- বইয়ের নামঃ অপঘাত
- লেখকের নামঃ গোলাম মাওলা নঈম
- সিরিজঃ ওয়েস্টার্ন সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ওয়েস্টার্ন, অ্যাডভেঞ্চার
অপঘাত
১. উঁচু বোল্ডারসারি
উঁচু বোল্ডারসারি ঘিরে রেখেছে জায়গাটাকে, খানাখন্দে ভরা এক চিলতে খোলা জায়গা; পাশে দীর্ঘ পাহাড়ী ঢল নেমে গেছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে। জায়গাটাকে কাউ-হাউস বলে সবাই, কারণ ক্ৰীকের পাড়ের ছোট ছোট গুহায় লুকিয়ে থাকে কিছু গরু। সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ধরে হঠাৎ উপস্থিত হলেন বাবা। আমি তখন তৃণভূমিতে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কয়েকটা বলদকে, মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওগুলো।
বাড়ি এসো তো, বয়। ট্যাপ এসেছে। পশ্চিমে কোথায় নাকি ভাল জমি আছে-তাই বলছে ও সবাইকে।
বাবার কণ্ঠে পরিষ্কার আগ্রহ। ট্যাপ এডলে এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে, শুধু এটাই ওঁর জন্যে বড় সুসংবাদ। আমার জন্যেও। কথাগুলো বলার পর দাঁড়ালেন না বাবা, ঘোড়া ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন।
ল্যাসো গুটিয়ে পমেলের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলাম আমি, স্যাডলে চেপে র্যাঞ্চহাউসের দিকে এগোলাম।
মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের টেক্সাস হাউস-এর পোর্চে ভিড় জমে গেছে তখন। ট্যাপ এডলেকে ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড় চোখে পড়ল। বিশ গজ দূরে পোর্চের এপাশে আরও কয়েকজন নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে কোন বিষয় নিয়ে।
ব্যাপারটা নতুন নয়, কারণ কিছুদিন ধরে এ নিয়ে বিস্তর তর্ক, আলোচনা আর পরামর্শ চলছে। সবাই বুঝতে পারছে দেয়ালে ঠেকে গেছে আমাদের পিঠ। একটা কিছু করতে হবে। হয় এখানে থেকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে রক্তসংগ্রাম করে টিকে থাকতে হবে, নয়তো টেক্সাস ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে সরে যেতে হবে নতুন কোন বসতির খোঁজে।
ট্যাপ এডলে দীর্ঘদেহী যুবক। সাতাশ-আটাশ হবে বয়েস। শৈশব আর কৈশোর একসঙ্গে কেটেছে আমাদের, যদিও আমার চেয়ে ছয় সাত বছরের বড় ও। কঠিন, বেপরোয়া যুবক; রোমাঞ্চপ্রিয় এবং কিছুটা হলেও ছন্নছাড়া স্বভাবের। কাউহ্যান্ড হিসেবে প্রথমসারির। অস্ত্রে দারুণ দক্ষ।
লোকজনের ভিড়ের মধ্যেও ঠিক নজরে পড়ে ট্যাপকে। ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা ও, একশো নব্বই পাউন্ড ওজন। ঝালর দেয়া ঝলমলে নীল শার্ট পরনে, নিপুণ ভাবে ইস্ত্রি করা নিচের দিকে দু’পাশে বোতামের সারি; আর রয়েছে শটগান চ্যাপস, লাল ব্যান্ডানা, স্প্যানিশ বুট এবং বড়সড় ক্যালিফোর্নিয়া স্পার। সব মিলিয়ে চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি।
এখনও মুক্তো বসানো হাতলের সেই সিক্সশূটারটা শোভা পাচ্ছে। ওর হোলস্টারে। পিস্তলটা ছিল এক বন্দুকবাজের, ট্যাপের হাতে খুন হয় সে।
ট্যাপ আমাদের বন্ধু, এবং এক হিসেবে আমার ভাইও বটে।
সব ক’জনের মাথা ছাড়িয়ে গেছে ও। দূর থেকে চোখাচোখি হলো আমাদের। নির্লিপ্ত কিন্তু সাবধানী দৃষ্টি ওর চোখে। এ চাহনি পরিচিত আমার, কিন্তু আজই প্রথম এভাবে আমাকে মাপছে ও। চাহনির মত অর্থটাও জানি আমি: বিরোধিতা বা অসহযোগিতার আশঙ্কা করছে ও! কেউ ওর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, সন্দেহ হওয়া মাত্র ট্যাপের চোখে এ চাহনি ফুটে ওঠে।
ড্যানি? ড্যান, বয়! ভিড় ঠেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল ও, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরিব্বাপস্! তুমি দেখছি সত্যিই পুরুষ মানুষ হয়ে গেছ! ভাবতেই পারিনি এতটা লায়েক হয়েছ!
স্যাডল ছেড়ে ট্যাপের হাত চেপে ধরলাম। টের পেলাম দৃঢ় মুঠিতে আমার হাত চেপে ধরেছে ও, চাপ দিচ্ছে। মনে পড়ল নিজের বাহুবলের ওপর কতটা অহংকার বোধ করে ট্যাপ। সেকেন্ড খানেক সমানে সমান চাপ প্রয়োগ করলাম, তারপর হাত শিথিল করে দিয়ে ইচ্ছেমত চাপ দিতে দিলাম ওকে, যেহেতু ট্যাপকে পছন্দ করি আমি এবং নিজের জোর প্রমাণ করার খায়েশ নেই আমার।
ট্যাপ এডলের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে খানিক বিস্মিতই হলাম, কারণ চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছি আমরা-ওর দিকে তাকাতে এতটুকু চোখ তুলতে হলো না আমার। অথচ আগে কত লম্বা মনে হত ওকে!
ব্যাপারটা বোধহয় ট্যাপকেও বিস্মিত করেছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, দৃষ্টি নিচু হয়ে গেল ওর, আমার কোমর হয়ে ঊরুতে গিয়ে ঠেকল; কিন্তু এই মুহূর্তে নিরস্ত্র আমি। রেঞ্জে কাজ করার সময় কোন কাউবয় কোমরে পিস্তল বহন করে না। স্ক্যাবার্ডে রাইফেল আর পমেলের সঙ্গে ঝুলন্ত খোপে ছুরি রেখে এসেছি।
পশ্চিমে যাচ্ছি আমরা, ড্যানি! আমার কাঁধে হাত রেখে বলল ট্যাপ। ঘুরে বাড়ির দিকে এগোলাম আমরা। পোর্চের এক কোণে রাস্টি বুচার্ড আর টিম অটম্যানের সঙ্গে কথা বলছেন বাবা। জায়গাটা আমি নিজে দেখে এসেছি। ঘাস বা পানির অভাব নেই।
সকৌতূহলে আমাদের দুজনকে দেখছেন বাবা। অবশ্য শুধু বাবাই নন, পোর্চের অন্ধকার কোণে দাঁড়ানো কার্ল ক্রকেটের নজরও আমাদের ওপর। ওর সবুজ চোখে অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য। দীর্ঘ ধূসর চুলের রাশি ছড়িয়ে আছে কাঁধের ওপর, মেয়েদের মতই সযত্নে আঁচড়ানো; স্প্যানিশ হ্যাটের ব্রিমের নিচে চোখজোড়ায় মাপা, সতর্ক এবং কঠিন চাহনি।
কার্ল ক্ৰকেট আমার বন্ধু। হাতে গোনা কিছু বন্ধু আছে ওর, কারণ স্বল্পভাষী, নিঃসঙ্গ এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষের বন্ধুর সংখ্যা সাধারণত কমই থাকে। মাঝারি উচ্চতা, কিন্তু প্রশস্ত কাঁধের কারণে খাটো দেখায় ওকে। লাগসই স্প্যানিশ জ্যাকেট আর বাকস্কিনের বেল বটম ব্রীচে মন্দ লাগছে না ওকে।
এর আগে ট্যাপের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি কার্লের-ব্যাপারটা উদ্বিগ্ন করে তুলল আমাকে, কারণ ওরা দু’জনেই কঠিন মানুষ এবং অপছন্দ বা অসন্তোষ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রায়ই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ফেলে ট্যাপ।
তাহলে যাচ্ছি আমরা? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে?
হ্যা…পশ্চিমে যাচ্ছি আমরা, ড্যান।
টিম অটম্যান আমাদের প্রতিবেশী। ছোট্ট একটা আউটফিটের মালিক হলেও প্রায়ই আমাদের হয়ে কাজ করে। দোহারা গড়নের গম্ভীর চেহারার মানুষ। সৎ। এটাই বোধহয় মোক্ষম সময়, মন্তব্যের সুরে বলল সে। কারণ তৃণভূমিতে ঘাসের সাইজ ছোট হয়ে গেছে, আর প্রতিবেশীরাও আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে।
জায়গাটা কত দূরে?
ছয়শো মাইলের মত, বেশিও হতে পারে। নিউ মেক্সিকোয়। যত দেরি হবে যেতে, ভাল জায়গার দখল পাওয়ার সম্ভাবনা ততই কমে যাবে।
কত গরু নিয়ে যেতে পারব আমরা, ড্যান? জানতে চাইলেন বাবা।
ইদানীং আমার মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি, মনোযোগ দিয়ে শোনেন সব কথা; যদিও এখনও তিনিই এই আউটফিটের সর্বেসর্বা। বাবাও জানেন এটা, কিন্তু আমার বিচার-বুদ্ধির ওপর আস্থা আছে ওঁর, বছর দুই আগে গরুর ব্যবসা আমার ওপর ছেড়ে দেয়ার পর থেকে সেই আস্থার পরিমাণ বেড়েছে বৈ কমেনি।
ট্যাপ এডলের চোখে বিস্ময় দেখতে পেলাম। স্বাভাবিক, এখনও আমাকে একটা বাচ্চা ছেলে মনে করে ও। স্রেফ দুধের বাচ্চা। ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইবেন বাবা।
হাজার তিনেক হবে বোধহয়। তবে বেশি ধরে নেয়াই ভাল। টিমের নিজস্ব তিনশো গরু রয়েছে, রাস্টিরও এরকম হবে। সব গরু রাউন্ড-আপ করার পর…তিন হাজার তো হবেই।
এত বিশাল গরুর পাল! অথচ তুলনায় আমাদের লোকজনের সংখ্যা কম হয়ে যাবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে মন্তব্য করল ট্যাপ!
তিনটে ওয়্যাগন থাকবে। আর ঘোড়ার পাল তো আছেই।
ওয়্যাগন? প্রতিবাদ করল ট্যাপ। ওয়্যাগন নেয়ার পরিকল্পনা তো আমি করিনি!
পরিবার আছে আমাদের, বলল টিম অটম্যান। তাছাড়া সবারই টুকিটাকি জিনিসপত্র নিতে হবে।
কি কি নিতে হবে, ট্রেইলের সম্ভাব্য সমস্যা, লোকসংখ্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো এবার। করালের রেইলে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি, টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে, কিন্তু মনোযোগ দিচ্ছি না তেমন। এ ধরনের যাত্রায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কথা বা আলোচনা হয়, কোন কাজে আসবে না এসব। সিদ্ধান্তটা শেষপর্যন্ত আমাকেই নিতে হবে। যা ভাল মনে হবে, তাই করব।
এ ধরনের ফলাফলহীন আলোচনায় নির্দিষ্ট কোন বিষয় থাকে না, যদিও, বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে কিছু কিছু ধারণা হতে পারে। বহু আগে, প্রথম যখন পশ্চিমে যাওয়ার কথা উঠেছিল, এ নিয়ে ভেবেছি আমি এবং মোটামুটি একটা পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছি। কার্ল গম্ভীর স্বভাবের বা মিতভাষী হলেও সুবিবেচক, খুঁটিনাটি কয়েকটা ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে আমাকে।
বড়জোর বারোজন লোক পাব আমরা, কাজের তুলনায় নেহাত কম। গরুর পাল ট্রেইলে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সামলাতে তেমন সমস্যা হবে না, চার-পাঁচজন ক্রুই তখন ড্রাইভ পরিচালনা করতে পারবে, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত গরু সামলানোর কাজটা সত্যিই কঠিন হবে। বয়স্ক অনেক গরু ঝোঁপঝাড়ে অনেক দিন থাকায় প্রায় বুনো হয়ে পড়েছে, চেনা এবং অভ্যস্ত রেঞ্জ ছেড়ে হঠাৎ সরতে চাইবে না এখন।
আমাদের নিজস্ব কিছু সমস্যাও দেখা দেবে, যদিও পরস্পরের পরিচিত সবাই। লোকালয় ছাড়িয়ে কোমাঞ্চি এলাকা পেরোতে হবে, ওখানেই বিপদের যত ভয়।
দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে আমাদের।
এখানেই থাকতে পারি আমরা, মাটি কামড়ে লড়তে পারি; কিন্তু টিকে থাকার সম্ভবনা একেবারে ক্ষীণ। এখন আর লড়াই করার মত সামর্থ্য নেই বাবার, যদিও দু’জন মানুষের সমান সাহস আছে ওঁর। মেক্সিকান বা ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মানসিক ভাবে এমনিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ফাইভ কাউন্টিতে বড় হয়েছেন বলে ফিউড কি জিনিস ভাল করেই জানেন। বোঝেন এই রক্তারক্তি ব্যাপার দিনকে দিন চলতে থাকবে, একজন একজন করে খুন হয়ে যাবে, অথচ রাসুলিঙের সমস্যার আশু কোন সমাধান হবে না।
পাঁচ-দশটা গরু একজন মানুষের জীবনের চেয়ে কখনোই বড় হতে পারে না। কিন্তু দুদিন পরপর পাঁচ-দশটা করে গরু চুরি হতে দেখলেও ভাল লাগবে না কারও। গত এক বছরে অন্তত কয়েকশো গরু খোয়া গেছে আমাদের।
বাবার মত আমিও মনে করি রাসলারদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে বরং অন্য কোথাও চলে যাওয়াই শ্রেয়। তাই ট্যাপ এডলে প্রস্তাবটা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়েছেন বাবা।
এখানেও ঝুঁকি আছে। রুক্ষ দুর্গম ট্রেইল পাড়ি দিয়ে ছয়শো মাইল যেতে হবে। পদে পদে রয়েছে বিপদের আশঙ্কা। খরা, রোদ আর পানির অভাবে মারা পড়তে পায়ে অসংখ্য গরু, হয়তো দেখা যাবে অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই বেশিরভাগ গরু মারা গেছে। ইন্ডিয়ানদের হাতে খুন হয়ে যেতে পারি আমরা কিংবা আমাদের পাল কেড়ে নিতে পারে ওরা।
আসলে কোন কাজে ঝুঁকি নেই? নিঠুর পশ্চিমে নিঃসঙ্গ ও কঠিন জীবনে অভ্যস্ত মানুষ আমরা, জানি কঠোর পরিশ্রম ছাড়া এখানে কিছু অর্জন করা অসম্ভব; নেহাত একঘেয়ে আর কষ্টকর এই জীবনও আনন্দমুখর হয়ে ওঠে প্রাণের জয়গানে-ক্যাম্পের মামুলি গল্প আর গলা ছেড়ে গাওয়া গান অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহ ছড়িয়ে দেয় সবার মধ্যে, ক্লান্তি বা অবসাদ ঘুচিয়ে দেয়, আরও একটা কষ্টকর ও কর্মচঞ্চল দিন কাটানোর উদ্যম যোগায়…স্বপ্ন দেখায়।
আনন্দ নিজে তৈরি করে নেয় পশ্চিমের মানুষ, এখানকার মাটিতেই রয়েছে আনন্দের উৎস। জীবিকার পদ্ধতিও আনন্দ যোগায় মানুষকে। খাবার, পরিধেয় বস্ত্র, বাড়ি, করাল, বার্ন-সবই নিজেরা তৈরি করে নেয়। একসঙ্গে থাকছে এমন সব মানুষ অন্যের সামর্থ্য, সাহস বা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে।
এটা এমন এক দেশ, যেখানে নিজের ঘোড়ায় নিজেকে ব্ল্যাডল পরাতে হয়, যার সমস্যা তাকেই মোকাবিলা করতে হয়। লড়াই যার যার নিজস্ব। একজন মানুষের বিচার তার কাজে। প্রয়োজনের সময় কাজটা সে করতে পারল কিনা, এতেই তার দক্ষতার বিচার! সাফল্য ব্যর্থতার হিসেব খুব সহজ।
আমি ড্যান ট্রেভেন। কাউহাউস ক্রীকের তীরে এক কেবিনে জন্ম। আমার জন্মের মুহূর্তে আনন্দ করার উপায় ছিল না বাবার, বরং নিজের এবং সবার প্রাণের জন্যে লড়াই করছিলেন তিনি। বাবা আর ফ্রেড চাচা মারকুটে ইন্ডিয়ানদের কোন রকমে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। মা-র জঠর থেকে এই পৃথিবীতে এসে প্রথমে গানপাউডারের কটু গন্ধ নাকে নিয়েছি আমি, শুনেছি বাফেলো গানের কান ফাটানো গর্জন। সন্তান জন্ম দেয়ার আনন্দ নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন মা, ছেলেকে স্তন্যদান বা মানুষ করার সৌভাগ্য তার হয়নি। মা মারা যাওয়ার পর এক মেক্সিকান মহিলার যত্নে বড় হয়েছি আমি।
আমার যখন ছয় বছর চলছে, ফোর্ট ওঅর্থে বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় ট্যাপের মা-র। বিধবা এই মহিলাকে বিয়ে করে পশ্চিমে নিয়ে আসেন বাবা, সঙ্গে ট্যাপও আসে।
যদূর মনে পড়ে সুন্দরী ছিলেন আমার দ্বিতীয় মা। ট্যাপ বা আমার মধ্যে কখনও পার্থক্য করেননি, সাংসারিক কাজেও অনীহা ছিল না ওঁর। কিন্তু কিছুদিন যেতেই পশ্চিমের রুক্ষ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হলেন বেচারী। সামান্য এক ড্রিফটারের সঙ্গে চলে গিয়ে পশ্চিমকে বিদায় জানান তিনি। সেই থেকে ট্যাপ আমাদেরই একজন।
মা-কে হারিয়ে মোটেও দুঃখী বা বিষাদগ্রস্ত মনে হয়নি ট্যাপকে। সবসময় নিজের ওজন নিয়ে চলাফেরা করত সে, বলা যায় তারও বেশি। ওর আচরণে মনে হত এখানেই জন্মেছে। মাত্র তেরো বছর বয়সে পূর্ণবয়স্ক লোকের কাজ করত, এ নিয়ে অহঙ্কারও করত। একজন যুবক বা তরুণের সঙ্গে বালকের পার্থক্য আসলে দৃষ্টিভঙ্গি বা বড়জোর দায়িত্ববোধের-কোন ছেলে যদি সাফল্যের সঙ্গে পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দায়িত্ব পালন করে, এ নিয়ে গর্ব বোধ করার অধিকার আছে তার।
যাই আমরা করি না কেন, বয়সে বড় হওয়ায় নেতৃত্ব বরাবরই ওর হাতে থাকত। স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই মারামারি হত তাগড়া ছেলেদের সঙ্গে; কুলিয়ে উঠতাম না যখন, সবসময় আমার পাশে এসে দাঁড়াত ট্যাপ।
সতেরো বছর বয়সে প্রথম বাড়ি ছাড়ে ও। অ্যারিজোনার বিগ থিকেটের এক আউটফিটে কাজ করার পর বছর খানেক বাদে যখন বাড়ি ফিরে এল, বয়স্কদের মত কোমরে পিস্তল, ঝোলাতে দেখলাম ওকে। অবশ্য ও পৌঁছা’র আগেই গুজব শুনেছি-কেডো লেকের কাছাকাছি এক লোক নাকি খুন হয়েছে ওর হাতে।
এরপর থেকে বাড়ি এলে প্রচুর খাটত ও, কোন কাজে গাফিলতি করত না; নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত, কারও ব্যাপারে কখনও নাক গলাত না-একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট একজন মানুষ যেন। বাবা খুব কমই কথা বলতেন ওর সঙ্গে, মাঝে মধ্যে হয়তো দু’একটা মন্তব্য করতেন বা নির্দেশ দিতেন; মন দিয়ে শুনত ট্যাপ, কিংবা শোনার ভান করত। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকত সে, এবং প্রতি বছর যখন ফিরে আসত, প্রতিবারই আরও সমর্থ, পোড়-খাওয়া আর দুর্দান্ত মনে হত ওকে।
এবার পাক্কা তিন বছর পর ফিরেছে ট্যাপ। বলা যায় মোক্ষম সময়ে এসেছে-যখন ওকেই সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল আমাদের। বেপরোয়া সেটলারদের উৎপাত চলছে বেসিনে, প্রায়ই গণ্ডগোল হচ্ছে। আরও পশ্চিমে সরে গিয়ে মুক্ত জমি ক্লেইম করার এখনই সময়।
এখানে তেমন কিছুই রেখে যাব না আমরা। একেবারে শুরুতে, বাবা যখন প্রথম..এসেছিলেন, ইন্ডিয়ানদের হামলার ভয়ে কেউই একা থাকার সাহস করত না; কাছাকাছি থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সবাই। তাদের কেউ মারা গেছে, কেউ খুন হয়েছে, কেউ এলাকা ছেড়ে ভেগেছে কিংবা জমি বেচে চলে গেছে। দেশটা এভাবেই বদলে গেছে। আর এখন রেঞ্জের দখল নিয়ে কামড়াকামড়ি লেগে গেছে। পরিস্থিতি এত খারাপ যে হয়তো শিগগিরই লড়াই বেধে যাবে।
নতুন বসতি করতে আসা অনেকেরই নিজস্ব গরু নেই। মাংসের প্রয়োজনে আমাদের গরু জবাই করেছে ওরা। ওদের বাচ্চা আর মহিলারা খিদেয় কষ্ট পাবে, শুধু এ কারণে ব্যাপারটা মেনে নেন বাবা। কিন্তু আরও সাহসী হয়ে উঠল ওরা-সমস্যারও শুরু হলো তখন থেকে শুধু মাংসের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষান্ত হয়নি সেটলাররা, বরং গরু সরিয়ে বেচতে শুরু করল।
দু’বার হাতে-নাতে ওদের ধরেছি আমি, গরু ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি; কিন্তু নিরস্ত হবে কি, উল্টো আড়াল থেকে আমার উদ্দেশে কয়েকবার গুলি করেছে ওরা।
দিনকে দিন পশ্চিমে আসছে মানুষ। ভাল-মন্দ সব ধরনের মানুষই আসছে। আগে দেখেছি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করত এরা, নিজের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকত, কিন্তু আমাদের নতুন প্রতিবেশীরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতের-আমাদের উপার্জন থেকে নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পথটাই যৌক্তিক মনে হয়েছে ওদের কাছে। এভাবেই ঝামেলার শুরু।
একসময় পরিকল্পনা ছিল প্রত্যেকের নিজস্ব জমি থাকবে আমাদের, নির্দিষ্ট সীমানা থাকবে; কিন্তু শুরু থেকে কাউ-হাউসে যেভাবে বসতি করেছে সবাই, তাতে নির্দিষ্ট কারও সীমানা নিরূপণ করা সম্ভব ছিল না। হলোও না।
পশ্চিমে চলে যাওয়ার আলোচনা জোরেসোরে শুরু হলো, এবং তখনই ট্যাপের আগমন। পশ্চিম অর্থাৎ নিউ মেক্সিকোর ওদিক থেকেই এসেছে ও।
খামারের প্রতিবেশি আগ্রহী বাবা, ফসল ফলাতে পারলেই আনন্দ পান, ইদানীং তাই গরুর ব্যাপারে একা আমিই মাথা ঘামাই।
‘মিথ্যে বলব না, যাত্রাটা সত্যিই কঠিন হবে,’ বলছে ট্যাপ। কিন্তু সারা বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। শিগগিরই যদি যাত্রা করি, তাহলে ট্রেইলে ঘাস আর পানি, দুটোই পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে।
‘আর ওখানে পৌঁছলে?’ জানতে চাইল অটম্যান।
‘এত ভাল ঘাস কোথাও দেখিনি আমি। আর পানির কথা কি বলব! নিউ মেক্সিকোর পেকোস অঞ্চলে থামতে পারি আমরা, কিংবা কলোরাডোয় চলে গেলেও অসুবিধে নেই’।
তুমি কি করতে বলো? অটম্যান সাবধানী মানুষ, প্রশ্নটা করার সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ট্যাপের দিকে।
আমি পেকোসের ধারে-কাছে বসতি করার পক্ষে। বস্ক রেডোন্ডো নামে একটা পাহাড়ী উপত্যকা আছে। ওখানে বসতি করাই ঠিক হবে।
আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইলেন অটম্যান, ট্যাপের ওপর স্থির হয়ে আছে ওর অনুসন্ধানী দৃষ্টি। দারুণ ব্যাপার, তাই না? মুগ্ধ স্বরে জানতে চাইল মেয়েটা। ও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে বলে সত্যিই খুশি হয়েছি আমি।
এই প্রথম, সামান্য হলেও ঈর্ষা বোধ করলাম। যদিও সেটা খুবই ক্ষীণ, কারণ আমি নিজেও ট্যাপ এডলের ভক্ত, ওকে পছন্দ করি, সমীহের চোখে দেখি। সম্ভবত ইলেনের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকটা আমারই মত।
ট্যাপ এডলে অবশ্যই ভিন্ন ধাতের মানুষ-সব বিচারেই। দামী কাপড় ওর পরনে, এত দামী কাপড় কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। দারুণ সুন্দর একটা চেস্টনাট ঘোড়ার মালিক, স্যাডলটাও কারুকাজ করা-এই প্রথম দেখলাম এমন জিনিস। সবচেয়ে বড় কথা, সবকিছুতে নিজস্ব ধরন আছে ওর, সবার চেয়ে সে যে আলাদা, বুঝিয়ে দিতে কখনও কার্পণ্য করে না ট্যাপ।
ট্যাপ আত্মবিশ্বাসী মানুষ। নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত। ওর চলাফেরায় এক ধরনের দৃঢ়তা রয়েছে যা আমাদের নেই। কখনোই অনিশ্চয়তায় ভোগে না সে, নিজের প্রত্যাশা বা চাহিদা সম্পর্কে সচেতন এবং জানে সেটা কিভাবে পেতে হবে। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়-সেজন্যে ক্ষীণ অপরাধবোধও হয় যে হয়তো ভুল করছি-অন্যদের ভাবনা বা অনুভূতি সম্পর্কে মোটেই পরোয়া করে না সে। সবকিছুর পরও, যে-যাত্রার পরিকল্পনা করেছি আমরা, সঙ্গী বা গাইড হিসেবে ট্যাপের তুলনা হয় না।
ইলেনের ব্যাপারটা ভিন্ন। মাঝে মধ্যে হাঁটতে বেরিয়ে গল্প করেছি আমরা, কয়েকবার রাইডও করেছি একসঙ্গে। পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া আছে আমাদের, তা বলা যাবে না; কিন্তু এ কথা সত্যি যে চৌহদ্দিতে ও-ই সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। টেক্সাসের এই পাহাড়ী অঞ্চলে ইলেন অটম্যান যে অনেকেরই কাঙিক্ষতা তাতে কোন সন্দেহ নেই।
টিম অটম্যানের তিন সন্তানের মধ্যে ও-ই বড়। অন্য দুজন ছেলে-একজনের চোদ্দ চলছে, অন্যজনের দশ।
দৃশ্যত, ট্যাপের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ইলেন। সম্ভবত ট্যাপও। মেয়েদের ব্যাপারে শুধু আগ্রহী নয়, রীতিমত সিরিয়াস ও, অনায়াসে মানিয়ে নিতে পারে যে-কোন মেয়ের সঙ্গে; ঠিক ঠিক পটিয়ে ফেলে।
ঘুরে আমার দিকে তাকালেন বাবা। এদিকে এসো, ড্যান। তোমার পরামর্শ দরকার আমাদের।
আমি দু’পা এগোতেই হেসে উঠল ট্যাপ, সবল, ভারী একটা হাত রাখল আমার কাঁধে, তবে কথা বলল, বাবার সঙ্গে: কি ব্যাপার, ট্রভেন? বাচ্চাদের পরামর্শ নেয়া শুরু করলে কবে থেকে?
ট্যাপের কণ্ঠে ক্ষীণ তাচ্ছিল্য থাকলেও গ্রাহ্য করলেন না বাবা। মানুষটা তিনি এমনই। দরকার না পড়লে, সাধারণত তর্ক এড়িয়ে যান। গরুর ব্যাপারে আমার চেনা যে-কোন লোকের চেয়ে ড্যানের জ্ঞান অনেক বেশি, শান্ত, মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন তিনি। এবং এই ড্রাইভও নতুন নয় ওর কাছে।
তাই? সন্দিহান সুরে জানতে চাইল ট্যাপ, বিস্মিত। সত্যি ট্রেইল, ড্রাইভে গেছ?
হ্যাঁ। গত বছর বেক্সটার স্প্রিং হয়ে এক পাল গরু নিয়ে ইলিনয়সে গেছি।
বেক্সটার স্প্রিং? দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। নিশ্চই গন্তব্যে পৌঁছার আগেই অর্ধেক গরু খুইয়েছ? বেক্সটার স্প্রিংয়ের আশপাশের বেয়াড়া আউটলদের সম্পর্কে জানি আমি।
উঁহু, ড্যানের পালের ক্ষতি করতে পারেনি ওরা, জানাল অটম্যান। সব গরু নিয়ে বহাল তবিয়তে ইলিনয়সে পৌঁছেছে ও, ভাল দামে বেচেছে।
দারুণ! আমার কাঁধে চাপ দিল ট্যাপ। পুরানো দিনের মত, দু’জনে মিলে অজেয় টীম হব আমরা, তাই না, বয়? আহ্, বাড়ি ফিরে এসে সত্যিই কাজের কাজ করেছি! ঘাড় ফিরিয়ে করালের দিকে তাকাল সে, ইলেন দাড়িয়ে আছে ওখানে। হঠাৎ বলল: তো, তোমরা জানো কি কি দরকার হবে আমাদের। সবকিছু গোছগাছ হলে ড্রাইভের দায়িত্ব নেব আমি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে রেইলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ইলেনের কাছে চলে গেল ও। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল টিম অটম্যান। মুখ যতই নির্বিকার দেখাক, বহুদিন ধরে তাকে চিনি আমি, জানি ব্যাপারটা অনুমোদন করছে না সে। মিনিট খানেক পর, আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল অটম্যান। অন্যরাও একে একে সরে পড়তে শুরু করল। কেবল আমি আর বাবাই রয়ে গেলাম।
ট্যাপ তো ফিরে এল। কেমন দেখলে ওকে?
ভালই হয়েছে ও আসায়। পানির উৎসগুলো চেনা আছে ওর, ক্রু হিসেবেও দক্ষ ট্যাপ। বিশ্বাস করো; বাবা, ড্রাইভের সময় প্রতিটি লোকের সাহায্য দরকার হরে আমাদের।
হ্যাঁ, হবে, চিন্তিত স্বরে বললেন বাবা, দেখে মনে হলো আরও কিছু বলবেন।
বাবা গম্ভীর প্রকতির মানুষ, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে অনভ্যস্ত। জানি আরও কিছু বলার থাকলে, শিগগিরই বলবেন। কোন একটা বিষয়ে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে ওঁকে, ভুরু কুঁচকে ভাবছেন কি যেন। মিনিট খানেক পর, হঠাৎ জানতে চাইলেন: এলসির কথা মনে আছে তোমার, ড্যান?
এলসি এডলে ট্যাপের মা। খুব মনে আছে ওঁকে। আসল মা-কে কখনও দেখিনি আমি, এলসি এডলেকেই মা বলে জানতাম। অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক হলেও সত্যি, কখনও সত্যিকার মা বলে মনে হয়নি ওঁকে…আমাদের বাড়িতে অতিথি মনে হত ওঁকে, যেন, কিছুদিন থাকবেন আমাদের সঙ্গে, তারপর চলে যাবেন নিজের পথে। তবে ট্যাপ বা আমার প্রতি কখনও অবহেলা করেননি মহিলা; এবং এতদিন পরও, নিশ্চিত বলতে পারি, আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন।
হ্যাঁ, মনে আছে।
পশ্চিমে টিকে থাকার মানসিকতা ছিল না…আসলে পশ্চিমে আসাই ঠিক হয়নি ওর।
আমি প্রায়ই ভাবতাম কেন পশ্চিমে এসেছিলেন উনি। সুন্দরী ছিলেন, হাল ফ্যাশনের কাপড় পরতে আর আয়েশী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। হয়তো পুবে থাকলেই সুখী হতেন।
চরিত্রই আসল, ড্যান…সেটা ঘোড়া, কুকুর, পুরুষ কিংবা মেয়েমানুষই হো।।
আর কিছু না বলে সরে গেলেন বাবা।
ঘোড়া নিয়ে করালের কাছে চলে এলাম। স্যাডল-ব্রিডল খুলে করাল-বারের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলাম। বাবার শেষ কথাটা মনে মনে উল্টে-পাল্টে দেখলাম, কেবলই মনে হচ্ছে গভীর কোন তাৎপর্য আছে। বাবার ধাতই এমন, মুখে যতটা বলেন তারচেয়ে বেশি চেপে যান-উহ্য থেকে যায়। বারবারই ভাবছি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন তিনি।
আসন্ন ড্রাইভের প্রাক্কালে এ নিয়ে বা অন্য কোন বিষয়ে ভাবার সুযোগ আসলে নেই।
বসন্থ এখন…দারুণ গরম্। খরা চলছে। শীতের সময় বেশ কয়েকবারই বৃষ্টি হয়েছে, হর্সহেড ক্রসিং হয়ে পেকোস অঞ্চলের ট্রেইলে পর্যাপ্ত পানি থাকার কথা।
করাল-রেইলের.. সঙ্গে হেলান দিয়ে ড্রাইভে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা বিচার করছি। আশপাশে কোথাও আছে ইলেন আর ট্যাপ, কিন্তু এ মুহূর্তে কেবল ঘোড়ার ব্যাপারে ভাবছি আমি। অন্তত পঞ্চাশ ষাটটা ঘোড়া দরকার হবে। টিম অটম্যান এবং রাস্টি বুচার্ডের সব ঘোড়া সহ, সব মিলিয়ে হয়তো ত্রিশটা হবে, তারমানে অন্তত বিশটা ঘোড়র ঘাটতি থেকে যাবে।
দুটো ওয়্যাগন আর হার্নেস মেরামত করতে হবে। কোমাঞ্চিদের হামলা ঠেকাতে প্রচুর কার্তুজ দরকার হবে। পানি জমিয়ে রাখার জন্যে আরও কয়েকটা ব্যারেল দরকার।
আমার পাশে এসে দাঁড়াল কার্ল ক্ৰকেট, রোল করা সিগারেট কুঁকছে। মেক্সিকানদের অভ্যাস এটা, তবে অনেক টেক্সানও দেখাদেখি অভ্যাসটা রপ্ত করে নিয়েছে। আমাদের বেশিরভাগই সিগার টানতে অভ্যন্ত।
তাহলে ও-ই ট্যাপ এডলে, অস্বাভাবিক সোজাসাপ্টা স্বরে বলল কার্ল।
ওর দিকে তাকালাম। অনেক দিন ধরে চিনি বলেই জানি যখন এভাবে কথা বলে, হয় অসন্তষ্ট নয়তো বিরক্ত ও। একটা ব্যাপার পরিষ্কার: ট্যাপ এডলেকে পছন্দ হয়নি ওর। অথচ আমি চাই পরস্পরকে পছন্দ করুক ওরা।
ছোটবেলায় একসঙ্গে বহুদিন কেটেছে আমাদের, কার্ল। আমার সৎ ভাই ও।
শুনেছি।
ওর মা চলে যাওয়ার পর, বাবা ওকে থাকতে দিয়েছেন। আপন সন্তানের মতই দেখেছেন।
ইয়ার্ড বরাবর ওপাশে তাকাল কার্ল। ইলেন আর ট্যাপের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, হাসছে ওরা।
মা-র সঙ্গে কি কখনও দেখা হয়েছে ওর?
যতদূর জানি কখনও দেখা হয়নি।
পিস্তলটা দারুণ মানিয়েছে ওকে, তাই না?
হ্যাঁ…এবং জিনিসটা চালাতে পারে ট্যাপ।
সিগারেটে শেষ টান মেরে দু’আঙুলে ছুঁড়ে মারল সে। সাহায্য দরকার হলে জানিয়ো আমাকে। …আরও ঘোড়া দরকার হবে তোমার।
আশপাশে বুনো ঘোড়া চোখে পড়েছে নাকি?
লিয়ন নদীর কাছাকাছি দেখেছি। ধরার চেষ্টা করবে?
বুনো ঘোড়া ধরে পোষ মানানোর ক্ষেত্রে কার্ল ক্রকেটের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ঘোড়া-শিকারী বলে সুনাম আছে ওর। কিন্তু ঘোড়া ধরে পোষ মানাতে অনেক সময় লাগবে। অত সময় নেই আমাদের অনেক আগেই ড্রাইভে যাত্রা করা উচিত ছিল।
কার্ল কখনও কারও অধীনে কাজ করেনি। স্বাধীনচেতা মানুষ। দরকার পড়লে সাহায্য করে আমাদের, পাঞ্চার হিসেবে টপহ্যান্ড, অথচ বিনিময়ে একটা ডলারও নেবে না। ব্যাপারটা দুর্বোধ্য, কিন্তু কেউই কৌতূহল প্রকাশ করেনি। কারণ টেক্সাসে কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করে না লোকজন। যার যার দৃষ্টিভঙ্গি বা ব্যক্তিগত বিষয় একেবারেই তার নিজস্ব।
টম জেপসনকে দলে ভেড়াতে পারলে ভাল হত, চিন্তিত সুরে বললাম আমি। বেশ কিছু ঘোড়া আছে ওর। ওকে ড্রাইভে নিতে পারলে উপকার হবে আমাদের।
তোমার কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে খুশি হয়েই যোগ দেবে ও
জেপসন। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ওর র্যাঞ্চের অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল। এত ভাল জায়গা ছেড়ে যাবে কেন ও?
হয়তো রোজিটার কারণে।
হ্যাঁ, এটা একটা সম্ভাবনা বটে। টম জেপসনের জায়গাটা ছোট, তবে যে-কোন বিচারে বেসিনের সেরা জায়গা। রেঞ্জের সব গরু হৃষ্টপুষ্ট। রোজিটার জন্যে হলেও এ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া স্রেফ বোকামি হবে, কারণ পরিণতিতে সবকিছু হারানোর আশঙ্কা রয়েছে টমের। রোজিটা জেপসন সুন্দরী এবং কাক্ষিতা, স্ত্রী হিসেবেও গুণী, কিন্তু অন্য পুরুষের প্রতি ওর আকর্ষণ কখনও কমবার নয়। সবচেয়ে খারাপ ব্যবহার হচ্ছে, পুরুষদের চোখ আটকে রাখার মত সবকিছুই আছে ওর, এবং রোজিটা নিজেও এ ব্যাপারে দারুণ সচেতন।
কোন একদিন ওর কারণে মারা পড়বে কেউ।
সেক্ষেত্রে টমই মারা পড়বে।
সিধে হলো কার্ল। সূর্য ওঠার আগেই চলে আসব আমি। কমবয়েসী গরু রাউন্ড-আপ করব দুজনে মিলে। কুকুরগুলোকে নিয়ে আসব সঙ্গে।
গরু দাবড়ানোয় দক্ষ কয়েকটা কুকুর আছে ওর..ব্রাশ-পপিঙে বা ঝোঁপঝাড় তল্লাশির সময় একেকটা তিনজন কাউহ্যান্ডের সমান কাজ করতে সক্ষম।
ঘোড়ার কাছে গিয়ে স্যাডিলে চাপল, কার্ল ক্ৰকেট। সমীহ আর নীরব বিস্ময় নিয়ে ওকে স্যাড়লে চড়তে দেখলাম। এই দৃশ্যটা শতবার দেখেছি, কিন্তু কখনোই একঘেয়ে বা বিরক্তিকর লাগে না। এত অনায়াসে, নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে স্যাডলে চড়ে ও, দেখে বিশ্বাসই হয় না। মানুষ হিসেবে কার্ল কর্মঠ, বিশ্বস্ত এবং দায়িত্বশীল; যে-কেউ আনন্দ পাবে ওর সঙ্গে কাজ করে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সারা জীবনে ওর মত নির্ভরযোগ্য সহকর্মী পাইনি আমি।
করালের পাশ দিয়ে ঘুরপথে এগোল ও, যাতে ট্যাপ এডলেকে পাশ কাটিয়ে যেতে না হয়। কার্ল মোড় ঘুরতে মুখ তুলে সেদিকে তাকাল ট্যাপ।
ব্যাপারটা ট্যাপও ধরতে পেরেছে, কারণ সহজ পথ অর্থাৎ বাড়ির সামনে দিয়ে না গিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে করালের পাশ দিয়ে যাচ্ছে কার্ল ক্ৰকেট। স্থির দৃষ্টিতে তাকে যেতে দেখল ট্যাপ, দৃষ্টিপথে ইলেনের বাধা এড়ানোর জন্যে দু’পা পাশে সরে গেল।
বাড়ি থেকে খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। মিসেস অটম্যানের রান্না সত্যিই ভাল।
বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলাম ইলেন আর ট্যাপ কথা বলছে এখনও। ট্যাপের নিচু স্বরের কি,একটা কথায় সহাস্যে মাথা নাড়ল ইলেন। বুঝলাম স্বল্প সময়ের মধ্যেই ইলেনকে পটিয়ে ফেলেছে, ট্যাপ, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু এবং স্পর্শকাতর মনে হলো আমার কাছে। যত যাই হোক, ইলেনকে পছন্দ করি আমি, এবং সবাই জানে সেটা।
মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল ট্যাপ, কিন্তু কথা বলল ইলেনের সঙ্গে। কি জানো, ইলেন, আমি ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছি না আমাদের ছোট্ট ড্যান তাগড়া জোয়ান হয়ে গেছে। অথচ এই কদিন আগেও দুধের বাচ্চার মত আমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াত ও।
খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল ইলেন।
অনুভব করলাম নাকে-মুখে রক্ত উঠে এসেছে আমার। উঁহু, সব জায়গায় তোমার পিছু লেগে থাকতাম না আমি, ট্যাপ। মনে আছে, সেবার ব্রাজোসে তোমার পিছু পিছু যাইনি?
যেন চড় খেয়েছে, মুখটা বেদান হয়ে গেল ট্যাপের। কড়া কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তার আগেই ওর আস্তিনে হাত রাখল ইলেন। তোমরা তো পুরানো বন্ধু…ভাইও বলা চলে। উঁহু, অযথা তর্ক করার দরকার নেই।
ঠিকই বলেছ, ইলেন, বলে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম আমি।
দরজায় আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল মিসেস অটম্যান, তারপর আমাকে ছাড়িয়ে গেল মহিলার দৃষ্টি-ইলেন আর ট্যাপকে দেখল। তোমার ভাই তো বেশ সুদর্শন, হালকা সুরে বললেও বলার ঢঙে মনে হলো এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বেশ গভীর।
পরের তিনদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বেগার খাটলাম আমরা। ট্যাপ, কার্ল, রাস্টি এবং আমি ঝোঁপঝাড়ে ছড়িয়ে থাকা কমবয়েসী গরু রাউন্ড-আপ করলাম। এদিকে টম জেপসনের সঙ্গে কথা বলার জন্যে গেছেন বাবা। দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ওয়্যাগন মেরামত করল টিম অটম্যান।
ক্রীকের ধারে ঝোঁপঝাড় আর বুনো লতাপাতায় ঘেরা কিছু গুহা আছে। গুহার কারণেই জায়গাটার নাম কাউ-হাউস। গরু খেদানোর সময় দারুণ কাজে এল কুকুরগুলো। দশজন কাউহ্যান্ডের কাজ কমিয়ে দিয়েছে ওরা।
স্যান এন্টোনিয়োয় ছোটখাট একটা পাল নিয়ে গিয়েছিল জেফ মুর, বেন টিল্টন আর চার্লি হীখ। ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে ওরা। বেশ দ্রুত এগিয়ে চলল রাউন্ড-আপের কাজ।
সুযোগ পেলেই পশ্চিমে যাওয়ার ট্রেইল সম্পর্কে ট্যাপকে জিজ্ঞেস করেছি আমি। ক্যান্সাস-মিসৌরি হয়ে ইলিনয়সের ড্রাইভে গিয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। কিন্তু ওটা তুলনামূলক সহজ ট্রেইল।
কর্ন পেষা বেশ ঝক্কির কাজ। বিরক্তিকর এবং একঘেয়েও বটে। দুই যাতার একটা কর্নমিল আছে আমাদের। কর্ন থেকে ময়লা বানাতে হলে অন্তত দু’বার পিষতে হবে। কাজটা আয়াসসাধ্য বলে পুরুষদেরই করতে হলো।
ড্রাইভে যাত্রা করার আগে যতটা সম্ভব কর্ন পিষে ময়দা তৈরি করে নিতে চাই আমরা। কারণ যাত্রাপথে হয়তো কর্নমিল ব্যরহার করার সুযোগ হবে না। কর্ন পেষার পাশাপাশি মাংসের জার্কি তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। কারোই দম ফেলার সুযোগ নেই।
কেনা কাপড় পরার দিন ছিল না তখন। আমরাও ঘরে তৈরি সুতীর কিংবা বাকস্কিনের কাপড় পরতাম। যার যার কাপড় তার নিজেরই তৈরি করে নিতে হত। শার্টের আস্তিন বা ট্রাউজারের হাঁটুতে থাকত সরু ঝালর, পানি যাতে দ্রুত সরে যায়। পুবের বেশির ভাগ লোক মনে করে এসব ঝালর মূলত বাহারের জন্যে। আসলে মোটেই তা নয়।
ঘরে তৈরি সব কাপড়ই সুতী বা উলের। লেই বসিয়ে পরে হাতে বুনতে হয়, সুতার ক্ষেত্রে বীজও আলাদা করতে হয়। সবাই যার যার মোকাসিন বা বুট তৈরি করে নেয়, অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি মেরামতের ক্ষেত্রেও তাই; কখনও কখনও একেবারে কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে হয়।
কাউ-হাউসের কাছাকাছি ঝোঁপঝাড়ে ঘেরা জায়গাটার বাতাস গুমট। আঁকাবাঁকা ক্ৰীকের উঁচু তীরে গুহাগুলোর অবস্থান। ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে, গরুগুলো। কাজটা কঠিন, ভাপসা গরমে অতিষ্ঠ হওয়ার দশ, আর অপরিসর জায়গা বলে দড়িও ব্যবহার করা যায় না।
বিশাল একটা ডোরাকাটা বলদ গাছের ফাঁকে ঢুকে পড়ল হঠাৎ, এস্তা হরিণীর মত ছুটতে শুরু করল। পিছু নিয়েছে আমার স্টিলডাস্ট গেল্ডিং। ধেয়ে আসা বড়সড় একটা ডাল এড়িয়ে গেলাম মাথা নিচু করে, কিন্তু ছোট একটা সপাটে আঘাত করল মুখে; সঙ্গে সঙ্গে চোখে পানি চলে এল। ছয় ফুট উঁচু ঝোঁপের দিকে ছুটছে বলদটা, স্টিলডাস্টও পিছু ছাড়ছে না। মাথা নিচু করে এগোচ্ছি আমি, তারপরও নাকে-মুখে গাছের ছোট ছোট শাখার সংঘর্ষ হচ্ছে, কাঁটা বিঁধছে চ্যাপসে। ঝোঁপের ওপাশে খোলা জায়গায় একটা ল্যারিয়েট বের করে ছুঁড়ে দিলাম। বলদের শিঙে মালার মত জড়িয়ে গেল ফাসটা।
এবার প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল ওটা, কোন কিছুরই পরোয়া করছে না। কিন্তু ঘোড়ার কৌশল আর শক্তির কাছে হার মানতে হলো ওটাকে। দুটো চক্কর খাইয়ে মাটিতে আছড়ে ফেললাম বলদটাকে। মুহূর্ত খানেক মাত্র, ঝট করে উঠে দাঁড়াল ওটা, ছুটে এসে মারমুখী আক্রমণ চালাল, বলদটা বিশাল, যোলো হাতের চেয়েও বেশি উঁচু হবে, ওজন অন্তত আঠারোশো পাউন্ড•••এ মুহূর্তে দারুণ খেপে গেছে।
মাথা নিচু করে ছুটে এল ওটা। শেষ মুহূর্তে পাশ কাটিয়ে গেল স্টিলডাস্ট। আর মি. বলদ প্রপাত ধরণীতল! ভারসাম্য হারিয়ে ধুলোয় আছড়ে পড়ল ওটা।
সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল বলদটা সারা শরীর কাঁপছে, রক্ত লাল চোখে তাকাল চারপাশে। এ মুহূর্তে, এতই খেপে আছে যে সামনে যাই পড়বে, সেটার সঙ্গে লড়াই করবে। কিন্তু কোন সুযোগ দিলাম না ওটাকে। ঘোড়াকে তুমুল বেগে ছুটিয়ে দিলাম। দড়িতে টান পড়তে পিছু পিছু ছুটতে বাধ্য হলো ওটা।
খোলা জায়গায় পালের কাছে আসার পর দড়িতে ঢিল দিলাম। ছোটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বলদটা, লড়াই করার খায়েশও মিটে গেছে। বাঁধন খুলে দিতে গরুর দলে ভিড়ে গেল ওটা।
রাউন্ড-আপ মানেই অমানুষিক খাটুনি। গরম, ঘাম বা ধুলোর অত্যাচারের মধ্যে বেয়াড়া বলদের পেছনে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হয়, ঘোড়াগুলোর নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। একটা একটা করে বলদকে ঝোঁপ থেকে বের করে আনছি আমরা, খোলা জায়গায় এনে করালে আটকে রাখছি। বুড়ো কয়েকটা মসিহর্ন অবশ্য তেমন সমস্যা করছে না। অন্য গরুর সঙ্গে থাকতে পারলেই সন্তুষ্ট এরা, জায়গা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
ডোরাকাটা বলদটা ঝোপে ফিরে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে, কাউ হাউসে নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে। ওটাকে খেদিয়ে অন্য গরুর সঙ্গে ভিড়ে থাকতে বাধ্য করলাম।
পিস্তলবাজ হোক আর ভবঘুরে হোক, রাউন্ড-আপ বা পাঞ্চিঙে ট্যাপ সত্যিই দক্ষ। আমাদের যে-কারও সমান খাটছে ও।
পুবাকাশে ফ্যাকাসে আভা দেখা দেওয়ার আগেই বেডরোল ছেড়ে উঠে পড়ি আমরা, সূর্য উঠতে উঠতে চলে যাই ঝোঁপঝাড়ের গভীরে। একদিনে তিন-চারটে ঘোড়া বদল করি প্রত্যেকে, কিন্তু লোকের বদল হয় না কখনও। মটরশুটি আর মাংস জোটে সকালের নাস্তায়; দুপুরেও তাই; মহিলারা যদি খোশমেজাজে থাকে তাহলে রাতে কেক বা সরগ্যাম জোটে-কর্ন থেকে তৈরি হয় জিনিসটা।
তৃতীয়দিন সকাল হলো ধূসর আকাশে মেঘে ছেয়ে, কিন্তু কেউই খেয়াল করিনি আমরা। দুটো দিন হাড়ভাঙা খাটুনি গেছে, অথচ হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। সাধারণত বাড়িতে ঘুমই আমি। টেক্সাস হাউজের একটা অংশে বাবা আর আমি থাকি, অন্য পাশে অটম্যানরা থাকে। বুচার্ডের বউ-বাচ্চাদের জন্যে দুটো কামরা ছেড়ে দিয়েছি আমরা, বাইরে অন্যদের সঙ্গে থাকছি দু’দিন ধরে।
বেডরোল গুটিয়ে মাথায় হ্যাট চাপালাম। কাউহ্যান্ডরা ঘুম থেকে উঠে সবার আগে হ্যাট চাপায় মাথায়। তারপর পায়ে বুট গলিয়ে দিলাম।
মেয়েরাও উঠে গেছে। রান্নাঘর থেকে বাসন-কোসনের শব্দ আসছে। বেড়রোল ছেড়ে পানির কলের কাছে চলে গেল ট্যাপ, একটা বালতিতে পানি ভরে হাত-মুখ ধুলো। আমিও পরিষ্কার হয়ে নিলাম। খেয়াল করলাম বরাবরের মতই মেজাজ খিচড়ে আছে ওর-সকালে যা হয়–আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা ভিন্নরকম-সকাল সবসময় সুন্দর, সতেজ এবং একটা দিনের শুরু। শুভ মুহূর্ত। তবে এ নিয়ে ওর সঙ্গে তর্ক করার ইচেছ নেই।
বাড়িতে ঢুকলাম নাস্তা করার জন্যে। আজকের আয়োজন ভিন্ন-মাংস আর মটরশুটি ছাড়াও ফ্রায়েড পেঁয়াজ রয়েছে।
সঙ্গে সর্বক্ষণ ব্রিডল রাখি আমি, জ্যাকেটের ভেতরে পুরে রাখি যাতে খানিকটা উষ্ণ থাকে ওটা। ঠাণ্ডা বা বৃষ্টির দিনে আগুনে খানিক সেঁকে নিই, তাহলে ব্রিডল পরার সময় চমকে ওঠে না ঘোড়া। আজ অবশ্য তেমন ঠাণ্ডা পড়ছে না, তবুও সাতসকালে যাতে ঘোড়ার মুড খারাপ হয়ে না যায়, সেজন্যে জ্যাকেটের ভেতরে রেখেছি ওটা। ঘোড়ার মতিগতির ওপর সারাদিনে কাউহ্যান্ডদের কাজ নির্ভর করে অনেকাংশে।
অবশ্য এমনিতেও খোশমেজাজে থাকবে না ঘোড়াটা..কখনও ছিলও না।
দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেয় বসে পড়েছি আমরা। ইলেন খাবার পরিবেশন করছে। সামনে এসে বড়সড় বাটি থেকে থালায়, খাবার তুলে দিচ্ছে। ট্যাপের থালায় খাবার তুলে দিতে একটু বেশি সময়ই যেন লাগল ওর।
নীরবে খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম আমরা। শেষে আমার পাশে চলে এল কার্ল, সিগারেট রোল করার সময় জানতে চাইল: কখনও লিয়নের ওদিকে গেছ?
