করিতে ইচ্ছুক লোকদিগকে আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হইয়াছে কিন্তু তাহারা অপরের নিকট হইতে শ্রদ্ধা পাইবার বাসনা ত্যাগ করে নাই। ম হওয়া, আত্মসম্মান বিকাইয়া দেওয়া ইহারা লোকের বাহবা পাওয়ার উপায় বলিয়া মনে করিয়াছে। এইভাবে মিথ্যাচার এবং ভণ্ডামি প্রশ্রয় পাইয়াছে। শিশুদিগকে যুক্তি দিয়া বুঝাইয়াই আদেশ মানিয়া লইতে শিখানো হইত না; তাহাদের বয়স বেশি হইলে তাহারাও অন্যের নিকট হইতে এইরূপ নতি স্বীকার দাবি করিত; বলা হইত যে, যাহারা আদেশ মান্য করিতে জানে, কেবল তাহারাই আদেশ করিতেও জানি। আমি বলি কি আদেশ মান্য করার শিক্ষার প্রয়োজন নাই, কাহাকেও আদেশ দান করারও প্রয়োজন নাই। অবশ্য আমি একথা বলি না যে, সহযোগিতামূলক সমবায় পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত কোনো কাজে কোনো নেতা থাকিবে না; ফুটবল-দলের অধিনায়কের নির্দেশ যেমন সকলে স্বেচ্ছায় মানিয়া চলে, তেমনি একই উদ্দেশ্যসাধনের ব্যাপারে সফর নেতার আদেশ সানন্দে এবং স্বেচ্ছায় মানিয়া চলিবে। এই উদ্দেশ্য যেন আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য হয়, বাহির হইতে কেহ যেন আমাদের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দিয়া তাহা সাধন করিতে হুকুম না করে। কাহারও আদেশ করার দরকার নাই, কাহারও আদেশ পালন করারও প্রয়োজন নাই একথা বলিতে আমি ইহাই বুঝাইতে চাই।

সর্বশ্রেষ্ঠ সাহস প্রদর্শনের জন্য আরও একটি জিনিসের কথা বলা হইয়াছে; তাহা হইল জীবনের প্রতি নৈর্ব্যত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। যে ব্যক্তি অতিমাত্রায় আত্মসর্বস্ব, যাহার আশা, ভয় সমস্ত কিছুই কেবল নিজেকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হয়, সে প্রশান্তচিত্তে মৃত্যুবরণ করিতে পারে না; কেননা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাহার ভাব ও আশা-আকাঙ্ক্ষা জগতের পরিসমাপ্তি ঘটে। এখানেও আমরা আত্মদমনের একটা সহজ পন্থা প্রচলিত দেখি; সাধুব্যক্তিকে আত্মবর্জন করিতে হইবে, দেহের কষ্ট বরণ করিতে হইবে, স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত আনন্দ উপভোগ পরিত্যাগ করিতে হইবে। এইরূপ করা যায়, কিন্তু ইহার ফল হয় খারাপ। নিজের সুখ বর্জন করিয়া ত্যাগী সন্ন্যাসী ব্যক্তি অপরের পক্ষেও ইহা বর্জনীয় মনে করে। এইরূপ মনে করা সহজ। আত্মনিপীড়নকারী ব্যক্তি বুঝিতে পারে না কিন্তু সংসারের ভোগীদের প্রতি ঈষা তাহার মনের গভীরে ফল্পর স্রোতের মতো বহিত থাকে; তিনি মনে করেন শারীরিক দুঃখকষ্ট সহ্য করা সহনীয় কাজ, কাজেই ন্যায়সঙ্গতভাবেই ইহা অন্যের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া যায়। এইভাবে জীবনের মূল্য সম্বন্ধেই, এক সম্পূর্ণ ভুল এবং বিপরীত ধারণার সৃষ্টি হয়। যাহা ভালো তাহাকে মনে হয় মন্দ এবং যাহা মন্দ তাহাকেই মনে হয় ভালো। এইসব ক্ষতির মূল কারণ হইল স্বাভাবিক বাসনা ও প্রবৃত্তিগুলির বৃদ্ধি এবং বিকাশ না ঘটাইয়া নীতিমূলক আদর্শের সাহায্যে মহৎ জীবন গঠনের চেষ্টা। মানুষের স্বভাবে এমন কতকগুলি জিনিস আছে যাহা বিনা চেষ্টাতেই আমাদিগকে আমাদের সত্তার উর্ধ্বে লইয়া যাইতে পারে। ইহাদের প্রধান হইল প্রীতি, বিশেষ করিয়া জনক-জননীর বাৎসল্য। কোনো কোনো লোকের মধ্যে এই প্রীতি এমন ব্যাপক যে সমগ্র মানবজাতিকে তাঁহারা প্রীতি-পাশে আবদ্ধ করিতে পারেন। অন্য বিষয়টি হইল জ্ঞান। গ্যালিলিও যে বিশ্বের কল্যাণকামী ঋষি-প্রকৃতির লোক ছিলেন এমন অনুমান করিবার কোনো কারণ নাই, তথাপি জ্ঞানের সাধনায় তিনি যাহা সত্য বলিয়া স্থির বিশ্বাস করিয়াছিলেন তাহার নজ্য জীবন দিতে তিনি কুণ্ঠিত হন নাই। অপর বিষয় হইল শিল্প। প্রকৃতপক্ষে মানুষে নিজের দেহ ছাড়া বাহিরের জিনিসের দিকে যে পরিমাণ আকৃষ্ট হইবে ততই তাহার জীবনের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিও সেই পরিমাণে বাড়িবে। এইজন্য, শুনিতে স্বয়ং বিরোধী মনে হইলেও, ইহা সত্য যে, যে-ব্যক্তি বহির্জগতের নানা বিষয়ে দীপ্ত উৎসাহ দেখাইয়া থাকে সে যত সহজে জীবনের মায়া কাটাইতে পারে। একজন হতভাগ্য, সর্বদা অমূলক রোগের ভয়ে শঙ্কিত, মনোবিকারগ্রস্ত রোগী তত সহজে প্রাণের মায়া কাটাইতে পারে না। এমন মানুষের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়, যিনি নিজের সত্তাকে বিশ্বের একটি অংশ বলিয়া অনুভব করন–নিজেকে হেয় করিয়া নয়, নিজের জীবন ছাড়া অন্য কোনো জিনিসকে জীবনের চেয়ে মহত্তর বলিয়া মনে করিয়া।

প্রকৃতি মুক্ত এবং বুদ্ধি সক্রিয় না থাকিলে এরূপ ঘটিতে পারে না। এই দুইটির মিলনের ফলে দৃষ্টিভঙ্গির এমন উদারতা এবং ব্যাপকতা জন্মে যে, তাহা ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং সংযমী ঋষি উভয়েরই কাছে অজ্ঞাত; এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির নিকট ব্যক্তিগত মৃত্যু অকিঞ্চিৎকর বলিয়া মনে হয়। এই সাহস অস্থি-মূলক [positive] এবং প্রবৃত্তি সজ্ঞাত, নেতিমূলক [Negative] ও দমনমূলক নয়।

.

অনুভূতিশীলতা : এক হিসাবে অনুভূতিশীলতাকে সাহসের সংশোধন বলা যায়। যে-ব্যক্তি বিপদ সম্বন্ধে ধারণা বা অনুভব করিতে পারে না তাহার পক্ষে সাহসীর ন্যায় আচরণ করা সহজ; এইরূপ সাহস প্রায় মূর্খতার শামিল। অজ্ঞতা বা বিস্মৃতির ফলে যে কাজ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে কখনোই সন্তোষজনক বলা যায় না। কোনো কাজের মূলে যথাসম্ভব সম্পূর্ণ জ্ঞান এবং তাহার সম্বন্ধে ধারণা বিদ্যমান থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে গেলে বুদ্ধির কথা ওঠে; আমি এখানে অনুভূতিশীলতাকে মনের ভাব বা প্রক্ষোভের পর্যায়ে ফেলিয়াছি। ইহার সহজ ব্যাখ্যা এইভাবে করা যায় : যখন অনেকগুলি ঘটনা কোনো ব্যক্তির মনে নানা প্রক্ষোভের [Emotions] সৃষ্টি করিয়া নানা ভাব জাগাইয়া তোলে তখন বলা যায় যে, সে অনুভূতিশীল হইয়া উঠিয়াছে; ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করিলে এই মানসিক অবস্থা কল্যাণকর না-ও হইতে পারে! ভালো হইতে হইলে মনের উপর এই অনুভূতির প্রতিক্রিয়া যথাযথ হওয়া দরকার; শুধু প্রতিক্রিয়ার তীব্রতার প্রয়োজন নাই। বাহিরের সুখদুঃখ আনন্দ-বেদনাময় ঘটনায় মনে অনুরূপ অনুভূতি জাগরিত হউক ইহাই আমার কাম্য। আনন্দময় ঘটনা মনে আনন্দের অনুভূতি জাগাইবে, দুঃখময় ঘটনা মনে বেদনার অনুভূতি জাগাইবে ইহাকেই বলা চলে যথাযথ প্রতিক্রিয়া।

যথার্থ বিষয় কি তাহাই বুঝাইতে চেষ্টা করিব। শিশুর বয়স যখন পাঁচ মাসের মতো তখন খাদ্য এবং কোমল উষ্ণতায় সে যে আনন্দ অনুভব করে তাহা ছাড়াইয়া আরও একটি নূতন অনুভূতি। এই অনুভূতি খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। প্রত্যেক শিশুই প্রশংসা ভালোবাসে, দোষারোপ অপছন্দ করে। সাধারণত লোকে ভাল বলুক এই ইচ্ছা মানুষের সারা জীবন ধরিয়া প্রবল থাকে। অপরের প্রশংসা লাভ করার বাসনা মানুষকে মনোজ্ঞ আচরণ করিতে উৎসাহিত করে। তাহার লোভের প্রবৃত্তি দমন রাখিতে সাহায্য করে। কোন্ কোন্ গুণ প্রকৃতই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য সে সম্বন্ধে আমরা যদি কিছু বিচক্ষণতার পরিচয় দিতাম, তবে ফল অনেক ভালো হইত। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের হত্যাকারীকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বলিয়া প্রশংসা করা হইবে, ততদিন শিশুর প্রশংসালাভের বাসনাকেই ভালো জীবন গঠনের একমাত্র উপাদান হিসাবে গ্রহণ করা যাইবে না। দিগ্বিজয়ী বীরের প্রশংসা শুনিয়া বালক নিজেও প্রশংসিত ব্যক্তির গুণাবলি অনুকরণ করিতে চেষ্টা করে; যাহাকে সে বীর বলিয়া অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাহার গুণগুলি তাহার কাছে সহনীয় মনে হয়। এইভাবে প্রকারান্তরে সে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার নিষ্ঠুরতাকে গুণ বলিয়া বরণ করিয়া নেয় এবং নিজের জীবনেও অনুকরণ করে।

অনুভূতিশীলতা বিকাশের দ্বিতীয় সোপান হইল সমবেদনা। এক রকম সমবেদনা আছে যাহা দৈহিক–যেমন ছোট শিশু তাহার ভাই বা বোনকে কাঁদিতে দেখিলে নিজেও কাঁদিতে শুরু করে। এই সূত্র অবলম্বন করিয়া সমবেদনা বিকাশের সুযোগ কাজে লাগানো যায়। স্বাভাবিক সহানুভূতি বোধকে দুইদিকে বাড়ানো দরকার প্রথম, বিপন্ন ব্যক্তি বিশেষ স্নেহের পাত্র না হইলেও তাহার দুঃখে সহানুভূতি বোধ করা; দ্বিতীয়, যখন বিপন্ন ব্যক্তি চোখের সামনে নেই, তখন তাহাদের দুঃখদুর্দশার কথা শুনিয়াই সমবেদনা বোধ করা। এই দ্বিতীয় উপায়ে সমবেদনা বোধ করা প্রধানত বুদ্ধির উপর নির্ভর করে। ভালো উপন্যাসে দুঃখ-দুর্দশার জীবন্ত বর্ণনা পাঠ করিয়া পাঠক সমবেদনা বোধ করিতে পারে; আবার ইহা (বুদ্ধি) এমন উৎকর্ষ লাভ করিতে পারে যাহার ফলে পরিসংখ্যান [Statistics] দেখিয়াই কেহ সহানুভূতিতে বিগলিত হইতে পারেন। নিজের প্রিয়জনের কর্কটরোগ [Cancer] হইলে প্রায় সকলেই সমবেদনায় উদ্বেল হইয়া ওঠেন। বেশিরভাগ লোক হাসপাতালে অপরিচিত রোগীর যন্ত্রণা দেখিয়া বিচলিত হয়। অথচ যখন তাহারা পড়ে যে, কর্কটরোগে মৃত্যুর হার বাড়িয়াছে তখন তাহারা তাহাদের নিজেদের ওই রোগ হইতে পারে; কিংবা তাহাদের প্রিয়জনের হইতে পারে এই আশংকায় সাময়িকভাবে বিচলিত হয় মাত্র। যুদ্ধ সম্বন্ধে এ কথা খাটে। যাহাদের ছেলে বা ভাই যুদ্ধে বিকলাঙ্গ হয় তাহারা যুদ্ধকে ভয়ঙ্কর মনে করে; আরও লক্ষ লোক যে বিকলাঙ্গ হইতে পারে তাহা ভাবিয়া তাহারা যুদ্ধকে লক্ষ গুণ ভয়ঙ্কর মনে করে না। যিনি ব্যক্তিগত আচরণে সহৃদয়তার পরিচয় দেন তিনিও যুদ্ধে উত্তেজনা দান ব্যাপার হইতে কিংবা অনুন্নত দেশে শিশুদের উপর অত্যাচার চালনা হইতে অর্থোপার্জন করেন। এই সকল পরিচিত ঘটনার কারণ হইল এই যে, বস্তু-নিরপেক্ষ [Abstract] কোনো তথ্য বেশিরভাগ লোকের মনে সহানুভূতি জাগাইতে পারে না। জাগাইতে পারিলে বর্তমান জগতের অনেক অন্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব হইত। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদিগকে দূরবর্তী দেশের মানবগোষ্ঠীর উপরও প্রভাব বিস্তার করিতে সক্ষম করিয়াছে কিন্তু তাহাদের জন্য সহানুভূতি বোধ বৃদ্ধি করে নাই। মনে করুন, আপনি সাংহাইতে তুলা উৎপাদন ব্যবসাতে লিপ্ত কোনো কোম্পানির অংশীদার। আপনি হয়তো কর্মব্যস্ত লোক; ব্যবসায়ী উপদেষ্টার পরামর্শক্রমেই আপনি টাকা খাটাইতেছেন; সাংহাই বা তুলা ব্যবসা কোনওটি সম্বন্ধেই আপনার কৌতূহল নাই, আপনি কেবল চান লাভের টাকা। তবু নিরীহ লোকেদের হত্যার ব্যাপারে আপনি অংশ গ্রহণ করিতেছেন এবং ছোট ছোট বালক-বালিকাকে অস্বাভাবিক ও বিপজ্জনক কাজে না খাটাইলে আপনার লাভের অঙ্কে শূন্য পড়িবে। আপনার মনে কোনও ভাবান্তর হয় না, কেননা আপনি সেখানকার বালক-বালিকাদিগকে দেখেন নাই এবং শুধু তথ্য আপনাকে বিচলিত করিতে পারে না। বৃহদাকারের যন্ত্রশিল্প যে এত নির্মম কেন এবং পরাধীন জাতির অধিবাসীদের উপর অত্যাচার যে বিজয়ী জাতির লোকে সহ্য করে কেন তাহার মূল কারণ ইহাই। যদি এমন শিক্ষা দেওয়া যায় যাহার সাহয্যে বস্তু নিরপেক্ষ তথ্য দ্বারাও অনুভূতি জাগানো সম্ভব, তাহা হইলে সেই শিক্ষাই এরূপ অবিচার ও অত্যাচারের বিলোপ ঘটাইবে।

জ্ঞানোত্থিত অনুভূতি অর্থাৎ জ্ঞান হইতে যে অনুভূতি উদ্ভত হয় সেরূপ ভাবাবেগও প্রয়োজন। ইহাকে অন্য কথায় পর্যবেক্ষণের অভ্যাসও বলা যায়। বুদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে ইহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। সৌন্দর্যবোধের সাথে কতকগুলি সমস্যা জড়িত আছে; সেগুলি বর্তমানে আলোচনা করিতে চাই না। কাজেই উন্নত চরিত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য বুদ্ধি সম্বন্ধে আলোচনা করিব।

.

বুদ্ধি : প্রচলিত নীতি-জ্ঞানের একটি দোষ এই যে ইহা বুদ্ধির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে নাই। গ্রিকগণ ভুল করেন নাই কিন্তু খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ লোকের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করিয়া দিয়াছেন যে, কতকগুলি গুণ ছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের মূল্য নাই। গুণ বলিতে কি বোঝায়? কতকগুলি কাজকে তাহারা নিজেদের খেয়াল খুশিতো পাপ আখ্যা দিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। এ কাজগুলি হইতে বিরত থাকাই তাহাদের গুণের পরিচায়ক, যতদিন এই ধারণা প্রচলিত থাকিবে ততদিন এই তথাকথিত গুণ অপেক্ষা যে বুদ্ধি অনেক বেশি কাজে লাগে তাহা লোককে বুঝানো যাইবে না। বুদ্ধি বলিতে অর্জিত জ্ঞান এবং জ্ঞান গ্রহণের ক্ষমতা এ দুইটিই বুঝাইতেছি। বস্তুত এই দুইটি পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। মূর্খ বয়স্ক ব্যক্তিগণ জ্ঞান গ্রহণ করিতে অক্ষম; উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্বাস্থ্যনীতি বা খাদ্য সম্বন্ধে বিজ্ঞান যাহা বলে তাহা তাহারা কিছুতেই বিশ্বাস করিবে না। একজন লোক যত বেশি জানে, তাহাকে তত বেশি শিখানো সহজ, অবশ্য সে যদি কোনো প্রকার কুশিক্ষার ফলে মানসিক সংকীর্ণতা বা গোড়ামিতে অভ্যস্ত না হইয়া উঠিয়া থাকে। অজ্ঞ লোকেরা এমন অপরিবর্তনশীল, আড়ষ্ট মানসিক অভ্যাস গঠন করিয়া থাকে যে, তাহারা কিছুতেই তাহা বদলাইতে পারে না। যেখানে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ না করিয়া সহজে কিছু বিশ্বাস করা উচিত নয়, সেখানে অজ্ঞ ব্যক্তিরা অতি সহজেই বিশ্বাস করে; শুধু তাহাই নয়, যেখানে জ্ঞান গ্রহণ করা উচিত সেখানে তাহারা হয় অবিশ্বাসী। বুদ্ধি কথাটির যথাযথ অর্থ হইল অর্জিত জ্ঞান নয়, জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা বা মানসিক শক্তি। পিয়ানোবাদক বা দৈহিক কসরত প্রদর্শনকারী যেমন পুনঃ পুনঃ অনুশীলনের ফলে কৌশল আয়ত্ত করেন, জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা বা শক্তিও তেমনি চেষ্টা করিয়া আয়ত্ত করিতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন না করিয়াই অবশ্য শিক্ষাদান করা সম্ভবপর; শুধু সম্ভবপর নয়, এরূপ করা সহজ এবং প্রায়শই করা হইয়া থাকে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে, জ্ঞান দান ব্যতিরেকে বুদ্ধির অনুশীলন সম্ভব। বুদ্ধি ব্যতীত আমাদের বর্তমান জটিল জগৎ চলিতে পারে না, উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া তো অসম্ভব। এজন্য বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশকে আমি শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলিয়া মনে করি। মনে হইতে পারে, ইহা তো অতি সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা সেরূপ নয়। সত্য বিশ্বাস বলিয়া যাহা প্রচলিত সেগুলি ছাত্রদের মনে। অনুপ্রবিষ্ট করাইয়া দিতে গিয়া শিক্ষাবিদগণ অনেক সময় বুদ্ধির সম্যক শিক্ষণের প্রতি উদাসীন হইয়া পড়েন। এই বিষয়টি স্পষ্ট করিয়া বুঝাইতে গেলে বুদ্ধি কথাটি ভালভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার, কেননা ইহা দ্বারাই জানা যাইবে বুদ্ধির অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য কি কি মানসিক অভ্যাসের প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে অর্জিত জ্ঞানের কথা বাদ দিয়া জ্ঞান অর্জনের শক্তি সম্বন্ধেই আলোচনা করিব।

বুদ্ধিময় [Intellectual] জীবনের ভিত্তি হইল কৌতূহল প্রবৃত্তি। ইহা ইতর প্রাণীর মধ্যে প্রাথমিক আকারে দেখা যায়। বুদ্ধির জন্য চাই সদা-জাগ্রত কৌতূহল। কিন্তু ইহাও কোনো বিশেষ ধরনের হওয়া দরকার। পাড়াগাঁয়ে প্রতিবেশিরা সন্ধ্যার অন্ধকারে, পরদার আড়ালে উঁকিঝুঁকি মারে যে কৌতূহলের বশে, তাহার বিশেষ কোনো মূল্য নাই; খোশগল্প করার যে উৎসাহ, তাহাও জ্ঞানার্জনের বাসনা হইতে নয়; ইহা ঈর্ষা হইতে সঞ্জাত; কেহ অপরের গোপন গুণগুলির আলোচনা করিয়া খোশগল্পের আসর জমায় না, অপরের গুপ্ত দোষ সম্বন্ধে সরস রসালাপই হইল উপভোগের বিষয়। কাজেই অধিকাংশ খোশগল্পের মূলেই সত্য নাই, কিন্তু এগুলি সত্য কি না তাহা যাচাই করিয়া দেখার চেষ্টা হয় না। ধর্মের সান্ত্বনার মতো আমাদের প্রতিবেশির দোষগুলি আমাদের কাছে এত মুখরোচক যে, সে সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখার কোনো প্রয়োজন অনুভব করি না। পক্ষান্তরে প্রকৃত কৌতূহল জ্ঞানলাভের বাসনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। একটি বিড়াল নূতন অপরিচিত কোনো কক্ষে ছাড়িয়া দিলে ইহার আচরণে কৌতূহলের প্রকাশ দেখা যাইবে; ইহা তখন কক্ষের প্রতি কোনো এবং প্রতিটি আসবাব শুকিয়া দেখিবে। শিশুদের মধ্যেও ইহা দেখা যাইবে; কোনো বদ্ধ ড্রয়ার বা কাবার্ড তাহাদিগকে দেখাইবার জন্য খুলিলে তাহারা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত দেখিতে ঝুঁকিয়া পড়িবে। জীবজন্তুর, কলকবজা, বজ্রবিদ্যুৎ, বিভিন্ন রকমের হাতের কাজ শিশুদের কৌতূহল জাগ্রত করে। নূতন জিনিস জানিবার আগ্রহ তাহাদের এত বেশি যে, অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তিকেই লজ্জায় পড়িতে হয়। বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃত্তি ক্রমে কমিয়া আসে; অবশেষে এমন হয় যে, অজ্ঞাত বা অপরিচিত কোনো জিনিস মাত্রই বিরক্তি উৎপাদন করে। এই অবস্থায় পৌঁছিলে লোকে বলে, দেশটা জাহান্নামে যাইতেছে, আর বলে আমাদের ছোট বয়সে যেমন ছিল দিনকাল আর এখন তেমন নেই। সে জিনিসটি অতীতে যাহা ছিল, এখন তাহা নাই, তাহা হইল বক্তার কৌতূহল। কৌতূহলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, আমরা ধরিয়া লইতে পারি যে, সক্রিয় বুদ্ধিরও মৃত্যু ঘটিয়াছে।

বাল্যকালের পর কৌতূহলের তীব্রতা ও পরিমাণ কমিয়া আসে বটে কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত ইহার উৎকর্ষ বাড়িতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে কৌতূহল অপেক্ষা সাধারণ বিষয় সম্বন্ধে কৌতূহল উচ্চতরস্তরে বুদ্ধির পরিচয় দেয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, কৌতূহল উদ্রেককারী বিষয়বস্তু যত বেশি ব্যাপক হইবে ততই তাহা হইবে উচ্চতর বুদ্ধির পরিচায়ক। (তবে সকল ক্ষেত্রে এই সূত্রটিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করিয়া বুদ্ধির স্তর নির্ণয় করা হইবে না;) যাহার সঙ্গে বক্তিগত সুবিধা, যেমন খাবার সংগ্রহ করা, জড়িত নাই এমন বিষয়ের প্রতি কৌতূহল এই প্রবৃত্তিটির উত্তর্ষের নিদর্শন। যে-বিড়ালটি নূতন কক্ষের কোণে কোণে ঘ্রাণ লইয়া বেড়ায় তাহাকে নিছক বৈজ্ঞানিক গবেষক মনে করিলে চলিবে না; সে হয়তো দুরের সন্ধান পাওয়া যাইবে কি না তাহারই খোঁজ করিতেছে, স্বার্থসম্বন্ধবিহীন হইলেই যে কৌতূহল সর্বশ্রেষ্ঠ হইল তাহা বলা ঠিক হইবে না, বরং যখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ সাক্ষাৎ বা সুস্পষ্ট নয় কিন্তু বুদ্ধিপ্রয়োগ করায় অধিকার করা যায় তখন সে কৌতূহলকে অতি উচ্চস্তরের বলা যায়। যাহা হউক, এ বিষয়ে নির্ধারণ করা এখন আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

কৌতূহল ফলপ্রদ হইতে হইলে জ্ঞান অর্জনের কতকগুলি কৌশল ইহার সহিত সংযুক্ত হওয়া উচিত। পর্যবেক্ষণের অভ্যাস, জ্ঞানের সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে বিশ্বাস, ধৈর্য এবং পরিশ্রম একান্ত আবশ্যক। যদি আসল জিনিস অর্থাৎ কৌতূহল থাকে এবং তাহার সঙ্গে থাকে উপযুক্ত জ্ঞানাত্মক শিক্ষা তবে এ অভ্যাসগুলি আপনা আপনি বিকাশলাভ করিবে। কিন্তু সারা দিনমান আমরা যে কাজকর্মে লিপ্ত থাকি জ্ঞানাত্মক কাজ তাহার একটি অংশ মাত্র এবং নানা প্রবৃত্তির সঙ্গে কৌতূহলের অবিরত সংঘর্ষ হইতেছে; সেজন্য বুদ্ধিকে সজাগ রাখিয়া ঠিক পথে চালিত করার জন্য কতকগুলি জ্ঞানমূলক গুণের প্রয়োজন, যেমন ভোলা-মন সবকিছুকেই নিরপেক্ষভাবে যুক্তি দ্বারা যাচাই করিয়া দেখিবার অভ্যাস। আমাদের অভ্যাস এবং মনোবাসনা নূতন সত্যকে গ্রহণ করিতে স্বভাবতই নারাজ হয়। যাহা অনেক বছর ধরিয়া আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছি যাহা আমাদের আত্মসম্মান বা অন্য প্রধান প্রবৃত্তিগুলির পরিতৃপ্তি সাধন করিয়া আসিতেছে তাহা অবিশ্বাস করা কঠিন সন্দেহ নাই। কাজেই খোলা সতেজ মন গঠন করা শিক্ষার একটি কাম্য গুণ হওয়া উচিত।

বুদ্ধির সততা এবং দৈহিক শৌর্য প্রদর্শনের জন্য সাহসের একান্ত প্রয়োজন। এই বাস্তব জগতের যতখানি আমরা জানি বলিয়া মনে করি প্রকৃতপক্ষে জানি তাহার চেয়ে অনেক কম, জীবনের প্রথম দিন হইতে আমরা নানারূপ বাস্তব অবাস্তব সিদ্ধান্ত এবং অনুমান প্রয়োগ করিতে থাকি এবং প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে আমাদের মানসিক অভ্যাসগুলিকে তাল পাকাইয়া ফেলি। নানারকম বুদ্ধি পরিচালিত প্রতিষ্ঠান, যেমন খ্রিষ্টধর্ম, সাম্যবাদ, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি অনাথ আশ্রমের মতো সকলকে দাসত্বের বিনিময়ে নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। কোনো নীতিকে আশ্রয় করিলে জীবন নিরাপদ এবং আরামদায়ক হইতে পারে; কিন্তু স্বাধীনমনা ব্যক্তি যিনি দলে বা গোষ্ঠীতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মিশাইয়া দেন নাই, এরূপ আরামের জীবন লাভ করিতে পারেন না; বাহিরে যখন শীতের প্রবল ঝটিকা গর্জন করিয়া ফেলে কোনো একটি নীতিই কেবল মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দান করিতে পারে।

এই প্রসঙ্গে একটি কঠিন প্রশ্ন ওঠে; ভালো জীবনকে এইরূপে নীতি বা দল হইতে কতখানি মুক্ত করা উচিত আমি দলপ্রবৃত্তি বা যূথপ্রবৃত্তি [Hard instinct] কথাটি প্রয়োগ করিতে ইতস্তত করিতেছি; কেননা ইহার সত্যতা সম্বন্ধে বিরুদ্ধে অভিমত আসে কিন্তু যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হউক, এই প্রবৃত্তির স্বরূপ যাহা বর্ণনা করা হইয়াছে তাহার সহিত সকলেই পরিচিত। যে দলের সহিত আমরা সহযোগিতা করিতে চাই, তাহার সঙ্গে মিলিত হইতে আমরা পছন্দ করি–যেমন আমাদের পরিবার-পরিজন, আমাদের প্রতিবেশি, আমাদের সহকর্মী, আমাদের রাজনৈতিক দল কিংবা আমাদের জাতি। এরূপ মিলনের বাসনা স্বাভাবিক, কেননা সহযাগিতা ভিন্ন আমরা জীবনের কোনো আনন্দই উপভোগ করিতে পারি না। অধিকন্তু প্রক্ষোভ [Emotion] বা মানসিক ভাবাবেগ ছোঁয়াচে, বিশেষ করিয়া অনেক লোক একত্র হইয়া যখন ইহা অনুভব করে। একটি উত্তেজনাপূর্ণ জনসভায় উপস্থিত থাকিয়া খুব কম লোকই উত্তেজিত না হইয়া থাকিতে পারে। তাহারা যদি বিরুদ্ধ দলীয় হয়, তাহাদের বিরোধের ভাব প্রবল হইয়া ওঠে।

বেশিরভাগ লোকের পক্ষে এরূপ বিরোধিতা কেবল তখনই সম্ভবপর যখন তাহারা বুঝিতে পারে যে, অন্যত্র ভিন্ন জনতার মধ্যেও তাহারা তাহাদের কাজের জন্য প্রশংসা লাভ করিবে। এই জন্যই ঋষিদের মিলন [Communion of Saints] অত্যাচারিতদের মনে সান্ত্বনা দিতে পারিয়াছে। আমরা কি জনতার সঙ্গে সহযোগিতার বাসনা মানিয়া লইব, না আমাদের শিক্ষা ইহা শিথিল করিতে চেষ্টা করিবে? ইহার দুই পক্ষেই যুক্তি আছে; কোনো এক পক্ষের সম্পূর্ণ অনুকূলে অভিমত না দিয়া ইহার যথার্থ উত্তর হইবে দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত পরিমাণ নির্ণয়ে, কোনো এক পক্ষের সম্পূর্ণ অনুকূলে যে অভিমত তাহার মধ্যে নয়।

আমার নিজের মনে হয় সকলেরই অন্যকে খুশি করার ও অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করার বাসনা প্রবল এবং স্বাভাবিক কিন্তু এমন হওয়া চাই যেন কোনো বিশেষ জরুরি ক্ষেত্রে অন্য বাসনা দ্বারা ইহাকে জয় করা যায়। অনুভূতিশীলতা আলোচনার সময় আমরা অন্যকে খুশি করার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি। ইহা না থাকিতে দিলে আমরা সকলেই হইতাম অসভ্য, বর্বর এবং পরিবার হইতে উপরের দিকে কোনো সামাজিক দল গঠনই সম্ভবপর হইত না। শিশুরা যদি তাহাদের পিতামাতার প্রশংসা কামনা না করিত তবে তাহাদিগকে শিক্ষাদান করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হইত। প্রক্ষোভ যে একজন হইতে অন্য জনের মধ্যে সংক্রামিত হয় তাহারও উপকারিতা আছে, বিশেষ করিয়া ইহা যখন বিজ্ঞ লোক হইতে অজ্ঞ লোকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু ভয় বা রাগ যদি ব্যাপকভাবে বহু লোকের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তাহার ফল হয় ঠিক বিপরীত। কাজেই দেখা যায় প্রক্ষোভ সংক্রামণের অর্থাৎ এক ব্যক্তি হইতে অন্যের মধ্যে প্রক্ষোভ বা ভাব সঞ্চারের প্রশ্নটি কোনমতেই সহজ নয়। যেখানে শুধু বুদ্ধিগত ব্যাপার সেখানেও বিষয়টি সুস্পষ্ট নহে। বড় বড় আবিষ্কারকদিগকে তাঁহাদের মননশক্তি ও বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইয়াছিল। (উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কলম্বাসের কথা; স্থির বুদ্ধি ও দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে তিনি নূতন মহাদেশের সন্ধানে বাহির হইয়াছিলেন কিন্তু তাহার সঙ্গীদের নিজেদের বুদ্ধি ও আত্মবিশ্বাসের উপর বিশেষ আস্থা ছিল না। নিজেদের প্রাণের ভয়ে তাহারা কলম্বাসের অভিযানে বাধা সৃষ্টি করিতে উদ্যত হইয়াছিল।

সাধারণ মানুষ যদি অন্যের মতামত গ্রহণ না করিয়া সর্বদা কেবল নিজের অভিমতই প্রকাশ করিত তবে তাহার দরুন সে অজ্ঞতার পরিচয় দিত; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্তত তাহারা যে বৈজ্ঞানিকদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাহা কল্যাণকর হইয়াছে।

আমার মনে হয়, অতি অসাধারণ লোকের কথা বাদ দিলে সাধারণ মানুষের জীবনের দুইটি ক্ষেত্র আছে; একটি বড় ক্ষেত্র, সেখানে যূথপ্রবৃত্তি বা দলের সঙ্গে মিশিয়া, সহযোগিতা করিয়া দলের ভার গ্রহণ করিয়া চলিবার বাসনা প্রবল; অন্যটি ছোট ক্ষেত্র, যেখানে যূথপ্রবৃত্তি প্রবেশ করে না। এই ছোট ক্ষেত্রটি তাহার নিজের বিচারবুদ্ধির স্থান। যে ব্যক্তি আর অন্যান্য সকলে প্রশংসা না করা পর্যন্ত কোনো স্ত্রীলোককে প্রশংসা করিতে পারে না তাহার ব্যক্তিগত অভিমত সম্বন্ধে কেহই উচ্চ ধারণা পোষণ করে না। আমরা মনে করি পত্নী নির্বাচনের ব্যাপারে যে-কোনো লোকের পক্ষে সমাজের আর সকলে কি বলিবে সে চিন্তা না করিয়া নিজের স্বাধীন অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা চালিত হওয়া উচিত। তাহার প্রতিবেশিদের অভিমতের সঙ্গে তাহার মতের মিল হইবে কি না সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়; সে যদি কোনো মেয়েকে ভালোবাসে তবে তাহার পক্ষে নিজের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও ভালোবাসার অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হওয়াই উচিত।

ইহার বিপরীত দিকেও অনুরূপ কথা বলা চলে। চাষি যে জমি চাষ করে তাহার গুণাগুণ ও উৎপাদন ক্ষমতা সম্বন্ধে সে নিজের অভিমত অনুযায়ী কাজ করিবে যদিও চাষ-আবাদের বৈজ্ঞানিক প্রণালী সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়ার পরেই সে নিজের অভিমত গঠন করিতে পারিবে। অর্থনীতিক প্রচলিত মুদ্রা সংক্রান্ত প্রশ্নে নিজের স্বাধীন অভিমত গঠন করিবেন, কিন্তু সাধারণ লোকের পক্ষে ওইরূপ জটিল ব্যাপারের মধ্যে মাথা না ঘামাইয়া বিশেষজ্ঞের অভিমত মানিয়া চলাই কর্তব্য। যেখানেই বিশেষজ্ঞান, গবেষণা ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োজিত হয় সেখানেই অভিমতের স্বাধীনতা মানিয়া চলা উচিত। কিন্তু তাই বলিয়া বিশেষজ্ঞগণ অত্যুগ্র মতের কন্টকে নিজেদের আবৃত রাখিযা জনসাধারণকে দূরে সরাইয়া রাখিলে বিশেষ কোনো উপায় হইবে না। আমাদের বেশিরভাগ কাজই সহযোগিতামূলক হওয়া উচিত এবং প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করিয়াই সহযোগিতা গড়িয়া তোলা। কর্তব্য। তবু যে-সব বিষয় আমাদের ভালো রকম আছে সে সম্বন্ধে নিজেদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করিবার ক্ষমতা থাকা চাই এবং প্রয়োজন হইলে অন্যের পক্ষে। অপ্রিয় হইলেও স্বাধীন অভিমত প্রকাশ করিবার সৎসাহস থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এই সাধারণ নীতি প্রয়োগ করিতে হয়তো অসুবিধা হইতে পারে। কিন্তু আমরা যে-সব গুণের কথা আলোচনা করিতেছি তাহা যখন বেশিরভাগ লোকের মধ্যে দেখা যাইবে তখন ইহা প্রয়োগ করিতে এত বেশি কঠিন হইবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, এই রকম জগতে সাধু ব্যক্তির উপর অত্যাচার চলিবে না; প্রকৃত সৎলোকে আত্মাভিমানে গর্বিত হইয়া বিশ্বজন হইতে পৃথক থাকিবেন না; ভাবের আবেগ দ্বারা চালিত সৎস্বভাব সুখের কারণ হইয়া উঠিবে। তাঁহার প্রতিবেশিরা তাঁহাকে ঘৃণা করিবে না কারণ তাহারা তাহাকে ভয় করিবে না। অগ্রগামী ব্যক্তিগণ [Pioneers] অপরের ভয় উৎপাদন করেন বলিয়াই তাহাদের ঘৃণার পাত্র হইয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা সাহসী হইতে শিখিয়াছে তাহাদের মধ্যে এরূপ ভয় থাকিবে না। ভয়ে অভিভূত হইয়া লোকে কু ক্লাক্স ক্লান [Ku Klux Klan] কিংবা ফ্যাসিস্তি [Faseisti] দলে যোগদান করে। সাহসী লোকপূর্ণ জগতে এরূপ অত্যাচারী সংঘের অস্তিত্বই থাকিবে না, এবং সে যুগের সৎলোকেরা প্রবৃত্তিগুলিকে এ যুগের মতো এমনভাবে বাধাও দিব না। কেবল নির্ভীক লোকেরাই এরূপ সুখের জগৎ সৃষ্টি করিতে এবং চালু রাখিতে পারে; তবে যতই তাহারা এ কাজে সফল হইবে ততই তাহাদের সাহস প্রয়োগের প্রয়োজন কমিয়া আসিবে।

শিক্ষার ফলে যদি উদ্যম, সাহস, অনুভূতিশীলতা এবং বুদ্ধি নরনারীর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয় তবে এমন এক সমাজ গড়িয়া উঠিবে যেরূপ মানবগোষ্ঠী কোনোকালে ছিল না। খুব কম লোকই তখন অসুখি হইবে। বর্তমানে সুখি না হইবার প্রধান কারণ হইল : স্বাস্থ্যহীনতা, দারিদ্র্য এবং অসন্তোষজনক যৌনজীবন। এ সকলই তখন হইবে অত্যন্ত বিরল। প্রায় সকলেই তখন পূর্ণ স্বাস্থ্যের অধিকারী হইবে। এমনকি বার্ধক্যও বিলম্বের আসিবে। শিল্প-বিপ্লবের পর হইতেই দারিদ্রের একমাত্র কারণ হইয়াছে বহু লোকের সমবেত মূর্খতা। অনুভূতিশীল লোকের মধ্যে ইহা বিলোপ করার বাসনা জাগাইয়া তুলিবে, বুদ্ধি দেখাইবে কি উপায়ে ইহা সম্ভব এবং সাহস সে উপায় গ্রহণ করিতে উৎসাহিত করিবে। ভীরু ব্যক্তি অস্বাভাবিক কিছু করার পরিবর্তে বরং দুঃখদুর্দশার মধ্যেই থাকিতে পছন্দ করিবে। বর্তমানে অধিকাংশ লোকের যৌনজীবন কমবেশি রকমের অসন্তোষজনক। ইহার জন্য অংশত দায়ী কুশিক্ষা, অংশত দায়ী ভাব্যতার বাঁধাধরা সংস্কার এবং কর্তৃপক্ষের অত্যাচার। অবাস্তব যৌনভীতি হইতে মুক্ত এক প্রজাতি [Generation] স্ত্রীলোক এই অবস্থার অবসান ঘটাইবে। ভয় স্ত্রীলোকের পক্ষে গুণ বলিয়া ধরা হইয়াছে এবং চেষ্টা করিয়া তাহাদিগকে দেহে মনে ভীরু করিয়া গড়িয়া তোলা হইয়াছে। যে-সব স্ত্রীলোকের প্রেম স্বাভাবিকভাবে আত্মপ্রকাশের পথ পায় না, তাহারা তাহাদের স্বামীদের নিষ্ঠুরতা ও ভণ্ডামিতে উৎসাহ দেয় এবং তাহাদের সন্তান-সন্ততির প্রবৃত্তিগুলি বিকৃত করিয়া তোলে। একজনই নির্ভীক স্ত্রীলোক নির্ভীক, সরল, উদার স্নেহশীল এবং স্বাধীন সন্তানের জন্ম দিয়া বিশ্বের রূপই বদলাইয়া দিতে পারে। আমরা অলস, ভীরু, হৃদয়হীন এবং মূর্খ বলিয়া যে-সব নিষ্ঠুরতা এবং দুঃখ সহ্য করি, তাহাদের অন্তরের অনুরাগ ও উদ্যম সেগুলি নির্মূল করিয়া দূর করিয়া দিবে। শিক্ষা হইতে আমরা এই দোষগুলি পাই, আবার একমাত্র শিক্ষাই ইহার বিপরীত গুণগুলির বিকাশ ঘটাইতে পারে। শিক্ষাই নূতন জগতের চাবিকাঠি।

সাধারণ নীতির আলোচনা ছাড়িয়া দিয়া যে উপায়ে আমাদের আদর্শগুলি বাস্তব রূপ গ্রহণ করিতে পারে তাহার বস্তুনিষ্ঠ এবং বিস্তারিত আলোচনা আরম্ভ করা যাক।

০৩. চরিত্রের শিক্ষা

প্রথম বৎসর

পূর্বে শিশুর জীবনের প্রথম বসরকে শিক্ষার আওতার বাহিরে ধরা হইত। যতদিন শিশু কথা বলিতে না শেখে ততদিন ইহাকে জননীর বা ধাত্রীর সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে রাখা হইত; মনে করা হইত শিশুর পক্ষে কি মঙ্গলজনক তাহা হঁহারা নিজেদের প্রবৃত্তি হইতেই জানেন। প্রকৃতপক্ষে হাঁহারা কিছুই জানিতেন না। জীবনের প্রথম বৎসরেই বহু শিশু মারা যাইত; লালন-পালনের দোষে বহু খারাপ অভ্যাস গঠিত হইত। সম্প্রতি এ সকল বিষয় জানা গিয়াছে। শিশু-পালনাগারে যদি বিজ্ঞান প্রবেশ করে তবে অনেকে রুষ্ট হন। কেননা তাহাদের ধারণা শিশুর মঙ্গলের সম্পূর্ণ ভার মায়ের হাতে; শিশুর জীবনে মায়ের কথঞ্চিৎ স্থান যে বিজ্ঞান গ্রহণ করিবে তাহা তাঁহারা বরদাস্ত করিতে চান না। কিন্তু ভাবপ্রবণতা এবং বাৎসল্যপ্রীতি একসঙ্গে থাকিতে পারে না। যে জনক বা জননী নিজ সন্তানকে ভালোবাসেন তিনি চান যে তাঁহার সন্তান বাঁচিয়া থাকুক; দরকার হইলে এজন্য বুদ্ধি প্রয়োগ করিতেও তিনি কুণ্ঠিত নন; কাজেই নিঃসন্তান লোকের মধ্যে এবং রুশোর মতো যাহারা নিজেদের সন্তানদিগকে অনাথ আশ্রমে প্রতিপালনের পক্ষপাতি তাহাদের মধ্যেই এ ভাবপ্রবণতা প্রবল হইতে দেখা যায়। শিশুর পালন ব্যাপারে বিজ্ঞান কি বলে বেশিরভাগ শিক্ষিত জনক-জননী তাহা জানিতে ইচ্ছুক; অশিক্ষিত পিতামাতাও শিশুর-মঙ্গল কেন্দ্র হইতে ইহা জানিয়া লয়। ইহাতে যে সুফল ফলিয়াছে তাহা শিশু মৃত্যুর সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পাওয়া হইতে বোঝা যায়। ইহা বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, যথোপযুক্ত যত্ন ও নিপুণতা প্রয়োগ করিলে অতি অল্প শিশুই আঁতুড়ে মারা যাইবে। কেবল খুব অল্পই যে মরিবে তাহা নহে, যাহারা বাঁচিয়া থাকিবে তাহারা দেহে এবং মনে অধিকতর স্বাস্থ্যের অধিকারী হইবে।

শিশুর দৈহিক স্বাস্থ্যের প্রশ্ন (সমস্যা) এ পুস্তকের আলোচ্য নয়; ইহা চিকিৎসকদের হাতেই ছাড়িয়া দেওয়া উচিত। যেখানে ইহা মনোবিজ্ঞানের সহিত জড়িত সেখানেই কেবল ইহার উল্লেখ করিব। কিন্তু জীবনের প্রথম বছরে কোটি মানসিক, কোনটি দৈহিক সমস্যা তাহা নির্ণয় করা অসম্ভব। অধিকন্তু শিশুর দেহের দিকে কোনো লক্ষ্য না রাখিলে–কয়েক বৎসর পরে শিশুর দৈহিক সমস্যা শিক্ষকের প্রধান প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে। অতএব অনধিকার প্রবেশ হইলেও মধ্যে মধ্যে আমাদিগকে শিশুর দৈহিক প্রশ্ন লইয়াও আলোচনা করিতে হইবে।

সদ্যপ্রসূত শিশু কতকগুলি প্রতিবতী [reflx) স্বভাব এবং প্রবৃত্তি লইয়া ভূমিষ্ঠ হয়; প্রথমে ইহার অভ্যাস বলিয়া কিছু থাকে না। মাতৃগর্ভে থাকিবার সময় সে যাহা অভ্যাস করিয়াছিল তাহা নূতন পরিবেশে কোনোই কাজে আসে না। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াও অনেক সময় শিখাইতে হয় এবং কতক শিশু এই অভ্যাস তাড়াতাড়ি শিখিতে পারে না বলিয়াই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় একটি প্রবৃত্তি বেশ পুষ্ট [Developed] দেখা যায়; ইহা হইল চুষিবার প্রবৃত্তি। শিশু যখন কিছু চুষিতে শুরু করে তখন এই নূতন পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করে না। কিন্তু জাগ্রত অবস্থার অন্য সময়টুকু তাহার কাছে ফাঁকা, বিস্ময়কর মনে হয়। চব্বিশ ঘণ্টার অধিকাংশ সময় ঘুমাইয়া কাটাইয়া সে এই অস্বস্তিকর অবস্থায় আরামবোধ করে। এক পক্ষ পরে কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের মধ্যে নিয়মিতভাবে বারবার অভিজ্ঞতা লাভের পর কিছু পাওয়ার বাসনা তাহার মনে দানা বাঁধিযা উঠে। শিশু অত্যন্ত সংরক্ষণশীল; কোনো নূতনত্ব সে পছন্দ করে না। সে যদি কথা বলিতে পারিত, তবে হয়তো বলিত: তুমি কি মনে কর, আমার জীবনকালের অভ্যাস আমি ছাড়িয়া দিব? যেরূপ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শিশু অভ্যাস আয়ত্ত করে তাহা বিস্ময়কর। প্রত্যেকটি কু-অভ্যাস পরিবর্তীকালে সদভ্যাসগুলির প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায়; এ জন্যই অতি শৈশবে প্রথম অভ্যাস গঠনের গুরুত্ব এত বেশি। প্রথম অভ্যাসগুলি যদি ভালো হয় তবে পরে অশেষ ঝামেলার হাত হইতে রেহাই পাওয়া যায়। অধিকন্তু শৈশবে কোনো অভ্যাস আয়ত্ত হইলে তাহাকে পরে প্রবৃত্তি বলিয়া মনে হয় এবং প্রবৃত্তি মতোই ইহা স্থায়ী ও দৃঢ়মূল হইয়া উঠে। পরবর্তীকালে ইহার বিপরীত অভ্যাস গঠিত হইলে তাহা প্রথম গঠিত অভ্যাসের মতো দৃঢ় হয় না। এজন্যও প্রথম অভ্যাস গঠনের উপর খুবই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

শৈশবে অভ্যাস গঠনের বিষয় আলোচনা করিবার সময় দুইটি বিষয়ের কথা ওঠে : প্রথম এবং বিশেষ প্রয়োজনীয় হইল স্বাস্থ্য, দ্বিতীয় চরিত্র। আমরা চাই শিশু যেন সকলের প্রিয় হয় এবং জীবন-সংগ্রামে জয়ী হইতে সমর্থ হয়। সৌভাগ্যক্রমে স্বাস্থ্য এবং চরিত্র এ উভয়েরই লক্ষ্য ইহাই; একটির পক্ষে যাহা শুভঙ্কর অন্যটির পক্ষেও তাহা কল্যাণকর। এই পুস্তকে আমরা চরিত্র সম্বন্ধেই বিশেষভাবে বিবেচনা করিব; কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্যও অনুরূপ অভ্যাস এবং প্রক্রিয়া দরকার। কাজেই আমাদিগকে স্বাস্থ্যবান শয়তান বা রুগ্ন ঋষির মধ্যে একজনকে বাছিয়া লইবার কঠিন সমস্যার সম্মুখিন হইতে হইবে না।

শিশু যখন চিৎকার করে তখনই না খাওয়াইয়া নিয়মিত সময় অন্তর খাওয়ানোর উপকারিতা আজকাল প্রত্যেক মাতাই জানেন। এ রীতি প্রচলিত হইয়াছে এইজন্য যে, ইহা শিশুর হজম ক্রিয়ার পক্ষে উপকারী; এ কারণই নিয়মিত খাবার দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কিন্তু নৈতিক শিক্ষার পক্ষেও ইহা বাঞ্ছনীয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা যতখানি মনে করেন শিশুরা তাহার চেয়ে অনেক বেশি চতুর; যদি তাহারা দেখে যে, চিৎকার করিলেই আরামদায়ক কিছু পাওয়া যায় তবে তাহারা চিৎকার করিবেই। পরবর্তীকালে সবকিছু লইয়াই খুঁত খুঁত করার বা আবদার করার অভ্যাসের ফলে যখন তাহারা অপরের নিকট অপ্রিয় হয় এবং নিজেদের ঈপ্সিত জিনিস পায় না,তখন তাহারা রুষ্ট ও বিস্মিত হয়; জগৎ তাহাদের নিকট উদাসীন এবং সহানুভূতিহীন বলিয়া মনে হয়। তাহারা আদর পাইবে এবং ইহার ফলে শৈশবে যে কুশিক্ষা পাইয়াছিল তাহাই দৃঢ়তর হইবে। ধনীলোকের বেলাতেও ইহা সত্য। শৈশবে যদি উপযুক্ত শিক্ষা না পায় তবে পরবর্তীকালে তাহারা (নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী) মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়ায় হয় অসন্তুষ্ট হইবে, আর না হয় হইবে স্বার্থপর ও অত্যাচারী। যে মুহূর্তে শিশুর জন্ম হয় তখনই নৈতিক শিক্ষাদান আরম্ভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়; কেননা তখন তাহার কোনো বাসনা গঠিত হয় নাই; কাজেই তখন এ শিক্ষা দিতে গিয়া তাহার কোনো বাসনাকে খর্ব করিতেও হইবে না। পরবর্তীকালে এ শিক্ষা দিতে গেলেই কতকগুলি অভ্যাসের বিরুদ্ধে ইহা প্রয়োগ করিতে হইবে এবং স্বভাবতই ইহা শিশুর ক্রোধের উদ্রেক করে।

শিশুর সঙ্গে ব্যবহারে অবহেলা ও আদর এই দুইটির মধ্যে সমতা রাখা দরকার। তাহার স্বাস্থ্যের জন্য যাহা প্রয়োজন তাহা অবশ্যই করিতে হইবে; ঠাণ্ডা বাতাসে থাকিলে তাহাকে তুলিয়া শুকনা গরম জায়গায় রাখিতে হইবে। কিন্তু কাঁদিবার পক্ষে যথেষ্ট কোনো দৈহিক কারণ না থাকা সত্ত্বেও যদি সে কাঁদিতে থাকে, তাহাকে কাঁদিতেই দিতে হইবে; তাহা না হইলে অল্পদিনের মধ্যেই সে স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিবে। তাহাকে পরিচর্যা করিবার সময় অযথা হইচই বা অত্যধিক আদর ও প্রীতি দেখাইবার কোনো প্রয়োজন নাই। কোনো বয়সেই শিশুকে অতিরিক্ত মাত্রায় আদর আপ্যায়ন দেখানো উচিত নয়। প্রথম হইতেই তাহাকে একজন ভাবী বয়স্ক ব্যক্তিরূপে দেখিতে হইবে। বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে যে অভ্যাস অসহনীয় মনে হয়, শিশুর মধ্যেই তাহাই প্রীতিকর বোধ হইতে পারে। অবশ্য শিশু যথার্থ বয়স্ক ব্যক্তির অভ্যাস গঠন করিতে পারে না, তবে এরূপ অভ্যাস গঠনে যাহা যাহা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিতে পারে তাহা এড়াইয়া যাওয়াই উচিত। সর্বোপরি কখনই শিশুর মনে আত্ম-প্রাধান্যের ভাব জন্মিতে দেওয়া ঠিক হইবে না, কেননা এই ভাব গড়িয়া উঠিলে পরবর্তী বয়সে সে যখন অন্য সকলের নিকট হইতে বিশেষ আপ্যায়ন পাইবে না, তখন তাহার মনে আঘাত লাগিবে।

শিশুকে শিক্ষা দিবার সময় পিতামাতার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হইল আদর ও অনাদরের মধ্যে সূক্ষ্ম সমতা রাখিয়া আচরণ করা। শিশুর যাহাতে কোনো প্রকার স্বাস্থ্যহানি না ঘটে সেজন্য সদাজাগ্রত সতর্কতা এবং যত্ন দরকার। সন্তানের প্রতি মমতা অত্যধিক না হইলে এগুলি প্রায় দেখা যায় না। কিন্তু যেখানে এইরূপ সতর্কতা ও যত্ন পরিচর্যা আছে সেখানে হয়তো বিশেষ বিজ্ঞতার সঙ্গে এগুলি প্রয়োগ করা হয় না। স্নেহশীল পিতামাতার কাছে সন্তান একটি মহাসামগ্রী। পিতামাতা যদি সন্তানের প্রতি আচরণে বিশেষ সংযত না হন তবে শিশু ইহা বুঝিতে পারে এবং নিজেকে মহামূল্যবান মনে করিয়া নিজের সম্বন্ধে কাল্পনিক উচ্চ ধারণা গড়িয়া তোলে। পরবর্তীকালে সামাজিক পরিবেশে সে তো পিতামাতার কাছে যেরূপ পাইয়াছে সেরূপ আদর যত্ন পাইবে না; পিতামাতার অহেতুক স্নেহের আতিশয্য তাহার মনে যে ধারণা সৃষ্টি করিয়াছিল যে সে সকলের আদরের মধ্যমণি তাহা অবশেষে তাহাকে নিরাশ করিবে। কাজেই পিতামাতার কর্তব্য হইল শুধু শিশুর প্রথম বৎসর নয়, পরেও সন্তানের কোনো অসুখ ও বিসুখ হইলে উকণ্ঠা প্রকাশ না করিয়া স্বাভাবিকভাবে প্রফুল্লতার সঙ্গেই তাহা গ্রহণ করা উচিত। আগের দিনে শিশুর অসুখ হইলেই তাহাকে অন্য সকলের কাছ হইতে পৃথক করিয়া, জামাকাপড় দিয়া আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া বিছানায় শোওয়াইয়া রাখা হইত, কিংবা কোলে করিয়া অথবা দোলনায় রাখিয়া দোলানো হইত। তাহার স্বতঃস্ফূর্ত আচরণে বাধা পড়িত। সন্তান মানুষ করার এই পন্থা ছিল আগাগোড়া ভুলে ভরা। ইহা শিশুকে অসহায়, পরজীবী আদুরে গোপালে পরিণত করিত। যথার্থ নিয়ম হইল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত কাজে উৎসাহ দিন, কিন্তু অন্যের উপর দাবি করিলে তখন তাহাকে থামান। আপনি শিশুর জন্য কতখানি করেন বা কি পরিমাণ কষ্ট করেন তাহা শিশুকে দেখিতে দিবেন না। যেখানে সম্ভব সেখানে শিশু বয়স্ক ব্যক্তির উপর জুলুম করিয়া নয়, নিজের চেষ্টাতেই সাফল্য লাভ করুক; ইহাতে সে আত্মতৃপ্তি লাভ করিবে। আধুনিক শিক্ষায় আমাদের উদ্দেশ্য হইল–বাহিরের শাসন ও শৃঙ্খলা যথাসম্ভব কমাইয়া দেওয়া। ইহার জন্য ভিতর হইতে আত্মশৃঙ্খলা জাগানো দরকার। এই আত্মশৃঙখলা শিশুর প্রথম বছরে আয়ত্ত করানো যেমন সহজ তেমন কোনো সময়ে নয়। উদাহরণ দিয়া বলি শিশুকে যখন ঘুম পাড়াইতে চান তখন ইহাকে দোলনায় রাখিয়া দোলানো বা কোলে করিয়া বেড়াইবার দরকার নাই, এমনকি আপনি যেখানে থাকিলে সে শুইয়া থাকিয়া আপনাকে দেখিতে পাইবে এমন জায়গাতেও থাকিবেন না। কিন্তু আপনি যদি সোহাগ দেখাইয়া কোলে করিয়া ঘোরেন কিংবা আরামদায়ক দোল দেন, তবে পরে ঘুম পাড়াইতে চাহিলেও আপনাকে আবার ওইরূপ করিতে হইবে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে বুঝিবেন শিশুকে ঘুম পাড়ানো কি ঝকমারি কাজ। আপনি বরং উহাকে শুকনো জামা পরাইয়া, শুকনা বিছানায় শোওয়াইয়া দিন; তারপর শান্তস্বরে কয়েকটি মন্তব্য করিয়া চলিয়া আসুন। কয়েক মিনিট সে কাঁদিতে পারে কিন্তু যদি কোনোরূপ অসুখ না থাকে তবে সে খানিক পরেই থামিবে। তখন যদি দেখিতে যান, দেখিতে পাইবেন শিশু গভীর ঘুমে মগ্ন রহিয়াছে। কোলে করিয়া ঘোরা বা আদর করিয়া চাপড়ানোর চেয়ে এই প্রক্রিয়ায় শিশু অনেক বেশি ঘুমাইবে।

পূর্বে বলা হইয়াছে সদ্যপ্রসূত শিশুর কোনো অভ্যাস থাকে না, থাকে কেবল কতকগুলি প্রতিবর্তী এবং প্রবৃত্তি। ইহা অনুমান করা যায় যে, তাহার জগৎ কোনোরূপ বস্তু দ্বারা গঠিত নয়। কোনো জিনিস চিনিতে হইলে বারংবার একই প্রকার অভিজ্ঞতা দরকার; কোনো জিনিস সম্বন্ধে ধারণা জন্মিবার পূর্বে তাহা নিশ্চয়ই চিনিতে হইবে। শিশুর কাছে তাহার খাটের স্পর্শ, তাহার মায়ের স্তন বা দুধের বোতলের গন্ধ ও স্পর্শ এবং তাহার মায়ের কিংবা ধাত্রীর কণ্ঠস্বর অল্প সময়ের মধ্যে পরিচিত হইয়া ওঠে। তাহার মায়ের চেহারা বা খাটের আকৃতি সম্বন্ধে ধারণা পরে আসে, কেননা সদ্যোজাত শিশু কোনো জিনিস ভালো করিয়া দেখিবার মতো চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে পারে না, ক্রমে সংস্পর্শের ফলে অভ্যাস গঠনের ভিতর দিয়া স্পর্শ, দৃষ্টি, ঘ্রাণ এবং শ্রবণ একত্রে মিলিয়া কোনো বিষয় সম্বন্ধে শিশুর ধারণা জন্মায় অর্থাৎ স্পর্শ করিয়া, চোখ দিয়া দেখিয়া ঘ্রাণ লইয়া এবং শব্দ শুনিয়া শিশু কোনো বস্তু সম্বন্ধে ধারণা গঠন করে; একটি চিনিলে আর একটি চিনিতে আগ্রহ জন্মে। তখনও কিছু সময়ের জন্য শিশুর কোনো পদার্থ বা মানুষের মধ্যে পার্থক্য বোধ জন্মে না। যে শিশু কখনও মায়ের দুধ পান করে, কখনও বা বোতলভরা দুধ পান করে সে কিছুদিন পর্যন্ত তাহার মা এবং বোতলের প্রতি একইরকম ভাব পোষণ করিবে। এই সময়ে কেবল নিছক দৈহিক উপায়েই শিক্ষা দিতে হইবে। এ সময়ে শিশুর আনন্দ এবং কষ্ট সবই দৈহিক। খাবার পাইলে এবং কোমল উষ্ণতা বোধ করিলে সে আনন্দিত হয়, দেহের ব্যথাতেই কষ্ট পায়। আনন্দের সহিত যাহা সংযুক্ত তাহা পাওয়ার জন্য আচরণের অভ্যাস এবং কষ্টের সঙ্গে যাহা সংযুক্ত তাহা পরিহার করার জন্য আচরণের অভ্যাস এই সময় গড়িয়া ওঠে। শিশুর ক্রন্দন আংশিকভাবে প্রতিবর্তী মাত্র, দৈহিক কষ্ট পাইলেই স্বভাবতই সে কাঁদিয়া ওঠে; আনন্দ পাওয়ার উপায় হিসাবেও কখনও কখনও শিশু কাঁদিয়া থাকে। প্রথম প্রথম অবশ্য কেবল কষ্ট অনুভব করিয়াই কাঁদে। শিশু যখন কষ্ট বা ব্যথা পাইয়া কাঁদিতে থাকে তখন কষ্টের কারণ দূর করিলেই সে আনন্দ পায়। এইভাবে কাদার সঙ্গে আনন্দের অনুভূতির যোগ সাধিত হয়। ইহার পরে শিশু দৈহিক কোনোরকম ব্যথা বোধ না করিলেও আনন্দ কামনা করিয়া কাঁদিতে শুরু করে; ইহা তাহার বুদ্ধির জয়ের একটি প্রথম পরিচয়। কিন্তু যতই চেষ্টা করুক, প্রকৃত বেদনা বা কষ্ট বোধ করিলে যেভাবে চিৎকার দেয় সেরূপ চিৎকার কিন্তু তাহার মুখ দিয়া বাহির হয় না। মায়ের কানে এ পার্থক্য ধরা পড়ে এবং তিনি যদি বুদ্ধিমতি হন তবে যে কান্না দৈহিক কষ্টের দ্যোতক নয় তাহা উপেক্ষাই করিবেন। শিশুকে কোলে করিয়া নাচাইয়া কিংবা ইহার কানের কাছে মিষ্টি স্বরে গান করিয়া আনন্দ দেওয়া সহজ এবং শিশুর কাছে তাহা আরামদায়ক। এরূপ পাইলে শিশু শীঘ্রই আরও বেশি বেশি আরাম দাবি করিবে এবং ইহা না হইলে ঘুমাইবে না; কিন্তু কেবল খাবার সময় ছাড়া সারা দিন শিশুর ঘুমাইয়া কাটানো উচিত। এ উপদেশ কঠোর মনে হইতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতা হইতে দেখা যায় যে, ইহা শিশুর স্বাস্থ্য ও আনন্দের কারণই হইয়া থাকে।

বয়স্ক ব্যক্তিরা শিশুদিগকে আদর দিতে গিয়া যেন বাড়াবাড়ি না করে সেদিকে লক্ষ রাখিতে হইবে; শিশুরা নিজেদেরই চেষ্টায় যে আনন্দ লাভ করিতে পারে তাহাতে বরং উৎসাহ দিতে হইবে। প্রথম হইতেই যাহাতে ইহারা হাত-পা ছুড়িয়া মাংসপেশির সঞ্চালন করিতে পারে তাহার সুবিধা করিয়া দিতে হইবে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এতদিন পর্যন্ত কেমন করিয়া শিশুদিগকে গরম কাপড় দিয়া জড়াইয়া রাখিতেন ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। ইহা দেখিয়া মনে হয় সন্তান-স্নেহ আলস্যকে জয় করিতে পারে নাই, কেননা হাত-পা মুক্ত থাকিলে শিশুর প্রতি বেশি সতর্কতা রাখিতে হয়। যখন শিশু দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে পারে তখন হইতেই সে চলমান জিনিস দেখিতে আনন্দ পায়, বিশেষ করিয়া হাওয়ায় কোনো কিছু দুলিতে দেখিলে। কিন্তু যতদিন না শিশু যাহা দেখে তাহা ধরিতে পারে ততদিন ইহার আনন্দদানের জিনিস খুব বেশি থাকে না। তারপর অকস্মাৎ একটি নূতন আনন্দের সন্ধান পায়–ইহা হইল কোনো জিনিস ধরিবার আনন্দ। কিছুদিন শিশু জাগ্রত অবস্থায় অনেকটা সময় কিছু ধরিয়া বা ধরিবার চেষ্টা করার আনন্দে অতিবাহিত করে। এই সময় সে ঝুমঝুমি হইতে আনন্দ পায়। ইহার কিছু আগে সে হাত-পায়ের আঙুল জয় করিয়াছে। প্রথমে শিশু পায়ের আঙুলগুলির যে সঞ্চালন তাহা সম্পূর্ণ প্রতিবর্তী, অর্থাৎ শিশু নিজে ইচ্ছা করিয়া চালায় না, আপনা আপনি সঞ্চালিত হয়; পরে সে বুঝিতে পারে যে, ইহার সঞ্চালন তাহার আয়ত্তে। একজন সাম্রাজ্যবাদী কোনো বিদেশ জয় করিলে যেরূপ আনন্দিত হন, হাত পায়ের উপর অধিকার লাভ করিয়া শিশুও সেইরূপ আনন্দ অনুভব করে। এগুলি তখন তাহার কাছে আর বাহিরের অঙ্গ নয়। তাহার নিজের অধিকারে; নিজ দেহেরই অংশ। শিশুর পক্ষে উপযুক্ত জিনিস তাহার হাতের কাছে থাকিলে এই সময় হইতে সে অনেক প্রকারে আনন্দ লাভ করিতে পারে। এই ধরনের আনন্দ শিশু শিক্ষার পক্ষে উপযোগী, অবশ্য দেখিতে হইবে সে যেন উলটাইয়া না পড়ে, পিন গিলিয়া না ফেলে কিংবা অন্য প্রকারে আঘাত না পায়।

