- বইয়ের নামঃ শেবা
- লেখকের নামঃ জ্যাক হিগিনস
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য,রোমাঞ্চকর, গোয়েন্দা কাহিনী
শেবা
০১. বার্লিনে বৃষ্টিঝরা মার্চের শেষ বিকেল
শেবা / মূল : জ্যাক হিগিনস / ভাষান্তর : কাজী আখতারউদ্দিন
অনুবাদকের উৎসর্গ
আমার সহধর্মিণী হাবিবা খান-কে
বাতাসের ঝাপটায় মুখ ঢেকে রাখা কাপড়টা সরে যেতেই খোলা মুখের চামড়ায় জ্বলন্ত সুর্যের তেজ কেটে বসেছে। তারপর আবার সে মুখ থুবড়ে বালুতে পড়ে গেল, আবার জামাল তাকে টেনে তুলল।
এবার সে জামালের চওড়া কাঁধে এলিয়ে পড়ল। সে ভ্রু কুঁচকে মাথা ঝাঁকাল, চেষ্টা করল পরিষ্কারভাবে সবকিছু ভাবতে, কিন্তু কোন কাজ হলো না। এখন আর কোন কিছুই ভাল নেই। সে অন্ধকার একটা তাপের শূন্যতার মাঝে সেঁধিয়ে একটু একটু করে তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলল।
তার মুখে বালু ঢুকেছে। সে আর হাতের আঙুল দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগল। কিন্তু এবার কোন শক্ত হাত থাকে ধরে টেনে তুলল না। এবার সে সম্পূর্ণ একা।
.
খ্রিষ্টপূর্ব ২০ অব্দে রোমান সেনাপতি এলিয়াস গ্যালাস, দক্ষিণ আরব জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। তবে সেই অভিযানে ‘রাভ আল খালি’ নামে এক ভয়ংকর শূন্য এলাকায় তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সেনাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যালেক্সিয়াস নামে এক দুঃসাহসী গ্রিক দলপতি। ১০ম লিজিয়নের একশো সেনার এই দলপতি সেই মরুভূমি থেকে হেঁটে ফিরে আসেন, বয়ে নিয়ে আসেন প্রাচীন জগতের এক লুক্কায়িত বিষয়। বাদশাহ সোলায়মানের গুপ্তধনের মতো এটিও একটি অত্যাশ্চর্য নিদর্শন, যা দুহাজার বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর…
.
বার্লিন, মার্চ ১৯৩৯
০১.
বার্লিনে বৃষ্টিঝরা মার্চের শেষ বিকেল। একটি কালো মার্সেডিস লিমোজিন উইলহেমস্ট্রাস দিয়ে নতুন রাইখ চ্যান্সেলারির দিকে যাচ্ছে। ওই ভবনটি জানুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়েছে। এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করার জন্য হিটলার এক বছর সময় দিয়েছিলেন। তবে সময়সীমা শেষ হওয়ার দুসপ্তাহ আগেই তার নির্দেশ পালিত হয়। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী–এবহোয়ের চিফ, এডমিরাল উইলহেম ক্যানারিস একটু ঝুঁকে গাড়ির জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলেন, যাতে তিনি ভবনটি ভালভাবে দেখতে পারেন।
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘অবিশ্বাস্য ব্যাপার, বুঝতে পেরেছো হান্স, ভস-স্ট্রাসের দিকে শুধু সামনের দিকটাই সিকি মাইল লম্বা।
পাশে বসা তার সহকারী হান্স রিটার একজন লুফটওয়াফ ক্যাপ্টেন। আয়রন ক্রস সেকেন্ড ও ফার্স্ট ক্লাস প্রাপ্ত সুদর্শন যুবকটি মুখ ফেরাতেই তার ডান গালে একটি বিভৎস ক্ষত চিহ্ন চোখে পড়ল; আর তার পায়ের কাছে দেখা গেল একটি পায়ে ভর দেবার লাঠি পড়ে রয়েছে। স্পেনিশ সিভিল ওয়ারে যখন সে জার্মান কনডর লিজিয়নে উড়ছিল তখন একজন আমেরিকান ভলান্টিয়ার পাইলট গুলি করার ফলে তার এই দুর্দশা হয়েছে।
সে বলল, “ঐ পিলারগুলো আর মার্বেল ইত্যাদিসহ এটাকে প্রাচীন যুগের একটি অত্যাশ্চর্য নিদর্শন মনে হচ্ছে, হের এডমিরাল।
‘তার মানে নতুন যুগের একটি নিদর্শনের বদলে?’ ক্যানারিস কাঁধে একটা কঁকি দিয়ে জানালার কাঁচটা উঠিয়ে দিলেন। সবকিছু এক সময়ে চলে যায় হান্স, এমনকি থার্ড রাইখও। যদিও আমাদের প্রিয় ফুয়েরার আমাদেরকে এক হাজার বছরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি কেস থেকে একটা সিগারেট বের করতেই রিটার তার লাইটার দিয়ে সেটা ধরিয়ে দিল। প্রবীন লোকটির কথার সুরে প্রচ্ছন্ন উপহাসের আভাস পেয়ে সব সময়ের মতো সে একটু শঙ্কিত হল।
‘তা আপনি যা বলেন, হের এডমিরাল।
কী এক উদ্ভট ভাবনা তাই না? হয়তো একদিন, টুরিষ্টরা এই চ্যান্সেলারির ভগ্নাবশেষের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখবে, যেরকম তারা মিশরে লুক্সর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে বেড়ায়; আর মন্তব্য করবে, ‘ভাবছি কি ছিল জিনিসটা?
মার্সিডিসটা গিল্টি করা চকচকে গেট পেরিয়ে সোজা সামনের বিশাল প্রবেশ পথের সিঁড়ির দিকে এগোলো৷ রিটার একটু অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। ‘হের এডমিরাল যদি অনুগ্রহ করে আমাকে একটু আভাস দিতেন কেন আমাদের এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে?
‘এ সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তাছাড়া উনি কেবল আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, তোমার সাথে নয়, হান্স। আমি তোমাকে সাথে এনেছি যদি অস্বাভাবিক কোন কিছু ঘটে যায়, সে কারণে।
‘আমি কি গাড়িতে অপেক্ষা করব?’ গাড়িটা সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাতেই রিটার জিজ্ঞেস করল।
‘না তুমি রিসিপশনে অপেক্ষা করতে পার। জায়গাটা বেশ আরামপ্রদ আর সেখানে তুমি থার্ড রাইখের নতুন শিল্প কর্মগুলো দেখতে পারবে, সময়টাও বেশ কেটে যাবে।
তার ড্রাইভার, ক্রেগম্যারিন পেটি অফিসারটি ঘুরে এসে দরজা খুলে ধরল। ক্যানারিস গাড়ি থেকে বের হয়ে রিটারের জন্য অপেক্ষা করলেন। তার যথেষ্ট বেগ পেতে হল গাড়ি থেকে নামতে। সার্জিক্যাল নকল বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবার পর সে হাতের লাঠির সাহায্যে বেশ স্বচ্ছন্দে এগিয়ে গেল। তারপর দুজনে একসাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।
এস এস গার্ডরা ছিল লেইবস্টান্ডার্ট এডলফ হিটলারের বাহিনীর অধীনে। এদের ইউনিফর্ম কালো আর বুকে সাদা চামড়ার বর্ম। ক্যানারিস আর রিটার ভেতরে ঢুকতেই এরা চৌকশ স্যালুউট করল। চমৎকার হলঘরটির মেঝেটা মোজাইকের, দরজাগুলো সতেরো ফুট উঁচু আর দরজার গায়ে নখে স্বস্তিকা আঁকড়ে ধরা ঈগলের বিশাল প্রতিকৃতি। সোনালি রঙের ডেস্কে ড্রেস-ইউনিফর্ম পরা একজন তরুণ হটস্টার্ন-ফুয়েরার বসে রয়েছে। দুজন আর্দালি তার পেছনে দাঁড়ানো রয়েছে। সে এক লাফে উঠে দাঁড়াল।
‘হের এডমিরাল! ফুয়েরার দুবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছেন।’
প্রিয় হফার, আধঘণ্টাও হয়নি, আমি তার সাথে দেখা করার আদেশ পেয়েছি। ইনি আমার সহকারি, ক্যাপ্টেন রিটার। দয়া করে আমার হয়ে এর দেখাশোনা করো।
‘অবশ্যই, হের এডমিরাল। তারপর হফার পাশে দাঁড়ানো একজন আর্দালিকে ইশারা করে বলল, ‘হের এডমিরালকে ফুয়েরারের রিসেপশন সোয়টে নিয়ে যাও।
আর্দালি দ্রুত পদক্ষেপে রওয়ানা দিল, ক্যানারিস তার পিছু পিছু চললেন। হফার ডেস্ক ঘুরে এসে রিটারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, স্পেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ, রিটার নকল পায়ের উপর হাতের লাঠি দিয়ে মৃদু আঘাত করে বলল, “আমি এখনও উড়তে পারি, কিন্তু ওরা আমাকে অনুমতি দেবে না।
‘কি দুঃখজনক,’ হফার তাকে বসার আসনগুলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। আপনি বিশাল আয়োজনটা মিস করবেন।’
রিটার সোফায় আরাম করে বসে সিগারেট কেসটা বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি মনে করেন, এটা আসলেই হবে?
‘কেন, আপনার মনে হয় না? আচ্ছা আরেকটা কথা, এখানে ধুমপান সম্পূর্ণ নিষেধ, ফুয়েরারের সুস্পষ্ট নির্দেশ।’
‘ধুত্তুরি, রিটার বলে উঠল। অনবরত পায়ে ব্যাথার কারণে সিগারেট খেলে সে কিছুটা আরাম পায়।
হফার সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, “দুঃখিত। তবে আমাদের এখানে সবচেয়ে ভাল কফি আছে।
তারপর সে ঘুরে ডেস্কের কাছে গিয়ে টেলিফোন তুলল।
.
গার্ড হিটলারের স্টাডিরুমের বিশাল দরজা খুলে ধরতেই ক্যানারিস ভেতরে এত মানুষ দেখে অবাক হলেন। সেখানে উপস্থিত তিন বাহিনী প্রধান–লুফটওয়াফের গোয়েরিং, সেনাবাহিনীর খিষ্ট এবং ক্রেগম্যারিনের রায়েডার। আরো রয়েছে হিমলার, ভন রিবেট্রপ, জেনারেল জড, কেইটেল আর হালডার। পুরো কামরায় নিরবতা। ক্যানারিস ঢুকতেই সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখল।
‘এই যে এডমিরাল অনুগ্রহ করে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন, তাহলে আমরা এবার শুরু করতে পারি, হিটলার বললেন। আমি খুব সংক্ষেপে বলবো। আপনারা নিশ্চয়ই জেনেছেন ব্রিটিশরা আজ ঘোষণা করেছে, যুদ্ধ বাধলে তারা পোলিশদের নিঃশর্তভাবে সমর্থন করবে।
গোয়েরিং বললেন, কিন্তু ফুয়েরার, ফরাসিরাও কি তাই করবে?
হিটলার তাকে বললেন, “নিঃসন্দেহে করবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার। সময় তারা কিছুই করবে না।
এবার ও কে ডব্লিউর চিফ অফ স্টাফ হালডার জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন পোলান্ডে অভিযান চালানো হবে। আর রাশিয়ানরা কী করবে?
‘তারা এখানে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধরে নিন তাদের সাথে একধরনের বুঝাঁপড়া চলছে আর এই বিষয়টি এ পর্যন্তই থাক। অতএব ভদ্রমহোদয়গণ, এ বিষয়ে আমার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত এটিই। আপনারা কেইস হোয়াইটের প্রস্তুতি নিন–পয়লা সেপ্টেম্বর পোলান্ডে অভিযান চালানো হবে। ‘যেন প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে সবার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হলো। কর্ণেল জেনারেল ব্ৰখিস্ট প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, কিন্তু ফুয়েরার, আমাদের হাতে তো মাত্র ছয়মাস সময় আছে।’
হিটলার বললেন, যথেষ্ট সময়। যদি কারো এ বিষয়ে দ্বিমত থাকে তাহলে এখনই বলুন। চারপাশে পিন পতন নিরবতা নেমে এল।
‘ঠিক আছে, তাহলে কাজে লেগে পড়া যাক, ভদ্রমহোদয়গণ। আপনারা সবাই এবার যেতে পারেন, কেবল হের এডমিরাল আপনি যাবেন না।
সবাই সারিবদ্ধ হয়ে চলে গেল। ক্যানারিস সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন আর হিটলার জানালা দিয়ে বাইরে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলেন। তারপর তিনি ঘুরে তাকালেন। ব্রিটিশ আর ফরাসিরা যুদ্ধ ঘোষণা করবে ঠিকই কিন্তু কিছুই করবে না। আপনার কি মনে হয়?
‘একদম সঠিক, ক্যানারিস বললেন।
‘আমরা পোলান্ড আক্রমণ করে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেব। একবার এটা করা হলে ব্রিটিশ আর ফরাসিদের আর এগোবার কোন অর্থ আছে? এরপর তারা শান্তির জন্য আবেদন করবে।’
“আর যদি তা না করে?
হিটলার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন। তাহলে আমি কেইস ইয়েলো কাজে লাগাবো। আমরা বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ফ্রান্সে অভিযান চালিয়ে ব্রিটিশদেরকে সাগর পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাবো। তখন তাদের বোধোদয় হবে। তবে তারা আমাদের স্বাভাবিক শত্রু নয়।’
‘আমি একমত, ক্যানারিস বললেন।
‘এ কথাটা বলার পর আমার মনে হলো, যত শীঘ্র সম্ভব আমার ইংরেজ বন্ধুদের দেখিয়ে দেওয়া দরকার যে, আমি যা বলি তা করি।
ক্যানারিস একটা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন, আপনার মনে ঠিক কি চিন্তা আছে, ফুয়েরার?
দূরের দেয়ালে টাঙানো বিশাল বিশ্ব মানচিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, “এদিকে আসুন হের এডমিরাল! আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।’
.
এক ঘণ্টা পর ক্যানারিস চ্যান্সেলারির রিসেপশন হলে ফিরে দেখলেন হকার তার ডেস্কে বসে রয়েছে, পেছনে দুজন আর্দালিসহ। রিটারের কোন দেখা নেই। এস এস ক্যাপ্টেন তাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে বলল,
‘হের এডমিরাল!
