হেরাক্লিটাসের রচনার যেটুকু আমাদের কাল পর্যন্ত টিকে আছে, তা থেকে তার চরিত্রের যে পরিচয় মেলে তা সৌহার্দ্যময় নয়। ঘৃণা বা বিরূপ মনোভাবের প্রতি তার বেশ আসক্তি ছিল, আর তিনি ছিলেন একজন গণতন্ত্রমনার বিপরীত। সহ-নাগরিকদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এফেসাস-এর প্রত্যেকটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যদি গলায় দড়ি দিয়ে মরে গিয়ে নগরটাকে শশ্রুবিহীন নারীদের জন্য রেখে যায় তাহলেই ভালো হয়। কারণ তারা তাদের মধ্যেকার সর্বোত্তম ব্যক্তি হারমোডরাসকে এই বলে বিতাড়িত করেছে, আমরা এমন কাউকে রাখব না যে আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম; যদি সে রকম কেউ থাকে, তাকে অন্য কোনোখানে, অন্য লোকদের মধ্যে গিয়ে সর্বোত্তম হতে বলব। হেরাক্লিটাস তার পূর্বসূরিদের মধ্যে শুধু একজন ছাড়া সব প্রখ্যাত ব্যক্তির সম্বন্ধে মন্দ কথা বলেছেন
তাদের তালিকা থেকে হোমারকে বের করে এনে চাবকানো উচিত।
যাদের আলোচনা আমি শুনেছি তাদের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি বুঝতে পেরেছেন যে প্রজ্ঞা সবকিছুর থেকে আলাদা।
নানা ধরনের বস্তুকে জানার বিদ্যা কোনো কিছু বুঝতে শেখায় না, শেখালে হেসিয়ড, পিথাগোরাস, জেনোফেনিস আর হেকাটিয়াস অনেক কিছু বুঝতে শিখতেন।
পিথাগোরাস দাবি করতেন…তার প্রজ্ঞা আছে। আসলে তার যা ছিল তা নেহায়েত বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান আর দুষ্টামির কলাকৌশল।
একমাত্র যে ব্যক্তিটি হেরাক্লিটাসের নিন্দার ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি টিউটেমাস। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, টিউটেমাস বলেছিলেন অধিকাংশ মানুষ খারাপ।
মানবজাতির প্রতি ঘৃণা পোষণের ফলে হেরাক্লিটাস মনে করতেন, মানুষকে নিজেদের পক্ষে মঙ্গলজনক কাজে বাধ্য করা যায় শুধু বল প্রয়োগের দ্বারা। তিনি বলতেন, প্রত্যেকটি পশুকে তৃণভূমিতে নিয়ে যেতে হয় ঠেঙিয়ে। তার আরো একটি মন্তব্য ছিল, গর্দভরা সোনা চায় না, খড় চায়।
এসব কারণে যেমনটি প্রত্যাশিত, হেরাক্লিটাস যুদ্ধে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধই সবকিছুর জনক, সবার রাজা। যুদ্ধই কাউকে দেবতা বানিয়েছে, কাউকে বানিয়েছে মানুষ, কাউকে করেছে বন্দি, কাউকে মুক্ত। তিনি আরো বলেন, হোমার বলেছিলেন, ঈশ্বর আর দেবতাদের মধ্যে এই বিরোধের কি অবসান হবে না! ঠিক বলেননি হোমার। তিনি বুঝতেই পারেননি যে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসের জন্য প্রার্থনা করছেন। তার প্রার্থনা পূর্ণ হলে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে, সবকিছুর মধ্যেই যুদ্ধ চলছে, আর দ্বন্দ্ব বিরোধই ন্যায়বিচার, সব বস্তুর সৃষ্টি ও বিলয় ঘটে বিরোধের মধ্য দিয়ে।
হেরাক্লিটাসের নৈতিকতা একধরনের গর্বিত কৃচ্ছসাধনা। নিটশের নৈতিকতার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। হেরাক্লিটাস মনে করেন, আত্মা আগুন ও পানির মিশ্রণ, আগুন মহৎ আর পানি হীন। যে আত্মার বেশি অংশ আগুন তাকে তিনি বলেন শুষ্ক। তিনি বলেন, শুষ্ক আত্মা সবচেয়ে প্রজ্ঞাময় ও সর্বোত্তম। আত্মা যখন আর্দ্র হয় তখন সে আনন্দ বোধ করে। একজন পুরুষ যখন মাতাল হয়, দাড়িগোঁফহীন নারীর অঙ্গুলিহেলনে চলে, টলমল করে, বুঝতে পারে না কোথায় সে পা ফেলছে, তখন তার আত্মা আর্দ্র হয়।আত্মা যখন পানি হয়ে যায় তখন তার মৃত্যু ঘটে। কোনো ব্যক্তির মনের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। সে যা পেতে চায়, তা ক্রয় করে আত্মার বিনিময়ে। মানুষ যা পেতে চায় তার সবকিছু পাওয়া মানুষের জন্য ভালো নয়। কেউ বলতে পারেন, হেরাক্লিটাস আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে অর্জিত ক্ষমতাকে মূল্য দেন, আর সেসব আবেগকে ঘৃণা করেন যেগুলো মানুষকে তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে।
নিজের যুগের ধর্মগুলোর প্রতি, অন্তত বাক্কাসীয় ধর্মের প্রতি হেরাক্লিটাসের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিরূপ, কিন্তু সেটা একজন বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিবাদীর বিরূপতার মতো নয়। হেরাক্লিটাসের নিজের ধর্ম আছে, সমকালীন ধর্মতত্ত্বের কিছু অংশ তিনি নিজের মতবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করে নিতেন আর কিছু অংশ বেশ ঘৃণাভরে নাকচ করে দিতেন। তাকে বাক্কাসীয় বলা হয়েছে (কর্নফোর্ড), আবার তাকে গুহ্য বিষয়াদির ব্যাখ্যাকারী হিসেবেও মনে করা হয়েছে (ফ্লেইডেরার)। আমার মনে হয় না, এ সম্পর্কিত উদ্ধৃত্তিগুলো এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। লোকজন যেসব গুহ্যাচারের চর্চা করে সেগুলো অপবিত্র গুহ্যাচার। এ কথা থেকে এমন মনে হয় যে তার মনে এমন গুহ্য বিষয়েরও ধারণা ছিল যেগুলো অপবিত্র নয়, কিন্তু সেগুলো প্রচলিত গুহ্যাচারগুলো থেকে বেশ ভিন্ন ধরনের। তিনি যদি অশ্লীল বিষয়াদির বিরুদ্ধে অত্যধিক নিন্দামুখর প্রচারণায় লিপ্ত না হতেন তাহলে একজন ধর্মসংস্কারক হতে পারতেন।
হেরাক্লিটাস সম্পর্কে নিচে বর্ণিত মতগুলো এখনো প্রচলিত আছে। এগুলো তার যুগের ধর্মতত্ত্বগুলোর ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে। ডেলফি নগরীতে বর্ষিত দৈববাণী ঈশ্বরের। তিনি তার অর্থ প্রকাশও করেন না, গোপন রাখেন না, বরং প্রতাঁকের সাহায্যে তা প্রদর্শন করেন। আর সিবিল, যে সুগন্ধি মাখে না, জমকালো পোশাক পরে না, সে উত্তেজিত ঠোঁটে নিরানন্দ কথাবার্তা বলে; তার ভেতরের দেবতার কল্যাণে সে তার কণ্ঠস্বর নিয়ে সহস্রাধিক বছর অতিক্রম করে।