নাযযাক তার জায়গা ছেড়ে উঠে বললো, দেশপ্রেমিক জনগণ! আমায় আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে, পূর্বপুরুষের খুন আর আপনাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এখন আপনাদের কাছে কিছু বলতে চান আমাদের এক সম্মানিত মেহমান। আপনারা গোলাম বলেই আপনাদের প্রতি তার হামদর্দী। নাযযাক কথাটি বলেই বসে পড়লো। ইবনে সাদেক উঠে বক্তৃতা শুরু করলো। মুসলমানদের খেলাপ যতটা বিদ্বেষ প্রচার তার সাধ্যায়ত্ত, তার সবই সে করলো। তারপর সে বললো, শাসক কওম গোড়ার দিকে শাসিত কওমকে গাফলতের ঘুম পাড়াবার জন্য কঠোর রূপ নিয়ে দেখা দেয়, কিন্ত শাসিত কওম যখন আরামের যিন্দেগীতে অভ্যস্ত হয়, বাহাদুরীর ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, তখন শাসকরা তাদের কর্মনীতি পরিবর্তন করে ফেলে। ইবনে সাদেক তুর্ক সরদারদের প্রভাবিত হতে দেখে আরও জোর আওয়াযে বললো, মুসলমানদের বর্তমান নরম নীতি দেখে মনে করবেন না যে, তারা হামেশা এমনি থাকবে। শিগগীরই তারা আপনাদের উপর এমন যালেমের রূপ নিয়ে দেখা দেবে যা আপনারা কল্পনাও করতে পাবেন না। আপনারা শুনে হয়রান হবেন যে, কিছুকাল আগে আমিও ছিলাম মুসলমান, কিন্ত আধিপত্য লোভী এই কওম সারা দুনিয়ার আযাদ কওমকে গোলাম বানাবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি তাদের কওম থেকে আলাদা হয়ে গেছি। আপনারা তাদেরকে আমার চাইতে ভাল করে জানেন না। এরা চায় দৌলত আর শিগরীই দেখবেন যে, তারা এ মুলুকে একটি কানাকড়িও অবশিষ্ট রাখবে না। আর যদি তা না-ও হয়, তাহলে আপনাদের স্ত্রী-কন্যাকে দেখবেন শাম ও আরবের বাজারে বিক্রি হতে। ইবনে সাদেকের কথায় প্রভাবিত হয়ে তামাম সরদার পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো।
এক বৃদ্ধ সরদার উঠে বললেন, তোমাদের কথায় অনিষ্টের আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা নিজেরাও বেশক মুসলমানদের গোলামীকে খারাপ জানি, কিন্ত দুশমনের সম্পর্কেও মিথ্যা কথায় একিন আনা আমাদের জন্য ঠিক হবে না। মুসলমান শাসিত কওমের ইযযত ও দৌলত হেফাযত করে না, এ এক কল্পিত কাহিনী মাত্র। ইরানে গিয়ে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, সেখানকার লোক নিজেদের হুকুমতের চাইতেও বেশী খুশী রয়েছে মুসলমানদের হুকুমাতে। দেশপ্রেমিক জনগণ! নাযযাক ও এই লোকটির কথায় বিভ্রান্ত হয়ে লোহার পাহাড়ের সাথে সংঘর্ষ লাগানোর চেষ্টা করা সংগত হবে না আমাদের পক্ষে। এই নতুন লড়াইয়ে জয়লাভের বিন্দুমাত্র উম্মীদ যদি আমি দেখতে পেতাম, তাহলে সবার আগে আমি নিজেই হাতে নিতাম বিদ্রোহের ঝান্ডা। কিন্তু, আমি জানি আমাদের বাহাদুরী সত্ত্বেও এ কওমের মোকাবিলা করতে আমরা পারবো না। রুম ও ইরানের মতো প্রবল শক্তি যাদের সামনে মস্তক অবনত করেছে, যে কওমের সামনে দরিয়া ও সমুদ্র সংকুচিত হয়ে যায়, আকাশচুম্বী পর্বত যাদের কাছে শির অবনত করে, তাদের উপর বিজয় হাসিল করবার কল্পনাও মনে এনো না তোমরা। আমি মুসলমানদের পক্ষে ওকালতি করছি না। কিন্তু একথা আমায় বলতেই হবে যে, আমাদের অবশিষ্ট শক্তিটুকু লোপ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না এ বিদ্রোহের পরিণাম। এর ফলে হাজারো বাচ্চা হবে এতীম আর হাজারো নারী হবে বিধবা! কওমের গলায় ছুরি চালিয়ে নাযযাক চায় নিজের সুখ্যাতি। আর এ লোকটি কে আর কি তার মকসুদ, তা আমার জানা নেই।’
ইবনে সাদেক এ আপত্তির জওয়াব আগেই চিন্তা করে রেখেছে। সে আর একবার শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বক্তৃতা শুরু করলো : বৃদ্ধ সরদারের মোকাবিলায় তার দুষ্ট বুদ্ধি অনেক বেশি। তাছাড়া অভিনয় সে জানে। মুখের উপর এক কৃত্রিম হাসি টেনে এনে সে আপত্তির জওয়াব দিতে লাগলো। তার যুক্তির সামনে বুড়ো সরদারের কথাগুলো লোকের মনে হলো অবাস্তব। বড় বড় সরদার তার যাদুতে ভুললো এবং আযাদী ও বিদ্রোহের আওয়ায তুলে শেষ হলো জলসা।
*
রাতের বেলা কুতায়বা বিন মুসলিমের খিমায় জ্বলছে কয়েকটি মোমবাতি এবং এক কোণে জ্বলছে আগুনের কুণ্ড। কুতায়বা শুকনো ঘাষের গালিচায় বসে একটি নকশা দেখছেন। তাঁর মুখের উপর গভীর উদ্বেগের চিহ্ন সুপরিস্ফুট। নকশা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে তিনি উঠে পায়চারী করে গিয়ে দাঁড়ালেন খিমার দরযায় এবং দূরে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন বরফপাতের দৃশ্য। অনতিকাল মধ্যে গাছের পেছন থেকে এক সওয়ার এসে হাযির হলেন। কুতায়বা তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে গেলেন কয়েক কদম আগে। কুতায়বাকে দেখে সওয়ার ঘোড়া থেকে নামলেন। এক পাহারাদার এসে ধরলো ঘোড়ার বাগ।
কি খবর নিয়ে এলে, নয়ীম?’ কুতায়বা প্রশ্ন করলেন।
নাযযাক এক লাখের বেশী ফউজ সংগ্রহ করেছে। আমাদের শিগগিরই তৈরী হওয়া দরকার।’
কুতায়বা ও নয়ীম কথা বলতে বলতে খিমার ভিতরে দাখিল হলেন। নয়ীম নকশা তুলে কুতায়বাকে দেখাতে দেখাতে বললেন, “এই যে দেখুন! বলখ থেকে প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তর-পূর্বে নাযযাক তার ফউজ একত্র করেছে। এই জায়গাটির দক্ষিণ দরিয়া আর বাকী তিন দিকে পাহাড় ও নিবিড় বন। বরফপাতের দরুন এ পথ অতি দুর্গম কিন্তু গরমের দিনের প্রতীক্ষা করা আমাদের ঠিক হবে না। তুর্কদের উৎসাহ দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে। মসুলমানদের তারা হত্যা করে চলেছে
নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে। সমরকন্দেও রয়েছে বিদ্রোহের সম্ভাবনা।