না।
আমি আর তুমি যাব…একটু চক্কর দিয়ে আসি। কি বলো?
কিন্তু এখানে তো অনেক কাজ! ওখানে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তো…।
আমি যাব, মাঝখানে বলে উঠল ট্যাপ। ও কি বলতে চাইছে জানি আমি।
কাগজের কিনারায় জিভ চালিয়ে ভিজিয়ে নিল কার্ল। কি মনে হয়, অন্যমনস্ক সুরে জানতে চাইল সে। গরু নিয়ে আমাদের চলে যেতে দেবে ওরা?
গরুগুলো তো আমাদের, তাই না?
অবশ্যই। হয়তো সারা রেঞ্জ চষে বেড়ালে ওদের দু’একটা গরু পাওয়া যাবে। অথচ প্রথম থেকেই তোমাদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে ওরা। কিন্তু এখন ওরা জেনে গেছে ড্রাইভের পরিকল্পনা করছ তোমরা, ঝোঁপঝাড় থেকে সব গরু রাউন্ড-আপ করছ।
তো?
ড্যান, হয়েছে কি তোমার, বলো তো? ত্যক্ত স্বরে জানতে চাইল ট্যাপ। বুঝতে পারছ না পারলে প্রতিটা গরু চুরি করবে ওরা, আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে প্রয়োজনে লড়াইও করবে? আচ্ছা, ক’জন লোক আছে আমাদের?
এখন? নয়-দশজন হবে হয়তো।
ওরা ক’জন? ত্রিশজন তো হবেই।
চল্লিশের কাছাকাছি, শুধরে দিল কার্ল। লিয়নের তীরে প্রচুর ট্র্যাক দেখলাম। আমাদের চেয়েও দ্রুত রাউন্ড-আপ করছে ওরা, উত্তরের বুনো এলাকায় গরু সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তাহলে আগে বরং ওগুলো ফিরিয়ে আনাই উচিত।
উঠে দাঁড়াল ট্যাপ দেরি করা ঠিক হবে না, শুকনো স্বরে বলল সে, তারপর আমার দিকে ফিরল। পিস্তল নেই তোমার? থাকলে সঙ্গে নাও। দরকার পড়বে।
যুক্তি আছে ওর কথায়। যাদের নিয়ে আলাপ করছি আমরা, কিছু রুগ্ন চেহারার ঘোড়া আর লক্কড়ঝক্কড় মার্কা ওয়্যাগন নিয়ে এখানে এসেছিল ওরা। দু’একজনের গাভী ছিল..অথচ দিব্যি চলে গেছে। ওদের। আমাদের গরু জবাই করে মাংসের চাহিদা মিটিয়েছে, তারপর বিক্রিও করেছে। রেঞ্জের উন্নয়নে সামান্য ভূমিকাও নেই ওদের কারও। দক্ষিণ আর পুবের কোন এলাকা থেকে এসেছে ওরা-অলস কিন্তু দারুণ সুযোগসন্ধানী অকৃতজ্ঞ কিছু মানুষ।
পেছনে তিক্ত অতীত ফেলে এসেছে ওরা। কেউ এসেছে মিসৌরী বা আরক্যান্সাস থেকে, কারও আদি নিবাস ফাইভ কাউন্টি, যেখানে বহু বছর ধরে রক্তক্ষয়ী ফিউড লেগে আছে। বাবা নির্বিরোধী শান্তিপ্রিয় লোক বলেই এ ব্যাপারে কখনও কঠিন হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি; তাতেই বাড় বেড়েছে ওদের। উদারতা আর সহানুভূতিকে দুর্বলতা মনে করেছে।
বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই, বললাম আমি। অস্ত্রও আগের মত চালাতে পারেন না।
আড়চোখে আমার দিকে তাকাল ট্যাপ, যেন বলতে চাইছে, তুমিও কি চালাতে পারো নাকি? ব্যাপারটা গ্রাহ্য করলাম না। কারও ক্ষমতা সম্পর্কে অন্যরা সন্দিহান হলে তার ক্ষমতা বাড়ে-কমে না। প্রয়োজনের সময়ে সেটা প্রমাণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমাদের গোছগাছ করতে দেখে এগিয়ে এল টিম অটম্যান। এই এক লোক, কোন কিছুই ওর চোখ এড়ায় না। কিভাবে যেন জেনে যায়, অথচ সাধারণত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে। কারও ব্যাপারে নাক গলায় না, কিন্তু চোখ-কান সর্বক্ষণ সজাগ রাখে। সতর্ক থেকো, ছেলেরা, সংক্ষেপে শুধু এই বলল অটম্যান।
রওনা দেয়ার আগে বেন টিল্টনের সঙ্গে কথা বললাম, নির্দেশ দিলাম অন্যদের যেন কাউ-হাউসের আশপাশে ব্যস্ত রাখে। প্রায় সবাই জানে একটা কিছু ঘটবে, বা ঘটতে যাচ্ছে; কিন্তু কেউই এ নিয়ে মন্তব্য করল না।
প্রথমে পশ্চিমে এগিয়েও দিক বদলে পরে উত্তরে এগোলাম আমরা।
কারা ওরা; জানো তুমি? কার্লকে জিজ্ঞেস করলাম।
হর্নার আউটফিট। ম্যাক, বিলি আর ওয়েব। সাঙ্গপাঙ্গের অভাব নেই ওদের। যত সব হারামখেকোর দল এসে জুটেছে কাউ-হাউসে!
নীচ কিন্তু কঠিন বেপরোয়া লোক ওরা। বিতাড়িত মানুষ সাধারণত ধাক্কা খেতে পছন্দ করে না। এরা তারচেয়েও খারাপ। নোংরা, জঘন্য গরু চোর আর খুনী। বেশ কয়েকবারই রেঞ্জে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি ওদের কয়েকজনকে।
ওয়েব লোকটা বাঁ-হাতি, বললাম আমি।
ঝট করে আমার দিকে তাকাল ট্যাপ। তো, একটা তথ্য বটে! জরুরী খবর।
পিস্তল উল্টো করে ডান দিকে ঝোলায় ও, বাঁট সামনের দিকে থাকে। প্রয়োজনে দু’হাতেই ড্র করতে পারে।
লিয়ন নদীর কাছাকাছি গিরিখাতে ওদের ট্রেইল খুঁজে পেলাম। অনুসরণ করতে সমস্যা হচ্ছে না। প্রায় বিশটা গরু তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা-দু জন মানুষ। একেবারে সহজে এগোচ্ছি, কারণ ট্র্যাক লুকানোর কোন চেষ্টাই করেনি ওরা; বরং যেন চাইছে ট্র্যাক ধরে ওদের পিছু নিক,কেউ, বুঝুক গরু উদ্ধার করতে গেলে কি বিপদ বা ঝামেলায় পড়তে হবে।
ঘোড়াকে হটিয়ে প্রতিটি ঢাল পেরোলাম আমরা, পাহাড় বা রীজ পেরোনোর আগে চারপাশ ভাল করে দেখে নিচ্ছি। যতটা সম্ভব নিচু এলাকা ধরে চলছি, ট্রেইল যাতে না-হারিয়ে ফেলি সে-ব্যাপারেও পুরোপুরি সচেতন।
সমস্ত গরু নিয়ে যদি চলে যাই আমরা, এলাকা ছেড়ে ভাগতে বাধ্য হবে সুযোগসন্ধানী লোকগুলো কিংবা না-খেয়ে মারা পড়বে। উঁহু, তেমন কিছু হবে না। চাইলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারবে ওরা, মাংসের চাহিদা মেটাতে পারবে যে-কোন রেঞ্জে। সমস্ত টেক্সাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গরু, বেশিরভাগ রেঞ্জে নির্দিষ্ট সীমানাও নেই। মোষ শিকারের মতই, মাংসের প্রয়োজনে একটা গরু জবাই করলে কেউই কিছু মনে করবে না।
শুধু মাংসই নয়, গরুর চামড়া বা চর্বিও উপকারী। বাজার নেই, তাই গরুর চাহিদা কেবল মাংসের যোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে লুইসিয়ানা, সেভপোর্ট বা অ্যালাবামায় গরু নিয়ে গেছে, প্রচুর দামেও বিক্রি করেছে; কিন্তু এতদূর পথ পাড়ি দেয়া সত্যিই কঠিন। পশ্চিমে গরুর দল ক্রমশ স্বাস্থ্য হারাচ্ছে, আগের মত বনে-বাদাড়েও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এটা উঠতি পশ্চিম, একসময় অনাবিকৃত ছিল; কিন্তু এখন বসতি গড়ার চেষ্টা করছে মানুষ। আমাদের পশ্চিমে কোন লোকালয় নেই, আছে জনমানবহীন বিস্তৃত বুনো অঞ্চল। এ পর্যন্ত টেক্সাসের পশ্চিমে যাওয়ার সাহস কেউই করেনি, কেবল দুঃসাহসী এক কৃষক ফোর্ট বেল্কন্যাগ থেকে চার মাইল পশ্চিমে বসতি করেছিল। জায়গাটা আমাদের এখান থেকে কিছুটা উত্তর-পশ্চিমে।
পর্যাপ্ত ঘাস আছে, এমন জায়গায় থাকতে পছন্দ করে গরুর দল। এখান থেকে পুবের জমি ছাড়াও নদী-তীরবর্তী নিচু এলাকায় প্রচুর ঘাস রয়েছে। পশ্চিমে, কলোরাডো নদীর তীরে কিছু গরু চোখে পড়েছে কার্লের, প্রায় বুনো হয়ে পড়েছে ওগুলো, কোন ভাবে চলে গেছে ওখানে। আমার জানা মতে ওদিকে কোন লোকই থাকে না।
ঠাণ্ডা, আর্দ্র সকাল। আকাশে ভারী মেঘের আনাগোনা। বাতাস ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে-অনাগত বৃষ্টির পূর্বাভাস। হাতে জরুরী কাজ থাকা সত্ত্বেও আমরা চাইছি বৃষ্টি হোক। বৃষ্টি হলে ওঅটরহোল আর বেসিনগুলো ভরে যাবে, কচি ঘাস গজিয়ে উঠবে কিংবা সতেজ হয়ে উঠবে তৃণভূমি। শিগগিরই ঘাস আর পানির ওপর নির্ভর করবে আমাদের জীবন এবং ভবিষ্যৎ।
হঠাৎ রাশ টেনে ঘোড়া থামাল কার্ল। ড্যান, এদিকে দেখো!
ট্রাক জরিপ করলাম আমরা। পুব দিক থেকে আরও দুই’রাইডার যোগ দিয়েছে আগের দু’জনের সঙ্গে। ঘোড়ার খুরের চাপে দেবে গেছে ঘাস, এখনও সোজা হয়নি-সম্ভবত মিনিট কয়েক আগে এসেছে লোকগুলো।
কাকতালীয় হতে পারে, ট্র্যাক দেখে মন্তব্য করল ট্যাপ।
মানে? জানতে চাইলাম।
কিংবা কেউ হয়তো জানাতে এসেছে আমরা অনুসরণ করছি। ওদের!
সিগারেট রোল করছে কার্ল, কোন মন্তব্য করল না।
কে করতে পারে এমন জঘন্য কাজ? প্রতিবাদ করলাম। আমাদের কেউ নয়!
আমার মত বয়েস হোক তোমার, সংক্ষেপে বলল ট্যাপ। তাহলে শিখবে যে দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। দু’জন লোককে অনুসরণ করছিলাম আমরা…অথচ আকাশ থেকে এসে পড়েছে আরও দুজন।
দ্বিগুণ সতর্কতার সঙ্গে এগোলাম আমরা। ট্যাপ অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ। চালচুলোহীন ওসব নেস্টরদের খবর দেয়ার দরকার পড়েনি আমাদের কারও। অথচ ওরা এখন চারজন, আর আমরা তিনজন। লোকের হেরফের নিয়ে ভাবছি না, তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার মত ব্যাপার বটে। ওরা যদি সত্যিই আমাদের আসার খবর পেয়ে থাকে, তাহলে আরও লোক থাকতে পারে।
আচমকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ট্যাপ, ঢালু পথে ঘোড়া ছুটিয়েছে কার্ল-সরে যাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। ও কি করছে? জানতে চাইল সে।
চিহ্ন খুঁজতে গেল। দূর থেকে ওদের উপস্থিতি টের পেতে চাইছে। চাঁদের আলোয় ক্যাপরকের ওপর একটা কূনকেও ট্র্যাক করতে পারবে ও।
ও কি থাকবে শেষপর্যন্ত? মানে…গোলাগুলির সময় কেটে পড়বে না তো?
থাকবে। ওর চেয়ে লড়াকু লোক দেখোনি তুমি, ট্যাপ।
স্থির দৃষ্টিতে কার্লের দিকে তাকিয়ে থাকল ট্যাপ, কোন মন্তব্য করল না। স্যাডলে সিধে হয়ে বসল ও, সতর্ক, মাথা উঁচু, যে-কোন ঝামেলার জন্যে তৈরি। স্যাডলে বসার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ঝামেলা হলে সামাল দিতে অভ্যস্ত। অথচ একটা সময় ছিল-আমাদের ছেড়ে যাওয়ার আগে-কঠিন সমস্যা হলে ঘাবড়ে যেত ও, কিন্তু তারপর এত বেশি সমস্যায় পড়েছে যে এসব ওর কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
- কূন (Coon) আমেরিকার ভালুক জাতীয় প্রাণি বিশেষ
আচমকা ধোয়ার গন্ধ পেলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে গরুও চোখে পড়ল। প্রায় তিনশো গরু, সবই আমাদের। ছোট্ট উপত্যকার কোণে-আগুনের কাছাকাছি বসে আছে চারজন লোক। কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম আমরা। একজন ছাড়া কেউই উঠে দাঁড়াল না।
সাবধান, ট্যাপ, নিচু স্বরে সতর্ক করলাম ট্যাপকে। আরও লোক থাকতে পারে।
ক্রীকের ধারে জড়ো করা হয়েছে সব গরু। সিকি মাইল হবে জায়গাটার পরিধি। দু’ধারে কটনউড এবং উইলোর সারি; এখানে সেখানে কিছু মেস্কিটও রয়েছে। উইলোর ঝাড় এত ঘন যে ক্রীকটাও ঠিকমত চোখে পড়ছে না। আড়ালে কেউ লুকিয়ে থাকলে বোঝার উপায় নেই।
কাছাকাছি ঘোড়া পিকেট করেছে ওরা। সবকটাকে খুঁটিয়ে দেখলাম। ট্যাপ, পাঁচটা ঘোড়ার শরীর ভেজা।
চারজনের মধ্যে ওয়েব হর্নার, বাড সটক্লীফ আর টাটল নামে শীর্ণদেহী এক লোর্ককে চিনতে পারলাম। চতুর্থজনের চুল ব্লন্ড, শার্টের কলারের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। লোকটার চিবুক মুখের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলো। চাহনি অশুভ ওর, ঝামেলাবাজ এবং নীচ লোক।
ওই গরুগুলোর গায়ে আমাদের ব্র্যান্ড, মৃদু স্বরে বললাম আমি। ওগুলোকে নিয়ে যাব আমরা।
তাই? এখনই নেবে? ঔদ্ধত্যের স্বরে জানতে চাইল ওয়েব হর্নার।
হ্যাঁ, এবং একটা নোটিশও দিয়ে যাচ্ছি তোমাদের। আর কোন গরু পাবে না তোমরা, এমনকি মাংসের জন্যেও নয়।
অনেক জায়গার দখল নিয়েছ তোমরা, মন্তব্য করল ওয়েব। সব গরুর অধিকার কিভাবে পেলে? নিজেরাই কি পয়দা করেছ ওগুলো? উঁহু, ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তোমরা শুধু ছাপ্পড়-মেরেছ।
ভুল করছ। শুরুতে এখানে কোন গরুই ছিল না, আমার বাবা নিয়ে এসেছেন। প্রাকৃতিক নিয়মেই সংখ্যাটা বেড়েছে। কিন্তু সেজন্যে মাথার ঘাম পায়ে ঝরাতে হয়েছে আমাদের।
অথচ খালি হাতে এখানে এসেছ তোমরা, কোন কিছু গড়ার বা তৈরি করার চেষ্টা করোনি। শুধু মানবিক কারণে তোমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছি, আমরা চাইনি কেউ খিদেয় কষ্ট পাক-বিশেষ করে বাচ্চারা-অথচ এখন তোমরা চুরি করছ।
তাই? বেল্টের ভেতর আঙুল গুঁজে দিল হর্নার, আয়েশী ভাব ফুটে উঠল ভঙ্গিতে। এবার আমার কাছ থেকে একটা কথা শুনে নাও। এখান থেকে চলে যেতে চাইছ তোমরা। বেশ, যাও। কিন্তু গরু নিয়ে যেতে পারবে না।
ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোকটার ওপর অতিরিক্ত ভরসা করছ না? ঝোলার বেড়াল বের করে দিলাম। ওর কথা ভুলে যাওয়াই মঙ্গল। তোমাদের সাহায্য করতে পারবে না সে।
সামান্য বিস্ফারিত হলো হর্নারের চোখজোড়া। জিভ চালিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল বাড সটক্লীফ। ব্লভ লোকটার একটা চুলও নড়েনি, স্থির দৃষ্টিতে ট্যাপ এডলের দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় আগে কোথাও, দেখেছে ট্যাপকে।
জানি না কি ভাবছ তোমরা, কিন্তু তোমাদের জায়গায় থাকলে স্যাড়লে চেপে কেটে পড়তাম আমি। ফিরে গিয়ে চুরি করা সব গরু খেদিয়ে দিতাম রেঞ্জের দিকে।
কেন ভাগব বা গরু ফিরিয়ে দেব? জানতে চাইল হর্নার, নিজেকে ফিরে পেয়েছে। গরুগুলো এখন আমাদের জিম্মায় আছে, অথচ
তোমাদের হাতে কিছুই নেই। লোকবলও কম তোমাদের।
বেশি লোকের দরকার হয় না আমাদের, বলল ট্যাপ। কাজ সারার জন্যে এই যথেষ্ট।
ট্যাপের দিকে সরে গেল হারের দৃষ্টি। তোমাকে তো চিনলাম না!
মাথা নাড়ল ও। বলতে পারো ড্যানের সৎ ভাই আমি। ওই স্টকে আমারও ভাগ আছে। গোলাগুলি করে যদি ওগুলোর দখল নিতে হয়, একটুও আপত্তি নেই আমার।
চিনি ওকে, হঠাৎ মুখ খুলল ব্লন্ড। ওর নাম ট্যাপ এডলে। নসেজের ওদিকে দেখেছি ওকে।
তো?
বন্দুকবাজ ও, ওয়েব।
ওয়েব হর্নারের সমস্ত মনোযোগ এখন ট্যাপের ওপর ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে লোকটা। এক পাশে কিছুটা সরে গেল বাড সাইক্লীফ, ছড়িয়ে পড়তে ইচ্ছুক। আমার প্যাটার্সন রিভলভিং রাইফেলটা পড়ে আছে স্যাডলের ওপর, ট্রিগারে চেপে বসেছে আঙুল। সাইক্লীফ নড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যাটার্সনের মাজলও অনুসরণ করল, তাকে…
পরিস্থিতি দেখে ঘাম জমতে শুরু করল সাইক্লীফের কপালে। হর্নারের ওপর স্থির হয়ে আছে ট্যাপের দৃষ্টি।
জানি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে ওদের একজন, কিন্তু কার্ল ক্রকেটের ওপর ভরসা করছি যে লোকটার গতি করবে ও। অন্য কেউ করলেও অন্তত আমি করছি। হয়তো অতিরিক্ত বা অনুচিত হচ্ছে সেটা, কারণ একজনের পক্ষে এ পরিস্থিতিতে কিছু করা সত্যিই কঠিন; অথচ এদিকে আমাদের সামনে চারজন বেপরোয়া লোক।
ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো, বিদ্রুপের স্বরে পরামর্শ দিল ট্যাপ। সময় কিন্তু নেই। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে হয়তো জানে বেঁচে যেতেও পারো।
জিভ দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করল ওয়েব হর্নার। দেখতে হলো না, অবচেতন মন থেকে টের পাচ্ছে ওর বুক বরাবর ধরা আছে ট্যাপের বন্ধুকের মাজল; ট্যাপ যদি ওর চেয়ে ফাস্ট হয়, নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ওর লাশ পড়ে যাবে আজ।
এদিকে ঘোড়াকে দু’কদম পিছিয়ে এনেছি আমি, ফলে সাটুক্লীফ আর ব্লন্ড লোকটাকে একইসঙ্গে নজরে রাখতে সুবিধে হলো। ঘোড়া, নিয়ে কেটে পড়ো সবাই, বললাম আমি। আর যদি লড়াই করতে চাও, যে-কোন সময় শুরু করতে পারো, আপত্তি নেই আমাদের।
হঠাৎ ঝোঁপের কিনারায় এসে দাঁড়াল কার্ল ক্ৰকেট। যে-কোন সময় কাজ শুরু করতে পারো তোমরা, হালকা সুরে জানাল সে। আড়ালে লুকানো কাউকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
ঘামছে ওরা। তিনজনের বিরুদ্ধে চারজন এখন। আমার রাইফেল একজনের বুক বরাবর নিশানা করা। বাড সাইক্লীফ যথেষ্ট পোড় খাওয়া মানুষ, কিন্তু নায়ক হওয়ার খায়েশ নেই ওর। বসন্তের এই সুন্দর সকালটা বড় ভাল লাগছে ওর। মিনিট কয়েক আগেও জঘন্য ভাষায় আবহাওয়াকে গালাগাল করছিল, অথচ এ মুহূর্তে বছরের যে কোন সকালই ওর কাছে অপূর্ব মনে হচ্ছে বোধহয়।
ওকে খুন করেছ তুমি? কার্লের উদ্দেশে জানতে চাইল হর্নার।
আমাদের কাজে নাক গলাতে পারবে না সে, জবাব এল।
মিনিট খানেক নীরবতায় কেটে গেল, কেউই কিছু বলছে না। সামান্য একটা মিনিট, কিন্তু বড় দীর্ঘ মনে হলো। তারপর ঘোড়াকে এক পা আগে বাড়ালাম আমি, রাইফেলের নিশানা সাইটক্লীফের বুক থেকে এক চুলও নড়ল না তোমাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, নির্লিপ্ত স্বরে বললাম আমি। এটা প্যাটার্সন রিভলভিং রাইফেল। পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স ক্যালিবারের পাঁচটা গুলি আছে এতে।
ওয়েব…? নার্ভাস বোধ করছে সাইক্লীফ, প্যাটার্সনের মাজল থেকে ওর দূরত্ব মাত্র বিশ ফুট। নার্ভাস হওয়ার মত যথেষ্ট দূরত্ব।
বেশ, না হয় দুদিন অপেক্ষা করলাম! চাপা অসন্তোষের সুরে বলল ওয়েব হর্নার। চল্লিশজন আছি আমরা, এবং এই গরুগুলো চাই আমাদের। আপাতত নিয়ে যেতে পারো তোমরা-কিন্তু ধরে রাখতে পারবে না।
ওয়েব? ট্যাপের কণ্ঠ শুনে ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল আমার সবকটা চুল। আমি আর তুমি-সমানে সমান। অন্যরা এসবের বাইরে থাকুক।
আরে? এমন কিছু বলেছি নাকি? স্পষ্ট আতঙ্ক ফুটল হর্নারের স্বরে।
একটু আগেই তো, বললে চল্লিশজন, একেবারে শান্ত স্বরে বলল ট্যাপ। আমি বলছি উনচল্লিশজন…স্রেফ ঊনচল্লিশজন। একজন খালাস হয়ে যাবে!
আকাশে হাত তুলল বাড সাইক্লীফ। শীর্ণদেহী লোকটা এত দ্রুত পিছিয়ে গেল যে লগের একটা খুঁটিতে হোঁচট খেয়ে ধপাস করে পড়ে গেল। কিন্তু ওঠার সাহস হলো না তার, হাত-পা ছড়িয়ে ওভাবেই পড়ে থাকল।
স্থির ভাবে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ব্লন্ড লোকটা। ও-ই শুরু করেছে, চড়া, স্বরে ঘোষণা করল সে। আমি এতে নেই। ওদের দু’জনের ব্যাপার এটা।
পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েব হর্নার, মুখোমুখি হয়নি বরং ট্যাপের দিকে খানিক পাশ ফিরে আছে-ডানদিকে। ডান কোমরে ওর পিস্তল, কোল্টের বাঁট থেকে ডান হাত বেশ দূরেই আছে। দেখো, মেকী আপসের সুরে বলল সে। অযথা ঝামেলার কি দরকার… বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর হাতে।
ট্যাপের গুলি বিধল ওর বুকে দুটো। ভোতা শব্দে ঘাসের গালিচায় আছড়ে পড়ল ওয়েব হর্নারের লাশ।
ধন্যবাদ, ড্যানি। ভাগ্যিস, ওর বাম হাতের ব্যাপারে সতর্ক করেছ আমাকে! নির্লিপ্ত স্বরে বলল ট্যাপ। জানা না থাকলে হয়তো ভুল করতাম। ব্যাটার ডান হাতের দিকে নজর রাখলে ঠিক ওর, মত পড়ে থাকতে হত এখন?
সব গরু জড়ো করে ফিরতি পথ ধরলাম আমরা। কেউ কিছু বলল, একটা শব্দও উচ্চারণ করল না।
ঊনচল্লিশজনের কথা ভাবছি আমি, বিশেষ করে হর্নারের দুই ভাই সম্পর্কে। খবরটা পাওয়া মাত্র ছুটে আসবে ওরা। ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাইবে।
সুতরাং যত জলদি রওনা দেয়া যায় ততই মঙ্গল-উটকো কিছু ঝামেলা এড়ানো যাবে।
২. টেক্সাসের এই এলাকা
টেক্সাসের এই এলাকা যখন পুরোপুরি নির্জন আর বুনো ছিল, তখন এসেছি আমরা। সবাই যে পালিয়ে আসা বা ব্যর্থ মানুষ, তা নয়। কেউ কেউ মুক্ত বুনো জীবন পছন্দ করে, ধাতস্থ হয়ে গেছে এতে, সেজন্যেই এখানে আসা। আবার কেউ কেউ স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পশ্চিমে পাড়ি জমায়। ৩-অপঘাত
জীবন এখানে শত বিপদ ও দুর্ভোগে ভরা, কিন্তু আমরা কেউই বিপদ মনে করি না, এসব বরং দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ দুর্ভোগের মতই, যেগুলোকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকতে হয় বাহবা পাওয়ার জন্যে কিংবা সাহস দেখানোর জন্যে অস্ত্র বহন করে না কেউ, বরং টেক্সাসের বুনো অঞ্চলে নিরস্ত্র অবস্থায় বেঁচে থাকা অসম্ভব বলেই অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে মানুষ। খাবার বা ঘোড়া ছাড়া যেমন বাঁচতে পারে না কেউ, অস্ত্রের গুরুত্বও ঠিক তেমনি।
ইন্ডিয়ানদের মত বেঁচে থাকতে শিখেছি আমরা, ওরাই আমাদের আদর্শ। কারণ রেডস্কিনরাই এই এলাকার আদি অধিবাসী এবং দেশটার নাড়ি-নক্ষত্র জানে। কারও সাহায্য প্রত্যাশা করা যায় না এখানে, নিজের গরজে নিজের খাবার যোগাড় তৈরি করে নিতে হয়। এখানে একজন মানুষের বন্ধু কেবল সে নিজে।
অথচ যথেষ্ট সময় নেই হাতে। পশ্চিমে অবারিত জমি পড়ে আছে-ওখানেই আমাদের স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে। এমনকি পুবেও একটা কথা চালু আছে-পশ্চিমে সোনা ফলে। পশ্চিম বিপদগ্রস্ত, ব্যর্থ বা পলাতক মানুষের পৃথিরী। এবং স্বপ্নের পৃথিবী-যারা স্বপ্ন দেখতে জানে এবং স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপান্তর করার পূর্বশর্ত হিসেবে কঠোর পরিশ্রম করার ইচ্ছে রাখে। অর্ধেক পৃথিবী জানে এ খবর, লোকজন আলোচনা করতে পছন্দ করে। পশ্চিম হচ্ছে বেকার, জালিয়াত, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়, একাকী কিংবা ব্যর্থ মানুষের পুনর্বাসন কেন্দ্র। প্রায় সবার স্বপ্নের পৃথিবী।
কাউ-হাউসের তৃণভূমি পেছনে ফেলে পশ্চিমে এগোচ্ছে গরুর পাল। ডোরাকাটা বলদটা নেতৃত্ব দিচ্ছে। জানে না কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু যেখানেই যাক প্রথম হওয়ার ইচ্ছে ষোলোআনাই আছে ওটার। প্রায় তিন হাজার পাঁচশত গরু, বিভিন্ন বয়সী। পালের আগে আগে চলছেন বাবা আর ট্যাপ এলে?
ধুলোর অত্যাচার এড়াতে ওয়াগনগুলো একপাশে দেখেছি আমরা। টিম অটম্যানের এক ছেলে চালাচ্ছে, একটা, মিসেস অটম্যান চালাচেই আরেকটা ওয়্যাগন। তৃতীয় ওয়াগনটা চালাচ্ছে রাস্টি বুচার্ডের স্ত্রী। আর টম জেপসনের বিশাল ওয়াগন চালাচ্ছে ফ্রাঙ্ক কেলসি।
টম এবং রোজিটাও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। ঠিকই ধারণা করেছে। কার্ল ক্ৰকেট, কারণ বাবার কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়া মাত্র গরু সহ পুরো র্যাঞ্চ বেচে দিয়ে আমাদের সঙ্গী হয়েছে জেপসন। সব ঘোড়া আর তিনশোর মত গরু রেখেছে। গরুগুলো অবশ্য ব্রীডিং স্টকের অংশ।
সঙ্গে দু’জন কাউহ্যান্ডকে নিয়ে এসেছে টম-কেলসি আর স্যাম গার্ট। শীর্ণকায় একটা মিউলে চড়ে প্রথম যখন টেক্সাসে এসেছিল জেপসন, তখন থেকে ওর সঙ্গে আছে কেলসি আর গার্ট?
টিল্টন, হীথ আর মুর পালের এক পাশে রাইড করছে, সঙ্গে বাবার দুই হ্যান্ড রয়েছে। মিলো ডজ এবং ফ্রিম্যান স্কয়ার। পালের ওপাশে আছে অন্যরা।
ট্যাপ এডলে আসার আগে থেকেই গরু জড়ো করছিলাম আমরা, যাত্রা করতে তাই দেরি হয়নি। যাওয়ার সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত, অয়থা দেরি করার কিংবা আক্রমণের অপেক্ষায় থেকে লাভ নেই। একমাত্র দ্রুত গতিই নিরাপত্তা দিতে পারে আমাদের।
সূর্য উঠার আগেই যাত্রা করেছি। প্রথম কয়েক মাইল গরুগুলোকে প্রায় ছুটতে বাধ্য করেছি। যতটা সম্ভব ওদের ব্যস্ত রাখতে পারলেই মঙ্গল, তাহলে গন্তব্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ পাবে না।
স্কাউটিঙের দায়িত্বে রয়েছে দু’জন। বাম দিকে রেকি করতে গেছে টিম অটম্যান, আর রাস্টি বুচার্ড গেছে ডান দিকে। হর্নার আউটফিটের আগমনের আভাস পাওয়ার ইচ্ছে।
পালের পেছনে আছি কার্ল আর আমি! ধুলোর অত্যাচার আমাদেরই বেশি সইতে হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া বা অনিচ্ছুক গরুকে তাগাদা দেয়া আমাদের কাজ। কোনটা যদি দলছুট হওয়ার ধান্ধা করে, ওটাকে খেদিয়ে পালে ঢোকানোর দায়িত্বও, পড়েছে আমাদের ঘাড়ে। ড্রাইভে এষ্টাই সবচেয়ে কঠিন এবং কষ্টকর কাজ।
প্রথম রাতে পনেরো মাইল দুরে ক্যাম্প করলাম আমরা। ঝর্নার পাড়ে এক চিলতে খোলা জায়গা বেছে নিয়েছি, যথেষ্ট ঘাস রয়েছে। আশা করা যায় দলছুট হবে না গরুগুলো। সঙ্গে কি কয়েক মাইল দূরে লিয়ন নদীতে গিয়ে পড়েছে।
রাতের প্রথম দিকে পাহারায় থাকল বেন টিল্টন আর জিম মুর, পালের ওপর নজর রাখছে সারাক্ষণ। চাক-ওয়্যাগনের কাছে চলে এল অন্যরা, মেয়েরা রান্নার আয়োজন করছে।
এখন থেকে প্রায় রুটিনমাফিক চলবে সবকিছু ব্যতিক্রম হবে খুবই কম। যদি না কোন ঝামেলা হয়। সারাদিনে পনেরো মাইল এগোনো সম্ভব, যদিও গড়ে বারো মাইল হলেও সন্তুষ্ট হব আমরা। ঘোড়া কম আমাদের, মাথা পিছু পাঁচটা করে আছে: কিন্তু এতবড় ড্রাইভের জন্যে জনপ্রতি অন্তত আট-নয়টা ঘোড়া দরকার।
পাল যেহেতু বিশাল, পানি পান করার জন্যে ছড়িয়ে পড়বে গরুগুলো, মাইল খানেক দূরে সরে যাওয়াও বিচিত্র নয়। ঘাসে চরার পর ভরপেট খেয়ে ঘুমাবে ওরা, প্রায় মাঝরাতে জেগে উঠবে, হাত-পা ঝেড়ে খানিক ঘোরাফেরা করবে, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়বে। কয়েক ঘন্টা পর, জেগে আড়মোড়া ভেঙে ফের ঘুমিয়ে পড়বে। দ্বিতীয়বারের সময় কিছু গরু হয়তো সরে পড়তে পারে। কিন্তু ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াবে সব গরু, চলার জন্যে তৈরি হয়ে যাবে। সাধারণ আবহাওয়ায় ওদের সামলে রাখার জন্যে দুজনই যথেষ্ট, কিন্তু ঝড় হলে প্রতিটি লোককে দরকার হবে।
কাপ আর টিনের থালা হাতে আগুনের কাছে চলে গেলাম, বেন টিল্টনের কণ্ঠ কানে এল-ঘুম তাড়ানোর জন্যে গান গাইছে। গান গাওয়ার বাড়তি একটা সুবিধে রয়েছে-নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় না; এর আংশিক কারণ: কণ্ঠটা মানুষের-বেশিরভাগ কাউহ্যান্ড যখন গান গায়, কণ্ঠটা ওদের নিজের কাছেই অপরিচিত মনে হয়। গরুগুলোর ওপরও গানের প্রভাব রয়েছে। রাইডারের উপস্থিতিতে শান্ত থাকে ওরা, মানুষের চলন্ত ছায়া দেখে আশ্বস্ত হয়, বুঝে নেয় সবকিছু স্বাভাবিক আছে।
আমার কাপ আর থালা ভরে দিল ইলেন।
রাইড করতে অসুবিধে হয়নি তো? জানতে চাইলাম।
দায়সারা গোছের মাথা নাড়ল ও, আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেল। দৃষ্টি-ট্যাপের দিকে।
মানুষটা ও ভালই, শুকনো স্বরে বললাম।
চিবুক উঁচু হয়ে গেল মেয়েটার, গলায় আপসের সুর। ওকে পছন্দ করি আমি। মুহূর্ত খানেক পর যোগ করল: যত যাই হোক, তোমার ভাই।
খাবার নিয়ে ট্যাপের পাশে গিয়ে বসলাম।
কেমন চলছে তোমার, কিড? জানতে চাইল সে।
নীরবে খাওয়া সেরে নিলাম আমরা। সম্ভবত সবাই কম-বেশি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, অতীতটাও চলে আসছে ভাবনায় পেছনে কি ফেলে এসেছি সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয় এখন, বরং ভবিষ্যতে কি আছে সেটাই আসল ব্যাপার। সামনে বিস্তীর্ণ বন্ধুর প্রান্তর; বসন্ত বলে মোটামুটি ঘাস রয়েছে তৃণভূমিতে, তাই যে-কোন সময়ের চেয়ে আমাদের সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি। হর্স হেড ক্রসিং পর্যন্ত ভালই কাটার কথা।
প্যাটার্সনটা পরিষ্কার করে ক্যাম্প থেকে সরে এলাম। সারাদিনে প্রচণ্ড খাটুনির পর একটা বিছানাই হতে পারে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। অন্যদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে বিছানা করলাম যাতে রাতের শব্দ ঠিকমত শুনতে পাই, ক্যাম্পের সাড়াশব্দ বাইরের, সমস্ত আওয়াজ ঢেকে ফেলবে।
মেঘের দল ছুটছে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, আকাশ পরিষ্কার এখন। চাঁদের ম্লান আলোয় ভাসছে নিসর্গ। তৃণভূমির ঘাসে চরছে গরুর পাল। কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। নিশাচর কয়েকটা পাখি ডেকে উঠছে মাঝে মধ্যে।
ঘুমিয়ে পড়লাম।
কাঁধে কারও ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল আমার। চার্লি হীথ। দ্বিতীয় পালায় সে আর বুচার্ড পাহারা দিয়েছে।
বেডরোল ছেড়ে মাথায় হ্যাট চাপালাম। পায়ে বুট গলিয়ে দেখলাম এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে টিল্টন, তামাক চিবুচ্ছে। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলল সে, শেষ মুহূর্তে মত পাল্টে ঘুরে দাঁড়াল, হেঁটে আগুনের দিকে চলে গেল। আগুনে শিখা নেই এখন, জ্বলন্ত কয়লার কোমল কিন্তু ম্লান উষ্ণতায় ক্যাম্পের কিছু অংশ চোখে পড়ছে।
প্যাটার্সন হাতে আগুনের কাছে চলে গেলাম আমি। গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে বসে আছে ট্যাপ, আমার সঙ্গে ওর পাহারা দেয়ার কথা। দু’হাতের তালুয় গরম কাপ ধরে রেখেছে বাড়তি উষ্ণতার আশায়, কফিতে চুমুক দিচ্ছে মাঝে মধ্যে। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল ও, তবে কিছু বলল না।
ড্রাইভ চলাকালীন সময়ে হসল্যারের দায়িত্ব নিয়েছে টম জেপসন। যখনই প্রয়োজন হচ্ছে, ঘোড়া তৈরি করে দিচ্ছে। খেয়াল করলাম জেগে গেছে সে, আমার জন্যে একটা গ্রুপ্সাও ধরেছে। সাধারণত যার যার ঘোড়া তার নিজেরই ধরতে বা স্যাডল পরাতে হয়, কিন্তু ইদানীং রাতে তেমন ঘুম হয় না বলে স্বেচ্ছায় কাজটা নিয়েছে টম। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে ওর যে সমস্যা, অযথা উদ্বেগে না ভুগে বরং আরও বেশি বিশ্রাম নেওয়া উচিত ওর।
রাতটা শীতল। চাঁদের দিকে তাকিয়ে সময় আন্দাজ করলাম, ভোর হতে আরও তিন ঘণ্টার মত বাকি। কড়া কালো আরেক কাপ কফি গিলে ঘোড়ার কাছে চলে এলাম, স্যাড়লে চাপলাম। প্রথমে দু’বার চক্রাকারে ক্যাম্পের চারপাশে চক্কর মারল ঘোড়াটা, হালকা পা ফেলছে। পালের কাছে চলে এলাম।
শান্ত, সংক্ষেপে জানাল টিল্টন। একেবারে শান্ত সবকিছু।
আর কিছু না বলে চলে গেল সে ক্যাম্পের দিকে।
বিভিন্ন বিচারে সে একজন অদ্ভুত মানুষ। প্রায় তিন বছর ধরে আমাদের হয়ে কাজ করছে, অথচ লোকটার ধাত এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। প্রথম পরিচয়ের সময় ওকে যতটা জানতাম, তারচেয়ে বেশি কিছু জানি না। এটা অবশ্য মোটেও অস্বাভাবিক নয়। ব্যক্তিগত বিষয় সয়ত্নে এড়িয়ে চলে সবাই, এটাই রীতি; আর টেক্সাসে আসা বেশিরভাগ মানুষ “ভূতুড়ে” অতীত পেছনে ফেলে এসেছে, যেটা ওরা নিজেরাও ভুলে যেতে পারলে স্বস্তি বোধ করবে।
টেক্সাসে কারও অতীত সম্পর্কে প্রশ্ন করা রীতিবিরুদ্ধ, কারণ জিনিসটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। মানুষের পরিচয় কাজে। যার যা করা উচিত সেটা ঠিকমত করল কিনা, এটাই বিবেচ্য এবং যতক্ষণ পর্যন্ত কাজটা করছে সে, অতীতে কি ঝামেলায় পড়েছিল তা নিয়ে আমল দেয় না কেউ। আইনের ক্ষেত্রেও তাই। আইন সবাইকে নিজের মত থাকতে দেয়। কোন লোক অন্য কোথাও যতই অবাঞ্ছিত বা ফেরারী হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত স্থানীয় কোন ঝামেলায় না জড়াবে, কেউই এ নিয়ে ভাববে না বা প্রশ্ন করবে না।
এ কারণেই বাবার হয়ে কাজ করছে এমন বেশ কয়েকজনের ঘোলাটে অতীত সম্পর্কে কিছু জানা নেই আমাদের, কিন্তু কাজে খুঁত নেই ওদের, ব্র্যান্ডের প্রতি আন্তরিকতায়ও খাদ নেই। আর এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
রীজের ওপরে ডেকে উঠল একটা কয়োট, আকাশের তারাকে দুনিয়ার অভিযোগ জানাল বোধহয়? আসল কয়োর্ট, ইন্ডিয়ান নয়। ইন্ডিয়ানরা কয়োটের ডাক নকল করে সঙ্কেত দেয়। অনভিজ্ঞ লোকের জন্যে দুটোর মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল বৈকি, কিন্তু দুটোই যখন শোনে কেউ, পার্থক্য ধরতে অসুবিধা হয় না। কেবল মানুষের কণ্ঠেরই জোরাল প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হয়, কয়োট বা নেকড়ের ডাকের প্রতিধ্বনি হলেও তীক্ষ্ণতায় সেটা দুর্বল, আর পেঁচা বা কোয়েলের ডাকের সামান্য প্রতিধ্বনিও সৃষ্টি হয় না।
পালের ওপাশে আছে ট্যাপ, নিচু স্বরে গান গাইছে। গলাটা মন্দ নয় ওর। “ব্রেনান অন দ্য মূর” গাইছে-বহু পুরানো আইরিশ গান। পালের চারপাশে চক্কর দেয়ার ফঁক ঘোড়ার রাশ টেনে থামলাম আমি, কান খাড়া করলাম।
কয়োটটা চুপ হয়ে গেছে…ট্যাপের গান শুনছে বোধহয়•••তারাগুলোর উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে। সবকিছু একেবারে শান্ত, আর কোন শব্দ নেই, শুধু ক্রীকে পানি প্রবাহের কুলকুল ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
বিশাল একটা বলদ উঠে দাঁড়িয়ে শরীর টানটান করল। ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে যেতে ঝট করে মাথা তুলল ওটা। যে-লোক শুধু নিজের শ্রবণশক্তির ওপর আস্থা রাখে সে অাসলে নেহাত বোকা…শুধু দেখতে আর শুনতে সক্ষম হলেই চলে না; বরং পশু-পাখির প্রতিক্রিয়া বা আচরণ দেখেও অনেক কিছু অনুমান করতে হয়। আসন্ন বিপদের আভাস আগে থেকে টের পায় এরা, মানুষের ইন্দ্রিয়ে যা কখনোই ধরা পড়ে না।
একটা কিছু নড়াচড়া করছে ক্ৰীকের পাড়ের ঝোঁপের আড়ালে। ঘুরে দাঁড়িয়ে সেদিকে ফিরেছে বলদটা, দু’পা এগিয়ে গেছে। প্যাটার্সনটা একটু তুলে সন্তর্পণে হ্যামার টানলাম। ক্লিক শব্দটা নিস্তব্ধ রাতে জোরাল শোনা গেল, আমার দিকে একটা কান খাড়া করল বলদটা, কিন্তু ঝোঁপের ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ ওটার, দৃষ্টি সরায়নি মুহূর্তের জন্যেও।
পালের ওপাশে রয়েছে ট্যাপ, টের পেলাম ঘোড়াকে হটিয়ে নিয়ে এগিয়ে আসছে। শুধু বলদটাই নয়, কাছাকাছি অন্য গরুগুলোও টের পেয়ে গেছে অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে ঝোঁপের আড়ালে। অস্বস্তিতে নড়াচড়া করছে ওরা।
খানিকটা ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে এলাম অন্ধকার থেকে, দেখতে চাই ঘটনা কি। নিচু কোমল স্বরে কথা বললাম, আশ্বস্ত করতে চাইলাম গরুগুলোকে। ধীরে ধীরে ঝোঁপের কাছে চলে যাচ্ছে আমার ঘোড়া।
হয়তো বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
মাথা নিচু করে রেখেছে বিশাল বলদটা, এক পা এগোল। আবছা অন্ধকারেও ওটার নাকের পাটা ফুলে উঠতে দেখতে পেলাম। অদ্ভুত কোন কারণে রেগে গেছে ওটা; লড়াই করতে ইচ্ছুক-ব্যাপারটা বিস্মিত করে তুলল আমাকে।
গরু ইন্ডিয়ানদের উপস্থিতি বা গন্ধ পছন্দ করে না। কাছাকাছি কোন ইন্ডিয়ান এলে ছটফট করে ওরা…হয়তো রেডস্কিনদের গায়ের গন্ধের কারণে, কিংবা ওদের চামড়ার পোশাকের গন্ধে। কিন্তু গরুগুলোর আচরণ দেখে মনে হচ্ছে না আশপাশে কোন ইন্ডিয়ান আছে।
সাদা মানুষকে কাছে আসতে দেখলে মোটেই উত্তেজিত হয় না ওরা। বাঘ বা ভালুকের উপস্থিতি টের পেলে অস্থির বা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তেমনও করছে না গরুগুলো। ট্রেক্সাসের এসব পাহাড়ী অঞ্চল বা এডওয়ার্ডস প্লেটো এলাকায় গ্রিজলি বা সিংহের উপস্থিতি মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
গ্রুলাটা এগোচ্ছে, রাইফেলটা আরও সিধে করলাম, তারপর কান পাতলাম।
আমার আগে আগে এগোচ্ছে বলদটা। ভয় পায়নি, বরং লড়াই করার জন্যে মুখিয়ে আছে ওটা। এদিকে, আমার উপস্থিতিতে স্বস্তিও বোধ করছে।
হঠাৎ শব্দটা কানে এল।
কান খাড়া করতে পরিষ্কার শুনতে পেলাম। ক্ৰীকের পাড়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁচড়ে এগোচ্ছে কেউ, কিংবা ভারী কিছু টেনে নিয়ে আসছে।
থেমে গেল শব্দটা, তারপর আবার শুরু হলো কয়েক মিনিট পর।
আমার পাশে চলে এসেছে ট্যাপ। ব্যাপার কি, ড্যান? ফিসফিস করে জানতে চাইল ও।
কিছু একটা পিছলে বা টেনে নিয়ে আসার শব্দ। কাভার করো আমাকে। দেখা দরকার।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার গ্রুলার লাগাম চেপে ধরল ও।
সাবধান, কিড! ইন্ডিয়ান হতে পারে।
স্যাডল ছেড়ে সন্তর্পণে ঝোঁপের দিকে এগোলাম। নিঃশব্দে ঢুকে পড়লাম। প্রায় পুরোটা জীবন বুনো এলাকায় কেটেছে আমার, প্রকৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। চিতার ক্ষিপ্রতায় চলতে শিখেছি, ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পাতার ওপর দিয়েও নিঃশব্দে এগোতে পারি।
কয়েক পা এগিয়ে, থেমে কান পাতলাম। গোড়ালির ওপর বসে ঝোঁপের দিকে উঁকি দিলাম। কিন্তু গাঢ় অন্ধকারের কারণে কিছুই চোখে পড়ল না। ক্ষীণ খসখসে, এবং শ্বাস টানার শব্দ কানে এল..বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছে কেউ!
শব্দের উৎস বরাবর প্যাটার্সনের মাজল স্থির করলাম, নিচু স্বরে সতর্ক করলাম লোকটাকে: পাঁচ শটের একটা প্যাটার্সনে কাভার করেছি তোমাকে, মিস্টার। যদি বিপদে পড়ে থাকো, নিশ্চিন্তে বলতে পারো। কিন্তু বেতাল কিছু করলে রাইফেল খালি করে ফেলব আমি।
অস্কুট একটা শব্দ হলো, মনে হলো কেউ কথা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে কোন কারণে। তারপর একেবারে নীরব হয়ে গেল চারপাশ।
ঝোঁপের ভেতরে আলগোছে সেঁধিয়ে গেলাম আমি। উইলোর সারির ফাঁকে সরু একটা পথ ধরে কয়েক গজ এগোতে খোলা জায়গায় পৌঁছলাম। আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আবছা ভাবে ঘাসের ওপর গাঢ় একটা আকৃতি চোখে পড়ল।
কথা বলো! আরেকটু জোরাল স্বরে বললাম।
জবাব এল না। হঠাৎ পাশে ক্ষীণ নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেলাম, ঘেউ করে ডেকে উঠল একটা কুকুর। কার্ল ক্রকেটের কুকুর।
সাবধান, বাছা! কুকুরটার উদ্দেশে ফিসফিস করলাম আমি। গন্ধ শুকে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা।
কোন পশু নয়, নিশ্চিত ধারণা আমার। কৌতূহলী হয়ে এগোলাম, অস্পষ্ট একটা কাঠামো চোখে পড়ল। প্রায় মুমূর্ষ একজন মানুষ।
ট্যাপ? নিচু স্বরে উকিলাম। আহত একজন লোক। জখমটা গুরুতর বোধহয়।
আসছি আমি, সঙ্গে সঙ্গে জানাল সে।
তুমি বরং মিলোকে নিয়ে এসো।
আমাদের মধ্যে কেবল মিলো ডজই জখমের চিকিৎসা বা শুশ্রূষা সম্পর্কে মোটামুটি জানে। বুনো নির্জন এলাকায় ডাক্তার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সত্যি কথা বলতে কি, পঁচিশ বছরের জীবনে এ পর্যন্ত কোন ডাক্তার দেখিনি আমি, যদিও অস্টিনে থাকে একজন; সম্ভবত স্যান এন্টোনিয়াতেও আছে দু’একজন। কেউ অসুস্থ বা জখম হলে, যেহেতু কোথাও ছুটে যাওয়ার মত জায়গা নেই, সাধ্যমত নিজেরাই চিকিৎসা করি আমরা।
মিনিট কয়েকের মধ্যে মিলো ডজকে নিয়ে ওখানে পৌঁছল ট্যাপ। ইতোমধ্যে শুকনো ডালপালা যোগাড় করে ছোটখাট একটা আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে ফেলেছি আমি।
আহত লোকটা মেক্সিকান। ছিপছিপে দেহ, সুদর্শন মানুষ। কালো গোঁফ। কাউকে এত বিধ্বস্ত অবস্থায় কখনও দেখিনি আমি। শার্ট জ্যাকেট ছাড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত পুরো প্যান্ট রক্তে ভিজে গেছে। হেঁচড়ে, ক্রল করে বহুদূর এসেছে লোকটা, কিন্তু এখনও তার এক হাতে একটা ছোরা রয়েছে, এত শক্ত ভাবে চেপে ধরে রেখেছে যে আমরা কেউই মুঠি থেকে ওটা খসাতে পারলাম না।
ছিড়ে ফালাফালা হয়ে যাওয়া জ্যাকেটের আস্তিনের দিকে ইঙ্গিত করল মিলো। নেকড়ে আক্রমণ করেছিল ওকে! লোকটার কজির চামড়া ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ছুরি দিয়ে নেকড়ের বিরুদ্ধে লড়েছে ও। কঠিন সময় পার করেছে বেচারা!
গরুর কাছে ফিরে যাচ্ছি আমি, বলল ট্যাপ। মিলোর সঙ্গে থাকো, ড্যান ফ্রি স্কয়ার পালের দায়িত্বে থাকবে আমার সঙ্গে।
নড়ে উঠল মেক্সিকান, বিড়বিড় করে বলল কি যেন। এদিকে ছুরি দিয়ে রক্তাক্ত কাপড় কৈটে ফেলেছে মিলো। লোকটাকে পরীক্ষা করতে ঘটনাটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে গেল।
কয়েকদিন আগে, অন্য কোথাও গুলি খেয়ে স্যাডল থেকে পড়ে যায় লোকটা। ঘোড়াটা হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যায় ওকে অসমতল পথে: হেঁচড়ানোর কারণে সমস্ত বুক আর পেটের চামড়া ছিলে গেছে। কোন ভাবে পিস্তল বের করে, গুলি করে উন্মত্ত ঘোড়াটাকে থামায় সে। পশ্চিমে অস্ত্র বহন করার এটাও একটা কারণ, যেহেতু আধ-পোষা বুনো ঘোড়ায় চড়তে হয় আমাদের, যে-কোন সময় পিঠ থেকে সওয়ারীকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে ঘোড়াটা।
তারপর ক্রল করেছে মেক্সিকান। রক্তের গন্ধ পেয়ে ওক আক্রমণ করে নেকড়ের দল। কাজ শেষ হওয়ার পর ছুরি দিয়েই নেকড়ের মোকাবিলা করেছে সে।
বাঁচার জন্যে মরিয়া ছিল ও, শুকনো স্বরে বলল মিলো। লড়েছেও আপ্রাণ!
ভাবছি কে গুলি করেছে ওকে!
