যারা নিরাপত্তার অভাববোধ নিয়ে জীবন শুরু করেন, তাদের চেয়ে তারাই বেশি সুখী হন যারা নিরাপত্তার বোধ নিয়ে জীবন শুরু করেন। অন্ততপক্ষে যতদিন না নিরাপত্তা বোধ তাদের বিপদের মধ্যে না ফেলে। সব ক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রে যে বিপদে একজন নিমজ্জিত হয়ে পড়েন, নিরাপত্তাবোধই সেই বিপদ থেকে অন্যজনকে উদ্ধার করেন। এক গভীর গহ্বরের ওপরে অবস্থিত একটা সরু কাঠের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ভয় পেলেই বেশি থাকে, ভয় না পেলে নয়। জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও একই রীতি। ভয়হীন মানুষ অবশ্য হঠাৎ করে বিপদে পড়তে পারেন। কিন্তু অনেক বিপদসংকুল অবস্থার ভিতর থেকে অক্ষত অবস্থায় তিনি বেরিয়ে আসতে পারবেন, তবে একজন মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এইরকম প্রয়োজনীয় আত্মপ্রত্যয়ের অসংখ্য ধরণ আছে। কেউ আত্মবিশ্বাসী পাহাড়ে, কেউ বা সমুদ্রে আবার অন্যজন হয়তো আকাশে। কিন্তু জীবনের প্রতি সাধারণ আত্মবিশ্বাস আসে সেই যথার্থ প্রয়োজনীয় ভালবাসা পেতে অভ্যস্ত হলে, অন্য কিছু থেকে নয়। উদ্দীপনার উৎসরূপে মনের যে অভ্যাস, তা নিয়েই আমি এই অধ্যায়ে আলোচনা করব।
ভালবাসা যা দেওয়া হয় তা থেকে নয়, যা পাওয়া যায় তা থেকেই নিরাপত্তা বোধ জন্ম নেয়। এই বোধ আরো বেশি জন্মায় যদি ভালবাসা পারস্পরিক হয়। জোর দিয়ে বলতে হলে বলতে হয়, শুধু স্নেহ ভালবাসা নয়, তার সাথে শ্রদ্ধা ও প্রশংসাও মিশে থাকে। অভিনেতা, ধর্মপ্রচারক, বক্তা, রাজনীতিক যাদের কাজই হল জনগণের প্রশংসা কুড়িয়ে পাওয়া, তারা ক্রমেই এদের সমর্থনের ওপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। যখন তারা জনসাধারণের কাছ থেকে যোগ্য পুরস্কার পেয়ে যান, তখন তাঁদের জীবন উদ্দীপনায় ভরে ওঠে। কিন্তু যখন তা পান না। তারা অসন্তুষ্ট হন এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েন। বহুজনের কেন্দ্রীভূত ভালবাসা অন্যদের জন্যে তাই করে। যে শিশু বাবা-মার প্রিয়পাত্র, সে তাদের স্নেহকে প্রকৃতির বিধান হিসাবে গ্রহণ করে। এই বিষয়ে সে বিশেষভাবে কিছু চিন্তা করে না, যদিও তার সুখের জন্যে এর গুরুত্ব অনেক। সে পৃথিবীকে নিয়ে চিন্তা করে। যেসব উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে এবং আরো সব দুঃসাহসিক ঘটনা তার ঘটতে পারে, যখন সে বড় হবে তা নিয়েও ভাবে। বাইরের নানা ব্যাপারে এই যে উৎসাহ, তার পিছনে রয়েছে সেই অনুভূতি যে, যত বিপদই আসুক বাবা মার স্নেহ তাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করবে। যদি কোনও কারণে কোনও শিশু বাবা-মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় তবে সে শিশু সাধারণভাবে ভীরু এবং দুঃসাহসিক কাজে অনুৎসাহী হয়। তার মন ভয়ে ভয়ে থাকে। নিজেকে সে করুণা করে এবং আনন্দময় অনুসন্ধিৎসার মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ রকম শিশু অবাক হওয়ার মতো কম বয়সে জীবন, মৃত্যু এবং মানব জীবনের পরিণাম নিয়ে ধ্যান করতে শুরু করে। সে অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। প্রথমে বিষাদময়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও বিশেষ দর্শনবিদ্যা বা ধর্মতত্ত্বের মধ্যে অবাস্তব সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ায়। জগৎ বিশৃঙ্খল স্থান, এখানে আনন্দের জিনিস যেমন আছে নিরানন্দের জিনিসও আছে কিন্তু শৃঙ্খলাহীন পরমার্থ নিয়ে-এবং এই কামনার একটি বোধগম্য অবস্থা অথবা প্রতিরূপ সৃষ্টি মূলত ভয় থেকেই জাত, যাকে বলা হয় মুক্তস্থানাতঙ্ক বা এক ধরনের উন্মুক্ত স্থান সম্পর্কে ভীতি। নিজের পাঠাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে ভীরু ছাত্রটি নিজেকে নিরাপদ মনে করে। এই পৃথিবী সমরূপ শৃঙ্খলাপূর্ণ এই অনুভূতি যদি সে নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারে, তা হলে পথে বের হওয়ার পরও সে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে। সে যদি আরো বেশি স্নেহ পেত, তা হলে বাস্তব পৃথিবীকে আরো কম ভয় পেতে পারত এবং মনে এক আদর্শ পৃথিবী আবিষ্কার করতে হত না যা স্থান করে নিয়েছে তার বিশ্বাসে।
একথা কখনো সঠিক নয় যে, সব স্নেহ-ভালবাসা একই ধরনের সাহসিক অভিযানের পথে চলতে উৎসাহিত করে। যে স্নেহ দেওয়া হয়েছে তা যেন নিজেই ভীরু না হয়ে শক্তিশালী হয় এবং স্নেহের পাত্রের নিরাপত্তার চেয়েও তার উল্কর্ষতা বাড়িয়ে তোলে, যদিও তার নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন হতে হবে তা নয়। ভীরু জননী অথবা ধাত্রী যদি সবসময় শিশুদের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সাবধান করতে থাকে এবং মনে করে প্রত্যেকটি কুকুরই তাদের কামড়াবে অথবা প্রত্যেকটি গরুই উদ্যত শিং ষাঁড়, তা হলে তারা নিজেদের মনের ভীরুতাকেই শিশুদের মনে সঞ্চারিত করবেন এবং তা হলে শিশুরা ভাববে মা কিংবা ধাত্রীর কাছাকাছি না থাকলেই বিপদ। যে জননী সবসময় সন্তানকে চোখে চোখে রাখতে চান তার কাছে সন্তানের এইরকম অনুভূতিই পছন্দনীয়। সন্তান পৃথিবীর সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিক, এই ইচ্ছার চেয়েও সে সবসময় তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকুক, এই ইচ্ছাটা তার বেশি হতে পারে। এরকম অবস্থার পরিণামকে সে স্নেহ না পেলে যা হত, তার চেয়েও বেশি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। শৈশবে মনের যে অভ্যাস গড়ে ওঠে, সারা জীবন তার ছাপ থেকে যায়। অনেকের কাছে প্রেমে পড়া হল পৃথিবী থেকে পালিয়ে গিয়ে এমন একটা ছোট নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান, যেখানে তারা নিশ্চিতভাবে শ্রদ্ধা এবং প্রশংসা পায় তার যোগ্য না হয়েও, সত্যি থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষের আরেক আশ্রয় তার নিজের বাড়ি, ভীতি এবং ভীরুতাই তাদের এই সাহচর্যের সন্ধান দেয় যা উপভোগ করলে সেই অনুভূতি অক্রিয় হয়ে যাবে। তারা পত্নীদের কাছে তাই চান, যা আগে তারা পেয়েছে অবিজ্ঞ মায়েদের কাছে, কিন্তু তারা অবাক হয়, যদি পত্নীরা তাদের বয়ঃপ্রাপ্ত শিশু মনে করে।