পিথাগোরাসের জীবন সম্পর্কে অল্প যা কিছু জানা গেছে তাই দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। তিনি ছিলেন সামোস দ্বীপের অধিবাসী; তার জন্ম আনুমানিক ৫৩২ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে। অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন মেসারকস নামে এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ নাগরিকের পুত্র। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। পাঠকরা এ দুই ভাষ্যের যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। পিথাগোরাসের সময়ে সামেসের শাসক ছিলেন পলিক্রেটিস নামের একজন স্বৈরাচারী। বৃদ্ধ এই লোকটি ছিলেন একজন দস্যু। বিশাল ধন-সম্পত্তি করেছিলেন তিনি। তার একটি বিশাল নৌবাহিনী ছিল।
সামোস দ্বীপ ছিল মিলেটাসের এক বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী। সামোসের ব্যবসা বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল সুদূর স্পেনের টারটেসাস পর্যন্ত। টারটেসাস ছিল খনিশিল্পের জন্য বিখ্যাত। পলিক্রেটিস সামোসের স্বৈরশাসক হন খ্রি.পূ. ৫৩৫ সালের দিকে এবং শাসন করেন ৫১৫ সাল পর্যন্ত। ন্যায়-অন্যায়ের নৈতিক বালাই তার ছিল না। তার দুই ভাই শাসনকার্যে তার সহযোগী ছিলেন, তিনি তাদেরকে হত্যা করেন। তিনি তার বিশাল নৌবাহিনীকে ব্যবহার করতেন প্রধানত জলদস্যুতার কাজে। সে সময় মিলেটাসের কাছে পারস্যের পরাজিত ও অধীনস্ত হবার ঘটনা থেকে পলিক্রেটিস লাভবান হয়েছিলেন। পারসিকরা যাতে আরো পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে না পারে সে লক্ষ্যে পলিক্রেটিস মিসরের রাজা আমাসিস-এর সঙ্গে মৈত্রী করেন। কিন্তু পারস্যের রাজা কামবাইসিস যখন মিসর জয়ের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন তখন পলিক্রেটিস বুঝতে পারেন যে কামবাইসিস জয়ী হতে যাচ্ছেন এবং তিনি পক্ষ পরিবর্তন করেন। মিসর আক্রমণের জন্য তিনি একটি নৌবহর পাঠান, যেটা গঠন করা হয়েছিল তার রাজনৈতিক শত্রুদের নিয়ে। কিন্তু নাবিকরা বিদ্রোহ করে উলটো পলিক্রেটিসকেই আক্রমণ করার জন্য সামোস ফিরে যায়। সে যাত্রা পলিক্রেটিস নাবিকদের বিদ্রোহ দমন করে রক্ষা পেলেও শেষ রক্ষা তার হয়নি। অতিশয় লোভের ফলে অবশেষে তার পতন ঘটে। সারদেস-এ পারস্যের প্রাদেশিক প্রশাসক ঘোষণা করেন তিনি মহারাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চান, পলিক্রেটিস যদি সে বিদ্রোহে তাকে সাহায্য করেন তাহলে তিনি তাকে বিশাল অঙ্কের অর্থ দেবেন। পলিক্রেটিস সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মূল ভূখণ্ডে গেলে বন্দি হন এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
পলিক্রেটিস শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সামোসকে তিনি অনেক দর্শনীয় জনকর্ম দিয়ে সাজিয়েছিলেন। আনাক্রেন ছিলেন তার সভাকবি। কিন্তু পিথাগোরাস পলিক্রেটিসের শাসন পছন্দ করেননি, সে কারণে তিনি সামোস ত্যাগ করে চলে যান। বলা হয়, তিনি মিসর গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি অনেক জ্ঞান আহরণ করেন। এ তথ্য অসম্ভব নয়। সে যাই হোক না কেন, এটা নিশ্চিত যে তিনি দক্ষিণ ইতালির ক্রোটনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