আমার দিকে ফিরলো মিলো। আমার ধারণা, পশ্চিম দিক থেকে এসেছে ও।
পানি গরম করে ক্ষতের শুশ্রূষা করলাম আমরা। মেক্সিকানের পুরো শরীর মুছে দিলাম। বুলেট আর হেঁচড়ানোর ক্ষতগুলো কয়েকদিনের পুরানো, কিছু কিছুতে সংক্রমণ শুরু হয়েছে। কজিতে নেকড়ের দাঁতের দাগ পরের-কালকের বোধহয়।
বুলেটটা ছেদা করে ফেলেছে তাকে, পিঠের চামড়ার বিপরীতে গিয়ে থেমেছে। বাউই ছুরি দিয়ে ছোট একটা ফুটো তৈরি করল মিলো, সীসা বের করে ফেলল মেক্সিকানের শরীর থেকে। তারপর সেজ পাতার পুলটিশ দিয়ে বুলেটের দুটো চেরাই ভরে দিল।
শুশ্রূষা যখন শেষ হলো, ততক্ষণে পুরোপুরি সকাল হয়ে গেছে। একটা ওয়্যাগন নিয়ে এসে মেক্সিকানকে তুলে নিয়েছে কার্ল ক্ৰকেট।
গরুর দল যাত্রা শুরু করেছে। সবার শেষে ছিলাম আমরা। অন্যান্য ওয়্যাগন আগেই চলে গেছে। টিম অটম্যানের দেয়া ম্যাট্রেসের ওপর মেক্সিকান ইয়ে দেয়া হয়েছে ওয়্যাগনের পাটাতনে।
উজ্জ্বল রোদ্দুরে দিন। বেশ দ্রুতই এগোচ্ছে গরুর পাল, গুটিকয়েক বেয়াড়া গরু দলছুট হতে চাইছে। একে একে সবকটা গরু যাত্রা করার পর পিছু পিছু এগোলাম আমি। সবচেয়ে উঁচু ব্লফের চূড়ায় উঠে এসে চারপাশের এলাকা নিরীখ করলাম। যদ্র চোখে পড়ল, বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বাতাসে দুলছে সবুজ ঘাস, অন্য কিছুই নেই। ড্র থেকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের দিকে এগোল একটা কালো অবয়ব, পিছু নিল আরও একটা…মোষ।
ট্রেইলে নজর রাখার সময় মেক্সিকানের কথা মনে পড়ল। ট্র্যাক ফেলে এসেছে সে-নিচু হয়ে পড়া ঘাস চোখে পড়ল, এখনও সিধে হয়নি। বোধহয় রাতে তৃণভূমি পেরিয়েছে লোকটা।
প্যাটার্সনটা হাতে রেখে ঢালু পথ ধরে নামতে শুরু করলাম। খুঁটিয়ে দেখছি ক্ষীণ ট্র্যাকগুলো। একেবারে কাছ থেকেও ঠিকমত চোখে পড়ছে না, যদিও মোটামুটি এগোতে পারছি।
ঘাসের ওপর রক্ত পড়েছে।
এগোতে এগোতে লোকটার দৃঢ় প্রত্যয় ও সাহসের নমুনা দেখতে পেলাম। মেক্সিকানের অবর্ণনীয় কষ্ট আর দুর্ভোগের জন্যে যারা দায়ী, তাদের প্রতি ঘৃণা অনুভব করছি। জাতশত্রুও এত কষ্ট দেয় না মানুষ। টেক্সাসের অনেক লোক, এমনকি আমার পরিচিত অনেকেই মনে করে ব্রা বিশ্বাস করে: ইন্ডিয়ান আর মেক্সিকানরা কেবলই করুণার পাত্র। যে-কোন অন্যায়ই এদের বিরুদ্ধে ন্যায্য।
মেক্সিকানের পরিচয় যাই হোক, বহু পথ সরে এসেছে। দারুণ সাহস দেখিয়েছে। মনে মনে লোকটার প্রতি সমীহ বোধ করছি। সাহস আম বীরত্ব প্রায় সমার্থক। কিন্তু খুব কমই খুঁটিয়ে বিবেচনা করে মানুষ। মুখে বলা এক কথা, কাজে প্রমাণ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শারীরিক দুর্ভোগ, সীমাহীন কষ্ট, যন্ত্রণা বা অত্যাচার সহ্য করা সত্যিই কঠিন। মরা সবসয়ই সহজ, স্রেফ হাল ছেড়ে দিলেই হলো; ব্যস, মৃত্যুর সঙ্গে অবসান হবে সমস্ত যন্ত্রণা বা দুর্ভোগের। কিন্তু লড়াই করার অর্থ আরও দুর্ভোগ, আরও যন্ত্রণা। এমনকি সেটা কয়েকগুণ বেশিও হতে পারে। কষ্ট সহ্য করার এই সাহস করতে পারে না সবাই। যে পারে, সে শুধু সমীহ নয় বরং শ্রদ্ধা এবং প্রশংসার দাবীদার।
শুধু সাহস নয়, রীতিমত বীরত্ব দেখিয়েছে মেক্সিকান।
গুরুতর আহত অবস্থায় প্রবল মনের জোরে ক্রল করে বহু পথ পাড়ি দিয়েছে সে, প্রতি পদে প্রাণের ঝুঁকি ছিল। অন্ধকারে লড়েছে নেকড়ের বিরুদ্ধে, মৃত্যুর প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল; অথচ প্রাণপণ লড়াই করেছে লোকটা-সামান্য একটা ছুরি দিয়ে নেকড়ের দলকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। সুস্থ থাকলে নেকড়ের দল কখনোই আক্রমণ করত না ওকে, অথচ দুর্বল বলেই একজন মানুষকে আক্রমণ করার দুঃসহাস দেখিয়েছে নিষ্ঠুর নেকড়ের দল। এরকম অসমসাহসী লোককে বন্ধু হিসেবে চাই আমি, কারণ এ ধরনের লোক সত্যিই বিরল।
গিরিখাতের কাছে এসে বাঁক নিয়ে দ্রুত ঘোড়া ছোটালাম, আড়াআড়ি পথে গরু পালের কাছে চলে যাওয়ার ইচ্ছে।
লোকটার মধ্যে এমন কি ছিল যে এভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিল? স্রেফ বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে, সমস্ত প্রতিকূলতা উতরে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প? নাকি অন্য কোন কারণে? যারা ওকে গুলি করে স্যাডল থেকে ফেলে দিয়েছিল, তাদের প্রতি ঘৃণাই শক্তি যুগিয়েছে, ওকে? প্রতিশোধ স্পৃহা, নাকি অন্য কিছু?
পালের কাছে পৌঁছে দেখলাম কার্লের সঙ্গে ড্রাগিঙের দায়িত্বে রয়েছেন বাবা।
মিলো বলছে লোকটার অবস্থা ভাল না, বললেন বাবা। কিছু দেখতে পেলে?
গতরাতে ক্রল করে অনেক পথ এসেছে লোকটা। ব্যস, এই।
দীর্ঘ সারিতে গরু জড়ো করা হচ্ছে, ড্রাগের কেন্দ্র থেকে প্রায় আধ-মাইল লম্বা হয়ে গেছে সারির দৈর্ঘ্য। বাবার সঙ্গে হাত লাগালাম, আরও কিছু গরুকে একত্র করলাম, টানা চলার মধ্যে থাকতে বাধ্য করলাম ওদের। কাউ-হাউসের সঙ্গে যতটা সম্ভব দূরত্ব সৃষ্টি করা দরকার, এবং যত জলদি শুকনো এলাকা পেরিয়ে যেতে পারব ততই মঙ্গল।
তবে দ্রুত এগোনোর ব্যাপারে অনিচ্ছুক গরুগুলো, কাউ-হাউসের তৃণভূমিতে ফিরে যাওয়ার আশা ছাড়েনি এখনও। দলছুট হওয়ার চেষ্টা করছে কোন কোনটা, কিন্তু সুবিধে করতে পারছে না।
এখন পর্যন্ত হর্নার আউটফিট বা রেনিগেডদের কোন নমুনা চোখে পড়েনি। সন্ধে হলো যখন, ততক্ষণে আরও পনেরো মাইল পেছনে ফেলে এসেছি আমরা। কলোরাডো নদীর কাছাকাছি একটা ব্লাফের ছায়ায় ক্যাম্প করলাম।
পরদিন থেকে নদীর কিনারা ধরে এগোলাম। ধুলো বা বৃষ্টি গ্রাহ্য করছি না, এগোতে পারলেই হলো। সারাদিন টানা চলার মধ্যে থাকে গরুগুলো, রাতে সবুজ তৃণভূমিতে চরে বেড়ায়। কলোরাডো নদীর পানি তেষ্টা মেটাচ্ছে ওদের। প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই যাত্রা করছি, সন্ধের আগে থামছি না।
বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে কয়েকবার, তাতে ট্রেইলের ধূলো থিতিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু ওঅটরহোলে পানি জমেনি। নদী ক্রমশ শুকিয়ে আসছে দেখে উদ্বেগ ফুটে উঠল ট্যাপের মুখে। তবে কিছুই বলল না সে। বাবাও এ নিয়ে কথা বললেন না।
পশ্চিম যাত্রায় সর্বস্ব বাজি ধরেছি আমরা, সবকিছু হারানোর ঝুঁকি নিয়েছি। সামনে কি আছে জানি সবাই, এও জানি আশি মাইল দীর্ঘ রুক্ষ খটখটে জমি পেরিয়ে যেতে হবে স্বপ্নের এলাকায়।
দারুণ কষ্টকর যাত্রা। ক্লান্তিকর, একঘেয়ে। ক্ষারের মিহি প্রলেপ পড়েছে আমাদের মুখে, প্রায় সাদা হয়ে গেছে সবার মুখ, ঘোড়া আর পোশাকে ধুলোর পুরু আস্তর জমেছে। ঘামের ধারা পিঠে বা শরীরে জমে থাকা ধুলোর জমিনে আঁকাবাঁকা রেখা তৈরি করেছে। চেহারার আদল বদলে গেছে, যেন কিম্ভুতকিমাকার মুখোশ পরেছে সবাই। চলার পথে ওয়্যাগন থেকে নেমে আসছে বাচ্চারা, বাফেলো চিপস সংগ্রহ করছে, রাতে আগুন জ্বালাতে কাজে লাগবে ওগুলো। চিপস বহন করার জন্যে প্রতিটি ওয়াগনের পেছনে গরুর চামড়ার তৈরি বিশাল থলে ঝুলছে।
নদীর কিনারা ধরে কিছুটা উত্তরে চলে এসেছি আমরা। এতটা উত্তরে আসার কথা নয়, এদিকে একটা ট্রেইল পাওয়ার কথা। যত দূরে আশা করেছি, তারচেয়ে বেশিই চলে এসেছি। কিন্তু ট্রেইলের দেখা নেই। অন্য ট্রেইলেও যেতে পারতাম, সমস্যা সেখানেও আছে, তবে জানা ট্রেইল ধরে এগোলে সমস্যা মোকাবিলা করা সহজ।
ফোট ফ্যান্টম হিলের কাছাকাছি এসে উদ্দিষ্ট ট্রেইল খুঁজে পেলাম আমরা, দক্ষিণে বাঁক নিয়ে পশ্চিমে এগোলাম আবার।
কেউ অনুসরণ করছে আমাদের…দিনের বেলায় পেছনে ধুলোর মেঘ চোখে পড়েছে; আর রাতে গরুর অস্থিরতায় বোঝা গেছে খুব বেশি দূরে নেই তারা। পৃনি চুরি, কিংবা চাদির চামড়া শিকারে আসা কোমাঞ্চি হতে পারে এরা, কিংবা ব্র্যাজোস অঞ্চল বা কাউ-হাউস থেকে আসা রেনিগেড।
একটা মোষ মেরেছে ট্যাপ। মাংস পেয়ে খুশিই হলো সবাই। পরে অবশ্য অ্যান্টিলোপও শিকার করেছে ও; এবং আশপাশে ইন্ডিয়ানদের উপস্থিতির নমুনা দেখতে পেয়েছে। ক্রমশ বুনো হয়ে আসছে ট্রেইল আর আশপাশের এলাকা। একেবারে জনমানবশূন্য। পেকোসের হর্স হেড ক্রসিঙের দিকে যাচ্ছি আমরা। মেক্সিকোয় রেইড করার সময় ট্রেইলটা ব্যবহার করত কোমাঞ্চিরা। অদ্ভুত নামকরণের সার্থকতা ওই ট্রেইলে গেলে চোখে পড়ে-অসংখ্য ঘোড়ার খুলি আর কঙ্কাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আশপাশে। মেক্সিকো থেকে রেইড করে ফেরার পথে সর্বোচ্চ গতিতে ঘোড়া ছোটায় নিষ্ঠুর কোমাঞ্চিরা, অনেক ঘোড়াই প্রাণ হারায় পথে।
মাঝে মধ্যে ট্র্যাক চোখে পড়ছে। একসময় ধারণা ছিল ইন্ডিয়ানরা নালহীন আর সাদারা নালঅলা ঘোড়ায় চাপে, কিন্তু ধারণাটার গুরুত্ব নেই এখন; কারণ রেডস্কিনরা অহরহ নালঅলা ঘোড়া চুরি করছে র্যাঞ্চ থেকে, এবং সাদা মানুষও নালহীন ঘোড়ায় চড়ছে ইদানীং।
ওঅটরহোলের তলায় প্রায় শুকনো কাদা উদ্বিগ্ন করে তুলছে আমাদের। নদীতে পানি আছে বটে, কিন্তু একেবারে কম। অথচ কয়েকবার বৃষ্টি হয়েছে আর বসন্ত চলছে এখন। মাস খানেক পর কি অবস্থা হবে মাটির, সূর্যের তাপে উনুনের মত শুকনো হয়ে উঠবে না?
অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কার দোলায় দুলছে সবাই। ক্যাম্পে গান থেমে গেছে, গলায় জোর পাচ্ছে না কেউ। গরুর পালটাই এখন আমাদের সর্বস্ব। এই যাত্রায় ভবিষ্যৎ-হয়তো জীবনেরও ঝুঁকি নিয়েছি আমরা।
সবার সামনে ট্যাপ, সাধারণত বাবা থাকছেন ওর সঙ্গে বুনো রুক্ষ প্রান্তর ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের। রাতে নেকড়ের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, দিনের বেলায় দু’একটাকে চোখে পড়ছে; ধান্ধায় আছে ওরা, যদি কোন রকমে একটা গরুকে কজা করা যায়।
সঙ্গে অস্ত্র বাখছি, আমরা। সারাক্ষণই সতর্ক, সজাগ; যে-কোন পরিস্থিতির জন্যে, তৈরি। ত্যক্ত ও মেজাজী হয়ে উঠেছে সবাই, অল্পতে ধৈর্য হারাচ্ছে। তাই পরস্পরকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলছি আমরা। এমন পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত দু’একটা বাক্য অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে জানি বলেই জিভ সামলে রাখার চেষ্টা করছি সবাই।
ইলেন এড়িয়ে চলছে আমাকে। ট্যাপ আসার আগে একসঙ্গে ঘুরেছি, রাইড করেছি আমরা। কিন্তু ইদানীং দেখাই হচ্ছে না ওর সঙ্গে যতটা সম্ভব ট্যাপের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে ও।
আজ অটম্যানদের ওয়াগনটা চালাচ্ছে ইলেন। পাল থেকে কিছুটা সরে এসে, ঘোড়া দাবড়ে ওয়্যাগনের কাছে চলে এলাম আমি। আমার উপস্থিতি টের পেলেও ফিরে তাকাল না ইলেন, মনোযোগ আর দৃষ্টি দুটোই ট্রেইলের দিকে।
ইদানীং তোমার সঙ্গে দেখাই হয় না, বললাম।
চিবুক উঁচু হয়ে গেল ওর। ব্যস্ত ছিলাম।
হ্যাঁ, খেয়াল করেছি।
আমি তোমার সম্পত্তি নই। তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতেও বাধ্য নই।
ঠিকই বলেছ তুমি, ম্যাম। তাছাড়া…ট্যাপ খুব ভালমানুষ। হাজার জনের মধ্যেও ওর মত কাউকে পাওয়া যাবে না।
ঘাড় ফিরিয়ে আমার চোখে চোখ রাখল ও। ওকে বিয়ে করব আমি।
ট্যাপকে বিয়ে করবে? ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হচ্ছে। ট্যাপ এডলে আগাগোড়া ছন্নছাড়া স্বভাবের মানুষ, থিতু হওয়া দূরে থাক, কোথাও বেশিদিন থাকতে পারে না সে। এটা অবশ্য পুরোপুরি আমার ধারণা। ভুলও হতে পারে। মনস্থির করার জন্যে একটুও দেরি করোনি তুমি, মন্তব্য করলাম শেষে। অথচ সপ্তাহ খানেক আগে পরিচয় হয়েছে তোমাদের।
তাতে কি? আচমকা চটে উঠল মেয়েটা। সবাই তো বলবে ওর মত মানুষই হয় না-হাসি-খুশি, চটপটে। সব কাজেই ওস্তাদ। সত্যিকার পুরুষ! হাজার বছর চেষ্টা করলেও ওর মত হতে পারবে না তুমি!
ইলেন অটম্যানের মন্তব্যে খেপে ওঠার কারণ নেই, শুধু একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে-মেয়েটা যেন তর্ক করার জন্যে মুখিয়ে আছে! হয়তো, একমত হলাম আমি। ট্যাপ সত্যিই ভালমানুষ। কোন সন্দেহ নেই এতে। কিন্তু সত্যিকার পুরুষ কিনা, সেটা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। আমি যদি মেয়ে হতাম, তাহলে এ নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনা করতাম। আসলে ও বাঁধনহীন পুরুষ মানুষ-নিজের কাজ করে ঠিকমত, সমর্থ, আন্তরিক
তো?
এক জায়গায় বসে থাকার লোক নয় ট্যাপ। আমার মনে হয় না কখনও বদলাবে ও।
বদলায় কিনা দেখবে তুমি! জোরাল, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেও খুব একটা আত্মবিশ্বাসী মনে হলো না ইলেনকে। আমার সন্দেহ হলো আদৌ এ নিয়ে কখনও ভাবেনি ও। মেয়েরা প্রেমে পড়লে শুধু আবেগ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, পরিণতিতে কি হতে পারে ভাবার অবকাশই পায় না। উপলব্ধিও করতে পারে না। ঘোর কেটে যাওয়ার পর আচমকা টের পায় যে-মানুষটিকে ভালবাসে, ভালবাসার মানুষ হিসেবে সে অদ্বিতীয়, কিন্তু স্বামী হিসেবে জঘন্য।
তো, ওখান থেকে সরে এলাম আমি, ভেতরে ভেতরে কিছুটা হলেও ক্ষরণ অনুভব করছি। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। লোকজন অযথাই নিজেদের বোকা বানায়। ইলেন আর আমি ঘুরতে বেরিয়েছি দুতিনদিন, সবাই তাতে মনে করেছে, স্থায়ী একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, বড়জোর বন্ধু বলা যাবে আমাদের। মেয়েটা অন্য কাউকে পছন্দ করলে বা বিয়ে করলে, একজন বন্ধু হারাব আমি, শুধু এটাই ক্ষরণের কারণ; কখনোই দাবি করব না যে ওর ব্যাপারে আমি বা আমার ব্যাপারে সিরিয়াস ছিল ইলেন।
সবকিছুর পরও, ক্ষণিকের আবেগতাড়িত উন্মাদনাই বলা যায় এটাকে। ইলেন আর আমার মধ্যে এমন কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, কিন্তু স্বামী হিসেবে ট্যাপ এডলেকে নির্বাচন করে নিঃসন্দেহে ভুল করেছে ইলেন। মেয়েটাকে কিছুটা হলেও চিনেছি, জানি ওর সম্পর্কে নিজের চারপাশে পুরুষদের দেখেছে ও, তাদের মধ্যে কাউকেই অসাধারণ মনে হয়নি, হঠাৎ উদয় হওয়া সুবেশী চটপটে ট্যাপ এডলে ওর চোখে হয়ে গেছে জবরদস্ত এক দেবদূত। এই দেবদূতকে নিজের কাঙ্ক্ষিত পুরুষ মনে করেছে।
সত্যি কথা বলতে কি, জোয়ান-বুড়ো সবাই স্বপ্ন দেখে, কাঙ্খিত মানুষটির ছবি নিজের মনে লালন করে, তাকে ভালবেসে সংসারী হতে চায়। স্বপ্নের পরিধি সীমাহীন, অথচ বাস্তবে তার প্রাপ্তির পরিমাণ অনেক কম-তাই অল্পতে তুষ্ট থাকে সবাই। এমনও হয়েছে, স্বামী-স্ত্রী একই বিছানায় পাশাপাশি ঘুমাচ্ছে, স্বপ্ন দেখে দু’জনেই-অথচ দু’জনের স্বপ্নের মধ্যে হাজার মাইল ফারাক। কারও চাওয়ার সঙ্গে কারও মিল নেই।
ট্যাপ এডলে ছন্নছাড়া-ড্রিফটারও বলা যাবে ওকে। হয়তো সত্যিই ইলেনের স্বপ্নের পুরুষ ও, কিংবা ইলেনের উসিলায় থিতুও হয়ে যেতে পারে। ব্যাপারটা যতই অস্বাভাবিক মনে হোক, এটা আমার মাথা ব্যথার বিষয় নয়। মাথা ঘামানোও উচিত নয়।
পালের একেবারে পেছনে এসে দলছুট একটা বলদকে খেদিয়ে পালে ঢুকিয়ে দিলাম। ধুলোর অত্যাচারে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম, দাঁতের ব্যথায় আক্রান্ত গ্রিজলির মত করুণ মনে হচ্ছে নিজের অবস্থা।
আমার পাশে চলে এল মিলো ডজ। মেক্সিকামের সঙ্গে আলাপ হলো। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে ও।
আমার সঙ্গে?
তুমি ওকে খুঁজে পেয়েছ, তুমিই ওর কাছে নিয়ে গেছ আমাদের।
কোত্থেকে এসেছে ও?
নিজের ব্যাপারে কিছুই বলেনি। গালে মাকড়সার মূত ক্ষত আছে, এমন এক লোক সম্পর্কে জানতে চাইছিল বারবার। লোকট বিশালদেহী।
সেদিন অ্যান্টিলোপ কীকের ধারে ক্যাম্প করলাম আমরা। ক্রীকের পানি স্বচ্ছ, টলটলে এবং মিষ্টি। তীরে বিশাল ওক আর পেকানের সারি। প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ একরের মত খোলা জায়গা বেছে নিয়েছি গরু রাখার জন্যে। ক্রীকের ধারে ছড়িয়ে পড়ল তৃষ্ণার্ত গরুর দল, তেষ্টা মেটানোর পর তৃণভূমিতে ফিরে এল।
পেকানের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছি আমি, এ সময় এলেন বাবা। দারুণ সুন্দর জায়গা, ড্যান। এখানেই থেকে যেতে লোভ হচ্ছে।
মাথা ঝাঁকালাম। এখানে একটা দিন কাটিয়ে দিলে মন্দ হয় না। ইচ্ছামত পানি আর ঘাস খাওয়ার সুযোগ পাবে গরুগুলো। আমাদেরও বিশ্রাম নেওয়া হবে। ট্যাপের কাছ থেকে যা শুনেছি, শিগগিরই সামনে রুক্ষ এলাকা পড়বে। যত এগোব, ততই পানি বা ঘাস,কমে যাবে।
ট্যাপ আর কার্ল যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। ক্ৰীকের ধারে একটা বৃত্তের আকারে রাখা হয়েছে ওয়্যাগনগুলো। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। কঞ্চো নদীর ওপাড়ের ব্লাফের দিকে চলে গেল ট্যাপের দৃষ্টি। কাছাকাছি, নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে অ্যান্টিলোপ ক্রীক। পরে পশ্চিমে চলে গেছে নদীটা।
ওই ব্লাফগুলো ঠিক পছন্দ হচ্ছে না আমার, যে-কেউ লুকিয়ে থাকতে পারবে ওখানে, চিন্তিত সুরে মন্তব্য করল ট্যাপ। তবে এরচেয়ে নিরাপদ জায়গা বোধহয় আশপাশে নেই।
এখানে একদিন বিরতি নেয়ার প্রস্তাব করলেন বাবা ট্যাপও সায় জানাল। আশ্রয় হিসেবে জায়গাটা দারুণ, ব্লাফের কারণে উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাস আটকে যাবে, পর্যাপ্ত ঘাস আর পানিও আছে। কচি পাতার লোভে কয়েকটা বাছুর ইতোমধ্যে পেকানের সারিতে ঢুকে পড়েছে, গতবারের শীতে মোটামুটি টিকে গেছে কিছু পাতা।
একটা ডান ঘোড়ায় স্যাড়ল চাপিয়ে ক্যাম্পের দিকে রওনা দিলাম আমি। মেক্সিকান লোকটার ওয়্যাগনের সামনে চলে এলাম। ক্যানভাসের দৈয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে সে, কিছুটা হলেও রঙ ফিরে এসেছে মুখে।
আমি ড্যান ট্রেভেন, পরিচয় দিলাম।
বাদামী শীর্ণ একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে, স্মিত হাসল। ঝকঝকে সাদা লোকটার দাঁত। ঘেসিয়াস, অ্যামিগো। আমার জীবন বাঁচিয়েছ তুমি। মনে হয় না এরচেয়ে বেশি যেতে পারতাম।
অনেক পথ ক্রল করে এসেছ তুমি। বুঝতে পারছি না কিভাবে সম্ভব করেছ কাজটা।
শ্রাগ করল মেক্সিকান। পানি আর আশ্রয় দরকার ছিল আমার, ওগুলোর তাগিদেই এগিয়েছি। এবার গম্ভীর হয়ে গেল সে। সেনর, তোমাকে সূতর্ক করা আমার দায়িত্ব। আমাকে আশ্রয় দিয়ে আসলে শত্রু তৈরি করেছ…একাধিক শত্রু।
শত্রু কার নেই? যে যত ভাল ভাবে বেঁচে থাকে, তার শত্রু তত বেশি। যাকগে, আমার মনে হয় দু’একজন বাড়লে এমন কিছু যাবে আসবে না।
খুব খারাপ মানুষ ওরা…নিষ্ঠুর। কোমাঞ্চেরো।
কোমাঞ্চিদের সঙ্গে ব্যবসা করে যেসব মেক্সিকান, তাদের কথাই বলছ তো? শুনেছি ওদের সম্পর্কে।
সি…মেক্সিকান, কিন্তু সাধারণ মেক্সরা সমর্থন করে না ওদের। ওদের এলাকায় আমাকে পেয়ে গিয়েছিল, ব্যাটারা। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। ভাবিনি তর্কের মধ্যেই গুলি করে বসবে। কোন রকমে পালিয়ে এলাম, কিন্তু ঠিকই পিছু নিল ওরা। এক কোমাঞ্চি আর এক কোমাঞ্চেররাকে খুন করে ফেললাম, তারপরই আমাকে কোণঠাসা করে ফেলল ওরা। স্যাডল থেকে পড়ে গেলাম। দড়িতে বেঁধে আমাকে টেনে নিয়ে চলল ওরা। ভাগ্যিস, ছুরি ছিল সঙ্গে। দড়ি কেটে ঘোড়া কেড়ে নিলাম লোকটার কাছ থেকে..তারপর ছুট লাগিয়েছি। তবে ওদের ফাঁকি দেয়া সত্যিই কঠিন। এবারও আমার পিছু নিল। ঘোড়াটা মরে যাওয়ার পর প্রাণপণে ছুটেছি, কোন্ দিকে গেছি নিজেও জানি না। একসময় দেখলাম আর পিছু নিচ্ছে না ওরা।
মেক্সিকানের সহজ কথাবার্তায় তার সাহস, দৃঢ় মনোবল বা কষ্টসহিষ্ণুতার পুরো চিত্র ফুটে ওঠে না। সমীহ করার মত একজন মানুষ বটে। হাজার লোকের মধ্যেও এমন একজন খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানসচক্ষে লোকটাকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য কল্পনা করলাম। ঘোড়া দখল এবং নিজেকে বাঁচানোর জন্যে একটাই উপায় ছিল-রাইডারকে খুন করতে হত। ঠিক তাই করেছে সে। ঘোড়াটা মারা যাওয়ার পর উড্রান্তের মত ছুটেছে, ক্রল করে এগিয়েছে, হিংস্র নেকড়েকে ঠেকিয়ে দিয়েছে…
নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নাও, সেনর, শেষে আশ্বস্ত করলাম ওকে। এখানে যদ্দিন আছ কোমাঞ্চি বা কোমাঞ্চেরো, কেউ বিরক্ত করতে পারবে না তোমাকে।
আমার খোঁজে ঠিকই আসবে ওরা, নড়েচড়ে আরামদায়ক অবস্থানে শুয়ে পড়ল সে। অযথাই বিপদে পড়বে তোমরা। তারচেয়ে একটা ঘোড়া দাও আমাকে, চলে যাই। তাহলে কারোই বিপদের ঝুঁকি থাকে না।
আসুক ওরা, ওয়্যাগনের পাটাতন থেকে মাটিতে নেমে এলাম। বাইবেলে নাকি আছে: মানুষ মাত্রই ঝামেলার সঙ্গে বসবাস করে। জীবনে দুঃখ-কষ্ট বা দুর্ভোগ থাকবেই। কি জানো, বাইবেলের বাণীতে অবিশ্বাস নেই আমার, কিংবা আস্থাও হারাতে চাই না। যত বিপদ বা ঝামেলাই আসুক, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করব আমরা। আহত একজন লোককে কখনও ফিরিয়ে দেইনি আমরা, নিয়মটার ব্যতিক্রম করার ইচ্ছে নেই আমার।
ডানটা দারুণ চালু ঘোড়া। হাতে বেশ কিছু কাজ পড়ে আছে। ক্যাম্পের দিকে এগোলাম আমি। কার্ল ক্ৰকেট যোগ দিল আমার সঙ্গে।
ইন্ডিয়ান এলাকা এটা। যে-কোন মুহূর্তে উদয় হতে পারে রেডস্কিনরা। ওদের জন্যে তৈরি আছি আমরা। নদীর পাড় ধরে কিছুদূর স্কাউট করলাম, কোন ট্র্যাক চোখে পড়ল না। নদী পেরিয়ে ব্লফের কাছাকাছি চলে গেলাম, একটা বুনো ট্রেইল ধরে কিছুক্ষণ পর ব্লাফের ওপর উঠে এলাম দুজনে।
দারুণ বাতাস এখানে। অনেকদূর পর্যন্ত চোখে পড়ছে। সামনের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ওপর নজর চালালাম। বাতাসে উড়ছে কার্লের বাদামী চুল।
নদীর উল্টোদিকে পুরো এলাকাই রুক্ষ ঊষর প্রান্তর, কারও স্বপ্নের জায়গা নয় এটা। অনেকক্ষণ ধরে নজর রাখলাম আমরা, কিন্তু কোন নড়াচড়া বা ট্র্যাক চোখে পড়ল না। শেষে ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
শত্রুপক্ষ ধারে-কাছে আছে, নিশ্চিত জানি আমরা। কিন্তু কোথায়?
ক্যাম্পে পৌঁছার আগেই জ্বলন্ত আগুন চোখে পড়ল, বাতাসে কফি আর স্টুর সুঘ্রাণ। ইতোমধ্যে পালের পাহারার দায়িত্বে চলে গেছে বেন টিল্টন এবং ফ্রিম্যান স্কয়ার।
এখনও চরছে গরুগুলো। সতেজ দীর্ঘ ঘাসের লোভ সামলাতে পারছে না। কয়েকটা তেষ্টা মেটাতে ক্রীকের কাছে চলে গেছে আবার। ব্লাফের ওদিকে কোথাও ডেকে উঠল একটা কোয়েল।
বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ট্যাপ এল একটু পর। পাহারা দ্বিগুণ করাই মঙ্গল, প্রস্তাব করল সে। অবস্থা ভাল ঠেকছে না আমার। মন কু গাইছে কেবল।
এ পর্যন্ত ভালই কাটল। আমার কাছে তো তেমন বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না, বললেন বাবা। কি জানি, হয়তো আমাদের প্রতিবেশীরা অতিরিক্ত চালাক, কোমাঞ্চি এলাকার মাঝামাঝি পর্যন্ত এগোতে দেবে আমাদের, তারপর বোধহয় হামলা করবে। যাতে দোষটা ইন্ডিয়ানদের ওপর চাপানো যায়।
আমার দিকে ফিরল ট্যাপ। তোমার মেক্সিকান বন্ধুর পরিচয় জেনেছ?
কোমাঞ্চেররাদের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে ওর। বলল মাকড়সার মত ক্ষত আছে মুখে, এমন এক লোকওর পিছু নিয়েছে।
দীর্ঘক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল ট্যাপ। আমার মনে হয় ওকে একটা ঘোড়া দিয়ে দেওয়াই উচিত, বলেই ঘুরে দাঁড়াল সে, হেঁটে চলে গেল ক্যাম্পের দিকে।
ব্যাপার কি, হয়েছে কি ওর? জানতে চাইলেন বাবা।
ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, ট্যাপের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। ঝামেলাকে ভয় পায় না ও। এভাবে কখনও এড়িয়ে যেতে দেখিনি ওকে, শুনিওনি এমন কিছু। একটা ঘাপলা আছে কোথাও। হয়তো আমরা জানি না এমন কিছু জানে ট্যাপ। ক্ষতঅলা লোকটার ব্যাপারে কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছে আমার।
খাওয়া সেরে, পেকানের নিচে বেডরোল বিছালাম। ক্লান্তি লাগছে খুব। ঘুম এল বটে, কিন্তু আধো ঘুম আধো জাগরণে কাটছে সময়, ক্যাম্পের স্বাভাবিক প্রতিটি শব্দ কানে আসছে।
কার্ল ক্রকেটের ডাকে ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখলাম পায়ে বুট গলাচ্ছে সে, ঠিক আমার পাশে বসে আছ। একেবারে শান্ত সবকিছু, সন্দিহান সুরে বলল ও। অবস্থা ভাল ঠেকছে না। ভালুকের জন্যে তৈরি থাকাই ভাল।
আগুনের ধারে বসে কফি গিলছে মিলো ডজ আর রাস্টি বুচার্ড। শার্পস রাইফেলটা পাশে রেখেছে বুচার্ড।
পায়ে বুট গলিয়ে আগুনের কাছে চলে এলাম। ঘুমটা শুরুতে হালকা থাকিলেও গভীর হয়ে গিয়েছিল শেষদিকে, নইলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জাগাতে হত না আমাকে। মনে মনে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলাম নিজের ওপর। সাবধানী মানুষের ঘুম পাতলা হওয়া উচিত। গভীর ঘুম শুধু বিপদই ডেকে আনে।
কফিটা দারুণ গরম, কড়াও। বাবাও উঠে এসেছেন। ঠাণ্ডা একটা বিস্কুট ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। কফির সঙ্গে খেলাম ওটা।
সতর্ক থেকো সবাই। ট্যাগকে এমন অস্থির হতে দেখিনি আমি। রাতটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ও।
আমার জন্যে ডানে স্যাডল চাপিয়েছে টম জেপসন। স্যাডলে চড়ে ট্যাপ এডলের বেডরোলের দিকে তাকালাম। শূন্য ওটা। ট্যাপকে দেখেছ?
ঘুরে দাঁড়াল জেপসন। না, দেখিনি! প্রায় খেকিয়ে উঠল সে।
আগুনের কাছ থেকে সরে আসতে অন্ধকার গ্রাস করল আমাদের। জায়গাটা ব্লাফের পেছনে হওয়ায় ঠাণ্ডা বাতাসের অত্যাচার সইতে হচ্ছে না। তবে তৃণভূমিতে যেতে শীতল বাতাসের ঝাঁপটা অনুভব করলাম। একসঙ্গে পালের দিকে এগোলাম চারজন, কিছুক্ষণ পর ছড়িয়ে পড়লাম।
গভীর রাতে সামান্য শব্দও তীক্ষ্ণ এবং স্পষ্ট শোনায়। অতি চেনা শব্দও রহস্যময় বা অদ্ভুত মনে হতে পারে। প্রকৃতির সাধারণ শব্দ থেকে বিপজ্জনক শব্দ আলাদা করতে সক্ষম সতর্ক ও অভিজ্ঞ মানুষ, যারা বুনো প্রকৃতি আর রাতের নৈঃশব্দ্য সম্পর্কে অভ্যস্ত।
গাছে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে পাখি। ছোট একটা সরীসৃপ বুকে হেঁটে এগোচ্ছে, ঘাস ঠেলে এগোচ্ছে ছোটখাট কোন পশু, বাতাসে পাতার মর্মরধ্বনি, গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার শব্দ বা নেহাত দুর্ঘটনাক্রমে দুটো গরুর শিঙের সংঘর্ষের আওয়াজ-সবই পরিচিত এবং স্বাভাবিক।
পালের ওপাশে একত্র হলাম আমরা। এবার জোড়ায় জোড়ায় রেকি শুরু করলাম, বরাবরের মতই,কার্ল ক্ৰকেট রয়েছে আমার সঙ্গে।
সবকিছু বড় বেশি শান্ত হয়ে গেছে হঠাৎ। স্বাভাবিক শব্দগুলোও শুনতে পাচ্ছি না এখন। এর তাৎপর্য একটাই: অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার-আশপাশে একটা কিছু আছে কিংবা ঘটতে যাচ্ছে। কারণ ছোট ছোট পশু-পাখি নিজের চারপাশে অস্বাভাবিকতা টের পেলে শঙ্কিত হয়ে ওঠে, নিশ্ৰুপ হয়ে পড়ে ওরা।
কি মনে হয় তোমার, কার্ল?
কাছাকাছি আসার চেষ্টা করবে ওরা। অপঘাত
অন্য পাশ থেকে আসা মিলো ডজ আর রাস্টি বুচার্ডের মুখোমুখি হলাম আমরা। মিলো, ফিসফিস করে বললাম আমি। কার্ল আর আমি গাছপালার ওদিকে যাব। সম্ভবত ওদিক থেকে হামলা করবে শত্রুপক্ষ। ওরা আমাদের ওপর চড়াও হওয়ার আগেই মুখোমুখি হওয়া ভাল।
ঠিক আছে।
জায়গাটা দেখিয়ে দিলাম ওকে। বুচার্ডও দেখে নিল, ব্লাফের ঠিক সোজাসুজি।
কিন্তু সামান্য সুযোগও পেলাম না আমরা। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল অনেক ঘটনা। আচমকা খুরের ভোতা শব্দ হলো, পরপরই ছুটে এল ওরা। ব্লাফের গাঢ় কাঠামোর বিপরীতে বলে স্পষ্ট ঠাহর করা মুশকিল হয়ে পড়ল। নিশানা করব কি, ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কোন টার্গেটই খুঁজে পেলাম না।
ছুটে এল ওরা, কেবল খুরের শব্দ হচ্ছে। লম্বা, ঘাসের কারণে ভোতা শোনাচ্ছে। তীক্ষ্ণ স্বরে গর্জে উঠল একটা পিস্তল। অন্যদের সতর্ক করে দেয়ার জন্যে অন্ধকার বরাবর ব্লাফের দিকে গুলি করেছি আমি।
সঙ্গে সঙ্গে তুমুল গোলাগুলি শুরু হলো। কাছাকাছি ভারী কিছু মাটিতে আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম, অস্ফুট স্বরে যন্ত্রণা প্রকাশ করল কেউ। আবছা ভাবে সামনে সাদা একটা কাঠামো দেখতে পেলাম-সাদা ঘোড়ায় চেপেছে কেউ। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলাম।
আচমকা হোঁচট খেল যেন ঘোড়াটা, তীক্ষ্ণ মোচড় উঠল পেশীবহুল শরীরে। তুমুল গুলি বৃষ্টি শুরু হয়েছে ততক্ষণে, ঘোড়াটার দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ বা ফুরসত হলো না।
প্রতিপক্ষের চমক তেমন কাজে আসেনি। স্থান বা কৌশল নির্বাচনে কোন খুঁত নেই, কিন্তু সময়টা সামান্য এদিক-ওদিক হয়ে গেছে। আক্রমণের সময় নেহাত সৌভাগ্যবশত চারজনই কাছাকাছি ছিলাম আমরা। চারটে অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে উল্টো দৌড় দিতে হলো ওদের। সমানে চেঁচাচ্ছে ওরা এখন, ছোটার মধ্যে গরুর পাল ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে।
মাঝরাতে এমন তীব্র গোলাগুলি আর ছুটন্ত রাইডারদের তুমুল চিৎকারে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল গরুর দল। তুমুল বেগে উপত্যকার দিকে ছুটতে শুরু করল ওরা।
ফ্যাকাসে আকাশের পটভূমিতে এক লোকের কাঠামো দেখে গুলি করলামপরপর দু’বার। দ্রুত হাতে রিলোড করলাম পিস্তলটা, তারপর হামলাকারীদের পিছু পিছু ঘোড়া ছোটালাম।
কিন্তু যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল জমজমাট লড়াই। ফলাফল: হামলাকারীরা পালিয়েছে। সঙ্গে আমাদের গরুর পাল উধাও।
ঘোড়া ছুটিয়ে আমার পাশে চলে এল কার্ল। রাস্টি বোধহয় গুলি খেয়েছে।
দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালেন বাবা। ম্লান আলোয় রাস্টি বুচার্ডের নিথর দেহ চোখে পড়ল। বুকে বিঁধেছে গুলিটা।
মাশুল দিতে হবে ওদের! তপ্ত স্বরে শপথ করলেন তিনি। খোদার কসম, এজন্যে মাশুল দিতে হবে ওদের!
চারপাশে চক্কর দিলাম আমরা, মনে শঙ্কা হয়তো আরও কাউকে পাব। মৃত দুই হামলাকারীর লাশ খুঁজে পেলাম। একজনের নাম স্ট্রিটার, নসেজে রেঞ্জারদের আধিপত্যে টিকতে না পেরে কাউ-হাউসে চলে এসেছিল লোকটা। অন্যজনকে চেহারায় চিনি বটে, কিন্তু পরিচয় জানি না।
দু’জনের বিপরীতে একজন, গম্ভীর স্বরে বলল ট্যাপ।
দু’জন? ধমকে উঠলেন বাবা। দশজনের বিপরীতে হলেও বুচার্ডের মৃত্যু মেনে নিতে রাজি নই আমি। ওর মত লোকই হয় না!
সকালে ওদের খোঁজে বেরোব আমরা, বললাম আমি। সম্ভবত এটাই একমাত্র এবং সঠিক পদক্ষেপ।
বুচার্ডের লাশ নিয়ে ক্যাম্পে এলাম আমরা। প্রায় সবার প্রতিক্রিয়াই বাবার মত। তবে বাড়তি দায়িত্বের জন্যে ওঁকে একটুও ঈর্ষা হচ্ছে না কারও-মিসেস বুচার্ডকে বাবাই দুঃসংবাদটা দেবেন।
একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল ক্যাম্প। আগুনের ধারে বসে আছি, কিন্তু কেউই কথা বলছি না। কিছু ডালপালা যোগাড় করে আগুন আরও উস্কে দিলাম আমি। অন্যদের খোঁজখবর নিলাম, অক্ষত আছে সবাই।
মাত্র দু’জন! ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না, মন্তব্য করল কার্ল। উঁহু, আরও বেশি লোক হতাহত হয়েছে ওদের। সরাসরি আমাদের দিকে চার্জ করেছে ওরা!
আগুনের কাছাকাছি রয়েছে ইলেন আর মিসেস অটম্যান, কফি তৈরি করছে। সযত্নে, প্যাটার্সনটা পরিষ্কার করছি আমি। কার্তুজ পরখ করে রিলোড় করলাম আবার। তারপর ক্যাম্প ছেড়ে ঘোড়ার কাছে চলে এলাম, পরখ করলাম ওটার গায়ে কোন গুলি বিধেছে কিনা। যা গোলাগুলি হয়েছে, সওয়ারীর চেয়ে ঘোড়ার গায়ে গুলি লাগার সম্ভাবনা, বেশি ছিল।
ঘোড়াটা বহাল তবিয়তে আছে। নিশ্চিন্ত মনে ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
বাকি রাতটুকু বড় দীর্ঘ মনে হলো আমাদের কাছে। তবে একসময় সকাল হলো। ধূসর আকাশের পটভূমিতে মাথা উঁচিয়ে থাকা গাছপালার দীর্ঘ কাঠামো স্পষ্ট হলো ধীরে ধীরে, নিজস্ব আকার পেল। সূর্য ওঠার আগেই স্যাডলে চাপলাম আমরা।
অনেকক্ষণ তর্ক করেও সুবিধা করতে পারেনি টিম অটম্যান, ওয়্যাগনের দায়িত্বে ওকে রেখে ব্লাফের দিকে এগোলাম আমরা।
তুমি বরং এখানেই থাকো, টম, জেপসনকে নিরস্ত করার জন্যে যুক্তি দেখালেন বাবা। এরই মধ্যে বিবাহিত একজনকে হারিয়েছি আমরা। আমার মনে হয় তাই যথেষ্ট।
মাথা খারাপ! তপ্ত স্বরে অস্বীকৃতি জানাল সে। তারপর খানিকটা দ্বিধার সুরে বলল, আমাদের বোধহয় আরও একজনকে রেখে যাওয়া উচিত। ওরা যদি আবার আসে?
ফ্রি, স্কয়ারের দিকে ফিরলেন বাবা। তুমিই থাকো। রাতেও পাহারা দিয়েছ তুমি।
দেখো, ট্রেভেন, আমি… প্রতিবাদ করল সে, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলেন বাবা।
এটা অনুরোধ-ব্যক্তিগত একটা ফেভার চাইছি তোমার কাছে। থাকবে?
শ্রাগ করে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল ফ্রিম্যান স্কয়ার, ফিরতি পথে এগোল এবার নিশ্চিন্তে এগোলাম আমরা।
ট্রেইল একেবারে স্পষ্ট, কারণ একে তো রাত ছিল, তারওপর গরুর পালের পেছন পেছন গেছে ওরা। দক্ষিণে বিস্তীর্ণ বুনো অঞ্চলের দিকে এগিয়েছে গরুগুলো। লিপান ইন্ডিয়ানদের এলাকা এটা, যদিও ইদানীং সাদাদের প্রতি কিছুটা উদার মনোভাব দেখাচ্ছে ওরা।
ভোরের অস্পষ্ট আলোয় এগিয়ে চলেছি আমরা-গম্ভীর, ক্ষুব্ধ কয়েকজন মানুষ। গরুর পাল এবং রাস্টি বুচার্ডকে হারিয়ে প্রায় খেপে আছে সবাই, উসিলা পাওয়া মাত্র খুনোখুনি শুরু করবে। এখন আর শান্ত, নির্বিরোধী, নিজের চরকায় তেল দিতে অভ্যস্ত পরিশ্রমী মানুষ নই আমরা। আউটল বা উজ্জ্বল রেনিগেডদের পিছু তাড়া করার মানে শুধু প্রতিশোধ নেওয়া বা সম্পত্তি পুনরুদ্ধার নয়, বরং এরচেয়ে বেশি কিছু, বুনো পশ্চিমের অপরিহার্য একটা দাবি-আইন, নীতি কিংবা সাম্যের প্রতিষ্ঠা। যেখানে আইনের অস্তিত্ব নেই, সেখানে সৎ বিবেচক মানুষের প্রস্তাবনাই আইন।
বসন্তের বাদামী ঘাসে ঝিলিক মারছে সকালের সোনা রোদ, পেছনে ফেলে আসা কঞ্চো নদীর কাঠামো ধীরে ধীরে গাঢ় একটা রেখার আকৃতি পেল। ট্র্যাক খুঁজে পাওয়ার আশায় খানিকটা ছড়িয়ে পড়লাম আমরা। ট্রেইলে বা আশপাশে গরুর অসংখ্য ছাপ রয়েছে, তার মধ্যে রাইডারদের ছাপ খুঁজছি।
ট্রেইল ছেড়ে ডান দিকে সরে এসে হঠাৎ ভিন্ন ধরনের কিছু ট্র্যাক খুঁজে পেলাম। নিঃসঙ্গ একজন রাইডার। দারুণ শক্তিশালী এবং দীর্ঘ একটা ঘোড়ায় চড়েছে লোকটা। লাগাম টেনে ঘোড়া থামালাম, মনোযোগ দিয়ে দেখলাম ছাপগুলো।
দারুণ লম্বা ঘোড়াটা, লাফ দেয়ার ভঙ্গি স্বচ্ছন্দ-আমাদের পনিগুলোর মত নয় মোটেই, বরং এরচেয়ে বড় এবং ঢের ভাল স্বাস্থ্যের। খুরের ছাপের গভীরতা দেখে আন্দাজ করলাম স্যাডলে খুব বেশি ওজন নেই।
বিস্ময়কর ব্যাপার, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এসেছে লোকটা। তারমানে আমরা যাদের অনুসরণ করছি তাদের কেউ নয়। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না রহস্যময় এই রাইডারের উপস্থিতি। হয়তো স্কাউটিং করার জন্যে কাউকে পাঠিয়েছে ওরা, সে-ই এখন মিলিত হয়েছে দলের সঙ্গে। কিন্তু স্কাউটিঙে যাবে কেন? রেনিগেডদের মধ্যে এমন কে আছে যে এত দুর্দান্ত আর শক্তিশালী ঘোড়ার মালিক? হর্নারদের অনুসরণ করছে কেন সে?
গতরাতের কিংবা বিকেলের ট্র্যাক এগুলো। দারুণ কৌতূহল বোধ করছি, আমি, শক্তিশালী ঘোড়াটাকে অনুসরণ করে এগোলাম, তবে অন্যদের কাছ থেকে বেশি দূরে সরে যাইনি।
হঠাৎ ডানে বাঁক নিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে ট্র্যাক, ঘোড়া থামিয়ে সেদিকে তাকালাম।
খোলা প্লেয়ারিতে কালো একটা কাঠামো চোখে পড়ল…মেক্সিটের ছোটখাট বন? সতর্কতার সঙ্গে এগোলাম, হাতে রাইফেল প্রস্তুত। কাঠামোটা ধীরে ধীরে বড় হলো…খোলা জায়গায় বড়সড় খাদে জন্মেছে গাছ আর ঝোঁপ।
ঝোঁপঝাড়ের কিনারা থেকে বোল্ডার আর পাথুরে দেয়ালের শুরু হয়েছে, বেশ উঁচু দেয়ালটা, গাছের মাথা ছাড়িয়ে গেছে প্রায়। দেয়ালের দিকে চলে গেছে ঘোড়াটার ট্র্যাক, ওপাশের খোলা মাঠে হারিয়ে গেছে। খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
পানির কুলকুল ধ্বনি ছাড়াও ঝর্নার পানি আছড়ে পড়ার শব্দ কানে এল। বাতাসে নড়ে উঠল গাছের পাতা। তারপর একেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে গেল চারদিক।
কান খাড়া হয়ে গেছে আমার ঘোড়ার, সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে ওটা। এতই সঙ্কীর্ণ যে দু’পাশে গাছের পাতার সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। স্টিরাপ। প্রায় ত্রিশ গজ এগোনোর পর আচমকা অগভীর একটা খাদ চোখে পড়ল, ওকের শাখা-প্রশাখা ঝুঁকে পড়েছে খাদের ওপর। পাশে পঞ্চাশ ফুট ব্যাসের খোলা জায়গা, ক্ষীণ ঝর্না নেমে এসেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। ঝোঁপের কিনারে দারুণ সুন্দর কালো ঘোড়াটা চোখে পড়ল, আমার ঘোড়ার উপস্থিতি টের পেয়ে কান খাড়া করে তাকাল ওটা, নিচু, স্বরে হেষাধ্বনি করল।
ঝর্নার কাছাকাছি মাটিতে ক্যাম্প করেছে কেউ। গর্ত করে আগুন জ্বেলেছে, স্টোভে কফির পানি ফুটছে; আর বাতাসে বেকনের সুবাস।
যেখানে আছ, ওখানেই দাঁড়াও, সেনর! তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠ শুভেচ্ছা জানাল আমাকে। নইলে ঠিক পেট ফুটো করে ফেলব তোমার?
সতকর্তার সঙ্গে কাঁধের ওপর দু’হাত তুললাম। রাইফেলের হ্যামার টানার ক্লিক শব্দ শুনতে ভুল হয়নি, কিন্তু কণ্ঠটা কোন মেয়ের!
৩. মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী
মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী। বড়জোর উনিশ কি বিশ হবে বয়েস। লালচে সোনালী চুল ঝলমল করছে সূর্যের আলোয়। হাতে ধরা রাইফেলটা একটুও নড়ছে না, নগ্ন কালো নল স্থির হয়ে আছে আমার পেট বরার।
ফ্ল্যাট-ক্রাউন স্প্যানিশ হ্যাট পড়ে আছে মেয়েটার কাঁধে, চিবুকের স্ট্র্যাপ নেমে এসেছে গলার কাছাকাছি। বাকস্কিনের পোশাক ওর পরনে, ডিভাইডেড স্কার্ট-এই প্রথম কোন মেয়ের পরনে দেখলাম আমি। যদিও জিনিসটার কথা বহুবার শুনেছি।
কে তুমি? আমাকে অনুসরণ করছ কেন?
তুমি যদি গরুচোরদের একজন না হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিন্ত হতে পারো যে তোমাকে অনুসরণ করছি না। গরুচোরদের অনুসরণ করছিলাম আমরা। গতরাতে আমাদের সব গরু তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে ওরা। মাইল কয়েক পেছনে তোমার ট্র্যাক দেখে কৌতূহল হলো।
রাইফেল বা মেয়েটার দৃষ্টি, সামান্যও নড়ল না। কে তুমি? কোত্থেকে এসেছ?
অদ্ভুত একটা ধারণা এসেছে আমার মাথায়। অসম্ভব হলেও হয়তো ঠিক এটাই ঘটেছে। আমার নাম ড্যান ট্রেভেন। কাউ-হাউসের ওদিক থেকে এসেছি আমরা। নিউ মেক্সিকোয় ড্রাইভ নিয়ে যাচ্ছি। হয়তো কলোরাভোয়ও থামতে পারি। নতুন বসতি খুঁজছি আমরা।
গরুচোরদের কথা বলছিলে তুমি।
গতরাতে আমাদের গরু তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে ওরা। সম্ভবত কাউ-হাউসে আমাদের কিছু প্রতিবেশী এর সঙ্গে জড়িত। আসলে ওরা রাসলার। গরু নিয়ে আমরা চলে আসায় বিপদে পড়ে গেছে। গায়ে খেটে কামাই করার ইচ্ছে নেই ওদের।
ঠাণ্ডা, সাবধানী চাহনি মেয়েটার বেগুনী চোখে। যদিও আমার মনে হলো কথাগুলো বিশ্বাস করেছে ও।
তুমি নিশ্চই কয়েক ঘণ্টা আগে গরুর পাল চলে যেতে দেখেছ বা শব্দ শুনেছ, যোগ করলাম আমি! তো, আমি কি হাত নামাতে পারি, ম্যাম?