শিশু কেবল খাইবার সময়ই আনন্দ পায়। তাহা ছাড়া শিশুর প্রথম তিন মাস মোটের উপর বড়ই নিরানন্দময়। আরাম বোধ করিলেই সে ঘুমাইবে। জাগিলেই কিছুটা অস্বস্তি। মনের শক্তির উপর মানুষের সুখ নির্ভর করে কিন্তু তিনি মাসের কম বয়সের শিশুর মধ্যে ইহা দেখা দেয় না; তখন তাহার অভিজ্ঞতা হয় নাই, পেশিও ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে না। ইতর প্রাণীর বাচ্চাগুলি অল্প বয়স হইতেই জীবন উপভোগ করিতে শুরু করে কারণ তাহাদের অধিকাংশ আচরণই প্রকৃতি কর্তৃক চালিত; অভিজ্ঞতার বিশেষ প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মানবশিশু প্রবৃত্তিচালিত হইয়া আনন্দদায়ক কাজ খুব কমই করিতে পারে। মোটের উপর শিশুর প্রথম তিন মাস কালকে অবসাদের কাল বলা যায়; কিন্তু অধিক সময় ঘুমাইবার জন্য এরূপ অবসাদেরই প্রয়োজন। শিশুকে বেশি আমোদ আহ্লাদ দিতে গেলে তাহার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিবারই সম্ভাবনা।

শিশুর বয়স যখন দুই তিন মাস তখন সে হাসিতে শেখে এবং মানুষ ও জড়পদার্থের মধ্যে পার্থক্য বুঝিতে পারে। এই সময় হইতে মায়ের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিতে থাকে; মাকে দেখিলে সে আনন্দ প্রকাশ করে এবং সাড়া দেয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাহার মনে প্রশংসা ও অনুমোদন পাওয়ার বাসনা জাগিয়া ওঠে। আমার নিজের ছেলের বয়স যখন পাঁচ মাস তখন এ বাসনায় স্পষ্ট প্রকাশ দেখা গিয়াছে, কয়েকবার চেষ্টার পর সে টেবিলের উপর হইতে একটা ভারী ঘণ্টা তুলিয়া লইল এবং বাজাইবার সময়ে গর্বের হাসি হাসিয়া সকলের মুখের দিকে তাকাইতে লাগিল। এই সময় হইতে শিক্ষকের হাতে একটি নূতন অস্ত্র আসিল ইহা হইল প্রশংসা ও নিন্দা। শৈশবে এই অস্ত্রের শক্তি খুব বেশি কিন্তু বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে ইহা প্রয়োগ করিতে হইবে। শিশুর প্রথম বছরে তাহাকে কখনই নিন্দা করা ঠিক হইবে না, পরেও ইহা খুব কম প্রয়োগ করিতে হইবে। প্রশংসা বরং কম ক্ষতিকর। কিন্তু ইহা অতি অল্পতেই যখন তখন প্রয়োগ করিলে ইহার মূল্য কমিয়া যায়; শিশুকে অতিরিক্ত মাত্রায় উৎসাহিত করার জন্যও ইহা প্রয়োগ করা উচিত নয়। শিশু যখন প্রথম হাঁটে এবং বোধগম্য কথা বলে তখন খুব কম পিতামাতাই প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারেন। তাহা ছাড়া শিশু যখন চেষ্টা করিয়া কোনো কঠিন বিষয়ে কৃতকার্য হয় তখন পুরস্কার হিসাবে প্রশংসা তাহার সত্যই প্রাপ্য। অধিকন্তু শিশুকে ইহা বুঝিতে দেওয়া ভালো যে, আপনি তাহার শিক্ষার বাসনার সহানুভূতি দেখাইতেছেন।

শিশুর শিখিবার বাসনা এত বেশি যে, পিতামাতা কেবল ইহার সুযোগ করিয়া দিলেই যথেষ্ট। শিশুকে আত্মবিকাশের সুযোগ দিন, সে নিজের চেষ্টাতেই অগ্রসর হইবে। শিশুকে হামাগুড়ি দিতে, হাঁটিতে অথবা তাহার পেশি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অন্য কোনো কিছু শিখাইতে হইবে না। আমরা অবশ্য কথা বলানো শিখাইব কিন্তু ইহাতে কোনো উপকার হয় কি না সন্দেহ। শিশুরা নিজেদের বুদ্ধির সঙ্গে সমতা রাখিয়া শিখিতে থাকে, জোর করিয়া শিখানোর চেষ্টা করা ভুল। চেষ্টা করিয়া প্রাথমিক অসুবিধাগুলি জয় করিয়া কৃতকার্য হওয়ার যে অভিজ্ঞতা তাহাই সারাজীবন ধরিয়া চেষ্টার প্রেরণা জোগায়। এই অসুবিধাগুলি এমন হওয়া উচিত নয় যাহা শিশু জয় করিতে না পারিয়া নিরুৎসাহ হইয়া পড়ে কিংবা এমন সহজও হওয়া উচিত নয় যাহাতে কোনো চেষ্টারই প্রয়োজন হয় না। জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত ইহাই হইল মৌলিক নীতি। আমরা নিজেরা যাহা কিছু করি কেবল তাহা দ্বারাই শিখিয়া থাকে। বয়স্ক ব্যক্তি এইটুকু করিতে পারেন–শিশু যাহা করিতে চাহিবে এমন কিছু নিজে করিয়া দেখাইলেন যেমন ঝুমঝুমি বাজানো; তারপর কেমন করিয়া ঝুমঝুমি বাজাইতে হয় শিশু নিজে চেষ্টা করিয়া শিখুক। অন্যে যাহা করে তাহা দেখিয়া সে সেইরূপ চেষ্টা করিতে উৎসাহী হয় মাত্র; অন্যের কিছু করা তাই শিশুর শিক্ষা নয়, শিক্ষার প্রেরণা মাত্র।

নিয়মানুবর্তিতা এবং রুটিন মতো কাজ শিশুর জীবনে বিশেষ করিয়া প্রথম বৎসরে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রথম হইতে ঘুম, খাওয়া এবং মলমূত্র ত্যাগে নির্দিষ্ট অভ্যাস গঠন করাইতে হইবে। ইহা ছাড়া পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত শিশুর মনের দিক দিয়া বিশেষ উপকারী। ইহা তাহাকে জিনিস চিনিতে সাহায্য করে এবং তাহার মনে নিরাপত্তার ভাব গড়িয়া তোলে। আমার অনেক সময় মনে হইয়াছে যে, প্রকৃতির নিয়ম সর্বদা একইরকম থাকে বলিয়া যে বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস আমাদের মধ্যে গড়িয়া উঠিয়াছে নিরাপত্তার বাসনা হইতেই তাহার উৎপত্তি। যাহা ঘটিবে বলিয়া জানা আছে তাহার সঙ্গে আমরা আঁটিয়া উঠিতে পারি কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যদি অকস্মাৎ পরিবর্তিত হইয়া যাইত তবে আমরা বাঁচিতাম না। প্রথম অবস্থায় শিশু থাকে দুর্বল, তাহাকে আশ্বস্ত করিবার এবং সকল আপদ হইতে রক্ষা করিয়া আরামে রাখিবার প্রয়োজন আছে। শৈশবাবস্থার শেষ দিকে শিশুর নূতনের প্রতি ঝোঁক বাড়ে কিন্তু প্রথম বছরে অস্বাভাবিক জিনিস মাত্রই তাহার ভীতি উৎপাদন করে। যদি পারেন, শিশুকে ভয় অনুভব করিতে দিবেন না। যদি সে অসুস্থ হয় এবং আপনি উদ্বিগ্ন হন, আপনার উদ্বেগ সযত্নে গোপন রাখিবেন যাহাতে শিশু মোটেই বুঝিতে না পারে। এমন কিছুই করিবেন না যাহা উত্তেজনা সৃষ্টি করিতে পারে। শিশু যদি না খায়, না ঘুমায়, কিছুক্ষণ মলমূত্র ত্যাগ না করে তবে উদ্বেগের ভাব দেখাইবেন না। কেননা এরূপ করিলে শিশুর মনে আত্মপ্রাধান্যের ভাব উঠিতে পারে। ইহা কেবল শিশুর প্রথম বছরেই প্রযোজ্য নয়, পরেও মানিয়া চলা উচিত। শিশুকে কখনোই বুঝিতে দিবেন না যে, আপনি চান শিশু কোনো একটি স্বাভাবিক কাজ করুক যাহা তাহার নিজের পক্ষেও আনন্দদায়ক। যেমন খাওয়া এবং তাহা করিয়া সে আপনাকে আনন্দ দিক। এরূপ করিলে সে বুঝিবে যে একটি নূতন ক্ষমতা সে হাতে পাইয়াছে; এবং যাহা সে আপনা-আপনিই করিত তাহা করাইবার জন্য তাহাকে অন্যে আদর আপ্যায়ন তোষামোদ করুক ইহাই সে মনে মনে কামনা করিবে। অনুমান করিবেন না যে, শিশুর এইরূপ আচরণ বুঝিবার মতো বুদ্ধি নাই। ইহার ক্ষমতা কম, বুদ্ধিও সীমাবদ্ধ কিন্তু যেখানে সে ইহা প্রয়োগ করিতে পারে সেখানে তাহার বুদ্ধি বয়স্ক ব্যক্তির মতোই। প্রথম বারো মাসের মধ্যে শিশু যতখানি শেখে পরবর্তীকালে ওই পরিমাণ সময়ের মধ্যে সে আর ততখানি শিখিতে পারে না; অত্যন্ত সক্রিয় বুদ্ধি না থাকিলে কখনই ইহা সম্ভব হইত না।

আসল কথা হইল শিশুর মধ্যে ভবিষ্যতের একজন বয়স্ক ব্যক্তির সম্ভাবনা নিহিত রহিয়াছে ইহা মনে করিয়া ছোট্ট শিশুর প্রতিও শ্রদ্ধাযুক্ত আচরণ করুন। আপনার বর্তমান সুবিধার নিকট কিংবা শিশুকে অত্যধিক আদর করিয়া যে আনন্দ পান তাহার নিকট শিশুর ভবিষ্যৎ বলি দিবেন না। এই দুইটিই সমান ক্ষতিকর। অন্যত্র যেমন এখানেও তেমনই শিশুর শিক্ষাদান ব্যাপারে ঠিক পথে চলিতে হইলে স্নেহ ও জ্ঞানের মিলন আবশ্যক।

০৪. ভয়

পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে দুই হইতে ছয় বৎসর বয়স্ক শিশুর নৈতিক শিক্ষার বিষয় আলোচনা করিব। শিশুর বয়স ছয় বৎসর হইতেই তাহার নৈতিক শিক্ষা প্রায় শেষ হওয়া উচিত; অর্থাৎ পরবর্তীকালে বালক-বালিকার নিকট হইতে যে গুণের বিকাশ আশা করা হইবে এই সময়ের মধ্যে ভালো অভ্যাস গঠনের ফলে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগরিত হওয়ায় তাহার সূত্রপাত হওয়া চাই। যেখানে নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয় কিংবা খারাপভাবে দেওয়া হয় কেবল সেখানেই পরে এ শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক হইয়া পড়ে।

ধরিয়া লইলাম যে, পূর্ব অধ্যায়ে চারিত্রিক শৃঙ্খরা বিধানের জন্য যে প্রণালী আলোচিত হইয়াছে তাহা অবলম্বিত হওয়ায় শিশু সুখি ও স্বাস্থ্যবান হইয়া এক বৎসর বয়সের হইয়াছে। অবশ্য পিতামাতার সর্বপ্রকার যত্ন সত্ত্বেও অল্পসংখ্যক শিশুর স্বাস্থ্য খারাপ থাকিবেই। কিন্তু আশা করা যায় যে, কালক্রমে এ সংখ্যাও হ্রাস পাইবে। বর্তমান যুগের জ্ঞান যথাযথভাবে প্রয়োগ করিলে অন্য দিক দিয়া রুগ্ন শিশুর সংখ্যা খুবই তুচ্ছ হইত। যে সব শিশুর শৈশবের শিক্ষা ভালো হয় নাই তাহাদের জন্য কি করা উচিত তাহা আমার আলোচ্য বিষয় নয়; এ সমস্যা শিক্ষকের, পিতামাতার নয়। এ-বই বিশেষ করিয়া সন্তানের পিতামাতার উদ্দেশ্যেই লিখিত।

শিশুর দ্বিতীয় বৎসর খুবই আনন্দময়। সে হাঁটিতে এবং কথা বলিতে শিখিয়াছে; ইহার ভিতর সে স্বাধীনতা ও নূতন শক্তির সন্ধান পাইয়াছে। শিশু দিন দিন বাড়িতে থাকে। (১) তাহার পক্ষে স্বাধীনভাবে খেলা করা সম্ভব হয়, এবং বিশ্বের সব জিনিস দেখিবার বাসনা তাহার এত বেশি হয় যে, একজন ভূপর্যটকের তত হয় না। পাখি, ফুল, নদী, সমুদ্র, মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, স্টিমার প্রভৃতি তাহার অপরিসীম আনন্দ ও কৌতূহলের উদ্রেক করে। এই সময় তাহার কৌতূহলের শেষ নাই, প্রায়ই তাহার মুখে শোনা যাইবে দেখতে চাই। নিজের শোওয়ার খাট কিংবা ঠেলাগাড়ি হইতে মুক্ত হইয়া শিশু বাগানের ভিতর, মাঠে অথবা সাগরতীরে ছোটাছুটি করিয়া মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে। প্রথম বৎসর অপেক্ষা এখন হজম শক্তি বেশি হইয়াছে, খাদ্যেও বৈচিত্র্য আসিয়াছে; চিবানো এখন একটি নূতন আনন্দ। এইসব কারণে শিশুর যদি উপযুক্ত যত্ন লওয়া হয় এবং যদি তাহার স্বাস্থ্য ভালো থাকে তবে এই বয়সে শিশুর জীবন তাহার কাছে আনন্দময় এবং রোমাঞ্চকর মনে হয়।

হাঁটা ও দৌড়ানোর মধ্যে শিশু যে নূতন স্বাধীনতার সন্ধান পায় তাহার সঙ্গে একটি নূতন ভয়ও তাহার মনে আসে। শিশুকে সহজেই ভয় দেখানো যায়; ডক্টর এবং শ্রীমতী ওয়াটসন দেখিয়াছেন যে, শিশু উচ্চ শব্দ এবং পড়িয়া যাওয়ার আশঙ্কা হইতে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। শিশুকে এমনভাবে যত্নের সঙ্গে রাখা হয় যে, ইহার বাস্তব ভয়ের কোনো কারণই থাকিতে পারে না; সত্যিকারের কোনো বিপদ হইলেও শিশু সেখানে অসহায়, কাজেই ভয় শিশুর কোনো কাজেই আসিবে na। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৎসরে শিশুর মনে নূতন ভয় আসে। তর্কের বিষয় হইল এই যে, এই ভয় কি শিশুর প্রবৃত্তিগত অর্থাৎ আপনা-আপনি বিকশিত হয়, না অন্যের নিকট হইতে শিশু ইহা ছোঁয়াচে রোগের মতো পায়? শিশুর প্রথম বৎসরে ভয় থাকে না, কিন্তু তাই বলিয়া ইহা যে প্রবৃত্তি হইতে জ্ঞাত নয় এমন প্রমাণ করা চলে না; কেননা যে-কোনো বয়সে একটি প্রবৃত্তি পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে। উগ্র ফ্রয়েডবাদীও বলিবেন না যে, জন্মের সময়ই শিশুর যৌন প্রবৃত্তি পরিপূর্ণ মাত্রায় রহিয়াছে। স্পষ্টতই দেখা যায় যে শিশু হাঁটিতে পারে না তাহার চেয়ে যে চলাফেরা করিতে পারে তাহারই ভয়ের প্রয়োজন বেশি; কাজেই যখন প্রয়োজন তখন যদি ভয় প্রকাশ পাইতে থাকে তবে বিস্ময়ের কিছু নাই। এ প্রশ্নটির শিক্ষাসম্বন্ধীয় গুরুত্ব অনেক। ভয় যদি অন্যের নিকট হইতে সংক্রামিত হয় তবে সহজ উপায়েই ইহা নিবারণ করা যায়–যেমন শিশুর সম্মুখে ভয় বা বিরক্তি প্রকাশ না করিয়া পক্ষান্তরে যদি কতক ভয় প্রবৃত্তি হইতে উদ্ভূত হয় তবে ইহা নিবারণের জন্য আরও ব্যাপক কোনো পন্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

ডক্টর চার্মাস মিচেল তাহার The Childhood of Animals (জীবজন্তুর শৈশব) পুস্তকে পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করিয়াছেন যে, সাধারণত জীবজন্তুর শাবকদের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভয় থাকে না। বানর এবং কয়েক প্রকার পাখি ছাড়া অন্য কোনো জীবের শাবক তাহাদের প্রজাতির চিরশত্রু। যেমন সাপ প্রভৃতিকেও মোটেই ভয় করে না, যদি না তাহাদের জনক-জননী তাহাদিগকে ভয় করিতে শিখাইয়া না দেয়। এক বছরের কম বয়সের শিশু কোনো প্রাণীকেই ভয় করে না। এইরূপ একটি শিশুকে ডক্টর ওয়াটসন ইঁদুরকে ভয় করিতে শিখাইয়াছিলেন; যখনই ইঁদুরটি ইহার সামনে আসিত তখনই শিশুটির পিছনে খুব জোরে ঘণ্টার আওয়াজ করিতেন; আওয়াজ শুনিয়া সে ভয় পাইত; ক্রমে ইঁদুরের সঙ্গে এই ভয়েই সংযোগ সাধিত হইল অর্থাৎ পরে শব্দ না হইলেও ইঁদুর দেখিলেই সে ভীত হইত। কিন্তু প্রাণী শাবকদের প্রথম কয়েক মাসে কোনো প্রবৃত্তি-জাত ভয় থাকে না। অন্ধকারে ভয়ের কারণ আছে বলিয়া যাহাদিগকে শিখানো হয় নাই এমন ছেলেমেয়েদের অন্ধকার ভীতিপ্রদ নয়। এরূপ ধারণার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বেশিরভাগ ভয় যাহা আমরা এতদিন প্রবৃত্তিজাত মনে করিতাম অপরের নিকট হইতে সঞ্চারিত হয়; বয়স্ক ব্যক্তিরা সৃষ্টি না করিলে এরূপ ভয় মোটেই দেখা দিত না।

এই বিষয়ে নূতন তথ্য পাইবার আশায় আমি আমার ছেলেমেয়েদিগকে সযত্নে পর্যবেক্ষণ করিয়াছি। কিন্তু ধাত্রী এবং পরিচারিকারা কখন তাহাদিগকে কি বলিয়াছে তাহা সর্বদা জানিতে পারি নাই। এইজন্য ঘটনার বিশ্লেষণও কখনও সন্দেহজনক হইয়াছে। যতদূর বিচার করিতে পারিয়াছি তাহাতে মনে হয় শিশুর প্রথম বছরে ভয় সম্বন্ধে ডক্টর ওয়াটসন যাহা বলিয়াছেন তাহাই ঠিক; আমার ছেলেমেয়েদের বেলায় ইহা পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে। দ্বিতীয় বৎসরে তাহারা কোনো প্রাণী দেখিয়া ভয় পাইত না, কেবল একজন কিছুকাল ঘোড়া দেখিলেই ভীত হইত। ইহার কারণ বোধহয় যে, একদিন একটি খুব জোরে শব্দ করিয়া তাহার পাশ দিয়া ছুটিয়া গিয়াছিল। এই মেয়েটির বয়স এখন দুই বৎসর; ইহার পরবর্তী বয়সে ভয়ের প্রকাশ কেমন তাহা লক্ষ করিবার জন্য ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করিতে হইয়াছে। দুই বৎসর পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি এ ছেলেটির জন্য একজন নূতন ধাত্রী নিযুক্ত করা হয়। এ ধাত্রীটি ছিল ভিতু প্রকৃতির, বিশেষ করিয়া অন্ধকারকে অত্যন্ত ভয় করিত। ছেলেটির মধ্যে অল্পদিনেই এ ভয় সংক্রামিত হইল (প্রথম অবশ্য আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই); সে কুকুর বিড়াল দেখিলে ছুটিয়া পলাইত, কালো কাবোর্ড দেখিলে ভয়ে জড়সড় হইত। অন্ধকার ঘরের প্রত্যেক অংশে আলো চাহিত, এমনকি প্রথমবার তাহার ছোট বোনটিকে দেখিয়া রীতিমতো ভয় পাইয়াছিল; হয়তো সে ইহাকে কোনো অজানা অদ্ভুত প্রাণী মনে করিয়াছিল। [প্রথম কলের পুতুল দেখিলে যেরূপ ভয় হয় এমনও হইতে পারে। সে যখন প্রথম দেখে তখন মেয়েটি ঘুমাইতেছিল; সে ইহাকে কলের পুতুল মনে করিয়াছিল; মেয়েটি যখন নড়িয়াছিল অমনি সে চমকিয়া উঠিয়াছিল।

ছেলেটি হয়তো এই ভয় ভিতু ধাত্রীর নিকট হইতে লাভ করিয়াছিল; বস্তুত ধাত্রী চলিয়া যাওয়ার পর ভয়ও ধীরে ধীরে লোপ পাইয়াছিল। কিন্তু অন্য ধরনের ভয়ও ছিল। এরূপ ভয় ধাত্রী আসিবার পূর্বে প্রকাশ পাইয়াছিল; তাহা ছাড়া কোনো বয়স্ক ব্যক্তি এরূপ ভয় বোধ করিবে না। কাজেই অন্যের নিকট হইতে সঞ্চারিত হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। এরূপ ভয়ের মধ্যে প্রধান হইল যাহা কিছু অদ্ভুতভাবে চলে তাহার প্রতি ভয়, যেমন ছায়া ও খেলনা কলের পুতুল। ইহা পর্যবেক্ষণ করিয়া আমি বুঝিলাম যে, এই ধরনের ভয় শিশুর পক্ষে স্বাভাবিক এবং এগুলি প্রবৃত্তি হইতে উদ্ভূত মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। উইলিয়াম স্টার্ন তাহার Psychology of Early Childhood (শৈশবের মনস্তত্ত্ব) পুস্তকে রহস্যজনক বস্তুর প্রতি ভয় [Fear of the mysterious] শীর্ষক নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন :

পূর্ববর্তী শিশু-মনোবিজ্ঞানবিদগণ এই ধরনের ভয়ের কথা, বিশেষ করিয়া অতি শৈশবে এরূপ ভয়ের স্বরূপ কি তাহা আলোচনা করেন নাই। পরে গ্রুস এবং তাঁহার সঙ্গে আমরা ইহার স্বরূপ জানিতে পারিয়াছি। জানা বিপদের ভয় অপেক্ষা অপরিচিত বিষয়ের ভয়ই বেশি স্বভাবগত বলিয়া মনে হয়। শিশু যদি এমন কোনো জিনিস দেখিতে পায় যাহা তাহার পরিচিত ধারণার সঙ্গে মেলে না তবে তিন প্রকার প্রতিক্রিয়া হইতে পারে। যথা–(১) নূতন জিনিসটি এত অপরিচিত মনে হইবে যে, ইহার প্রতি সে মোটেই আকৃষ্ট হইবে না। (২) কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেও তাহার মনে বিপর্যয় সৃষ্টি করিতে পারিবে না। তখন ইহার মনে জাগ্রত হইবে বিস্ময়, জানিবার বাসনা, নানা চিন্তা, বিচার এবং অনুসন্ধানের মনোভাব। (৩) অথবা নূতন জিনিস তাহার পূর্বের ধারণাকে সম্পূর্ণ উলটাইয়া দিয়া তাহার মনে গভীর অসন্তোষ ও অজানার প্রতি ভয়ের ভাব সৃষ্টি করিবে। গ্রুস বিশেষ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়া বলিয়াছেন যে, এই অজানার প্রতি ভীতি প্রবৃত্তিজাত ভয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, জীবকুলের আত্মরক্ষার পক্ষে প্রয়োজনীয় বলিয়াই ইহা এক প্রজাতি [Grneration] হইতে অন্য প্রজাতিতে সঞ্চারিত হয়।

স্টার্ন ভয়ের অনেক উদাহরণ দিয়াছেন; তাহার মধ্যে ছাতা খুলিলে ভয় পাওয়া এবং কলের পুতুল দেখিয়া ভয় পাওয়ার কথাও আছে। প্রথমোক্তটি গরু ঘোড়ার মধ্যেই বেশি; আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি গরু বা ঘোড়ার দলকে একটি ছাতার সাহায্যে ঊধ্বশ্বাসে ধাবিত করা যায়। স্টার্ন যেমন বর্ননা করিয়াছেন আমার নিজের ছেলের ভয়ও তেমনি ছিল। অস্পষ্ট দ্রুত চলমান ছায়া দেখিলে (যেমন রাস্তায় চলমান গাড়ির ছায়া যদি ঘরের দেওয়ালে পড়িত) ভয় পাইত। আমি মেঝেতে এবং দেওয়ালে আঙুল দিয়া ছায়া ফেলিতাম এবং তাহাকে দিয়া অনুরূপ করাইতাম; এইভাবে তাহার ছায়া-ভীতি দূর হইয়াছিল। শীঘই সে বুঝিয়াছিল ছায়া জিনিসটি কি এবং ইহাতে সে আনন্দ অনুভব করিত। কলের পুতুল সম্বন্ধেও এই নীতিই প্রযোজ্য। পুতুলের ভিতরকার কলকবজাটুকু দেখা হইলে সে আর ভয় পাইত না। কলকজা যদি দেখা না যাইত তবে ভয় দূর হইতে কিছু সময় লাগিত। কেহ তাহাকে একটি ছোট বসিবার আসন দিয়াছিল; চাপ দিলেই ইহা হইতে এক রকম করুণ একটানা শব্দ বাহির হইত। অনেকদিন পর্যন্ত সে এটা দেখিয়া ভয় পাইয়াছে। কিন্তু আমরা এই ভয়ের জিনিসটাকে কিছুতেই সরাইয়া ফেলি নাই। প্রথমে এটি কিছুটা দূরে রাখা হইয়াছিল যাহাতে সে বেশি ভয় না পায়। পরে অল্প অল্প করিয়া এটি ছেলের কাছে পরিচিত করাইয়া লইলাম এবং তাহার ভয় সম্পূর্ণ দূর না হওয়া পর্যন্ত থামি নাই। আসনের যে রহস্যময় ভাবের জন্য এটি ভীতিপ্রদ হইয়াছিল। খোকার ভয় কাটিয়া যাওয়ার পর ইহাই তাহাদের আনন্দ দিয়াছে। আমার মনে হয় অবাস্তব ভয় চাপিয়া রাখা ঠিক উচিত নয়; ক্রমে ক্রমে পরিচয় জন্মাইয়া ইহা সম্পূর্ণ দূর করাই সঙ্গত।

দুইটি ক্ষেত্রে বাস্তব ভয় সম্বন্ধে আমরা ঠিক ইহার বিপরীত প্রণালী অবলম্বন করিয়াছিলাম। হয়তো ইহা ভুলই হইয়াছিল। তখন প্রত্যক্ষ ভয়ের কারণ বিদ্যমান ছিল না। বৎসরের অর্ধেকটা আমি কোনো পাহাড়ময় সাগরতীরে কাটাই। ছেলেটির উচ্চতা সম্বন্ধে কোনোরূপ ভীতি ছিল না এবং না ঠেকাইলে সে খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠিয়া যাইত। একদিন আমরা একটি খাড়া পাহাড়ের উপর বসিয়াছিলাম; সমুদ্রের জল হইতে ইহা প্রায় একশত ফুট উচ্চে। ছেলেকে শান্তভাবে এই বৈজ্ঞানিক তথ্য বলিলাম : যদি পাহাড়ের ধারে যাও নিচে পড়ে যাবে; পড়ে গেলে প্লেটের মতো ভেঙে যাবে। (সে কয়েকদিন আগে একখানা প্লেট মেঝেতে পড়িয়া ভাঙিয়া যাইতে দেখিয়াছিল) কিছুক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া সে নিজে নিজে উচ্চারণ করিল পড়ে যাবে, ভেঙে যাবে। তাহার পর সে সেইখান হইতে তাহাকে সরাইয়া আনিতে বলে। এ ঘটনা ঘটে তখন তাহার বয়স প্রায় আড়াই বৎসর। ইহার পর হইতে আমরা লক্ষ রাখিলে সে খুব উঁচুতে উঠিত না। কিন্তু কাছে কেহ না থাকিলে বিপদ সম্বন্ধে তাহার কোনো হুঁশ থাকিত na। তাহার বয়স যখন তিন বৎসর নয় মাস তখনই নিঃসঙ্কোচে ছয় ফুট উচ্চ হইতে লাফাইত। বারণ না করিলে কুড়ি ফুট উচ্চ স্থান হইতে লাফ দিতেও সে প্রস্তুত ছিল। কাজেই দেখা যাইতেছে যে, ভয় সম্বন্ধে শিক্ষাদান বিশেষ কার্যকরি হয় নাই। ইহার কারণ আমার নিকট এই মনে হয় যে, উচ্চস্থান হইতে পতনের ভয় সম্বন্ধে শুধু শিক্ষাদান করা হইয়াছিল, ভয় সঞ্চার করা হয় নাই। যখন উপদেশ দেওয়া হইতেছিল, তখন আমাদের দুইজনের মধ্যে কেহই ভয় অনুভব করি নাই। শিক্ষা ব্যাপারে ইহার গুরুত্ব খুব বেশি। বাস্তব বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা থাকা দরকার; ভয় থাকার কোনো প্রয়োজন নাই। কিছুমাত্রায় ভয়ের সঙ্গে মিশ্রিত না থাকিলে শিশু বিপদের আশঙ্কা অনুভব করিতে পারে না; কিন্তু উপদেষ্টা বা শিক্ষকের মধ্যে এই ভয়ের সামান্য প্রকাশ না থাকিলে শিশুর মনে ইহা কোনো রেখাপাত করে না। শিশুর তত্ত্বাবধানকারী বয়স্ক ব্যক্তিদের কখনোই ভীত হওয়া উচিত নয়, এই কারণেই পুরুষের মধ্যে যেমন স্ত্রীলোকদের মধ্যেও তেমনই সাহস বাড়ানো প্রয়োজন।

দ্বিতীয় উদাহরণটি ততটা ইচ্ছাকৃত নয়। খোকার বয়স যখন তিন বৎসর চার মাস একদিন তাহাকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে গিয়া পথে একটি বিষধর সাপ দেখিতে পাই। খোকা পূর্বে সাপের ছবি দেখিয়াছিল কিন্তু আসল সাপ দেখে নাই। সাপ যে কামড়ায় তাহা সে জানিত না। সাপ দেখিয়া সে খুশি হইয়া উঠিল। এবং সেটি চলিয়া গেলে তাহার পিছে পিছে দৌড়াইতে লাগিল। আমি জানিতাম যে সে সাপের কাছে দৌড়াইয়া পৌঁছিতে পারিবে না; কাজেই তাহাকে বারণ করি নাই এবং সাপ যে বিপজ্জনক তাহাও বলি নাই। এই ঘটনার পর হইতে তাহার পরিচারিকা লম্বা ঘাসের মধ্যে সাপ থাকিতে পারে এই ভয়ে তাহাকে দৌড়াদৌড়ি করিতে দিত না। ইহার ফলে খোকার মনে সামান্য ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল, কিন্তু তাহা খুব বেশি নয়।

সমুদ্রের ভয় দূর করাই ছিল সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। খোকার যখন আড়াই বৎসর বয়স তখন তাহাকে প্রথমবার সমুদ্রের জলে নামাইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। প্রথমে ইহা একেবারেই অসম্ভব ছিল। ঠাণ্ডা জল সে মোটেই পছন্দ করিত না, ঢেউ-এর গর্জন শুনিয়া সে ভয়ে জড়সড় হইয়াছিল; তাহার মনে হইতেছিল সমুদ্র কেবলই আসিতেছে, ফিরিয়া যাইতেছে না। ঢেউ বড় থাকিলে সে সমুদ্রের কাছে যাইতেই চাহিত না। এটা ছিল সাধারণভাবে ভয় পাওয়ার কাল। জীবজন্তু, উচ্চ বিকট শব্দ এবং বিভিন্ন জিনিস তাহার ভয় উৎপাদন করিত। সমুদ্রের ভয় আবার অল্প অল্প করিয়া দূর করিয়াছিলাম। প্রথমে শিশুকে সমুদ্র হইতে কিছুটা দূরে অগভীর ডোবার মধ্যে বসাইয়া রাখা হইত ও ঠাণ্ডার ভয় এইভাবে কাটিয়া গিয়াছিল। গরম চার মাসের শেষ দিকে সে এই ডোবার মধ্যে হাঁটিয়া আনন্দ পাইত কিন্তু কোমর পর্যন্ত জলে নামাইলে চিৎকার করিতে থাকিত। সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় অথচ ঢেউ দেখা যায় না এমন স্থানে প্রত্যহ এক ঘণ্টা করিয়া তাহাকে খেলিতে দেওয়া হইত। ভাইবোনদিগকে সমুদ্রে স্নান করিতে দেখিত। ইহার পর আমরা তাহাকে এমন জায়গায় লইয়া যাইতাম যে স্থান হইতে সাগর দেখা যাইত, তাহাকে দেখানো হইত যে, ঢেউ আসিয়া আবার চলিয়া যাইতেছে। এইভাবে তাহার সাগর গর্জন ভীতি দূর করা হইল। ইহা ছাড়া সে তাহার পিতামাতা ও অন্যান্য ভাইবোনকে সমুদ্রে স্নান করিতে দেখিত।

এ সবের ফলে এইমাত্র হইল যে খোকা নির্ভয়ে ঢেউ-এর নিকটে যাইত মাত্র। এ ক্ষেত্রে ইহা নিশ্চিত যে ভয় প্রবৃত্তি হইতে সঞ্জাত; অন্যের নিকট হইত সঞ্চারিত হইবার কোনো কারণ ছিল না। পরের বছর গ্রীষ্মকালে আবার সমুদ্র স্নান শুরু হইল। তখন তাহার বয়স সাড়ে তিন বৎসর। তখনও ঢেউ-এর মধ্যে যাইতে তাহার রীতিমত ভয় ছিল। মিষ্টি কথায় যখন কোনো ফল হইল না, অন্য সকলের স্নান করা দেখিয়াও যখন খোকার জলে নামিতে সাহস হইল না, তখন আমরা। পুরনো প্রণালী গ্রহণ করিলাম। তাহাকে বুঝিতে দিলাম যে তাহার ভীরুতা দেখিয়া আমরা লজ্জা বোধ করি এবং তাহার সাহস দেখিলে প্রশংসা করি। প্রায় এক পক্ষকাল ধরিয়া প্রত্যেক দিন তাহার ধস্তাধস্তি এবং চিৎকার সত্ত্বেও তাহাকে গলা পর্যন্ত জলে ডুবাইয়া রাখা হইত। দিন দিন চিৎকার এবং হাত পা-ছোঁড়া কমিয়া আসিতে লাগিল। ভয় সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হওয়ার আগেই সে জলে নামিতে চাহিত। এক পক্ষ শেষে বাঞ্চিত ফল পাওয়া গিয়াছিল–সে আর সমুদ্র দেখিয়া ভয় পাইত না। সেই সময় হইতে আমরা তাহাকে সম্পূর্ণভাবে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম; আবহাওয়া ভালো থাকিলে নিজের খুশিমতো সে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে স্নান করিত। প্রথমে ভয় সম্পূর্ণভাবে লোপ পায় নাই; গর্ব ইহাকে আংশিকভাবে চাপিয়া রাখিয়াছিল। পরিচয়ের ফলে ভয় কমিতে কমিতে অবশেষে সম্পূর্ণ লোপ পায়। তাহার কুড়ি মাস বয়স্ক ছোট বোন সমুদ্রকে মোটেই ভয় করে না এবং নিঃসঙ্কোচে দৌড়াইয়া জলে নামিয়া পড়ে।

এই ব্যাপারে এই রকম বয়সে আমার উপর যে প্রণালী প্রয়োগ করা হইয়াছিল তাহা অদ্ভুত। গোড়ালি ধরিয়া উঁচু করিয়া আমার মাথা জলের মধ্যে ডুবাইয়া দেওয়া হইত, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইহার ফলে সমুদ্রের জল আমি ভালোবাসিতে আরম্ভ করি। তথাপি এ প্রক্রিয়া আমি অন্যের জন্য অনুমোদন করি না।

এ কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইল, কারণ যে বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে আমার বিশেষ আস্থা আছে ইহা কতকাংশে তাহার বিরুদ্ধে গিয়াছে। শিক্ষাক্ষেত্রে জোর প্রয়োগ না করাই ভালো। কিন্তু আমার মনে হয় ভয় জয় করিতে কিছুটা জোর জবরদস্তি সুফল দেয়। কোনো অবাস্তব ভয় যদি প্রবল হয় শিশুর নিজের উপর ছাড়িয়া দিলে সে কখনোই পরীক্ষা করিয়া দেখিবে না বাস্তবিক সে-ভয়ের কোনো প্রকৃত হেতু আছে কি না। যাহা পূর্বে বিপজ্জনক মনে হইয়াছিল এরূপ ঘটনা যদি বারে বারে অনুষ্ঠিত হয় অথচ কোনো বিপদ না ঘটে তবে ইহার সঙ্গে শিশুর পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ই ভয় নাশ করে। এই ভীতিনাশক অভিজ্ঞতা কেবল একবার দিলেই চলিবে না; বারংবার ঘটাইতে হইবে যেন ইহার সম্বন্ধে কোনো ভয়ই আর না থাকে। কোনো প্রকার জোর না করিয়া যদি এরূপ অভিজ্ঞতা দেওয়া যায় তবে ভালোই, তাহা যদি সম্ভব না হয় তবে অপরাজিত ভয় পোষণ করা অপেক্ষা জোর করিয়া দূর করাই শ্রেয়।

আরও একটি বিষয় আছে। আমার ছেলের ক্ষেত্রে এবং মনে হয় অন্য সকলের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়াছে যে ভয়কে জয় করার আনন্দ অপরিসীম। বালকের গর্ববোধ জাগানো সহজ; সাহস দেখানোর জন্য প্রশংসা পাইলে সারাদিন সে আনন্দে উৎফুল্ল থাকে। পরবর্তী বয়সে ভীরু ছেলেরা অন্য সকলের ঘৃণার পাত্র হইয়া মানসিক কষ্ট বোধ করে কিন্তু তখন তাহাদের পক্ষে নূতন অভ্যাস গঠন করাও কঠিন। এইজন্য আমার মনে হয় অল্প বয়স হইতেই ভয় দমন করার ব্যাপারে আত্মসংযম অভ্যাস এবং দৈহিক পটুতা [Enterprise] শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ জন্য যদি কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হয় তাহাও বরং বাঞ্ছনীয়।

পিতামাতা তাহাদের ভুল হইতে শিক্ষালাভ করেন। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হইয়া উঠে তখনই তাঁহারা নিজেদের ভুল বুঝিতে পারেন এবং কিভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল তাহাও উপলব্ধি করিতে পারেন। ছেলেকে অতিরিক্ত আদর দিলে কি কুফল ফলে তাহার একটি উদাহরণ উল্লেখ করিব। আমার ছেলের বয়স যখন আড়াই বৎসর তখন তাহাকে একটি কুঠুরিতে একা একা শুইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। পরিচারিকার তত্ত্বাবধানে শিশুর শয়ন-ঘর হইতে অন্যত্র শুইতে পাওয়ায় পদোন্নতির গর্বে সে খুবই আনন্দিত হইয়াছিল এবং প্রথম প্রথম সারারাত্রি নির্বিঘ্নে ঘুমাইয়া কাটাইত। এক রাত্রিতে খুব জোরে ঝড় বহিতেছিল, ভীষণ শব্দ করিয়া জানালার একটি খিল খুলিয়া গিয়াছিল। ভয়ে জাগিয়া উঠিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিল। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার কক্ষে গিয়াছিলাম সে হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়াছিল; সে আমার কণ্ঠলগ্ন হইয়া শুইয়া রহিল; দ্রুততালে তাহার হৃৎস্পন্দন হইতেছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার ভয় দূর হইল কিন্তু আলো না থাকায় অনুযোগ করিতে লাগিল। অথচ ওই সময় সে সারারাত্রি অন্ধকার ঘরে ঘুমাইত। তাহাকে রাখিয়া আসার পর আবার সে ভয়ের কথা বলে। কাজেই তাহাকে একটি আলো দেওয়া হইল। ইহার পর সে প্রায় প্রতি রাত্রিতেই চিৎকার করিয়া উঠিত, পরে বোঝা গেল ইহার উদ্দেশ্য শুধু এই যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা আসিয়া তাহাকে লইয়া কিছুটা হইচই করুক। কাজেই আমরা তাহাকে শান্তভাবে বুঝাইয়া বলিলাম যে, অন্ধকারে ভয়ের কিছুই নাই এবং ঘুম ভাঙিয়া গেলে সে যেন পাশ ফিরিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়ে। কোনো গুরুতর কিছু না ঘটিলে যে আমরা তাহার কাছে রাত্রিতে আর যাইব নাতাহাও জানাইয়া দিলাম। সে মনোযোগ দিয়া শুনিল এবং তারপর হইতে বিশেষ কারণ ছাড়া আর রাত্রিতে কাঁদিয়া ওঠে নাই। রাত্রিতে ঘরে আলো রাখা অবশ্য বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। আমরা যদি আরও বেশি আদর দেখাইতাম তবে হয়তো কিছুকাল, শুধু কিছুকাল কেন হয়তো বরাবরই তাহার ঘুমের ব্যাঘাত করিতাম।

এই গেল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। আমরা এখন ভয় দূর করার সাধারণ প্রণালী সম্বন্ধে আলোচনা করিব।

প্রথম কয়েক বৎসরের দৈহিক সাহস শিক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত শিক্ষক হইল অন্য শিশুরা। যদি শিশুর বড় ভাইবোন থাকে তাহারাই উদাহরণ দেখাইয়া বা উপদেশ দিয়া উহাকে উৎসাহিত করিবে; তাহারা যাহা করিতে পারে শিশুও তাহা অনুকরণ করিবে। স্কুলে দৈহিক ভীরুতাকে সকলেই অবজ্ঞা করে; বয়স্ক শিশুদের এ বিষয়ে আর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নাই। বালকদের মধ্যে অন্তত এই ভাবই প্রচলিত। মেয়েদের মধ্যেও এইরূপ হওয়া উচিত, তাহাদেরও ছেলেদের মতো সাহস থাকা বাঞ্ছনীয়। সৌভাগ্যক্রমে বালিকাদিগকে এখন আর মেয়েলি শিক্ষা দেওয়া হয় না এবং তাহাদের দৈহিক শক্তি বিকাশের পূর্ণ সুযোগ তাহারা পায়। তথাপি বালক ও বালিকাদের মধ্যে এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ পার্থক্য রহিয়াছে। আমার বিশ্বাস এই যে, এইরূপ পার্থক্য থাকা উচিত নয়। আমি যখন সাহস বাঞ্ছনীয় মনে করিয়াছি তখন সাহসের আচরণমূলক ব্যাখ্যাই আমার মনে আসিয়াছে। অন্যেরা যে কাজ ভয়ে করিতে পারে না সে কাজ যে করে তাহাকে সাহসী বলা যায়। সে যদি মোটেই ভয় না করে তাহা হইলে সবচেয়ে ভালো; শুধু ভয়কে দমন করাকেই আমি সত্যিকারের সাহস কিংবা শ্রেষ্ঠ সাহস বলি না। বর্তমান নৈতিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হইল–যাহাতে বালক-বালিকা বাঞ্ছনীয় আচরণ করে সে জন্য তাহাদের সদভ্যাস গঠন। ইহাই পূর্বে আত্ম-সংযম এবং ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে করানো হইত। ইচ্ছা শক্তির দ্বারা যে সাহস প্রদর্শিত হয় তাহা স্নায়বিক বিকলতা সৃষ্টি করে। যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের গোলা-ভীতি [Shell Shock] দ্বারা সৃষ্ট মনোবিকলতার বহু দৃষ্টান্ত আছে। যে-ভয় দমিত হইয়াছিল তাহাই পরে এমন নৃতনরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল যে, মনঃসমীক্ষণ দ্বারা তাহা নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় নাই। আমি এ কথা বলিতে চাহি না যে, আত্ম-সংযমের কোনো প্রয়োজন নাই; বরং এ কথা ঠিক যে, আত্ম-সংযম ব্যতীত পূর্বাপর সামঞ্জস্য রাখিযা জীবনধারণ করাই অসম্ভব। আমার বক্তব্য এই যে, এরূপ অবস্থার সম্মুখিন হইবার জন্য পূর্ব হইতে শিক্ষা দেওয়া হয় নাই। শুধু সেইরূপ অভাবিত বা অদৃষ্টপূর্ব অবস্থায় উপযুক্ত আচরণের জন্য আত্ম-সংযমের ব্যবহার প্রয়োজন। সকলকে সবরকম বিপদের সম্মুখিন হইবার মতো শিক্ষা দেওয়াও সম্ভবপর নয়। রাজ্যের সকল অধিবাসীকে যুদ্ধের সময় কিরূপ সাহস প্রদর্শন করিতে হইবে তাহা শিখাইতে যাওয়া মূর্খতারই শামিল। যুদ্ধের ন্যায় সর্বাত্মক বিপদ স্বল্পকাল স্থায়ী এবং কদাচিৎ ঘটিতে থাকে; কাজেই যুবকদিগকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিক্ষার মধ্যে কিরূপ আচরণ করিতে হইবে তাহা অভ্যাস করাইতে গেলে অন্য সকল রকম শিক্ষা খর্ব করিতে হয়।

যে ধরনের ভয়ের সহিত আমি পরিচিত, স্বর্গত ডক্টর রিভার্স তাঁহার প্রকৃতি ও নির্জন মন [Instinct and the Onconscious] পুস্তকে চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়াছেন। তিনি বলেন, কোনো বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখিন হইবার একটি উপায় হইল দৈহিক পটুতা এবং যাহারা ইহা উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করিতে পারে তাহারা অন্তত সজ্ঞানে ভয় অনুভব করে না। এইরূপ অভিজ্ঞতার যথেষ্ট মূল্য আছে; ইহা আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করে এবং ভয়কে জয় করিবার কৌশল আয়ত্ত করিতে উৎসাহ দেয়। সাইকেল চালানো শিখিবার মতো সহজ কৌশলও বালকের মনে এইরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে। বর্তমান জগতে যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসারের জন্য এই ধরনের কৌশল আয়ত্ত করার প্রয়োজন দিন দিন বাড়িতেছে।

আমার অভিমত এই যে, অন্য লোকের সহিত দৈহিক কসরতের ভিতর দিয়া সাহস অর্জন অপেক্ষা নানা কলকজা আয়ত্ত করার মতো দৈহিক পটুতা শিক্ষা করানো বেশি প্রয়োজনীয়। পর্বত আরোহণে, উড়োজাহাজ চালনায় কিংবা ঝড়ের মধ্যে ছোট একটি জাহাজ চালাইতে যে প্রকার সাহস দরকার তাহা আমার নিকট যুদ্ধ করিতে যেরূপ সাহস দরকার তাহা অপেক্ষা বেশি প্রশংসার যোগ্য মনে হয়। কাজেই আমি স্কুলের ছাত্রদিগকে ফুটবল খেলার দিকে ঝোঁক দিতে না দিয়া কমবেশি রকমের বিপজ্জনক বিষয়ে নিপুণতা শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী। যদি কোনো শত্রুকেই অভিভূত করিতে হয়, এই শত্ৰু মানুষ না হইয়া কোনো বস্তু হোক, ইহাই বাঞ্ছনীয়। এ নীতি শুধু কাগজ-কলমে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখিলেই চলিবে না, শরীরচর্চা ও ক্রীড়া কৌশলের ক্ষেত্রে ইহার গুরুত্ব বৃদ্ধি করিতে হইবে।

দৈহিক সাহস দেখানোর আরও নিষ্ক্রিয় (Passive] উপায়ও আছে। কোনো রকম হইচই আহা-উঁহু না করিয়া আঘাত সহ্য করা ইহার একটি দৃষ্টান্ত। ছোটখাটো আঘাত পাইলে শিশুদের প্রতি যদি সমবেদনা না দেখানো হয়, তবে এই ধরনের সাহস গড়িয়া তোলা যায়। পরবর্তীকালে অত্যধিক সমবেদনা পাওয়ার বাসনা হইতে নানা উত্তেজনাময় বায়ুরোগের কারণ ঘটিতে পারে। লোকে একটু আদর আপ্যায়ন, একটু আঁচড় লাগিলে বা কাটিয়া গেলেই শিশুদিগকে কাঁদিতে উৎসাহ না দিলে এইরূপ মনোভাব প্রতিরোধ করা যায়। এই ব্যাপারে বালকদের প্রতি যেমন অতি মৃদু ও কোমল ব্যবহার সঙ্গত নয়, বালিকাদের প্রতিও তেমনই। স্ত্রীলোকেরা যদি পুরুষের সমকক্ষ হইতে চায় তবে চরিত্রের দৃঢ় গুণগুলির বিষয়েই বা তাহারা পুরুষ অপেক্ষা হীন হইবে কেন?

যে সাহস কেবল দৈহিক নয় এখন সেই ধরনের সাহসের আলোচনা করা যাক। এই প্রকার সাহসই বিশেষ প্রয়োজনীয় কিন্তু কোনো প্রাথমিক ধরনের সাহসকে ভিত্তি না করিয়া ইহা গড়িয়া তোলা কঠিন। অবাস্তব ভয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে রহস্যজনক জিনিসের প্রতি ভয়ের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। আমার বিশ্বাস এই যে, ভয় প্রবৃত্তি হইতে সমুৎপন্ন এবং ইহার ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব বেশি। ইহাই অধিকাংশ কুসংস্কারের কারণ। চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, ভূমিকম্প, প্লেগ এবং অনুরূপ ঘটনা অশিক্ষিত লোকের মধ্যে রীতিমত ভয় উদ্রেক করে। ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে এ ভীতি বড়ই বিপজ্জনক, কাজেই প্রথম জীবনেই ইহা সমূলে উৎপাটন করা বাঞ্ছনীয়। এ ভীতির প্রধান ঔষধ হইল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। প্রথম দৃষ্টিতে যাহা রহস্যজনক তাহারই যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কতকগুলি ব্যাখ্যা দিলে শিশু অনুমান করিবে যে অন্য ঘটনারও অনুরূপ কারণ আছে এবং ইহা বলা সম্ভবপর হইবে যে, এখনও ব্যাখ্যা দেওয়া যাইতেছে না। কোনো কিছুর রহস্য যে অজ্ঞতা হইতেই উদ্ভূত এবং ধৈর্য ও মানসিক চেষ্টা দ্বারা যে এই অজ্ঞতা দূর করা যায় এই ধারণা যত শীঘ্র জন্মান যায় ততই মঙ্গল। ইহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, যে-রহস্য প্রথমে শিশুর ভীতি উৎপাদন করে তাহার কারণ জানা হইয়া গেলে তাহাই আবার শিশুকে আনন্দ দেয়। এইভাবে দেখা যায়, যখনই রহস্য আর কুসংস্কার বৃদ্ধি করে না তখন হইতেই ইহা শিশুর পাঠের অনুপ্রেরণা জোগায়। আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে একাকী তন্ময় হইয়া বহু ঘণ্টা ধরিয়া বাগানের পিচকারিটি পরীক্ষা করিয়াছে। অবশেষে সে বুঝিতে পারে কিভাবে জল ভিতরে আসে এবং বাতাস বাহির হইয়া যায় এবং কীভাবে ইহার বিপরীত অবস্থা ঘটে অর্থাৎ জল বাহির হইয়া গেলে বাতাস প্রবেশ করে। ছোট ছেলেমেয়েরাও যাহাতে বুঝিতে পারে এমনভাবে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ বুঝাইয়া বলা যায়। শিশুরা যাহা দেখিয়া ভয় পায় বা আনন্দ পায় তাহা সম্ভবপর হইলে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া উচিত।

এই সংক্রান্ত কতকগুলি সমস্যা বেশ কঠিন। ইহাদের ব্যাখ্যা করিয়া শিশুদিগকে বুঝাইয়া দিতে রীতিমত কৌশলের প্রয়োজন। ইহাদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হইল মৃত্যু রহস্য। শিশু দেখে যে, গাছপালা এবং জীবজন্তু মরিয়া যায়। তাহার ছয় বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই হয়তো তাহার পরিচিত ব্যক্তির মৃত্যু হইতে পারে। তাহার মন যদি সক্রিয় হয় তবে তাহার মনে হইতে পারে যে তাহার পিতামাতারও একদিন মৃত্যু হইবে। এমনকি সে নিজেও মরিবে। (নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা চিন্তা করা কঠিন)। এই চিন্তাগুলি তাহার মনে বহু প্রশ্ন তুলিবে; এগুলির উত্তর দেওয়া আবশ্যক। যিনি পরলোক বিশ্বাস করেন তাঁহার পক্ষে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিথঞ্চিৎ সহজ। কিন্তু যিনি বিশ্বাস করেন না তিনিও যেন নিজের বিশ্বাসের বিপরীত কোনো অভিমত না দেন। পিতামাতার পক্ষে শিশুর নিকট মিথ্যা বলিবার কোনো সঙ্গত কারণ নাই। ইহা বলাই সবচেয়ে ভালো যে, মৃত্যু হইল মহান্দ্রিা; মৃত্যুঘুমে ঘুমাইয়া পড়িলে কেহ আর জাগিয়া ওঠে না। কোনোরূপ গাম্ভীর্যের অবতারণা না করিয়া এমনভাবে বলুন যে, মৃত্যু একটি সাধারণ ঘটনা। শিশু যদি নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে চিন্তাকুল হয় তাহাকে বলুন যে, অনেকদিন পর্যন্ত তাহার পক্ষে মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা নাই। দুঃখপূর্ণ হইলেও মৃত্যু অনিবার্য এবং ইহার কষ্ট সহ্য করিতেই হইবে। মৃত্যু সম্বন্ধে এই ধরনের ভাব বাল্যকালে শিশুর মনে সঞ্চার করার চেষ্টা বৃথা। আপনি নিজে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিবেন না কিন্তু শিশু জানিতে চাহিলে প্রশ্ন এড়াইয়া যাইবেন না।

শিশুকে বুঝাইয়া দিন যে, ইহার মধ্যে কোনো রহস্য নাই। শিশু যদি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হয় এবং স্বাস্থ্যবান হয় তবে সে ইহা লইয়া দুশ্চিন্তা করিয়া মাথা ঘামাইবে না। এ প্রসঙ্গে কথা উঠিলে খোলাখুলিভাবে আপনি যাহা বিশ্বাস করেন তাহা সরলভাবে বলিবেন এবং শিশুর মনে এই ধারণা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিবেন যে, বিষয়টি খুব আনন্দপ্রদ নয়। কি শিশু কি বৃদ্ধ কাহারও পক্ষেই মৃত্যুচিন্তায় সময় কাটানো মঙ্গলজনক নয়।

কোনো কিছু সম্বন্ধে বিশেষ ভয় ছাড়াও শিশুর একটা সাধারণ উত্তষ্ঠা বোধ করিতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের অত্যধিক শাসনই মোটামুটিভাবে এ জন্য দায়ী। কিন্তু বর্তমানে ইহা অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে।

পদে পদে দোষ ত্রুটি ধরা, গোলমাল করিতে নিষেধ করা, সর্বদা ভদ্র আচরণ সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া প্রভৃতি শিশুর জীবন দুঃখময় করিয়া তুলিত। আমার মনে আছে, পাঁচ বৎসর বয়সে আমি শুনিয়াছিলাম যে শৈশবকাল জীবনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুখের কাল (সে যুগে ইহা ছিল নিছক মিথ্যা কথা)। আমি কাঁদিয়া আকুল হইতাম, মনে করিতাম মরিলেই বাঁচি, অবসাদময় বছরগুলি কিভাবে কাটাইব তাহা ভাবিতেই পরিতাম না। কেহ যে শিশুকে এরূপ বলিতে পারেন বর্তমান যুগে তাহা অচিন্ত্যনীয়।

শিশুরা স্বভাবতই আশাবাদী; তাহাদের মন আগামী দিনের স্বপ্ন দেখে, ভবিষ্যতের আশায় উৎসাহিত হয়। ইহা শিশুকে কাজে অনুপ্রেরণা দেয়। শিশুর দৃষ্টি যদি পিছন দিকে ফিরাইয়া দেওয়া যায়, বলা হয় যে ভবিষ্যৎ অতীতের চেয়ে বেশি দুঃখপূর্ণ তবে তাহার জীবনের উৎসকেই নির্জীব ও দুর্বল করিয়া ফেলা হয়। অথচ বাল্যকাল সুখের সময় এই ধরনের কথা বলিয়া হৃদয়হীন ভাবপ্রবণ ব্যক্তিরা শিশুদের জীবন বিষাদময় করিয়া তুলিতেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহাদের কথা শিশুদের জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। প্রায় সময়েই আমার মনে হইত বয়স্ক ব্যক্তিদের পড়াশুনার চাপ নাই, তাহারা যাহা ইচ্ছা তাহাই খাইতে পারেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই খুব সুখি। আমার এই বিশ্বাস ছিল স্বাস্থ্যপ্রদ এবং প্রেরণার উৎসস্বরূপ।

.

লাজুকতা : লাজুকতা বড়ই বিব্রতকর ধরনের ভীরুতা। ইহা ইংল্যান্ড ও চীনদেশে ব্যাপকভাবে দেখা যায়, অন্যত্র খুব কম। ইহার উৎপত্তির আংশিক কারণ হয় অপরিচিত লোকের সংস্পর্শে না আসা এবং আংশিক কারণ সামাজিক আদাব কায়দার উপর জোর দেওয়া। সুবিধা হইলেই শিশুদিগকে প্রথম বৎসরের পর হইতেই অপরিচিত লোক দেখিতে এবং তাহাদের সান্নিধ্যে আসিতে দেওয়া উচিত। আদব-কায়দা সম্বন্ধে বলা চলে, নিম্নতম যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু শিখানো দরকার, প্রথম অবস্থায় শিশু অন্যের নিকট অসহনীয়রূপে বিরক্তিকর না হইলেই হইল। শিশুদিগকে অপরিচিত আগন্তুকের সম্মুখে ঘরের মধ্যে শান্তভাবে বসাইয়া না রাখিয়া বরং কিছুক্ষণ নিজের ইচ্ছামতো থাকিতে দিয়া পরে অন্যত্র লইয়া যাওয়া উচিত। প্রথম দুই বৎসর শিশুর ছবি, কাদামাটি, যন্ত্রপাতি অথবা অন্য কোনো খেলার সরঞ্জাম লইয়া দিনের মধ্যে কিছু সময় নিজের ইচ্ছামতো কাটাইতে অভ্যাস করানো ভালো। শিশুকে শান্ত হইয়া থাকিতে বলিলে তাহার এমন কারণ থাকা চাই যাহা সে বুঝিতে পারে। খেলার মতো প্রীতিকর অভ্যাসের ভিতর দিয়াই ভদ্র আচরণ শিখানো উচিত; নীরস উপদেশ বা তত্ত্বহিসাবে প্রয়োগ করিলে ইহাতে বিশেষ সুফল পাওয়া যাইবে না। যখনই শিশুর বুঝিবার ক্ষমতা হইবে, সে অনুভব করিবে যে তাহার পিতামাতারও অধিকার আছে; সে অন্যকে কাজে স্বাধীনতা দিবে, নিজেও যথাসাধ্য ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে। শিশুরা সহজেই ন্যায় বিচার উপলব্ধি করে; অন্যের নিকট হইতে তাহারা যেরূপ আচরণ পাইবে অন্যের প্রতিও তাহারা দ্রুপ করিতে প্রস্তুত থাকিবে। ইহাই ভদ্র আচরণের মূল।

ভয় নিবারণের উপায় :

সর্বোপরি, আপনি যদি আপনার সন্তানদের ভীতি দূর করিতে ইচ্ছা করেন, আপনি নিজে নির্ভীক হউন। আপনি যদি মেঘগর্জনে ভয় পান, তবে প্রথমবার যখন আপনার শিশু আপনার সম্মুখে থাকিয়া মেঘ গর্জন শুনিবে, তখনই তাহার মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হইবে। আপনি যদি সামাজিক বিপ্লব সম্পর্কে ভীতি প্রকাশ করেন, আপনি কি বিষয়ে বলিতেছেন তাহা বুঝিতে না পারায় আপনার সন্তান আরও বেশি ভীত হইবে। আপনি যদি রোগ সম্বন্ধে শঙ্কিত হন আপনার সন্তান আরও বেশি শঙ্কিত হইবে। জীবন বিঘ্ন-সংকুল কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তি অবশ্যম্ভাবী বিপদকে উপেক্ষা করেন এবং যেগুলি প্রতিরোধ করা সম্ভব সেগুলি সম্বন্ধে বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া অবিচলিতভাবে কাজ করেন। আপনি মৃত্যুর হাত এড়াইতে পারেন না কিন্তু বিনা উইলে মৃত্যুর হাত এড়াইতে পারেন। কাজেই আপনার উইল (দানপত্র) করিয়া ফেলুন তারপর মনে ভুলিয়া যান যে আপনি মরণশীল। বাস্তব দুর্ভাগ্য বা দৈব-দুর্বিপাকের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা ভয় হইতে সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস; ইহা বিজ্ঞতার পরিচায়ক, কিন্তু ভীতি আত্ম অমর্যাদাকর। আপনি যদি নিজের ভয় দমন করিতে না পারেন তবে চেষ্টা করিবেন যাহাতে আপনার সন্তান ইহা সন্দেহ করিতে না পারে। সর্বোপরি তাহাকে এমন উদার দৃষ্টিভঙ্গি দিবেন এবং তাহার মনে বহুবিচিত্র বিষয়ে এমন জীবন্ত উৎসাহ সঞ্চার করুন যেন সে পরবর্তী জীবনে নিজের ব্যক্তিগত বিপদের আশঙ্কা সম্বন্ধে চিন্তা না করে। কেবল এই উপায়েই আপনি তাহাকে বিশ্বের একজন মুক্ত নাগরিকরূপে গড়িয়া তুলিতে পারেন।

০৫. খেলা ও কল্পনা

কি মনুষ্য, কি কি মনুষ্যেতর প্রাণী সকলের সন্তানই খেলা ভালোবাসে। মানব শিশুরা খেলার ভিতর দিয়া নানারূপ ভান করিয়া অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করে। খেলা এবং তাহার ভিতর দিয়া নানা কাজের ভান শিশুর সুখ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়, এইরূপ খেলার অন্য কোনো উপকারিতার কথা চিন্তা না করিলেও শুধু শিশুর স্বাভাবিক এবং সুস্থভাবে বৃদ্ধির জন্যও ইহা প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে দুইটি বিষয় চিন্তা করিবার আছে : প্রথম, শিশুর খেলার সুযোগদানের জন্য পিতামাতা এবং স্কুল কি করিবেন? দ্বিতীয়, খেলার শিক্ষাসম্বন্ধীয় উপকারিতা বৃদ্ধি করিবার জন্য তাহাদিগকে কি আরও বেশি কিছু করিতে হইবে?