‘আমার সহকারি?’ ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন।
‘হপটম্যান রিটারের প্রচণ্ড ধুমপানের প্রয়োজন হওয়ায় তিনি আপনার গাড়িতে ফিরে গেছেন।
‘ধন্যবাদ, ক্যানারিস বললেন। আমি নিজেই যেতে পারব।’
তিনি বিশাল দরজার বাইরে গিয়ে সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গ্রেটকোটের বোতাম লাগাতে লাগলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ড্রাইভার আসার আগেই লিমোজিনের পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রিটারের পাশে বসলেন।
‘সোজা আমার অফিস, ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে মাঝখানের কাঁচের পার্টিশনটা বন্ধ করে দিলেন।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই রিটার হাতের সিগারেট নিভিয়ে দিতে উদ্যত হল। কোন দরকার নেই। আমাকেও একটা দাও।
রিটার সিগারেট কেস খুলে একটা সিগারেট দিল এবং লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিল। সব কিছু ঠিক আছে তো হের এডমিরাল? আমি দেখলাম ওরা সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে, আমার চিন্তা হচ্ছিল।
‘হান্স, ফুয়েরার ব্যক্তিগতভাবে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন পয়লা সেপ্টেম্বর পোলান্ডে অভিযান চালাবার।
‘হায় ঈশ্বর!’ রিটার বলল। কেইস হোয়াইট।’
‘ঠিক তাই, তিনি রাশিয়ানদের সাথে এক ধরনের বোঝাঁপড়া করে যাচ্ছেন। তারা একটা চুক্তিতে আসবে। তারা আমাদেরকে এ কাজ করতে দেবে পূর্ব পোলান্ডের একটা অংশের বিনিময়ে।
আর ব্রিটিশরা?
‘হু, ব্রিটিশরা যুদ্ধ ঘোষণা করবে আর আমি নিশ্চিত সেই সাথে ফরাসিরাও তাই করবে। তবে ফুয়েরার কোন এক কারণে বিশ্বাস করেন তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে কোন কিছু করবে না এবং এ ব্যাপারে আমিও একমত। আমরা যখন পোলান্ড পুরোপুরি দখলে নেব ওরা চুপ করে বসে থাকবে। তার ধারণা একবার কাজটা শেষ হয়ে যাবার পর, আমরা সবাই আলোচনার টেবিলে বসবো এবং একটা স্থিতাবস্থায় চলে আসবো। তিনি আমাদের জানিয়েছেন ব্রিটেন আমাদের স্বভাবজাত শত্রু নয়।
‘আপনি এ বিষয়ে একমত, হের এডমিরাল?’
‘এ বিষয়ে তিনি অনেকটা সঠিক হান্স, তবে ব্রিটিশরা বড় একরোখা জাতি আর চ্যামবারলেন খুব একটা জনপ্রিয় নন। মিউনিখের ঘটনার পর থেকে তার নিজের দেশের লোকেরাই তাকে পছন্দ করে না।
তিনি সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে নিভিয়ে দিলেন। যদি উপরের দিকে কোন পরিবর্তন হয়, ধরো চার্চিল…’ তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন। কে জানে কি হয়?
‘আর আমরা কি করব?
‘আমরা কেইস ইয়েলো কার্যকর করবো। ভাটির দেশগুলো আর ফ্রান্সে অভিযান চালিয়ে, ব্রিটিশরা যেসব সেনাদল চ্যানেল পার করে এনেছিল তাদেরকে সাগরের দিকে ঠেলে দেব।’
একটুখানি থেমে রিটার বলল, এটা কি করা সম্ভব হবে?’
‘আমার মনে হয় এটা সম্ভব হান্স, যতক্ষণ না আমেরিকানরা এদিকে হস্তক্ষেপ করে। ফুয়েরারের প্রেরণাদায়ক নেতৃত্বে আমরা রাইনল্যান্ড পুনর্দখল করতে পেরেছি, অস্ট্রিয়া আর চেকোস্লোভাকিয়া আয়ত্ব করেছি, এছাড়া টুকটাক আরো কিছু পেয়েছি। আমার কোন সন্দেহ নেই পোন্ড আমরা জয় করব।’
“কিন্তু তারপর কি হবে, হের এডমিরাল? ফরাসি আর ব্রিটিশরা?
‘হ্যাঁ, এবার মূল বিষয়ে আসা যাক, কেন সবাই চলে যাবার পর ফুয়েরার আমাকে আটকে রেখেছিলেন।
‘কোন বিশেষ প্রজেক্ট, হের এডমিরাল?
‘সেরকমই কিছু একটা, তুমি বলতে পারো। তিনি চাচ্ছেন পয়লা সেপ্টেম্বর আমরা সুয়েজ খাল উড়িয়ে দেই, ঠিক যেদিন পোলান্ড আক্রমণ করা হবে।’
রিটার সিগারেট কেসটা খুলতে খুলতে বলে উঠল, ‘হায় ঈশ্বর!
ক্যানারিস তার হাত থেকে কেসটা নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন।
‘তিনি কর্ণেল রোমেলের কাছ থেকে এই আইডিয়াটা পেয়েছেন। সুদেনল্যান্ড দখল করাকালীন রোমেল আমাদের ফুয়েরারের এসকর্ট ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন। উপযুক্ত কারণেই তিনি রোমেল সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। আর বলা যায় এই আইডিয়াতে এক ধরনের পাগলামো যুক্তি আছে। তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি সুয়েজ খাল হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সরাসরি যোগাযোগের পথ। এই সংযোগ পথটি কেটে দিলেই ভারতবর্ষ, দূর প্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়াগামি সব জাহাজকে আফ্রিকা এবং উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ঘুরে যেতে হবে। এর ফলে সামরিক প্রতিক্রিয়া কী হবে বুঝতেই পারছো।
কিন্তু হের এডমিরাল, কি উপায়ে আমরা সেই এলাকায় লোকজন আর যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবো?
ক্যানারিস মাথা নেড়ে বললেন, না, হান্স, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে ভুল করেছে। আমরা সেখানে সরাসরি সামরিক অভিযানের কথা বলছি না, আমরা বলছি স্যাবোটাজের কথা। ফুয়েরার চাচ্ছেন পোলান্ডে অভিযানের দিনে আমরা সুয়েজ খালটা উড়িয়ে দেই, পুরো পথটা অকার্যকর করে ফেলি। এমনভাবে পুরোপুরি বন্ধ করে দেই যেন আবার এটা চালু করতে এক বছরের বেশি সময় লাগে।
‘বাপরে! কি বিশাল আঘাত, পুরো পৃথিবী চমকে যাবে। রিটার বলল।
‘সঠিক করে বলতে গেলে ব্রিটিশদের অন্তরাত্মা কেঁপে যাবে আর তখন ওরা বুঝতে পারবে আমরা কি করতে পারি। অর্থাৎ এভাবেই আমাদের ফুয়েরার বিষয়টি বিশ্বাস করেন। ক্যানারিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘অবশ্য, কীভাবে কাজটা আমরা করবো সেটা আরেক ব্যাপার। তবে আমাদেরকে কিছু একটা প্ল্যান দেখাতে হবে, অন্তত কাগজে কলমে। আর সেখানেই তোমার ভুমিকা, হান্স।
‘আচ্ছা, এবার বুঝতে পেরেছি হের এডমিরাল।
৭৪/৬ তিরপিজ উফারে এবহোয়ের অফিসের সামনে এসে লিমোজিনটা থামল। পেটি অফিসারটি দ্রুত ঘুরে এসে গাড়ির দরজা খুলে ধরতেই ক্যানারিস আর রিটার গাড়ি থেকে নামলেন। যুবক রিটার প্রু কুঁচকে কিছু ভাবছে মনে হলো।
ক্যানারিস বললেন, তুমি ঠিক আছে তো?”
‘আমি ঠিক আছি হের এডমিরাল। আমার মনের মধ্যে কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে, যা আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক হতে পারে।
‘সত্যি?’ ক্যনারিস একটু মৃদু হেসে সামনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজার কাছে একটু থামলেন–এটা একটা সুখবর বটে, তবে শুভস্য শীঘ্রম, মনে রেখো হান্স। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, যখন ক্যানারিস তার ডেস্কে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে কাজ করছিলেন আর তার প্রিয় ডাকসান্ড কুকুরদুটো কামরার এককোণে একটা বাক্সে ঘুমিয়ে ছিল, তখন দরজায় ঠক ঠক শব্দ হলো। আর সাথে সাথে রিটার এক হাতে একটা ফাইল, বগলে রোল করা একটা ম্যাপ নিয়ে ঢুকল। সে তার লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এগুলো।
‘এই সুয়েজ খাল প্রকল্প নিয়ে আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে, হের এডমিরাল?
ক্যানারিস চেয়ারে পিঠ দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, ‘এত শীঘ্রই হান্স?’
‘আমিতো আগেই আপনাকে বলেছি, আমার মনে একটা বিষয় খচ খচ করছিল, অফিসে ফেরার পরই বিষয়টি মনে পড়ল। গত মাসেই আমি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের একজন অধ্যাপক অটো মুলারের কাছ থেকে একটা রিপোর্ট পাই। কিছুদিন আগে তিনি দক্ষিণ আরব থেকে ফিরে এসেছেন। শীঘ্রই আবার সেখানে যেতে চাচ্ছেন। তবে তার আরো কিছু তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজন পড়েছে।
ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন, এর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক?
আপনিতো জানেন হের এডমিরাল, যেসব জার্মান নাগরিক বিদেশে কাজ করেন, তারা কোন ধরনের অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে এখানে এবহোয়ের সদর দপ্তরে রিপোর্ট করতে বাধ্য।
‘তো?”
‘আমাকে বলতে দিন, হের এডমিরাল, রিটার অন্যপাশের দেয়ালে টাঙানো ম্যাপ-বোর্ডের পাশে গিয়ে তার বগলের নিচ থেকে ম্যাপটা নিয়ে ঐ বোর্ডে পিন দিয়ে জায়গামতো টাঙালো। ম্যাপটিতে মিশর ও সুয়েজ খাল, পুরো দক্ষিণ আরব, লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগর দেখা যাচ্ছে।
‘আপনি এখানে দেখতে পাচ্ছেন হের এডমিরাল, ব্রিটিশ উপস্থিতি–ইয়েমন, এডেন উপসাগর জুড়ে বিভিন্ন আরব রাজ্য, ভারত মহাসাগর, দোফার এবং ওমান।
‘তারপর?’ ম্যাপটি নিরীক্ষণ করতে করতে ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনি নিশ্চয়ই উপসাগরের উপকূলে দাহরান বন্দরটি লক্ষ্য করেছেন। এখান থেকেই মুলার তার কাজ পরিচালনা করেন। এ জায়গাটি স্পেনের অধীনে। অনেকটা ভারতীয় উপকুল বন্দর গোয়র মতো। সেখানে স্পেনিয়রা কয়েকশো বছর ধরে রয়েছে।
‘আমি বুঝতে পারছি এ জায়গাটা অনেকটা সেরকম, ক্যানারিস বললেন।
উত্তরে সউদী আরবের সীমানা জুড়ে রয়েছে রাব আল খালি, শূন্য এলাকা, পৃথিবীর বুকে ভয়ংকর মরুভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আর এখানেই মুলার কাজ করেন?
‘হ্যাঁ, হের এডমিরাল।
‘কিন্তু সেখানে তিনি কী কাজ করেন?
‘এ জায়গায় প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। মুলার একজন ভাষাবিদ, বিশেষত প্রাচীন ভাষায়। তিনি ল্যাটেক্স দ্রবণ ব্যবহার করে শিলালিপির ছাপ তুলে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন।
‘এর সাথে সুয়েজ খালের কি সম্পর্ক, হান্স?
‘একটু ধৈর্য্য ধরে আমার কথা শুনুন, হের এডমিরাল। সাবাহ্ নামে সেই এলাকাটির নাম বহুদিন ধরে শেবার রানির সাথে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে।
‘হায় ঈশ্বর!’ বলে কানারিস তার ডেস্কে গিয়ে বসলেন।
‘এতো দেখছি বাইবেল। তিনি একটা রুপার সিগারেট বাক্স থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। আমি তো সবসময় জেনে এসেছি বাইবেলে উল্লেখ ছাড়া আর কোন প্রমাণ নেই যে এর অস্তিত্ব আছে।’
‘হ্যাঁ, তিনি অবশ্যই ছিলেন। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি।’ রিটার বলল। ভেনাসের সমার্থক অ্যাসথার নামে এক আরব দেবীর উপাসক। সম্প্রদায় ছিল। শেবার রানি ছিলেন সেই সম্প্রদায়ের সব্বোর্চ পুরোহিত। আর তিনি সেই রাব আল-খালি এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
‘সেতো কাহিনীতে, ক্যানারিস বললেন।
‘হের এডমিরাল, মুলার এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেছেন, যা সম্ভবত এর ধ্বংসাবশেষ। স্বভাবতই তিনি তার এই আবিষ্কার গোপন রেখেছেন। এ ধরনের একটি ঘটনা ভ্যালি অফ দি কিংস-এ তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সারা দুনিয়া থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ছুটে আসবে সেখানে। আমি আপনাকে বলেছি, তিনি তহবিল সংগ্রহের জন্য বার্লিন ফিরে এসেছেন, তবে তিনি কী জিনিস আবিষ্কার করেছেন তার পূর্ণ বিবরণ এবহোয়েরের কাছে জমা দিয়েছেন।
ক্যানারিস ভ্রু কুঁচকে বললেন, তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে?
‘এ জায়গাটা অচেনা, হের এডমিরাল, মরুভূমির মাঝে লুকোনো রয়েছে। রসদ সরবরাহের জন্য একটা এরোপ্লেন ব্যবহার করে এই জায়গাটিকে সুয়েজ খাল আক্রমণের একটা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্যানারিস উঠে ম্যাপটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি সেটা পরীক্ষা করে ঘুরে বললেন, ‘ঐ জায়গা থেকে সুয়েজ খালের দূরত্ব কমপক্ষে এক হাজার মাইল হবে।’
‘খুব বেশি হলে বারোশো মাইল, হের এডমিরাল। কিন্তু আমি নিশ্চিত, উপায় একটা খুঁজে বের করা যাবে।’
ক্যানারিস মৃদু হাসলেন, তুমি সাধারণত তাই পারো, হান্স। ঠিক আছে মুলারকে নিয়ে এসে আমার সাথে দেখা করাও।
‘কখন, হের এডমিরাল?”
‘কেন, অবশ্যই আজ রাতে। আমি আজ রাতে অফিসেই ঘুমাবো।
তারপর তিনি তার টেবিলের দস্তাবেজের দিকে ফিরলেন। রিটার বের হয়ে গেল।
অধ্যাপক অটো মুলার একজন ছোটখাটো, টাক মাথার মানুষ। সারাক্ষণ রোদে থেকে থেকে তার মুখের চামড়া তামাটে হয়ে গেছে। যখন রিটার তাকে ক্যানারিসের সাথে সাক্ষাৎ করাবার জন্য কামরায় ঢুকালো, তখন নার্ভাস হয়ে সে মৃদু হাসতেই তার সোনা বাঁধানো দাঁত দেখা গেল।
ক্যানারিস বললেন, ঠিক আছে, হান্স। রিটার কামরার বাইরে চলে গেল। ক্যানারিস একটা সিগারেট ধরালেন, বেশ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, কি বলেন, প্রফেসর। আমাকে এ সম্পর্কে সব কিছু বলুন।
মুলার একজন স্কুলছাত্রের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার সৌভাগ্য হের এডমিরাল। আমি বেশ কিছুকাল যাবত শাবওয়া এলাকায় কাজ করছিলাম। এক রাতে এক বুড়ো বেদুঈন পিপাসায় আর জ্বরে মৃতপ্রায় হয়ে আমার ক্যাম্পে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমি তার সেবা শুশ্রূষা করে জীবন বাঁচালাম।
“আচ্ছা!