মাথা ঝাঁকাল সুন্দরী। কিন্তু সাবধান, বেতাল কিছু করলে পস্তাবে!
সতর্কতার সঙ্গে হাত নামিয়ে স্যাডল-হর্নের ওপর রাখলাম। চারপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি চালালাম। দেখে তো মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে অনেকদূর চলে এসেছ তুমি, তাও একা…
একা নই আমি, বাধা দিল মেয়েটা, হাতের রাইফেলে চাপড় মারল। এটা আছে সঙ্গে।
ঘোড়াটা দারুণ তোমার, ম্যাম। কি জানো, আঙুল দিয়ে হ্যাট পেছনে ঠেলে দিলাম। তোমাকে অনুসরণ করার এটাও একটা কারণ। ঘোড়াটাকে দেখার ইচ্ছে ছিল আমার।
কিছুটা নিচু হলো রাইফেলের নল। কফি খাবে? হঠাৎ প্রস্তাব করল মেয়েটা। শুধু শুধু বাম্প হচ্ছে।
কৃতজ্ঞচিত্তে স্যাডল ছেড়ে নামলাম আমি। ধন্যবাদ। এক কাপ গিলেই কেটে পড়ব। অন্যরা আমার চেয়ে এগিয়ে গেছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে গরুচোরদের ধরে ফেলতে পারব বোধহয়।
স্যাডল-হর্নের সঙ্গে নিজের কাপ ঝুলিয়ে রাখি আমি। ওটা নিয়ে কেতলি থেকে কাপে কফি ঢাললাম। তারপর তাকালাম মেয়েটির দিকে। অস্বীকার করব না, সারা জীবনেও এত সুন্দরী মেয়ে দেখিনি আমি। তো, আমার ধারণা কি জানো…তুমি বোধহয় কারও খোঁজ করছ?
ঝট করে আমার দিকে তাকাল মেয়েটি। কেন মনে হলো?
আন্দাজ, কফিতে চুমুক দিলাম। কোমাঞ্চেবরাদের সম্পর্কে কিছু জানো তুমি?
জায়গামত পড়েছে ঢিল! মেয়েটার চেহারাই বলে দিচ্ছে ঠিক আন্দাজ করেছি।
জানি ওদের সম্পর্কে, চেষ্টাকৃত নির্লিপ্ত স্বরে বলল ও।
আসার পথে এক লোককে খুঁজে পেয়েছি আমরা। কোমাঞ্চেরোরা গুলি করেছে ওকে।
বেঁচে আছে ও? কেমন আছে এখন?
তোমার বন্ধু?
কোথায় ও? ওর কাছে যাব আমি!
অবস্থা বিশেষ ভাল নয় ওর। নেকড়ের দল আক্রমণ করেছিল ওকে। তার আগে কোমাঞ্চেরোরা ল্যাসোয় বেঁধে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সাধ্যমত লড়েছে ও, বেশ কয়েক জায়গায় জখম হয়েছে। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে ঝর্নার পানিতে কাপটা ধুয়ে ফেললাম। তিনজন মানুষের সমান সাহস ওর। নার্ভ বটে! কিভাবে ক্রল করে যে এতদূর গেল, কেবল খোদাই জানে!
দ্রুত খুঁটিনাটি জিনিস গুছিয়ে ফেলল মেয়েটা। ওর কাছে যাব আমি। তোমাদের ক্যাম্প কোথায়?
ম্যাম, অবস্থা সত্যিই খারাপ ওর। বলেছি তো, কোমাঞ্চেরোরা অত্যাচার করেছে ওকে। কিছু মনে কোরো না, ম্যাম, তোমাকে আমি চিনি না। কিভাবে বুঝব তুমি ওর শত্রু নও?
আমি ওর পালক বোন। বাবার মৃত্যুর পর ওদের সঙ্গেই বড় হয়েছি।
ইতোমধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, সুতরাং আর দেরি করা ঠিক হবে না।
ক্যাম্পে ঢোকার সময় সতর্ক থেকো, পথ নির্দেশনা দিয়ে শেষে বললাম। ইদানীং সময় ভাল যাচ্ছে না আমাদের বিপদ আশা করছে সবাই। হয়তো দূর থেকে গুলি ছুঁড়তে পারে কেউ। কাছাকাছি গিয়েই তোমার পরিচয় আর উদ্দেশ্য জানিয়ে দিয়ো।
এখান থেকে সরাসরি উত্তরে যাবে। মিডল কঞ্চোর ওপারে অ্যান্টিলোপ ক্ৰীকের ধারে আমাদের ক্যাম্প। ওদের বোলো ড্যান ট্রেভেন পাঠিয়েছে তোমাকে।
স্যাডলে চেপে খোলা জায়গায় চলে এলাম আমি, দক্ষিণে এগোলাম। যতটা সম্ভব নিচু এলাকা ধরে এগোচ্ছি। তুমুল বেগে ছুটছে ঘোড়াটা, নষ্ট হওয়া সময়, পুষিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে আমার। এগোতে অসুবিধে হচ্ছে না, টি-বার রাইডারদের ঘোড়ার টাটকা চিহ্ন রয়েছে ট্রেইলে।
ধীর গতিতে এগোচ্ছে ওরা। আশা করছি রাসলারদের মুখোমুখি হওয়ার আগেই ধরে ফেলতে পারব ওদের।
বাস্তবে তা হলো না, বরং অনেক দেরিতে পৌঁছলাম আমি।
দূর থেকে দেখতে পেলাম ওদের, ছড়িয়ে পড়ে ব্লাফের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওপাশে বিস্তৃত রুক্ষ জমি, ব্লাফের ফাঁকফোকর দিয়ে মাঝে মধ্যে দু’এক চিলতে চোখে পড়ছে। ঘোড়ার গতি কমিয়ে এনেছি, নইলে হয়তো ভুল করে নিজের দলের ওপর চড়াও হতে পারি। হঠাৎ ঘাসের বুকে নড়াচড়া চোখে পড়ল; পরমুহূর্তে ব্লাফের কিনারে এক লোককে উঠে দাঁড়াতে দেখতে পেলাম, হাতে রাইফেল লোকটার।
অন্য কারও দিকে মনোযোগ রাইফেলধারীর, আমাকে দেখতে পায়নি। ঘাসের কারণে খুরের শব্দও চাপা পড়ে গেছে। ধীর গতিতে এগোচ্ছে ডান ঘোড়াটা। হঠাৎ লোকটার টার্গেট দেখতে পেলাম-নিশানা করছে ট্যাপকে!
চট করে স্পার দাবালাম আমি। সাধারণত স্পার ব্যবহার করি না, তাই আচমকা লাফ দিল ভানটা, পরমুহূর্তে তুফান বেগে ছুটতে শুরু করল।
একেবারে শেষ মুহূর্তে খুরের শব্দ শুনতে পেল লোকটা, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাইফেল পজিশনে নিয়ে এসেছে, সে-মুহূর্ত খানেক পরেই গুলি করবে। সম্ভবত ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেয়েছে সে, ছোট ছোট নরম ঘাসে জোরাল শব্দ হওয়ার কথা নয়, কিংবা অবচেতন মনু সতর্ক করেছে ওকে। আচমকা, ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াল সে, ততক্ষণে লোকটার দুহাতের মধ্যে চলে এসেছি আমি। প্যাটার্সনটাকে পিস্তলের মতই কাজে লাগালাম-ঊরুর কাছে নিচু করে এক হাতে চেপে ধরেছি ওটা। মুহূর্তে ট্রিগার টেনে দিলাম।
কুঠার দিয়ে যেন আঘাত করেছে কেউ, পয়েন্ট ফাইভ-সিক্সের ভারী গুলিতে পেছনে ছিটকে পড়ল সে। পরমুহূর্তে লোকটাকে ছাড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিলাম আমি।
আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ছুটতে শুরু করল ট্যাপরা; দ্রুত পেরিয়ে গেল ত্রিশ গজ। আমি যখন ব্লাফের কিনারে পৌঁছলাম, ততক্ষণে স্যাডলে চড়েছে সবাই।
রীজের কাছে এসে নিচের ক্যাম্পটা আর তৃণভূমিতে চরতে থাকা, গরুর পাল দেখতে পেলাম।
অন্তত দুই ডজন, লোক বিশ্রাম নিচ্ছিল, গুলির শব্দ নিশ্চই চমকে দিয়েছে ওদের। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়েছে ওরা, যার যার অস্ত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
পালের কাছাকাছি কয়েকজন: লোক রয়েছে। সবচেয়ে কাছের লোকটার উদ্দেশে প্রথম গুলিটা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে স্যাডলচ্যুত হলো লোকটা। ঘাসের আড়ালে ঢাকা পড়ল দেহ।
তুমুল বেগে নিচের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম আমরা। মুহূর্তে তছনছ হয়ে গেল ক্যাম্প।
সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ শত্রুপক্ষ, কিন্তু চমক আর আক্রমণের ভয়াবহতায় ঘাটতিটা পুষিয়ে গেল। ট্যাপকে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরতি পথে চলে যেতে দেখলাম, সেকেন্ড কয়েক পরই ফিরে এসে চার্জ করল ও, সিক্সশূটার থেকে সমানে গুলি করছে। গুলি ফুরিয়ে যেতে এহোলস্টারে ওটা ঢুকিয়ে রেখে এবার অন্যটা তুলে নিল, একই ভাবে গুলি শুরু করল। আমার ধারণা যদি ভুল না হয়ে থাকে, নির্দ্বিধায় বলা যায় অন্তত আরও দুটো পিস্তল আছে ওর কাছে।
তখনকার দিনে ক্যাপ-এন্ড-বল পিস্তলগুলো অন্যরকম ছিল, রিলোড করতে সময় বেশি লাগত বলে যত বেশি সম্ভব, সঙ্গে রাখত লোজন, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান বা আউটলদের সঙ্গে লড়াই করার সময়। কেউ কেউ বাড়তি সিলিন্ডার ব্যবহার করত। পিস্তলের সঙ্গে দিব্যি জুড়ে দেয়া যেত।
লাল দাড়িঅলা এক লোকু হঠাৎ ছুটে এসে চড়াও হলো আমার ওপর। আক্রমণ করার পর কাপড় পরার সময় পায়নি লোকটা। লালচে লোমশ বুক দেখতে অদ্ভুত লাগছে। শূন্য রাইফেলের ব্যারেল চালাল আমার মাথা; বরাবর ডান ঘোড়াটা প্রায় হামলে পড়ল ব্যাটার ওপর, সংঘর্ষের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে আগুনে পড়ল নোকটা। বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল সে। কয়লা এবং ছোট ছোট ফুলিঙ্গ চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে ঝটিতি আগুন থেকে উঠে দাঁড়াল, ট্রাউজারে আগুন ধরে গেছে, বুকের লোম পুড়ে কালো হয়ে গেছে।
মিলো ডজের গুলিতে মুখ থুবড়ে পড়ল সে, আর উঠল না।
লড়াই শেষ। অন্তত দশজন খুন হয়েছে ওদের, বাকিরা ভেগেছে। কাউ-হাউসে আমাদের প্রতিবেশী এরা। হয়তো একসময় ওদের প্রতি কিছুটা হলেও সহানুভূতি ছিল আমাদের, কিন্তু এখন বিন্দুমাত্র নেই।
পেছনে দশটা লাশ ফেলে যেতে একটুও খারাপ লাগছে না কারও।
গরু রাউন্ড-আপ করে উত্তরের পথ ধরলাম আমরা। যাওয়ার পথে দলছুট কিছু ঘোড়া পেলাম, তবে আমাদের কিনা সেটা পরখ করার ঝামেলায় গেলাম না। পালের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলাম ওগুলোকে।
যতটা সম্ভব দ্রুত ফিরতি পথে এগোলাম।
বেন টিল্টনের ঘাড়ের মাংসে ছ্যাকা দিয়ে চলে গেছে একটা বুলেট, ক্যাম্প পর্যন্ত ফিরতি পথে সারাক্ষণই এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করল সে। সম্ভবত ঘামের কারণে জ্বালা করছে ক্ষতটা, সেজন্যেই অস্থির হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু ওঁর আচরণে মনে হচ্ছে যেন হাঁটু ভেঙেছে বা খুলি ফেটে গেছে।
আমার পাশাপাশি রাইড করছে কার্ল ক্ৰকেট। দারুণ লম্বা মানুষ সে, পাগুলো অস্বাভাবিক দীর্ঘ। এমনিতে দেখে মনে হবে, খোলা মাঠে একটা কচ্ছপ ধরার মত ক্ষিপ্রতাও নেই ওঁর, কিন্তু একটু আগে লড়াইয়ের সময় দারুণ ব্যস্ত ছিল ও।
গতি কমিয়ে আমার পাশে চলে এল ট্যাপ। কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে তুমি? ত্যক্ত স্বরে জানতে চাইল ও। আমি তো ভেবেছি ভয়ে সটকে পড়লে নাকি!
একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো, নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দিলাম। কফি অফার করেছিল মেয়েটা; তাই মিনিট কয়েক দেরি হয়ে গেল।
সরু চোখে আমাকে দেখছে ও, মিটিমিটি হাসছে। মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে? বয়, এমন নির্জন এলাকায় যে-মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে, ওকে নিশ্চিন্তে দখল করে নিতে পারবে!
ওর চেয়ে সুন্দরী মেয়ে দেখোনি তুমি। ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে দেখতে পাবে ওকে।
তামাশা করছ! স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ট্যাপ, বোঝার চেষ্টা করছে সত্যিই এমন কিছু ঘটেছে কিনা। দৃশ্যত, মেয়েটার উপস্থিতির ব্যাপারে সন্দিহান সে। ওর জায়গায় থাকলে আমিও বিশ্বাস করতাম না।
আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে শিগগিরই বিয়ে করছ তুমি, আসল কথা পাড়লাম এবার। নইলে হয়তো ওকে পটানোর চেষ্টা করতে পারতে।
মুহূর্তে লালচে হয়ে গেল ট্যাপের মুখ। কে বলল বিয়ে করছি আমি? খেপা স্বরে জানতে চাইল সে।
ইলেন। পাত্রী নিজেই স্বীকার করেছে।
থমকে গেল ও। উঁহু, এমন কিছু নয় ব্যাপারটা। মোটেই তা নয়।
ওকে কিন্তু সিরিয়াস মনে হলো। এখানকার লোকজনকে চেনো তুমি, ট্যাপ, ইলেনের মত ভদ্র ঘরের মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করার পর এড়িয়ে যেতে পারবে না, লোকজনও সেটাকে ভাল চোখে দেখবে না। টিম অটম্যান মানুষ হিসেবে যাই হোক, শটগান কিন্তু খুব ভাল চালাতে পারে। তোমার জায়গায় হলে আরও একটু সতর্ক থাকতাম আমি।
দাঁত বের করে হাসল সে, নিজেকে সামলে নিয়েছে। অযথা দুশ্চিন্তা করছ, বয়। ট্যাপ এডলেকে শটগান হাতে ধাওয়া করবে, দুনিয়ার বুকে এমন মায়ের ব্যাটার জন্ম হয়নি এখনও! ইলেন খুব ভাল, সুন্দরী মেয়ে…কিন্তু বিয়ে? মাথা খারাপ! ওসব বিয়ে-শাদীর মধ্যে নেই আমি।
আমার কথার কারণে নাকি অন্য কারণে জানি না, সে-রাতে একাকী বসে থাকতে দেখলাম ইলেনকে, মুখ গম্ভীর, বিষণ্ণ এবং চিন্তিত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা একটুও পছন্দ হচ্ছে না ওর।
লাল-চুলো মেয়েটাও আছে ওখানে, প্রায় সবার আগ্রহ আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ পুরুষ ঘোরাফেরা করছে ওর আশপাশে। মেয়েটার সৌন্দর্য আড়ষ্ট ও হতবাক করে দিয়েছে তাদের, তবে ট্যাপের কথা আলাদা, প্রতিযোগিতায় প্রথম
পুরস্কার জয় করার প্রায় ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে ওর।
আমি? মেয়েটিকে বলার মত কিছুই নেই আমার। তবে স্বীকার করছি, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ও। ভাইয়ের খোঁজে কোমাঞ্চি এলাকায় একা রাইড করেছে মেয়েটা, এই দুঃসাহস বহু লোকেরই হবে না। ভাইয়ের যোগ্য বোন বটে!
দু’তিনবার আমার দিকে তাকাল ও। কিন্তু মনোযোগ দিলাম না। বেশিরভাগ সময় মেক্সিকানের সঙ্গে কথা বলে কাটিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা; ভাইয়ের জন্যে খাবার তৈরি করছে।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ইলেনের মুখ। ক্ষণে ক্ষণে ঠোঁটজোড়া কামড়ে ধরছে। আজ রাতের আগে এত বিষণ্ণ বা গম্ভীর হতে দেখিনি ওকে, ভেতরে ভেতরে বোধহয় দারুণ খেপে আছে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করছে না ট্যাপ, চুটিয়ে পুরুষদের সঙ্গে গল্প করছে, প্রায়ই তামাশা করছে। একটু পর ট্যাপ উঠে দাঁড়াতে ঝট করে উঠে দাঁড়াল ইলেন, দু’পা এগোল ট্যাপকে একা পাওয়ার জন্যে, কিন্তু স্যাডলে চেপে পালের কাছে চলে গেল সে।
কফি পান করার জন্যে ক্যাম্পে এসেছে টম জেপসন। দেখলাম একটা সিক্সশূটার ঝুলছে-ওর কোমরে, আজকের আগে কখনও ওকে অস্ত্র ঝোলাতে দেখিনি। আমার মতই রাইফেল পছন্দ করে সে; কিন্তু আজ রাতের জন্যে পিস্তল বেছে নিয়েছে। রোজিটাও আছে আগুনের কাছে। খানিক রঙজ্বল ত্বকের সুন্দরী মেয়ে, তবে সৌন্দর্যের চেয়ে শরীরই ওর বড় সম্পদ। পুরুষদের মনোযোগ আকর্ষণ করার প্রতিটি কৌশল জানা আছে, ওর! কালো গভীর বড় বড় চোখ, যখন কোন সুদর্শন পুরুষের দিকে তাকায় ওর চাহনিতে থাকে চ্যালেঞ্জ অথবা আমন্ত্রণ; কিংবা এমন কিছু যাতে অবস্থাটা সেরকমই মনে হবে। তবে একটা কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, এ ধরনের আউটফিটে বা ড্রাইভে মোটেও মানায় না রোজিটা জেপসনকে।
কয়েকবারই আগুনের ওপাশে বসে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকাল জেপসন, চোখে সন্দিহান চাহনি। ভেতরে ভেতরে কোন কারণে খেপে আছে সে।
কিছু মটরশুটি আর মাংস থালায় পুরে টমের জন্যে নিয়ে এল রোজি, তারপর আমার দিকে ঘুরল। ড্যান, কিছু লাগবে তোমার?
চোখু তুলে তাকালাম, দেখলাম হাসছে মহিলা। অজান্তে দুবার ঢোক গিললাম। ধন্যবাদ, ম্যাম। কিছু ফ্রিয়োল পেলে ভাল হত। দারুণ স্বাদের হয়েছে ওটা।
কোমর দুলিয়ে আগুনের কাছে চলে গেল রোজিটা। কিন্তু মহিলার পশ্চাদ্বেশে নয়, টম জৈপসনের দিকে তাকালাম আমি। দেখলাম স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে সে-অশুভ, সন্দিগ্ধ চাহনিতে।
দারুণ গরম পড়ছে, শার্টের কলারের ভেতর দিকে আঙুল চালিয়ে খানিকটা বাতাস ঢোকার সুযোগ করে দিলাম আমি।
কই, আমার তো লাগছে না, নির্লিপ্ত সুরে বলল ও।
আমার পাশে এসে বসলেন বাবা। ট্যাপ বলছে, সকালে, সূর্য ওঠার আগেই রওনা দেয়া উচিত। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গরুগুলোকে ট্রেইলে তুলতে হবে। তুমি কি বলো?
মন্দ নয় আইডিয়াটা।
থপথপ করে পা ফেলে চলে গেল টম জেপসন।
ঝট করে আমার দিকে ফিরলেন বাবা। ড্যান, রোজিটা জেপসনের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছ নাকি তুমি?
মাথা খারাপ!
কিন্তু কারও নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। টমও জানে এটা, দারুণ খেপে আছে ও। ও যদি দু’জনকে একসঙ্গে ধরতে পারে, তো খুনোখুনি হয়ে যাবে।
এভাবে আমার দিকে তাকিয়ো না! কোন মেয়ের সঙ্গে যদি মেলামেশা করি, নিশ্চিত থাকতে পারো রোজিটা জেপসনের কাছে যাব না, ও ছাড়াও সুন্দরী মেয়ে আছে এখানে।
সকালে নির্বিঘ্নে ট্রেইলে উঠে এলাম, এগোচ্ছি ধীর গতিতে। নদী বা ঝর্নার কিনারা ছাড়া পুরো এলাকার জমি রুক্ষ, অনুর্বর; ঘাস নেই বলতে গেলে। সামনে যে আরও খারাপ সময় অপেক্ষা করছে, এসব তারই নমুনা।
এ পর্যন্ত ভালই এগিয়েছি আমরা। ছিনিয়ে নেয়া গরু ফিরিয়ে এনেছি, দু’একটা হয়তো দলছুট হয়ে সরে পড়েছে, কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে প্রায় পুরো পালই উদ্ধার করতে পেরেছি। গরুর সঙ্গে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ঘোড়ার অর্ধেকই ফিরিয়ে আনা গেছে।
শিকার চোখে পড়ছে না তেমন। সাধারণ প্রেয়ারি কুকুর আর জ্যাকাস খরগোশ আছে। রাতে ক্যাম্পের লাগোয়া ক্রীকে কিছু ক্যাটফিশ ধরল স্যাম গার্ট, রুচি বদল হলো।
নদীর অদূরে পাহাড়ী এলাকার শুরুতে রয়েছে প্রিকলি পিয়ার, গ্রিজউড় আর সেজ-ঝোঁপ। এছাড়া পাহাড়গুলো প্রায় ন্যাড়াই বলা চলে। মাঝে মধ্যে শুকিয়ে আসা ক্রীকের পাড়ে বা তলায় কিছু গ্রামা চোখে পড়েছে, সানন্দে ওগুলোর সদ্ব্যবহার করেছে গরুর দল। সামনে ঘাসের পরিমাণ কেবলই কমে আসবে, দীর্ঘ যাত্রার কথা চিন্তা করলেই হতোদ্যম হয়ে পড়তে হয়
দীর্ঘ আশি মাইল ঘাসহীন রুক্ষ প্রান্তর পেরোতে হবে। পানি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। তাপদগ্ধ দিনের কথা ভেবে প্রতি রাতে যতগুলো সম্ভব পানির ব্যারেল ভরে নিই। সবাই জানি, একটা সময় আসবে যখন পানি ফুরিয়ে যাবে-এমনকি আমাদের বা ঘোড়ার জন্যেও থাকবে না।
বিকেলে একটা ওঅটরহোলের কাছে থামলাম আমরা। পানি, অগভীর, তবে বেশ চওড়া ওটরহোলটা। ওটা ছেড়ে যখন রওনা দিলাম, তখন পানির চিহ্নমাত্র দেখা গেল না কোথাও, শুধু থকথকে কাদা পড়ে আছে তলায়।
এক ফাঁকে মেক্সিজেনের ওয়্যাগনে গেলাম। আমার সাড়া পেয়ে পর্দা সরিয়ে দিল মেয়েটা। হাসল। ধক করে লাফিয়ে উঠল কলজে। আহ, হাসি বটে! এত সুন্দর হাসি!
ভেতরে… এসো, প্লীজ, কোমল স্বরে আহ্বান করল ও। মিগুয়েলের কাছ থেকে জানলাম তুমিই ওকে খুঁজে পেয়েছিলে।
আরে নাহ, স্রেফ ভাগ্যই আমাকে নিয়ে গেছে ওর কাছে। আমি না গেলে অন্য কেউ যেত।
তুমি যদি আমাকে খুঁজে না পেতে, তর্ক করল মেক্সিকান। এতক্ষণে মরে পচে যেতাম। এটা খুব ভাল করে জানি আমি। ক্যাম্পের কিনারে কি আছে, কেউই দেখতে এগিয়ে যায়নি। তুমি সাহস করেছ বলেই… শেষ করল না মেক্সিকান।
তোমার নাম ড্যান ট্রেভেন? হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। আমি জুয়ানিতা। জুয়ানিতা ম্যাকনেয়ার। আমার বাবা আইরিশ আর মা মেক্সিকান ছিলেন।
- গ্র্যামা (Grama) এক ধরনের ঘাস
সাহস আছে তোমার, ম্যাম! নিশ্চই অন্তত কয়েকদিন রাইড করেছ?
আর তো কেউ ছিল না। মিগুয়েলের বাবা মারা গেছেন, আর আছেন কেবল আমাদের মা…ওর মা। ছেলেকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি।
যাই হোক, কোমাঞ্চি এলাকায় একা রাইড করার জন্যে বুকের পাটা লাগে, সে মেয়ে আর ছেলেই হোক। গরুর পাল ড্রাইভ করাও চাট্টিখানি কথা নয়। শক্তিশালী, তেজী এবং চালু একটা ঘোড়া ছিল জুয়ানিতার, কিন্তু কোমাঞ্চি এলাকায় দ্রুতগামী ঘোড়া বাড়তি কোন কাজে আসে না। অ্যাম্বুশ-প্রিয় কোমাঞ্চিরা মুখিয়ে থাকে লুটপাট করার জন্যে।
শিকার-পশু আর মানুষই হোক লড়াই সম্পর্কে কিছুই অজানা নেই ইন্ডিয়ানদের, আর যদি কিছু অজানা থাকেও, খুব দ্রুত শিখে নেয় ওরা।
জুয়ানিতার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কিংবা সরাসরি চোখের দিকে তাকানোর মধ্যে চাপা, আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পায়। মেয়েদের মধ্যে জিনিসটা এই প্রথম চোখে পড়ল-প্রত্যয়ী কোন মেয়েকে আমি দেখিনি।
কোমাঞ্চেররাদের কাজকারবার মোটেও সমর্থন করি না আমি, বলল জুয়ারেজ। ওরা আমাদের লোক হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মেক্সরাও সমর্থন করে না ওদের। অসৎ ব্যবসা করছে ওরা। কোমাঞ্চিদের কাছে রাইফেল বিক্রি করছে। ওই রাইফেল দিয়ে সাদা মানুষ, মেক্সিকান…সবাইকে খুন করছে ইন্ডিয়ানরা। থেমে শ্বাস নিল সে, খেই ধরল ধীর ভঙ্গিতে: বুনো ঘোড়া ধরার জন্যে ওদিকে গিয়েছিলাম আমি, হঠাৎ ওদের হাইড-আউট আবিষ্কার করে ফেলি। কোমাঞ্চেররারা ধরে নেয়: ওদের বিরুদ্ধে স্পাইগিরি করছি আমি। এমন ভাবার কারণও আছে, ওরা জানে যে ওদের কাজে অনুমোদন বা সমর্থন নেই আমার। ওদেক্স মধ্যে এমনওঁলোক আছে যারা খোদ কোমাঞ্চিদের চেয়েও খারাপ।
মুখে ক্ষতঅলা ওই লোকটার মত?
চোখ কুঁচকে গেল মেক্সিকানের। দলের মধ্যে ওই সবচেয়ে খারাপ। মহা হারামী লোক। ওর নাম ফেলিপ জাপাটা। চেনো নাকি?
চিনি লোকটাকে। গানফাইটার এবং খুনী। পিস্তল বা ছুরি লড়াইয়ে সব মিলিয়ে অন্তত বিশটা খুন করেছে। আড়াল থেকে বা অ্যাম্বুশ করে আরও কত মানুষ খুন করেছে, সম্ভবত কেউই তা জানে না।
অল্প কয়েক বছরের মধ্যে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে লোকটা, যদিও আমার জানা মতে পেকোসের পুবে মাত্র একবারই আবির্ভূত হয়েছে সে। ম্যাটামোরাস থেকে রিও গ্র্যান্ড নদী পেরিয়ে ব্রাউন্সভিলে এসেছিল এক লোককে খুন করার জন্যে।
কুখ্যাত আউটল সে। কিন্তু জাতভাই মেক্সিকানরা সাহায্য করে বলে আইন কখনও ধরতে পারেনি ওকে। মেক্সদের চোখে একেবারে নিরপরাধ সে, কারণ স্বগোত্রের কারও প্রতি কোন অন্যায় করেনি জাপাটা। তাছাড়া, সাধারণ মেক্সরা যমের মত ভয় পায় বিশালদেহী এই লোককে, ওদের চোখে সমীহ আর আতঙ্কের অপর নাম ফেলিপ জাপাটা। বেপরোয়া এবং ক্ষিপ্র অনেক পিস্তলবাজও এড়িয়ে চলে ওকে-এদের অনেকেই ক্ষিপ্রতায় হারাতে পারবে জাপাটাকে; কিন্তু ঝুঁকিটা নিতে অনিচ্ছুক সবাই।
কোথায় তোমাকে বাগে পেয়েছিল ওরা?
এটাই তো বড় ঝামেলা, অ্যামিগো! আমাকে খুঁজে পেল একেবারে ওদের…কি বলবে এটাকে-রদেভু? শব্দটা পরিচিত তোমার?
উত্তরে বিশাল একটা ক্যানিয়ন আছে, দেয়ালগুলো বেশ উঁচু, তলায় রয়েছে সবুজ ঘাসের গালিচা। ওখানেই ছিল কোমাঞ্চি আর কোমাঞ্চেরোরা। জায়গাটার কথা জানতাম আগে থেকে, শুনলেও কখনও দেখিনি। সেদিন হঠাৎ করেই চলে গেলাম, এবং বিপদে পড়ে গেলাম। ক্যানিয়নটার নাম পেলো ডিউরো।
ওকে অনুসরণ করবে লোকগুলো, মি. ট্রেভেন, চিন্তিত স্বরে বলল জুয়ানিতা। জুয়ারেজকে বাচতে দেবে না কোমাঞ্চেরোরা। হাল ছাড়বে না ওরা। এখানে যদি নাও আসে, ঠিক বাড়ি চলে যাবে।
পরে কি করে তাতে কিছু যায়-আসে না আমার, বললাম আমি।
- রদেভু (Rendezvous): সৈন্যদের মিলিত হওয়ার স্থান
কিন্তু এখানে, তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ম্যাম, আমাদের কাছ থেকে জুয়ারেজকে কেড়ে নিতে পারবে না ওরা।
পেছনে নড়াচড়ার শব্দ পেলাম। যে-প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে না, সেটা না দেয়াই ভাল, ড্যান।
ট্যাপ এডলে। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে, চোখে অধৈর্য চাহনি। জিনিসটা আগেও দেখেছি ওর চোখে।
প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিই না আমি; ট্যাপ, শান্ত স্বরে জবাব দিলাম। কথা যখন দিয়েছি, যেভাবেই হোক রাখব।
শোনো! তুমি জানো না নিজেকে কিসের সঙ্গে জড়াচ্ছ।
কথা যখন দিয়েছি, রাখব আমি।
মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার! শীতল হয়ে গেছে ট্যাপের কণ্ঠ। দেখো, কিড, কি বলছ তুমি নিজেও জানে না। মুখে যা আসছে বা যা মনে হচ্ছে, তাই বলে যাচ্ছ। থেমে পকেট থেকে সিগার বের করে ধরাল ও। এমনিতে নানান ঝামেলায় আছি আমরা…পশ্চিমে নিয়ে যেতে হবে সমস্ত গরু, বাড়তি কোন ঝামেলা ঘাড়ে নেয়ার দরকার নেই আমাদের।
প্লীজ, এক কনুইয়ে ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হলো জুয়ারেজ। কারও অশান্তি বা ঝামেলা করতে চাই না আমি। তোমরা যদি একটা ঘোড়া আর কিছু খাবার দাও, দিব্যি চলে যেতে পারব আমরা।
শুয়ে পড়ো, সেনর, বললাম। তুমি আমার অতিথি, এবং এখানেই থাকবে তুমি।
কে এই আউটফিটের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তুমি না আমি? ট্যাপের অসন্তোষ চরমে রূপ নিয়েছে।
বাবা, শুকনো স্বরে বললাম ওকে। আমাদের কথা উঠল যখন, তাহলে বলছি, আমরা দু’জনেই ওঁর হয়ে কাজ করছি।
আড়ষ্ট হয়ে গেল ট্যাপের মুখ। ঠিক আছে, দেখা যাক, বাবা কি বলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি দেখা গেল ওর ঠোঁটের কোণে।
আগুনের কাছে বসে ছিলেন বারা। ওঁর সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমরা। হাঁটু গেড়ে কি যেন করছে, কালক্রকেট, স্যাম গার্টও রয়েছে ওর সঙ্গে। পাহারা দেয়ার ফাঁকে কফি গিলতে এসেছে চার্লি হীথ, শঙ্কিত দৃষ্টিতে ট্যাপকে দেখছে সে!
অপঘাত
বাবা, মেক্সিকানদের ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নিউ মেক্সিকো পর্যন্ত পুরো পথ আমাদের নিরাপদ হেফাজতে থাকবে ওরা। অথচ কোমাঞ্চেরোরা হন্যে হয়ে খুঁজছে ওই লোকটাকে। যে-কোন সময় এখানে চলে আসতে পারে ওরা। যদূর জানি, বিশ-ত্রিশজন লোক ওদের জন্যে কোন ব্যাপারই নয়। এমনকি একশোজন সাদা লোক বা তারচেয়ে বেশি কোমাঞ্চিকে শেষ করে দিতে সক্ষম ওরা। আমাদের অবস্থা এমনিতে খারাপ, এখন এতবড় আর বেপরোয়া একটা দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার অবস্থা নেই আমাদের। আমি বলেছি ওদেরকে নিজের পথ দেখতে বলাই ভাল।
চোখ তুলে ট্যাপের দিকে তাকাল স্যাম, কিন্তু লম্বাটে মুখ, দেখে কিছুই বোঝা গেল না।
বাবা আমার দিকে ফিরলেন। তোমার কি বলার আছে, ড্যান?
আমি ওদের বলেছি যে ওরা আমাদের অতিথি। আমাদের সঙ্গে থাকলেই নিরাপদ থাকবে ওরা।
এবার ট্যাপের দিকে ফিরলেন তিনি। তো, সমস্যাটা কি? প্রস্তাবটা তো মন্দ লাগছে না আমার কাছে।
গম্ভীর হয়ে গেল ট্যাপ, চোখে শীতল চাহনি। বাবা, তুমিও জানো না আসলে কি বলছ! কোমাঞ্চেররাদের ওই আউটফিট যদি আমাদের পেছনে লাগে, তাহলে তুমি, গরু বা আমাদের একজনও এই ড্রাইভ শেষ করতে পারবে না, গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। মেক্স লোকটার কথা কানে এসেছে আমার, ও বলছিল কোমাঞ্চেররাদের হাইড-আউট চেনে, অথচ এই এলাকায় এটাই সবচেয়ে গোপন সংবাদ। শুধু এই একটা কারণে ওকে কখনোই ছেড়ে দেবে না ওরা।
আমরা চেষ্টা করব যাতে সে বেঁচে থাকে, শান্ত স্বরে বললেন বাবা।
বাবার মুখ চৌকাকৃতির। মাথায় সযত্নে আঁচড়ানো ধূসর চুল, গোঁফ খাটো করেন নিয়মিত। যত দুঃসময় যাক কিংবা যতই কাজ থাকুক, নিয়মিত শেভ করেন; চুল থাকে আঁচড়ানো এবং পোশাক থাকে পরিপাটি। সারা জীবনে কখনও হেলান দিয়ে বা ঝুঁকে দাঁড়াতে দেখিনি ওঁকে-সবসময় নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে অভ্যস্ত।
স্থির দৃষ্টিতে ট্যাপের দিকে তাকিয়ে আছেন বাবা। অবাক লাগছে আমার, ট্যাপ। তুমি ভাল করেই জানো কাউকে এমন বিপদের মধ্যে ছেড়ে দেব না আমি-বিশেষ করে একজন মহিলা আর আহত একজন লোককে। এমন বিপজ্জনক এলাকায় ওদের ছেড়ে যাওয়া অমানবিক হবে। ওদেরকে রক্ষা করতে যদি লড়াই করতে হয়, তাহলে তাই করব আমরা।
অপছন্দের দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে ট্যাপ।“বাবা, এটা করতে পারো না তুমি! ওরা তোমার কে? কেউ না!. ওরা…
সাহায্য দরকার ওদের। অন্তত আমি যদ্দিন বেঁচে আছি, সব ধরনের সহযোগিতা পাবে ওরা। দরজার কাছ থেকে কোন লোককে ফিরিয়ে দেইনি আমি, দেবও না।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিল ট্যাপ। বাবা… প্রায় মিনতির সুরে বলল ও। ওই কোমাঞ্চেরোরা…কোমাঞ্চিদের চেয়েও খারাপ ওরা। বিশ্বাস করো, আর কেউ না জানলেও অন্তত আমি জানি ওরা কতটা খারাপ…
কিভাবে জানলে, ট্যাপ? শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন বাবা।
চড় খেয়েছে যেন, বিস্ময়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল ট্যাপ। আচমকা ঘুরে দাঁড়াল। আমাদের সবাইকে নিরেট বোকা ভাবছে: ও, হয়তো ঠিকই। বাবা কখনোই কাউকে অনুরোধ বা অনুনয় করতে পছন্দ করেন না, নিজের সন্তানদের তো নয়ই। আমাদের শিখিয়েছেন ন্যায়ের পথে কিংবা নিজের বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে কিভাবে অটল, থাকতে হয়।
শেখানোর কথা বললাম, ব্যাপারটা আসলে তা নয়, বক্তৃতা বা গালভরা বুলি দিয়ে শেখানো হয়নি আমাদের; বরং উদাহরণ দেখে শিখেছি আমরা। এখানকার বেশিরভাগ লোকই বাবা সম্পর্কে জানে, জানে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে ঠিক কোন্ পক্ষে থাকবে বিল ট্ৰেভেনের অবস্থান। এতে কোন ভুল নেই, ভুল বোঝাবুঝিরও সুযোগ নেই।
এমন নয় যে আসন্ন ঝামেলা বা বিপদের ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমাদের। কোমাঞ্চিদের এলাকা এটা। কিন্তু বিপদের ভয়টা সম্ভবত কোমাঞ্চেরোদের কাছ থেকে বেশি, ইন্ডিয়ানদের চেয়েও খারাপ এরা। ট্যাপ ঠিকই বলেছে-জুয়ারেজকে খুন করতে আসবে ওরা।
হঠাৎ করেই আশার আলো দেখতে পেলাম, একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে মাথায়। জুয়ারেজের ওপর দিয়ে যে-পরিমাণ ধকল গেছে, সম্ভবত ওকে মৃত বলে ধরে নেবে কোমাঞ্চেররারা। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্যে যদি লাশ দেখতে চায়?
বাবা…আমার মনে হয় ওকে গোর দেয়া উচিত…জুয়ারেজের কথা বলছি।
ওয়াগন থেকে নেমে এসেছে জুয়ানিতা, আমার কথা শুনে থমকে দাঁড়াল।
ঠিক এখানে ওকে কবর দেয়া উচিত, বললাম আমি। …কবরের ওপর একটা মার্কার লাগিয়ে দেব।
ওয়্যাগনের ভেতর থেকে কোদাল নিয়ে এল স্যাম গার্ট। কেউ কিছু বলার আগেই এক পাশে সরে গিয়ে মাটিতে কোপ বসাল সে। আরেকটা কোদাল নিয়ে ওর সঙ্গে যোগ দিলাম আমি।
ছয় ফুট গভীর একটা কবর খুঁড়লাম আমরা, তারপর কয়েকটা বড়সড় পাথর ঠেলে ফেললাম ওটায়। ছোট ছোট পাথর ফেলে কবরটা পূর্ণ করলাম। কেউ যদি কৌতূহলী হয়ে ওঠে, সব পাথর খুঁড়ে আরও গভীরে যাওয়ার ধৈর্য হয়তো রাখতে পারবে না। সবশেষে মাটি দিয়ে কবর ভরাট করে ওপরে মার্কার পুঁতে রাখলাম।
নাম কি লিখব? জানতে চাইল গার্ট।
উঁহু, নাম-ধাম লেখার দরকার নেই। তাহলে ওরা বুঝে ফেলবে মুখ খুলেছে জুয়ারেজ। লেখো: হতভাগ্য এই মেক্সিকান ১৮৫৮ সালের ১৬ এপ্রিল এখানে মারা গেছে।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলাম আমরা।
ট্যাপ মুখে কিছু না বলুক, ভেতরে ভেতরে যে প্রচণ্ড খেপে আছে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। শীতার্ত র্যাটলারের মত ফুসছে যেন, চামড়া বদলের সময় প্রচণ্ড খেপা আর স্পর্শকাতর থাকে সাপটা, সামান্য উস্কানিতে খেপে ওঠে; এসময় অবশ্য র্যাটলার কখনও খটখট শব্দ করে না-বরং সামনে যা নড়ে, তাতেই ছোবল হানে।
কিন্তু অস্থির হয়ে আছে ট্যাপ। বেশিরভাগ সময় পালের সামনে স্কাউটিং করছে, পাহাড়সারি জরিপ করছে। কোমাঞ্চেররাদের পক্ষ থেকে হামলা হতে পারে, খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় সবাই সশস্ত্র এখন। ধীর গতিতে এগোচ্ছে পাল, আরও পাঁচ মাইল পর সাউথ ফর্ক অতিক্রম করলাম আমরা। মাঝে মধ্যে এটাকে বয়েলিং কঞ্চোও বলা হয়। তবে সত্যিকার নদী একেই বলে-গভীর স্বচ্ছ পানি, স্রোতও রয়েছে বেশ। নদীর কিনারা ধরে ছড়িয়ে পড়ল তৃষ্ণার্ত গরুর দল, এদিকে ক্যাম্প করার জন্যে জুৎসই জায়গার খোঁজ করছি আমরা।
কাক্ষিত জায়গাটা ট্যাপই খুঁজে পেল-পাথুরে চাতালের নিচে খোলা একটা জায়গা, কাছেই নদী। বোল্ডারসারির ফাঁক গলে অনায়াসে ঢোকানো যাবে ওয়্যাগন। ভোলা জায়গায় যথেষ্ট মেস্কিট আর ওক রয়েছে। দুটো ওয়্যাগন ভেতরে ঢুকিয়ে গরুর দলকে খাড়ি ধরে এগোতে বাধ্য করলাম আমরা। সতেজ বড় বড় ঘাস দেখে উৎসাহ পেল গরুর দল। ডোভ ক্রীক পেরিয়ে, বিশ্রাম নেওয়ার পর গুড স্প্রিং ক্রীর্কের দিকে এগোলাম।
পানি স্বচ্ছ। টলটলে এবং ঠাণ্ডা। ঘাসও চমৎকার। আশপাশে যথেষ্ট কাঠ বা বাফেলো চিপস রয়েছে। ওয়াগন বৃত্তাকারে রেখে সব গরু ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল।
ইতোমধ্যে বড়শি নিয়ে ক্রীকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে স্যাম গার্ট। সন্ধের আগে আগেই কয়েকটা বেস (Bass) ধরে ফেলল, সবকটাই হৃষ্টপুষ্ট। মাছগুলো একে তো ছিল ক্ষুধার্ত, তারওপর বড়শি সম্পর্কে একেবারে অনভিজ্ঞ, তাই টোপ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে গিলে নিয়েছে।
মাছ খেতে ভালই লাগল। কেউ কিছু বলছে না বটে, কিন্তু সবাই জানি, রসদ ফুরিয়ে এসেছে আমাদের। ড্রাইভের শুরুতে করা হিসেব অনুসারে যত দিন যাবে ধরা হয়েছিল, ততদিন যাবে না। চলার পথে শিকার করার ইচ্ছে ছিল আমাদের, রসাদের তালিকায় তা বিবেচনাও করা হয়েছিল; কিন্তু এ পর্যন্ত তেমন কোন শিকার চোখে পড়েনি; এবং কোন বলদও জবাই করিনি, কারণ এর প্রতিটাই দরকার হবে আমাদের। বলদ ছাড়াও, উঠতি কিছু স্টকের ওপর নির্ভর করছি আমরা।
কেউই তেমন কথা বলছে না, দ্রুত খাওয়ার পালা চুকিয়ে শুয়ে পড়ার ইচ্ছে। বেন টিল্টন আর স্যাম গার্ট, প্রথমে পাহারায় থাকবে, তবে ট্যাপও জেগে আছে। কিছুক্ষণ আগুনের পাশে বসে ধূমপান করল ও, তারপর হেঁটে চলে গেল ওয়্যাগনের দিকে। ঘুমানোর আগে ওকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমি।
টম জেপসন জাগাল আমাকে। গম্ভীর থমথমে, দেখাচ্ছে ওর মুখ, প্রায় অভদ্র ভাবে জাগিয়েছে আমাকে। বেডরোল ছাড়তে ঠাণ্ডা বাতাস কামড় বসাল, শরীরে, মাথায় হ্যাট চাপিয়ে পায়ে বুট গলালাম। কিছু না বলেই চলে গেছে টম, খেপে বোম হয়ে আছে।
কার্ল ক্ৰকেট রয়েছে আগুনের কাছে, আমার দিকে তাকাল চোখে প্রশ্ন নিয়ে। টমকে দেখেছ নাকি?
হ্যাঁ।
ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না আমার। শয়তান ভর করেছে ওর ওপর, কিছু একটা ঘটিয়ে ছাড়বে ও।
ট্যাপের বিছানার দিকে তাকালাম, ঘুমাচ্ছে সে। স্যাড়লে চেপে পালের কাছে চলে এলাম আমরা-কেলসি আর স্কয়ারের জায়গায় পাহারা দেব।
শান্ত সব, জানাল কেলসি।
ক্যাম্পের দিকে চলে গেল ওরা। পালের ওপাশে চলে গেল কার্ল। কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি আমি, টম জেপসনকে দেখতে পেলাম-বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ট্যাপের বিছানার দিকে চলে গেল দৃষ্টি, ঝোঁপের কারণে স্পষ্ট দেখা না গেলেও, মনে হলো শূন্য ওটা। তবে এ নিয়ে মাথা ঘামালাম না। এটা আমার ব্যাপার নয়।
ধীর গতিতে পালের চারপাশে চক্কর মারা শুরু করলাম। বিশাল একটা রোয়ানে চেপেছি এখন, খানিকটা বেয়াড়া স্বভাবের হলেও ঘোড়াটা শক্তিশালী, স্রেফ আকারের কারণেই দ্রুত গতির ও।
হঠাৎ করেই ব্লন্ড সেই গানম্যানের কথা মনে পড়ল, ওয়েব হর্নারের সঙ্গে ছিল সে। লোকটাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন আমি, পুরো ঘটনাটাই নির্লিপ্ততার সঙ্গে নিয়েছে লোকটা, ওয়েব হর্নার খুন হওয়ার পরও বিন্দুমাত্র বিকার দেখা যায়নি ওর মধ্যে। অবচেতন মন বলছে লোকটার সঙ্গে আবারও দেখা হবে। আর বাড সাটক্লিফ তো আছেই।
প্রায় এক ঘণ্টা পর, গরুগুলো তখন উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে; কয়েকটা চরতে শুরু করেছে আবার। হঠাৎ কান খাড়া করল বিশাল একটা লংহর্ন। উত্তরের ঝোঁপের দিকে তাকিয়ে আছে ওটা। গরুটার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম, অন্ধকারে ওকের পাঢ় অবয়ব চোখে পড়ল শুধু।
প্যাটার্সন হাতে রেখে হাঁটুর গুঁতোয় এগোনোর নির্দেশ দিলাম রোয়ানটাকে। গাছের প্রায় ত্রিশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেছি। লংহর্ন গৃহপালিত পণ্ড হিসেবে সমাদৃত হলেও, আসলে ওরা বুনো প্রকৃতির, যে-কোন উদ্দীপনায় বুনো প্রাণীর মতই সাড়া দেয়। তাই বিপদের পূর্বাভাস এদের আচরণ থেকে পাওয়া সম্ভব।
হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে গাঢ় অন্ধকারে, ক্ষীণ নড়াচড়া দেখতে পেলাম, পিস্তলের ব্যারেলে ক্ষণিকের জন্যে ঝিকিয়ে উঠল ম্লান আলো।
গাছের ফাঁকফোকরে তল্লাশি চালাচ্ছে অন্য কেউ-আমাদের ক্যাম্পের কোন লোক। একটা ঝোঁপকে চক্কর মেরে এগিয়ে গেলাম, আমি, প্রায় ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে এসে দাঁড়ালাম। কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ঘোড়াটা, আমার মত ওটাও বিপদ আঁচ করতে পেরেছে, তাই হালকা এবং ধীর গতিতে, প্রায় নিঃশব্দে পা ফেলছে।
ক্ষীণ নড়াচড়ার শব্দ কানে এল। ফিসফিস করে কথা বলল কেউ, তারপর নারীকণ্ঠের চাপা হাসির শব্দ হলো।
মুহূর্তে, থমকে দাঁড়ালাম আমি। অজান্তে মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠল, ঘাড়ে গরম রক্তপ্রবাহ টের পাচ্ছি। দৃশ্যত, ওকের আড়ালে মিলিত হয়েছে দু’জন নারী-পুরুষ। দেখতে না পেলেও এদের পরিচয় নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আমার।
রোয়ানটাকে ঝোঁপের ফোকর বরাবর আগে বাড়ালাম। খুরের নিচে শুকনো ডাল ভাঙার মটমট শব্দ হলো, ঝোঁপের সরু ফাঁক দিয়ে এক লোককে রাইফেল তুলে নিশানা করতে দেখতে পেলাম। তৎক্ষণাৎ স্পার দাবালাম, লাফিয়ে আগে বাড়ল ঘোড়াটা, মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লোকটার পাশে। রাইফেল গর্জে উঠার আগেই ব্যারেলটা তুলে দিলাম ওপরের দিকে। তারপর হঁচকা টান মারলাম, বিস্ময়ের কারণেই রাইফেল ছেড়ে দিল লোকটা-কি থেকে কি হয়েছে, এখনও বুঝতে পারেনি।
নিচু স্বরে কাউকে সতর্ক করল কেউ, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। তারপর শীতল একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম, আমার উদ্দেশে বলল কেউ ছেড়ে দাও ওকে, বয়! আমাকে যদি শিকার করতেই এসে থাকে, সুযোগটা দাও ওকে।
রাইফেলটা দাও আমাকে, ড্যান! টম জেপসনের খেপা স্বরের নির্দেশ। আজীবন যা দেখে এসেছি, একেবারে সহজ-সরল মিতভাষী মানুষটি আর নেই, সে, এ মুহূর্তে ঠাণ্ডা মাথার বিপজ্জনক একজন লোক।
দিয়ে দাও ওকে! শীতল সুরে বলল ট্যাপ।
কিন্তু রাইফেলে ট্যাপকে নিশানা করলাম আমি। ঘুরে দাঁড়াও, ট্যাপ, তারপর পালের কাছে ফিরে যাবে। পিস্তলের দিকে যদি হাত বাড়াও, স্রেফ খুন হয়ে যাবে।
আমার সঙ্গে বেঈমানি করছ? ব্যঙ্গ আর বিদ্বেষের সুরে জানতে চাইল সে।
নিজেদের মধ্যে কোন গোলাগুলি হতে দেব না আমি। এমনিতে যথেষ্ট ঝামেলার মধ্যে আছি আমরা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম শার্টের চেরার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে টম জেপসনের ডান হাত। উঁহু, টম, চেষ্টা কোরো না। তোমার ক্ষেত্রেও একই কথা। যে-ই পিস্তলে হাত দেবে, তার লাশ পড়ে যাবে এখানে।
অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। হঠাৎ দেখলাম একটা গাছের গুড়ির বিপরীতে উঠে দাঁড়িয়ে আছে রোজিটা জেপসন। দু’চোখ ভরা আতঙ্ক নিয়ে পুরো ঘটনা দেখছে।
পদশব্দ এগিয়ে আসছে ক্যাম্পের দিক থেকে।
ঘুরে দাঁড়াও, টম, ক্যাম্পে চলে যাও, অবিচল কণ্ঠে নির্দেশ দিলাম আমি। ব্যাপারটার নিষ্পত্তি এখনই করে ফেলব আমরা। মিসেস জেপসন, তুমিও যাবে।
ঝট করে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল মহিলা। আমি? কাঁপা স্বরে জানতে চাইল। কিন্তু আমি কি কারণে…
টমের পেছনে পেছনে এগোও।
স্বামী-স্ত্রী চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ নড়ল না ট্যাপ এডলে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ইদানীং প্রায়ই আমার কাজে বাগড়া দিচ্ছ তুমি, বয়। একসঙ্গে বড় হয়েছি এটা বোধহয় ভুলেই যেতে হবে আমাকে।
ও-কাজ কোরো না, ট্যাপ। আমি তোমাকে পছন্দ করি, এবং তুমি আমার ভাই। কিন্তু কখনও যদি আমার বিরুদ্ধে ড্র করো, তোমাকে খুন করব আমি।
শেষ রাতের চাঁদের স্লান আলোয় আলোকিত হয়ে আছে জায়গাটা। মায়াবী, রহস্যময় আলো। এখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ট্যাপ, আমার মুখোমুখি, হ্যাটের ব্রিমের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে মুখটা, কিন্তু চোখ দুটোর মণি জ্বলছে জোনাকি পোকার ন্যায় ক্ষুদ্র আলোক বিন্দুর মত।
আস্ত বেকুব তুমি, বয়! জানো কার সঙ্গে কথা বলছ? বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলেছ সব?