সূচনায় খেলার মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। কার্ল গ্রুস এ সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছেন; পূর্ব অধ্যায়ে উইলিয়াম স্টার্নের যে পুস্তকের কথা উল্লিখিত হইয়াছে তাহাতে কিছু সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা আছে। এ বিষয়ে দুইটি পৃথক প্রশ্ন আছে প্রথমটি, খেলার মূল উৎস কি, সে সম্পর্কে; দ্বিতীয়টি খেলার দৈহিক বা জৈবিক উপযোগিতা সম্পর্কে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি সহজতর। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে পূর্ণ বয়সের প্রাণিদিগকে যে কাজ দৈহিক প্রয়োজনের খাতিরেই করিতে হইবে সকল প্রজাতির [species] শিশুরাই তাহা শৈশবে খেলাচ্ছলে করিয়া থাকে। কুকুর শাবকদের খেলা ঠিক বয়স্ক কুকুরের লড়াইয়ের মতোই, কেবল সত্য সত্যই দাঁত বসাইয়া কামড়ায় না এই যা পার্থক্য। বিড়ালছানাদের খেলা বিড়ালের ইঁদুর ধরিবার কস্রতের অনুরূপ। শিশুরা যাহা দেখে তাহা অনুকরণ করিতে ভালোবাসে, যেমন ইট, পাথর, কাঠের টুকরা প্রভৃতি দিয়া বাড়ি তৈয়ার করা কিংবা গর্ত খনন করা। যে কাজ তাহাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় তাহারা সে কাজই করিতে বেশি পছন্দ করে। যে সব খেলায় শিশুদের মাংসপেশি নূতনভাবে সঞ্চালিত হইবার সুযোগ পায় তাহা তাহাদের নিকট বড়ই আনন্দদায়ক মনে হয়, যেমন–লাফানো মই বা খুঁটি বাহিয়া উপরে ওঠা, সরু তক্তার উপর দিয়া হাঁটা প্রভৃতি; তবে দেখিতে হইবে এ কাজ যেন খুব কঠিন না হয়। ইহা যদিও সাধারণভাবে শিশুর (খেলার আবেগের) ক্রীড়া আবেগের উপযোগিতা প্রমাণ করে, খেলার জন্য তাহার যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত কামনা থাকে, তাহার সম্পূর্ণ প্রকাশ শুধু ইহার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইহার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

কতক মনঃসমীক্ষক শিশুর খেলার ভিতর যৌন প্রতীকতা খুঁজিয়া বাহির করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহা যে সম্পূর্ণ অলীক সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই। শৈশবে শিশুর কার্যকলাপের মধ্যে প্রবৃত্তি-জাত যৌন আবেগ প্রধান নয়, বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার বাসনা কিংবা আরও খাঁটিভাবে বলিলে বলা যায় যে, শক্তিলাভের বাসনাই তখন থাকে প্রবল। বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনায় শিশু তাহার দুর্বলতা বুঝিতে পারে; সে মনে মনে তাহাদের সমকক্ষ হওয়ার বাসনা পোষণ করে। আমার ছেলে যখন বুঝিয়াছিল যে সেও একদিন বয়স্কব্যক্তি হইবে এবং আমি নিজেও একদিন তাহার মতোই ছোট ছিলাম তখন সে অত্যন্ত সুখি হইয়াছিল। কৃতকার্য হওয়া যাইবে এই আশ্বাস মানুষের উদ্যম বৃদ্ধি করে। শিশুদের অনুকরণের অভ্যাস হইতেই দেখা যায় বয়স্ক ব্যক্তিরা যাহা করে শিশুরাও তাহা করিতে চায়; শিশুদের কাজে প্রেরণা জোগাইতে বড় ভাইবোনেরা খুব সাহায্য করে; তাহাদের উদ্দেশ্য কি তাহা শিশুরা সহজে বুঝিতে পারে এবং তাহাদের শক্তিও বয়স্ক লোকের দৈহিক শক্তির মতো বেশি নয় বলিয়া শিশুদের নাগালের সম্পূর্ণ বাহিরে নয়। বয়স্ক লোকের সঙ্গে তুলনায় শিশু নিজেকে যতখানি হীন মনে করে তাহার বড় ভাইবোনের সঙ্গে তুলনা করিয়া ততখানি ছোট মনে করে না। শিশুদের মধ্যে স্বভাবতই হীনতাবোধ খুব বেশি; তাহারা যদি স্বাস্থ্যবান হয় এবং উপযুক্তভাবে শিক্ষা পায় তবে এই হীনতাবোধ তাহাদিগকে চেষ্টায় প্রেরণা দেয়, তাহারা শক্তিমান হইয়া বয়স্কদের সমান হইতে চায় কিন্তু তাহাদিগকে যদি দমন করিয়া রাখা হয় তবে তাহাদের মানসিক অশান্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে।

খেলার ভিতর আমরা দুই প্রকারে শিশুর শক্তি অর্জনের বাসনার প্রকাশ (দুইটি স্বরূপ) দেখিতে পাই : প্রথম, কোনো কাজ শিখিবার চেষ্টায়; দ্বিতীয়, ভান বা কল্পনার আশ্রয় গ্রহণে। যৌনজীবনে ব্যর্থকাম হতাশ যুবক তাহার মনের কামনাগুলি পরিতৃপ্ত করিবার জন্য অনেক সময় জাগ্রত স্বপ্নের আশ্রয় নেয়; বাস্তব জীবনে যাহা পায় না, কল্পনায় তাহাই উপভোগ করিতে আনন্দ পায়। তেমনই স্বাভাবিক সুস্থ শিশু খেলার ভিতর দিয়া এমন ভান করিতে ভালোবাসে যাহাতে সে নিজের দৈহিক শক্তির পরিচয় দিতে পারে। সে দৈত্য, সিংহ কিংবা রেলগাড়ি হইতে চায়, সে এমন প্রাণী সাজিতে চায় বা এমন জিনিসের ভান করা পছন্দ করে যাহাতে অন্যের মনে ভয়ের সঞ্চার করিতে পারে। আমি পুত্রকে দানব নিধনকারী জ্যাকের গল্প বলিয়া তাহাকে জ্যাক সাজিতে বলিলাম কিন্তু সে দানব হওয়ার জন্যই ইচ্ছা প্রকাশ করিল।

সে যখন তাহার মায়ের নিকট ব্লু-বিয়ার্ডের গল্প শোনে তখন ব্লু-বিয়ার্ড হওয়ার জন্য সে পীড়াপীড়ি করিতে থাকে এবং বলে যে অবাধ্য হওয়ার জন্য তাহার স্ত্রীকে শাস্তি দেওয়া ঠিক কাজই হইয়াছে। বু-বিয়ার্ডের ভান করিয়া খেলার সময় সে মহিলাদের মাথা কাটিয়া ফেলে। ফ্রয়েডবাদী মনস্তাত্ত্বিকগণ হয়তো বলিবেন– স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচার করার বাসনা শিশুর মনে লুকাইয়া রহিয়াছে। কামজ প্রেমের বিকৃত অবস্থায় এই প্রকার ধর্ষকাম অর্থাৎ প্রীতির বিপরীত ভাব, নিষ্ঠুরতা দেখা দেয়। মহিলাদিগকে শাস্তি দেওয়ার বাসনা শিশুর ধর্ষকামের পরিচায়ক। কিন্তু সে শুধু মহিলাদিগের মাথা কাটিতেই আনন্দ পায় নাই, ছোট ছোট বালকদিগকে খাইয়া ফেলিয়াছিল যে দৈত্য সেই রূপ দৈত্য সাজিতে কিংবা ভারী ওজনের জিনিস টানিয়া লইয়া যাইতে পারে এমন ইঞ্জিন সাজিতেও অনুরূপ আনন্দ লাভ করিয়াছে। এইসব ভান-ক্রীড়ার মধ্যে শক্তিমান হওয়ার, দৈহিক ক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার বাসনাই ছিল, যৌনবাসনার কোনো প্রকার প্রকাশ ছিল না। একদিন বেড়াইয়া ফিরিবার পথে গল্পচ্ছলে কৌতুক করিয়া ছেলেকে বলিয়াছিলাম, হয়তো বাড়ি গিয়া দেখিব যে ঢিডলিউইংক্স নামে এক অপরিচিত ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি দখল করিয়া রহিয়াছেন; তিনি হয়তো আমাদগিকে বাড়িতে ঢুকিতেই দিবেন না। ইহার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমার ছেলে বাড়িতে ঢুকিতেই দিবেন না। ইহার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমার ছেলে বাড়িতে ঢুকিবার পথের দেওয়ালের উপর দাঁড়াইয়া মিঃ টিডইলিউইংক্স সাজিয়া আমাকে অন্য বাড়িতে যাইতে আদেশ করিত। এই খেলায় তাহার আনন্দের সীমা থাকিত না; এইভাবে যে সে শক্তির পরিচয় দেওয়ার ভান করিত তাহা স্পষ্টই বোঝা যায়।

যাহা হউক শক্তিমান হওয়ার বাসনাই যে শিশুর খেলার প্রেরণা জোগাইবার একমাত্র উৎস তাহা অনুমান করিলে বিষয়টি অযথাভাবে সহজ করিয়া দেখা হইবে। ইহার মূলে আরও অন্য কারণ আছে। শিশুরা ভয় পাওয়ার ভান করিতে আমোদ পায়; ইহার কারণ বোধহয় এই যে ইহা যে ভান সত্য নয় এই জ্ঞান তাহাদের নিরাপত্তার বোধ বৃদ্ধি করে। সময় সময় আমি কুমিরের ভান করিয়া ছেলেকে খাইতে আসি। সে এমন স্বাভাবিকভাবে চিৎকার করিয়া উঠে যে, সে সত্যই ভয় পাইয়াছে, মনে করিয়া আমি থামিয়া যাই, কিন্তু আমি থামা মাত্রই সে বলিয়া উঠে, বাবা আবার কুমির হও। নাটক অভিনয়েও এই ভান আনন্দ দেয়; ইহার জন্যই বয়স্ক ব্যক্তিরা উপন্যাস ও নাটক অভিনয় পছন্দ করেন। আমার মনে হয় এ সকলের মধ্যে কৌতূহলের বিশেষ স্থান আছে। ভালুক সাজিয়া শিশু ভালুক সম্বন্ধে কিছু কিছু শিখিল মনে করে, যেমন ভালুক কেমন করিয়া হাঁটে, কেমন শব্দ করে, কেমন পোষ মনে ও নাচে ইত্যাদি। আমি মনে করি যে শিশুর জীবনের প্রত্যেকটি প্রবল আবেগ তাহার খেলার ভিতর প্রতিফলিত হয়। ক্ষমতা বা শক্তি শিশুর বাসনার মধ্যে যেরূপ প্রাধান্য লাভ করে তাহার খেলার ভিতরেও সেই পরিমাণে তাহার প্রাধান্য প্রকাশ পায়। ক্ষমতার প্রতি যদি তাহার ঝোঁক বেশি থাকে তবে খেলায় সে এরূপ ভানই ভালোবাসিবে যাহাতে সে নিজেকে শক্তিশালী বলিয়া মনে করিতে পারে। এইভাবেই তাহার বাসনা কতকটা তৃপ্তি লাভ করে।

খেলার শিক্ষামূল্য কি, শিশুর শিক্ষাদান ব্যাপারে খেলা কতখানি সাহায্য করে সে বিষয় আলেচনা করিলে সকলেই স্বীকার করিবেন যে, যে-খেলার ভিতর দিয়া শিশু নূতন প্রবণতা ও কৌশল আয়ত্ত করে তাহা উপকারী ও প্রশংসনীয়। কিন্তু আধুনিককালের অনেকে ভান বা কল্পনা অবলম্বনে শিশু যে খেলা করে তাহার শিক্ষামূল্য সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। বয়স্ক যুবক যখন মনের রুদ্ধ কামনাগুলির তৃপ্তির জন্য জাগর স্বপ্নে অর্থাৎ রঙিন কল্পনাবিলাসে মগ্ন হয়, তখন ইহাকে একপ্রকার মানসিক রোগ বলিয়া অভিহিত করা যায়। মনের বাসনাকে কার্যে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে জাগর স্বপ্নবিলাসী নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকিয়া কল্পনায় বাসনার সার্থকতা আস্বাদ করিতে চায়। এই প্রকার অলস কল্পনাবিলাস কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। ইহার উপর সাধারণ মানুষের যে বিরূপ ভাব আছে তাহা কালক্রমে শিশুর কল্পনাবিলাসের উপরও গিয়া পড়িয়াছে। শিশুরা যেন তাহাদের খেলার সরঞ্জামগুলি রেলগাড়ি বা স্টিমার বা অন্য কোনো কিছু বলিয়া কল্পনা করিয়া লইবে, মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তাহা পছন্দ করেন না। তাঁহারা ইহাকে বলেন বিশৃঙ্খল কল্পনা। তাহাদের অভিমত সম্পূর্ণ সত্য, কেননা শিশুরা এভাবে প্রকৃতই কোনো খেলায় মগ্ন হইতেছে না। এমনকি শিশুদের নিজেদের নিকটও ইহা পূর্ণাঙ্গ খেলা বলিয়া মনে হয় না। মন্তেসরি সরঞ্জাম শিশুকে আনন্দ দেয়; এ সরঞ্জামের উদ্দেশ্য শিশুকে শিক্ষা দেওয়া; এখানে আনন্দ শিক্ষাদানের একটি উপায় মাত্র। কিন্তু প্রকৃত খেলায় আনন্দ লাভই প্রধান উদ্দেশ্য। কাজেই মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিক্ষা সরঞ্জাম লইয়া খেলা ও প্রকৃত খেলা সম্পূর্ণ একপ্রকার নয়। বিশৃঙখল কল্পনা সম্বন্ধে যে আপত্তির সঙ্গত কারণ আছে তাহাই যদি আসল খেলার বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয় তবে ইহা একটু বাড়াবাড়ি হইবে। শিশুকে পরি, দৈৰ্ত, ডাইনি জাদুভরা কার্পেট প্রভৃতি অবাস্তব গল্প শুনাইতে যাহারা আপত্তি করেন তাহাদের সম্বন্ধে এ কথা বলা যায় যে শিশুকে সত্য ও বাস্তবের উপর গড়িয়া তুলিতে গিয়া তাঁহারা বাড়াবাড়ি করিতেছেন। এই ধরনের সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির সহিত আমি একমত হইতে পারি না। এরূপ বলা হয় যে শিশুরা বাস্তব এবং বাস্তবের ভানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করিতে পারে না কিন্তু ইহা বিশ্বাস করার কোনো কারণ আমি দেখি না। বাস্তব জগতে কখনও হ্যামলেট ছিল বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন আমরা হ্যামলেট নাটকের অভিনয় দেখিতেছি তখন যদি কেহ সর্বদা বলিতে থাকে এ কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক তখন আমরা বিরক্ত না হইয়া পারি না। সেইরূপ শিশু যখন কোনো কিছুর ভান করিয়া খেলার আনন্দ উপভোগ করিতে থাকে তখন ইহাকে কখনোই সত্য বলিয়া গ্রহণ করে না কিন্তু কেহ যদি তাহাকে সর্বদা স্মরণ করাইয়া দেয় যে ইহা নিছক মিথ্যা তবে সে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করে।

সত্য এবং কল্পনা উভয়ই প্রয়োজনীয় কিন্তু জাতির ইতিহাসে যেমন, ব্যক্তির জীবনেও তেমনই, কল্পনার স্ফুরণই হয় প্রথমে। যতদিন শিশুর স্বাস্থ্য সবল এবং স্বাভাবিক থাকে ততদিন সে বাস্তব সত্য অপেক্ষা খেলাতেই বেশি আনন্দ পায়। খেলার সময় সে যেন রাজা। বাস্তবিক সে নিজের কল্পনারাজ্যে জাগতিক রাজার অপেক্ষা বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ করিয়া রাজত্ব করিয়া থাকে। বাস্তবে তাহাকে নির্দিষ্ট সময়ে শুইতে হয়, কত রকম আদেশ, হুকুম পালন করিতে হয়, উপদেশ অনুসারে কাজ করিতে হয়। কঠোর কল্পনাবিহীন বয়স্ক ব্যক্তিরা যখন শিশুর এই কল্পনাবিলাসে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে তখন সে অত্যন্ত রুষ্ট হয়। সে হয়তো একটি দেওয়াল তৈয়ারি করিয়াছে এবং কল্পনা করিয়াছে যে সেটি এত উঁচু যে সবচেয়ে বড় দৈত্যও তাহা ডিঙাইতে পারে না; আপনি যদি তাহা ডিঙাইয়া গিয়া হেলায় তাহার কল্পনা তুচ্ছ করিয়া দেন তবে সে আপনার উপর বিরক্ত হইবেই। বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনায় শিশুর হীনতা বোধ একান্তই স্বাভাবিক; ইহা মানসিক রোগের লক্ষণ নয়। তেমনি কল্পনায় এই হীনতা দূর করিয়া নিজের শক্তির পরিচয় দেওয়ার কামনা শিশুর পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক। ইহা কোনোরূপ মনোবিকারের লক্ষণ নয়। খেলায় যে সময় ব্যয়িত হয় তাহা অন্য কোনো প্রকারে ইহার অপেক্ষা সার্থকতরভাবে নিয়োজিত হইতে পারে না, সব সময়ই যদি শিশুকে গুরুতর কাজকর্মে ব্যাপৃত রাখার ব্যবস্থা হয় তবে অচিরেই তাহার স্নায়ু বিকল হইয়া পড়িবে, সে হইবে অসুখি এবং অপদার্থ। যে বয়স্ক ব্যক্তি জাগর স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে তাহাকে কাজে প্রবৃত্ত হইয়া মনের বদ্ধ ভাবগুলিকে বাস্তবে পরিণত করিতে উপদেশ দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু শিশুর পক্ষে এ উপদেশ নিরর্থক, কেননা ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দিবার দৈহিক ও বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও কৌশল তাহার কাছে আশা করা যায় না। কল্পনা তাহার নিকট বাস্তবের স্থায়ী পরিবর্ত [Substitute] নয়; চিরদিন সে কল্পনা লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে প্রস্তুত নয়, উপযুক্ত সময় হইলে সে বরং তাহার কামনাকে বাস্তবে পরিণত করার আশাই মনে পোষণ করে।

সত্য ও কঠোর বাস্তবকে একত্রে মিশাইয়া তাল পাকাইয়া ফেলা একটা মারাত্মক ভুল। আমাদের জীবন কেবল বাস্তব ঘটনা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় না; জীবন গঠনে আশারও যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। সত্য বলিতে গিয়া যদি বাস্তব ঘটনা ছাড়া আর কিছু না বুঝায় তবে এরূপ সত্যনিষ্ঠা মানব মনের পক্ষে কারাগারস্বরূপ হইয়া দাঁড়ায়। কল্পনা যদি মনের বাসনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার পরিবর্তে কেবল অলস স্বপ্নেই পর্যবসিত থাকে কেবল তখনই তাহা নিরুৎসাহ করা উচিত; কিন্তু কল্পনা যখন কাজের প্রেরণা জোগায় তখন ইহা মানুষের আদর্শগুলিতে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করিতেই সাহায্য করে। শৈশবে কল্পনাকে পিষিয়া মারিয়া ফেলিলে মানুষ বস্তুতান্ত্রিকতার দাসরূপে পরিণত হয়; মাটির পৃথিবীর বাস্তব দীনতা, হীনতা, তুচ্ছতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ থাকিয়া সে ভাবের স্বর্গলোক সৃষ্টি করিতে পারে না। আপনি হয়তো বলিবেন এ সবই উত্তম কিন্তু শিশু ভক্ষণকারী দৈত্যের সঙ্গে অথবা স্ত্রী হত্যাকারী ব্লু-বিয়ার্ডের সঙ্গে ইহার কি সম্বন্ধ? আপনার স্বর্গে কি এ সব থাকিবে? কল্পনা যাহাতে সত্যই কোনো ভালো কাজে লাগে সে জন্য কি ইহা বিশুদ্ধ ও উন্নত ধরনের করিতে হইবে না? আপনি তো একজন শান্তিবাদী কিন্তু আপনার নির্দোষ শিশু মানুষ হত্যার চিন্তায় আনন্দ পাইবে। ইহা কি আপনি সমর্থন করিবেন? মানুষ আদিম প্রবৃত্তিগত বর্বরতার স্তর পার হইয়া আসুক ইহাই কাম্য, কিন্তু নিষ্ঠুরতার চিন্তায় শিশু যে আনন্দলাভ করে তাহা আপনি কিভাবে সমর্থন করিবেন? পাঠক হয়তো এইরূপ চিন্তা করিতেছেন। এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ; কেন আমি এ বিষয়ে পৃথক অভিমত পোষণ করি তাহাই বিবৃত করিতে চেষ্টা করিব।

প্রবৃত্তিগুলি দমন করিয়া রাখিলেই শিক্ষাদান সম্পূর্ণ হইল না; এগুলির যথাযথ বৃদ্ধি এবং মঙ্গলজনক কাজে নিয়োগ করিতেই শিক্ষার সার্থকতা। মানব প্রবৃত্তিগুলি বড়ই অস্পষ্ট; ইহারা কোনো নির্দিষ্ট আকারে কোনো নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হয় না, নানাভাবে ইহাদের তৃপ্তিসাধন করা যায়। বেশিরভাগ প্রবৃত্তিরই পরিতৃপ্তির জন্য কোনও প্রকার কৌশল আবশ্যক। ক্রিকেট এবং বেসবল একই প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করে কিন্তু বালক যে খেলাটি জানে সেইটিই খেলিবে। বালকের ক্রীড়াপ্রবৃত্তির তৃপ্তিসাধনের জন্য শুধু যে একই নির্দিষ্ট প্রকার খেলার কৌশল আয়ত্ত করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কাজেই চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তাহার মূল সূত্র হইল মানুষকে এমন কৌশল আয়ত্ত করানো যাহাতে সে তাহার প্রবৃত্তিগুলিকে ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগাইতে পারে। শক্তিমান হওয়ার যে বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য শিল্প কল্পনায় অত্যাচারী, নিষ্ঠুর,–বিয়ার্ড সাজিয়া নিজের ক্ষমতার পরিচয় দেয়, পরবর্তীকালে সেই বাসনাই পরিতৃপ্তির জন্য অন্য পথ খোঁজে, শৈশবের সেই ক্ষমতাকামী কল্পনাপ্রবণ কামনা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, শিল্পসৃষ্টি, শিক্ষার ভিতর দিয়া উন্নত প্রকৃতির মানুষ সৃষ্টি প্রভৃতি অসংখ্য রকমের উৎকৃষ্ট কাজের মধ্যে সার্থকতা লাভ করে। কোনো লোক যদি কেমন করিয়া যুদ্ধ করিতে হয় কেবল তাহাই জানে তবে যুদ্ধই হইবে তাহার আনন্দের বিষয়। কিন্তু যদি অন্যান্য বিষয়েও তাহার নিপুণতা থাকে তবে আরও অনেক উপায়ে তাহার বাসনা চরিতার্থতা লাভ করিতে পারে। যদি তাহার শক্তিলাভের বাসনা শৈশবেই বিনাশ করিয়া ফেলা হয় তবে সে হইবে উদ্দেশ্যবিহীন এবং অলস। ভালো বা মন্দ কোনোপ্রকার কাজ করার ক্ষমতাই তাহার থাকিবে না। এই রকম নিরীহ, নিবীর্য নিষ্ক্রিয় ভালো মানুষ দ্বারা জগতের কোনো উপকারই হয় না; আমাদের শিশুদিগকে আমরা এইভাবে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে পরিণত করিতে চাই না। বাল্যকালে শিশুরা বর্বরতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কল্পনায় তাহারা অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার অভিনয় করিতে ভালোবাসে, দৈহিক বিক্রমের প্রকাশ তাহাদের নিকট আনন্দদায়ক। শিশুর ক্রমবিকাশের পক্ষে এরূপ আচরণ তাহার জৈবিক প্রয়োজন বলিয়া গণ্য করা হয়। ক্রম বিবর্তনের ফলে আদিম হিংস্র বর্বর মানব বর্তমানে সভ্য মানবে রূপান্তরিত হইয়াছে। বয়স্ক সভ্য মানুষ তাহার আদিম পূর্বপুরুষের আচরণ অনুসরণ করে না, করিলে সভ্য সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত না, পৃথিবী নবরূপী হিংস্র পশুর আবাসে পরিণত হইত। মানব-শিশু তাহার জীবনের প্রথম কয়েক বৎসর কল্পনা ও আচরণের ভিতর দিয়া আদিম মানুষের জীবনস্তর পার হইয়া আসে। এই সময় তাহারা থাকে ছোট, তাহাদের ক্ষতি করার সামর্থ্যও থাকে কম; কাজেই বর্বর আদি মানবের অভিনয় করিলেও তাহারা সমাজের কোনো অপকার করিতে পারে না। তাহাদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য উন্নততর কোনো কৌশল আয়ত্ত করিতে পারিলে তাহারা বর্বরের স্তরে থাকিয়া যাইবে না। অতএব বাল্যে যেরূপ কল্পনায় তাহারা আনন্দ অনুভব করে পরবর্তীকালেও যে তাহারা সেই কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চাহিবে এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নাই। বাল্যকালে ডিগবাজি খাইতে আমি খুব আনন্দবোধ করিতাম। এ কাজ যদিও খারাপ মনে হয় না তবু আমি আর এখন ডিগবাজি খাই না। সেইরূপ যে শিশু এখন ব্লু-বিয়ার্ড সাজিতে ভালোবাসে পরে রুচির পরিবর্তন ঘটিলে সে অন্য উপায়ে তাহার কামনা তৃপ্ত করিবে। বাল্যকালে শিশুর দেহ মনের উপযোগী উদ্দীপকের [Stimuli] সাহায্যে যদি তাহার কল্পনা সরস ও সজীব রাখা হয়, তবে সেই শিশু যখন বয়স্ক মানুষে পরিণত হইবে তখন তাহার কল্পনা বয়স্ক ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নানা প্রবৃত্তিকে বাস্তবরূপ দিতে সাহায্য করিবে। শৈশবে শিশুর মনে নৈতিক ভাব বা আদর্শ প্রবেশ করাইবার চেষ্টা করা বৃথা; ইহাতে তাহাদের কোনো সাড়া পাওয়া যাইবে না; ওই বয়সে তাহাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এইরূপ নৈতিক উপদেশের কোনো প্রয়োজন নাই। এইরূপ করিলে শিশুর মনে আসিবে অবসাদ এবং ফল হইবে যে, যে-বয়সে শিশু এই ভাব গ্রহণে সক্ষম হইত তখনও সে উহা গ্রহণ করিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাইবে না। অপ্রবেশ্য শিলায় জল জমিলে তাহা যেমন চুয়াইয়া নিচে নামে না শিশুর মনেও তেমনই নৈতিক ভাব গ্রহণের বিরুদ্ধে একটি শক্ত স্তর গঠিত হইবে। ভিন্ন ভিন্ন বয়সে শিশুর মনে গতি-প্রকৃতি কেমন থাকে তাহা প্রত্যেক পিতামাতা এবং শিক্ষকের জানা দরকার। এজন্যই শিশু মনস্তত্ত্ব শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলিয়া গণ্য করা হয়।

শৈশবের খেলার সঙ্গে পরবর্তীকালের খেলার পার্থক্য এই যে, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খেলাও ক্রমে বেশি প্রতিযোগিতামূলক হইয়া উঠে। প্রথমে শিশু একা একা নির্জনে খেলিতে ভালোবাসে; বড় ভাইবোনের সঙ্গে মিলিয়া খেলিবার সামর্থ্য তখন তাহার থাকে না। কিন্তু সে যখন অন্যের সঙ্গে একত্রে খেলিলে আনন্দ পায় তখন একাকী খেলা আর তাহার নিকট পছন্দ হয় না। ইংরেজ অভিজাত সম্প্রদায় স্কুলের খেলাধুলার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। যদিও খেলার কতকগুলি উপকারিতা আছে তবুও আমার মনে হয় ইংরেজরা ক্রীড়াকৌশলকে যেরূপ প্রাধান্য দিয়াছে তাহাতে যেন কিঞ্চিৎ আতিশয্য ঘটিয়াছে। খেলাধূলায় যদি চরম উৎকর্ষের দিকে ঝোঁক দেওয়া না হয় তবে ইহা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী সন্দেহ নাই। যদি খেলায় নিপুণতা প্রদর্শনীই উদ্দেশ্য হয় তবে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়গণ বাড়াবাড়ি করে এবং অপর সকলে দর্শকে পরিণত হয়। যাহারা ভালো খেলা জানে তাহারা আরও উৎকর্ষ লাভ করিবার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, সাধারণ খেলোয়াড়গণ প্রতিযোগিতা হইতে দূরে সরিয়া শুধু অপরের ক্রীড়াকৌশল দেখে, তাহাদের নিজেদের স্বাস্থ্যচর্চা আশানুরূপ হয় না। খেলার একটি গুণ এই যে ইহা বালক-বালিকাদিগকে হইচই না করিয়া আঘাত সহ্য করিতে এবং প্রফুল্লচিত্তে কঠোর পরিশ্রম করিতে শিক্ষা দেয়। খেলার অন্যান্য উপকারিতা সম্বন্ধে যাহা বলা হয় তাহার বেশিরভাগই আমার কাছে কাল্পনিক বলিয়া মনে হয়। বলা হয় যে, খেলা সহযোগিতা শিক্ষা দেয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বালক-বালিকা উহা প্রতিযোগিতার আকারেই শিক্ষা করে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা শিল্পে বা যথাযথ রূপ সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নয়, ইহার প্রয়োজন যুদ্ধে। বিজ্ঞানের কল্যাণে অর্থনীতিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রতিযোগিতার স্থান গ্রহণ করিতে সক্ষম হইয়াছে; বিজ্ঞানের কল্যাণেই প্রতিযোগিতা (যেমন যুদ্ধবিগ্রহ) পূর্বের অপেক্ষা অনেক বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করিয়াছে। সে জন্য যে প্রতিযোগিতামূলক কার্যকলাপে মানুষে মানুষে সংঘাত বাঁধে, যাহাতে একদল মানুষ হয় জয়ী, অপর দল হয় পরাজিত তাহার পরিবর্তে এমন সহযোগিতামূলক কর্মপ্রচেষ্টায় উৎসাহ দেওয়া উচিত যাহাতে সেখানে বহিঃপ্রকৃতিকে শত্রু বলিয়া গণ্য করিয়া মানুষ তাহার উপর আধিপত্য লাভ করিতে পারে। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা না করিয়া পরস্পরের সহযোগিতায় মানুষ প্রকতিকে জয় করিতে যত্নবান হউক ইহাই কাম্য। এই বিষয়ের উপর আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না, কেননা প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক এবং ইহা প্রকাশের কোনো পথও থাকা দরকার; আর খেলাধুলায় ও দেহচর্চায় দ্বন্দ্বের মতো নির্দোষ প্রতিযোগিতাও বিশেষ কিছু নাই। খেলা বন্ধ না করার পক্ষে ইহা যুক্তিপূর্ণ কারণ সন্দেহ নাই কিন্তু এই কারণে স্কুলের পাঠ্যতালিকায় ইহাকে প্রধান স্থান দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। বালকেরা খেলা পছন্দ করে, কাজেই তাহাদিগকে খেলিতে দেওয়া উচিত; জাপানিরা যাহাকে বলে বিপজ্জনক চিন্তা তাহা হইতে বালকদিগকে মুক্ত রাখিবার উদ্দেশ্যে বিপজ্জনক চিন্তার প্রতিষেধকরূপে কর্তৃপক্ষ দ্বারা খেলার প্রবর্তন ও প্রয়োগ সমর্থন করা চলে না।

পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে ভয়কে জয় করা এবং সাহস প্রদর্শনের উপযোগিতা আলোচনা করা হইয়াছে। মনে রাখিতে হইবে সাহস এবং নির্দয়তা [Brutality] এক জিনিস নয়। একজনের ইচ্ছা জোর করিয়া অন্যের উপর চাপাইয়া যে আনন্দ তাহাই নির্দয়তা; ব্যক্তিগত বিপদ উপেক্ষা করার মধ্যে দেখা যায় সাহস। সুযোগ পাওয়া গেলে আমি বালক-বালিকাদিগকে ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রে ছোট জাহাজ চালানো, উচ্চস্থান হইতে জলে ঝাপানো, মোটর গাড়ি চালানো, এমনকি বিমান চালনা শিক্ষা দিতে চাই। আউন্ডলের [Sanderson of Oundle] স্যান্ডারসন যেমন করিয়াছিলেন আমিও তেমনি কিশোর-কিশোরীকে যন্ত্র তৈয়ার করিতে এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার বিপদের সম্মুখিন হইতে শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী। যতদূর সম্ভব খেলাধুলায় জড় প্রকৃতিকে আমি মানুষের প্রতিপক্ষরূপে বিচেনা করিতে চাই; জড় প্রকৃতির সহিত দ্বন্দ্বেও বালকের ক্ষমতালাভের বাসনা পরিতৃপ্ত হইবে, যেমন হয় অপর মানুষের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এই উপায়ে যে কৌশল অধিগত হয় তাহা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার কৌশল অপেক্ষা বেশি প্রয়োজনীয় এবং যে চরিত্র গঠিত হয় তাহা সামাজিক নীতির সহিত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। নৈতিক গুণগুলি ছাড়াও দেহচর্চার উপর অতিরিক্ত ঝোঁক দেওয়ার ফলে বুদ্ধিবৃত্তি ম্লান হইয়া পড়ে। মূর্খতা হেতু এবং কর্তৃপক্ষ বুদ্ধির বেশি মূল্য দেন না কিংবা ইহা বিকাশের উপর গুরুত্ব দেন না। এইজন্য গ্রেট ব্রিটেন শিল্পজগতে তাহার অধিকার হারাইতেছে, হয়তো সাম্রাজ্যও হারাইবে। এই সবই খেলাধুলার উপকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অতিরিক্ত গোঁড়া বিশ্বাসের ফল। ইহার আরও গভীরতর দিক আছে : বর্তমানের জটিল সমস্যাসঙ্কুল জগৎকে বুঝিতে হইলে জ্ঞান এবং চিন্তার বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু খেলাধুলার যোগ্যতাই কোনো যুবকের গুণপনার একমাত্র মাপকাঠি, এই বিশ্বাস যেখানে প্রবল সেখানে বুঝিতে হইবে যে বর্তমান জগতের মানুষের কোন কোন্ গুণ বেশি দরকারি তাহা আমরা উপলব্ধি করিতে পারি নাই। এই বিষয়টি পরে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হইবে।

স্কুলের খেলাধুলার আরও একটি দিকে আছে; সাধারণত এটি ভালো বলিয়াই বিবেচিত হয় কিন্তু আমার মতে ইহার ফল মোটের উপর ভালো নয়। খেলার ভিতর দিয়া সংঘ-প্রীতি বা দলের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করার কথাই এখানে বলিতেছি। কর্তৃপক্ষ এই সংঘ-প্রীতি পছন্দ করেন, কেননা ইহার সাহায্যে খারাপ উদ্দেশ্যকেও তথাকথিত ভালো কাজে লাগানো যায়। ছাত্রদের কাজে উৎসাহ দিতে হইলে অন্য এক দলকে প্রতিযোগিতায় পরাভূত করার বাসনা জাগাইয়া তুলিলেই কাজ সহজ হয়। ইহার অসুবিধা হইল এই যে, যাহাতে প্রতিযোগিতা নাই সেইরূপ কাজে উদ্যম আসে না। আমাদের সকল কাজেই প্রতিযোগিতার মনোভাব কতদূর প্রসারিত হইয়াছে তাহা চিন্তা করিলে বিস্মিত হইতে হয়। আপনি যদি আপনার নিজের জেলার শিক্ষা মঙ্গল সমিতির সেবাকার্য আরও ভালো করিতে চান আপনাকে উল্লেখ করিতে হইবে যে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে শিশু-মৃত্যুর হার অনেক কম। কোনো শিল্পোৎপাদনকারীকে যদি কোনো নূতন প্রকৃত পন্থা গ্রহণ করিতে বলেন তবে আপনাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইহা দ্বারা কিরূপ সুবিধা হইবে তাহা দেখাইয়া দিতে হইবে। প্রতিযোগিতা ভিন্ন। কোনো নির্মাণ ক্ষমতার বা গঠন কৌশলের উন্নতির চেষ্টা হয় না; অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চিন্তা বাদ দিয়া লোকে কেবল উন্নতির জন্যই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয় না। আমাদের স্কুলের খেলাধুলার তুলনায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গেই ইহার বেশি সম্বন্ধ। কিন্তু বর্তমানে স্কুলের অনুষ্ঠিত খেলাধূলার মধ্যে প্রতিযাগিতার ভাব বিদ্যমান রহিয়াছে। যদি প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাব প্রবর্তন করিতে হয় তবে স্কুলের খেলাধুলায় এর পরিবর্তন আবশ্যক হইবে। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করিতে হইলে আমাদের নির্ধারিত বিষয়বস্তু ছাড়া অন্য বিষয়ের অবতারণা করিতে হয়। আমরা এখানে ভালো রাষ্ট্র গঠনের বিষয় আলোচনা করিতেছি না, বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতরেই ভালো নাগরিক সৃষ্টি করার উপায়ই এ পুস্তকের আলোচ্য বিষয়। নাগরিকের ব্যক্তিগত উন্নতি এবং সমাজের উন্নতি পাশাপাশি চলা উচিত কিন্তু শিক্ষা প্রসঙ্গে লেখকের নিকট ব্যক্তি ও তাহার যথোপযুক্ত বিকাশ সাধনই প্রধান।

০৬. সৃজন কার্য

খেলার আলোচনা প্রসঙ্গে এ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে উল্লিখিত হইয়াছে। এখন কিঞ্চিৎ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইবে।

আমরা দেখিয়াছি, শিশুদের প্রবৃত্তিজাত বাসনাগুলি প্রথমে কোনো নির্দিষ্ট আকারে থাকে না; শিক্ষা এবং সুযোগ তাহাদিগকে বিভিন্ন আকার দিয়া বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। আদি পাপ সম্বন্ধে পুরাতন ধারণা কিংবা স্বভাবতই শিশু নিষ্পাপ এবং সকল গুণের আধার বলিয়া রুশোর বিশ্বাস ইহার কোনোটাই সত্য নয়। কিতক লোকের ধারণা ছিল, শিশু মানুষের পাপ হইতে জাত, তাহার ভিতরেও পাপের বীজ রহিয়াছে এবং কালক্রমে তাহা বিকাশ লাভ করিবে; পাপ হইতে জাত তাহা কখনোই আপনা আপনি ভালো হইতে পারে না। রুশো ঠিক ইহার বিপরীত বিশ্বাস প্রচার করিয়াছেন। তাহার মতে শিশু নিষ্কলুষ এবং সকল গুণের সম্ভাবনা তাহার মধ্যে সুপ্ত রহিয়াছে।] কাঁচামালের মতো শিশুর প্রবৃত্তি নিরপেক্ষ থাকে; পরিবেশের প্রভাবে ইহা ভালো বা মন্দ আকার গ্রহণ করে। এরূপ বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে কতকগুলি অস্বাভাবিক ক্ষেত্র ছাড়া অধিকাংশ লোকের প্রবৃত্তিগুলি এমন থাকে যে তাহাদিগকে ভালোর দিকেই বিকশিত করা যায়; শিশুর অল্প বয়স হইতেই যদি তাহার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন লওয়া যায় তবে মনোরোগীর সংখ্যা খুব অল্পই হইবে। উপযুক্ত শিক্ষার ফলে মানুষ তাহার প্রবৃত্তি অনুসারে আচরণ করিয়া জীবনধারণ করিতে পারে; প্রবৃত্তি হইতে শিশু অমার্জিত নির্দিষ্ট আকারবিহীন, উদ্দাম প্রবৃত্তি লাভ করে। শিক্ষার ফলে ইহাই হয় সুসংযত, সুষ্ঠুভাবে বিকশিত। আদিম ও অসংস্কৃত প্রবৃত্তি দ্বারা নয়, উপযুক্ত শিক্ষার ফলে মানুষের প্রবৃত্তি যখন সুনিয়ন্ত্রিত হয় তখনই ইহা দ্বারা পরিচালিত হইয়া সে ভাবে জীবনযাপন করিতে পারে। কোনো বিষয়ে দক্ষতা বা কৌশল মানুষের প্রবৃত্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে বিকশিত করার একটি প্রধান উপায়, এই কৌশল কোনো নির্দিষ্ট প্রকারের তৃপ্তি দান করে; মানুষকে কোনো যথাযথ রকমের কৌশল শিখাইলে কিংবা কোনো প্রকার কৌশলই না শিখাইলে সে হইবে পাপী। শিশুর প্রবৃত্তিগুলিকে প্রথম অবস্থায় মনে করা যায় কাঁচামালের মতো। শিল্পী যেমন কাঁচামালকে তাহার সামর্থ্য ও অভিরুচি অনুসারে সুন্দর অথবা অসুন্দর দ্রব্যে পরিণত করে, তেমনই শিশুর প্রবৃত্তিগুলি যেরূপভাবে নিয়ন্ত্রিত ও বিকাশপ্রাপ্ত হয় তাহার উপরই নির্ভর করে শিশু কিরূপ বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হইবে।

এই সাধারণ নিয়ম শিশুর ক্ষমতা অর্জনের বাসনার প্রতি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আমরা কোনো কিছু করিতে চাই; এইরূপ কাজের ভিতর দিয়া ক্ষমতার প্রকাশ দেখানই উদ্দেশ্য। কি ধরনের কাজের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রকাশ করা হইবে সে সম্বন্ধে প্রথমে কোনো লক্ষ্য থাকে না। মোটামুটিভাবেই বলা যায়, কাজ যত কঠিন হইবে ইহা সম্পন্ন করার আনন্দও তত বেশি হইবে। মানুষ পাখির মতো ডানা মেলিয়া উড়িতে চায়, কারণ ইহা কঠিন কাজ; শিকারি উপবিষ্ট পাখিকে গুলি করিয়া মারিতে বিশেষ আনন্দ পায় না। কেননা ইহা সহজ কাজ। উদাহরণস্বরূপ ইহাদের কথা উল্লেখ করা হইল। আকাশে ওড়া বা গুলি করিয়া পাখি মারা কাজ সম্পন্ন করিতে যে পদ্ধতি কঠিন বা অসাধারণ তাহাই বেশি আনন্দ দেয়। অন্যত্রও এই নীতি প্রয়োগ করা চলে। জ্যামিতি শেখার আগে পর্যন্ত আমি গণিত পছন্দ করিতাম, বিশ্লেষণমূলক [Analytical Geometry] জ্যামিতি শেখার পূর্বে পর্যন্ত জ্যামিতি ভালো লাগিত। এইভাবে একটি আয়ত্ত করার পর কঠিনটির দিকে ক্রমশ ঔৎসুক্য অগ্রসর হইতে থাকে। শিশু প্রথমে হাঁটিতেই আনন্দ পায়, পরে দৌড়াইতে, তাহার পর লাফাইতে এবং কোনো কিছু বাহিয়া উপরে উঠিতে সে ভালোবাসে। যাহা আমরা সহজে করিতে পারি তাহার মধ্যে আর শক্তির প্রকাশ অনুভব করি না। নূতন কৌশল অথবা যাহা আয়ত্ত করা সম্ভব হইবে কি না সন্দেহ আছে তাহা আয়ত্ত করিতে পারিলে কৃতকার্য হওয়ার তীব্র আনন্দানুভূতি লাভ হয়। কাজেই দেখা যায় ক্ষমতা লাভের বাসনাকে যে-কোনো প্রকার কৌশল আয়ত্ত করার সঙ্গেই খাপ খাওয়াইয়া লওয়া চলে।

কোনো কিছু সৃষ্টি করা এবং কোনো কিছু ভাঙিয়া ফেলা উভয়ই ক্ষমতা প্রকাশের বাসনাকে তৃপ্ত করে কিন্তু ভাঙিয়া ফেলার তুলনায় সৃষ্টি করা কঠিনতর। কাজেই ধ্বংস করা অপেক্ষা সৃষ্টিতে আনন্দ বেশি। সৃজন বা ধ্বংস বলিতে কি বুঝায় তাহার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করিব না।

মনোবিজ্ঞানের কথায় বলা যায় আমরা যখন পূর্বপরিকল্পিত গড়ন অনুযায়ী কিছু তৈয়ার করি তখনই সৃষ্টি করি; নূতন কোনো আকার দিবার পরিকল্পনা না রাখিয়া আমরা যখন কোনও বর্তমান জিনিসের পরিবর্তন সাধন করি তখনই ধ্বংস করা হইল। এ ব্যাখ্যার সম্বন্ধে যাহাই মনে করা হউক না কেন কোনো কাজ গঠনমূলক কি না কার্যক্ষেত্রে তাহা আমরা সকলেই বুঝিতে পারি। তবে ইহারও ব্যতিক্রম আছে; কোনো লোক যখন বলে যে নূতন সৃষ্টির জন্যই সে ধ্বংস করিতেছে তখন তাহার আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকিলে তাহার কাজ সৃষ্টিকার্য কি ধ্বংসকার্য তাহা নির্ণয় করা সত্যই কঠিন।

সৃষ্টি অপেক্ষা ধ্বংস করা সহজ; এ জন্য ধ্বংস করা অর্থাৎ কোনো কিছু ভাঙিয়া ফেলা হইতে শিশুর সূত্রপাত হয়। বালির মধ্যে খেলা করিবার সময় শিশুরা চায় বয়স্ক ব্যক্তিরা কেহ বাটি দিয়া ছোট ছোট পিঠার মতো টিবি তৈয়ার করিয়াদিক; তারপর তাহারা সেইগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে আনন্দ পায়। কিন্তু যখন তাহারা নিজেরা এইরূপ তৈয়ার করিতে শেখে তখন ইহা প্রস্তুত করিতেই তাহাদের আনন্দ; তখন তাহারা কাহাকেও সেইগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে দিতে চায় না। শিশুরা যখন প্রথম ইট লইয়া খেলা করে তখন তাহারা তাহাদের অপেক্ষা বয়সে বড় সঙ্গীদের নির্মিত ইটের খেলার ঘরবাড়ি ভাঙিয়া ফেলিতে ভালোবাসে। কিন্তু তাহারা নিজেরা ইট দিয়া কোনো কিছু তৈয়ার করিতে পারিলে নিজেদের কাজের জন্য রীতিমত গর্ব বোধ করে এবং কেহ যে তাহাদের সাধের সৌধ ভাঙিয়া দিবে তাহা তাহারা সহ্য করিতে পারে না। যে আবেগের ফলে শিশু এই খেলার আনন্দ পায় তাহা ভাঙা এবং গড়া উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে বিদ্যমান আছে। নূতন কৌশল কেবল খেলার আবেগ পরিতৃপ্ত করার পরিবর্তন আনিয়াছে। ভাঙিতে শিশুর যেইরূপ, গড়িতেও সেইরূপ আনন্দ। গড়িবার কৌশল শিক্ষার পর শিশু ভাঙা অপেক্ষা গড়াই বেশি পছন্দ করে। দেখা যায় যে শিশু পূর্বে কেবল ভাঙিয়া ফেলিয়াই আনন্দ পাইত, সেই পরে গড়িতেই বেশি আনন্দ পাইতেছে।

শিশু যেমন প্রথম সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করে তখন তাহার মধ্যে অনেকগুলি গুণের বিকাশ ঘটানো যায়। শিশু যখন তাহার নিজের তৈরি জিনিস নষ্ট না করিতে অনুরোধ করে তখন তাহাকে সহজেই বুঝাইতে পারেন যে, সে নিজেও যেন অন্যের কোনো জিনিস নষ্ট না করে। এইভাবে আপনি শিশুর মনে অপরের পরিশ্রম দ্বারা উৎপাদিত জিনিসের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাইয়া তুলিতে পারেন। পরিশ্রমই ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের পক্ষে সমাজের দিক হইতে একমাত্র নির্দোষ উপায়। সৃজন কার্যের উৎসাহ দান করিতে আপনি শিশুর ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ দিন; এ গুণগুলি ছাড়া সে যতখানি উঁচু চুড়া তৈয়ার করিতে চায় ততখানি পারিবে না। শিশুদের সঙ্গে খেলায় যোগদান করিয়া আপনি এমনভাবে কোনো কিছু তৈয়ার করুন যাহাতে তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়; আপনি কেবল দেখাইয়া দিন কিভাবে তৈয়ার করিতে হয়, তারপর শিশুদের উপরই তৈয়ার করিবার ভার ছাড়িয়া দিন।

শিশুকে বাগানে প্রবেশ করিতে দিলে তাহার সৃষ্টির বাসনাকে নূতন আকারে ভালোভাবে বর্ধিত করা যায়। বাগানে ঢুকিলেই সুন্দর আকর্ষণীয় ফুলগুলি তোলাই হইবে তাহার প্রথম আবেগ। নিষেধ করিয়া তাহাকে নিবৃত্ত করা যায় কিন্তু শিক্ষা হিসাবে শুধু নিষেধই যথেষ্ট নয়, যে শ্রদ্ধাযুক্ত মনোভাবের ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা বাগানের ফুল যথেচ্ছভাবে নষ্ট করে না, সেইরূপ মনোভাব শিশুর মধ্যেও জাগাইয়া তুলিতে হইবে। সুন্দর এবং নয়নানন্দদায়ক কিছু তৈয়ার করিতে কি পরিমাণ পরিশ্রম ও চেষ্টার দরকার তাহা উপলব্ধি করিতে পারে বলিয়াই বয়স্ক ব্যক্তিদের মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগে। শিশুর বয়স যখন তিন বৎসর হইবে তখনই তাহাকে বাগানের মধ্যে এক কোণে কিছুটা জায়গায় ফুলগাছের চারা লাগাইতে উৎসাহিত করা যায়। গাছগুলি বড় হইয়া ফুল ফুটিলে তখন সেইগুলি তাহার কাছে অপূর্ব এবং মহামূল্যবান বলিয়া মনে হইবে। তাহার ফুল কেহ নষ্ট করুক ইহা যেমন সে চাহিবে না, তেমনই সে বুঝিতে পারিবে যে তাহার মায়ের ফুলগুলির প্রতিও অনুরূপ যত্ন লওয়া উচিত।

গঠনমূলক কাজ ও জীবন্ত প্রাণীর প্রতি প্রীতি এবং অনুরাগ বৃদ্ধি করিয়া শিশুর নিষ্ঠুরতা দূর করা যায়। প্রায় সকল শিশুই একটু বড় হইলেই মাছি এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গ মারিতে চায়। এই অভ্যাস ক্রমে বড় প্রাণী এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ হত্যা করার অভিলাষ জন্মায়। ইংল্যান্ডে সাধারণ সম্ভ্রান্ত পরিবারে পাখি হত্যা করা বিশেষ প্রশংসনীয় কাজ বলিয়া পরিগণিত; যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ হত্যা তো তাহাদের নিকট একটি মহান কাজ। এই সকল কাজ অসংস্কৃত প্রবৃত্তির প্রেরণাসঞ্জাত। যে সকল লোক কোনো প্রকার গঠনমূলক কৌশল জানে না এবং যাহারা ক্ষমতা প্রকাশের বাসনাকে অন্য কোনো নির্দোষ শান্তিপূর্ণ উপায় পূর্ণ করিতে পারে না, তাহারাই নৃশংস আচরণের ভিতর দিয়া ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া থাকে। তাহারা সুন্দর পাখি হত্যা করিতে পারে, রায়ত প্রজাদিগের উপর অত্যাচার করিতে পারে; প্রয়োজন হইলে তাহারা একটি গণ্ডার অথবা একজন জার্মানকে বিনা দ্বিধায় গুলি করিয়া মারিতে পারে। কিন্তু তাহাদের পিতামাতা ও শিক্ষকগণ শিক্ষা দিয়া তাহাদিগকে শুধু ইংরেজ ভদ্রলোকে পরিণত করিয়াছেন; অন্যান্য অধিকতর প্রয়োজনীয় শিল্পকাজে তাহারা সম্পূর্ণ অপারগ। আমি বিশ্বাস করি না যে জন্মের সময় তাহারা অন্যান্য শিশু অপেক্ষা অধিকতর মূর্খ ছিল; পরবর্তীকালে তাহাদের চরিত্রের ত্রুটিগুলির জন্য একমাত্র কুশিক্ষাই দায়ী। যদি বাল্যকাল হইতে তাহারা প্রাণী পুষিয়া যত্নের সঙ্গে তাহাদের বৃদ্ধি লক্ষ করিত এবং জীবনের মূল্য উপলব্ধি করিত, যদি তাহারা সৃজন কৌশল আয়ত্ত করিত, যদি তাহারা বুঝিত যে কোনো ভালো জিনিস তৈয়ার করিতে কত যত্ন পরিশ্রম এবং অনুরাগ দরকার কিন্তু নষ্ট করা যায় এক মুহূর্তেই, তবে অন্যের উৎপাদিত বা লালিতপালিত কোনো কিছু অনায়াসে ধ্বংস করিতে উদ্যোগী হইত না। যদি অপত্যস্নেহ জাগ্রত হয় পিতৃত্ব এ বিষয়ে বড় শিক্ষকের কাজ করে। [পিতৃ-হৃদয়ে সন্তানের প্রতি স্নেহ সঞ্চার হইলে তাহা মানুষের মন কোমল এবং অপরের সন্তানের প্রতি মমতাশীল করে। অপত্যস্নেহ মানুষের হৃদয়ের কঠোরতা দূর করিয়া করুণা ও ক্ষমা গুণে তাহাকে মহত্তর করে। কিন্তু ধনীদের মধ্যে কদাচিৎ এইরূপ ঘটে কেননা সন্তানের লালন পালনের ভার তাহারা বেতনভূক পরিচারিকাদের হস্তে ছাড়িয়া দেয়। সন্তানকে নিজেদের স্নেহরসে পুষ্ট করিবার বা সন্তানের প্রতি বাৎসল্য-প্রীতি জাগ্রত করার ও প্রয়োগ করার তাহাদের অবসর কোথায়? কাজেই এইরূপ পরিবারের শিশুরা পিতৃত্বে উপনীত হওয়ার পরও যে ধ্বংসমনোবৃত্তি পরিত্যাগ করিবে সেইরূপ আশা নাই। বাল্যকাল হইতেই জীবনের মূল্যবোধ এবং জীবনের প্রতি দরদ সঞ্চার করিয়া শিশুর মন হইতে নিষ্ঠুরতা দূর করিতে হইবে।

যে লেখকের বাড়িতে অশিক্ষিতা পরিচারিকা আছে তিনিই জানেন লেখার পাণ্ডুলিপি দিয়া আগুন জ্বালাইতে ইহারা কেমন উৎসাহী এবং তাহাদিগকে এইকাজ হইতে নিবৃত্ত করা কত কঠিন। এই লেখক যদি অন্য লেখকের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হন তবু তিনি এইরূপ কাজ করিবেন না, কেননা পাণ্ডুলিপির মূল্য তিনি জানেন। তেমনই যে বালকের নিজের বাগান আছে সে অন্যের ফুলের চারাগুলি মাড়াইবে না, যে বালক কোনো পশুপক্ষি পোষে তাহাকে জীবজন্তুর প্রতি সদয় ব্যবহার করিতে শিখানো যায়। নিজের সন্তানের প্রতি যাহার প্রীতি আছে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিও তাহার দরদ থাকা স্বাভাবিক। যাহাদিগকে সন্তান লালনপালন করিতে প্রত্যক্ষভাবে ঝামেলা পোহাইতে হয়, তাহাদের মধ্যে অপত্যস্নেহ প্রবল আকারে প্রকাশ পায়; যাহারা এই ঝামেলা এড়াইয়া চলে, তাহাদের অপত্যস্নেহ অসাড় হইয়া পড়ে এবং শুধু সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধে পর্যবসিত হয়। বাল্যাবস্থায় শিশুদের গঠনমূলক আবেগ অথবা সৃজন মনোবৃত্তির বিকাশ সাধিত হইলে তাহারা যখন পিতামাতাতে পরিণত হয় তখন তাহারাও সযত্নে সন্তানকে গড়িয়া তোলার চেস্টা করে। এইজন্যও শিশুর চরিত্রের এই দিকটিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক।

সৃজন কার্য বলিতে কেবল বস্তুগত কোনো জিনিস তৈয়ার করার কথাই বুঝাইতেছি না। অভিনয় এবং সমবেত-সংগীত ও সহযোগিতামূলক সৃজনকার্য, যদিও দৃশ্যত বস্তুর সাহায্যে কোনো কিছু প্রস্তুত করা হইল না। এইরূপ কাজ অনেক বালক-বালিকার পক্ষে আনন্দদায়ক। এইরূপ প্রীতিপ্রদ সৃজনকার্যে তাহাদিগকে উৎসাহ দেওয়া কর্তব্য কিন্তু জোর-জবরদস্তি করিবার প্রয়োজন নাই। যে-কাজে নিছক বুদ্ধিবৃত্তিই প্রধান সেইখানেও সৃজনাত্মক ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব থাকিতে পারে। প্রাচীন সাহিত্য-শিক্ষাকে একরকম দোষাগ্রাহী (Critical] বলা চলে। ছাত্র ভুল না করিতে এবং যাহারা ভুল করে তাহাদিগকে ঘৃণা করিতে শিক্ষা করে। ইহার ফলে নিজেদের শিক্ষণীয় বিষয়টুকু শুদ্ধভাবে শিখিবার ঝোঁক আসে এবং নূতনত্বের পরিবর্তে প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব বৃদ্ধি পায়। বিশুদ্ধ ল্যাটিন ভাষা একেবারেই স্থির হইয়া গিয়াছে–ভার্জিল এবং সিসরোর সাহিত্যই ইহার নিদর্শন; কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতি চিরদিনের মতো স্থির ও রুদ্ধ হইয়া যায় নাই। ইহা প্রতিনিয়তই আগাইয়া চলিয়াছে। যে কোনো সমর্থ যুবক ইহার অগ্রগতিতে সাহায্য করিতে পারে। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে যে মনোভাব গড়িয়া ওঠে তাহা মৃত ভাষা শিক্ষার ফলে উদ্ভূত মনোভাব হইতে বেশি গঠনমূলক। কেবল ভুল না করাই যেখানে শিক্ষার প্রধান কাম্য-লক্ষ্য সেখানে শিক্ষার মধ্যে সজীবতা থাকে না। সকল সুস্থ সবল কিশোর-কিশোরীকে নূতন উদ্যম প্রয়োগ করিয়া নূতন কিছু করিতে অনুপ্রাণিত করা উচিত; শুধু ভুল বাঁচাইয়া কোনরকমে গতানুগতিক পন্থায় চলার মধ্যে প্রাণের গতিবেগ ও নবসৃষ্টির উন্মাদনা নাই। প্রায় মনে করা হয় যে, উচ্চশিক্ষা মানুষকে ভদ্র আচরণ শিখায় মাত্র; যাহাতে সে। ব্যাকরণগত কোনো গুরুতর ভুল না করে সে সম্বন্ধে নেতিবাচক শিক্ষা দেয় মাত্র। এইরূপ শিক্ষায় গঠনকার্য বা সৃজন-প্রচেষ্টা উপেক্ষিত হইয়াছে। ইহার ফলে সৃষ্ট হয় সংকীর্ণচেতা, কর্মপ্রচেষ্টাবিমুখ এবং অনুদার লোক। কোনো কিছু গঠন করা এবং সৃষ্টি করাকেই যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করা হয় তবে এইরূপ কুফলের হাত হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইতে পারে।

শিক্ষার শেষ কয়েক বৎসরে সামাজিক গঠনের জন্য বিশেষ অনুপ্রেরণা দিতে হইবে। অর্থাৎ সমাজের বর্তমান শক্তিগুলিকে [Forces] অধিকতর ফলপ্রদভাবে প্রয়োগ করিতে কিংবা নূতন শক্তি সৃষ্টি করিতে বুদ্ধিমান যুবকদিগকে উৎসাহ দিতে হইবে। লোক প্লেটোর রিপাবলিক [Republic] পুস্তক পাঠ করে কিন্তু তাহারা বর্তমান রাজনীতিতে কোথাও তাহার নীতি প্রয়োগ করে না। আমি যখন বলিয়াছিলাম যে প্লেটোর রিপাবলিকের যাহা আদর্শ প্রায় ঠিক সেই আদর্শ ছিল ১৯২০ সনে রুশ রাষ্ট্রের, তখন প্লেটোর সমর্থকগণ কিংবা বলশেভিকগণ কোন দল যে বেশি বিস্মিত হইয়াছিল তাহা বলা শক্ত। লোকে যখন প্রাচীন সাহিত্য পাঠ করে তখন চিন্তা করিয়া দেখে না তখনকার অবস্থা রাম, শ্যাম, যদুর জীবনে কতখানি প্রযোজ্য কোনো লেখক যখন রামরাজ্যের চিত্র পাঠকের সম্মুখে তুলিয়া ধরে তখন সে বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে; কেননা বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা হইতে রামরাজ্যে উপনীত হইবার কোনো পথের হদিশ সেরূপ পুস্তকে থাকে না। সমাজ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য কি পন্থা অবলম্বন করা দরকার তাহা বিচারবুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ উদারনীতিকদের এই গুণ ছিল, যদিও তাঁহাদের কাজের শেষ পরিণতি দেখিলে তাহারা স্তম্ভিতই হইতেন।

.

