যে লেখকের বাড়িতে অশিক্ষিতা পরিচারিকা আছে তিনিই জানেন লেখার পাণ্ডুলিপি দিয়া আগুন জ্বালাইতে ইহারা কেমন উৎসাহী এবং তাহাদিগকে এইকাজ হইতে নিবৃত্ত করা কত কঠিন। এই লেখক যদি অন্য লেখকের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হন তবু তিনি এইরূপ কাজ করিবেন না, কেননা পাণ্ডুলিপির মূল্য তিনি জানেন। তেমনই যে বালকের নিজের বাগান আছে সে অন্যের ফুলের চারাগুলি মাড়াইবে না, যে বালক কোনো পশুপক্ষি পোষে তাহাকে জীবজন্তুর প্রতি সদয় ব্যবহার করিতে শিখানো যায়। নিজের সন্তানের প্রতি যাহার প্রীতি আছে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিও তাহার দরদ থাকা স্বাভাবিক। যাহাদিগকে সন্তান লালনপালন করিতে প্রত্যক্ষভাবে ঝামেলা পোহাইতে হয়, তাহাদের মধ্যে অপত্যস্নেহ প্রবল আকারে প্রকাশ পায়; যাহারা এই ঝামেলা এড়াইয়া চলে, তাহাদের অপত্যস্নেহ অসাড় হইয়া পড়ে এবং শুধু সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধে পর্যবসিত হয়। বাল্যাবস্থায় শিশুদের গঠনমূলক আবেগ অথবা সৃজন মনোবৃত্তির বিকাশ সাধিত হইলে তাহারা যখন পিতামাতাতে পরিণত হয় তখন তাহারাও সযত্নে সন্তানকে গড়িয়া তোলার চেস্টা করে। এইজন্যও শিশুর চরিত্রের এই দিকটিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক।
সৃজন কার্য বলিতে কেবল বস্তুগত কোনো জিনিস তৈয়ার করার কথাই বুঝাইতেছি না। অভিনয় এবং সমবেত-সংগীত ও সহযোগিতামূলক সৃজনকার্য, যদিও দৃশ্যত বস্তুর সাহায্যে কোনো কিছু প্রস্তুত করা হইল না। এইরূপ কাজ অনেক বালক-বালিকার পক্ষে আনন্দদায়ক। এইরূপ প্রীতিপ্রদ সৃজনকার্যে তাহাদিগকে উৎসাহ দেওয়া কর্তব্য কিন্তু জোর-জবরদস্তি করিবার প্রয়োজন নাই। যে-কাজে নিছক বুদ্ধিবৃত্তিই প্রধান সেইখানেও সৃজনাত্মক ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব থাকিতে পারে। প্রাচীন সাহিত্য-শিক্ষাকে একরকম দোষাগ্রাহী (Critical] বলা চলে। ছাত্র ভুল না করিতে এবং যাহারা ভুল করে তাহাদিগকে ঘৃণা করিতে শিক্ষা করে। ইহার ফলে নিজেদের শিক্ষণীয় বিষয়টুকু শুদ্ধভাবে শিখিবার ঝোঁক আসে এবং নূতনত্বের পরিবর্তে প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব বৃদ্ধি পায়। বিশুদ্ধ ল্যাটিন ভাষা একেবারেই স্থির হইয়া গিয়াছে–ভার্জিল এবং সিসরোর সাহিত্যই ইহার নিদর্শন; কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতি চিরদিনের মতো স্থির ও রুদ্ধ হইয়া যায় নাই। ইহা প্রতিনিয়তই আগাইয়া চলিয়াছে। যে কোনো সমর্থ যুবক ইহার অগ্রগতিতে সাহায্য করিতে পারে। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে যে মনোভাব গড়িয়া ওঠে তাহা মৃত ভাষা শিক্ষার ফলে উদ্ভূত মনোভাব হইতে বেশি গঠনমূলক। কেবল ভুল না করাই যেখানে শিক্ষার প্রধান কাম্য-লক্ষ্য সেখানে শিক্ষার মধ্যে সজীবতা থাকে না। সকল সুস্থ সবল কিশোর-কিশোরীকে নূতন উদ্যম প্রয়োগ করিয়া নূতন কিছু করিতে অনুপ্রাণিত করা উচিত; শুধু ভুল বাঁচাইয়া কোনরকমে গতানুগতিক পন্থায় চলার মধ্যে প্রাণের গতিবেগ ও নবসৃষ্টির উন্মাদনা নাই। প্রায় মনে করা হয় যে, উচ্চশিক্ষা মানুষকে ভদ্র আচরণ শিখায় মাত্র; যাহাতে সে। ব্যাকরণগত কোনো গুরুতর ভুল না করে সে সম্বন্ধে নেতিবাচক শিক্ষা দেয় মাত্র। এইরূপ শিক্ষায় গঠনকার্য বা সৃজন-প্রচেষ্টা উপেক্ষিত হইয়াছে। ইহার ফলে সৃষ্ট হয় সংকীর্ণচেতা, কর্মপ্রচেষ্টাবিমুখ এবং অনুদার লোক। কোনো কিছু গঠন করা এবং সৃষ্টি করাকেই যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করা হয় তবে এইরূপ কুফলের হাত হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইতে পারে।