না, ট্যাপ, ঠিকই বলেছি আমি। আমার ব্যাপারে খুব বেশি নিশ্চিত হয়ো না, কারণ পিস্তল বা রাইফেল আমি তোমার চেয়ে ভাল চালাই। তবে প্রমাণ করার ইচ্ছে নেই আমার। আর•••তোমার মত গানফাইটার হিসেবে নাম কিনতে চাই না নামি, খ্যাতির দরকার নেই কিনা। তোমাকে ড্র করতে কিংবা গুলি করতে দেখেছি, ট্যাপ, কিন্তু আমাকে দেখোনি তুমি। যে-কোন সময়ে তোমাকে ড্র-তে হারাতে পারব আমি।
ঝটিতি ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পের দিকে এগোল সে। প্রায় সবাই জেগে গেছে ততক্ষণে, বাবাও। মহিলারাও বাকি নেই। মিসেস অটম্যান বা ইলেনও ঘিরে দাঁড়াল আমাদের। একেবারে রক্তশূন্য দেখাচ্ছে ইলেনের মুখ।
ফ্রি, স্কয়ারকে বললাম আমি। তুমি কি আমার জায়গায় পাহারা দিতে যাবে? একটা ব্যাপারে ফয়সালা করতে হবে আমাদের।
শার্টস্লিভ পরনে আগুনের কাছে বসে আছেন বাবা, মুখ গম্ভীর।
ক্যাম্পে পা রাখল ট্যাপ এডলে। কঠিন মুখে সামান্য ব্যঙ্গের, হাসি, টম জেপসনের দিকে তাকাল যখন, স্পষ্ট বিপ আর তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল চাহনিতে; কিন্তু ভুলেও ওর দিকে তাকাল না টম।
আগুনের কাছে এসে দাঁড়াল রোজিটা, মাথা উঁচু ওর, নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টায় রীতিমত ক্লান্ত বোধ করছে। কিন্তু পুরোপুরি সফল হয়েছে, তা বলা যাবে না।
সময় নষ্ট করলেন না বাবা। ঝটপট প্রশ্ন করলেন, উত্তরও এল। ক্যাম্পের বাইরে বনের কিনারে ট্যাপের সঙ্গে দেখা করেছে রোজিটা। বেশ কয়েকবারই আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছে টম জেপসন, আশা করেছে ওকে দেখে চলে আসবে রোজিটা কিংবা ট্যাপই হাল ছেড়ে দেবে।
মাথা নিচু করে সব শুনছে ইলেন, দৃষ্টি মাটির দিকে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি পুরো ঘটনা ওর জন্যে কতটা বেদনার। ট্যাপ সম্পর্কে ওকে সতর্ক করতে পারতাম, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করত না, মেয়েটা। মানুষ হিসেবে সে মন্দ নয়; দশজন পুরুষের মেলায় নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত, অথচ মেয়েদের বেলায় কোন সীমারেখা বেঁধে রাখতে পারে না ওকে, মানেও না সে। মেয়ে মাত্র, যেখানেই হোক, তাদের পছন্দ করে ট্যাপ, পটাতে ভালবাসে এবং ওখানেই শেষ হয়ে যায় সবকিছু। ইলেনকে যা বলেছি তারচেয়ে বেশি কিছু বলে আসলে কোন কাজ হত না। মাঝে মধ্যে এমনও সময় আসে, যেটা আমরা বিশ্বাস করতে চাই শুধু সেটাই বিশ্বাস করি।
ট্যাপকে সমীহ করি আমি, একসময় নিজের আদর্শ মনে করতাম ওকে। একসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা, অনেক কিছুই ওর কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু সবাই আমরা একটা আউটফিটের অংশ, তাই ব্যক্তির চেয়ে দলের স্বার্থই এখানে বড়। শেষপর্যন্ত সফল হতে হলে একসঙ্গে থাকতে হবে আমাদের। একাট্টা হতে হবে। এখানকার প্রতিটি লোকই জানে যে ট্যাপ এডলে আমাদের স্বপ্নের মূল কারিগর। এই ট্রেইলে পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা আছে ওর, যা আমাদের কারোই নেই। যেদিকে যাচ্ছি আমরা, এলাকাটা চেনে ট্যাপ, অথচ আমরা এই প্রথম এলাম। মাইল খানেক পরেও কি আছে জানি না কেউ, সামান্য ধারণাও নেই।
ট্যাপ জন্মগত ভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। কাউহ্যান্ড হিসেবে দক্ষ। এখন ও ভাবছে পুরো ব্যাপারটাই আসলে স্রেফ তামাশা বা লোক দেখানো ব্যাপার। কিন্তু ভুল করছে সে। বাবাকে এখনও ঠিক চেনা হয়নি ওর।
রোজিটাকে ওয়াগন থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে টম জেপসন, জানত তার আগেই নিজের বিছানা ছেড়ে গেছে ট্যাপ; সুতরাং স্ত্রীকে অনুসরণ করে সে। লংহর্নটা ঝোঁপের ওপাশে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে না উঠলে, নিঃসন্দেহে দু’জনের একজন খুন হয়ে যেত এতক্ষণে, হয়তো দু’জনকেই খুন করত জেপসন। দেখামাত্র ট্যাপকে গুলি করত সে। ঠান্ডা নির্লিপ্ত স্বরে এই বলল সে।
জেপসন যখন কথা বলছে, সারাক্ষণই তাকে দেখল ট্যাপ; আমার কাছে মনে হলো এই প্রথম জেপসনকে খানিকটা হলেও শ্রদ্ধা আর সমীহের চোখে দেখছে ও।
তোমার কিছু বলার আছে? ট্যাপকে জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
শ্রাগ করল সে। কি বলব? ও-ই তো যা বলার বলে দিয়েছে-স্পষ্ট এবং সরাসরি। আমরা কথা বলছিলাম, অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে হাসল ট্যাপ। ব্যস, আর কিছু নয়।
রোজিটার দিকে ফিরলেন বাবা। তোমার কাছে কিছু জানতে চাইব আমরা, রোজ! তোমার আর টমের মধ্যে যাই ঘটুক, সেটা তোমাদের ব্যাপার। আমাদের যা বলার আছে: আবার যদি এরকম কিছু ঘটে, তাহলে ড্রাইভ ছেড়ে চলে যেতে হবে তোমাদের, সেটা যেখানেই হোক। টম একা যদি থেকে যেতে চায়, আমাদের অন্তত কোন আপত্তি নেই।
এবার ট্যাপের দিকে ফিরলেন বাবা, একেবারে নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে মুখ। আমার ড্রাইভে একটা জিনিস কখনও সহ্য করব না-কোন ঝামেলাবাজ লোকের উপস্থিতি যথেষ্ট ঝামেলা করেছ তুমি, ট্যাপ, সম্ভবত ভবিষ্যতেও করবে। আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত খুনোখুনি ছাড়া থাকতে পারবে তুমি আর টম। সেটা হতে দেব না আমি। এবং এই ঘটনা নিয়ে দলের মধ্যে ভাগাভাগি হোক, তাও হতে দেব না।
আমি জানি বাবা কতটা পছন্দ করেন ট্যাপকে। এও জানি সিদ্ধান্তটা নিতে কতটা ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে ওঁকে।
ছয়দিনের রসদ পাবে, ট্যাপ, চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করলেন তিনি। আর একটা পূর্ণ ক্যান্টিন। তোমার নিজস্ব ঘোড়া আছে। আমি চাই এক ঘণ্টার মধ্যে চলে যাবে তুমি।
বিশ্বাস করতে পারছে না ট্যাপ, বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন বাবা ওকে চড় কষেছেন।
পরের বউকে ফুসলাবে এমন কোন লোকের দরকার নেই আমাদের! এটা ড্রাইভ হতে পারে, কিন্তু কয়েকটা পরিবার আছে এখানে, ড্রাইভের ভালমন্দের মত সবার মান-সম্মানও দেখতে হবে, আমাকে। বলেই ঘুরে দাঁড়ালেন বাবা, হেঁটে চলে গেলেন ওয়্যাগনের দিকে।
মিনিট খানেক পর ওয়্যাগনের কাছে চলে গেল ট্যাপ। নিজের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করল।
দুঃখিত, ট্যাপ, বললাম আমি।
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল ও। গোল্লায় যাও তোমরা! শীতল সুরে বলল সে। তুমি আমার ভাই নও!
গিয়ার কাঁধে ফেলে ঘোড়ার কাছে চলে এল সে। চার্লি হীথ এগিয়ে গেল ওর দিকে, মিনিট দুয়েক কথা বলল দু’জনে, তারপর ক্যাম্পে ফিরে এসে আগুনের কাছে বসে পড়ল হীথ। স্যাডলে চেপে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেল ট্যাপ এডলে।
ভোরের আলো ফুটতে যাত্রা করলাম আমরা।
নদীর পানি কমে যাচ্ছে, প্রায় কর্দমাক্ত, ঘঘালাটে হয়ে গেছে এখন। ধীর গতিতে এগোচ্ছি আমরা, গরুগুলোকে সতেজ ঘাস খাওয়ার সুযোগ দিচ্ছি চলার মধ্যে, যদিও ঘাস খুব পাতলা এবং ছোট ছোট।
যাত্রার শুরু থেকেই যথেষ্ট লোক ছিল না আমাদের। তারওপর রাস্টি বুচার্ডের মৃত্যু আর ট্যাপ চলে যাওয়ায় খারাপ হয়েছে অবস্থা। ওয়াগন যাত্রা করার আগে টেরই পেলাম না যে আরও একজন নেই দলের মধ্যে।
ইলেন অটম্যান। কোন এক ফাঁকে পনিতে স্যাঙল চাপিয়ে ট্যাপের পিছু নিয়েছে ও।
মিসেস অটম্যান সমানে বিলাপ করছে। টিমকে বেশ বিষণ্ণ মনে হলো, কিন্তু সবাই আমরা ট্যাপকে একা চলে যেতে দেখেছি; এবং গত কয়েকদিন ধরে ইলেনের সঙ্গে তেমন কোন কথাবার্তা হয়নি ট্যাপের, সেটাও খেয়াল করেছে সবাই। দৃশ্যত, তারপরও ট্যাপকে অনুসরণ করেছে ইলেন। এরচেয়ে বোকামি কল্পনাও করা যায় না।
পালের একেবারে পেছনে আছেন বাবা। সান, তুমি আর কার্ল স্কাউটিংয়ে যাবে, কাছাকাছি যেতে চিন্তিত স্বরে বললেন আমাকে। দেখোত পানি খুঁজে পাও কিনা। মনে হয় না পেকোসের এপাশে পানি পাওয়া যাবে। সমানে মাসট্যাঙ পন্ডস, যদ্দর মনে পড়ে ওঁগুলোর ব্যাপারে তেমন কিছু বলেনি ট্যাপ।
পালের আগে আগে এগিয়ে চললাম আমরা, কিন্তু আশান্বিত হওয়ার মত কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ঝর্নাগুলো ক্ষীণ হয়ে এসেছে, কোথাও কোথাও ফোঁটার আকারে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েকটা ক্ষুদ্র ওঅটরহোল রয়েছে বটে, কিন্তু পানি এত কম যে বড়জোর দু’একটা গরু তেষ্টা মেটাতে পারবে। প্ৰেয়ারিতে গুটিকয়েক মেস্কিট জন্মেছে-জীর্ণ দশা ওগুলোর, প্রায় গুলোর আকারে বেড়ে উঠেছে।
ঠাণ্ডা সকাল তেতে উঠছে ক্রমশ। উঁচু একটা জায়গায় উঠে এসেছি আমরা, যথেষ্ট বাতাস থাকার কথা এখানে, অথচ একটুও নেই। ঘাড়ের ঘাম মুছে কালের দিকে তাকালাম আমি। ট্যাপ থাকলেই বোধহয় ভাল হত।
হয়তো। কিন্তু ট্রেভেন ওকে তাড়িয়ে দিয়ে ঠিকই করেছে। দলের স্বার্থে এটাই উচিত ছিল।
শেষপর্যন্ত একটা পানির উৎস খুঁজে পেলাম আমরা। নদীর গভীর অংশ এটা, অন্য অংশ প্রায় শুকিয়ে এসেছে; কিংবা এমনও হতে পারে বৃষ্টির কারণে পানি জমেছে এখানে।
কি মনে হয় তোমার, কার্ল, চলবে?
যথেষ্ট, দূরের পাহাড়সারির দিকে তাকিয়ে আছে সে। হর্সহেডের আগে হয়তো এটাই পানির শেষ উৎস। এবার আমার দিকে ফিরল সে। ড্যান, পেকোসের পানি কিন্তু ক্ষারে ভরা। নদীর পানি অবশ্য তত খারাপ নয়। কিন্তু আশপাশে যত ওঅটরহোল আছে, সবই ক্ষারে ভরা। ওই পানি খেলে মরে যাবে গরুগুলো। যেভাবে তোক আটকে রাখতে হবে ওদের।
আচমকা রাশ টেনে ধরল সে। কিছু দূরে নালহীন ছয়টা, ঘোড়ার ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণে চলে গেছে। একেবারে তাজা ট্র্যাক, বড়জোর কয়েক ঘণ্টা আগের।
ঝামেলা কি শেষ হয়নি আমাদের? বিরক্ত স্বরে শঙ্কা প্রকাশ করল সে, চোখ কুঁচকে দূরে নাচতে থাকা তাপতরঙ্গের দিকে তাকাল।
কিছুই চোখে পড়ছে না…
ভাবছি ট্যাপ কোথায় গেল।
আমি ভাবছি ইলেন ট্যাপকে খুঁজে পেয়েছে কিনা। বোকার মত ওর পিছু নিয়েছে মেয়েটা। তারপর আমার দিকে ফিরল সে। আমরা সবাই মনে করতাম ওকে পছন্দ করো তুমি, তোমার সঙ্গেই গাঁট বাঁধবে ইলেন।
কয়েকবার গল্প করেছি, আমরা ব্যস, এরচেয়ে গভীর কোন সম্পর্ক ছিল না আমাদের।
এগিয়ে গেলাম আরা। ঘামে ভিজে গেছে ঘোড়ার শরীর। আমাদের অবস্থাও তথৈবচ। ঘাম আর ধুলোর অত্যাচারে গা চটচট করছে। প্রখর রোদে চোখ কুঁচকে তাকালাম। সামনে বিস্তৃত প্রান্তর পড়ে রয়েছে, ঘাস নেই বলতে গেলে, পানির চিহ্নমাত্র নেই কোথাও…
সঙ্গে মেয়েরা না থাকলে… বললাম আমি।
পালের আগে আগে পুরো একদিনের পথ এগিয়ে এসেছি আমরা। পেছনে পানির উৎস রয়েছে, হয়তো একটা দিন কোন রকমে চলে যাবে; কিন্তু সামনে পানির চিহ্ন নেই কোথাও, অথচ হর্স হেড ক্রসিং এখনও অনেক দূরের পথ।
অনেক গরু মারা পড়বে, সিগারেট ধরাল কার্ল। পানি খুঁজে না পেলে সত্যিই অনেক গরু হারাতে হবে আমাদের।
পানি থাকলেও ক্ষারে ভরা থাকবে। পানির ওপর ক্ষারের ঘন স্তর পড়বে।
হ্যাট সরিয়ে হাটবেন্ড মুছলাম। সূর্য এখন পিঠ নয়, চাঁদি তাতাচ্ছে। ভাগ্যিস ঘন চুল আছে আমার মাথায়।
একবার অগভীর একটা জায়গায় কিছু ঘাস চোখে পড়ল। গ্ল্যামা ঘাস, তবে শুকিয়ে মৃতপ্রায় এখন। ঘোড়া দুটো সানন্দে শুকনো ঘাস নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জায়গাটার কিনারায় উঠে এসে সামনের বিস্তৃত অঞ্চলের দিকে তাকালাম। কি মনে হয় তোমার, কার্ল, অন্য কোন পথ ছিল ড্রাইভের জন্যে?
শ্রাগ করল সে। মনে হয় না, আঙুল তুলে একটা জায়গা দেখাল ও। কি এটা?
কাছাকাছি দুই পাহাড়ের ফাঁকে একটা রাস্তার ওপর কয়েকটা বাজার্ড উড়ছে, চক্কর মারছে আয়েশী ভঙ্গিতে। দু’তিনটে বাজার্ড। সংখ্যাটা নেহাতই অল্প।
গত কয়েক ঘণ্টায় জীবন্ত কোন প্রাণী দেখলাম এই প্রথম, মন্তব্য করল ও। নিশ্চই কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে ওরা।
কিছু যদি পেয়েই থাকে, জিনিসটা মৃত।
ঘোড়াকে হুঁটিয়ে নিয়ে এগোলাম, অস্ত্রের কাছাকাছি রয়েছে হাত। প্যাটার্সনটা আমার হাতে, আলতো ভাবে ধরে রেখেছি মুঠিতে। ব্যারেলের ব্যাপারে সচেতন, কারণ সূর্যের তাপ আর গরমে তেতে আছে ওটা।
মৃত একটা ঘোড়া চোখে পড়ল প্রথমে। প্রায় একদিন আগে মারা গেছে। বাজার্ড থাবা বসায়নি এখনও। কাঁধে মার্কা দেখলাম-রকিং এইচ। হর্নার ব্র্যান্ড।
পাহাড়ের ওপর উঠে এসে ওপাশের অ্যারোয়ায় নজর চালালাম। অস্ফুট স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করল কার্ল, ফ্যাকাসে এবং অসুস্থ দেখাল মুখটা। এমনিতে কঠিন মানুষ হিসেবে পরিচিত সে, সামনের দৃশ্য নিশ্চই দারুণ ধাক্কা দিয়েছে ওকে। আমার ঘোড়াটা এগোতে চাইছিল না, কিন্তু কার্লের ঘোড়ার পাশে যেতে বাধ্য করলাম ওটাকে।
দৃশ্যটা ভয়ঙ্কর এবং রীতিমত অস্বস্তিকর। যেখান থেকে দেখছি আমরা, আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। অ্যারোয়ার তলায় মানুষ আর ঘোড়ার লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে…প্রথম দৃষ্টিতে সংখ্যাটা আন্দাজ করা কঠিন হলো।
মৃতদের শরীরে একটা সুতোও নেই। সবার চোখ উপড়ানো। কোমাঞ্চিরা যখন ছেড়ে গিয়েছিল, কেউ কেউ নিশ্চই জীবিত ছিল, কারণ অ্যারোয়োর মাটিতে ক্রল করার প্রচুর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, অন্ধের মত এখান থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে লোকগুলো-যেন অসহায় কোন পশু আশ্রয় খুঁজেছে। যে-কোন আশ্রয়।
মৃত্যুকূপে নেমে এসে চারপাশে নজর চালালাম। জীবনে এরচেয়ে তিক্ত এবং বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়েনি আমার। ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেছে। কাউ-হাউস থেকে আমাদের অনুসরণ করে এসেছে এরা-এদের অনেকেই আমাদের গরু চুরি করছিল এবং গরুগুলো উদ্ধার করেছিলাম কয়েকদিন আগে।
ঘুরপথে, বড়সড় চক্কর কেটে সামনে চলে এসেছিল এরা, এখানে এসে অবস্থান নিয়েছিল আমাদেরকে অ্যাম্বুশ করার জন্যে। কিন্তু, হঠাৎ আক্রমণ করেছে কোমাঞ্চিরা, কিছুই টের পায়নি এরা। ওরা জানত যে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে, সেজন্যেই আগুন জ্বেলে খাবার তৈরির আয়োজন করেছিল-ছাই আর কয়লা পড়ে রয়েছে এক জায়গায়, কয়েকটা পাত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
এগারোজন, গুনলাম।
অন্যরা কোথায়? অন্য কোথাও সরে গেছে। নাকি ইন্ডিয়ানরা বন্দী করে নিয়ে গেছে?
অ্যারোয়ো থেকে উঠে এসে স্যাডল ছাড়লাম। কিনারে কিছু পার্থর অপঘাত জড়ো করলাম, যাতে ট্রেইল থেকে অ্যারোয়োটা কারও চোখে না পড়ে। একইসঙ্গে কিছু পাথর তলায় ফেলে দিলাম। মোটামুটি ঢাকা পড়ল লাশগুলো।
নেকড়ের দল লাশ নষ্ট করতে পারবে না, মন্তব্য করল কার্ল। গত কয়েকদিন একটা নেকড়েও চোখে পড়েনি।
থাকবে কি করে, সাপ ছাড়া খাওয়ার কিছু আছে নাকি ওদের জন্যে? ট্যাপের কাছে শুনেছি জায়গাটা সাপে ভরা।
মনে এবং পেটে অস্বস্তি নিয়ে অ্যারোয়ো থেকে সরে এলাম আমরা। হয়তো শত্রু ছিল এরা, কিন্তু শত্রুর এমন ভয়াবহ পরিণতিও চায় না সুস্থ কোন লোক। কোমাঞ্চিদের হাতে কেউ যখন মারা পড়ে, মৃত্যুটা হয় প্রলম্বিত এবং সীমাহীন যন্ত্রণার!
জায়গাটার চারপাশে চক্কর মেরে ইন্ডিয়ানদের ট্র্যাক খুঁজে পেলাম। অন্তত চল্লিশজন ছিল ওরা, বেশিও হতে পারে। উত্তরে চলে গেছে রেডস্কিনরা, অবস্থা দেখে মনে হলো না আশপাশে থাকার ইচ্ছে আছে ওদের। পানির অভাবই এর কারণ। কিন্তু রুক্ষ এ প্রান্তর নিশ্চই পাড়ি দিয়েছে ওরা, আমাদের জানা নেই এমন পানির উৎসের অবস্থান জানা থাকতে পারে ওদের; যদিও চারপাশের এলাকা দেখে মনে হচ্ছে তেমন সম্ভাবনা একেবারে কম।
ফিরতি পথে এগোনোর সময় অন্য ট্র্যাকগুলো চোখে পড়ল-দুটো ঘোড়ার। হঠাৎ চোখে পড়েছে। তো, দেখা যাচ্ছে ঠিকই ট্যাপের দেখা পেয়েছে ও, এক সেট ছাপ দেখিয়ে মন্তব্য করল কার্ল। ওগুলো ট্যাপের ঘোড়ার…আর অন্যগুলো ইলেনের ছোটখাট গ্রুলাটার। অন্য কোথাও হলেও দুটো ঘোড়ার ট্র্যাকই চিনতে পারব আমি।
অ্যারোয়োর ভয়াবহ ঘটনার পর এদিকে এসেছে ওরা…সরাসরি পশ্চিমে চলে গেছে। হর্স হেড পর্যন্ত দীর্ঘ আশি মাইল রুক্ষ জমি পাড়ি দিতে হবে ওদেরইলেন কি সঙ্গে পানি নিয়েছে। পানি দরকার হবে ওদের।
সে-রাতে নদীর কিনারে ক্যাম্প করলাম আমরা-জানা মতে এটাই পানির শেষ উৎস।
৪. নদীর পানি প্রায় নিঃশেষ
নদীর পানি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। এক রাতের ব্যবধানে তৃষ্ণার্ত গরুর পেটে চলে গেছে সব পানি। একটু আগেও যেখানে পানি ছিল, সেখানে এখন থকথকে কাদা, সকালের সূর্যের আলোয় ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে।
বেশ, ড্যান, এবার তোমার পালা, গম্ভীর মুখে বললেন বাবা। আমি ক্যাটলম্যান নই, এটুকু বোঝার মত বুদ্ধি আছে আমার। এখন থেকে তুমি ড্রাইভ নিয়ে যাবে। তোমাকে নতুন করে বলার দরকার নিশ্চই হবে না, এই ড্রাইভের সাফল্যের ওপর কতটা নির্ভর করছি আমরা।
আশি মাইল পথ-কম-বেশি হতে পারে-পেরিয়ে হর্স হেড যেতে হবে, সবার উদ্দেশে বললাম আমি। পেকোসের কাছাকাছি অবশ্য কিছু ওঅটরহোল পাওয়া যাবে। আমি বা অন্য যে-কোন একজন আগে আগে রাইড করব, বিপজ্জনক ওঅটরহোলগুলো স্পট করতে হবে। গরুর দলকে ওসব উৎসে যেতে দেয়া যাবে না, যেভাবে হোক ঠেকিয়ে রাখতে হবে।
ওসব পানিতে ক্ষারের ঘন স্তর পড়ে আছে, পানি পান করা মানেই মৃত্যু। আমাদের পালে সব ধরনের গরুই রয়েছে, তবে কষ্টকর ড্রাইভের জন্যে অভ্যস্ত গরুগুলো। এখন থেকে যেটাই পিছিয়ে পড়বে; ওটাকে পেছনে ফেলে যাব আমরা। পথে কোন বাছুর জন্ম নিলে মেরে ফেলতে হবে।
সারাদিনে হয়তো পনেরো-ষোলো মাইল এগোতে পারব আমরা। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, এরচেয়ে বেশি যেতে হবে আমাদের এবং পানি ছাড়া।
প্রথম রাতে একটু দেরি করে ঘুমাব আমরা, সকালে আগে আগে রওনা দেব। কিন্তু তারপর থেকে পুরুষরা দিনে-রাতে প্রায় সারাক্ষণই রাইড করবে।
আমি রাইড করতে পারব, ভিড়ের শুরুতে দেখতে পেলাম জুয়ানিতাকে। বাচ্চা বয়স থেকে গরু নিয়ে কাজ করেছি আমি। এই ডাইভে কোন ভাবে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলে খুশি হব আমি। জুয়ারেজ সুস্থ হলে সেও হাত লাগাতে পারবে।
তোমার সাহায্য কাজে লাগবে, ম্যাম, জবাব দিলাম আমি। ধন্যবাদ।
কয়েক মিনিট কেউই কিছু বলল না, শেষে মুখ খুলল টিম অটম্যান। আশি মাইলের মধ্যে কোন পানি নেই? তাহলে মাসট্যাঙ পুলের ব্যাপারটা কি গুজব?
হয়তো সত্যিই আছে, ওখানে যে পানি পাওয়া যাবে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই। তাই পানি পাওয়া যাবে না ধরে নেয়াই ভাল।
শ্রাগ করলেন বাবা। এমন কিছু হতে পারে ভেবেই এসেছি আমরা। কেউ বলতে পারবে না যে আগেই তাকে সতর্ক করা হয়নি। এখন, আসলে যা করা উচিত আমাদের-সব ব্যারেল, জার পানিতে পূর্ণ করে ফেলতে হবে, আর যতটা সম্ভব কম পানি ব্যবহার করতে হবে।
কার্ল নেতৃত্ব দিচ্ছে, আগে আগে চলল সে, বড় বড় বাদামী চুল উড়ছে বাতাসে। ওর পিছু নিল ডোরাকাটা বলদটা, এখনও যে ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে ওটা খোদা মালুম; এবং ঠিক পেছনেই রয়েছে গরুর পাল।
দু’পাশে-পালের কিনারে-রয়েছে বেন টিল্টন আর মিলো ডজ। ওদের পেছনে রয়েছে ফ্রিম্যান স্কয়ার এবং স্যাম গার্ট।
ঘুরে টিম অটম্যানের দিকে এগোলাম আমি। ওয়্যাগনে উঠছে সে, এদিকে আগেই আসনে চেপে বসেছে মিসেস অটম্যান। বিষণ্ণ মুখ, দৃষ্টি দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে।
সব ঠিকঠাক আছে তো, টিম?
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল সে। না–তুমি ভাল করেই জানো। ইলেন চলে গেছে, অথচ ওকে আটকে রাখতে পারতে তুমি, ড্যান!
আমি? আর যাই হোক, এমন কোন মন্তব্য টিম অটম্যানের কাছ থেকে আশা করিনি আমি। টিম, আমার জন্যে থাকত না ও। আমার তো মনে হয় অন্য কারও জন্যেও থাকত না।
আমরা তো ভেবেছি বিয়ে করবে তোমরা। অন্তত আমার ধারণা ওরকমই ছিল। ছন্নছাড়া ওই ট্যাপ এডলেকে কখনোই পছন্দ হয়নি আমার।
মানুষ হিসেবে মন্দ নয় ও। আর…আমার এবং ইলেনের মধ্যে বিয়ে সম্পর্কে কোন কথা হয়নি। গল্পগুজব করেছি আমরা, এলাকায় সমবয়সী আর কোন ছেলে-মেয়ে ছিল না…স্রেফ আমরা দুজন। ইলেন কিন্তু সত্যিই ট্যাপকে পছন্দ করে।
মেয়েটাকে শেষ করে দেবে সে, যদি না পথে কোথাও মরে পড়ে থাকে।
ট্যাপের সঙ্গে আছে ও। ওদের ট্র্যাক দেখেছি। ট্যাপকে ধরে ফেলেছে ইলেন, পরে একসঙ্গে পশ্চিমে এগিয়েছে ওরা।
অ্যারোয়োর ভয়াবহ ওই ঘটনাটা মনে পড়লেও চেপে গেলাম, এদেরকে বলার কোন মানে হয় না। বাবাকে বলেছি আমি, অন্য বেশ কয়েকজনকেও বলেছি, কারণ আমি চাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুক ওরা। মেয়েরা শুনলে শুধু শুধু উদ্বিগ্ন হবে।
আমার যদি স্ত্রী থাকত, তো, অবশ্যই সবকিছু ওকে বলতাম আমি। বেশিরভাগ পুরুষ মেয়েদের অন্ধকারে রাখতে পছন্দ করে; অথচ পুরুষদের মতই বিপদ বা ঝামেলা উতরে যেতে জানে মেয়েরা। স্ত্রীকে ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কোন অধিকার নেই পুরুষের, কিন্তু মিসেস অটম্যান, মিসেস বুচার্ড বা রোজিটা জেপসন ভিন্ন ধাতে গড়া। ওদের উদ্বিগ্ন না করাই ভাল।
ওয়াগনগুলো নড়ে উঠল, ভারী চাকা গড়াল ঘড়ঘড় শব্দে, ধীর গতিতে এগোতে থাকল গরুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। পশ্চিমে এগোচ্ছি আমরা। খুরের দাপটে ধুলো উড়ছে, পেছনে উদীয়মান সূর্যের আলো ঝিলিক মারছে হাজারো শিং-এ। পালের একপাশ থেকে গান ধরল কেউ, সুর মেলাল অন্য একজন; ওদের গান শুনতে পেয়ে সন্তুষ্ট হলাম-দীর্ঘ ড্রাইভ শেষ করার জন্যে যে সাহস, ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা দরকার, তার সবই দরকার হবে নিকট ভবিষ্যতে-হর্স হেড পর্যন্ত, আশি মাইল পাড়ি দেয়ার সময়।
হেলে-দুলে এগিয়ে চলেছে গরুর পাল, চিৎকার করছে, ডাক ছাড়ছে। ধুলো আরও ঘন হয়ে এসেছে। সতেজ সকাল পেরিয়ে রৌদ্রদগ্ধ দুপুর হলো একসময়। ঘামের ফোঁটা নেমে আসছে গরুর পেট বেয়ে। কিন্তু থামলাম না আমরা। প্রতিটি পদক্ষেপ বিজয়ের দিকে একেকটা মাইলফলক, প্রতিটি মাইল মানে পানির আরও নিকটবর্তী হওয়া। কিন্তু আমার জানা আছে, পালে অনেক গরু পানি স্পর্শ করার আগেই মারা পড়বে, কিছু ঘোড়াও, হয়তো মানুষও মারা যাবে।
বুনো পশ্চিমের রীতি এমনই কঠিন, পরিশ্রমী মানুষ এভাবেই এগিয়ে চলে; এটাই তাদের জন্যে একমাত্র পথ, উপায়-রীতি, এবং পছন্দও। যত এগোবে, ততই তেষ্টা বেড়ে যাবে। এদিকে সকালের সূর্যও তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে বেরসিকের মত; সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আরও তেতে উঠছে রোদ। ধুলোর অত্যাচার বাড়ছে।
দুপুরের আগে দু’বার ঘোড়া বদল করেছি। জিম মুরের সঙ্গে পালের পেছনে ড্রাগের দায়িত্বে আছি আমি। কার্ল ক্রকেটের সঙ্গে পালের সামনে রয়েছেন বাবা।
শেষপর্যন্ত প্রশান্তিময় ঠাণ্ডা রাত এল, যখন, যোলো মাইল পেরিয়ে থামলাম। একদিনের জন্যে যথেষ্টরও বেশি দূরত্ব। সবার মধ্যেই চাপা আতঙ্ক, স্রেফ যন্ত্রের মত চলছি আমরা, জানি সামনে কি আছে-ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে আতঙ্কিত। জুয়ানিতা যখন আমার দিকে তাকাল, বিস্ময় দেখতে পেলাম ওর চোখে, জানি কি ভাবছে ও। ভাবছে আমরা পাগলামি করছি..অসম্ভব জেনেও চেষ্টা করছি এবং সর্বস্ব, বিসর্জন দিচ্ছি।
সাপার একেবারে সংক্ষিপ্ত হলো আজ। ভরপেট কফি গিললাম। এদিকে অস্থির হয়ে পড়েছে গরুর দল-পানি নেই, তেষ্টা মেটাতে পারছে না। অনেক, অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করল ওরা, একসময় ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়ল।
সমস্ত দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। একে একে সবার মুখ জরিপ করলাম, সময় নিয়ে নিরীখ করলাম সবক’টা মুখ। বোঝার চেষ্টা করলাম, কতটা সহিষ্ণুতা বা ধৈর্য দেখাতে পারবে এরা। এদের সামর্থ্যই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
বেশ রাত করে ঘুমালাম। সকালে উঠলাম সবার আগে, বেডরোল গুছিয়ে ডানের পিঠে স্যাডল চাপালাম। আগুনের কাছে ফিরে এসে দেখলাম কফির আয়োজন করছে স্যাম গার্ট। তাজা জিনিস, আঙুল তুলে পাত্র দেখাল সে। নিয়ে নাও।
কাপ ভরে ওর বিপরীতে বসলাম।
কথাবার্তায় তেমন পটু নই আমি, হঠাৎ মন্তব্য কল গার্ট। সেজন্যেই কিছু বলিনি। বিশেষ করে, ট্যাপ যখন তোমার ভাই।
কফি গেলার ফাঁকে ওর দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না।
ট্যাপ যদি আমাদের জন্যে ভোলা রেঞ্জ ঠিক করে থাকে-তাহলে এতদিনে কেউ বসতি করেনি কেন?
আশপাশে কেউ নেই বলেই বোধহয়।
ফালতু অজুহাত! ওই রেঞ্জে আগেও লোক এসেছে, জমি ব্যবহার করেছে-এমনকি তোমার জন্মের আগে থেকে, ড্যান।
তো, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ট্যাপ ওই রেঞ্জ সম্পর্কে বলেছে আমাদের, কারও মালিকানা নেই, কাউকে জিজ্ঞেসও করতে হবে না, বিস্তৃত তৃণভূমি পড়ে আছে মাইলকে মাইল-কেবল দখল করে নিলেই হলো।
স্যাম গার্ট কথা কম বলে, এবং যা বলে তার সবই সত্যি-জানি আমি। না জেনে কখনোই কিছু বলে না সে। ট্যাপ নিজেই জায়গাটা খুঁজে বের করেছে, আমাদের জন্যে, প্রতিবাদ করলাম আমি। একজন লোক রেখে এসেছে ওখানে।
হোনাস গান্টকে?
তুমি চেনো ওকে!?
হাসি পাচ্ছে আমার, ড্যান। হোনাস গান্ট জঘন্য চরিত্রের লোক। ট্যাপের মুখে ওর কথা শুনেছি বেশ কয়েকবার, স্রেফ ঝামেলা এড়ানোর জন্যেই কিছু বলিনি। প্রতিবাদ করতে যাওয়া মানেই ট্যাপকে মিথ্যুক বলা, তাই না? আমি গানফাইটার নই, তাই ট্যাপের ধারণা ভুল প্রমাণ করার জন্যে ভুয়েল লড়তে রাজি নই। সত্যি কথা হচ্ছে, ওই হোনাস লোকটা গরুচোর এবং আউটল।
এই তাহলে অবস্থা। রুক্ষ বিরান প্রান্তর ধরে পশ্চিমে ছুটছি আমরা, জীবন আর জীবিকার ঝুঁকি নিয়েছি, মনে স্বপ্ন যে একেবারে আনকোরা একটা জায়গায় বসতি গড়ব; যে-জমির স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই দুর্ভোগ পোহানো, এখন দেখা যাচ্ছে সেটা আরেকজনের জমি এবং ওখানে পৌঁছে হয়তো পুরোদস্তুর লড়াই করতে হবে আমাদের।
সবাই বলে বিপদ একাকী আসে না; আমাদের বর্তমান অবস্থায় কথাটা একশো ভাগ সত্যি। কফি গেলার ফাঁকে পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছি, কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পেলাম না। পশ্চিমে যেতেই হবে আমাদের, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই, অথচ গন্তব্যে পৌঁছে লড়াই করতে হবে-পৌঁছব যখন, আমরা থাকব ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। গরুগুলোর অবস্থা এরচেয়ে ভাল থাকবে, তা বলা যায় না।
স্যাম, ব্যাপারটা আমাদের দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক। আপাতত কাউকে কিছু জানাব না। এ নিয়ে ভাবতে হবে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ট্যাপের আরও খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল।
কফির কাপ নামিয়ে রেখে পাইপে তামাক ভরল গার্ট। নিচু স্বরে কথা বলল যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়। কিছু মনে কোরো না, ড্যান, ট্যাপ এডলেকে স্রেফ স্বার্থপর একজন লোক মনে হয়েছে আমার। বলতে চাইছি, সবার আগে নিজের কথা ভাবতে অভ্যস্ত ও। ধরো, ওই জমিটা চাই আমরা। কিন্তু সঙ্গে যদি গরু না থাকে? এই এলাকায় কোন জমি ক্লেইম করতে হলে গরু থাকতেই হবে..জমিতে গরু চরাতে হবে।
আসলে নিজের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করতে চেয়েছে ও। জানত যে তোমরা কাউ-হাউসে থাকতে পারছ না, পশ্চিমে নতুন কোন জায়গায় নিঝঞ্ঝাট বসতি করতে চাইছ, তাই বস্ক রেভোরন্ডার কথা বলেছে তোমাদের। অথচ জায়গাটা নিয়ে ইতোমধ্যে কামড়াকামড়ি লেগে গেছে। আমার তো মনে হয়, পুরোদস্তুর রেঞ্জ ওঅরের মধ্যে গিয়ে পড়ব আমরা, হোনাস গান্টের পাশে হবে আমাদের অবস্থান…অর্থাৎ জমি দখলের জন্যে নিরীহ কিছু মানুষকে ব্যবহার করতে চেয়েছে ট্যাপ।
স্বীকার করছি পরিস্থিতি খুব খারাপ। গান্ট সম্পর্কে আর কি জানো?
যা বলেছি, নীচ জাতের লোক। যে-কোন অস্ত্র নিয়ে লড়াই করবে সে, এবং প্রচুর মানুষ খুন হয়ে যাবে ওর হাতে। কেউ কেউ বলে আসলে ও বাল্ড নেব পরিবারের লোক, মিসৌরীতে কেমন আধিপত্য ছিল ওদের, শুনেছ তো? সত্যি-মিথ্যে জানি না, তবে আমার কাছে মনে হয়েছে জর্জিয়ার লোক সে-কথাবার্তায় টান স্পষ্ট।
ট্রেইলে গরুর পাল নিয়ে এলাম আমরা। কাজটা সহজ হলো না। গরুগুলো অস্থির, অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তেষ্টা মেটেনি ওদের, গতরাতের পর এ পর্যন্ত পেটেও কিছু পড়েনি; অথচ দৃষ্টিসীমায় পানি বা ঘাস-কোনটার চিহ্নমাত্র নেই।
সূর্য ওঠার আগেই গরুর পাল রওনা করিয়ে দিলাম আমরা, ধীর গতিতে এগোচ্ছে গরুগুলো। সেদিন অন্য যে-কোন দিনের চেয়ে বেশি খাটুনি গেল আমাদের। পানি না পাওয়ায় ফিরতি পথে কাউ-হাউস বা মিডল কঞ্চোয় চলে যাওয়ার কুবুদ্ধি উঁকি দিয়েছে ওদের মাথায়, সামনের কক্ষ এলাকার দিকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কোন একটাকে উল্টো ঘুরতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যগুলোও ফিরতি পথ ধরতে চাইছে।
ড্রাগের দায়িত্ব নিলাম আমি। এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। পালের নেতৃত্ব এখন আমার, সুতরাং দায়িত্ববোধের কারণে কঠিন কাজটা আমারই করা উচিত। দুপুরের দিকে একটা ব্লফের কিনারায় পৌঁছলাম আমরা। প্রায় আধ-মাইলের মত জায়গায় ছায়া পড়েছে। সব গরু ছায়ার মধ্যে এনে থামলাম। দুপুরের সময়টা এখানেই কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছে।
ওয়াগনে ঢুকে দেখলাম উঠে বসেছে জুয়ারেজ। আগের চেয়ে বেশ সুস্থ এবং সবল দেখাচ্ছে ওকে। শিগগিরই রাইড করতে পারব আমি, স্মিত হেসে বলল সে। তোমাদের সাহায্য করতে পারব।
আশপাশে তাকালাম, কাউকে চোখে পড়ল না। জুয়ারেজ, নিউ মেক্সিকোয় যাচ্ছি আমরা।
সি, জানি আমি।
মিম্বার্স ভ্যালি চেনো তুমি?
সি, টানটান হয়ে গেল মেক্সিকানের মুখ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে আমাকে।
ওখানকার জমি কি ক্লেইম করা?
সামান্য দ্বিধা করল সে। সি…বেশিরভাগই ক্লেইম করেছে লোকজন। ঝামেলাও হয়েছে সেজন্যে। তবে উপত্যকাটা বিশাল-হয়তো আমি যেটার কথা বলছি সেটা নয়।
আর লেক ভ্যালি?
সি…চিনি। ওখানেও ঝামেলা হচ্ছে, অ্যাপাচীরা কাউকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না…সাদা মানুষ বা মেক্সরাও রেহাই পাচ্ছে না। মেক্সিকানদের মধ্যে অনেকেই খারাপ, যেমন ফেলিপ জাপাটা।
কি মনে হয় তোমার, ওখানে গিয়ে ঝামেলায় পড়ব? আমরা যদ্দূর জানতাম উপত্যকাটা উন্মুক্ত। কেউ ক্লেইম করেনি-তাই শুনেছি। কিন্তু আসলে উন্মুক্ত নয়, তাই না?
না…সত্যিই ঝামেলায় পড়তে হবে তোমাদের। সেনর, আফসোস হচ্ছে আমার…রাইড করতে পারতাম যদি! সবকিছু সামলাতে ধকল যাচ্ছে তোমার।
ওদিকে কখনও গেছ নাকি-এই ট্রেইল ধরে?
না.. উত্তর দিক থেকে এসেছি আমি। পালানোর ধান্ধায় ছিলাম, আহত হওয়ার পর পানির খোঁজে কঞ্চোর দিকে যাচ্ছিলাম।
বিকেলের দিকে রওনা দিলাম আমরা। জুয়ানিতা পুরুষদের মতই রাইড করছে, ড্রাইভে খাটছে সাধারণ কাউবয়ের মত। বিশাল কালো ঘোড়ায় চড়েছে ও। বিস্ময়কর হলেও, ঘোড়াটা কাটিং-হর্স হিসেবে দক্ষ, যা দরকার ছিল আমাদের।
প্রতিটি লোককে দরকার আমাদের এখন। ধীর গতিতে চলছে গরুগুলো, পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে কিংবা উল্টোদিকে চলে যেতে চাইছে; কিন্তু ওগুলোকে এগোতে বাধ্য করলাম আমরা-টানা তাগাদার মধ্যে রাখতে হলো। সন্ধে গড়িয়ে রাত হলো, থামলাম না আমরা, তারার আলোয় পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছে না-টানা পশ্চিমে এগিয়ে চলেছি। একসময় থামলাম আমরা, কি গরুর দল থামতে চাইছে না, বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছে দেখা গেল না ওদের মধ্যে, অস্থির ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম আমি।
বাবা, ওদেরকে বরং হাঁটার মধ্যে রাখাই ভাল। বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছে নেই ওদের, হয়তো হাঁটবে ওরা।
তো, আবার যাত্রা করলাম আমরা। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছি সবাই। গর্তে বসে গেছে চোখ, কিন্তু থামার উপায় নেই। ধুলোর অত্যাচারে হাঁসফাঁস অবস্থা সবার।
সকাল হওয়ার পরও থামলাম না আমরা। পুব আকাশে সূর্য উঠল অগ্নিবলয়ের মত, গাঢ় টকটকে লাল রঙ। বাতাস স্থির। বিন্দুমাত্র কাঁপন নেই কোথাও। নিঃশ্বাস নেয়া হয়ে উঠল আয়াসসাধ্য। পুরো একটা দিন টানা চলার পর, এবার থামার লক্ষণ দেখা গেল গরুগুলোর মধ্যে, কিন্তু থামলাম না আমরা।
মাঝে মধ্যে পড়ে গেল দু’একটা, এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করলাম না কেউ। ঘোড়ার গতি ধীর হয়ে গেছে, মাঝে মধ্যে থেমে গেল, তারপর মিনিট কয়েকের বিশ্রাম পেয়ে আবার এগোল।
দুপুরের মধ্যে প্রতিটি গরুর পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়ল, বুনো দৃষ্টি ফুটে উঠেছে ওগুলোর চোখে। ডোরাকাটা বলদটা খেপে গিয়ে আক্রমণ করতে এল, কোন রকমে এড়িয়ে গেল ক্লান্ত পর্যুদস্ত পনিগুলো, ওটার পথ থেকে সরে গেল।
থেমে কফি তৈরি করলাম আমরা। রাইডাররা একে একে আসছে ক্যাম্পে। রক্তলাল চোখ সবার, ক্লান্তি এতটাই যে স্যাডল থেকে হেঁচড়ে নামছে। কেউ কেউ পড়েই গেল। তারপরও অভিযোগ করল না কেউ। জুয়ানিতাও রয়েছে এদের মধ্যে। গর্তে বসে গেছে ওর বড় বড় চোখ, কিন্তু আমার উদ্দেশে হাসল ও, ওকে বিশ্রাম নিতে বলায় মাথা নেড়ে নাকচ করে দিল।
আমার কাছে চলে এল অটম্যান। ড্যান, একেবারে পর্যুদস্ত সবাই। ঘোড়াগুলোর অবস্থাই বেশি খারাপ। বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ঠিক আছে…দুটো ওয়্যাগনে সব মালপত্র তুলে ফেলল।
নিজেই ওয়্যাগনের দরজার কাছে চলে এল জুয়ারেজ। আমি রাইড করতে পারব। এখন রাইড় করাই উচিত।
জুয়ারেজ জেদী মানুষ, মানা করলেও শুনবে না। তাছাড়া রাইড করলেই সাহায্য হবে, যদিও নিজের যত্ন করার সুযোগই সে পাবে না।
সব মালপত্র দুটো ওয়্যাগনে ভরা হলো। রদপত্র কমে এসেছে। বাদ পড়া ওয়্যাগনের ঘোড়া অন্য দুটোয় জুড়ে দেয়া হলো।
গরুর খুরের দাপটে ধুলো উঠছে, ভারী করে তুলেছে বাতাস। মাথার ওপর গনগনে সূর্য তপ্ত হক্কা ছড়াচ্ছে, দূরে দিগন্তের কাছাকাছি তাপতরঙ্গ নাচছে, মরীচিকা দেখা যাচ্ছে প্রায়ই। প্রতিটি মাইল এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আরও অস্থির হয়ে উঠছে গরুগুলো, বারবার পেছনে পড়ে যাচ্ছে, খেদিয়ে কিংবা পাছায় চাপড় মেরে পালের সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য করা হলো ওগুলোকে।
মাঝে মধ্যে বয়স্ক গরু পড়ে গেল, ময়দার বস্তার মত ঢলে পড়ল, মারাও গেল তৎক্ষণাৎ। তেষ্টা আর ধুলোর অত্যাচারে গলা জ্বলছে আমাদের, শুকনো খটখটে হয়ে গেছে মুখ, গলার স্বর মিইয়ে এসেছে সবার-তৃষ্ণার্ত গরু পালের ডাকের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু এর কোন শেষ নেই। এগিয়ে চলেছি আমরা, থামার মত জুতসই কোন জায়গা চোখে পড়ছে না।
দুপুরের পর থামতেই হলো। কয়েকটা গরু ঢলে পড়ল, একটা ঘোড়া মারা পড়ল। আকাশ যেন জ্বলন্ত একটা ছাদ, খরতাপ ঢলে পড়ছে জমিনের ওপর। ঘামে জবজব করছে আমাদের দেহ। গরুর পেটের ওপর অদ্ভুত আঁকাবাঁকা চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে ঘামের রেখা।
দুর্ভোগের সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের মেজাজেরও অবনতি ঘটছে। অধৈর্য হয়ে উঠেছে সবাই। যখনই দরকার হলো, অন্যদের সাহায্য করলাম আমি, অন্য যে-কারও চেয়ে দ্বিগুণ ছোটাছুটি করছি, মরিয়া চেষ্টার যেন কোন শেষ নেই। ক্ষার মেশানো ধুলোয় গা চটচট করছে, প্রখর রোদ আর ঘামে কুঁচকে গেছে চোখজোড়া।
অমানুষিক শ্রমের পরও জুয়ানিতাকে ব্যস্ত এবং স্বতঃস্ফুর্ত দেখে সত্যিই বিস্মিত হলাম। অন্য যে-কোন লোকের সমান কাজ করেছে ও, মেয়ে বলে বিশেষ সুবিধা নেয়নি। এমনকি জুয়ারেজও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না, মাঝে মধ্যে ওকে দেখেছি দলছুট গরু খেদিয়ে পালে ঢোকাতে।
ক্লান্ত দিশেহারা গরুগুলো লড়ছে অবসাদ, ক্ষুধা আর তৃষ্ণার সঙ্গে, মাঝে মধ্যে টলমল পায়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কোন কোনটা পড়ে গেল দড়াম করে, কিন্তু ওগুলোকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করলাম আমরা।
পাল ছেড়ে এগিয়ে গেলাম আমি। স্কাউটিং করে ক্ষারে পূর্ণ ওঅটরহোলগুলো খুঁজে বের করতে হবে। ট্যাপ এ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল আমাদের।
হাজারবার মনে হলো, ও সঙ্গে থাকলে কত ভাল হত, হাজারবার বাড়তি একজন লোকের জন্যে আফসোস হলো। পুরো তিনদিন কোন রকম বিরতি ছাড়াই এগিয়ে চলেছি আমরা, এক ফোঁটা ঘুমাইনি কেউ। স্রেফ কফি গিলে স্যাভলে চেপে বসেছি, ঘাম আর ধুলোর অত্যাচারে দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে অর্ধেক। গরুগুলোকে পালের মধ্যে রাখতে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে। এখোনো ছাড়া উপায় নেই। পানিই ওদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এবং পানির কাছে পৌঁছতে হলে এগোতেই হবে।
ডোরাকাটা বলদটা নেতৃত্ব দিচ্ছে এখনও। প্রায় দিশেহারার মত এগোচ্ছে ওটা, অদম্য মনোবল নিয়ে লড়ে চলেছে ক্লান্তির সঙ্গে, যেন আমাদের মরিয়া প্রয়াস আর প্রয়োজন আঁচ করতে পেরেছে ওটা
প্রতিদিনই জ্বলন্ত উনুনের মত তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে সূর্য। ঠাণ্ডা শীতল রাত্রিতেও থামলাম না আমরা। অনেক গরু পড়ে গেল। পা ছড়িয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। মাথা নুয়ে পড়েছে ওগুলোর। এ পর্যন্ত কত গরু খোয়া গেছে?