সামোস ও মিলেটাসের মতো দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরীগুলো ধনী ও সমৃদ্ধ ছিল। তা ছাড়া পারসিকদের পক্ষ থেকে তাদের ওপর আক্রমণের ভয় ছিল না। সবচেয়ে বড় দুটি নগরী ছিল সাইবারিস ও ক্রোটন। বিলাসিতার জন্য সাইবারিসের খ্যাতি প্রবাদ হয়ে আছে। ডিওডরাস-এর ভাষ্য অনুযায়ী সাইবারিসের সবচেয়ে সুদিনে সে নগরীর জনসংখ্যা ছিল তিন লাখ। অবশ্য সন্দেহ নেই যে এটা অতিরঞ্জন। আকারের দিক থেকে ক্রোটন সাইবারিসের প্রায় সমান ছিল। উভয় নগরীর জীবিকা ছিল আয়োনীয় পণ্যসামগ্রী ইতালিতে আমদানি করা। এর কিছু অংশ সে দেশে ব্যবহৃত হতো আর কিছু অংশ ফের রপ্তানি করা হত। পশ্চিম উপকূল থেকে গল ও স্পেনে। ইতালির গ্রিক নগরীগুলোর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। পিথাগোরাস যখন ক্রোটন পৌঁছেন তখন সে নগরী সদ্য লকরির কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে তার আগমনের অল্প পরেই সাইবারিসের সঙ্গে এক যুদ্ধে ক্রোটন সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করে এবং সাইবারিসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেন (৫১০ খ্রি.পূ.)। মিলেটাসের সঙ্গে সাইবারিসের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ক্রোটন চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ক্রোটনের জনৈক ডেমোসেডিস প্রথমে পলিক্রেটিসের এবং পরে দারিয়ুসের চিকিৎসক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
পিথাগোরাস তার শিষ্যদের নিয়ে ক্রোটন নগরীতে একটি সংঘ স্থাপন করেন। সেটি সে নগরীতে কিছুকালের জন্য প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু নগরবাসীরা শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তিনি সেখান থেকে মেটাপন্টিওন চলে যান (এটিও দক্ষিণ ইতালিতেই অবস্থিত ছিল)। সেখানে তার মৃত্যু হয়। অচিরেই তিনি এক পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত হন; গালগল্প ছড়িয়ে পড়ে যে তার নানা রকম অলৌকিক ও জাদুকরী ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তিনি আবার গণিতবিদদের একটি স্কুলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এভাবে পিথাগোরাসের স্মৃতি দুই বিপরীতমুখী বিশ্বাস দ্বারা বিতর্কিত। এই বিতর্কের জট খুলে আসল সত্য বের করে আনা কঠিন।
ইতিহাসের সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ও দুর্বোধ্য ব্যক্তিদের অন্যতম পিথাগোরাস। তার সম্বন্ধে প্রচলিত বিশ্বাসগুলো যে শুধু সত্য ও মিথ্যার একটি প্রায়-অমোচনীয় মিশ্রণ তা-ই নয়, এমনকি তার সম্পর্কে সবচেয়ে সরল ও সবচেয়ে কম বিতর্কিত মতগুলোও আমাদের সামনে এক অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক মনস্তত্ত্ব হাজির করে। সংক্ষেপে তাকে বর্ণনা করা যেতে পারে আইনস্টাইন ও মিসেস এডির এক সমন্বয় রূপে। তিনি একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন যার মূলনীতি ছিল আত্মার পুনর্জন্ম ও শিমজাতীয় খাদ্য খাওয়ার পাপ। তার ধর্ম মূর্ত রূপ লাভ করে একটি ধর্মীয় জীবন বিধানের মধ্য দিয়ে, সে বিধানটি কোথাও কোথাও রাষ্ট্রের ওপরে নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিল এবং ঋষিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু অদীক্ষিত লোকজন শিম খাওয়ার জন্য লোলুপ থেকে যায় এবং বিদ্রোহ করে।