নয়মের কথায় মসজিদের ফিরে এসেছে প্রশান্তি। গলার আওয়াটা খানিকটা বিষণ্ণ করে তিনি বলে যানঃ
‘এ সেই জায়গা, যেখানে ঢুকেই তোমাদের পূর্বপুরুষ কেঁপে উঠতেন খোদার ভয়ে। দুনিয়ার সব ব্যাপার পিছনে ফেলে এখানে ঢুকতেন তাঁরা। আমি ভেবে হয়রান হচ্ছি, তোমাদের মনের উপর কি করে পয়দা হলো এমনি এক যবরদস্ত ইনকেলাব! তোমাদের ঈমান এতটা কমফের হয়ে গেছে, তা যেনো আমি ভাবতেও পারি না। খোদা ও রসূলের পথে জান বাজি রাখতেন যে মুজাহিদ দল, তাদেরই আওলাদ তোমরা। কোনোদিন সেই পূর্বপুরুষের কাছে ফিরে গিয়ে মুখ দেখাতে হবে, এ অনুভুতি যতক্ষণ তোমাদের মনে রয়েছে, ততক্ষণ তোমরা এমনি, জঘন্য কার্যকলাপের পথে যেতে পারো না। আমি জানি, তোমাদের মধ্যে এ ধরনের মনোভাব পয়দা করছে অপর কোন লোক।
ইবনে সাদেক চমকে উঠলো। নাযুক পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সে শ্রোতাদের মন থেকে নয়ীমের কথার প্রভাব দূর করবার চেষ্ট করলো। সে চীৎকার করে বললোঃ দেখুন, এও হাজ্জাজের গুপ্তচর।একে বের করে দিন।’
এ আরো কিছু বলতে চাইলো, কিন্ত রাগে কাঁপতে কাঁপতে নয়ীম বুলন্দ আওয়াযে বললেনঃ
‘আমি হাজ্জাজের গুপ্তচর, তাই ঠিক, তাই ঠিক, কিন্ত ইসলামের গাদ্দার নই। বসরার বদ-নসীব লোকেরা! তোমরা এই ব্যক্তির যবান থেকে শুনেছো আমাদের জিহাদের প্রয়োজন ছিল তখন, যখন আমরা করযোর ছিলাম; কিন্তু একথা শুনেও তোমাদের দেহের খুন গরম হয়ে ওঠেনি। তোমাদের মধ্যে কেউ একথা ভাবলো না যে, আগের দিনের প্রত্যেকটি মুসলমান শক্তি, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার দিক দিয়ে এ যামানার সকল মুসলমানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পাতেন। তারা কি ছিলেন আর কি করে গেছেন? তাঁদের ভিতরে কি ছিলো, তা তোমাদের জানা নেই? তাঁদের ভিতরে ছিলো সিদ্দীকে আকবরের (রাঃ) আন্তরিকতা, উমর ফারুকের (রাঃ) মহৎ মন, উসমানের (রাঃ) বদান্যতা, আলী মুরতযার (রাঃ) শৌর্য এবং আসমান-যমিনে মালিক আল্লাহর প্রীয়তম পয়গাম্বরের দো’আ। তোমাদের মনে পড়ে, যেদিন কুফর ও ইসলামের পহেলা লড়াইয়ে তেগ ও কাফন নিয়ে তারা তিনশ তেরো জন বেরিয়েছিলেন, সেদিন দীন-দুনিয়ার রহমতের নবী বলেছিলেনঃ আজ পুরো ইসলাম কুরের পূর্ণ শক্তির মোকাবিলা করতে যাচ্ছে। কিন্তু আজ এক নীচ মানুষ তোমাদের মুখের উপর বলছেঃ আমাদের চাইতে তাঁরা ছিলেন কমযোর। নাউযুবিল্লাহ।’
নয়মের কথাগুলো সবারই মনের উপর দাগ কাটলো। একজন আল্লাহ আর’ তীর ধ্বনী করলো, আর সবাই তার সাথে আওয়ায় তুলল। এর পর সবাই ফিরে ফিরে তাকাতে লাগলো ইবনে সাদেকের দিকে। কেউ কেউ চাপা গলায় তার নিন্দাও শুরু করলো। নয়ীম বক্তৃতা করে চললেনঃ
