- বইয়ের নামঃ স্ত্রী যখন বান্ধবী
- লেখকের নামঃ ডেল কার্নেগি
- প্রকাশনাঃ মেমোরী পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
স্ত্রী যখন বান্ধবী
০১. সাফল্যের প্রথম সিঁড়ি
স্ত্রী যখন বান্ধবী
ডেল কার্নেগি
০১. সাফল্যের প্রথম সিঁড়ি
দু’জন মানুষের কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক। ১৯১০ সালের কথা। নিউইয়র্ক শহর। সেখানকার এক এলাকায় কম ভাড়ায় একখানা ঘর ভাড়া নিতে দেখা গেল দুই বন্ধুকে। দুই বন্ধুর একজন হলেন মিসৌরী থেকে আসা ডেল কার্নেগী আর অন্যজন তার বন্ধু ম্যাসাচুসেটস থেকে আসা এক গ্রামের ছেলে জে. এফ. লুইটনি। কার্নেগী আমেরিকার একাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টসের ছাত্র ছিলেন।
আমি ডেল কার্নেগীর কাছে তাঁর বন্ধুর জীবন কাহিনী শুনেছি।
লুইটনি এক কৃষি খামারে কাজ করে তার জীবন শুরু করেছিলেন। সামান্য ওই কাজ করেও লুইটনি তার জীবনে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে হারিয়ে ফেলেন নি। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল অপরিসীম। তিনি মনে কল্পনা করতেন যে একদিন তিনি মস্ত এক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবেন।
একদিন সত্যই লুইটনির কপালে একটা কাজ জুটে গেল। সেটা হল বিরাট খাদ্য সামগ্রীর দোকানে কর্মচারীর চাকরি। লুইটনি কাজে উন্নতির চেষ্টায় পাইকারী জিনিস বিক্রি দপ্তরের কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইতেন। সেইজন্য মধ্যাহ্ন ভোজের সময়টা তিনি কাজে লাগাতেন। এর পুরস্কারস্বরূপ তিনি হলেন প্রধান সেলসম্যান। তারপর ডিপার্টমেন্টের প্রধান আর সেখান থেকে জেলার বিক্রয় অধিকর্তা। এভাবে নিজের পরিশ্রম আর কৃতিত্বের ফলশ্রুতিতে ধাপে ধাপে লুইটনি একবারে শিখরে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন।
লুইটনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেখান। বীচনাট প্যাকিং কর্পোরেশন’ তাঁকে তাঁর যোগ্যতার দাম দিল। সেখানকার প্রেসিডেন্টের পদও তিনি অলঙ্কৃত করতে সক্ষম হন। এরপর লুইটনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্লু মুন চীজ কোম্পানী। জীবনের স্থির লক্ষ্য তার সামনে ধ্রুবতারার মতো বর্ণনাজ্জ্বল করতে চাইতেন। এই আশা তাকে যুগিয়েছিল বড় হওয়ার শক্তি।
এখন প্রশ্ন হল সকলেরই জীবনে তো সফলতা আসে না। লুইটনির এই অসামান্য খ্যাতি আর সাফল্যের মূল কথাটা কী? এই রহস্যের মূল হল তিনি যে কাজ করতেন হৃদয় দিয়েই তাকে গ্রহণ করতেন। কোনো কাজকেই তিনি তুচ্ছ বলে, ছোট বলে ভাবতেন না। নিত্যনতুন কাজে তার উৎসাহ ছিল অপরিসীম।
উদ্দেশ্যহীন কাজ কখনই সফল হতে পারে না। উদ্দেশ্যহীন মানুষেরা লক্ষ্য সামনে না রেখেই লক্ষ্যহীনভাবে এগিয়ে যেতে চায়। পরিণামে তারা শুধু ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে বেড়ায়। এদের একমাত্র অভাব হল, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সাফল্যের সুনির্দিষ্ট কোনো পথ।
নিউইয়র্ক শহরে কর্মজীবীদের বিভিন্ন পরামর্শ দেবার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর নাম কেরিয়ার বেজিং ক্লিনিক। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন মিস অ্যানী হেউড। যে সব চাকরিজীবী নিজেদের কর্মজীবনে খুশি নন তাদের নানা পথের সন্ধান দেওয়া হয় এখানে। মিস হেউডের সঙ্গে চাকরির নানা সমস্যা নিয়ে আমি আলোচনা করেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, তাঁর কাজের একমাত্র অসুবিধা হল তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের বেশির ভাগই জানে না-তারা কী চায়, তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যই বা কী? যে কোনো তরুণী যখন বিয়ে করে স্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তার প্রথমেই জানা দরকার তার স্বামী জীবনে কী চান? এ সম্পর্কে স্ত্রীর মনে একটা স্পষ্ট ছবি থাকা চাই-ই। এর পরের কাজটি হবে স্ত্রীকে স্বামীর সব কাজকে সমান করে তোলার জন্য সহযোগিতা করে যাওয়া এর জন্য প্রয়োজন নিজেকে যোগ্য করে তোলা।
স্যামুয়েল ও ক্রাথার কিং ম্যারেজ গাইড’ নামে একখানা বই রচনা করেন। তাঁর বইটিতে বলেছেন যে, কোনো স্বামী-স্ত্রীর সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা চাই। এই লক্ষ্য বাসগৃহ তৈরি থেকে দেশভ্রমণ বা অন্য যে কোনো বিষয় হতে পারে। উদ্দেশ্য যাই হোক দুজনের মনে একই পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি থাকা দরকার। স্যামুয়েল ও ক্রাথার কিং-এর বক্তব্য হল-আসল কাজ নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করা আর সেই লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে রূপদান করা। স্বামী-স্ত্রী উভয়কে উদ্দেশ্যে সফল করার জন্য একই চিন্তায় বিভোর থাকতে হবে। কোনো কারণে যদি ব্যর্থতা এসে হাজির হয়, তবে সেই ব্যর্থতার গ্লানিও দু’জনকেই ভাগ করে নিতে হবে। এর ফলেই আমার সমব্যথিতার সমচিন্তার সুযোগ।
একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি : আমেরিকায় কানসাস শহরে মি, ও মিসেস উইলিয়াম বিল গ্রাহামের সাফল্যের মূলে এই ধরনের ব্যবস্থা অপূর্ব কাজ করে। কানসাসে মি. গ্রাহামের একটি বড় প্রতিষ্ঠান আছে। নাম গ্রাহাম অয়েল কোম্পানী, ব্যবসাতে মি. গ্রাহাম মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে অগাধ সম্পত্তি অর্জন করেন। বিল গ্রাহাম ও তার স্ত্রী মার্জোরি গ্রাহাম ছিলেন সুখী পরিবার। তাঁদের ছ’টি সন্তান।
একদিন আমি বিল গ্রাহামকে তার সাফল্যের গোপন রহস্যটি কী জানাতে চাইলে তিনি বললেন, ভবিষ্যতের জন্য আগেভাগে পরিকল্পনা করে রাখা আর কাজ করে যাওয়া। এগুলোকে মূলধন করেই তারা কাজে নামেন। এই কাজের জন্য তাদের অফিসঘর বলতে ছিল একজন ব্যবসায়ীর অব্যবহৃত একটি কামরা।
একে একে গ্রাহাম দম্পতি নিজেরাই বাড়ি কিনে বিক্রি শুরু করেন। তার সাথে সাথে তেলের ব্যবসাতেও লেগে থাকেন। ধাপে ধাপে উন্নতি হতে লাগলো।
এখানেই থেমে থাকার মানুষ নন গ্রাহ্যম দম্পতি। তাঁদের ব্রত হল আরও এগিয়ে চলা। তাই গ্রাহাম দম্পতি ভাবতে লাগলেন বৈদেশিক ব্যবসার দিকে হাত বাড়াবেন কি না।
এই দম্পতির সাফল্যের মূল কথা হল-কোনো কাজ বা পরিকল্পনা হাতে নিলে তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাতে সাফল্যে কোনো বাধা না ঘটে। তারা তাদের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আর পরিশ্রমকে উজাড় করে দিতেন এই কাজে। গ্রাহাম দম্পতির জীবন থেকেই বোঝা যায়, ইচ্ছা আর পরিশ্রম যে কোনো মানুষকে তার উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তা করে থাকে। এছাড়াও আছে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সফলতার কাছাকাছি পৌঁছান সম্ভব, তাতে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না।
কলম্বিয়া কলেজের ডীন হার্বাট ই হক বলেন যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতা দুশ্চিন্তার এক প্রধান কারণ। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হলে সাফল্যের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। এই কারণেই বলতে বাধা নেই যে, প্রত্যেক স্ত্রীর জানা প্রয়োজন তাদের স্বামীর সাফল্য লাভ করার পথে তাদেরই প্রেরণা যোগান দিতে হবে, যাতে তাঁর স্বামী জীবনে স্থির লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পারেন।
সাফল্যের অর্থ এক-একজনের কাছে এক-একরকম। তাই সফলতার অর্থ কি শুধু বিপুল সম্মান, না অর্থ, না নির্বিঘ্ন জীবন তা আপনার এবং আপনার স্বামী উভয়কেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী এই দু’জনের মিলিত আকাক্ষাই আপনার স্বামীর পথনির্দেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর উচিত স্বামীকে প্রেরণা যোগানো, আর স্বামীর কর্তব্য কোনো সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
জেনে রাখা উচিত, স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা শুধুমাত্র প্রেমের প্রসন্ন দৃষ্টির মধ্যেই থাকে না–আদর্শ দম্পতির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম আর ভালবাসা হল পরস্পরের হৃদয়কে, মনকে জানতে চাওয়া, বুঝতে চাওয়া।
এই কথাটা বলেছিলেন–একজন মানব-প্রেমিক মানুষ। অতএব মনে রাখা প্রয়োজন, কৃতকার্য হওয়ার প্রথম পদক্ষেপটি হবে স্বামীকে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করা।
০২. এক কাজে সফল হলে আরেক কাজে নজর দিন
একজনের কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক। তার নাম নিক আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডারের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কলেজের শিক্ষায় সাফল্য লাভ করা। ছেলেটার কপাল মন্দ যে ছোটবেলায় সে এক ছোট অনাথ আশ্রমেই বেড়ে উঠেছিল। সেই অনাথ আশ্রমে ছিল সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম। দু’বেলা ভালো খাওয়াও জুটতো না। আলেকজান্ডারের লেখাপড়ায় খুব আগ্রহ ছিল। তাঁর ধীশক্তিও ছিল প্রখর। কিন্তু ভাগ্যদোষে দরিদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করায় বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারে নি। মাত্র চৌদ্দ বছর, বয়সে হাই স্কুলের শিক্ষা শেষ হতেই তাঁকে জীবিকার জন্য চাকরি করা শুরু করতে হয়। বাধ্য হয়েই তাঁকে এক দর্জির দোকানে সেলাই করার চাকরি নিতে হয়। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর তাঁকে সামান্য পারিশ্রমিকের বদলে ঐ সেলাইয়ের চাকরি করে যেতে হয়। এরপর একসময়ে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় কাজের সময় কিছুটা কমে আসে এবং মাইনেও কিছুটা বাড়ে।
নিক আলেকজান্ডার এক কিশোরীকে বিয়ে করে সংসারী হয়। তাঁর মনে একটা দুঃখবোধ থেকে গিয়েছিল যে, সে কলেজে পড়াশুনা করার সুযোগ পেল না। নিকের স্ত্রী স্বামীর মনের খবর জানতে পেরে ঠিক করলো যে, যেমন করেই হোক স্বামীর জন্য সে কলেজ শিক্ষার ব্যবস্থা করবে।
১৯৩২ সালে হঠাৎ করে একটা সুযোগ এসে গেল তরুণ দম্পতির জীবনে। একটা নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তোলার সুযোগ। নিজেদের সঞ্চিত সামান্য টাকা মূলধন করে তারা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’জনে গড়ে তোলে আলেকজান্ডার রিয়েল এস্টেট কোম্পানী, ১০০ নম্বর ওয়েস্ট প্রভিন্স স্ট্রীটে।
বছর দুয়েকের মধ্যেই তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। তারা লাভের মুখ দেখতে শুরু করলো। আলেকজান্ডারের স্ত্রী তাঁর ইচ্ছার কথা ভুলে যায় নি। তাই স্ত্রীর ইচ্ছায় আলেকজান্ডার আবার কলেজি শিক্ষা শুরু করেন। একদিকে পড়াশুনা, অন্যদিকে ব্যবসা। থেরেশার তো সুখের কোনো পরিসীমা ছিল না।
নতুন পরিকল্পনা নিতেও ওরা দেরি করল না। সমুদ্রের কাছে ওরা নতুন বাড়ি গড়ে তুলল। ওদের স্বপ্ন কিন্তু থেমে থাকে নি, ইতোমধ্যে ওদের একটা ছোট্ট মেয়ে হয়েছিল। দু’জনে মনস্থ করল মেয়ের শিক্ষার সমস্ত ব্যবস্থা করবে। কিছু অর্থের সমস্যা দেখা দিলেও নিজেদের বাড়ির মধ্যে ভাড়াটে বসিয়ে সে সমস্যা তারা মিটিয়ে ফেললো।
আলেকজান্ডার দম্পতি সত্যিই পরিশ্রমী আদর্শ সুখী পরিবার। উভয়েই ওরা সুখী। ওদের সাফল্যের মূল কথা হল একটাই-নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে চলা। কোনো কিছুতেই ভেঙে না পড়া।
পৃথিবীতে এমন অনেক লোক আছে যাদের জীবনে কোনো রকম নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। তারা গতানুগতিক জীবনযাপন করে। এসব মানুষের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু যারা সবসময় সুযোগকে আঁকড়ে ধরতে পারে তাদের পক্ষেই সম্ভব জীবনকে সঞ্জীবিত করা।
নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া মানুষের জীবনে সাফল্য আসা সম্ভব নয়। তাই যে কোনো মানুষ পরিকল্পনা নিতে পারে। যেমন প্রথম পাঁচ বছরে লাভ করতে হবে কলেজের শিক্ষা আর চাকরিতে উন্নতির চেষ্টা। পরের দশ বছরে কাজ হবে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হওয়ার চেষ্টা। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের সামনে থাকা চাই ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য, আর তা সফল করার নিদিষ্ট পরিকল্পনা।
বাইবেলে লেখা আছে এই ধরনের এক উপদেশ–যে কাজেই হাত দাও সেই কাজেরই পরিণতির কথা স্মরণ রাখতে ভুলো না। তাহলে অকৃতকার্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। যে সত্যিকারের সফল মানুষ তারও ধর্ম এটাই হওয়া উচিত যে, কোনো কাজে সফল হলেই অন্য একটি কাজে মন দেওয়া। সুতরাং যে কোনো স্ত্রীরই মনে রাখা উচিত যে, তার স্বামী কোনো কাজে সফল হওয়ার সাথে সাথেই অন্য কোনো কাজে তাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা।
০৩. উদ্দীপনা আর স্ত্রীর দায়িত্ব
ফ্রেডারিক উইলিয়ামসন এক সময়ে নিউইয়র্ক মেন্টাল রেলওয়েজে চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেছিলেন। একবার এক বেতার সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়, কোনো ব্যবসাতে কৃতকার্যতার গোপন রহস্যটি কী হতে পারে?
উইলিয়ামসন এর উত্তরে বলেছিলেন, “আমি আমার সারা জীবনেই মনে রাখব যে, কোনো কাজে কৃতকার্য হতে গেলে চাই একমাত্র উদ্দীপনা। সাফল্যের গোপন রহস্য হল উদ্দীপনা।” দুজন বিভিন্ন মানুষের বাস্তব দক্ষতা, শক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তির পার্থক্যের ওপরই যে কোনো কাজে কৃতকার্য হওয়া বা না হওয়া সম্পূর্ণ নির্ভর করে। কোনো সমান যোগ্যতাবিশিষ্ট দুজন মানুষকে ধরা যাক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হল। প্রতিযোগিতার শেষে নিশ্চয়ই দেখা যাবে, দুজনের মধ্যে যে সত্যিকার উদ্যোগী তার জয় অবশ্যম্ভাবী। একটি কথা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, যিনি খুবই উদ্যোগী পুরুষ তিনি যদি দ্বিতীয় শ্ৰেণীর শক্তিসম্পন্ন মানুষও হন তাহলেও তিনি প্রথম শ্রেণীর ক্ষমতা বিশিষ্ট অথচ উদ্যোগহীন কাউকে সহজেই প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেবেন।
এখন আমাদের জানা প্রয়োজন যে, উদ্যোগ ব্যাপারটি কী? উদ্যোগের অর্থই হল, নিজস্ব কর্মক্ষমতার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে কোনো কাজে উৎসাহের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। এক্ষেত্রে অন্য কারও কাছে কাজটা সামান্য বা অসামান্য হতে পারে। কোনো লোকের কাছে কাজটি আনুষঙ্গিক বলে মনে হওয়া চাই-সে কাজ যতই কষ্টকর বা সহজ হোক না কেন।
আমেরিকার মনীষী রালফ ওয়ালডো এমরারসন বলেছেন : ‘পৃথিবীর কোনো মহৎ বা শ্রেষ্ঠ কাজ উদ্যোগ ছাড়া সম্পন্ন করা যায় নি। যার কাজে উদ্যোগ থাকবে তার কাজেই আসবে উদ্দীপনা। উদ্যোগ যেমন উদ্দীপনার জন্ম দেয় সেইরকমই এর ফলশ্রুতিতে সাফল্য লক্ষ্য করা যায়।
প্রত্যেক স্ত্রীকে এই কথাই বলতে চাই যে, আপনার পক্ষে যা পাওয়া সম্ভব তা হল আপনার স্বামীকে কৃতকার্যতার দিকে চালনা করার, তার কাজে উদ্দীপনা সৃষ্টি করার প্রেরণা। তাই আপনার ভূমিকা একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে তুলনাহীন। মনে রাখতে হবে, উদ্যোগই একমাত্র গুণ যা সমস্ত সফল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। কাজটি উদ্দীপনা নিয়ে যাতে সুসম্পন্ন হয় সেটিই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
উদ্দীপনা হল অনেকটা সঞ্জীবনীর মতো। উদ্দীপনার বীজ যে মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, সে যদি কোনো কাজে উদ্দীপনা বোধ করে তাহলে সে দুর্দম হয়ে ওঠে। কাজটি শেষ করার জন্য তার আবেগ আর বাধা মানতে চায় না। এ ব্যাপারে অতি জনপ্রিয় অধ্যাপক উইলিয়াম ফ্লেক্স তাঁর বিখ্যাত ‘দি এক্সাইটমেন্ট অফ টিচিং’ গ্রন্থে লিখেছেন, “শিক্ষকতার কাজ আমার কাজে যে কোনো কলাবিদ্যা বা ব্যবসার চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। শিক্ষকতার মধ্যে আমি মানসিক উত্তেজনার খোরাক পাই। আমার কাছে শিক্ষাদান ব্যাপরটি শিল্পীর ছবি আঁকা, গায়কের গান গাওয়া, আর কবির কাব্য রচনা করার মতোই প্রিয়। শিক্ষাদান করতে আমি আনন্দ পাই। ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে ওঠার পর আমি এক অপরূপ আনন্দে আমার ছাত্রদের স্মরণ করতে চাই। তাই আমি মনে করি আর বিশ্বাস করি জীবনে কৃতকার্য হওয়ার প্রধান উপায় নিঃসন্দেহে নিজের কাজে দৈনন্দিন আগ্রহ বজায় রাখা। শক্তি অর্জন করা এই কাজের মধ্যেই উদ্দীপনা খুঁজে পাওয়া।“
সুতরাং আপনার কাজ হবে স্বামীর কাজ সম্পর্কে জেনে তাকে সেই কাজে উদ্যোগী হয়ে উঠতে সাহায্য করা। সত্যিকারের কার্যকরী ভূমিকা হবে আপনার স্বামীর মধ্যে উদ্দীপনার রেশ জাগিয়ে তোলা। চার্লস সামিনার উলওয়ার্থ-এর মতে, কোনো লোকই সাফল্য লাভ করতে পারে না, যদি-না তার নিজের কাজে সে উৎসুক হয়ে ওঠে।
বিখ্যাত চার্লস বেন্থয়াও বলেছেন, মানুষ তার প্রতিটি কাজে কৃতকার্য হতে পারে যদি কাজের প্রতি তার আনুগত্য আর উৎসাহ উদ্যম থাকে।
তাই বর্তমানে মানুষ আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় সচেতন আর উদ্দীপনাপূর্ণ আর্থিক বা আধ্যাত্মিক-দুটি বিষয়েই সে অন্যকে ঢের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবেই। অনেকের ধারণা উদ্দীপনা খুবই উঁচু দরের বৈজানিক অনুসন্ধানেরও পথ হয়ে উঠতে পারে। এ ব্যাপারে স্যার এডওয়ার্ড ভিক্টর বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসাহ আর উদ্দীপনাকে যে কোনো সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করে ধীশক্তিরও আগে স্থান দিতে হবে। তাহলে বুঝতে হবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে যদি এই উদ্দীপনা এতো বেশি রকম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তাহলে আপনার স্বামীর জীবনেও নিশ্চয়ই তা কার্যকরী হবে।” একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন জীবনবীমা ব্যবসায়ী ফ্রাঙ্ক বেটলারের জীবনের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনি নিজেই বলেছেন, “আমি ১৯০৭ সালে বেসবল খোলোয়াড় হিসাবে জীবন শুরু করি। এরপর কিছুদিন পরে আচমকা মারাত্মক ব্যাপার আমার জীবনে চরম আঘাত হয়ে নেমে আসে। আমাকে অযোগ্য বলে বরখাস্ত করা হয়। ম্যানেজার আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেন, যে কাজ এবার থেকে করব তার মধ্যে যেন কিছুটা উদ্দীপনা ঢেলে দেবার চেষ্টা করি। ওখানে আমার মাইনে ছিল ১৭৫ ডলার। বরখাস্ত হওয়ার পর মাত্র মাসিক ২৫ ডলারের আর একটা চকরি নিতে হল আটলান্টিক লীগে। সেটা পেন্সিলভানিয়াতে। সামান্য টাকায় খুশি না হলেও হতাশায় কিন্তু আমি ভেঙে পড়ি নি। যে কাজে যোগ দিয়েছি তাকে সফল করবই বলে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। বিরাট উৎসাহ নিয়ে আমি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দশদিন ওখানে থাকার পরেই আমার ডাক আসে নিউ হ্যাঁভেন সংস্থা থেকে। আমি মনে মনে শপথ নিলাম যে করেই হোক সবচেয়ে উদ্দীপনাময় খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করব। আমার দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল, এটাই হবে আমার বেঁচে থাকার মূলকথা। খেলার মাঠে হাজির হওয়ার পরেই অদ্ভুত একটা শিহরণ আর বৈদ্যুতিক শক্তির স্পর্শই যেন শরীর আর মনের মধ্যে দোলা দিয়ে যায় আমার। আমার দলের খেলোড়রাও যেন উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আমার সঙ্গে তাল দিয়ে তারাও পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ায় বিপক্ষ দল দাঁড়াতেই পারল না। আমার উদ্দীপনা যেন মন্ত্রের মতোই কাজ করতে শুরু করেছিল। আমার উৎসাহ আর উদ্দীপনা এমন একটা পর্যায়ে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল যে, আমার নিজের সম্পর্কে কোনো খেয়ালই ছিল না।
পরদিন সকালে খবরের কাগজ খুলে দেখলাম অধিকাংশ খবরই আমার প্রশংসায় ভরা। কাগজে লেখা ছিল নতুন খেলোয়াড় বেটগার অসাধারণ উদ্দীপনাময়। সে দলের সব খেলোয়াড়কেও উদ্দীপিত করেছে। নিউ হ্যাঁভেন শুধু যে খেলায় বিজয়ী তাই নয়, তারা এ মৌসুমের সব সেরা খেলারই নিদর্শন রেখেছে।
আমার মন এই খবর পড়ে আনন্দে ভরে গেল। আমার উদ্দীপনাই আমার ভাগ্যের দরজা খুলে দিল। দিন-দশেকের মধ্যে আমার মাইনে হয়ে গেলো ২৫ ডলার থেকে ১২৫ ডলার। দু’বছর যেতে-না-যেতে নামী ক্লাব কার্ডিনালে সুযোগ পেলাম। সেখানে মাইনে বেড়ে গেল আরও শতকরা ত্রিশ ভাগ। আমি জানি আমার এই সৌভাগ্যের মূল কথা হল-উদ্যম আর উদ্দীপনা।
মি. বেটগার হাতে আঘাত পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেসবল খেলা ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর তিনি জীবনবীমায় আসেন ব্যবসার চাকরিতে। তিনি ফাঁইডেলিটি মিউঁচুয়াল লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে চাকরি নেন। বছরখানেক কাজ করার পর কোনো উন্নতি না দেখে মি. বেটগার নতুন উদ্যমে উদ্দীপনা নিয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বেসবল খেলার পুরোনো অভিজ্ঞতা ভুলতে পারেন নি।
বর্তমানে মি. বেটগার জীবনবীমা জগতে একজন সফল ব্যক্তিত্ব বলে চিহ্নিত। তিনি বলেন, আমার ত্রিশ বছরের জীবনবীমা বিক্রির অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করি একজন বিক্রয় প্রতিনিধির জীবনে উদ্দীপনা কতখানি। আবার উদ্দীপনার অভাবে বহু বিক্রয়কারীকে প্রায় দেউলিয়া হতেও দেখেছি।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেই প্রয়োজন উদ্দীপনা। কোনো কাজ যতই কষ্টসাধ্য হোক না কেন এই গুণটি থাকলে কাজে সফলতা অবশ্যম্ভাবী।
সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীর মধ্যে উদ্দীপনার প্রকাশ ঘটানো, উদ্দীপনাময় কাজে উৎসাহ দেওয়া। আপনার এই উদ্যোগ অনেক সহজ হবে যদি কয়েকটি নিয়ম মেনে চলা যায়। পরের পরিচ্ছেদে আমরা এই নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
০৪. ছয়টি উদাহরণ
যে ছ’টি নিয়মের কথা এই পরিচ্ছেদে উল্লেখ করবো সেগুলো যদি ঠিক মতো অনুসরণ করা যায়, আমার মনে হয় এর সুফল নিশ্চয় প্রত্যক্ষ করা যাবে। একজন আদর্শ স্ত্রী হিসাবে এই নীতি আপনি আপনার স্বামীকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করুন। অল্প সময়ের মধ্যেই ফল বুঝতে পারবেন। এবার আমরা নিয়মগুলো আলোচনা করবো:
১। আপনার কাজের জায়গায় শিক্ষা নিন। কাজের সব খুঁটিনাটি আর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সার্বিক সম্পর্কে জেনে নিন : যারা চাকরি করতে অভ্যস্ত তাদের শতকরা অন্তত পঁচাত্তর ভাগ মানুষ মনে করেন, তারা কোনো বিশাল যন্ত্রের একটা অংশ মাত্র। এর অর্থ হল, তারা নিজেদের কাজের গুরুত্ব বা নিজেদেরও গুরুত্ব সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এই সমস্ত লোক শুধু নিজেদের কাজটুকু নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সেই কাজের সঙ্গে অন্য যে সব কাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকে সে সব কাজ সম্পর্কে তার আর কোনো রকম আগ্রহ থাকে না।
এটা আমাদের জানা দরকার যে, কোনো জিনিস সম্পর্কে জানতে গেলে যেটা একান্ত প্রয়োজন সেটা হল অনুসন্ধিৎসা। যদি অনুসন্ধিৎসা না থাকে তাহলে জানার স্পৃহা গড়ে ওঠা একেবারেই সম্ভব নয়। এই সম্বন্ধে প্রখ্যাত সাংবাদিক আইডা এম, টারবেল বলেন-একবার মাত্র পাঁচ’শ শব্দের একটি রচনা লেখার জন্য আমি কয়েক সপ্তাহ পরিশ্রম করে রচনার বিষয়বস্তুর মালমসলা যোগাড় করেছিলাম। কিন্তু লেখার সময় আমার সংগ্রহ করা মালমসলার সামন্যই কাজে লেগে ছিল। তবু তাতে আমি প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলাম। যে মালমসলা বাইরে পড়েছিল সেগুলো থেকে আমার জ্ঞান বেড়ে গিয়েছিল অঢেল। আমার লেখায়ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় দারুণ কার্যকরী হয়ে ওঠে।
প্রখ্যত বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবনেও এই অনুসন্ধিৎসা ভীষণভাবে কার্যকরী হয়েছিল। ফ্রাঙ্কলিন জীবন শুরু করেছিলেন এক সাবানের কারখানায় মজুর হিসাবে। কীভাবে সাবান তৈরি করা হয় সে সম্পন্ধে তার আগ্রহ ছিল। নিজের করণীয় কাজে তার একটুও অনীহা ছিল না। কাজের ব্যাপারে মালিকও ফ্রাঙ্কলিনের ওপর খুব খুশি ছিলেন।
এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের উৎপন্ন মালপত্র বিক্রির জন্য বিক্রয় প্রতিনিধি রাখা হয়, তাদের প্রতিটি উৎপন্ন জিনিসের তৈরি বিশদ বিবরণ লিখতে হয়। অথচ বিক্রি করার সময় সেটার কোনো প্রয়োজন হয় না। এই বাড়তি জ্ঞান থাকার দরুন প্রতিনিধিদের দায়িত্ব জ্ঞান বাড়ে আর উৎসাহও দেখা যায়। যে বিষয়ে যত বেশি জানা যায়, সে বিষয়ে আমাদের ততই উৎসাহ বেড়ে যায়। এই জন্যই যে কোনো আদর্শ স্ত্রীর জানা প্রয়োজন যে, যদি তার স্বামী কাজে উৎসাহ বোধ না করে তবে তার ত্রুটি কোথায়? এই ত্রুটি খুঁজে বের করে স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করাই হবে স্ত্রীর কাজ। হয়তো লক্ষ্য করা যাবে যে স্বামীর নিজের কাজ সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নেই বা আগ্রহও নেই, এক্ষেত্রে স্ত্রীর কর্তব্য হবে সেই সুপ্ত অজ্ঞানতাকে দূর করার জন্য সাহায্য করা।
২। লক্ষ্য স্থির করে তাতে লেগে থাকুন : আপনি যদি মনে করেন, কোনো কাজে সফল হবেন তাহলে আপনার প্রথম কাজ হবে কাজটির দিকে স্থির দৃষ্টি রাখা। আপনার জানা অবশ্যই প্রয়োজন যে কাজটির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? এর পরের কাজ হবে তার পিছনে লেগে থাকা। এই ধরনের মন মানসিকতা থাকলে নানা বাধা-বিপত্তি বা সাময়িক ব্যর্থতায় কখনও নিরুৎসাহ হবেন না।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, কেউ যদি নিজের কাজে সিদ্ধিলাভ করতে আগ্রহী হয়, তাহলে নিজের কাজ আর কর্তব্য সম্পর্কে তাকে নিবিষ্ট হতেই হবে। জীবনে কৃতকার্য হতে গেলে এটা প্রয়োজন।
একজন কর্তব্যপরায়ণা স্ত্রী হিসাবে আপনার কাজ হবে আপনার স্বামীর কাজ সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা গড়ে তোলায় সহায়তা করা, ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে অবহিত করে তোলা-বাস্তব পরিস্থিতি মেনেই এটা করা প্রয়োজন।
৩। ছোটখাটো গল্প বলুন : যে কোনো ধরনের গল্প হোক না কেন, এতে মানুষের অনুসন্ধিৎসা বাড়ে। এর উপযোগিতা অনেক। বিশিষ্ট সাংবাদিক এইচ. ভি. কেন্টেনবার্ন বলেন, এক সময় তিনি যখন ফ্রান্সে জীবনবীমা বিক্রির কাজ করতেন তখন তিনি এই ধরনের গল্প কাজে লাগিয়ে সফল হন।
এইরকম ঘটনা ঘটে বিখ্যাত জাদুকর হাওয়ার্ড আমটর্নের জীবনেও। এই গল্প বলার মধ্যে দিয়ে আমটর্ন বেশ সজীবতা লাভ করতেন আর দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন।
আমাদের উচিত নানা ছোট ছোট ঘটনাকে মনে রেখে কাজের মধ্যে সজীবতা আর অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলা। যে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার প্রথম ও একমাত্র চাবিকাঠি হল সজীব থাকা, প্রাণবন্ত থাকা। এই কারণে ছোট ছোট সরলতায় ভরা গল্প তাই মানুষের মন সজীব করে তোলার কাজে খুবই উপকারী।
৪। অল্প স্বার্থপরতায় দোষ নেই : বিখ্যাত দার্শনিক সম্রাট আলেকজান্ডারের শিক্ষাগুরু অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘দোষমুক্ত স্বার্থপরতা মানব কল্যাণকর।’ যারা জীবনে উন্নতি করতে চায় তাদের জন্য একটি চমৎকার পথ। পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক স্বার্থপর। আর সেই স্বার্থপরতা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যস্ত থাকে। এইসব লোক হল অলস, ক্লান্ত, জীবনপথে সে ব্যর্থ।
আমাদের জেনে রাখা উচিত যে, অপরের স্বার্থ লক্ষ্য রেখে কাজ করা অনেক বেশি আনন্দ আনে। এতে মনে উদ্যমের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে অনেক কৃতী মানুষ আছেন যারা অপরের জন্য নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেন। এই সব মানুষ সমাজসেবা আর ধর্মের কাজে নিজেদের বিলিয়ে দেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়। তাই তাদের সামান্য স্বার্থপরতা বজায় রেখে চললে দোষ হয় না। সেই
কারণে আপনার স্বামীকে উদ্দীপনায় উৎসাহিত করতে হলে একটু স্বার্থপরতার আশ্রয় নিতে পারেন।
৫। উদ্যোগী মানুষের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করুন : এমন মানুষের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করবেন যার মধ্যে উদ্যোগী পুরুষের সব লক্ষণ চোখে পড়ে, জীবন সংগ্রামে যার প্রচেষ্টা সার্থক। এ কাজ করলে আপনার নিরুৎসাহ ভাবটা তাতে দূর হয়ে যাবে। মার্কিনী দার্শনিক রালফ ওয়ালজে এমারসন বলেছিলেন, ‘যে মানুষ আমাকে কর্তব্য আর কাজে অনুপ্রাণিত করতে পারে তেমন মানুষকে আমার প্রয়োজন।
আপনি স্ত্রী হয়ে স্বামীর বন্ধু হয়ে তার সুপ্ত কর্মকুশলতা জাগিয়ে তুলতে পারেন। এ কাজ ঢের বেশি বাস্তব চিন্তা যোগাতে সাহায্য করে আর জীবনযাত্রায় উদ্বুদ্ধ করে। আপনার স্বামীকে যদি সত্যিই উদ্দীপনায় উত্তেজিত হতে দেখতে চান তাহলে কৃতী আর উদ্যোগী মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে আপনার প্রভাবকে কাজে লাগান। এমন সব মানুষ উৎকর্ষতায় সজীব আর জাগ্রত জেনে রাখা ভালো যে, প্রত্যেক দেশে ও সমাজে এই ধরনের মানুষের অভাব নেই। এই উদ্দীপনা ব্যাপারটা প্রত্যেককেই স্পর্শ করবে এমন কী আপনার স্বামীকেও।
পার্শি এইচ. লুইটিং তার বিখ্যাত বই ‘ফাইভ গ্রেট রাথস ফর সেলিং’-এ বলেছেন, যে সব মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা জেগে থাকে তাদের আগ্রহের অভাব লক্ষ্য করা যায়। যারা অনিচ্ছার সঙ্গে দৈনিক কাজ কোনোরকমে শেষ করতে চায় তাদের সংস্পর্শ বিষবৎ এড়িয়ে চলাই ভালো।
৬। উদ্যোগী হতে মনে জোর আনুন, সফল হবেনই : বিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জেম্সই এই দার্শনিক তত্ত্বের উদাতা। জেম্স বলেছিলেন, যদি আপনার মনের মধ্যে আবেগপূর্ণ উদ্দীপনার স্রোত জাগাতে চান তাহলে ভাবতে হবে আর এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন ওই ভাব সত্যিই আপনার মনে সঞ্চার হয়েছে। এটা সত্যিই প্রমাণিত সত্য। এভাবে কাজ করতে করতে দেখা যাবে উদ্দীপনার জন্ম আপনার থেকেই হবে। উদ্যোগী হতে গেলে উদ্যোগপূর্ণ চিত্তে কাজ করতে হবে। স্ত্রী হিসাবে আপনার স্বামীকে এভাবেই সাহায্য করা ভালো।
এই সূত্রগুলো মনে রাখবেন :
১। সাফল্যের প্রথম সিঁড়ি : আপনার স্বামীর জীবিকা আর জীবনদর্শন নির্বাচনে সাহায্য করুন। কোনো আদর্শ লক্ষ্য রেখে তাকে এগিয়ে চলতে আপনার প্রেরণা উজাড় করে দিন।
২। কোনো কাজের সাফল্য এলেই অন্যটিতে নজর দিন : কোনো কাজে সফলতা লাভ করতে পারলে অন্য কাজ হাতে নিন। পাঁচ বছরের পরিকল্পনার ছক তৈরি করুন।
৩। স্বামীকে উদ্দীপিত করুন : স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করুন, উদ্দীপনার মূল্য কতখানি আর জীবনে যারা সফল ব্যক্তিত্ব তাদের জীবনের উদাহরণ দিন।
স্বামীর উদ্যম বৃদ্ধির জন্য নিম্নের পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করুন :
১। স্বামীর প্রতিটি কাজে অনুপ্রেরণা দিন।
২। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির রেখে কাজে এগিয়ে চলুন আর তাতেই লেগে থাকুন।
৩। প্রতিদিন স্বামীর কাজে টুকরো টুকরো গল্প বলুন আর তাকে অনুপ্রাণিত করুন।
৪। সমান্য স্বার্থপরতা অন্যায় নয়, তবে পরের কথা আগে ভাবতে শিখুন।
৫। উদ্যমশীল লোকের সাথে মেলামেশা করুন।
৬। একটা কথা মনে সব সময় রাখুন, উদ্যোমের সঙ্গে কাজ করলে উদ্যমশীল হওয়া যায়।
০৫. মানসিক ভাবধারা গঠনের কথা শুনুন
১৯৫০ সালের একটা ঘটনার কথা আপনাদের শোনাচ্ছি।
আমেরিকার শিকাগো শহরে বিল জোনস নামে একজন লোক প্রচণ্ড মানসিক বিপর্যয়ে পড়ে অর্থাৎ দৈন্যদশার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা নেয়। পাঁচতলা একটা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পাওনাদার আর অন্যান্যদের ধার শোধ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি। নিজের মানসিক যন্ত্রণার কথা সে কিন্তু তার স্ত্রীকে আদৌ বলতে পারে নি। স্ত্রী যদি আঘাত পায় তাই সে তার স্ত্রীকে কথাটা জানাতে পারে নি। একে একে নৈরাশ্যের অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। এই নৈরাশ্যই তাকে আত্মহননের পথে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বোধ হয় কেউ যেতে পারে না। তাই বিল ঝাঁপিয়ে পড়লেও বাইরে বেরিয়ে থাকা কার্নিশের উপর ওর দেহ পড়ার ফলে কার্নিশ ভেঙে বিল রাস্তার উপর পড়ে যায়। কার্নিশের উপর পড়াতেই তার জীবন রক্ষা পেয়ে গেল।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন জোনস দেখলো যে, সে বেঁচে রয়েছে আর ছটফট করে চলেছে। ব্যাপারটা বিল-এর কাছে অলৌকিক বলে মনে হল। সে ভাবতেই পারলো না যে, সে বেঁচে আছে। জীবন ফিরে পেয়ে সে আনন্দে শিহরিত হল। যত শীঘ্র সম্ভব বাড়ি ফিরে গিয়ে স্ত্রীকে সব কথা খুলে বললো। সমস্ত কথা শুনে জোনসের স্ত্রী প্রথমে ভেঙ্গে পড়লেও নিজেকে সামলে নিল। তার দুঃখ হল যে, তার স্বামী কেন তাকে আগে সব কথা বলে নি এই ভেবে। বিল-এর স্ত্রী শান্তভাবে এবারে তার স্বামীকে বিভিন্নভাবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে নানা পরামর্শ দিয়ে চললো।
এরপর নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করলো বিল জোনস। ওর স্ত্রীর পরামর্শ আর প্রেরণাই জোনসকে পথ দেখাতে চাইল। নানা সমস্যার মধ্যে দিয়েও বিল সমস্ত দুশ্চিন্তা আর বিপদ-আপদ কাটিয়ে উঠলো। দুঃখ আর বাধা সে জয় করেছিল নিজের স্ত্রীকে সমব্যথী হিসেবে পেয়ে। বিল জোনসের এই কাহিনী থেকে এই কথাই প্রমাণ হয় যে, স্ত্রীকে বিশ্বাস করে সব কথাই বলা প্রত্যেক স্বামীর অবশ্য কর্তব্য।
আবার অনেক পরিবারে দেখা যায় যে, স্বামী ক্লান্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে অফিস সংক্রান্ত কোনো কথা স্ত্রীকে বলতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বহু ক্ষেত্রেই একা কোনো সমস্যার ভার বহন অসহনীয় হতে পারে, এক্ষেত্রে স্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। একজন আদর্শ গৃহিণীকে মনে রাখতে হবে, যে কোনো স্ত্রীই ভালো শ্রোতা হয়ে স্বামীকে গভীর প্রশান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে। স্ত্রী অনেক সময় স্বামীর কাছে সুপরামর্শদায়িনী হতে পারে। স্বামীকেও ধৈর্য সহকারে স্ত্রীর কথা শুনতে হবে। উভয়কেই হতে হবে ভালো শ্রোতা। জনপ্রিয়তা অর্জনের ক্ষেত্রে এর দাম অনেক। অনেক ক্ষেত্রে ভালো শ্রোতা বিরক্তিকর লোকের কাছে প্রভাবিত হতে পারে। বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী মার্নালয় বলেছিলেন যে, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থায় নানা দেশ থেকে আগত নানা প্রতিনিধির কথা শুনে বিভিন্ন দেশ আর জাতির সমস্যা সম্পর্কে তিনি চমৎকার জ্ঞান লাভ করেন। মিস লয়ে আরও বলেন যে, অনেকেই হয়তো উদ্দেশ্যহীন ভাবে নানা মুখরোচক গল্পে মেতে থাকেন। কিন্তু আমার ধারণা এরকম করার চেয়ে একজন ভালো শ্ৰেতা হওয়া অনেক বেশি কাজের।
কেমন করে ভালো শ্রোতা হবেন?