শিক্ষার শেষ কয়েক বৎসরে সামাজিক গঠনের জন্য বিশেষ অনুপ্রেরণা দিতে হইবে। অর্থাৎ সমাজের বর্তমান শক্তিগুলিকে [Forces] অধিকতর ফলপ্রদভাবে প্রয়োগ করিতে কিংবা নূতন শক্তি সৃষ্টি করিতে বুদ্ধিমান যুবকদিগকে উৎসাহ দিতে হইবে। লোক প্লেটোর রিপাবলিক [Republic] পুস্তক পাঠ করে কিন্তু তাহারা বর্তমান রাজনীতিতে কোথাও তাহার নীতি প্রয়োগ করে না। আমি যখন বলিয়াছিলাম যে প্লেটোর রিপাবলিকের যাহা আদর্শ প্রায় ঠিক সেই আদর্শ ছিল ১৯২০ সনে রুশ রাষ্ট্রের, তখন প্লেটোর সমর্থকগণ কিংবা বলশেভিকগণ কোন দল যে বেশি বিস্মিত হইয়াছিল তাহা বলা শক্ত। লোকে যখন প্রাচীন সাহিত্য পাঠ করে তখন চিন্তা করিয়া দেখে না তখনকার অবস্থা রাম, শ্যাম, যদুর জীবনে কতখানি প্রযোজ্য কোনো লেখক যখন রামরাজ্যের চিত্র পাঠকের সম্মুখে তুলিয়া ধরে তখন সে বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে; কেননা বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা হইতে রামরাজ্যে উপনীত হইবার কোনো পথের হদিশ সেরূপ পুস্তকে থাকে না। সমাজ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য কি পন্থা অবলম্বন করা দরকার তাহা বিচারবুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ উদারনীতিকদের এই গুণ ছিল, যদিও তাঁহাদের কাজের শেষ পরিণতি দেখিলে তাহারা স্তম্ভিতই হইতেন।
.
সমাজ-ব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা
ছাঁচ :
মানুষ যখন কিছু গঠন করিতে বা পুরাতনের সংস্কার সাধন করিতে চায় তখন তাহার কাম্য বিষয়ের যে আকৃতি বা রূপ তাহার মনের পটে স্পষ্টভাবে অঙ্কিত থাকে তাহা অনেক সময় অজ্ঞাতসারে তাহার চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যাহা আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করেন অনেক দিনের মনন, কল্পনা, অনুরাগ, যুক্তি ও অনুভূতির রঙে রঞ্জিত হওয়ায় তাহা তাঁহাদের মনে স্পষ্ট আকার লাভ করে। তাহারে মনে যে আদর্শ বিশেষ করিয়া আকার গ্রহণ করিয়াছে। পরিকল্পনার সাহায্যে তাহারই বাস্তবরূপ তাহারা সমাজে গড়িয়া তুলিতে চান। সমাজ-ব্যবস্থা গঠনের প্রণালী অনেকভাবে চিন্তা করা যায় এবং সাধারণত ইহাকে তুলনা করা যায় ছাঁচ যন্ত্র এবং গাছের সঙ্গে। ছাঁচে ঢালা সমাজ-ব্যবস্থা বলিতে এমন সমাজ বোঝায় যেখানে কঠোর সামাজিক নিয়মকানুন অচলায়তনের মতো দেশের বুকে চাপিয়া আছে, যেমন ছিল প্রাচীন স্পার্টায় এবং চীনদেশে, যেখানে সমাজবিধি এবং সংস্কারের ছাঁচে ঢালিয়া সকল মানুষকে একই মানসিক আকার দিবার চেষ্টা করা হইত। কঠোর নৈতিক ও সামাজিক রাজনীতির মধ্যে এই ধারণা কিছুটা বিদ্যমান রহিয়াছে। এইরূপ ছাঁচে ঢালা সমাজ-ব্যবস্থা যাহার আদর্শ, তাহার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হয় শক্ত, অনমিত, কঠোর এবং অত্যাচারী।