‘এরা অদ্ভুত মানুষ। কোনভাবেই ঋণগ্রস্ত থাকতে রাজি নয়, কাজেই সে আমাকে শেবার মন্দিরের হদিশ বাতলে দিয়ে তার ঋণ শোধ করল।
‘ভাল প্রতিদান বটে। তারপর বলুন এর সম্পর্কে।
‘আমি প্রথমে এটাকে সেই বিশাল বিরান ভূমির মাঝে মাটির উপরে বেরিয়ে আসা লালচে পাথরের একটা শিলাস্তরের অংশ হিসেবে দেখলাম। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন হের এডমিরাল! সেখানে অনেক বালিয়াড়ি আছে যেগুলোর উচ্চতা অনেক সময় কয়েক শো ফুট হয়ে থাকে।
‘আশ্চর্য!
‘আরো সামনে এগিয়ে আমরা একটা গিরিখাতের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সাথে বেদুঈন প্রহরী ছিল। আমরা উটে চড়ে সেখানে গিয়েছিলাম। প্রথমে দেখলাম শক্ত মাটির একটা সমতল ভূমি, তারপর একটা গিরিখাত, দুপাশে পিলারসহ একটা চওড়া রাস্তা।
‘আর মন্দির! সে সম্পর্কে বলুন।
মুলার প্রায় আধ-ঘণ্টা ধরে বর্ণনা দিল আর ক্যানারিস মনোযোগ সহকারে সব শুনলেন। শেষে এডমিরাল মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ক্যাপ্টেন রিটার আমাকে বলেছে আপনি আমাদের এবহোয়েরকে একটা চমৎকার রিপোর্ট দিয়েছেন।’
‘আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, হের এডমিরাল। আমি পার্টির একজন সদস্য।
‘অবশ্যই, ক্যানারিস শুষ্ক মন্তব্য করলেন।
‘তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আপনার প্রয়োজন মাফিক তহবিল সংগ্রহ করে সে জায়গায় ফিরে গিয়ে আপনাকে যা করতে বলা হবে তা করবেন। এটি এমন একটি প্রজেক্ট যাতে ফুয়েরার নিজে বিশেষভাবে জড়িত আছেন।’
মুলার উঠে দাঁড়াল, ‘আমি আপনার আদেশের অপেক্ষায় আছি, হের এডমিরাল।
‘ঠিক আছে, ক্যানারিস তার ডেস্কে একটা বোম টিপলেন। আমরা আপনাকে যথাসময়ে সব জানাবো।
রিটার প্রবেশ করল–’হের এডমিরাল।
‘আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন প্রফেসার। মুলার বাইরে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন, তারপর বললেন, “তাকে মোটামুটি নিরীহ মনে হচ্ছে, তারপরও আমার সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে, হান্স। তুমি যদি এই জায়গাকে, তোমার বেস হিসেবে ব্যবহার করো, সেক্ষেত্রে তোমাকে সুয়েজ খাল পৌঁছতে বারোশো মাইল উড়ে যেতে হবে। আর একটা মাত্র বোমারু বিমান দিয়ে কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে? এছাড়া এতদুর উড়ে যাওয়ার মতো কোন উড়োজাহাজ কি আমাদের আছে?
‘সে ব্যাপারে আমি ইতোমধ্যে ভেবে রেখেছি, রিটার বলল। তবে আপনাকে জানাবার আগে আমি আরেকবার পরীক্ষা করে দেখবো।
কানারিস একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন, এটা কি খুব সিরিয়াস কোন ব্যাপার, হান্স?
‘আমি তাই বিশ্বাস করি, হের এডমিরাল।
‘তা হলেই ভাল, ক্যানারিস মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আমার নিশ্চয়ই তোমাকে বলার দরকার নেই, মুলারকে চেপে ধরে এই দাহরান জায়গাটি সম্পর্কে সব কিছু জেনে নেবে–কীভাবে স্পেনিশরা এটা পরিচালনা করছে ইত্যাদি। অবশ্য ওরা আমাদের পক্ষেই আছে। এই বিষয়টি কাজে আসতে পারে।’
‘আমি এটা দেখবো, স্যার।’
যত শীঘ্র পারো, হান্স। একটা প্রকল্প নাও। তিন দিন সময় দিলাম।
রিটার ঘুরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে গেল আর ক্যানারিস তার কাগজপত্র নিয়ে পড়লেন।
.
০২.
আবার অফিসে তার ছোট্ট সামরিক বেডে ঘুমিয়ে রাত কাটাবার পর বুধবার সকালে যখন ক্যানারিস বাথরুমে দাড়ি কামাচ্ছিলেন, তখন ঠক ঠক শব্দ হল।
‘ভেতরে আসুন, তিনি ডেকে বললেন।
‘আমি, হের এডমিরাল, রিটার উত্তর দিল। আর আপনার প্রাতরাশ।’
ক্যানারিস মুখ মুছে কফির সুঘ্রাণেভরা টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলেন একজন আর্দালি তার ডেস্কে একটা ট্রেতে প্রাতরাশ সাজিয়ে রাখছে আর রিটার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আর্দালিকে ‘ডিসমিস’ বলে বিদায় করে ক্যানারিস কফির কাপ তুলে নিয়ে রিটারকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, আমার সাথে যোগ দাও, হান্স।
‘আমি ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছি, হের এডমিরাল।
তার মানে তুমি অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। বেশ দায়িত্ব সচেতন বটে।
‘ঠিক তা নয়, হের এডমিরাল। আসলে আমার ঘুমাতে কষ্ট হয়।’
ক্যানারিস সাথে সাথে সমবেদনা জানিয়ে বললেন, ‘মাই ডিয়ার হান্স। আমি সত্যিই নির্বোধ। আসলে অনেক সময় আমি ভুলে যাই তুমি কত কষ্ট করে জীবন কাটাও
‘যুদ্ধের অভিশাপ, হের এডমিরাল। সে টেবিলে একটা ফাইল রাখল।
এডমিরাল টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে মুখ তুলে বললেন, কী এটা?”
‘অপারেশন শেবা, হের এডমিরাল।
‘তার মানে তুমি একটা সমাধান খুঁজে বের করেছো?
‘আমার তাই বিশ্বাস।’
‘তোমার কি মনে হয় এটা বাস্তবায়ন করা যাবে?’
‘শুধু করা নয় হের এডমিরাল। আমি মনে করি এটা অবশ্যই করা উচিত।’
‘সত্যি। ক্যানারিস অন্য কাপটাতে কফি ঢাললেন। তাহলে আমি বলবো। তুমি বরং একটা সিগারেট ধরাও আর এই কাপটা শেষ করো। ততক্ষণে আমি দেখি তুমি কি এনেছে।
রিটার তার কথা মতো আদেশ পালন করে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। তিন এপ্রিল। আর কিছুদিন পর ঈস্টার অথচ নভেম্বরের একটি খারাপ দিনের মতো বৃষ্টি হচ্ছে। তার পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছিল, প্রয়োজন হলে যদি তাকে মরফিন পিল খেতে হয় তাহলে মুশকিল হবে। সে কফিটা শেষ করে সিগারেট ধরাল। পেছনে শুনতে পেল ক্যানারিস টেলিফোন তুলে কথা বলছেন।
‘রাইখ চ্যান্সেলারি, ফুয়েরার সোয়ীট, এডমিলার বললেন। এক মুহূর্ত পর বললেন, ‘সুপ্রভাত, ক্যানারিস বলছি। আমাকে অবশ্যই ফুয়েরারের সাথে দেখা করতে হবে। হ্যাঁ, অত্যন্ত জরুরি। আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর তিনি বললেন, ‘চমৎকার। এগারোটা।
রিটার ফিরে বলল, ‘হের এডমিরাল?
‘তোমার এই প্ল্যানটা চমৎকার, হান্স। তুমি নিজে বরং আমার সাথে চল এবং আসল মানুষকে বিষয়টা বল।
.
রিটার কখনও প্রধান অভ্যর্থনা কেন্দ্রের ওপাশে পা রাখেনি, কাজেই ভেতরে গিয়ে যা দেখল তাতে বিস্ময়বিমুঢ় হয়ে গেল। কেবল বিশাল দরজা আর ব্রোঞ্জের ঈগলগুলোই নয়, সেই সাথে চারশো আশি ফুট লম্বা মার্বেল গ্যালারি। এটা ফুয়েরারের গর্বের একটা বস্তু কেননা এটা ভার্সেইলেসের হল মিররের দ্বিগুণ।
ওদেরকে যখন হিটলারের বিশাল স্টাডিতে উপস্থিত করা হল, তখন তারা দেখল হিটলার তার ডেস্কে বসে রয়েছেন। তিনি মুখ তুলে বললেন, “আশা করি জরুরি কোন বিষয়।
‘আমার তাই মনে হয়, সম্মানীয় ফুয়েরার, ক্যানারিস বলল। “ইনি আমার সহকারী, ক্যাপ্টেন রিটার।
হিটলার তার পুড়ে যাওয়া মুখ, হাতের লাঠি, বুকের মেডেল দেখে উঠে দাঁড়িয়ে রিটারের হাত ধরলেন। একজন সৈনিক হিসেবে আমি তোমাকে স্যালুট করছি।’
তিনি ফিরে গিয়ে তার চেয়ারে বসতেই রিটার অভিভূত হয়ে বলল, “আমি আর কি বলবো, মহামান্য ফুয়েরার।
ক্যানারিস মাঝখান থেকে বললেন, ‘সুয়েজ খালের বিষয়টা। ক্যাপ্টেন রিটার একটা অসামান্য পরিকল্পনা করেছে। পরিকল্পনাটা অসাধারণ।’ তিনি হিটলারের ডেস্কের উপর ফাইলটা রাখলেন। অপারেশন শেবা।’
হিটলার হেলান দিয়ে বসে দুহাত বুকে ভাঁজ করে বললেন, এটা আমি পরে পড়বো। তুমি বিষয়টি খুলে বলো, ক্যাপ্টেন রিটার।
রিটার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “মহামান্য ফুয়েরার। এই বিষয়টি শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের একজন অধ্যাপক মুলারের থেকে, যিনি দক্ষিণ আরবে এক অভূতপূর্ব মন্দির আবিষ্কার করেন, সেখান থেকে।
.
‘চমৎকার, হিটলার বললেন। তার চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছিল, কেননা প্রত্নতত্ত্বের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। যে কোন মূল্যে আমি ওই মন্দিরটি দেখতে রাজি। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। তাহলে তুমি কাজ শুরু করে দাও ক্যাপ্টেন। ঐ জায়গায় ঘাঁটি করে ফেলো। কিন্তু কীভাবে তুমি কাজটা করবে?
‘এই পরিকল্পনার মূল বিষয়টি হচ্ছে এর সহজ প্রক্রিয়াটি। একটি মাত্র বোমারু বিমান দিয়ে সুয়েজ খাল আক্রমণের চেষ্টা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কোনভাবেই কেউ সঠিক লক্ষ্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না।
হিটলার বললেন, তাহলে?
‘ক্যাটালিনা নামে দুই ইঞ্জিনের একটি উভচর আমেরিকান উড়োজাহাজ আছে। এটি চাকা ফেলে মাটিতে যেমন ল্যান্ড করতে পারে, তেমনি পানিতেও পারে। এর ক্রইজিং সীমা অসাধারণ। দেড় হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা নিয়ে এটি ১৬০০ মাইলের বেশি একনাগাড়ে অতিক্রম করতে পারে।
হিটলার বললেন, ‘চমৎকার, এই উড়োজাহাজটি কীভাবে কাজে লাগাবে?’
‘আমি যেরকমটি বলেছি, ব্যাপারটি অত্যন্ত সহজ, মহামান্য ফুয়েরার। এই উড়োজাহাজটি মরুভূমিতে আমাদের ঘাঁটিতে ল্যান্ড করে বোমা না নিয়ে মাইন নেবে। তারপর উড়ে যাবে মিশরে আর ল্যান্ড করবে সুয়েজ খালে। সেখানে উড়োজাহাজের ক্রুরা মাইনগুলো অফলোড করবে। সেগুলো সহজেই স্রোতে ভাসতে থাকবে। আমার প্রস্তাব, কান্ট্রার কাছেই একটা ভাল স্পট হবে। ক্রুরা অবশ্যই ক্যাটালিনাটি ডুবিয়ে দেবে। আর উড়োজাহাজের ভেতরটা আমাদের অত্যাধুনিক বিস্ফোরক-হেলিকন দিয়ে ভর্তি করবে। এটাও খালের প্রচুর ক্ষতিসাধন করতে পারবে। এরপর নিশ্চয়ই বিশদ ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই, লেক টিমসাহ্ থেকে উত্তরমুখী চলাচলকারী
জাহাজগুলোর খালের পানির নিচে ভেসে থাকা মাইনগুলোর সাথে সংঘর্ষ হবে। আমরা ধরে নিতে পারি কয়েকটা জাহাজ ডুবে গিয়ে পুরো খালের গতিপথ বন্ধ হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ সবাই নির্বাক বসে রইল আর হিটলার উপরের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলেন। এরপর তিনি এক হাতের তালুতে জোরে একটা ঘুষি মেরে বললেন। চমৎকার! তুমি যেমন বলেছো, খুবই সরল পরিকল্পনা। তারপর একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন, কিন্তু এই ক্যাটালিনা প্লেন। এটা কি যোগাড় করতে পারবে?