একজন ভালো জাতের শ্রোতা হতে গেলে মোটামুটি তিনটি গুণ থাকা প্রয়োজন–
১। শুধু কানকে কাজে না লাগিয়ে শ্রোতাকে তারই সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে চোখ মুখ আর সারা শরীরকে :
শ্রোতাকে প্রথমত খুব মনোযোগী হতে হবে। অর্থাৎ সমস্ত কাজের ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে তুলতে হবে। আমাদের তাই ভালো শ্রোতা হতে গেলে এমন কাজ করতে হবে যাতে বোঝা যায় শ্রোতার দিকে আমরা আকৃষ্ট হয়েছি। শরীরের ভঙ্গির মধ্যেও সেই ভাবটি পরিস্ফুট করতে হবে।আসল কথা আদর্শ স্বামী আর স্ত্রীকে পরস্পরের কাছে ভালো শোতা হতে হবে।
২। ভালো কার্যকর প্রশ্ন করুন :
প্রশ্ন করা ব্যাপারটা দু’জনের মধ্যে চমৎকার বোঝাঁপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে শ্রোতাই বক্তাকে পরিচালনা করবেন। এমন প্রশ্ন হবে যাকে বলা হয় পরিচালক প্রশ্ন। এই ধরনের পরিচালক প্রশ্ন আলোচনার মনোভাব জাগিয়ে তোলায় সাহায্য করে।
কিন্তু সরাসরি আর পরিচালক প্রশ্ন কী রকম? ধরা যাক কোনো শ্রোতা বক্তাকে প্রশ্ন করল, কাজ নির্বাহ আর কাজ পরিচালনা-এ কাজ দুটি কি একই সাথে করা যায়? এটা হল সরাসরি প্রশ্ন। কিন্তু বক্তা যদি প্রশ্ন করেন, আপনি কি মনে করেন যে ক্ষেত্রবিশেষে কাজ নির্বাহ আর কাজ পরিচালনা-এই দুয়ের সমন্বয় সাধন কী করে সম্ভবপর?’ এই ধরনের প্রশ্নকে বলা হয় পরিচালক প্রশ্ন। কোনো লোক যদি একজন ভালো শ্রোতা হতে চায় তবে তার কাছে এই ধরনের পরিচালক প্রশ্ন করা অবশ্যই চমৎকার নৈপুণ্যের। একজন আদর্শ স্ত্রীর পক্ষে ভালো শ্রোতা হওয়াও খুব কার্যকরী।
কোনো স্বামীকে তার স্ত্রী এই ধরনের পরিচালক প্রশ্ন করতে পারে, যেমন—’আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় আরও বিজ্ঞাপন দিলে সত্যিই কি জিনিসের বিক্রি বাড়ে?’ এই ধরনের প্রশ্নের মধ্যে উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গি মোটেই থাকে না অথচ এতে চমৎকার কাজ হয়। শ্রোতার উত্থাপন করা ভালো প্রশ্ন খুবই ফলপ্রসূ হয়। যে কোনো মানুষই যখন কোনো ভাব সম্পন্ধে আলোচনা করে তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে কিছুটা আত্মস্মিত হয়। অবশ্য এ ধরনের ব্যাপার বিষয় বৈচিত্রের উপর নির্ভর করে। এক ভাব অপর ভাবকে আকর্ষণ করে।
৩। কখনও বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণা নয় :
আমাদের সমাজে এমন বহু পুরুষ আছেন যারা স্ত্রীর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা করা পছন্দ করেন না। আসলে তারা স্ত্রীকে বিশ্বাস করেন না। তাদের ধারণা স্ত্রী সব কথা বিভিন্ন জনের কাছে প্রকাশ করে ফেলবে। শোনা যায়, একজন কার্য পরিচালক নীতি গ্রহণ করে তার অধীনস্থ সব কর্মচারীকে আদেশ দিতেন যে বাড়ি ফেরার পর স্ত্রী বা কারও সঙ্গে অফিস সংক্রান্ত খোলামেলা আলোচানা বিশেষ করে মহিলা মহলে যদি করা হয় তাহলে প্রচুর ক্ষতির আশংকা থাকে।
এমন উদাহরণও লক্ষ্য করা যায়, যেখানে স্ত্রী স্বামীর প্রত্যেকটি কাজেরই খুঁটিনাটি বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই ধরনের স্বামী তার স্ত্রী সম্বন্ধে খুবই গর্ব অনুভব করবেন সেটাই স্বাভাবিক। এই ধরনের স্ত্রী বাড়ির পরিবেশকে চমৎকার সুন্দর করে তুলবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
নিচের তিনটি নিয়ম মেনে চললে যে কোনো গৃহিণী সত্যই ভালো শ্রোতা হয়ে উঠতে পারেন।
১। মুখের কথা অর শারীরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণ করুন।
২। বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করুন।
৩। কখনোই বিশ্বাসঘাতকা বা প্রতারণা করা উচিত নয়।
০৬. স্বামীর কাজে সহায়তা করুন
০৬. স্বামীর কাজে সহায়তা করুন
বিখ্যাত লর্ড চেষ্টারফিল্ড সুন্দর একটি মন্তব্য করেছিলেন। যেমন–প্রত্যেক মানুষই বাস্তবিক পক্ষে দুজনে মানুষ-বর্তমানে সে যে রকম রয়েছে অর ভবিষ্যতে সে যেরকম মানুষ হতে চায়।
আমরা প্রায়ই দেখি মানুষ যা নয় তাই হতে চায়। যে নিজের শক্তিতে কোনো রকম বিশ্বাস রাখতে পারে না সেও আত্মবিশ্বাসী হতে চায়। এই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা মোটেই কিন্তু অসম্ভব কাজ নয়। কোনো দোষত্রুটিযুক্ত মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনতে গেলে সহানুভূতির সঙ্গে তার বিচার করা প্রয়োজন। এই কাজটি সহজ ভাবে করতে পারেন একমাত্র তারই আদর্শ স্ত্রী। স্বামীকে সুপরামর্শ দিয়ে তার সুপ্ত মনোভাব জাগিয়ে তুলবেন তার স্ত্রী। এ বিষয়ে মার্জোরি হোমস বলেন, এমন কোনো পুরুষ বা স্বামী নেই যিনি স্ত্রীর প্রশংসা শোনার পর আনন্দে উচ্ছ্বসিত না হন।
একমাত্র স্ত্রীই পারেন সকলের চেয়ে বেশি স্বামীর পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে। বেশির ভাগ স্বামীই তাদের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্ত্রীর কাছ থেকে চমৎকার সহায়তা আর পরামর্শ লাভ করতে পারে স্ত্রী যদি সহানুভূতিসম্পন্ন হন।
মি. পার্কস বলেন, স্বামীর জীবনযাত্রার ওপর স্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি ও স্ত্রী যতদূর পর্যন্ত স্বামীর মনোবলের পরিচয় পান তার সাহায্যেই স্বামীর ক্ষমতা পরিমাপ বা সীমা নির্দেশ করা যায়।
মি. পার্কস আরও বলেন যে, আমার নিজের জীবনেই এর উজ্জ্বল উদাহরণ আছে। আমার স্ত্রী অনবরত উৎসাহ দান আর প্রেরণা যোগানোর মধ্যে দিয়েই আমার জীবনে সফলতা আসে। আমার কোনো অর্থ, শিক্ষা-সম্পদ কিছুই ছিল না। একমাত্র যে সম্পদ আমার ছিল তা হল বড় হওয়ান অদম্য স্পৃহা, সফল হওয়ার বাসনা। আমার কর্মশক্তির ওপর আমার স্ত্রীর ছিল অগাধ বিশ্বাস। স্ত্রীর প্রেরণায়, তার অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায় আমি ধীরে ধীরে সাফল্য লাভ করতে থাকি। আমার সৌভাগ্য আমার স্ত্রী, এ কথা আমি অকপটে স্বীকার করছি।’
এমন বহু স্বামী-স্ত্রীর কথা শোনা যায় যাদের পারিবারিক জীবন অশান্তিতে ভরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্ত্রীর ভূমিকাই সমালোচনার যোগ্য। এইসব স্ত্রীর জানা একান্তই প্রয়োজন যে স্বামীকে অনুযোগ জানালে সব সমস্যার সমাধান হয় না, বরং তাকে অনুপ্রেরণা যোগালেই সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়ে ওঠে।
স্বামীকে অনুপ্রাণিত করার কৌশল :
বিভিন্নভাবে যে কোনো স্ত্রী তার স্বামীর ভবিষ্যৎ জীবনধারাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। প্রথমে যেটি করতে হবে সেটি হল-স্বামীর দোষত্রুটি যদি থেকেও থাকে তবুও সে কথা না তুলে তার প্রশংসার দিকটাকে তুলে ধরা, আর আত্মশক্তিতে বিশ্বাস জন্মানো। স্বামীর গুণের কথা উল্লেখ করে তাকে উন্নতির পথ দেখানো। এর ফলে স্বামীর আত্মবিশ্বাস অনেক গুণে বেড়ে যায়। স্বামী যদি কখনও অকর্মণ্য হন তাহলেও স্বামীকে কোনো সময়ের জন্য অকর্মণ্যতার অপবাদ দেওয়া উচিত নয়। স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর প্রশংসা করা।
মানুষের জীবনের এমন ঘটনাও দেখা গেছে, যে স্ত্রীর প্রশংসা তাকে নিজের প্রতি বিশ্বাসী ও সাহসী করে তুলেছে। এই ধরনের একটা উদাহরণ আমরা লক্ষ্য করি টম জনস্টন নামে একজনের জীবনের ঘটনায়। টম জনস্টন খুব দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। তাঁর জীবনে এক দুর্ঘটনা ঘটায় তিনি কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও সাঁতার কাটা ছাড়তে পারেন নি। সাঁতারে তিনি অপরিসীম আনন্দ পেতেন।
কোনো-এক ছুটির দিনে টন জনস্টন লক্ষ্য করলেন, যে স্ত্রীর সঙ্গে হেম্পটন সমুদ্র সৈকতে রোদ উপভোগ করার সময় গোসল করতে আসা বহু মানুষ তার দিকে তাকিয়ে তার পায়ের ক্ষত চিহ্নগুলো লক্ষ্য করছে। টম জনস্টনের শারীরিক ত্রুটির কথা বারে বারে মনে হতে লাগলো। এরপর তিনি সমুদ্রতীরে যাওয়া বন্ধ করলেন। তাঁর স্ত্রী সমস্ত ব্যাপারটি ভালোভাবে বুঝতে পেরে এমন সহানুভূতিপূর্ণ কথা বলতে শুরু করলেন যে টম আবার সমুদ্র তীরে যাওয়ার প্রেরণা পান। তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন যে, ‘টম, তোমার পায়ের ক্ষত চিহ্ন যে তোমার সাহসেরই প্রতীক। তোমার গৌরবের অংশ ওই ক্ষত চিহ্ন মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে না রাখাই ভালো। তোমার সৌভাগ্য যে এগুলো তুমি একদিন পেয়েছিলে, আজ ওগুলো গৌরবের সঙ্গে ধারণ করো। চল আমরা আবার সমুদ্রের তীরে যাই।
এরপর টম জনস্টন যেন অন্য মানুষ হয়ে যান, তার মনে হতে থাকে সমস্ত ক্ষত চিহ্নই যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ডঃ পাওয়ার্স প্রতিটি গৃহিণীকে অনুরোধ করেন যে, তাঁরা যেন প্রত্যেকদিন সকালে এমন কাজ করেন যে, তাঁদের স্বামীরা যেন সারাদিন আবেগমণ্ডিত আর আনন্দপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। অনেক বেশি সুখী আর অনুরক্ত স্বামী লাভের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে এই ফর্মুলা ভীষণভাবে কার্যকরী হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের ইতিহাসের পাতায় অনেক কাহিনী আছে, যেখানে চেষ্টার ফলে বহু অকৃতকার্য অনায়াসভাবেই সফলতায় মণ্ডিত হয়ে ম্যাজিকের মতোই কাজ দিয়েছে।
সুতরাং আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য হবে অপরের বা স্বামীর ত্রুটির কথা না বলে তার যোগ্যতার স্ফুরণ ঘটানো।
০৭. ব্যর্থ হয়েও সাফল্যের আশা ত্যাগ করবেন না
এখন যে কাহিনীটি বলবো, সেটি হল উনিশ শতকের শেষদিকের।
একজন মিস্ত্রি আমেরিকার মিসিগান রাজ্যের ডেট্রয়েটের ইলেকট্রিক লাইট কোম্পানীতে কাজ করতো। প্রতিদিন দশ ঘন্টা কাজ করে সে মাত্র এগার ডলার উপার্জন করতো। কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে সে এক ধরনের কাজে নিজেকে নিযুক্ত রাখতো তা হল বিশেষ এক ধরনের ইঞ্জিন তৈরির কাজে সে একদিন সফলতা লাভ করবে কেউ কোনোদিন বিশ্বাস করে নিতো। একমাত্র তার স্ত্রী বিশ্বাস করতো যে তার স্বামী একদিন অবশ্যই সফল হবেন। শত কাজের মধ্যেও সে তার স্বামীকে এই ইঞ্জিন তৈরির ব্যাপারে বিশেষভাবে সাহায্য করতো। স্ত্রীর এই অসামান্য ভূমিকা স্বামীর মধ্যে এনেছিল আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা।
অবশেষে ১৮৯৩ সালে এক বিচিত্র ঘটনা সকলকে অবাক করে তোলে। একদিন পাড়া পড়শীরা ক্রমাগত কিছু অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল। তারা পথের দিকে তাকিয়ে দেখে সেই পাগল যুবকটি যার নাম হেনরি ফোর্ড, সে ও তাঁর স্ত্রী ঘোড়াবিহীন একটা গাড়িতে রাস্তা দিয়ে চলেছে। গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরেও এলো। পাড়া-প্রতিবেশীরা নিজেদের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারলো না।
পরিশ্রম আর প্রচেষ্টার দ্বারা এভাবেই জন্ম নিয়েছিল একজন অনন্যপ্রতিভাধর। হেনরি ফোর্ড নামে এই অসীম প্রতিভাবান যুবকটি প্রথম মোটর গাড়ি আবিষ্কার করে। এই মোটর গাড়ি আবিষ্কারের পেছনে তার স্ত্রীর অবদান ছিল অনেকখানি। তাঁর স্ত্রীর ক্রমাগত সাহায্য আর অনুপ্রেরণা এই আবিষ্কারকে অগ্রগামী করেছিল।
কারও পক্ষে যখন অবস্থা প্রতিকূল হয় তখন প্রত্যেক স্বামী আশা করেন প্রেরণাদাত্রী এমন একজন তার পাশে থাকুক। এই স্ত্রীলোকটি আর কেউ নয় তারই স্ত্রী।
মানুষ অনেক সময় এমন অবস্থার মধ্যে পড়ে যখন কোনো কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে অসমর্থ হয়, দুশ্চিন্তা তাকে সর্বক্ষণ ঘিরে ধরে। এই সময় প্রয়োজন এমন একজন স্ত্রীর যে, প্রতিরোধ শক্তি আর আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলবে স্বামীর মধ্যে। স্বামীর কর্মশক্তির উপর একমাত্র আস্থা থাকে স্ত্রীর বিশ্বাস এমনই এক শক্তি যা মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
রবার্ট ডিউপার নামে এক ব্যক্তি বলেন, একমাত্র আমার স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় আমি জীবনে আত্মবিশ্বাসকে জাগ্রত করে সাফল্য লাভ করেছি। ইঞ্জিনের জ্বালানির মতো আমারও প্রয়োজন ছিল প্রেরণার। আমার নির্জীব মানসিক শক্তিকে জাগাতে পেরেছে একমাত্র আমার স্ত্রী।
পবিত্র বাইবেলে আছে, আকাক্ষিত বস্তুর সার হল বিশ্বাস।
স্বামীর প্রতি অবাধ বিশ্বাস অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। স্ত্রী তার বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে স্বামীকে উৎসাহদান করে, তার প্রেমের পরশে পৃথিবীকে রঙে রূপে ভরিয়ে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই সূত্রগুলি মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
প্রথম নিয়ম :
১। তৎপরতা ও মনোযোগের সঙ্গে স্বামীর বক্তব্য শুনুন।
২। বুদ্দিমত্তার সঙ্গে প্রশ্ন করুন।
৩। বিশ্বাসকে নষ্ট না করে কার্যকরী ভাবে শুনুন। দ্বিতীয় নিয়ম : প্রশংসা ও উৎসাহদানের মধ্য দিয়ে স্বামীকে সহায়তা করুন।
তৃতীয় নিয়ম : স্বামী কোনো কাজে ব্যর্থ হলে স্বামীর শক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করুন ও তার উল্লেখ করুন।
০৮. স্বামীর কাজে সহায়তা করুন ও জেনে নিন
মিসেস আইডো ফিশারের জীবন থেকে এমন এক উদাহরণ আমরা উল্লেখ করবো, যাতে লক্ষ্য করা যাবে একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাজে কতখানি বিমোহিত আর মগ্ন থাকতে পারেন। আইডো ফিশারের স্বামী ছিলেন মেয়ার ফিশার। মি. ফিশার ছিলেন বিরাট এক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরি প্রতিষ্ঠানের সফল বিক্রয় প্রতিনিধি।
মিসেস ফিশারের একমাত্র ব্রত ছিল স্বামীর কাজে সহায়তা করা। তার স্বামীকে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে সাফল্যের তোরণে পৌঁছে দেওয়া। মিসেস ফিশারের প্রেরণায় তার স্বামী জীবনে অভূতপূর্ব উন্নতি করেন। মিসেস ফিশার একদিন আমাকে বলেছিলেন, “আমার স্বামী আহারে, চলাফেরায়, মুখে যে কোনো কাজে ও তার কাজের জন্য দারুণ উৎসুক হয়ে চিন্তা করেন। গত পঁচিশ বছর স্বামীর সাহচর্য আমাকে একই সাথে চালনা করেছে। আমিও তারই সাফল্যের চিন্তায় মশগুল থাকি। যে কোনো কাজেই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান স্বামীর সহায়তা করে যাওয়া। এ কাজ করতে আমি দারুণ আনন্দ পাই।”
মিসেস ফিশার সবসময় চিন্তা করে এসেছেন কীভাবে স্বামীর কর্মশক্তিতে আস্থা রেখে তার বিক্রি বাড়ানো যায়। স্বামী কীভাবে আরও ভালোভাবে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন। কীভাবে সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে। স্বামীর কাজে সাহায্য করার জন্য তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন। স্বামীর কাজকর্মে নিজেকে মগ্ন রাখা মিসেস ফিশারের এক নেশা ছিল। মি. ফিশারও তার স্ত্রীকে নিজের অচ্ছেদ্য অংশ বলেই ভাবতে চাইতেন। এটা প্রমাণিত সত্য যে, কোনো মানুষের উন্নতির পথে তার স্ত্রীর প্রেরণা আর সহায়তাই সবার আগে প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে স্বামীকে শুধুমাত্র যন্ত্র হলে চলবে না, স্ত্রীর প্রেরণা আর সহায়তা পুরোপুরি পেতে হলে স্ত্রীর সম্পর্কেও তার কিছু দায়িত্ব থাকে।
সংসারের প্রতি স্ত্রীর অনেক দায়িত্ব থাকে। সমস্ত পরিশ্রমের মাঝেই স্ত্রী পারেন স্বামীকে সাহায্য করতে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সাহায্য স্ত্রী করবেন সেটাই হবে প্রকৃত সাহায্য। যাদের বাড়ির কাজ তেমন কিছু করতে হয় না, তারা অনায়াসেই স্বামীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারেন। নিউইয়র্ক শহরের মতো ইস্ট অ্যান্ড অ্যাভিনিউর মিসেস লুইস যা করেন সেটা এই রকম :
মিসেস লুইস তাঁর চিকিৎসক স্বামীর কাজে সাহায্য করতেন। সারাদিন সংসারে কাজ করার পর সন্ধ্যায় মিসেস লুইস স্বামীর কাজে সাহায্য করতেন। স্বামীর কাজে স্ত্রী এমন অংশ নেয় তখন স্ত্রী এক বিশেষ গুণ অর্জন করে থাকে। গার্ল গাইডরা বহু বিখ্যাত কৃতী মানুষের বহু প্ররিশ্রম লাঘব করেছে। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক অ্যান্টনী ট্রলোপ বলেছেন যে, তাঁর লেখা বই প্রকাশিত হওয়ার আগে তাঁর স্ত্রী ছাড়া আর কেউই ওই পাণ্ডুলিপির একছত্রও পড়ে দেখেন নি। বিখ্যাত ফরাসী সাহিত্যিক এলকোমসের ভয় ছিল বিয়ে করলেই তার কল্পনাশক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত জুলি এলার্ড নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তার সমস্ত ধারণাটাই বদলে যায়। তাকে বিয়ে করার পরই তার কয়েকটি ভালো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। জুলির সাহিত্যের জ্ঞান থাকায় এলকোমস স্ত্রীর সমালোচনার উপর নির্ভর করতে পারতেন।
বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ্ আর মৌমাছি পালন বিশারদ হিউবার মাত্র সতের বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যান।
এই অন্ধ অবস্থায় থাকার সময় তাঁর স্ত্রী তাকে প্রকৃতির ইতিহাস’ বইটি পড়ার জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন আর শেষ পর্যন্ত তিনিই তা স্বামীকে পড়ে শোনান। তিনি এটা করেছিলেন স্বামীকে বিখ্যাত করে তোলর উদ্দেশ্য নিয়ে।
অনেকেই চান স্বামীর কাজ সম্বন্ধে স্ত্রীরা অনেক বেশি আরও ভালোভাবে জানুক। স্যার জেমস রচিত এক নাটক ‘প্রতিটি স্ত্রী যা জানেন’ নাটকের কোনো-এক দৃশ্যে দেখা যায়, নায়িকা ম্যালী উইলি শুতে যাওয়ার আগে বেশ ভারি কিছু বই নিয়ে চলেছে। তাকে তার ভাইয়েরা ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করলে ম্যালী জানায় তার স্বামীর নানা বিষয়ে সে জানতে চায় বলেই সে আইনের বই পড়ে নিচ্ছে।
বহু অভিজ্ঞ মানুসের মত হল যে সব স্ত্রীর মনে স্বামীর অবলম্বিত কাজের প্রতি উৎসুক ভাব থাকে, সে তার স্বামী আর স্বামীর নিয়োগকর্তা উভয় পক্ষেরই সত্যিকার সাহয্যকারিণী হন। সুইজারল্যান্ডের কোনো কারখানার এই বিষয়ে ভারি চমৎকার এক নিয়ম চালু আছে। সেখানে সপ্তাহের কোনো এক নির্দিষ্ট দিনে কারখানার কর্মীদের স্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারপর তাদের ওই কারখানা ভালো করে ঘুরে দেখিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রের কাজ, উৎপাদন সবই ব্যাখ্যা করা হয়। কারখানার কর্তৃপক্ষ তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করে দেখেছেন যে, এই কাজের ফলশ্রুতিতে সুন্দর বাতারবণ তৈরি হয়। ঐ সব মহিলারা অনেকেই খুব বুদ্ধিমতী হওয়ায় নানা উৎপাদন সম্পর্কে মতামতও দেন। এর ফলে দেখা গেছে যে প্রতিষ্ঠানের বেশ উন্নতিও হয়েছে।
মার্টিন কোল ‘টুডেজ উওম্যান’ নামের এক গ্রন্থে বলেন যে, একজন মহিলা নিউ ওয়েস্টার্ন নামে কোনো কারখানা পরিদর্শন করতে গিয়ে তার স্বামীকে কোনো মেশিন চালাতে দেখেন। এরপর স্বামী বাড়ি ফিরে আসার পর মহিলাটি স্বামীকে বলেন মেশিনটার মাথার দিকে সিভার না লাগিয়ে নিচের দিকে একটা পাদানি লাগানো থাকলে পরিশ্রম অনেক কমে যেত। আর উৎপাদনও অনেক বেড়ে যেত। কথাটা তাঁর স্বামীর উপযুক্ত মনে হওয়ায় তিনি কর্তৃপক্ষকে তা জানালেন। কর্তৃপক্ষও তা পরীক্ষা করে দেখলেন উৎপাদন প্রায় বিশ ভাগ বেড়ে গেছে। এই পরামর্শের জন্য কর্মীটিকে সাড়ে তিনশত ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়। স্বামীর কর্মজীবনে স্ত্রীর অংশ নেওয়া সত্যিই লাভজনক।
একান্তভাবে মনে রাখা প্রয়েঅজন যে, যদি আপনার স্বামীকে অতিরিক্ত উৎসাহ দিতে চান তবে নিচের কথাগুলি অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন :
১। সাধ্য অনুযায়ী স্বামীর কাজ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করুন।
২। স্বামীকে তার কাজের ব্যাপারে বাইরে থেকে সহায়তা করুন।
০৯. স্বামীর সেক্রেটারির প্রতি কী ধরনের ব্যবহার করবেন
কোনো পুরুষের সময়বিশেষ প্রিয়তম বন্ধু হল তার সেক্রেটারী। একজন সত্যিকার যোগ্য সেক্রেটারীর সাহায্যে কোনো পুরুষ তার দৈনন্দিন কাজের সমাধান চমৎকার আর সুচারুভাবেই করে ফেলতে পারেন। জীবন অগ্রগামী হওয়ার ক্ষেত্রে সেক্রেটারীর সাহায্য একান্ত অপরিহার্য। এখন প্রশ্ন হল একজন বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন স্ত্রী এর কী রকম অর্থ করতে পারেন?