‘আমাদের দোস্ত ও বুযুর্গগণ! খোদার রাহে জান, মাল ও দুনিয়ার তামাম স্বাচ্ছন্দ্য কোরবান করেন যে মুজাহিদ দল, তাঁদের উপর রাজ্য ও মালে-গণিমতের লোভের অপরাধ আরোপ করা না-ইনসাফী। দুনিয়ার লোভ যদি তাদের ভিতরে থাকতো, তাহলে মুষ্টিমেয় সহায় সম্বলহীন মুজাহিদ যে ভাবে কাফেরদের সংখ্যাহীন বাহিনীর সামনে বুক ফুলিলে দাঁড়িয়েছেন, আত্মদানের সে উদ্যম-উৎসাহ তোমরা দেখতে পেতে না। রাজ্য লোভ নিয়ে বেরুলে বিজিত কওম কে তাঁরা দিতে পাতেন না সম অধিকার। আজো আমাদের ভিতরে এমন কেই নেই, যে শাহাদতের পরিবর্তে মালে গণিমতের লোভ নিয়ে যাচ্ছে জিহাদের ময়দানে! মুজাহিদ শাসন-ক্ষমতা চায় না, কিন্তু খোদার রাহে যারা সব কিছু কোরবান করে দিতে তৈরী, সব দিক দিয়ে দুনিয়ায় তাঁদের মাথা উঁচু থাকায় বিস্ময়ের কিছু নেই। সাতানাত মুজাহিদের মহিমারই অংশ।
‘মুসলমান ভাইরা! আমাদের অতীত ইতিহাসের পষ্ঠা যেমন সিদ্দীকে আকবরের ঈমান ও আন্তরিকতার কাহিনীতে পরিপূর্ণ, তেমনি আব্দুল্লাহ বিন উবাইর মুনাফেকির কাহিনী থেকেও তা মুক্ত নয়। সিদ্দীকে আকবরের (রাঃ) পদাংক অনুসরকারীদের সামনে হামেশা যেমন থাকে ইসলামের সংগঠনী দৃষ্টিভংগী, তেমনি আবদুল্লাহ্ বিন্ উবাইর উত্তরাধিকারীরা হামেশা ইসলামের তরীর পথে তুলে দেয়া বাঁধার প্রাচীর; কিন্ত তার ফল কি হয়ে থাকে? আমি আবদুল্লাহ বিন উবাইর এই উত্তরাধিকারীর কাছে জিজ্ঞেস করছি।’
ইবনে সাদেকের অবস্থাটা তখন চারদিক থেকে শিকারীর বেড়াজালের মধ্যে অবরুদ্ধ শিয়ালের মতো। সে তখন ঠিকই বুঝে নিয়েছে যে, কথার যাদুকর এ নওজোয়ান আরো কয়েকটা কথা বললে সমবেত লোকজন সবাই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি দেকে পিছন দিকে সরতে লাগলো। একজন বলে উঠলো, মুনাফেক পালাচ্ছে, ধর।’ এক নওজোয়ান ‘ধর ধর’ আওয়ায করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সাথীরা তাকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো, কিন্ত জনতার ভিড়ে টিকতে পারলো না। কেউ তাকে ধাক্কা মারে আর কেউ বা মারে চড়চাপড়। মুহম্মদ বিন কাসিম ছুটে এসে জনতার হাত থেকে বহু কষ্টে তার জান বাঁচিয়ে দিলেন।
ইবনে সাদেক কোনমতে বিপদমুক্ত হয়ে ছুটে পালালো। কয়েকটি দুর্দান্ত নওজোয়ান শিকার হাত ছাড়া হচ্ছে দেখে ছুটতে চাইলো পিছু পিছু। কিন্ত মুহাম্মদ বিন কাসিম বাধা দিলেন তাদেরকে। ইবনে সাদেকের দলের লোকেরা একে একে বেরিয়ে গেলো মসজিদ থেকে। আবার সবাই চুপ করে নয়ীমের দিকে মনোযোগ দিলে তিনি বলতে লাগলেনঃ