হোহেন স্টেফেনের পতনের পর চার্চ কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা দুনিয়ার উপর ইতালির শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল বলে মনে হয়। অর্থের মানদণ্ডে বিচার করলে দেখা যায়, এই শাসন সুসংহত ছিল এন্টানাইনের সময় পর্যন্ত। রোমানদের সেনাদল কর্তৃক সংগৃহীত অর্থের চেয়ে ইংল্যান্ড এবং জার্মান থেকে রাজস্ব হিসেবে যে অর্থ রোমে চলে যেত তা ঢের বেশি ছিল। কিন্তু তা পোপের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণেই আদায় করা সম্ভব হতো- কোনোরূপ অস্ত্রবলে নয়।
পূর্ববর্তী তিন শতাব্দী ধরে অর্জিত সম্মান পোপরা এভিগননে সরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারাতে বসে। তার একমাত্র কারণ ছিল না ফরাসি রাজার প্রতি পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার, বরং এর কারণ ছিল সংঘের সদস্যদের দমনের মতো নির্মমতায় অংশগ্রহণও। রাজা চতুর্থ ফিলিপ অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়ে এসব সম্পদের প্রতি অন্যায়ভাবে লাভ করে। বিরুদ্ধমত পোষণ করার অজুহাতে অন্যায়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাকে অভিযুক্ত করার জন্যে। যারা ফ্রান্সে ছিল পোপের সাহায্য নিয়ে তাদেরকে আটক করা হয় এবং অত্যাচার করা হয় যে পর্যন্ত না তারা স্বীকার করে যে শয়তানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিল এবং ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতিমূর্তির প্রতি থুথু ফেলেছিল। পরে পোপের জন্য কোনো উপরি পাওনা না রেখেই যখন রাজা তাদের সম্পত্তি থেকে সবটুকু হস্তান্তরিত করেছিলেন তখন তাদেরকে পুড়িয়ে ফেলা হয় অধিক সংখ্যায়। পোপের মর্যাদার নৈতিক অধঃপতনের সূচনা করে এসব কাজ।
পোপের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠল এই বিরাট বিভক্তি। কারণ দাবিদারদের ভেতর কে বৈধ তা কেউই জানত না। তারা একে অপরকে অভিশপ্ত মনে করত। প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষই এই মহাবিভক্তিকালে তাদের অশোভন অভিপ্রায় প্রদর্শন করে ক্ষমতার প্রতি। এমনকি তারা তাদের সংসক্ত শপথও পরিহার করে। উভয় পোপের প্রতি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র ও স্থানীয় চার্চ একত্রে বশ্যতা প্রত্যাহার করে। অবশেষে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ দুর্যোগের অবসান ঘটাতে পারে মাত্র একটি সাধারণ পরামর্শ সভাই। ভিন্নমত পোষণকারী হিসেবে তাদের পদচুতি ঘোষণা করলেও সাফল্যজনকভাবে উভয় পোপের প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ না করেই বিপথগামী হয়ে পিশার কাউন্সিল শুধু জন্ম দেয় তৃতীয় এক পোপের; অবশেষে কনস্টেন্সের কাউন্সিল সফলতার সঙ্গে তিনটিই অপসারণ করে এবং পুনরুদ্ধার করে সংহতি। কিন্তু সগ্রামী পোপের প্রতি ঐতিহ্যগত শ্রদ্ধাবোধ মর্যাদা সম্পর্কে বলা সম্ভব হয়েছিল যে, এ রকম দৈত্য থেকে ব্যাহতি চার্চের পক্ষে ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী; চার্চ তার ধ্বংসের জন্য কাজ করতে গিয়ে একান্তভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্যই কাজ করবে।