সেক্রেটারী আর স্ত্রী এই দুজনেরই উদ্দেশ্য কিন্তু এক-আসল মানুষটির জীবনের অগ্রগতি বজায় রাখা। এই ব্যক্তিটির কাজকর্মের শেষ ফল লাভের মধ্যে স্ত্রী আর সেক্রেটারী দুজনেরই একটা সীমা নির্দেশক স্থান থাকে। যেহেতু এই দুজনেরই কাজের মূল সুরটি এক, তাই এটাই হওয়া প্রয়োজন যে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে হবেন পরস্পরের পরিপূরক।
বহু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, দুজন স্ত্রীলোক সম্পূর্ণ বিপরীত মনোভাব নিয়েই হাজির হন। একে অপরের প্রতিপত্তিতে বিদ্বেষ পোষণ করে চলতে থাকেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস দুজনের সুসংহত সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে স্ত্রীর ভূমিকাই হয় সব থেকে জরুরি। আমার মনে হয় সামান্য কয়েকটা নিয়ম মেনে চললেই স্ত্রী হিসেবে প্রত্যেকেই স্বামীর সেক্রেটারী সম্পর্কে বিদ্বেষ ভাব থেকে মুক্ত হয়ে চমৎকার এক সম্পর্ক আর সহযোগিতার বাতাবরণ গড়ে তুলতে পরেন। এখন আমারা নিম্নে কয়েকটি নিয়মের উল্লেখ করব :
১। স্বামীর সেক্রেটারীর প্রতি স্ত্রী কি বিদ্বেষ পোষণ না করে পারেন? সুশ্রী সুন্দরী সেক্রেটারী প্রায় প্রত্যেকেই চেয়ে থাকেন, কেননা প্রতিষ্ঠানে একজন সুন্দরী ফিটফাট চেহারার সেক্রেটারী অফিসারকে শ্রীমণ্ডিত করে তোলে। বহু স্ত্রীই আছেন যারা সেক্রেটারী যদি মহিলা হন তবে তার প্রতি ঈর্ষা পোষণ করে থাকেন। তারা ধারণা করেন যে, সেক্রেটারীরা শুধু তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে আর পুরুষদের কাছে প্রিয় পাত্রী হওয়ার জন্যই মোটা মাইনে আর সুযোগ লাভ করে থাকে।
কিন্তু সেক্রেটারীর চাকরি সহজলভ্য নয়। একজন ভালো জাতের অফিস সেক্রেটারীকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় ঠিক যেমনটি গৃহিণী করে থাকেন অথচ পুরস্কার পাওয়া তেমন কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
সেই কারণে সেক্রেটারীদের বেশ প্রফুল্লতা বজায় রেখে কাজ করতে হয়। স্ত্রীরাও যদি এই কথাটা চিন্তা করে দেখেন তাহলে ভালোই হয়। তাই স্ত্রীদের উচিত সেক্রেটারীদের প্রতি বিদ্বেষ ভাবটি মুছে ফেলা
২। কোনো সেক্রেটারীকে দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করানো উচিত নয় : এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে লক্ষ্য করা যায় যে, অফিসের যিনি কর্তাব্যক্তি তিনি তার বহু ব্যক্তিগত কাজ সেক্রেটারীকে দিয়ে করাতে চান। এই ধরনের কাজ খুবই অন্যায়। আর সেক্রেটারীর পক্ষেও অফিসের কর্তাব্যক্তির মুখের ওপর কিছু বলা কঠিন হয়ে ওঠে। সেক্রেটারীরা যখন কাজে যোগ দেন তখন তারা ধরেই নেন যে, তাদের অফিস বসের বহু ব্যক্তিগত কাজই করে দিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় যে বসের পারিবারিক অনুষ্ঠানেও যোগদান করে অতিথি আপ্যায়নের কাজটিও করে দিতে হয়, অথচ এই সব বাড়তি কাজের জন্য কখনোই পুরস্কার পাওয়া যায় না।
৩। অতিরিক্ত কাজের জন্য মুল্য দেওয়া উচিত : একটা প্রচলিত সত্য যে মানুষ তার যোগ্য কাজের মূল্য চায়, সে তার প্রাপ্য প্রশংসা চায়। কোনো কোনো সময় সেক্রেটারি এমন অনেক কাজ বসের জন্য করে যা অনেক ক্ষেত্রেই তার স্ত্রীরও উপকারে লাগে। যদিও অনুরোধ স্ত্রীর কাছ থেকে আসে না তবুও স্ত্রীরা যেভাবেই হোক উপকৃত হয়ে থাকেন। সেক্রেটারীরা সবসময় কাজের মূল্য পেতে আগ্রহী।
যে সব স্ত্রীদের স্বামী খুব বড় প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত থাকেন, তাদের কখনোই স্বামীর সেক্রেটারীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের খুব একটা সাক্ষাৎ ঘটে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের এটা ঘটে না। পারস্পরিক যোগাযোগ তাদের পক্ষে অনেক সহজ। এক্ষেত্রে তাই উচিত সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা।
নিচের কয়েকটি নিয়ম যদি আমরা মেনে চলি তাহলে আমরা উপকৃত হতে পারবো :
১। যে কোনো রকম সন্দেহের ভাব ত্যাগ করুন।
২। ঈর্ষার ভাব পোষণ করা উচিত নয়।
৩। সেক্রেটারীকে কখনও ব্যক্তিগত কাজে লাগানো উচিত নয়।
৪। সেক্রেটারীকে কখনও সহানুভূতি বা তিরস্কার করা উচিত নয়।
৫। যখনই সম্ভব হবে সেক্রেটারীকে কাজের মূল্য দেওয়া উচিত।
১০. স্বামীকে জ্ঞানার্জনে উৎসাহ দিন
মানুষ যখন তার কর্মজীবন শুরু করে তখন সে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে না। মানুষ অনবরত জ্ঞান অর্জন করেই কর্মপথে এগিয়ে চলে। জীবনের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলতে চলতেই সে জ্ঞানের অধিকারী হয়।
আমেরিকার বিশিষ্ট সমাজবাদী ডব্লিউ, লয়েড ওয়ার্নার বলেন, “আমেরিকার স্বপ্ন এই বিশ্বাসের উপরেই স্থাপিত যে, মানুষ অগ্রগামী হতে সক্ষম’ আর অগ্রগামী হওয়ার প্রধানতম পথ হল ‘বিদ্যাশিক্ষা’।” মি. ওয়ার্নার আরও বলেছিলেন যে, যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা-বাণিজ্য পদোন্নতির তালিকা লক্ষ্য করেই কর্ম প্রার্থীদের সুযোগ দেওয়া। বর্তমানে বহু প্রতিষ্ঠানই নিজেদের খরচে কর্মচারীদের বিশেষ ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছেন।
এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে অনেক মহান চরিত্র অবসর সময়ে লেখাপড়া আর বিদ্যার্জনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে। এই ধরনের এক উদারহরণ হল চার্লস জি. ফ্রন্ট। তিনি ছিলেন একজন ভারমন্ট এলাকার চর্মকার বা চলতি কথায় মুচি। অথচ এমনই একজন মানুষ তাঁর অবসর সময়ে মাত্র এক ঘন্টা পড়াশোনায় ব্যস্ত থেকে বিখ্যাত একজন অন্ধবিশারদ হয়ে ওঠেন। এই ধরনের আর একজন মানুষ হলেন শ্রমিক জন হান্টার। তিনি তার অবসরের সময়ে তুলনামূলক শারীরবিদ্যা পাঠ করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রতি রাতে মাত্র চার ঘন্টা ঘুমোতেন। ব্যাঙ্ক কর্মচারী লুবেক তার অবসর মুহূর্তে পড়াশোনা করে হয়ে ওঠেন প্রাগৈতিহাসিক বিজ্ঞানী। বিখ্যাত জর্জ স্টিফেনসন যখন রাতের বেলায় ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজে ব্যস্ত থাকেন তখন অবসর পেলেই পাটীগণিত শিখতেন। এভাবেই তিনি পরে আবার রেলের ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। বিখ্যাত বিজানী জেমস ওয়াট যে সময় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন তখনই আবার অবসর সময়ে রসায়ন শাস্ত্র আর গণিত শিক্ষা করতেন। পরে আবার তিনি বাষ্পীয় শকট আবিষ্কার করেছিলেন। এই সব জ্ঞানী মানুষ যদি শুধুমাত্র নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকতেন তাহলে জগতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতো।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, একজন পুরুষ বা স্বামীর এই বাড়তি শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে একজন স্ত্রী কতখানি সাহায্য করতে পারে? এটা একমাত্র সম্ভব হয় স্ত্রী যদি স্বামীর মনোভাব বুঝে নিয়ে তাকে উন্নত করার জন্য মন-প্রাণ ঢেলে দিতে পারে। স্বামীর অমনোযোগিতা কৃতকার্যের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রীদের মনে রাখতে হবে যে, স্বামীর অকৃতকার্যতার জন্য তারাও অনেকটাই দায়ী। স্বামীদের পক্ষে গতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য বাইরের নানা বিষয় সম্পন্ধে জানার চেষ্টা করা ভালো। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা অসীম।
কেউই চায় না নিচে পড়ে থাকতে, এর জন্য চাই বড় হয়ে উঠার বাসনা। তাকে নিজেকে শিক্ষিত করে ভোলা চাই।
অবশ্য সারাদিন কাজ করার পর প্রতিটি রাতে বিদ্যা শিক্ষা করে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। এ কাজে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ চায় স্ত্রীর কাছ থেকে। দেখতে হবে যেন চলার পথে স্বামীর পদস্খলন না হয়। স্বামী কখনও নিরুৎসাহ হয়ে না পড়েন। ক্লান্ত না হন বা সাফল্য সম্বন্ধে হতাশা না আসে। স্ত্রীর কাজ অনবরত স্বামীকে উৎসাহ দেওয়া। ঐ সময় স্ত্রীও নিজেকে শিক্ষার কাজে নিযুক্ত রাখতে পারেন। অমূল্য সময় কখনোই হাতছাড়া করা উচিত নয়। জ্ঞানের স্পৃহাই মানুষকে তৎপর করে তুলতে সাহায্য করে। স্বামীর কাজে সহায়তা করে স্ত্রীরা প্রচুর আনন্দ আর প্রফুল্লতা লাভ করতে পারেন। মানব জগতের জ্ঞানভাণ্ডারকে বাড়িয়ে তোলার জন্য পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা অসীম। কলেজ শিক্ষাই সব নয়। স্ত্রী হিসাবে স্বামীর নতুন কোনো শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা পূরণে উৎসাহ দিতে থাকুন আর তারই সঙ্গে নিজেও শিক্ষিত হয়ে উঠুন। স্ত্রীর কর্তব্য হল, যে স্থায়ী জীবনে নিজের উন্নতির জন্য উৎসুক সেই স্বামীর কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা আর সেই ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। স্বামীর সব সাফল্যই ভবিষ্যৎ জীবনে এক অপরিসীম সুখ আর আনন্দ বয়ে আনতে পারে।
আমরা যদি আমেরিকান স্কুল ও কলেজের অ্যাসোসিয়েশন দেওয়া হোরেশি ও এলজার এডওয়াড পুরস্কারে ভূষিত মানুষদের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, এইসব পুরস্কার প্রাপক হলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট লুভার। লুভার ছিলেন আইওয়ার একজন কর্মকারের অনাথ সন্তান। এছাড়া হেনরি ক্রোস্টন-যিনি এক সময়ে একজন সুইচবোর্ডে অপারেটর ছিলেন আর বর্তমানে তিনি বিরাট এক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। টমাস জে. ওয়াটসন নামে আর একজন সপ্তাহে মাত্র দু’ডলার পারিশ্রমিকে জীবন শুরু করে বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনের প্রেসিডেন্ট। পল ইবম্যান প্রথম জীবনে শ্রমিক হিসেবে জীবন শুরু করেন। বর্তমানে হয়েছেন বোর্ড অফ স্টুডিবেকার কর্পোরেশনের প্রধান। তাই স্ত্রীদের মনে রাখা উচিত, আপনার স্বামীর শিক্ষার সুযোগ নিয়ে আপনারই উৎসাহ কাজে লাগিয়ে জীবনে চমৎকার প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেন।
পৃথিবীতে এই রকম অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে একজন সত্যিকারের কর্মতৎপর মানুষ তার জ্ঞান ও কর্মকুশলতা বৃদ্ধি করার কাজে অনেক বেশি আগ্রহশীল হয়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. লরেন্স বলেন : ‘একটি মাত্র জিনিসই মানুষের মনকে শিক্ষাদান করতে পারে-আর তা হল নিজের মনকে ইচ্ছা করে কাজে লাগানো। আপনি মনকে চালনা করে তাকে সহায়তা দিতে পারেন, পথ দেখাতে পারেন, প্রস্তাব দিতে পারেন। যা প্রতিদিনের চেষ্টায় পাওয়া যায় তাই প্রকৃত লাভ। মনের ইচ্ছাই তাই উন্নতির প্রকৃত সহায়ক।
১১. হঠাৎ দুর্যোগে মন শক্ত রাখুন
নিউইয়র্ক শহরের জোসেফ আইজেনবার্গ এক কাপড় ধোলাইয়ের কারখানায় কাজ করত। হঠাৎ তাকে বরখাস্ত করা হয়। আইজেনবার্গ দম্পতি চিন্তায় ভেঙে পড়ে। শেষ পর্যন্ত জমা সামান্য পুঁজি দিয়ে তারা ছোট একটা রুটির কারখানা কিনে নিল। তারা আগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু করল। মিসেস আইজেনবার্গ বাড়ির কাজকর্ম সামলে রুটির কারখানায় কাজ করে চললো। আট-দশ ঘন্টা কাজ করে মিসেস আইজেনবার্গ নিরুৎসাহ হয়ে পড়লো না। আনন্দের সঙ্গেই কাজ করে গেল। পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের ব্যবসা উন্নতির মুখ দেখলো। দুর্যোগের মধ্যে কখনোই ভেঙে পড়া ঠিক নয়, তাতে জীবন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
আর একটি কাহিনী বলবো। মহিলার নাম মিসেস উইলিয়াম আর কোলম্যান তিনি থাকতেন টেনেসিতে। মিসেস কোলম্যান শুধু যে স্বামীর কাজেই সাহায্য করেন তাই নয়, নিজের অবলম্বিত ব্যবসার মধ্যে দিয়ে তার সমস্ত উপার্জনই তিনি পরিবারের স্বচ্ছলতার কাজে লাগিয়েছিলেন। মিসেস কোলম্যান ছিলেন একজন নার্স।
১৯৩৬ সালে মিসেস কোলম্যান যখন মি. কোলম্যানকে বিয়ে করেন তখন উইলিয়াম কোলম্যান দিনের বেলা চাকরি আর রাতের বেলা নৈশ স্কুলে শিক্ষালাভ করতেন। মি. কোলম্যান শত বিপদেও একদিনও অনুপস্থিত থাকেন নি। ছ’বছর পর তিনি মা স্ত্রী ও মেয়ের আনন্দের পরিপ্রেক্ষিতে ডিপ্লোমা গ্রহণ করেন। একদিন ছিল যখন বিল কোলম্যান রঙ না করা লোহার রান্নার আসবাবপত্র বিক্রি করেছিলেন আর সে কাজে তাকে সাহায্য করতেন তারই স্ত্রী। এরপর একসময় বিলের বাবা মারা যান। বিলের ভাইয়ের একটা ছাপাখানা ছিল, বিল ও তাঁর স্ত্রী ভাইয়ের অংশ কিনে নেন। হেলেন কোলম্যান আমাকে লিখেছিলেন: আমি এটা বুঝতে পেরে আনন্দিত যে আমাদের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তাহলে পাঁচ বছরের মধ্যেই আমাদের বাড়ি আর ব্যবসার ঋণ শোধ করতে পারবো। তারপর আমার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিল আর ছেলে-মেয়েদের জন্য সেবার কাজ করতে শুরু করব।
মিসেস কোলম্যান আর মিসেস আইজেনবার্গের জীবনের এই উদাহরণ আমাদের শিক্ষণীয়। একজন সতিকার বাস্তববাদী স্ত্রীর কাহিনী।
জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন স্ত্রীকে স্বামীর চাকরিহীন বা অসুস্থতার জীবনে সাময়িকভাবে কাজে লাগাতে হয়। স্বামীর কাজে সহায়তা করে তার অংশীদার হওয়া আনন্দের কাজ, এর ফলে জীবন সুখময় হয়ে ওঠে।
এক মহিলার কথা এখানে উল্লেখ করবো। বিপদের মধে পড়ে ভদ্রমহিলা চমৎকার মানসিক শক্তির পরিচয় দিয়ে কাজ করে যান আর পরিবারকে বাঁচানোর জন এক নতুন উপায় উদ্ভাবন করেন। মহিলার নাম মিসেস জিনা স্টার্ন। তিনি নিউইয়র্কের ৪২২ স্ট্যানলি অ্যাভিনিউয়ের, ওয়েস্টফিল্ডে স্বামী ও পাঁচটি সন্তান নিয়ে বাস করেন।
মিঃ স্টার্ন পেশায় একজন সেলসম্যান। কঠিন রোদে আক্রান্ত হয়ে তিনি কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। স্ত্রী এবং সন্তানদের ভরণপোষণ তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় মিসেস স্টার্ন খুবই চিন্তায় পড়ে যান। তিনি ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। তার একটি বিশেষ গুণ ছিল। তিনি খুব ভালো রান্না করতে পারতেন। ব্যাপারটা তিনি কথায় কথায় কয়েকজন পরিচিত মানুষদের বলে ফেলেন। তারা তাদের দেওয়া পার্টির খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব এরপর মিসেস স্টার্নকেই দিতে শুরু করেন। মিসেস স্টার্নের রান্না করা চমৎকার সুস্বাদু খাবার সকলের দারুণ পছন্দ হল। অল্প দিনের মধ্যেই তার পরিচিতি আর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। এরপর অযাচিতভাবেই মিসেস স্টার্ন খাবারের বায়না পেতে লাগলেন। এক সময়ে মিসেস স্টার্ন একজন বিখ্যাত খাদ্য সরবরাহকারিণী হয়ে উঠলেন। বর্তমানে মিসেস স্টার্ন তাঁর প্রসিদ্ধ শীতল বিস্কুটের প্যাকেটেও পার্টি উপলক্ষ্যে খাবার সরবরাহ করে থাকেন প্রায় পঞ্চাশ মাইল এলাকা জুড়ে। মিসেস স্টানের ব্যবসা এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বামী মি. স্টার্নকেও কাজে নামতে হল। তিনিই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার।
মানুষের জীবনে দুঃসময় যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে। আচমকা এমন দুর্যোগ এলে ভেঙে না পড়ে মন শক্ত রাখতে হবে। এই ধরনের কোনো অবস্থার জন্য সবাইকেই কিছু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে অর্থ উপার্জনের একটা বিকল্প পথ অনুসন্ধান করতে হবে। যাতে বিপদের সময় সেই বাধা অতিক্রম করা যায়।
এই পরিচ্ছেদ শেষে এই কথাই আমরা বলবো যে, স্বামীকে অতিরিক্ত সাহায্য দানের চারটি নিয়ম আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন :
১। স্বামীর কাজ সম্বন্ধে স্ত্রী হিসেবে অবহিত থেকে তাকে সাহাযের জন্য এগিয়ে দিতে হবে।
২। স্বামীর সেক্রেটারীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।
৩। শিক্ষার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে তাতে লেগে থাকতে অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিতে হবে। নৈশ স্কুল বা এমন কী বাড়িতে বসেও তিনি যাতে বাড়তি শিক্ষালাভ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। আকস্মিক কোনো দুর্যোগ বা অসুবিধার জন্য মনকে তৈরি করে রাখতে হবে। প্রয়োজনে কাজে আত্মনিয়োগ করার উদ্দেশ্যেও নিজেকে তৈরি করতে হবে। এজন্য নিজের কর্মকুশলতা যাতে বাড়ে সে দিকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
১২. নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলুন
এক ধরনের মহিলাদের দেখা যায়, যারা স্বামীদের নিজের কাজের জায়গাতেই আবদ্ধ রাখতে চান-তারা কোনো অবস্থাতেই স্বামীদের অন্য জায়গায় যেতে দিতে রাজি হন না। অনেক সময় এই ধরনের মহিলারাই হয়ে ওঠেন পুরুষের উন্নতি লাভের প্রধান অন্তরায়।
এটা ঠিক কথা যে, নিজের পরিচিত গণ্ডি নিজের বাসস্থানটি ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে বেশ একটু সাহসের প্রয়োজন হয়। মেয়েরা এ ব্যাপারে প্রকৃতিগত দিক থেকে দক্ষ হতে পারে। অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সুখের সংসার গড়ে তুলতে পারে একমাত্র মেয়েরা। এর জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা। একজন সহনশীলা স্ত্রীই চলার পথে সব বাধা কাটিয়ে উঠতে পারেন। এই রকমই একজন মহিলা ছিলেন মিসেস লিওনার্ড কাসনার। মিসেস কাসনার উওম্যান’স ডে ম্যাগাজিন নামের এক পত্রিকায় নিজের কাহিনী লিখেছিলেন। তিনি যা লেখেন তা হল এই রকম :
দু’বছর আগে আমার স্বামীর ডাক পড়েছিল এক নৌযুদ্ধে যোগদান করার জন্য। আমাকেও যেতে হল সঙ্গে। কিন্তু আমাদের নতুন সুন্দর বাড়ি ছেড়ে মাত্র দু’বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে যেতে হবে জেনে, বিশেষ করে বিদেশে, আমার মন খুবই খারাপ হয়ে যায়। উপায়হীন হয়ে আমাকে যেতে হল, স্বামীর সঙ্গে প্রথম সেনা ছাউনীতে হাজির হলাম।
আমি কেবলই ভাবছিলাম যে, আমদের চরম দুঃখের দিনই বোধ হয় এসে গেছে। কিন্তু আবহাওয়া আর নতুন নতুন জায়গায় ঘোরার পর ভেবে দেখতে লাগলাম ব্যাপারটা সত্যিই তো তেমন খারাপ হল না। আমার স্বামী তাড়াতাড়ি কাজ থেকে অবসর নিতে চলেছেন। আমরা আবার ফিরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করবার চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেছি। ভবিষ্যৎ জীবনের হাতছানিতে রোমাঞ্চিত হয়েও কিন্তু বর্তমান জীবন থেকে সরে যাওয়াটাও খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
এই নতুন জীবনের দু’টো বছর যেভাবে কাটালাম তাতে আমি কৃতজ্ঞ না হয়ে পারছি না। দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সমস্ত অসুবিধা এখন আমি কাটিয়ে উঠতে শিখেছি।
আজ আমি বুঝতে শিখেছি যে, সুখের ঘর সংসার বলতে কেবল কিছু সুযোগ সুবিধা আর বস্তুকেই বোঝায় না-বরং যে সব মানুষের সংশ্রবে আমরা বাস করি তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতাকেই বোঝায়। পারস্পরিক প্রীতি ও ভালবাসা, মূল্যবোধ আর পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে জীবন উপভোগই আসল জীবনের মাধুর্য।
.
কোনো কারণে যদি পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে কোথাও যেতে হয় এবং সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়, তাহলে নিচের চারটি পরিকল্পনার কথা মনে রাখা প্রয়োজন।
(১) এ কথা কখনও মনে করতে নেই বা এ ধরনের আশা পোষণ করতে নেই যে, নতুন জায়গায় পরিচিত পরিবেশ পাওয়া যাবে। স্বামীর আগের চাকরি বা কর্মস্থল যদি কোনো ভাবে বর্তমানের চেয়ে কম মর্যাদার হয় তাহলে নিরুৎসাহ হবার কিছু নেই। মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান অতীতের থেকে বেশি মর্যাদা আনতে পারে।
২) অভ্যস্ত আর পরিচিত সুযোগ-সুবিধা থেকে হঠাৎ বঞ্চিত হতে হলেও ভেঙে পড়ার কিছু নেই। যা পাওয়া যাচ্ছে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থেকে নিজের কর্মশক্তিকে পরীক্ষা করতে হবে। আত্মবিশ্বাসই হল মূল শক্তি, এই বিশ্বাস হারানো উচিত নয়।
আমার নিজের জীবন থেকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি : এক গ্রীষ্মকালে আমার স্বামী উইওমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাকোর্সে শিক্ষা দান করছিলেন। থাকার জায়গার অভাবে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম প্রবীণ সৈনিক ও তাদের পরিবারদের জন্য তৈরি অস্থায়ী বাড়ির একটিতে। আমি ভাবতেই পারি নি যে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আমার ভুল ভেঙে গেল। ওখানে বাস করতে গিয়ে আমি আমার জীবনের এক মূল্যবান আর শ্রেষ্ঠ পুরস্কারই লাভ করেছিলাম।
এক সুন্দর অভিজ্ঞতা আমার লাভ হল। আমি দেখলাম আমার কাছাকাছি যারা ছিল তারা কেমন নিশ্চিন্ত আরামেই জীবনধারণ করছে। সব কিছু স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখে নিজের মনোভাবের জন্য লজ্জিত হলাম। বহু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার অভিজ্ঞতাও অনেক বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম যে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে কৃতকার্যতা ও আনন্দের কোনো সম্পর্ক নেই, সবটাই মানসিক।
(৩) যে অবস্থার মধ্যে পড়ুন না কেন কখনোই অবস্থার ভালো-মন্দ না দেখে বিচার করা ঠিক নয়।
আমার পরিচিত একজন মহিলার কথা বলছি। মহিলাটির স্বামীর পদোন্নতির ফলে অন্য জায়গায় বদলী হন। স্বামীর সঙ্গে মহিলাটিও নতুন বড় কোনো শিল্প শহরে গেলেন। কিন্তু পরিবেশে মানাতে না পেরে চব্বিশ ঘন্টা পরেই নিজের শহরে চলে এলেন। স্বামীকে এরপর দু’জায়গায় খরচ চালাতে হল আর সমস্ত আয়ই নিঃশেষ হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক আগে মাইনের, আগের পদ ও জায়গায় ফেরার আবেদন জানালেন যেহেতু ভদ্রলোকের স্ত্রী পদোন্নতির জায়গা পছন্দ করেন নি।
(৪) নতুন সুযোগ-সুবিধার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করুন-পিছনে ফেলে আসা কিছুর জন্য চিন্তা করবেন।
নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে যেতে হলে প্রথমেই সেখানে নিজে এগিয়ে গিয়ে মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হয়। যে সব কাজকর্ম আপনার রুচি-বিরুদ্ধ তার সম্বন্ধে অনুযোগ না জানিয়ে সেগুলোর উন্নতি সাধনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই নিষ্কলঙ্ক নয়-প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকটির মধ্যে দোষ, গুণ, সমানভাবে থাকে।
আর এক মহিলার কথা আপনাদের শোনাব। তিনি হলেন মিসেস রবার্ট ওয়াটসন। তিনি বর্তমানে থাকেন ওকলাহোমায়। তিনি তার স্বামীর সঙ্গে প্রায় সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন। তার স্বামী মি. ওয়াটসন কার্টার অয়েল কোম্পানীর ভূতাত্ত্বিক।
ওয়াটসন দম্পতি তাদের চারটি সন্তানকে নিয়ে পৃথিবীর সুদূর আদিম পরিবেশের মধ্যে কাটিয়েছেন। ওইভাবে অচেনা অজানা পরিবেশে বাস করে আশ্চর্য অভিজ্ঞতা লাভ করে তারা প্রচুর আনন্দও পেয়েছেন। ওয়াটসন পরিবারের মতো সত্যিকার আদর্শ পরিবার পাওয়া সত্যিই কঠিন ব্যাপার।
মিসেস ওয়াটসন অত্যন্ত দক্ষ মহিলা। তিনি বলেন, যে কোনো মুহূর্তে আমি আমার পরিচিত পরিবেশ আর বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে দ্বিধা বোধ করি না। আমার অনুভূতি আর প্রবণতাকে এই অতি সহজ কাজ করার জন্য তৈরি রাখি। আমাদের পরিবার আজ বুঝতে পেরেছে যে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় তাদের সকলকেই সমান আনন্দ, শিক্ষা আর উপভোগের সমস্ত রকম উপকরণই সরবরাহ করতে পারে। এরজন্য যে আগ্রহের প্রয়োজন হয় তার সবটুকুই আমাদের সকলের আছে। সুদূর বাহামা দ্বীপপুঞ্জে থাকার সময় হঠাৎ জানা যায় যে, একজন বিখ্যাত ডুবুরী, সমুদ্রে ডুবুরীর কাজ সম্বন্ধে চিত্তাকর্ষক শিক্ষা দান করছে। আমাদের মেয়ে সুমির ডুবুরীর কাজে আগহ থাকায় ওই মানুষটির কাছে তাকে পাঠালাম আর অল্প কিছুদিনের মধে সে চমৎকার দক্ষতা অর্জন করলো। আমরা যদি অন্য কোথাও থাকতাম তাহলে এমন আনন্দময় অভিজ্ঞতা কখনোই অর্জন করতাম না।
মিসেস ওয়াটসন আরও বলেন যে, আমি একসময়ে কোনো এক প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিচালককে মন্তব্য করতে শুনেছি তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে সেই কর্মীদেরই নিয়োগ করেন যাদের স্ত্রীরা যে কোনো জায়গায় সানন্দে যেতে প্রস্তুত।
.