সময় সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান লোপ পেয়েছে আমাদের। গরুগুলোকে সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, প্রচণ্ড তাপ আর ধুলোর অত্যাচারের মধ্যেও মরিয়া হয়ে ওগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
স্কাউটিঙের সময় মাসট্যাঙ পুল আবিষ্কার করলাম আমি, কিন্তু দেখে হতাশ হলাম। কাদার ওপর সামান্য পানি আছে এ মুহূর্তে। গত কয়েক মাসেও পানি ছিল না এখানে। ফ্ল্যাটরক হোলসের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা হলো, নদীর এপাশে পানির কোন নমুনা চোখে পড়ল না। দূরে, উত্তরে ওয়াইল্ড চেরি হোলস রয়েছে, কিন্তু ভিন্ন রুট ওটা, তাছাড়া ওখানে পানি আছে কিনা সেটাও জানা নেই আমাদের।
ধুধু তাপতরঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেলাম, মনে পড়ল কেন এখানে এসেছি। কেন পশ্চিমে আসে মানুষ? এর আগে কখনও ভাবিনি, যদিও সুউচ্চ পর্বতাশ্রণীর নির্জনতা আর সুনীল আকাশের সাহচর্য যে-কাউকে ভাবুক করে তুলবে।
পশ্চিমে আসতেই হত, আমাদের, নয়তো অন্যদের সঙ্গে জমি ভাগাভাগি করতে হত। হয়তো এই দুর্ভোগের চেয়ে হার আউটফিটের সঙ্গে লড়াই করাই শ্রেয়ঙর ছিল। কিন্তু এই ড্রাইভ কি স্রেফ নতুন একটা ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি? হয়তো অবচেতন মনে পশ্চিমে সুরে আসার ইচ্ছে ছিল আমাদের, নতুন এলাকা দেখার, নতুন জমি জয়ের আনন্দ ভেতরে ভেতরে তাড়া করেছে আমাদের।
রোমাঞ্চ বা অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষ সব সমাজেই থাকে, কিন্তু পশ্চিমা মানুষ স্বভাবগত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। বহু লোককে ভাল জমি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে দেখেছি আমি, ভাগ্য পরীক্ষা করার ইচ্ছে তাদের শেষ হয় না কখনও।
দুবার ক্ষারীয় ওঅটরহোল চোখে পড়ল। সাদা ক্ষারের স্তর জমেছে পানির ওপর, সুপের চেয়েও ঘন, যে-কোন পশু মারা পড়বে এই পানি পান করলে।
এগিয়ে গেলাম আরও। উঁচু একটা জায়গায় উঠে ওপাশে পেকোসের লাগোয়া ঢেউ খেলানো প্রান্তর চোখে পড়ল। সরু রেখার মত গাঢ় একটা ঝিলিক দেখা যাচ্ছে পেকোসের কাছাকাছি। অধীর হয়ে সেদিকে ফিরল ঘোড়াটা। স্যাডল ছেড়ে রুমাল বের করে পানিতে চুবিয়ে ঘোড়ার নাক মুছে দিলাম দু’বার। তারপর ফিরতি পথের দিকে তাকালাম।
পাল থেকে ষোলো কি সতেরো মাইল এগিয়ে আছি আমি।
চোঙাকৃতির একটা পাহাড়ের ওপর থেকে গরুর পালটাকে আসতে দেখতে পেলাম। দৃশ্যটা করুণ, ভয়াবহ এবং হতাদ্যম হওয়ার মত। সবার সামনে বাবা, বরাবরের মতই মাথা উঁচু করে স্যাডলে বসে আছেন, কিন্তু ক্লান্তি, উদ্বেগ বা অস্থিরতা ঢাকতে পারেননি-অন্তত আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে ঠিকই। বিশ ফুট দূরে ডোরাকাটা বলদটা, পঞ্চাশ গজ পেছনে মূল পাল।
ঠিক পেছনে বেন টিল্টন আর জিম মুর। প্রথম দিকের গরুগুলোকে তাগাদার মধ্যে রেখেছে যাতে সঠিক পথে এগিয়ে যায়।
পুরো পালের ওপর ধুলোর আস্তর ছেয়ে আছে, যেন ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে ধুলোর মেঘ। ক্ষারের উপস্থিতির কারণে মেঘটাকে সূর্যের আলোয় দেখাচ্ছে শুদ্র তুষারের মত। গরু, রাইডার আর ঘোড়াকে ঢেকে ফেলেছে…এমনকি ওয়্যাগনও ঢাকা পড়েছে।
পেছনে, ফেলে আসা ট্রেইলে কয়েকটা গরু দেখতে পাচ্ছি-দৃষ্টিসীমায় অন্তত দশ-বারোটা চোখে পড়ল। দুটো পড়ে গেছে, কয়েকটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে হয়তো লুটিয়ে পড়বে।
যাই হোক, শেষপর্যন্ত আসতে পেরেছে গরুর পাল-অন্তত বেশিরভাগ। পাহাড়ী ঢাল ধরে ট্রেইলের দিকে নেমে এলাম আমি।
বাবা, টিকতে পারবে শুধু এমন গরুকে নদীর দিকে নিয়ে যাব আমরা, বাবাকে বললাম। ভাগাভাগি না করে উপায় নেই। যে কটাকে নিয়ে যেতে পারব, বেঁচে যাবে ওগুলো।
থামলাম আমরা। চরম ক্লান্তির পরও কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে বেশিভাগ গরু, কিন্তু ভাগ করে ফেললাম আমরা-সেরাগুলোকে আলাদা করে ফেললাম। বাবার নেতৃত্বে ওগুলোকে নিয়ে তখনই পেকোসের হর্স হেডের দিকে যাত্রা করল মিলো আর গার্ট।
রৌদ্রদগ্ধ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। পশ্চিমাকাশে নেমে গেছে। সূর্য। সোনালী গোলাপের শুভ্রতায় সেজেছে পশ্চিম আকাশ, মেঘের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল সূর্যের শেষ রশ্মি, দীর্ঘ রক্তিম তীর যেন, মেঘের রক্তলাল বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। নিচে বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণীর ধূসর বাদামী শূন্যতা অদ্ভুত মায়া তৈরি করেছে, মেঘের দল ক্ৰমে কাঁধে কাঁধ মেলাচ্ছে, সাদা পেঁজা তুলোর মত বিশাল একেকটা প্রাসাদ উঠে গেছে স্বর্গের দুয়ার পর্যন্ত।
বহুবার এই সৌন্দর্যের কথা শুনেছি, কিন্তু নিজের চোখে এই প্রথম দেখলাম। অপূর্ব সুন্দর। শেষ বিকেলের সৌন্দর্য কখনও এতটা মনোমুগ্ধকর মনে হয়নি আজকের আগে। সামনে হর্স হেড ক্রসিং, কাছাকাছি পবর্তশ্রেণীর খাঁজকাটা চূড়ার ওপর অসীম শূন্যতা, তারওপর মেঘের দলের সঙ্গে বিকেলের সূর্যের আলোকমালা। এত উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, হৃদয়ছোঁয়া দৃশ্য-না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
অটম্যানদের ওয়্যাগনের কাছে চলে এলাম আমি। চালাতে থাকো, ম্যাম, মিসেস অটম্যানকে বললাম। হর্স হেডের আগে থামছি না আমরা!
গম্ভীর, ক্লান্ত মুখে নড করল মহিলা। চাবুক আর মুখ চালিয়ে পরিশ্রান্ত ঘোড়াগুলোকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করল। হাতের চেটো দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছে আমার দিকে তাকাল ফ্রাঙ্ক কেলসি। হাসল। নরক, তাই না, বাছা? জীবনেও এমন দেখিনি!
এগোতে থাকো! এগোলাম আমি। জুয়ারেজ আর জুয়ানিতা আসছে পাশাপাশি তোমরাও, জুয়ানিতার উদ্দেশে বললাম, ভাইকে ধরে রেখেছে সে। পালের ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ো না। পারলে আগে ভাগেই নদীর কাছে চলে যাও।
টকটকে লাল আর গোলাপী আভা বিদায় নিয়েছে আকাশ থেকে, নীল বা নীলচে রঙ গাঢ় হচ্ছে এখন। দূরে পাহাড়শ্রেণীর চূড়ার কাছাকাছি ঘন বেগুনী বর্ণ পেয়েছে আকাশ, বাতাসেও যেন সেই ছোঁয়া। গোধূলি লগ্নে, হর্স হেডের দিকে এগোল ক্লান্ত গরুর দল। চলার গতি খুবই ধীর, জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে, ওগুলোর, মাথা নিচু হয়ে গেছে। বদ্ধ মাতালের মত এগোচ্ছে ওরা, হেলে-দুলে, ছন্দহীন এবং ক্লান্ত চলন।
ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে রাত আর অন্ধকার।
ক্রুদের অবস্থাও যে ভাল বলা যাবে না। চেহারায় ক্লান্তি, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার ছায়া। কোন রকমে স্যাডলে টিকে আছে এরা, রক্তলাল হয়ে গেছে চোখ। কিন্তু তারপরও অদ্ভুত এক স্বপ্নের আকর্ষণ তাদের টেনে নিয়ে চলেছে পশ্চিমে। গরুর চিৎকার নেই, মৃদু স্বরে যোৎ ঘোৎ করে সবসময়, এমনকি তাও করছে না এখন। পড়ন্ত বিকেলের নিস্তব্ধতায় এগিয়ে চলেছে ওরা।
একটা বাছুর পিছিয়ে পড়েছিল। ওটার পাশে চলে এলাম আমি, কয়েল করা দড়ি দিয়ে পাছায় আঘাত করলাম। বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করল না ওটা, ডান ঘোড়াটা ওটাকে মুখ দিয়ে ঠেলা দিতে নড়ার ইচ্ছে দেখা গেল ওটার মধ্যে, টলমল পায়ে এগোল।
অনেক গরু লুটিয়ে পড়েছে। দুবার পড়ে যাওয়া গরুর মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দিলাম কান্টিন থেকে দুটোই উঠে দাঁড়াল। রাতের ঠাণ্ড বাতাসে একসময় কিছুটা হলেও শক্তি ফিরে পাবে ওরা, অনুসরণ করবে আমাদের, কারণ অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
হঠাৎ দমকা বাতাস বয়ে এল পাহাড়ের দিক থেকে, বাতাসে পানির সোঁদা গন্ধ!
যাদুর মত কাজ হলো। ঝট করে মাথা তুলল গরুর দল, দ্রুত এগোল, তারপর হালকা চালে ছুটতে শুরু করল। মিনিট কয়েক পর তুমুল বেগে ছুট লাগাল, রীতিমত স্ট্যাম্পিড় ঘটে গেল। পানির গন্ধ খেয়েছে ওরা, পানির কাছে কে কার আগে পৌঁছা’বে-তাই নিয়ে হিড়িক পড়ে গেছে। কয়েকটা পড়ে গেলেও পানির টানে ঠিক খাড়া হয়ে গেল এবং ছুটতে শুরু করল আবার।
ছুটন্ত খুরের শব্দ কাঁপিয়ে দিয়েছে প্রান্তরের নিস্তব্ধতাকে, যেন গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডাকছে; তারপর হঠাৎ করে নীরবতা নেমে এল। ধুলোর উৎকট গন্ধ ট্রেইলে।
পেকোসের ধারে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে আকাশে তারা ফুটেছে। আগুন জ্বালানো হয়েছে, ওয়াগনগুলো পৌঁছে গেছে।
ঘোড়াটার পা কাঁপছে থরথর করে। হেঁচড়ে স্যাডল ছাড়লাম, মিনিট খানেক ডানের গায়ের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর ধীর ভঙ্গিতে স্যাডল-ব্রিডল খুলে দলাইমলাই করে দিলাম ওটাকে।
আগুনের কাছে এসে রিপোর্ট করল কার্ল। এক রাউন্ড পান করেছে ওরা। পানির কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছি ওদের।
ভাল…সকালের আগে আর পানি দেয়া যাবে না, আগুনের কাছাকাছি বসে স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে ওটা পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। যাই ঘটুক, এটাকে ঝকঝকে কার্যকর অবস্থায় রাখা উচিত।
চারজন লোক পাহারায় থাকবে আজ, বললাম কালকে। একজন ক্যাম্প থেকে দূরে থাকবে; শুনবে, চারপাশে নজর রাখবে। এ পথে প্রায়ই যাতায়াত করে ইন্ডিয়ানরা।
আমার হাতে কফির কাপ ধরিয়ে দিল মিসেস বুচার্ড। গিলে ফেল, বয়, বলল মহিলা! এটা তোমার পাওনা, অর্জন করেছ।
কফি তো অবশ্যই, সঙ্গে খানিকটা আইরিশও মেশানো, চুমুক দিয়ে টের পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে চাঙা বোধ করলাম। রাইফেল পরিষ্কার করে, ওয়্যাগনে গিয়ে আমার ডাফ-ব্যাগটা বের করলাম। পিস্তল দুটো বের করে একটা হোলস্টারে ঝুলিয়ে দিলাম, অন্যটা ভেস্টের পেছনে কোমরে গুঁজে রাখলাম।
আগুনের কাছে এসে বাবাকে দেখতে পেলাম। চট করে আমার হোলস্টারের দিকে তাকালেন তিনি, কিন্তু কিছুই বললেন না।
অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখছে টম জেপসন, শেষে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জানতাম না হ্যান্ডগান চালাও তুমি। ঝামেলা, আশা করছ নাকি
তুমি ক্লান্ত, টম। আজ রাতে খানিকটা ঘুমিয়ে নাও। যাকগে, আমি চাই সব ব্যারেল ভরে ফেলবে তোমরা। এখনই।
এখন? ভুরু কুঁচকে তাকাল জেপসন। মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার? ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে সবাই। এ অবস্থায় তুমি ওদের পানি ভরার জন্যে বলতে…
পারি, এবং বলছি। কাজ শুরু করো, টম-ঘুমানোর আগে সব কটা ব্যারেল ভরবে।
সত্যি তাই করল ওরা।
প্রায় রাত একটার পর ঘুমাতে গেলাম আমি। ধীরে ধীরে শরীর শিথিল করে দিলাম, আড়ষ্ট মাংসপেশীর খিল ছাড়িয়ে, উদ্বেগ আর উত্তেজনার প্রভাব কাটাতে চাইছি শরীর থেকে। ক্লান্তি, দারুণ ক্লান্তি লাগছে-ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর…তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, নিজেও জানি না।
সচেতন হওয়া মাত্র প্রথমে পানির শব্দ শুনতে পেলাম-স্বস্তিকর কুলকুল ধ্বনি। পেকোসের ঝর্না…পানি। চারটে দিন পানির আশায় হন্যে হয়ে ছুটেছে সাড়ে তিন হাজার গরু।
আকাশে ক্ষীণ ধূসর আভা। প্রায় দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, চাঁদ দেখে আন্দাজ করলাম।
গড়ান দিয়ে সিধে হয়ে বসে, মাথায় হ্যাট চাপালাম। সব শান্ত। নিস্তব্ধ। পায়ে বুট গলিয়ে গানবেল্ট ঝুলিয়ে আগুনের কাছে চলে গেলাম।
পেকোসের ধারে দেখা ছায়াঘেরা নদীর উঁচু তীরকে একটু আগে গাছপালা আর ঝোঁপ মনে করেছিলাম। নদী এখানে খোলামেলা-গাছ, গুলু বা ঝোঁপ কিছুই নেই। কেবল অল্প কয়েকটা লতা জাতীয় উদ্ভিদ জন্মেছে।
নদীর তীর বেশ উঁচু, পাড় থেকে পানি ছয় থেকে দশ ফুট গভীর। নদী প্রায় একশো ফুট প্রশস্ত, আর সবচেয়ে গভীর জায়গায় চার ফুট। ওপাশে পাহাড়ী ঢালে, বেলে মাটির জমিতে গ্রিজউড, বেঁটে মেস্কিট আর গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা কিছু ঘাস জন্মেছে।
আগুনের কাছে এসে ঘোড়াকে পিকেট করল কার্ল ক্ৰকেট। স্যাডল ছেড়ে কফির কাপ হাতে বসে পড়ল।
চারপাশ শান্ত•••একেবারে নীরব। গরুগুলো শুয়ে পড়েছে, তবে ক্লান্ত ঘোচেনি ওদের। মাঝে মধ্যে দু’একটা নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু খানিক পরই সজাগ ক্রুদের তাগাদায় ফিরে আসছে।
এখানেই শোবে নাকি?
না।
আমার দিকে তাকাল টিম অটম্যান। মানুষটা চমৎকার। কিন্তু প্রায়ই মনে করে কাজের তুলনায় এখনও বয়স হয়নি আমার। বয়সের ব্যাপারটা কখনোই বড় মনে হয়নি আমার কাছে। বয়স কাউকে বেশি বুদ্ধিমান বা ক্ষিপ্র বানায় না, বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে কেবল অভিজ্ঞতা আর বিচক্ষণতাই বাড়তে পারে। কারও কর্মক্ষমতা, সামর্থ্য বা স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে ওই দুটোর কোন সম্পর্ক নেই।
ক্রসিং পেরিয়ে, নদীর উজান ধরে কয়েক মাইল এগোব আমরা, কাছাকাছি পড়ে থাকা করোটির হাড়ের স্তুপের দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি, ক্রসিঙের উপস্থিতি নির্দেশ করছে ওগুলো। কোমাঞ্চিদের সঙ্গে লাগার কোন ইচ্ছে নেই।
ঘোড়া নিয়ে আমাদের কাছে চলে এল কার্ল ক্ৰকেট, হঠাৎ থেমে গেল। ড্যান…!
অস্বাভাবিক কিছু ছিল ওর কণ্ঠে, ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। ঘোড়সওয়ারদের একটা দল আসছে আমাদের দিকে। চোখ কুঁচকে তাকালাম-ছয় কি সাতজন।
পিস্তল আছে তোমার সঙ্গে, টিম?
হ্যাঁ।
আমার সঙ্গেও আছে, জানাল স্যাম গার্ট।
পেছনে, ক্যাম্পে ক্ষীণ নড়াচড়া শুনতে পাচ্ছি। নদীর দিকে চলতে থাকা গরুর পালের ওপর চোখ বুলালাম, চারজন আছে ওখানে…কিন্তু প্রথম লোকটার কি হলো? আগুয়ান রাইডারদের: দেখেনি সে? নাকি তাকেই খুঁজে বের করেছে অনাকাক্ষিত অশ্বারোহীরা?
কাছাকাছি দেখতে পেলাম জুয়ানিতাকে, ওয়্যাগনের চাকার আড়ালে অবস্থান নিয়েছে।
সবচেয়ে সামনের লোকটার ওপর স্থির হলো আমার দৃষ্টি। দারুণ শক্তিশালী একটা ঘোড়ায় চেপেছে সে, বিশালদেহী। দেখার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলাম-ফেলিপ জাপাটা।
ক্যাম্পের কিনারে এসে দাঁড়াল সে, সতর্ক চাহনি হানল-প্রায় সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখে নিল; লোকটার চোখের দৃষ্টি দেখেই বুঝলাম। যদিও আদপে ঠিক কতটা দেখেছে সে জানি না, কারণ দেখে মনে হবে ঘুমন্ত একটা ক্যাম্পে এসেছে ওরা, সময়টাও তাই। স্রেফ তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আগুনের ওপাশে, আগন্তুকদের কাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে টিম অটম্যানের অবস্থান, আমার আশপাশে বিশ ফুট দূরে স্যাডলে আছে কাল। মাঝখানে আমি, এবং এখানেই থাকার ইচ্ছে আমার।
প্রায় ডজন খানেক দূরে বেভারোলের ওপর পড়ে আছে প্যাটার্সনটা।
মিগুয়েল জুয়ারেজকে খুঁজছি আমি, বলল বিশালদেহী জাপাটা। ওকে তুলে দাও আমার হাতে, তাহলে কোন রকম ঝামেলা হবে না তোমাদের।
এক পা আগে বাড়লাম, পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলাম হাতে। কি বললে, ঝামেলা? ঝামেলা হবে না বলতে কি বোঝাতে চাইছ? মিস্টার, এই আউটফিটের কাউকে যদি চাও তুমি, তাহলে সবাইকে নিতে হবে। ঝামেলার শেষ নেই আমাদের, তোমার কাছে যা আছে দিয়ে যেতে পারো
সতর্ক চাহনিতে আমাকে দেখছে সে, মুখ দেখেই বুঝলাম সে ভাবছে কথাগুলোর কতটা ব্লাফ আর কতটা সত্য। দেখো, সেনর, তুমি বোধহয় পরিস্থিতি ঠিক বুঝতে পারোনি, পেছনে ইঙ্গিত করে বলল সে। প্রচুর লোক আমার মাত্র কয়েকজন এসেছে এখন। মহিলা আছে তোমাদের সঙ্গে, সম্ভবত ঝামেলা বা বিপদ না হলেই ভাল তোমাদের জন্যে।
বলে যাও, ইচ্ছে হলে হাজারবার বলতে পারো, শান্ত স্বরে বললাম। কিন্তু তোমাদের মতই তৈরি আছি আমরা। এ পর্যন্ত ড্রাইভ নিয়ে আসতে বেগার খাটুনি গেছে আমাদের, একেবারে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। তুমি যদি সত্যিই ঝামেলা করতে চাও, আপত্তি নেই। ঝামেলা দিতে গেলে বিনিময়ে ভোগান্তি বা দুর্ভোগ, বিশ্বাস করো, বিস্তর দিতে পারব আমরা। দেরি করার দরকার নেই, শুরু করে দাও।
জাপাটার লোকজনকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করতে দেখে বাধা দিল কার্ল ক্ৰকেট। দাঁড়াও! যেখানে আছ ওখানেই দাঁড়াও, নইলে গুলি শুরু করব আমি! শীতল স্বরে বলল সে। গোলাগুলি যদি হয়ই, তোমাদের সবাইকে একসঙ্গে, কাছাকাছি চাই আমরা।
আমার ওপর থেকে দৃষ্টি সরায়নি জাপাটা, মনে মনে আমাকে খুন করতে চাইছে কিনা কে জানে, কিন্তু তৈরি আছ আমি
মনে যাই থাকুক, দ্রুত সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলল সে, সম্ভবত স্যাম গার্টের কারণে। বিশাল বপুকে তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম, ড্যান, আলাপী সুরে বলল গার্ট। ওর ডানের লোকটাকে চাই আমি।
দৃষ্টি সামান্যও নড়ল না জাপাটার, কালো গোঁফের নিচে পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসল ঠোঁটজোড়া। স্যামকে দেখেনি ওরা, এমনকি আমিও জানি না ঠিক কোথায় অবস্থান নিয়েছে সে। আমাদের তিনজনকে দেখতে পাচ্ছে ওরা…কিভাবে নিশ্চিত হবে যে আরও কয়েকজন লুকিয়ে নেই?
সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়, তাই স্যাম গার্টের সঙ্গে পরামর্শ চালিয়ে গেলাম আমি। স্যাম, একটা দারুণ ব্যাপার ভুলে গেছ। নদীর পাড়ে ছেলেরা আছে না? আমার তো মনে হয় তুমি আর ওরা মিলে বেশ কিছু চাদির চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে।
পরিস্থিতি পছন্দ হচ্ছে না জাপাটার, এক ফোঁটাও নয়। নদীর তীরে কেউ আছে কিনা, জানা নেই ওর, সেটা পরখ করতে গিয়ে বিপদে পড়ার চিন্তাও ভাল লাগছে না তার। সে জানে, গরুর ২ঙ্গে অবশ্যই লোক থাকবে, ওদের আগে থেকে আসতে দেখলে সত করে দেবে অন্যদের, নদীর উঁচু তীরের কাছাকাছি অবস্থান নিতে পারে-বেচাল দেখলে কচুকাটা করে ফেলবে ওদের।
বেশি লোক নিয়ে আসিনি বলে আফসোসই হচ্ছে, আড়ষ্ট হাসি ফুটল জাপাটার ঠোঁটে। আর যখন আসব, তখন অনেক লোক থাকবে আমার সঙ্গে আমি কিছু বন্ধুও থাকবে-কোমাঞ্চি। তোমরা বরং এই ফাঁকে জুয়ারেজকে বের করে দিতে পারো ক্যাম্প থেকে।
পেছনে একটা কবর ফেলে এসেছি আমরা, মনে করিয়ে দিলাম ওকে। এক মেক্সিকানকে পেয়ে গোর দিয়েছিলাম।
ফের হাসল জাপাটা। কৌশলটা মন্দ নয়…কিন্তু আমি সাবধানী মানুষ কিনা, তাই কবর খুঁড়ে দেখলাম। কারও লাশ ছিল না। ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে, তারপর ধীর গতিতে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেল।
আমরা সবাই জানি, আবার আসবে সে। হয়তো শিগগিরই। তখন যে ঝামেলা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বেশ, এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই, দ্রুত ঘোষণা করলাম। নাস্তা সেরে ঝটপট রওনা দেব।
রাতে বেশ কয়েকটা বলদ আর গাভী নদীর কাছে যেতে সক্ষম হয়েছে, পরে আবার ফিরেও এসেছে। ড্রাইভে মোট কত গরু খোয়া গেল গোনার উপায় নেই, ফুরসতও নেই এখন, তবে আন্দাজ করা যায় কয়েকশো গরু হবে।
এগোলাম আমরা। মোটামুটি একই গতিতে এগিয়ে চলেছি। দুপুরে পানি পান করার জন্যে পেকোসে থামলাম, পাহাড়শ্রেণীর লাগোয়া ট্রেইল ধরে সমান্তরালে এগোচ্ছি এখন। মাঝে মধ্যে পাহাড়ে উঠে গিয়ে চারপাশে নজর চালাচ্ছে ক্রুদের কেউ, শত্রুর উপস্থিতি আগেই টের পাওয়ার ইচ্ছে। কখনও কখনও পেছনে চলে গিয়েও অপেক্ষায় থাকলাম।
মাটি শুকনো খটখটে, বেশিরভাগ জায়গায় সাদা স্যালাইনের মত আবরণে ঢাকা-ক্ষারের অবশেষ। যেখানেই পানি ছিল, জমি বা মাটি সাদা হয়ে আছে, যেন তুষার জমেছে।
পিছিয়ে পড়ে আমার পাশে চলে এলেন বাবা। সংখ্যায় নিতান্তই কম আমরা, ড্যান, বললেন তিনি। পঞ্চাশ-ষাটজন লোক নিয়ে ফিরে আসবে ওরা।
জীবন্ত কোন কিছু চোখে পড়ছে না। এখানে-সেখানে মরা গরু পড়ে। আছে। শুকনো হাড় আর চামড়ার সংস্করণ, নেকড়ে বা অন্য কোন প্রাণী হামলা করেনি মৃত গরুর ওপর। এর মানে পরিষ্কার-এমনকি নেকড়েও এই এলাকায় থাকে না।
রাত হয়ে গেল, তখনও কোন ঘাস চোখে পড়েনি, তাই নিচু একটা টিলার কাছাকাছি ওয়্যাগনগুলো জড়ো করলাম আমরা, ঠিক পেছনেই রয়েছে সব গরু।
কাছাকাছি বনে প্রিকলি পিয়ার রয়েছে। গরুর জন্যে ঘাসের বিকল্প হতে পারে। জিনিসটা সঁাাতে ও ভেজা বলে পানির চাহিদা অনেকটা মিটে যাবে। প্রায় দশ-বারোজন বনের ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমরা, প্রিকলি পিয়ারের কাটা ছেটে ফেললাম। মশাল জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাঁটা না থাকায় সাগ্রহে প্রিকলি পিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল গরুর দল।
সকালে, বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ধুলোর মেঘ উঠল। মাথার ওপর পুরো আকাশ ভরে গেল, ধুলোর ঘূর্ণি ছুটে গেল জমিন ধরে। সূর্য যেন আগুনের বলয়, ধুলোর মেঘ ঢেকে ফেলেছে। পেছনে দমকা বাতাস নিয়ে এগিয়ে চলেছে গরুর পাল, পেকোসের প্রায় সমান্তরালে, তবে একেবারে কাছেও নয়, কারণ কাছে থাকলেই বাঁক আর উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিতে হবে।
রাতে ধুলো থিতিয়ে এল বটে, কিন্তু বাতাস অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা মনে হলো। বড়সড় একটা টিলার পেছনে ওয়্যাগন থামিয়ে ক্যাম্প করলাম আমরা।
কার্ল ক্ৰকেট সবার সাথে আগুনের কাছে গিয়ে বসল। এমা বুচার্ডকে রান্নায় সাহায্য করছে। খাবার বলতে গেলে নেই তেমন, খোড়া কয়েকটা বলদ জবাই করেছি আমরা, কিছু মাংস শুকিয়ে রাখা হয়েছে। আটা প্রায় শেষ এবং গুড় নেই একটুও।
স্যাম গার্ট এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গড়িয়েছে ওর, বড়বড় বিষণ্ণ চোখে আমাদের নিরীখ করল। কলোরাডো যাওয়ার পথে ক্যানাড়া নদীর তীরে কাটানো একটা রাতের কথা মনে পড়ছে। এমন ধুলো ঝড়ে পড়েছিলাম যে সূর্যও দেখা যাচ্ছিল না। প্রেয়ারি কুকুরগুলো দূরে থাক, নিজেদেরকেও ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিলাম শিখার দিকে, খানিকটা উষ্ণতার আশায়, মনে মনে বেশ কয়েকটা ব্যাপারে ভাবছি। ট্যাপ চলে যাওয়ার পর বাবা পুরোপুরি আমার ওপর নির্ভর করছেন; কিন্তু এ পর্যন্ত নির্ভার হওয়ার মত কিছুই করতে পারিনি। এই গরুগুলোই আমাদের শেষ সম্বল, অথচ পালের অবস্থা মোটেও সুবিধের নয়। ফেলিপ জাপাটা আর কোমাঞ্চেলরদের সঙ্গে সম্ভাব্য একটা লড়াই রয়েছে হাতে, দেখা হওয়া মাত্র মরণপণ লড়াই করতে হবে, অথচ ওদের তুলনায় আমাদের লোকজন নিতান্তই অল্প।
ইতোমধ্যে কয়েকশো গরু হারিয়েছি আমরা। আর হারানো যাবে। জুয়ানিতা বা জুয়ারেজের কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে-জায়গার জন্যে এই দুর্ভোগ, গন্তব্যে আমাদের জন্যে রয়েছে। অনিশ্চয়তা এবং বিপদের সম্ভাবনা। ভয়াবহ ঝামেলায় পড়ে যেতে পারি।
রসদপত্র প্রায় ফুরিয়ে গেছে, শিকার করারও সুযোগ নেই। বুনন পশু এখানে থাকলেও দূরে চলে গেছে কোন কারণে। শুধু একটা কাজই করার আছে আমাদের-গরু দলকে সামনে নিয়ে যাওয়া।
ঘোড়ার ব্যাপারে সন্তুষ্ট আমরা, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছে ওগুলো। হর্স হেড পর্যন্ত আসতে আসতেই বেশিরভাগ ঘোড়া মারা যায় নয়তো ইন্ডিয়ানরা চুরি করে নিয়ে যায়; কিন্তু এ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি। বেশিরভাগ লোকের ড্রাইভের সঙ্গে পায়ে হাঁটার কথা, এখন স্যাডলে চড়ছি আমরা। এ মুহূর্তে, কেনল এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র কাজ, কারণ দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজটাও লেগে থাকলে সম্পন্ন করা যায়, কিন্তু আমার অনেকবারই মনে হয়েছে চলার মধ্যে থাকলে কখনও কখনও সমস্যার সমাধানও হয়ে যায়।
ফেলিপ জাপাটাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। কঠিন, বেপরোয়া মানুষ। ধূর্ত এবং জেদী। আবার আসবে সে। মওকামত চেপে, ধরবে আমাদের। কোমাঞ্চেরা বা পেলো ডিউরো ক্যানিয়ন সম্পর্কে কেউ আলাপ-আলোচনা করুক চায় না ওরা, ওই ক্যানিয়নের ধারে-কাছেও কাউকে দেখতে অনিচ্ছুক; ইতোমধ্যে জাতভাইদের সামলাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
যতটা সম্ভব পালের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করব আমরা, স্যামকে বললাম আমি। শিগগিরই ডেলাওয়ারে পৌঁছতে হবে।
পানি আর স্বল্প সময়ের বিশ্রামের ফলাফল সত্যিই বিস্মিত করেছে আমাকে। দারুণ চটপটে মনে হচ্ছে গরুর পালকে। ঘাস প্রায় ছিলই না, কিন্তু প্রিকলি পিয়ারের মধ্যে চাহিদার যোগান খুঁজে পেয়েছে এরা, এগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোন সমস্যাই হলো না, বলা যায় স্বেচ্ছায় এগোচ্ছে। যেন ওরা কোন ভাবে টের পেয়ে গেছে দীর্ঘ ড্রাইভের সবচেয়ে কঠিন অংশ পেছনে ফেলে এসেছে। সুদূর শুনেছি বা জানি, আমি অন্তত নিশ্চিত নই।
গরুগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে এগোতে বাধ্য করলাম, দু’পাশে রয়েছে ওয়াগনগুলো। স্যাম গার্ট আর ফ্রিম্যান স্কায়ার পেছনে রয়ে গেছে, পিছিয়ে পড়া বা রয়ে যাওয়া গরু নিয়ে আসবে; পাশাপাশি স্কাউটিঙের কাজও করবে। বাবা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মাঝে মধ্যে পাল ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছেন, অ্যাম্বুশ বা ট্র্যাকের খোঁজে রেকি করছেন। অন্যরা, যতটা সম্ভব পালকে ছোট করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
টোয়াহ্ ক্রীক শুধু নামেই ক্রীক, তলায় চকচকে বালি দেখতে পেলাম আমরা। বছরের অন্য সময়ে হয়তো পানি থাকে, কিন্তু এখন নেই। সুতরাং এগিয়ে চললাম আমরা। চলার পথে পরিত্যক্ত বা ভাঙা ওয়্যাগন থেকে কাঠ সগ্রহ করলাম, যেহেতু ট্রেইলের ধারে-কাছে বাফেলো চিপস আর মেস্কিট ছাড়া জ্বালানি হিসেবে ব্যরহার করার জন্যে কিছুই নেই। মেস্কিট বা বাফেলো চিপসগুলো বেশিরভাগই মাটি খুঁড়ে বের করতে হলো।
শীতল পরিবেশ বদলে তেতে উঠল, খরতাপে পুড়তে শুরু করল মাটির ওপর সবকিছু। গরুগলো পরস্পরের গা ঘেঁষে থাকায়, ওদের শরীর থেকেও যে-ভাপ বেরোল, সেটাও সহ্য করার মত নয়।
ঘোড়া দাবড়ে আমার পাশে চলে এল জুয়ানিতা।
জুয়ারেজের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, খানিক দ্বিধার পর বলল ও। তুমি আমাদের না বাঁচালে এতক্ষণে হয়তো খুন হয়ে যেতাম।
এমন কিছু নয় ওটা।
কিন্তু এটুকুও আশা করিনি আমরা, জুয়ারেজ তো নয়ই…মেক্সিকান বলেই কারও কাছ থেকে কোন রকম সহায়তা আশা করে না ও।
কারও কারও কাছে হয়তো কথাটার গুরুত্ব আছে, কিন্তু আমাদের কাছে নেই। প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম আমরা।মানে বাবার কথা বলছি-প্রতিবেশী মেক্সদের সাহায্য না পেলে বাবা বখনোই টিকতে পারতেন না।
তোমাদের ড্রাইভের ব্যাপারেও পরামর্শ করেছি আমরা। একটা জায়গার কথা জানি-খুব ভাল জায়গা। ইন্ডিয়ানদের হামলার ভয় আছে বটে, কিন্তু পশ্চিমের কোন জায়গাই বা নিরাপদ? সবখানে ইন্ডিয়ান হামলার আশঙ্কা আছে।
জায়গাটা কোথায়?
দেখিয়ে দেব। পাদ্রীরা যাতায়াত করত ওদিকে। ব্যবসায়ীরাও যেত। পানি, ঘাস সবই প্রচুর আছে। আমার তো ধারণা ওখানেই বসতি করতে পারো তুমি। ইন্ডিয়ান আক্রমণ ছাড়া কোন ঝামেলা হওয়ার কথা নয়।
তোমরা কি করবে-যাবে কোথায়?
বাড়ি যাব। মিগুয়েলের মা আর বউ আছে। স্ত্রীর কথা তো বলেনি ও! আমি তো ভেবেছি হয়তো তুমি আর ও…
না, সেনর, ও বিবাহিত। একসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা, ভাইবোনের মত। ভাল বন্ধু বলতে পারো আমাদের। জুয়ারেজ বা ওর মা, দুজনেই ভালমানুষ…ওর বউয়ের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক আমার।
ট্যাপ আর আমার মত। কখনোই সমস্যা হত না আমাদের মধ্যে।
প্রায় সারাটা দিন একসঙ্গে রাইড করলাম আমরা, এটা-সেটা নিয়ে কথা বললাম। গরুর পাল টানা এগিয়ে চলেছে। রাত নামার আগে প্রায় বারো মাইল পেছনে ফেলে এলাম।
ধুলো ঝড়ে হয়তো আমাদের ট্র্যাক মুছে যাবে। বিরাট স্বস্তির ব্যাপার। কিন্তু এ ধরনের এলাকায় মানুষ মাত্রই পানির উৎসের খোঁজে থাকে, থাকতে বাধ্য হয়, তাই একবার ট্র্যাক হারিয়ে ফেললেও পানির উৎসের কাছে এলে হারানো ট্র্যাক ফিরে পাওয়া সম্ভব।
পেকোসের কিনারে এটাই আমাদের শেষ বিরতি। ড্রাইভের উত্তরের কিনারায় দায়িত্বে রয়েছে চার্লি হীথ। এখান থেকে অনায়াসে ডেলাওয়ারের দিকে চলে যেতে পারব।
সন্ধের আগে আগে একটা অ্যান্টিলোপ শিকার করে ক্যাম্পে ফিরে এল হীথ। এত মানুষের তুলনায় সামান্য মাংস, কিন্তু স্রেফ রুচি বদলের সুযোগ হলো বলেই কৃতজ্ঞ সবাই।
পালের কোন গরু জবাই করার ইচ্ছে নেই আমাদের। নতুন ভাবে শুরু করতে প্রতিটা কমবয়েসী গরু দরকার হবে আমাদের, আর বলদগুলো সেনাবাহিনী বা অন্য কারও কাছে বেচে দেব। গরু বিক্রির টাকা রসদপত্র কিনতে লাগবে-পুরো একটা বছর কাটাতে হবে। আমরা নেহাতই গরীব মানুষ, গরুর পাল আর জনবলই আমাদের ভরসা। মূলধন।
সে-রাতে আগুনের পাশে এসে বসলাম সবাই। কাট্টহ্যান্ডদের ক্লান্ত মুখে নেচে বেড়াচ্ছে আগুনের শিখার প্রতিফলন। পরস্পরের কাছ ঘেঁষে বসেছি আমরা। জানা সব গান গাইলাম, গল্প করলাম বিভিন্ন বিষয়ে-তবে শিকার আর ভ্রমণের গল্পই হলো বেশি। ভেতরে ভেতরে হয়তো উদ্বেগ বা অনিশ্চয়তার দোলায় ভুগছি সবাই, কিন্তু পেকোস অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছি আমরা-যে-কোন লোকের জন্যে এটা বিরাট এক স্বস্তি।
ক্যাম্পের আলোয় দুলছে ওয়্যাগনের ছায়া। মিসেস অটম্যান এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। জুয়ানিতার সোনালী চুলে আগুনের ছোপ লেগেছে, মাথা নাড়তে ঝিকিয়ে উঠল মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলাম, বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওর দিকে…আহ, এত সুন্দর ও!
রোজিটা জেপসনও এসেছে, স্বামীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে ও; তবে একটা কথাও বলেনি। একেবারে নীরব হয়ে, আছে মহিলা। ট্যাপের সঙ্গে তিক্ত ওই ঘটনা প্রায় সবাই ভুলে গেছে, রোজিটাকে কেউই তিরস্কার বা ভৎর্সনা করেনি, কারণ আমাদের চেয়ে আর বেশি কে জানবে যে মানুষের মন আসলে সবচেয়ে দুর্বল এবং স্পর্শকাতর জায়গা?
বাবাও আছেন আমাদের মধ্যে, চুপচাপ শুনছেন সবার গল্প। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বয়স কয়েক বছর কমে গেছে। নতুন একটা জায়গা খুঁজে নেব আমরা, এক ফাঁকে বললেন তিনি। বসতি করব। টি-বারকে নিয়ে যেন গর্ব করতে পারি, এমন আউটফিট তৈরি করব আমরা।
প্রায় সবার মধ্যে নতুন ভাবে আশা জেগে উঠছে, স্বপ্ন দেখছে সবাই; কিন্তু একইসঙ্গে শঙ্কিতও। আমরা জানি, অনিশ্চিত ভাগ্য, ভবিষ্যৎ বা শত দুর্ভোগের পরও, কোমাঞ্চি আর কোমাঞ্চেরোদের হামলার হুমকি খড়গের মত ঝুলে আছে মাথার ওপর। যে-কোন সময় আক্রমণ করতে পারে ওরা।
উঠে দাড়ালাম আমি, জুয়ানিতার দিকে তাকাতে দেখলাম সেও উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে আমার পাশে চলে এল ও, আগুনের কাছ থেকে সরে এলাম আমরা। ওয়্যাগনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জুয়ারেজ, ওর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তিনটা শব্দে শুভেচ্ছা জানাল সে; ‘ভায়া কন ডিয়োস’।
ফ্রিম্যান স্কয়ার ঘুম থেকে জাগাল আমাকে। ঝটপট উঠে বসে মাথায় হ্যাট চাপালাম। সবুকিছু শান্ত…আকাশে তারা নেই, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ, ভারী বাতাসে সোঁদা গন্ধ। গায়ে বুট গলিয়ে পিস্তল দুটো তুলে নিলাম। গানবেল্ট কোমরে জড়িয়ে অন্যটা বেল্টের পেছনে গুঁজে রাখলাম।
রাইফেলের দিকে হাত বাড়ালাম, তখনই পাহাড়ের কাছে তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পেলাম। সেকেন্ড কয়েক পর তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে এল-বুনো উন্মাদনায় যুদ্ধ ঘোষণা করল একদল কোমাঞ্চি। ছুটন্ত ঘোড়া রাতের নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে ছুটে আসছে ক্যাম্পের দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল গরুর পাল-ছুটতে শুরু করল। স্ট্যাম্পিড ঠেকাতে মরিয়া হয়ে গরুর দিকে ছুটে গেল ফ্রিম্যান স্কয়ার, কিন্তু হোঁচট খেল ঘোড়াটা। মাটিতে ভূপতিত হলো সে। উন্মত্ত গরুর দল ছুটে গেল ওর ওপর দিয়ে।
ফ্রিম্যানের জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই। চট করে এক হাঁটু গেড়ে বসলাম আমি, গুলি শুরু করলাম।
ক্যাম্পে ঢুকে পড়া এক কোমাঞ্চিকে গুলি করলাম প্রথমে, স্যাড়ল থেকে খসে পড়ল সে। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম গড়ান দিয়ে বিছানা থেকে সরে গেলেন রাবা, শটগানের ট্রিগার টিপলেন!
মুহূর্তের মধ্যে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা-পিস্তল আর রাইফেল গর্জে উঠছে, কমলা আগুন ওগরে দিচ্ছে, রক্তলাল ঝলক ছুটে যাচ্ছে রাতের অন্ধকার ভেদ করে!
ওয়াগনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কার্ল ক্ৰকেট, সমানে গুলি করছে সিক্সশূটার থেকে। ঘোড়া ছুটিয়ে ওকে পিষে ফেলার চেষ্টা করল এক ইন্ডিয়ান। কিন্তু সুবিধে করতে পাল্প না। ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কোমাঞ্চিকে খামচে ধরল সে, তারপর এক লাফে ইন্ডিয়ানের পেছনে, পনির পিঠে চেপে বসল। অন্ধকারে ছুটে গেল ঘোড়াটা, পিঠে দুই সওয়ার নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে দারুণ ব্যস্ত।
ধূসর ঘোড়ায় বিশালদেহী এক লোক ছুটে গেল পাশ দিয়ে-সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে চিনতে পারলাম। ব্লন্ড চুল লোকটার। ওয়েব হর্নারের সঙ্গে ছিল সে।
কোত্থেকে ছুটে এসে আমার কাঁধে ধাক্কা মারল একটা ঘোড়া, তৎক্ষণাৎ ভূপতিত হলাম, মুখের সামনে ধুলো চটকাল একটা বুলেট।
গড়ান দিয়ে উঠে বসলাম আমি। দেখলাম হাঁটু গেড়ে বসে গুলি করছেন বাবা। মুখে রক্ত লেগে আছে ওঁর, কিন্তু এত ধীর-স্থির ভাবে এবং ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করছেন যেন শূটিং গ্যালারিতে অনুশীলন করছেন। মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বেন টিল্টন, দেখলাম হঠাৎ করেই উঠে বসে নতুন অবস্থানের দিকে খিচে দৌড় মারল জিম মুর, গুলির তুবড়ি ছুটছে ওর আশপাশ দিয়ে।
আচমকা বাড সাটক্লীফকে দেখতে পেলাম, ক্যাম্পে চার্জ করেছে সে,, বাবার উদ্দেশে গুলি করছে। হোলস্টার থেকে পিস্তল তুলে নেওয়ার সময় দেখলাম বুলেটের ধাক্কায় চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন বাবা। পরমুহূর্তে সাটক্লীফের বিশাল বুকের ছাতি ফুটো হয়ে গেল আমার গুলিতে। স্যাডল থেকে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল সে, ঘোড়াটা তুফান বেগে ক্যাম্প পেরিয়ে গেল। গোড়ালির ওপর আধ-পাক ঘুরলাম আমি, উঠতে উদ্যত হওয়া সাইক্লীফের মাথায় নিশানা করলাম এবার, কোমরের কাছ থেকে করলাম গুলিটা। কাটা কলা গাছের মত দড়াম করে আছড়ে পড়ল সে, ধীর ভঙ্গিতে গড়ান খেয়ে চিৎ হলো শরীরটা।
যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনি শেষ হয়ে গেল লড়াই। অখণ্ড নীরবতা নেমে এল চারপাশে।
একটা ওয়াগনের ছাদে আগুন জ্বলছে, দেখেই পানি ভরা বালতি তুলে নিয়ে আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। এক লাফে উঠে পড়লাম ওয়্যাগনে, জ্বলন্ত ক্যানভাসের কিনারা ধরে ফ্রেম থেকে টেনে ছিড়ে ফেললাম। পুরো ক্যানভাস খুলে আসার পর মাটিতে ফেলে ঠেসে ধরলাম, বুট দিয়ে মাড়ালাম। তীক্ষ্ণ শব্দে পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা সীসা, ওয়্যাগনের পাটাতনে বিঁধল। ঝটপট মাটিতে শুয়ে পড়লাম আমি, স্থির হয়ে পড়ে থাকলাম।
গরুর পাল উধাও হয়ে গেছে। ফ্রিম্যান স্কয়ারমৃত, সম্ভবত বেন টিল্টনেরও একই পরিণতি হয়েছে।
কিছুই নড়ছে না। কোন শব্দ নেই। অন্ধকারে শুয়ে থেকে সিক্সশূটারে তাজা শেল ঢোকালাম আমি, প্যাটার্সনের খোঁজে আশপাশে তাকালাম।
ধারে-কাছে অন্ধকারে অস্কুট গোঙানি শুনতে পেলাম, তারপর নীরব হয়ে গেল সব। ধুলো উড়ছে বাতাসে, নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে ধুলো। গায়ে আড়ষ্ট ব্যথা অনুভব করছি। হাতের তালুতে পিস্তলের বাঁটের স্পর্শ স্বস্তি আর নির্ভরতা এনে দিল শরীরে। পেছনে নদীর কুলকুল ধ্বনি কানে আসছে, কিন্তু এছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
ধারে-কাছেই আছে ওরা, জানি আমি। নড়লেই খুনী বুলেট ছুটে আসবে।
জুয়ানিতার কি হয়েছে? মিসেস অটম্যানের ভাগ্যে কি ঘটল? বাবা কোথায়?
দূরে মেঘের গুড়গুড় শব্দ হলো…রাতটা নিঃশব্দ আর শূন্যতায় ভরা। দমকা হিমেল বাতাস বয়ে গেল, ছড়িয়ে দিল ক্যাম্পের জ্বলন্ত কয়লাকে, একটা কাপ কাৎ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
সন্তর্পণে মাটিতে হাতের তালু রেখে, হাতের ওপর ভর করে ধীরে ধীরে শরীর তুললাম। উঠে বসলাম এরপর, পিছিয়ে গাঢ় অন্ধকারে চলে এলাম। কয়েক মুহূর্ত পর আরও দুই গজ পিছিয়ে এলাম।
বজ্রপাত হলো ধারে-কাছে..নীল বজ্র চিরে গেল ঘন অন্ধকার। আবার বজ্রপাত হলো, এবং পরপরই বৃষ্টি শুরু হলো। প্রচণ্ড বৃষ্টি। মাত্র কয়েক মিনিটেই তৃষিত ধুলোময় জমির উষ্ণতা ছাপিয়ে গেল, স্যাতস্যাঁতে এবং ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।
আবার যখন বজ্রপাত হলো, নীলচে রূপালী আলোয় বাবাকে চিৎ হয়ে পড়ে থাকতে দেখতে পেলাম। মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে, তারপর মেঘের গর্জন ভেসে এল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।
৫. তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে গেলাম
তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে গেলাম আমি, একটু আগে যেখানে বাবাকে দেখেছি।
মারা গেছেন তিনি। দুটো গুলি বিঁধেছে শরীরে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।
বাবার পাশে পড়ে থাকা রাইফেল তুলে নিয়ে এক ছুটে কাছের ওয়্যাগনের আড়ালে চলে এলাম। পাটাতনের তলায় অবস্থান নিলাম। অন্য কেউ বেঁচে আছে কিনা জানি না, কিন্তু বাবা মারা গেছেন; সব গরু হারিয়েছি আমরা, সব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে; এবং এই প্রথম নিজের ভেতর তীব্র ঘৃণা আবিষ্কার করলাম আমি।
ওয়্যাগনের নিচে, আংশিক আশ্রয়ে থেকে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলাম। জাপাটা আর ওর লোকেরা কি করবে এখন? যুক্তি আর সহজাত প্রবৃত্তি বলছে পালানো উচিত আমার, সকাল হওয়ার আগেই কেটে পড়া উচিত, যদি ভুল না করে থাকি, নির্ঘাত ওয়্যাগন লুট করার জন্যে ফিরে আসবে কোমাঞ্চেরোরা।
আর ক’জন মারা গেছে? কেউ কি গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছে? যদি তাই হয়, ওদেরকে খুঁজে বের করা উচিত। যে-কোন বিচারেই হোক, এ মানুষগুলোর কাউকে কোমাঞ্চিদের অসহায় শিকার হওয়ার জন্যে রেখে যেতে পারি না আমি।
সতর্কতার সঙ্গে ভেজা পিস্তল মুছলাম। প্যাটার্সনটা ধারে-কাছে কোথাও পড়ে আছে, তবে ওটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না এখন, কারণ বাবার ব্রীচ-লোডিং শার্পসটা এখন আমার হাতে। বাবার কাছে যে শটগান ছিল, ওটাও নিশ্চই পড়ে আছে কোথাও।
ঝড় বন্ধ হয়নি। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, পেকোসের দুই কুল ছাপিয়ে উঠবে পানিতে। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কারও বাইরে থাকার কথা নয়, সম্ভবত আমাদের শত্রুরাও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে এখন, যদি চেনা কোন আশ্রয় থেকে থাকে ওদের; কিংবা আমাদের গরুর পালের পিছু নিয়েছে, নিঃসন্দেহে বলা যায় পালের দখল নেবে ওরা।
আচমকা, মাথার ওপর ওয়্যাগনের ভেতর ক্ষীণ নড়াচড়া টের পেলাম। দূরে মেঘের গর্জন হলো, বজ্রপাত হলো আবারও। নীল বিদ্যুতের আলোয় নদীর পাড়ে, বড়জোর বিশ গজ দূরে দুটো কাঠামো চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলাম।
টিম অটম্যান আর ওর বউ!
অন্তত দু’জন বেঁচে আছে। আর…ওয়্যাগনে কে আশ্রয় নিয়েছে? নিঃসন্দেহে আমাদের একজন, কিন্তু নিশ্চিত বলা যায় কি? এমনও হতে পারে কোন কোমাঞ্চি, লুট করার ধান্ধায় উঠে পড়েছে ওয়্যাগনে।
সন্তর্পনে ওয়্যাগনের তলা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। বৃষ্টির সুচাল ফোঁটা গায়ে খোঁচা মারছে যেন, মুখে চিমটি কাটার মত অনুভূতি হচ্ছে। ওয়্যাগনের ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার, বাইরের অপেক্ষাকৃত আলোর বিপরীতে আমার কাঠামো নিশ্চই পরিষ্কার ফুটে উঠবে।কিন্তু ভেতরে কে আছে, জানতেই হবে। সুতরাং ঝুঁকিটা নিতে মনস্থ করলাম। অটম্যানরা আসছে, কোন ভাবেই ফাঁদে পড়তে দেয়া উচিত হবে না ওদের।
চাকার অনুভূমিক স্পোকের ওপর একটা পা রেখে, বাম হাতে ওয়্যাগনের কিনারা চেপে ধরে শরীর টেনে তুললাম, তারপর শরীর বাঁকিয়ে পাশ থেকে হঠাৎ ওয়্যাগনের ভেতরে উঁকি দিলাম।
অস্ফুট স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করল কেউ।
জুয়ানিতা?
ড্যান! ওহ্, ড্যান! বেঁচে আছ তুমি!
টিকে আছি কোন রকমে। তুমি ঠিক আছ তো?
হ্যাঁ, কিন্তু এই লোকটা আহত হয়েছে। গুলি লেগেছে।
ঝুঁকি নিয়ে দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালাম। স্যাম গার্ট। চাদিতে দীর্ঘ একটা আঁচড় কেটে চলে গেছে বুলেট, কাঁধ থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নিয়েছে। দৃশ্যত, ওয়্যাগনে শুয়ে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে, চাদির চামড়ায় আঁচড় কেটে কাঁধের ওপরের অংশে গিয়ে আঘাত করেছে তপ্ত সীসা। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে, এছাড়া মোটামুটি সুস্থ, সে।
টানা বৃষ্টি হচ্ছে, ওয়্যাগনের ক্যানভাসে বৃষ্টির ভোতা কিন্তু জোরাল শব্দ ছাপিয়ে আগুয়ান কারও পদশব্দ শুনতে পেলাম, একটু পর মিসেস অটম্যান আর টিম উঠে পড়ল ওয়্যাগনে।
মাথা চেপে ধরে উঠে বসল স্যাম, চারপাশে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে।
এবার বোধহয় বাতি জ্বালানো যেতে পারে, বললাম আমি। চলে গেছে ওরা, নইলে দেয়াশলাই জ্বালানোর পর আমার লাশ ফেলে দিত।
মোমবাতি জ্বেলে বাড়তি কার্তুজের খোঁজে ওয়্যাগনে তল্লাশি চালালাম।
এই যে, তোমার রাইফেল, প্যাটার্সনটা এগিয়ে দিল টিম অটম্যান। আসার পথে খুঁজে পেয়েছি।
শার্পসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। প্যাটার্সটা মুছে, কার্তুজ বের করে তাজা বুলেট ঢোকালাম।
শুধু কি আমরাই বেঁচে আছি? প্রায় বিলাপের সুরে জানতে চাইল মিসেস অটম্যান। অন্যদের খবর জানো?