‘মহামান্য, ফুয়েরার। লিসবনে এই এরোপ্লেন একটা বিক্রি হবে। আমি মনে করি এটি আমরা কিনে নিয়ে দাহরানে আমাদের নিজস্ব একটা এয়ারলাইন শুরু করতে পারি। অবশ্য কোম্পানিটা স্বভাবতই স্পেনিশ মালিকানাধীন। আমি নিশ্চিত উপকুলে আমরা ভাল ব্যবসা পাবো।’
হিটলার উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্ক ঘুরে এসে তার কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন। “ঠিক বলেছো। আমি এই ছেলেকে পছন্দ করি, হের এডমিরাল। অবিলম্বে এর পরিকল্পনা কাজে লাগান। আপনাকে আমি পুর্ণ ক্ষমতা দিলাম।
‘মহামান্য ফুয়েরার। ক্যানারিস দরজার দিকে এগোলেন, তারপর পেছন ফিরে একটা নাৎসী স্যালুট দিতে চেষ্টা করলেন। চল যাই. ফিসফিস করে রিটারকে বললেন, তারপর দরজা খুলে ফিরে চললেন।
মার্বেল গ্যালারি দিয়ে যেতে যেতে ক্যানারিস বললেন, তুমি সহজভাবে নিজের কথা বলেছো। ক্যাটালিনা কেনার জন্য আমি অবশ্যই প্রয়োজনীয় অর্থের অনুমোদন দিচ্ছি, কিন্তু উপযুক্ত ক্রু পেতে সমস্যা হতে পারে। অবশ্য একটা স্পেনিশ এয়ারলাইনের এরোপ্লেন চালাতে কোন জার্মানের আপত্তি থাকার কথা নয়।’
“তবে খুব ভাল হয় যদি স্পেনিয় ক্রু পাওয়া যায়।
‘কোথায় পাবে এদের?’
‘এস, এস, সৈনিকদের মধ্যে অনেক স্পেনিয় ভলান্টিয়ার আছে।’
ক্যানারিস বললেন, তা অবশ্যই আছে, এটা একদম সঠিক হবে।’
‘আমি ইতিমধ্যেই একজন উপযুক্ত বৈমানিক খুঁজে বের করেছি। স্পেনিশ সিভিল ওয়ারে এর প্রচুর লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে। এখন এই লোকটি এস.এস এর অধীনে কুরিয়ার পাইলট হিসেবে কাজ করছে। আমি আজই গ্যাটো বিমান ঘাঁটিতে এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’
‘ভাল। আমিও তোমার সাথে গিয়ে লোকটাকে দেখতে চাই, ক্যানারিস বললেন।
সাতাশ বছর বয়সি সুদর্শন যুবক–গোমরামুখো কার্লোস রোমেরো, মাদ্রিদের একজন ধনী মদ-ব্যবসায়ীর পুত্র। ষোল বছর বয়সে সে প্লেন-চালনা শিখে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই স্পেনিশ বিমান বাহিনীতে একজন ফাইটার পাইলট হিসেবে যোগদান করে। সিভিল ওয়ারের সময় সে জেনারেল ফ্রাংকোর পক্ষে যোগদান করে, তবে এই কারণে নয় যে সে একজন উৎসর্গকৃত ফ্যাসিস্ট। আসলে তাদের শ্রেণীর মানুষেরা তখন তাই করেছিল। সে এগারোটা প্লেন গুলি করে ভূপাতিত করেছিল। এরপর জার্মান কনডর লিজিয়নে প্লেন চালিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করে সেটা বন্ধ হয়ে গেল, যা সে চায় নি। এমন সময় সে কানাঘুষা শুনতে পেল এস, এস, স্পেনিয় ভলান্টিয়ার খুঁজছে। পাইলট হিসেবে তার রেকর্ড দেখে ওরা কোন ধরনের দ্বিধা না করে তাকে নিযুক্ত করল। মূলত কুরিয়ার দায়িত্বে, এদের কাজ ছিল উচ্চ পদস্থ অফিসারদের বিভিন্ন স্থানে আনা নেওয়া করা।
এ মুহূর্তে সে বার্লিনের আকাশে এক হাজার ফুট উচ্চতায় একটা ছোট স্টর্ক স্পটার এরোপ্লেনের নিয়ন্ত্রণে বসে ছিল। গ্যাটো টাওয়ারে কল দিয়ে ল্যান্ড করার অনুমতি পেয়ে বিমান ঘাঁটির দিকে নামতে শুরু করল। এই একঘেয়েমি কাজে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
স্পেনিশ ভাষায় সে ফিসফিস করে বলে উঠল, “হায় ঈশ্বর! এর চেয়ে ভাল কিছু নিশ্চয়ই আমার জন্য আছে।
.
তা অবশ্যই ছিল এবং তা সে জানতে পারল একটু পরেই। মেসে গিয়ে ফ্লাইং জ্যাকেট খুলতেই তার নিচে কালো রঙের এস এস ইউনিফর্ম বেড়িয়ে পড়ল। ইউনিফর্মের বাম কাঁধে একটা ছোট স্পেনিশ শিল্ড, স্পেনিশ অর্ডার অফ মেরিট ফর গ্যালাষ্ট্রি আর কনডরে তার বীরত্বসূচক কাজের জন্য আয়রন ক্রস ফার্স্ট ক্লাস লাগানো রয়েছে।
প্রথমে তার নজরে পড়ল ক্যানারিসকে তার উচ্চ পদমর্যাদার কারণে, যদিও তাকে সে চিনতে পারল না। তবে রিটারকে চিনতে পেরে খুশি হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।
‘হান্স রিটার, কী ব্যাপার!
রিটার তার হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে তার সাথে হাত মেলালো। তোমাকে বেশ ভালই দেখাচ্ছে। স্পেনের ঘটনা অনেক আগে গত হয়েছে মনে হচ্ছে।’
‘আমি তোমার পায়ের কথা শুনেছি। দুঃখিত বন্ধু।
রিটার বলল, এডমিরাল ক্যানারিস। এবহোয়ের চীফ।
রোমেরো গোড়ালি ঠুকে স্যালুট করল। আমি সম্মানিত বোধ করছি, হের এডমিরাল।
‘আমাদের সাথে এসো, হের হল্সটার্মফুয়েরার। ক্যানারিস মেস স্টুয়ার্ডকে ডেকে বললেন। বলিংগার শ্যাম্পেন আর তিনটে গ্লাস। তারপর তিনি রোমেরোর দিকে ফিরে বললেন। আমি জানি তুমি একজন কুরিয়ার পাইলট। কাজটা কি তোমার পছন্দ?
‘সত্যি বলতে কি হের এডমিরাল, এই সাধারণ কাজটা আমার জন্য একঘেয়ে হয়ে উঠেছে।
‘সেক্ষেত্রে আমরা দেখবো তোমার জন্য এর চেয়ে ভাল কাজ পাওয়া যায় কি না। ওকে খুলে বলল হান্স।
.
রোমেরো ফাইলটা পড়া শেষ করে বন্ধ করল। তার চেহারা বিবর্ণ আর উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। ক্যানারিস বললেন, “তোমার কি এতে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা আছে?
‘ইচ্ছা মানে?’ রোমেরো রিটারের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিল, ওর হাত কাঁপছিল। এতে অংশগ্রহণের জন্য আমি নতজানু হয়ে অনুমতি ভিক্ষা করতে রাজি।
ক্যানারিস হেসে ফেললেন, না, তা করার দরকার নেই।’
রিটার বলল, ‘ক্যাটালিনা চালাতে তোমার কোন সমস্যা হবে না তো?”
রোমেরো চেয়ারে বসে বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করল। একজন দ্বিতীয় বৈমানিক আর ইঞ্জিনিয়ার হলে আমি এটা সামলাতে পারব।’
‘কোথায় পাবো আমরা এদের?’ ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন।
“ঠিক এখানে এস এস এর স্পেনিশ লিজিয়নে এদের পাওয়া যাবে। আমার মতোই হের এডমিরাল। এই মুহূর্তে আমি দুজন উপযুক্ত পদপ্রার্থীর কথা ভাবছি। জেভিয়ার নোভাল একজন ভাল পাইলট আর জুয়ান কোন্ডে একজন প্রতিভাবান বিমান প্রকৌশলী।
রিটার নাম দুটো নোট করে নিল। চমৎকার। আমি তোমার সাথে। ওদেরকেও এবহোয়ের ডিউটিতে বদলি করে দেব।
‘বিস্ফোরক আর মাইনের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা?’ রোমেরো জিজ্ঞেস করল।
‘আমরা আমাদের সুবিধামতো কোন কার্গো জাহাজে করে ওগুলো ডেলিভারি দেবার ব্যবস্থা করব।’ রিটার ওদের জানাল। দাহরানের মতো জায়গায় আমার মনে হয় কোন সমস্যা হবে না। সেপ্টেম্বর থেকেই যাতায়াত করে তোমরা তোমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তুলবে। উপসাগরীয় এলাকায় ব্যবসা, পণ্য পরিবহন এই ধরনের ব্যবসা।
রোমেরো ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে। সময় হলে আমরা মাইনগুলো সাগরে নিয়ে যেতে পারব। আমি সহজেই কোন জাহাজের পাশে ল্যান্ড করতে পারব। সেখান থেকে সরাসরি ঘাঁটিতে উড়ে গেলে পুরো ব্যপারটা আরো সহজ হবে।
‘চমৎকার, ক্যানারিস উঠে দাঁড়ালেন। আমার মনে হয় তোমার উচিত হবে আমাদের বন্ধু প্রফেসার মুলারের সাথে সাক্ষাত করা। তুমি বরং আমাদের সাথে শহরে চল। পথে আমাকে নামিয়ে দিয়ে তোমরা সোজা বিশ্ববিদ্যালয় চলে যাও। এখন থেকে সব বিষয়ে ক্যাপ্টেন রিটারের সাথে তুমি পরামর্শ করবে।
‘আপনি যা আদেশ করেন, হের এডমিরাল।
“ঠিক আছে,’ বললেন ক্যানারিস। তারপর ঘুরে ওদেরকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলেন।
.
বিশ্ববিদ্যালয়ে মুলারের বিভাগটি সব ধরনের নৃতাত্ত্বিক আগ্রহের বস্তু দিয়ে পরিপূর্ণ একটি বিশাল হলে অবস্থিত। মিশরীয় মমি, রোম ও গ্রীস থেকে আনা স্ট্যাচু, ভূমধ্যসাগরের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত এমফোরা–সব কিছু রয়েছে সেখানে। রিটার আর রোমেরো ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখতে লাগল আর ততক্ষণ মুলার তার কাঁচ ঘেরা অফিস ডেস্কে বসে অপারেশন শেবা ফাইলটা পড়ল। পড়া শেষ হওয়ার পর সে ওদের সাথে যোগদান করল।
রিটার ঘুরে জিজ্ঞেস করল, তো আপনার কি মনে হয়?
মুলার অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। সে মুখে হাসি ফুটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘এটি একটি চমৎকার আইডিয়া, হের হপ্টম্যান। তবে আমি ভাবছিলাম এ কাজের জন্য আমি উপযুক্ত কি না, অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আমি তো একজন প্রশিক্ষিত স্পাই নই। আমি কেবল একজন প্রত্নতত্তবিদ।
‘এ কাজটা করতেই হবে প্রফেসার, ফুয়েরারের সরাসরি নির্দেশ অনুযায়ী। এতে কি আপনার কোনো সমস্যা আছে?
‘হায় ঈশ্বর! না নেই।’ মুলারের মুখমন্ডল ছাইবর্ণ ধারণ করল।
রোমেরো তার কাঁধে একটা চাপড় দিয়ে বলল, কোন চিন্তা করবেন না প্রফেসর। আমি আপনার খেয়াল করব।’
রিটার বলল, তাহলে সব ঠিক আছে। যখন হস্পটার্মফুয়েরার রোমেরো ক্যাটালিনা নিয়ে লিসবন রওয়ানা দেবেন, আপনি তার সাথে গিয়ে সব কিছুর প্রস্তুতি নেবেন। আমি সব সময় যোগাযোগ রাখবো।’
রিটার তার লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলল। হলের মাঝ দিয়ে যখন ওরা প্রবেশ পথের দিকে যাচ্ছিল তখর রোমেরো বলল, বেচারা খুব বেশি নার্ভাস হয়ে গেছে রিটার।’
‘সে ঠিকই পথে চলে আসবে আর সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
মূল প্রবেশ পথের বাইরে এসে সিঁড়ির প্রথম ধাপের উপর ওরা দাঁড়াল। ‘আমি আজই তোমার, নোভাল আর কোন্ডের বদলির ব্যবস্থা করব। তোমরা কালই সাদা পোশাকে লিসবন রওয়ানা দাও। আমি লুফথানসা ফ্লাইটে তোমাদের জন্য প্রায়োরিটি সিটের ব্যবস্থা করে রাখবো। ক্যাটালিনা কেনার ব্যাপারে সেখানকার জার্মান দূতাবাসে আমাদের লোক তোমার ব্যাংকার হিসেবে কাজ করবে। প্লেনটা পরীক্ষা করার পর তুমি দূতাবাসের নিরাপদ টেলিফোনে আমাকে জানাবে। আশা করি বৃহস্পতিবারের মধ্যে তুমি কিছু একটা জানাতে পারবে।
‘হায় ঈশ্বর! তুমি কোন কিছুতেই দেরি করতে চাওনা, তাই না হান্স?
‘এটা না করার কোন কারণ তো আমি দেখি না এ কথা বলে রিটার সিঁড়ি বেয়ে অপেক্ষামান মার্সেডিসের দিকে এগিয়ে চলল।
.
কেউ কেউ বলে চওড়া উপসাগর আর অনেকগুলো নোঙ্গর-স্থান নিয়ে টাগুস নদীই লিসবনের অস্তিত্বের সত্যিকার কারণ। এখান থেকেই বিশাল আকৃতির ফ্লাইং বোট-বিশাল ক্লিপারগুলো আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এখানেই তীর থেকে প্রায় তিনশো গজ সাগরে দুটো বয়ার সাথে বাঁধা ক্যাটালিনাটিকে দেখতে পেল কার্লোস রোমেরো। উড়োজাহাজটির মালিকের প্রতিনিধি দ্যা গামা নামে লোকটির সাথে সাক্ষাতের জন্য জেভিয়ার নোভাল আর জুয়ান কোন্ডেকে নিয়ে দশমিনিট আগেই সে আভেনিদা দ্য ইন্ডিয়ার কাছে ডকে পৌঁছেছিল। ডকের কিনারায় দাঁড়িয়ে ওরা উভচর উড়োজাহাজটির দিকে তাকাল।
‘এটা দেখতো ভালই মনে হচ্ছে,’ বলল রোমেরোর প্রায় সমবয়সী শক্ত সমর্থ গড়নের নোভাল। তার পরনে একটা পুরনো ফ্লাইং জ্যাকেট।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী মোটাসোটা কোন্ডে ওদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড়। সেও একটা ফ্লাইং জ্যাকেট পরেছিল। সে চোখের উপর হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে ক্যাটালিনার দিকে তাকিয়ে ছিল।
‘তোমার কি মনে হয় জুয়ান? সামলাতে পারবে এটাকে?
‘দেখি একবার চেষ্টা করে।
একটা মোটর বোট ডকে এসে নাক ঠেকালো। বাদামি স্যুট আর পানামা হ্যাট পরা একজন লোক বোট থেকে হাত নাড়তে লাগল। লোকটি স্পেনিশে বলল, ‘সিনর রোমেরো? আমি ফার্ডিনান্ড দা গামা, বোটে উঠে আসুন।
তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে মোটরবোটে চড়তেই লোকটি বোটম্যানকে ইশারা করতেই সে বোট ছেড়ে দিল।
দা গামা বলল, দেখতে ভাল মনে হচ্ছে না?