এই সব ঘটনা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, বিদেশে বা অপরিচিত কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকলে নিজেদের উন্নতির পথই পরিষ্কার হয়। তাই কোনো অনুযোগ না জানিয়ে বিদেশে চাকরির সমস্ত সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা উচিত। প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীর কাজ যদি এই ধরনের হয় তবে সব সময় তাকে উৎসাহিত করা।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘সঞ্চরণশীল প্রস্তরখণ্ডে শেওলা ধরে না।’ কথাটি খুবই সত্য, প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীকে ওই প্রবাদের মতো সঞ্চরণশীল পাথর হতে উৎসাহিত করা।
কতকগুলি নিয়ম আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন :
১। এই ধরনের আশা কখনোই করা ঠিক নয় যে, নতুন পাওয়া পরিবেশ আপনার আগের পরিবেশের মতোই হবে।
২। আপনার অভ্যস্ত পরিচিত সুযোগ-সুবিধার স্মৃতি মনে না রাখাই ভালো, অতীতের চিন্তা মন থেকে মুছে না ফেললে বিরক্তির শিকার হতে হবে। তাই অতীতের স্মৃতিতে অবগাহন করা ঠিক নয়।
৩। নতুন কোনো কাজে নতুন জায়গায় আসতে হলে কখনোই সেই কাজ আর পরিবেশকে ভালোভাবে পরীক্ষা না করে এমন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না যে, ‘এই কাজ বা জায়গা আপনার পক্ষে উপযোগী হবে না।’
৪। নতুন পাওয়া সুযোগকে সুফলদায়ী করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আগের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা ভাবনা করে কাতর না হওয়াই ভালো।
১৩. স্বামীর কাজে প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলুন
বেশ কিছুদিন আগের কথা। হঠাৎই আমাদের এক পুরনো বন্ধু দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁকে দেখে খুব ক্লান্ত বলে মনে হল। তাঁকে প্রশ্ন করতে তিনি বললেন, ‘খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছি, কী করা উচিত ঠিক করতে পারছি না। কয়েক মাস ধরে ওভার টাইমে কাজ করছি, এর কারণ হল আমাদের প্রতিষ্ঠানের একটা নতুন শাখা খোলার চেষ্টা হচ্ছে। খুব বেশি পরিশ্রম হচ্ছে, বাড়ি ফিরতে খুবই রাত হয়। স্ত্রী খুবই রাগারাগি করে, রাত করে বাড়ি ফেরার জন্য। তার মত হল, বিকেলে সময় মতো ফিরতে না পারার জন্য আমার স্বাস্থের ক্ষতি হচ্ছে। অথচ এই নতুন শাখা খোলা আমাদের দুজনের পক্ষেই অত্যন্ত দরকারি। কিন্তু দুঃখের কথা হল আমার স্ত্রী হেলেনকে কিছুতেই কথাটা বোঝাতে পারছি না। স্ত্রীর কথা মনে করে আমি কিছুতেই নিজের কাজে মন দিতে পারছি না।’
এই বন্ধুটির মতো সমস্যা হয়তো আজ অনেকেরই। ঠিক এই রকম সমস্যার সম্মুখীন আমাকেও এক সময় হতে হয়েছিল, যখন আমার স্বামী একখানা বই লিখছিলেন। ওই সময় আমাদের দুজনের মধ্যে কার বেশি কষ্ট হয়েছিল সেটা প্রায় জানতেই পারি নি। যদিও আমার স্বামী বাড়িতে থেকেই তাঁর লেখার কাজ করতেন, তাহলেও দেখতাম লাইব্রেরীতে কিছু না লিখে তিনি শুধু চুপচাপ বসে চিন্তা করে চলেছেন। আর গভীর রাত অবধি তিনি সেটা করে যেতেন।
এই অবস্থার মধ্যে পড়ে আমরা একসঙ্গে কোনো সামাজিক কাজকর্মে বা অনুষ্ঠানে যেতে পারতাম। কোনো জায়গায় যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে সময়টা নির্জন বাস বলেই মনে হতো। তবে আমার একান্ত আপনজন ডেল কার্নেগীর খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রামের কোনো ব্যাঘাত না হয় সেদিকে আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলাম।
আমি অহঙ্কার করে বলতে চাই না তবে কথা ঠিক যে কোনো কাজ স্বামীর কাছে যতই চিত্তাকর্ষক বা প্রয়োজনীয় মনে হোক না কেন, কোনো স্ত্রীর পক্ষে সেটা অম্লানবদনে মেনে নেওয়া নেহাতই কঠিন কাজ।
তবুও একজন স্ত্রী হিসেবে এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হল, অসুবিধা যতই হোক যে কোনো স্ত্রীরই কর্তব্য হবে মুখ বন্ধ রেখেই নিঃশব্দে আমাদের স্বামীর দেহরক্ষী হয়ে তাদের নৈতিক ভাবধারা বজায় রাখায় সহায়তা করে যাওয়া, আর পাশে থাকা।
স্ত্রী হিসাবে আমাদের দেখতে হবে যে কীভাবে স্বামীদের কাজে সাহায্য করতে পারি যাতে স্বামীরা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারেন।
কয়েকটি সুন্দর মতবাদের আমরা উল্লেখ করবো যা, যে কোনো মানুষের পক্ষেই এগুলো প্রযোজ্য।
মতবাদগুলি হল :
১। যখন স্বামী কোনো কঠিন পরিশ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত থাকবেন, তখন স্ত্রী হিসাবে আপনার কর্তব্য হবে তাকে উপযুক্ত খাদ্য দেওয়া। তাঁকে এই সময় একেবারে বেশি খাদ্য না দিয়ে অল্প খাবার কয়েকবার দিতে হবে। খাদ্য যেন সহজ পাচ্য হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। খাদ্য হিসাবে এই সময় সবচেয়ে ভালো হতে পারে টাটকা ফল, যেমন–আপেল, ফলের রস, আতাফল, স্যালাড, গাজরের তৈরি খাবার ইত্যাদি।
২। স্বামীর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকার সময় নিজের কথা ভুলে গেলে চলবে না। নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, নিজেকে সকলের কাছে প্রিয় করে তুলতে হবে। স্বামীর পরিচয়েই নিজেকে পরিচিত করে তুলতে চেষ্টা করতে হবে। অবসর সময়ে নিজেকে পড়াশুনা, গান-বাজনার মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে।
৩। আপনার আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের বুঝিয়ে বলতে হবে যে, কেন আপনার স্বামী বা আপনি মেলামেশায় অসুবিধা বোধ করছেন। এটা যে অল্প সময়ের জন্য সেটা তাদের বুঝিয়ে দিন। আর স্বামীর কাজে আপনার যে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে সেটা তাদের উপলব্ধি করান।
৪। আপনার স্বামীকেও বোঝাতে হবে যে, তাঁর পক্ষে আপনার সাহায্য ও সহযোগিতা কতখানি জরুরি। স্বামীকে উপলব্ধি করতে দিন যে আপনি সর্বদাই তাঁর পাশে আছেন। এবং পাশে থাকার প্রয়োজনীয়তাও আছে।
৫। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে সমস্ত ব্যাপারটাই সম্পূর্ণভাবে সাময়িক। আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, আপনি এই পরিস্থিতি বেশ আয়ত্তে আনতে পেরেছেন, তাহলে বুঝবেন এই বিরাট কর্মযজ্ঞে আপনি সফল হতে পেরেছেন। এখন আপনারা স্বামী-স্ত্রী এক নতুন জীবনে প্রবেশ করবেন।
১৪. সাধারণ কাজে সমন্বয় কীভাবে করবেন
কোনো মানুষেরই একভাবে মানুষের জীবন কাটে না। আমি এমন এক মহিলার কথা জানি, যিনি তার স্বামীকে তার নিজের পেশা ত্যাগ করতে একরকম বাধ্যই করেছিলেন। অসুবিধা যেটি সৃষ্টি হয়েছিল সেটি হল, ভদ্রলোককে প্রায়ই নিজের কাজে বাইরে রাত কাটাতে হতো। এ ব্যাপারটা তার স্ত্রী একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। ভদ্রলোক থিয়েটারে একজন বাদ্যযন্ত্রীর কাজ করতেন। অনুষ্ঠান চলতো রাতের বেলায়। ভদ্রলোক নিজের কাজে বেশ আনন্দ পেতেন, মাইনেও ছিল ভালো।
কিন্তু ভদ্রলোকের স্ত্রী রাত্রিবেলা একে থাকা সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে ওই বাদ্যযন্ত্রীর কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য করলেন এবং পরিবারগত যন্ত্রপাতি বিক্রির কাজ নিতে বললেন। কিন্তু ভদ্রলোকের নতুন কাজে অভিজ্ঞতা না থাকায় উপার্জন অনেক কমে গেল এবং জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল।
এ ব্যাপারে তাই একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, যেসব মানুষকে প্রচলিত সময়ে কাজ না করে অন্য কোনো সময়ে তাদের জীবিকায় কাজটি করতে হয় তাদের আসলে এমন স্ত্রী প্রয়োজন যিনি স্বামীর কাজের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে চলতে পারেন। বিশেষ করে যেসব জীবিকার এই অসুবিধা দেখা দেয় সেগুলি হল জাহাজের কাজ, রেলপথের কাজ, উড়োজাহাজের কর্মচারীর কাজ, সাংবাদিকতার কাজ। এইসব কাজে নিযুক্ত মানুষদের স্ত্রীকে স্বামীর কাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেই হবে। তাদের স্বামীর কাজে সন্তুষ্ট থাকা উচিত।
এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের কর্ম পদ্ধতিতে সময়ের কোনো ঠিক থাকে না। এদের কাজে প্রচলিত নিয়ম খুব একটা থাকে না বা থাকা সম্ভবও নয়। এই ধরণের মানুষের স্ত্রীদের জেনে রাখা দরকার যে তাদের সব দিক সামলেই চলতে হবে আর স্বামীর আয় অনুসারে সংসার চালাতে হবে।
বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত মানুষের মধ্যে এক বিশিষ্ট শ্রেণীর মানুষ হলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা, গায়ক, লেখক বা বাদ্যযন্ত্রী, খেলোয়াড় ইত্যাদি মানুষের। এসব আশ্চর্য বা অভিনব পেশায় নিযুক্ত মানুষের স্ত্রীদের ভাগ্য সাধারণ মানুষের স্ত্রীদের চেয়ে স্বভাবতই আলাদা। আর এই কারণে এই সমস্ত পেশার মানুষের স্ত্রীদের অনেকে আবার হিংসাও করে থাকেন। অবশ্য বিখ্যাত মানুষের স্ত্রী হওয়ার জন্য নিজের ও কিছু বিশেষ যোগ্যতা থাকা চাই। মিসেস লাওয়েল টমাসের মত হল এরকম হওয়া কখনোই সহজ কাজ নয়। এইরকম মহিলার সংখ্যা সত্যই বড় কম যিনি বিখ্যাত স্বামীর মতোই খ্যাতি অর্জন করেছেন। অথচ মিসেস টমাস নিজে কিন্তু তাই-ই হন। তাঁর স্বামী লাওয়েল টমাস একজন বিখ্যাত মানুষ। তিনি নিপুণ একজন সংবাদ প্রেরক, আবিষ্কারক, দুঃসাহসী রহস্য কাহিনীর রচয়িতা, বক্তা আর একজন খেলোয়াড়। তাদের জীবনটাই আরব্য উপন্যাসের মতো চিত্তাকর্ষক ও উত্তেজনা ভরা।
তাঁর স্ত্রী ফ্রান্সিস টমাসও একজন প্রতিভাময়ী ও নানা গুণের অধিকারিণী মহিলা। তিনি তাঁর বহুগুণে অধিকারী স্বামীর সঙ্গে প্রায় সারা পৃথিবী পর্যটন করেছেন।
সারা পৃথিবী এভাবে পরিক্রমার শেষে তারা আমেরিকায় স্থায়িভাবে বসবাস করার জন্য বাড়ি কেনেন। মিসেস লাওয়েল তার সারাজীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট সব কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন বৈমানিক, ভাগ্যান্বেষী সৈনিক ইতাদি বহু মানুষ। তারা কৃতজ্ঞতা জানাতে স্রোতের মতোই তাঁর বাড়িতে আসতেন। এই সময় মিসেস লাওয়েল টমাস চমৎকার এক অতিথিপরায়ণা রমণীর ভূমিকাই নিয়েছিলেন। তাঁদের বাড়িতে গড়পড়তা প্রায় প্রতি সপ্তাহে পঞ্চাশ থেকে প্রায় দুশ’জন পর্যন্তও অতিথি আসতেন।
মিসেস ফ্রান্সিস টমাসের স্বামী লাওয়েল টমাস যখন বিদেশ যাত্রা করতেন, তখন তাঁকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন জীবন কাটাতে হত। এমনই একদিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি খবর পান যে, তার স্বামী জার্মান আক্রমণের মুহূর্তে রাস্তায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।
এই ধরনের বহ ঘটনাই মিসেস টমাসকে বিচলিত করেছে। যেমন-১৯২৬ সালে মি. লাওয়েল টমাস একদিন আন্দালুনিয়া মরু প্রান্তরে উড়োজাহাজ থেকে নামার সময় দুর্ঘটনায় পড়েন। মিসেস টমাসকে তখন প্যারিসে থেকে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে খবরের জন্য সময় কাটাতে হয়।
আশ্চর্য ব্যাপার ইদানীংকালে আবার লাওয়েল টমাসের একমাত্র সন্তান লাওয়েল টমাস জুনিয়র বাবার পথই অনুসরণ করে বিপদসংকুল পথে পাড়ি দিতে শুরু করেছেন। মিসেস টমাসকে স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের জন্যও উদ্বিগ্ন থাকতে হচ্ছে।
মিসেস ফ্রান্সিস টমাসের জীবনের সামান্য এই দু’চারটি উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, বিশিষ্ট কোনো মানুষের স্ত্রী হওয়ার জন্য প্রয়োজন কোনো বিশিষ্ট স্ত্রীলোকের। সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা কখনোই সম্ভব হবে না।
বিখ্যাত মানুষের স্ত্রীদের অনেকেই ঈর্ষা করে থাকেন, সম্মান পাওয়ার জন্য অনেকেই লালায়িত হয়ে থাকেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না বা অনুভব করেন না এর মধ্যেও নানারকম যন্ত্রণাবোধ লুকিয়ে থাকে।
মেরীল্যান্ডের গভর্নরের স্ত্রী মিসেস থিওডর ম্যাক কেলডিনের মত হল, এই অবস্থাতেও নানা ধরনের সমস্যা আর অসুবিধার ব্যাপার থাকে। মিসেস কেলডিন তার তড়িৎ গতিসম্পন্ন ও উচ্ছ্বসিত মেজাজ আর ভাবাবেগ সম্পন্ন স্বামীর যোগ্য স্ত্রী। তিনি অত্যন্ত শান্ত, নম্রভাষী, শিষ্টাচারিণী, আর নরম স্বভাবের মহিলা।
মিসেস কেলডিন বলেন, তাঁর স্বামী সারাদিন অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে সারাদিন তাঁদের দেখাই হতো না। কিন্ত তা নিয়ে কোনো অভিযোগ তার মনে নেই। তিনি সব সময় স্বামীর কোনো সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হন ও স্বামীর সঙ্গেই থাকেন।
তিনি বলেন, আমার জীবনযাত্রায় আমি একটুও দুঃখ অনুভব করি না। আমাদের মিলিত ভ্রমণ আর সাহচর্য থেকে আমরা যে আনন্দ পাই তা আমাদের দুজনের কাছেই মূল্যবান আর স্মরণীয়।
লাওয়েল টমাস এবং ম্যাক কেলডিন এই দুজন মানুষের স্ত্রী যে তাদের স্বামীদের কেবল শ্ৰদ্ধার চোখে দেখতেন তা নয় বরং স্বামীদের কাজের অসুবিধা ও খ্যাতির উচ্চ মর্যাদার অসুবিধাটুকুও সমানভাবে গ্রহণ করেন। এরাই সত্যিকার আদর্শ স্ত্রী।
.
সুতরাং বলা যায়, আপনাদের স্বামীদের কাজের ধারা যদি এমন হয় যে সাধারণ সচরাচর দেখা যায় তা নয়, তাহলে নিচের নিয়মগুলো মেনে চললে সুবিধা হবে:
১। আপনাদের জীবনে বর্তমান কোনো অসুবিধা যদি অস্থায়ী হয় তাহলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় থেকে সহ্য করতে হবে।
২। এই অবস্থায় কোনো কারণে যদি দীর্ঘস্থায়ি বলেই মনে হয়, তাহলে তার প্রতিকার করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন-মিসেস ম্যাক কেলডিন করেছিলেন।
৩। মনে রাখতে হবে, স্বামীর সাফল্যেই আপনার সাফল্য। তাই তাঁর উন্নতির জন্য যে কাজ করা উচিত তা করুন এবং সমস্ত কাজের ফল হাসি মুখে গ্রহণ করতে শিখুন।
৪। মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু বিনা বাধায় বা অসুবিধার মধ্যে দিয়ে কখনোই পাওয়া যায় না।
৫। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই অসুবিধা রয়েছে। যে সমস্ত মানুষ শুধুমাত্র অসুবিধার কথা ভাবতে থাকে, তারা কখনোই সন্তুষ্ট হতে পারে না। বিনা কারণে কাতর হয় বলে তাদের খুশি থাকা কঠিন কাজ।
১৫. স্বামীর কাজে বিরক্ত না হওয়ার উপায়
স্বামীর কাজের সঙ্গে যে কোনো স্ত্রীরই বিশেষ একটা মনোভাব জড়িত থাকা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষত, স্বামীর কাজের সময় নিয়ে অসুবিধার যেটা সৃষ্টি হয় সেটা হল স্বামীর কাজের নির্দিষ্ট থাকে না তার স্ত্রীর কাছে। হয়তো এমন পুরুষকে আপনি বিয়ে করেছেন যার কাজের বেশির ভাগ সময় কাটে বাড়িতে। এসব ক্ষেত্রে আপনার দিক থেকে বিরোধিতা যেমন থাকবে, তেমন একটা আপসের মনোভাব নিয়েও আপনাকে চলতে হবে।
স্বামীর প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ থাকলে সুন্দরভাবেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়। এ বাপারে একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
ক্যাথারিন গিল্লিস হলেন ডন গিল্লিসের স্ত্রী। ডন গিল্লিস হলেন একজন বিখ্যাত সিম্ফনি কনসার্টের রচয়িতা। তিনি এন. বি. মি. সিম্ফনির জনক। সঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ সঙ্গীত বিশারদ আর্থার ফিডলার আর অন্যান্য কনসার্ট ও ডন গিল্লিসের সঙ্গীত কাজে লাগানো হয়। এই ডন গিল্লিস কিন্তু তার বেশির ভাগ সঙ্গীতই রচনা আর সম্পাদনা করেন নিজের বাড়িতে বসেই। নিজের আলাদা পাঠাগার থাকা সত্ত্বেও গিল্লিস কিন্তু খাওয়ার টেবিলে বসে কাজ করতে পছন্দ করেন।
স্ত্রী ক্যাথারিন খুব শান্ত চরিত্রের মহিলা বলে স্বামীর কোনো কাজেই আপত্তি করেন না।
ক্যারিন গিল্লিস নিজেদের বাড়িতে কাজ আর বিশ্রাম এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গড়ে তুলেছেন নিজেকে। স্বামীর কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়ার দিকে তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখেন, বাড়ির সব খরচের হিসাব নিকাশের ব্যাপারেও তিনি লক্ষ্য রাখেন। সাংসারিক সমস্ত কাজটাই মিসেস গিল্লিসের পূর্ণ এক্তিয়ারভুক্ত। এ কাজে তিনি প্রচুর আনন্দ পান। তিনি বলেন, কোনোভাবে যদি এ কাজে একবার আত্মনিয়োগ করা যায়, তাহলে কাজটা শুধু যে সহজ হয় তা নয় প্রচুর আনন্দও পাওয়া যায়। আমি ডনকে বোধ হয় হারিয়ে ফেলতাম সে যদি সারাদিন কোনো স্টুডিওতে কাজে ব্যস্ত থাকতো। সারাদিন তাকে কাছে পাওয়ায় আমি অবস্থার সঙ্গে চমৎকার ভাবেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, কতগুলো সাধারণ নিয়ম যদি মানা যায় তাহলে স্বামীর কাজে সাফল্যজনক ভাবে সাহায্য করা কোনো শক্ত কাজ নয়।
মিসেস ক্যাথারিন গিল্লিস নিম্নে কয়েকটি নিয়মের উল্লেখ করেন :
১। স্বামীকে যতদূর সম্ভব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, আপনার সহায়তায় আপনার স্বামী কতখানি সন্তুষ্ট, নিজের কাজে আপনার স্বামী কতটা আত্মনিয়োগ করতে পারছেন।
২। খেয়াল রাখতে হবে, পাওনাদারদের ডাকাডাকিতে স্বামীর কাজে যেন বাধা সৃষ্টি না হয়। এদের সামলানো আপনারই কর্তব্যের অঙ্গ হওয়া উচিত। মনে করতে হবে, স্বামী কাজের তাগিদে যেন বাড়িতে নেই।
৩। কোনো কারণে সহজে বিপর্যন্ত হওয়া মনোভাব বদলানোর চেষ্টা ঠিক নয়। স্বামীর কাজ যদি সুচারুভাবে সম্পন্ন না হয় তাহলে তিনি বিরক্ত হতে পারেন। এই অবস্থায় শান্ত হয়ে স্বামীর মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করা উচিত।
৪। কোনো সময় যদি বাড়িতে কোনো সামাজিক উৎসব করার প্রয়োজন হয়, সেটা এমন ভাবে করতে হবে যাতে স্বামীর কাজকর্মের ব্যাঘাত না জন্মায়।
৫। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার ব্যাপারেও আপনাকে নজর রাখতে হবে। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে কাজের সময় ঠিক করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, আপনাদের দুজনেরই কর্তব্য সন্তানদের সঠিক পদ্ধতিতে পালন করা।
উপরের এই পাঁচটি নিয়ম সম্পর্কে এইটুকু বলা যায় যে, কার্যক্ষেত্রে এগুলো ফলপ্রসূ হবেই।
১৬. আপনার কাজ কি স্বামী-স্বার্থ বা রুচি বিরোধী
পারিবারিক জীবনে বহু স্ত্রীকেই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তা হল নিজের কাজ সম্পর্কে। অর্থাৎ স্ত্রীর যদি নিজের জীবিকা বা শখের জন্যেও কোনো চাকরি বা নিজস্ব কোনো কাজের ধারা থাকে সেই কাজ বা চাকরি তিনি ত্যাগ করতে রাজি কিনা।
মনে রাখবেন কোনো মানুষের সফলতার ক্ষেত্রে যে কোনো রকম আংশিক সহায়তা একটা পুরো কাজের সমান সাহায্য দিতে পারে। এ ব্যাপারে এক সুন্দরী তরুণীর জীবনের উদাহরণ তুলে ধরছি। তরুণীর মনের ধারণা ছিল যে, নিজের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার বিষয়কেই প্রথম স্থান দিতে হবে। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হল যে কোনো এক বিশেষ পরিস্থিতিতে তার এই ধ্যান-ধারণা একেবারে পরিবর্তন হয়ে যায়।
জেট্টা ওয়েলস ছিলেন বিখ্যাত আবিষ্কারক কার্বেথ ওয়েলসের স্ত্রী। অতি সুন্দরী জেট্টা ওয়েলসের নিজস্ব এক আকর্ষণীয় জীবন নির্বাহের উপায় ছিল। কাবেথ ওয়েলসের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই এটা ছিল।
জীবনটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য জেট্টাওয়েলসের সত্যিই কৃতিত্ব ছিল। তিনি ছিলেন। কৃতকর্মা মহিলা। তাঁর কাজ ছিল বেতারে শিক্ষাদান করা। অনেক সফল বিখ্যাত মানুষের ব্যবসার কাজও তিনি তত্ত্বাবধান করেছিলেন। এভাবেই একদিন কার্বেথ ওয়েলসের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে।
কার্বেথ ওয়েলস তার কাছে উন্নতির পথ খুঁজতে এসেছিলেন। এভাবে দুজনের মধ্যে ভালবাসা জন্মায় এবং দুজনে বিয়ে করেন। বিয়েতে একটা শর্ত ছিল বিয়ের পর জেড়া ওয়েলসের উদ্দীপনাময় কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
এরপর কোনো এক বছর জুন মাসে কার্বেথ ওয়েলস রওনা হন রাশিয়া আর টোকিও শহরের উদ্দেশ্যে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মাউন্ট আরারাথ পর্বতের শৃঙ্গে ওঠা। স্ত্রী জেষ্ট্রার পরিকল্পনা ছিল বাড়িতে থেকে নিজের ব্যবসা আর কাজকর্ম চালানো। কিন্তু ওয়েলস যখন যাওয়ার ব্যাপার শেষ করে ফেললেন, জেট্টা ওয়েলস পিছিয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি পাহাড়ের হাতছানি আর স্বামীর সাহচর্য এড়িয়ে যেতে না পেরে এক দুঃসাহসী অভিযানে রওনা হলেন। সে অভিযান ছিল ভয়ঙ্কর কঠিন।
অভিযান শেষে জেট্টা ওয়েলস নিজের জায়গায় ফিরে আসার পর বুঝলেন যে, এক অদ্ভুত আনন্দময় অভিজ্ঞতা তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এর তুলনায় তার নিজের কাজ অতি সামান্য। এই আশ্চর্য রকম অভিজ্ঞতার ফলে জেট্টা ওয়েলস এর পর স্বামীর সঙ্গে পুনরায় মেস্কিকোর এক দুর্গম পর্বতে আরোহণ করার জন্য অভিযানে অংশ নেন। এই অভিযানও ছিল অত্যন্ত বিপদসংকুল আর কঠিন। এই বিপদের মধ্যেও তিনি যে আনন্দ পেয়েছিলেন, যে শিহরণ অনুভব করেছিলেন তার তুলনা মেলে না।
একজন আধুনিকা স্ত্রী হয়েও জেটা ওয়েলস উপলব্ধি করেছিলেন, কার্বেথ ওয়েলসের মতো মানুষের স্ত্রী হওয়া কত ভাগ্যের আর গৌরবের-তার তুলনায় তার নিজের আগের জীবনবেদ কত তুচ্ছ। এরপর অভিযান শেষে ফেরার পর জেট্টা ওয়েলস তার ব্যক্তিগত কাজের অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন তার মনে একটাই মাত্র আকাঙক্ষা জন্ম নেয় যে, পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় যাওয়ার স্বাধীনতা পাওয়া। এরপর থেকে আফ্রিকার অরণ্যময় এলাকা, সেখানকার দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চল, জাপান, আইসল্যান্ড, কাশ্মীর উপত্যকা প্রভৃতি জায়গা এই পরিব্রাজক দম্পতি ঘুরে বেড়িয়েছেন।
নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে জেট্টা ওয়েলস বলেন, আমার আগের জীবনের কথা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে পড়ি। যখন ভাবতাম আমার নিজের কাজ কত আনন্দের ছিল। সেটা কতটা যে ভুল আজ ভাবলে খুব অবাক লাগে।
জেট্টা ওয়েলসের মত মেনে চলার ফলে আমি নিজে যে মহামূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আজ মনে হয় আমার একাকী গড়ে তোলা জীবন যাত্রাকেই যদি আঁকড়ে ধরতাম, তাহলে কী আনন্দ আর সুখ থেকেই না বঞ্চিত হতাম। আমি আমার স্বামীর রুচির সঙ্গে আমার নিজস্ব রুচি মিলিয়ে তার জয়যাত্রায় অংশ নিয়ে তারই সাফল্যের ভাগি হয়েছি। তার সুখ দুঃখের অংশীদার হয়েছি। আবার যখন নৈরাশ্য এবং কঠিন মুহূর্তের মুখে পড়েছি তখন দুজনে একই সঙ্গে তার সামনে দাঁড়াতে সামথ্যও হয়েছি, যুদ্ধ করেছি।
জেট্টা ওয়েলস তাঁর লেখা বইখানি তার প্রিয়তমা স্ত্রী জেট্টা ওয়েলসের নামে উৎসর্গ করেছিলেন।
মিসেস জেট্টা ওয়েলস বলেছেন—’আমার স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া এই ভালবাসার দান আমাকে কৃতজ্ঞতা আর সুখ যতখানি দিতে পেরেছে আর কোনো কিছুই আমাকে ততখানি আনন্দ দিতে পারে নি।‘ যারা স্বামীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে মনোযোগ দিতে পারেন, স্বামীর কাজকে যারা ভালবাসেন, তাদের জীবন এমনই আনন্দময় হয়ে ওঠে। এটাই শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাওয়া স্বামীর কাছ থেকে।
এ ব্যাপারে একটা কথা বলা আছে। যে সব স্ত্রী অবস্থার বা অন্য কোনো চাপে পড়ে বাইরের কাজের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন তাদের আমি কোনোভাবেই ছোট করতে চাই না।
আমার মতে, প্রত্যেক, স্ত্রীরই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকা উচিত। আমরা কিন্তু কেউ জানি কখন কাকে জীবিকার সন্ধানে নামতে হবে। সব অবস্থার জন্য তৈরি থাকা বুদ্ধিমতীর কাজ।
আমরা যারা স্ত্রীর ভূমিকা পালনে আগ্রহী,স্বামীর কৃতকার্যতাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি সে বিষয়ে যখন আমরা আলোচনার সূত্রপাত করেছি। একটা ব্যাপার আমাদের উপেক্ষা করার উপায় নেই, সেটি হল-স্ত্রীর মন আত্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিত হবে না। এমন কোনো স্ত্রীলোক পাওয়ার উপায় নেই, যিনি শুধু নিজের স্বার্থে কোনো বড় কাজে হাত দিতে চান। তবে বহু ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম থাকে।
স্বামী স্ত্রী দুজনের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ যদি এক থাকে তবে সুন্দরভাবে তাদের জীবন গড়ে উঠতে পারে। স্বামী স্ত্রী দুজনকে একই পথের পথিক হতে গেলে এই নিয়মটি মেনে চলতে হবে-যদি আপনার নিজের ব্যবসা বা কাজকর্ম আপনার স্বামীর সুখ ও স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাহলে আপনার নিজের কাজটি ত্যাগ করাই ভালো।
১৭. এক তরুণী স্ত্রী ও তার স্বামীর কাহিনী
আমেরিকার কেন্টাকির অধিবাসী মি. এবং মিসেস হাইনস চৌদ্দ বছর বিবাহিত জীবন যাপন করেছিলেন। আশ্চর্য ঘটনা যেটা তা হল, মিসেস হাইন্স অহেতুক নানান রকম ভয় পেতেন। সব রকম আত্মবিশ্বাসই তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
মি. হাই ছিলেন একজন স্থানীয় রাজনীতিজ্ঞ যুবক আর আইন ব্যবসায়ী। প্রায় সময়ই তাকে অতিথি অভ্যাগতদের অপ্যায়ন করতে হত। তার স্ত্রী কোরী হাইন্স কিন্তু এই সব কাজে এগিয়ে যেতে ভয় পেতেন। স্বামীর সব রকম সামাজিক কাজকর্মে অংশ নিতে ভয় পেতেন। লজ্জা আর ভয় তাকে ঘিরে থাকতো। মিসেস হাইস মনস্থির করে ফেললেন যে, যেভাবেই হোক স্বামীর কাজে সহায়তা করার জন্য এই ভয় আর আড়ষ্টতা তাকে দূর করতেই হবে।
একদিন এক মাসিক পত্রিকার একটি প্রবন্ধ পড়েই তার চিন্তাধারা একেবারে পাল্টে যায়। তাতে লেখা ছিল: মানুষ বিশেষভাবে নিজের প্রতি আকর্ষণশীল হয়-তাই সব সময় অন্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অপরকে তাই সুকৌশলে তার সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তার নিজের সাফল্যের বর্ণনা করতে দিন। তার দিকেই মনোযোগ দিয়ে নিজের কথা ভুলে যান।
কোরী হাইন্স ঠিক করলেন যে, এই পরামর্শ নিজের জীবনে লাগাবেন। তিনি বলেন, অন্যের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে সত্যিই একটু একটু করে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিল, আমার সমস্ত ভয়ও দূর হয়ে গেল। আমি লক্ষ্য করলাম আমার মতো অন্যদেরও সমস্যা আর অসুবিধা আছে। একে একে তাদের আমি ভালবাসতে শুরু করলাম। আমার বাড়িতে তাদের আদর আপ্যায়ন করতে লাগলাম। আমার স্বামীর সঙ্গে আমি নানা জায়গায় যেতে লাগলাম। সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজে আমার স্বামীকে অর্থাৎ বর্তমানে আইনসভার একজন সম্মানিত সদস্য যিনি, তার সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ পতন থেকে রক্ষা করেছি। এ কথা যখন মনে হয় তখন নিজেকে ধন্য বলে ভাবি। . স্বামীর জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রত্যেক স্ত্রীর অবশ্য কর্তব্য। স্বামীর কাজের উন্নতির পথে এগিয়ে চলার জন্য স্ত্রীকে অন্য সকলের সঙ্গে সদ্ভাব আর আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখাই কর্তব্য। এ কাজে নিজেকে যোগ্য করে তোলা চাই।