বাবা মারা গেছেন। স্কয়ার বেচারা স্ট্যাম্পিড ঠেকাতে গিয়ে পিষ্ট হয়েছে খুরের নিচে। বেন টিল্টনকে পড়ে থাকতে দেখেছি।
জিম মুর নদীর পাড় ধরে নেমে গিয়েছিল। নদীতে ডুবে মারা গিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে ও।
ওয়্যাগনে গাদাগাদি অবস্থায় বসে সকালের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা। লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। আর যাই হোক, পানির কোন ঘাটতি হবে না এখন। একটা গরু খুঁজে জবাই করতে হবে, নিরুদ্দিষ্ট একটা খুঁজে পেতেই হবে। আর যেভাবেই হোক রিও গ্রান্ড বা কপার মাইন পর্যন্ত পৌঁছতে হবে আমাদের।
খাবার নেই, এটাই দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ। অন্য ওয়্যাগনে খাবার ছিল। আগুনে নষ্ট না হলেও বৃষ্টিতে নিশ্চই নষ্ট হয়ে গেছে এখন। যদিও আমার প্রত্যাশা হয়তো কিছু খাবার পাব, তবে পরিমাণ নিতান্ত অল্প।
ঘোড়া নেই আমাদের, গরুর পালের সঙ্গে ওগুলোও পালিয়েছে। হয় চুরি হয়েছে, নয়তো ছড়িয়ে পড়েছে। ওগুলোর দু’একটাকে যে ধরতে পারব এমন সম্ভাবনা কম। সামনে কেবলই অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ আর কষ্টকর মৃত্যুর হাতছানি। এরচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কেউ কল্পনাও করতে পারে না; অথচ সঙ্গে মহিলা আছে আমাদের।
পুরো দায়িত্বই আমার। এরা আমাদের লোক, আমাদের হয়ে কাজ করেছে; বাবা মারা যাওয়ায় স্বভাবতই পুরো দায়িতু এখন আমার। এ অবস্থায়, সব গরু হারানোর পরও দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না আমি। এখন বরং যে-কোন সময়ের চেয়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দরকার, অনিশ্চয়তায় ভরা এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হবে-খাবার আর ঘোড়া যোগাড় করতে হবে; এবং একটা আশ্রয় খুঁজে পেতে হবে।
ভেতরে ভেতরে গভীর শঙ্কা বোধ করছি, যেহেতু এমন ভয়াবহ এবং অসহায় পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি। মন জুড়ে ব্যর্থতার আশঙ্কা, আর ব্যর্থতা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু…সবাই না হলেও আমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের জন্যে।
সারারাত ধরে বৃষ্টি হলো। পেকোসের দু’কুল ছাপিয়ে উঠেছে, কাছাকাছি সব অ্যারোয়োও ভরে গেছে। পশ্চিমে যাওয়ার পথে একাধিক বাধা তৈরি হয়ে গেছে। তবে সূর্য ওঠার পর অনেক অ্যারোয়ো শুকিয়ে যাবে, বালিময় তীর পানি শুষে নেবে। শুধু প্রাকৃতিক কিছু টিনাজায় পানি থাকবে।
মেঘের কম্বল মুড়ি দেওয়া ধূসর গম্ভীর আকাশের পেছন থেকে উদিত হলো সূর্য। বৃষ্টি ধরে এসেছে কিছুটা, কাছাকাছি, বজ্রপাত হচ্ছে না এখন। দূরে গুয়াডালুপে পর্বতশ্রেণীর আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনি তুলছে বজ্রপাতের গম্ভীর শব্দ।
আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর মাটিতে পা রাখলাম। গায়ে স্লিকার চাপিয়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালালাম।
ভেজা মাটি গাঢ় রঙ ধারণ করেছে, পুরো ক্যাম্প কর্দমাক্ত হয়ে আছে। আকাশে ভারী মেঘের আনাগোনা। ভরা যৌবন ফিরে পেয়েছে পেকোস-গাঢ় রঙের পানিতে স্রোত উঠেছে। বাবার শরীর তুলে নিয়ে ওয়্যাগনের কাছে ফিরে এলাম, ওয়্যাগনের তলায় রেখে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম।
ক্যাম্পের কিনারে বাড সাইক্লীফের লাশ পড়ে আছে। নদীর তীরে পড়ে আছে আরেকটা লাশ-অপরিচিত লোক কোমাঞ্চেরোদের একজন। বেন টিল্টনের লাশ তুলে নিয়ে এসে বাবার পাশে রাখলাম।
যে-কোন কিছু করার আগে ঘোড়া দরকার আমাদের, কিন্তু দৃষ্টিসীমায় চোখে পড়ল না। মরা একটা ঘোড়া পড়ে আছে কাছাকাছি। এগিয়ে গিয়ে ওটার পিঠ থেকে স্যাডল ছাড়িয়ে নিলাম, ব্রিডল খুলে ওয়্যাগনে এনে রাখলাম।
ওয়্যাগন থেকে নেমে এসেছে টিম অটম্যান। তুমি আর মিসেস অটম্যান সাহায্য করতে পারো, ওকে বললাম, ওয়্যাগন খুঁজে দেখো খাবার কিছু পাওয়া যায় কিনা। ক্যান্টিন, বেড়িং, অস্ত্র বা কার্তুজ, যাই পাবে সংগ্রহ করো।
নড করল সে, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে। আমাদের শেষ করে দিয়েছে ওরা, ড্যান। একেবারে ফকির বানিয়ে দিয়েছে।
অত হতাশ হয়ো না। প্রথমে কপার মাইনে যাব আমরা, তারপর দেখব কি করা যায়। বাবার কাগজপত্র, টালি-বুক বা ওরকম কিছু খুঁজে পেলে আমার জন্যে আলাদা করে রেখো।
স্যাম গার্টও নেমে এসেছে। অসুস্থ এবং ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওকে, কিন্তু স্মিত কৌতুকের হাসি উপহার দিল আমাকে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে আমাদের। পারবে তো, ড্যান?
চারপাশে খোঁজ চালালাম আমরা। জিম মুরের পাত্তা নেই, হয় ডুবে গেছে নয়তো নদীর স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাকে।
একটা ব্যাপার সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা, বাচ্চাদের প্রসঙ্গ তুলছি না কেউ। টিমের দুই ছেলে এবং বুচার্ডের বাচ্চারা। ক্যাম্পে হামলার পর এদের কাউকে দেখেনি কেউ, কিন্তু রাতে পাহারা দেয়ার জন্যে জেগে ওঠার পর ওদেরকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি আমি।
স্যাম গার্টের সঙ্গে নদীর তীর ধরে এগোলাম আমি। ট্র্যাক যদি কিছু পড়েও থাকে, বৃষ্টিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এতগুলো মানুষের বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক, কিন্তু এ পর্যন্ত কোন মৃতদেহ চোখে পড়েনি আমাদের-এটাই স্বস্তি এবং প্রত্যাশার ব্যাপার।
দুজনে আলাদা হয়ে গেলাম আমরা। একটু পর ওর চিৎকার শুনতে পেলাম। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে সে, পায়ের কাছে কি যেন দেখছে। ওখানে যাওয়ার পর দেখলাম, কিছু লাইমস্টোনের ডোবার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।
সামনের মাটিতে বড়সড় গুহার মত গর্ত তৈরি হয়েছে, গর্তের ব্যাসার্ধ অন্তত ত্রিশ ফুট। গার্টের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গর্তের দিকে তাকালাম, গুহার গাঢ় অন্ধকার মুখ চোখে পড়ল।
কেউ আছ নাকি? ডাকল স্যাম।
বিস্ময়কর হলেও সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া এল। গুহার কিনারায় এসে দাঁড়াল মিলো ডজ। তোমার গলা শুনলাম, বলল সে। ঠিক আছ তো তোমরা?
বাচ্চাদের দেখেছ?
আমার সঙ্গে আছে ওরা। এমা বুচার্ডও আছে এখানে।
ধীরে ধীরে গুহা থেকে উঠে এল বাচ্চারা। সবার শেষে মিসেস বুচার্ডের পিছু পিছু মিলো ডজ বেরিয়ে এল।
ফ্রাঙ্ক কেলসি মারা গেছে। সারারাত কষ্ট পেয়েছে বেচারা, সকালেই মারা গেল। দুটো গুলি বিধেছিল…একটা পেটে।
বাবা আর টিল্টন মারা গেছে, বললাম আমি।
প্রথম হামলার সময় বাচ্চাদের নিয়ে এদিকে চলে আসে মিসেস বুচার্ড। জায়গাটা আগেই দেখেছিলাম আমি, দ্রুত ওদেরকে এখানে রেখে বেরিয়ে গেলাম। দুটো গুলি লাগিয়েছি, কিন্তু যাঁকে লাগাতে পারলে সবচেয়ে শান্তি পেতাম, ওটাই মিস্ হয়েছে।
মানে? মিলো ডজের চোখে বিতৃষ্ণা দেখে বিস্ময় বোধ করছি।
কার কথা বলছ?
চার্লি হীথ! ওদের সঙ্গে ছিল সে। ক্যাম্পে হামলার সময় বাড সাটক্লীফের পাশে দেখেছি ওকে। একটা গুলি করেছিলাম ওকে।
ওয়েব হর্নারের সঙ্গে ট্যাপের গানফাইটের কথা মনে আছে? চার্লি যদি ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে থাকে, তাহলে অন্তত একটা ঘাপলা পরিষ্কার হয়ে যায়-আচমকা দু’জনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ওরা, মনে আছে? হীথ নিশ্চই সতর্ক করে দিয়েছিল ওদের।
হীথের সঙ্গে এটা আমার ব্যক্তিগত লড়াই, শীতল সুরে বলল মিলো। ওই লোকটাকে চাই আমি!
তাহলে আমার আগেই ওকে পাকড়াও করতে হবে তোমার, বলল স্যাম গার্ট। ওই ব্যাটাকে কখনোই পছন্দ হয়নি আমার।
সবাই একত্রিত হলাম আমরা। বিধ্বস্ত, পরাজিত, ক্লান্ত, হতোদ্যম কিছু মানুষ।
টিম অটম্যান, মিলো ডজ, স্যাম গার্ট এবং আমি…তিনজন মহিলা। পাঁচটা বাচ্চা। অটম্যানের ছেলে দুটোর বয়স চোদ্দ আর দশ, এমা বুচার্ডের মেয়েটার বয়স তেরো বছর, আর দুই ছেলের বয়স নয় এবং এক বছর।
সবার আগে, বললাম আমি। এই গুহায় আশ্রয় নেব আমরা, মিলল। তারপর, ঘোড়ার খোঁজে বেরোব পুরুষরা, মেয়েরা তখন বাচ্চাদের নিয়ে গুহায় থাকবে। আমার মনে হয় না সব ঘোড়া নিয়ে গেছে ওরা কিংবা তাড়িয়ে দিতে পেরেছে; সেজন্যেই চারপাশে চক্কর মেরে দেখা উচিত। ছড়িয়ে পড়া দু’একটা ঘোড়া ক্যাম্পেও ফিরে আসতে পারে।
ব্যবহার করা যাবে, এমন যা কিছু রয়েছে ওয়্যাগন থেকে নামিয়ে ফেললাম আমরা, তবে খুঁটিনাটি এবং সহজে বহন করা যাবে এমন জিনিসই নিয়েছি। বিছানা, রান্নার তৈজসপত্র, কার্তুজ গুহায় স্থানান্তর করলাম। সামান্য যে খাবার ছিল তাও সরিয়ে নেয়া হলো।
স্যামের সঙ্গে বেরোলাম আমি, দুজনের হাতেই দড়ি রয়েছে। মিলো আর টিম অন্য দিকে গেছে। দুর্ভাগ্য যে ঝড়ের পর কোন ট্র্যাকই নেই, তবে ঠিক করে নিয়েছি বেশিদূর যাব না আমরা; কোমাঞ্চিদের ব্যাপারে সতর্ক থাকছি, কয়েক মাইলের মধ্যে যদি কিছু খুঁজে না পাই, তাহলে ফিরে আসব।
রীজের দিকে চলে এসেছি স্যাম আর আমি। কর্দমাক্ত ঢালু জমি উঠে গেছে রীজের চূড়ায়। প্রায় গোলাকার ওটার মাথা; বেশ কিছু সোপইড, প্রিকলি পিয়ার, এবং মেস্কিট রয়েছে। দূরে ঘোড়ার মতই একটা অবয়ব চোখে পড়ল, বলদও হতে পারে-দূরত্বের কারণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
ওই যে, আরেকটা আঙুল তুলে দেখাল স্যাম। চলো! ধরি ওদের!
পশু দুটোর দিকে এগোলাম আমরা, প্রায় আধ-মাইল যাওয়ার পর কাঠামো পরিষ্কার হলো-ঘোড়া নয় বলদ। ডোরাকাটা বলদটা। আমাদের পালের লীডার।
কখনও বলদের পিঠে রাইড করেছ, ড্যান?
হ্যাঁ-বাচ্চা বয়সে। আমার মনে হয় না এটার পিঠে রাইড করতে পারবে কেউ।
হয়তো, হিসেবী দৃষ্টিতে বলদটার দিকে তাকাল স্যাম গার্ট। শেষ দিকে কিন্তু পোষা হয়ে এসেছিল এটা, এমন আচরণ করত যেন ও আর আমরা মিলে গরুর পাল সামলাচ্ছি। চলো যাই, আগে ধরি ওকে।
তো, এগোলাম দুজনে। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের দেখতে পেল বলদটা। ঝট করে মাথা তুলল, দুই শিংয়ের দূরত্ব আট ফুট; হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে এল ওটা, মাথা নিচু করে রেখেছে, শিং দুটো সামনের দিকে ঝুঁকে আছে যেন লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত। সাধারণত কোন অশ্বারোহীকে আক্রমণ করে না ওরা, অথচ সেই একই লোককে বাহনহীন অবস্থায় পেলে হামলা করতে দ্বিধা করবে না। অশ্বারোহীর সঙ্গে লড়াই করা যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই সহজ মাটিতে দাঁড়ানো লোকের বিপক্ষে।
কাছাকাছি চলে এল ওটা। এদিকে নিচু কোমল স্বরে ওটার সঙ্গে কথা বলছি, আমি। চোখ বড়বড় করে আমাদের দিকে তাকাল ওটা, মাথা তুলল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য পশুটা যেদিকে দেখেছি, সেদিকে এগোলাম। আয়, ব্যাটা! তুই আমাদের সঙ্গে আছিস এখনও।
অবিশ্বাস্য হলেও, সত্যি সত্যি এগোল ওটা, বাধ্য বিশাল একটা কুকুরের মত। আমরা যা করছি নির্দ্বিধায় তাই করছে-থামলে ওটাও থামছে, আবার চলা শুরু করলে ওটাও এগোচ্ছে।
মালপত্র চাপানো যাবে ওর পিঠে, আশান্বিত স্বরে বললাম। সেটাও বিরাট স্বস্তি। মালপত্র আমাদের নিজেদের বইতে হবে না।
চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
তারপরই চমৎকার ঘটনাটা ঘটল।
মেস্কিটের ওপাশে রয়েছে অন্য পশুটা-ঘোড়া বা বলদ। কয়েক পা এগিয়ে মোড় ঘুরতে ওটাকে দেখতে পেলাম। নিচু একটা, খাদে ঘাস নিয়ে ব্যস্ত আমার ডান ঘোড়াটা। ওটার সঙ্গে আরও দুটো ঘোড়া রয়েছে। একটা বে পনি, অন্যটা পেইন্ট।
ডানটাকে ডাক দিলাম, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করল না ওটা। ফাস তৈরি করে ছুঁড়ে মারলাম। এড়ানোর জন্যে মাথা নিচু করল ওটা, সরে গেল কয়েক পা; তবে গলায় ফাঁস পড়া মাত্র স্থির হয়ে দাঁড়াল; মনে হলো ধরা পড়ায় যেন কৃতজ্ঞ বোধ করছে। ঘোড়া বা কুকুর, স্বভাবের কারণেই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। সামাজিক পশু বলা যায় ওদের। মানুষের জন্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু এবং নিঃসঙ্গ সময়ের স্বস্তিকর সঙ্গী। অন্য কোন প্রাণী এ যোগ্যতা রাখে না।
হ্যাকামোর লতা সগ্রহ করে লাগাম হিসেবে চালিয়ে নিলাম, তারপর ডানের স্যাডলে চড়লাম। মিনিট কয়েক চেষ্টা করার পর পেইন্টটাকে ধরে ফেললাম। বাড সাটক্লীফের মৃত ঘোড়া থেকে সংগ্রহ করা ব্রিডল ওটাকে পরাল স্যাম গার্ট-তারপর চড়ে বসল পেইন্টে।
তৃতীয় ঘোড়াটাকে ধরতে সময় লাগল বটে, কিন্তু দুই সঙ্গীকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক নয় ওটা। যতই এড়িয়ে যাক, দূরে সরে যায়নি ওটা। দুই ঘোড়ায় চড়ে ক্যাম্পের দিকে যাত্রা করলাম আমরা, দেখলাম পিছু পিছু আসছে ওটা। মিনিট কয়েকের মধ্যে ওটার গলায় ফাস পরিয়ে ফেলল স্যাম।
টিম বা মিলোর ভাগ্য আমাদের মত সুপ্রসন্ন হয়নি। খালি হাতে ফিরেছে ওরা। তবে তাজা ট্র্যাক দেখেছে, বৃষ্টির পরের-গরু এবং ঘোড়া, দুটোরই।
রাতটা গুহায় কাটালাম আমরা। লবণ মেশানো শুয়োরের মাংস আর মটরশুটি দিয়ে সাপার করলাম।
এই গুহাটা অনেক বড়, মন্তব্য করল টিম অটম্যান। মনে হচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। কেন্টাকির লাইমস্টোন এলাকায় ছিলাম আমি, বিশ্বাস করো, কয়েক মাইল দীর্ঘ এরকম গুহা প্রচুর আছে ওখানে। মাটির নিচে মাইলকে মাইল ছড়িয়ে পড়ে।
সকালে সামান্য জিনিসপত্র যা ছিল, সব নিয়ে বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে। বাচ্চা আর মহিলারা পর্যায়ক্রমে ঘোড়ায় চড়ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার, পিঠের বোঝাকে সহজ ভাবে নিয়েছে বলদটা। বুড়ো এই মসিহর্নটা সত্যিই বিস্মিত করেছে আমাদের। স্পষ্টত, মানুষের উপস্থিতি বা সঙ্গ উপভোগ করছে ওটা। জুয়ানিতা বা বাচ্চারা ওটাকে বিস্কুট এবং গুড় মেশানো কর্ন খেতে দিয়েছে, সেজন্যেই যে এত খাতির তা বলা যাবে না।
নিরুদ্যম অনিশ্চিত যাত্রা, তবে শুরু তো হয়েছে। বাবা আর অন্যদের কবর দিয়েছি আমরা। ফ্রিম্যান স্কয়ারের শরীরের অবশিষ্টাংশ যা খুঁজে পেয়েছি, তাই গোর দিয়েছি সসম্মানে। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা মার্কার দেওয়া সম্ভব হয়নি, একটা মার্কারে কাজ চালিয়ে নিয়েছি।
কার্ল ক্ৰকেট, জিম মুর কিংবা জেপসনদের কোন খবর নেই। শেষ যখন কার্লকে দেখেছিলাম, এক ইন্ডিয়ানের স্যাডলে চেপে মরণপণ লড়াই করছিল, ছুটে ক্যাম্প পেরিয়ে গেছে ঘোড়াটা। হয়তো বন্দী হয়েছে ও, কিংবা অক্ষত অবস্থায় ইন্ডিয়ানকে কায়দা করে ফেলেছে। যাই হোক, আশপাশে অন্য কোন মৃতদেহ খুঁজে পাইনি আমরা, ঘোড়ায় চড়ে চারপাশে বেশ খানিকটা রেকি করেছি।
এগিয়ে চললাম আমরা। সন্ধেয় ডেলাওয়ার ক্রীকের বাকের কাছাকাছি এক জায়গায় ক্যাম্প করলাম। একসময় বোধহয় ক্যাম্প করেছিল কেউ এখানে, বামে প্রচুর কাঠ পড়ে আছে; পরিত্যক্ত একটা ওয়াগনও রয়েছে। দুটো চাকা নেই ওটার।
ক্রীকের পাড়ে বেশ ঘাস রয়েছে, খুব বেশি না হলেও, গত কয়েকদিনে তাও চোখে পড়েনি। প্রমাণ সাইজের কিছু মেস্কিটও রয়েছে।
সূর্য ডুবে যাওয়ার পরপরই একটা অ্যান্টিলোপ শিকার করল স্যাম গার্ট, সাপারে ওটার মাংস খেলাম আমরা। পেকোস ছাড়ার পর এই প্রথম ভাল এবং পর্যাপ্ত খাবার জুটল।
রাতে পাহারায় থাকছি আমরা, নিশ্চিত ভাবে বলা যায় কোমাঞ্চেরোদের সঙ্গে দেখা হবে আবার। এবার আর অসতর্ক অবস্থায় ওদের মোকাবিলা করতে চাই না। তৈরি থাকতে চাই। প্রায় মাঝরাতের দিকে দূরাগত খুরের শব্দ শুনতে পেলাম-ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কিন্তু ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে, অন্ধকারে থামল ঘোড়াটা।
ডানটা হেষাধ্বনি করল, উত্তরে ডেকে উঠল ঘোড়াটা, আরও এগিয়ে এল। জুয়ানিতার বিশাল কালো ঘোড়া ওটা।
জুয়ানিতাকে জাগালাম আমি, দ্রুত ব্যাখ্যা করলাম। বেডরোল ছেড়ে উঠে পড়ল ও, আগুনের কিনারে গিয়ে ঘোড়াটাকে ডাকল। দ্রুত এগিয়ে এল কালো রোয়ান, এসেই জুয়ানিতার হাত শুকতে শুরু করল যেন চিনি বা অন্য কিছু আছে ওর হাতে। স্প্যানিশ ধাঁচের স্যাডল-ব্রিডল চাপানো ওটার পিঠে, উঁচু ক্যান্টল; আমি অন্তত এত উঁচু ক্যান্টলে অভ্যস্ত নই। স্ক্যাবার্ডে একটা রাইফেল ঝুলছে, স্যাডল-ব্যাগ ফুলে-ফেঁপে-আছে। নিশ্চই ভেতরে কিছু আছে।
স্যাডল-ব্যাগ খুলল জুয়ানিতা। কার্তুজ আর বাকস্কিনের তৈরি থলেয় স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল।
এগুলো কাজে লাগবে আমাদের, মুদ্রার থলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল ও।
জুয়ারেজের প্রসঙ্গ আসেনি, কিন্তু জুয়ানিতার আড়ষ্ট মুখ বা চেপে বসা চোয়াল দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজেকে সামলে রাখতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে ওর। জুয়ারেজের দেহ খুঁজে পাইনি আমরা, ক্যাম্পে হামলার পর কেউ তাকে দেখেওনি।
দৃশ্যত, বিশাল ঘোড়টাকে দখল করেছিল কোমাঞ্চেরোরা। রাইডও করেছিল, কিন্তু কোন ভাবে রাইডারকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছে ঘোড়াটা, তারপর ফিরে এসেছে আমাদের কাছে।
কোন লোকই সুবিধে করতে পারে না ওর সঙ্গে, ব্যাখ্যা করল জুয়ানিতা। আমাকে ছাড়া কাউকে সহ্য করে না ওটা, এমনকি কোন মহিলাকেও নয়। কেউ হয়তো সাময়িক ভাবে চড়তে পারে, কিন্তু ঘোড়াটা সুযোগ পাওয়া মাত্র পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলবে তাকে।
পশ্চিমে এগোতে থাকলাম আমরা। মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঠেছে আবার। খরতাপে তেতে উঠছে জমিন..ঘাসের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে, জ্বালানির ঘাটতিও পড়েছে। পুরুষরা হাঁটছি আমরা..ইন্ডিয়ানদের চিহ্ন চোখে পড়েনি এ পর্যন্ত।
তৃতীয় দিন মরুভূমিতে একটা ষাড় খুঁজে পেয়ে ওটাকে শিকার করলাম। সম্ভবত কোন ওয়াগন ট্রেন থেকে পিছিয়ে পড়েছিল ওটা কিংবা নিরুদ্দেশ হয়ে পড়েছিল বহু আগে। মেস্কিটের বীচি খেয়ে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে উঠেছে ওটা। মাংস কেটে বেশিরভাগই সংগ্রহ করলাম ভবিষ্যতের জন্যে। সেদিনের সাপারটা দারুণ হলো। বহুদিন পর পেট পুরে খাওয়ার সুযোগ হলো।
দিগন্তে গুয়াডালুপে পর্বতশ্রেণীর চূড়াগুলো আবছা ভাবে চোখে পড়ছে। গরুর পাল বা ওয়্যাগন নেই। পায়ে হাঁটছি আমরা, তারপরও বেশ দ্রুত এগোচ্ছি। জুয়ানিতার ঘোড়াটা পাওয়ার পর প্রথমদিন ষোলো মাইল এগিয়েছি, সেদিন অবশ্য শুকনো খটখটে জায়গায় ক্যাম্প করতে হলো।
সূর্য ওঠার আগেই রওনা করলাম। সবার আগে পাশাপাশি এগোচ্ছি আমি আর স্যাম গার্ট। মাঝখানে বাচ্চা আর মহিলারা-ঘোড়ায় চড়েছে সবাই-শেষে মিলো ডজ এবং টিম অটম্যান।
মরুভূমিতে তাপতরঙ্গ নাচছে, বালিঝড় ছুটছে বালির সমুদ্র বরাবর, শয়তানের উন্মত্ততার সঙ্গে যার তুলনা করা যায়। একটা চ্যাপারাল মুরগীকে হঠাৎ দেখতে পেলাম, আমাদের পাশাপাশি এগোল কিছুক্ষণ। চারপাশে ছোটখাট পানির ডোবা চোখে পড়ছে-বৃষ্টির সময় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে, তলা ফেটে চৌচির। প্রায় সব ক্যান্টিনই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, আর ষাঁড়ের শুকনো মাংস ছাড়া কোন খাবার নেই আমাদের সঙ্গে।
মাটি শক্ত, পাথুরে, মাঝে মধ্যে লাইমস্টোনের আস্তর চোখে পড়ছে। নিচু পাহাড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পশ্চিমে গুয়াডালুপে পর্বতশ্রেণীর নীলাভ সবুজ শরীর আহবান করছে আমাদের। সন্ধের আগে ছোট একটা উপত্যকায় ক্যাম্প করলাম আমরা। বেশ ঘাস আছে এখানে। কিছু গাছ ছাড়াও তিনটা ঝর্না আছে, যার একটার পানিতে গন্ধকের তীব্র ঘ্রাণ; আরেকটার পানি প্রায় সোডার মত, কিন্তু তৃতীয়টায় স্বচ্ছ টলটলে বিশুদ্ধ পানি।
মিসেস অটম্যানকে স্যাডল ছেড়ে নামতে সাহায্য করল টিম, মুহূর্ত খানেক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকল ওরা, প্রবল নির্ভরতায় টিমের বাহু চেপে ধরেছে মহিলা। রোদ আর বাতাসের অত্যাচারে কিছুটা রোদপোড়া বা লালচে রঙের আড়ালে ফ্যাকাসে এবং পাণ্ডুর দেখাচ্ছে মুখটা। একটা গাছের নিচে গেল ওরা, ক্লান্ত দেহে বসে পড়ল মিসেস অটম্যান।
বাচ্চারা ছড়িয়ে পড়েছে-কাঠ আর গরুর চিপস খুঁজছে আগুন জ্বালানোর জন্যে। গাছের ছায়ায় সবগুলো ঘোড়াকে নিয়ে গেল স্যাম গার্ট।
স্যামের সঙ্গে কথা বলছি, এসময় আমাদের সঙ্গে যোগ দিল টিম অটম্যান। আমার মিসেস খুব ভাল অবস্থায় আছে তা বলা যাবে না। কিছু খাবার আর পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেলে ওকে হয়তো চিরতরে হারাতে হবে।
ঠিকই বলেছ, টিম, বললাম আমি। মনে হচ্ছে এখান থেকে যাত্রা করার আগে কিছু মাংস যেভাবেই হোক যোগাড় করতে হবে।
এটা অ্যাপাচী এলাকা, জানাল মিলো ডজ। সুতরাং চোখ-কান খোলা রেখো।
শেষপর্যন্ত ঠিক হলো আমি একাই যাব, অন্য তিনজন আশপাশে থাকবে-সতর্ক নজর রাখবে। টিম অটম্যানের বড় ছেলেকে একটা রাইফেল দেয়া হয়েছে, উঠতি বয়সের তরুণ সে, গায়ে-গতরেও বেশ তাগড়া হয়ে উঠেছে। ঘোড়া আর মেয়েদের চারপাশে অবস্থান নিয়ে পাহারায় থাকল ওরা।
দুটো পিস্তলই সঙ্গে নিয়েছি, প্যাটার্সটা পুরো লোডেড। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। দু’বার র্যাটলার চোখে পড়ল, ওগুলোকে এড়িয়ে গেলাম।
বিকেল একেবারে শান্ত, স্থির হয়ে আছে যেন। মরুভূমির নিচু এলাকায় ছায়া ঘনাচ্ছে, দূরের পর্বতমালায় কোমল ফিকে লাল রঙের সঙ্গে বিকেলের বেগুনী রঙের ছোপ লেগেছে। আশপাশে কোথাও ডেকে উঠল একটা কোয়েল…মিনিট খানেক পর, উত্তর দিল আরও একটা। এগুলো নীল কোয়েল, বলতে গেলে উড়েই না। কিন্তু ছুটতে পারে দারুণ গতিতে। আকারে বড়জোর পায়রার চেয়ে বড় হবে।
দু’বার থামলাম। হতে র-হাইডের তৈরি স্ট্রিং। বাছুরের পা বাঁধার জন্যে এগুলো ব্যবহার করে কাউবয়রা। খরগোশের ট্র্যাক চোখে পড়ার পর কয়েকটা ফাঁদ তৈরি করলাম।
কিন্তু ফাঁদে কিছু আটকায়নি। সন্ধের দিকে একটা কোয়েল শিকার করলাম। ফিরতি পথে ক্যাম্পের দিকে এগোলাম, শুধু কোয়েলটাই একমাত্র শিকার। ভোরে ফাদগুলো পরখ করতে গিয়ে দেখলাম বিশাল একটা জ্যাকাস খরগোস ধরা পড়েছে। ওটার মাংস পুরোটাই বাচ্চা আর মহিলাদের জন্যে বরাদ্দ করা হলো।
সকালে আবার যাত্রা করলাম আমরা। গুয়াডালুপের চূড়াগুলোকে যে-কোন সময়ের চেয়ে উঁচু মনে হচ্ছে এখন, উত্তরের প্রেয়ারিকে দেখাচ্ছে অবারিত গাঢ় রঙের এক বিস্তৃত প্রান্তর। সেদিন দুবার পড়ে গেল টিম অটম্যান। আমাদের মধ্যে ওই বয়স্ক। প্রতিবারই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর হাঁটতে শুরু করল আবার।
মাত্র কয়েক মাইল পর সেদিন ক্যাম্প করলাম আমরা। ওক আর পাইনের আড়ালে এক চিলতে জায়গা, পেছনে পাহাড়ের চূড়া যেন হামলে পড়েছে আমাদের ওপর।
ঝপ করে মাটিতে বসে পড়ল টিম অটম্যান, ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে। মিলল আর স্যাম মেয়েদের নামতে সাহায্য করল, তারপর ঘোড়ার স্যাডল-ব্রিডল খুলে যত্ন নিল। ক্যাম্প করার আগেই প্যাটার্সন হাতে শিকার করতে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
ভেতরে ভেতরে সত্যিই শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। পুরো একটা দিন খাবার ছাড়া কেটেছে পুরুষদের, গত চার-পাঁচদিন যাও বা মুখে দিয়েছি প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম ছিল। টিম আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, প্রায় সারাটা জীবনই স্যাডলে কেটেছে ওর। অথচ কুপার মাইন এখনও বহুদূরের পথ।
জেদ, মনোবল বা স্বপ্নও এখন আর ওদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। যদি খাবার যোগাড় না করতে পারি, হয়তো বেশিদূর এগোতে পারব না আমরা।
কয়েকবার হরিণের লাদি চোখে পড়ল, কিন্তু সবই অনেকদিন আগের। হরিণ দূরে থাক, ট্রাকও চোখে পড়েনি। জাপাচী এলাকা বলেই, নিশ্চিত না হয়ে গুলি ছোড়ার ইচ্ছে নেই আমার।
শান্ত বিকেল। ঘাম জমেছে কপালে, শার্টের ভেতর বুকে গড়িয়ে পেটের দিকে নেমে যাচ্ছে, ঘামের ধারা। আকাশ সুনীল, মেঘ নেই কোথাও। অদ্ভুত কোন কারণে টানটান হয়ে আছে স্নায়ুগুলো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, দেখতে যাচ্ছি না। তাই সতর্কতার সঙ্গে এগোলাম।
দূরে আকাশের গায়ে অলস ভাবে চক্কর মারছে একটা বাজার্ড। ক্ষীণ ট্রেইল ধরে প্রায় হাজার খানেক ফুট উঁচু উপত্যকায় উঠে এলাম, নিচের ক্যাম্প আড়ালে পড়ে গেছে। শার্টের আস্তিনে হাতের তালু মুছে এগোলাম। হঠাৎ পঞ্চাশ গজ দূরে ক্লিফের কিনারে একটা বিগহর্ন ভেড়া চোখে পড়ল।
ভেড়াটা বেশ বড়সড়, ক্লিফের নিচে মনোযোগ ওটার। সামনের দিকে ঝুঁকে আছে লম্বা শিং, হরিণের মতই গায়ের রঙ ওটার, পশমগুলোও তাই। এটাই আমার দেখা প্রথম বিগহর্ন।
প্যাটার্সন তুলে সতকর্তার সঙ্গে নিশানা করলাম, ঠিক ওটার ঘাড়ের পেছনে-একটু নিচে। মেরুদণ্ডে গুলি বেঁধানোর ইচ্ছে, যাতে ঠিক যেখানে আছে সেখানেই ধরাশায়ী হয়। হৃৎপিণ্ডে গুলি করলেও ভেঁড়াটা ছুটে যেতে পারে কয়েকশো গজ, হয়তো পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাবে। হরিণের ক্ষেত্রে সচরাচর এটাই ঘটে, হৃৎপিণ্ডে গুলি লাগার পরও আধ-মাইল ছুটে যেতে সক্ষম ওরা। বিগহর্নটা হয়তো আরও বেশিদূর চলে যাবে। সামনে জমি হলে সমস্যা ছিল না, কিন্তু এটা পাহাড়ী এলাকা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বোল্ডারের কোন্ ফাঁকে গিয়ে লুকাবে, শেষে হয়তো খুঁজেই পাব না।
নিশানা স্থির করেছি, কিন্তু বিগহর্নের ধীর-স্থির শান্ত মূর্তি আর মনোযোগ বেখাপ্পা লাগছে। রাইফেল নামিয়ে সন্তর্পণে কয়েক পা এগোলাম, ক্লিফের ধারে পৌঁছে নিচের জমির দিকে তাকালাম।
প্রথমে একটা গরু চোখে পড়ল…সাদা-মুখো লংহর্ন। ওটার পেছনে আরও দুটো বেরিয়ে এল। আমাদের গরু এগুলো। তারপর ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক লোক।
জিম মুর!
দাঁড়িয়ে থেকে, গরুর পেছন পেছন মুরকে ড্র থেকে পাহাড়ের কিনারে বেরিয়ে আসতে দেখতে পেলাম। অন্তত ত্রিশটা বলদ রয়েছে ওখানে, তাছাড়া কয়েকটা গাভী, কিছু বাছুর বা বয়স্ক ষাড়ও আছে। পেছনে দুজন মানুষ এবং একমাত্র ঘোড়ার স্যাডলে একজন মহিলা।
চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বিগহর্নটার দিকে তাকালাম। খানিক পিছিয়ে গেছে ওটা, পাশ ফিরেছে, উপত্যকা থেকে নেমে যাবে। দ্রুত রাইফেল তুলে নিশানা করেই ট্রিগার টেনে দিলাম।
শূন্যে উঠে গেল ভেড়াটা। পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ল মাটির ওপর। ঝট করে উঠে দাঁড়াল ওটা, খিচে দৌড় দেবে মনে করে আবারও নিশানা করলাম। কিন্তু হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মোষটা, গড়ান খেল শরীর, তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল।
নিচের বেসিনে তাকিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না। গরুগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ক্লিফের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। স্মিত হেসে রাইফেল নামালাম আমি, তারপর নিচু স্বরে ডাকলাম। জানি বিকেলের নিস্তরঙ্গ বাতাসে কারও কণ্ঠ অনেকদূর থেকে শোনা যাবে।
ভয় পেয়েছ নাকি তোমরা? আরে, বেরিয়ে এসো, গরম পাথরে পা রাখার দরকার নেই!
ড্যান? ড্যান ট্রেভেন? কার্ল ক্রকেটের কণ্ঠ।
যদি তা না হয়, পাল্টা চিৎকার করলাম আমি। শুধু শুধু এত বছর আমাকে খাইয়ে বড় করেননি বাবা!
খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। ঘোড়ার স্যাডলে বসে আছে রোজিটা জেপসন, পুরুষরা কার্ল ক্ৰকেট, জিম মুর এবং জুয়ারেজ। তারপর ঝোঁপের আড়াল থেকে আরও একজন বেরিয়ে এল-টুম জেপসন!
আনন্দে চিৎকার করলাম আমি, ছুটে নামতে গিয়ে ভেড়াটার কথা মনে পড়ল।
জিম! জলদি এখানে চলে এসো! একটা বিগহর্ন শিকার করেছি!
ঢাল বেয়ে উঠে এল সে। তুমি আসলে আমার চেয়েও বড় কসাই, ড্যান। ঝটপট খালাস করে ফেলো এটাকে, ওস্তাদ। এই ফাঁকে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আসি। ফিরে এসে সাহায্য করব তোমাকে।
রোজিটা জেপসন, যে-ঘোড়ায় চড়েছে, চিনতে পারলাম। ইন্ডিয়ান পনি। এটার মালিকের ওপর চড়াও হয়েছিল কার্ল ক্ৰকেট। কার্লের কাছ থেকে পরে জেনেছি ছুটতে ছুটতে অনেকদূর, চলে গিয়েছিল সে, ইন্ডিয়ানকে কায়দা করে ফিরে আসার সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়, এবং ততক্ষণে লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এলাকায় কোমাঞ্চি আর কোমাঞ্চেররাদের আধিপত্য, তাই নদীর কিনারে একটা খাদে আশ্রয় নেয় সে, ঘোড়া সহ লুকিয়ে পড়ে। পুরো রাত ভিজে কাটিয়েছে, সকালে দেখতে পায় কিছু গরু দক্ষিণে চলে যাচ্ছে। ওগুলোকে জড়ো করতে গিয়ে জেপসনদের দেখা পেয়ে যায়।
জুয়ারেজ ছিল ওদের সঙ্গে। অবস্থা বেশ খারাপ ছিল তার। ইন্ডিয়ানরা বন্দী করেছিল ওকে, কিন্তু দুই কোমাঞ্চিকে খুন করে পালিয়ে আসে জুয়ারেজ। তবে আবার জখম হয়েছে। ক্ষতগুলো গুরুতর না হলেও গত কয়েকদিনে মোটামুটি সেরে উঠেছে।
একসঙ্গে গরু জড়ো করেছে ওরা, তারপর দক্ষিণ-পুবে ড্রাইভ করেছে, মিগুয়েলের পরিচিত এক লাইমস্টোনের বেসিনে যাওয়ার উদ্দেশে। ওখানে পানি ছিল। কিছু লিপানের সঙ্গে দেখা হয়েছে ওদের, একটা বলদের বিনিময়ে লিপানদের কাছ থেকে কর্ন আর বীজ কিনেছে।
প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে আসার পর জিম মুরের দেখা পায় ওরা। খোড়া ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে..নদীর কিনারে আশ্রয় নিয়েছিল, সওয়ারহীন একটা ঘোড়া ধরে বৃষ্টির পর পশ্চিমে রওনা দেয়। ওর ধারণা ছিল ক্যাম্পের সবাই মারা পড়েছে।
নয়দিন পর এল পাসোয় পৌঁছলাম আমরা। ছোট্ট শহর। একতলা একটা অ্যাডোবি দালান, নদীর মেক্সিকান অংশে অবস্থান ওটার। উত্তর অংশে বেশ কিছু বসতি রয়েছে, সবচেয়ে বড়টা কুন র্যাঞ্চো এবং ম্যাগোফিন্সভিল, দুটোর মধ্যে দেড় মাইল তফাত। তৃতীয় আরেকটা বসতি রয়েছে, ম্যাগাফিন্সভিল থেকে এক মাইল দূরের এক র্যাঞ্চ।
শহরের কাছাকাছি করালে সব গরু জড়ো করেছি আমরা-ডোরাকাটা বলদটাই নেতৃত্ব দিয়েছে। কাছাকাছি চলনসই একটা আশ্রয়ও খুঁজে নিয়েছি আমরা।
ড্যান, এবার কি করব আমরা? জানতে চাইল কার্ল।
যা করার কথা ছিল, উত্তরে বললাম। অন্তত আমি তাই করব। এগিয়ে যাব। একটা আউটফিট দাঁড় করাব। যে-কটা গরু আছে তা নিয়েই র্যাঞ্চ শুরু করব।
তারপর?
তারপর? শিকারে-বেরোব। মুখে মাকড়সার মত একটা ক্ষত আছে এক লোকের, ওর নাম ফেলিপ জাপাটা, ওই লোকের খোঁজে বেরোব।
মনে মনে পরিস্থিত বিচার করলাম। সঙ্গে যারা আছে, বাবা বা আমার অধীনে কাজ করার জন্যে এসেছে সবাই। আমাদের ওপর বিশ্বাস আর আস্থা রেখেছে ওরা। ওদের কাউকে নিরাশ করা যাবে না, যেভাবেই হোক সফল হতে হবে। অথচ আমাদের সবার কাছে যে টাকা আছে সব মিলিয়ে হয়তো বড়জোর পঞ্চাশ ডলার হবে, গুটিকয়েক গরু ছাড়া সবই হারিয়েছি। এগোতে হলে ঘোড়া, গিয়ার আর বিভিন্ন ধরনের সাপ্লাই প্রয়োজন।
সামনে মাইলকে মাইল অ্যাপাচী এলাকা, এবং যেখানে আমরা বসতি করব, সম্ভবত সেই জায়গাটাও অ্যাপাচী এলাকায় পড়েছে। জাপাটা বা ওর লোকজনের ওপর শীতল অসন্তোষ আর বিষ্ণা ক্রমে রাগ এবং ঘৃণায় রূপ পাচ্ছে। জিনিসটাকে সত্যি ভয় পাই আমি।
আমার ভেতরে অদ্ভুত একটা প্রবণতা রয়েছে। এমনিতে আমি মিতভাষী, গম্ভীর চেহারার আত্মকেন্দ্রিক মানুষ, সকাল-সন্ধ্যা গাধার মত খাটতে পারি এবং মানুষের সঙ্গ উপভোগ করি, অথচ এসবের আড়ালে অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর একটা স্পৃহা আছে যেটাকে সত্যিই ভয় পাই আমি। অদম্য এই স্পৃহাকে প্রায়ই দমন করতে হয়, কারণ বিপজ্জনক বা ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে নাম কেনার ইচ্ছে নেই আমার-এটা অতি উৎসাহী সব তরুণের জানা উচিত, পরিপকৃত আসেনি এমন বয়স্ক লোকদেরও জানা থাকা উচিত। কিন্তু তারপরও, এটা ঠিকই বাস করে আমার মধ্যে, খুব কম লোকেরই ভয়ঙ্কর এই রাগ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
বাবা জানতেন-স্যান এন্টোনিয়োতে আমার সঙ্গে ছিলেন তিনি; কার্লও জানে, কারণ লারেডোর ঘটনা সেও দেখেছে।
এবং এখন, ক্রমে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে ওটা, রাগ বাড়ছে আমার। উন্মত্ত আক্রোশ অনুভব করছি। বাবা মারা গেছেন, স্বাভাবিক মৃত্যু তা বলা যাবে না। বাবা ছাড়াও কয়েকজন ভালমানুষ খুন হয়েছে। ব্র্যান্ডের জন্যে রাইড করত এরা, বিশ্বস্ততা আর আন্তরিকতার কারণে অকালে ঝরে গেছে কয়েকটা প্রাণ।
মনের গভীরে প্রচণ্ড আক্রোশের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, ক্রমে বাড়ছে সেটা। এই অনুভূতি অচেনা নয়। বাড়তে বাড়তে এমন একটা মুহূর্ত আসবে যখন ঠাণ্ডা মাথায় কিছুই ভাবতে পারব না আমি-যা করা উচিত, শুধু এ ব্যাপারটাই থাকবে মাথায়। সামান্য ভয়ও থাকবে না তখন, শত্রুকে খুঁজে বের করার নিরন্তর তাগাদা ছাড়া অন্য কিছু থাকে না মনে, কোন কারণ, ঘটনা বা পরিবেশই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।
অনুভূতিগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে আসে, হৃৎস্পন্দন হয়ে পড়ে শ্লথ, ধীর গতিতে শ্বাস নিই, সতর্ক পায়ে এগোনোর সময় চারপাশে সতর্ক চালাই। এমন সময়ে চরম নিষ্ঠুর হয়ে পড়ি আমি, অদম্য এবং দুর্জয় হয়ে উঠি।
এই অবস্থা কখনোই পছন্দ নয় আমার।
শুধু এ কারণেই পিস্তল ঝোলাই না আমি। বেশ কয়েকবারই, স্রেফ পিস্তল ছিল না বলেই বুনো রাগ আর আক্রোশকে চেপে রাখতে পেরেছি-যা করার ইচ্ছে হয়েছিল, পিস্তল না থাকায় করতে পারিনি। দু’বার সীমাহীন এই আক্রোশ চালনা করেছে আমাকে, প্রতিবারই সারা সত্তায় প্রবল আলোড়ন অনুভব করেছি, শপথ করেছি এই ঘটনা যেন আর না ঘটে।
ফেলিপ জাপাটার প্রতি যত বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাই থাকুক, আপাতত বর্তমান কয়েকটা সমস্যার সমাধান করতে হবে। ঘোড়া, একটা ওয়্যাগন, এবং অপরিহার্য সাপ্লাই দরকার, ট্রিপটা চালিয়ে যেতে হবে। করুণ হাল আমাদের ছোট্ট পালের। কিন্তু ওটাকেও বড়সড় করে তোলা সম্ভব। দুটো কমবয়েসী বঁড় আর বিশটার মত গাভী রয়েছে, বেশিরভাগই অল্পবয়সী। অন্যগুলো বলদ, নগদ লাভের একমাত্র উপায়-এমনকি এ মুহূর্তে এদের মূল্য কম হলেও।
ম্যাগোফিন্সভিলের কিছু কিছু লোক শহরটাকে ফ্রাঙ্কলিন বলে। অন্যরা নাম দিয়েছে এল পাসো ডেল নার্ট, অর্থাৎ এল পাসোর উত্তর অংশ, যেটা আমেরিকার সীমানায় পড়েছে। তবে বেশিরভাগ লোকই আলাদা আলাদা নামে তিন শহরকে আখ্যায়িত করছে।
জেমস উইলি ম্যাগোফিনের সেলুনের সামনের হিচিং রেইলে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে ঢুকলাম। স্যাম গার্ট আর কার্ল ক্ৰকেট রয়েছে আমার সঙ্গে।
ম্যাগোফিন কেন্টাকির লোক, প্রায় তেরো-চোদ্দ বছর আগে এখানে এসেছিল, বাড়ি তৈরি করার পর স্টোর আর ওয়্যারহাউস খাড়া করে ব্যবসা শুরু করে।
দীর্ঘ কামরা পেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজের বাহ্যিক উপস্থিতি সম্পর্কে ভাবলাম-সমীহ করার মত বিশেষ কিছু নেই আমার মধ্যে। কোমাঞ্চেরোদের হামলার সময় রেজর হারিয়েছি, তাই কয়েকদিন ক্ষৌরি করা হয়নি। কালো জীর্ণ হ্যাট চাপানো মাথায়, ক্রাউনের কাছাকাছি একটা বুলেটের ফুটো রয়েছে। রঙ ঝলসে যাওয়া মলিন বাকস্কিন শার্ট পরনে। ঝালর দেয়া শটগান চ্যাপস রয়েছে গায়ে। স্পানিশ বুটের চেহারা ভোতা হয়ে এসেছে। গোড়ালি ক্ষয়ে গেছে ওগুলোর। গার্ট আর ক্রকেটকে আমার চেয়ে ধোপদুরস্ত এবং সমীহকরার মত দেখাচ্ছে।
মি, ম্যাগোফিন, বললাম আমি। কোমাঞ্চেরোরা আমার গরুর পাল নিয়ে গেছে। আমরা টি-বার আউটফিট, কাউ-হাউস থেকে পশ্চিমে এসেছি। এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমের রেঞ্জ বসতি করব। এ মুহূর্তে করুণ দশা সবার। মেয়ে আর বাচ্চারা ঘোড়ায় চেপে এসেছে, পুরুষরা পায়ে হেঁটে এসেছি আমরা।
চিন্তিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। কি চাও তুমি?
দশ-বারোটা ঘোড়া, একটা ওয়্যাগন এবং সতেরোজন লোকের দুই সপ্তাহের রসদ।
স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে সে, ক্ষণিকের জন্যে কার্ল আর স্যামের ওপর ঘুরে গেল তার দৃষ্টি। মহিলাদের কথা বললে না?
হ্যাঁ। আমার দু’জন লোকের স্ত্রী, একজনের বিধবা বউ। পাঁচটা বাচ্চা আর একটা মেয়ে। নিউ মেক্সিকো থেকে এসেছে ও।
ওর নামটা জানতে পারি?
জুয়ানিতা ম্যাকনেয়ার।
আমার কাঁধের ওপর দিয়ে দরজার দিকে তাকাল সে। আচমকা টের পেলাম ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে আমার সবক’টা চুল। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালাম, দরজায় ফেলিপ জাপাটাকে দেখতে পেলাম। লোকটার পেছনে আরও তিনজন কোমাঞ্চেরো রয়েছে।
অজান্তে মুঠি হয়ে গেল হাত, জাপাটা কাছে আসা মাত্র ঘুসি হাঁকালাম।
এমন কিছু আশা করেনি সে। হয়তো ভেবেছে তর্কাতর্কি হবে প্রথমে, তারপর ডুয়েল বা গোলাগুলি হবে। টেক্সাস বা নিউ মেক্সিকোর লোকেরা হাতাহাতি তেমন পছন্দ করে না। তখনকার দিনে দু’জন মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের নিস্পত্তি করার জন্যে পিস্তলকে ধরা হত সবচেয়ে ভদ্রোচিত উপায়, হাতাহাতি বা মুষ্টিযুদ্ধ ছিল বর্বরোচিত, অভদ্রলোক-সুলভ।
চিবুকে লাগল মোক্ষম ঘুসিটা। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা আমি, কয়েক আঙুল খাটো হব জাপাটার চেয়ে। জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে কুঠার চালিয়ে, ঘোড়া বলদ বা বুনো ঘোড়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ে। কঠোর পরিশ্রমে সামর্থ্য বাড়িয়ে নিয়েছি। জাপাটা বিন্দুমাত্র টলল না, স্রেফ হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেয়।
অন্য কেউ কিছু করার আগেই, পিস্তলে তিন কোমাঞ্চেররাকে কাভার করল কার্ল, পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল ওদের।
ঝুঁকে জাপাটার শার্ট খামচে ধরে টেনে তুললাম তাকে, পায়ের ওপর দাঁড় করালাম। তারপর জোরাল ঘুসি হাঁকালাম বিশালদেহী মেক্সিকানের পেটে। ঘুসির ধাক্কায় টলে উঠল সে, পা হড়কে পিছিয়ে গেল, কাউন্টারের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে পতন রোধ করল। পাল্টা ঘুসি চালাল সে এবার, কিন্তু মাথা নিচু করে ঘুসিটা এড়িয়ে গেলাম; উল্টো প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দিলাম ওর সোলার প্লেক্সাস বরাবর। সামলে নেয়ার সুযোগ দিলাম না ওকে, প্রচণ্ড হুক ঝাড়লাম লোকটার চিবুকে।
উন্মত্ত আক্রোশ নিয়ে, মরিয়া হয়ে লড়াই করল সে, বুঝে গেছে মরণপণ না লড়লে কপালে খারাবি আছে আজ, এবং একা লড়তে হবে-সঙ্গীরা সাহায্য করতে পারবে না। দারুণ শক্তিশালী মানুষ, বিশাল দেহ ওর জন্যে বাড়তি একটা অস্ত্র। মুগুরের মত হাতে জোরও আছে বেশ। কিন্তু দিনটা আমার। শীতল উন্মাদনায় রূপ পেয়েছে আমার সমস্ত রাগ আর প্রতিহিংসা। জাপাটার একটা আঘাতও গ্রাহ্য করছি না। আমাকে ফেলে দিল ও…দু’বার বোধহয়।
উঠে দাঁড়িয়ে, পা ছড়িয়ে দাঁড়ালাম, তারপর ঘুরতে শুরু করলাম। ঘুসি মেরেই সরে এলাম ওর নাগাল থেকে। এমন বেশ কয়েকবার ঘটল। মারের চোটে পিছিয়ে গেল সে ঘুসি মেরে দরজা দিয়ে বাইরের রাস্তায় ফেলে দিলাম ওকে, পিছু নিয়ে আমিও বেরিয়ে এলাম। নাক-মুখ থেঁতলে দিলাম দুই ঘুসিতে, দুই মুঠি একসঙ্গে চালালাম ওর চিবুকে।
পাল্টা আঘাত করছে সে, কিন্তু কিছুই অনুভব করছি না আমি। ওকে মেরে থেঁতলে বানানো ছাড়া অন্য কোন চিন্তা নেই মাথায়। এক ঘুসিতে থ্যাবড়া হয়ে গেল জাপাটার নাক, আরেক ঘুসিতে ঠোঁট ফেটে গেল। ভুরু কেটে গেছে ওর, রক্ত পড়ছে গলগল করে, কিন্তু, থামলাম না আমি। পথিবীতে কাউকে যদি ঘৃণা করে থাকি, তাহলে এই লোকটিকে। এত সহজে ওকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই আমার। হিচিং রেইলের সঙ্গে ঠেসে ধরে একের পর এক ঘুসি হাঁকালাম ওর মুখে।
বুনো আক্রোশে উন্মত্ত হয়ে উঠেছি আমি। কে থামাবে আমাকে? স্যাম গার্টের হাতেও একটা সিক্সশূটার বেরিয়ে এসেছে, তিন কোমাঞ্চেররাকে নাচার বানিয়ে রেখেছে।
নিচু হয়ে মার এড়ানোর চেষ্টা করছে জাপাটা, প্রতিরোধ করার বা পাল্টা মার দেয়ার স্পৃহা হারিয়েছে। সুযোগটা তাকে দিতে নারাজ আমি। টেনে মুখ তুললাম ওর, একের পর এক ঘুসি বসিয়ে দিলাম মুখে। কিছুক্ষণের মধ্যে থকথকে মাংসের দলা হয়ে উঠল ওর, মুখ। ভূগোল পাল্টে গেছে। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল সে, মাটি খামচে ধরল যেন তাতে উঠে দাঁড়াতে পারবে।
বেদম মার খেয়েছে সে, বিধ্বস্ত দেহটা পড়ে থাকল মাটিতে। সামান্যও নড়ছে না।
এগোতে গিয়ে পাশে জেমস ম্যাগোফিনকে দেখতে পেলাম। আমার কাধ চেপে ধরে থামাল সে। যথেষ্ট হয়েছে, ট্রেভেন! ওকে খুন করবে নাকি?
