আপনি হয়তো এই সব নীতি একেবারে কাজে লাগাতে অসুবিধা বোধ করতে পারেন। ব্যাপারটা আমি ভালোই জানি যেহেতু বইটা আমারই লেখা। আমি নিজেও তাই অসুবিধা বোধ করি। তাই বইটা যখনই পড়বেন তখনই মনে রাখবেন শুধু খবর সংগ্রহ করার জন্যই বইটা পড়ছেন না। আপনি নতুন অভ্যাস পড়ে তুলতে চাইছেন। হ্যাঁ, আপনি নতুন জীবন যাপনের উপায় খুঁজছেন। এজন্য দরকার ধৈয্য আর প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহার।
সুতরাং পাতাগুলোয় মাঝে মাঝেই চোখ বোলান। বইটিকে দুশ্চিন্তা জয় করার কাজে লাগানোর বই ভাবুন–আর কোন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে চঞ্চল হবেন না। তার বদলে বইটার পাতা উল্টে অধ্যায়গুলো পড়ুন। এটা করলে দেখবেন ইন্দ্রজালেন মতই কাজ হবে।
৭। আপনার স্ত্রীকে কিছু টাকা দিন যাতে তিনি বইটির নিয়মের বাইরে কোন কাজ করলে আপনাকে যেন ধরে ফেলেন। দেখবেন তিনি এটা করলে আপনার উচিত শাস্তি হবে।
৮। এ বইয়ে যেখানে ওয়ালস্ট্রীটের ব্যাঙ্কার এইচ, পি. হাওয়েল আর বুড়ো ফ্রাঙ্কলিনের কথা আছে সে জায়গাটা পড়ে দেখুন তারা কিভাবে ভ্রম সংশোধন করেছিলেন। আপনিও তাদের মত ব্যাপারটা কাজে লাগান না কেন? এটা করলে দুটো ব্যাপার দেখতে পাবেন :
প্রথমতঃ দেখবেন এইভাবে শেখার সময় খুব চিন্তায় কাটবে আর অমূল্য বলেই তা মনে হবে।
দ্বিতীয়তঃ আপনি দেখবেন দুশ্চিন্তা কাটিয়ে জীবন যাপনের ক্ষমতা আপনার অদ্ভুত গতিতেই বেড়ে উঠেছে।
৯। একটা ডায়েরী রাখুন–সেই ডায়েরীতে আপনার সমস্ত সাফল্যের বিবরণ লিখে রাখবেন। পরিষ্কারভাবে লিখবেন। নাম, তারিখ আর ফলাফল লিপিবদ্ধ করবেন। এভাবে লিখে রাখলে আপনি আরও বেশি সফল হওয়ার প্রেরণা পাবেন। বহু বছর পরে যখন ডায়েরীটা দেখবেন কি ভালোই না তখন লাগবে।
০৬. দুশ্চিন্তা দূর করার উপায়
একটা রাতের কথা আমি ভুলবো না, কবছর আগে ম্যারিয়ন জে. ডগলাস যখন আমার ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। (নামটা তিনি প্রকাশ করতে বারণ করেছিলেন বলে ছদ্মনাম দিচ্ছি)। গল্পটা কিন্তু সত্যি। আমার বয়স্ক শিক্ষার ক্লাসে তিনি এটা বলেন। তিনি জানান বারবার দুবার তার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রথমে তিনি তার পাঁচ বছরের মেয়েকে হারান। এই মেয়েটিকে তিনি প্রাণের অধিক ভালবাসতেন। তিনি আর তার স্ত্রী ভেবেছিলেন এ শোক তারা সহ্য করতে পারবেন না। দশমাস পরে ঈশ্বর তাদের আর একটি কন্যাসন্তান উপহার দিলেন। কিন্তু সেও পাঁচদিনের মাথায় মারা যায়।
এই দুটো পরপর শোক আমাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো, ভদ্রলোক আমাদের বলেছিলেন। কিছুতেই তা সহ্য করতে পারিনি। ঘুমোতে, বিশ্রাম নিতে বা খেতে পারছিলাম না। আমার সমস্ত স্নায়ু অবশ হয়ে যায়, সব আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিন ডাক্তারের কাছে গেলে একজন ডাক্তার ঘুমের ঔষধ খেতে বলেন অন্যজন কোথাও ঘুরে আসতে বলেন। দুটোই তিনি করলেন কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। তিনি বলেছিলেন, মনে হতে লাগলো আমার শরীর কেউ চিমটে দিয়ে চেপে ধরেছে–শোকের অসহায়তা যারা টের পেয়েছেন তারাই শুধু এটা বুঝবেন।