সমাজ-ব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা

ছাঁচ :

মানুষ যখন কিছু গঠন করিতে বা পুরাতনের সংস্কার সাধন করিতে চায় তখন তাহার কাম্য বিষয়ের যে আকৃতি বা রূপ তাহার মনের পটে স্পষ্টভাবে অঙ্কিত থাকে তাহা অনেক সময় অজ্ঞাতসারে তাহার চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যাহা আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করেন অনেক দিনের মনন, কল্পনা, অনুরাগ, যুক্তি ও অনুভূতির রঙে রঞ্জিত হওয়ায় তাহা তাঁহাদের মনে স্পষ্ট আকার লাভ করে। তাহারে মনে যে আদর্শ বিশেষ করিয়া আকার গ্রহণ করিয়াছে। পরিকল্পনার সাহায্যে তাহারই বাস্তবরূপ তাহারা সমাজে গড়িয়া তুলিতে চান। সমাজ-ব্যবস্থা গঠনের প্রণালী অনেকভাবে চিন্তা করা যায় এবং সাধারণত ইহাকে তুলনা করা যায় ছাঁচ যন্ত্র এবং গাছের সঙ্গে। ছাঁচে ঢালা সমাজ-ব্যবস্থা বলিতে এমন সমাজ বোঝায় যেখানে কঠোর সামাজিক নিয়মকানুন অচলায়তনের মতো দেশের বুকে চাপিয়া আছে, যেমন ছিল প্রাচীন স্পার্টায় এবং চীনদেশে, যেখানে সমাজবিধি এবং সংস্কারের ছাঁচে ঢালিয়া সকল মানুষকে একই মানসিক আকার দিবার চেষ্টা করা হইত। কঠোর নৈতিক ও সামাজিক রাজনীতির মধ্যে এই ধারণা কিছুটা বিদ্যমান রহিয়াছে। এইরূপ ছাঁচে ঢালা সমাজ-ব্যবস্থা যাহার আদর্শ, তাহার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হয় শক্ত, অনমিত, কঠোর এবং অত্যাচারী।

যন্ত্র :

যে ব্যক্তি সমাজকে একটি যন্ত্র বলিয়া মনে করে তাহাকে অনেকটা আধুনিক বলা চলে। শিল্পপতি এবং কমিউনিস্ট এই শ্রেণিতে পড়ে। তাহাদের নিকট মানব স্বভাব নীরস এবং আকর্ষণবিহীন; মানবজীবনের উদ্দেশ্যও অতি সরল বলিয়া বোধ হয়। তাহারা মনে করে দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধিই মানুষের একমাত্র কাম্য। এই সহজ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করাই তাহাদের সমাজ সংগঠনের লক্ষ্য। কিন্তু অসুবিধা হইল এই যে, সংগঠকগণ যাহা সাধারণ মানুষের বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে করেন লোকে তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি জিনিস পাওয়ার কামনা করে। সংগঠকগণ পরিকল্পনা করিয়া নির্ধারণ করেন। কি কি জিনিস পাইলেই মানুষের সন্তুষ্ট থাকা উচিত; তাহাদের পরিকল্পনা মতো দ্রব্যের উৎপাদন বাড়াইয়া লোকের অভাব পূরণ করা এবং সকলকে সুখি করাই ইহাদের উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষের বাসনার অন্ত নাই। নূতন সমাজ সংগঠকের তালিকাভুক্ত জিনিস পাইয়া লোকে সন্তুষ্ট হয় না। ইহার ফলে সংগঠককে বাধ্য হইয়া এমন ছাঁচে ঢালা সমাজ গড়িতে চেষ্টা করিতে হয় যেখানে সকলেই তাঁহার আদর্শকে মানিয়া লইয়া তিনি যাহা ভালো মনে করেন তাহাই সানন্দে গ্রহণ করিবে। এই প্রচেষ্টাকে বলা যায় সোজা খাপে বাঁকা তলোয়ার ভরার কসরৎ। ইহা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি করে এবং অবশেষে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করে।

বৃক্ষ :

সমাজ-ব্যবস্থাকে যিনি একটি বৃক্ষের মতো মনে করেন তাঁহার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যের সঙ্গে পার্থক্য থাকে। একটি খারাপ যন্ত্র ভাঙিয়া ফেলিয়া তাহার পরিবর্তে নূতন যন্ত্র স্থাপন করা যায়। কিন্তু একটি গাছ কাটিয়া ফেলিলে সেইরূপ আকার ও শক্তিসম্পন্ন একটি নূতন গাছ জন্মিতে অনেক সময় লাগিবে; যন্ত্র বা ছাঁচ নির্মাতার ইচ্ছামতো তৈয়ার করা যায় কিন্তু বৃক্ষের নিজস্ব স্বভাব আছে। যত্ন পরিচর্যায় সেই নির্দিষ্ট স্বভাবই বিকশিত হইয়া ওঠে। যে-জাতীয় গাছ তাহার বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিয়া ইহাদের বৃদ্ধি কম বেশি করা যায় এইমাত্র; এক জাতীয় গাছকে অন্য জাতীয় গাছে পরিণত করা যায় না। জীবন্ত জিনিস গড়িয়া তোলা আর যন্ত্র তৈয়ার করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। জীবন্ত জিনিস গড়িতে কৌশলের প্রয়োজন বেশি নয়; ইহার জন্য এক প্রকার সহানুভূতির প্রয়োজন। এইজন্য শিশুদিগকে গঠন-কার্য শিক্ষা দিবার সময় কেবল ইট, কাঠ ও যন্ত্রের উপর তাহাদের গঠন-ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে শিখাইলেই চলিবে না, তাজা গাছ, পোষা পশু-পক্ষীর প্রতি যত্ন ও সমবেদনার মনোভাবও গড়িয়া তুলিতে হইবে। নিউটনের সময় হইতে জড়বিজ্ঞান মানুষের মন অধিকার করিয়াছিল, শিল্প বিপ্লবের সময় হইতে ইহার বাস্তব প্রয়োগ চলিতেছে। যন্ত্রশিল্পের উন্নতি ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রতিও যন্ত্রসুলভ মনোভাব ক্রমে বৃদ্ধি পাইয়াছে। জীবের ক্রমবিবর্তনবাদ কতকগুলি নূতন ভাবধারার প্রবর্তন করিয়াছিল কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে এইগুলি কতকটা ম্লান হইয়া পড়ে; সুপ্রজনন, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং শিক্ষা দ্বারা ইহার বিলোপ সাধন করা আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সমাজকে বৃক্ষরূপে কল্পনা করা ছাঁচ কিংবা যন্ত্ররূপে কল্পনা করার চেয়ে ভালো কিন্তু ইহাও দোষমুক্ত নয়। মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে লইয়া এই দোষ-ক্রটি দূর করিতে হইবে।

মনোবিজ্ঞানমূলক সংগঠন :

মনোবিজ্ঞানমূলক গঠন (Psychological Constructiveness] নূতন এবং সম্পূর্ণ অভিনব ধরনের। এ পর্যন্ত ইহার বৈশিষ্ট্য এবং উপকারিতা লোকে উপলব্ধি করিতে পারে নাই। শিক্ষাপ্রণালী, রাজনীতি ও সকল মানবীয় ব্যাপারে ইহার একান্ত প্রয়োজন এবং নাগরিক যাহাতে মিথ্যা সাদৃশ্য দেখিয়া বিভ্রান্ত না হয় সেইজন্য তাহাদের কল্পনাক্ষেত্রে ইহাকে একটি বিশেষ স্থান দিতে হইবে। কতক লোক মানুষের ব্যাপারে কোনও কিছু গঠন করিতে ভয় পান; তাহাদের আশঙ্কা আছে তাহাদের মানুষকে প্রাণহীন যন্ত্রে পরিণত করিয়া ফেলেন; মানুষের স্বভাবের উপরই তাঁহারা নির্ভর করেন।

অতএব অরাজকতা এবং তাহার ফলে মানুষের পুনরায় পশুত্বে প্রত্যাবর্তন [Back to nature] ইহার উপরই তাঁহাদের বিশ্বাস। মনোবিজ্ঞানমূলক গঠন ও যন্ত্রের গঠনের মধ্যে কি পার্থক্য তাহা এই পুস্তকে স্কুল উদাহরণ সাহায্যে দেখাইতে চেষ্টা করিতেছি। উচ্চশিক্ষায় এইভাবের কল্পনা-উদ্রেককারী দিকটার সহিত বিদ্যার্থীর পরিচয় ঘটাইতে হইবে। এইরূপ করিতে পারিলে আমার বিশ্বাস এই যে, আমাদের রাজনীতি আর এমন তীব্র ও ধ্বংসমুখি থাকিবে না; ইহার পরিবর্তে রাজনীতি হইবে নমনীয় এবং বিজ্ঞানসম্মত, আর উৎকৃষ্ট নরনারী প্রস্তুত করাই হইবে ইহার উদ্দেশ্য।

০৭. স্বার্থপরতা ও সম্পত্তি

পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে ভয় সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে, বর্তমান অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়টিও ভয়ের মতোই প্রবল আবেগসঞ্জাত, আংশিকভাবে প্রবৃত্তি হইতে উৎপন্ন এবং বিশেষভাবে অবাঞ্ছনীয়। এই রকম ক্ষেত্রে শিশুর স্বভাবকে হঠাৎ বাধা দিয়া সংশোধনের চেষ্টা বা তাহাকে মনোমতোভাবে চালাইবার চেষ্টা করা কখনই উচিত হইবে না। শিশুর স্বভাব এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে উদাসীন থাকায় কোনো লাভ নাই কিংবা শিশুর প্রকৃতি যদি অনুরূপ হইত তবে ভালো হইত মনে মনে কেবল এরূপ আশা করিয়াও কোনো উপকার হইবে না। শিশুকে তাহার স্বভাব ও প্রকৃতিজাত আবেগসহ কাঁচামালরূপে [Raw material] গ্রহণ করিতে হইবে। তারপর উপযুক্ত শিক্ষার ভিতর দিয়া এমনভাবে তাহার প্রবৃত্তিগুলির বিকাশ ঘটাইতে হইবে যাহাতে বাঞ্ছনীয় আচরণগুলি তাহার জীবনে অভ্যস্ত হইয়া যায়।

স্বার্থপরতা : যতই বিশ্লেষণ করা যায় ততই ইহা অস্পষ্ট হইতে থাকে। কিন্তু শৈশবে শিশুর জীবনে ইহা সুস্পষ্ট আকারে প্রকাশ পায়; এবং ইহার ফলে যে সমস্যার উদ্ভব হয় তাহার সমাধান একান্ত আবশ্যক। কোনোরূপ শিক্ষা না দিলে একজন শিশু তাহার অপেক্ষা কম বয়সীর খেলনা কাড়িয়া লইবে, নিজের ভাগ অপেক্ষা বেশি দাবি করিবে এবং তাহার কমবয়সী নিরাশ হউক আর নাই হউক সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করিয়া নিজের বাসনা পূর্ণ করিতেই চেষ্টা করিবে। বাহিরের চাপে যদি নিয়ন্ত্রিত ও সংযত না হয় তবে গ্যাসের মতো মানুষের সাহসিকতাও ক্রমেই বিস্তার লাভ করে। এ ব্যাপারে শিক্ষার উদ্দেশ্য হইল মানুষের ক্রমবর্ধমান স্বার্থপরতাকে সংযত করিবার জন্য বাহিরের চাপ প্রয়োগ করা; এ চাপ শিশুকে কিল, চড় বা অন্য শাস্তিদান নয়, শিশুর মনে সহানুভূতি, ভাল ভাব ও সদভ্যাস গড়িয়া তোলা। শিশুর মনে ন্যায় বিচারের ভাবটি দৃঢ় করিতে হইবে, আত্মত্যাগের ভাব নয়। সংসারে প্রত্যেক লোকেরই কিছু স্থানের উপর অধিকার আছে; সে যদি তাহার নিজের প্রাপ্য অধিকারের জন্য দণ্ডায়মান হয় তবে তাহাকে দোষ দেওয়া উচিত নয়। যখন স্বার্থত্যাগ শিক্ষা দেওয়া হয় তখন হয়তো (শিক্ষাদাতার) উপদেষ্টার মনে এই ধারণা বিদ্যমান থাকে যে, ইহা পুরাপুরি মাত্রায় অনুসরণ করা হইবে না; কাজেই বাস্তব ফল প্রায় ঠিকই হইবে অর্থাৎ ন্যায়সঙ্গতভাবে যেটুকু তাহার প্রাপ্য তাহার দাবি সে ছাড়িবে না। কিন্তু কার্যত লোকে এরূপ উপদেশ গ্রহণ করিতে পারে না কিংবা নিজেদের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করিতেও মনে মনে পাপ ও সঙ্কোচ বোধ করে, আর না হয় হাস্যকরভাবে আত্মত্যাগের চরম নিদর্শন দেখায়। যদি কেহ নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকার পর্যন্ত ত্যাগ করে তবে যাহার জন্য ত্যাগ করা হইল ত্যাগীর মনে তাহার প্রতি ক্ষীণ আক্রোশ লুক্কায়িত থাকে; স্বার্থপরতা কৃতজ্ঞতা লাভের বাসনার ছদ্মবেশে তাহাদের মনে মনের পিছন-দরজা দিয়া প্রবেশ করে। যাহাই হোক আত্মত্যাগ সত্য নীতি বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না, কেননা ইহাকে সর্বজনীন করা সম্ভবপর নয়। যাহা সত্য নয় তাহাকে গুণের উপায় হিসাবে শিক্ষা দেওয়া কখনোই সমীচীন নয়, কারণ মিথ্যা ধরা পড়িলেই গুণও কর্পূরের মতো উবিয়া যায়। পক্ষান্তের ন্যায়বিচার সকলের পক্ষে সমানভাবে প্রযোজ্য; ইহা সর্বজনীন। কাজেই শিশুর অভ্যাসে ও চিন্তায় আমাদিগকে ন্যায়ের ধারণা অনুপ্রবেশ করাইতে হইবে।

ন্যায়বিচার শিখানো : সঙ্গিনীর শিশুকে ন্যায়বিচার শিখানো অসম্ভব না হইলেও কঠিন। বয়স্ক ব্যক্তির অধিকার ও বাসনা এবং শিশুর আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে এত বেশি পার্থক্য যে, এগুলি শিশুর মনে কোনো সাড়া জাগায় না। একই প্রকার আনন্দলাভের জন্য উভয়ের মধ্যে কোনোরূপ সাক্ষাৎ প্রতিযোগিতাও নাই; অধিকন্তু বয়স্ক লোকেরা জোর করিয়া অন্যকে দিয়া তাহাদের দাবি পূরণ করাইতে পারে, কাজেই তাহাদের বিচারক তাহারা নিজেরাই। তাহাদের স্বার্থের সঙ্গে শিশুর স্বার্থের দ্বন্দ্ব রাখিলে শিশুরা নিরপেক্ষ লোকের নিকট হইতে ন্যায়বিচার পাইল বলিয়া ধারণা করিতে পারে না। বয়স্ক লোকেরা শিশুদের আচরণ সম্বন্ধে উপদেশ দিতে পারে, যেমন মা যখন কিছু গুনিতেছেন তখন মাঝখানে বাধা দিয়ো না, বাবা, যখন কাজ করেন তখন চিৎকার করো না, যখন বাড়িতে আগন্তুক আসে তখন কিছুর জন্য বায়না ধরো না ইত্যাদি। শিশুরা যদি অন্য সময় সদয় ব্যবহার পায় তবে উপদেশ মানিয়া লইয়া সংযত আচরণ করে কিন্তু ইহার যুক্তিযুক্ততা তাহারা বুঝিতে পারে না। শিশুদিগকে এরূপ নিয়ম মানিতে বাধ্য করা উচিত, কেননা তাহাদিগকে যথেচ্ছাচারী হইতে দেওয়া সঙ্গত। ইহা ছাড়া তাহাদিগকে ইহাও বুঝিতে হইবে যে অন্যলোকের কাছে তাহাদের কাজের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। কিন্তু এরূপ শিক্ষার ফলে শিশুদের নিকট হইতে বাহিরে-দেখানো ভদ্র আচরণ ছাড়া আর কিছু আশা করা যাইবে না; যখন শিশুর সমবয়সী অন্য বালক-বালিকা থাকে কেবল তখনই তাহার মনে ন্যায়বিচার সম্বন্ধে যথার্থ ধারণা জন্মানো যায়। শিশুকে বহুদিন একাকী সাথীবিহীন অবস্থায় না রাখার পক্ষে ইহা একটি যুক্তি বটে। যে দম্পত্তির একটিমাত্র সন্তান তাহাদিগকে মাঝে মাঝে শিশুর জন্য সঙ্গীর ব্যবস্থা করিতে হইবে। ইহার জন্য শিশুকে সাময়িকভাবে কাছছাড়া করিতে হইলে তাহা করা উচিত। নিঃসঙ্গ শিশুর বাসনাগুলি বয়স্ক ব্যক্তির হাতে নিগৃহীত, দমিত হয়, অথবা সে স্বার্থপর হইয়া বাড়িয়া উঠে।

কোনো পরিবারের একমাত্র শিশু যদি দ্র আচরণে অভ্যস্ত হয় তবে সে হয় অনুকম্পার পাত্র, আর যদি অভদ্র ব্যবহার শেখে তবে হয় বিরক্তিজনক। সমবয়সীদের সঙ্গলাভে বঞ্চিত হইলে শিশুর মনের অনেকগুলি গুণ পরিপূর্ণভাবে বিকাশের সুযোগ পায় না। সঙ্গীবিহীন শিশু সর্বদা বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকিলে তাঁহাদের উপদেশ পালন করিতে শেখে বটে কিন্তু সেইরূপ জোর করিয়া চাপানো আচরণ তাহার কাছে প্রীতিপ্রদ হইতে পারে না। নিরূপায় হইয়া সে প্রাণহীনভাবে কতকগুলি বাঁধাধরা ভদ্র আচরণ পালন করে। তাই সে কৃপার পাত্র। পক্ষান্তরে পিতামাতার অতিরিক্ত আদর যত্ন লাভ করিয়া শিশু যদি আত্মসর্বস্ব, স্বার্থপর, আবদারের হইয়া ওঠে তবে তাহার আচরণ অন্যের বিরক্তি উৎপাদন করে।

বর্তমানে ছোট পরিবারের সংখ্যাই বেশি; এজন্য অনেক পরিবারে শিশুর শিক্ষায় এই দিকটি সমস্যা সৃষ্টি করে। নার্সারি স্কুল এরূপ ক্ষেত্রে উপকারে আসে। সেখানে সমবয়সী শিশুদের পরস্পর মিলিয়া খেলা করিবার সুযোগ শিশুর জীবন গঠনে বিশেষ কাজে লাগে। এ সম্বন্ধে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে। বর্তমানে শিশুর স্বার্থপরতা কিভাবে দূর করা যায় তাহা আলোচনা করিবার সময় ধরিয়া লওয়া হইতেছে যে, পরিবারের অন্তত দুইটি প্রায় সমবয়সী শিশু আছে; তাহাদের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না হওয়ায় তাহাদের রুচিও প্রায় একইরূপ হইবে।

যেখানে খেলনা আছে মাত্র একটি অথবা খেলার আনন্দ একেবারে মাত্র একজন করিয়া উপভোগ করিতে পারে; যেমন ঘোট ঠেলাগাড়িতে চড়া, সেখানের শিশু সহজেই ন্যায়বিচার বুঝিতে পারে। অবশ্য প্রথমে সে অন্যকে বাদ দিয়া নিজেই সবটা আনন্দভোগ করিতে চায় কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তিরা যখন নিয়ম করিয়া দেন একজনের পর আর একজন পরপর সকলেই আনন্দ ভোগ করিবে, তখন শিশু তৎক্ষণাৎ রাজি হয়। ন্যায়বিচার বোধ যে শিশুর সহজাত তাহা মনে করিবার কোনো কারণ নাই। তবে কত শীঘ্র এ বোধ সৃষ্টি করা যায় তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। বিচার অবশ্য প্রকৃতই ন্যায় বিচার হওয়া চাই, কোনো একজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকিলে চলিবে না। আপনি যদি কোনো শিশুকে অপরের অপেক্ষা বেশি ভালোবাসেন, লক্ষ্য রাখিবেন তাহাদিগকে আনন্দ দিবার সময় আপনার আচরণে যেন পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ না পায়। এটা সর্বসম্মত নীতি যে একই বাড়ির শিশুদের খেলনা সমান হওয়ার দরকার।

ন্যায় বিচার ও নীতি উপদেশ : শিশু যখন ন্যায় বিচার দাবি করে তখন শুধু নীতি উপদেশে ভুলাইয়া রাখিলে কোনো ফল হইবে না। ন্যায়সঙ্গতভাবে যেটুকু তাহার প্রাপ্য তাহার তুলনায় বেশি দিবেন না কিন্তু ইহাও আশা করিবেন না যে, সে কিছু কম লইয়াই সন্তুষ্ট থাকুক। The Fair Child Family পুস্তকে অন্তরের গুপ্ত পাপ [The Secret Sins of the Heart] শীর্ষক একটি অধ্যায় আছে, যে যে প্রণালী বর্জন করা উচিত এখানে তাহার উল্লেখ আছে। লুসি জানে সে ভাল মেয়ে কিন্তু তাহার মা তাহাকে বলেন যে, তাহার আচরণ দৃশ্যত ভাল হইলেও তাহার চিন্তাগুলি খারাপ। তিনি বাইবেল হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলেনঃ হৃদয় সবচেয়ে বেশি প্রবঞ্চনাপূর্ণ এবং ভীষণ পাপে ভরা শ্ৰীমতী Fairchild তাঁহার মেয়ে লুসিকে একখানি ছোট খাতা দিলেন, তাহার বাইরের আচরণ যখন ভালো, তখন হৃদয়ে যে পাপ উঁকিঝুঁকি মারে তাই এই খাতায় লিখিয়া রাখিতে হইবে। একদিন প্রাতভোজনের সময় লুসির পিতামাতা তাহার বোনকে একটি ফিতা এবং তাহার ছোট ভাইকে চেরি ফুল দিলেন কিন্তু তাহাকে কিছুই দেওয়া হইল না। এই বিষয়ে লুসি তাহার খাতায় লিখিয়া রাখিল আমার মা-বাবা আমার অপেক্ষা ছোট ভাইবোনকে বেশি ভালোবাসে এই পাপচিন্তা আমার মনে উদয় হইয়াছিল। তাহাকে শিখানো হইয়াছিল এবং সে বিশ্বাসও করিত যে, নৈতিক-মানসিক শাসন দ্বারা এই পাপচিন্তা দূর করিতে হইবে। কিন্তু এইরূপ করিলে মনের স্বাভাবিক বাসনাকে শুধু দাবাইয়া রাখা হইবে এবং পরবর্তিকালে এই নিগৃহীত বাসনাই নূতন ও বিকৃত আকারে আত্মপ্রকাশ করিবে। এ ব্যাপারে প্রকৃত পন্থা ছিল–লুসির পক্ষে তাহার মনের কথা প্রকাশ করা এবং তাহার পিতা-মাতার পক্ষে উচিত ছিল লুসিকে কোনো উপহার দিয়া অথবা তখন দিবার মতো অন্য কোনো কিছু না থাকায় দেওয়া গেল না, পরে তাহাকেও দেওয়া হইবে ইহা বুঝাইয়া তাহার পিতামাতার ন্যায় বিচার ও পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে যে সন্দেহ জাগিয়াছিল তাহা নিরসন করা। সত্য কথা খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করিলে তাহা সন্দেহ দূর করে কিন্তু শুষ্ক নৈতিক উপদেশ দিয়া ও শাসন করিয়া ইহা দমন করিতে গেলে ইহাকে শুধু বাড়াইয়া দেওয়া হয়। সম্পত্তি বোধ :

ন্যায় বিচারের সহিত আরও একটি বিষয়ের নিবিড় সম্বন্ধ আছে; ইহা হইল সম্পত্তি বোধ অর্থাৎ কোনো জিনিস নিজের অধিকারে রাখিবার আত্মপ্রসাদ। এই মনোভাবটির ভালো এবং মন্দ উভয় দিকই আছে। কাজেই ইহাকে অতিরিক্ত উৎসাহ দিলে যেমন ক্ষতিকর হইতে পারে, শাসন দ্বারা দাবাইয়া রাখিলেও তেমনি শিশুর সুস্থ আত্মবিকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি করিতে পারে। এ সম্পর্কে শিশুর সঙ্গে কিরূপ আচরণ করিতে হইবে তাহার বাধা-ধরা নিয়ম ঠিক করিয়া দেওয়া যায় না। শিশুর প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝিয়া কিরূপ আচরণ করা সঙ্গত তাহা নির্ণয় করিতে হইবে। তবে এরূপ ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত।

শিশুর সম্পত্তি-প্রীতি যদি খুব বেশি হয় তবে পরবর্তী জীবনে ইহা হইতে অনেক দুর্বিপাকের সৃষ্টি হইতে পারে; পৃথিবীতে যত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতা অনুষ্ঠিত হয়, যত মতবাদ, কলহ ও দ্বন্দ্ব মানবসমাজকে আলোড়িত করে তাহার অন্যতম কারণ মূল্যবান সম্পত্তি হারানোর ভয়। কাজেই যতদূর সম্ভব নরনারী যাহাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর ভীতি না করিয়া সুখি হইতে পারে এইরূপ মনোভাব গড়িয়া তোলাই বাঞ্ছনীয়, অর্থাৎ কেবল নিজেদের সম্পত্তির রক্ষামূলক কাজে লিপ্ত না থাকিয়া তাহারা যাহাতে সৃজনাত্মক কাজে আনন্দ পাইতে পারে এইরূপ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এইজন্য শিশুদের সম্পত্তির অধিকার-বোধ উগ্রভাবে বাড়িতে না দেওয়া ভাল। তবে এই সম্বন্ধে মনে রাখিতে হইবে যে, কোনো জিনিসের অধিকার পাইবার বাসনা শিশুর জীবনে অত্যন্ত প্রবল থাকে। শিশু যখন দৃষ্ট জিনিস ধরিতে পারে, যখন তাহার হস্ত ও চক্ষুর মধ্যে সামঞ্জস্য সাধিত হয় তখন হইতেই এই অধিকার লাভের বাসনা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। যাহা সে হস্তে চাপিয়া ধরে তাহাই সে নিজের মনে করে এবং কাড়িয়া লইলে রাগান্বিত হয়। শিশুর যদি খেলনা না থাকে তবে সে ভাঙা কাঠি, ইটের টুকরা এবং এইটা সেইটা কুড়াইয়া আনিলে নিজের সম্পত্তি বলিয়া জমাইয়া রাখিবে। জিনিস থাকিলে শিশু তাহার যত্ন লইতে শেখে এবং ধ্বংস করা মনোবৃত্তি কমিয়া যায়। শিশু নিজে যাহা নিজের জন্য তৈয়ার করিয়া লয় তপ্রতি তাহার মমতা ও গর্ববোধ খুব বেশি। সম্পত্তির উপর অধিকার-বোধ জন্মিতে না দিলে শিশুর গঠন করার আবেগ আহত করা হয়।

পূর্বে বলা হইয়াছে যে শিশুর সম্পত্তির উপর অধিকার-বোধের অপকারিতা আছে, উপকারিতাও আছে। ইহাকে উৎসাহ দিয়া বৃদ্ধি করা যেমন ক্ষতিকর, দমন করাও তেমনি অপকারী। কি উপায়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করিয়া শিশুর সহিত আচরণ করা উচিত তাহা আলোচনা করা যাক।

খেলার মধ্যে কতক হইবে শিশুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, কতক হইবে সকলের সাধারণ সম্পত্তি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দোলনা, ঘোড়া সর্বদাই সাধারণ সম্পত্তি হইবে। ইহা হইতে একটি নীতি ঠিক করা যায় : যেখানে খেলনাটি ব্যবহার করিয়া সকলে আনন্দ পায় কিন্তু ব্যবহার করিতে হয় একে একে একজনের পর আর একজন পালা করিয়া সেখানে ইহা যদি বেশ বড় এবং দামি হয় তবে ইহাকে সাধারণ সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করা সঙ্গত। পক্ষান্তরে শিশুদের বয়সের কমবেশি হওয়ায় যদি কোনো খেলনা সকলের পক্ষে সমান আকর্ষণীয় না হয় তবে ইহা যাহাকে সবচেয়ে আনন্দ দেয় তাহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হইতে পারে। যদি কোনো খেলনা নাড়াচাড়া করিতে যত্নের প্রয়োজন হয় যাহা কেবল একটু বয়স্ক শিশুরাই করিতে পারে তবে ছোটদের হাতে দিয়া তাহা নষ্ট করিয়া ফেলা উচিত নয়। ছোট শিশুকে বরং তাহার বয়সের উপযোগী পুতুল বা খেলনা দিয়া তাহার অভাব পূরণ করা চলে। দুই বৎসর বয়সের পর শিশু যদি নিজের দোষে পুতুল ভাঙিয়া ফেলে তবে সঙ্গে সঙ্গে আবার নূতন খেলনা দিবেন না; খেলনার অভাব তাহাকে কিছুদিন বুঝিতে দিতে হইবে। শিশু যাহাতে তাহার খেলনা অন্য ছেলেকে খেলিতে দিতে সর্বদা অসম্মত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখিবেন। শিশুর যদি বেশি খেলনা থাকে তবে সে যেইগুলি ব্যবহার করে না, সেইগুলি অন্য শিশুর খেলার জন্য দিতে তাহাকে আপত্তি করিতে দিবেন না। তবে যে খেলনা অন্য শিশু হয়তো ভাঙিয়া ফেলিতে পারে কিংবা যে খেলনা দিয়া ইহার মালিক নূতন কিছু তৈয়ার করিয়াছে তাহা অন্যের হাতে না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়; যতদিন না সে তাহার সৃষ্টির কথা ভুলিয়া না যায় ততদিন তাহার পরিশ্রমের পুরস্কারস্বরূপ ইহা রাখা উচিত। এই ব্যতিক্রমটুকু মনে রাখিয়া শিশুর খেলার সরঞ্জাম দিয়া অন্য শিশুকে খেলিতে দিতে হইবে। শিশু হয়তো অনেক সময় স্বেচ্ছায় এইরূপ ভদ্র আচরণ করিবে না। সে ক্ষেত্রে কঠোর হওয়াই উচিত। শিশুর কোনো জিনিস অন্য কেহ হাতে লইলেই যে তৎক্ষণাৎ তাহার হাত হইতে তাহা কাড়িয়া লইবে এরূপ আচরণ কখনই বরদাস্ত করিবেন না। বয়স্ক শিশু যদি অপেক্ষাকৃত ছোট শিশুর প্রতি অসদয় ব্যবহার করে আপনিও তাহার প্রতি দ্রুপ ব্যবহার করুন এবং কেন আপনি ওইরূপ করিলেন তাহা সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে বুঝাইয়া দিন। এইরূপ আচরণ দ্বারা শিশুদের মধ্যে কিছুটা প্রীতির ভাব গড়িয়া তোলা যায়, যাহার ফলে তাহাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া ও কান্নাকাটি বন্ধ হইতে পারে। সময় সময় কিছুটা কঠোর হওয়ার এবং মৃদু শাস্তিদানের প্রয়োজনও হইতে পারে। কিন্তু কোনোক্রমেই দুর্বলের উপর অত্যাচার করার অভ্যাস গড়িয়া উঠতে দেওয়া সঙ্গত হইবে না।

সাধারণ সম্পত্তি : শিশুর নিকট প্রিয় কতকগুলি খেলনা তাহার নিজস্ব সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করিতে হইবে, আর যে খেলনাগুলি অন্যকেও ব্যবহার করিতে দেওয়া চলে সেইগুলির সম্বন্ধে এইরূপ নিয়ম করিতে হয় : যে যখন ব্যবহার করিবে সেইগুলির উপর তখনকার জন্য সম্পূর্ণরূপে তাহারই অধিকার থাকিবে। মন্তেসরি খেলার সরঞ্জামগুলি বিদ্যালয়ের সকল শিশুর সাধারণ সম্পত্তি কিন্তু একজন যখন কোনো একটি ব্যবহার করে তখন আর কেহ সেটি দাবি করিয়া তাহার খেলায় বাধা দেয় না। এইরূপ ব্যবস্থার ফলে শিশুর মনে ধারণা জন্মে যে, যতক্ষণ যে কোনো দ্রব্য ব্যবহার করিবে ততক্ষণ সেইগুলির মালিক সে নিজে। কাজই হইল তাহার মালিকানা-স্বত্বের ভিত্তি। পরবর্তিকালের কর্মপ্রণালী ও মনোভাবের সঙ্গে এ সময়কার মনোভাবের কোনো বিরোধ নাই।

অত্যন্ত কচি শিশুর পক্ষে এইরূপ ব্যবস্থা প্রয়োগ করা যায় না, কেননা তখনও তাহাদের গঠন ক্ষমতা প্রকাশ পায় নাই। ক্রমে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে ইহা প্রবর্তন করা উচিত। যখন তাহারা বুঝিতে পারে যে তাহাদের খেলিতে ইচ্ছা হইলেই খেলার সরঞ্জাম ফিরিয়া পাইবে তখন তাহাদের অন্যকে ব্যবহার করিতে দিতে বিশেষ আপত্তি থাকে না, থাকিলেও রীতি মানিয়া চলার ফলে ক্রমে তাহা দূর হয়।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি : তথাপি শিশুর বয়স কিছু বেশি হইলেই তাহাকে কিছু বই দেওয়া উচিত; এইগুলি হইবে তাহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পুস্তক প্রীতি তাহার পড়ার বাসনা উদ্রেক করিবে। তবে দেখিতে হইবে বইগুলি যেন প্রকৃতই ভালো বই হয়; তার শিশুরা যদি বাজে বই চায় তাহা বরং সকলের সাধারণ সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে।

মূলনীতি : স্বার্থপরতা এবং সম্পত্তি লাভের বাসনা দুই-ই শিশুর জীবনে সত্য এবং তাহার চরিত্রগঠনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে : পিতামাতাকে শিশুর প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করিয়া যত্নসহকারে এই উপযুক্ত আচরণ শিখাইতে হইবে। এই সম্পর্কে কয়েকটি মূলনীতি মনে রাখা আবশ্যক :

প্রথম, যথেষ্ট পরিমাণ খেলনা নাই বলিয়া শিশুর মনে যেন বিফলতা বা ব্যর্থতার ভাব জাগ্রত না হয়। এই ভাব বদ্ধমূল হইয়া গেলে শিশু পরবর্তিকালে হয় অনুদার, সংকীর্ণমনা, কৃপণ।

দ্বিতীয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি যখন শিশুর কতকগুলি সগুণ বিকাশ করে, বিশেষ করিয়া যখন তাহাকে নিজের জিনিসের প্রতি যত্ন লইতে শিখায়, তখন তাহাকে কিছু জিনিস ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে রাখিতে দিন। তবে লক্ষ্য রাখিবেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তিই যেন শিশুর আনন্দলাভের একমাত্র বা প্রধান উপায় না হয়।

০৮. সত্যবাদিতা

সত্য বলার অভ্যাস গঠন করা নৈতিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সত্য বলিতে সত্য কথা ও সত্য চিন্তা উভয়ই বুঝাইতেছি; বস্তুত এই দুইটির মধ্যে শেষোক্তটিই আমার কাছে বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়। মিথ্যাবাদীকে দুইটি পৃথক দলে ভাগ করা যায় : একদল লোক সজ্ঞানে মিথ্যা বলে অর্থাৎ তাহারা যে মিথ্যা কথা বলিতেছে তাহারা তাহা জানে; অপর দল প্রথমে মিথ্যা দ্বারা নিজেদের অচেতন মনকে বঞ্চনা করে তাহার পর কল্পনা করে যে তাহারা ধার্মিক ও সত্যবাদী। প্রথম দল মিথ্যাবাদী, দ্বিতীয় দল ভণ্ড কপটাচারী। এই দুই দলের মধ্যে যদি একদলকে বাছিয়া লইতে হয় তবে আমি প্রথম দলকে পছন্দ করিব। যাহারা সত্যভাবে চিন্তা করেন তাহারা মিথ্যা কথা বলা যে সর্বদাই অন্যায় তাহা বিশ্বাস করেন না। যাহারা এইরূপ মনে করেন, যাহারা কোনও অবস্থাতেই সত্যভাষণ হইতে বিরত হওয়ার পক্ষপাতী নন, তাঁহাদিগকে ধর্মাচার দ্বারা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করিয়া অনেক সময় নিজেদের অভিমতের পরিবর্তন করিতে হয়। ইহার ফলে মনকে ফাঁকি দিয়া নিজেদের মিথ্যাচার স্বীকার না করিলেও ক্ষেত্রবিশেষে তাঁহারা প্রকৃতই মিথ্যাচারী। তবে যেইরূপ ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদিতা সমর্থনযোগ্য সেইরূপ অবস্থা মানুষের জীবনে খুব কমই আছে। প্রায় সকল সময় দেখা যায় এইরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয় অত্যাচারী শক্তিমানের উদ্ধত অবিচারে অথবা যুদ্ধের ন্যায় কোনো দেশব্যাপী ব্যাপক বিপদের সময়ে। মানব-সমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটিলে এইরূপ অবস্থা কমই সংঘটিত হইবে।

প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভয় হইতে মিথ্যাবাদিতার উৎপত্তি। যে শিশু নিঃশঙ্কভাবে বাড়িয়া ওঠে সে কখনো মিথ্যা কথা বলে না; কোনোপ্রকার নৈতিক উপদেশ বা চেষ্টা ইহার কারণ নয়, প্রকৃত কারণ এই যে, মিথ্যা কথা বলার কোনো প্রয়োজন সে অনুভব করে না। যে শিশু গৃহে উপযুক্ত অভিভাবকের নিকট হইতে সদয় ব্যবহার লাভ করে তাহার চোখে ফুটিয়া উঠে সরলতার দীপ্তি এবং অপরিচিত লোকের সঙ্গেও তাহার আচরণ হয় নির্ভীক ও সঙ্কোচহীন। কিন্তু যে শিশু সর্বদা অত্যাচার এবং কঠোরতার মধ্যে লালিতপালিত হয়, শাস্তি পাওয়ার ভয়ে সে সর্বক্ষণ সঙ্কুচিত হইয়া থাকে, তাহার ভয় কখনো বা কি অন্যায় করিয়া ফেলে, সর্বদা ভীতি ও সঙ্কোচের মধ্যে থাকিতে হয় বলিয়া তাহার আচরণের স্বাভাবিকতা আসে না।

শিশু আপনা হইতে মিথ্যা কথা বলিতে শেখে না। মিথ্যা বলিয়া যে কিছু আছে এবং মিথ্যা কথা যে বলা যায় তাহা প্রথমে শিশুর ধারণায় আসে না। বয়স্কদের নিকট হইতে শিশু এ শিক্ষা পায়; ভয় ইহাকে দ্রুততর করে। শিশু বুঝিয়া ফেলে যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা তাহার নিকট মিথ্যা কথা বলে এবং তাহাদের নিকট সত্য কথা বলার বিপদ আছে; কাজেই সে মিথ্যা বলিতে শুরু করে। যে কারণগুলি শিশুকে মিথ্যাভাষণে উৎসাহ দেয় বা বাধ্য করে সেইগুলি দূর করুন, দেখিবেন সে মিথ্যা বলার চিন্তা তাহার মনেই আসিবে না।

মিথ্যাবাদিতা ও শিশুমনের বৈশিষ্ট্য : শিশু প্রকৃতই মিথ্যা কথা বলিতেছে কি না সে সম্বন্ধে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। শিশুদের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল, তাহারা অনেক সময় বয়স্কদের প্রশ্নের উত্তর কি হইবে তাহা জানে না কিন্তু বয়স্করা হয়তো মনে করেন তাহারা ঠিক জানে। শিশুদের সময় সম্পর্কে ধারণা খুবই অস্পষ্ট; চার বৎসরের কম বয়স্ক শিশুর কাছে গতকাল ও এক সপ্তাহ পূর্বের মধ্যে কিংবা গতকাল ও ছয় ঘণ্টা পূর্বের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। আপনার প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকিলে তাহারা আপনার প্রশ্ন করার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর অনুসারে হ্যাঁ কিংবা না বলিবে। আবার অনেক সময় কল্পনার আশ্রয়ে কোনো কিছু ভান করিয়াও তাহারা কথা বলে। তাহারা যখন বলে যে পিছনের বাগানে সিংহ আছে তখন এ ভান সহজেই বোঝা যায়; শিশু তখন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করিতেছে; সিংহ সম্বন্ধে সে শুনিয়াছে বা ছবি দেখিয়াছে; সিংহ গাছপালার মধ্যে থাকে তাহাও সে জানে না; কল্পনায় সিংহকে সে নিজের বাড়ির কাছেই আনিয়াছে মাত্র। এ ক্ষেত্রে শিশুর কথা কল্পনাপ্রসূত বলিয়া সহজেই বোঝা গেল; অনেক সময় তাহার কল্পনাপ্রণোদিত কথা ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। বাস্তবতার কষ্টিপাথরের এইগুলিকে মিথ্যা বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। বাস্তবতার কষ্টি পাথরের এইগুলিকে মিথ্যাভাষণ বলা যায় সত্য কিন্তু ইহাতে কাহাকেও বঞ্চনা করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য বক্তার নাই। বস্তুত বয়স্ক ব্যক্তিকে ঠকানো বা ফাঁকি দেওয়ার কোনো চিন্তাই শিশুদের মনে উঠিতে পারে না; তাহাদের নিকট বয়স্ক ব্যক্তিরা সর্বজ্ঞ; কাজেই তাহাদিগকে বঞ্চনা করা অসম্ভব। আমার পৌনে চার বছর বয়সের ছেলে শুধু গল্প শোনার আনন্দের জন্যই, আমি যখন বর্তমান ছিলাম না তখন তাহার কি হইয়াছিল সে সম্বন্ধে গল্প শুনিতে চায়। তাহার ধারণা তাহার পিতার অজানা কিছু নাই। তাহাকে বোঝানো কষ্ট যে তাহার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। শিশুরা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধির সঙ্গে বয়স্কদের জ্ঞানের তুলনা করিয়া এত পার্থক্য দেখে যে, বয়স্কদের জ্ঞানের যে সীমা আছে তাহা ধারণা। করিতে পারে না। গত ইস্টারের সময় ছেলেকে কতকগুলি চকোলেট দেওয়া হইয়াছিল। আমরা তাহাকে বলিয়াছিলাম বেশি খাইলে অসুখ করিবে; শুধু বলিয়াই ক্ষান্ত ছিলাম, চকোলেটগুলি তাহার কাছেই রাখা হইয়াছিল। বেশি খাইয়া সে অসুখে পড়িল। অসুখসারিলে সে একদিন হাস্যোজ্জ্বল, কতকটা বিজয়োৎফুল্ল কণ্ঠে বলিল : বাবা আমার অসুখ হয়েছিল–বাবা বলেছিলেন যে আমার অসুখ হবে। তাহার পিতার ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা পরীক্ষা করিয়া শিশু বিস্মিত হইয়াছিল। সে যেন পরীক্ষা দ্বারা কোনও বৈজ্ঞানিক নিয়মের সত্যতা প্রমাণ করিয়াছিল। ইহার পর হইতে তাহার হাতে অধিক পরিমাণে চকোলেট দিয়াও নিশ্চিন্ত হওয়া গিয়াছে। যদিও চকোলেট পাইত তবু কখনো লোভের বশে বেশি খাইয়া অসুখ সৃষ্টি করিত না। ইহা ছাড়া আরও একটি সুফল হইয়াছে এই যে তাহার খাদ্য সম্বন্ধে আমরা যাহা বলি তাহা সে একান্তভাবে বিশ্বাস করে। তাহার মনে এই ভাব জাগ্রত করার জন্য নৈতিক উপদেশ শাস্তি অথবা ভয়ের প্রয়োগ করিতে হয় নাই। প্রথম অবস্থায় শিশুর সঙ্গে আচরণে ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রয়োজন হইয়াছে। সে এমন এক বয়সে আসিয়া পৌঁছিতেছে, যখন সকল ছেলের পক্ষেই মিষ্টি খাবার চুরি করা এবং এ সম্বন্ধে মিথ্যা বলা স্বাভাবিক। আমার ছেলেও খাবার চুরি করিবে নিশ্চয় কিন্তু এ বিষয়ে মিথ্যা কথা বলিলে আমি বিস্মিত হইব। শিশু যখন মিথ্যা কথা বলে তখন তাহাকে ইহার জন্য দায়ী না করিয়া পিতামাতার নিজেদিগকেই দায়ী মনে করা উচিত। তাহাদের কর্তব্য হইবে–কি জন্য মিথ্যা কথা না বলা ভালো তাহা শান্তভাবে শিশুকে বুঝানো এবং যে যে কারণে শিশু মিথ্যা কথা বলিতে অভ্যস্ত হয় তাহা দূর করা। শাস্তি দিয়া মিথ্যা ভাষণ বন্ধ করার চেষ্টা ঠিক হইবে না, ইহার ফলে বরং তাহার ভয় বেশি হইবে এবং ভয় তাহার মিথ্যা ভাষণের প্রবণতা আরও বাড়াইয়া দিবে। আঘাত করিয়া আগুন নিভানো চেষ্টাই মতোই শাস্তিদিয়া মিথ্যা বলার অভ্যাস ত্যাগ করাইতে গেলে বিপরীত ফল ফলিবে।

শিশুদিগকে যদি মিথ্যা ভাষণ অভ্যাস করা হইতে বিরত রাখিতে চাহেন তবে তাহাদের সহিত ব্যবহারে বয়স্ক ব্যক্তিদের সত্যবাদিতা একান্তভাবে অপরিহার্য। যে পিতা-মাতা শিক্ষা দেন যে, মিথ্যা কথা বলা পাপ তাহাদের ছেলে-মেয়েরাই যদি তাহাদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়া জানে তবে সে পিতা-মাতার উপদেশ দিবার নৈতিক অধিকার থাকে না। সন্তান-সন্তুতির নিকট সত্যকথা বলার নীতিটা সম্পূর্ণ নূতন; বর্তমান প্রজাতির [Generation] পূর্বে বড় বিশেষ কেহ ইহা মানিয়া চলিতেন না; ইভ তাহার ছেলে Cain এবং Abel কে আপেলের সম্বন্ধে সত্য কথাটি বলিয়াছিলেন কি-না আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে; আমার বিশ্বাস তিনি বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার পক্ষে যাহা কল্যাণকর নয় এমন কোনও খাদ্য তিনি গ্রহণ করেন নাই। পিতামাতা সন্তানের নিকট নিজদিগকে সর্ব শক্তিসম্পন্ন, মানুষের স্বাভাবিক কাম, ক্রোধ প্রভৃতি রিপুর তাড়না হইতে মুক্ত এবং সর্বদা বিশুদ্ধ বিচারবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত বলিয়া জাহির করিতেন। শিশুদিগকে তিরস্কার করিবার সময় ক্রোধে অপেক্ষা দুঃখের ভাবই বেশি দেখাইতেন। যত গালমন্দই করুন না কেন তাহারা মেজাজ ঠিক রাখিয়া সন্তানদের মঙ্গলের জন্যই বলিতেছেন এরূপ ভাব দেখাইতেন। তাঁহারা বুঝিতেন না যে শিশুরা বিস্ময়করভাবে স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন; তাহারা ভাওতা বা ভণ্ডামির রাজনৈতিক কারণ বোঝে না কিন্তু ইহাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। আপনার যে হিংসা-বিদ্বেষ সম্বন্ধে আপনি নিজেই জানেন না তাহা শিশুদের নিকট সহজে ধরা পড়ে; ইহার পর আপনি হিংসা-বিদ্বেষের দোষ সম্বন্ধে শিশুদিগকে যতই উপদেশ দিন না কেন তাহারা কিছুই মানিবে না। কখনওই নিজেকে দোষত্রুটিশূন্য, অতিমানব বলিয়া ভান করিবেন না; ইহাতে শিশু আপনাকে বিশ্বাস করিবে না, পছন্দও করিবে না। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, অতি অল্প বয়সে আমি কেমন করিয়া আমার উপর প্রযুক্ত ভিক্টোরিয়া যুগের ভাওতা ভণ্ডামি বুঝিয়া ফেলিয়াছিলাম এবং প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে, আমার যদি কখনো সন্তান-সন্ততি হয় তবে তাহাদের প্রতি আচরণে এইরূপ ভুল করিব না। যথাসাধ্য আমি এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিয়া চলিতেছি।

বয়স্কের পক্ষে আর এক প্রকার মিথ্যা হইল–শিশুকে যে শাস্তি দেওয়া হইবে না, তাহার ভয় দেখানো। ডক্টর ব্যালার্ড তাঁহার চিত্তাকর্ষক পুস্তক [The Changing School] এই নীতি বিশেষ জোরের সঙ্গে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন : শাসাইবেন না। যদি শাস্তির ভয় দেখান তবে আপনাকে শাস্তি দিতেই হইবে। আপনি যদি ছেলেকে বলেন, আবার যদি এ কাজ করো তবে তোমাকে মেরে ফেলব এবং সে যদি সেই কাজ আবার করে তবে ছেলেকে হত্যা করিতেই হইবে। আপনি যদি তা না করেন, তবে ছেলে আপনার প্রতি সকল শ্রদ্ধা হারাইবেন। পরিচারিকা এবং অশিক্ষিত পিতা-মাতা শিশুদের সঙ্গে ব্যবহারে যে শাস্তির ভয় দেখায় তাহা হয়তো এমন চরম নয় কিন্তু এ ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য। বিশেষ যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকিলে শিশুকে দিয়া কোনও কিছু করাইবার জন্য জেদ করিবেন না কিন্তু একবার যদি জেদ শুরু করেন তবে (ফল যাহই হউক) শেষ পর্যন্ত আপনাকে ইহা বজায় রাখিতেই হইবে। যদি কোনও শাস্তির ভয় দেখান তবে আপনি যাহা প্রয়োগ করিতে প্রস্তুত আছেন সেইরূপ শাস্তির ভয় দেখাইবেন; আপনার শাস্তিদানের হুমকিতেই কাজ হইবে, বাস্তবিক শাস্তি দিতে হইবে না, এরূপ ধারণা করিবেন না। অশিক্ষিত জনসাধারণকে এই নীতি বুঝানো বড় কঠিন। পুলিশ লইয়া গিয়া আটকাইয়া রাখিবে; দৈত্য আসিয়া ধরিয়া লইয়া যাইবে, প্রভৃতি ধরনের অবাস্তব ভীতি প্রদর্শন বিশেষ আপত্তিজনক। ইহা প্রথমে শিশুর মনে নিদারুণ ভীতি সঞ্চার করে, পরে যখন বুঝিতে পারে যে সবই ভাঁওতা-মাত্র তখন বয়স্ক ব্যক্তিগণের কথা ও ধমকানির উপর তাহার আর কোনো আস্থা থাকিবে না। আপনি জেদ করিয়া শেষ পর্যন্ত শিশুকে আপনার মনোমতভাবে চলিতে বাধ্য না করান তবে সে শীঘ্ৰ বুঝিয়া ফেলিবে যে এইরূপ ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া নিষ্প্রয়োজন; সে বরং তৎক্ষণাৎ মুখে স্বীকার করিবে কিন্তু কার্যত কিছুই করিবে না। শাস্তির ভয় দেখাইয়া সংশোধন করিতে চাহিলে মনে রাখিতে হইবে যে বিশেষ উপযুক্ত কারণ না থাকিলে কখনওই শিশুকে ভয় দেখানো বা ধমকানো উচিত নয়।

আর এক ধরনের অবাঞ্ছনীয় ভাঁওতা হইল প্রাণহীন পদার্থের প্রতি জীবন্ত প্রাণীর মতো আচরণ করিতে শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু টেবিল বা চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়া আঘাত পাইলে তাহার পরিচারক পরিচারিকারা দুষ্ট টেবিল, দুষ্ট চেয়ার প্রভৃতি বলিয়া এইগুলিকে আঘাত করিতে শিখাইয়া দেয়। শিশুর আঘাত লাগার জন্য টেবিল বা চেয়ার যেন দায়ী এইরূপ ধারণা শিশুর মনে আনিয়া দেওয়া হইল। ইহার ফলে স্বাভাবিক উপায়ে শৃঙ্খলা বিধানের একটি অতি প্রয়োজনীয় সূত্র নষ্ট করিয়া ফেলা হয়। নিজের বুদ্ধিতেই শিশু অল্প দিনেই বুঝিতে পারে যে প্রাণহীন পদার্থের সঙ্গে রাগ খাটাইয়া বা তোষামোদ করিয়া কোনো লাভ নাই। এইগুলি নাড়াচাড়া করিতে নিজের শারীরিক পটুতা অর্জন করিতে হইবে। এই বোধ তাহাকে দৈহিক কৌশল বা পটুতা অর্জন করিতে উৎসাহ দেয় এবং শিশু নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতার সীমা কতদূর তাহা উপলব্ধি করিতে শেখে।

যৌন জীবন বা যৌন আচরণ সম্বন্ধে শিশুর নিকট মিথ্যা কথা বলা অনেক কালের রেওয়াজ হইয়া গিয়াছে। আমার কাছে ইহা অত্যন্ত অপকারী মনে হয়। পরবর্তী এক অধ্যায়ে যৌন শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে।

যদি রূঢ় আচরণ দ্বারা শিশুদের কৌতূহল দমিত না হয় তবে তাহারা অসংখ্য প্রশ্ন করিবে, কতক প্রশ্ন হইবে বুদ্ধির পরিচায়ক, কতক বা ইহার বিপরীত। প্রশ্নগুলি প্রায়ই বিরক্তিকর, কখনো বা অসুবিধাজনক। তথাপি আপনার সাধ্যানুসারে ইহাদের সদুত্তর দিতে হইবে। কিন্তু যদি ধর্ম সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করে তবে এ সম্বন্ধে আপনার নিজের যাহা অভিমত তাহাই বলুন; ইহাতে যদি অন্য ব্যক্তির সঙ্গে মতের পার্থক্য প্রকাশ পায় তাহাতেও কিছু আসে যায় না। সে যদি এমন প্রশ্ন করে যাহার উদ্দেশ্য আপনাকে দুষ্ট বা বোকা বলিয়া প্রতিপন্ন করা, তাহারও উত্তর দিন। সে যদি যুদ্ধ অথবা মৃত্যুদণ্ড সম্বন্ধে প্রশ্ন করে, উত্তর দিন। কতক প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জটিলতা জড়িত থাকে–যেমন- বৈদ্যুতিক আলো কেমন করিয়া উৎপন্ন করা হয় ইত্যাদি। এই ধরনের কঠিন প্রশ্ন ছাড়া অন্য প্রশ্নের উত্তরে তুমি এখন সব বুঝতে পারবে না বলিয়া শিশুকে থামাইয়া দিবেন না। যদি কখনো এরূপ উত্তর দিতে হয় তবে তাহাকে বুঝাইয়া দিবেন যে, প্রশ্নের উত্তরটি খুবই আনন্দদায়ক; তাহার জ্ঞান আরও কিছু বেশি হইলে তবে সে ইহার আনন্দ উপলব্ধি করিতে পারিবে। কোনো প্রশ্নের উত্তরে শিশুকে কিছু বলিবার সময় কম না বলিয়া সে যাহা বুঝিতে পারে তাহার চেয়েও কিছু বেশি বলিবেন; যেটুকু সে বুঝিতে পারিল না তাহা তাহার কৌতূহল ও জ্ঞানবুদ্ধির বাসনা জাগাইয়া তুলিবে।

শিশুর সঙ্গে যদি সর্বদা সকল অবস্থাতেই সত্য কথা বলা যায় তবে ইহার সুফলস্বরূপ তাহার আস্থা এবং শ্রদ্ধালাভ করা যায়। আপনি যাহা বলিলেন তাহা বিশ্বাস করার প্রবণতাই শিশুর বেশি থাকে যদি না আপনার কথা তাহার কোনো প্রবল বাসনার বিরুদ্ধে যায়, যেমন হইয়াছিল ইস্টারের সময় খোকার চকোলেট খাওয়ার ব্যাপারে। একথা একটু পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। আপনার মন্তব্যের সত্যতা পরীক্ষিত হইলে সহজেই আপনি শিশুর বিশ্বাস উৎপাদন করিতে পারিবে। কিন্তু আপনি যদি মিথ্যা শাস্তির ভয় দেখান তবে শিশু আর সহজে ভীত হইবে না এবং আপনার কথামত চলিবেও না; তখন আপনাকে আরও বেশি কড়াকড়ি ও ভীতি প্রদর্শন করিতে হইবে; ফলে শিশুর অস্থিরচিত্ততা সৃষ্টি হইবে। একদিন আমার ছেলে স্রোতের জলের মধ্যে হাঁটিতে চায়। সেখানে ভাঙা কাঁচ। প্রভৃতির টুকরা থাকিলে তাহার পা কাটিয়া যাইতে পারে, এজন্য আমি তাহাকে বারণ করি। জলে নামার বাসনা তাহার এমন প্রবল হইয়াছিল যে, সে কাঁচের টুকরা সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া ওঠে কিন্তু আমি যখন একটি টুকরা পাইয়া তাহার ধারালো কিনারা দেখাইলাম তখন সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিল। আমি যদি আমার নিজের সুবিধার জন্য অর্থাৎ তাহাকে জলে নামা হইতে বারণ করার জন্য বাসনাপত্রের ভাঙা টুকরা আছে বলিয়া মিথ্যা ভাঁওতা দিতাম তবে সে আমার উপর বিশ্বাস হারাইত; সেখানে কোনো ভাঙা ধারালো টুকরা না পাইলে আমি তাহাকে নিশ্চয়ই জলে নামিতে দিতাম। এই ধরনের নানা পরীক্ষার ফলে শিশু আমার যুক্তি ও বিবেচনা সম্বন্ধে আর কোনও প্রকার সন্দেহ পোষণ করে না।

আমরা ছলনা ও প্রতারণাময় সংসারে বাস করিতেছি। যে শিশু ইহার আওতায় বর্ধিত হয় না সে সাধারণত যাহা শ্রদ্ধার যোগ্য বলিয়া অনেকে মনে করে তাহার ভিতরকার ভণ্ডামির জন্য অনেকে কিছুই ঘৃণা করিবে। কোনও কিছুর প্রতি ঘৃণার ভান পোষণ করা বাঞ্ছনীয় নয়। আমি এরূপ অবস্থার প্রতি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করার পক্ষপাতী নই, তবে সে যদি স্বেচ্ছায় জানিতে চায় তবে তাহার কৌতূহল নিবৃত্ত করিতেই হইবে। ভণ্ডামিপূর্ণ সমাজে জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা কতকটা বাধাস্বরূপ হয় বটে কিন্তু সত্যবাদিতাকে ভিত্তি করিয়া মানুষের যে নির্ভীকতা লাভ হয় তাহার মূল্য অনেক বেশি। আমাদের সন্তানগণ সৎ, সরল এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হউক ইহাই আমরা কামনা করি। আমি তো মনে করি এই সকল গুণে ভূষিত হইয়া তাহারা যদি কর্মক্ষেত্রে অকৃতকার্য হয় তাহা বরং ভালো তবু তাহারা যে ক্রীতদাসের কলাকৌশলে অর্থাৎ মিথ্যা, কপটতা ও ভণ্ডামির সাহায্যে কৃতকার্য হইবে তাহা চাই না। প্রত্যেক খাঁটি চমৎকার ব্যক্তির সততা এবং নিজের সততা সম্বন্ধে প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ থাকা উচিত। [এই গর্ববোধকে তুলনা করা চলে মাংসপেশির অভ্যন্তরস্থিত অস্থির সঙ্গে। শক্তি অস্থি দেহকে উন্নত ও দৃঢ় রাখে; অস্থিহীন প্রাণী উন্নত মস্তকে চলিতে পারে না। কিন্তু অস্থি যদি মাংস দ্বারা আবৃত না থাকে তবে অপরের সংস্পর্শে আসিলে তাহা অন্যকে রূঢ় আঘাত দেয়। বিনয় ও ভদ্রতারূপ মাংসপেশির আড়ালে অস্থিরূপ গর্ববোধ মানুষকে অনেক হীনতা ও নীচতা হইতে রক্ষা করে। এইরূপ গর্ববোধ থাকিলে বিশেষ কোনো মহত্তর উদ্দেশ্য ব্যতীত সে ব্যক্তির পক্ষে মিথ্যা কথা বলা অসম্ভব। আমি চাই আমার ছেলেমেয়েরা চিন্তায় ও বাক্যে সত্যবাদী হউক; ইহার জন্য যদি তাহাদিগকে জাগতিক ব্যাপারে দুর্ভাগ্য ভোগ করিতে হয় তাহাতেও আমি রাজি, কেন না সত্যকে পরিত্যাগ করা ধন, মান অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান সম্পদ বিসর্জন দেওয়ারই শামিল।

০৯. শাস্তি

আগেরকার দিনে এবং কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত শিশু এবং বালক-বালিকাদিগকে শাস্তি দেওয়া একটি অতি সাধারণ প্রচলিত ব্যাপার ছিল; শিক্ষার জন্য ইহাকে সর্বজনস্বীকৃত এবং অপরিহার্য মনে করা হইত। বেত্রাঘাত সম্বন্ধে ডক্টর আর্নল্ড কি অভিমত পোষণ করিতেন তাহা সর্বজনবিদিত। তাহার সময়ে ডক্টর আর্নল্ডের অভিমত অতি কোমলতাপূর্ণ বলিয়া বিবেচিত হইত। শিশুকে তাহার নিজের স্বভাব ও প্রকৃতি অনুসারে বাড়িয়া উঠিতে দিবার নীতি প্রচার করেন রুশো। তথাপি তিনিও এমিল [Emile] গ্রন্থে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিদানের অনুকূলে অভিমত দিয়াছেন। একশত বৎসর পূর্বে শিশুর শাস্তি বিধান সম্পর্কে কিরূপ ধারণা ছিল তাহা তখনকার সতর্ককারী একগল্পে বর্ণিত আছে। ছোট্ট একটি মেয়েকে সাদা জামা পরাইয়া দেওয়া হইতেছে কিন্তু সে জেদ ধরিয়াছে ফিকে লাল রঙেরটি পরিবে। তাহার অবাধ্যতার ফল কি হইল?