‘অবশ্যই এটি দেখতে চমৎকার, রোমেরো বলল। এখন এর বিষয়ে বলুন।
‘স্থানীয় একটা শিপিং কোম্পানি ম্যাদেইরা দ্বীপে প্রতিদিন ফ্লাইট চালাতে চেয়েছিল। গত বছর ওরা যুক্তরাষ্ট থেকে একটা ক্যাটালিনা কেনে। চমৎকার সার্ভিস দিয়েছিল ওটা, কিন্তু ওদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী পরিবহন। তবে যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা এত সীমিত ছিল যে তাতে কোন লাভের উপায় ছিল না। আচ্ছা কী উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করতে চান জানতে পারি কী?
রোমেরো প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি কথাটা বলল–লোহিত সাগর আর এডেন উপসাগরে সাধারণ পণ্য আনা নেওয়া করা। এমনকি গোয়া পর্যন্ত যেতে পারি। এটা একটা নতুন ব্যবসা।
দ্যা গামা বলল, এই এলাকা আমি চিনি। এ কাজের জন্য ক্যাটালিনা খুবই উপযোগী হবে।
ওদের মটরবোটটি ভাসমান একটা ডকের সাথে ঠেকতেই বোটম্যান ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। নোভাল আর কোন্ডে একটা রশি ধরে তার সাথে বাধল। দা গামা কেবিনের দরজা খুলে পথ দেখিয়ে চলল। রোমেরো ককপিটের চারপাশে প্রীত হয়ে তাকাল এবং ককপিটের একটা আসনে বসে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে হাত বাড়াল। নোভাল অন্য আসনটিতে বসে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করল।
কী সুন্দর।
দা গামা একটা ফাইল মেলে ধরল। তার কাঁধের ঠিক পেছনে কোন্ডে দাঁড়াল। ফাইল খুলে সে বলল, আমি আপনাদের এর আয়তন বলছি। দৈর্ঘ্য তেষট্টি ফিট, উচ্চতা বিশ, উইংস্প্যান একশো চার। দুটো প্র্যাট এত হুইটনি ইঞ্জিন, প্রত্যেকটা বারোশো অশ্বশক্তি সম্পন্ন। কুইজিং গতি ঘণ্টায় একশো আশি মাইল। বেশ চমৎকার রেঞ্জ। একবার জ্বালানী নিয়ে পণ্য বোঝাই ছাড়া এটি চারহাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। আমি আর কোন উড়োজাহাজের কথা জানি না–যা এরকম করতে পারে।
‘আমিও তাই মনে করি, রোমেরো বলে উঠলো। আপনি এখন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।’
মটরবোটটিতে গাদাগাদি করে সবাই বসতেই দা গামা সেই পুরনো গাধা বুলি আওড়ালো’–অবশ্য আরো কিছু লোক প্লেনটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।’
মোটরবোটটি চলতে শুরু করতেই রোমেরো বলল, “ঐসব বিক্রেতা মার্কা বুলি ছেড়ে আপনি বরং একটা চুক্তিপত্র তৈরি করুন। আমি আপনাকে আমার উকিলের নাম দিচ্ছি। আমরা কালকেই চুক্তিপত্র সই করব আর আপনি যে দাম চেয়েছেন সে অংকেরই একটা চেক পাবেন। খুশি তো?’
দা গামাকে একটু অবাক দেখাল। অবশ্যই সিনোর।
রোমেরো একটা সিগারেট বের করল, নোভাল লাইটার দিয়ে সেটা জ্বেলে দিলে সে ক্যাটালিনাটার দিকে চেয়ে লম্বা একটা ধুয়া ছাড়লো।
‘মনে হচ্ছে আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেছে,’ সে বলল।
.
ব্যারন অসওয়াল্ড ভন হেইনিনজেন-হিউন ছিলেন লিসবনের জার্মান মিশনের মিনিষ্টার। তিনি একজন অভিজাত পরিবারের সন্তান, পুরোনো আমলের পেশাদার কূটনীতিক এবং নাৎসি নন। আর অধিকাংশ কর্মচারীর মতো বার্লিন থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকতে পেরে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।
প্রথমদিকে এই অচেনা স্পেনিয় এসএস হল্সটার্মফুয়েরারটিকে দেখে একটু সতর্ক হলেও তিনি বার্লিনের নির্দেশ পালনে বাধ্য হলেন। একটু অবাক হলেও রোমেরোর প্রতি আকৃষ্ট হলেন।
স্পেনিয় লোকটি তার অফিসে প্রবেশ করতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘মাই ডিয়ার রোমেরো! সব কিছু ঠিকঠাক মতো হয়েছে তো?
‘এর চেয়ে আর ভাল হতে পারে না। আপনি যে আইনজীবীর কথা বলেছেন দা গামা তার সাথে যোগাযোগ করবে। আপনি টাকার ব্যবস্থা করলেই আমরা আগামীকালের মধ্যে সবকিছু সেরে ফেলব। ও হ্যাঁ,আমার এখুনি এবহোয়ের হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন রিটারের সাথে কথা বলতে হবে।’
‘অবশ্যই।’ ব্যারন তার ডেস্কের লাল নিরাপদ ফোনটি টেনে নিয়ে একটা কল বুক করলেন। বেশি সময় লাগবে না।’ তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কনিয়াক চলবে?
‘চলবে না কেন?
রোমেরো একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা সোফায় বসল। ব্যারন তার হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে উল্টো দিকে বসলেন। সব কিছু খুব গোপনীয় বিষয় তাই না?
‘হ্যাঁ, খুবই গোপনীয়।
না আমি কোন নাক গলাতে যাচ্ছিনা। সত্যি বলতে কি, আমি বরং কিছুই জানতে চাই না।’ তিনি গ্লাস তুলে বললেন। তবে যাইহোক আমি আপনার সাফল্য কামনা করি।
সেই মুহূর্তে ফোনটি বেজে উঠল। রোমেরো বলল, ‘অনুগ্রহ করে আপনার অনুমতি পেলে?
‘অবশ্যই। আমি বরং বাইরে যাচ্ছি।’
ব্যারন অফিসের বাইরে যেতেই রোমেরো ফোন তুলল-কে হান্স বলছো?
‘আর কে?’ রিটার বলল। তোমার কতদূর এগুলো?’
‘চমৎকার, রোমেরো তাকে সব খুলে বলল। অপূর্ব একটা উড়োজাহাজ। এর চেয়ে বেশি খুশি আমি আর হতে পারি না। এডমিরালকে বলল আমরা আমাদের পথে বেড়িয়ে পড়েছি।
.
রিটার দরজায় টোকা মেরে ভেতরে ঢুকল। ক্যানারিস কোলে একটা কুকুরছানা নিয়ে চা পান করছিলেন। তিনি তাকিয়ে বললেন, কী খবর, হান্স?
‘রোমোরা এখুনি লিসবন থেকে আমার সাথে কথা বলেছে, হের এডমিরাল। ক্যাটালিনা সম্পূর্ণ ঠিক আছে আর কালকেই তারা সেটা কেনার কাজ সেরে ফেলবে।
‘চমৎকার, ক্যনারিস ঘাড় নেড়ে বললেন। “তুমি সবশেষ ঘটনাবলির সমস্ত বিবরণ দিয়ে আরেকটা প্রতিবেদন তৈরি কর। আমরা আগামীকালই ফুয়েরারের সাথে দেখা করার এপয়েন্টমেন্ট করে ফেলব।’
‘এক্ষুণি সব করছি, হের এডমিরাল।
তারপর রিটার খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে যেতে উদ্যত হতেই ক্যানারিস তাকে ডেকে বললেন, “ওহো, আরেকটা কথা, আমরা মুলারকে আমাদের সাথে নেবো।’
কিন্তু তাদের প্রত্যাশার আগেই ওদের ডাক পড়ল। সে রাতেই দশটায় চ্যান্সেলারিতে তাদের সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট করা হলো। পথেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা মুলারকে তুলে নিল। ফুয়েরারের সাথে দেখা করার কথা শুনে মুলার হতভম্ব হয়ে পড়ল।
হিটলারের সোয়ট-এর অভ্যর্থনা কাউন্টারে পৌঁছতেই সেখানকার দায়িত্বরত সহকারী উঠে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। আশা করি আপনি ফুয়েরারের জন্য একটি প্রতিবেদন নিয়ে এসেছেন, হের এডমিরাল।’
হ্যাঁ তাই। ক্যনারিস বললেন।
সহকারী হাত বাড়িয়ে বলল, আপনাদের সাথে দেখা করার আগে তিনি এটা পড়তে চাচ্ছেন।
‘অবশ্যই।
ক্যানারিস তার হাতে ফাইলটা দিলেন; সেটা নিয়ে সে দরজা খুলে ভেতরে চলে গেল। ক্যানারিস বাকী দুজনের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে সবাইকে নিয়ে বসে পড়লেন।
মুলার একটু কাঁপছে দেখে ক্যানারিস বললেন, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?
‘হায় ঈশ্বর, আমি কীরকম বোধ করব বলে আপনি আশা করেন, হের এডমিরাল! এটাতো ফুয়েরার, আমাকে কি বলতে হবে?
যতো কম বলা যায় ততই মঙ্গল, ক্যানারিস তাকে বললেন। তারপর একটু শ্ৰেষমাখা কণ্ঠে বললেন, মনে রাখবেন, তিনি একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব, অতএব ঠিকমতো আচরণ করবেন।
দরজা খুলে গেল, সহকারী বলল, “ভদ্রমহোদয়গণ, ফুয়েরার এখন আপনাদের সাথে সাক্ষাত করবেন।
.
পুরো কামরাটি ছায়া ছায়া অন্ধকারে রয়েছে আর হিটলার একটা বিশাল ডেস্কে বসে রয়েছেন। একটি মাত্র পিতলের ল্যাম্প আলো দিচ্ছে। তিনি ফাইলটি পড়ছিলেন, এবার সেটা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালেন।
‘অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, হের এডমিরাল! একটি প্রথম শ্রেণীর কাজ।’
‘এর সমস্ত কৃতিত্ব ক্যাপ্টেন রিটারের।
না হের এডমিরাল, আমার মনে হয় এসবের পর মেজর রিটার বললে আরো উপযুক্ত হবে। সত্যি বলতে কি, আমি আপনাকে আগাম সতর্ক করে দিচ্ছি তাকে আমি আপনার কাছ থেকে চুরি করে আমার নিজস্ব স্টাফ করতে পারি।
তিনি উঠে দাঁড়াতেই রিটার যা বলা স্বাভাবিক তাই বলল–আপনি আমাকে খুব বেশি সম্মান করেছেন, মাননীয় ফুয়েরার।
হিটলার ডেস্ক ঘুরে মুলারের কাছে এলেন। প্রফেসার মুলার, তাই না? একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার আর আপনি এটি রাইখের জন্য উৎসর্গ করছেন।’
আর মুলার কাঁপতে কাঁপতে সঠিক কথাটিই বলল–’শুধু আপনার জন্য, মাননীয় ফুয়েরার, কেবল আপনার জন্যই।
হিটলার তার কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, একটি বড় দিন আসছে, জার্মানির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিন।
তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন আর ডেস্ক ল্যাম্পটি তার দেহের ছায়া ফেলল বিশাল পৃথিবীর মানচিত্রটির গায়ে। সেখানে তিনি হাত বেঁধে দাঁড়ালেন। আপনারা এবার যেতে পারেন।’
ক্যানারিস বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইশারা করে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন।
.
মুলারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দেবার পর ক্যানারিস ড্রাইভারকে বললেন তাদেরকে টিরপিজ উফারে নিয়ে যেতে। পাশের রাস্তাটিতে ঢুকতেই এক কোনে একটা রেস্তোরাঁর সামনে এলেন। জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।
ক্যানারিস একটু ঝুঁকে বললেন, এখানেই থামো। তারপর রিটারের দিকে ফিরে বললেন, ‘একটু কফি আর শ্যাপস। আমরা তোমার পদোন্নতি উদযাপন করব মেজর।
‘আমি অবশ্যই আনন্দিত হের এডমিরাল।
ক্যাফেটা প্রায় খদ্দের শূন্য ছিল আর এর মালিক ওদের দেখে অভিভূত হয়ে পড়ল। সে তাদেরকে জানালার পাশে একটা বুথে নিয়ে বসিয়ে খুব দ্রুত অর্ডার নিল। ক্যানারিস তার সিগারেট কেস বের করে রিটারকে এগিয়ে দিলেন। রিটার একটা সিগারেট নিয়ে তার লাইটার দিয়ে জ্বেলে দিল।
এডমিরাল ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তিনি খুব খুশি হয়েছেন। অবশ্য মুলার একদম তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। লোকটা মোটেও শক্ত নয়।’
‘আমি একমত,’ রিটার বলল। তাকে ঠিকমতো চালাবার জন্য আমাদের একজন পেশাদার লোক দরকার।
ক্যাফের মালিক তাদের জন্য একটা ট্রেতে করে কফি আর পানীয় নিয়ে এল। ক্যানারিস তাকে হাত নেড়ে বিদায় করে দিলেন। তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে সেরকম কাউকে, একজন পুরোনো এবহোয়ের কর্মী, যার উপর আস্থা রাখা যায়।
‘কোন সমস্যা নেই, হের এডমিরাল।
‘তুমি তো বুঝতেই পারছো এই বিষয়টি এতো সরল যে এটা অবশ্যই কার্যকর করা যাবে।’ কথাটি বলে ক্যানারিস বোতল থেকে শ্যানপস দুটো গ্লাসে ঢাললেন।
‘আমি একমত, রিটার বলল।
ক্যানারিস মাথা নাড়লেন, তবে একটি সমস্যা আছে।
‘সেটা কি, হের এডমিরাল?
‘এটি আমাদের যুদ্ধে জয় এনে দেবে না, বন্ধু। কোন কিছুই তা করবে না। তুমি দ্যাখো হান্স, আমরা সবাই নরকে যাবে। তবে যাই হোক এটা তোমার পদোন্নতির জন্য।’
তিনি গ্লাসটি তুলে এক ঢোকে পুরোটা শেষ করে ফেললেন।
.
দাহরান, আগস্ট ১৯৩৯
০৩.
আফ্রিকা থেকে উপসাগরের উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস তখনো দিনের উষ্ণতা নিয়ে আসছে কেইনের দেহে। সে লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে কান পেতে কিছু শুনছিল।
চাঁদ না থাকলেও কোটি কোটি তারার আলোয় ভাস্বর আকাশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সে তাজা বাতাসের আস্বাদন নিল। তার চোখ অনুসরণ করছে একঝাক উড়ঙ্কু মাছকে যেগুলো সাগর থেকে বাঁকা হয়ে মৃদু আলোকিত পানির ঝর্নাধারা ছড়িয়ে বের হয়ে আসছে।
একটা দরজা খুলতেই সেলুন থেকে এক মুহূর্তের জন্য একঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ল। হিন্দু খালাসি পিরু ধূমায়িত এক মগ কফি নিয়ে কোম্পেনিয়ানওয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে এল।
কেইন একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাহ্ চমৎকার!’