সফল স্বামীর স্ত্রীর সাফল্যও অবহেলার নয়। এটি একটি প্রয়োজনীয় গুণ। আমেরিকার একজন অত্যন্ত বিখ্যাত গভর্নর আমাকে বলেছেন যে, তার সাফল্যের বেশির ভাগটাই একজন চিন্তাশীল সুন্দরী স্ত্রীর উপরেই নির্ভরশীল ছিল। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর সহায়তা আমার পক্ষে অপরিহার্য।
এই প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, কোরী হাইসের মতো আপনার যদি ভয় থাকে তাহলে সেটা ত্যাগ করার জন্য তৈরি হোন। অন্য মানুসের সঙ্গ আপনার সাহায্যে আসতে পারে। অন্যকে তাই সম্মান করুন, তাদের ভালবেসে একাত্ম হয়ে উঠুন, দেখবেন আপনার ত্রুটি অনেকটাই দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যের সাহচর্যেই এটা সম্ভব।
আমেরিকান সিনেমা অ্যাসোয়িশনের প্রেসিডেন্টের স্ত্রী মিসেস জনস্টন লিখেছেন-’সফল কোনো বিবাহের আসল চাবিকাঠি হল, স্বামীর সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সঙ্গে তালে পা ফেলে চলতে পারার ক্ষমতা। মিসেস জনস্টনের উপদেশ হল, যারা স্বামীর পদক্ষেপের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে চান তারা যেন সুযোগ পেলেই সামাজিক কাজকর্মে বেশি করে অংশ গ্রহণ করে বন্ধু-বান্ধবের পরিচয়ের গণ্ডী যেন বাড়াতে থাকেন।’
আমরা কিন্তু কেউই জানি না কীভাবে কার ভবিষ্যতের দরজা খুলে যাবে। কিন্তু যখন সুযোগ উপস্থিত হবে তখন তার জন্য নিজেকে তৈরি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমন-দেখবেন আপনার স্বামী একটা উপযুক্ত সামাজিক অবস্থায় পৌঁছে গেছেন, সেই সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য তৈরি সামাজিক অবস্থা যাই হোক না কেন আপনার উচিত হবে আপনার স্বামীকে সব সময় সাহায্য করা। কোনো ক্ষেত্রে যদি কখনও স্বামীর আচার-ব্যবহার অভদ্রোচিত হয়, তখন বুদ্ধিমতী স্ত্রীর উচিত হবে স্বামীর ভুল সংশোধন করা।
আবার এটাও মনে রাখা চাই যে, স্ত্রী সব সময় ভালবাসাপূর্ণ মনোভাব ও পরিবেশের সৃষ্টি করেন, সে রকম স্ত্রীকে পিছনে ফেলে কখনও কোনো স্বামী জীবনপথে এগিয়ে যেতে পারেন না। এই ধরনের স্ত্রী যে কোনো স্বামীর কাছেই শুভেচ্ছায় দূত। এমনও মানুষ বহু পথের সন্ধান পেতে পারে যার সাহায্যে যে কোনো সুরুচিসম্পন্ন স্ত্রী স্বামীকে মূল্যবান সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে পারে। মনে রাখা দরকার অন্য সব কৌশলের মতো এই কৌশলেও সব সময় অনুশীলন করা প্রয়োজন।
এই বিষয়ে একজনের উদাহরণ দিচ্ছি। তিনি হলেন আমেরিকান সংবাদ পরিবেশন সংস্থার প্রেসিডেন্ট মি. হ্যাঁনস ডি. কান্টেনবর্নের স্ত্রী মিসেস কান্টেনবর্ন। এই ধরনের সহায়তা দানের কাজে অত্যন্ত নিপুণা তিনি। তিনি অতি কৌশলে কথা বলতে পারেন।
একবার টাউন হলে কোনো সভায় বক্তৃতার শেষে মি. ক্যন্টেনবর্ন শ্রোতাদের কাছ থেকে এত বেশি সংখ্যায় প্রশ্নের সম্মুখীন হন যে মিসেস কান্টেনবর্ন দেখেন যে, কোনোভাবে বাধা না দিলে তার স্বামী খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। মিসেস কান্টেনবর্ন চাইলেন, যত শীঘ্র সম্ভব সভা ভেঙে দেওয়া দরকার। মিসেস কান্টেনবর্ন তাই মাথা তুলে বলে উঠেছিলেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে, দয়া করে শুনুন। সবাই থামতেই তিনি বললেন, ‘মিসেস কান্টেনবর্ন’ জানতে চায় মি. কান্টেনবর্ন কখন মধ্যহ্নভোজ সারতে বাড়ি ফিরবেন?’ এ কথায় শ্রোতারা বেশ লজ্জিত বোধ করে থেমে যান আর বক্তাও বাড়ির দিকে রওনা হল।
স্বামীকে সফলতার পথে নিয়ে যাওয়ার কাজে আরও এক মূল্যবান সাহায্য স্ত্রী করতে পারেন। এই কাজটি করতে গেলে যথেষ্ট রকম ভালবাসা, অনুভূতি এবং তারই সঙ্গে চাই বেশ কিছু সময়। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এটা নিপুণভাবে সম্পন্ন না করা হয় তাহলে ভীষণভাবে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। স্ত্রীর নজর রাখা প্রয়োজন যে স্বামীর মন থেকে সাফল্যের আর কৃতকার্য হওয়ার আশা বা ধারণা যেন কোনোভাবেই চলে না যায়।
প্রত্যেক স্ত্রীই জানেন বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো স্বামী-স্ত্রী কীভাবে কাজটি করতেন চান। এই কাজটি যে স্ত্রী সাফল্যের সঙ্গে করতে পারেন তিনি সত্যিই কৃতজ্ঞতার পাত্রী তাতে সন্দেহ নেই। এই ধরনের স্ত্রী নিঃসন্দেহে যা চায় তাই পেয়ে থাকে। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলি তার স্ত্রীকে কঠোর সমালোচক বলতেন। ডিজরেলি স্ত্রীর কথাকে প্রচুর মূল্য দিতেন বলেই এ কথা বলতেন। তিনি এই প্রশংসা করেছেন সমালোচনার জন্যই। তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী সমালোচনার মধ্যে দিয়েই তাঁকে পদঙ্খলন থেকে রক্ষা করেছেন সেই কারণে তিনি ধন্য।
আমার একজন অতি পরিচিত অত্যন্ত সফল মানুষ আমাকে একবার বলেছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী তার সফল জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের এক বিরাট অংশ। ভদ্রলোকের নাম লাইনম্যান বীচার স্টো। তার পিতামহী হ্যারিয়েট বীচার স্টো একদিন বিখ্যাত ‘আঙ্কল টমস কেবিন’ নামের বইটি রচনা করেছিলেন। তিনি একজন বিখ্যাত লেখক আর অধ্যাপক।
মিষ্টার স্টো বলেন, যখন আমি প্রথম মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তখন সৌভাগ্যক্রমে আমার শ্রোতাদের খুবই সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলাম। কলেজে ওই বক্তৃতার কথা ছাপাও হয়। আমার স্ত্রী হিলডা প্রধানত আত্মবিশ্বাসের উপরেই জোর দিয়েছে। সে আমাকে বলল, লাইনম্যান, তুমি যে ভালো করেছ তাতে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত, কিন্তু কখনোই প্রশংসায় তুমি পথভ্রষ্ট হবে না। মনে রেখো, কঠোর পরিশ্রম করে তারই সঙ্গে যদি তোমার কাজের ধারাকে ঠিক না রাখ, তাহলে দেখবে তোমার এই শ্রোতারাই তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে।
একবার এক জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফিরে হিলডার কাছে বক্তৃতার খুঁটিনাটি শোনালাম। আর অপেক্ষা করতে থাকলাম তার প্রশংসা শোনার জন্য।
হিলডা মন দিয়ে সব শুনে সে মৃদু হেসে বললো, ‘খুবই চমৎকার আর আনন্দের খবর, কিন্তু বক্তৃতার বিষয় থেকে দেখতে পেলাম তুমি ওই বাড়িতে যারা থাকবে তাদের সম্বন্ধে কিছুই বল নি। আমার ধারণা তারাও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর প্রশংসা পাওয়ার সব আশাই মিলিয়ে গেল। কিন্তু হিলডাকে আমি আরও বেশি ভালবাসতে শুরু করলাম কারণ ওর সুরুচি সম্বন্ধে জ্ঞান দেখে। আমি এর পরই আমার কাজে আরও সতর্ক হলাম আর সেই ভাবেই কাজ করতে লাগলাম। এভাবেই আমার ভবিষ্যতকে মজবুত করলাম।
মিসেস হাইস, মিসেস জনস্টন, মিসেস কান্টেনবর্ন ও মিসেস স্টো এই সমস্ত মহিলারাই জানেন, কেমন করে স্বামীর সঙ্গে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হয়। আর কেমন করে তাদের ভালবাসা লাভ করা যায়।
এই কাজ তারা করেছেন বন্ধু-বান্ধবদের ভালবাসা জয় করে, আদরণীয় হয়ে স্বামীদের বাস্তবভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করে। এর সঙ্গে তারা স্বামীদের সঙ্গে সমান তালেই চলতে পেরেছেন।
যে স্ত্রী এভাবে কাজ করতে পারেন তার ভবিষ্যৎ স্বামীর সঙ্গে মজবুত না হয়ে পারে না।
সংক্ষেপে তের-চৌদ্দ-পনের-ষোল-সতের পাঠের নিয়মগুলি:
১। যখনই প্রয়োজন দেখা দেবে তখনই অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি রাখতে হবে।
২। স্বামীকে বাড়তি কাজ করতে হলে সে ব্যাপারটি মানিয়ে নিতে হবে।
৩। স্বামীর কাজে হাসিমুখে যোগ দেওয়া দরকার।
৪। স্বামীকে যদি ঘরে বসে কাজ করতে হয় তবে পরিবেশকে সহজ করে নেওয়া দরকার।
৫। নিজের কাজ যদি কোনো ভাবে স্বামীর স্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে তা পরিত্যাগ করা উচিত।
৬। স্বামীর কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলা প্রয়োজন।
১৮. পুরুষেরা কেন গৃহত্যাগ করে
স্বামী-স্ত্রীর বিবাহিত জীবন যে সবসময় আনন্দে পরিপূর্ণ থাকে তা নয়, অনেক সময় বিচিত্র সমস্যাও দেখা দেয়।
ডরোথি ডিক্স নামে বিখ্যাত একজন সমাজ সেবিকা বলেন, ‘কোনো লোকের বিয়ের আনন্দ সব থেকে বেশি নির্ভর করে সাধারণভাবে তার স্ত্রীর মেজাজ আর চরিত্রের প্রকৃতির উপর। কোনো সুন্দরী স্ত্রী নানারকম সদগুণের অধিকারিণী হলেও যদি তার মেজাজটি ভালো না হয়, সে যদি কলহপ্রিয় হয় বা ঈর্ষাপরায়ণ হয় তাহলে জীবনের অর্থাৎ বিবাহিত জীবনের সব আনন্দই মাটি হয়ে যায়।’
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. লুই এম. টারম্যান পেন প্রায় একশ’রও বেশি বিয়ের গবেষণা করেছেন। গবেষণার ফল থেকে তিনি দেখেছেন, বেশির ভাগ বিয়ে সফলতা লাভ করে না স্বামী স্ত্রীর দোষ ত্রুটি ধরতে শুরু করায়।
গ্যালাপ পলও ঠিক এই ধরনের কথাই বলেছেন। তিনিও গবেষণায় একই রকম ফল পেয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন, পুরুষরা স্ত্রীদের দোষের মধ্যে প্রধান বলে ভাবে বিরক্তি উৎপাদক কাজকে।
তিনি দি জনসন টেম্পারমেন্ট অ্যানালিসিজসানের বৈজ্ঞানিক মনোবিশ্লেষণে দেখেন যে স্ত্রীদের একমাত্র বিরক্তি উৎপাদন আর স্বামীদের দোষত্রুটি ধরার প্রবৃত্তির মতো অন্য কোনো মনোভাবই জীবনযাত্রার এত ক্ষতিসাধন করে না। বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস তার কলহপ্রিয় স্ত্রীর সাহচর্য থেকে আত্মরক্ষার জন্যই দূরে সরে গিয়ে এথেন্স শহরের কোনো গাছের তলায় বসেই তার দার্শনিক তত্ত্ব প্রচার করতেন। তৃতীয় নেপোলিয়ন স্ত্রীর অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার জন্য অপর এক মহিলার কাছে গোপনে অভিসার করে শান্তি পেতে চাইতেন। রোমের বিখ্যাত আগাস্টাস সীজার বাধ্য হয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বনিয়ার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করেছিলেন। তিনি নিজেই লিখে যান যে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। আধুনিক যুগেও এই অবস্থা ঘটে চলেছে। আমাদের পরিচিত একজন ভদ্রলোক বলেছেন যে তার পারিবারিক জীবন তার স্ত্রীর জন্য প্রায় নষ্ট হতে চলেছিল। তার স্ত্রীর সবসময়েই তার কাজকর্ম আর সব ব্যাপারে তাকে তাচ্ছিল্য দেখাতেন। ভদ্রলোক স্ত্রীর খারাপ ব্যবহার সত্ত্বেও মুখ বন্ধ করে কাজ করে যান। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ। ভদ্রলোক দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। এই মেয়েটি প্রথমা স্ত্রী যা করতে ব্যর্থ হন তাই করে-স্বামীর সমস্ত কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে। ফলে তাদের পারিবারিক জীবনে শান্তি নেমে আছে।
স্বামী চেয়েছিলেন কিছু সহানুভূতি আর ভালবাসা যা প্রথমা স্ত্রী একেবারেই স্বামীকে দিতে পারে নি। এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাবই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অলঙ্ প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। বিরক্তি উৎপাদনের সব থেকে মারাত্মক ব্যাপারটি হল যে, কোনো মানুষকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করে হীন বা ছোট প্রতিপন্ন করার চেষ্টা।
স্ত্রীর জ্বালা ধরানো বাক্যবাণ খারাপ প্রতিক্রিয়া জন্ম দিয়ে থাকে। অত্যন্ত ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে।
একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, নিজেদের রসনা বা সমালোচনার কাজকে সংযত করতে পারা একটা বিশেষ গুণ। আর এটা করলে মনে রাখবেন যে, কোনো স্বামী-স্ত্রী তাদের পারিবারিক জীবনে শান্তি পেতে পারেন ও নিষ্কলঙ্কভাবে জীবন কাটাতে পারেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, কাজের জায়গায় স্বামীর উন্নতি হোক আর নাই হোক তাকে কখনও প্রত্যেকটি মুহূর্তে বাক্যবাণে জর্জরিত করা উচিত নয়।
ভার্জিনিয়া প্রদেশের একজন অধ্যাপক ড. স্যামুয়েল ডব্লিউ. স্টিফেনসন সম্প্রতি তাঁর এক বক্তৃতায় আমেরিকান স্বামীদের কাছে চারটি দাবি রাখেন। সেগুলো হল :
(১) ঘ্যানর ঘ্যানর থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকা।
(২) পিছু হটে যাওয়া থেকে নিরস্ত হওয়ার চেষ্টা করা।
(৩) সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের শেষে দিনের শেষে পুরনো পোশাকে শয্যায় গা এলিয়ে দেওয়া থেকে মুক্তি।
(৪) বদহজম থেকে মুক্তি।
সব ক্ষেত্রে যে স্ত্রী দোষী তা নয়, স্বামীরা সে সম্পূর্ণ নির্দোষ তা বলা যায় না। দেখা প্রয়োজন এই ঘ্যানর ঘ্যানর কোনো রকম শারীরিক ত্রুটি থেকে আসছে কিনা। সেই কারণে স্ত্রীর সম্বন্ধেও কিছুটা সহানুভূতিশীল হওয়া প্রত্যেক স্বামীর উচিত।
এটা করলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বহু ক্ষেত্রেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে আর পরস্পরকে বুঝতে শুরু করেছে। তাই এর প্রতিকারের উপায় হল জীবনযাত্রাকে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলা।
এবার যে সমস্যাটির কথা উল্লেখ করবো তা হল অবসন্নতা। আমার পরামর্শ হল অবসন্নতার কারণ বের করে তা দূর করা।
মনোবিজ্ঞানীদের মত হল, শত্রুতার ভাব মন থেকে দূর করে ফেলতে হবে। ঈর্ষার ভাব মনের মধ্যে জেগে থাকার ফলে অনেক সময় স্ত্রীদের ঘ্যানর ঘ্যানর করার মনোবৃত্তি জাগতে পারে। এর মধ্যে নানা ধরনের কারণ থাকা সম্ভব, যেমন, আইনগত সমস্যা, ভালবাসার অভাব, জীবনের প্রতি বিভিন্ন কারণজনিত বিতৃষ্ণা। এসব কিছুর পরিণতি মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ যার প্রকাশ বাইরে ঘটে থাকে।
এটা দূর করতে গেলে অবশ্যই নিজের আভ্যন্তরীণ সংগ্রামের স্বরূপটি খুঁজে বের করে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। –একটি ঘটনার কথা বলছি। কোনো এক সময় আমেরিকার জর্জিয়া প্রদেশের সুপ্রিম কোর্টে এক মামলায় রায় দেওয়া হয় যে, কোনো স্বামী যদি কলহপ্রিয়া স্ত্রীর হাত থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে কোনো অতিথি গৃহে নিজেকে আলাদা ভাবে রাখতে চায় তাহলে কোনো ভাবেই স্বামীকে দোষ দেওয়া যায় না। সুপ্রীম কোর্ট আরও জানায় যে পবিত্র বাইবেলে সলোমনের কথা এই রকম:
বিস্তৃত ঘরে কলহপ্রিয়া স্ত্রীর সঙ্গে বাস করা অপেক্ষা ছাদের ছোউ ঘরে এক কোণে বাস করাই শ্রেয়।
এটা প্রামণিত সত্য যে, বহু লোকই তাদের স্ত্রীর হাত থেকে কোনো অর্থ ব্যয় না করে মুক্তি পেতে আগ্রহী। অবশ্য এও দেখা গেছে, বহু স্বামী আবার যে কোনো উপায়েই স্ত্রীর হাত থেকে মুক্তি চায় আর সেজন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেও গররাজি নয়।
এখন জানা দরকার যে, আপনার রোগটা কী এবং সেটা পরিষ্কার করতেই হবে না হলে সে রোগ আরোগ্যের আশা দুরাশা মাত্র।
কোনো স্ত্রী যদি জানতে চান এ রোগ তার আছে কিনা, তবে তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া দরকার তিনি অসন্তুষ্ট হন কিনা। তাহলে শীঘ্রই সেটা করা প্রয়োজন।
এই কাজ ছটি পরিকল্পনা কাজে আসতে পারে :
(১) স্বামী ও পরিবারের সহযোগিতা মেনে নিতে উদ্যোগ নিন। সব চেয়ে সেরা উপায় হল আপনি যখন রেগে গিয়ে বেশি মাত্রায় ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন তখনই যেন আপনাকে বেশ ভালো রকম জরিমানা করা হয়।
(২) যে কোনো কথা মাত্র একবারই বলা অভ্যাস করুন। বার বার খিট খিট করলে জানবেন সে কাজ হওয়ার অনেক অসুবিধা আছে।
(৩) মিষ্টি কথা বলে যে কোনো কাজ করানোর চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখবেন ভিনিগারের স্বাদ টক-এর সাহায্যে যত মাছি ধরা সম্ভব চিনির সাহায্যে তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মাছি ধরা সহজ। খিট খিট করে কিছু বলার চেয়ে মিষ্টি কথায় বললে কোনো কাজ শতকরা অনেক বেশি হারে সম্পন্ন হবার সম্ভাবনা থাকে।
(৪) স্বভাবকে সবসময় সরল রাখার চেষ্টা করতে হবে। দেখা যাবে এ কাজটি আপনার মনে অনেক বেশি উন্নতির ভাব জাগাতে পারে।
বেশি রকম ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এর ফলে প্রচণ্ড ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকাতে বহু স্ত্রীকে অভিনয় করতে দেখা যায়, যা কখনোই উচিত নয়। অনেক স্ত্রীকে দেখা যায় যে মানসিক ধৈর্য হারিয়ে এমন অনেক কাজ করে বসেন যার ফলে স্বামী-স্ত্রীর স্বর্গীয় ভালবাসা ঘৃণাতে পরিণত হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে যে, পশ্চাদপসরণ জয়ের কাজও করতে পারে।
(৫) যে কোনো ধরনের গুরুতর দুঃখ কষ্টের কথা শান্তভাবে গ্রহণ করতে দেখা দিলে সেটা অগ্রাহ্য না করে স্বামী-স্ত্রী আলোচনার মধ্যে দিয়ে তার সমাধান করা উচিত। এখানে বিশ্বাসই হল মূলকথা।
(৬) স্বামীকে দিয়ে জোর করে কোনো কাজ করানোর চেষ্টা না করে বরং অনুপ্রেরণার মধ্যে দিয়ে সেটা করাই ভালো।
১৯. স্বামীর কাজে মাথা গলাবেন না
কিছুদিন আগে এক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁর মতে,
কীভাবে স্ত্রীরা স্বামীদের জীবনে উন্নতির পথে সহায়তা করতে পারে।
ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস স্ত্রীরা যেভাবে স্বামীদের উন্নতির সহায়তা করতে পারেন তার মধ্যে দুটি কাজ প্রধান। প্রথমটি হল, স্বামীকে প্রকৃত ভালবাসা; আর দ্বিতীয়টি হল, স্বামীর কাজে বাধা সৃষ্টি না করে তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া।’ যে কোনো প্রিয় স্ত্রীরই কর্তব্য হওয়া উচিত তার স্বামী যাতে সুখী-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারেন সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
অনেক স্ত্রী আবার স্বামীকে আরও উঁচু পদে প্রমোশন পাওয়ার জন্য উৎসাহ দান করতে পারে। তবে স্বামীর কাজে স্ত্রীর অকারণ হস্তক্ষেপ ও অনেক সময় বিপজ্জনক হতে পারে। তাই স্বামীর কাজে মাথা গলানো ঠিক নয়।
কিছুদিন আগে আমার জনৈক বন্ধু বলেন যে তার প্রতিষ্ঠানে বহুদিনের উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী বরখাস্ত হন, কারণ তার স্ত্রী বেশ জোর করেই তার কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। স্ত্রী যে কাজ করেছিলেন তা অত্যন্ত গর্হিত তাতে সন্দেহ ছিল না। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানেরই অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তার ধারণা ছিল, তারা স্বামীর প্রতিদ্বন্দী। ভদ্রমহিলা ওইখানেই থামেন নি। তিনি ওই সব কর্মচারীর স্ত্রীদের বিরুদ্ধে নানা রকম কুৎসা রটাতে শুরু করেন।
স্বামী এসব ব্যাপার জানার ফলে নানাভাবে স্ত্রীকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত তিনি অপারগ হয়ে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এ ছাড়া তার কোনো পথ ছিল না। স্বামীর কাজে স্ত্রীর অকারণ অন্যায় হস্তক্ষেপের পরিণতি এই রকমই হতে পারে।
২০. স্বামীর কাজে উৎসাহ দিন
১৯২৬ সালে জেন ওয়েলস টমাস কার্লাইলকে বিয়ে করেন। তিনি ইচ্ছে করলে যে কোনো উচ্চপদস্থ মানুষকে সহজেই বিয়ে করতে পারতেন। কারণ টমাস কার্লাইল অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্ন মানুষ হলেও প্রায় গ্রাম্য আর কিছু বিচিত্র চরিত্রের। প্রচণ্ড রকম খামখেয়ালী। তাঁর অর্থকরী অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। বলতে গেলে কিছু ভবিষ্যতও ছিল না। থাকার মধ্যে তাঁর যা ছিল তা হল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর সুপ্ত প্রতিভা।
জেন কার্লইল তাঁর স্বামীর জীবন-যাত্রার মানকে করে তুলতে চান উন্নত। সম্রমকে উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছে দিতে চান।
জেন নিজে ছিলেন একজন সত্যিকার ধীশক্তি-সম্পন্ন মহিলা কবি। অথচ স্বামীর কাজে আরও বেশি সময় দেবার উদ্দেশ্যে কবিতা রচনা ত্যাগ করেন। টমাস কার্লাইল ছিলেন একজন স্কটল্যান্ডের মানুষ। জেন কার্লাইল চাইছিলেন এটাই দেখতে যে তার স্বামী এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড রেক্টরের পদ অলংকৃত করছেন। এই কারণেই জেন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজনকে ছেড়ে চলে যান সুদূর স্কটল্যাণ্ডের এক নিরিবিলি গ্রামে স্বামীর সঙ্গে। জেন ছিলেন সত্যিকার একজন মিতব্যয়ী গৃহিণী। নিজের পোশাক পরিচ্ছদ তিনি নিজেই বানিয়ে নিতেন। তিনি স্বামীর সেবা শুশ্রূষা করতেন এবং স্বামীর অসন্তোষকে হেসেই উড়িয়ে দিতেন। তাঁর সবচেয়ে যে প্রশংসনীয় গুণটি ছিল তা হল-তিনি কখনোই স্বামীর ব্যক্তিগত মতামত বদল করার চেষ্টা করতেন না। তিনি স্বামীকে তাঁর পছন্দ করা পথেই চলতে দিতে চাইতেন আর পৃথিবীর সকলেই এই মতটাই গ্রহণ করুক এটাই তিনি চেয়েছেন।
এটা সত্যি যে, একজন মানুষকে তার নিজের শক্তির পরিমাণ বুঝতে দেওয়া আর তার শক্তির বাইরে ঠেলে দেওয়া-এই দুটোর মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ আছে। প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত পুরুষদের শক্তির সীমা বোঝার চেষ্টা করা। এটা সত্যি যে আমরা কখনোই সব সময় অতখানি সচেতন থাকি না। এখনও দেখা যায় যে, অনেকে কারও অধীনস্থ থাকার ফলে চমৎকার কাজ করার দক্ষতা লাভ করে। অথচ তাদের যদি কোনো সময় জোর করে উঁচু পদে দায়িত্বশীল কাজের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাদের যোগ্যতা কমতে শুরু করে। এদের পরিণতি হয় খুবই করুণ। তারা হয় আলসার, না হয় অন্যভাবে মৃত্যু বরণ করে। কারণ তাদের দেহের গঠনে ওই অতিরিক্ত পরিশ্রম সহ্য হয় না। কৃতকার্যতা নির্ভরশীল যে পরিমাণ কাজ আমাদের মানসিক, শারীরিক আর আভ্যন্তরীণ ধাতু প্রভৃতি সহ্য করতে সক্ষম।
ওরিমান মারডেন বলেন, প্রথম শ্রেণীর ভারবাহকের চেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর বাহক হওয়া অনেক ভালো।
এটা আমাদের মনে রাখা দরকার যে, প্রকৃতি কখনও কোনো মানুষকে উচ্চপদস্থ মানুষ হওয়ার যোগ্যতা দিয়ে তৈরি করে না। কিন্তু আমরা উঁচু উপাধিকারীদের এই ধরনের অতিরঞ্জিত সম্মানই কিন্তু দিতে অভ্যস্ত।
কোনো মানুষকে সে যে কাজ পছন্দ করে না সে ব্যাপারে যতই উদ্যোগী করে তোলার চেষ্টা করা হোক না কেন, সে ওই কাজ কিছুতেই মন দিয়ে করতে পারে না। উন্নতি জড়িত থাকলেও আবার দেখা যায়, মানুষ তাতেও সফল হয় না আবার কখনও কখনও বেশি এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও দুর্ভাগ্যের সূচনা করে বসে।
এ ব্যাপারে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের হনলুলুর পুলিশ বিভাগের ক্লিফোর্ড ওয়েজম্যানের কথাই বলতে চাই। সে ছিল পুলিশের মোটর টহলদারী দলের একজন। সে হাইডেন স্ট্রীটে বাস করে। তার ছোট মেয়ে জন্মানোর সময় তাকে অন্য এক দপ্তরে বদলি করা হয়, এই বদলির ফলে তার মাইনেও বাড়ে। কিন্তু এর ফলে তার পরিশ্রম আর দায়িত্বও অনেক বৃদ্ধি হয়। এর ফলে স্ত্রী আর শিশুকন্যার দেখাশোনা করার মতো সময়ও তার থাকে নি। কিন্তু বাধ্য হয়েই তাকে নতুন কাজের দায়িত্ব পালন করে চলতে হল। এর পরিণামে ওয়েজম্যানের ওজন কমতে শুরু করল। ওয়েজম্যান অবসাদে প্রায় ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হল।
ডাক্তার ওয়েজম্যানের সঙ্গে নানা আলোচনার পর আসল রোগ ধরতে পারলেন। ডাক্তার পুলিশ প্রধানকে জানালেন ওয়েজম্যানকে যেন আগের পদেই কাজ করতে দেওয়া হয়, না হলে তারা একজন দক্ষ পুলিশ কর্মীকে হারাবেন। কারণ ওয়েজম্যান অবসাদগ্রস্ত, পুলিশ প্রধান আবার ওয়েজম্যানকে আগের পদেই ফিরিয়ে আনার পর তার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটতে লাগল। অবসাদও দূর হয়ে গেল। মাইনের চেয়ে অনেক বেশি মহৎ হল স্বাস্থ্য, সুখ ও তৃপ্তি।
অনেক স্ত্রী আছেন যারা তাদের স্বামীদের চাকরিতে উঁচু পদে দেখতে আগ্রহী। প্রতিযোগিতায় স্বামীদের জয়ই তাদের একমাত্র কাম্য, হঠাৎ কোনোভাবে কোনো স্বামী এই ধরনের উঁচুপদে আসীন হলে পরে কিন্তু নানা সমস্যা পারিবারিক জীবনকে কন্টকিত করে তোলে। এখন স্বামীদের আর আগের জায়গায় ফিরে আনার কোনো উপায় থাকে না। কারণ সেটা তার ক্ষমতার বাইরে এ কথা ঠিক যে অত্যধিক মাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাংঘাতিক রকম ক্ষতিকর। নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় একটি খবরের শিরোনাম আমার নজরে পড়েছিল, সেই শিরোনামে জানা যায় যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বহু অফিসার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
কিছু ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। আমরা আমাদের আয়ত্তাধীন কাজের অনবরতই সমালোচনা করি-আর যে কাজ আমাদের বহির্ভূত তারই প্রতি আমাদের আগ্রহ থাকে সব থেকে বেশি। এই মিথ্যার পিছনে ছুটতে চেয়ে আমরা ব্যর্থ হই আর নিজেদের বা স্বামীদের আত্মহত্যার পথ খুলে দিতে চাই। এ বিষয়ে ডাঃ পিটার জে, স্টেইনক্রোন হাউ টু স্টপ কিলিং ইওর সেলফ’ গ্রন্থটিতে এই ধরনের মনোভাবাপন্ন স্ত্রীদের দায়ী করেছেন, যারা আরও সম্মান-অর্থ আর জীবনধারনের জন্য বিলাসিতা আর তারই সঙ্গে প্রতিবেশীদের চেয়ে আরও যশ প্রতিপত্তি লাভ করার জন্য স্বামীদের উৎসাহিত করেন সেই স্ত্রীদের তিনি দোষারোপ করেছেন।
ডা. স্টেইনক্রোন বলেন, ওই ধরনের মহিলারা হয় জন্মসূত্রে বা শিক্ষার ফলে এই ধরনের অতিমাত্রায় উচ্চভিলাসী হয়ে থাকেন। আমাদের একমাত্র উচিত হবে আমাদের স্বামীদের তাদের ক্ষমতার সদ্বব্যবহার করতে দেওয়া আর অযথা ব্ৰিত না করা। স্ত্রী হিসাবে কোনোভাবেই আমাদের উচিত নয় যে, স্বামীদের অনির্ধারিত কোনো কাজের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা।
বিখ্যাত লেখক এন. ডি. ব্যারোচ তাঁর ‘আর্ট অব লিভিং’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “একজন রাষ্ট্রনায়ক কখনোই রাষ্ট্রের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে না। আবার তেমনই একজন ভ্রমণকারী পৃথিবীর সব দেশও ভ্রমণ করতে পারেন না।” এই কারণে প্রয়োজন দেখা দিলে কোনো প্রলোভন মত্ত অনুপযুক্ত ব্যক্তিকেও প্রয়োজন দেখা দিলে কোনো প্রকল্প থেকে সরিয়ে দিতে হয়।
তাই স্ত্রীদের সব সময় মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামীর সাফল্য যদি চান তবে তাকে উৎসাহিত করুন, ভালবাসুন ও তার সহকর্মী হয়ে উঠুন। কিন্তু কখনোই, তাঁকে দিয়ে কিছু অতিরিক্ত কাজ করানোর চেষ্টা করা উচিত হবে না।
২১. পরিবর্তনে ভয় পাবেন না
আমেরিকার কানসাস প্রদেশের এক খামারের মালিক চার্লস রবার্টসন আশি বছর আগে একবার পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন ইন্ডিয়ান সীমান্তে গিয়ে কিছু করতে পারেন কি না। এরকম কিছু মনস্থ করেই তিনি তার স্ত্রী হ্যারিয়েট সমস্ত মালপত্র আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা ওয়াগনে চেপে অজানার দিকে যাত্রা শুরু করনে। শেষ পর্যন্ত তারা আমেরিকার ওকলাহোমার উত্তর-পূর্ব দিকে সিমারুন নদীর তীরে থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। সেখানে রবার্টসন একটা কাঠের বাড়ি বানিয়ে ফেলেন। এরপর কিছুদিন কাটলে তিনি সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ওই ছোট্ট গ্রামীণ এলাকায় একটা দোকান করেন। ওই গ্রামটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে টালমা’ নামে পরিচিত।