বহির্বাটি থেকে এসে   বাবা শুনিলে যবে
খুকুর তর্জন ক্রন্দন;
তখনই রাগের বশে   ভিতরে ছুটিয়া এসে
বেত্রাঘাতে করে দমন।

The Fair Child Family পুস্তকে বর্ণিত আছে মিঃ ফেয়ার চাইল্ড তাঁহার ছেলেমেয়েদিগকে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া করিতে দেখিলে বেত মারিতেন আর তালে তালে কবিতা আবৃত্তি করিতেন কুকুর মাতুক আনন্দে কামড়ে গর্জনে [Let dogs delight to bark and bite] তারপর ফাঁসির কাষ্ঠের সঙ্গে ঝুলানো মৃতদেহ দেখানোর জন্য লইয়া যাইতেন। বাতাসে মৃতদেহটি নড়িত, শিকলের ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ হইত; ছেলেমেয়েরা ভয়ে জড়ো হইয়া তাহাদিগকে বাড়িতে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে অনুরোধ করিতে থাকিত। কিন্তু মিঃ ফেয়ার চাইল্ড তাহাদিগকে বহুক্ষণ সেই বীভৎস দৃশ্য দেখিতে বাধ্য করিতেন এবং বলিতেন, যাহাদের অন্তরে ঘৃণা আছে তাহাদের এই দশাই হয়। পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ধর্মযাজক করা; এবং এই উদ্দেশ্যেই হয়তো তাহাকে এমন শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল যাহাতে সে পাপীর অপরাধ যে কিরূপ ভীষণ হয় সে সম্বন্ধে পরে প্রত্যক্ষদর্শীর মতো জ্বলন্ত বর্ণনা দিতে পারে। বর্তমান যুগে এইরূপ শাস্তি কেহই সমর্থন করিবে না। কিন্তু ইহার পরিবর্তে কিরূপ শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত সে সম্বন্ধে বহু মতভেদ আছে। কেহ এখনও ভালোমতো শাস্তিদানের পক্ষপাতী আবার কেহ কেহ মনে করেন ইহার কোনও প্রয়োজন নাই। এ দুইটিই চরম অভিমত।

আমার মনে হয় শিক্ষায় শাস্তির প্রয়োজন আছে, তবে ইহার স্থান খুব কম; আর কঠোর শাস্তি মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়, আমার মতে ধমক দেওয়া বা তিরস্কার করাও শাস্তির অন্তর্ভুক্ত। যদি কখনো কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করিতে হয়, তাহার জন্য স্বাভাবিক ক্রোধ প্রকাশই যথেষ্ট হওয়া উচিত। কয়েকবার আমার ছেলে তাহার ছোট বোনের উপর রূঢ় ব্যবহার করিলে তাহার মা রাগিয়া বিরক্তির সঙ্গে জোরে ধমক দেন। ইহাতেই সুফল ফলিল। ছেলে ফেঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল এবং তাহার মা তাহাকে আদর না করা পর্যন্ত সে শান্ত হইল না। পরে ছোট বোনের সঙ্গে তাহার ব্যবহার লক্ষ্য করিয়া দেখা গেল ক্রোধের সুফল তাহার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করিয়াছে। আমরা কোনও জিনিস না চাহিলেও সে যখন ইহার জন্য জেদ করিয়াছি কিংবা তাহার ছোট বোনের খেলায় বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়াছে, তখন তাহাকে মৃদু আকারে শাস্তি দিতে হইয়াছে। এইরূপ ক্ষেত্রে ভালোভাবে বুঝাইলেও কোনো ফল না হইলে আমরা তাহাকে একটি ঘরে একাকী রাখিয়া আসিতাম। ঘরের দরজা খোলা থাকিত; তাহাকে বলা হইত যে ভালো হইলেই যেন ঘর হইতে চলিয়া আসে। কয়েক মিনিট সে খুব জোরে চিৎকার করিয়া কাঁদিত তারপর শান্ত হইয়া বাহির হইয়া আসে এবং ভালো ব্যবহার করিতে থাকে। সে ইহা ভালোভাবেই বুঝিত যে বাহিরে আসায় সে শান্ত আচরণের শর্ত মানিয়া লইয়াছে। আমাদিগকে ইহার চেয়ে কঠোরতর শাস্তি প্রয়োগ করিতে হয় নাই।

যাহারা কঠোর শাস্তি দিয়া শিশুকে শায়েস্তা করিতে চাহিতেন এমন প্রাচীনপন্থি শৃঙ্খলা-বিধানকারী ব্যক্তিদের বই পড়িয়া বোঝা যায় যে, বর্তমান প্রণালীতে শিক্ষিত শিশুদের অপেক্ষা প্রাচীন প্রণালীতে শিক্ষিত শিশুরা অনেক বেশি দুষ্ট ছিল। The Fair Child Family পুস্তকে শিশুদের যেরূপ আচরণের কথা উল্লেখ করা আছে, আমার ছেলে তাহার অর্ধেক খারাপ আচরণ করিলেই আমি স্তম্ভিত হইব। এরূপ ক্ষেত্রে আমি মনে করিব ছেলের পিতামাতার দোষই বেশি। আমি বিশ্বাস করি যে, বিচারবুদ্ধি বিশিষ্ট পিতামাতাই অনুরূপ সন্তান গড়িয়া তুলিতে পারেন। শিশুদের জীবনগঠনের পক্ষে পিতামাতার স্নেহ বিশেষ প্রয়োজনীয়। সন্তানের প্রতি শুষ্ক কর্তব্য ও দায়িত্ব সন্তানগণ বোঝে না তজ্জন্য কৃতজ্ঞও থাকে না। তাহারা চায় জনক-জননীর অন্তর নিঙড়ানো মধুর স্নেহ। শিশুকে ভালোভাবে গড়িয়া তুলিতে হইলে তাহাকে বুঝিতে দিতে হইবে যে, সে পিতামাতার স্নেহের অধিকারী। ইহা ছাড়া তাহাকে কোনো কাজ বা আচরণ হইতে বিরত থাকিতে বলিলে অথবা কোনও কাজ করিতে নিষেধ করিলে সম্পূর্ণ অসম্ভব না হইলে, ইহার কারণ তাহার নিকট যথাযথভাবে বুঝাইয়া বলা উচিত। খেলাধুলা করিতে গেলে অনেক সময় ছোটখাট আঘাত লাগে, হাত-পা কাটে বা ছাল উঠিয়া যায়; এইরূপ বরং ঘটিতে দেওয়া ভালো, তথাপি শিশুদিগকে দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটির খেলা হইতে নিবৃত্ত করা উচিত নয়। এইরূপ কিছু কিছু অভিজ্ঞতা হইতে তাহারা উপলব্ধি করিতে পারে যে নিষেধ মানিয়া চলা বুদ্ধিমানের কাজ। যেখানে প্রথম হইতেই শিশুরা এইরূপ অবস্থার মধ্যে দিয়া শিক্ষা পাইতে থাকে সেখানে গুরুতর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য কোনো কাজ তাহারা করিবে না বলিয়া আমার বিশ্বাস।

শিশু যখন জেদ করিয়া ক্রমাগতই অন্য শিশুদের খেলায় প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিতে থাকে কিংবা অন্যদের আনন্দে বাধা দেয় তখন শাস্তিস্বরূপ তাহাকে অপর শিশুদের কাছ হইতে পৃথক করিয়া সরাইয়া রাখা উচিত। এইরূপ কোনো শাস্তি দিতেই হইবে, কেননা একজনের দুষ্টামির জন্য অন্য সকলের আনন্দে বিঘ্ন হইতে দেওয়া কর্তব্য নয়। কিন্তু দিবার কোনো প্রয়োজন নাই যাহাতে সে যে বিশেষভাবে দোষী সেই ভাব তাহার মনে হয়। সে যদি বুঝিতে পারে যে অন্যেরা যে আনন্দভোগ করিতেছে সে তাহা হইতে বঞ্চিত তবেই যথেষ্ট। এরূপ ক্ষেত্রের মাডাম মন্তেসরি কি ব্যবস্থা অবলম্বন করেন, তাহা তিনি বর্ণনা করিয়াছেন :

আমরা অনেক সময় এমন শিশুদের সংস্পর্শে আসিয়াছি যাহারা কোনো রকম সংশোধন বা উপদেশ কর্ণপাত না করিয়া অন্যের আনন্দে উৎপাত সৃষ্টি করিয়াছে। এইরূপ শিশুকে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করান হয়। যখন দেখা যায় যে তাহাদের কোনোরূপ শারীরিক অসুস্থতা নাই,তখন তাহাকে ধরিয়া কোনো ছোট একটি টেবিলে বসাইয়া অন্যের নিকট হইতে দূরে পৃথক করিয়া রাখা হয়। তাহাকে ছোট একটি হাতওয়ালা আরাম চেয়ারে এমনভাবে একটু উঁচুতে বসানো হয় যাহাতে সে অন্য ছেলে মেয়েদের খেলা দেখিতে পারে। যে সব খেলনা সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, তাই তাহাকে খেলিতে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া প্রায় সকল ক্ষেত্রে শিশুকে শান্ত করিয়াছে। পৃথক স্থানে বসিয়া থাকিয়া সে অন্য সাথীদের খেলা দেখিতে পায় এবং তাহা তাহার নিকট বস্তূপাঠ [Object lesson]-এর মতো কাজ করে। শিক্ষাকে মৌখিক উপদেশ অপেক্ষা ইহা বেশি কার্যকরি হয়। ধীরে ধীরে সে অন্য সকলের সঙ্গে মিলিয়া-মিশিয়া খেলার সুবিধা উপলব্ধি করিতে পারে, সে নিজেই সকলের মধ্যে ফিরিয়া যাইতে চায়। এইভাবে যে সব শিশু প্রথমে আমাদের শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিল তাহাদের সকলকেই শৃঙ্খলার মধ্যে আনিতে সক্ষম হইয়াছি। পৃথক করিয়া রাখা শিশুর প্রতি সর্বদা বিশেষ যত্ন লওয়া হইত, যেন সে পীড়িত। আমি নিজে কক্ষে প্রবেশ করিয়াই প্রথমে তাহার কাছে যাইতাম; যেন সে অতি কচি শিশু। তারপর আমি অন্যদের প্রতি দৃষ্টি দিতাম, তাহাদের বেলায় কৌতূহল দেখাইতাম, তাহারা যেন ছোট ছোট বয়স্ক ব্যক্তি এইভাবে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতাম। যাহাদিগকে পৃথক করিয়া রাখিয়া শাস্তি দিতে হইত, তাহাদের মনে কি হইত তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু তাহাদের আচরণের পরিবর্তন হইত স্থায়ী এবং সম্পূর্ণ। কেমন করিয়া কাজ করিতে হয়, কেমন করিয়া অন্যের সঙ্গে ব্যবহার করিতে হয়, ইহা শিখিতে তাহারা রীতিমতো গর্ববোধ করিত। তাহারা অন্য শিক্ষয়িত্রী এবং আমার প্রতি সর্বদা প্রীতির ভাব দেখাইত।

যে যে কারণের জন্য, এই প্রণালীতে সুফল পাওয়া যায়, তাহা আগেকার দিনের স্কুলে ছিল না। কোনোরূপ অসুস্থতার জন্য শিশু খারাপ ব্যবহার করিতে শুরু করিলে এখন তাহাকে সরাইয়া পৃথক করিয়া রাখা হয়। তারপর এ প্রণালী প্রয়োগ করার কৌশল ও নিপুণতা তো আছেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বড় কথা হইল, বেশিরভাগ শিশুর শৃঙ্খলা মানিয়া চলার স্পৃহা। অবাধ্য শিশু একাই যে জগতের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু ইহাকে উপেক্ষা করিতে পারি না। যে স্কুলে শ্রেণির সকল ছাত্রই হইচই করিয়া শৃঙ্খলা অমান্য করিতে উৎসুক সেখানে শিক্ষককে এক সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থার সম্মুখিন হইতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে শিক্ষকের কি প্রণালী অবলম্বন করা উচিত তাহা আলোচনা করিতে চাই না, কেননা প্রথম হইতে শিশুকে উপযুক্তভাবে শিক্ষা দিলে শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে এরূপ বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টিই হইবে না।

তোষামোদ করিয়া শিক্ষাদান : শিশুরা শিক্ষণীয় বিষয় শিখিতে চায় তবে বিষয়টি শিখিবার উপযুক্ত হওয়া চাই এবং উপযুক্তভাবে শিক্ষা দেওয়া চাই। শৈশবে খাওয়ান ও ঘুম পাড়ানোর ব্যাপারে যে ভুল, শিক্ষাদানের ব্যাপারেও সেই ভুল করা হইয়া থাকে। শিশুর পক্ষে যাহা করা উপকারী তাহার জন্য তাহাকে এমন তোষামোদ করা হয় যে সে ভাবে সে বুঝি তদ্বারা বয়স্ক ব্যক্তিদিগকে কৃতার্থ করিতেছে। শিশুদের মনে অতি সহজেই এই ধারণা আসে যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা চাহেন বলিয়াই তাহারা খায় এবং ঘুমায়। আহার ও নিদ্রায় কোনোরূপ ব্যতিক্রম দেখাইলে অভিভাবকগণ ব্যস্ত হইয়া পড়েন, শিশুর অহমিকাবোধ তৃপ্ত হয়। এই অবস্থার বাড়াবাড়ি ঘটিলে শিশুর পরিপাক ক্রিয়া ও নিদ্রা দুই-ই ব্যাহত হয় এবং সে রুগ্ন হইয়া পড়ে। পরিচারিকা আমার ছেলেকে খোশামোদ করিয়া খাওয়ানো অভ্যাস করিয়াছিল, ইহার ফলে ক্রমেই সে জেদি হইয়া উঠিতেছিল। একদিন দুপুরে তাহাকে আহার করিতে ডাকিলে সে পুডিং খাইতে অস্বীকার করিল। কাজেই ইহা রাখিয়া দেওয়া হইল। কিছুক্ষণ পরে সে নিজেই খাবার চাহিল কিন্তু তখন দেখা গেল পাঁচক তাহা খাইয়া ফেলিয়াছে। ইহাতে সে সংযত হইয়া গেল এবং পরে আর কখনো আমাদের কাছে রাগের ভান করে নাই। শিক্ষা ব্যাপারে ঠিক এইরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। যদি কেহ শিক্ষা নিতে না চায় তাহাকে বাদ দেওয়া উচিত। তবে দেখিতে হইবে পাঠদান হইতে সে যতক্ষণ অনুপস্থিত থাকিবে, ততক্ষণ যেন। আনন্দে সময় কাটাইতে না পারে। সে যদি অন্যকে শিখিতে দেখে, তাহা হইলে শীঘ্রই নিজেই শিখিতে আগ্রহ প্রকাশ করিবে। শিক্ষক তখন তাহাকে সাহায্য করিতে পারেন; কাজটি এমনভাবে করিতে হইবে যেন শিশু বুঝিতে পারে যে, সে নিজেই উপকৃত হইতেছে, অপর কাহাকেও কৃতার্থ করিতেছে না। আমি স্কুলে একটি করিয়া বড় খালি কক্ষ রাখার পক্ষপাতী। পাঠে অনিচ্ছুক ছেলেদিগকে সেখানে পাঠানো হইবে। একবার সেখানে যাইলে সে-দিন আর তাহাকে শ্রেণিতে ফিরিতে দেওয়া হইবে না। পাঠের সময় খারাপ ব্যবহার করিলে শাস্তিস্বরূপ তাহাদিগকে শূন্য কক্ষে নির্বাসন করিতে হইবে। সাধারণ নীতি এই যে অপরাধীকে এমন শাস্তি দিতে হইবে যাহা সে পছন্দ করে না। তথাপি ছাত্রের মনে প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি প্রীতি জন্মাইবার উদ্দেশ্যে ওইরূপ পুস্তক হইতে লেখা নকল করার শাস্তি প্রদান করা হইয়া থাকে।

প্রশংসা ও নিন্দা : ছোটখাটো রকমের অপরাধের জন্য (যেমন আচরণের অশোভনতা ইত্যাদি) মৃদু রকমের শাস্তির উপযোগিতা আছে। প্রশংসা ও নিন্দা ছোট শিশুদের এবং বয়স্ক বালক-বালিকাদের পক্ষেও পুরস্কার ও শাস্তি হিসেবে বিশেষ প্রয়োজনীয়। যিনি ছোটদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে পারেন এমন লোক যদি প্রশংসা বা নিন্দা করেন তবে ইহার গুরুত্ব আরও বাড়ে। প্রশংসা ও নিন্দা ব্যতীত শিক্ষাদান কার্য চলে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না, তবে ইহা প্রয়োগ করিতে কিছুটা সতর্কতা আবশ্যক।

প্রথমত, প্রশংসা বা নিন্দা তুলনামূলকভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয়। কোনো শিশুকে বলা ঠিক হইবে না–তুমি অমুকের চেয়ে ভালো করিয়াছ বা অমুকে অমুকে মোটেই খারাপ নয়। প্রথমটির ফলস্বরূপ তাহার মনে অবজ্ঞার ভাব উৎপন্ন হয়, দ্বিতীয় শত্রুতার সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয়ত, প্রশংসা অপেক্ষা নিন্দার প্রয়োগ কম করা দরকার। শিশু কোনও অশোভন আচরণ করিলে শাস্তিস্বরূপ ইহা প্রয়োগ করিতে হইবে; ফল পাওয়া গেলে উহার প্রয়োগের আবশ্যকতা নাই।

তৃতীয়ত, যে কার্যে বিশেষ কৃতিত্ব নাই, তাহার জন্য প্রশংসা করা অনুচিত। সাহস কিংবা নূতন কৌশল প্রদর্শনের জন্য অথবা নিজের সংবাদের কোনো প্রকার নিঃস্বার্থপরতা দেখাইলে শিশুর নৈতিক শক্তির প্রকাশকে উৎসাহ দিবার জন্য প্রশংসা করিতে হইবে। শিক্ষা ব্যাপারে ছাত্র অনন্য সাধারণ ভাল কিছু করিলে তাহাকে প্রশংসা করা একান্ত আবশ্যক।

কঠিন কোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রশংসাপ্রাপ্তি তরুণদের নিকট অতি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা; প্রশংসা লাভের কামনা তাহাদের কাজে প্রেরণা জোগায়, যদিও ইহা প্রধান উদ্দেশ্য নয়। কাজের প্রতি অনুরাগ ও নিষ্ঠাই প্রেরণার মূল উৎস হওয়া উচিত।

নিষ্ঠুরতা : চরিত্রের গুরুতর দোষগুলি, যেমন নিষ্ঠুরতা, শাস্তি দিয়া সংশোধন করা যায়; তাহার জন্য শাস্তি প্রয়োগ করিলেও পরিমাণ খুব কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা ছেলেদের মধ্যে কম-বেশি স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়; ইহা প্রতিরোধকরার জন্য যথাসময়ে শিক্ষার প্রয়োজন। আপনি যদি মনে করেন ছেলেকে যখন কোনো প্রাণীর উপর নির্যাতন করিতে দেখিবেন, তখন তাহাকে শাসন করিবেন, তবে ভুল করা হইবে। এরূপ করিলে সে যাহাতে পরে আপনার নজরে না পড়ে সেই চেষ্টা করিবে। শিশুর যে ভাবটি পরে হয়তো নিষ্ঠুরতায় পরিণত হইতে পারে; তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া প্রথম অবস্থাতেই তাহা দূর করা প্রয়োজন। ছেলেকে অপরের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা শিখান; সে যেন আপনাকে কোনো প্রাণী, এমনকি বোলতা বা সাপও হত্যা করিতে না দেখে। যদি তাহা সম্ভবপর না হয়, তবে কোন্ কোন্ প্রাণী হত্যা করা হয় তাহা সহজভাবে শিশুকে বুঝাইয়া দিন। সে যদি অপর ছোট শিশুর প্রতি নির্দয় ব্যবহার করে, আপনিও তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতি সেইরূপ করুন। সে প্রতিবাদ করিবে; আপনি তখন তাহাকে বুঝাইবেন যে, সে যদি ইহা পছন্দ না করে, অন্যের প্রতিও তাহার নিষ্ঠুর আচরণ করা সঙ্গত নহে। এইভাবে অন্যেরও যে তাহার মতোই সুখ-দুঃখের অনুভূতি আছে তাহা সে বুঝিতে পারিবে।

নিষ্ঠুরতা নিবারণের উপায় শিশু অন্যের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করিলে তাহার উপরও অনুরূপ আচরণ করিয়া যদি তাহার নিষ্ঠুরতার মনোভাব দূর করিতে চান, তবে এ প্রণালী প্রথম হইতেই আরম্ভ করিতে হইবে। ইহার কারণ স্পষ্ট। অন্যের উপর নির্দয়তার প্রতিদানে শিশুর উপর যে অনুরূপ নির্দয় ব্যবহার করিবেন, তাহা তো গুরুতর হওয়া চলিবে না।

যখন নিষ্ঠুরতার প্রতিদানে নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করিবেন শিশু যেন বুঝিতে পারে আপনি রাগিয়া তাহাকে শাস্তি দিতেছেন না, তাহার শিক্ষার জন্যই ওইরূপ ব্যবস্থা করিতেছেন। তাহাকে বলিতে পারেন- দেখ তোমার ছোটবোনকে তুমি এমনিভাবে কষ্ট দিয়েছ। আঘাত পাইয়া ছেলে প্রতিবাদ কিরবে। তখন আপনি বলিবেন–বেশ তোমার যদি ইহা ভালো না লাগে অন্যের উপরেও তো তোমার এরূপ করা উচিত নয়। এইরূপে শিশু যদি সঙ্গে সঙ্গে সহজভাবে শিক্ষা পায়, তবে তাহার এই ধারণা হইবে যে, অন্যের সুখদুঃখ বোধকে মানিয়া চলা উচিত। ইহার ফলে কখনো গুরুতর নিষ্ঠুরতার উদ্ভব হইবে না।

নৈতিক উপদেশ : নৈতিক উপদেশ সকল ঠিক সময়ে এবং বস্তুসাপেক্ষভাবে (concrete) প্রয়োগ করা উচিত। শিশুকে উপদেশ দিবার জন্য আপনি ইচ্ছা করিয়া কোনো ঘটনার অবতারণা করিবেন না। স্বাভাবিকভাবে কোনো ঘটনা ঘটিলে তখন তাহার সুযোগ লইবেন। মনে রাখিতে হইবে, একটিমাত্র সুযোগ অবলম্বন করিয়া ব্যাপকভাবে নানা উপদেশ দিলে কোনো ফল হইবে না। কোনো একটি বিশেষ ঘটনায় শিশু যে উপদেশ পাইবে পরে অনুরূপ কোনো ক্ষেত্রে সে নিজেই উহা প্রয়োগ করিতে পারিবে। কোনগুলি মানুষের সগুণ এবং কিভাবে তাহা প্রকাশ করিতে হয়, সে সম্বন্ধে সাধারণ নীতি জানিয়া তাহা অনুসরণ করা শিশুর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। কোনো বিশেষ অবস্থায় কিরূপ আচরণ করিতে হয় তাহা জানাই বরং তাহার পক্ষে সহজ। পরে অনুরূপ অবস্থা ঘটিলে সে পূর্বের অভিজ্ঞতার সাহায্যে যথাযথ আচরণ করিতে পারিবে।

সাহসী হও, দয়ালু হও, সাধারণভাবে এরূপ উপদেশ দিবেন না; বরং কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে তাহাকে সাহস দেখাইতে উৎসাহ দিন; পরে বলুন–বেশ? এই তো তুমি সাহসী ছেলে, তাহার খেলনাটি তাহার ছোট ভাই বা বোনকে খেলিতে দিতে বলুন। খেলনা পাইয়া শিশু যখন আনন্দে উল্লসিত হইয়া উঠিবে, তখন খোকাকে বলুন–এই তো তুমি ঠিক কাজ করেছ। খোকার বেশ দয়া আছে। নিষ্ঠুরতা নিবারণ করিতেও এই নীতি প্রয়োগ করিতে হইবে। লক্ষ্য রাখিবেন কখনো ইহার সূচনা দেখিতে পান কিনা; নির্দয়তার ভাব বাড়িতে না দিয়া অঙ্কুরে ইহা নিবারণ করিতে হইবে।

সকল রকম চেষ্টা সত্ত্বেও যদি বয়স বাড়িলে শিশুর নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়, তবে রোগের মতো ইহার প্রতিবিধান করিতে হইবে। হাম বা অন্য কোনও প্রকার রোগ হইলে শিশুকে যেমন অপ্রীতিকর অবস্থা ভোগ করিতে হয়, এক্ষেত্রেও তেমনি ভোগ করিতে হইবে; শিশু যে অপরাধী এবং দুষ্ট হইয়াছে, এমন ভাব তাহার মনে জন্মাইবার প্রয়োজন নাই। কিছু সময়ের জন্য তাহাকে অন্যান্য বালক-বালিকা এবং প্রাণীর নিকট হইতে পৃথক করিয়া রাখিতে হইবে; তাহাকে বুঝাইতে হইবে যে, অপরের সঙ্গে তাহাকে মিশিতে দেওয়া নিরাপদ নয়। তাহার প্রতি অন্যে নির্দয় ব্যবহার করিলে তাহার কি দশা হইত তাহাও শিশুকে যথা সম্ভব বুঝান উচিত। তাহাকে ইহা উপলব্ধি করাইতে হইবে যে, নির্দয়তার আবেগ তাঁহার দুর্ভাগ্যের সূচনা করিতেছে এবং তাহার বয়োজ্যেষ্ঠরা তাহাকে ভবিষ্যতে ইহা হইতে রক্ষার চেষ্টাই করিতেছেন। আমার বিশ্বাস, অল্প কিছু মনোরোগ বিশিষ্ট শিশু ছাড়া অন্য সকলের পক্ষেই এ প্রণালী সুফল প্রদান করিবে।

দৈহিক শাস্তির কুফল দৈহিক শাস্তিদানকে আমি কখনোই যুক্তিযুক্ত বলিয়া বিশ্বাস করি না, তবে মৃদু আকারে দিলে ইহা বিশেষ ক্ষতি করে না, যদিও ভালও কিছু করে না, কঠোর আকারে দিলে ইহা নির্দয়তা সৃষ্টি করে। ইহা সত্য যে, শাস্তিদাতার প্রতি অনেক সময় শিশুর ক্রোধের উদ্রেক হয় না। যেখানে শিশুকে প্রায়ই শাস্তিভোগ করিতে হয়, সেখানে সে ইহাকে স্বাভাবিক মনে করে এবং নিজেকে ইহার সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া নেয়। কিন্তু ইহা তাহার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে যে, কর্তৃত্ব বজায় রাখিবার জন্য এইরূপ দৈহিক শাস্তি প্রদান করা ন্যায়সঙ্গত। যে শিশু বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হইয়া কর্তৃত্ব করিবে, তাহার পক্ষে এ শিক্ষা বিপজ্জনক।

তাহা ছাড়া পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে যে খোলাখুলি সরল বিশ্বাসের সম্বন্ধ থাকা উচিত শাস্তির কঠোরতা তাহা নষ্ট করিয়া দেয়। আধুনিক পিতা চান তাহার পুত্রকন্যা তাহার উপস্থিতিতে নিঃসংকোচে অবস্থান করুক; তাঁহাকে আসিতে দেখিলে তাহারা যেন খুশি হয়–তিনি ইহা চান। তিনি যতক্ষণ উপস্থিত আছেন ততক্ষণ সবাই মিথ্যা ভয়ে সংকোচে (কাচুমাচু হইয়া) চুপচাপ থাকিবে আর আড়ালে যাইলেই নরকের তাণ্ডব শুরু করিবে ইহা পিতার নিকট বাঞ্ছনীয় নয়। শিশুদের অকৃত্রিম প্রীতি লাভ করা জীবনের যে কোনো বড় আনন্দ লাভের মতই লোভনীয়। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এই আনন্দ কি জানিতেন না, কাজেই তাহারা কি হারাইতেছিলেন তাহাও বুঝিতেন না। তাঁহারা সন্তানদিগকে শিক্ষা দিতেন যে, পিতামাতাকে ভালোবাসা তাহাদের কর্তব্য কিন্তু কার্যত এই কর্তব্য পালন করা এক রকম অসম্ভব করিয়া তুলিতেন। এই অধ্যায়ের প্রথমে কবিতায় যে-মেয়েটির কথা উল্লেখ করা হইয়াছে তাহার পিতা যখন বেত্রাঘাতে তাহাকে দমন করিতে আসিতেন, তখন সে নিশ্চয়ই খুশি হইত না। যতদিন পর্যন্ত লোকে বিশ্বাস করিত যে হুকুম করিয়া ভালবাসা আদায় করা সম্ভব, ততদিন তাহারা শিশুদিগের অকৃত্রিম প্রক্ষোভ [Emotion] হিসাবে স্নেহ প্রীতি লাভ করিতে চেষ্টা করে নাই। ইহার ফলে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ ছিল কঠোর রূঢ় ও নির্দয়। শিশুর শাস্তিবিধান এই সমগ্র মনোভাবের সঙ্গে সংযুক্ত এবং এই মনোভাব দ্বারাই পুষ্ট। ইহাই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, যে সকল লোক কোনো স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধে হাত তোলার কথা কল্পনাও করিতে পারিত না, তাহারাই অসহায় অরক্ষিত শিশুর উপর দৈহিক নির্যাতন করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হইত না। সৌভাগ্যের কথা এই যে, গত একশত বৎসরের মধ্যে পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রীতির সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিয়াছে এবং ইহারই ফলে শাস্তির নীতিই আগাগোড়া পাল্টাইয়া গিয়াছে! আমি আশা করি, শিক্ষাক্ষেত্রে যে উন্নতির ভাবধারার প্রবর্তন হইয়াছে তাহা ক্রমে মানুষের অন্যান্য কর্মক্ষেত্রেও প্রসারিত হইবে, কারণ আমাদের শিশুদের সহিত ব্যবহারে যেমন, অন্যত্রও তেমনি উহার বিশেষ প্রয়োজন আছে।

 ১০. অপর শিশুর সাহচর্য

পিতামাতা এবং শিক্ষক কিভাবে নিজেদের চেষ্টায় শিশুর চরিত্রগঠনে সহায়তা করিতে পারেন, এ পর্যন্ত তাহাই আলোচনা করা হইয়াছে কিন্তু অনেক কিছু আছে যাহা অপর শিশুর সাহায্য ব্যতীত বিকাশ করা যায় না। শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীর প্রয়োজনও বাড়িতে থাকে; বাস্তবিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্রের সতীর্থ সঙ্গীর যত প্রয়োজন এমন আর কোনো সময়ে নয়। শিশুর প্রথম বৎসরে প্রথম কয়েক মাসে অন্য শিশুর কোনো প্রয়োজনই হয় না, শেষ তিন মাসে সামান্য সাহায্য করে মাত্র। এই সময় কিঞ্চিৎ অধিক বয়স্ক শিশুরা উপকারে আসে। পরিবারের প্রথম শিশু সাধারণত হাঁটিতে এবং কথা বলিতে শিখিতে বেশি সময় নেয়, কারণ বয়স্ক ব্যক্তিদের কার্যকলাপ ও শক্তি তাহার তুলনায় এত বেশি যে তাহাদিগকে অনুসরণ করা কঠিন। এক বৎসর বয়সের শিশুর কাছে তিন বৎসরের শিশুই বেশি অনুকরণযোগ্য কারণ তিন বৎসরের শিশু যাহা করে ছোট শিশুও তাহা করিতে চায় এবং তাহার শক্তিও অসাধারণ বলিয়া মনে হয় না। শিশুদের নিকট অন্য শিশুরাই বেশি সমগোত্র, বয়স্ক ব্যক্তিরা নয়; অন্য শিশুরাই তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে, কাজে প্রেরণা দেয়। পরিবারেই কেবল ছোট শিশুরা অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের শিশুদের নিকট হইতে এরূপ শিক্ষার সুযোগ পায়। খেলার সময় যদি শিশুকে সঙ্গী নির্বাচন করিতে দেওয়া হয়, তবে সে তাহার অপেক্ষা বেশি বয়সের শিশুকেই সৎসঙ্গীরূপে বাছিয়া লইবে; ইহাতে তাহার অহমিকাবোধ তৃপ্ত হয়, সে যে উপরের স্তরের শিশুদের সমকক্ষ হইতে পারিয়াছে ইহা ভাবিয়া আনন্দ অনুভব করে। কিন্তু বয়স্ক শিশুরা আবার তাহাদের অপেক্ষা বেশি বয়সের ছেলেদের সঙ্গ কামনা করে। তাই দেখা যায় স্কুলে কি বস্তির রাস্তায়, কি অন্যত্র প্রায় সমবয়সী ছেলেরাই একত্রে খেলে, অধিক বয়সের ছেলেরা ছোটদের সঙ্গে খেলিয়া আনন্দ পায় না। এইভাবে দেখা যায় কিঞ্চিৎ বেশি বয়সের শিশুদের সাহচর্যে যে সুবিধা তাহা কেবল গৃহে লাভ করাই সম্ভবপর। কিন্তু ইহার একটি অসুবিধা এই যে, প্রত্যেক পরিবারেই জ্যেষ্ঠ শিশু এই সুযোগ হইতে বঞ্চিত হয়। পরিবার যত ছোট ছোট হয়, বড় শিশুর হারও তত কমিয়া আসে। কাজেই এই অসুবিধা ক্রমে বাড়িয়াই চলে। নার্সারি স্কুলে শিক্ষা দ্বারা শিশুদের অপর শিশুর সাহচর্য লাভের অভাব পূরণ না করিলে ছোট পরিবার শিশুদিগের শিক্ষায় ও আত্মবিকাশে অসুবিধাই সৃষ্টি করে। নার্সারি স্কুলে উপযোগিতা কি এ সম্বন্ধে পরে এক অধ্যায়ে আলোচনা করা হইবে।

বেশি বয়সী শিশুর উপকারিতা : শিশুর ক্রমবিকাশে সহায়তা করার জন্য বেশি বয়সী, কম বয়সী অপর শিশুদের প্রয়োজন আছে। স্কুলে বা অন্যত্র সমবয়সী শিশুরাই একত্র হইয়া খেলাধুলা করে; গৃহেই প্রথমোক্ত দুই প্রকার শিশুর সাহচর্য সীমাবদ্ধ থাকে। বেশি বয়সী শিশুরা ছোটদের সম্মুখে এমন এক আদর্শ তুলিয়া ধরে যাহা তাহাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। শিশুরা যাহাতে তাহাদের বড়দের খেলায় যোগদানের যোগ্য হইতে পারে সেইজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে। বেশি বয়সী শিশুরা ছোটদের সঙ্গে খেলিতে স্বাভাবিকভাবে খেলে, কোনো প্রকার ভান করে না কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তিরা সেইরূপ করিতে পারে না। তাহার কারণ বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে শিশুর শক্তির সমতা নাই; সে নিজের সুখের জন্য শিশুর সঙ্গে খেলে না, শিশুকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই খেলে, কাজেই তাহার পক্ষে ভান না করিয়া উপায় নাই। সে শিশুকে নিজের সমকক্ষ মনে করিতে পারে না, করা উচিতও নয়। শিশু যেমন সহজে ও সানন্দে বড় ভাইবোনের অনুগত হয় তেমন কোনো বয়স্ক ব্যক্তির হয় না; অবশ্য যদি অতিরিক্ত শাসন করা হয় তবে অন্য কথা; এইরূপ ক্ষেত্রে শিশু ক্রীতদাসের মতো বয়স্ক ব্যক্তির অনুগত হয়, ইহাতে শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ থাকে না।

অপরের অনুগত হইয়া কোনো কাজে সহযোগিতা করার অভ্যাস শিশুরা অপর শিশুর নিকট হইতে লাভ করে। বয়স্ক ব্যক্তিরা ইহা শিক্ষা দিতে গেলে দুইটি অসুবিধা দেখা দেয়। প্রথম, তাহারা যদি জোর করিয়া সহযোগিতা আদায় করিতে না চান, তবে শিশুদের মিথ্যা ভানকেই সত্য বলিয়া গ্রহণ করার ভান করিতে হইবে। সহযোগিতা–তাহা সত্য হউক, আর মিথ্যাই হউক তাহার যে কোনো মূল্য নাই বা তাহা যে সর্বদা বর্জনীয় এমন কথা বলিতেছি না। বেশি বয়সী ও কম বয়সী শিশুর মধ্যে যে সহযোগিতা থাকে তাহা যেমন স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত, বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে ছোটদের সহযোগিতায় তেমন সম্ভবপর নয়। এইরূপ অবস্থায় উভয় পক্ষ বহুক্ষণ সানন্দে সহযোগিতা করিতে পারে না।

বাল্য, কৈশোর, যৌবন সকল অবস্থাতেই কম বয়সীদের শিক্ষাদান ব্যাপারে কিছু বেশি বয়সীর যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান থাকে; এই শিক্ষা শ্রেণির পাঠদান হইতে স্বতন্ত্র ইহা কাজের সময়কার বাহিরের শিক্ষা। কিছু বেশি বয়সী ছেলে বা মেয়ে তাহাদের অপেক্ষা কিছু কম বয়সীর উচ্চাকাচ্চা জন্মায় ও কর্ম-প্রেরণা দান করে; ছোটদের কোনো কঠিন সমস্যা তাহারা বয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায়ও ভালোভাবে বুঝাইয়া দিতে পারে, কারণ তাহারা নিজেরাও এ সমস্যার সমাধান করিয়া বিষয়টি অধিগত করিয়াছে এবং সেই জন্যই তাহারা ছোটদের অসুবিধা ভালোভাবে বুঝিতে পারে ও তাহা দূর করিবার উপায় দেখাইতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমি আমার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে এমন অনেক কিছু শিখিয়াছিলাম যাহা প্রবীণ জ্ঞানবৃদ্ধ অধ্যাপকদিগের নিকট হইতে শিখিতে পারিতাম না। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক জীবনে ছাত্রদের বয়সের তারতম্য ভিন্ন ভিন্ন কঠিন স্তর সৃষ্টি করে না, অর্থাৎ বয়সের পার্থক্য থাকিলেও ছাত্রগণ পরস্পরের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেশে এবং ভাবের বিনিময় করে সেইখানেই বেশি বয়সীদের প্রভাব কম বয়সীদের সুফল প্রদান করে কিন্তু যেইখানে বেশি বয়সী ছাত্ররা কম বয়সীদের সঙ্গে মেলামেশাকে মর্যাদাহানিকর মনে করে সেইখানে এইরূপ ফলোভের সম্ভাবনা নাই।

ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বিশেষ করিয়া তিন হইতে ছয় বৎসর বয়স্কদের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাহারা কিঞ্চিৎ বেশি বয়সীদের কতকগুলি নৈতিক গুণবিকাশে সহায়তা করে। শিশু যখন বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকে তখন যে গুণগুলি দুর্বলের সঙ্গে আচরণে বিকাশ লাভ করে, সেইগুলি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায় না। শিশুকে শিখানো দরকার–তাহার ছোট ভাইবোনদের জিনিস কাড়িয়া লইতে নাই, ছোট কেহ হঠাৎ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে তাহার ইটের খেলনা ঘর ভাঙিয়া ফেলে তবে অত্যধিক রাগ দেখাইতে নাই, তাহার অব্যবহৃত খেলনা যদি অন্য কেহ চায় তবে জমাইয়া না রাখিযা দেওয়াই ভালো ইত্যাদি। তাহাকে শিখানো দরকার যে, কচি শিশুকে অসতর্কভাবে বা শক্তভাবে ধরিয়া নাড়াচাড়া করিলে সে ব্যথা পায়। অনিচ্ছায় এইভাবে কোনও শিশুকে ব্যথা দিয়া কাঁদাইলে তাহার নিজেরও মনে কষ্ট অনুভব করা উচিত। এমনই ছোট শিশুকে রক্ষা করিতে বয়স্ক ব্যক্তিদিগকেও শক্ত কথা শুনানো বা ধমক দেওয়া যায় কিন্তু অন্য কোনও কারণে এইরূপ করা শোভন হইবে না; এইরূপ অপ্রত্যাশিত আচরণ ছোটদের মনের উপর দাগ রাখিয়া যায়। এই সবই শিক্ষাপ্রদ কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এইরূপ সৃষ্টি না হইলে অন্য কোনো উপায়ে এই শিক্ষা দেওয়া চলে না।

শিশুকে বস্তুনিরপেক্ষ সাধারণ নৈতিক উপদেশ দান সময়ের অপব্যবহার ও মূর্খতারই পরিচায়ক। শুধু বাস্তব ঘটনাই শিশুর কাছে সত্য, ঘটনাও স্বাভাবিকভাবে ঘটা চাই। বয়স্ক ব্যক্তিরা যাহা মনে করেন নৈতিক উপদেশ, শিশুর নিকট তাহার বিশেষ কোনও আকর্ষণ নাই। শিশু উপদেশ হইতে তেমন শেখে না যেমন শেখে উদাহরণ হইতে। এইজন্যই শিশুর নিকট উপদেশের অপেক্ষা উদাহরণের মূল্য বেশি। মিস্ত্রিকে কাজ করিতে দেখিলে শিশু তাহার কাজ অনুকরণ করে; শিশু তাহার পিতামাতাকে অন্যের সহিত ভদ্র ও সদয় ব্যবহার করিতে দেখিলে নিজেও তাহা অনুকরণ করিতে চেষ্টা করে। উভয়ক্ষেত্রে শিশু যাহা অনুকরণ করিতে চায় তাহা মর্যাদাকর মনে করে। আপনি নিজে যদি ছেলেকে মিস্ত্রির করাত খুব ভালোভাবে ব্যবহার করার উপদেশ দেন কিন্তু যেমন তেমন করিয়া ব্যবহার করেন তবে আপনার উপদেশ কার্যকরি হইবে না। আপনি যদি শিশুকে তাহার ছোটবোনের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতে উপদেশ দেন কিন্তু নিজেই তাহার উপর নির্দয় আচরণ করেন তবে আপনার উপদেশ ব্যর্থ হইবে। যদি আপনার কোনো কাজের ফলে ছোট শিশু কাঁদে যেমন নাক পরিষ্কার করিয়া দিতে গেলে কাঁদিতে পারে তবে তাহার তুলনায় বেশি বয়সী শিশুদিগকে এইরূপ দাঁড়াইয়া আপনাকে নির্দয় আচরণ হইতে থামাইতে চেষ্টা করিতে পারে। আপনার আচরণে শিশুর মনে যদি এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ছোট শিশুকে কাঁদাইয়া আপনি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়াছেন, তবে তাহার নিষ্ঠুরতার আবেগকে দমন করা আপনার পক্ষে সম্ভব হইবে না।

সমবয়সীদের উপযোগিতা : বেশি বয়সী ও কম বয়সী শিশুদের প্রয়োজনীয়তা আছে কিন্তু সমবয়সীদের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি, বিশেষত শিশুর চার বৎসর বয়স হইতে আরম্ভ করিয়া বেশির দিকে। সমবয়স্কদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করিতে হয় তাহা শেখা বিশেষ প্রয়োজন। জগতে যত কিছু অসমতা তাহার অধিকাংশই কৃত্রিম; আমাদের আচরণের ভিতর দিয়া এইগুলি দূর করিতে পারিলেই সর্বাপেক্ষা ভালো হইত। ধনীলোকেরা নিজদিগকে তাঁহাদের পাঁচক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করেন এবং সমাজে যেইরূপ আচরণ করেন পাঁচকের সঙ্গে সেইরূপ করেন না। কিন্তু তাহারাই আবার একজন ডিউকের তুলনায় নিজদিগকে নিকৃষ্ট মনে করেন এবং তাহার সঙ্গে আচরণে তাঁহাদের আত্মমর্যাদাবোধের অভাবই পরিলক্ষিত হয়। এই দুই জায়গাতেই তাহারা ভুল করেন; পাঁচক এবং ডিউক উভয়ের প্রতি একইরূপ ভাব পোষণ করা এবং একইরূপ আচরণ করা উচিত। যে যৌবনে বয়সের তারতম্য অনুসারে স্তরভেদ করা হয় তাহা কৃত্রিম নয়; এই জন্যই যে সামাজিক অভ্যাসগুলি পরবর্তিকালে কাজে লাগিবে তাহা সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে অর্জন করা উচিত। সমানে সমানে সকল খেলা এবং স্কুলের প্রতিযোগিতা ভালো জমে। স্কুলে যে সুনাম বা প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহা সে অর্জন করে নিজের চেষ্টায়। সে সকলের প্রশংসা লাভ করিতে পারে অথবা সকলের ঘৃণার পাত্রও হইতে পারে; ইহা নির্ভর করে তাহার চরিত্র ও শক্তির উপর। স্নেহশীল পিতামাতা সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়া আদুরে গোপাল সৃষ্টি করেন, এইরূপ ক্ষেত্রে ছেলে আত্মশক্তি প্রকাশে বিশেষ উৎসাহিত হয় না; সন্তানের প্রতি স্নেহশীল পিতামাতা এমন কঠোর পরিবেশ সৃষ্টি করেন যেখানে শিশুর স্বতঃপ্রবৃত্ততা রুদ্ধ হইয়া যায়। কাজেই দেখা যায় অতিরিক্ত স্নেহ প্রদর্শনের ফলে যে সব শিশুর কর্মশক্তি লোপ পায়, অতিরিক্ত কঠোরতার ফলেও তেমনই তাহার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কাজের উৎসাহ ও উদ্যম নষ্ট হইয়া যায়। সমবয়সীরাই কেবল মুক্ত প্রতিযোগিতায় এবং সমানভাবে সহযোগিতার ভিতর দিয়া শিশুদের কাজে স্বতস্ফূর্ত আনিতে পারে। স্বেচ্ছাচারিতা না দেখাইয়াও কিভাবে আত্মসম্মান বজায় রাখা যায়, হীনতা প্রকাশ না করিয়া কিভাবে অন্যের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা যায় সমবয়সীদের সঙ্গে আচরণের মাধ্যমেই তাহা ভালোভাবে শিক্ষা করা যায়। এই জন্য শিশুরা ভালো স্কুলে সদাচরণ শিক্ষার যে সুবিধা পায় পিতামাতা হাজার চেষ্টা করিয়াও বাড়িতে তাহা দিতে পারেন না।

শিশু ও কিশোরের জীবনে সমবয়সীদের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলা হইল। আরও কয়েকটি কারণে তাহাদের সঙ্গলাভ একান্ত আবশ্যক। শিশুর দেহ ও মনের সুস্থ বিকাশের জন্য খেলা অত্যাবশ্যক কিন্তু প্রথম বৎসরের পর শিশু অন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে না হইলে খেলিয়া আনন্দ পায় না। খেলিতে না পাইলে শিশু হয় দুর্বল; জীবনের আনন্দের আস্বাদ সে পায় না। আনন্দই শিশুর জীবন রসায়ন। ইহা হইতে বঞ্চিত হওয়ায় তাহার মনে উৎকণ্ঠা বাড়িয়া উঠিতে থাকে। অবশ্য শিশুকে তিন বৎসর বয়স হইতেই একটি বিদেশি ভাষা শিকাইতে আরম্ভ করিয়া সকল প্রকার বাল্যসুলভ চপলতা হইতে দূরে সরাইয়া রাখা যায়, যেমন ঘটিয়াছিল জন স্টুয়ার্ট মিলের জীবনে। কেবল জ্ঞানসঞ্চয় দিক হইতে বিবেচনা করিলে ইহার ফল ভালই হয় বলিতে হইবে কিন্তু সকল দিক বিবেচনা করিয়া এই প্রণালীর প্রশংসা করা যায় না। মিল তাহার আত্মজীবনীতে বলিয়াছেন– কৈশোরের একসময়ে তাহার মনে দারুণ উৎকণ্ঠা উপস্থিত হইয়াছিল এই ভাবিয়া যে, নানা সুরের সংমিশ্রণ কোনো না কোনো সময় শেষ হইয়া যাইবে; তখন তো আর নূতন গান রচনা করা চলিবে না। এই দুশ্চিন্তায় তিন আত্মহত্যা করার উপক্রম করিয়াছিলেন। ইহা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এই ধরনের মানসিক আলোড়ন স্নায়বিক দুর্বলতারই পরিচায়ক। মিলের পিতাও একজন বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন কিন্তু পিতার দার্শনিক মত যে কোথাও ভুল হইতে পারে পুত্র তাহা চিন্তাই করিতে পারিতেন না। তাঁহার মানসিক দাস্যতা এইভাবে তাঁহার বিচার-শক্তির মূল্য অনেক হ্রাস করিয়া দিয়াছিল। সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়া যৌবনে উপনীত হইলে হয়তো মিল আরও বেশি সতেজ বুদ্ধি ও অধিকতর মৌলিকতার অধিকারী হইতেন। আর যাহাই হউক, জীবন উপভোগ করার শক্তি তিনি নিশ্চয় অনেক বেশিমাত্রায় লাভ করিতে পারিতেন। আমি নিজেও ষোলো বৎসর বয়স পর্যন্ত সমবয়সীদের সঙ্গ ও সাধারণ আনন্দ হইতে বঞ্চিত হইয়া নিঃসঙ্গভাবে লালিত হইয়াছিলাম। মিল যেইরূপ বর্ননা করিয়াছেন, কৈশোরে আমারও ঠিক ওইরূপ অবস্থা মনে আসায় আমিও আত্মহত্যার ইচ্ছা করিয়াছিলাম। আমার মনে হইয়াছিল–গতিবিজ্ঞানের নিয়মানুসারে দেহ চালিত হইতেছে, ইচ্ছা বলিয়া কোনো কিছু নাই; ইহা নিছক ভ্রান্তিমাত্র। এই চিন্তা দুশ্চিন্তার আকার ধারণ করিয়া আমার আত্মহত্যার বাসনা জাগাইয়াছিল। পরে সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করার সময় বুঝিলাম, কাহারও সঙ্গে আমার মতের বনিবনা হয় না। আমার চিন্তা ও ভাবধারার পরিবর্তন হইয়াছে কি না, কতদূরেই বা আমি আগের মতোই আছি তাহা আমার পক্ষে বলা সম্ভবপর নয়।

সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশার স্বপক্ষে সব রকম যুক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, কতক বালক-বালিকাকে স্কুলে পাঠানো উচিত নয়। ব্যক্তি হিসেবে ইহাদের মধ্যে অসাধারণত্ব থাকিতে পারে। কোনো বালকের যদি দৈহিক দুর্বলতার সঙ্গে অস্বাভাবিক [Abnormal] মানসিক শক্তি থাকে তবে সে সাধারণ সঙ্গীদের সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলিতে নাও পারে; হয়তোবা সঙ্গীরা খেপাইয়া উত্ত্যক্ত করিয়া তাহাকে পাগল করিয়া দিতে পারে। অসাধারণ মানসিক শক্তি অনেক সময় পাগলামির পর্যায়ে পড়ে; এইরূপ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মনীষাসম্পন্ন বালকের জন্য পৃথক ব্যবস্থা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। প্রথমে বালকের অস্বাভাবিক অনুভূতিশীলতার কারণ অনুমান করিয়া ধৈর্য ও যত্নের সহিত ইহা নিরাময় করার চেষ্টা করিতে হইবে। বালক যাহাতে অত্যাচারিত না। হয় সেইদিকে বিশেষ লক্ষ রাখা আবশ্যক। আমার মনে হয় শৈশবে শিশুর শিক্ষার ত্রুটির মধ্যে ইহার কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। শৈশবে কুশিক্ষার ফলে পরিপাকক্রিয়ার ব্যাঘাত অথবা স্নায়ুর বিকলতা ঘটা অসম্ভব নয়। শৈশবে যথোপযুক্তভাবে এবং বিজ্ঞতার সহিত লালন-পালন করিলে অধিকাংশ শিশুই সুস্থ, সবল, স্বাভাবিকরূপে বাড়িয়া ওঠে; অন্য শিশুদের সঙ্গ তাহাদের দেহের এবং মনের শক্তিবিকাশে অনুকূল অবস্থাই সৃষ্টি করে। তবু খুব অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রম দেখা দিতে পারে, যেমন দেখা যায় প্রতিভাবানদের জীবেন। এইরূপ অবস্থায় অসাধারণ বালককে বরং স্কুলে না পাঠাইয়া নিরিবিলিতে আত্মবিকাশের বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া উচিত।

 ১১. স্নেহ ও মনোবেদনা

অনেকে মনে করিতে পারেন অকারণে আমি এ পর্যন্ত এ স্নেহ সম্বন্ধে কোনো কথা উল্লেখ করি নাই, অথচ শিশুর সুচরিত্রের ইহা একটি প্রধান উপাদান। ইহা স্বীকার্য যে, স্নেহ ও জ্ঞান যথাযোগ্য আচরণের জন্য একান্ত আবশ্যক কিন্তু উন্নতির শিক্ষার আলোচনা প্রসঙ্গে আমি স্নেহ বা ভালোবাসা সম্বন্ধে কিছুই বলি নাই, তাহার কারণ আছে। আমার উদ্দেশ্য এই যে শিশুকে যত্নের সঙ্গে উপযুক্ত শিক্ষা দিলে তাহার ফলস্বরূপ স্নেহপ্রীতি আপনা আপনি বিকাশ লাভ করিবে,সচেতন চেষ্টা দ্বারা জোর করিয়া শিশুর কাছ হইতে ইহা আদায় করার কোনো প্রয়োজন নাই। কি ধরনের স্নেহ বাঞ্ছনীয় এবং শিশুর ক্রমবিকাশের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে তাহার মন, প্রকৃতি কেমন থাকে তাহাও জানা দরকার। দশ-বারো বৎসর হইতে যৌবনাগম পর্যন্ত বালকের স্নেহপ্রীতি বিশেষ মোটেই থাকে না এবং প্রকৃতির উপর জোর করিয়াও কোনো লাভ নাই।

বয়স্ক ব্যক্তি সমবেদনা দেখানোর যতখানি সুযোগ পায় তরুণ কিশোর ততখানি পায় না, কারণ ইহা প্রকাশের ক্ষমতা তাহাদের কম; তাহা ব্যতীত অন্যের কথা বাদ দিয়া নিজেদের জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার চেষ্টাতেই তাহারা থাকে বিভোর। এইসব কারণে অল্প বয়সে শিশুর মধ্যে অকালে এই গুণগুলির বিকাশ ঘটাইবার চেষ্টা না করিয়া আমাদের বরং বয়স্ক ব্যক্তিকে সহানুভূতিশীল ও স্নেহপরায়ণ করিয়া গড়িবার চেষ্টা করা উচিত।

বালকের মনে স্নেহবিকাশের সমস্যা চরিত্রের শিক্ষার অন্যান্য সমস্যার মতোই বিজ্ঞানসম্মত; ইহা মনস্তাত্ত্বিক গতিবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। শিশুর কাছে কর্তব্য হিসেবে স্নেহ ভালোবাসার অস্তিত্ব নাই। পিতামাতাকে এবং ভাইবোনকে ভালোবাসা উচিত শিশুকে এ কথা বলা নিরর্থক। আদেশ করিলে বা উপদেশ দিলেই শিশু ভালোবাসিতে শুরু করিবে না। যে পিতামাতা সন্তানের ভালোবাসা চান, তাহাদিগকে নিজেদের আচরণ দ্বারা পুত্রকন্যার অন্তরে ইহার উদ্বোধন করিতে হইবে। সন্তানদিগকে এমন দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য দানের চেষ্টা করিতে হইবে যাহা স্বাভাবিকভাবে তাহাদের মনে জনক-জননীর প্রতি প্রীতির ভাব জাগায়।

.

অপত্য-স্নেহের স্বরূপ

শিশুদিগকে কখনই তাদের পিতামাতাকে ভালোবাসিতে আদেশ করা উচিত হইবে না; শুধু তাহাই নহে, এমন কিছু করা উচিত নহে যাহার উদ্দেশ্য একই, অর্থাৎ অপত্যস্নেহের প্রতিদানে পিতামাতার প্রতি সন্তানের প্রীতির বিকাশ। এইখানে অপত্যস্নেহের সঙ্গে যৌনভালবাসার পার্থক্য। যৌন ভালবাসার ব্যাপারে একপক্ষের আবেদনে (প্রতিদানে) অন্য পক্ষের সাড়া একান্ত আবশ্যক; ইহা স্বাভাবিক, জৈবিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই ইহার প্রয়োজন। কিন্তু অপত্যস্নেহের প্রতিদানে সন্তানের নিকট হইতে সাড়া পাওয়ার কোনো আবশ্যকতা নাই। বিশুদ্ধ অপত্যস্নেহ পিতামাতার মনে এমন একটি ভাব জাগ্রত করে যাহার ফলে তাহার সন্তানকে নিজেদের একটি (বাহ্য) পৃথকৃত অংশ বলিয়া মনে করেন। আপনার পায়ের বুড়া আঙুলের নিকট হইতে প্রতিদানের কৃতজ্ঞতা আশা করেন না। আমার মনে হয় অসভ্য বন্য রমণী তাহার সন্তানের প্রতি ঠিক এমনই ভাব পোষণ করে। সে যেমন নিজের মঙ্গল চায় তেমনি চায় সন্তানের মঙ্গল, বিশেষ করিয়া যতদিন শিশু নিতান্ত ছোট থাকে। নিজ দেহের যত্ন লওয়ার সময় যেমন সে আত্মত্যাগ [self-denial] করিতেছে বলিয়া ভাবে না, তেমনই সন্তানের যত্ন পরিচর্যা করার সময়ও সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ করা হইতেছে বলিয়া তাহার মনে হয় না; কাজেই কোনো প্রতিদানের আশা সে করে না। যতদিন শিশু অসহায় থাকে ততদিন সে যে জননীকে একান্তভাবে চাহে ইহাই জননীর স্নেহের প্রতিদান। পরে, সে যখন ক্রমে বাড়িয়া উঠে, জননীর স্নেহ কমিয়া আসে এবং সন্তানের উপর প্রতিদানে কোনো কিছুর দাবি বাড়িতে থাকে। জীবজন্তুর মধ্যে দেখা যায় সন্তান সাবালক হইলে অপত্যস্নেহ ফুরাইয়া যায়; জনক-জননী সন্তানের উপর কোনো দাবিও রাখে না কিন্তু মানুষের সমাজে, এমনকি আদিম মানুষের মধ্যেও, ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায়। পুত্র যখন সবল বলিষ্ঠ যোদ্ধাতে পরিণত হয় তখনও পিতামাতা কামনা করে যে তাহাদের বার্ধক্যে সে তাহাদিগকে ভরণ-পোষণ করিবে। মানুষের দূরদৃষ্টি বৃদ্ধির ফলে পিতামাতা অপত্যস্নেহ হইতেও কিছু লাভের আশা করিতে শুরু করে। বৃদ্ধ বয়সে তাহারা দুর্বল ও অক্ষম হইয়া পড়ে; সন্তানকে সস্নেহে পালন করার প্রতিদানে তাহারা বার্ধক্যে যত্ন ও সাহায্য আশা করে। ইহা হইতেই জনক-জননীর প্রতি সন্তানের কর্তব্যের মূলনীতির উৎপত্তি; মানুষের ধর্মশাস্ত্রেও এই নীতি স্থান পাইয়াছে। পরে ক্রমে যখন সুশৃঙ্খল শাসন-ব্যবস্থা গড়িয়া ওঠে এবং মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার ও ভোগ করিতে থাকে তখন বৃদ্ধ জনক-জননীর অসহায় ভাব অনেকটা কমিয়া আসে; নিজের সম্পত্তি থাকিলে তাহাদিগকে তো বয়স্ক সন্তানের উপর ভরণপোষণের জন্য নির্ভর করিতে হইবে না। মানুষ যখন ইহা সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে তখন পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যবোধও নীতি হিসাবে ক্রমে লোপ পায়। বর্তমান জগতে পঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক লোকও আশি বৎসরের বৃদ্ধ পিতামাতার উপর আর্থিক দিক দিয়া নির্ভরশীল হইতে পারে; কাজেই এখনও পিতার প্রতি সন্তানের ভালবাসার চেয়ে সন্তানের প্রতি পিতার স্নেহই প্রধান হইয়া রহিয়াছে। ইহা অবশ্য বিত্তশালী লোকদের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য। দিনমজুরদের জীবনে পিতাপুত্রের মধ্যে পূর্বের ভাবই এখনও বর্তমান আছে, তবে বৃদ্ধ বয়সে পেনশন বা ভাতার ব্যবস্থা থাকার ফলে এভাবও ক্রমে শিথিল হইয়া আসিতেছে। পিতামাতার প্রতি সন্তানের স্নেহ ক্রমে গুণের তালিকা হইতে বাদ পড়িতেছে কিন্তু সন্তানের প্রতি পিতামাতার স্নেহ শিশুর জীবনে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে।

পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের স্নেহের সম্পর্ক, কিন্তু মনঃসমীক্ষকগণ এ সম্বন্ধে কিছু নূতন তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন। তবে এইগুলি বিচারযোগ্য কি না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। পিতা বা মাতার প্রতি সন্তানের অত্যধিক অনুরক্তিকে ইহারা যৌনবাসনার নবরূপ প্রকাশ বলিয়া মনে করেন।

পিতা বা মাতার প্রতি অত্যধিক অনুরাগ : পিতা বা মাতার পক্ষে কোনো বয়স্ক সন্তানকে, এমনকি কিশোরকেও এমনভাবে আবৃত করিয়া রাখা উচিত নহে যাহাতে সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতে বা অনুভব করিতে না পারে। জনক বা জননীর ব্যক্তিত্ব যদি সন্তানের অপেক্ষা প্রবলতর হয় তবে এইরূপ সহজেই ঘটিতে পারে। দুই-একটি মনোবিকারগ্রস্ত রুগ্ন ব্যক্তির কথা বাদ দিলে আমি বিশ্বাস করি না যে, ছেলেদের মায়ের প্রতি এবং মেয়েদের পিতার প্রতি বিশেষ আকর্ষণের কোনো যৌনগত গূঢ় কারণ আছে। যেই স্থানে পিতামাতার অত্যধিক প্রভাব বিদ্যমান সেই স্থানে পিতা বা মাতা যিনিই সন্তানের ঘনিষ্ঠ সংস্রবে আসিবেন তাহার প্রভাবই বেশি অনুভূত হইবে; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জননীই সন্তানের পড়ে সন্তান পুত্র কি কন্যা তাহা বিচার করিয়া প্রভাবের মাত্রা কমবেশি হয় না। অবশ্য এমন হইতে পারে যে, কোনো মেয়ে তাহার জননীকে পছন্দ করে না এবং পিতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায় না; সে হয়তো মনে মনে পিতাকেই আদর্শরূপে কল্পনা করিয়া লইতে পারে। এইরূপ ক্ষেত্রে পিতা কিন্তু নিজে কন্যার মনে প্রভাব বিস্তার করেন না, কন্যা নিজেই পিতাকে কল্পনার রঙে ও মায়াস্বপ্নের মাধুর্যে মণ্ডিত করিয়া নিজের অন্তরে স্থাপিত করিয়াছে। একটি সুতা অবলম্বন করিয়া যেমন মিছরি দানা বাঁধিয়া উঠে, দেওয়ালের গায়ের একটি গোজার সঙ্গে যেমন জিনিস ঝুলইয়া রাখা যায়, তেমনই কোনো একটি খুঁটি অবলম্বন করিয়া মনের ভাব আদর্শরূপে গড়িয়া উঠে। খুঁটিটি ভাবের আরোপ-ক্ষেত্র মাত্র; ভাব বা আদর্শের প্রকৃতির সহিত ইহার কোনো সম্বন্ধ নাই। এই স্থানে পিতাকে ঘিরিয়া কন্যার মানসিক ভাব পল্লবিত হইয়া উঠিয়াছে মাত্র কিন্তু পিতা এইজন্য মোটেই দায়ী নহেন। যথায় পিতামাতারা অপরিমিত প্রভাব বিস্তার করিয়া সন্তানকে আচ্ছন্ন রাখেন তাহার অবস্থা স্বতন্ত্র।

কোনো বয়স্ক ব্যক্তি যদি শিশুর নিত্য সঙ্গিরূপে জীবন-বিকাশের প্রথম হইতে প্রভাব বিস্তার করিতে থাকেন তবে পরবর্তীকালেও সেই শিশুকে মানসিক দিক দিয়া দাসরূপে পরিণত করা তাহার পক্ষে সহজ। বয়স্ক ব্যক্তির বুদ্ধি, প্রক্ষোভ অথবা উভয় কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে অভিভূত হইয়া শিশু নিজের বয়স্ক জীবনেও নিজের সত্তাকে হারাইয়া ফেলিতে পারে। এইরূপ অবস্থায় সে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তির মানবদাসে পরিণত হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল এই বিষয়ে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁহার পিতার বুদ্ধিগত প্রভাব তাহার জীবনকে এমনভাবে আচ্ছন্ন। করিয়াছিল যে, পিতার চিন্তাধারায় যে কোথাও ভুল থাকিতে পারে তাহা তিনি ভাবিতেই পারিতেন না।

শৈশবে শিশুর পক্ষে অন্যের বুদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া কতকটা স্বাভাবিক; পিতামাতা বা শিক্ষক যে অভিমত পোষণ করেন ও প্রচার করেন তাহা হইতে মুক্ত থাকা বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষেও কঠিন, অবশ্য যদি অন্য কোনো উৎস হইতে বিরুদ্ধ মতবাদের স্রোত প্রবাহিত হইয়া তাহাদিগকে অন্যদিকে পরিচালিত করে, তাহা স্বতন্ত্র কথা। কাজেই ইহা বলা যাইতে পারে যে, লোকের পক্ষে অন্যের বুদ্ধিগত দাস্যতা বা প্রভাব অনুভব করা অস্বাভাবিক নয়; আমার মনে হয় ইহা নিবারণের উদ্দেশ্যে বিশেষ শিক্ষা দ্বারাই এই প্রভাব মুক্ত হওয়া যাইতে পারে; বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে পূর্বপুরুষদিগের চিন্তা ও ভাবধারাকে আঁকড়াইয়া থাকা বিপজ্জনক, কাজেই শিশুদিগকে পিতামাতার বুদ্ধিগত প্রভাবের দাসত্ব রক্ষা করা উচিত। এ সমস্যা বর্তমান আলোচনার বিষয়ীভূত নহে। বর্তমানে কেবল প্রক্ষোভ ও চিন্তার দাসত্ব আলোচনা করিব।

পিতামাতা সন্তানকে ভালবাসেন; ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু অপত্যস্নেহের প্রতিদানে তাহারা যখন পুত্র বা কন্যার নিকট হইতে প্রক্ষোভগত [Emotion] সাড়া কামনা করেন তখনই অন্যায় অস্বাভাবিকতার সূত্রপাত হয়। মনঃসমীক্ষকগণ এই অবস্থাকে বলেন ইডিপাস্ গুঢ়ৈয়া অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন যৌনবাসনার বিকৃত রূপ। জনক-জননীর সঙ্গে পুত্রকন্যার আচরণের মধ্যে যৌন কামনার কোনোরূপ প্রভাব আছে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না। অল্প কিছুক্ষণ পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে যে, বিশুদ্ধ অপত্যস্নেহ সন্তানের নিকট হইতে প্রক্ষোভগত প্রতিদান বা সাড়া কামনা করে না। সন্তান যদি খাদ্য ও প্রতিপালনের জন্য পিতামাতার উপর নির্ভর করে তবেই স্নেহ তৃপ্ত হয়। সন্তানের এই নির্ভরতা। যখন কমিয়া আসে, পিতামাতার স্নেহও কমিয়া আসে। প্রাণিজগতে ইহাই নিয়ম এবং ইতর প্রাণীর উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে ইহা সম্পূর্ণ সন্তোষজনক। দেখা যায়, ইতর প্রাণীর পিতামাতা সন্তানদিগকে খাওয়ায় ও শত্রুর হাত হইতে রক্ষা করে। সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে পিতামাতা উদাসীন হইয়া পড়ে, সন্তানগণ পিতামাতা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নিজেদের আহার সংস্থান ও যৌন সম্বন্ধ স্থাপনে চেষ্টিত হয়। ইতোমধ্যে তাহাদের পিতামাতা আবার সন্তানলাভের আয়োজন করিয়া থাকে। ইতর প্রাণিজগতে অপত্যস্নেহ এই সরল নিয়মের ধারা অনুসরণ করিয়া চলিতেছে। কিন্তু মানুষের এই প্রবৃত্তি এত সরলভাবে প্রকাশ পায় না। অসভ্য বর্বর মানবসমাজে দেখা যায়, পিতামাতা আশা করেন বার্ধক্যে অক্ষম হইলে তাহাদের বলিষ্ঠ সন্তানগণ তাহাদিগকে রক্ষা করিবে। সভ্য মানব সমাজে পিতামাতা কামনা করেন, উপার্জনশীল সন্তানগণ তাহাদের ভরণপোষণ করিবে। এই ভাবের কামনা হইতে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য কি তাহা নির্দিষ্ট হয় এবং তাহা পুত্র কন্যার বাঞ্ছিত গুণ বলিয়া বিবেচিত হইতে থাকে। এখানে অপত্যস্নেহ অপপ্রয়োগের দুইটি মূল মনোবিজ্ঞানসম্মত কারণের আলোচনা করিব।

প্রথম কারণ ঘটে যখন প্রবৃত্তি হইতে কিরূপ আনন্দ লাভ হইবে তাহা বুদ্ধি বুঝিতে পারে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, প্রবৃত্তি এখন সুখকর কাজেই প্রেরণা দেয় যাহার ফল জীবদেহের পক্ষে প্রয়োজনীয়, কিন্তু এ ফল সুখকর না-ও হইতে পারে। খাদ্য গ্রহণ সুখকর, কিন্তু পরিপাক ক্রিয়া সুখকর নহে, বিশেষ করিয়া যদি অজীর্ণ রোগ থাকে। যৌনমিলন সুখকর কিন্তু সন্তান প্রসব সুখকর নয়; ছোট শিশুর নির্ভরতা সুখকর কিন্তু বলিষ্ঠ বয়স্ক পুত্রের স্বাধীনতা সুখকর নয়। অসভ্য আদিম জননীর প্রকৃতিবিশিষ্ট রমণী অসহায় সন্তানকে স্তন্য দিয়া পালন করিতেই সর্বাপেক্ষা বেশি আনন্দ পায়, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুর অসহায় ভাব যখন কমিয়া আসে, মায়ের আনন্দও কমিতে থাকে। কাজেই আনন্দলাভের জন্যই সন্তানের অসহায় অবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার প্রবণতা দেখা দেয়; সন্তান যখন পিতামাতার স্নেহ-পরিচর্যা ও নির্দেশের আওতার বাহিরে চলিয়া যাইবে সে সময়কে ঠেকাইয়া রাখার চেষ্টাও স্বাভাবিকভাবে দেখা দেয়। মায়ের আঁচল-ধরা ছেলে এই ধরনের প্রচলিত কথার মধ্যে মাতৃহৃদয়ের এ কামনার প্রকাশ স্বীকৃত হইয়াছে। পুত্রগণকে বিদ্যালয়ে পাঠানো ব্যতীত তাহাদিগকে এই কু-প্রভাব হইতে মুক্ত রাখা অসম্ভব বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল। কন্যার বেলায় ইহাকে কু প্রভাব হইতে বিবেচনা করা হইত না; তাহাদিগকে অসহায় এবং অপরের উপর নির্ভরশীল করিয়া গড়িয়া তোলাই বাঞ্ছনীয় মনে হইত। আশা করা হইত যে, বিবাহের পূর্বে যে কন্যা মায়ের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করিত, বিবাহের পর সে স্বামীকেই একান্ত আশ্রয় বলিয়া মনে করিবে। কিন্তু কার্যত খুব কম ক্ষেত্রেই এইরূপ ঘটে। কেহই বুঝিতে পারে নাই যে, বালিকাকে যদি পরনির্ভরশীল করিয়া গড়িয়া তোলা হয় তবে সে স্বাভাবিকভাবে মাতার উপরই নির্ভর করিবে; ইহার ফলে তাহার পক্ষে কোনো পুরুষকে, একান্ত আপনার জন ও সঙ্গিরূপে গ্রহণ করা সম্ভব হইবে না, অথচ ইহাই সুখি দাম্পত্য-জীবনের মূল উপাদান।

দ্বিতীয় কারণটি ফ্রয়েডীয় মতবাদের কাছাকাছি আসে। যৌন ভালোবাসার কিছু উপাদান যখন অপত্যস্নেহের ভিতর প্রকাশ পায় তখনই ইহার উৎপত্তি। ইহার জন্য দুইজনের যে বিপরীত লিঙ্গ হইতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। এখানে কেবল কতকগুলি বাসনা ক্রিয়া করিতেছে। যৌন মনোবিজ্ঞানের যে অংশের ফলে মানবসমাজে এক বিবাহ সম্ভবপর হইয়াছে তাহা মানুষের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে সে, পৃথিবীতে অন্তত একজন লোকের সুখবিধানের জন্য সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় এবং একান্ত বাঞ্ছিত ব্যক্তি। যেখানে দাম্পত্যজীবনে এই ভাবটি প্রবল সেখানে অন্য কতকগুলি বিষয় অনুকূল থাকিলে স্বামী-স্ত্রীর জীবন সুখবহ হয়। কোনো না কোনো কারণে সভ্যজগতে বহু বিবাহিত স্ত্রীলোকের যৌনজীবন অতৃপ্ত থাকে। এরূপ রমণীর পক্ষে নিজের সন্তানদের নিকট হইতে অবৈধ ও কৃত্রিম উপায়ে যৌন কামনা চরিতার্থ করার বাসনা জাগ্রত হইতে পারে, যে কামনা শুধু পুরুষই যথেষ্টভাবে এবং স্বাভাবিকভাবে পরিতৃপ্ত করিতে পারে। আমি স্পষ্টত কিছু বুঝাইতেছি না; সন্তানের প্রতি মাতার আচরণে প্রক্ষোভগত আলোড়ন, কতক ভাবের তীব্রতা, চুম্বন ও আলিঙ্গনে আনন্দলাভের জন্য চুম্বন ও আলিঙ্গনের আতিশয্যের কথা বলিতেছি। স্নেহশীলা জননীর নিকট ইহা ন্যায়সঙ্গত বলিয়াই বিবেচিত হইত। বস্তুত, কি ন্যায়সঙ্গত এবং কি ক্ষতিকর তাহার পার্থক্য বড়ই সূক্ষ্ম। ফ্রয়েডীয় মতবাদের কতক সমর্থক মনে করেন যে পিতামাতার পক্ষে সন্তানকে চুম্বন করা এবং কোলে করিয়া আদর করা উচিত নহে; ইহা মোটেই সমর্থন করা চল না। পিতামাতার আন্তরিক স্নেহ-প্রীতিতে সন্তানের অধিকার আছে : ইহা তাহাদের জীবনের প্রতি আনন্দোজ্জ্বল দৃষ্টিভঙ্গি দান করে, মনের স্বাস্থ্য বিকাশের পক্ষেও ইহা একান্ত আবশ্যক। কিন্তু পিতামাতার এই স্নেহ সম্বন্ধে এমন ধারণা হওয়া দরকার যেন সে আকাশ ভরা আলো বাতাসের মতোই ইহা গ্রহণ করিতে শেখে, ইহার জন্য কোনো প্রতিদান দিবার চিন্তা যেন তাহার মনে না আসে। সাড়া দেওয়ার প্রশ্নটিই এই স্থানে আসল। স্নেহের প্রতিদানে শিশুর নিকট হইতে কতকগুলি স্বতঃপ্রবৃত্ত সাড়া পাওয়া যাইবে। ইহা সবই কাম্য। কিন্তু ইহা হইবে বালকবৎ সঙ্গীদের বন্ধুত্বের কামনা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক পিতামাতার বিশুদ্ধ স্নেহ পুষ্ট সন্তান স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া যে সাড়া দেয় তাহা দূষণীয় নয় কিন্তু মানসিক ভেঁপোমির ফলে সে যখন পিতা বা মাতার বন্ধুত্ব কামনা করে তখনই অস্বাভাবিক অবস্থার উদ্ভব হয়। মনস্তত্ত্বের দিক দিয়া পিতামাতা হইবেন শিশুর জীবনচিত্রের পটভূমি; তাহাদিগকে আনন্দ দেওয়ার জন্য শিশুকে সক্রিয়ভাবে কোনো কিছু করিতে উদ্বুদ্ধ বা প্ররোচিত করা উচিত হইবে না। তাহার বুদ্ধি ও উন্নতিতেই পিতামাতার আনন্দ; সে স্বেচ্ছায় কোনো সাড়া দিলে তাহা পিতামাতা অতিরিক্ত বিশুদ্ধ লাভ হিসাবে গ্রহণ করিবেন, যেন বসন্তকালে চমৎকার আবহাওয়া; কিন্তু এইরূপ সাড়া কাম্য প্রাপ্য বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত নয়।