‘সাহিব, আজ রাতে কানতারা আসতে বেশ দেরি করছে, পিরু বলল।
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘড়ি দেখল। প্রায় দু’টা বেজেছে। আমি ভাবছি ঐ বুড়ো শয়তান ও’হারা আজ কী খেলা খেলছে।’
‘আমার মনে হয় আবার হুইস্কিতে ডুবেছে।’
কেইন হেসে বলল, “হতে পারে।
সে কফি শেষ করতেই পিরু তার বাহু ছুঁলো। আমার মনে হয়ে সে আসছে।’
কেইন কান খাড়া করল। প্রথমে শুধু লঞ্চের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর বাতাসের শিস শোনা গেল। তারপর সে পানির উপর হালকা একটা কম্পন অনুভব করল। দূরে দেখা গেল সবুজ এক বিন্দু আলো-কানোরার স্টারবোর্ড নেভিগেশন বাতি।
“ঠিক সময়ের আগে নয়, সে মুদু স্বরে বলল।
কেইন হুইলহাউসে গিয়ে নেভিগেশন বাতি জ্বেলে স্টার্ট বোতাম টিপতেই ইঞ্জিন শব্দ করে চালু হলো। ধীরে থ্রটল খুলে অপেক্ষা করল যতক্ষণ না স্টিামারটা প্রায় তাদের উপরে এসে পড়ল, তারপর লঞ্চটা এগিয়ে নিয়ে দুটো জলযান সমান্তরাল করল।
পুরনো পণ্যবাহী জাহাজটা দুই কি তিন নট গতিতে চলছিল। কেইন লঞ্চটা কাছাকাছি আনতেই সংঘর্ষ এড়াতে পিরু দড়িদড়ার গুচ্ছটা বের করল। একজন লস্কর রেইলে হাজির হয়ে একটা দড়ির প্রান্ত ছুঁড়ে মারতেই পিরু সেটা ধরে বাধল। এক মুহূর্ত পর একটা দড়ির সিঁড়ি বের হতেই কেইন ইঞ্জিন বন্ধ করে ডেকে বের হয়ে এলো।
উঁচু মরচে ধরা কানতারার পেছনটা রাতের অন্ধকারে চোখে পড়ল। কালো লম্বা একটা ছায়ার মতো উপরে দেখা যাচ্ছে। দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কেইন আবার ভাবলো কি উপায়ে এই বাতিল লোহার টুকরাটা পানিতে ভাসছে।
সে রেইল আঁকড়ে ধরে টপকালো, তারপর হিন্দিতে বলল, ক্যাপ্টেন কিধার?’
লস্কর কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘কেবিনে।
সে দ্রুত কোম্পেনিয়ানওয়ে দিয়ে উপরের ডেকে পৌঁছে ক্যাপ্টেনের দরজায় টোকা দিল। কোন উত্তর নেই। এক মুহূর্ত পর সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। কেবিন অন্ধকার–তীব্র দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে হাতড়ে হাতড়ে আলোর সুইচটা অন করল।
ও’হারা বাংকে শুয়ে আছে।
পরনে হাতাকাটা গেঞ্জি আর প্যান্ট। হা করা মুখে হলুদ ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত দেখা যাচ্ছে। জাহাজের দুলুনির সাথে তাল মিলিয়ে একটা খালি হুইস্কির বোতল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেইন ঘেন্নায় নাক কুঁচকে বাইরে ডেকে চলে এল।
আরেকজন লস্কর তার জন্য অপেক্ষা করছিল। লোকটি বলল, “মেট বলেছে আপনাকে উপরে ব্রিজে যেতে।
কেইন দ্রুত ডেক পার হয়ে একটা লোহার সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজে পৌঁছাল। পাগড়ি মাথায় মেট গুপ্ত হুইল ধরে আছে।
কেইন দরজায় ঠেস দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কতক্ষণ হল সে এরকম আছে?’
গুপ্ত দাঁত বের করে হাসল। সেই যখন আমরা এডেন ছেড়েছি তখন থেকেই। অন্তত দুদিন ঘুমালে এই অবস্থা কাটবে।
‘জাহাজ চালাবার কি সুন্দর উপায়!’ কেইন বলল, “আচ্ছা এবার তোমাদের কি হয়েছে বলতো? নিয়মমাফিক বোম্বে থেকে আসার পর দাহরানে যোগাযোগ করনি কেন?
গুপ্ত জানাল, আমাদের কাছে মোম্বাসার কার্গো ছিল, তারপর এডেন।
কেইন বলল, ‘স্কিরোজ খুব একটা খুশি হবে না। মাল ঠিকঠাক আছে আশা করি।’
গুপ্ত মাথা নেড়ে সায় দিল। ওরা এখনই মাল উপরে নিয়ে আসবে। ওহ! আরেকটা কথা এবারের ট্রিপে আমরা একজন যাত্রী নিয়ে এসেছি।’
‘যাত্রী?’ কেইন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।এই গামলাতে?’
‘একজন আমেরিকান ভদ্রমহিলা। গুপ্ত বলল। তার খুব তাড়া ছিল এডেন ছেড়ে যাবার আর আমাদেরটাই ছিল একমাত্র জাহাজ। ক্যাটালিনাও এক সপ্তাহের আগে আসবে না।’
কেইন সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে বলল। তাহলে আমি আর এখানে বেশিক্ষণ থাকব না। ভদ্রমহিলাকে জাগাবার দরকার নেই। অহেতুক কৌতূহল সৃষ্টি করবে।
গুপ্ত মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার মনে হয় সেটাই ভাল হবে। গতকাল ভোরের একটু আগে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে।
কী সেটা?
‘রোমেরোর ক্যাটালিনাটাকে দেখলাম প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে। একটা পর্তুগিজ পণ্যবাহি জাহাজের পাশে ল্যান্ড করল আর কিছু ক্রেট অফলোড় করল।’
‘সেটা আর আমরা এখানে যা করছি তার মাঝে কি পার্থক্য? তার মানে। রোমেরোও কিছু একটা স্মাগলিং করছে।’
কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল। আমরা সবাই কিছু টা করছি। আচ্ছা আসি, আবার আগামী মাসে দেখা হবে।
তারপর সে লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচে ডেকে নেমে গেল। রেইলে ঝুঁকে দেখল দুজন লস্কর একটা তেলের ড্রাম লঞ্চের ডেকে পিরুর কাছে নামাচ্ছে। পেছন থেকে হঠাৎ একটা মৃদু নারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আপনার কাছে কি লাইটার আছে?
সে দ্রুত ঘুরল। গোলাকার নিটোল মুখের একজন দীর্ঘাঙ্গী। মাথায় একটা স্কার্ফ জড়ানো আর পরনে ডাস্টার কোট। কেইন লাইটার জ্বেলে দুহাত দিয়ে আড়াল করে ধরল। বেড়াবার জন্য সময়টা একটু বেশি রাত হয়ে গেল না?’
ভদ্রমহিলা এক মুখ ধোয়া ছেড়ে রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আসলে আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। এই জাহাজে যাত্রী সেবার ব্যবস্থা খুবই সীমিত।
‘সেটা আমি বিশ্বাস করি।’
‘আরেকজন আমেরিকানের সাথে দেখা হওয়ার আজব জায়গা এটা, তাই না?
কেইন দাঁত বের করে হাসল। আজকাল আমরা যেখানে সেখানে ভেসে উঠছি।
মহিলাটি রেইলের উপর ঝুঁকে তার লঞ্চের দিকে তাকিয়ে বলল। ওটা নিশ্চয়ই আপনার লঞ্চ?’
কেইন সায় দিয়ে বলল। আমি গভীর সমুদ্রের একজন মৎস্যশিকারী। দাহরান থেকে অপারেট করি। ঝড়ের কবলে পড়ে গিয়েছিলাম আর জ্বালানিও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস কানতারা এগিয়ে এল।
‘ও আচ্ছা।’ মহিলা বলল।
তার পারফিউমের সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর কোন এক কারণে কেইন বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না। এমন সময় লঞ্চ থেকে পিরুর হাঁক শোনা গেল। সে মৃদু হেসে বলল। এবার আমাকে যেতে হবে।’
সে তাড়াতাড়ি মই বেয়ে নিচে নেমে আসতেই পিরু দড়ির বাঁধনটা খুলে ফেলল। সাথে সাথে কানতারা সরে গেল। আর যখন সে উপরের দিকে তাকাল, ডেকের হলুদ আলোয় দেখা গেল মহিলাটি রেইলে হেলান দিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখছে। এক সময় রাতের অন্ধকারে ওরা মিলিয়ে গেল।
এই মুহূর্তের জন্য সে মন থেকে মহিলার কথা ঝেড়ে ফেলল। কেননা এখন অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। দুই গ্যালনের তেলের টিনটা পিরু ডেকের যেখানে রেখেছিল সেখানেই আছে। কেইন সেটা দ্রুত একবার পরীক্ষা করে নিচে সেলুনে গেল।
পিরু এয়ার ট্যাংক রেডি করে রেখেছিল। কেইন সব পোশাক খুলে ফেলল, পরনে কেবল একটা শর্ট। পিরুর সাহায্য নিয়ে এয়ার ট্যাংকটা পিঠে বেঁধে নিল। পিরু হইল হাউস থেকে একটা শক্তিশালী স্পট ল্যাম্প নিয়ে এল। লম্বা একটা তার লাগানো আছে এর সাথে। পানির নিচে ব্যবহারের জন্য ল্যাম্পটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। তারের আরেক মাথার প্লাগ বোটের লাইটিং সিস্টেমের সাথে লাগানো আছে। তেলের টিনটার দুই মাথায় একটা আংটা ঝালাই করা আছে। পিরু একটা মোটা শনের দড়ি আংটার মধ্য দিয়ে ঢোকালো। কেইন ডাইভিং মাস্ক পরে শ্বাস নেবার নলের মাউথ পিসটা দাঁতের মাঝে শক্ত করে কামড়ে ধরল। তারপর এক হাতে ল্যাম্প নিয়ে লঞ্চের এক পাশ দিয়ে সাগরের পানিতে ঝাঁপ দিল।
এক মুহূর্ত অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক করার পর সাঁতার কেটে নিচে নেমে লঞ্চের তলায় গিয়ে পৌঁছাল।
নিস্তব্ধ এক জগতে একাকী ভেসে বেড়াবার অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করল। চারপাশে সাগরের পানি ফসফরাসের মতো জ্বলে উঠছে আর ল্যাম্পের আলোয় আকৃষ্ট হয়ে আসা স্বচ্ছ মাছের দল উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
একটু পর তেলের টিনটা পানির মধ্য দিয়ে নিচে নেমে এল। কেইন এক হাতে রশিটা ধরে জাহাজের খোলের নিচে লাগানো দুটি আংটার মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দিল।
রশিটা আংটার মাঝে শক্ত করে বাঁধার সময় সে চারপাশের অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। সাগরের তলদেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে ভাস্বর মাছগুলোর কারণে, যেন অনেক মোমবাতি জ্বলছে। এক ঝাঁক ব্যারাকুড়া একটা রূপালি রেখার মতো বিদ্যুত গতিতে ছুটে গেল। তারপর আট ফুট দৈর্ঘ্যের একটা শার্ক ল্যাম্পের আলোর আভার মাঝে এসে থমকে দাঁড়িয়ে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
শাকটা সামনে এগোতেই সে মুখ থেকে শ্বাস নেবার নলটা খুলে ফেলল। সাথে সাথে রূপালি রঙের বুদবুদ মুখ থেকে বেরিয়ে এল। শাকটি তার লেজ দিয়ে পানিতে একটা ঝাপটা মেরে গতিপথ বদলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কেইন দ্রুত সাঁতার কেটে উপরে চলে এল, পিরু তাকে টেনে নিচু রেইলের উপর দিয়ে তুলল। সব ঠিক আছে তো সাহিব?’
কেইন মাথা নেড়ে ট্যাংকটার স্ট্র্যাপ খুলল। কোন সমস্যা নেই, শুধু একটা শার্ক ছাড়া। সে ব্যাটা একটু খেলা করতে চেয়েছিল।
পিরু অন্ধকারে সাদা দাঁতগুলো বের করে হেসে তার হাতে একটা তোয়ালে দিল। কেইন নিচে নেমে এল। পানি অসম্ভব ঠাণ্ডা ছিল। সে গা রগড়ে মুছলো, তারপর পোশাক পরলো।
ডেকে বের হবার পর পিরু তাকে আরো এক মগ কফি দিল। কফি পান করতে করতে কেইন দূর দিগন্ত রেখায় কানতারার নেভিগেশন আলো দেখতে পেল। তখন আবার সেই মহিলার কথা মনে পড়ল।
দেখতে তিনি অবশ্যই সুন্দরী, কিন্তু কানতারার মতো একটা গামলায় কি করছিলেন! অবশ্য এর কোন সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মৃদু হেসে হুইলহাউসে ঢুকে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে সে লঞ্চটা সামনের অন্ধকারে চালিয়ে নিয়ে চলল।
.
০৪.
