বিদেশি ভাষা শিক্ষা : আধুনিক ভাষা শিক্ষার প্রশ্নটি একেবারে সহজ নয়। শৈশবে কোনো আধুনিক ভাষায় কথা বলা যেমন সুন্দরভাবে শেখা যায় অন্য কোনো বয়সে তত সম্পূর্ণভাবে শেখা যায় না। শৈশবে ভাষা শিক্ষা দিলে দেওয়ার স্বপক্ষে ইহাও একটি সুযুক্তি। অনেকে আশঙ্কা করেন যে, শৈশবে বিদেশি ভাষা শিক্ষা শিশুর মাতৃভাষা শিক্ষায় ব্যাঘাত জন্মে। আমি ইহা বিশ্বাস করি না। টলস্টয় এবং টুর্গেনিভ যদিও শৈশবে ইংরাজি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষা শিখিয়াছিলেন তবু রাশিয়ান ভাষায় তাঁহাদের দখল ছিল অসাধারণ। গিবন ইংরাজি ভাষার মতো সহজ সাবলীল ভঙ্গিতেই ফরাসিও লিখিতে পারিতেন, কিন্তু এইজন্য তাঁহার ইংরাজি রচনাশৈলি [Style] মোটেই ব্যাহত হয় নাই। অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক ইংরেজ অভিজাত ব্যক্তি কৈশোরেই ফরাসি এবং অনেকে ইতালি ভাষাও শিক্ষা করিতেন তথাপি তাহাদের ইংরাজি ভাষা তাঁহাদের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের অপেক্ষা অনেক ভালো ছিল। কেহ হয়তো মনে করিতে পারেন শিশু বহুভাষা শিক্ষা করিলে তালগোল পাকাইয়া ফেলিবে। সে যদি বিভিন্ন লোকের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলিবার সুযোগ পায় তবে তাহার নাটকীয় প্রবৃত্তিই তাহাকে এইরূপ খিচুড়ি পাকাইতে দেয় না। আমি ইংরাজি শিক্ষার সময় হইতেই জার্মান ভাষা শিক্ষা করা শুরু করিয়াছিলাম এবং দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত পরিচারিকা ও গৃহশিক্ষয়িত্রী এবং শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলিতে ওই ভাষা ব্যবহার করিতাম। ইংরাজির সহিত মিশিয়া যাইত না কারণ ইহার প্রত্যেকটি সঙ্গে পৃথক ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ [Association] জড়িত ছিল।
বিদেশি ভাষা শিক্ষার সহজ উপায় : আমার মনে হয় যদি বর্তমান ভাষা শিক্ষা করিতে হয় তবে উহা যাহার মাতৃভাষা এমন লোকের নিকটই শেখা উচিত কারণ তিনি যে কেবল ভালোভাবে শিখাইতে পারিবেন তাহাই নয়, শিক্ষার্থী শিশুর মাতৃভাষায় যিনি কথা বলেন তাহার সঙ্গে বিদেশি ভাষায় কথা বলিতে যেইরূপ কৃত্রিমতা থাকে বিদেশির সঙ্গে বিদেশি ভাষায় বাক্যালাপ করিতে সেইরূপ কৃত্রিমতা-বোধ আসে না। কাজেই আমার মনে হয় প্রত্যেক স্কুলেই একজন করিয়া ফরাসি শিক্ষয়িত্রী থাকা উচিত। ভাষা শিক্ষাদানের প্রথম অবস্থায় কেবল ইহারা যথারীতি পাঠ দিবেন। তারপর খেলাধুলা এবং শিশুদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার ভিতর দিয়া ভাষা শিক্ষা চলিবে; এমন হওয়া চাই যেন বিদেশি ভাষা বুঝিয়া তাহাতে উত্তর করিতে পারার ভিতর দিয়াই খেলা পূর্ণাঙ্গ ও সফল হয়। শিক্ষয়িত্রী প্রথমে সহজ খেলা হইতে শুরু করিয়া ক্রমে জটিলের দিকে অগ্রসর হইতে পারেন। এইভাবে কোনোরূপ। মানসিক পরিশ্রম ছাড়াই আনন্দদায়ক কাজের মাধ্যমে বিদেশি ভাষা শিখানো চলে। বাল্যকালে যেমন সহজে এবং যত কম সময় অপচয় করিয়া ইহা আয়ত্ত করা যায় অন্য কোনো বয়সে সেইরূপ করা সম্ভবপর নয়।
অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা : আমরা যে বয়সের পাঠ্যক্রম আলোচনা করিতেছি ইহার শেষ দিকে অর্থাৎ বারো বৎসর বয়সে অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হইবে। অবশ্য আমি ধরিয়া লইতেছি যে ইতোমধ্যে পাটীগণিত শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে এবং জ্যোতিষ ও ভূবিদ্যা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, বিখ্যাত আবিষ্কারক এবং অনুরূপ কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় সম্বন্ধে মোটামুটি আলোচনা করা হইয়াছে। আমি এখন জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যা শিখানোর কথা চিন্তা করিতেছি। খুব কমসংখ্যক বালক-বালিকা জ্যামিতি ও বীজগণিত পছন্দ করে, বেশিরভাগই পছন্দ করে না। কেবল ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাদান প্রণালীই ইহার কারণ কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। গান গাহিবার ক্ষমতার মতোই গাণিতিক বোধ দেবদত্ত শক্তি; মাঝারি রকম মাত্রায়ও ইহা একান্ত বিরল। তথাপি প্রত্যেক বালক-বালিকারই গণিতের প্রতি অনুরাগ থাকা উচিত; কাহারাও গাণিতিক প্রতিভা আছে কি না তাহা ইহার অনুশীলনের ভিতর দিয়াই আবিষ্কার করা যায়। যাহারা বিশেষ কিছু শিখিতে পারে না, তাহারা ইহা জানিয়া উপকৃত হয় যে, ওই ধরনের একটি শিক্ষণীয় বিষয় আছে। উপযুক্ত প্রণালীতে শিক্ষা দিলে প্রায় সকলেই জ্যামিতির বিষয়বস্তু বুঝিতে পারে। বীজগণিত সম্বন্ধে ঠিক একথা বলা চলে না; জ্যামিতির চেয়ে ইহা অধিকতর বস্তুনিরপেক্ষ [abstract] এবং স্থূল বস্তু হইতে যাহারা মনকে সরাইয়া লইতে পারে নাতাহাদের পক্ষে ইহা দুর্বোধ্য। উপযুক্তভাবে শিক্ষা দিলে পদার্থবিদ্যা ও রাসায়নবিদ্যার প্রতি অনুরাগী ছাত্রের পরিমাণ গণিতানুরাগীর অপেক্ষা কিছু বেশি হইতে পারে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় ইহার প্রতি অনুরাগ খুব কম সংখ্যক যুবকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কোনো বালক বা বালিকার গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি কোনোরূপ প্রবণতা আছে কি না তাহা জানিবার জন্য বারো হইতে চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত ইহা শিখানো উচিত। অনেক সময় ইহা প্রথমেই ধরা পড়ে না। আমি প্রথমে বীজগণিত মোটেই পছন্দ করিতাম না যদিও পরে ইহার কায়দা শিখিয়া লওয়ার বিষয়টি সহজ মনে হইয়াছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রের কোনো প্রতিভা আছে কি না চৌদ্দ বৎসর বয়সে তাহা যথার্থভাবে জানা নাও যাইতে পারে। এইরূপ ছাত্র বা ছাত্রীকে পরীক্ষামূলকভাবে আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা চলে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চৌদ্দ বৎসর বয়সেই বাছাই করা যায়। কতক এই বিষয়গুলি পছন্দ করিবে এবং ইহাতে ভালো করিবে, কতক ইহা মোটেই পছন্দ করিবে না কিংবা বোকা ছাত্র ইহা পছন্দ করিবে। এইরূপ ব্যাপার অতি কদাচিৎ ঘটিতে পারে।