হ্যাররিয়েটের সময় তেমন ভালো যাচ্ছিল না। অর্থাভাবে নটি সন্তান নিয়ে কোনো রকমে দিন কাটছিল, তাদের তৈরি ঘর ছিল সম্পূর্ণ খবরের কাগজের। গ্রামে ডাক্তার বলেও কেউ ছিল না। ছেলেমেয়েদের স্কুল বলতে ছিল একখানা কামরার এক মিশনারি বিদ্যালয়। আবহাওয়া ছিল যেমন গরম তেমনই শীত। তা সহ্য করা খুবই কঠিন। রবার্টসন দম্পতি কিন্তু সব কিছুই সহ্য করতে শিখলেন, প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিলেন, আর ধীরে ধীরে সফলতার দিকে এগিয়ে চলতে থাকেন। হ্যারিয়েট স্বামীর জন্য সবই হাসিমুখে সহ্য করতে থাকেন। তিনি স্বামী ও ছেলেমেয়েদের দেখতে চাইতেন উন্নতিশীল নাগরিক আর শিক্ষিত। একে একে তারা সত্যিকার সুখী দম্পতি হয়ে ওঠেন।
রবার্টসন পরিবার ওই এলাকায় পরিচিত হয়ে ওঠেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওই সুদূর সীমান্ত এলাকা যে উন্নত হয়ে ওঠে তার জন্য এই পরিবারটির দান অসামান্য। তাদের চেষ্টায় এক নতুন অঞ্চল সেখানে গড়ে ওঠে। সবচেয়ে প্রশংসিত হল মিসেস রবার্টসন। তাঁর স্বামীর প্রতি অবিচল আস্থা, ভালবাসা আর কঠিন পরিশ্রমই এই সুন্দর পরিবেশের জন্ম দেয়।
হ্যারিয়েট রবার্টসনের জীবনে থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, যারা কষ্ট আর সহিষ্ণুতার মধে দিয়ে স্বামীকে উৎসাহ যোগাতে পারে তারা রোগ, বিপদ আপদ সবকিছুই অনায়াসে দমন করতে সক্ষম। ভয় তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কোনো বাধা-বিপত্তি এই ধরনের মানুষের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করতে পারে না। তারা কখনও অতীতে সুখ ঐশ্বর্য বা ধনসম্পদের জন্য ভাবেন না। সমস্ত দেশেই এমন মানুষ ধন্যবাদের যোগ্য।
এ কথা মনে রাখা চাই যে স্বামী-স্ত্রীর সাফল্য প্রয়াসী তাকে অগ্রগামী মহিলাদের মতোই উৎসাহী আর সংগ্রামী মনোভাব সম্পন্ন হতে হয় স্বামী যে কাজ পছন্দ করেন সেই কাজে উৎসাহ দিতে হয়। অর্জন করতে হয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা।
এমন এক মানুষের কথা জানা ছিল যিনি তার নির্দিষ্ট চাকরিটি করতেন একান্ত অনিচ্ছায়-তার কাছে ওই কাজ যেন মৃত্যুর আদেশের মতো মনে হত। এর কারণ তার স্ত্রী চাইতেন আরও নিরাপত্তা আর উন্নতি।
ভদ্রলোক বুককিপার হিসাবে চাকরি শুরু করেন। আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ভদ্রলোক একটা মোটর গাড়ি মেরামত করার কারখানা স্থাপন করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বিয়ে করেন। তার স্ত্রী চাইলেন, যা করছেন নিজেদের একটা বাড়ি না হওয়া পর্যন্ত সেটাই করে যান। শেষ পর্যন্ত তাদের একটা বাড়িও হল, তাদের সন্তানও হল। কিন্তু স্ত্রী সেখানেই থেমে থাকলেন না, তার চাপে পড়ে ভদ্রলোক পরিশ্রম করেই চললেন। বেশ কয়েক বছর ওই ভাবেই কেটে চললো। ভদ্রলোক যা কিছু করলেন সবই শুধু মাত্র স্ত্রীর চাপে পড়ে করেন। ওই কাজে তার ইচ্ছা কিছুমাত্র ছিল না। কোনো পরিবর্তন তার স্ত্রীর মোটেই কাম্য। ছিল না।
জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে ভদ্রলোক আজ বড়ই ক্লান্ত। তিনি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, স্মরণশক্তি একেবারেই নেই। কোনো রকমে তিনি জীবনের বোঝা বহন করে চলেছেন। জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই তাঁর কেটেছিল অতৃপ্তির মধ্য দিয়ে। স্ত্রীর চাপে পড়ে তাকে এমন কাজ করে যেতে হয় যাতে মানসিক আনন্দ এক কণাও ছিল না।
অথচ লোকটি যদি নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারতো তাহলে কিছুটা মানসিক আনন্দ লাভ করতে পেতো ও অনাবিল তৃপ্তি। হয়তো একদিন সাফল্যও আসতো। আমেরিকার শিক্ষার ব্রিউয়িং প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি প্রায় ছ’হাজার গৃহিণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এক সমীক্ষা তৈরি করেছেন। এই সমীক্ষাতে দেখা যায়, শতকরা পঁচিশ ভাগ গৃহিণী তাদের স্বামীদের জীবনে কোনো পরিবর্তন চান না। বাকি শতকরা পঁচাত্তর ভাগ পরিবর্তন চান।
একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, যে ধরনের কাজ মানুষকে সুখী করে তোলে সেই রকম কাজই তার উপযুক্ত। যে কাজ তাকে শুধু ধনী বা সম্পদ শালী করে সে ধরনের কাজ নয়। যে কাজে মানুষ তৃপ্তি পায় সে কাজে তার সাফল্যও আসে না। এই কারণেই স্ত্রীদের কর্তব্য সচেতন হওয়া উচিত-তাদের স্বামীদের প্রতি গভীর অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে তাদের কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে। সামাজিক প্রতিপত্তির আকাক্ষা অতিরিক্ত অর্থলোভ তাই ত্যাগ করা দরকার। যে স্ত্রীরা স্বার্থপরতা শূন্য হয়ে স্বামীর কাজে সময়মতো প্রেরণা যোগাতে তৈরি থাকে তাদের জীবনেই সাফল্য আসে।
মনে রাখা দরকার যে, সাফল্য বলতে সেই কাজকেই বোঝায় যে কাজ আপনার পছন্দ। তাই অপছন্দের কাজ সম্পূর্ণ দূর করে দিতে হবে। আমরা কারও পরিপূর্ণ সাফল্য চাইলে তাকে পরিপূর্ণতা অর্জন করতেই হবে, তাদের পরিবর্তনের জন্য উৎসাহিত করতে হবে আর তারই সঙ্গে নানা বাধা-বিপত্তির জন্য তৈরি থাকতে হবে।
আঠার, উনিশ, কুড়ি, একুশ পাঠের সূত্র : স্ত্রী হিসেবে আপনার স্বামীকে সুখী ও সমর্থ দেখতে চাইলে নিচের এই ত্রুটিগুলো ত্যাগ করুন:
১। অযথা স্বামীকে বিরক্ত করবেন না।
২। স্বামীর অফিসের কাজে নাক গলাতে চাইবেন না, যাতে তার কাজের জায়গায় অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
৩। স্বামীর ক্ষমতার বাইরে এমন কিছু বলবেন না বা তাকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করবে না।
৪। সুযোগ গ্রহণ করার সময় কোনো কাজে ভীত হবেন না।
২২. স্বামীকে সুখী করার চেষ্টা করুন
যে সমস্ত স্ত্রী সম্প্রদায়িনী তাদের বিশেষ কিছু গুণ অবশ্যই থাকে। স্বামীকেও তার মধ্যে বাদ দেওয়া উচিত নয়। যে সব স্ত্রী স্বামীদের মনোহারিণী তাদের স্বামীরা কাজে সব সময় সাফল্য লাভ করেন।
অনেক সময় দেখা যায়, অনেক মহিলা অন্তর দিয়ে তাদের ভালবাসে কিন্তু কিছুতেই তাদের স্বামীদের সন্তুষ্ট করতে পারে না। এর কারণ হল তারা সব কিছু তলিয়ে না দেখেই কাজ করতে চান। তাই ক্রটি অবশ্য শুধরে নেওয়া যায়। সামান্য চেষ্টা, যত্ন আর আশাতীত রকম কম সময়েই যে কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে পারে যদি সে একটি আগ্রহী হয়। কেননা, কোনো মানুষকে সন্তুষ্ট করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। অনেকের ভুল ধারণা হল রূপ-যৌবন আর সৌন্দর্যের মাধ্যমেই বোধ হয় মানুষকে সন্তুষ্ট করা যায়। কিন্তু তা কখনোই নয়, সৌন্দর্য ক্ষণিক আনন্দ দান করতে পারে, চিরকালীন নয়। আসলে ভালবাসার সঙ্গে সৌন্দর্যের কোনো যোগ নেই। দৈহিক সৌন্দর্যের কোন যোগ নেই দৈহিক সৌন্দর্য কখনোই ভালবাসা বা সুখের পক্ষে একান্ত অপরিহার্য বস্তু নয়। বহু নারীই তাদের স্বামীদের মনোরঞ্জন করার জন্য তাদের সৌন্দর্য কাজে লাগান নি। এমন কী বহু বিখ্যাত মহিলা সুন্দরী ছিলেন না। প্রতিটি প্রাইভেট সেক্রেটারী জানেন কীভাবে তাদের বসকে সন্তুষ্ট করতে হয়। এই ধরনের কাজ যারা করেন তারা যে সবসময় অপরূপ সুন্দরী হন তা মোটেই নয়। তাদের গুণ মনোরঞ্জন আর কর্তব্যনিষ্ঠা এবং দক্ষতায় নির্ভরশীল।
এই ধরনের সেক্রেটারী কেমন করে হতে হয় বই থেকে বহু শিক্ষা আমরা গ্রহণ করতে পারি। এই কাজে যারা দক্ষতা অর্জন করেছে তারা বেশ সহজেই বসদের মতো স্বামীরও মনোরঞ্জন অবশ্যই করতে পারবে। পারিবারিক শান্তি কিন্তু স্ত্রীদের সুন্দর চিন্তা, শিক্ষা আর করণীয় কাজের মধ্যে দিয়েই আসে।
একজন মহিলার প্রাথমিক দায়িত্ব হওয়া উচিত যে সব ছোট ছোট কাজ অন্যদের খুশি করতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। লর্ড চেস্টারফিল্ডের মত হল এই সব কাজের গুরুত্ব অনেক। ভালো ব্যবহার ছোট ছোট উৎসর্গ থেকেই আসে। সুখী দাম্পত্য জীবনের গোপন রহস্যটি হল এটাই। যে সব স্ত্রীরা এই সব ব্যাপারে মনোযোগী তারাই এই ক্ষুদ্র উৎসর্গের পুরস্কার পান।
এই রকমই পুরস্কার পেয়েছিলেন নিউইয়র্ক শহরের মিসেস ওলগা। তিনি থাকেন হাথ ওয়েস্ট ৮১ এম. টি. ষ্ট্রীট, নিউইয়র্কে। ওলগা ছিলেন রাওল ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার বিধবা স্ত্রী। ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার ছিলেন কুবানের একজন কুটনীতিজ্ঞ আর আন্তর্জাতিক দাবা চ্যাম্পিয়ন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাধর, জনপ্রিয় আর জোরালো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। বিয়ের পর থেকেই ওলগা তার স্বামীর নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী চলার ব্যাপারে সহায়তা করে চলতেন।
এই আশ্চর্য ব্যাপারটি ওলগার জীবনে ঘটে সেই ছোট ছোট উৎসর্গ থেকে। ওলগা তার স্বামীকে কখনোই বিরক্ত করতেন না যখন তিনি কোনো ভাবনার গভীরে ডুবে থাকতেন। ওলগা পার্টিতে যেতে ভালবাসলেও স্বামীর ইচ্ছায় তিনি বেশির ভাগই বাড়িতেই থেকে যেতেন।
ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার ছিলেন চিন্তাবিদ। তিনি দর্শনশাস্ত্র আর ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু ওলগা পড়তে ভালবাসতে হালকা উপন্যাস। স্বামীর মনোরঞ্জনের আর কথোপকথনের আনন্দ পাওয়ার জন্য ওলগা নিজে মনোযোগ দিয়ে দর্শন আর ইতিহাস পড়তে শুরু করেন।
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, যে স্ত্রীরা স্বামীদের সুখী করতে পারেন তারা নিজেরাও তারই সঙ্গে সুখী হন। তারা অতি সহজেই বলতে পারেন যে স্বামীর সহযোগিতায় আমাদের জীবন কানায় কানায় পূর্ণ।
কোনো মানুষকে সুখী করে তার জীবনে আরাম আর সুখে পূর্ণ করলে তার কাজের মানসিকতারও পরিবর্তন আনা সম্ভবপর। একজনের কর্তব্য আর সহযোগিতার মধ্যে দিয়েই অন্য জনের ব্যক্তিত্ব আর কর্মক্ষমতা প্রসারিত করা যায়। তাই একজন মানুষকে সুখী করে তাকে পৃথিবীতে সাফল্যের পথে এগিয়ে দেওয়া যায়।
২৩. দাম্পত্য জীবনে একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী হোন
দাম্পত্য জীবনে একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী হওয়ার মতো আনন্দময়, সুখময় কাজ আর পৃথিবীতে নেই। একজনের হাসির আর আনন্দের অংশীদার হওয়ার মানেই হল মানুষের জীবনের সুখ আনার চাবিকাঠি। এই ব্যাপার গবেষণা করার জন্য সি. জি. ওডহাইস নামে একজন ব্যক্তি ২৫০ জন দম্পতির এক সমীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর মতে, দাম্পত্য জীবনের সাফল্যের মূল কথাই হল পরস্পরের সান্নিধ্য লাভ। আসল কাজ হল পরস্পরের গভীর ভালবাসা, ছোট ছোট স্বার্থ ত্যাগ, আর সুন্দর ধারণা গড়ে তোলা। সুলভ সস্তা আবেগ আর স্বার্থপরতা ত্যাগ সবচেয়ে ভালো কাজ একথা সকলেরই স্মরণে রাখা উচিত। যে স্ত্রী স্বামীর প্রিয় কাজে অংশ নেয় তার সান্নিধ্য হয় অনেক প্রবল আর জোরালো।
হ্যারি সি. এই স্টেনমেজ তার পত্রিকা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি’তে লিখেছিলেন, একজন সঙ্গীর পছন্দ প্রবন্ধ সম্পর্কে। তাতে তিনি বলেন, যে কোনো বিবাহিত জীবনের সাফল্য সঙ্গীর সঙ্গে তার পছন্দ-অপছন্দ আর অভ্যাসের মিলের উপরেই নির্ভর করে।
অতীতের মিশরের ভুবন বিখ্যাত সুন্দরী ক্লিনিক্যাল মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সম্ভবত কোনো রকম ধারণা ছিল না। ক্লিওপেট্রা শুধু সুন্দরীরই ছিলেন, আনন্দে অংশ গ্রহণ করার ক্ষমতা তার একেবারেই ছিল না। তার রূপ শুধু পুরুষকে আকর্ষণ করে পতঙ্গের মতো পুড়িয়ে মারত। ক্লিওপেট্রার শেষ দিকের প্রেমিক রোমান বীর মার্ক অ্যান্টনী মাছ ধরতে ভালবাসতেন। এই ক্লিওপেট্রা একবার মাছ ধরার উৎসবের ব্যবস্থা করে অ্যান্টনীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অ্যান্টনী অনেক সময় ধরে চেষ্টা করেও বঁড়শীতে মাছ গাঁথতে পারলেন না। ক্লিওপেট্রার আদেশে তাঁরই একজন ক্রীতদাস পানিতে ডুবে বঁড়শীতে বড় একটা মাছ আটকে দিয়েছিল। আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বামীর মনোরঞ্জন করা। মাঝে মাঝে ক্লিওপেট্রা অ্যান্টনীর আনন্দের ভাগীদার হওয়ার জন্য সাধারণ পোশাক পরতেন। একবার ভেবে দেখুন তো; ক্লিওপেট্রার মতো ক’জন স্বামীর বঁড়শীতে মাছ গেঁথে দিতে পারবেন? স্বামীর মন রাঙানোর জন্য সাধারণ পোশাক পরতে পারেন। এই ধরণের কিছু অসুখী, গলফ খেলতে অভ্যস্ত, স্বামীদের স্ত্রীর কথা আমার জানা আছে। সেই সব স্ত্রীর অভিযোগ তাদের স্বামীর বাকি সপ্তাহ শেষের ছুটির দিনগুলো গলফ খেলার মাঠেই কাটান।
এটা প্রমাণিত সত্য যে, যে সব স্ত্রীরা স্বামীদের অবনত আর অলস মুহূর্তকে আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারেন, তাঁরা নিজেরা কখনও অবহেলার শিকার হন না।
মিসেস ফ্রান্সিস শট, ৫০৮ রোল্যান্ড স্ট্রীট, নিউইয়র্কের বাসিন্দা। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় তিনি কিছুটা অসুখী ছিলেন। কারণ তার স্বামী বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে কাটাতেন আর মিসেস শট চাইতেন তার স্বামী যেন বাড়িতেই থাকেন। শেষ পর্যন্ত মিসেস শট তার স্বামীর মতের বিরুদ্ধ কিছুই করতেন না।
মি. শট হৈ-হল্লা ভালবাসতেন। মিসেস শট তাই ঘরকে চমৎকার করে সাজিয়ে রাখতেন যাতে তার স্বামী বাইরে কাটানোর সময় লোকজনদের নিয়ে ঘরে সময় কাটাতে পারেন। এই কৌশল বেশ কাজে লাগে।
মি. শট বিনোদনের জন্য ঘরমুখো হয়ে পড়েন। এরপর অবস্থা হয় যে, মিসেস শট শত চেষ্টা করেও ঘরের বাইরে স্বামীকে পাঠাতে পারতেন না। মিসেস শট তার নিজের প্রচেষ্টা দিয়ে স্বামীর অন্যতম সঙ্গিনী আর পরিচালিকা হয়ে ওঠেন। আপনিও চেষ্টা করুন, আপনার স্বামীর সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে ওঠার।
আসলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে সমব্যথী আর সমদর্শী হতে পারলে দাম্পত্য জীবনের বহু সমস্যারই সমাধান সম্ভব হয়।
২৪. স্বামীকে উৎসাহ দিন
একজন মানুষকে যে কোনো ভাবে সহযোগিতা করার অর্থই হল তাকে সুখী করা। সেই জন্য স্ত্রী হিসেবে আপনার উচিত স্বামীর যে সমস্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা থাকে তাকে বাস্তবে রূপায়িত করা। আপনার কাজ হবে স্বামীকে অনুপ্রাণিত করা। অ্যান্ডে মাওরিচ তাঁর ‘দি আর্ট অফ ম্যারেজ’ বইতে বলেন, কোনো বিবাহিত মানুষ সুখী হতে পার না, যদি-না সেই আনন্দে দুজনেরই সমান ভাগ থাকে। এটা কখনোই সম্ভব নয় যে দুজন মানুষের ধ্যান-ধারণা মনোভাব সবই একই রকম হবে। সেই কারণে স্বামী যে ধরনের বাসনা মনে মনে পোষণ করেন তাকে তাই করতে দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে কোনোরকম হিংসা পোষণ করা ঠিক নয়।
এটা খুবই সত্য যে, কোনো লোককে শখ বশত তার দৈহিক ও মানসিক শান্তি পাওয়ার সুযোগ সব সময়ই দেওয়া চাই, সেই কাজটি থেকে লোকটিই যে কেবল উপকৃত হন তা মোটেই নয়। তার পরিবারের সকলে যেমন, স্ত্রী ছেলেমেয়েরাও সমানভাবে উপকৃত হয় ও অংশীদার হয়।
যে সমস্ত স্ত্রীরা স্বামীদের বিভিন্ন শখে বা ইচ্ছাতে উৎসাহ দেন-তাদের স্বামীরা নিঃসন্দেহে স্ত্রীর অনুরক্ত থাকেন।
মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, কোনো মানুষ যদি তাতে বেশি রকম কাজের বদলে শখের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠে তাহলে বুঝতে হবে কোথাও কোনো গোলমাল রয়েছে। এই গোলমালের মূল খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আর এটা করার পরেই তাকে কাজে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব হবেই। কারণ শখ কোনো কাজ নয়, বরং শখের সাহায্যে মূল কাজের আনন্দের রসদ সগ্রহ করা হয়
মিসেস ক্লার্ক ছিলেন চীনা বয়ন বিভাগের একজন কর্মী। জাপানিদের হাতে তারা সকলেই বন্দি হন। বন্দি অবস্থায় তিনি অন্যান্য সব সহ-বন্দিদের কাছে সাহিত্য সম্বন্ধে বিভিন্ন রকম কথা শোনাতেন, বক্তৃতা করতেন-এতে বন্দিরা তাদের সাময়িক দুঃখ ভুলে আনন্দ লাভ করত। মিসেস ক্লার্ক জাপানি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বন্দিদের সামনে বন্দি শিবিরে একটা গানের ‘কোরাস্ সঙ্’ গড়ে তোলেন। ওই দলটি বড়দিনের সময় ব্যারল, নাচগান ইত্যাদিতে অংশ গ্রহণ করে বন্দিদের আনন্দ দান করত।
এর সবই সম্ভব হয়েছিল মাত্র একটা কারণে। প্রত্যেকটি মানুষের শখ থাকা একান্ত দরকার। কারণ এই শখ মানুষকে অবসর মুহূর্তগুলো আনন্দে পূর্ণ করে তোলে।
কিছু পুরুষ স্বামী হিসেবে বিচিত্র স্বভাবের মানুষ হয়ে থাকে। তাদের দেখা গেছে, রাতের বেলায় ছেলেদের সঙ্গে খেলে বা মাছ ধরে কাটাতে ভালবাসে। আবার কেউ কেউ আছেন যারা সময় পেলেই গোয়েন্দা কাহিনীতে ডুবে থেকে সময় কাটাতে চান।
স্বামীরা তাদের আনন্দময় অবসর সময় ধরা যায় একাকীই কাটান। স্ত্রীরা আর নিপুণ গৃহিণীরা ব্যাপারটা একটু লক্ষ্য করবেন।
আমি আমার বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, আমার স্বামী প্রত্যেক শুক্রবার তার বৃদ্ধ বন্ধু হোমারের সঙ্গেই কাটিয়েছেন। আমরা কেবল ছুটির অন্যান্য দিন একসঙ্গে কাটাতাম। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আমি শুক্রবার বিকেলটা একাকী কাটাব। আমার স্বামী যখন তার বন্ধুর সঙ্গে বাইরে সময় কাটান তখন তার চালচলন হয়ে ওঠে বাচ্চার মতো।
স্বামীরা আসলে আনুষ্ঠানিক কাজকর্মের বিরোধী হয়ে ওঠে। স্ত্রী হিসেবে যদি আমরা তাদের শখের জন্য কিছু সময় দিই প্রয়োজন মতো স্বাধীনতাও দিই তাহলে এ কথা নিঃসন্দেহে ঠিক যে, তাদের ঢের বেশি রকম আনন্দিত আর খুশি দেখতে পাব।
এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষের চেয়ে একজন সুখী মানুষ হাজার গুণ বেশি কর্মক্ষম।
২৫. সমস্ত কাজে উৎসাহী হয়ে উঠুন
একজন যোগ্য সহধর্মিণী হওয়ার তৃতীয় পন্থা হল এই যে, শুধু প্রতিদিনের গৃহস্থালির কাজে নিবিষ্ট না থেকে বিভিন্ন রকম কাজে অংশ নেওয়া। সংসারের কাজ সামলে কিছু সময় চিত্তবিনোদনে অতিবাহিত করা সব মেয়েদের ক্ষেত্রেই উচিত। এতে দারুণ উৎসাহ পাওয়া যায়। এক নাগাড়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে গেলে অবসাদ আসতে পারে। নিয়ম মাফিক কাজকর্ম থেকে কিছু সময় দূরে থাকলে আর তারপর কাজে মন ঢাললে শুধু যে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা যায় তাই নয়, প্রতিটি কাজই তাতে সুষ্ঠু আর নিখুঁতভাবেই শেষ করা যায়।
শুধু কাজের দায়িত্বভার বেশি হলেই যে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি তা নয় আসলে কাজের একঘেয়েমি আর বৈচিত্র্যহীনতাই আমাদের আবসাদগ্রস্ত করে তোলে। কাজকর্মে বৈচিত্র্য এলেই মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই সতেজ প্রফুল্ল আর উদ্যোগী হয়ে ওঠে।
একই ধরনের কাজে আবদ্ধ হয়ে থাকলে স্বাভাবতই দেহ আর মনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয়। নিঃসঙ্গতার অবসাদ থেকে বাঁচাতে হলে নানা কাজে অংশ নেওয়া খুবই সুন্দর ফলদায়ক অভ্যাস। এর মধ্যে ক্রেতা প্রশিক্ষণ পাঠমালা, সঙ্গীত শিখার আসর বা প্রতি সপ্তাহে কোনো সেবামূলক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে কিছু সময় কাজ করলে যে কোনো মহিলাই তার চিত্তবিনোদনের সুন্দর সুযোগ পাবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই চিত্তবিনোদনের সাথে সাথে আরও অনেক উপকার পাওয়া যাবে, যেমন, তার জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিধি দারুণভাবে বেড়ে যাবে, আর এর ফলে ব্যক্তিত্ব সুন্দর আর প্রখর হয়ে উঠবে। টেক্সাসের সান অ্যান্টিনিয়োর অধিবাসী মিসেস ওয়ান্টার জি, ফ্রাংকবিনার তার ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়াশুনা শুরু করার পর অবসর কাটানোর উদ্দেশ্যে শুক্রবার এবং সমস্ত ছুটির দিন সেন্ট লুইস গির্জার স্কুলে যোগদান করেন। তিনি শিক্ষয়িত্রীর কাজ নেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, শিশুদের সঙ্গে তিনি চমৎকার মানিয়ে নিতে পারেন। তাছাড়া অবসর সময়ে বিভিন্ন কাজকর্মে অংশ নেওয়ার পর নানা রকম আলাপ আলোচনায় তিনি যেন অভিনবত্ব খুঁজে পান।
তিনি বলেন, বাইরের কাজকর্মগুলো আমার মূল্যবোধের ও উন্নতির বিকাশ ঘটিয়েছে। আগে যে সব নগণ্য ব্যাপারে আমার রাগ হতে চাইতো বর্তমানে নগণ্য বলে সেগুলোর প্রতি কোনো মনোযোগ না দিয়ে আমাদের ঘরকে কীভাবে সকলের জন্য প্রেম ও শান্তির সখের স্বর্গে পরিণত করা যায়, সেই ধরনের অপেক্ষাকৃত বড় ধরনের চিন্তায় মনোনিবেশ করতে পারি।
কোন্ ধরনের কাজ আপনার উপযুক্ত সেটা আসলে নির্ভর করে আপনার প্রতিভার বিশেষ দিক আর অভিরুচির উপর। ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি নিউইয়র্ক শহরে শেক্সপীয়ার ক্লাবে যোগদান করে আমি প্রচুর প্রশান্তি আর আনন্দ পেয়েছিলাম। এই ক্লাবকে আমি বরাবর পছন্দ করে এসেছি। সেখানে নান বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। চারশ’ বছরের প্রাচীন পৃথিবীতে পদচারণা করতে গিয়ে আমি আমার বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর সমস্যাকে নতুন পরিপ্রেক্ষিতেই দেখার সুযোগ পেতাম। প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন সম্পর্কে আমার স্বামীর উৎসাহ অপরিসীম। অন্যদিকে আবার সে শেপীয়ারেরও বড় ভক্ত। আমরা একে অপরের কাজ থেকে নিজের নিজের মানসিকতা সম্বন্ধে প্রচুর আলোচনা আর সমালোচনা করেছি। আমরা বিভিন্ন ধরনের যুক্তিতর্কেরও অবতারণা করি। এছাড়া নানারকম রঙ-তামাশাতেও আমরা সময় কাটাই।
এটা খুবই সত্যি যে, বিয়ের ফলে স্বামী-স্ত্রী এতই কাছাকাছি এসে পড়ে যে সব কিছুই একসাথে করার চেষ্টা করার একটা চমৎকার মানসিকতা গড়ে ওঠে। একটা ভিন্ন প্রবৃত্তি বৈচিত্রের অবকাশ ঘটায় আর বিবাহিত জীবনকে স্বাভাবিক এবং সজীব রাখতে সহায়তা করে।
আপনারা যদি মনে করেন যে, আপনাদের বিবাহিত জীবনের কোথাও কোনো রকম অসঙ্গতি থেকে গেছে তাহলে আপনাদের জীবনের বিভিন্ন দিক বিচার করে দেখা প্রয়োজন। অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে যে, আপনি আপনার স্বামীর যথাযযাগ্য বা উপযুক্ত সহধর্মিণী বা জীবনসাথী হতে পেরেছেন কি না।
বাইশ, তেইশ, চব্বিশ, পঁচিশ পাঠের সূত্র ক’টি মেনে চলার চেষ্টা করুন:
১। সব সময় মনে আনন্দ রাখার চেষ্টা করবেন।
২। আপনি আপনার স্বামীর কিছু কিছু খেয়াল বা অভিরুচির অংশীদার হয়ে উঠুন।
৩। আপনার স্বামীকে তার নিজস্ব শখ মেটাতে দিন আর এ জন্য তাকে কিছু সময় একা থাকতে দিন।
৪। স্ত্রী হিসেবে আপনিও বাইরের কাজের শরিক হয়ে উঠুন।
২৬. কীভাবে স্বপ্নের নীড় গড়বেন
আজকাল সুখী গৃহ, স্বপ্নের নীড় রচনার জন্য মহিলারা শ্রদ্ধাভাজন হন না একথা বা অভিমত বহু বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদৃই প্রকাশ করে থাকেন। স্ত্রী হিসাবে নারী জীবনের এই প্রাথমিক দায়িত্ব সম্পাদন করার প্রতি আমরা যতই উদ্যোগ গ্রহণ করি না কেন, তার প্রতি সামাজিক ভাবে একেবারেই কোনো রকম গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এর ফলে মহিলারা যেন অসহায় আর আহত বোধ করেন। কোনো মহিলা যখন নিজেকে গৃহবধু বলে পরিচয় দিতে যান তার গলায় যেন ক্ষমা প্রার্থনার সুর বেজে ওঠে। কিন্তু মনে হয় যে মহিলা স্ত্রীর ভূমিকা পালন করার মধ্যে দিয়ে গৃহস্থালির কাজ সম্পন্ন আর পরিবারের লোকজনের পরিচর্যার জন্য তার সমস্ত সময় আর কর্মশক্তি ব্যয় করেন তার গর্বই বোধ করা উচিত। কোন সংসারে কত্রীকে বিভিন্ন ধরনেরই না কাজ করতে হয়। প্রতিনিয়ত তাকে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় তার জন্য কোনো পেশাদার অভিযানের থেকে প্রয়োজন হয় অনেক বেশি মেধা আর বহুমুখী নজর। কোনো গৃহকর্ত্রীর জীবনকে যদি আমরা ঠিকভাবে লক্ষ্য করে যাই তবে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোনো গৃহবধূর কাজ অফিসের কর্তাব্যক্তির চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ব্যাপারটা ভাবতে খুব অবাক লাগে যে বেচারী গৃহবধূকে কেবল চালাক, চটপটে, কর্মদক্ষ হলে হবে না তাকে আবার সুন্দরী আর মোহময়ী হতে হবে স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য। তাই বলছি, স্ত্রী হিসাবে আমরা যে কখন কোন কাজে অনভ্যস্ত হয়ে পড়ি তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। আমার মনে হয়, আমরা খুবই আনন্দ পেতে পারতাম যদি বছর বছর গৃহকর্ত্রীদের বিশেষত তরুণী গৃহবধূদের বাৎসরিক পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতো। কেননা, একজন গৃহবধূ অনেক বেশি বিচক্ষণ, আর তার দক্ষতাও প্রতিভার অধিকারী।
এবারে আমরা যে প্রশ্নটি রাখবো তা হল সংসার গড়ে তোলার ব্যাপারে আপনার ভূমিকা আপনার স্বামীর সাফল্যের উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করে থাকে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি উওম্যান দি লষ্ট সেক্স গ্রন্থের রচয়িতা বিখ্যাত ডা. ফানহ্যাম-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। তাঁর বক্তব্য হল, একজন পুরুষ যা আয় করেন তার স্ত্রী বিবেচনা আর কাজের মধ্যে দিয়ে এর কার্যকারিতা শতকরা ত্রিশ থেকে প্রায় ষাট ভাগ বেড়ে যায়। সাংসারিক অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, উপার্জিত অর্থ স্ত্রীর মাধ্যমে খরচ হলে সপ্তাহ বা মাস ধরে সংসারে অর্থের কোনো অভাবই বোঝা যায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সঞ্চয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
আমেরিকার বিখ্যাত লাইফ পত্রিকায় ‘উওম্যানস্ ডিলেমা’ শীর্ষক কোনো একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে, একজন পুরুষ তার ঘরে স্ত্রীর কাছ থেকে যে সেবা যত্ন আর সহযোগিতা পেয়ে থাকেন তার জন্য তিনি যদি নগদ অর্থ ব্যয় করতেন, তাহলে তাকে খরচ করতে হতো বছরে কম করেও প্রায় ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। এই তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ১৬ই জুন তারিখে।
অনেক বিখ্যাত মানুষের জীবন অগ্রগতি আর খ্যাতি মুলে রয়েছেন তাঁদের স্ত্রীরা। এসব মহিলারা অবলা গৃহবধূদের জীবনধারাকে নতুন অর্থ আর গৌরবে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। উদাহরণ হিসাবে একজন অবলা গৃহহ বলবো। প্রে
তিনি হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইস্ট ডি, আইজেন হাওয়ারের স্ত্রী। টুডেজ উইমেন’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে মিসেস আইজেন হাওয়ার গৃহবধু হিসাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি আর অনুভূতির এক চমৎকার বর্ণনা করেছেন। তাঁর অভিমত হল এই যে, একজন মহিলা জীবনে যা কিছু দেয় তার মধ্যে সবেচেয়ে সেরা বস্তু হল কোনো গৃহবধূর জীবনের গৌরবময় ভূমিকা। কেননা, এটা অত্যন্ত বিবেচনা-প্রসূত আর মহত্ত্বের পরিচয় যে বাড়তি লোভ ত্যাগ করে একজন গৃহবধূ স্ত্রী হিসাবে সংসারের কাজ করাকেই অনেক বেশি প্রয়োজন বলেই ভাবেন। আর এটাই সংসারকে আনন্দময় করে তোলে তাতে সন্দেহ নেই। এর মধ্যে দিয়ে একজন স্ত্রী অনায়াসেই পেতে পারেন নিবিড় এক প্রশান্তি আর রামধনুর স্পর্শ।