তবুও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ একটি সন্তান আমাদের ছিলো–চার বছরের একটা ছেলে। সেই আমার সমস্যার সমাধান করে দিলো। এক সন্ধ্যায় শোকাহত হয়ে যখন বসেছিলাম সে বললো : বাবা, আমায় একটা নৌকা বানিয়ে দেবে? নৌকা বানাবার মত মনের অবস্থা আমার ছিলো না–আসলে কিছু করার মতই আমার অবস্থা ছিলো না। কিন্তু ছেলে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকায় মত দিতেই হলো।
নৌকা তৈরি করতে আমার তিনঘন্টা লেগে গেল। যখন কাজ শেষ করলাম টের পেলাম ওহ তিনঘন্টাই আমি দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে প্রথম মানসিক প্রশান্তিতে কাটিয়েছি।
ওই আবিষ্কারের ফলেই অবসাদ কাটিয়ে আমি কয়েক মাসের মধ্যে প্রথম চিন্তা করতে পারলাম। বুঝলাম কাজে ব্যস্ত থাকলে দুশ্চিন্তা করার আর কোন সময় বা অবকাশ থাকে না। আমার ক্ষেত্রে ওই নৌকো বানানোই আমায় রক্ষা করেছে। তাই ঠিক করলাম কাজে ব্যস্ত থাকবো।
পরদিন সব ঘর ঘুরে কি কি কাজ করতে হবে স্থির করলাম। বহুঁকাজ করা বাকি ছিল–বইয়ের আলমারী, সিঁড়ির ধাপ, জানালা, দরজার হাতল, তালা, পাইপ, নানা জিনিস। আশ্চর্য লাগলেও দু’সপ্তাহের মধ্যে ২৪২টা জিনিসের তালিকা তৈরী করে ফেলোম।
গত দুবছরে প্রায় সবই শেষ করেছি। আমার জীবন নানা উত্তেজনায় নিয়োজিত রেখেছি। প্রতি সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে বয়স্ক শিক্ষা ক্লাসে যোগ দিই। নানা সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছি, আমি এখন স্কুলবোর্ডের চেয়ারম্যান। রেড ক্রশের জন্য আমি টাকাও তুলি, তাই দুশ্চিন্তার সময় নেই। ঠিক এই কথাই উইনষ্টন চার্চিল বলেছিলেন যুদ্ধের বিবর্ণবিষময় দিনগুলোয় যখন তিনি দৈনিক আঠারো ঘন্টারও বেশি কাজ করতেন। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে প্রচণ্ড দায়িত্ব সম্বন্ধে তার দুশ্চিন্তা হয় কিনা, তিনি জবাব দেন; আমি দারুণ ব্যস্ত। দুশ্চিন্তা করার মত সময় নেই।
মোটর গাড়ির ফেলফ স্টার্টার আবিষ্কারের সময় চার্লস্ কেটারিংয়েরও এই বিপদ আসে। অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি বিখ্যাত জেনারেল মোটরস্–এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তবুও তিনি তখন এতই গরীব ছিলেন যে প্রথমে খড় রাখা বাড়িতেই তাকে গবেষণাগার বসাতে হয়। মুদির দোকানের দেনা মেটাতে তাকে তার স্ত্রীর পিয়ানো শিখিয়ে আয় করা পনেরো শ’ ডলার ব্যয় করতে হয়, তাছাড়া বীমা কোম্পানী থেকেও পাঁচশ ডলার ধার করতে হয়। আমি তার স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম তার দুশ্চিন্তা হয় কি না। তিনি উত্তর দেন, হ্যাঁ, এতোই দুশ্চিন্তা হয় যে ঘুমোতে পারিনি। তবে আমার স্বামীর কোনো দুশ্চিন্তাই ছিল না। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকায় তার দুশ্চিন্তার সময় ছিলো না।