পরদিন বিকালে তারা দাহরানে পৌঁছাল। লঞ্চটি বাঁকা শৈলান্তরীপ পার হতেই দুই মাস্তুলওয়ালা একটা ধাও–(আরবি স্টাইলের জাহাজ) বন্দর থেকে বের হয়ে এল। উপসাগরের বাতাসে এর পাল ফুলে উঠেছে। আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ধাওটি ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে।
কানতারা জেটিতে মাল নামাচ্ছিল। সমুদ্র সৈকতের বাঁকা অংশে জেলেরা ধৈর্য ধরে বসে তাদের জাল মেরামত করছে। আর নেংটা কয়েকটা শিশু অগভীর পানিতে খেলা করছে।
কেইন ইঞ্জিন বন্ধ করে পিরুকে ইশারা করল। সে লঞ্চের পেছনের ডেকে নোঙর নিয়ে তৈরি ছিল। নোঙরটা বন্দরের সবুজ পানিতে সশব্দে পড়ে নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। লঞ্চটা একটু সামনে এগিয়ে নোঙরের টানে পূব দিকের পাথুরে জেটির পঞ্চাশ কি ষাট গজ দূরে থেমে পড়ল।
পিরু কেবিনে অদৃশ্য হল। আর কেইন হুইলহাউস থেকে বের হয়ে এল। একটা সিগারেট ধরিয়ে লঞ্চের পেছন দিকে ধীরে ধীরে এগোল। সেখানে দাঁড়িয়ে এক পা পিতলের রেইলের সাথে ঠেকালো। রোদের প্রচণ্ড তেজ থেকে চোখ জোড়া বাঁচাতে তোবড়ানো নোনা দাগে ভরা পিক ক্যাপের সামনের অংশটা একটু বেশি নামিয়ে নিল।
বলিষ্ঠ গড়নের দীর্ঘদেহের অধিকারী একজন মানুষ, পরনে নিল ফেডেড ডেনিম আর সোয়েট শার্ট। বাদামি চুলগুলো রোদে ঝলসে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। গালে তিন দিনের না কামানো দাড়ি। রোদে পোড়া মুখের চামড়া গালের হাড়ের উপর টান টান হয়ে আছে। গর্তে ঢোকা চোখ জোড়া শান্ত, ভাবলেশহীন। চোখের দৃষ্টি সবসময় দূরে তাকিয়ে রয়েছে, যেন কিছু একটা খুঁজছে।
বন্দরের দিকে তাকিয়ে সে দেখল নোঙর করা দুটো ধাওয়ের মাঝ খান দিয়ে একটা ছোট দাঁড়টানা নৌকা এগিয়ে আসছে। পেশিবহুল দেহের অধিকারী একজন আরব বৈঠা বাইছে। আর কুঁচকানো খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন দাড়িওয়ালা মোটা সোটা অফিসার তাকে দ্রুত যাওয়ার জন্য বলছে। অফিসারের মাথায় একটা সাদা। জড়ানো।
পেছন থেকে একটা মৃদু কাশির শব্দ শোনা যেতেই কেইন না ঘুরে পেছনে এক হাত বাড়াল। পিরু তার হাতে বড় এক গ্লাস বরফ দেওয়া জিন-স্লিং দিল। সে শান্ত স্বরে বলল, সম্ভবত ক্যাপ্টেন গনজালেস বোটে তল্লাসি চালাবেন, সাহেব।
কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল। সেজন্যই তাকে বেতন দেওয়া হয়।
সে আস্তে আস্তে গ্লাসের ড্রিংকস চুমুক দিয়ে শীতল আমেজটুকু উপভোগ করতে করতে তাকিয়ে দেখতে লাগল নৌকাটাকে এগিয়ে আসতে। নৌকা লঞ্চের গায়ে মৃদু ধাক্কা লাগতেই গনজালেস তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ঘামে তার সারা মুখ চক চক করছে। ডান হাতে একটা কাগজের জাপানি পাখা অনবরত নেড়ে মাছি তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
কেইন তার দিকে তাকিয়ে একটা সেঁতো হাসি দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে গরম তোমাকে পেয়ে বসেছে, জুয়ান।
গনজালেস কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে উত্তর দিল, “শুধু মাত্র ডিউটি করার কারণেই একজন কর্তব্যরত অফিসার হিসেবে আমাকে বাধ্য হয়ে জেটিতে আসতে হয় যখন কোন মেইল বোট এডেন থেকে আসে। মাথা-ঢাকা কাপড়ের এক প্রান্ত দিয়ে সে মুখ মুছলো–”এবার কোত্থেকে এলে?
কেইন ড্রিংকসটা শেষ করে গ্লাসটা পিরুর হাতে দিল। সে তখনও ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, “মুকাল্লা, মেরি পেরেটকে ডেলিভারী দেবার জন্য আমার কাছে কয়েকটা চিঠি রয়েছে।’
গনজালেস তার আঙ্গুলে চুমু খেয়ে বলল, “আহ, সেই আনন্দময়ী মাদমোয়াজেল পেরেট। আমরা হচ্ছি সুবিধাপ্রাপ্ত লোক। এইখানে এই পৃথিবীতে এক ঝলক স্বর্গ। তুমি কি কোন কার্গো এনেছো?
কেইন মাথা নেড়ে বলল, ‘ফেরার সময় আমরা একটা শার্ক আনতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বরশি শুদ্ধ অর্ধেকটা রশি সে নিয়ে গেছে।’
গনজালেস একটা হাত তুলে চোখ ঘুড়িয়ে বলল, ‘তোমরা, আমেরিকানরা এতে উৎসাহী—আর সেটা কিসের জন্য?
কেইন বলল, তুমি কি উপরে আসবে তল্লাশি চালাতে?’।
গনজালেস মাথা নেড়ে বলল, আমি কি একজন বন্ধুকে অপমান করব? সে হাতে ইশারা করে বৈঠাধরা লোকটাকে ফিরে যেতে বলল। আমি এখন বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ড্রিংকস আর আমার স্ত্রীর শীতল হাতের পরশ নেবো।’
কেইন লক্ষ্য করল অনেকগুলো ধাওয়ের মাঝে নৌকাটা অদৃশ্য হয়ে। গেল। কিছুক্ষণ পর সিগারেটটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলে রেইল থেকে ঘুরে পেছন ফিরল। ভাবছি একটু সাঁতার কাটবো,’ সে বলল। ডেকটা মুছে ফেলে, পিরু। তারপর তুমি তীরে গিয়ে তোমার ভালোবাসার মেয়েটির সাথে দেখা করতে যেতে পারো।
সে নিচে কেবিনে গিয়ে দ্রুত পোশাক বদল করল। ডেকে যখন ফিরে এল, তখন তার পরনে একটা পুরনো খাকি শর্টস আর কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলানো চামড়ার খাপে একটা কর্ক হ্যান্ডলওয়ালা ছুরি।
পিরু রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে একটা রশি টানছে। কয়েকমুহূর্ত পর একটা বড় ক্যানভাসের বালতি উঠে এল। সে এর ভেতরের বস্তুগুলো ডেকে খালি করে বালতিটা আবার পানিতে ছুঁড়ে ফেলল।
কেইন ডাইভিং মাস্ক পরার প্রয়োজন বোধ করল না। সে দৌড়ে এসে পিরুকে পাশ কাটিয়ে রেইল টপকে সোজা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ জায়গায় বন্দরের গভীরতা প্রায় বিশ ফুট। সে পরিষ্কার সবুজ পানিতে সাঁতার কাটতে লাগল। কয়েকবার সাগরের তলদেশে গিয়ে সাদা বালুতে লাথি দিয়ে আবার উপরে উঠে এল।
প্রায় উপরে পৌঁছার পর দিক পরিবর্তন করে লঞ্চের নিচে পৌঁছাল। দুই গ্যালনের তেলের ক্যানটা তখনো একইভাবে আংটা থেকে ঝুলছে, যেভাবে সে রেখে গিয়েছিল।
দ্রুত সেটা পরীক্ষা করে উপরে ভেসে এল। পিরু রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতে ক্যানভাস বালতিটা নিয়ে। কেইন একবার মাথা নেড়ে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবার ডুব দিল।
তেলের ক্যানটার কাছে পৌঁছে ছুরিটা বের করে রশির বাধনটা কাটলো। একমুহূর্ত পরেই ক্যানভাসের বালতিটা তার পিঠে এসে ধাক্কা মারল। মুক্ত হাত দিয়ে সেটা টেনে নিয়ে এর ভেতরে তেলের ক্যানটা ঠেলে ভরলো। দুবার রশি ধরে টান দিতেই বালতিটা হালকাভাবে উপরের দিকে উঠে গেল।
কোন তাড়া নেই তার। সে আবার সাঁতার কেটে সাগরের তলদেশের সাদা বালুতে পৌঁছে অলসভাবে বুদবুদের ধারার মাঝে উপরে ভেসে উঠল। একটু পর ভেসে উঠে রেইল পেরিয়ে ডেকে উঠে দেখল কেউ নেই। শুধু একটা তোয়ালে পরিষ্কার ভাঁজ করে হ্যাঁচের উপরে রাখা রয়েছে। সে তাড়াতাড়ি গা মুছে নিচে গেল ভেজা চুল মুছতে মুছতে।
পিরু কেবিনের মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে। দুই হাঁটুর মাঝে তেলের টিনটা ধরে বেশ নিপুণতার সাথে বাটালির চাপে ঢাকনিটা খুলে ফেলল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা পেট মোটা পানি নিরোধক কাপড়ের পুটলি বের করল। মুখ তুলে বলল, আমি কি এটা খুলবো, সাহিব?’
কেইন মাথা নেড়ে বলল, “আমরা বরং স্কিরোজকে এই আনন্দটুকু উপভোগ করতে দেব। কারণ টাকা তো সেই দিচ্ছে। তুমি বরং তেলের টিনটা এখান থেকে সরিয়ে ফেল।
পিরু টিনটা নিয়ে উপরে ডেকে চলে গেল। কেইন কাপড়ের পুটলিটা হাতে নিয়ে এর ওজন আন্দাজ করল এক সেকেন্ড। তার ভ্রু কুঁচকে উঠল। তারপর সেটা টেবিলে রেখে বাংকে শুয়ে পড়ল।
ক্লান্তিতে তার সারা শরীর ভেঙে এল। হঠাৎ মনে পড়ল গত চব্বিশ ঘণ্টা সে ঘুমায়নি। চোখ বুজে সারা শরীর একটু শিথিল করল। এমন সময় লঞ্চের গায়ে একটা নৌকার ঘসা লেগে মৃদু শব্দ শোনা গেল আর পিরু হাজির হল দরজায়। সাহিব! সেলিম এসেছে।’
একটা মুহূর্ত বাংকের উপর বসে সে ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগল। তারপর বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা ‘৪৫ ক্যালিবার কোল্ট অটোমেটিক বের করে আনল। প্যান্টের কোমর বন্ধনিতে ওটা গুঁজে পিরুকে পাশ কাটিয়ে উপরে ডেকে চড়লো। •
একজন দীর্ঘদেহী আরব রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা ঢাকা কাপড়টা কালো সিল্কের কর্ড দিয়ে আটকানো। কালো মুখে ঠাণ্ডা চোখ জোড়া চক চক করছে। একটা পুরোনো ক্ষত মুখটাকে বাঁকা করে দাড়ির মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
কী চাও তুমি? কেইন প্রশ্ন করল।
সেলিম তার বেল্টে আটকানো বাঁকা জামবিয়া ছুরিটার রূপালি বাঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল, “স্কিরোজ আমাকে পাঠিয়েছে, সে বলল। আমি পুটলিটা নিতে এসেছি।’
‘তাহলে তুমি বরং স্কিরোজের কাছে ফিরে গিয়ে তাকে নিজে আসতে বলো।’ কেইন বলল। কে আমার লঞ্চে উঠতে পারবে না পারবে সে ব্যাপারে আমার নিজের পছন্দ অপছন্দ আছে।
সেলিম নরম স্বরে বলল, ‘একদিন তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলবে, সেদিন তোমাকে আমার মেরে ফেলতে হবে।’
‘আমি প্রাণ ভয়ে এখনই কাঁপছি।’
আরব লোকটি অতিকষ্টে তার রাগ সামলে বলল, ‘পুটলিটা।
কেইন কোমরবন্ধ থেকে কোল্টটা বের করে গুলি ছোঁড়ার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বলল। “আমার লঞ্চ থেকে নামো।’
হঠাৎ একটা বিপজ্জনক নিরবতা নেমে এল। সেলিম হাতের মুঠোয় জামবিয়ার হাতল শক্ত করে ধরল। কেইন দ্রুত কয়েক পা সামনে এগিয়ে এক পা তুলে নিচু রেইলের উপর দিয়ে তাকে একটা ধাক্কা মারল।
বৈঠার কাছে বসে থাকা দুজন আরব মাঝি তাড়াহুড়ো করে তাদের মালিককে পানি থেকে তুলল। সে পানিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়েছিল, কাশতে কাশতে মুখ থেকে সে পানি বের করল। তার আলখাল্লা পানিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে।
কেইন এক পা রেইলে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। কোল্টটা অলসভাবে এক হাতে ধরে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য সেলিম তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর আঙ্গুলে তুড়ি মারতেই দুই দাড়ি নৌকা নিয়ে লঞ্চের পাশ থেকে সরে গেল।
জেটিতে মরচে ধরা কার্গো জাহাজটার পাশে একটা বড় তিন মাস্তুলওয়ালা ধাও নোঙর করা রয়েছে। সেলিম চিনতে পারল ওটা সেলিমের ধাও ফারাহ। দাঁড়টানা নৌকাটা ধীরে ধীরে ওটার দিকে যাচ্ছিল। কয়েক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে সে রেইল থেকে ফিরল।
পিরু ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বেশ চিন্তিত। কাজটা ভাল হলো না সাহিব। সেলিম এটা ভুলবে না।’
কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “সে আমি ভাববো। ক্লান্তি আবার ভর করতেই সে অলসভাবে হাই তুলল। এখন একটু ঘুমানো দরকার। স্কিরোজ এলে আমাকে জানাবে।
পিরু মাথা নেড়ে রেইলে হেলান দিয়ে ডেকের উপর আসন পেতে বসল। কেইন নিচে চলে গেল।
কোল্টটা বালিশের নিচে ঠেলে দিয়ে একটা ড্রিংকস নিয়ে সিগারেট ধরাল, তারপর বাংকে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রেখে কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এয়ারকন্ডিশনারের হাওয়ায় নীল ধোয়ার মোচড় খাওয়া দেখতে দেখতে সেলিমের কথা ভাবলো।
লোহিত সাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত সমস্ত বন্দরে সে পরিচিত। যে কোন জিনিস–সোনা, অস্ত্র, এমনকি মানুষ, যাতেই লাভ পাওয়া যায় সে তা নিয়েই ব্যবসা করে। তবে তার কাজের এই অংশটুকু কেইন সহ্য করতে পারে না। এখনো আরব দেশগুলোতে ক্রীতদাস বিশেষত ক্রীতদাসীর বেশ চাহিদা আছে। সেলিম এই চাহিদা মেটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সে বিশেষ করে অল্পবয়সি মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করে।
কেইন মনে মনে চিন্তা করল, কোন এক অন্ধকার রাতে যদি ফারাহ কোন দুর্ঘটনায় পড়ে তখন সেলিম কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এটা অবশ্য সহজেই ঘটানো যায়। মুকাল্লাতে উদ্ধারকাজ করার সময় সে যে পানি নিরোধক বিস্ফোরক ব্যবহার করেছিল তার একটা দিয়ে কাজটা সারা যেতে পারে। এই ভাবনাটা তাকে বেশ স্বস্তি দিল।
চোখ বন্ধ করতেই অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরল।
.
ঘণ্টাখানেক ঘুমাতেই কাঁধে হালকা ঠেলা খেয়ে সে জেগে উঠল। পিরু বাংকের পাশে দাঁড়ানো।
কেইন কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হল। কী ব্যাপার, স্কিরোজ এসেছে?