কোনো স্ত্রীলোক যদি যৌন ব্যাপারে পরিতৃপ্ত না হন তবে তাহার পক্ষে আদর্শ জননী হওয়া কিংবা ছোট ছোট শিশুদের আদর্শ শিক্ষিকা হওয়া অত্যন্ত কঠিন। মনঃসমীক্ষকগণ যাহাই বলুন না কেন, অপত্যস্নেহ যৌন প্রবৃত্তি হইতে মূলত পৃথক; যৌন বাসনা-উদ্ভূত প্রক্ষোভ ইহাকে ঘোলাইয়া তোলে। মনস্তত্ত্বের বিচারে কুমারী স্ত্রীলোকদিগকে শিক্ষকতা কার্যে নিযুক্ত করা সম্পূর্ণ ভুল। শিক্ষকদের শিক্ষকতার জন্য এমন মহিলাই যোগ্য যিনি তাহাদের নিকট হইতে নিজের প্রবৃত্তির পরিতৃপ্ত কামনা করিবেন না। বিবাহিত জীবনে সুখি স্ত্রীলোক বিনা চেষ্টাতেই এ পর্যায়ে পড়িবেন কিন্তু অন্য স্ত্রীলোকের পক্ষে এজন্য অসাধারণ আত্মসংযমের প্রয়োজন হইবে। অবশ্য একই অবস্থায় পুরুষের পক্ষেও ঠিক এই কথাই খাটে; কিন্তু পুরুষের বেলায় এরূপ ঘটনার সম্ভাবনা অনেক কম এই জন্য যে, তাহাদের অপত্যস্নেহ সাধারণত খুব বেশি প্রবল নয় এবং খুব কম পুরুষেরই যৌনক্ষুধা অপরিতৃপ্ত থাকে।

পিতামাতার প্রতি সন্তানের আচরণ: শিশুদের নিকট হইতে কিরূপ আচরণ প্রত্যাশা করি সে সম্বন্ধেও আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। সন্তানের প্রতি জনক-জননীর স্নেহ যদি যথাযথ হয় তাহাদের আচরণও অনুরূপ হইবে। পিতামাতাকে দেখিলে সে খুশি হইবে, অন্য কোনো আনন্দপ্রদ খেলা বা কাজে লিপ্ত না থাকিলে তাহাদের অনুপস্থিতিতে দুঃখিত হইবে; দৈহিক বা মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিলে তাহাদের সাহায্য কামনা করিবে; দুঃসাহসিক কাজে তাহাদের উদ্যম আসিবে কেননা তাহারা উপলব্ধি করিবে পিতামাতার অফুরন্ত স্নেহ, এবং তাহাদের রক্ষার জন্য কল্যাণশক্তি সর্বদা তাহাদের জন্য সঞ্চিত রহিয়াছে যদিও প্রকৃত বিপদের সময় ছাড়া শিশুর মনে এ চিন্তা আসিবে না। তাহারা আশা করিবে, পিতামাতা তাহাদের প্রশ্নের উত্তর দিবেন, তাহাদের জটিল সমস্যার সমাধান করিয়া দিবেন এবং কঠিন কাজে সাহায্য করিবেন। সন্তানগণ পিতামাতার নিকট হইতে খাদ্য ও আশ্রয় পায় ইহা চিন্তা করিয়া তাহারা জনক-জননীকে ভালবাসিবেন না; পিতামাতার কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়া এবং সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা শিশুদের স্বভাব নয়। তাহাদের সঙ্গে খেলিলে, তাহাদিগকে নূতন জিনিস দেখাইলে, তাহাদিগকে বিচিত্র পৃথিবীর গল্প শুনাইলে তাহারা পিতামাতাকে বেশি পছন্দ করিবে। তাহারা ক্রমে উপলব্ধি করিবে যে, তাহাদের উপর পিতামাতার স্নেহ বিদ্যমান রহিয়াছে, পৃথিবীর উপর যেমন চন্দ্ৰসূর্যের কিরণ বর্ষিত হয় জনক জননীর স্নেহও দ্রুপ স্বাভাবিকভাবে বর্ষিত হইতেছে এই ধারণা সন্তানদের মনে আসা উচিত। পিতা-মাতার প্রতি তাহাদের ভালোবাসা অপর শিশুদের প্রতি ভালোবাসা হইতে পৃথক প্রকৃতির হইবে। পিতামাতা সন্তানকে পুরোভাগে রাখিয়া তাহার মঙ্গলের জন্য কাজ করিবেন, শিশুর কাজ হইবে আত্মবিকাশ ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা। এখানেই আসল পার্থক্য। পিতামাতার প্রতি শিশুর করণীয় বিশেষ কিছু নাই। জ্ঞানে, স্বাস্থ্যে ক্রমে পুষ্ট হইয়া ওঠাই তাহার কাজ এবং ইহা দ্বারাই পিতৃমাতৃহৃদয়ের অপত্যস্নেহ প্রবৃত্তি পরিতৃপ্তি লাভ করে।

কেহ যেন মনে না করেন যে আমি পারিবারিক জীবনে স্নেহ এবং ইহাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কমাইবার পক্ষপাতী। তাহা মোটেই নহে। আমি যাহা বলিতে চাই তাহা এই যে, বিভিন্ন প্রকারের স্নেহ আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্নেহ এক প্রকার, সন্তানের প্রতি পিতামাতার স্নেহ অন্য প্রকার, পিতামাতার প্রতি সন্তানের স্নেহ আবার অন্য আর এক প্রকার। ক্ষতি তখনই সাধিত হয় যখন বিভিন্ন প্রকার স্নেহ তালগোল পাকাইয়া ফেলা হয়। ফ্রয়েডীয়গণ এ সম্বন্ধে যে সত্য সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন তাহা আমি বিশ্বাস করি না, কারণ তাঁহারা বিভিন্ন স্নেহের প্রবৃত্তিগত পার্থক্য স্বীকার করেন না। ইহার ফলে পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে আচরণেও ইহারা বাধা নিষেধের কড়াকড়ি আরোপ করেন। কেননা তাহাদের মতে জনক-জননী ও সন্তানের মধ্যে যে স্নেহ বিদ্যমান তাহা প্রচ্ছন্নভাবে যৌন ভালোবাসারই নামান্তর। বিশেষ কোনো দুর্ভাগ্যসূচক ক্ষেত্র ব্যতীত আমি এরূপ স্নেহচ্ছতার সমর্থক নহি। যে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসেন এবং সন্তানদিগকে স্নেহ করেন তাঁহারা নিজেদের হৃদয়বৃত্তির নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করিতে পারিবেন। সন্তানের মঙ্গলের জন্য যথেষ্ট চিন্তা ও জ্ঞানের প্রয়োজন হইবে কিন্তু এইগুলি অপত্যস্নেহের ভিতর দিয়াই তাহারা লাভ করিতে সক্ষম হইবেন। পরস্পরের নিকট হইতে তাহারা যাহা পান, তাহা সন্তানের নিকট হইতে কামনা করা তাঁহাদের পক্ষে কখনই সমীচীন হইবে না; তাঁহারা যদি পরস্পরকে ভালবাসিয়া সুখি হন তবে সন্তানের স্নেহ লাভের আকাঙ্ক্ষা তাহাদের মনে জাগ্রতই হইবে না। আবার পুত্রকন্যা যদি যথোচিত যত্নের সঙ্গে লালিত-পালিত হয়, পিতামাতার প্রতি তাহাদের স্নেহ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রকাশ পাইবে, তাহাদের স্বাধীনতার কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিবে না। সন্তানের প্রতি যথোপযুক্ত আচরণ করিতে পিতামাতার আত্ম-কৃচ্ছতার প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন হইল জ্ঞান বুদ্ধিদীপ্ত অপত্যস্নেহের সম্প্রসারণের।

আমার পুত্রের বয়স যখন দুই বৎসর চার মাস তখন আমি আমেরিকায় যাইয়া তিন মাস ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে সে বেশ সুখিই ছিল কিন্তু ফিরিলে আনন্দে আত্মহারা হইয়া উঠিয়াছিল। আমার জন্য সে অধীরভাবে বাগানের প্রবেশ পথে অপেক্ষা করিতেছিল : আমার হাত ধরিয়া সে ঘুরিয়া এটা-সেটা দেখাইতে লাগিল। আমি তাহার কথা শুনিতে চাহিতেছিলাম, সে-ও বলিতে চাহিতেছিল; আমার কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না, তাহারও শোনার ইচ্ছা ছিল না। আবেগ বিপরীতমুখি হইলেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। যখন গল্প বলার কথা উঠে, সে শুনিতে চায়, আমি বলিতে চাই। এখানেও সামঞ্জস্য রহিয়াছে। শুধু একবার এই অবস্থার ব্যতিক্রম ঘটিয়াছিল। তাহার তিন বৎসর ছয় মাস বয়সের সময় আমার জন্মদিন করিয়াছিল। তাহার মায়ের নিকট সে শুনিয়াছিল যে, সেইদিন আমায় খুশি করার জন্যই সব কিছু করিতে হইবে। গল্প শোনা ছিল তাহার কাছে সবচেয়ে আনন্দদায়ক। সেইদিন উৎসবের সময় সে বলিল যে আমাকে গল্প শুনাইবে। আনন্দের ব্যাপার শুরু হইল। সে কোলে বসিয়া পর পর গোটা বারো গল্প শুনাইল, তাহার পর আজকে আর নয় এই বলিয়া লাফ দিয়া নামিয়া গেল। ইহার পর অনেকদিন পর্যন্ত সে আর গল্প শুনাইতে আসে নাই।

আমি এখন সাধারণভাবে স্নেহ ও সমবেদনা সম্বন্ধে আলোচনা করিব। পিতামাতা ও সন্তানের প্রীতি সম্পর্কের মধ্যে জটিলতার উদ্ভব হইতে পারে; কেননা জনক-জননী কর্তৃক অপত্যস্নেহের অপব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। এইজন্যই প্রথম অপত্যস্নেহের স্বরূপ কি তাহা আলোচনা করা হইল।

সমবেদনা : শিশুকে জোর করিয়া স্নেহ প্রকাশ করা বা সমবেদনা বোধ করা অভ্যাস করানো যায় না। ইহার একমাত্র উপায় হইল কিরূপ অবস্থায় এই ভাবগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগ্রত হয় তাহা লক্ষ্য করা এবং তাহার পর ওইরূপ অবস্থা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করা। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে, সমবেদনা কতকটা সহজাত। শিশুগণ তাহাদের ভ্রাতাভগিনীদের কাঁদিতে দেখিয়া উৎকণ্ঠিত হয় এবং নিজেরাও কাঁদিতে শুরু করে। ভ্রাতাভগিনীদের উপর কস্টদায়ক কোনো আচরণ করিতে দেখিলে তাহারা তাহাদের পক্ষ সমর্থন করিয়া বড়দের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। আমার পুত্রের কনুইতে ঘা হইয়াছিল। ব্যান্ডেজ করিয়া দেওয়ার সময় সে চিৎকার করিতেছিল। সংলগ্ন ঘর হইতে তাহার কনিষ্ঠ ভগিনী (বয়স আঠারো মাস) কান্না শুনিয়া আকুল হইয়া ওঠে এবং যতক্ষণ কান্না থাকে ততক্ষণ বারংবার বলিতে থাকে খোকন কাঁদছে, খোকন কাঁদছে। অন্য একদিন তাহার পায়ে কাঁটা ফুটিয়াছিল; তাহার মা সূঁচ দিয়া তাহা বাহির করিয়া দিতেছিলেন। খোকন উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এতে লাগে না তো, মা? এইসব ব্যাপারে যে একটু কষ্ট সহ্য করিতে হয়, হইচই করিতে হয় না তাহা শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাহার মা বলিলেন, হ্যাঁ লাগেই তো। খোকন বারে বারে জেদ করিতে লাগিল যে, কাঁটা বাহির করিতে ব্যথা লাগে না; তাহার মা বারে বারেই বলিতে লাগিলেন ব্যথা লাগে। অবশেষে খোকন ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল, যেন তাহার নিজের পায়ের কাঁটা বাহির করা হইতেছে। এইরূপ ঘটনা সহজাত দৈহিক সমবেদনাবোধ হইতে ঘটে। ইহাকে ভিত্তি করিয়াই আরও ব্যাপক সমবেদনাবোধ জাগ্রত করা সম্ভবপর। এইজন্য তাহাদিগকে উপলব্ধি করাইতে হইবে যে, মানুষ এবং অপরাপর জীবজন্তুও দুঃখ কষ্ট বোধ করিতে হইবে; শিশু যাঁহাকে শ্রদ্ধা করে তাঁহাকে যেন সে নির্দয় ব্যবহার বা কোনো নিষ্ঠুর কাজ করিতে না দেখে। পিতা যদি গুলি করিয়া পক্ষী হত্যা করেন মারেন এবং মা যদি পরিচারিকার প্রতি রূঢ় ব্যবহার করেন তবে শিশুর মধ্যেও দোষগুলি সংক্রামিত হইবে।

অন্যায় অত্যাচার সম্বন্ধে জ্ঞান : কখন এবং কিভাবে শিশুকে জগতে প্রচলিত অন্যায়, অনাচারের সঙ্গে পরিচিত করানো যায় তাহা একটি কঠিন প্রশ্ন। যুদ্ধ, অত্যাচার, দারিদ্র্য এবং প্রতিষেধক রোগ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকা শিশুদের পক্ষে অসম্ভব। কোনো-না কোনো স্তরে (অবস্থায়) শিশুকে এইসব বিষয় জানিতেই হইবে এবং জ্ঞানের সঙ্গে তাহার দৃঢ় বিশ্বাস গড়িয়া উঠা আবশ্যক যে, যে-দুঃখ হইতে পরিত্রাণ সম্ভবপর তাহা ঘটানো বা ঘটিতে দেওয়া কখনই উচিত নয়। যে সকল লোক স্ত্রীজাতির সতীত্ব রক্ষা করিতে চান তাহাদের যে সমস্যা, শিশুর মনকে অন্যায়, অত্যাচার, দুঃখদহনের বিরুদ্ধে জাগ্রত করিতে চান যাহারা তাহাদের সমস্যাও একইরূপ। পূর্বে স্ত্রীলোকের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ মনে করিতেন বালিকাদিগকে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত যৌন বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রাখাই ইহার প্রধান উপায়; কিন্তু এখন অজ্ঞতা জিয়াইয়া রাখার পরিবর্তে উপযুক্ত জ্ঞানদানের পন্থা গ্রহণ করা হয়।

আমি কতক শান্তিবাদী লোকের কথা জানি, তাহারা মনে করেন যুদ্ধের কথা বাদ দিয়া ইতিহাস পড়ানো উচিত; যতদিন সম্ভব শিশুদিগকে জগতের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে অজ্ঞ রাখাই তাহাদের কামনা। কিন্তু আমি জ্ঞানের অভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত এই ধরনের কাঁচের ঘরে আড়াল করিয়া রাখা গুণের প্রশংসা করিতে পারি না। যখনই ইতিহাস পড়ানো হইবে, সত্য কাহিনীই পড়ানো উচিত। আমরা যে নীতি উপদেশ প্রচার করিতে চাই ঐতিহাসিক ঘটনা যদি তাহার প্রতিকূল হয় তবে বুঝিতে হইবে সে নীতিই ভ্রান্ত এবং উহা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়। ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে অনেকে, এমনকি অনেক ধার্মিক ব্যক্তিও সত্য ঘটনাকে তাঁহাদের মতের পক্ষে অসুবিধাজনক বোধ করেন; ইহা তাহাদের আদর্শের কিছুটা দুর্বলতারই পরিচায়ক। সত্যকারের বলিষ্ঠ নীতিজগতে বাস্তব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ইহা দ্বারাই পুষ্ট। শিশুদিগকে অজ্ঞতার মধ্যে গড়িয়া তুলিলে এই ফল হইতে পারে যে, তাহারা পরে যখন অন্যায়, অনাচার বা কদাচারের সন্তান পাইবে তখন তাহার মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারে। এইরূপ ঝুঁকি লওয়া উচিত নহে। নিষ্ঠুরতার প্রতি তাহাদের বিতৃষ্ণা বা বিরূপ মনোভাব জাগাইতে না পারিলে ইহা হইতে শিশুদিগকে নিবৃত্ত করা কঠিন; সমাজে নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান আছে তাহা না জানিলেই বা ইহার প্রতি তাঁহাদের বিরাগ জাগ্রত হইবে কিরূপে?

কিন্তু অন্যায় অত্যাচার সম্বন্ধে শিশুকে ওয়াকিবহাল করার সহজ উপায়টি বাহির করা বড় সহজ নয়। অবশ্য বড় শহরের বস্তিতে যাহারা বাস করে তাহারা মদ্যপানের ফলে মাতলামি, ঝগড়া, মারামারি, স্ত্রীকে প্রহার করা ও এই জাতীয় অনেক প্রকার অনাচার, অত্যাচার দেখিতে পায়, ইহা তাহাদের উপর খুব গভীর প্রভাব বিস্তার করে না। কিন্তু কোনো যত্নশীল পিতা সন্তানকে এইরূপ দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত করাইতে চাহিবেন না। ইহার প্রধান কারণ এই যে, এইসব বীভৎস দৃশ্য শিশুমনে দারুণ ভীতি উৎপাদন করিয়া তাহার সমগ্র জীবনের উপরই গভীর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। অসহায় শিশু যখন প্রথম বুঝিতে পারে যে, শিশুদের উপরও নিষ্ঠুর অত্যাচার হওয়া অসম্ভব নয় তখন সে ভীত না হইয়া পারে না। আমার বয়স যখন চৌদ্দ বৎসর তখন আমি প্রথম ওলিভার-টুইস্ট [Oliver Twist] পড়ি; ইহা আমার মনে এমন ভীতি সঞ্চার করিয়াছিল যে, ইহা অপেক্ষা কম বয়সে পড়িলে আমি হয়তো সহ্যই করিতে পারিতাম না। কিছুটা বয়স বেশি হওয়ার ফলে শিশুর মনে সাহস না জন্মানো পর্যন্ত তাহাকে ভয়ঙ্কর বা ভীতি উৎপাদক কিছু না জানানই ভালো। এইরূপ মানসিক ধৈর্য কোনো শিশুর আগে আসে, কাহারও বা অন্যের তুলনায় পরে আসে। ভীরু বা কল্পনাপ্রবণ শিশুদের মনে ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য যেমন সহজে এবং গভীরভাবে রেখাপাত করিতে পারে, স্বাভাবিক সাহস সম্পন্ন অথবা শিশুদের মনে তেমন সহজে পারে না। শিশু যদি জানে যে তাহার পিতামাতার কল্যাণদৃষ্টি সর্বদা তাহার উপর নিবদ্ধ আছে এবং বিপদে তাহার ভয়ের কোনো কারণ নাই তবে স্বাভাবিকভাবে তাহার মনে নির্ভীকতার ভাব গড়িয়া উঠিবে। ইহা গড়িয়া না উঠা পর্যন্ত শিশুকে বাস্তব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পরিচিত করানো উচিত নয়। কখন এবং কিভাবে এই পরিচয় সাধন করিতে হইবে সে সম্বন্ধে বাধাধরা কোনো নিয়ম নাই; এই বিষয়ে অভিভাবকের দক্ষতা এবং বিচার-বুদ্ধির প্রয়োজন।

শিশুকে নিষ্ঠুরতার সহিত পরিচিত করাইবার উপায় : এ সম্বন্ধে যে কতকগুলি সাধারণ নীতি আছে তাহা পালন করা উচিত। অবাস্তব কাহিনী যেমন, ব্লু বিয়ার্ড ও দানবহত্যাকারী জ্যাকের গল্প, শিশুর মনে সত্যিকারের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে কোনো ভাব জাগায় না। সে এগুলিকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক উদ্ভট মনে করে, বাস্তব জীবনে যে ইহাদের অস্তি আছে তাহা সে মনে করে না। শিশুর ভিতরকার আদিম বন্য-প্রবৃত্তি নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনিয়া পরিতৃপ্ত হয় বলিয়াই সে আনন্দ লাভ করে; এই প্রবৃত্তি নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনিয়া খেলার আবেগরূপে প্রকাশ পায় বলিয়া ইহা দ্বারা কোনো ক্ষতি সাধিত হয় না। শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ প্রবৃত্তিও কমিয়া আসে।

শিশুকে যখন বাস্তব নিষ্ঠুরতার সহিত প্রথম পরিচিত করানো হয় তখন বিশেষ যত্নসহকারে এমন সমস্ত ঘটনার কাহিনী নির্বাচন করা উচিত যাহাতে সে অত্যাচারীর পক্ষ সমর্থন না করিয়া নিজেকে নির্যাতিতের দলে মনে করিবে। কোনো গল্পে বর্ণিত অত্যাচারীর সঙ্গে নিজেকে মনে মনে মিশাইয়া দিতে পারিলে শিশুর ভিতরকার বর্বর মানুষটি উল্লসিত হয়। এই ধরনের গল্প শিশুকে সাম্রাজ্যবাদীরূপে গড়িয়া উঠিতে সাহায্য করে। কিন্তু আব্রাহাম কেমন করিয়া আইজ্যাককে বলি দেওয়ার আয়োজন করিয়াছিল অথবা এলিসা কর্তৃক অভিশপ্ত শিশুদিগকে স্ত্রী-ভালুক কেমন করিয়া হত্যা করিয়াছিল এই কাহিনী স্বাভাবিকভাবেই শিশুর মনে নির্যাতিত শিশুর প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। এইসব গল্প যদি বলা হয়, তবে এমনভাবে বলিতে হইবে যেন শিশুরা বুঝিতে পারে বহু যুগ আগে মানুষ কতখানি নিষ্ঠুরতার কাজ করিতে পারিত। বাল্যকালে একবার আমি এক ধর্মযাজককে প্রায় একঘণ্টা ধরিয়া বক্তৃতা করিতে শুনিয়াছিলাম। তিনি প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিলেন যে এলিসা শিশুদিগকে অভিসম্পাত করিয়া ঠিক কাজই করিয়াছিলেন। সৌভাগ্যবশত আমার বয়স কিছু বেশি থাকায় সে ধর্মযাজককে আমি নেহাত নির্বোধ বলিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলাম, নতুবা ভয়ে হয়তো আমি অভিভূত হইয়া পড়িতাম। আব্রাহাম ও এলিসা নিষ্ঠুরতার কাজ করিয়া ধর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়াছিলেন, গল্পের মারফত ইহাই যদি প্রমাণ করিতে চেষ্টা করা হয় তবে এগুলি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা উচিত। নতুবা ইহা শিশুর নীতিজ্ঞানের মান নিকৃষ্ট করিয়া ফেলিবে। কিন্তু এইগুলি যদি মানুষের অন্যায় অত্যাচারের ভূমিকারূপে বিবৃত হয় তবে ইহা হইতে বাঞ্ছিত ফল পাওয়া সম্ভব, কারণ কাহিনী হিসাবে এইগুলি জীবন্ত, বহু প্রাচীন এবং ভিত্তিহীন। কিং জন। [King John] পুস্তকে বর্ণিত গল্পে হিউবার্ট কিভাবে বালক আর্থারের চোখ তুলিয়া ফেলিয়াছিল সেই কাহিনীও এই প্রসঙ্গে বলা চলে।

তারপর যুদ্ধ বর্ণনাসহ ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের কাহিনী শুনাইলে প্রথমদিকে শিশুর সহানুভূতি পরাজিতের পক্ষে জাগ্রত করানো দরকার। আমি বরং প্রথমে এমন যুদ্ধের গল্প আরম্ভ করিতে চাই যেখানে শিশু স্বাভাবিকভাবে পরাজিতের প্রতিই সমবেদনা বোধ করিবে–যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইংরাজ বালককে প্রথমে হেস্টিংসের যুদ্ধ কাহিনী শুনাইবে। যুদ্ধের দরুন মানুষের যে দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি হয় তাহার উপরই বেশি জোর দিতে হইবে। পরে ক্রমে ক্রমে শিশুর এমন মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করিতে হইবে যেন সে যুদ্ধের কাহিনী পড়িবার সময় নিজেকে কোনো পক্ষভুক্ত মনে না করে; তাহার মনে যেন এই ধারণা জন্মে যে, উভয়পক্ষের লোকেরাই ছিল নির্বোধ; সাময়িকভাবে তাহাদের মেজাজ চটিয়া গিয়াছিল এবং তাহাদের এমন পরিচারিকার প্রয়োজন ছিল যাহারা তাহাদিগকে শান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিছানায় শোয়াইয়া রাখিতে পারিত। যুদ্ধকে আমি নার্সারি বা শিশুপালনাগারে শিশুদের ঝগড়ার সমপর্যায়ভুক্ত করিব। আমার বিশ্বাস, শিশুদিগকে এইভাবে যুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ জানানো যায়। ইহা যে নির্বুদ্ধিতার কাজ তখন তাহারা উপলব্ধি করিতে পারিবে।

শিশু যদি নির্দয় আচরণের কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ দেখিতে পায় তবে বয়স্ক ব্যক্তি তাহাকে সে সম্বন্ধে সকল কথা বুঝাইয়া বলিবেন; শিশু যেন মনে মনে এই ধারণা করে যে, নির্দয় ব্যক্তিগণ জীবনের প্রথম হইতে ভালভাবে শিক্ষা পায় নাই। বলিয়াই নিষ্ঠুর আচরণ করিয়া থাকে, তাহাদের হৃদয়ে কোমল সমবেদনা বোধ বিকাশ লাভ করিলে তাহারা এইরূপ আচরণ করিত না। কাল্পনিক গল্প ও ইতিহাসের গল্প শুনিয়া শিশুগণ নিষ্ঠুরতার সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। ইহার পূর্বে তাহাদিগকে কোনোরূপ সত্যকারের নৃশংসতার দৃশ্য দেখানো উচিত নহে। অবাস্তব কাল্পনিক কাহিনী, তাহার পর যুদ্ধবিগ্রহের ঐতিহাসিক গল্প এবং সর্বশেষ পারিপার্শ্বিক বাস্তব জীবনের ঘটনা সম্বন্ধে শিশুকে ধীরে ধীরে অবহিত করাইতে হইবে। সকল ক্ষেত্রেই শিশুর মনে এই অনুভূতি জাগানো আবশ্যক যে, অন্যায় অত্যাচার প্রতিরোধ করা সম্ভবপর এবং কেবল আত্মসংযমের অভাব ও অশিক্ষা হইতেই ইহার উদ্ভব। তাহার মনে অত্যাচারীর প্রতি ক্রোধের উদ্রেক করা উচিত নহে, সে বরং নির্দয় ব্যক্তিকে যেন মনে করে আনাড়ি অপদার্থ লোক যে জানে না কি কাজ করিলে সকলের প্রকৃত সুখ হইতে পারে।

শিশুর ভিতর সহানুভূতির সহজাত বীজ (সুপ্ত) রহিয়াছে; এই প্রবৃত্তিটির যথাযথ বিকাশ ঘটাইয়া ব্যাপক সমবেদনা বোধ জাগ্রত করা প্রধানত বুদ্ধিসুলভ ব্যাপার; ইহা করিতে হইলে যথার্থ দিকে শিশুর মনোযোগে চালিত করা আবশ্যক এবং যুদ্ধলিপ্ত ব্যক্তিগণ ও কর্তৃপক্ষ যে সকল ঘটনা গোপন করিতে চাহেন তাহা শিশুকে উপলব্ধি করানো দরকার। যেমন ধরুন, অস্টারলিজের যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে সকল দিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া যে বীভৎস দৃশ্য দেখিয়াছিলেন টলস্টয় তাহার বর্ণনা দিয়াছেন। যুদ্ধের ফলে উভয় পক্ষের লোক যে চরম দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হয় তাহার বিবরণ পাঠক ও শ্রোতার মনে বেদনাবোধ জাগ্রত করে। অধিকাংশ ইতিহাসেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থার বর্ণনা থাকে না; যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী বারো ঘণ্টায় যুদ্ধক্ষেত্রের কি শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহা যদি ঐতিহাসিক বর্ণনা করেন তবে যুদ্ধ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অভিনব চিত্র পাঠকের চোখের সামনে ফুটিয়া ওঠে। ইহার জন্য ঘটনা গোপন করার প্রয়োজন নাই, বরং বেশি করিয়া প্রকাশ করা দরকার। যুদ্ধক্ষেত্র সম্বন্ধে যাহা খাটে, অন্য যে-কোনো নিষ্ঠুরতা সম্পর্কেই তাহা প্রযোজ্য। এই সকল ক্ষেত্রে নীতি-উপদেশ প্রদান করা অনাবশ্যক; যথাযথভাবে গল্প বর্ণনাই যথেষ্ট। আপনি নিজে কোনো উপদেশ দিয়া শিশুকে তাহা পালন করিতে বলিবেন না, ঘটনাগুলিকেই শিশুর মনে উপযুক্ত ভাব ও নীতিবোধ উন্মেষ করিতে সুযোগ দিন।

স্নেহ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক। স্নেহ ও সহানুভূতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে; সহানুভূতি-বোধ ব্যাপক, ইহার ক্ষেত্র বিস্তৃত। বহুজনের প্রতি ইহার প্রয়োগ হইতে পারে কিন্তু স্নেহ সকলের জন্য নয়। নির্বাচিত কতকের জন্যই কেবল শিশুর মনে স্নেহ বিদ্যমান সে সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে; এখন সমবয়সীদের মধ্যে স্নেহ সম্বন্ধে কেমন তাহাই বলা হইতেছে।

স্নেহ সৃষ্টি করা যায় না; হৃদয়ের অন্তস্থল হইতে ইহাকে কেবল যুক্ত করা যায়। এক প্রকার স্নেহ আছে যাহার মূল অংশত ভয়ের মধ্যে নিহিত। পিতামাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসায় এই ধরনের স্নেহের কিছু মিশ্রণ আছে। পিতামাতা সন্তানকে পালন করেন, বিপদ হইতে রক্ষা করেন। জনক-জননীর স্নেহচ্ছায়া হইতে বঞ্চিত হইলে সন্তান নিশ্চয়ই সুখি হয় না; কাজেই পিতামাতার প্রতি ভালোবাসার মধ্যে কিছু পরিমাণে ভয় মিশ্রিত থাকে। শৈশবেও অন্য শিশুর প্রতি ভালোবাসায় কিন্তু এই ধরনের ভীতির মিশ্রণ দেখিতে পাওয়া যায় না। আমার ছোট মেয়ে তার ভাইয়ের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত, যদিও তাহার জগতে সেই একমাত্র ব্যক্তি যে তাহার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করে না। সমান বয়সীদের মধ্যে ভালোবাসাই সবচেয়ে ভালো; যেখানে সুখ এবং ভীতিশূন্যতা আছে সেখানেই ইহা থাকা সম্ভব। ভয়–তাহা সংজ্ঞাত [Conscious] হউক কিংবা অজ্ঞাতই।

[Unconscious] হউক-ভীত ব্যক্তির মনে তীব্র ঘৃণা ও শত্রু তাহার উদ্রেক করে, কারণ যাহাকে ভয় করা যায়, সর্বদা মনে হয় সে কোনোরূপ ক্ষতি-সাধন করিতে পারে। নিজের ক্ষতির আশঙ্কা ভীত ব্যক্তির মনে আত্মরক্ষার উপায়স্বরূপ ঘৃণা ও শত্রুতা জাগাইয়া রাখে। অধিকাংশ লোকের জীবনে দেখা যায় ঈর্ষা স্নেহ বিস্তারের পক্ষে বাধা হইয়া দাঁড়ায়। সুখভোগ ব্যতীত ঈর্ষা দমন করার অন্য কোনো উপায় আছে বলিয়া আমি মনে করি না; নৈতিক শৃঙ্খলা ঈর্ষা বোধের অন্তঃপ্রবাহিত ফল্গুধারা রোধ করিতে পারে না। আবার যে সুখ ও স্বস্তিবোধ ঈর্ষাকে প্রতিরোধ করে তাহাই প্রধানত ভয় কর্তৃক দমিত হয়। ভয় অনেক সময় অনেকের উৎফুল্ল জীবনকেও বিষময় করিয়া তোলে। পিতামাতা ও তথাকথিত বন্ধুগণ আনন্দোজ্জ্বল কিশোর-কিশোরীর মনে ভয় সঞ্চার করিয়া বিষাদের ছয়াপাত করেন; নৈতিক কারণেই তাঁহারা এরূপ করেন, মনে ভাবেন; কিন্তু আসলে ঈর্ষা তাহাদিগকে এ কাজে প্ররোচিত করে। বলিতে পারেন–কিসের ঈর্ষা? করিবেই বা কেন? মানব-মনের গহনে নিত্যই নানা ভাবের আলোড়ন চলিতেছে। সকরেই সুখি হইতে চায়, আত্মসুখই প্রধান কাম্য। কিন্তু ইহা যখন সহজলভ্য হয় না তখন অন্যে যে ইহা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করিবে তাহাও মনে সহ্য করিতে পারে না। অপরকে যে নিজের অপেক্ষা বেশি ভাগ্যবান মনে করে তাহার প্রতি ঈর্ষা জাগ্রত হয়, তা সে ব্যক্তি শিশুই হোক কিংবা কিশোরই হউক। ঈর্ষা কিন্তু তখন খাঁটি ঈর্ষার আকারে আত্মপ্রকাশ করে না; ভদ্রতার মুখোেশ পরিয়া, নৈতিক উপদেশের শুভ্র পোশাকে সাজিয়া ইহা ছলনা করিতে বাহির হয়। তরুণ কিশোরগণ যদি যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভীক হয় তবে এই আশঙ্কাবাদীদের কথায় কর্ণপাত করিবে না, নচেৎ তাহাদিগকে ঈর্ষান্বিত নীতি-উপদেষ্টার দলভুক্ত হইয়া দুঃখময় জীবন বরণ করিতে হইবে।

আমরা যে চরিত্রে শিক্ষাদানের পরিকল্পনা করিতেছি তাহার উদ্দেশ্য হইল শিশুর জীবনে সুখ এবং সাহস উৎপাদন করা; এই শিক্ষা শিশুর হৃদয়স্থিত স্নেহের উৎস-মুখ খুলিয়া দেয়। ইহার তুলনায় বেশি কিছু করা সম্ভবপর নয়। প্রথমেই বলা হইয়াছে স্নেহ সৃষ্টি করা যায় না, শুধু ইহার বহির্গমনের পথ করিয়া দেওয়া যায় মাত্র। আপনি যদি শিশুদিগকে স্নেহশীল হইতে উপদেশ দেন, তবে কতকগুলি ভণ্ড ও প্রতারক সৃষ্টি করিতে পারেন কিন্তু তাহাদিগকে যদি মুক্ত পরিবেশে সুখি রাখিতে পারেন, যদি তাহাদিগকে সদয় আচরণে ঘিরিয়া রাখিতে পারেন তবে দেখিতে পাইবেন স্বতঃপ্রবৃত্তভাবেই তাহারা সকলের প্রতি বন্ধুর মতো ব্যবহার করিতেছে। ইহার ফলস্বরূপ প্রায় সকলেই তাহাদের প্রতি প্রীতিপূর্ণ আচরণ করিয়া সদ্ব্যবহারের প্রতিদান দিবে। বিশ্বস্ত এবং প্রীতিস্নিগ্ধ স্বভাবের বিশেষ সার্থকতা আছে; ইহা কিশোর-কিশোরীর চরিত্রে কমনীয় মাধুর্য দান করে এবং অপরের নিকট হইতে যেরূপ স্নেহ-মধুর আচরণ ও সাড়া কামনা করা হয় তাহাই সৃষ্টি করে। যথার্থ চরিত্রগঠনের শিক্ষার ইহা একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় সুফল।

১২. যৌন শিক্ষা

যৌন সম্পর্কিত বিষয় এত কুসংস্কার এবং নিষেধের বেড়াজালে ঘেরা যে, অত্যন্ত শঙ্কার সঙ্গে এই সম্পর্কে আলোচনা করিতে অগ্রসর হইতেছি। ভয় হয়, পাছে যে সমস্ত পাঠক এই পর্যন্ত আমার শিক্ষানীতি গ্রহণ করিয়াছেন তাহারাও এই ক্ষেত্রে প্রয়োগের সময় তাহাতে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাঁহারা হয়তো বিনা দ্বিধায় স্বীকার করিয়াছেন যে, নির্ভীকতা এবং স্বাধীনতা শিশুর পক্ষে মঙ্গলজনক; তথাপি যৌন ব্যাপারে তাহারাই হয়তো এ নীতির বিরোধিতা করিয়া শিশুদের উপর অকারণ ভীতি ও দাসত্ব প্রয়োগ করার পক্ষপাতী হইতে পারেন। যে-নীতি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া আমি বিশ্বাস করি, তাহা আমি কোনোক্রমেই সংকুচিত করিতে রাজি হইব না; মানব চরিত্রের অন্যান্য আবেগ, যেমন খেলা, নূতন কিছু গঠন করা, ভয়, স্নেহ প্রভৃতির বিকাশ বা নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে যেরূপ অবলম্বন করিয়াছি, যৌন ব্যাপারেও আমি ঠিক সেইরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পক্ষপাতী।

যৌনভাব ও ফ্রয়েডির মতবাদ : নানারূপ বাধানিষেধ আরোপ ও ঢাকঢাক-গুড়গুড় ছাড়াও যৌনভাবের একটি বিশেষত্ব এই যে, এই প্রবৃত্তি দেরিতে পরিপক্ক হয়। মনঃসমীক্ষকগণ সত্যই দেখাইয়াছেন যে, শৈশবেও যৌনপ্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকে; তবে ইহাদের অভিমতের মধ্যে অনেকখানি অতিরঞ্জন আছে।

যৌন প্রবৃত্তির শিশুসুলভ প্রকাশ বয়স্ক ব্যক্তিদের আচরণ হইতে পৃথক, ইহার বেগও যথেষ্ট কম। বয়স্ক ব্যক্তির মতো যৌন ব্যাপারে লিপ্ত হওয়া শিশুর পক্ষে দৈহিক দিক দিয়াই অসম্ভব। প্রথম যৌবনাগম কিশোর-কিশোরীর মনে এক প্রক্ষোভময় বিষয় আলোড়ন সৃষ্টি করে; পাঠ্য-জীবনের মাঝখানে বয়ঃসন্ধিক্ষণের রঙিন উন্মাদনা স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণের পথে বিঘ্ন উপস্থিত করে; এইগুলি অপসারণ করিয়া সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পথে কিশোরকে পরিচালিত করা শিক্ষাব্রতীর বড় সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়; এইরূপ সমস্যার অধিকাংশ সম্বন্ধেই কোনো আলোচনার চেষ্টা করিব না; কেবল যৌবনাগমের পূর্বে কি করা কর্তব্য তাহাই হইবে আমার আলোচ্য বিষয়। এই সম্পর্কে শিক্ষা সংস্কারের আবশ্যকতা অত্যন্ত বেশি, বিশেষত বাল্যকালের শিক্ষায়। যদিও ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমার মতের অনৈক্য ঘটিয়াছে তবু আমার মনে হয় একটি বিষয়ে তাঁহারা বিশেষ উপকার সাধন করিয়াছে। তাহারা দেখাইয়াছেন যে, বাল্যে যৌন-সংক্রান্ত ব্যাপারে শিশুদের প্রতি যথাযথ আচরণ না হওয়ার ফলে পরিবর্তীকালে স্নায়বিক বিকলতার উদ্ভব হইয়া থাকে। এই ক্ষেত্রে তাঁহাদের কাজে যথেষ্ট সুফল প্রদান করিয়াছে কিন্তু এখনও বহু পুঞ্জিভূত কুসংস্কার দূর করা প্রয়োজন। শিশুর যৌনভাব সংক্রান্ত কুসংস্কারগুলি দূর করার একটি প্রধান অন্তরায় হইল তাহার জীবনের প্রথম কয়েক বৎসর তাহার লালন-পালনের ভার সম্পূর্ণ অশিক্ষিত স্ত্রীলোকদের উপর ন্যস্ত করা। ইহার ফলে অনেক ক্ষেত্রে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যাহা সোজাসুজি বর্ণনা করিলে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হইতে হইবে বলিয়া বিশেষত পর্যবেক্ষক পণ্ডিতগণ ঘুরাইয়া ফিরাইয়া তাহার বিবরণ দিয়া থাকেন। মূর্খ পরিচারিকাগণ এই সম্বন্ধে কিছুই জানে না, তাহাদের পক্ষে বিশেষজ্ঞগণের সিদ্ধান্ত বিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই উঠে না।

করমৈথুনঃ শিশুর যৌন সমস্যাগুলির ক্রম অনুসারে আলোচনা করিতে গেলে জননী ও পরিচারিকাকে বিব্রত করে যে সমস্যা তাহা হইল শিশুর করমৈথুন। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে, দুই হইতে তিন বৎসর বয়সের সকল বালক-বালিকাই এইরূপ করিয়া থাকে এবং কিছুদিন পরে আপনা হইতেই ইহা বন্ধ হইয়া যায়। কখনও কখনও দৈহিক কয়নের ফলে এই বিব্রতকর কাজটি বেশি হয় কিন্তু ঔষধ প্রয়োগ করিয়া ইহার কারণ দূর করা যায়। (কি ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত তাহা আমার বিবেচ্য বিষয় নহে)। কিন্তু এইরূপ কারণ ব্যতিরেকেই সাধারণত শিশুরা করমৈথুন করিয়া থাকে। এই ব্যাপারে অভিভাবকগণ শঙ্কাৰিত হইয়া উঠেন এবং ইহা বন্ধ করিবার জন্য ভীতি প্রদর্শন করিতে থাকেন। কার্যত ভীতি প্রদর্শনে কোনো উপকার হয় না কিন্তু ফল হয় এই যে, ভয় শিশুর মানস স্তরে প্রবেশ করে এবং দমিত হইয়া তাহাই পরে শিশুর জীবনে দুঃস্বপ্ন, স্নায়বিক দুর্বলতা, ভ্রান্ত এবং অহেতুক ভীতিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। শিশুর করমৈথুন দূর করার চেষ্টা না করিলেও কোনও ক্ষতি নাই; তাহার স্বাস্থ্য এবং চরিত্রের উপর ইহার কোনও কুফল দেখা যায় না। খুব কম ক্ষেত্রে ইহা সামান্য অনিষ্ট করে কিন্তু ইহা সহজেই নিরাময় করা সম্ভব; এই অভ্যাসটি আঙ্গুল চোষা অপেক্ষা বেশি গুরুতর বা অপকারী নয়। স্বাস্থ্য ও চরিত্রের উপর করমৈথুনের যে কুফল লক্ষ্য করা গিয়াছে এই অভ্যাস বন্ধ করার চেষ্টা হইতেই তাহার উদ্ভব। করমৈথুন শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর হইলেও ভয় দেখাইয়া এই কুৎসিত অভ্যাস ত্যাগ করানো না গেলে শুধু নিষেধ করা বিজ্ঞোচিত কাজ হইবে না। কেননা নিষেধ করিলেই যে শিশু এই অভ্যাস হইতে বিরত হইবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নাই। আপনি যদি বন্ধ করার কোনো চেষ্টা না করেন তবে সম্ভবত ইহা আপনা আপনি বন্ধ হইয়া যাইবে কিন্তু এ বিষয়ে চেষ্টা করিলেই বরং নানা মানসিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই প্রতিক্রিয়ার ফলাফল বিবেচনা করিয়া শিশুকে এ সম্বন্ধে স্বাধীনতা দেওয়াই ভালো। অবশ্য আমি এইকথা বলিতেছি না যে, নিষেধ করা ব্যতীত অন্য কোনো সম্ভাব্য উপায় গ্রহণ করা হইতেও বিরত থাকিতে হইবে। যাহাতে শিশু বেশিক্ষণ বিছানায় জাগিয়া না থাকে সেই জন্য ঘুম ধরিলে তাহাকে শুইতে দিবেন। যাহাতে তাহার মন অন্য কোনও দিকে আকৃষ্ট হয় সেইজন্য তাহার প্রিয় কতকগুলি খেলনা বিছানায় রাখিতে দিবেন; এইরূপ প্রক্রিয়ায় কোনো অপকার হয় না। ইহাতে যদি কোনো উপকার না হয় তবে শিশুকে বাধা দিবেন না, বা একটি খারাপ অভ্যাস করিতেছে বলিয়া সেইদিকে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিবেন না, স্বাভাবিকভাবে শিশুকে অন্য বিষয়ে মনোযোগী করিতে পারিলে আপনা হইতেই সে ইহাতে ক্ষান্ত হইবে। এই চেষ্টা হইলেও দুশ্চিন্তার কারণ নাই; শিশুর করমৈথুন অভ্যাস বেশিদিন থাকে না।

সাধারণ শিশুর তৃতীয় বৎসরে যৌন কৌতূহল শুরু হয়। পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীলোকের, বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে শিশুর দৈহিক পার্থক্য প্রথমে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শৈশবে এই কৌতূহলের আর কোনো বিশেষত্ব নাই, ইহা তাহার সাধারণ কৌতূহলের অন্তর্গত। শুধু যেখানে ব্যাপারটিকে রহস্যাবৃত করিয়া রাখিবার রীতি, সেখানেই শিশুদের মধ্যে ভেঁপোমির ভাব দেখা যায়। যেখানে কোনো রহস্য নাই সেখানে কৌতূহল তৃপ্ত হইলেই আগ্ৰহ কমিয়া যায়। প্রথম হইতেই শিশুকে তাহার মাতা-পিতা-ভ্রাতা-ভগিনীকে মাঝে মাঝে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখিতে দিতে হইবে। বস্ত্র পরিবর্তনের সময় বা অন্য কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় শিশুর সম্মুখে ক্ষণিকের জন্য নগ্নদেহ হইলেও আচরণে কোনোরূপ ভাবান্তর দেখানো উচিত নহে; বয়স্ক ব্যক্তি বা শিশু কাহারই ইহাতে কিছু মনে করিবার নাই; নগ্নতা সম্বন্ধে বয়স্ক ব্যক্তিদের যে বিশেষ কোনো মনোভাব আছে তাহা শিশু না জানিলেই হইল। (পরে অবশ্য তাহাকে জানিতে হইবে।) দেখা যাইবে শিশু অতি সহজেই তাহার পিতা ও মাতার দৈহিক পার্থক্য লক্ষ্য করিবে এবং তাহার মাতা ও ভগিনীর দৈহিক পার্থক্যও যে অনুরূপ ধরনের তাহা বুঝিতে পারিবে। এতটুকু পর্যন্ত বুঝিতে পারিলে দৈহিক পার্থক্য সম্বন্ধে আগ্রহ যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়া যাইবে আলমারি বা টেবিলের দেরাজ মাঝে মাঝে ভোলা থাকিলে তাহার সম্বন্ধে শিশুর কৌতূহল যেমন বিশেষ থাকে না তেমনই এই সময়ে শিশু যৌন বিষয় সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করিলে অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নের মতোই তাহারও উত্তর দিতে হইবে।

যৌন বিষয় সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর : প্রশ্নের উত্তরদান যৌন শিক্ষার একটি প্রধান অংশ। এই প্রসঙ্গে দুইটি নিয়ম মানিয়া চলিতে হইবে। প্রথমে সর্বদা সত্য উত্তর দিন; দ্বিতীয় যৌনজ্ঞানকে অন্য যে-কোনও জ্ঞানের মতো বিবেচনা করুন। যদি কোনও মিশু আপনাকে চন্দ্র, সূর্য, মেঘ, মোটরগাড়ি বা ইঞ্জিন সম্বন্ধে বুদ্ধির পরিচায়ক কোনও প্রশ্ন করে তবে আপনি খুশি হন এবং সে যতটুকু বুঝিতে পারে সেই অনুপাতে প্রশ্নের উত্তর দিয়া থাকেন। কিন্তু সে যদি যৌনবিষয় সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করে আপনি হয়তো বলিবেন, চুপ চুপ। আপনি যদি জানেন যে, এরূপ বলা উচিত নহে তবু হয়তো সংক্ষেপে এবং শুষ্কভাবে ইহার উত্তর দিবেন; আপনার আচরণে বিব্রত হওয়ার ভাব প্রকাশ পাইতে পারে, শিশু তৎক্ষণাৎ আপনার আচরণের সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ করিবে এবং বুঝিবে সে প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে কোনো কিছু গুপ্ত রহস্য জড়িত আছে। রহস্যাবৃত বিষয়ের প্রতিই শিশুর কৌতূহল বেশি জাগ্রত হয়। যৌন বাসনা ও যৌন-জীবন সম্পর্কেও এইভাবে শিশু আকৃষ্ট হইতে পারে। কখনও যেন মনে করিবেন না যে, যৌন আচরণে ভীতিকর অন্যায় এবং অপবিত্র কোনো ভাব আছে। আপনি যদি এইরূপ মনে করেন শিশু ইহা বুঝিতে পারিবে, সে তবে স্বভাবতই ভাবিবে যে, তাহার পিতামাতার সম্পর্কের মধ্যে গোপনীয়, নোংরা কোনো রকম আচরণ আছে। পরে সে সিদ্বান্ত করিবে যে, জনক-জননী তাহার জন্মদান ক্রিয়াকে অশোভন ও কুৎসিত বলিয়া মনে করেন। ইহার ফলে সে নিজেকে সর্বদা অপবিত্র এবং পাপকর্মের ফল বলিয়া বোধ করিতে থাকিবে। এইরূপ ভাব বিদ্যমান থাকিলে কিশোর-কিশোরীর, এমনকি যুবক-যুবতির পর্যন্ত প্রবৃত্তি এবং মানসিক আবেগগুলি সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ প্রায় অসম্ভব হইয়া উঠে।

শিশুর যখন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার মতো বয়স হইয়াছে যেমন ধরুন তিন বৎসর বয়সের পর–তখন যদি তাহার ভাই বা বোন জন্মগ্রহণ করে তবে তাহাকে বলুন যে, শিশুটি তাহার মায়ের দেহের মধ্যে ধীরে ধীরে বাড়িয়া উঠিয়াছে, ঠিক এইভাবে সে নিজেও যে বাড়িয়া উঠিয়াছিল তাহাও বলুন। বালককে ছোট্ট শিশুর মাতৃস্তন্য পান করা দেখিতে দিন; তাহাকে বলুন সে নিজেও এমনইভাবে স্তন্যপান করিয়াছিল। যৌনজীবন সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের মতো এ বিষয়ও শিশুকে সহজ সরলভাবে বুঝাইয়া দিবেন। ইহার মধ্যে গুরুগাম্ভীর্য আনিবার কোনো প্রয়োজন নাই। মাতৃত্বের পবিত্র এবং রহস্যঘন কর্তব্য সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলিবার আবশ্যকতা নাই। সমস্ত বিষয়টি হওয়া উচিত সহজ এবং বস্তুনিষ্ঠ।

যে বয়সে শিশুর প্রথম যৌন কৌতূহল জাগ্রত হয় তখন যদি পরিবারে কোনো সন্তানের জন্ম না হয় তাহা হইলেও এ প্রশ্নের অবতারণা করা যায়। তখন বলিতে হয়–তোমার জন্মের পূর্বে এ ঘটনাটি ঘটিয়াছিল। ইহা হইতেই প্রশ্নোত্তর শুরু হইতে পারে। আমার ছেলের বেলায় দেখি সে যে এক সময় বর্তমান ছিল না তাহা বোঝাই তাহার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। কখন পিরামিড তৈয়ার করা হইয়াছিল বা এই জাতীয় প্রাচীন কোনও কাহিনী বলিতে গেলেই সে জিজ্ঞাসা করে তখন সে কি করিত। যদি বলি–তখন সে জন্মায় নাই, তাহার অস্তিত্ব ছিল না তবে সে বড়ই হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে। দুইদিন আগে হউক আর পিছে হউক জন্মানো মানে কি তাহা সে জানিতে চাহিবে; তখন আমরা তাহাকে বলিব।

শিশু যদি পশুপালন ক্ষেত্রে বাস করে তবে সন্তানের জন্মদানের ব্যাপারে পিতার অংশ কি স্বাভাবিক অবস্থায় সে প্রশ্ন তাহার মনে উঠিবে না। কিন্তু শিশু যাহাতে এই জ্ঞান পিতামাতা বা শিক্ষকের নিকট হইতে পায় সে বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। তাহা না হইলে কুশিক্ষাপ্রাপ্ত কুৎসিত স্বভাবের ছেলেদের নিকট হইতেই সে ইহা শিখিবে। আমার বয়স যখন বারো বৎসর তখন অন্য একটি ছেলে আমাকে কি বুঝাইয়াছিল তাহা আমার স্পষ্ট মনে আছে; সমস্ত বিষয়টি অশ্লীলতাপূর্ণ এবং গোপন হাসিঠাট্টার উপকরণ বলিয়া মনে করা হইত। আমাদের সে যুগের ছেলেদের ইহাই ছিল স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা। ইহার ফল হইত যে, অধিকাংশ লোক সারাজীবন ধরিয়া যৌন ব্যাপারটিকে নোংরা হাসিঠাট্টার বিষয় মনে করিত এবং যে স্ত্রীলোক যৌন সংস্পর্শে আসিত তাহারা তাহাদের সন্তানের জননী হইলেও তাহাদিগকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিত না। সন্তানের যৌন শিক্ষার ব্যাপারে পিতামাতা অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিত, যদিও পুরুষগণ জানিত কিভাবে নিজেরা যৌন সম্পর্কিত প্রথম জ্ঞান লাভ করিয়াছিল! কুসঙ্গ হইতে বালকদের যৌনশিক্ষা লাভ করার ব্যবস্থা কিরূপে যে সুস্থ নীতিবোধ গঠনে সহায়তা করিত তাহা আমি কল্পনা করিতে পারি না। যৌনজীবন স্বাভাবিক, শোভন এবং প্রীতিপদ প্রথম হইতেই শিশুর মনে এই বোধ জন্মাইতে হইবে। ইহার অন্যথা করিলে স্ত্রী এবং পুরুষের সম্পর্ক, পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ক বিষময় করিয়া তোলা হইবে। পিতামাতা যখন পরস্পরকে ভালোবাসেন এবং সন্তানদিগকে ভালোবাসেন তখন তাঁহাদের মধ্যে যৌনজীবনের মধুর প্রকাশ। পিতামাতার পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের বিষয় বালককে অশ্লীল কিশোরদের নোংরা হাবভাব ও কুৎসিত ইঙ্গিত হইতে শিক্ষা করিতে না দিয়া পিতামাতার নিজেদেরই এ ভার গ্রহণ করা উচিত। ছেলেমেয়ের মনে যদি এই ধারণা জন্মে যে, তাহাদের পিতামাতার যৌনজীবনের সম্পর্ক দূষণীয় গোপন ব্যাপার তবে তাহার ফলও ভাল হয় না।

যদি কোনো পরিবারের শিশুর অন্য বালকদের খারাপ সঙ্গ হইতে যৌনজ্ঞান শিক্ষার কোনো আশঙ্কা না থাকে তবে যতদিন সে স্বাভাবিক কৌতূহলের বশে এই সম্বন্ধে প্রশ্ন না করে ততদিন অপেক্ষা করা চলে। কিন্তু যৌবনাগমের পূর্বেই তাহাকে এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান দিতে হইবে। ইহা অবশ্য করণীয়। যৌবনারম্ভে যে দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে যে সম্বন্ধে বালক-বালিকাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ করিয়া রাখিলে তাহাদের উপর এক রকম নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়। যৌবন-সূচনায় কিশোরী অকস্মাৎ যে দৈহিক পরিবর্তনের সম্মুখিন হয় সে সম্পর্কে আগে হইতে তাহাকে অবহিত না করিলে কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়াছে বলিয়া সে অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িতে পারে। ইহা ছাড়া যৌনবিষয়টি কিশোরদের কাছে এমন উন্মাদনাকর যে, শৈশবে এ বিষয়ে আলোচনা তাহারা যেরূপ বিজ্ঞানসম্মত মনোভাবের সহিত গ্রহণ করিত, যৌবনের রঙিন আবেশ দেহমনে ছড়াইয়া পড়িলে আর তেমনভাবে পারে না। কাজেই যৌনজীবন সম্বন্ধে কুৎসিত আলোচনা করার সম্ভাবনা বাদ দিলেও বালক বা বালিকাকে যৌবনারম্ভের পূর্বেই যৌন কাজের প্রকৃতি সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া উচিত।

কখন শিক্ষা দিতে হইবে : যৌবনাগমের কতদিন পূর্বে এই শিক্ষা দেওয়া তাহা কতকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করিবে। অনুসন্ধিৎসু এবং সক্রিয় বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুকে জড়-প্রকৃতির শিশু অপেক্ষা পূর্বে এই শিক্ষা দিতে হইবে। কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। অনুসন্ধিৎসু বালকের কৌতূহলের অন্ত নাই; কৌতূহলের বশবর্তী হইয়াই সে এইদিকে অল্পবুদ্ধি বালকের তুলনায় আগে আকৃষ্ট হইবে। কখনও কোনো অবস্থাতেই শিশুর কৌতূহল অপরিতৃপ্ত রাখা উচিত হইবে না। শিশু বয়সে যত ছোটই হউক, সে যদি জানিতে চায় তাহার কৌতূহল মিটাইতেই হইবে। কিন্তু সে যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া কোনো প্রশ্ন না করে তবু পাছে সে কুসংসর্গ হইতে খারাপভাবে কিছু জানিয়া ফেলে, সে দোষ নিবারণের জন্য দশ বৎসর বয়সের পূর্বেই তাহাকে যৌনজীবন সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে হইবে। এইরূপ ক্ষেত্রে গাছপালার বংশ বৃদ্ধি ও প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনার ভিতর দিয়া স্বাভাবিকভাবে তাহার কৌতূহল উদ্দীপ্ত করা বাঞ্ছনীয়। এইজন্য কোনোরূপ আড়ষ্টভাব বা গুরুগম্ভীর ভূমিকার প্রয়োজন নাই, খানিক কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া লইয়া শোন খোকন, এ বয়সে তোমার যে বিষয়টি জানা বিশেষ প্রয়োজন তাই এখন বলছি এই ধরনের মুখবন্ধসহ প্রসঙ্গ উত্থাপনের আবশ্যকতা নাই। অতি সাধারণভাবে দৈনন্দিন ব্যাপারের প্রসঙ্গ তুলিতে হইবে। এই জন্যই প্রশ্নের উত্তর হিসাবে ইহার আলোচনা হইলেই ভালো হয়।

বালক ও বালিকাদের প্রতি যে একইরূপ আচরণ করা দরকার এবং তাহাদিগকে যে সমভাবে শিক্ষা দেওা উচিত সে সম্বন্ধে বর্তমান যুগে কোনো যুক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে করি না। আমাদের বাল্যকালে ভালোভাবে লালিত-পালিত মেয়ের পক্ষে বিবাহ সম্বন্ধে কোনো কিছু না জানিয়াও বিবাহ দেওয়া রেওয়াজ ছিল; স্বামীর নিকট হইতে সে যৌন-জীবন সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করিত। কিন্তু অধুনাকালে এইরূপ ঘটিতে শুনি নাই। আমার মনে হয়, এখন অধিকাংশ লোকই মনে করে অজ্ঞতার উপর যে গুণের ভিত্তি, তাহার কোনো মূল্য নাই এবং বালিকাদেরও বালকের মতো জ্ঞানলাভের অধিকার আছে। যাহারা ইহা মানেন না তাহারা হয়তো এ পুস্তক পাঠ করিবেন না; কাজেই তাহাদের সঙ্গে কোনো যুক্তি-তর্কের অবতারণার প্রশ্ন উঠে না।

যৌননীতিজ্ঞানের শিক্ষা আমি সংকীর্ণ অর্থে আলোচনা করিতে চাহি না। এই সম্বন্ধে বিভিন্ন অভিমত আছে। খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুসলমানদের পার্থক্য, মধ্যযুগীয়দের সঙ্গে স্বাধীন চিন্তাবাদীদের পার্থক্য রহিয়াছে। পিতামাতা যে যৌননীতিবিজ্ঞানে বিশ্বাস করেন, নিজেদের সন্তানদিগকেও তাঁহারা সেইমতো শিক্ষা দিতে চান; এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু এ সব জটিল বিতর্কসংকুল প্রশ্ন বাদ দিলেও সকলের পক্ষেই প্রযোজ্য এমন বিষয় আছে।

যৌনবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যনীতি প্রথমেই বলা যাইতে পারে স্বাস্থ্যনীতির কথা। যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার সম্মুখিন হওয়ার পূর্বেই যুবকদের এ সম্বন্ধে জানা উচিত। তাহাদিগকে এ সম্বন্ধে যথাযথ শিক্ষা দিতে হইবে; কতক লোক নীতি-উপদেশ দানের উদ্দেশ্যে যৌনব্যাধির কথা অতিরঞ্জিত করিয়া প্রচার করিয়া থাকে; এইরূপ করা অনাবশ্যক। কেমন করিয়া যৌনরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং কেমন করিয়াই বা ইহা হইতে আরোগ্য লাভ করা যায় তাহাও শিখাইতে হইবে। কেবল সপ্রকৃতির সংযত ব্যক্তিদের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষাদান করিয়া অন্য সকলের দুর্ভোগকে পাপের উপযুক্ত শাস্তি মনে করা ভুল। তাহা হইলে মোটর চালনায় যে ব্যক্তি আহত হইয়াছে তাহাকেও কোনো প্রকার সাহায্য না করিতে পারি এই বলিয়া যে, অসতর্ক অবস্থায় মোটর চালানো অন্যায়, অতএব পাপ। ইহা ছাড়া যৌনব্যাধির ক্ষেত্রে যেমন, মোটর চালানোর ক্ষেত্রেও তেমনি নিরপরাধ ব্যক্তির উপর শাস্তি পড়িতে পারে; একজন অসতর্ক মোটর চালক যদি কোনো লোককে চাপা দেয় তাহাতে যেমন আহত ব্যক্তির কোনও অপরাধ নাই, তেমনই কোনো শিশু যদি সিফিলিস রোগ লইয়াই জন্মগ্রহণ করে তবে তাহাকেও দোষী বা পাপী মনে করা উচিত নহে।

যুবক-যুবতিদিগকে বুঝানো দরকার যে, শিশুর জন্মদান একটি গুরুতর ব্যাপার এবং সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধানের সম্ভাবনা আছে কিনা তাহা বিবেচনা করিয়া সন্তানোৎপাদন সর্বদাই সমর্থনযোগ্য; এমনকি ঘন ঘন বেশিসংখ্যক সন্তান হওয়ার ফলে প্রসূতির স্বাস্থ্য যদি নষ্ট হইয়া যায়, সন্তানগণ যদি রুগ্ন এবং বিকৃত মস্তিষ্ক হয়, সকলের যদি যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যের সংস্থান না-ও হয় তবু ইহাতে দোষ নাই। হৃদয়হীন অদৃষ্টবাদীরাই কেবল এই অভিমত পোষণ করে; তাহাদের ধারণা মানুষের দুঃখদৈন্য অসম্মান ভগবানের মহিমার পরিচালক। শিশুদের প্রতি যাহাদের প্রীতি আছে, অসহায়ের উপর দুঃখের বোঝা যাহারা চাপাইয়া দিতে চান না তাঁহারাই এই নিষ্ঠুর নীতির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন। ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শিশুদের জীবনের প্রতি মমত্ববোধ নৈতিক মিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত।