একজন অবলা গৃহবধূ হিসাবে মিসেস আইজেন হাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক সুখী আর সমৃদ্ধ কর্মময় চমৎকার গৃহাঙ্গন রচনা করতে। তিনি তাঁর স্বামীকে আমেরিকার সর্ব বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছেন। স্ত্রীর সহায়তায় মি. আইজেন হাওয়ার হন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
২৭. ঘরের টান একান্তই মধুর
সারাদিন পরিশ্রমের পর আপনার স্বামী কী ধরনের পরিবেশে ফিরে আসেন বলুন তো? কোন্ ধরনের পারিবারিক পরিবেশ আপনার স্বামীকে সাংসারিক কাজে প্রেরণা যোগায় আর প্রত্যেকদিন সকালে নতুন উদ্যোগে কাজকর্ম সুন্দরভাবে করতে সহায়তা করে? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু ঠিক নয়-বরং তার নিজের সাফল্য আর ব্যর্থতার উপরেই সেটা বেশির ভাগ নির্ভর করে।
অবশ্য স্বামীর অবদান অনেকটা নির্ভর করলেও গৃহিণী হিসাবে আপনার অবদান ও ভূমিকাই প্রধান। হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, সবার উপরে আপনি যে উদাহরণ স্থাপন করবেন তার উপরেই প্রধানভাবে নির্ভর করবে আপনার গৃহের সুন্দর পরিবেশের সামগ্রীক রূপটি। একজন গৃহস্বামীকে উল্লেখযোগ্য দক্ষতার সঙ্গে সংসারের দায়িত্ব পালন করার জন্য পরিবারের কাছ থেকে তার কিছু মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়া চাই।
মনে রাখা দরকার যে, একজন সুগৃহিণী ও স্ত্রী হিসাবে এগুলো হচ্ছে স্বামী সংরক্ষণ ও উত্তরোত্তর বৃদ্ধির পূর্ব শর্ত। এই শর্তগুলি কী এবারে আমরা আলোচনা করবো:
১। বিনোদন : আমরা যদি একজন মানুষকে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাবো যে, সে কাউকে যতই পছন্দ করুক না কেন, কর্মব্যস্ততার মুখে তার মধ্যে কিছু না কিছু স্নায়ুবিক উত্তেজনা দেখা দেবেই। স্নায়ুর উপরে যে চাপ পড়তে চায়, তা দূর করা সম্ভবপর হলে দেখা যাবে তার দেহ আর মন ও অনুভূতির সূক্ষ্মতন্ত্রতে নতুন নতুন প্রাণের শক্তি জন্ম নেয়। পরের দিন অদ্ভুতভাবেই তার দেহ হয়ে ওঠে সজীব, সতেজ আর কর্মক্ষেত্রে তা আনবে নতুন প্রেরণা।
সব মহিলারই কম বেশি বাসনা থাকে যে, তিনি হয়ে উঠবেন একজন অতি নিপুণ গৃহিণী। মনে রাখতে হবে, একজন পুরুষের জন্য এটা তখনই প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে যখন কোনো স্ত্রী ভেবে বসেন তিনি একজন আদর্শ গৃহিণী হয়ে উঠবেন।
জর্জ কেলি নামের একজন নাট্যকার ‘ক্রেগস ওয়াইফ’ নামে একটি নাটকের জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই নাটকটির আশ্চর্য জনপ্রিয়তার প্রধান আর অন্যতম কারণ হল এই যে, হ্যারিয়েট ক্রেগের মতো বহু মহিলাই পৃথিবীতে আছেন। হ্যারিয়েট ক্রেগ খুবই ঝকঝকে তকতকে ভাবের পরিবার পছন্দ করতেন। যেসব মানুষ তাদের জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখতেন তাদের তার পছন্দ হত না বলে অভ্যর্থনা জানাতেন না। এমন কী নিজের স্বামীকেও যেন অনধিকারীর মতো ভয় করতেন। কারণ স্বামী সাজানো জিনিস ওলোট-পালোট করে ফেলতেন।
একটা কথা কী কারোর ওপর বিরক্ত হওয়ার আগে নিজের লঘু কোমল মনটাকে উন্মুক্ত করা উচিত। অবসাদ ও উত্তেজনা দমন করার প্রকৃষ্ট উপায় হল ব্যাপারটা সহজভাবে মেনে নেওয়া।
২। আরাম আর আয়েস : সাধারণত গৃহিণীরাই ঘর সাজানের কাজটি করে থাকেন। সুতরাং ঘর সাজানোর সময় তাদের মনে রাখতে হবে যে, সবরকম সাজসজ্জার ভিতরের কথাটি হল অনেক বেশি রকম স্বাচ্ছন্দ্য আর স্বাভাবিক বোধ করা। তাছাড়া স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম হচ্ছে পুরুষের কর্মক্ষম থাকার জন্য অন্যতম প্রধান প্রয়োজন।
যে কোনো স্ত্রীর উচিত কোনো পুরুষের সাজানো-গোছানো ব্যাপারটা কোন ধরনের হলে ভালো লাগে সেটা একবার যাচাই করে দেখা। কোনো অবিবাহিত পুরুষকে একবার ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে।
একজন অবিবাহিত লোকের কথা আমার মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের নাম ওয়াল্টার লিঙ্ক। তিনি আমেরিকার নিউ জার্সির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানীর প্রধান ভূতাত্ত্বিক। চাকরির জন্য তাকে দেশের নানা দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করতে হয়। তার বাড়ির ঘরটিকে অত্যাধুনিক বলা যায়। চাকরি উপলক্ষে নানা দেশের ভ্রমণ করার সময় তিনি যেখান থেকে যা পেয়েছেন তাই সগ্রহ করে এনে ঘর সাজিয়েছেন। মি. লিঙ্কের ঘরখানায় ঢুকলেই মন প্রসন্ন হয়ে যায়-যেন আরাম আর আয়েসেরই আলোয় তা ঝলমল করে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এই মানুষটি এখনও অবিবাহিতই রয়ে গেছেন। মজার ব্যাপারটা হল এই, তারা নিজেদের যেরকম আরামে রেখে দিতে পারেন পৃথিবীতে তেমন কম মহিলাই আছেন যারা তাদের এই আরাম আর আয়েস দিতে পারবেন।
আমরা স্ত্রীরা যখন ঘর সাজানো আর সৌন্দর্যের কাজটি করি, আমরা কখনোই মনে করি না যে ঘরের পুরুষটির আরামের জন্য কী কী প্রয়োজন হতে পারে। স্ত্রী হিসাবে আপনার দরকার স্বামীর হাতের কাছে সেইসব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি তুলে ধরা। স্বামী যদি বিরক্তি বোধ করেন তাহলে বুঝতে হবে কোথাও আপনার ত্রুটি রয়েছে।
ঘরের মানুষটাকে সুখী করে তুলতে পারাই হচ্ছে তাকে ঘরে আটকে রাখার শ্রেষ্ঠতম কৌশল।
৩। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা : অধিকাংশ পুরুষই সুব্যবস্থায় ভরা সুন্দর পরিবেশে থাকতে পছন্দ করেন। সময়মতো খাওয়া-দাওয়ায় অসুবিধা, সকালের নাশতা পরিবেশনে দেরি, অগোচালো বিছানা ইত্যাদি পুরুষকে ঘরের প্রতি ক্রমশই অসুখী করে তোলে। আর এর পরিণতিও হয় ভয়ঙ্কর-তাদের বাইরের রমণীর প্রতি টান দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৪। আনন্দময় পরিবেশ : ঘরের পরিবেশ ভালো কি খারাপ যাই হোক না কেন, তার জন্য কিন্তু গৃহিণীরাই দায়ী থাকেন। একজন স্ত্রী হিসাবে আপনি ঘরে যে পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন তা আপনার স্বামীর সাংসারিক কাজকর্মকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবেই। আমরা স্ত্রীরা কামনা করি যে নিজের এলাকায় তারা উন্নতি করুক আর পারদর্শিতা অর্জন করুক আমাদের কামনা পূর্ণ করা সম্ভব হবে যদি আমরা ঘরের পরিবেশেকে শান্তিপূর্ণ আর মধুময় করে তুলতে পারি। স্ত্রী হিসাবে আমাদের কাজ হবে পরম নিষ্ঠায় স্বামীর দৈহিক আর মানসিক শক্তি বাড়িয়ে তোলা এবং তাকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব পরম স্নেহে পালন করা। যে স্ত্রী তার সংসারে এমন মধুর পরিবেশ সৃষ্টি করতে জানেন ড. পাসিনোর মতে, তিনিই তার স্বামীর জীবনের শূন্যতা পূরণ করতে পারেন, আর গৃহিণী হিসাবে নিজের দায়িত্ব আর ভূমিকাটির কথাটিও উপলব্ধি করতে পারেন।
৫। একটি অনুভূতি ও নিজের সংসার : নিজস্ব পারিবারিক গৃহ হল এক সুখের আকর। এখানে এক অপূর্ব অনুভূতি বিরাজ করে। আর সেই চমৎকার অনভূতি গৃহকর্তাকে দেয় সুখানুভূতির পরশ। কিন্তু কোনো সময় যদি নিজের বাড়িতে পরিবারের কর্তাব্যক্তি তার স্ত্রীর কুশাসনের স্বীকার হন তখন তাঁর মন থেকে সমস্ত শান্তি বিদায় নেয়। আর এর পরিণতিতে এমন ঘটনাও বিচিত্র নয় যে তিনি সব কিছু থেকে অব্যাহতি পেতে চাইবেন। সংসারের কাজে অথবা পরিবারের কারো জন্য কিছু প্রয়োজন হলে সবসময় স্বামীর মতামত নেওয়াই ভালো। নিজের দায়িত্বে সবকিছু কেনাকাটা করে পরে বিলের টাকা মেটানোর সময় স্বামীকে বলবেন না।
মনে রাখবেন, আপনার হাসিমুখে যতই ভালবাসার ঝিলিক থাকুক, কোনো স্বামীই মনে মনে তার তারিফ করেন না।
আশ্চর্য রকম আকর্ষণীয় সোফা না কেনা হলে আপনি হয়তো পছন্দ করবেন না, তবুও স্বামীর কেনা দোলনা চেয়ারটি আপনাকে ভালো মনেই গ্রহণ করতে হবে। একে একে দেখতে পাবেন আপনার স্বামীর রুচিজ্ঞান আপনারই মতো প্রখর, প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছে।
ঘর-সংসার সম্বন্ধে বেশি আলোচনা না করে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, সমস্ত পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হল গৃহকে সুন্দর আর নিরাপদ করে তোলা।
স্বামীকে সুখী করতে হলে কিছু জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে তা হলো:
১। গৃহ বা সংসারকে চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রে পরিণত করুন।
২। সুখ ও শান্তির ব্যবস্থা করুন।
৩। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর নিয়ম মেনে চলুন।
৪। সংসারকে ঝগড়া-বিবাদহীন শান্তির নীড় করে তুলুন।
৫। দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় সংসারকে আনন্দময় করে তুলুন।
২৮. অযথা সময় নষ্ট করবেন না
আমরা প্রায় সকলেই বলে থাকি যে সময় নেই, সময়ের খুব অভাব। কিন্তু সারা দিন রাতের এই চব্বিশ ঘন্টা সময় নষ্ট না করে ঠিকমতো কাজে লাগানোই হল আসল কথা। আমেরিকার বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের স্ত্রী মিসেস রুজভেল্টকে কেউ কর্মবিমুখ অলস অপবাদ দিতে পারে নি। লেখাপড়ার সাথে সাথে নানারকম কাজ, তারই সঙ্গে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন করার জন্য তৎপরতা চালানো এই সমস্ত কাজের মধ্যে তিনি অহরহ ডুবে থাকতেন। এ কথা কখনোই শোনা যায় নি যে সময়ের অভাব হয়েছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার মিসেস রুজভেল্টের মতো চব্বিশ ঘন্টা হাতে পেয়েও আমরা কিন্তু নিজের আর সংসারের কাজে লাগে এমন কিছুই করতে পারি না। কিন্তু কেন পারি না? এর উত্তর হল, সংসারের কাজের জন্য।
কোনো মহিলা যদি তার সময়কে সুনির্বাচিতভাবে ব্যয় করেন তবে নিজের এই ফলাফল দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। তাই বলা যায়, বিষয়টির তাৎপর্য লক্ষ্য করে নিজেকে দিয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টা করুন। এক সপ্তাহের রোজনামচা আর খতিয়ান পর্যালোচনা করলে আপনি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, কীভাবে আপনার জীবনের মূল্যবান সময় বয়ে চলেছে।
এই সাপ্তাহিক হিসেবের আলোয় আপনি আপনার সময়ের বাজেট তৈরি করে নিন। এর মধ্যে থেকেই নির্ধারণ করে নিন, কোন কাজের জন্য দৈনিক কত সময় ব্যয় করবেন। দেখবেন, আপনার সময়ের বৃথা অপচয় আপনার থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে।
নিউইয়র্কে ‘নিউ স্কুল ফর সোস্যাল রিসার্চ কর্তৃপক্ষ একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করেছেন। এই কোর্সের নাম হল সমাজের নারীর মানবিক সম্পর্কের কারখানা।’ মিস এলিমা রাইসক নামে একজন ব্যবসায়ী আর শিক্ষিকা এখানে শিক্ষাদান করেন। এই শিক্ষার প্রধান অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মহিলাদের সমাজে যথোপযুক্ত মর্যাদা আর স্বীকৃতি লাভের জন্য করণীয় বিষয় শেখানো। এই শিক্ষণ ব্যবস্থার প্রথম কাজ হল প্রত্যেক ছাত্রী কীভাবে সময় ব্যয় করছে তার তালিকা তৈরি করা। কেননা, দৈনিক চব্বিশ ঘন্টা সময়ের বরাদ্দ থেকেই এইসব মুহূর্ত নিঃশেষ হয়ে চলে।
এই সব মুহূর্তকে বেশ লাভজনক ভাবেই কাজে লাগান যায়। থিয়োডর রুজভেল্ট যখন আমেরিকার রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন তখন তার ডেস্কের ভিতর সবসময় একখানা বই খুলে রেখে দিতেন। কথাবার্তা আর লোকজন ইত্যাদির দেখা সাক্ষাতের মাঝখানে তিনি যে দু’তিন মিনিট সময় পেতেন সেটুকু ওই বই পড়ার কাজে ব্যবহার করতেন। আপনিও চেষ্টা করলে পারেন আপনার জীবনে যে সময়গুলো নষ্ট হয় সেই সময়গুলোকে কাজে লাগাতে। সৃজনশীল লোকেরা যা করেন আপনিও তাই করে দেখতে পারেন। অর্থাৎ আপনার সময়সূচিকে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করুন। সময় এতই মূল্যবান যে তাকে সৃষ্টি ধর্মী কাজে ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন।
আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন যে, আপনার পরিচিত যে সব কর্মব্যস্ত মানুষ ঠিক ঠিক সময়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করেন তাদের কিন্তু কখনোই সময়ের অভাব ঘটে না। সম্ভবত, একজন কর্মব্যস্ত স্বামীর তরুণী স্ত্রী যিনি তিন সন্তানের মা, পেশায় তিনি হয়তো মেট্রন, এই সমস্ত কাজের মহা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাকে নিজের হাতে সংসারের যাবতীয় কাজ করতে হয়, আবার রবিবার দিন তিনি গির্জায় প্রার্থনা সঙ্গীতেও অংশ নেন।
এটা ঠিক যে এই ধরনের মহিলারা অনেক বেশি কর্মশক্তির অধিকারিণী হয়ে থাকে। কারণ তারা কীভাবে নিজেদের সব ব্যবস্থা করার মধ্যে দিয়ে ঘর সংসার গুছিয়ে নিতে হয় সেটা শিখে নিয়েছেন আর সবার উপরে সময়ের মূল্য সম্বন্ধে তারা অত্যন্ত সচেতন আর ওয়াকিবহাল থাকেন। এ কথা সত্য যে, সময়ের অপচয় করা বিপুল অর্থ ব্যয় করা চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। যে সময় একবার চলে যায় তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। কীভাবে সময়ের অপচয় বন্ধ করা যায়, সে সম্পর্কে এখানে কয়েকটি নিয়মের উল্লেখ করছি :
১। সময় জরিপ করুন : প্রত্যহ আপনি যে সময় ব্যয় করেন সে সম্পর্কে নিষ্ঠার সঙ্গে একটা জরিপ করার কাজ করুন। ভালোভাবে অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে সময় কোথায় যায়।
২। আগাম প্রতিটি দিনের কাজে জন্য সময় নির্দিষ্ট করে রাখুন : প্রত্যেক সপ্তাহে পরের সপ্তাহের জন্য আগাম প্রতিটি দিনের কাজের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে রাখুন। মনে রাখবেন, যুক্তিসঙ্গত সময়ে প্রতিদিনের কাজগুলো সমাধা করলে স্নায়ুর উপর চাপ কমে-ক্লান্তি আর অবসাদও দূর হয়ে যায়।
৩। বিভিন্নভাবে সময় কাজ লাগান : সময়ের অভাবে কাজটি করতে পারেন নি, এমন কোনো কাজ বেছে নিয়ে সেটা শেষ করার ব্যবস্থা করুন। এ কাজটি করবেন আপনার পাওনা অবসর সময়টুকু কাজে বেছে নিয়ে সেটা শেষ করার কোনো কারণ নেই।
৪। একটি ঘণ্টাকে দু’ঘণ্টায় পরিণত করুন : মিসেস গুজার্ডি এটাই করতেন। তিনি স্বামীর বিক্রির অভিযান সফল করার জন্যই করতেন। তিনি একটা কাজে নিবিষ্ট থাকার মধ্যেই অন্য কোনো কাজ করতে থাকেন। অর্থাৎ এক বিষয়ের কথাই মনে মনে চিন্তা করে চলেন। যেমন-শিশুকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে অনায়াসেই সেলাইয়ের কাজটি শেষ করে নেওয়া যায়। এভাবেই এক ঘণ্টা দু’ঘণ্টায় পরিণত হতে পারে।
৫। বিশ শতকের সময় রক্ষকের পদ্ধতি : দৈনিক সংবাপত্রের বিজ্ঞাপন, ক্রেতা গবেষণা কেন্দ্রের বুলেটিন, ডাকযোগে বইপত্রের গ্রাহক সংগ্রহ ডাকবিভাগ ও টেলিফোনের ব্যবহার ইত্যাদি নিঃসন্দেহে সময় সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যেই চালু হয়। যে সব জিনিস আগে থেকে ডাকযোগে আনার ব্যবস্থা করা যায়, তা নিঃসন্দেহে সময় বাঁচানোর তাগিদ থেকে উৎপন্ন।
৬। সময় বাঁচানোর জন্য ক্রয় কৌশল শিখুন : আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জানা থাকা, বিশেষ বিশেষ জিনিস কেনা বা বেচা সম্পর্কে অবহিত থাকা আর একই সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যত বেশি কিনে রাখা সম্ভব ক্রেতার পক্ষেও সত্যিই লাভজনক কাজ। সুচিন্তিতভাবে কেনাকাটা একটি বুদ্ধিমানের কাজ। এজন্য অবশ্য সতর্কতার প্রয়োজন। কীভাবে কিনতে হয়, এটা জানা থাকলে আপনি আর্থিক ও সময়ের দুটি দিক থেকেই লাভবান হতে পারেন। নিঃসন্দেহে এটা পৃথিবীর সব দেশেই প্রমাণ হয়েছে।
৭। কাজের প্রতিবন্ধকতা দূর করুন : কাজের সময় যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় একটু চেষ্টা করলেই আপনি তা দূর করতে পারবেন।
‘হাউ টু লিভ অন টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স এ ডে’ গ্রন্থটিতে লেখক মি. আর্নল্ড লিখেছেন যে সময় সরবরাহ ব্যাপারটা সত্যই অলৌকিক কোনো ব্যাপার…সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাবেন যে, আপনার জীবনের চব্বিশটি ঘন্টা মন্ত্রবলেই যেন প্রকৃতি আপনার মূলধনের সঙ্গে একই সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন। আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি সারা জীবন ধরে বলেন না, আর একটু সময় পেলেই আমি অনেক পরিবর্তন আনতে পারতাম। মনে রাখতে হবে, আমরা আর কখনোই এর চেয়ে বেশি সময় পাবো না। আমাদের হাতে সময় আছে, সবসময় ছিল-আর তা ভবিষ্যতেও থাকবে।’
২৯. যা বলার সংক্ষেপে বলুন
১৯৪৮ সালে আমরা যখন ইউরোপে ভ্রমণ করতে গিয়েছিলাম, সেখানে একজন অধ্যাপক আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ভদ্রলোকের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখলাম সেখানে তার স্ত্রী ছিলেন না। তিনি রান্নাঘরে চাকর-বাকরদের কাজের তদারকি করছিলেন। ইতোমধ্যে ভদ্রমহিলা এসে পড়লেন। আমাদের সঙ্গে তাঁর অল্পই কথাবার্তা হল, এরপর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল, ভদ্রমহিলা তার রান্নার মেনু আর তদারকিতে এমনই বিব্রত হয়েছিলেন যে কারও দিকে আর নজর দিতে পারলেন না। এর চেয়ে কোনো রেস্তোরাঁয় গেলে ভদ্রমহিলার সঙ্গে ভালোভাবে আলাপ করা যেত, তার সঙ্গও পেতে পারতাম। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই ‘শর্টকাট পদ্ধতির কথা জানতেন না। আজকালকার ব্যস্ততার দিনে এই শটকার্ট পদ্ধতিটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহিণীদের এই শর্টকাট বা স্বল্প পরিশ্রমে কাজকর্ম সমাধা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রচুর মেধা আর উদ্ভাবনীশক্তি ব্যয় করা শুরু হয়েছে। ‘ আমরাই বা এই ধরনের সুযোগ গ্রহণ করবো না কেন? যদি জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কর্মশক্তি ও সময়ের ব্যবহার বেশিরকম গুরুত্ব আর তাৎপর্যপূর্ণ হয়, আর তারই সঙ্গে জানা দরকার এই কর্মশক্তি ব্যয় করার মধ্যে দিয়ে আদর্শ স্ত্রী ও মা হাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন রকম ফলশ্রুতিতে জানা গেছে দক্ষতা অর্জন আর কাজের মান বাড়িয়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়াই হচ্ছে গৃহিণীদের প্রধান অন্তরায়।
আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের গৃহাঙ্গন রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। তাই আপনার কাজকর্ম পরীক্ষা করে নিন আর দেখুন আপনি আপনার দক্ষতা বাড়াতে পারেন কিনা। মনে রাখা দরকার যে, ক্ষেত্রবিশেষে দ্রুততম ব্যবস্থাই সর্বোত্তম ব্যবস্থা।
মূলকথা হল, গৃহস্থালির কাজের জন্য যেখানে যেটা দরকার আগে থেকেই সেখানে সেটা যেন সাজিয়ে রাখা থাকে। এই প্রসঙ্গে কিছু পরামর্শের উল্লেখ করছিঃ
১। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র : যেমন-টুথপেস্ট, সাবান, তেল একসঙ্গে কিনে রাখলে টাকা পয়সার দিক থেকেও সাশ্রয় হয় আর সময়ও বাঁচে।
২। পরিকল্পনা : কোনো জিনিস কেনাকাটার আগে কতটা দরকার কত দামের মধ্যে আগে থেকে ঠিক করে তবে দোকানের উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন।
৩। ক্রেতা রিচার্স সার্ভিস : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বহু উন্নত দেশে ক্রেতা রিচার্স সার্ভিসের সহায়তা গ্রহণ করা হয়। এই সার্ভিস কর্তৃপক্ষ মালিক বুলেটিনের আকারে আর বার্ষিক তালিকা বা ক্যাটালগ আকারে ক্রেতাদের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর দর-দাম ওঠানামা, গুণ, গুণগত পরিবর্তন আর নতুন আবিষ্কার সংযোজন করে ক্রেতাদের সব সময় অবহিত রাখেন। অনুন্নতদেশগুলোতে এই সুবিধার প্রচলন না থাকলেও নিজের পরিবারের চাহিদার জিনিসপত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা যায়। আর একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, দাম বেশি হলেই জিনিসের গুণগত মান কখনোই বেশি হয় না।
৪। তালিকা রাখুন : যদি স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর না হয় তাহলে যে কেউ প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্রের তালিকা রাখলে সুন্দর সময় সাশ্রয় করা যায়। আসল কথা হল, পদ্ধতিগত বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে কাজ যেমন সহজসাধ্য হয়ে ওঠে, তেমনই আবার সময় ও অর্থের অপচয় বন্ধ হয়ে যায়।
এবারে যে সব কাজ আপনি করতে পছন্দ করেন না অথচ করতে বাধ্য হন সেগুলি সংক্ষিপ্ত এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার তিনটি পদ্ধতি উল্লেখ করবো। এগুলি হল :
১। কাজের পদ্ধতি বিশ্লেষণ : নিজেকে কখন কোন কাজে লাগাবেন তা আগে থেকেই ঠিক করে ফেলুন। কীভাবে অযথা শ্রম ব্যয় করছেন তার একটা হিসাব রাখুন।
২। পরামর্শ : আপনার বান্ধবীদের কাছ থেকে যেমন পরামর্শ নেবেন, তেমন আপনার স্বামীর কাছ থেকেও পরামর্শ নেবেন। এ কথা ভাববেন না যে পুরুষ মানুষ হিসাবে সাংসারিক বিষয়ে তাঁর জ্ঞান নেই। শর্টকাটের ক্ষেত্রে পুরুষদের অবদান প্রচুর।
৩। দক্ষতা অর্জন : যে সব কাজে আপনি অদক্ষ সেগুলো বেশ সতর্কতার সঙ্গেই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে যে সব কাজ করণীয় সেগুলো সুষ্ঠুভাবে করতে হবে। সদ্ইচ্ছা থাকলে দক্ষতা আসবেই।
৪। একটি সতর্কবাণী : যে সমস্ত কাজে আপনি আনন্দ পান আপনার পরিবারের সকলে সুখী হন, সেগুলো শর্টকাট করার দরকার নেই। কোনো কোনো মহিলা সেলাই করা, নানা স্বাদের রান্না করা ইত্যাদি পছন্দ করেন। আপনার ক্ষেত্রে যে রকম ইচ্ছাই হোক সেটা ভালোভাবেই সম্পন্ন করার চেষ্টা করুন। দেখবেন, তাতে অনেক বেশি তৃপ্তি লাভ করবেন।
আধুনিক যুগে বৈজ্ঞানিক বা অবৈজ্ঞানিক যে পদ্ধতিই কাজে লাগানো হোক না কেন, তার প্রধান উদ্দেশ্যই হল অনেকটা কম সময়ে অন্যান্য কাজ শেষ করে সৃজনশীল কাজে বেশি সময় দেওয়া।
সংক্ষেপে ছাব্বিশ, সাতাশ, আটাশ, ঊনত্রিশ পাঠের নিয়মগুলি আমরা লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করব :
১। আপনি গৃহিণী হওয়ার জন্য গৌরব বোধ করুন।
২। আপনার সংসার সকলের জন্য গড়ে তুলুন। স্বামীর সংসারকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ ও বিনোদনের ক্ষেত্রে পরিণত করুন।
৩। সময়ের সুবিধা কাজে লাগান।
৪। শর্টকাট পদ্ধতি বা সংক্ষিপ্ত পথে কাজকর্ম সহজতর আর স্বচ্ছন্দ গতির করে তুলুন।
৩০. স্বামীকে জনপ্রিয় করার কৌশল
স্বামীকে জনপ্রিয় করার ব্যাপারে তিনটি কৌশল মনে রাখতে হবে। একটু চেষ্টা করলেই মহিলারা তাদের স্বামীদের জনপ্রিয় করে তুলতে পারেন। এখন আমরা সেই তিনটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো :
১। স্বামীকে প্রিয় করে তুলুন : প্রথমেই প্রশ্ন রাখবো, যেসব পুরুষ আকর্ষণীয় নন তাদের স্ত্রীদের কিছু করণীয় আছে কিনা। আমার মত হল, অবশ্যই আছে। আমি একজন মহিলাকে জানি যার স্বামী সামাজিকভাবে ব্যর্থ। ভদ্রলোক ছিলেন অসম্ভব জেদী, বিতর্ক প্রিয় আর অসহিষ্ণু। কিন্তু ভদ্রলোকের স্ত্রীর কাছ থেকে তার ছোটবেলার দুঃখ-কষ্টপূর্ণ জীবন কথা শোনার পরেই কিন্তু তার প্রতি আমাদের সমস্ত বিদ্বেষ, বিতৃষ্ণার ভাব দূর হয়ে মন সহানুভূতিতে ভরে যায়। ভদ্রলোকের স্ত্রীর কাছ থেকে জানা যায় যে, শৈশবে ভদ্রলোককে আশ্রয় আর অন্ন সংস্থানের জন্য আত্মীয় থেকে আত্মীয়ের কাছে আশ্রয় নিতে হয়। সমস্ত শৈশবের দিনগুলোতে তিনি কারও কাছেই কণামাত্র স্নেহ মমতার স্পর্শ পান নি, তার ভাগ্যে শুধু অপমান আর নিগ্রহ জোটে। এসব কথা শোনার পর ভদ্রলোকের ওই ধরনের আচরণে একটা কারণ বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না যে তার স্ত্রী হয়তো তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলতে পারেন নি। কিন্তু স্বামীর ভুল ত্রুটির কারণ সকলের কাছে ব্যাখ্যা করে তার প্রতি সবাইকে সহানুভূতিশীল করে তুলতে পেরেছেন। বিতৃষ্ণা থেকে সহানুভূতি-দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরু। কৃতকার্যময়ী স্ত্রীই পারবেন তার স্বামীকে সুন্দর ও মার্জিত রুচির মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। এই ধরনের স্ত্রী ইতিহাসে বহু সমাজ বিদ্বেষী স্বামীকে যে কীভাবে রক্ষা করেছেন তার প্রচুর নিদর্শন রয়েছে।
২। স্বামীর গুণের বিষয় প্রকাশ করুন : স্ত্রী হিসেবে আপনার উচিত স্বামীর গুণ আর ব্যক্তিত্বের কথা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে প্রকাশ করা। এর জন্য পারিবারিক আচার অনুষ্ঠান এমন ভাবে করা চাই যার মধ্যে দিয়ে স্বামীর গুণ আর ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়। যাতে স্বামীর গুণের প্রতিফলন ঘটে, তিনি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেন এমন পথই নেওয়া প্রয়োজন।
৩। বুদ্ধিমতী স্ত্রী হয়ে উঠুন : প্রায় সময়ই লক্ষ্য করা যায় যে, যাদের কোনো কাজের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয় আর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যারা নিজেরদের ওপর আস্থা রাখেন, তারাই আবার সামাজিক দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে কেমন যেন শঙ্কুচিত হয়ে পড়েন। একজন বুদ্ধিমতী স্ত্রী নিঃসন্দেহে এই ধরনের মানুষের শ্রেষ্ঠতম বন্ধু। বুদ্ধিমতী স্ত্রী ঘরোয়া আলাপের ক্ষেত্রে স্বামীকে অনেক কথার খেই ধরিয়ে দিতে পারেন। স্বামীর যদি বাকপটুতা নাও থাকে তিনি একে একে সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবেন।
একবার এক মেট্রন আমাকে বলেছিলেন, কীভাবে তিনি তার ঘরকুনো স্বামীকে নানারকম সামাজিক কাজকর্মে জড়িত করতে পেরেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল স্বামীকে সমাজচেতনাহীন অবস্থা থেকে সমাজ সম্বন্ধে উৎসাহী করে তোলা। মহিলা জানতেন, তার স্বামীর ফটো তোলার ঝোঁক আছে আর বিভিন্ন। ধরনের ফটোগ্রাফীতে তিনি বেশ আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। মহিলা ইতোমধ্যে তার স্বামীকে কিছুই জানতে দিলেন না। তার স্বামী যখন বাড়ির বাইরে যেতেন তখন ফটোগ্রাফী সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন কাউকে তিনি খুঁজে আনতেন আর স্বামী ফিরলে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। একই বিষয়ে আগ্রহ দেখে ওয়াল্টার তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিতেন। এর ফলে কথা বলতে বলতে তার স্বামী ওয়াল্টার আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়তেন আর তার নিজের স্বরূপও প্রকাশ হয়ে পড়তো।