পোপীয় মর্যাদা ইতালির পরিবেশে উপযোগী হলেও পনেরো শতকে উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলোর ঈশ্বর ভক্তির প্রতি পরিতৃপ্তি দানে তা অতিমাত্রায় জাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ এবং নগ্নভাবে নৈতিকতা বিবর্জিত ছিল। অবশেষে মুক্ত অর্থনীতির উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির অনুকূলে টিউটনিক দেশগুলোতে আনুপাতিক হারে জোরদার হয়ে ওঠে নৈতিক বিদ্রোহ। রোমের প্রতি সম্মান প্রর্দশনের একটি স্বাভাবিক অস্বীকৃতি দেখা দেয়। রাজপুরুষরা এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা চার্চের ভূমি দখল করে নেয়, কিন্তু তা সম্ভব হতো না প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ সংক্রান্ত বিদ্রোহ ছাড়া। আবার মহাবিভক্তি ও পোপীয় সংস্কারের কেলেঙ্কারী ছাড়া সংগঠিত হতো না প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ। অভ্যন্তরীণ কারণে চার্চের নৈতিক শক্তি দুর্বল না হলে এর আক্রমণকারীরা এতটুকু নৈতিক সাহস পেত না এবং তারা পরাজিত হতো ফ্রেডারিক-২-এর মতোই।
এই প্রেক্ষিতে এতটুকু খেয়াল করা মজার ব্যাপার যে, যাজকীয় শাসন বিষয়ে মেকিয়াভেলিকে তার প্রিন্স বইয়ের একাদশ অধ্যায়ে বলতে হয়েছে:
দশম ও লিও এর যাজকীয় কালে এই কথাগুলো লিখিত হয়েছিল। সংস্কার শুরু হয়ে যায় ওই সময়ে। এ কথা ধার্মিক জার্মানদের কাছে বিশ্বাস করা ক্রমে অসম্ভব হয়ে পড়ল যে ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের স্বজনপ্রিয়তা এবং লিও-এর অর্থ সংক্রান্ত প্রবল লোভ ঈশ্বর কর্তৃক প্রশংসিত ও রক্ষিত হতে পারে, লুথারের মতো। একজন বেপরোয়া দুঃসাহসী ব্যক্তি পোপীয় ক্ষমতার উপর আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন, যদিও তা থেকে পশ্চাৎপদ হয়েছিলেন মেকিয়াভেলি। চার্চবিরোধী নৈতিক ও ধর্মীয় সমর্থন লাভের সঙ্গে সঙ্গে স্বার্থজনিত বিরোধী প্রেরণা দ্রুতবেগে সম্প্রসারিত করে। যেহেতু চার্চের ক্ষমতা নির্ভর করত মূলনীতিগুলোর উৎকর্ষের উপর, তাই এটা স্বাভাবিক ছিল যে বিরোধিতার বৈধতা সংক্রান্ত নতুন মতবাদ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবে। কোনোরকমের ভীতি এবং প্রজাদের পক্ষ থেকে নৈতিক নিন্দাবাদ ছাড়াই লুথারের ধর্মতত্ত্ব অজ্ঞ যুবরাজদের চার্চ লুণ্ঠনে উদ্বুদ্ধ করে।
পোপবিরোধী ধর্ম বিপ্লব বিস্তারে অর্থনৈতিক প্রেরণার প্রভূত অবদান থাকলেও স্পষ্টত এর ব্যাখ্যাদানে ওইগুলো যথেষ্ট নয়, কারণ ওইগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্রিয়াশীল। পোপকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করেছিলেন অনেক ম্রাটই; অন্যত্র সার্বভৌম রাজা বা রানী এ রকমই করেছিলেন। যেমন ইংল্যান্ডের হেনরি-২ ও রাজা জন। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা অসৎ মনে করা হতো। এ কারণেই তা ব্যর্থ হয়। সফল প্রতিরোধ সম্ভব হয়ে ওঠে শুধু দীর্ঘকাল ধরে পোপীয় ঐতিহ্যগত ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে নৈতিক বিদ্রোহ ঘটলেই।