মেয়েদিগকে একদিন সন্তানের জননী হইতে হইবে; এইজন্য তাহাদের পক্ষে তকালে প্রয়োজন লাগিতে পারে এমন কতক জ্ঞান মোটামুটি অর্জন করা উচিত। অবশ্য বালক ও বালিকা উভয়কেই শারীরবিদ্রা ও স্বাস্থ্যনীতি কিছু কিছু শিখিতে হইবে। কিশোর-কিশোরীকে ইহা স্পষ্টভাবে বুঝাইতে হইবে যে অপত্যস্নেহ ব্যতীত কেহ ভালো পিতামাতা হইতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, অপত্যস্নেহের সঙ্গে অনেকখানি জ্ঞানের প্রয়োজন। শিশুর সহিত আচরণের প্রবৃত্তি ব্যতীত জ্ঞান এবং জ্ঞান ব্যতীত প্রবৃত্তি উভয়ই সমান অকেজো। জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা যতই অনুভূত হইবে ততই বেশিসংখ্যক বুদ্ধিমতী স্ত্রীলোক মাতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হইবে। বর্তমানে অনেক উচ্চশিক্ষিত মহিলা ইহাকে অবজ্ঞা করেন; তাঁহাদের ধারণা বুদ্ধি প্রয়োগের সুযোগ ইহার ভিতর নাই। বুদ্ধিমতী উচ্চশিক্ষিতা মহিলাদের পক্ষে মাতৃত্ব লাভ হইতে বিরত থাকা সমাজের পক্ষে বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়। কারণ এ দিকে তাঁহাদের চিন্তা নিয়োজিত হইলে তাহারা উৎকৃষ্ট জননী হইতে পারেন। যৌনপ্রেম ও হিংসা : যৌন ভালোবাসা সম্বন্ধে শিক্ষা-প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ে বিশেষ অবহিত হওয়া প্রয়োজন। প্রেমের ব্যাপারে জোর জবরদস্তি বা হিংসা সুখবহ হয় না; বরং দুঃখ ও অশান্তি সৃষ্টি করে। স্থূলপ্রেম যখন মূর্ত হইয়া ওঠে অর্থাৎ প্রেমের বস্তুর উপর যখন অধিকার বিস্তারের বাসনা জাগে তখনই প্রেমের স্বাধীনতা লোপ পায়, ব্যক্তিত্বের অবসান ঘটে; যেখানে এইরূপ কড়াকাড়ি নাই, সেইখানে আছে নিবিড় আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। পূর্ববর্তী যুগে পিতামাতা সন্তানদের নিকট হইতে কর্তব্য হিসাবে ভালোবাসা আদায় করিতে চেষ্টা করিয়া সন্তান-সন্ততির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক তিক্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন। এখনও অনেক স্বামী-স্ত্রী এই একই প্রকার ভুল পন্থা অবলম্বন করিয়া পরস্পরের মধ্যেকার প্রীতির সম্পর্ক ধ্বংস করিয়া ফেলেন। ভালোবাসাকে কর্তব্য বলিয়া গণ্য করা যায় না, কেননা ইহা ইচ্ছার বশ নহে। ইহা একটি শ্রেষ্ঠ স্বর্গীয় দান। ইহা মুক্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত হইলে সৌন্দর্য ও আনন্দের শতদল বিকশিত করিয়া তোলে কিন্তু খাঁচায় ভরিয়া রাখিলে প্রেমের অপমৃত্যু ঘটে। এখানেও ভয় শত্রু। জীবনে আনন্দের উপাদান হারাইবার ভয়ে যে ব্যক্তি ভীত হয় এবং ইহাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়াইয়া ধরিতে চেষ্টা করে তাহার ভাগ্যে কখনও সুখ প্রাপ্তি ঘটে না। অন্যান্য ব্যাপারে যেমন, যৌনপ্রেমের ব্যাপারেও তেমনই নির্ভীকতাই বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার মূল।

১৩. নার্সারি স্কুল

কিরূপ অভ্যাস গঠিত হইলে তাহা শিশুর পক্ষে সুখদায়ক এবং তাহার পরবর্তী জীবনে প্রয়োজনীয় হইতে পারে সে সম্বন্ধে আগের অধ্যায়গুলিতে আলোচনা করা হইয়াছে। কিন্তু এই সদভ্যাস গঠনের শিক্ষা পিতামাতা দিবেন কিংবা ইহার জন্য নির্ধারিত কোনো বিদ্যালয় থাকিবে সেই প্রশ্ন আলোচিত হয় নাই। আমার মনে হয় কেবলমাত্র দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং অতিরিক্ত কর্মভার প্রপীড়িত জনক-জননীর সন্তানদের জন্যই নয়, সকল শিশুদের জন্যই বিশেষ করিয়া শহরের শিশুদের জন্য নার্সারি স্কুল বা শিশুপালনাগার একান্ত আবশ্যক। আমি বিশ্বাস করি যে, যে কোনো অবস্থাপন্ন লোকের পুত্রকন্যা অপেক্ষা ডেপ্টফোর্ডে [Deptford] শ্রীমতী ম্যাকমিলান কর্তৃক পরিচালিত নার্সারি স্কুলের শিশুরা ভালো শিক্ষা পাইতেছে। এইরূপ সুশিক্ষার ব্যবস্থা ধনী-দরিদ্র সকল শিশুর জন্যই প্রসারিত হউক, ইহাই আমি কামনা করি। কোনো একটি বিশেষ নার্সারি স্কুলের বিষয় বর্ণনা করার পূর্বে কি কি কারণে এরূপ বিদ্যালয় বাঞ্ছনীয় তাহা আলোচনা করা যাক।

প্রথমেই বলা যায়–শিশুর দৈহিক স্বাস্থ্য ও মানসিক গুণগুলি বিকাশের পক্ষে শৈশবকাল অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর দেহ ও মনের বিকাশ পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ উল্লখ করা যায় : ভয় শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের ত্রুটির কারণ হইয়া দাঁড়ায় এবং দোষপূর্ণ শ্বাস-প্রশ্বাসের অভ্যাস নানাপ্রকার রোগ সৃষ্টি করে। ভয় মানসিক ব্যাপার কিন্তু শিশুর দেহের উপরও ইহার প্রক্রিয়া রহিয়াছে। এইরূপ পরস্পরাবদ্ধ সম্বন্ধ এত বেশি যে, চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছুটা জ্ঞান ব্যতীত শিশুর চরিত্রগঠনে আশানুরূপ ফললাভ সম্ভবপর নয়। তেমনই শিশুর মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান না থাকিলে কেহ শিশুকে স্বাস্থ্যবান করিয়া গড়িয়া তোলার আশাও করিতে পারেন না। শিশুর দেহ ও মন উভয়দিকের পুষ্টিসাধনের জন্য যেরূপ জ্ঞান প্রয়োজনীয় তাহার অধিকাংশই নূতন; প্রাচীন চিরাচরিত প্রথার সহিত ইহাদের মিল নাই। উদাহরণস্বরূপ শিশুকে শৃঙ্খলা মানিয়া চলিতে অভ্যাস করানোর প্রশ্নটি ধরুন, শিশুর সহিত কোনো দ্বন্দ্বে অর্থাৎ আপনি তাহাকে যেরূপভাবে চলিতে, যেরূপ আচরণ করিতে বলেন তাহা যদি সে না মানিয়া চলে এইরূপ অবস্থার প্রধান নীতি হইল : আপনি নত হইবেন না বা পরাজয় স্বীকার করিবেন না কিন্তু শিশুকে শাস্তি দিয়া বাধ্য করিতে বা জোরজবরদস্তি করিতে চেষ্টাও করিবেন না। সাধারণ পিতামাতা ইহার। বিপরীত পন্থাই গ্রহণ করেন; নির্ঝঞ্ঝাট ও শান্ত জীবন কামনা করিয়া অনেক পিতামাতা পুত্রকন্যার সঙ্গে এরূপ কোনো দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হন না, আবার কখনও বা শিশুদের ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হইয়া শাস্তি দিয়া তাকেন। এইরূপ ক্ষেত্রে কৃতকার্য হইতে হইলে পিতামাতার চরিত্রেও বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। তাহা হইল ধৈর্য এবং নীরবে প্রভাব বিস্তার করার মতো চারিত্রিক শক্তি। এই তো গেল শিশুর ক্রমবিকাশ ব্যাপারে অভিভাবকের মনস্তত্ত্বসম্মত আচরণের কথা। এইবার ধরুন শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে মুক্ত বায়ুর প্রভাবের কথা। বুদ্ধি প্রয়োগ এবং সতর্কতা অবলম্বন করিলে দিবারাত্রি সর্বদাই মুক্ত বাতাস এবং কম পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত থাকা শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী কিন্তু সতর্কতা এবং বুদ্ধির অভাবে হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগার ফলে শিশুর অপকার হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

পিতামাতার পক্ষে শিশুদিগকে মানুষ করার উপযুক্ত নূতন জ্ঞান ও কৌশল সম্বন্ধে জ্ঞান বা সেইগুলি প্রয়োগ করার অবসর নাও থাকিতে পারে। অশিক্ষিত পিতামাতার বেলায় এ প্রশ্ন উঠে না; প্রকৃত উপায় তাহারা জানেন না, বুঝাইয়া দিলেও বিশ্বাস করেন না। আমি সমুদ্রের ধারে একটি কৃষিপ্রধান জেলায় বাস করি; এইখানে টাটকা খাদ্যদ্রব্য সহজে মেলে, শীত বা গ্রীষ্মের আধিক্যও বেশি নয়। শিশুদের স্বাস্থ্যের পক্ষে চমৎকার বলিয়াই আমি এই স্থান পছন্দ করিয়াছিলাম। তথাপি এখানকার কৃষক এবং দোকানিদের প্রায় সব ছেলেমেয়েদের মুখ দেখি রোগা ফ্যাকাসে, কাজকর্মে তাহারা অলস, কেবল খেলাধুলায় পটু। সমুদ্রের তটে তাহারা কখনও যায় না কারণ তাহাদের ধারণা পা ভিজানো স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ানক খারাপ। গৃহের বাহির হইলেই তাহারা পশমের মোটা কোট পরিয়া থাকে, এমনকি গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের দিনেও ইহার ব্যতিক্রম নাই। খেলার সময় যদি হইচই করে তাহাদের আচরণ দ্র করার চেষ্টা করা হয়। অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাহারা বাড়ির বাহিরে থাকিলে কোনো আপত্তি করা হয় না, খাদ্যের ব্যাপারে কোনো বাধা নিষেধ নাই; বয়স্ক ব্যক্তিদের উপযোগী ছোটদের পক্ষে অপকারী সব রকম খাদ্যই তাহারা গ্রহণ করে। তাহাদের পিতামাতারা বুঝিতে পারে না তাহাদের ছেলেমেয়েরা ঠাণ্ডায় এতদিন মরিয়া যায় নাই কেন। কিন্তু চোখের সম্মুখে উদাহরণ দেখিয়াও তাহারা বিশ্বাস করে না যে, তাহাদের সন্তান মানুষ-করার প্রণালীতে অনেক গলদ আছে। তাহারা দরিদ্র নয়, সন্তানের প্রতি স্নেহহীনও নয় কিন্তু কুশিক্ষার ফলে নিদারুণভাবে অজ্ঞ। শহরবাসী গরিব ও কর্মক্লান্ত পিতামাতার পক্ষে এইরূপ অশিক্ষার কুফল আরও বেশি। কিন্তু যে পিতামাতা উচ্চশিক্ষিত, সন্তানের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন এবং অতিরিক্ত কর্মব্যস্ত নন তাঁহারাও শিশুদের পক্ষে যে পরিমাণ যত্ন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার এবং যে পরিমাণ শিক্ষা তাহারা নার্সারি স্কুলে পায় সেইরূপ বাড়িতে দিতে পারে না। শিশুদের ক্রমবিকাশের অনুকূল যে সর্বপ্রধান ব্যবস্থা অর্থাৎ সমবয়সী শিশুদের সঙ্গ, তাহা বাড়িতে দুর্লভ। পরিবার যদি ছোট হয় আজকাল ইহা হইয়াছে রীতি–তবে শিশুরা বয়স্কদের দৃষ্টি বেশি আকর্ষণ করে। প্রায় সর্বদা তাহাদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। ইহার ফলে শিশুরা ভেঁপো ও হঁচড়েপাকা হইয়া ওঠে। ইহা ছাড়া অনেক শিশুর সংস্পর্শে আসার ফলে শিশু যে বাস্তক শিক্ষা পায় পিতামাতা তাহা দিতে পারেন না। ধনী ব্যক্তিরাই কেবল-শিশুদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ফাঁকা জায়গা এবং খেলার সরঞ্জামের ব্যবস্থা করিতে পারেন। কিন্তু ইহারও কুফল আছে। যে শিশুদের এইরূপ বিশেষ বন্দোবস্ত থাকে তাহাদের মনে ইহার জন্য গর্ববোধ হয় এবং তাহারা নিজদিগকে অন্যের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে। করে। নৈতিক শিক্ষা হিসাবে ইহা বড়ই ক্ষতিকর। এইসব কারণে আমার মনে হয়, কাছাকাছি নার্সারি স্কুল থাকিলে অবস্থাপন্ন এবং উচ্চশিক্ষিত পিতামাতাও দুই বৎসর বয়সের সময় হইতেই শিশুকে সেইখানে পাঠাইলে উপকারই পাইবেন।

বর্তমানে পিতামাতার অবস্থানুযায়ী সন্তানদের শিক্ষার জন্য বিলাতে দুই রকম শিশু-বিদ্যালয় আছে : ফ্রয়বেল স্কুল এবং মন্তেসরি স্কুলে ধনী লোকদের ছেলেমেয়েদের জন্য; গরিব লোকদের সন্তান-সন্ততির জন্য আছে অল্প সংখ্যক নার্সারি স্কুল। নার্সারি স্কুলগুলির জন্য স্ত্রীমতী ম্যাকমিলানের বিবরণ সন্তানের মঙ্গলকামী প্রত্যেক ব্যক্তিরই পড়া উচিত। আমার মনে হয় ধনীব্যক্তির ছেলেমেয়েদের জন্য পরিচালিত কোনো-স্কুলই শ্ৰীমতী ম্যাকমিলানের স্কুলের মতো এত ভালো নয়, কারণ এইখানে ছাত্রসংখ্যা বেশি; তাহা ছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকগণ যেমন অল্পতেই হইচই করিয়া শিক্ষককে বিব্রত করিয়া তোলেন এইখানে সেইরূপ হয় না। শ্ৰীমতী ম্যাকমিলান সম্ভবপর হইলে শিশুকে এক বছর হইতে সাত বৎসর পর্যন্ত তাঁহার স্কুলে রাখেন যদিও শিক্ষাকর্তৃপক্ষ শিশুদিগকে পাঁচ বৎসর বয়সে সাধারণ প্রাথমিক স্কুলে পাঠাইবার পক্ষপাতী। শিশুরা সকাল আটটায় স্কুলে আসে এবং সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত থাকে; তাহারা সকলেই স্কুলের খাবার খায়। যতক্ষণ সম্ভব তাহারা ঘরের বাহিরেই কাটায়। ঘরেও প্রচুর মুক্ত বাতাসের বন্দোবস্ত আছে। শিশুকে ভর্তি করার পূর্বে তাহাকে ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়া দেখা এবং কোনো অসুখ থাকিলে চিকিৎসা করিয়া আরোগ্য করানো হয়। অতি অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হইলেও ভর্তির পর সাধারণত সুস্থ থাকে। স্কুলে একটি বড় মনোরম উদ্যান আছে; এইখানে অনেক সময় আনন্দে খেলাধুলায় অতিবাহিত হয়। মন্তেসরি প্রণালীতে শিক্ষাদান করা হইয়া থাকে। দুপুরে খাওয়ার পর সকল শিশু ঘুমাইয়া পড়ে। যদিও রাত্রিতে এবং রবিবারে শিশুদিগকে নিরানন্দ জীর্ণ বাসগৃহে অনেক সময় মাতাল পিতামাতার সঙ্গে একই কুঠুরিতে ঘুমাইতে হয় তবে দেহে এবং বুদ্ধিতে এই শিশুগণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের মতোই যোগ্যতা অর্জন করে। শ্রীমতী ম্যাকমিলান তাহার বিদ্যালয়ের সাত বৎসর বয়স্ক বালক-বালিকার কথা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন :

তাহারা প্রায় সকলেই দীর্ঘ ও ঋজু। সকলেই দীর্ঘ না হইলেও ঋজু সবাই; বেশির ভাগেরই দেহ সুগঠিত, পরিষ্কার ত্বক, উজ্জ্বল চোখ এবং রেশম কোমল চুল। উচ্চ মধ্যবিত্তশ্রেণির সাধারণ ছেলেমেয়ে অপেক্ষা ইহারা প্রায় সকলেই উন্নত ধরনের। এই গেল দৈহিক আকৃতি ও গঠনের কথা। মানসিক দিক দিয়াও ইহারা তীক্ষ্ণ অনুভূতি-সম্পন্ন, অপরের সঙ্গে মিলিতে ইচ্ছুক, নানা কাজের ভিতর দিয়া অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে উৎসুক। ভালো লিখিতে পারে এবং অনায়াসে বলিতে পারে। এইরূপ যে-কোনো ছাত্র ভালো ইংরাজি এবং ফরাসি ভাষাও বলে। সে কেবল নিজের যত্ন নিজে লইতেই শেখে নাই, কয়েক বছর ধরিয়া অন্যান্য ছোট ছেলেমেয়েকে সাহায্য করিয়াছে; সে গণিত পারে, ওজন করিতে পারে, নকশা আঁকিতে পারে; বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি তাহার হইয়াছে। তাহার প্রথম কয়েক বৎসর শান্ত ও প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে কৌতুক ও আমাদের ভিতর দিয়া অতিবাহিত হইয়াছে, শেষের দুই বৎসর হইয়াছে নানা গবেষণা এবং আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাপূর্ণ। বাগান সম্বন্ধে তার ধারণা হইয়াছে; সে নিজে চারগাছ পুঁতিয়াছে, জলসিঞ্চন করিয়াছে, গাছপালা এবং প্রাণীর যত্ন পরিচর্যা করিয়াছে। সাত বৎসর বয়সের বালক-বালিকা নাচিতে পারে, গান করিতে পারে এবং অনেক খেলা জানে। এই রকম হাজার হাজার ছেলেমেয়ে নিম্ন প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির জন্য উপস্থিত হইবে। ইহাদিগকে লইয়া কি করা যায়? আমি প্রথমেই উল্লেখ করিতে চাই যে, সমাজের নিম্নস্তর হইতে এইরূপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সবল সুস্থ বালক বালিকা স্কুলে ভিড় করিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের কাজ বহুলাংশে পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। হয় নার্সারি স্কুল ব্যর্থ হইয়া একটি বাজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে, আর না হয় ইহার প্রভাব শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও পড়িবে। ইহা নূতন ধরনের শিক্ষার্থীদল প্রস্তুত করিবে এবং দুই দিন পরেই হউক আর পরবর্তীকালেই হউক শুধু সব রকম স্কুলই নয় সামাজিক জীবন, শাসনব্যবস্থা, আইনকানুন এবং আমাদের সহিত অন্য জাতির সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করিবে।

নার্সারি স্কুলে সুফল স্বরূপ যাহা আশা করা হইয়াছে তাহার মধ্যে অতিরঞ্জন আছে বলিয়া আমি মনে করি না। নার্সারি স্কুল যদি সর্বজনীন করা যায় তবে ইহা এক প্রজন্মকালের মধ্যে [In one generation] অর্থাৎ পঁচিশ বৎসরের মধ্যে বর্তমান সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ভিতর শিক্ষাগত যে গভীর পার্থক্য রহিয়াছে তাহা দূর করিতে সমর্থ হইবে। ইহা সকল নাগরিকের মানসিক ও দৈহিক উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হইবে, যাহা বর্তমানে কেবল অল্পসংখ্যক ভাগ্যবান এই সুবিধা ভোগ করিতেছেন। যে রোগ অপচিকীর্ষা এবং অজ্ঞতার গুরুভার মানুষের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে তাহা দূর করিতে পারিবে। ১৯১৮ সনের শিক্ষা আইন অনুসারে সরকারি অর্থে নার্সারি স্কুলের উন্নতি সাধনের কথা ছিল কিন্তু পরে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে সুবিধা লাভের আশায় যুদ্ধ জাহাজ এবং সিঙ্গাপুর জাহাজঘাট [Dock] নির্মাণ করাই অধিকতর প্রয়োজনীয় বলিয়া বিবেচিত হয়। সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য গভর্নমেন্ট বর্তমানে কেবল এই খাতেই বার্ষিক সাড়ে ছয় লক্ষ পাউন্ড ব্যয় করিতেছেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাদের সন্তানদিগকে রোগ-দুর্দশা এবং অশিক্ষার মধ্যে নিক্ষেপ করা হইয়াছে অথচ সামাজ্য রক্ষার্থে যুদ্ধের আয়োজনে প্রতি বৎসর যে পরিমাণ টাকা খরচ করা হয় তাহা নার্সারি স্কুলের বাবদ ব্যয় করিলে জনসাধারণকে এই দুর্ভোগের কবল হইতে রক্ষা করা সম্ভব। মহিলাগণ এখন ভোটের অধিকার পাইয়াছে। তাহারা কি নিজেদের পুত্রকন্যার মঙ্গলকামনায় একদিন ইহা প্রয়োগ করিতে শিখিবেন?

নার্সারি শিক্ষার বৃহত্তম দিকটি ছাড়াও অন্য একটি বিষয় বিবেচনা করিবার আছে। শিশুদের উপযুক্ত যত্ন ও তত্ত্বাবধান বাবদ কাজ রীতিমত শিক্ষাসাপেক্ষ; পিতামাতার নিকট হইতে ইহা আশা করা যায় না এবং পরবর্তিকালের বিদ্যালয় শিক্ষা হইতেও ইহা পৃথক। শ্রীমতী ম্যাকমিলানের কথা আবার উদ্ধৃত করি :

নার্সারিতে প্রতিপালিত শিশুর স্বাস্থ্য ভালো। তুলনায় সে কেবল বস্তির ছেলেমেয়ে হইতেই উৎকৃষ্ট নয়, ভালো জেলার মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুও তাহার সমকক্ষ নয়। ইহা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শিশুকে মানুষ করিতে অপত্যস্নেহ এবং পিতামাতার দায়িত্ববোধ হইতেও বেশি কিছু আবশ্যক। শাসন এবং জোরজবরদস্তি ব্যর্থ হইয়াছে, জ্ঞানবিহীন অপত্যস্নেহ ব্যর্থ হইয়াছে কিন্তু শিশুর স্বভাব পরিবর্তিত হয় নাই। শিশুকে গড়িয়া তোলার চিন্তা বিশেষ শিক্ষা এবং কৌশলসাপেক্ষ।

তিনি আরও বলিয়াছেন :

নার্সারি স্কুলের একটি বড় সুফল হইল এই যে শিশুরা বর্তমানে প্রচলিত পাঠ্যক্রম দ্রুত শেষ করিতে পারিবে। প্রাথমিক বিদালয়ে ছাত্র-জীবনের অর্ধেক কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ কাল শেষ হইতেই তাহারা উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্য হইয়া উঠিবে! … মোট কথা, পাঁচ বৎসর বয়স পর্যন্ত হওয়া শিশুকে কেবল তদারক করার আখড়া না হইয়া নার্সারি স্কুল যদি প্রকৃতই শিশুর দৈহিক ও মানসিক শিক্ষার নিকেতন হয় তবে অল্প দিনেই ইহা আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আনয়ন করিবে। ইহা নিম্নপ্রাথমিক বিদ্যালয় হইতে শুরু করিয়া সকল প্রকার শিক্ষায়তন ছাত্রদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির মান উন্নত করিবে। বর্তমানে যে রোগ ও দুঃখ-দুর্দশার প্রকোপের ফলে শিক্ষক অপেক্ষা চিকিৎসকের প্রয়োজন বেশি অনুভূত হয় তাহা দূর করা সম্ভবপর হইবে। বর্তমানের বিদ্যালয় ইহার বিরাট প্রাচীর, প্রকাণ্ড প্রবেশ পথ, শক্ত খেলার মাঠ, আলোহীন বড় বড় শ্রেণিকক্ষ তখন দানবীয় ভবন বলিয়া মনে হইবে। নার্সারি স্কুল শিক্ষকদের প্রতিভা বিকাশের এক নূতন সুযোগ আনিয়া দিবে।

বাল্যের চরিত্রগঠনের শিক্ষা এবং পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষাদানে এই দুই অবস্থার মধ্যবর্তীকালীন শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে নার্সারি স্কুল। নার্সারি স্কুল এই উভয় দায়িত্ব পালন করে। শিশুর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাদান কার্যে প্রাধান্য দেওয়া হয়; এইরূপ বিদ্যায়তনেই শ্রীমতী মন্তেসরি তাঁহার শিক্ষাপ্রণালীর সার্থক প্রয়োগ করিয়াছিলেন। রোমে একটি বিরাট বাড়ির একটি বড় কক্ষে তিনি তিন হইতে সাত বৎসর বয়সের শিশুদের এক শিশুনিকেতন পরিচালনা করেন। ডেপ্টফোর্ডে যেমন তেমনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই আসিত : ডেপ্টফোর্ডের মত এখানেও দেখা গিয়েছিল যে বাল্যকাল হইতে যত্ন লইলে শিশুদিগকে গৃহের কুফল এবং অসুবিধা হইতে রক্ষা করিয়া তাহাদের যথোপযুক্ত দৈহিক ও মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভবপর।

ইহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, (সেগুই-এর পর হইতে), শিশুদের শিক্ষায় যাহা কিছু উন্নতি হইয়াছে তাহা সবই হইয়াছে বুদ্ধিহীন এবং দুর্বলচিত্ত লোকদের পরীক্ষার ফল হইতে। জড়প্রকৃতি, দুর্বল মানসিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদিগকেও মানসিক শক্তির বিষয়ে শিশু বলা যাইতে পারে। ইহাদের ক্ষীণ মননশক্তি বা বৃদ্ধিহীনতা দূষণীয় মনে করা হইত না বা শাস্তি দিয়া ইহা দূর করা যাইবে এমন ধারণাও করা হইত না। এই জন্যেই ইহাদের বৈশিষ্ট্য এবং প্রতিকারের উপায় চিন্তা করা হইয়াছিল। ডক্টর আর্নল্ড যেমন করিতেন যে, চাবুক মারাই কুঁড়েমি দূর করার একমাত্র ঔষধ; তাঁহার পরবর্তীকালের শিক্ষাবিদগণ সেইরূপ মনে করিতেন না। এইজন্য ক্রোধের বশবর্তী হইয়া নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি লইয়াই তাঁহারা এইরূপ ছাত্রদের অবস্থা পর্যালোচনা করিতেন; কেহ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারিলে ক্রুব্ধ শিক্ষক তাহাদিগকে বলিতেন না যে, বুদ্ধিহীনতার জন্য তাহাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। বয়স্ক ব্যক্তিরা যদি শিশুদের প্রতি ধমক ও উপদেশ বর্ষণের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিতে পারিত তবে দুর্বল মননশক্তিসম্পন্ন লোকদিগকে পরীক্ষা না করিয়া তাহারা বুদ্ধিহীন শিশুদের শিক্ষার উপায় নির্ধারণ করিতে সক্ষম হইত। নৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধে ধারণাই বহু অন্যায়ের জন্য দায়ী। দুইটি বালকের কথা কল্পনা করুন–একজন সৌভাগ্যক্রমে নার্সারি স্কুলে শিক্ষা পাইয়াছে। অন্যজন বস্তিজীবনের মধ্যে লালিতপালিত হইয়াছে। দ্বিতীয় বালকের যদি দৈহিক এবং মানসিক বিকাশ প্রথম বালকের তুলনায় হীনতর হয় তবে সে কি নিজেই ইহার জন্য নৈতিক দিক দিয়া দায়ী? সেই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার জন্য তাহার পিতামাতা তাহার যথোপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারিল না। সেই তাহার পিতামাতা কি সেই কারণে নৈতিকভাবে দায়ী? পাবলিক স্কুলে পড়িবার সময় ধনীব্যক্তিদের মনে স্বার্থপরতা এবং কতকগুলি ভ্রান্ত ধারণা সঞ্চারিত করা হয়। আর ইহার ফলেই তাহারা নিজেদের একটি পৃথক সমাজ সৃষ্টি করিয়া সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে ভোগবিলাসে মগ্ন হয়। এইজন্য ধনীরাই কি নৈতিকভাবে দায়ী? সকলেই অবস্থার দাস; বাল্যে তাহাদের চরিত্রের বুনন শুরু হইয়াছে, স্কুলে তাহাদের বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশ লাভ করে নাই। ইহার জন্যে নৈতিক দায়িত্ব তাহাদের ঘাড়ে চাপাইয়া কোনো লাভ নাই; তাহারা অন্যের মতো চরিত্রগঠনের পক্ষে অনুকূল বাল্যকাল এবং বুদ্ধি বিকাশের পক্ষে অনুকূল বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিতে না পারিলে তাহাদের দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়া অথবা তাহাদিগকে তিরস্কারে লাঞ্ছিত করিয়া কোনো উপকার হইবে না।

জাগতিক ব্যাপারে অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রেও তেমন উন্নতির একমাত্র পথই আছে; তাহা হইল প্রেম কর্তৃক বিধৃত বিজ্ঞান। বিজ্ঞান ব্যতীত প্রীতি শক্তিহীন; প্রীতিহীন বিজ্ঞান ধ্বংসকারী। শিশুদের শিক্ষাদান প্রণালীর যাহা কিছু উন্নতি হইয়াছে তাহা সম্ভব হইয়াছে এইরূপ ব্যক্তি সকলের চেষ্টায় যাহারা শিশুদিগকে ভালোবাসিতেন; উন্নততর প্রণালী উদ্ভাসিত হইয়াছে এইরূপ ব্যক্তিসকলের দ্বারা যাহারা শিশুর ক্রমবিকাশ ও মনঃপ্রকৃতি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য অবগত ছিলেন। ইহা স্ত্রীলোকদিগের উচ্চ শিক্ষালাভের একটি সুফল। আগেকার দিনে শিশুপ্রীতি এবং বিজ্ঞানের একত্র মিলন ঘটে নাই। বর্তমান যুগে শিশুদের মন গড়িয়া তোলার মতো যে ক্ষমতা বিজ্ঞান আমাদের হাতে দিয়াছে তাহা বড়ই নিদারুণ; এই ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার সম্ভবপর। ভ্রান্ত লোকে ইহা প্রয়োগ। করিয়া পশুরাজ্য অপেক্ষাও নিষ্ঠুর নির্দয় মানব-সমাজ গড়িয়া তুলিতে পারে। শিশুদিগকে ধর্ম, স্বদেশপ্রীতি এবং সাহস কিংবা কমিউনিজম, শ্রমিকতন্ত্রবাদ এবং বিপ্লববাদ শিক্ষা দেওয়ার অজুহাতে সংকীর্ণমনা, যুদ্ধপ্রিয় এবং হৃদয়হীন পশুরূপে গড়িয়া তোলা যাইতে পারে। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা তাহাদের শিক্ষাদানে অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত; শিশুদের অন্তরে প্রতিবোধ জাগানো ইহার উদ্দেশ্য হওয়া আবশ্যক। তাহা না হইলে বিজ্ঞানের উন্নতি শিশুদের অপকার করার ক্ষমতাই ক্রমে বাড়াইয়া দিবে।

শিশুর প্রতি ভালোবাসা কার্যকরি শক্তি হিসাবে মানবসমাজে বিদ্যমান রহিয়াছে; শিশু-মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস এবং শিশুর শিক্ষা-প্রণালীর উন্নতিই ইহার প্রমাণ। এই শিশুপ্রীতি এখনও পর্যন্ত দুর্বল বলিয়াই আমাদের রাজনীতিকগণ অত্যাচার ও রক্তপাতের পথে নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অগণিত শিশুর জীবন বলি দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। তথাপি শিশুর প্রতি মানুষের প্রীতি আছে এবং ক্রমে বৃদ্ধি পাইতেছে। যে সকল ব্যক্তি শিশুদিগের প্রতি স্নেহশীল তাহারাই আবার এমন ভাব মনে পোষণ করেন যাহার ফলে শিশুরা পরবর্তীকালে যুদ্ধবিগ্রহে মৃত্যুবরণ করিতে অনুপ্রাণিত এবং বাধ্য হয়। যুদ্ধকে বলা যায় বহু লোকের সম্মিলিত পাগলামি। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ক্রমে বয়স্ক ব্যক্তির জীবন পর্যন্ত প্রসারিত হোক ইহা কি আশা করা চলে না? শিশুদিগকে যাহারা ভালোবাসেন তাহারা তাহাদের অপত্যস্নেহ ও অনুরাগ কি শিশুদের পরবর্তী বয়স্ক জীবনেও বিস্তৃত করিতে পারেন না? শিশুদিগকে সবল দেহ ও বলিষ্ঠ মনে ভূষিত করিয়া তুলিয়া আমরা কি তাহাদিগকে তাহাদের শক্তি ও উদ্যমকে নূতন উন্নততর জগৎ গড়িয়া তোলার কাজে নিয়োগ করিতে দিব, না তাহারা এইকাজে প্রবৃত্ত হইলে আমরা ভয়ে পিছাইয়া গিয়া তাহাদিগকে পুনরায় দাসত্ব ও গতানুগতিক অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করিব? শিশুদের মঙ্গল করা এবং অমঙ্গল করা দুই ব্যাপারেই বিজ্ঞান আমাদের প্রধান সহায়। কোন পথ আমরা অবলম্বন করিব তাহা নির্ভর করে আমরা শিশুদিগকে ভালোবাসি না ঘৃণা করি তাহার উপর। কিন্তু দেখা যায় নৈতিক আদর্শের ধ্বজাধারীগণ শিশুদের প্রতি ঘৃণাকেই নানা আপাতশোভন নামের আবরণে ডাকিয়া অনুরাগের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং কাম্য আদর্শ বলিয়া প্রচার করেন।

সাধারণ নীতি : আমরা এ পর্যন্ত শিশুর চরিত্রগঠনের শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি। এই শিক্ষা প্রধানত বাল্যের শিক্ষা। ঠিকমতো পরিচালিত হইলে শিশুর ছয় বৎসর বয়সের মধ্যেই ইহা সম্পূর্ণ হইবে। আমি এইকথা বলি না যে, ছয় বৎসর বয়সের পর বালকের চারিত্রিক গঠন আর পরিবর্তিত হইতে পারে না; এমন কোনও বয়স নাই যখন প্রতিকূল ঘটনা বা পরিবেশ শিক্ষা পাইলে ছয় বৎসর বয়সের মধ্যে বালক বা বালিকার এমন বাসনা ও অভ্যাস গঠিত হয় যে, তাহা ঠিক পথেই চালিত হয়, কেবল পরিবেশের প্রতি অভিভাবকের কিছুটা দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। ছয় বৎসর পর্যন্ত উপযুক্ত বাল্যশিক্ষাপ্রাপ্ত বালক-বালিকা যে বিদ্যালয়ে পড়ে তথাকার কর্তৃপক্ষ অবিবেচক না হইলে তবে সেইস্থানে নৈতিক উপদেশদানের বিশেষ কোনো প্রয়োজন হইবে না, কেননা ছাত্রদের নিকট হইতে আর যে সব গুণের বিকাশ আশা করা হইবে তাহা বুদ্ধিমূলক শিক্ষার ফলস্বরূপ আপনা হইতে বিকশিত হইবে। ইহাই যে একমাত্র নীতি এবং ইহার কোনো ব্যতিক্রম নাই এইকথা আমি বলিতেছি না; নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়ার কোনো আবশ্যকতা নাই। স্কুল কর্তৃপক্ষকে শুধু এই কথাটিই মনে রাখিতে হইবে। এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই যে, ছয় বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশু চরিত্রগঠনের শিক্ষা পাইলে স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত কেবল বুদ্ধিমূলক শিক্ষার সুব্যবস্থা করা; কারণ ইহার মাধ্যমেই শিশুর চরিত্রের অন্য বাঞ্ছিত গুণগুলি পরিপূর্ণতা লাভ করিবে।

অবাঞ্ছনীয় বিষয়ের প্রতি কৌতূহল : শিক্ষাদান যদি নৈতিক বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত হয় তবে তাহা বুদ্ধির পক্ষে এবং শেষ পর্যন্ত চরিত্রের পক্ষে হানিকর হইয়া দাঁড়ায়। ইহা মনে করা উচিত নয় যে, কতক জ্ঞান ক্ষতিকর এবং কতক বিষয়ে অজ্ঞতা ভালো। শিক্ষার জন্যই শিক্ষাদান করা উচিত, কোনো নৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রমাণ করার জন্য নহে। ছাত্রের তরফ হইতে বিবেচনা করিলে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তাহার কৌতূহল নিবৃত্ত করা এবং এমন দক্ষতা আয়ত্ত করানো যাহার ফলে সে নিজেই কৌতূহল মিটাইতে সক্ষম হয়। শিক্ষকের তরফ হইতেও কতক ফলদায়ক কৌতূহল জাগ্রত করা উচিত। স্কুলের শিক্ষা বিষয়ের বহির্ভূত কোনো কিছুর প্রতি ছাত্রের কৌতূহল উদ্দীপ্ত হইলেও তাহাকে নিরুৎসাহ করা উচিত নহে। এই কৌতূহল পরিতৃপ্ত করার জন্য স্কুলের পাঠ্যবিষয়ে কোনোরূপ ব্যতিক্রম বা বিঘ্ন সৃষ্টি করার প্রয়োজন নাই; তাহাকে বরং প্রশংসনীয় কৌতূহলের জন্য উৎসাহিত করিয়া স্কুলের সময়ের পরে, অন্য উপায়ে–যেমন পাঠাগার হইতে বই লইয়া, কিভাবে যে কৌতূহল নিবৃত্ত করিতে পারিবে সে সম্বন্ধে উপদেশ ও নির্দেশ দান করা উচিত। এই বিষয়ে যেরূপ তর্ক উঠিতে পারে আগেই তাহার আলোচনা করা যাক। ছাত্রের কৌতূহলকে উৎসাহিত করিতে হইবে বলা হইয়াছে কিন্তু এ কৌতূহল যদি বিকৃত হয় তবে কি করা হইবে? বালক যদি অশ্লীলতা অথবা নিষ্ঠুরতার প্রতি কৌতূহলী হয় তবে কি করা হইবে? অন্যে কি করে কেবল তাহা জানিতেই যদি তাহার কৌতূহল হয় তবে কি করা হইবে? এইরূপ কৌতূহলেও কি তাহাকে উৎসাহ দিতে হইবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাদিগকে একটি পার্থক্যের কথা মনে রাখিতে হইবে। কখনই আমাদের এইরূপ আচরণ করা উচিত নহে যাহাতে বালকের কৌতূহল কেবল একই বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অবাঞ্ছনীয় বিষয়ের প্রতি কৌতূহলের উদ্রেক হইয়াছে বলিয়াই বালককে অপরাধী মনে করার কিংবা তাহার নিকট হইতে ওই সব বিষয়ের জ্ঞান লুকাইয়া রাখিবার কোনো প্রয়োজন নাই। প্রায় সকল ক্ষেত্রে দেখা যায়, এইসব বিষয় বালকের নিকট হইতে গোপন রাখার ফলেই ইহাদের প্রতি সে আকৃষ্ট হয়; কতক ক্ষেত্রে মানসিক রোগ এইজন্য দায়ী এবং এই রোগের চিকিৎসা করানো আবশ্যক। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই বাধা নিষেধ ও নৈতিক ভীতি প্রদর্শন ইহার নিরাময় করার উপযুক্ত উপায় নহে। অশ্লীলতার প্রতি কৌতূহলের উদাহরণটি লওয়া যাক; সাধারণভাবে এটি ব্যাপক আকারে দেখা যায়।

অশ্লীলতার প্রতি কৌতূহল যে বালক বা বালিকার কাছে যৌন বিষয়ের জ্ঞান অন্যান্য বিষয়ের মতোই অতি সাধারণ, অর্থাৎ কোনোরূপ বাধা নিষেধ বা গোপনতার অবলম্বনের ফলে ইহার প্রতি যাহার কোনো আকর্ষণ সৃষ্টি হয় নাই তাহার নিকট ইহার কোনো মোহ বা কৌতূহল থাকিতে পারে না। যে বালক কোনো অশ্লীল ছবি সংগ্রহ করে সে ইহা সংগ্রহ করার কৌশলের জন্য এবং ছবির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তাহার অন্য সঙ্গীদের তুলনায় বেশি কিছু জানে ইহা ভাবিয়া গর্ব বোধ করে। তাহাকে যদি যৌন বিষয় সম্বন্ধে খোলাখুলিভাবে আগেই বলা হইত তবে সে এইরূপ ছবিতে বিশেষ কোনো কৌতূহল বোধ করিত না। ইহা সত্ত্বেও যদি কোনো বালক এইরূপ ছবির প্রতি এবং যৌনজীবনের প্রতি কৌতূহল দেখাইতে থাকে তবে আমি বিশেষজ্ঞের দ্বারা তাহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিব। চিকিৎসার পদ্ধতি হইবে এইরূপ : প্রথমে বালককে তাহার মনের সব চিন্তা ও বাসনা তাহা যতই অশ্রাব্য বা অকথ্য হউক না কেন প্রকাশ করিয়া চলিতে উৎসাহ দিতে হইবে; এই সম্বন্ধে তাহাকে আরও অনেক বেশি বিষয় জানানো হইবে, এইভাবে তাহাকে যৌনজীবনের বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলি জানাইলে ইহার প্রতি তাহার কৌতূহল নিভিয়া আসিবে। সে যখন বুঝিবে যে, এই সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছু জানিবার নাই এবং যাহা জানা হইয়াছে তাহাও চমকপ্রদ নয় তখন সে এই মানসিক ব্যাধি হইতে আরোগ্য লাভ করিবে। এই বিষয়ে বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে যে, যৌনজ্ঞান দোষের কিছু নয়, কেবল কোনো কিছু সম্বন্ধে সর্বদা চিন্তায় তন্ময় হইয়া থাকাই ক্ষতিকর। জোর করিয়া মনকে অন্য কোনো বিষয়ে নিবদ্ধ করিলে এইরূপ তন্ময়তার ঝোঁক নিবারণ করা যায় না, মানসিক ব্যাধিও নিরাময় হয় না, ইহার জন্য বরং দরকার সেই বিষয়েই তাহাকে আরও বেশি করিয়া ভাবিবার এবং জানিবার সুযোগ দেওয়া। এই উপায়ে তাহার অস্বাভাবিক এবং অসুস্থ মনের পরিচয়ক বাসনাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা চলে। ইহা করা হইলে তখন সে-কৌতূহল আর অপকারক হয় না বা মনকে কেবল একই দিকে সর্বক্ষণ নিবদ্ধ করিয়া রাখে না। আমার বিশ্বাস, ইহাই কোনো সংকীর্ণ এবং অস্বাভাবিক কৌতূহল দমন করিবার প্রকৃষ্ট উপায়। নিষেধ করিয়া বা নৈতিক শাস্তির ভয় দেখাইয়া ইহা নিবৃত্ত করিতে গেলে বিপরীত ফলের সম্ভাবনাই বেশি।

চরিত্রের উন্নতিসাধন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য নয়, তবু মানব-চরিত্রের কতকগুলি বাঞ্ছিত গুণ আছে, জ্ঞান অর্জনের জন্য যেগুলি বিশেষ প্রয়োজনীয়। ইহাদিগকে বুদ্ধিমূলক গুণ বলা যাইতে পারে। বুদ্ধিমূলক শিক্ষার ফলস্বরূপ ইহাদের বিকাশ সাধিত হওয়া উচিত, গুণ হিসাবে পৃথকভাবে ইহাদিগকে আয়ত্ত করার প্রশ্ন ওঠে না, জ্ঞান অর্জনের সাধনায় স্বাভাবিকভাবেই এইগুলি আয়ত্ত হওয়া প্রয়োজন। এইরূপ গুণগুলির মধ্যে আমার কাছে প্রধান মনে হয় : কৌতূহল, মুক্ত মনোভাব, জ্ঞান অর্জন কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয় এই ধারণা, ধৈর্য, অধ্যবসায়, একাগ্রতা এবং যথার্থতা [Exactness]। ইহাদের মধ্যে কৌতূহলই মূল; যথায় কৌতূহল খুব প্রবল এবং ঠিক পথে পরিচালিত হয় তথায় অন্যগুলি আপনা হইতেই আসিবে। কিন্তু কৌতূহল হয়তো এত সক্রিয় নয় যে সমগ্র বুদ্ধিমূলক জীবনের ভিত্তিস্বরূপ হইতে পারে। কোনো কঠিন কিছু কাজ করিবার বাসনাও থাকা উচিত; যে জ্ঞান অর্জন করা হইবে তাহা শিক্ষার্থীর নিকট কৌশল বলিয়া বোধ হইবে, যেমন কৌশল আয়ত্ত হয় খেলার বা দৈহিক ক্রীড়া প্রদর্শনে। প্রথমদিকে স্কুলে, কৃত্রিম কাজ আয়ত্ত করার ভিতর দিয়াই কৌশল অর্জন করিতে হইবে, ইহার ব্যতিক্রম করা কঠিন; কিন্তু স্কুলের কাজের বাহিরের কোনো কাজে কৌশল আয়ত্ত করার বাসনা ছাত্রের মনে জাগাইতে পারিলে প্রকৃত উপকার করা হইবে। শিক্ষাকে জীবনের সহিত সম্পর্ক শূন্য করা শোচনীয় ব্যাপার; কিন্তু স্কুল জীবনে ইহা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা যায় না। যেখানে পরিহার করা একান্তই অসম্ভব সেখানে জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন যে জ্ঞান আয়ত্ত করার প্রশ্ন ওঠে, ব্যাপক অর্থে তাহার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আলোচনা করা দরকার; ছাত্র যেন বুঝিতে পারে তাহার বর্তমান জীবনের সঙ্গে সেরূপ জ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সংযোগ না থাকিলেও তাহারও প্রয়োজনীয়তা আছে এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাহা কাজে লাগিতে পারে। ইহা ছাড়াও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ কৌতূহলের জন্য আমি অনেকটা স্থান-দিব; ইহা ব্যতীত অনেক মূল্যবান জ্ঞান কখনই মানুষের আয়ত্ত হইত না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়–বিশুদ্ধ গণিতের কথা [Pure Mathematics]। এমন অনেক শিক্ষণীয় বিষয় যাহা অন্য কোনো প্রয়োজনে না লাগিলেও কেবল জ্ঞানের জন্যই আমার কাছে মূল্যবান মনে হয়। যে-কোনো রকম জ্ঞান অর্জন করিতে হইলেই ছাত্রগণ তাহা হইতে কিছু লাভের আশা করুক অথবা কোনো উদ্দেশ্য সম্মুখে রাখিয়া অগ্রসর হউক ইহা আমি চাই না। উদ্দেশ্য বা লাভ নিরপেক্ষ কৌতূহল উদ্দীপ্ত করা যায় না তথায়ই কেবল দক্ষতা অর্জনের বাসনা জাগাইবার চেষ্টা করিব যে দক্ষতা কাজে প্রকাশ করা যায়। শিক্ষার্থীর জীবনে প্রত্যেকটি উদ্দেশ্যেরই প্রয়োজনীয়তা আছে–জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত বিষয়ের প্রতি কৌতূহলের যেমন আবশ্যকতা আছে, উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ কৌতূহলেরও তেমনই মূল্য আছে। ইহাদের একটির প্রতি বেশি জোর দিতে গিয়া অন্যটিকে উপেক্ষা করা উচিত হইবে না।

শিক্ষার্থীর জ্ঞান লাভের বাসনা যদি অকৃত্রিম হয় তবে তাহার মনও থাকে উন্মুক্ত। যাহা কিছু জ্ঞাতব্য তা সবই জানিয়াছি এই বিশ্বাসের সঙ্গে যখন আরও অন্য কামনা একত্রে তালগোল পাকাইয়া যায় তখনই আমাদের ভোলা মন আর থাকে না, কোনো নির্দিষ্ট অভিমত আমাদের মনে স্পষ্ট হইয়া ওঠে। এইজন্য বাল্যে এবং প্রথম যৌবনে আমাদের মন যতখানি উন্মুক্ত এবং অন্যের নিকট হইতে ভাব গ্রহণের জন্য বা বিচার করিয়া দেখিবার জন্য প্রস্তুত থাকে শেষ বয়সে ততখানি থাকে না। কোনো বিষয় সম্বন্ধে বয়স্ক ব্যক্তিরা যে অভিমত পোষণ করেন তাহার সহিত তাহাদের কার্যকলাপ ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। ধর্মযাজক ধর্মের অনুশাসন সম্বন্ধে অথবা সৈনিক যুদ্ধ সম্পর্কে উদাসীন হইতে পারেন না। আইনজীবী বলিবেন অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত, তবে আসামিপক্ষে নিযুক্ত হইলে তিনি তাহার শাস্তি না দেওয়ার পক্ষেই যুক্তি প্রর্দশন করিবেন। স্কুল শিক্ষক যেরূপ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ট্রেনিং লইয়াছেন এবং যাহার ভিতর কাজ করিয়া অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়াছেন তাহাই সমর্থন করিবেন। যে রাজনৈতিক দলে থাকিলে উচ্চপদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা রাজনীতিক সে-দলের মতবাদ না মানিয়া পারেন না। উপজীবিকা হিসাবে একজন যখন কোনো কাজ নির্বাচন করিয়া লয় তখন ইহা আশা করা যায় না যে, সে সর্বদা এই চিন্তা করিবে সে অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করিলেই ভাল হইত। অতএব দেখা যায়, পরবর্তী জীবনে ভোলা মনে কোনো বিষয়ে অভিমত প্রকাশ বা পোষণ করায় নানা প্রতিবন্ধক আছে কিন্তু শিশু ও কিশোরের জীবনে উইলিয়াম জেমসের কথায় জোর করিয়া চাপানো মত গ্রহণ করার অবস্থা বেশি ঘটে না। এইজন্যই সহজে কোনো কিছু বিশ্বাস করার প্রবণতাও কম থাকে। বয়স্ক ব্যক্তিরা কর্মজীবনে শিশুদের মতো ভোলা মন রাখিতে পারে না। ইহা স্বাভাবিক; কেননা চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা এবং অবস্থার চাপে তাহাদিগকে কোনো বিষয় সম্বন্ধে অভিমত গ্রহণ করিতে হয়। তাহাদিগকে অনেক সময় নিজেদের বিবেকের নির্দেশসম্মত না হইলেও স্বার্থের যাহা অনুকূল এমনভাবেই মতামত গড়িয়া তুলিতে হয়। তরুণদিগকে উৎসাহ দেওয়া উচিত যাহাতে তাহারা প্রত্যেকটি প্রশ্ন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করিয়া নিজেদের বিচার বুদ্ধিমতো অভিমত প্রদান করিতে পারে। এই চিন্তার স্বাধীনতার অর্থ এই নহে যে, স্বেচ্ছামত যে-কোনোরূপ আচরণ করার অধিকারও তাহাদের থাকিবে। কোনো লোকের সমুদ্রে বীরত্ব প্রদর্শনের কাহিনী শুনিয়াই যে বালকগণ সমুদ্রে ঝাপাইতে যাইবে তাহাদিগকে এতখানি স্বেচ্ছাচারী হইতে দেওয়া ঠিক হইবে না। তবে তাহাদের ছাত্রাবস্থায় তাহারা যদি এইরূপ রোমাঞ্চকর অভিযানের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং মনে করে যে অধ্যাপক হওয়া অপেক্ষা জলদস্যু হওয়া বেশি বাঞ্ছনীয়। তবে তাহাকে এইরূপ চিন্তার স্বাধীনতা দিতে কোনোরূপ আপত্তি করা উচিত নয়।

একাগ্রতা : মনোবিকাশের ক্ষমতা বা একাগ্রতা একটি অতি মূল্যবান মানসিক গুণ কিন্তু শিক্ষা ব্যতীত ইহা অর্জন করা যায় না। ইহা অবশ্য সত্য যে, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে একাগ্রতা স্বভাবতই বাড়িতে থাকে; শিশুরা কোনো বিষয়েই কয়েক মিনিটের বেশি মনোনিবেশ করিতে পারে না কিন্তু বয়স যত বাড়িতে থাকে তাহাদের চঞ্চলমতিত্ব তত কমিতে থাকে। তথাপি বহুদিনব্যাপী বুদ্ধিগত শিক্ষা ব্যতীত তাহারা যথোপযুক্ত পরিমাণে মানসিক একাগ্রতা অর্জন করিতে পারে না। পূর্ণাঙ্গ একাগ্রতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে : ইহা হইবে তীব্র, দীর্ঘদিন স্থায়ী এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। একাগ্রতা কতখানি নিবিড় এবং গম্ভীর হইতে পারে আর্কিমিডিসের কাহিনীই তার প্রমাণ। একটি অঙ্কের সমস্যায় তিনি এমন তন্ময় হইয়াছিরেন যে, রোমান সৈন্যগণ কখন সায়রাকিউজ দখল করিয়া তাহাকে হত্যা করিতে তাহার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল তিনি তাহা কিছুই জানিতে পারেন নাই। কোনো কঠিন কাজ সম্পন্ন করিতে এবং এমন জটিল ও সূক্ষ্ম সমস্যার সমাধান বাহির করিতে একই কাজে গভীর একাগ্রতার প্রয়োজন। কোনো বিষয়ের প্রতি অনুরাগ থাকিলে স্বাভাবিকভাবেই এইরূপ তন্ময়তা আসে। অনেকেই কোনো যান্ত্রিক হেঁয়ালি বা ধাঁধার মধ্যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত মনোনিবেশ করিতে পারে কিন্তু ইহার বিশেষ মূল্য নাই। একাগ্রতা যখন ইচ্ছা দ্বারা চালিত হইবে তখনই বলা যায় যথার্থ মূল্যবান। ইহা বলার উদ্দেশ্য এই যে, কতক জ্ঞানের বিষয় স্বভাবতই নীরস, তবু ইচ্ছাশক্তির বলে লোকে তাহাতেও নিরবচ্ছিন্নভাবে মনোনিবেশ করিতে পারে। আমার মনে হয় উক্ত শিক্ষার ফলেই লোকে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করিয়া এইরূপ একাগ্রতা লাভ করিতে পারে। এই একটি ব্যাপারে প্রাচীন প্রণালীর শিক্ষা প্রশংসনীয়; স্বেচ্ছায় কোনও নীরস কাজে আগ্রহের সঙ্গে মনোনিবেশ করাইতে বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী প্রাচীনের মতো এতখানি সফলতা লাভ করে কি না সন্দেহ। যাহাই হউক বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীর মধ্যে এই দোষ বিদ্যমান থাকিলেও তাহা অসংশোধনীয় নহে। প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালী শিক্ষার্থীর মনঃপ্রবৃত্তির উপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করিত না। কোনো শিক্ষণীয় বিষয় শিক্ষার্থীর নিকট সরস কি নীরস মনে হইবে তাহার বিচার না করিয়া তাহার উপর চাপাইয়া দেওয়া হইত। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ছাত্রকে তাহা শিক্ষা করিতেই হইত। ইহার ফলে অনেক নীরস বিষয়বস্তুর প্রতিও নিবিষ্টভাবে মনোনিবেশ করিতে হইত। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করা হইবে।

ধৈর্য ও অধ্যবসায় সুশিক্ষার ফলস্বরূপ বিকশিত হয়। পূর্বে মনে করা হইত যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাহিরেই কর্তৃপক্ষের শাসনের ফলে যে সদভ্যাস গঠিত হয় কেবল তাহা দ্বারাই এই-গুণগুলি অর্জন করা সম্ভব। কঠোর শাসনের ভিতর দিয়া প্রথমে ঘোড়াকে বাগ মানাইতে হয়; ইহা দেখিয়া মনে হয় এইরূপ শাসনে সংযত করার ও সদভ্যাস গঠন করানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু ইহার জন্য জোরজবরদস্তি না করিয়া ছাত্রকে প্রথমে সহজ একটি কাজে সাফল্য লাভ করিতে দিয়া তাহাকে ক্রমে কঠিনতর বিষয়ে কৃতকার্যতা অর্জনের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় উৎসাহিত করা যায়। ধৈর্য ও নিষ্ঠার ফলে সাফল্য অর্জিত হইলে তাহা ছাত্রকে পুরস্কার লাভের আনন্দময় অভিজ্ঞতা দান করে; পরে ক্রমে ধৈর্য ও চেষ্টার পরিমাণ বৃদ্ধি করা চলে। জ্ঞান অর্জন কঠিন হইলেও অসম্ভব নয়–এই বিশ্বাসও ঠিক অনুরূপভাবে শিক্ষার্থীদের মনে সঞ্চার করা যায়। এইজন্য তাহার দ্বারা প্রথমে সহজ হইতে শুরু করিয়া ক্রমে কঠিন সমস্যা সমাধান করাইয়া তাহার আত্মবিশ্বাস জন্মাইয়া লইতে হয়।

ইচ্ছামতো যে কোনো নীরস বিষয়েও মনোনিবেশের শক্তির মতোই নির্ভুলতার প্রতিও শিক্ষা-সংস্কারকগণ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন না। ডক্টর ব্যালার্ডের মতে বিলাতের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি অনেক বিষয়ে পূর্বের অপেক্ষা যথেষ্ট উন্নত হইয়াছে কিন্তু ছাত্রদের লিখিত উত্তরের নির্ভুলতা আগের তুলনায় অনেকাংশে হ্রাস পাইয়াছে। তিনি বলেন :

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই শতকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকে বার্ষিক পরীক্ষায় যে প্রশ্ন দেওয়া হইত তাহার উত্তর বিবেচনা করিয়া বিদ্যালয়ের আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ করা হইত। এইরূপ বহু প্রশ্ন এখনও রক্ষিত আছে। বর্তমানের ছাত্রছাত্রীদিগকে এই একই প্রশ্ন উত্তর করিতে দিলে ফল হয় পূর্বের অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট। ইহার কারণ যাহাই বলি না কেন, এই বিষয়ে যে অবনতি ঘটিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। সমগ্রভাবে ধরিলে আমাদের বিদ্যালয়ের কাজ অন্ততঃপক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ, পঁচিশ বৎসর পূর্বে যেমন ছিল এখন তাহা অপেক্ষা অনেক কম নির্ভুল হয়।

এই বিষয়ে ডক্টর ব্যালার্ডের আলোচনা এমন চমৎকার যে, ইহার উপর আমার আর বিশেষ কিছু বলিবার নাই। তাহার উপসংহারের কথা কয়েকটি উদ্ধৃত করি :

যত কিছুই বলা হউক না কেন, নির্ভুলতা বা কোনো কাজ যথার্থভাবে করার অভ্যাস এখনও একটি মহৎ এবং প্রেরণাদায়ক আদর্শ বলিয়া পরিগণিত। ইহাকে বুদ্ধির সততা বলা যায়। আমাদের চিন্তায়, বাক্যে এবং কর্মে আমরা কি পরিমাণ যথার্থ তাহা দ্বারাই আমাদের সত্যনিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়।

আধুনিক শিক্ষাপ্রণালীর সমর্থকগণ মনে করেন শিক্ষা শিশুর নিকট আনন্দপ্রদ করিতে পারাই মস্ত বড় লাভ; কোনো বিষয় নিখুঁতভাবে শিক্ষা দিতে গেলে যে পরিশ্রম ও অধ্যবসায় স্বীকার করিতে হয় তাহার ফলে ছাত্রের মনে অবসাদ আসিতে পারে। এইজন্য আধুনিক প্রণালী সমর্থনকারীগণ জ্ঞানে পূর্ণাঙ্গতার উপর বেশি জোর দেন নাই। এইস্থানে ছাত্রের মানসিক অবসাদ কি ধরনের হইতে পারে তাহা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। শিক্ষক যদি জোর করিয়া কোনো কিছু ছাত্রের উপর আরোপ করেন এবং তাহার ফলে যদি সে অবসাদ বোধ করে তবে তাহা নিশ্চয়ই অপকারী। কিন্তু নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিবার জন্য ছাত্র স্বেচ্ছায় যে কঠোর পরিশ্রমের কাজে আত্মনিয়োগ করে তাহা মাত্রা অতিক্রম না করিলে সত্যই বিশেষ মূল্যবান। যে সকল বাসনা পূরণ করা রীতিমত কষ্টসাধ্য তাহা সাধন করিতে ছাত্রদিগকে উৎসাহিত করা শিক্ষার অঙ্গ হওয়া উচিত। যেমন, বীজগণিতের জটিল অঙ্ক কষা, হোমারের কাব্য পাঠ করা, ভালো বেহালা বাজানো এইরকম নানা ধরনের কাজ ছাত্রদিগকে দেওয়া চলে। ইহার প্রত্যেকটি কাজে উৎকর্ষ অর্জন করিতে নিখুঁতভাবে তাহা জানা প্রয়োজন। যোগ্য বালক বালিকা উৎসাহিত হইলে এইরূপ কাজে নিপুণতা অর্জনের জন্য অপরিসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখাইতে পারে। কাজে দক্ষতা অর্জনের যোগ্য স্বাভাবিক ক্ষমতা না থাকিলেও কতক ছাত্র শিক্ষকের নিকট হইতে অনুপ্রেরণা লাভ করিয়া উৎসাহের সঙ্গে প্রবৃত্ত হইতে পারে। শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষার্থীর নিষ্ঠা, অনুরাগ এবং শেখার বাসনাই প্রধান শক্তি জোগায়, শিক্ষকের কর্তৃত্ব অনিচ্ছুক ছাত্রকে জোর করিয়া শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করিতে পারে না; পিপাসা না থাকিলে যেমন ঘোড়াকে জল পান করানো যায় না তেমনই। কিন্তু তাই বলিয়া এইরূপ মনে করিবার কোনো কারণ নাই যে, প্রত্যেক স্তরেই শিক্ষা হইবে কোমল, সহজ এবং সুখদায়ক। কোনো বিষয়ে সঠিকতা অর্জনের প্রশ্নে একথা বলা চলে। নিখুঁতভাবে কিছু শিক্ষা করিতে গেলে যতেষ্ট পরিশ্রম ও ধৈর্য দরকার কিন্তু ইহা ছাড়া জ্ঞানে বা বিদ্যায় উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভবপর নয়। শিশুদিগকে ইহা বুঝাইয়া দেওয়া যায়। আধুনিক প্রণালী এই বিষয়ে অনেকটা অকৃতকার্য হইয়াছে। কারণ প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালীর কঠোরতার বিরুদ্ধে যে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অতিরিক্ত শিথিলতা দেখা দিয়াছে, ইহার স্থানে নূতন শাসন বিধান গড়িয়া তুলিতে হইবে এবং এই শৃঙ্খলা বাহিরের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চাপানো শাসন হইবে না, মনোবিজ্ঞানকে ভিত্তি করিয়া শিক্ষার্থীর মনের দিক হইতে ইহা গড়িয়া তুলিতে হইবে। প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালীতে বাহিরের কর্তৃপক্ষ শাসন ও শৃঙ্খলা আরোপ করিয়া শিক্ষার্থীকে সংযত রাখিতেন, কাজে নিযুক্ত থাকিতে বাধ্য করিতেন। তাহাতে শিক্ষার্থীর মনে স্বাভাবিক স্ফূর্তি থাকিত না, আধুনিক প্রণালীর শিক্ষার্থীর উপর এরূপ জবরদস্তি করার পক্ষপাতী নয় কিন্তু শৃঙ্খলা ব্যতীত শিক্ষা কখনই সম্ভব হইতে পারে না; এ শৃঙ্খলাবোধ শিশুর মনে জাগ্রত করিতে হইবে এবং আচরণে ইহার প্রকাশ দেখা যাইবে। কাজ নিখুঁততা অর্জন হইবে এইরূপ নূতন শৃঙ্খলার পরিচায়ক।

অনেক প্রকার নিখুঁততা আছে; ইহাদের প্রত্যেকটিই প্রয়োজনীয়। প্রধান কয়েকটি হইল–মাংসপেশি সঞ্চালনে নিপুণতা, সৌন্দর্য ও রসসৃষ্টিতে সূক্ষ্ম নিপুণতা, কোনো বিষয় সম্পর্কে যথার্থ, যুক্তিতর্কে নিখুঁততা। প্রত্যেক বালক বালিকাই চলা-ফেরা করিতে মাংসপেশির শোভনভাবে সঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তা বুঝিতে পারে; দেহের ভারসাম্য ও সুষ্ঠু গতিভঙ্গির জন্য ইহা আবশ্যক। স্বাস্থ্যবান শিশু দেহের এই স্বচ্ছন্দগতির জন্য নিজের অজ্ঞাতে প্রস্তুত হইতে থাকে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে দৌড়ানো, লাফানো, মই বাহিয়া উপরে ওঠা-নামা প্রভৃতির ভিতর দিয়া সে দেহ সঞ্চালনের কৌশল আয়ত্ত করে; এইভাবে সে পরবর্তীকালের খেলাধুলার জন্য প্রস্তুত হয়। খেলাধুলা সংক্রান্ত দৈহিক উৎসুক এবং মাংসপেশির সুষ্ঠু সঞ্চালন ছাড়াও স্কুল-জীবনে শিক্ষণীয় অন্য প্রকার নিপুণতা আছে, যেমন স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর হস্তাক্ষর, বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি শিশু প্রয়োজনীয় মনে করিবে কি না তাহা নির্ভর করিবে তাহার পরিবেশের উপর।

সৌন্দর্য বা রসসৃষ্টির নিখুঁততা ব্যাখ্যা করিয়া বুঝানো মুশকিল; ইহার উদ্দেশ্য আনন্দের অনুভূতি সঞ্চার করা। সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য প্রভৃতিতে খুঁত থাকিলে তাহা যে রসভঙ্গ করে এবং পরিপূর্ণ আনন্দ দান করে না তাহা ছাত্রদিগকে বুঝানো সহজ। শেকসপিয়রের অথবা রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা মুখস্থ করান; আবৃত্ত করিবার সময় কোথাও ভুল করিলে সে স্থান তাহাকে নিজেকে কথায় পূরণ করিতে বলুন এবং মূলের সঙ্গে পার্থক্য দেখাইয়া দিন। সে নিজেই বুঝিতে পারিবে মূল রচনার সহিত তুলনায় তাহার নিজের দেওয়া কথাগুলি কবিতার অঙ্গহানি করিয়াছে। এইভাবে সংগীত ও নৃত্যে কোথাও ভুল হইলে তাহা অশোভন হয় এবং তাহার ফলে মানুষেরা সূক্ষ্ম রসবোধ তৃপ্তি লাভ করে না। আবৃত্তি, সংগীত এবং নৃত্য ছাত্রদিগকে নিখুঁততা শিক্ষা দেওয়ার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। অঙ্কনও শিশুদিগকে নিখুঁত কাজের উৎসাহ দেয় কিন্তু রসোপলব্ধির উপাদান হিসাবে ইহার মূল্য খুব বেশি নহে।