এই রকম একজন চামড়ার ব্যবসায়ীর কথা আমি জানি। ভদ্রলোকের চমৎকার জ্ঞান ছিল নানাধরনের আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন সম্বন্ধে। আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে পড়াশোনাতেও তার প্রচুর উৎসাহ ছিল। অথচ তার স্ত্রীর কথাটা জানা থাকলেও এ বিষয়ে কাউকেই কিছু জানান নি। আমার মনে হয়, মহিলা যদি কথাটা সকলকে জানাতেন তাহলে তার স্বামীর সুনামের ভাগ তিনিও পেতে পারতেন। তার অবশ্যই উচিত ছিল স্বামীকে সকলের কাছে প্রিয় করে তোলা। স্ত্রীর উচিত সর্বক্ষেত্রে স্বামীর বাড়তি শ্রেষ্ঠ গুণের কথা বাইরের মানুষকে জানানো।
৩১. স্বামীর গুণ ও দোষ
আপনার স্বামীর সম্বন্ধে অন্যরা যে ধারণা পোষণ করেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই আপনার স্বামীর প্রতি আপনারই ধারণা প্রতিফলন হতে পারে। একটি ঘটনার কথা আমি বলছি। কোনো-একটা জিনিসের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় আমি একজন ডিলারকে ফোন করি। সেই সময় ভদ্রলোক দোকানে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী টেলিফোনে তাঁর হয়ে কথা বলছিলেন। তিনি জানান যে, তাঁর স্বামী এই সব ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ। আমার ইচ্ছা হলে তিনি আমার ঘর দেখে আসার ব্যবস্থা করে দেবেন। ভদ্রলোক সত্যিই একজন বিশেষজ্ঞ মানুষ। আমার একটা ধারণা জন্মায়, তার অভিজ্ঞতার কোনো সীমা নেই। তার প্রতি আমার যে বিশ্বাস জন্মায় তা নিঃসন্দেহে তার স্ত্রীর জন্যই। এসব উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, এমন কোনো ব্যক্তি বা মহল নেই যা এসব ক্ষেত্রে কোনো স্ত্রীকে হারাতে পারে। যে কোনো একজন মানুষের সত্যিকার গুণগত খ্যাতি বা পরিচিতি বহুক্ষেত্রেই তাঁদের স্ত্রীদের উপর নির্ভরশীল।
মানবচরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে, একজন লোককে আমরা যেভাবে উপস্থিত করি, চরিত্রারোপ করতে চাই, একান্ত অজ্ঞাতসারে তিনি সেই চরিত্রেরই অধিকারী হয়ে পড়েন।
বিভিন্ন পেশার মানুষের স্ত্রীদের লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা স্বামীদের সম্পর্কে অনুকূল ধারণা প্রদান করতে অভ্যস্ত। যেমন-প্রস্তাবিত কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করতে অক্ষমতা জানাতে গেলে তাদের স্ত্রীদের কথা হল, তাদের নিশ্চয়ই পার্টিতে যোগ দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু তারা তা পারেন না। যেহেতু তাদের স্বামীরা তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। এক্ষেত্রে যদি তার স্ত্রী কোনো সময় স্বামীর কবিত্বের কথা প্রচার করেও থাকেন তাতে দোষাবহ কিছু থাকে না। অবশ্য স্ত্রী যদি সাধারণ ভদ্রতা আর রুচিবোধের সীমা অতিক্রম না করেন।
বিখ্যাত লোকেরা জানেন যে উঁচুদরের কোনো মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, এই কথাটি উপযুক্ত কৌশলের সঙ্গে প্রকাশ করতে জানে এমন একজন মহিলাকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়া জীবনে কত মূল্যবান ও অপরিহার্য।
শিকাগো শহরে জুনিয়র অ্যাসোসিয়েশন অব কমার্সের এক সভায় মি. কুশম্যান বিজেল বলেন যে, স্ত্রীদের তুচ্ছ করা বা তাদের কাজের অবমূল্যায়ন করা অনুচিত। মনে রাখবেন, আপনাদের স্ত্রীরাই শ্রেষ্ঠ বিক্রেতা বা সেলসম্যান হতে পারেন, যদি না তারা আতিশয্যের আশ্রয় নেন। তিনি আপনার পক্ষে যা সম্ভব নয় সেই রকম মধুরতা মিশিয়ে আপনার গুণকীর্তন করতে পারেন। স্ত্রীর পক্ষে সবকিছুই সম্ভব।
স্বামীর গুণের দিকগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়াও তিনি স্বামীর দোষ-ত্রুটিগুলো লঘু করে দেখাতে পারেন। আসলে প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউই ত্রুটিমুক্ত নই। স্ত্রীরও কিছু ভুল-ত্রুটি থাকে-কিন্তু সে ত্রুটি ঘরের বা সাংসারিক জীবনেই আবদ্ধ থাকে কিন্তু একজন পুরুষের ভুল ত্রুটি তার জীবন সাফল্যের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
অনেক বিদূষী স্ত্রীই স্বামীর শিক্ষাগত অথবা প্রশিক্ষণগত ত্রুটি দূর করতে পারেন। পৃথিবীর অনেক মহান ব্যক্তিই যারা নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে পেরেছেন, তাদের বিঘ্ন সঙ্কুল জীবনকে স্ত্রীরাই সহজ সরল মসৃণ করে তুলেছেন।
কোনো কোনো মানুষ আছেন যারা অত্যন্ত বিনম্র। আপনার স্বামী যদি ওই ধরনের লোকদের একজন হয়ে থাকেন, তা হলে তাকে সাহায্য করতে পারেন। সেটা কীভাবে করবেন তার জন্য কয়েকটা পদ্ধতির উল্লেখ করছি :
১। অতীতে আপনার স্বামী যে যে বিষয় সাফল্য অর্জন করেছেন তাকে সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিন।
২। যখনই সম্ভব নানা বিষয়ে মতামত জিজাসা করে তার আত্মপ্রকাশের সুযোগ দিন।
৩। এমন বন্ধু-বান্ধব লাভ করার চেষ্টা করুন-যারা তাকে প্রশংসা করবেন আর উৎসাহ দেবেন।
আপনার স্বামীর পরিচয় তার প্রকৃতি জানার সঠিক মাপকাঠি নাও হতে পারে। তা সত্ত্বেও তার বাহ্যিক আচরণের উপর নির্ভর করেই লোকে তার সম্পর্কে অভিমান পোষণ করবে।
ত্রিশ, একত্রিশ পাঠের সূত্র : স্বামীকে যেভাবে জনপ্রিয় করা যায় :
১। তাঁকে প্রিয় করে তুলুন-তার প্রতিভার প্রচার ঘটান। তার শ্রেষ্ঠ দিকটি উন্মোচন করুন।
২। আপনি একজন দক্ষ সাংবাদিক হয়ে উঠুন। তার দোষ প্রায় অদৃশ্য করে তাঁর সমস্ত গুণকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলুন।
৩২. বত্রিশ স্বামীর স্বাস্থ্য ও সম্পদ রক্ষা করুন আয় বুঝে ব্যয় করুন
সংসার জীবনটায় দারিদ্র্য আর আর্থিক অক্ষমতার মতো মারাত্মক আর কিছুই নেই। যে লোক নিজের আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করে সে কখনোই কৃতকার্য হতে পারে না। অমিতব্যয়ী স্ত্রী স্বামীর কাছে বিরাট বোঝার মতো। এটা প্রমাণিত সত্য যে, অতিরিক্ত আয় অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একটি পারিবারিক বিষয়ক সম্পর্কে মনস্তত্ত্বের বই আমার হাতে এসে পড়ে। লেখক মনস্তাত্ত্বিক ব্যক্তিটির এক বিশেষ দুর্বলতা ছিল-তিনি কোনো পারিবারিক বাজেট বরদাস্ত করতে পারতেন না। তার মতে, পরিবারের আয়-ব্যয় কোনো ঝামেলার ব্যাপার নয়। হাতে যখন প্রচুর টাকা থাকে তখন আমরা ইচ্ছামতো খরচ করি। আর যখন থাকে না তখন সংযম অভ্যাস করি।
আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে একমত যে তার পদ্ধতি বেশ সহজ। টাকা থাকলে খরচ করব, না থাকলে করব না। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই এই পদ্ধতিকে কোনো ভাবেই সত্যিকার বুদ্ধিদীপ্ত অর্থনীতি বলে না। পরিকল্পনাহীন ব্যয়ের অর্থই হল আপনার আয় প্রায় সকলেই ভোগে লেগেছে।
পরিকল্পনা আর ব্যয়ের মাধ্যমে আপনি ও আপনার পরিবারের মানুষ শুধু উপার্জিত অর্থের একাংশ ভোগ করতে পারছেন। বাজেটের অর্থ কিন্তু উদ্দেশ্য বিহীন ব্যয় বা চুলচেরা হিসাবের তালিকামাত্র নয়। এটা হল, আপনার কাছে যে টাকা আছে বা আসছে তার সাহায্যে বেশি পরিমাণে জিনিষপত্র কেনার পরিকল্পিত এক কর্মসূচি। বাজেট অনুযায়ী ব্যয় করলে আপনি কেনাকাটার ব্যাপারে কোথায় হ্রাস-বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, কোটা বাদ দেওয়া উচিত, কোটার সংযোজন চাই, এসব সহজেই বুঝতে পারবেন। আপনি যদি বরাবর বাজেট সম্পর্কে সচেতন না হন, তাহলে বাজেটানুগ হওয়ার পদ্ধতিটি লিখে ফেলুন। কীভাবে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করতে হয় তাও অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করার চেষ্টা করতে শুরু করুন।
আপনার স্বামীকে জীবনযুদ্ধে জয়ী করে তোলার ক্ষেত্রে আপনি যে মস্ত এক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন তা হল, যতদূর সম্ভব তার আয়-ব্যয়ের সাহায্যে চাহিদার সঙ্কুলান করা আর তাকে আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখা। আপনার কাছাকাছি ব্যাঙ্কে নিশ্চয়ই নিজস্ব বাজেট থাকে বা এ বিষয়ে তাদের উপদেস্টাও থাকা সম্ভব। তাহলে পারিবারিক বাজেট কীভাবে তৈরি করা যায় সে সম্পর্কে তাদেরই সাহায্য নিন। তারা নিশ্চয়ই আনন্দের সঙ্গে আপনাকে পরামর্শ দেবেন। বিনা খরচেই ব্যাঙ্ক আপনার সেবায় তৈরি থাকবে। এ ছাড়াও নানা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে পারিবারিক বাজেটের উপর নানা ধরনের বুলেটিন প্রকাশ করা হয়। এই সব পাঠ করলে আপনি নিশ্চয়ই উপকৃত হবেন। তবে আপনার নিজস্ব বাজেট আপনাকেই তৈরি করতে হবে-আর সেটা করতে হবে আপনার নিজের সামর্থ্য ও প্রয়োজনের দিকে নজর রেখেই।
এবার বাজেট সম্পর্কে আপনাকে কিছু ধারণা দিতে চাই। যেমন, তালিকা রাখুন :
১। প্রথমেই খরচের একটা তালিকা রাখতে শুরু করুন : কোথায় কীভাবে ব্যয় কমাতে হবে সেটা ধরতে না পারলেও খরচ কমানো যাবে না। অতএব কিছুদিনের জন্য নমুনা হিসাবে একটা খরচের তালিকা তৈরি করে নিন। ফলে বছরে মোট ব্যয়ের পরিমাণ কত হল, কোন্ খাতেই বা কত তার সবই বুঝতে পারা যায়। এর ফলে যদি দেখা যায় যে, খরচ বেড়ে যাচ্ছে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়। এটা করার সত্যিই দরকার আছে।
২। আপনার পরিবারের প্রয়োজনের দিকে নজর রাখার বাজেট তৈরি করুন : বছরের যে সব ব্যয় নির্দিষ্ট, যেমন-বাড়ি ভাড়া, ধার শোধ, জিনিসপত্র কেনাকাটা, বীমার প্রিমিয়াম ইত্যাদির হিসাব রাখা চাই। পারিবারিক বাজেটের ক্ষেত্রে এটা হল জটিলতার দিক। বাজেটের এই দিকের সিদ্ধান্তে পারিবারিক সহযোগিতা আর আত্মত্যগের প্রশ্ন জড়িত। সব কিছুই আমাদের পক্ষে পাওয়া সহজ নয় মনে রাখবেন, চটজলদি কোনো বাজেটে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করা থাকে না।
৩। বার্ষিক আয়ের দশভাগ যেন পরিবার পায় : একটা কৌশল সকলের পক্ষে বেশ কার্যকর। সেটা হল, নিজেকে আর পরিবারকে পাওনাদার বলে ভাবতে থাকা। এই জন্যই কমপক্ষে আপনার আয়ের দশভাগ সঞ্চয় করান বা বিনিয়োগ করুন। আপনি যদি স্বামীর আয়ের দশভাগ সঞ্চয় করতে সক্ষম হন, তাহলে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও খুব বেশি সময় লাগবে না।
এক ভদ্রলোকের কথা আমার জানা আছে, যার নীতি ছিল যেমন করেই হোক আয়ের দশভাগ তিনি বাঁচাবেন, এজন্যই তার যতরকম অসুবিধাই হোক তিনি তা সহ্য করতেন।
৪। দুর্দিনের জন্য তহবিল : বেশির ভাগ বাজেট বিশেষজ্ঞ এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন যে, তিন মাসের সমপরিমাণ অর্থ দুর্দিনের জন্য সঞ্চিত রাখা একান্ত প্রয়োজন। এমার্জেন্সী ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেই এই টাকা রাখা যায়। তাঁদের মতে, এ কাজ প্রত্যেকেরই করা উচিত। তারা এ কথা বলেন যে, অযৌক্তিকভাবে সঞ্চয় করতে থাকলে অনেক জরুরি কাজে ঘাটতি দেখা দেয়, কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হওয়ার অবস্থায় এসে পড়ে। একসাথে অনেক টাকা সঞ্চয় না করে বরং অল্প অথচ নিয়মিতভাবে সঞ্চয় করতে শুরু করলে সঞ্চয়ের আনন্দ উপভোগ করা যায়-আর পরিবারের আর্থিক অনটনও থাকে না।
৫। বাজেটকে পারিবারিক উদ্যোগ করে তুলুন : উপদেষ্টারা মনে করেন যে, পারিবারিক বাজেট তৈরি করার কাজে পরিবারের প্রায় সকলেই সহযোগিতা আর উৎসাহ থাকা একান্ত প্রয়োজন। মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যরা বাজেট বৈঠকে উপস্থিত থেকে নানা আবেগময় অভিযোগের সমাধান ঘটাতে পারেন। এতে অনেক সুরাহা হবে।
৬। জীবন বীমা গ্রহণ করে সুখী হয়ে উঠুন : ইনস্টিটিউট অফ লাইফ ইন্সুরেন্সের মহিলা বিভাগের পরিচালক মেরিয়ান স্টিভেন্স বীমা সংক্রান্ত তথ্যাবলীর উপর অতুলনীয় দক্ষতায় আলোচনা করতে পারতেন।
আসলে বীমা সম্বন্ধে ভদ্রমহিলার বিপুল অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি গৃহিণীদের এ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। প্রশ্নগুলো এই রকম : যেমন-আপনি কি জানেন জীবনবীমার পলিসি গ্রহণ করলে আপনার পরিবারের মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে কোনগুলো পূরণকরতে হবে? আপনি কি জানেন স্থায়ী ও অস্থায়ী পলিসির মধ্যে পার্থক্য কোথায় আর দুটোই বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক? আপনি কি জানেন যে আধুনিক জীবন বীমার লক্ষ্য হল দু’রকম। যেমন-যদি বীমাকারী অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যান তা হলে সম্পাদিত বীমাচুক্তি তার পরিবারকে রক্ষা করবে। আর যদি তার অকালে মৃত্যু না হয় তবে বার্ধক্যের সময় ওই টাকা তার জীবনে মূলধনের রূপ নিয়ে আসবে? এই ধরনের নানা প্রশ্নই আপনার পরিবারের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয়। এই সব প্রশ্নের উত্তর কেবল আপনার স্বামীর জানা থাকলেই চলবে না, পরিবারের অন্যতম পরিচালিকা হিসেবে আপনারও এসব জানা থাকা দরকার।
এটি সত্যি যে, টাকাই সবকিছু নয়। কিন্তু কীভাবে আমরা নিজের নিজের উপার্জন দূরদৃষ্টির সঙ্গে ব্যয় করব তা জানার উপরেই আমাদের মনের সুখ-শন্তি স্বামী আর পরিবারের মঙ্গল ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
আমাদের স্ত্রীদের উচিত, স্বামী যা উপার্জন করছেন ব্যয়ের ব্যাপারে অনেক সতর্ক আর সুবিবেচক হয়ে ওঠা। এক্ষেত্রে কয়েকটি নিয়ম আমাদের মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন :
১। একটি বাৎসরিক বাজেট তৈরি করে ফেলুন।
২। আপনার আয়ের দশ ভাগ সঞ্চয় করুন।
৩। দুর্দিনের জন্য একটি তহবিল তৈরি করুন।
৪। বাজেটকে পারিবারিক বিষয় করে তুলুন।
৫। জমানো সম্পর্কে সজাগ থাকার চেষ্টা করুন।
৩৩. স্বামীর জীবন আপনারই হাতে
পুরুষদের অকাল মৃত্যুর জন্য অতিরিক্ত খাওয়ার ব্যাপটারটা অনেকটাই দায়ী। আর সেই কারণে স্ত্রীদের দোষী করা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক পুরুষই পঞ্চাশ বছরের ওদিকে মারা যান। এই অকাল মৃত্যুর হার স্ত্রীদের তুলনায় শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বেশি।
দুঃখের বিষয় হল বেশির ভাগ পুরুষই এজন্য মহিলাদের দায়ী করতে চান।
ডাঃ হার্বার্ট পোলক ‘টু ডেজ উইম্যানে’ প্রকাশিত ‘হোয়াই হাজব্যান্ডস উই টু ইয়ং’ নামক প্রবন্ধে বলেন, স্বামীকে সুস্থ রাখার জন্য অপনার প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে তার পরমায়ু বৃদ্ধি করতে পারে। এই মুহূর্তে আপনার স্বামীর পরমায়ু বৃদ্ধি ক্ষমতা আপনারই হাতে রয়েছে।
স্বামীর ওজন যদি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাহলে সে সম্ভাবনা কিন্তু অনেকটাই কমে যায়। আমেরিকার ওহিও রাজ্যের ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এক চিকিৎসা বিষয়ক সম্মেলনে এই মন্তব্য করা হয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সমস্যাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
স্বামীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমরা আমাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না। স্বামীকে দীর্ঘজীবী করতে হলে আমাদের উচিত খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কড়া নিয়ম-কানুন মেনে চলা। অল্প ক্যালোরি যুক্ত অথচ কর্মশক্তি বাড়াতে পারে এমন খাদ্যই নির্বাচন করা উচিত। এছাড়াও প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডাঃ ইউজিন হোয়াইটহেডের মতে, প্রথমত চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে। তার মতে, দৈনিক তিনবার যে খাদ্য গ্রহণ করা হয় তার পরিমাণ সমান হওয়ার দরকার। তিনি আরও মনে করেন যে,
প্রতিবারের খাদ্যে সমপরিমাণ সব রকম প্রেটিন চাই-ই। উত্তেজক খাদ্য বর্জন করাই ভালো।
ডাঃ রবার্ট ভি. সেনিগার একজন খ্যাতনামা মনস্তাত্ত্বিক। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে। এই সময় স্বাস্থ্যকর প্রাতঃরাশই চাই আপনার স্বামীর জন্য।
আমার একজন বান্ধবী এই রকম সকালে শয্যা ত্যাগ করার ফলে চমৎকার ফল পেয়েছেন। মহিলার নাম মিসেস ক্লার্ক ব্রাইনস। আপনি যদি ব্যস্ত মানুষ হয়ে থাকেন, তবে খুব সকালে শয্যা ত্যাগ করার অভ্যাস করুন, তাতে নিঃসন্দেহে উপকৃত হবেন।
আপনার স্বামীকে যদি আপনি দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যে ভরপুর রাখতে চান তবে কিছু নিয়ম পালন করা উচিত :
১। স্বামীর শরীরের দিকে নজর রাখুন, তার দেহের ওজনের হেরফের লক্ষ্য রাখাই চাই :
দেখবেন তার ওজন ১০ ভাগের মতো মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়েছে কিনা। এ রকম দেখলেই চিকিৎসকের সাহায্য ও পরামর্শ নিতে দেরি করবেন না। তার মত অনুযায়ী স্বামীর খাদ্য তালিক বানিয়ে নেবেন। লক্ষ্য রাখবেন, যে খাদ্য স্বামীকে দিচ্ছেন তা যেন সুস্বাদু ও দেখতে লোভনীয় হয়।
২। বাৎসরিক ডাক্তারি পরীক্ষা : স্বাস্থ্যবান থাকার শ্রেষ্ঠ পথ হল রোগ প্রতিরোধ করা। প্রাথমিক পর্যায়ে যদি রোগ ধরা পড়ে তাহলে মৃত্যুর হার অবশ্যই কমে যাবে। লক্ষ্য রাখা দরকার যে, আপনার স্বামী যথারীতি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন কিনা।
৩। স্বামীকে বেশি কাজ করতে দেবেন না : প্রায় প্রত্যেকেই চায় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে আর কৃতকার্য হতে। সে ক্ষেত্রে অনেক দিন বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই। তখন চাকরিতে উন্নতির অর্থ হবে দেহমনের উপর মাত্রারিক্ত চাপ। এই কারণেই আপনার স্বামী অতি উচ্চাভিলাষী হয়ে থাকলে তাকে বেশি পদোন্নতি প্রত্যাখ্যান করার মতো সাহসী করে তুলুন।
বেশী আয় করার অর্থ যদি স্নায়ুর উত্তেজনা, অশান্তি আর অকাল মৃত্যুর কারণ হয় তবে সব থেকে গ্রহণযোগ্য পথটি হবে অল্প আয়েই সন্তুষ্ট থাকা। তাই স্বামী যদি বেশি পরিশ্রম শুরু করেন তা থেকে তাকে নিবৃত্ত করুন আর অল্পে সন্তুষ্ট থাকার জন্য অনুপ্রেরণা দিন। তাকে উত্তেজনা মুক্ত রাখুন। অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীর মনোভাবের উপরেই স্বামীর সাংসারিক প্রচেষ্টার গতিধারা অনেকাংশে নির্ভর করে।
৪। পরিমিত বিশ্রাম : লক্ষ্য রাখতে হবে যে, স্বামী যেন প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্রামের সুযোগ পান। অবসাদ আর ক্লান্তি দূর করার সবচেয়ে সেরা উপায় হল ক্লান্ত হওয়ার আগেই বিশ্রাম নেওয়া। বিশ্রাম খুব ভালো ফল দিয়ে থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনীতে মার্চ করার পর সৈন্যদের ১০ মিনিট বিশ্রাম নিতে দেওয়া হয়।
৭০ বছর পরেও বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক সমারসেট সমকর্মক্ষম ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেকদিন আহারের পর ১৫ মিনিট ঘুমিয়ে নেওয়াই তার জীবনীশক্তির গোপন রহস্য। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল দুপুরে খাওয়ার পর আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতেন। এই ধরনের বহু দৃষ্টান্ত আছে।
৫। পারিবারিক জীবন সুখী রাখুন : সর্বদাই কোনো-না-কোনো বিষয় নিয়ে অভিযোগ করা স্ত্রী-স্বামীর অগ্রগতির প্রতিবন্ধক–কথাটা মনে রাখা ভালো। এই ধরনের স্ত্রীরা স্বামীর স্বাস্থ্যহানিরও কারণ হয়ে ওঠেন।
দুঃখ-ভারাক্রান্ত কিংবা ক্রোধের বশবর্তী মানুষ সাধারণত মনের দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে থাকায় তাদের স্নায়ু তেমন জোরালোভাবে কাজ করতে পারে না। এই ধরনের মানুষের জীবন বেশ ঝুঁকির আর দুঃখেরও হতে পারে।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে সফলতার বৃহত্তম দিক হল, জীবনকে উপভোগ করার ক্ষমতা। আমাদের স্ত্রীদের উচিত, স্বামীর দৈহিক ও মানসিক মঙ্গল বিধান করার দায়িত্ব নেওয়া।
বত্রিশ, তেত্রিশ পাঠের সূত্র : কীভাবে স্বামীর স্বাস্থ্য ও সম্পদ রক্ষা করবেন সে বিষয়ে কতকগুলি কথা মনে রাখা প্রয়োজন।
১। আয় অনুযায়ী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হোন।
২। স্বামীর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখুন, যত্ন নিন।
লক্ষ্য রাখুন –
(ক) তাঁর ওজনের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটছে কিনা।
(খ) স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে কিনা।
(গ) তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে কিনা।
(ঘ) তিনি যথেষ্ট বিশ্রাম পাচ্ছেন কিনা।
(ঙ) তার পারিবারিক জীবনে শান্তি আছে কিনা।
৩৪. ভালোবাসার মান উন্নত করুন
নিউইয়র্ক সিটি ইউথ হাউসের সেক্রেটারী মি. ইয়েল এইচ. উইলার্ড ম্যাসাচুসেটস-এ অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, কিশোর অপরাধের অন্যতম প্রধান হচ্ছে শিশুর প্রতি ভালবাসার অভাববোধ। যখনই শিশু চিন্তা করতে শুরু করে যে, সে ভালবাসা থেকে বঞ্চিত কেউ তাকে ভালবাসে না তখনই তার প্রবণতা সঠিক পথ থেকে সরে আসে, সে অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হতে শুরু করে।
যেটা প্রধান সমস্যা বলে মনে হয় তা হল, হতভাগ্য কিশোরদের জন্য গভীর ভালবাসা আর মমত্ববোধের অভাব।
১৯ বছর বয়সী টমী একজন কিশোর অপরাধী, সে জেলখানায় ১০ বছরের ও বেশি কাটিয়েছে। সে বলে, আমার যা প্রয়োজন তা হল আমাকে স্নেহ, মায়া, মমতা ভালবাসা দিবে এমন কেউ।
আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই যে সব ছেলেমেয়েদের স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়, তারা শেষ পর্যন্ত অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হবেই। তারা চায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে স্নেহ মমতার ঘাটতি পূরণ করতে।
ভালবাসার উপরেই আমাদের সমস্ত উদ্যম, অনুভূতি আর জীবনীশক্তি নিয়ে আমরা টিকে থাকি। ভালবাসার ঘাটতি হলে আমাদের মানসিক সুকুমার কোমল প্রবৃত্তি যেন শুকিয়ে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
মানবজীবনে প্রেম হল পরমাণু শক্তির মতো। স্বামীর জীবনে আপনার ভালবাসার গুরুত্ব অত্যন্ত মৌলিক। আপনার ভালবাসা অকৃত্রিম বলে আপনি স্বামীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান আর তার কৃতকার্যতার অন্তরায়গুলো দূর করে দেওয়ার জন্য মনেপ্রাণে অনুপ্রাণিত হবেন। স্বামীর প্রতি আপনার ভালবাসা সন্তানদের মঙ্গল বিধানের কাজেও প্রভাব ফেলবে।
এখন আমরা দেখবো, কীভাবে আমরা ভালবাসার মান উন্নত করতে পারি
১। ভালবাসার দৈনন্দিন প্রকাশ : ভালবাসাই দাম্পত্য জীবনের মূলকথা। অনেক মহিলাই সংকটের সময় মহৎ ভূমিকা পালনের যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু স্বামীকে প্রাত্যহিক জীবনের মুহূর্তগুলো ভালোবাসায় পূর্ণ করে তুলতে ব্যর্থ হন। পনের শ’র বেশি বিবাহিত ব্যক্তির প্রতি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ভালবাসা প্রকাশের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে পুরুষরা খুঁতখুঁতে স্বাভাবের স্ত্রীদের কাছে দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যর্থ হয়েছেন। ডাঃ লুই এম টারম্যান ও তাঁর সমহকর্মীরা এই সমীক্ষা চালান। জীবন যখন স্বাভাবিক পথ ধরে চলতে থাকে, তখন স্ত্রী এত বেশি উদাসীন বা ব্যস্ত থাকেন যে, স্বামীকে তার জীবনে কতখানি প্রয়োজন, তা জানবার অবকাশ পান না।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, যেসব মহিলা স্বামীকে ভালবাসেন না, স্বামীর অবহেলা অসহ্য, স্বামী তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেন না বলে অভিযোগ করেন তারা নিজেরাই ভালবাসা ও প্রশংসার আসল মূল্যটি জানেন না।
ডাঃ উইলিয়াম মিনেজার বলেন যে, ওই ধরনের মানসিকতার মহিলারা নিজেকে এত বেশি ভালবাসেন যে অন্যদিকে তাকানোর বা অন্যকে ভালবাসার অবকাশ থাকে না। অপরদিকে, যেসব মহিলা ভালবাসার ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ও উদার তারা স্বামীর কাছ থেকে অপরিসীম ভালবাসা লাভ করেন।
২। সুরসিকা হয়ে উঠন : অনেক স্ত্রী আছেন যারা সম্পূর্ণ দক্ষ হওয়ার মানসিকাতর শিকার হয়ে থাকেন। মনে রাখতে হবে যে, সব ব্যাপার সহজভাবে হৃষ্টমনে গ্রহণ করতে পারলে হতাশায় না ভুগে বরং সব সরলভাবে মানিয়ে নিতে পারলে দাম্পত্য জীবনে প্রেমের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে।
৩। উদার হয়ে উঠুন : বিবাহিত জীবনে আধা-আধির কোনো ব্যাপার থাকে না। প্রেমের মূলকথাটি হল নিজেকে স্বামীর কাছে নিঃস্বার্থ ভাবে উজাড় করে দেওয়া। যে সব স্ত্রী একান্ত বিশ্বস্তভাবে স্বামীর প্রতি অনুরক্ত এবং পার্থিব সুখের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, তারাও আবার সামান্য ব্যাপারে বিভ্রাট ঘটিয়ে থাকে, কিন্তু এটা করা কখনোই উচিত নয়। অনেক সময় স্ত্রীরা বিয়ের পর স্বামীর পুরনো বন্ধুদের সহ্য করতে পারেন না, তাদের ঈর্ষা করেন। কিন্তু এই ব্যাপারগুলোকে যদি সহজভাবে মেনে নেওয়া যায়, তবে অশান্তি হওয়ার কোনো ভয় থাকে না।
৪। সামান্য বিষয়েরও প্রশংসা করুন : স্ত্রীকে সুখী করার জন্য স্বামী যা যা করে থাকে তার উল্লেখ আর প্রশংসা করা প্রত্যেক স্ত্রীরই কর্তব্য। এর স্বীকৃতি দেওয়া চাই। –আমাদের অনেকেই স্বীকার করি না যে স্বামী প্রতিদিন আমাদের কত সেবা করেন, কত কাজ করে দেন। এর একমাত্র কারণ হল আমরা কাজগুলো স্বামীদের দিয়েই করিয়ে নিতে অভ্যস্ত। স্বামীর কাজের স্বীকৃতি দেওয়া সব সময় প্রয়োজন।
৫। সুবিবেচক হয়ে উঠুন : স্বামী যখন ঘরে ফিরে একটু পবিশ্রাম নিতে চান, তখন কোনো বিবেচক স্ত্রীর সাজগোজ করে বাইরে যাওয়া উচিত নয়। স্বামীর প্রতি গভীর ভালবাসা থাকলে স্বামী কখন কী চান স্ত্রী স্বাভাবিকভাবেই সেটা উপলব্ধি করতে পারেন। এবং স্বামীর সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করে তার ভালবাসার ফসল আদায় করতে পারেন।
আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করতে পারি। বিরক্ত হয়ে কখনও তিনি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন নি। ভালবাসার আলোয় তিনি আমার জীবন ভরিয়ে দিয়েছিলেন।
একজন স্ত্রীর পক্ষে এসব কি বিনা প্রচেষ্টায় সম্ভব বলে ভাবেন আপনারা? এ কথা কি তারা ভাবেন যে স্ত্রী আজীবন স্বামীকে গভীর ভালবাসায় পরিপূর্ণ করে রাখেন?
ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে মি. ওয়ারনেক অ্যাঙ্গাস এক চিঠিতে আমায় লিখেছিলেন-জীবনে আমি যত সাফল্য অর্জন করেছি তার সবেরই মূলে রয়েছে আমার স্ত্রীর প্রেমময় সান্নিধ্য।’
ভালবাসা হল অমূল্য সম্পদ। ভালবাসা ছাড়া সম্মান ও সম্পদের কোনো দাম নেই। যদি আপনার ভালবাসায় আপনার স্বামী প্রকৃত সুখী হন, তাহলে জেনে রাখুন, আপনার জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা আরও অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
নিচের কয়েকটি নিয়ম মনে রাখার চেষ্টা করুন : স্বামীকে উন্নত পর্যায়ের ভালবাসায় পূর্ণ করুন এবং সেটা করবেন :
১। আপানার ভালবাসার প্রকাশ ঘটানোর মধ্য দিয়ে।
২। সুরসিকা হয়ে।
৩। নিজের অনুভূতিতে উদারতা সৃষ্টি করে।
৪। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে আর প্রশংসা করে।
৫। সুবিবেচক হয়ে উঠে।
স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা শুধুমাত্র প্রেমের প্রসন্ন দৃষ্টির মধ্যেই থাকে না আদর্শ দম্পতির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম আর ভালোবাসা হল পরস্পরের হৃদয়কে, মনকে জানতে চাওয়া, বুঝতে চাওয়া।