হাতের পাঞ্জা ফুলে গেছে আমার, রক্তাক্ত। টলমল পায়ে পিছিয়ে এলাম, কাঁধ ঝাঁকিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে বুনো আক্রোশ নিয়ে ফেলিপ জাপাটার ভূপতিত দেহের দিকে তাকালাম, একটুও নড়ছে না। ঝট করে তিন কোমাঞ্চেরোর দিকে ফিরলাম, চোখে শঙ্কা ফুটে উঠল ওদের। ওকে বোলো ফের যদি কখনও দেখি–যেখানেই হোক, খুন করে ফেলব ওকে!
নড়ে উঠল লোকগুলো, জাপাটার পাশে এসে দাঁড়াল একজন।
আরেকটা কথা, যোগ করলাম। ওকে ওটাও বোলো পালের সব গরু ফেরত চাই আমি পুরো তিন হাজার গরু, বেশিরভাগই ব্রীডিং স্টক। আজ থেকে ত্রিশ দিনের মধ্যে রেডোন্ডোয় আমাকে সব গরু ফেরত দিতে হবে! আর হ্যাঁ, ষাটটা ঘোড়াও ছিল পালের সঙ্গে, ওগুলোও ফেরত চাই আমি। এক মাস পর, সব ফেরত না পেলে যেখানেই থাকুক, খুঁজে বের করে ওকে পিটিয়ে মারব আমি!
ঘুরে দাঁড়িয়ে সেলুনের দিকে এগোলাম। দারুণ দুর্বল বোধ করছি। দরজার পোস্টের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম সেকেন্ড কয়েক, তারপর স্টোরে ঢুকে পড়লাম। ফেলিপ জাপাটার দিকে একবার তাকিয়ে আমাকে অনুসরণ করল জেমস ম্যাগোফিন। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল স্যাম আর কার্ল, তিন কোমাঞ্চেররাকে জাপাটার দেহ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখল।
ওই লোক ফেলিপ জাপাটা? কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল স্টোর মালিক। ওর কথা অনেক শুনেছি।
মাথা ঝাঁকালাম। এখনও শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি আমার। বুক ধড়ফড় করছে। হয়তো ওকে খুন করা উচিত ছিল!
কিন্তু তারচেয়েও বেশি করেছ। শেষ করে দিয়েছ জাপাটাকে, সামান্য দ্বিধা করল সে। এবার বলো তো, কি কি যেন লাগবে তোমার?
তোমার মনে রাখা উচিত, নগদ টাকা…মাত্র পঞ্চাশ ডলার আছে আমার কাছে। কবে টাকা শোধ করতে পারব, তার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।
রেখে দাও-তোমার সঙ্গে ব্যবসা করে ঠকব না আমি। টাকা ছাড়াও অন্য কিছু আছে তোমার-এমন জিনিস, বুনো এই দেশে শান্তি আনার জন্যে এটাই দরকার।
আমাকে দেখামাত্র ফ্যাকাসে হয়ে গেল জুয়ানিতার মুখ। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক, লড়াইয়ের উত্তেজনায় খেয়ালই করিনি নিজের দিকে, কম মার খাইনি, যদিও কোনটাই গ্রাহ্য করিনি। এক চোখ ফুলে গিয়ে প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগাড়, অন্য দিকের হনুর হাড়ের কাছে কেটে গেছে, ইঞ্চি দেড়েক তো হবেই! ঠোঁট আর একটা কানও ফুলে গেছে, দুই হাতের পাঞ্জা ফুলে-ফেঁপে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ওহ, খোদা, তোমার মুখের কি অবস্থা হয়েছে! আঁতকে উঠল ও, মুহূর্তের মধ্যে দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এদিকে এসো। মুখটার যত্ন নেব আমি…হাতেরও!
গরম পানির সঙ্গে বেসিনে লবণ মেশাল ও, তারপর আমার দুই হাত চুবিয়ে দিল গরম পানিতে। যতটা সম্ভব যত্ন আর সতর্কতার সঙ্গে আমার মুখ পরিষ্কার করল জুয়ানিত।
ব্যাপারটা অদ্ভুত, সম্পূর্ণ অচেনা আমার জন্যে। প্রিয়দর্শিনী কোন মেয়ে কাছে বসে ক্ষতের যত্ন নিচ্ছে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে, মৃদু স্বরে অনুযোগ করছে, সহানুভূতি আর মমতার কোমল স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে…অদ্ভুত ভাল লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা শরীরে। বহু আগে, একবার বুনো একটা ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম, ট্যাপের মা এভাবেই শুশ্রূষা করেছিলেন। কিন্তু দুটো ঘটনায় বিস্তর তফাৎ!
ট্যাপের কথা মনে পড়ল। কোথায় আছে সে? ইলেনের কি হলো?
ইলেন চলে যাওয়ার পর কখনও এ নিয়ে আলাপ করেনি টিম, ভুলেও তোলেনি দু’জনের প্রসঙ্গ। কে জানে স্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছে কিনা। যত যাই হোক, আমার ধারণা দুঃসাহসই করেছে ইলেন, ট্যাপ এডলের মত বাঁধনহীন মানুষের পেছনে ছুটে যাওয়ার পরিণাম মেয়েদের জন্যে করুণার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শুধু ইলেনের কারণে ট্যাপ বদলে যাবে, এ সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ।
স্যাম আর কার্লের কাছ থেকে ম্যাগাফিন্সভিলের কথা শুনেছে সবাই। প্রায় প্রত্যেক সন্তুষ্ট, আশার আলো দেখছে এখন। তখনকার দিনে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার, কারও মুখের কথাই তার কাজের নিশ্চয়তা, প্রতিজ্ঞাপত্ৰ; কথার বরখেলাপ হলে কাগুঁজে স্বাক্ষর বা নিশ্চয়তার কোন মূল্য নেই-বিবেচনাও করে না কেউ। সামান্য মুখের কথায় হাজার হাজার গরু কেনা-বেচা হয়, টাকা লেনদেনের সময় সাধারণত গরুগুলো গোনাও হয় না। সেজন্যেই একটা লোকের মুখের কথাই আগে বিবেচ্য। লোকটা গরু চোর, জুয়াড়ী বা খুনী হতে পারে এবং তারপরও পশ্চিমে নিশ্চিন্তে বাস করতে পারবে; কিন্তু তার মুখের কথার যদি দাম না থাকে, তাহলে কাপুরুষ হিসেবে তাকে দেখবে সবাই, পশ্চিমে থাকতে পারবে না সে, ব্যবসাও করতে পারবে না কারও সঙ্গে।
কি মনে হয় তোমার, গরুর পাল ফিরিয়ে দেবে জাপাটা? চিন্তিত স্বরে জানতে চাইল টিম অটম্যান।
যদি না দেয়, তাহলে পাকড়াও করব ওকে। ওর জায়গা চিনিয়ে দিয়েছি ওকে, সুতরাং কোন ভাবেই প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করতে পারব না আমি।
ও যদি ক্যানিয়ানে লুকিয়ে পড়ে?
ওকে অনুসরণ করে ঢুকে পড়ব ক্যানিয়নে।
ম্যাগোফিন্সভিল থেকে কিছুটা দূরে ক্যাম্প করলাম আমরা। জায়গাটা সুন্দর, ঝর্নার লাগোয়া। সিডার আর অ্যাসপেনের ছায়া প্রশান্তি বিলাচ্ছে ক্যাম্পে। রিও গ্রান্ড খুব বেশি দূরে নয়। দারুণ সুন্দর এক উপত্যকা। উত্তর-পশ্চিমে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি, ঢালু জমিতে আঙুরের চাষ করা হয়েছে। এই প্রথম আঙুরের চাষ দেখতে পেলাম।
অনেক রাত পর্যন্ত আগুনের পাশে বসে থাকলাম আমরা, গল্প করলাম, পুরানো দিনের গান গাইলাম। বুকে আগামী দিনের উজ্জ্বল স্বপ্ন। আমার পাশে বসেছে জুয়ানিতা, ঘনিষ্ঠ হয়ে, জীবনে এমন ভাল লাগার অনুভূতি কখনও হয়নি। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অনুভূতি, কারণ এই প্রথম কোন মেয়েকে চাইছি মনে মনে…আজীবনের জন্যে, ভালবাসার জন্যে। নিজের ভাবনা প্রকাশ করার মত যুৎসই শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। সত্যি করুণ অবস্থা!
শিগগিরই আবার ট্রেইলে উঠব আমরা-উত্তর-পশ্চিমের অনাবাদী জমির উদ্দেশে যাত্রা করব। সম্ভবত ওদিকেই আছে ট্যাপ এডলে, ওর সঙ্গে দেখা হবে আবার…বাবা মারা যাওয়ার পর, এখন কি সম্পর্ক দাঁড়াবে আমাদের মধ্যে?
বাবাকে সবসময়ই সমীহ করত ট্যাপ…অথচ আমার প্রতি ছিটেফোঁটাও নেই। আমাকে এখনও তরুণ মনে করে সে, কিন্তু যে পরিকল্পনাই থাকুক আমাদের, তাতে যোগ দিতে পারে সে, যদি নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকমত পালন করে।
উঠে দাঁড়িয়ে সিডার সারির দিকে এগোলাম আমি, ঘোড়াগুলো রয়েছে ওখানে। ওগুলো ঠিকঠাক আছে, দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে চাই। আলোর বাইরে এসে কান পেতে রাতের নৈঃশব্দ্য উপভোগ করলাম। আকাশে হাজার তারার মেলায় চোখ রেখে আনমনা হয়ে পড়লাম।
জেমস ম্যাগোফিন সাপ্লাই দেবে আমাদের, কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেনা শোধ করতে হবে। পুরোটাই আমার দায়িত্ব। নগণ্য একটা গরুর পাল রয়েছে আমাদের, এ থেকে কারও জীবিকা নির্বাহ হওয়া রীতিমত অসম্ভব। যাই ঘটুক, পালের সব গরু কোমাঞ্চেরোদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে, কিংবা যেভাবেই হোক অন্য কোন উপায়ে হাজার কয়েক গরু যোগাড় করতে হবে।
ফেলিপ জাপাটা যদি গরু ফেরত না দেয়, তাহলে ওদের ধাওয়া করতে হবে, এমনকি পেলো ডিউরো ক্যানিয়ন পর্যন্ত যেতে হতে পারে।
পাশে এসে দাঁড়াল জুয়ানিতা, টের পেলাম আমার একটা হাত চেপে ধরেছে। দুশ্চিন্তা করছ, ড্যান?
ওরা আমার সঙ্গে এসেছে, ক্যাম্পের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম। বাবা এবং আমাকে বিশ্বাস করেছে ওরা, আস্থা রেখেছে। কোন ভাবেই ওদেরকে নিরাশ করতে পারব না আমি।
করা উচিতও হবে না।
কাজটা সত্যিই কঠিন হবে।
জানি, ড্যান, খুব কঠিন হবে, থামল জুয়ানিতা, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার সামনে চলে এল, হাতটা ছাড়েনি। কিন্তু তুমি যদি সুযোগ দাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব।
ওর গভীর কালো চোখে তাকালাম-প্রতিশ্রুতি আর দৃঢ় প্রত্যয় দেখতে পেলাম। হাত বাড়িয়ে ওর কোমর চেপে ধরতে আমার বুকে চলে এল ও। মৃণাল দুই বাহু দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, ড্যান-আজীবন! নিচু, রুদ্ধ স্বরে প্রতিশ্রুতি দিল ও।
৬. আটান্ন সালের গ্রীষ্মে
আটান্ন সালের গ্রীষ্মে মিম্বার্স নদীর তীরের উপত্যকায় পৌঁছলাম আমরা-গুটিকয়েক গরু আর সাপ্লাই ভরা ওয়াগন নিয়ে কয়েকজন মানুষ।
কুক’স প্রিংকে পেছনে ফেলে, ব্ল্যাক রেঞ্জ পর্বতমালাকে হাতের বাম পাশে রেখে নদী পেরিয়ে আরও এগিয়ে গেলাম, মোগোলন পর্বতশ্রেণীর বুনো নির্জন এলাকায় প্রবেশ করলাম। স্ক্যাবার্ডে বা হাঁটুর ওপর রাইফেল প্রস্তুত আমাদের, যেহেতু অ্যাপাচী এলাকার ঠিক মাঝখানে আছি এখন, দিন দুই চলার পর আমাদের স্বপ্নের জমিতে পৌঁছলাম।
সেন্ট অগাস্টিন পর্বতমালার পাহাড়ী এলাকা এটা, নয়ন জুড়ানো বিস্তৃত তৃণভূমি ছড়িয়ে আছে মাইলকে মাইল। এরচেয়ে সুন্দর সমৃদ্ধ তৃণভূমি সারা জীবনেও দেখিনি। ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো অ্যান্টিলোপ আর বুনো ঘোড়ার কিছু পাল চোখে পড়ল।
ঝর্নার ধারে ক্লিফের লাগোয়া উঁচু একটা জায়গায় ক্যাম্প করলাম আমরা। ক্লিফের গুহায় অসংখ্য বাদুড় বাসা বেঁধেছে। দীর্ঘ ঘাসে চরছে গরুগুলো। এদিকে আমরাও হাত গুটিয়ে বসে নেই-পোল-করাল তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি।
পাহাড়ে ভালুক আর হরিণের ছাপ চোখে পড়েছে। কাঠ কাটার মাঝখানে বিশ্রামের জন্যে থামল স্যাম গার্ট। নিষ্কণ্টক জমি এটা; ড্যান, কিন্তু যদূর শুনেছি ইন্ডিয়ান একটা ট্রেইল আছে ধারে-কাছে, এ পথে যাওয়া-আসা করে ওরা। আমাদের বোধহয় সতর্ক থাকা উচিত।
করালের কাজ শেষ হলে দুর্গ তৈরি করব আমরা, কিন্তু সবার আগে ঘোড়ার জন্যে করাল আর শেড তৈরি করতে হবে। আশপাশে বুনো ঘোড়া যা দেখলাম, ঘোড়া নিয়ে ভাবতে হবে না।
দুৰ্গটা শুরুতে নেহাত সাদামাঠা গোছের মনে হলো। ইংরেজি ভি আকৃতির একটা শেড তৈরি করলাম প্রথমে, খোলা উপত্যকার দিকে ওটার মুখ। একপাশে করালের জন্যে খুঁটি গেড়েছি, অন্যপাশে মাটির দেয়াল দাঁড় করিয়েছি। পেছনে ক্লিফের খাড়া নিরেট দেয়াল। দেখতে দুর্গের মত না হলেও, নিরাপত্তার বিচারে চলনসই-মাঝারি ধরনের যে কোন আক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়া যাবে।
তিনদিন পর আমাদের বাড়ি-টেক্সাস হাউস-খাড়া হয়ে গেল। একপাশে অটম্যানরা থাকবে, অন্যদিকে বুচার্ডরা। বাঙ্কহাউসের কাজ প্রায় শেষ। এদিকে উপত্যকার সমৃদ্ধ ঘাসে চরে মোটা-তাজা হতে শুরু করেছে গরুগুলো। চারপাশের এলাকায় স্কাউট করেছি আমরা, হরিণ আর পাহাড়ী সিংহ শিকার করেছি।
বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে, সত্যিকার বাড়ি-কারণ এখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব আমরা।
চারপাশের সব খবরই আসে আমাদের কাছে। মিম্বার্স ভ্যালির ওদিকে দু’একটা গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, হোনাস গান্ট নামটা শোনা যাচ্ছে খুব। এই লোকের কথাই বলেছিল ট্যাপ এডলে।
তারপর একদিন উপস্থিত হলো ওরা-গান্ট এবং ট্যাপ। আরও একজন রয়েছে ওদের সঙ্গে। সাটক্লীফের সঙ্গী ব্লন্ড লোকটা।
খেপে আছে ট্যাপ, ঈর্ষায় পুড়ছে-ওর ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট। চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল ও। ব্যাপারটা কি, ড্যান? আমি তো জানতাম, মিম্বার্স ভ্যালিতে আমাদের সঙ্গে বসতি করবে তোমরা?
তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব, শান্ত স্বরে বললাম ওকে, ব্লন্ড লোকটার দিকে আঙুল তাক করলাম। আগে ওকে এখান থেকে কেটে পড়তে বলো। ফের যদি এখানে দেখি, ওকে খুন করব আমি।
ও আমার বন্ধু। বাদ দাও।
ও কিভাবে তোমার বন্ধু হয়, ট্যাপ? আমাদের পাল ছিনিয়ে নিয়েছে কোমাঞ্চেরোরা, দলে এই লোকটাও ছিল। ওদের কারণেই মারা গেছেন বাবা।
আড়ষ্ট হয়ে গেল ট্যাপের মুখ। শুনেছি। খবরটা বিশ্বাসই করতে পারিনি।
করালের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে কার্ল ক্ৰকেট, টেক্সাস হাউসের দরজায় জিম মুর আর মিলো ডজ অবস্থান নিয়েছে। সতর্ক, তৈরি ওরা।
ওকে চলে যেতে বলো, ট্যাপ।
চোয়ালের পেশী শক্ত হলো ট্যাপের, কঠিন চাহনিতে তাকাল আমার দিকে। হয়েছে কি কিড, আমাকেও পরামর্শ দেয়া শুরু করেছ দেখছি! তোমার কথামত…
সবার ওপর চোখ রেখেছি, বিশেষ করে ব্লন্ড লোকটাকে। তুমি, তাকে বললাম। স্পার দাবাও, স্রেফ কেটে পড়ো এখান থেকে! ফের যদি দেখি তোমাকে, কথা না বলে গুলি চালাব।
জিভ চালিয়ে ঠোঁট ভেজাল লোকটা। নিজেকে কি মনে করো তুমি, আঁ? বেশি বাড়…
গুলি করে স্যাডল থেকে ফেলে দিলাম লোকটাকে।
মুহূর্ত খানেকের নীরবতা, সামান্য টু শব্দ করল না কেউ, নড়লও। পিস্তলের নল কিছুটা নিচু করলাম আমি, ধোঁয়া উঠছে এখনও। মাটিতে পড়ে আছে ব্লন্ড লোকটা।
হোনাস গান্টের মনে যাই থাকুক, সেটা বাস্তবে পরিণত করার দুঃসাহস হলো না। কার্লের হাতে রাইফেল চলে এসেছে, মিলোও ওর শার্পসটা তাক করে রেখেছে ওদের দিকে।
ট্যাপ, বললাম আমি। এই লোকটাকে তুলে নিয়ে কেটে পড়ো। যে-কোন সময়ে আসতে পারো এখানে, কিন্তু যখনই আসবে, ভুলেও ওর মত খুনী রেনিগেডদের সঙ্গে এনো না।
কাধে গুলি লেগেছে লোকটার, কিন্তু ব্যাটার চেহারা দেখে মনে হলো যেন বুকে বিঁধেছে গুলিটা।
স্যাডলে স্থির হয়ে বসে আছে ট্যাপ এডলে, অদ্ভুত দৃষ্টি ওর চোখে-যেন এই প্রথম দেখছে আমাকে।
আবার আসব আমি, ড্যান। তোমার খোঁজে আসব। কেউ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলে নিস্তার পায়নি!
তুমি আমার ভাই, ট্যাপ, হয়তো রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু এভাবেই বড় হয়েছি আমরা। তোমার সঙ্গে কোন গোলমালে যেতে চাই আমি, তবে শুক্রর সঙ্গে তোমাকে মেলামেশা করতে দেখলে প্রশ্নটা উঠবেই-আসলে কার প্রতি বিশ্বস্ত তুমি?
আমাকেও দেখতে পাবে! শীতল স্বরে ঘোষণা করল গান্ট।
ওর দিকে তাকালাম। ভাবছিলাম কখন তুমি এই খেলায় যোগ দেবে। যাকগে, যে-কোন সময় তৈরি থাকব আমি, মি. গান্ট!
তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল সে। এখন নয়…বিপক্ষে অনেক লোক। তোমার চামড়া বাঁচাতে ব্যস্ত ওরা।
তাহলে ভাগছ না কেন?
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল হোনাস গান্ট। এদিকে স্যাডল ছেড়ে নামল ট্যাপ, আহত লোকটাকে ঘোড়ার পিঠে চাপতে সাহায্য করল।
যখন ইচ্ছে আসতে পারো, ট্যাপ। একা অথবা ইলেনকে নিয়ে আসো, আপত্তি নেই আমাদের, কিন্তু উদ্দেশ্যটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৎ হতে হবে।
ইলেন কোথায়? হঠাৎ জানতে চাইল টিম অটম্যান।
সকোবরায় আছে ও, বিষণ্ণ স্বরে বলল ট্যাপ। ভাল আছে।
একটা শটগান রয়েছে অটম্যানের হাতে। তোমরা কি বিয়ে করেছ?
শূন্য দৃষ্টিতে অটম্যানের দিকে তাকাল ট্যাপ। ঠিক ধরেছ। তুমি কি ভেবেছ অন্য কিছু করব?
ওর দিকে খেয়াল রেখো। আমি গানফাইটার নই, ট্যাপ এডলে, কিন্তু এই শটগান থেকে গুলি করতে বন্দুকবাজ হওয়া লাগবে না!
চলে গেল ট্যাপ, আহত লোকটার ঘোড়া লীড করছে। সমানে বিলাপ করছে ব্লন্ড। শপথ করছে সুযোগ পেলে দেখে নেবে আমাকে।
দাঁড়িয়ে থেকে, উপত্যকা ছেড়ে ওদের চলে যেতে দেখলাম আমি। প্রখর রোদ গ্রাহ্য করছি না। ট্যাপ এডলের অপসৃয়মান কাঠামোয় স্থির হয়ে আছে দৃষ্টি, কৈশোরে ও-ই ছিল আমার আদর্শ-নায়ক, আর এখন একমাত্র বন্ধন, আত্মীয় বলতে কেবল ওকেই চিনি। নিজেকে কেমন নিঃসঙ্গ, একাকী মনে হলো।
বুনো দেশ এটা। কঠিন এখানকার জীবনযাত্রা। জীবিকা আর বেঁচে থাকার তাগিদে কঠিন হতে হয় সবাইকে। নিয়ম বা রীতিগুলোও প্রয়োগ করতে হয়, সীমারেখা টেনে দিতে হয় যাতে অনায়াসে পড়তে পারে সবাই।
ট্যাপ এডলে ভিন্ন খাতে গড়া। আমার কাছে মনে হয়েছে ও আসলে ছন্নছাড়া, শুধু সেজন্যেই নিজের অবস্থান কখনও উপলব্ধি করতে পারেনি, সীমানা নিয়েও ভাবেনি কখনও। তো, আজ একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। সে জেনে গেছে কোথায় আমার অবস্থান।
ওই ব্লড লোকটা পিস্তল বের করার চেষ্টা করলে কি করতাম জানি না, নিশ্চিত নই আমি, কিংবা পরোয়াও করি না। বাবার মৃত্যুর সময় ধারে-কাছে ছিল: লোকটা, সে নিজে গুলি করুক বা না-করুক, সমান দায়ী বাবার মৃত্যুর জন্যে-আবার সে নিজেও কাজটা করে থাকতে পারে।
একটা জিনিস শিখেছি আমি। এতে তর্ক আর ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়। সম্ভবত ভুল থেকেই সংঘাতের পথ তৈরি হয়; যদি কারও সঠিক অবস্থান অন্যরা জানতে না পারে। বুনো এবং নির্জন অঞ্চলে এসেছি আমরা, আইন বিবর্জিত একটা অঞ্চল, সামাজিক রীতি বা নিয়মের থোড়াই পরোয়া করে এমন লোকের অভাব নেই এখানে-আবার ঠিক বিপরীত চরিত্রের লোকও আছে যারা স্কুল, চার্চ তৈরি করতে চায়; চায় একটা দিন ঘুরে বেড়ানোর জন্যে বা বাজার করার জন্যে উন্মুক্ত থাকবে, যারা হৃদ্যতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সমাজ গড়তে চায়।
এখন, নিজের অবস্থান পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছি আমি, ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশ নেই…
ট্যাপরা চলে যাওয়ার পর, এ নিয়ে কেউই কোন মন্তব্য করল না। যার যার কাজে ফিরে গেলাম আমরা, এটাই ধ্রুব সত্য-জন্ম-মৃত্যুর মতই চিরন্তন। দৈনন্দিন কাজ কখনও পুড়ে থাকে না। জীরন ধারণের জন্যেই করতে হয়। খাবার তৈরি, গরুর যত্ন, মাংস যোগাড়, বেড়া তৈরি বা মেরামত, কাঠ সংগ্রহ-সবই চলছে পুরোদমে। শুধু রুটি খেয়ে বাঁচতে পারে না মানুষ, অন্য কিছু পাওয়ার আগে রুটির রুজি করতে হয়। অবকাশ থেকে সভ্যতার ঠিকানা তৈরি হয় বটে, কিন্তু জমিতে ফসল ফলানোর পরই কেবল অবকাশ মেলে।
অন্তস্তল থেকে এসব উপলব্ধি করি আমরা, কারণ নিঃসঙ্গ মানুষ মাত্রই চিন্তাশীল এবং সুবিবেচক, জীবনের অসঙ্গতিগুলো পুরণ করার উপায় বাতলে অবসরটুকু কাটায় এরা।
পুবে যাওয়ার সময় হয়েছে এখন, পালের গরু ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের। মনে হয় না গরু বিক্রি করে ফেলেছে ওরা, অন্তত আমি যথেষ্ট সন্দিহান; আমার নির্দেশ শুনে ফেলিপ জাপাটা খেপে গিয়ে গরু বিক্রি করার ব্যাপারে তাড়া অনুভব করবে, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মনে হয় না গরু বিক্রি করেছে সে। সে চাইলেও-আমার সন্দেহ-অন্য কেউ জড়িত আছে এসবে।
টিম, পালের খোঁজে যাচ্ছি তামি, টিম অটমানকে ডেকে বললাম। তোমাকে দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি। জিম মুর আর টম জেপসন থাকবে তোমার সঙ্গে-সুয়ারেজও থাকছে।
আমি তোমার সঙ্গে যাব, ড্যান, একটা রিয়াটা তৈরি করছিল মেক্সিকান, মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। আমি সঙ্গে থাকলেই মঙ্গল হবে। জাপার্টার অনেক লোকজন। ওঁকে ধরতে হলে মেক্সিকানদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওদের কাছে তুমি একজন আগন্ত্রক, জাপাটা মেক্সিকান বলে কেউ তোমাকে সাহায্য করতে চাইবে না। তোমার বিরুদ্ধে না গেলেও কেউই সাহায্য করবে না।
কিন্তু আমি সঙ্গে থাকলে, জাপাটার কুকর্মের কথা আমার কাছ থেকে জানতে পারলে বিশ্বাস করবে ওরা। তাহলে শুধু কোমাঞ্চেরোদেরই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে তুমি। সামান্য হাসল সে। দলটা অনেক বড়, সেনর, আমি সঙ্গে থাকলে উপকারই হবে তোমার। তাছাড়া ওদের সঙ্গে কিছু দেনা-পাওনা বাকি রয়ে গেছে আমার।
ঠিকই বলেছে সে, যুক্তির সঙ্গে তর্ক করা চলে না। টেক্সাস বা নিউ মেক্সিকোর এসব স্প্যানিশ-আমেরিকানরা গোষ্ঠিপ্রিয়। বাইরের লোকদের পছন্দ করে না, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এমন মানসিকতার জন্যে দোষ দেওয়া যায় না ওর। একজন আগন্তুক গ্রিংগো হিসেবে আমাকে দেখবে ওরা। আমাদের এই সমস্যার ব্যাপারে মোটেই ভাববে না-সত্যি কি মিথ্যে বলছি আমি; এক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে-হয় স্রেফ আমাকে উপেক্ষা করবে, নয়তো বিরুদ্ধে চলে যাবে।
কার্ল, গার্ট, মিলো, জুয়ারেজ আর আমি-পাঁচজনে রওনা দিলাম। ছোট্ট একটা দল, অন্তত কাজের তুলনায় দুলটা নেহাতই ছোট।
রিও গ্রান্ডের তীরে ছোটখাট শান্ত শহর সকোরো। পুয়েবলোর এক পাশে গড়ে উঠেছে। বহু আগে, ১৬২৮ সালে মিশন তৈরি হয়েছিল এখানে, কিন্তু পুয়েবলো বিদ্রোহের সময় লোকজন দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ে, রিও গ্রান্ডের তীরে একই নামে একটা বসতি তৈরি করে। ১৮১৭ সালে ফিরে গিয়ে এরাই পুনরায় তৈরি করে গ্রামটা। এর সবই জুয়ানিতার কাছ থেকে শোনা, ম্যাগোফিন্সভিল থেকে পশ্চিমে যাওয়ার সময় বলেছে ও।
সংখ্যায় অল্প হলেও, এ ধরনের কাজে অভিজ্ঞ আমরা-ঝামেলা সামাল দিতে দক্ষ। টেক্সাসের বুনো অঞ্চলে এমনিতে বড় হয় না কেউ। তেরো বছর বয়সে এক কিওয়াকে প্রথম খুন করে কার্ল ক্ৰকেট, তারও আগে, পুরো এক সপ্তাহ কোঞ্চিদের একটা দলকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে ও, নিজের চোখে পরিবারকে খুন হতে দেখেছে।
স্যাম গার্টের আদি নিবাস কেন্টাকি এবং টেনেসি। নাচেল ট্রেসের ধারে-কাছে কেটেছে ওর, পাহাড়ী মানুষ। জীবনের বেশিরভাগ সময় শিকারী ছিল। মিলো ডজ টেক্সাস রেঞ্জার ছিল একসমসয়, মেক্সিকান যুদ্ধের সময় বালক বয়সেই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল।
সকোরোয় ঢুকলাম আমরা। ছোটখাট কিন্তু টাফ একটা দল। সাপ্লাই কিনে পশ্চিমে যাত্রা করব, কোমাঞ্চেরোদের এলাকায় যেতে কয়েকদিন লেগে যাবে।
একটা ক্যান্টিনায় ঢুকলাম আমরা। ড্রিঙ্ক গেলার চেয়ে খবর সগ্রহ করার আগ্রহই বেশি। তবে চারজন ঢুকেছি ভেতরে। আঙুর থেকে ওয়াইন তৈরি করে এরা, তারই ফরমাশ দিলাম। অবশ্য বহু পুরোনো কিছু আপেল গাছও আছে এদিকে, শোনা যায় রোমানরা লাগিয়েছিল এগুলো।
ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। শান্ত। টেবিলে হ্যাট রেখে দীর্ঘ বাদামী চুলে আঙুল চালাল কার্ল, মেয়েদের মতই লম্বা চুল ওর। আকর্ষণীয়। গোঁফে তা দেয়ার ফাঁকে, নীরবে ওকে দেখছে স্যাম গার্ট।
অপেক্ষা করার গভীরে এক ধরনের শান্ত স্থৈর্য রয়েছে আমাদের মধ্যে। প্রত্যেকেই জানি নিকট ভবিষ্যৎ কি রয়েছে, কিংবা সকোরো পেরিয়ে পশ্চিমে, যাওয়ার সময় কি ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমে অ্যাপাচীদের এলাকা, তারপর কোমাঞ্চি অঞ্চল-রাইডার হিসেবে দুর্ধর্ষ ওরা, দুর্দান্ত লড়য়ে। অসংখ্য শত্রুকে পেছনে ফেলে যেতে হবে। মাত্র গুটিকয়েক লোক আমরা। কিন্তু এটা আমাদের কর্তব্য, পিছিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কারও নেই।
ওয়াইনটা ভাল। কিছুক্ষণ পর ক্যান্টিনার মালিক ফ্রিগোল পরিবেশন করল। টরটিয়া আর মশলাদার ডিমও রয়েছে মেনুতে।
ক্যান্টিনায় ঢুকল জুয়ারেজ। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল সে, ভেতরের অপেক্ষাকৃত স্নান আলোয় চোখ সয়ে আসার পর টেবিলে এসে বসল। ঝুঁকে এল সে, চোখ দারুণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বন্ধুদের কাছ থেকে জবর একটা খবর পেয়েছি!
অপেক্ষায় থাকলাম আমরা। সিগারেটো বের করে দুই ঠোঁটের সঙ্গে, চেপে ধরল জুয়ারেজ।
পেলো টিউটে যেতে হবে না আমাদের…টুলারোসায় আছে জাপাটা।
এখান থেকে পুবে শহরটা, তাই না? জানতে চাইল স্যাম।
খুব ছোট জায়গা। অ্যাপাচীরা ঘনঘন আক্রমণ করে বলে বেড়ে ওঠেনি। লাস প্লাসিটাস নামে একটা জায়গা আছে কাছাকাছি। পাশে ফোর্ট স্টান্টন, সৈন্যরা আছে ওখানে। সিগারেটো ধরাল সে। শুনলাম সৈন্যদের কাছে বিক্রি করার জন্যে গরুর পাল, ওখানে নিয়ে গেছে জাপাটা।
জানতাম না ফোর্ট আছে ওখানে, বলল মিলো ডজ। স্টান্টন, তাই তো বুললে? কয়েক বছর আগে স্টান্টন নামে এক ক্যাপ্টেন মারা গিয়েছিল ওখানে।
সি, ওর নামেই জায়গাটার নামকরণ করা হয়েছে। ফোর্ট তৈরি হয়েছে পঞ্চান্ন সালে। লোকজন রিও বনিটোর আশপাশে বসতি করছে, কিন্তু আমার তো মনে হয় অ্যাপাচীদের তোপের মুখে দেশছাড়া হবে সবাই।
জাপাটা আছে ওখানে?
সি...সঙ্গে প্রায় সব কু আছে ওর। গরুর পাল ছাড়াও কিছু ঘোড়াও আছে সঙ্গে।
ওখানেই যাব আমরা, টেবিলের চারপাশে তাকালাম আমি। ঝটপট পেটপূজা সেরে ফেলল।
বেরিয়ে এসে বোড়ওঅকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা, রাস্তার দু’ধারে সতর্ক দৃষ্টি চালালাম। জানি যে-কোন সময় বিপদ আসতে পারে।
হঠাৎ ইলেনকে দেখতে পেলাম। আসলে বলা উচিত মিলো ডজই দেখতে পেল ওকে। ড্যান…দেখো!
উজের উত্তেজিত স্বরে তাকালাম। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে ইলেন। মনে হলো বয়স বেড়ে গেছে ওর, কিছুটা স্বাস্থ্যহানিও হয়েছে। বরাবরের মত পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরনে। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াল মুহূর্তের জন্যে, তারপর চিবুক উঁচু রেখেই এগিয়ে এল।
ইলেন…মিসেস এডলে, বললাম আমি। তোমাকে দেখে সত্যি খুশি হয়েছি।
কেমন আছ? যেন পরস্পরের অপরিচিত আমরা, এমন সুরে বলল ও। তারপর পাশ কাটিয়ে নিজের পথ ধরল।
তোমার পরিবারের সবাই আছে আমাদের সঙ্গে। ট্যাপ জানে কোথায় জায়গাটা। তোমাকে দেখলে খুশি হবে ওরা।
কয়েক পা এগিয়ে গেছে ও। থেমে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। আমার তো মনে হয় আমার স্বামীকে পছন্দ করো না তুমি!
যখনই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হবে তোমাদের, স্মিত হেসে বললাম আমি। নির্দ্বিধায় চলে আসতে পারো। তোমাদের জন্যে যথেষ্ট জায়গা আছে আমাদের-হৃদয়ে এবং ওই উপত্যকায়। কি জানো, বাবা কোন উইল রেখে যায়নি এবং ট্যাপকে তাড়িয়ে দিলেও ওকে যথেষ্ট পছন্দ করতেন তিনি। যাকগে, ওসবে কিছু যায়-আসে না এখন। ট্যাপ ফিরে এলেই বরং খুশি হব আমি। সমান-সমান ভাগাভাগি করব আমরা।
ধন্যবাদ।
ফের এগোতে গিয়েও থামল ইলেন। হয়তো আমাদের আচরণে এমন কিছু ছিল, কিংবা আমাদের সাজসজ্জা দেখে-কারণ প্রত্যেকের কাছে রাইফেল ছাড়াও দুতিনটে করে পিস্তল রয়েছে।
কোথায় যাচ্ছ…কি করছ তোমরা?
গরুর পালের খোঁজে বেরিয়েছি আমরা, ইলেন। আমাদের সব গরু নিয়ে লাস প্লাসিটাসে গেছে ফেলিপ জাপাটা।
কিন্তু…ওই, ওরা তো অনেক লোক! সামান্য সুযোগও পাবে না তোমরা। অন্তত, বিশজন লোক আছে ওর সঙ্গে…দ্বিগুণও হতে পারে।
জানি, ম্যাম, কিন্তু গরুগুলো আমাদের। ওগুলো ফিরিয়ে আনতেই হবে।
এটাই আমাদের মূলমন্ত্র-গরু ফিরিয়ে আনতে হবে। গরু তো আনতে হবেই, উপরন্তু গরুচোরদেরও ছাড় দেব না-কৃতকর্মের শাস্তি ওদের পেতেই হবে। বুনো একটা জায়গায় বসতি করতে হবে আমাদের, শান্তি আনতে হবে। আগামী কয়েক বছর বন্দুকের জোরেই সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ঝামেলাবাজদের কাছে শুধু ঝামেলাই গুরুত্ব পায়-সুবিচার তখনই মানে ওরা; মেনেও নেয়-যখন শক্তি থেকে আসে। অর্থাৎ যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল।
পুবের পাহাড়ের পেছনে সূর্য হারিয়ে গেল, ততক্ষণে বেশ কয়েক মাইল চলে এসেছি আমরা। মরুভূমির মত একটা জায়গা পেরিয়ে এসেছি, লাভার চাঙড় ছাড়িয়ে ঘেসো এক উপত্যকা ধরে এগোলাম। জায়গাটা রিও বনিটোর ধারে। প্রচুর পাইন আর ওক রয়েছে আশপাশে। পাইনের সারিকে পাশে রেখে কিছুদূর এগোতে দূরে অ্যাডোবি দালান আর জীর্ণ কিছু শ্যাক চোখে পড়ল নদীর তীরে।
সব মিলিয়ে হয়তো আট-দশটা হবে। কয়েকটা তাবুও রয়েছে, আর কিছু টিপি। কাছাকাছি গিয়ে ছড়িয়ে পড়লাম আমরা। শহরের ওপাশে গরুর পালটা চোখে পড়েছে। পালের ধারে-কাছে কয়েকজন রাইডার রয়েছে, কারও কারও পরনে ইউনিফর্ম আর মাথায় হেলমেট। এরা নিশ্চই ক্যাভালরির সদস্য।
ঢাল ধরে নিচে নেমে শহরে ঢুকলাম, এগোলাম পালের দিকে। কৌতূহলী লোকজন আমাদের পিছু নিয়েছে। রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে অনেকেই।
একটা ব্যাপার খোলসা করা উচিত, বন্ধুদের বললাম। এটা আমার লড়াই। অন্য কেউ যদি উৎসাহী হয়, আপত্তি নেই, যা ইচ্ছে করতে পারো তোমরা…কিন্তু কথাবার্তা আমিই বলব। জাপাটার সঙ্গে ফয়সালা করব আমি একা। সমানে-সমানে।
না বোঝার কিছু নেই। আমার কাজের ব্যাপারে যাতে কোন সন্দেহ থাকে, সেজন্যেই বলা।
ফেলিপ জাপাটা আছে ওখানে। সঙ্গের লোকটাকে দেখে ভেতরটা শীতল হয়ে গেল আমার। ট্যাপ এঙলে। সঙ্গে হোনাস গান্টও রয়েছে। বোঝা গেল সেদিনের কথাগুলো কোন কাজেই আসেনি।
আট বা নয়জন ওরা। চার-পাঁচজন সৈন্য গরুর পাল জরিপ করছে।
সৈন্যদের দিকে এগোনোর সময় হঠাৎ গান্টকে কথা বলতে দেখতে পেলাম। ঝট করে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল জাপাটা।
জাপাটা বা গান্টের ওপর থেকে চোখ সরালাম না। ক্যাপ্টেন, সামনের দীর্ঘদেহী সৈন্যের উদ্দেশ্যে বললাম। এগুলো চুরির মাল। আমার কাছ থেকে চুরি করেছে ওরা। পরে মার্কা পরিবর্তন করেছে, কিন্তু যে-কোন একটা গরুর চামড়া ছিললে ভেতরে টি-বার ব্র্যান্ড দেখতে পাবে।
গরু কিনছি আমি, মিস্টার, বিরক্ত স্বরে বলল ক্যাপ্টেন, প্রায় শীতল শোনাল কণ্ঠ। এ নিয়ে লড়াই করার খায়েশ নেই আমার, কিংবা গরুর মালিকানা নিষ্পত্তি করার দায়িত্বও দেয়া হয়নি আমাকে। ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে। তোমরা নিজেরাই ঠিক করে নাও। লাস পাসিটাসে পাবে আমাকে।
ঘোড়া ঘুরিয়ে এগোল সে। কয়েকজন অফিসার আর সার্জেন্ট অনুসরণ করল।
প্রত্যেকটা লোককে খুঁটিয়ে দেখলাম-একজন একজন করে। প্রত্যেকের প্রতি মনোযোগ দিলাম, অন্তত মিনিট খানেকের জন্যে। আমি চাই প্রতিটা লোক ভাবুক তাকেই গুরুত্বপূর্ণ বা টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করছি আমি।
তো, জাপাটা, গরুর পাল ডেলিভারি দাওনি তুমি। বাধ্য হয়ে আমার নিজেরই আসতে হলো।
ড্যান…!ট্যাপের কণ্ঠ। ড্যান, খোদার দোহাই!
ট্যাপ, গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই বরং ঠিক করে নাও কোন পক্ষে থাকবে, নির্লিপ্ত স্বরে বললাম ওকে। বেড়া ডিঙাতে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। বহুদিন ধরেই ওই কাজটা করছ তুমি। যথেষ্ট হয়েছে বোধহয়।
দেখো, আগে তো…
কিসের দেখাদেখি, এডলে!? হঠাৎ খেপে উঠল হোনাস গান্ট। হয় আমাদের সঙ্গে থাকবে, নয়তো বিপক্ষে! সরে দাঁড়াও, দেখো কিভাবে খুন করি ট্রেভেন হারামজাদাকে!
আমি যা করলাম, ঘুণাক্ষরেও এমন কিছু আশা করেনি ওরা। বহু বছর ধরেই ছোটার মধ্যে গুলি করার অনুশীলন করেছি আমি আর ট্যাপ, তুমুল গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করেছি, পাহাড়ী মানুষদের মত ঈর্ষণীয় দক্ষতা অর্জন করেছি। স্পার দাবাতে লাফিয়ে এগোল ডানটা, ঠিক ওদের ওপর হামলে পড়ল।
সংখ্যায় বেশি ওরা, সুতরাং গুলিও শুরু করলাম।
দেখে মনে হবে হঠকারি এবং দারুণ বিপজ্জনক একটা কৌশল, কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা যখন এসেছি, বেশিরভাগই বসে ছিল ওরা, নিঃসন্দেহে সবাই একজন করে টার্গেটও ঠিক করে নিয়েছিল। পরিস্থিতি ঠিকই বিচার করেছে ওরা, আমাদের মতই, জানে মুহূর্তের ব্যবধানে কয়েকটা লাশ পড়ে যাবে এখানে।
কিন্তু ভাবেনি নিজেদের লাশ পড়বে।
ঠাণ্ডা মাথায়, নিশানা করে লড়াই শুরু করলে হয়তো সঠিক নিশানায় গুলি করা যাবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত হেরে যাব আমরা। সুতরাং সরাসরি ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওদের ওপর। সব ক’জনকে নড়ে উঠতে বাধ্য করলাম, যার যার টার্গেটকে নিশানায় আনতে সরে যেতে হলো ওদের।
স্যাভলের ওপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে প্যাটার্সনটা। লাফের সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলাম। জাপাটাকে অল্পের জন্যে মিস্ করলাম। কিন্তু ওর পেছনের লোকটা হড়কে পড়ল স্যাডল থেকে। পরমুহূর্তে ওদের ঠিক মাঝখানে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। আরেকটা গুলি করলাম প্যাটার্সন থেকে, তারপরই রাইফেল ছেড়ে দিলাম মুঠি থেকে। অল্প দূরত্বে ওটা দিয়ে সুবিধে করা যাবে না। ভোজবাজির মত বাম হাতে উঠে এসেছে বেল্টের পেছনে গুঁজে রাখা কোল্টটা, রাইফেল ছেড়ে দেয়ার সময় ড্র করেছি।
ঘুরে দাঁড়াল জাপাটা, প্রায় আমার মুখের সামনে গর্জে উঠল ওর পিস্তল। ডানের ধাক্কায় কেঁপে উঠল ওর ঘোড়া, স্যাডলে জাপান্টার শরীর টলে গেল। ইতোমধ্যে গুলি করেছি আমি। চাবুকের বাড়ি খেয়েছে যেন, এমন ভাবে স্যাডলে হেলে পড়ল ওর দেহ। ফের গুলি করল সে, কিন্তু ততক্ষণে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি।
ঘোড়া ঘোরাল সে, কিন্তু ওর ঘোড়াটা বিস্ময়ের কারণেই দ্রুততায় হেরে গেল ডানের সঙ্গে। সামান্য হেরফের হলো বটে, দুজনেই গুলি করলাম আমরা। ফেলিপ জাপাটার নাকের ঠিক নিচে বিঁধল আমার এবারের বুলেট।
ঘুরে গেল জাপাটার দেহ, স্যাডল থেকে খসে পড়ল। প্রায় শেষ মুহূর্তে স্টিরাপ থেকে পা মুক্ত করে নিয়েছে। উঠে দাঁড়ানোর প্রয়াস পেল সে, মুঠিতে পিস্তল ধরে রেখেছে, গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে বুলেটের ফুটো দিয়ে।
তুফান বেগে ছুটল ডানটা, খানিক নিচু করলাম পিস্তলটা, একেবারে কাছ থেকে গুলি করলাম। গুলির তুবড়িতে জাপাটার শার্ট থেকে ধুলো চটকে উঠতে দেখতে পেলাম-দু’বার; তারপরই পড়ে গেল সে। ডানটা মাড়িয়ে গেল ওকে।
ঝটিতি ঘোড়া ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম দৃশ্যটা-হোনাস গান্টের মুখোমুখি হয়েছে ট্যাপ এডলে। ওদের সঙ্গে আছি আমি, হোনাস! ও আমার ভাই!
নরকে যাও তুমি! ট্যাপের বুকে নিশানা করল গান্ট। আমার মতই, ছোটার মধ্যে গুলি করল ট্যাপ।
স্যাডল থেকে খসে পড়ল গান্ট, ধুলোয় পড়ার পর পাক খেয়ে চিৎ হলো শরীর। একবার ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু নিথর হয়ে গেল দেহটা।
বাতাসে ধুলো উড়ছে, চক্কর খাচ্ছে। ধীরে ধীরে থিতিয়ে এল। সওয়ারহীন ঘোড়াগুলো এলোমেলো পা ফেলল, ঝুলন্ত স্টিরাপ ঝাঁকি খেল। তার শান্ত হয়ে মাথা তুলল ঘোড়াগুলো। ধুলোয় পড়ে আছে। কয়েকটা লাশ।
গার্ট ভূপতিত হয়েছে। যন্ত্রণাকাতর মুখে এক হাতে রক্তাক্ত বাহু চেপে ধরেছে কার্ল।
প্রতিপক্ষের চারজন শেষ। আচমকা ওদের ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্যেই লড়াইয়ের সমীকরণ ওলট-পালট হয়ে গেছে, আমাদের পক্ষে চলে এসেছে। প্রয়োজন পড়া মাত্র, মুহূর্তের মধ্যে গুলি করতে অসুবিধে হয়নি আমার বন্ধুদের, নিশানা ঠিক করাই ছিল ওদের।
ঘোড়া ছুটিয়ে ওখানে পৌঁছল সৈন্যদের একটা দল। একজন পৌঁছে গেল কার্লের পাশে। দেখি! তোমার ক্ষতটা দেখতে দাও! আমি আর্মির সার্জন!
চারপাশে, পড়ে থাকা লাশগুলো দেখলাম। ফেলিপ জাপাটা মারা গেছে, অন্যদের মধ্যে কেবল একজন জীবিত। মৃতদের মধ্যে চার্লি হীথও আছে। ক্ষণিকের এই লড়াইয়ে ওকে খেয়াল করিনি, কিংবা জানিও না কার বুলেটে মারা পড়েছে সে। কিন্তু কুৎসিত মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে তাকে।
ক্ষত দেখে বোঝা গেল ভারী ক্যালিবারের বুলেট ওটা, নিশ্চই পমেল বা অন্য কিছুতে আগে লেগেছিল, তারপর ছিটকে গিয়ে ঢুকেছে হীথের পেটে। ক্ষতটা রিকোশেটের। পেট ফুড়ে চলে গেছে সীসা, নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। করুণ এবং বীভৎস মৃত্যু, জাতশত্রুরও এমন মৃত্যু কামনা করে না কেউ।
অফিসার চলে এসেছে। তার দিকে এগোলাম আমি। ক্যাপ্টেন, ওই লোকের নাম ফেলিপ জাপাটা, পড়ে থাকা বিশালদেহী কোমাঞ্চেরোকে দেখিয়ে বললাম। বহু বছর ধরে ইন্ডিয়ানদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে ও। ওর জাতভাইরা আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করবে।
আমি গরু কিনছি, মিস্টার, ব্যক্তিগত কোন কলহ বা সংঘাতে মাথাব্যথা নেই আমার। যাই হোক, জাপাটা সম্পর্কে শুনেছি, তবে জানতাম না এই লোকের সঙ্গেই ব্যবসা করছি। আমার দিকে ফিরল সে আমার নাম ডবসন! কেলি ডবসন। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, স্যার দারুণ দেখিয়েছ তোমরা বিশেষ করে তুমি! জবাব নেই ওই কৌশলটার।
মাটি থেকে প্যাটার্সনটা তুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল কার্ল ক্রকেট। তুমি বরং ডাক্তারের কাছে যাও, ড্যান। রক্ত বেরোচ্ছে তোমার ক্ষত থেকে।
ঠিকই তো আছি। আমি স্রেফ… নিচে তাকাতে সেডলের স্কার্টে রক্ত দেখতে পেলাম, পুরো বাম পা ভিজে গেছে রক্তে।
তুমি! আঙুল তুলে আমাকে নির্দেশ দিল সার্জন। স্যাডল থেকে নেমে এদিকে এসো!
নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম আমি, নিজেও জানতাম না সত্যিই কতটা আহত হয়েছি ছুটে এসে আমাকে চেপে ধরল ট্যাপ। ধরাধরি করে একটা গাছের নিচে আমাকে বসাল ও, শার্ট খুলে ফেলল।
কোমরের ঠিক ওপর দিয়ে মাংস, কুঁড়ে চলে গেছে বুলেট! প্রচুর রক্ত হারিয়েছ বটে, কিন্তু ক্ষতটা তেমন মারাত্মক নয়, ক্ষতটা দেখার পর জানাল ডাক্তার।
খুরের শব্দ শুনতে পেলাম, তুমুল বেগে ছুটে আসছে কয়েকটা ঘোড়া। চোখ তুলে তাকাতে জুয়ানিতাকে ঘোড়া থেকে নামতে দেখতে পেলাম আমি, ছুটে কাছে চলে এল ও{ সরু চোখে ওর দিকে তাকাল ডাক্তার, তারপর আমার দিকে। ও যদি তোমাকে সুস্থ করতে না পারে, শুকনো স্বরে বলল সে। তাহলে কেউ পারবে না।
স্যাম গার্ট মারা যায়নি। দুটো বুলেট ঢুকেছে ওর শরীরে। অবস্থা গুরুতর হলেও ঠিক সেরে উঠবে ও। পরে আমাকে বলেছে ট্যাপ। এদিকে জুয়ানিতা আসার পর সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যায়, কিছু বলার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু জিভটাকে খুব ভারী মনে হলো। সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
পরে নিজেকে ফোর্টের হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলাম।
গরু নিয়ে যেতে কোন অসুবিধে হয়নি তো?
সব বেচে দিয়েছি, বলল ট্যাপ। অবশ্য কয়েকশো ব্রীডিং স্টক রেখে দিয়েছি।
মনে হচ্ছে এখানে কয়েকটা দিন থাকতে হবে আমার, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললাম আমি, প্রশান্তি অনুভব করছি। তুমি বরং গরু নিয়ে বাড়ি চলে যাও।
ড্যান, দ্বিধা করছে ট্যাপ, জীবনে এমন বিব্রত হতে দেখিনি ওকে। বেকুবের মত কাজ করেছি আমি। আমি…স্বীকার করছি, বস্ক রেডোণ্ডোয় ওই গরুর পাল নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আগেই ছিল আমার। মিম্বার্স ভ্যালির জমির দখল নেওয়ার জন্যে পালটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম আমি আর হোনাস গান্ট।
আমিও এরকম কিছু সন্দেহ করেছিলাম।
মিনিট কয়েক স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখল ও। ড্যান, ইলেনকে নিয়ে সবার কাছে চলে যাব আমি। তুমি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকব, তারপর একসঙ্গে বাড়ি ফিরে যাব আমরা।
নিশ্চয়ই, ক্লান্ত কিন্তু সন্তুষ্ট স্বরে বললাম আমি। বাবা সবসময় এটাই চাইতেন-একসঙ্গে থাকব আমরা!