মডেল দেখিয়া অংকন, ছাত্রের নিখুঁততা শিক্ষার উপাদান হিসাবে কাজে লাগানো চলে কিন্তু ইহার মূল্য খুব বেশি নহে; কারণ সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য প্রভৃতি যেমন নিখুঁত হইলে আনন্দদান করে এবং ছাত্র ইহার মাধ্যমে নূতন সৃষ্টির আনন্দ বোধ করে, অঙ্কনের ক্ষেত্রে তেমন নয়; একটি নির্দিষ্ট বস্তু দেখিয়া ঠিক অনুরূপ করিয়া আঁকায় নূতন সৃষ্টির আনন্দ নাই। এই হিসাবে সংগীত, নৃত্য আবৃত্তি অঙ্কনের অপেক্ষা ছাত্রকে নিখুঁততা অর্জনে বেশি আনন্দ দেয়। ইহা সত্য যে, কোনো মডেল দেখিয়া আঁকিতে গেলে মামুলি এবং বাঁধাধরা উপায়ই গ্রহণ করিতে হয়, নূতন সৃষ্টির উন্মাদনা। মডেল ভালো বলিয়াই ইহার নকল আঁকা হয়, যে কোনো জিনিসের নকল করাই যে ভালো তাহা নহে।

ইতিহাসের সন তারিখ এবং ভূগোলে উল্লিখিত স্থানের নাম প্রভৃতি যথাযথ মনে রাখা অত্যন্ত বিরক্তিকর ব্যাপার। ইংল্যাণ্ডের রাজাদের রাজত্বের তারিখ এবং প্রধান জেলাগুলির নাম মুখস্থ করা বিলাতের ছেলেমেয়েদের কাছে এক ভয়াবহ বিষয় ছিল। আমি অন্তরীপগুলির নাম মনে রাখিতে পারিতাম না কিন্তু আট বৎসর বয়সে আমি ভূগর্ভস্থ রেল লাইনের প্রায় সবগুলি স্টেশনের নাম বলিতে পারিতাম। পুত্র কন্যাদিগকে যদি সিনেমার ছবিতে দেশের উপকূল দিয়া জাহাজ চালানো ছবি দেখানো যায় তবে তাহারা শীঘ্রই অন্তরীপগুলি চিনিয়া ফেলিবে। এইগুলি শেখা যে একান্তই কর্তব্য তাহা আমি বলি না; আমি বলিতে চাই যে, ইহা শিখানোর প্রকৃষ্ট পন্থা হইল চলচ্চিত্রে ইহা দেখানো। সিনেমার মারফত সমগ্র ভূগোল শিক্ষা দেওয়া উচিত; ইতিহাসও প্রথমে এইভাবে শিকানো উচিত। ইহার জন্য প্রাথমিক খরচ পড়িবে খুব বেশি কিন্তু গভর্নমেন্টের পক্ষে ইহা খুব বেশি নয়। ইহার ফলে এ বিষয়গুলি শিখানো সহজ হইয়া আসিবে।

যুক্তিতর্কের নিখুঁততা এবং বিচারবুদ্ধি কিঞ্চিৎ বেশি বয়সে অধিগত হয়; শিশুদের নিকট হইতে ইহা আশা করা উচিত হইবে না। নামতার ছক মুখস্ত করিয়া গুণফল মুখে মুখে বলার নিখুঁততা আছে বটে কিন্তু প্রথমে শিশু ইহা না বুঝিয়াই মুখস্থ করে এবং পরে সে ইহার ভিতরকার যুক্তি বুঝিতে পারে। যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির উন্মেষের জন্য অঙ্কশাস্ত্রই স্বাভাবিক পন্থা কিন্তু ইহা যদি কতকগুলি নীরস এবং পূর্ব নির্দিষ্ট কানুন বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় অর্থাৎ ইহার মধ্যে যে যুক্তির প্রয়োগ রহিয়াছে তাহা লক্ষ্য করা না হয় তবে এই শিক্ষা ব্যর্থ। নিয়মকানুনগুলি অবশ্যই শিখিতে হইবে কিন্তু এক সময়ে শিশুর কাজে ইহার মূলে যে যুক্তি রহিয়াছে তাহা বুঝাইয়া দিতে হইবে, নতুবা অঙ্কের কোনো শিক্ষা-মূল্য নাই।

এখানে একটি প্রশ্ন আলোচনা করা যাক : শিক্ষাদান সকল অবস্থাতে আনন্দপ্রদ করা সম্ভব কি না কিংবা বাঞ্ছনীয় কি না। পূর্বে ধারণা ছিল ইহার বেশিরভাগই নীরস, কেবল কর্তৃপক্ষের কঠোর শাসনে শিশু ইহা গ্রহণ করিত। (বেশিরভাগ মেয়েই অজ্ঞ থাকিত) আধুনিক শিক্ষাবিদগণের অভিমত এই যে, শিক্ষা আগাগোড়া আনন্দদায়ক করা চলে। আধুনিকদের অভিমতের প্রতিই আমার সহানুভূতি বেশি, তথাপি আমার মনে হয়, শিক্ষা সকল স্তরেই বিশেষ করিয়া উচ্চশিক্ষায় ইহা সর্বদা সম্ভবপর হয় না।

শিশু মনোবিজ্ঞানের আধুনিক লেখকগণ সকলেই এই কথাটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন যে, খাওয়া বা ঘুমানোর জন্য শিশুকে পীড়াপীড়ি করা অনুচিত; শিশু স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ইহা করিবে; এইজন্য তোষামোদ বা জোর করার কোনো প্রয়োজন নাই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এই অভিমতের সত্যতা প্রমাণ করিয়াছে। প্রথমে আমরা শিশু-শিক্ষার এই নূতন প্রণালী জানিতাম না বলিয়া প্রাচীন পন্থা অনুসরণ করিয়াছিলাম। এই প্রণালী সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছিল কিন্তু নূতন প্রণালীতে আশানুরূপ সাফল্য লাভ করি। কেহ যেন ইহা মনে না করেন যে, আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী প্রয়োগ করিতে গিয়া আধুনিক পিতামাতা সন্তানের খাওয়া বা ঘুমানোর জন্য কিছুই করেন না; পক্ষান্তরে শিশু সদভ্যাস গঠনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হইয়া থাকে। নিয়মিত খাবার সময় আসে, শিশু ভোজন করুক বা না করুক খেলাধুলা বাদ দিয়া তখন তাহাকে অন্যের সঙ্গে একত্রে বসিতেই হইবে। নিয়মিত সময়ে তাহাকে ঘুমাইতে যাইতে হইবে। বিছানার মধ্যে সে কোনো খেলনা প্রাণী আদর করিবার জন্য কাছে রাখিতে পারে কিন্তু এমন কৈানো খেলনা রাখা চলিবে না যাহা টিপিলে শব্দ করে, স্প্রিং কষিয়া দিলে যাহা ছুটাছুটি করে কিংবা অন্য কোনো প্রকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে। শিশুকে বরং বলা যায়–পোষা প্রাণীটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাকে ঘুম পাড়াও। তারপর তাহাকে একা থাকিতে দিন, শীঘ্রই সে ঘুমাইয়া পড়িবে। কিন্তু শিশুকে কখনোই বুঝিতে দিবেন না যে, তাহার খাওয়া বা ঘুমানোর জন্য আপনি উৎকণ্ঠিত হইয়া পড়িয়াছেন; ইহা বুঝিতে পারিলে সে মনে করিবে আপনি তাহার নিকট একটু অনুগ্রহ চাহিতেছেন; নিজের শক্তি সম্বন্ধে সে সচেতন হইয়া উঠিবে এবং ক্রমেই বেশি বেশি আদর-আপ্যায়ন বা শাস্তি দাবি করিতে থাকিবে। সে যেন বুঝিতে পারে যে আপনাকে খুশি করিবার জন্য নয়, তাহার নিজের তাগিদেই খাওয়া এবং ঘুমানো প্রয়োজন।

মনোবিজ্ঞানের এই নীতি শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা চলে। আপনি যদি শিশুকে জোর করিয়া শিখাইতে চান, সে মনে করিবে আপনাকে খুশি করিবার জন্য সে কিছু অপ্রীতিকর কাজ করিতে বাধ্য হইতেছে। এই মনোভাবের ফলে তাহার মনে একপ্রকার প্রতিরোধ দানা বাঁধিয়া উঠে। অন্যের তাগিদে কোনো কাজ করিতে গেলে তাহাতে তাহার স্বাভাবিক প্রাণের আবেগ থাকে না, মনের ভিতর বরং একটি বিরুদ্ধ ভাব জমিতে থাকে। শিশুর প্রথম জীবনে এইরূপ ভাব সঞ্চারিত হইলে, তাহা বরাবর থাকিবে; পরবর্তীকালে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বাসনায় সে পড়াশুনায় মন দিবে বটে কিন্তু জ্ঞানলাভের বাসনায় নহে। পক্ষান্তরে আপনি যদি প্রথমে শিশুর জ্ঞানলাভের স্পৃহা জাগ্রত করিতে পারেন এবং তাহার প্রতি অনুগ্রহ হিসাবে যে-শিক্ষা লাভ করিতে সে উন্মুখ তাহা দান করেন, তবে অবস্থা ভিন্নরূপ ধারণ করিবে। বাহিরে শাসনের বিশেষ প্রয়োজন হইবে না এবং শিশুর মনোযোগ আকর্ষণ করা সহজ হইবে। এই বিষয়ে কৃতকার্য হইতে হইলে কতকগুলি শর্ত আবশ্যক। শ্রীমতী মন্তেসরি ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই অবস্থা সাফল্যের সঙ্গে সৃষ্টি করিয়াছেন। শিশুর জন্য নির্দিষ্ট কাজগুলি সহজ এবং চিত্তাকর্ষক করিতে হইবে। প্রথম অবস্থায় অন্য শিশুদিগকে কাজ করিতে দেখিয়া সে উৎসাহিত হইবে। সে সময় যেন অন্যত্র শিশুর পক্ষে অধিকতর আকর্ষণের কোনো বস্তু না থাকে। শিশু কাজে লাগাইতে পারে এমন অনেকগুলি জিনিস থাকিবে; যেটি ইচ্ছা সেটি লইয়া সে কাজ করিতে পারিবে। এইরূপ অবস্থায় প্রায় সকল শিশুই আনন্দে থাকে এবং বাহিরের কোনো প্রকার চাপ না থাকাতেও পাঁচ বৎসর বয়সের পূর্বেই পড়িতে ও লিখিতে শেখে।

এই প্রণালী বয়স্ক শিশুদের উপর কতদূর প্রয়োগযোগ্য তাহা তর্কের বিষয়। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের মনও অন্যান্য বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়; তখন শিক্ষার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষযই যে আনন্দপ্রদ করিতে হইবে এমন কোনো আবশ্যকতা নাই। কিন্তু শিক্ষালাভের জন্য শিশুরাই আগ্রহান্বিত হইবে এই মূলনীতি শিশুর যে-কোনো বয়স পর্যন্ত চালু রাখা যায়। এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থা সৃষ্টি করিতে হইবে যাহাতে শিশু নিজেই যেন শিক্ষার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশ করে। শিক্ষাগ্রহণ কাজে ব্যাপৃত না থাকিলে তাহাকে যেন নিঃসঙ্গ অবস্থায় অবসাদের মধ্যে সময় কাটাইতে হয়। শিক্ষা লাভ করিতে আনন্দ আছে, পরিশ্রমও আছে কিন্তু ইহার বিকল্প অবস্থায় শিশু যেন আনন্দ না পায়; তাহা হইলে সে নিঃসঙ্গভাবে অবসন্ন হইয়া সময় কাটানোর পরিবর্তে শিক্ষা গ্রহণের কাজই পছন্দ করিবে। কিন্তু কোনো শিশু যদি কখনও এই বিকল্প অবস্থাই পছন্দ করে তাহাকে নিষ্ক্রিয় হইয়া থাকিতে দিতে হইবে, পরে নিজের ভুল সে নিজেই বুঝিবে। শিশুর ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার নীতি সম্প্রসারণ করা চলে যদিও প্রথম কয়েক বৎসর পর সমবেতভাবে কাজ করানো অত্যাবশ্যক। কোনো বালক বা বালিকাকে যদি শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করার প্রয়োজন হয় অর্থাৎ সে যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ইহাতে উৎসুক না হয় তবে তাহার দেহ বা মনের স্বাস্থ্যগত কোনো কারণ না থাকিলে, বুঝিতে হইবে যে, শিক্ষকের দোষই ইহার জন্য দায়ী কিংবা শিশুর বাল্যশিক্ষা খারাপ হইয়াছে। পাঁচ বা ছয় বৎসর পর্যন্ত শিশুর শিক্ষানুরাগ উদ্দীপ্ত করিতে পারেন।

ইহা সম্ভব হইলে সুবিধার অন্ত নাই। শিক্ষক তখন ছাত্রের শত্রু নন। তিনি তাহার বন্ধু। শিক্ষক তাহার সহযোগিতা করেন বলিয়া সে দ্রুত শিখিতে থাকে; সে পরিশ্রান্ত হয় কম, কারণ অনিচ্ছুক মনকে জোর করিয়া কোনো অপ্রীতিকর কাজে আটকাইয়া রাখার কোনো প্রশ্ন এখানে নাই। ছাত্র স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া কাজ করার আনন্দ বোধ করে, শিক্ষকের পক্ষ হইতে তাহাকে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করার প্রয়োজন হয় না। অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রে যদি ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায় তবে সেইরূপ ছাত্রদিগকে পৃথক করিয়া তাহাদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করিতে হয়। তবে আমার মনে হয়, শিশুর বুদ্ধি অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষাপ্রণালী অনুসরণ করিলে এরূপ ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম হইবে।

শিক্ষায় বিশেষ নিপুণতা অর্জন করিতে হইলে শিক্ষার সকল স্তরই আনন্দদায়ক করা সম্ভব হয় না। কোনো বিষয় ভালো করিয়া শিখিতে গেলে ইহার কতক অংশ নীরস মনে হইবেই। কিন্তু আমার মনে হয়, এইরূপ নীরস অংশও আয়ত্ত করার প্রয়োজনীয়তা বুঝাইয়া দিলে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশে বালক-বালিকা আগ্রহের সঙ্গেই ইহাতে ব্রতী হইবে। নির্দিষ্ট কাজের উৎকর্ষ ও অপকর্ষ দেখিয়া কাজের প্রশংসা করিয়া বা তাহার দোষ দেখাইয়া দিয়া ছাত্রকে উৎসাহিত করিতে হইবে। এই নীরস অংশের গুরুত্ব শিক্ষক ছাত্রের নিকট সুস্পষ্টরূপে বুঝাইয়া দিবেন। এই প্রণালী ব্যর্থ হইলে ছাত্রকে কমবুদ্ধিসম্পন্ন বলিয়া বুঝিতে হইবে। তখন তাহাকে অন্যান্য সাধারণ ছাত্রের শ্রেণি হইতে পৃথক করিয়া পৃথকভাবে শিক্ষাদানের বন্দোবস্ত করিতে হইবে কিন্তু লক্ষ্য রাখিতে হইবে এ ব্যবস্থাকে সে যেন শাস্তি বলিয়া গ্রহণ না করে।

শিশুর চারি বৎসর বয়সের পর পিতা বা মাতার পক্ষে তাহার শিক্ষার ভার নিজ হাতে রাখা উচিত নহে (অবশ্য খুব কর্মক্ষেত্রে ইহার ব্যতিক্রম সমর্থন করা চলে!) শিক্ষাদানের কৌশল বিশেষ শিক্ষাসাপেক্ষ কিন্তু বেশিরভাগ পিতামাতাই শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া বা কৌশল সম্বন্ধে কিছু শিখিবার সুযোগ পান না। শিশুর বয়স যত কম থাকে, তাকে শিখাইবার কৌশলও তত বেশি দরকার। ইহা ছাড়া শিশু সর্বদা পিতামাতার সঙ্গ লাভ করে; কাজেই তাহাদের আচরণ ও অভ্যাস সম্পর্কে তাহার মনে কতকগুলি ধারণা স্পষ্ট হইয়া থাকে। কিন্তু মামুলি শিক্ষার কাজ আরম্ভ হইলে শিক্ষার প্রতি সে যেইরূপ আচরণ করিত পিতামাতার প্রতি সেইরূপ করে না। অধিকন্তু পিতা হয়তো নিজের সন্তানের পাঠোন্নতির জন্য অতিরিক্ত আগ্রহশীল হন। শিশু বুদ্ধির পরিচয় দিলে তাঁহার আনন্দের অবধি থাকে না। আবার বোকামির পরিচয় দিলে ক্রোধে কাণ্ডজ্ঞানহীন হইয়া পড়েন। চিকিৎসক যে কারণে নিজের পরিবারের লোকজনের চিকিৎসা করেন না, পিতামাতার পক্ষেও নিজ সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ না করার অনুরূপ যুক্তি আছে। কিন্তু আমি এ-কথা বলি না যে, তাঁহাদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে যাহা সম্ভব সন্তানকে সেইরূপ শিক্ষাও দেওয়া উচিত নয়; আমার বক্তব্য এই যে, অন্যের ছেলেমেয়ের পক্ষে ভালো শিক্ষক হইলেও পিতামাতা সাধারণত নিজেদের সন্তানের বিদ্যালয়ের পাঠ শিখানোর পক্ষে সর্বোত্তম নন।

শিক্ষার প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সমগ্র শিক্ষাকাল ব্যাপিয়া ছাত্রের মনে এই ধারণা জাগাইয়া রাখিতে হইবে যে, সে যেন বুদ্ধিমূলক রোমাঞ্চকর অভিযানের প্রবৃত্ত হইয়াছে। ইহার উদ্দেশ্য, জানিবার ভিতর দিয়া অজানাকে জয় করা। এই বিশ্বজগতে বহু জটিল বিষয় আছে, যেইগুলি একনিষ্ঠ চেষ্টার দ্বারা বুঝিতে পারা যায়; জটিল এবং কঠিন বিষয় বুঝিতে পারায় মানসিক উল্লাস আছে। প্রত্যেক যোগ্য শিক্ষক ছাত্রকে ইহা উপলব্ধি করাইতে পারেন। মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিশুরা যখন প্রথম দেখে যে, তাহারা লিখিতে শিখিয়াছে তখন তাহাদের যে কিরূপ বিপুল উল্লাস হয় তাহা শ্রীমতী মন্তেসরি বর্ণনা করিয়াছেন : আমি যখন প্রথম মাধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত নিউটন-লিখিত কেপলারের দ্বিতীয় সূত্র [Keplers Second Law] পাঠ করি তখন আনন্দে আত্মহারা হইয়াছিলাম। এইরূপ বিশুদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় আনন্দ খুব কমই আছে। নিজের চেষ্টা এবং ব্যক্তিগত উদ্যম ছাত্রকে নূতন আবিষ্কারের আনন্দ দান করে এবং এইভাবেই তাহার বুদ্ধিগত রোমাঞ্চকর অভিযান সার্থক এবং জয়যুক্ত হয়। সেখানে সব কিছুই কেবল ক্লাসে শিখানো হয়, ছাত্রকে স্বচেষ্টায় কোনো বিষয় অধিগত করিতে উৎসাহিত করা হয় না; সেইখানে এই মানসিক আনন্দ বোধের সুযোগও কম। যে স্থানেই সুযোগ পাওয়া যায় তথায়ই ছাত্রকে এই বুদ্ধি অভিযানে উৎসাহিত করুন; ইহাতে সে নিষ্ক্রিয় না থাকিয়া সক্রিয় হইয়া উঠিবে। ইহাই শিক্ষাকে শিশুর কাছে কষ্টদায়ক না করিয়া আনন্দময় করিবার অন্যতম উপায়।

চৌদ্দ বৎসরের পূর্বে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম : কি শিক্ষা দেওয়া হইবে? এবং কেমন করিয়া শিক্ষা দেওয়া হইবে? এই প্রশ্ন দুইটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যোগসূত্র বিদ্যমান রহিয়াছে, কারণ শিক্ষার জন্য উন্নত ধরনের প্রণালী অবলম্বন করিলে বেশি শিক্ষা করা সহজসাধ্য। শিক্ষণীয় বিষয় যদি ছাত্রের নিকট নীরস মনে না হয় এবং সে যদি স্বেচ্ছায় শিক্ষার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে তবে বেশি পরিমাণ শিখানো সম্ভবপর হয়। শিক্ষার প্রণালী সম্বন্ধে পূর্বে মোটামুটি বলা হইয়াছে, পরবর্তী অধ্যায়ে আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হইবে। এখন ধরিয়া লওয়া হইতেছে যে, উন্নত শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করা। হইয়াছে। কি শিক্ষা দেওয়া উচিত তাহাই এই অধ্যায়ে আলোচিত হইতেছে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের পক্ষে কি জানা উচিত তাহা বিবেচনা করিলে বোঝা যায় এমন কতক বিষয় আছে যাহা প্রত্যেকের জানা প্রয়োজন এবং কতক অল্পসংখ্যক লোকের ভালো করিয়া শেখা দরকার, সকলের জানা না থাকিলেও চলে। কতক লোককে ভালো করিয়া চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করিতে হইবে কিন্তু বেশিরভাগ লোকের পক্ষেই শারীরবিদ্যা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মোটামুটি বিষয় ও নিয়মগুলি জানা থাকিলেই যথেষ্ট। কতককে উচ্চ গণিত শিক্ষা করিতে হইবে কিন্তু যাহাদের নিকট ইহা মোটেই প্রীতিপদ নয় তাহারা গণিতের সাধারণ মৌলিক বিষয় জানিলেই চলে। কতককে ট্ৰমবোন (জয়ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র) বাজানো শিখিতে হইবে কিন্তু সকল ছাত্রেরই ইহা অভ্যাস করিবার আবশ্যকতা নাই। চৌদ্দ বৎসর বয়সের পূর্বে প্রধানত এমন জিনিসই শিক্ষা দেওয়া উচিত যাহা সকলেরই শিক্ষা করা প্রয়োজন। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ছাত্রের কথা বাদ দিলে, কোনো বিষয়ে বিশেষ শিক্ষা সাধারণত পরবর্তীকালে দিতে হইবে। তবে এই সময়েই অর্থাৎ চৌদ্দ বৎসরের পূর্বেই বালক বা বালিকার কোন বিষয় শিক্ষার দিকে বেশি প্রবণতা আছে তাহা লক্ষ্য করিতে হইবে যাহাতে পরবর্তীকালে তাহার বিকাশ সাধন সম্ভবপর হয়। এইজন্য প্রথম অবস্থায় প্রত্যেকের পক্ষেই শিক্ষণীয় বিষয়গুলি সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করা উচিত, কোনো বিষয় কাহারও ভালো লাগিলে পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার স্তরে তাহার জের টানিবার প্রয়োজন নাই।

প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তির কে কোন বিষয় শিক্ষা করা উচিত তাহা নির্ধারিত হইলে প্রথমে ঠিক করিতে হইবে কোনটি আগে এবং কোনটি তাহার পর শিখাইতে হইবে। এইস্থানে নীতি হইবে, সহজটি আগে শিখাইতে হইবে এবং কঠিন বিষয়গুলি পরে ক্রমে ক্রমে আসিবে। ছাত্রদের বিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিকে এই নীতিই শিক্ষাক্ষেত্রে অবলম্বিত হয়।

আমি ধরিয়া লইব যে, শিশুর পাঁচ বৎসর বয়স হইতে হইতেই সে পড়িতে এবং লিখিতে শিখিয়াছে। মন্তেসরি স্কুল কিংবা ইহার অপেক্ষা অন্য উন্নত ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইলে তথায় শিশুর এই প্রাথমিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হইবে। মন্তেসরি স্কুলে বিভিন্ন খেলনা লইয়া নাড়াচাড়া করিতে করিতে শিশুর নানা জিনিসের আকৃতি, আয়তন, পরিমাণ, ওজন প্রভৃতি সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা জন্মে। অঙ্কন, সংগীত ও নৃত্যশিক্ষারও সূত্রপাত হয়। অপর শিশুর মধ্যে থাকিয়াও শিক্ষামূলক কোনো বিষয় মনোযোগ দেওয়ার অভ্যাসও এই সময় গঠিত হয়। অবশ্য পাঁচ বৎসর বয়সে শিশুর এই গুণগুলি পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হইবে না; পরে আরও কিছুদিন তাহাকে এই সকল বিষয়ে শিক্ষা লাভ করিতে হইবে। আমার মনে হয় শিশুকে সাত বৎসর বয়সের পূর্বে কোনোরূপ গুরুতর মানসিক পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত করা উচিত নহে। তবে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োগ করিলে শিশুর অসুবিধাগুলি অনেক পরিমাণে লাঘব করা যায়। ছেলেবেলায় গণিত একটি ভয়ের বিষয়; মনে পড়ে গুণনের নামতা মনে রাখিতে না পারিয়া বাল্যকালে আমি বহুদিন কাদিয়াছি। গুণনের ছক ধীরে ধীরে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় শিশুকে আয়ত্ত না করাইলে ইহা দুরূহ রহস্য বলিয়া বোধ হয় এবং তাহার মনে গভীর নৈরাশ্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু মন্তেসরি স্কুলে যেমন সরঞ্জামের সাহায্যে ক্রমে ক্রমে এবং যত্নের সঙ্গে ইহা শিক্ষা দেওয়া হয় তাহাতে এইরূপ ভীতি বা নৈরাশ্যের কোনো কারণ ঘটে না। তবে অঙ্ক কষা ভালো করিয়া শিখিতে হইলে শিশুকে নিয়ম মুখস্থ করার অপ্রীতিকর ও নীরস কাজটি করিতেই হইবে। শৈশবের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রম যখন শিশুদের নিকট আনন্দদায়ক করার চেষ্টা হয় তখন এই বিষয়টি সেখানে স্থান দিলে কিছুটা বিসদৃশ হয় বটে কিন্তু প্রয়োজনের খাতিরেই ইহা করিতে হয়। ইহা ছাড়া গণিত শিশুর মনকে স্বাভাবিকভাবেই যথার্থতার জন্য প্রস্তুত করে; কোনো অঙ্কের উত্তর শুধু ঠিক কিংবা ভুল হইতে পারে; ইহা বলা চলে না যে, উত্তরটি খুব আনন্দদায়ক কিংবা ভাবপূর্ণ হইয়াছে। গণিতের ব্যবহারিক উপযোগিতা তো আছেই, তাহা ছাড়া যথার্থতা শিক্ষার সহায়ক বলিয়া বাল্যশিক্ষায় ইহার গুরুত্ব অনেকখানি। প্রথম হইতেই অঙ্ক যাহাতে শিশুর কাছে ভীতিজনক বলিয়া মনে হইতে না পারে সেইজন্য কঠিনতা অনুসারে ইহার ক্রম নির্ধারণ করিয়া ধীরে ধীরে সহজ হইতে কঠিনের দিকে আগাইয়া যাইতে হয়; একসঙ্গে খুব বেশি সময় শিশুকে এ বিষয়ে নিয়োজিত রাখা উচিত নহে।

আমাদের বাল্যকালে ভূগোল ও ইতিহাস পড়ানো হইত সর্বাপেক্ষা খারাপ। ভূগোলের প্রতি আমার বিশেষ ভীতি ছিল; ইতিহাসের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ ছিল বলিয়া ইহার পাঠ কোনো রকম সহ্য করিয়াছি। এই দুটি বিষয়ই শিশুদের নিকট আনন্দদায়ক করা যায়। আমার পুত্রটি এখনও ভূগোলের পাঠ গ্রহণ করে নাই, তবু সে তাহার পরিচারিকার অপেক্ষা ভূগোলের বিবরণ বেশি জানে। অন্যান্য বালকের মতোই তাহার যে রেলগাড়ি ও স্টিমারের প্রতি আকর্ষণ আছে তাহারই ভিতর দিয়া সে জ্ঞান অর্জন করিয়াছে। তাহার কল্পনার জাহাজ কোন পথে চলিবে সে তাহা জানিতে চায় এবং আমি যখন চীনদেশে যাওয়ার পথের বর্ণনা দিই তখন সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাহা শোনে। তখন সে যদি দেখিতে চায় তবে আমি তাহাকে পথে বিভিন্ন দেশের ছবি দেখাই। সময় সময় সে বড় ভূচিত্রাবলিখানা টানিয়া লইয়া তাহাতে দেশ ভ্রমণের পথ দেখিতে চায়। আমরা প্রতি বৎসর দুইবার করিয়া লন্ডন যাই। লন্ডন ও কর্নওয়ালের মধ্যে ট্রেনে ভ্রমণে খোকা যারপর নাই আনন্দিত হয় এবং যেখানে যেখানে ট্রেন থামে অথবা যেখানে গাড়ি জুড়িয়া দেওয়া হয় সেই সব স্থানের নাম তাহার মুখস্থ। উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু তাহাকে মুগ্ধ করে কিন্তু সে ভাবিয়া পায় না পূর্ব মেরু ও পশ্চিম মেরু নাই কেন! কোন দিকে ফ্রান্স ও স্পেন দেশ এবং কোন্ দিকে আমেরিকা তাহা সে জানে; ওই সব দেশে কি কি দেখিতে পাওয়া যায় তাহাও মোটামুটিভাবে অনেক কিছু জানে। এইসব বিষয় তাহাকে শিক্ষা দিবার জন্য শিখানো হয় নাই, কৌতূহলের বসে প্রশ্ন করিয়া করিয়া সে এইসব শিখিয়াছে। ভ্রমণের সঙ্গে সংযুক্ত হইলে ভূগোল শেখার আগ্রহ প্রায় সকল শিশুরই হয়। শিশুকে ভূগোল শিখানোর উপায় স্বরূপ ছবি এবং ভ্রমণকারীদের গল্প বলা চলে কিন্তু প্রধান উপায় হইল বিভিন্ন দেশে ভ্রমণকারী কি। দেখিতে পায় তাহা চলচ্চিত্রে ছাত্রদিগকে দেখানো। এমনই কতকগুলি ভৌগোলিক বিষয়ের জ্ঞান কাজে লাগিতে পারে কিন্তু ইহার বুদ্ধিমূলক কোনো মূল্য নাই। কিন্তু ছবির সাহায্যে ইহা যখন শিশুর মনে স্পষ্ট ও জীবন্ত হইয়া উঠে তখন ইহা শিশুকে কল্পনার খোরাক জোগায়। পৃথিবীতে যে গরম দেশ ও শীতল দেশ আছে, শ্বেতকায় লোকের ন্যায় কৃষ্ণকায় লোক, পীত লোক, বাদামি বর্ণের লোক এবং লোহিত বর্ণের লোকও যে আছে শিশুর পক্ষে তাহা জানা ভালো। ইহা জানা থাকায় পরিচিত ভৌগোলিক পরিবেশ শিশুর মন ও কল্পনার উপর চাপিয়া বসিয়া তাহার মনের সতেজটা নষ্ট করিয়া ফেলিতে পারে না এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশ সে সত্য সত্যই আছে–এই বোধ জন্মাইতে সাহায্য করে। নতুবা দেশভ্রমণ ব্যতীত অন্যান্য দেশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে স্পষ্ট বিশ্বাস বা অনুভূতি লাভ করা বড় কঠিন। এই সব কারণে অতি অল্প বয়সেই শিশুদিগকে আমি ভূগোল শিখাইবার পক্ষপাতী; তাহারা ইহাতে আনন্দবোধ না করিলে আমি বিস্মিত হইব। কিছুদিন পরে আমি শিশুদিগকে ছবিযুক্ত বই, মানচিত্র দিব এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সম্বন্ধে মোটামুটি বিবরণ জানাইব। এই প্রসঙ্গে আমি তাহাদিগকে বিভিন্ন দেশের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ছোট ছোট প্রবন্ধ রচনা করিতে বলিব।

ভূগোলের সম্বন্ধে যাহা প্রযোজ্য ইতিহাস শিক্ষার বেলাতেও তাহাই বরং আরও বেশি ভাবে খাটে। তবে ইতিহাস শিক্ষা একটু বয়স বেশি হইলে শুরু করিতে হয় কারণ অতি অল্পবয়সে শিশুর সময়-জ্ঞান খুবই কম থাকে। প্রথমে বিখ্যাত লোকদের গল্প বহুচিত্রিত পুস্তকে বিশেষ আকর্ষণীয়ভাবে শিশুদের সম্মুখে ধরিতে হইবে। ওই রকম বয়সে আমার নিজের একখানা ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসের ছবির বই ছিল। তাহাতে একটি ছবি ছিল রানী ম্যাটিল্ডা আবিংডনে বরফের উপর দিয়া টেমস্ নদী পার হইতেছেন। সেই ছবিখানি আমার মনে এমন গভীরভাবে রেখাপাত করিয়াছিল যে, আঠারো বৎসর বয়সে আমি যখন ঠিক ওইরূপভাবে বরফ পার হইয়া গিয়াছিলাম তখন আমার দেহ-মনে শিহরণ উঠিয়াছিল। মনে হইতেছিল রাজা স্টিফেন যেমন রানী ম্যাটিল্ডাকে সসৈন্যে অনুসরণ করিয়াছিলেন তেমনই আমার পিছনে যেন স্টিফেন ছুটিয়া আসিতেছিলেন। আমার ধারণা পাঁচ বৎসর বয়সের এমন কোনো বালক নাই যে আলেকজান্ডারের জীবনী শুনিয়া আনন্দিত না হইবে। কলম্বাসের জীবনকথায় ইতিহাস অপেক্ষা ভূগোলের অংশই বেশি। দুই বৎসর বয়স্ক শিশু অন্তত সমুদ্রের সঙ্গে পরিচয় আছে এমন শিমু যে কলম্বাসের জীবন-কথায় আনন্দ পায় এ প্রমাণ আমি নিজেই দিতে পারি। শিশু যখন ছয় বৎসর বয়সে পদার্পণ করে তখন মিঃ এইচ, জি ওয়েলসের ধরনের লেখা পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তাহাকে দেওয়া চলে, অবশ্য কোনো কোনো অংশ আরও সরলভাবে লেখা এবং অধিকতর ছবি সন্নিবেশ করার প্রয়োজন হইবে; অথবা সম্ভবপর হইলে চলচ্চিত্রের সাহায্য গ্রহণ করা চলে। লন্ডনে বাস করিলে শিশু প্রাকৃতিক ইতিহাসের জাদুঘরে [Natural History Museum] অদ্ভুত প্রাণী দেখিতে পারে কিন্তু দশ বৎসর কিংবা ওই রকম কাছাকাছি বয়স ছাড়া শিশুকে আমি ব্রিটিশ জাদুঘরে [British Museum-F] লইয়া যাইতে চাহি না। ইতিহাস শিখাইবার সময় বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে যাহাতে আমাদের বয়স্ক ব্যক্তিদের নিকট যাহা আনন্দদায়ক তাহা যেন জোর করিয়া শিশুর উপর চাপাইয়া দেওয়া না হয়। যে দুইটি বিষয় শিশুকে প্রথমে আকৃষ্ট করে তাহা হইল পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাব, বন্য মানুষ হইতে ক্রমে সভ্য মানুষের পর্যায়ে তাহার। জয়যাত্রার কথা। দ্বিতীয়, যেখানে কোনো ব্যক্তির বীরত্বে মুগ্ধ হইয়া বালক তাঁহার প্রতি অনুরক্ত হয় তাহার জীবনের ঘটনাগুলির সরস নাটকীয় ভঙ্গিতে বর্ণনা। এ স্থানে মনে রাখিতে হইবে মানুষের অগ্রগতি সরল এবং সহজ পথে হয় নাই। আদিম বর্বর মানুষের নিকট হইতে রক্তের ভিতর দিয়া আমরা যে বর্বরতা উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছি তাহাই মাঝে মাঝে সভ্যতার দিকে আগাইয়া যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছি কিন্তু জ্ঞানের বলে মানুষ এই প্রতিরোধ জয় করিয়াছে। কোনও বিশেষ এক দেশের অধিবাসীদের কথা নয়, সমগ্র মানব জাতির ক্রমবিবর্তন ও অগ্রগতির কাহিনী হইবে ইতিহাস শিক্ষার গোড়ার কথা। মানুষ তখন বাহিরের নানারূপ প্রতিকূল ও বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং ভিতরের অজ্ঞানতার সঙ্গে সংগ্রাম করিতে করিতে আগাইয়া চলিয়াছে, বিচারবুদ্ধির ক্ষুদ্রদীপ জ্ঞানের দীপ্তিতে ক্রমশ উজ্জ্বলতর হইয়া অজ্ঞানের অন্ধকার রজনীর অবসান ঘটাইতেছেন। বিভিন্ন গোষ্ঠী, জাতি এবং ধর্মসম্পদায়ে বিভক্ত হওয়া মানবের পক্ষে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক; বিশৃঙ্খলা ও অজ্ঞান তমসারাত্রির আবাসনকল্পে মানবের যে সংগ্রাম অবিরাম চলিয়াছে তাহাতে এই ভেদবুদ্ধি মানুষকে দুর্বল এবং বিভ্রান্ত করিয়া ফেলে। পক্ষান্তরে, সুশৃঙ্খল ও জ্ঞানদীপ্ত মানবসমাজ গড়িয়া তোলাই মানবোচিত কাজ।

প্রথমে আমি ছবি ও গল্পের ভিতর দিয়া বিষয়বস্তুটির অবতারণা করিব। প্রথমে থাকিবে কেবল মানুষের আদিম যুগ হইতে ক্রমোন্নতির পথে জয়যাত্রার কথা। ইহার অন্তর্নিহিত ভাব এবং মানুষের আদর্শে কি হওয়া উচিত সে কথা প্রথমে না বলিয়া পরে শিশুর বিচারবুদ্ধি কিছুটা বৃদ্ধি পাইলে–অবতারণা করা চলে। আমি দেখাইব কেমন করিয়া আদিম মানব শীতে কষ্ট পাইয়াছে, কাঁচা ফল খাইয়া জীবন ধারণ করিয়াছে। কখন আগুন আবিস্কার করা হইল এবং ইহার ফলে আদি মানবের জীবনে কি পরিবর্তন আসিল তাহা দেখাইব। এই প্রসঙ্গে প্রমিথিয়ুস কর্তৃক আগুন আনার কাহিনী বর্ণনা করিলে তাহা সময়োপযোগী হইবে। তাহার পরে দেখাইব কেমন করিয়া মিশর দেশে নীল নদের উপত্যকায় কৃষিকার্যের পত্তন হয় এবং কুকুর, ভেড়া ও গরু পোষা শুরু হয়। গাছের গুঁড়ি খোদাই করিয়া যে নৌকা তৈয়ার করা হইত তাহা হইতে শুরু করিয়া কেমন করিয়া বর্তমান যুগের বিরাট জাহাজ নির্মাণ করা সম্ভব হইয়াছে তাহা দেখাইব। মানুষের বাসস্থান আদি মানবের পর্বত গুহা হইতে কিভাবে বর্তমানে লন্ডন ও নিউইয়র্কের মতো বিরাট শহরের অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহার চিত্র দেখাইব। অক্ষর ও সংখ্যা লেখার ক্রমবিকাশ দেখাইব, গ্রিসের উন্নত সভ্যতার কথা, রোমের বিপুল ঐশ্বর্যের কথা, তাহার পরবর্তীকালের সভ্যতার অবনতি ও অজ্ঞানের অন্ধকারের কথা এবং সর্বশেষ বর্তমান যুগের বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির কথা গল্প ও চিত্রের সাহায্যে শিশুদিগকে বুঝাইতে হইবে। খুব কম বয়সের শিশুর নিকটও এই বিষয়গুলি চিত্তাকর্ষক করা যায়। মানবজাতির ইতিহাস বর্ণনায় যুদ্ধবিগ্রহ, অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে নীরব থাকিব না তবে রণজয়ী বীরদিগকে আমি খুব প্রশংসার পাত্র বলিয়া ছাত্রদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিব না। আমার ইতিহাস শিক্ষার প্রকৃত বিজয়ী বীর তাহাদিগকেই বলিব যাহারা মানুষের ভিতরের ও বাহিরের অজ্ঞান-তমসা দূর করিয়াছেন-যেমন বুদ্ধ এবং সক্রেটিস, আর্কিমিডিস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং আর সমস্ত জ্ঞানী ব্যক্তি যাহারা আমাদিগকে আত্মজয় করিতে কিংবা বহিঃপ্রকৃতি জয় করিতে সাহায্য করিয়াছেন। মানুষের মহান সম্ভাবনা এবং বিপুল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি ছাত্রদের ধারণা গড়িয়া তুলিতে চাই। তাহারা যেন বুঝিতে পারে যে যুদ্ধবিগ্রহ এবং আমাদের পূর্বপুরুষ আদি বর্বর মানবের মতো আচরণ দ্বারা আমরা অবনতির ভ্রান্ত পথেই চারিত হইব, মানুষের মধ্যে সদ্ভাব, মানবজাতির পক্ষে কল্যাণকর কাজ করাতেই মানুষের সভ্যতার আসল পরিচয়।

নৃত্য ও সংগীত বিদ্যালয়ে প্রথম কয়েক বৎসরে নৃত্য অভ্যাস করার জন্য কিছু সময় নির্দিষ্ট করিয়া রাখিতে হইবে। নৃত্য শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করে, তাহাদিগকে প্রচুর আনন্দ তো দেয়ই, তাহা ছাড়া সুরুচিবোধ জাগ্রত করে। নৃত্যের প্রথম পাঠ শিক্ষা করা হইলে শিশুদিগকে সমবেত নৃত্য শিখাইতে হইবে। এই ধরনের সহযোগিতামূলক আনন্দদায়ক কাজ শিশুরা ভালোবাসে। সংগীত সম্বন্ধে ঠিক এইরূপ ব্যবস্থা করা চলে, তবে নৃত্যের কিছু পরে ইহা আরম্ভ করিতে হইবে, কারণ নৃত্যে যেমন দেহের আন্দোলনজনিত আনন্দ আছে সংগীতে তেমন সুযোগ নাই। তাহা ছাড়া সংগীত নৃত্যের অপেক্ষা কঠিনও। সকলে না হইলেও অনেক শিশুই গান গাহিতে আনন্দ পাইবে এবং শিশুর ছড়া শেখার পর ভালো গান গাহিতে শিখিবে। প্রথমেই শিশুদের রুচি বিকৃত করিয়া পরে সংশোধনের কোনো লাভ নাই। ইহার ফলে তাহাদিগকে হঁচড়ে-পাকা করা হয় মাত্র। বয়স্ক ব্যক্তিদের ন্যায় সকল শিশুর গান গাহিবার সমান যোগ্যতা থাকে না। কাজেই কঠিন সুরের গানগুলি শিখিবার জন্য কতক ছেলেমেয়েকে বাছাই করিয়া লইতে হইবে। এইরূপ বালক-বালিকার পক্ষেও গান স্বেচ্ছাধীন বিষয় রাখিতে হইবে। গান গাহিতে পারে বলিয়াই তাহাদের উপর জোর করিয়া ইহা চাপাইবার প্রয়োজন নাই।

সাহিত্য শিক্ষার ব্যাপারে সহজেই ভুল হইতে পারে। কি শিশু, কি বৃদ্ধ কাহারও পক্ষেই সাহিত্য সম্বন্ধে কেবল কতকগুলি বিষয়, যেমন কবিদের সময়কাল, তাহাদের রচনাবলির নাম বা এই ধরনের বিষয় জানিয়া কোনো লাভ নাই। এইরূপ নোটবুকে টুকিয়া রাখার যোগ্য যে জ্ঞান তাহা শুধু পল্লবগ্রহিতারই পরিচায়ক; ইহার প্রকৃত মূল্য কিছু নাই। সৎ সাহিত্য যদি পাঠকের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে তবেই ইহার পাঠে সার্থকতা। সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের প্রভাব পাঠকের কেবল রচনাশৈলির [Style] উপর নয়, চিন্তার প্রকৃতির উপরও পড়া চাই। কয়েক শতাব্দী আগে বাইবেল ইংরাজ শিশুদের উপর এইরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। ইংরাজি গদ্যরচনায় ইহার সুফল দেখা গিয়াছে কিন্তু আধুনিককালের খুব কম বালক-বালিকারই বাইবেলের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় আছে। আমার মনে হয় মুখস্থ না করিলে সাহিত্য হইতে সম্পূর্ণ সুফল পাওয়া যায় না। স্মৃতিশক্তি বেশি করার উপায়স্বরূপ পূর্বে মুখস্থ করানোর রীতি ছিল কিন্তু মনোবিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করিয়াছেন যে, ইহা এক রকম নিষ্ফল। আধুনিক শিক্ষাবিদগণ ইহাকে শিক্ষাক্ষেত্রে খুব কম স্থান দিতেছেন কিন্তু আমার মনে হয় ইহাতে ভুল করা হইতেছে। মুখস্থ করার ফলে যে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহা নয়, কথায় এবং লেখার সুন্দর ভাষা প্রয়োগ করার সে সুফল পাওয়া যায় তাহার জন্য মুখস্থ করা দরকার। কষ্ট করিয়া ভাষার মাধুর্য অর্জন করিতে হইবে না; চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত বাহন হিসাবে যদি সাবলীল ভাষা স্বাভাবিকভাবে আসে তবেই ইহার সার্থকতা প্রমাণিত হইবে। বর্তমান সমাজে প্রাচীন যুগের তুলনায় সৌন্দর্য ও রুচিবোধের আবেগ কমিয়া গিয়াছে। সৎ সাহিত্যের সঙ্গে ভালরকম পরিচয়ের ফলেই চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও ভাষার সৌষ্ঠব আয়ত্ত করা সম্ভবপর। এইজন্যই মুখস্থ করা আমার কাছে এত প্রয়োজনীয় মনে হয়।

কিন্তু এইজন্য কতকগুলি বাঁধাধরা গদ্য ও পদ্যের অংশ মুখস্থ করাইলে তাহা শিশুদের নিকট বিরক্তিকর ও অকৃত্রিম বলিয়া মনে হয়; কাজেই ইহাতে সুফল পাওয়া যায় না। অভিনয় করানোর সুযোগে মুখস্থ করাইলে বরং উপকার হয়, কেননা অভিনয় করিতে শিশুরা খুবই ভালবাসে। তিন বৎসর বয়স হইতেই শিশুরা ইহাতে আনন্দ পায়। নিজেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এইরূপ করে, ইহার জন্য যখন নানারূপ সাজসজ্জা করা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য আয়োজন হয় তখন তাহাদের উল্লাস ধরে না। বাল্যকালে জুলিয়াস সিজার নাটক অভিনয় করিতে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসের মধ্যে বিষাদের দৃশ্য অভিনয়ে আমি কিরূপ তীব্র আনন্দ অনুভব করিয়াছিলাম তাহা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

যে সকল শিশু অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে তাহারা যে কেবল নিজেদের অংশই মুখস্থ করে তাহা নহে, অপর অংশগুলিরও প্রায় সবটাই মুখস্থ করিয়া ফেলে। নাটকটি বহুদিন তাহাদের চিন্তায় স্পষ্ট হইয়া থাকে এবং আনন্দ দান করে। ভালো সাহিত্যের উদ্দেশ্যই হইল আনন্দদান করা; শিশুরা যদি সাহিত্য হইতে আনন্দ আহরণ করিতে না পারে তবে ইহা হইতে কোনো উপকারও পাইবে না। এই কারণের জন্য আমি বাল্যকালে কেবল অভিনয়োপযোগী অংশগুলি মুখস্থ করানোর পক্ষপাতী। ইহা ছাড়া শিশুরা ইচ্ছামতো স্কুলের লাইব্রেরি হইতে সুলিখিত গল্পের বই লইয়া পড়িতে পাইবে।

আজকাল অনেক লেখক শিশুদের জন্য বাজে এবং তরল ভাবোদ্দীপক বই লেখেন; ইহাতে শিশুদের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। এইগুলি শিশুদের ছেলেমিকে বাড়াইয়া তুলিয়া তাহাদিগকে অপমান করে। ইহার বিপরীত অবস্থা লক্ষ করুন রবিনসন ক্রুসো পুস্তকে। শিশুদের জন্য লিখিত হইলেও তাহাতে কোথাও ছেলেমি বা ন্যাকামির স্থান নাই। কি শিশুর সঙ্গে আচরণে কি অন্যত্র তার ভাবপ্রবণতার আকর্ষণ কখনই বেশি নয়। কোনো শিশুই ছেলেমির প্রতি আকৃষ্ট হয় না, সে চায় যতশীঘ্র সম্ভব বয়স্ক ব্যক্তির মতো আচরণ অভ্যাস করিতে। কাজেই শিশুদের জন্য বই লিখিতে তাহাদের ছেলেমি অবলম্বন করিয়া কাহিনী গড়িয়া তোলার কোনো আবশ্যকতা নাই। শিশুদের জন্য রচিত আধুনিক বইতে এইরূপ কৃত্রিম ন্যাকামি বড়ই বিরক্তিকর। শিশুরা ইহা পড়িয়া আনন্দ পায় না, তাহাদের মানসিক বৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল স্বাভাবিক ভাবাবেশও ইহা দ্বারা ব্যাহত হয়। শিশুদের মন বিকাশোনুখ এবং সম্প্রসারণের জন্য অধীর। শিশুরা চিরকাল শিশু হইয়া থাকিতে চায় না, তাহারা চায় শক্তিমান কর্মক্ষম বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হইতে। গল্পের বইতেও তাহারা এই বিকাশের পরিচয় দেখিতে পাইলে আনন্দিত হয়; কাজেই বইতে ইহার বিপরীত অবস্থা দেখিলে শিশুর ছেলেমিতে তাহাদের মন সায় দেয় না। এইজন্যই যে সব ভালো বই বয়স্কদের জন্য লিখিত অথচ তাহাদের পক্ষেও উপযোগী সেইগুলিই শিশুদের জন্য শ্রেষ্ঠ। ইংরাজি সাহিত্যে ইহার ব্যতিক্রম কয়েকখানি মাত্র বই আছে; যেমন লিয়ার [Lear] ও লুই ক্যারোল কর্তৃক [Lawis Carol] শিশুদের জন্য লিখিত বই; এগুলি পড়িয়া বয়স্ক ব্যক্তিরাও প্রচুর আনন্দ পায়।

বিদেশি ভাষা শিক্ষা : আধুনিক ভাষা শিক্ষার প্রশ্নটি একেবারে সহজ নয়। শৈশবে কোনো আধুনিক ভাষায় কথা বলা যেমন সুন্দরভাবে শেখা যায় অন্য কোনো বয়সে তত সম্পূর্ণভাবে শেখা যায় না। শৈশবে ভাষা শিক্ষা দিলে দেওয়ার স্বপক্ষে ইহাও একটি সুযুক্তি। অনেকে আশঙ্কা করেন যে, শৈশবে বিদেশি ভাষা শিক্ষা শিশুর মাতৃভাষা শিক্ষায় ব্যাঘাত জন্মে। আমি ইহা বিশ্বাস করি না। টলস্টয় এবং টুর্গেনিভ যদিও শৈশবে ইংরাজি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষা শিখিয়াছিলেন তবু রাশিয়ান ভাষায় তাঁহাদের দখল ছিল অসাধারণ। গিবন ইংরাজি ভাষার মতো সহজ সাবলীল ভঙ্গিতেই ফরাসিও লিখিতে পারিতেন, কিন্তু এইজন্য তাঁহার ইংরাজি রচনাশৈলি [Style] মোটেই ব্যাহত হয় নাই। অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক ইংরেজ অভিজাত ব্যক্তি কৈশোরেই ফরাসি এবং অনেকে ইতালি ভাষাও শিক্ষা করিতেন তথাপি তাহাদের ইংরাজি ভাষা তাঁহাদের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের অপেক্ষা অনেক ভালো ছিল। কেহ হয়তো মনে করিতে পারেন শিশু বহুভাষা শিক্ষা করিলে তালগোল পাকাইয়া ফেলিবে। সে যদি বিভিন্ন লোকের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলিবার সুযোগ পায় তবে তাহার নাটকীয় প্রবৃত্তিই তাহাকে এইরূপ খিচুড়ি পাকাইতে দেয় না। আমি ইংরাজি শিক্ষার সময় হইতেই জার্মান ভাষা শিক্ষা করা শুরু করিয়াছিলাম এবং দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত পরিচারিকা ও গৃহশিক্ষয়িত্রী এবং শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলিতে ওই ভাষা ব্যবহার করিতাম। ইংরাজির সহিত মিশিয়া যাইত না কারণ ইহার প্রত্যেকটি সঙ্গে পৃথক ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ [Association] জড়িত ছিল।

বিদেশি ভাষা শিক্ষার সহজ উপায় : আমার মনে হয় যদি বর্তমান ভাষা শিক্ষা করিতে হয় তবে উহা যাহার মাতৃভাষা এমন লোকের নিকটই শেখা উচিত কারণ তিনি যে কেবল ভালোভাবে শিখাইতে পারিবেন তাহাই নয়, শিক্ষার্থী শিশুর মাতৃভাষায় যিনি কথা বলেন তাহার সঙ্গে বিদেশি ভাষায় কথা বলিতে যেইরূপ কৃত্রিমতা থাকে বিদেশির সঙ্গে বিদেশি ভাষায় বাক্যালাপ করিতে সেইরূপ কৃত্রিমতা-বোধ আসে না। কাজেই আমার মনে হয় প্রত্যেক স্কুলেই একজন করিয়া ফরাসি শিক্ষয়িত্রী থাকা উচিত। ভাষা শিক্ষাদানের প্রথম অবস্থায় কেবল ইহারা যথারীতি পাঠ দিবেন। তারপর খেলাধুলা এবং শিশুদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার ভিতর দিয়া ভাষা শিক্ষা চলিবে; এমন হওয়া চাই যেন বিদেশি ভাষা বুঝিয়া তাহাতে উত্তর করিতে পারার ভিতর দিয়াই খেলা পূর্ণাঙ্গ ও সফল হয়। শিক্ষয়িত্রী প্রথমে সহজ খেলা হইতে শুরু করিয়া ক্রমে জটিলের দিকে অগ্রসর হইতে পারেন। এইভাবে কোনোরূপ। মানসিক পরিশ্রম ছাড়াই আনন্দদায়ক কাজের মাধ্যমে বিদেশি ভাষা শিখানো চলে। বাল্যকালে যেমন সহজে এবং যত কম সময় অপচয় করিয়া ইহা আয়ত্ত করা যায় অন্য কোনো বয়সে সেইরূপ করা সম্ভবপর নয়।

অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা : আমরা যে বয়সের পাঠ্যক্রম আলোচনা করিতেছি ইহার শেষ দিকে অর্থাৎ বারো বৎসর বয়সে অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হইবে। অবশ্য আমি ধরিয়া লইতেছি যে ইতোমধ্যে পাটীগণিত শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে এবং জ্যোতিষ ও ভূবিদ্যা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, বিখ্যাত আবিষ্কারক এবং অনুরূপ কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় সম্বন্ধে মোটামুটি আলোচনা করা হইয়াছে। আমি এখন জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যা শিখানোর কথা চিন্তা করিতেছি। খুব কমসংখ্যক বালক-বালিকা জ্যামিতি ও বীজগণিত পছন্দ করে, বেশিরভাগই পছন্দ করে না। কেবল ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাদান প্রণালীই ইহার কারণ কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। গান গাহিবার ক্ষমতার মতোই গাণিতিক বোধ দেবদত্ত শক্তি; মাঝারি রকম মাত্রায়ও ইহা একান্ত বিরল। তথাপি প্রত্যেক বালক-বালিকারই গণিতের প্রতি অনুরাগ থাকা উচিত; কাহারাও গাণিতিক প্রতিভা আছে কি না তাহা ইহার অনুশীলনের ভিতর দিয়াই আবিষ্কার করা যায়। যাহারা বিশেষ কিছু শিখিতে পারে না, তাহারা ইহা জানিয়া উপকৃত হয় যে, ওই ধরনের একটি শিক্ষণীয় বিষয় আছে। উপযুক্ত প্রণালীতে শিক্ষা দিলে প্রায় সকলেই জ্যামিতির বিষয়বস্তু বুঝিতে পারে। বীজগণিত সম্বন্ধে ঠিক একথা বলা চলে না; জ্যামিতির চেয়ে ইহা অধিকতর বস্তুনিরপেক্ষ [abstract] এবং স্থূল বস্তু হইতে যাহারা মনকে সরাইয়া লইতে পারে নাতাহাদের পক্ষে ইহা দুর্বোধ্য। উপযুক্তভাবে শিক্ষা দিলে পদার্থবিদ্যা ও রাসায়নবিদ্যার প্রতি অনুরাগী ছাত্রের পরিমাণ গণিতানুরাগীর অপেক্ষা কিছু বেশি হইতে পারে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় ইহার প্রতি অনুরাগ খুব কম সংখ্যক যুবকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কোনো বালক বা বালিকার গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি কোনোরূপ প্রবণতা আছে কি না তাহা জানিবার জন্য বারো হইতে চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত ইহা শিখানো উচিত। অনেক সময় ইহা প্রথমেই ধরা পড়ে না। আমি প্রথমে বীজগণিত মোটেই পছন্দ করিতাম না যদিও পরে ইহার কায়দা শিখিয়া লওয়ার বিষয়টি সহজ মনে হইয়াছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রের কোনো প্রতিভা আছে কি না চৌদ্দ বৎসর বয়সে তাহা যথার্থভাবে জানা নাও যাইতে পারে। এইরূপ ছাত্র বা ছাত্রীকে পরীক্ষামূলকভাবে আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা চলে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চৌদ্দ বৎসর বয়সেই বাছাই করা যায়। কতক এই বিষয়গুলি পছন্দ করিবে এবং ইহাতে ভালো করিবে, কতক ইহা মোটেই পছন্দ করিবে না কিংবা বোকা ছাত্র ইহা পছন্দ করিবে। এইরূপ ব্যাপার অতি কদাচিৎ ঘটিতে পারে।

প্রাচীন সাহিত্য : গণিত ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কেও তাহাই প্রযোজ্য। বারো হইতে চৌদ্দ বৎসর বয়সের মধ্যে প্রাচীন ভাষা (যেমন ল্যাটিন) ততটুকুই শিক্ষা দিতে হইবে যাহা হইতে বোঝা যায় কোনো বালকের বা কোনো বালিকার ইহার প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগ এবং দক্ষতা আছে। আমি মনে করি যে, চৌদ্দ বৎসর বয়স হইতেই ছাত্রের রুচিপ্রবণতা ও ক্ষমতা অনুসারে বিশেষ এবং উন্নত মানের শিক্ষা শুরু হওয়া উচিত। শিশুকে পরবর্তিকালে কী শিক্ষা দিলে ভালো হইবে তাহা ছাত্রের চৌদ্দ বৎসর বয়ঃপ্রাপ্তির কিছু পূর্ব হইতেই বিশেষভাবে নিরূপিত হওয়া আবশ্যক।

বহিঃপ্রকৃতির সহিত পরিচয় : সারা স্কুল জীবন ধরিয়াই বাহিরের সহিত পরিচয় চলিতে থাকিবে। অবস্থাপন্ন লোকের সন্তানদের বেলায় ইহার ভার ছাত্রের পিতামাতার উপর দেওয়া চলে কিন্তু অপর ছাত্রদের বেলায় এইরূপ পরিচয় সাধনের দায়িত্ব বিদ্যালয়কেই আংশিকভাবে গ্রহণ করিতে হইবে। আমি যখন বাহিরের বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার কথা বলিতেছি তখন আমি খেলাধুলার কথা ভাবিতেছি না। ইহার অবশ্য উপকারিতা আছে এবং তাহা রীতিমতভাবে স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু অন্য ধরনের বহির্বিষয়ের শিক্ষার কথা বলিতেছি–যেমন চাষ-আবাদের প্রণালী, গাছপালা ও জীবজন্তু চেনা, বাগানের কাজের সঙ্গে পরিচয়, পলি-পর্যবেক্ষণ এবং অনুরূপ বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান। আমি দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি যে, এমন শহুরে লোক আছে যাহারা কম্পাস বা দিগদর্শন-যন্ত্রের চিহ্ন বোঝে না। সূর্য কোন্ দিকে যায় জানে না, গৃহের কোন্ দিকটি বায়ুপ্রবাহের আড়ালের দিকে পড়ে জানে। প্রত্যেক গরু কিংবা ভেড়ার যে জ্ঞান সেইরূপ জ্ঞান হইতেও বঞ্চিত। ইহা নিরবচ্ছিন্নভাবে কেবল শহরে বাস করার কুফল। যদি বলি শ্রমিকদল যে পল্লি অঞ্চলে ভোটে জয়ী হইতে পারে না ইহা তাহার অন্যতম কারণ, তবে হয়তো অনেকেই আমাকে কল্পনা-বিলাসী বা খামখেয়ালি বলিবেন। কিন্তু শহরে লালিতপালিত ব্যক্তিদের পল্লির সঙ্গে কোনোরূপ সংস্রব না থাকার ফলেই বহু প্রাচীন এবং মৌলিক জিনিসের সঙ্গেও তাহাদের পরিচয় নাই।

বিভিন্ন ঋতু ও আবাহওয়া, ফসল বোনা ও কাটা, নানা গৃহপালিত প্রাণী প্রভৃতির মানব-জীবনের সহিত সংযোগ আছে। কাজেই জীবধাত্রী বসুন্ধরার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিতে না চাহিলে ইহাদের সহিত প্রত্যেকের পরিচিত হওয়া উচিত। বিদ্যালয়ের বাহিরে নানা কাজের ভিতর দিয়া শিশুগণ এইসবের সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিতে পারে। বিদ্যালয়ের বাহিরে কাজকর্ম এবং রৌদ্রে ও মুক্ত বায়ুতে অবস্থান ছাত্রদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অশেষভাবে উপকারী; শুধু এই জন্য পল্লি অঞ্চলে ভ্রমণ বাঞ্ছনীয়। শহরের শিশুরা পল্লিতে গেলে যেইরূপ আনন্দিত হয় তাহা হইতে বোঝা যায় যে, তাহাদের একটি বড় অভাব যেন পূরণ করা হইতেছে। যতদিন এই অভাব পূরণ না হয় ততদিন শিক্ষাপ্রণালী অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।

 ১৪. বিদ্যালয়-জীবনের শেষ কয়েক বৎসর

আমি ধরিয়া লইয়াছি যে, পঞ্চদশ বৎসরের গ্রীষ্মের ছুটির পর যে সকল বালক-বালিকা কোনো বিষয়ে উন্নতির বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করে তাহাদিগকে ওইরূপ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হইবে। ইহাও ধরিয়া লওয়া যায় যে, এইরূপ শিক্ষার্থীর সংখ্যা হইবে অনেক। যদি কোনো শিক্ষার্থীর কোন বিষয়ের প্রতি ঝোঁক বা কোন বিষয়ের উপযুক্ত মানসিক শক্তি আছে তাহা এই সময়ের মধ্যে নিরূপণ করা সম্ভবপর না হয় তবে তাহাকে আরও কিছুদিন সাধারণ-শিক্ষাই দিতে হইবে। বিশেষ প্রতিভাবান ছাত্রের ক্ষেত্রে উন্নততর শিক্ষা পনেরো বৎসর বয়সের আগেও আরম্ভ করা যাইতে পারে। বিশেষ কারণ থাকিলে শিক্ষা ব্যাপারে এই নিয়মগুলির ব্যতিক্রম করা চলে। কিন্তু আমার মনে হয় বুদ্ধিবৃত্তিতে যাহারা সাধারণ বা মাঝারি প্রকৃতির বালক-বালিকার তুলনায় উপরের স্তরে তাহাদের চৌদ্দ বৎসর বয়সের কাছাকাছি সময়ে উন্নততর বিশেষ শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হওয়া উচিত। যাহারা মাঝারির নিচে তাহাদের হাতের কাজ ছাড়া স্কুলে অন্য কোনো বিষয়ে উন্নততর শিক্ষা না দেওয়াই ভালো। হাতের কাজ বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে এখানে কিছু বলিব না। আমার মনে হয় চৌদ্দ বৎসর বয়সের পূর্বে ইহা আরম্ভ করা উচিত নহে এবং তখনও স্কুলে সর্বক্ষণ কেবল এই কাজেই ছাত্রকে নিয়োজিত রাখা সমীচীন নয়। ইহার জন্য কতখানি সময় দিতে হইবে, সকল ছাত্রকেই এইরূপ বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া উচিত কি না কিংবা কেবল অল্প সংখ্যককেই দিতে হইবে এই সকল প্রশ্ন এখানে আলোচনা করিতে চাহি না। ইহা করিতে গেলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা ওঠে, সংক্ষেপে ইহা বিশদভাবে আলোচনা করা চলে না। তাহা ছাড়া শিক্ষার সঙ্গে ইহা কেবল পরোক্ষভাবে সংযুক্ত। কাজেই চৌদ্দ বৎসর বয়সের পর ছাত্রের বুদ্ধিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রেই আমার বর্তমান আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখিব।

স্কুলের পাঠ্য বিষয়গুলিকে আমি তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করিতে চাই: (১) প্রাচীন সাহিত্য, (২) অঙ্ক ও বিজ্ঞান, (৩) আধুনিক সংস্কৃতিমূলক বিষয়। আধুনিক ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্য এই তৃতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত। আমি অনুমান করিয়া লইয়াছি যে, আঠারো বৎসর বয়সের পূর্বে ছাত্রগণ বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিবে না। ইতোমধ্যে এই তিনটি বিভাগের প্রত্যেকটি বেশ খানিকটা উন্নততর বিশেষ শিক্