পিরু মুখ গম্ভীর করে ঘাড় কাত করল। সে জেটিতে অপেক্ষা করছে, সাহিব।
কেইন মাটিতে দুপা নামিয়ে দাঁড়াল, তারপর দুহাত টান টান করল। ঠিক আছে তুমি বরং তাকে ডিঙ্গিতে করে এদিকে নিয়ে এস।’
পিরুকে পেছন পেছন নিয়ে সে উপরে ডেকে গেল। স্কিরোজ বড় একটা পানামা হ্যাট দিয়ে মুখ আড়াল করে জেটির কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ময়লা দাগলাগা সাদা লিনেন স্যুট।
পিরু পানিতে ডিঙ্গি নামিয়ে দ্রুত দাঁড় বেয়ে ওর দিকে এগোতেই গ্রিক লোকটি তার মালাক্কা বেতের লাঠিটা উঁচু করে উৎফুল্ল স্বরে বলল, আমার কি এখন আসাটা নিরাপদ হবে। সকালেই কিন্তু একবার গোসল করেছি।’
কেইন এক হাত উঠিয়ে বলল, “আমি তোমার জন্য একটা ড্রিংকস রেডি করে রাখবো।”
অনেক কসরত করে জেটির গায়ে লাগানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে অবশেষে সে ডিঙ্গিতে নামল। এ দৃশ্য দেখার পর কেইন কেবিনে গেল। দুই গ্লাস জিন স্লিং তৈরি করা শেষ করতেই ডিঙ্গিটা এসে লঞ্চের গায়ে ঠেকলো। একটু পরই স্কিরোজ ভারী পায়ে মচ মচ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে কেবিনে প্রবেশ করল।
ধপাস করে একটা চেয়ারে বসেই আর্তনাদ করে উঠল সে। আচ্ছা তুমি কেন বন্দরের মাঝখানে তোমার লঞ্চের নোঙ্গর ফেল? অন্য সবার মত কেন জেটির গায়ে বেঁধে রাখো না?
ঘামে তার কোটের বিভিন্ন জায়গা ভিজে বড় বড় ছাপ ফেলেছে। স্কিত মুখের ভাজ দিয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে। একটা লাল সিল্কের রুমাল বের করে সে ঘাম মুছলো। তারপর পানামা হ্যাটটা খুলে সেটা দিয়ে হাওয়া খেতে লাগল। সযত্নে আচোনো পমেড মাখা চুল চপ চপ করছে। তার কালো কুতকুতে চোখ জোড় ধূর্ততায় ভরে আছে।
কেইন তার হাতে একটা ড্রিংকস দিল। ইতোমধ্যে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চিনেছো। আমি এই হতচ্ছাড়া শহরের কাউকে বিশ্বাস করি না। বলতে পারো আমি আমার চারপাশে একটা পরীখা রাখাটাই শ্রেয় মনে করি।’
স্কিরোজ মাথা নাড়তে লাগল। পাগল আমেরিকান। তোমাকে আমি কখনো বুঝতে পারব না। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে সাবধানে টেবিলে নামিয়ে রাখল। আমার বিশ্বাস সেলিমের সাথে তোমার সামান্য ঝামেলা হয়েছে।’
কেইন একটা সিগারেট ধরাল। আমি একে সামান্য বলবো না। আমি কেবল আমার বোট থেকে তাকে পানিতে ফেলে দিয়েছি। আচ্ছা কবে থেকে সে তোমার হয়ে কাজ করছে বলতো?’
স্কিরোজ কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বেশ সময় নিয়ে কালো তেলতেলে একটা চুরুট ধরাল। মাঝে মাঝে আমি তাকে কাজে লাগাই। আবার প্রয়োজন পড়লে সে আমার হয়ে ভারতে জাহাজ নিয়ে যায়। আজ বিকেলে তাকে আমি এজন্য পাঠিয়েছিলাম, কারণ অন্য একটা ব্যাপারে আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।
কেইন ভ্রূ কুঁচকালো। “ঠিক আছে। ওকে আর কখনো পাঠিও না। আমি ওকে সহ্য করতে পারি না। এর আগে একবার ব্রিটিশ গান বোট ওর পিছু নিলে সে চারজন ক্রীতদাসকে উপসাগরে তিন মাইল গভীরে পানিতে ফেলে দেয়। তাদেরকে আমি উদ্ধার করি।’
স্কিরোজ কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে এক হাত তুলে বলল। “আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝলাম সে যেভাবে টাকা উপার্জন করে তা তোমার পছন্দ নয়। তবে একটা কথা মনে রেখো। আজ বিকেলে তুমি তার সাথে যে আচরণ করেছো, তোমার জায়গায় আমি হলে এখন থেকে সাবধান হতাম।
কেইন পানি নিরোধক পুটলিটা টেবিলে ঠেলে বলল, আচ্ছা এখন কাজের কথায় আসা যাক।
স্কিরোজ একটা ছুরি বের করে সতর্কতার সাথে পুটলিটা কাটতে শুরু করল। তোমার কোন সমস্যা হয়নিতো?’
কেইন মাথা নেড়ে বলল, মাঝরাতের পরপরই আমরা জায়গামতো পৌঁছে গিয়েছিলাম। তবে জাহাজটা দেরি করে আসে আর ও’হারা রোজকার মতো মাতাল হয়ে পড়েছিল। নিয়ন্ত্রণ গুপ্তর হাতে ছিল। সে আমাকে একটা নতুন খবর শোনালো।
কী সেটা?
‘ওরা ক্যাটালিনাকে সাগরের ত্রিশ মাইল গভীরে একটা পর্তুগিজ কার্গো জাহাজ থেকে মাল খালাস করতে দেখেছে।’
স্কিরোজ হেসে উঠল। “আচ্ছা তাহলে রোমেরোও হাত ময়লা করছে। বেশ ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা আসার পর কাস্টমসে কোন সমস্যা হয়েছে?”।
কেইন বলল, সেখানে কোন সমস্যা হয়নি। গনজালেস লঞ্চে উঠেনি। শুধু শুধু তেলের টিনটা জাহাজের নিচে বেঁধে নিয়ে আসাটা কেবল সময়ের অপচয় হয়েছে।
স্কিরোজ মাথা নেড়ে বলল। এই কাজে কোন কিছুই সময়ের অপচয় নয়। হয়তো একদিন যখন তুমি মোটেই আশা করবে না তখন সে হয়তো নিয়ম মাফিক দায়িত্ব পালন করতে শুরু করবে।
কথা বলতে বলতে সে পুটলিটার উপরের আবরণ সরিয়ে এক বান্ডিল ভারতীয় রুপি বের করল।
স্কিরোজ টাকা গণনা শুরু করতেই কেইন মাথা নাড়তে লাগল। আমি কোনদিন তোমার এই ধান্দা বুঝতে পারবো না। ভারতে সোনা পাচার করে সেখান থেকে ভারতীয় রুপি স্মাগলিং করে আনা।
স্কিরোজ মৃদু হাসল। এটা হল বিনিময়ের বিষয়। আজকের এই আধুনিক জগতে টাকা কামানো আসলে খুবই সহজ। চুরি করার দরকার পড়ে না।
আবার তার সারা মুখ ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে উঠেছে। সে ব্যাংক নোটগুলোর উপর আলতো হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আহা আমার বন্ধু, তুমি যদি জানতে টাকা আমার উপর কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ছয় মাস আগে যখন গোয়া থেকে এখানে চলে আসি তখন আমার ধারণা ছিল না এই জায়গাটা একটা সোনার খনির মত।
কেইন নিজের গ্লাসে আরেকটা ড্রিংকস ঢাললো। এই টাকার কিছুটা মাঝে মধ্যে খরচ করো না কেন?
স্কিরোজ কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। আমার জীবন শুরু হয়েছে উত্তর গ্রিসে একটা পাহাড়ি খামারে। সেখানে জমিতে মাটির চেয়ে পাথর বেশি। আমার মা পঁচিশ বছর বয়সেই বুড়ি হয়ে যান। আর এক বছর অনাবৃষ্টির কারণে ক্ষেতে ফসল ফলেনি। আমার দুই বোন অনাহারে মারা গেল। এই ঘটনা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না। সেজন্য আমি বেঁচে আছি শুধু টাকা কামাবার জন্য। আমার ব্যাংক ব্যালেন্স স্ফিত হলেই আমি খুশি হই। একটা পেনি হাতছাড়া করতেও আমার মায়া লাগে।
কেইন এবার দাঁত বের করে হাসল। টাকার কথা যখন উঠলই তখন আমার পাওনাটা মিটিয়ে দাও। যদি কিছু মনে না করো সবসময়ের মতো ডলারেই দিও।
ফিরোজ আবার হেসে উঠতেই তার বিশাল দেহের মাংসপেশিগুলো কেঁপে উঠল। তবে আমি কিন্তু কখনো ভুলিনা তুমি হচ্ছো আমার এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যাকে তোমরা বলে থাকো কিং পিন, তাই না?’
‘গ্যাস দেওয়া ছেড়ে এবার ক্যাশ বের করো।’ কেইন বলল।
স্কিরোজ একটা পেটমোটা ওয়ালেট বের করে একশো ডলারের নোটগুলো গুনতে শুরু করল। তার হাত ঘেমে উঠল আর বেশ অনিচ্ছা নিয়ে—- সে একটা একটা নোট টেবিলে রাখতে লাগল। বিশটা নোট রাখার পর একটু থেমে আরো পাঁচটা নোট তার সাথে যুক্ত করে বলল, এই নাও বন্ধু, আমাদের মাঝে চুক্তি হয়েছিল দুই হাজার। তবে আমি তোমাকে আরো পাঁচশো ডলার বোনাস হিসেবে দিলাম। কেউ যেন বলতে না পারে স্কিরোজ ভাল কাজের পুরস্কার দেয় না।’
কেইন নোটগুলো টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল। তুমি একটা বুড়ো মাকড়সা। খুব ভাল করেই জানো এ টাকার বেশির ভাগ তোমার কাছেই ফিরে আসবে, হয় তোমার হোটেলের বারে কিংবা জুয়ার টেবিল থেকে।’
স্কিরোজ আবার হেসে উঠল, তার সারা মুখ এমনভাবে কেঁপে উঠল যে দুই চোখ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর সে দুপায়ে খাড়া হলো।
‘এবার যেতে হবে। দরজার দিকে এগিয়েই তারপর একটু থামল। ‘একটা জরুরি খবর প্রায় ভুলেই বসেছিলাম। সে ধীরে ধীরে ঘুরল, “আজ বিকেলের জাহাজে এডেন থেকে একজন মহিলা এসেছেন। একজন আমেরিকানমিসেস কানিংহাম, বেশ সুন্দরী। তিনি তোমাকে খুঁজছিলেন।
কেইনের দেহ শক্ত হল। হঠাৎ অবাক হয়ে তার ভ্রু কুঁচকে উঠল। কানিংহাম নামেতো কাউকে আমি চিনি না।’
স্কিরোজ কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল, তিনি তোমাকে চেনেন অথবা তোমার সম্পর্কে জানেন সম্ভবত। আমার হোটেলে উঠেছেন। আমি তাকে বলেছিলাম তোমার সাথে আজ আমার দেখা হবে। তখন তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন তোমাকে একটা খবর দিতে। তুমি যেন আজ তার সাথে হোটেলে গিয়ে দেখা করো। জরুরি একটা ব্যাপারে।
কেইন টেবিলে দুহাত রেখে একটু সামনে ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ থেমে স্কিরোজ বলল, “আসছো তাহলে?
কেইন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে বলল, “অবশ্যই যাবো। আজ সন্ধায় যে কোন একসময় যাবো।’
স্কিরোজ মাথা নাড়ল। আমি তাই জানাবো তাকে। সে মৃদু হাসল। এত দুশ্চিন্তা করছো কেন। তিনি হয়তো একজন টুরিস্ট। সম্ভবত তোমার লঞ্চ ভাড়া নিতে চান, সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য।
কেইন ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্ত তার মনে হল, এটা কারণ হতে পারে না–অন্তত এই মুহূর্তের জন্য। স্কিরোজ চলে যাবার পর সে বাংকে শুয়ে উপরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অতীতের দিকে পেছনে ফিরে খুঁজতে চেষ্টা করল রুথ কানিংহামকে, কিন্তু কোন ফলোদয় হলো না। এই নামে কাউকে মনে পড়ল না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল তিনটা বেজেছে। আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে মেঝেতে পা নামাল। তারপর পোশাক পরতে শুরু করল।
ফেডেড জিন্স আর সোয়েট শার্ট পরে উপরে ডেকে গেল। পিরু রেইলে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ঢুলছিল। কেইন তাকে আস্তে ঠেলা দিতেই সে সাথে সাথে জেগে উঠে দাঁড়াল। আমি তীরে যাচ্ছি, তুমি কী করবে? কেইন বলল।
পিরু বলল, না এখন নয় পরে যাবো। আমি ডিঙিতে করে আপনাকে জেটিতে পৌঁছে দিয়েই আবার ফিরে আসবো। এটাই ভাল হবে। সেলিম আবার হয়তো আসবে।’
কেইন সায় দিয়ে বলল, তোমার কথায় যুক্তি আছে। যদি সে আসে তবে তুমি বালিশের নিচে আমার কোল্ট রিভলবারটা পাবে। প্রয়োজনে ব্যবহার করতে মোটেই ইতস্তত করো না। এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে, ওর চেয়েও বেশি।
সে ডিঙ্গিতে চড়ে বসতেই পিরু দ্রুত দাঁড় বেয়ে পাথরের জেটির দিকে চলল। জেটিতে পৌঁছার সাথে সাথে কেইন লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। উপরে উঠতেই তার নজরে পড়ল কয়েক ফুট দূরে একটা বড় পাথরের উপর বসে একজন মহিলা তার দিকে চেয়ে রয়েছে।
সে সামনে এগোতেই মহিলাটিও উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগোলো। পরনে সাদা সিল্কের দামী পোশাক, কষানি স্টাইলে মাথায় একটা নীল স্কার্ফ জড়ানো, চোখে সানগ্লাস। চশমা খুলতেই সে সাথে সাথে চিনতে পারল ইনিই সেই মহিলা যার সাথে গতরাতে কানতারা জাহাজে দেখা হয়েছিল।
একটু অনিশ্চয়তার হাসি, সেই সাথে একটু বিহ্বলতা তার কণ্ঠে, আবার আপনি? কিন্তু আমিতো ক্যাপ্টেন গ্যাভিন কেইনকে খুঁজছি।’
‘আমিই সেই লোক।’ কেইন বলল। আপনি নিশ্চয়ই মিসেস কানিংহাম, তা আপনার জন্য কী করতে পারি আমি?
মহিলাটি বেশ অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়ল। এডেনের আমেরিকান কনসাল মি. এন্ড্রুজ আমাকে বলেছেন আপনাকে খুঁজে বের করতে। তিনি বলেছেন আপনি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, দক্ষিণ আরব সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ।
সে একটু মৃদু হাসল। আমার ধারণা আমার চেহারা দেখে আপনার সে রকম মনে হচ্ছে না। এভুজ দুটোই সঠিক বলেছেন। আমি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ আর দক্ষিণ আরব সম্পর্কে আমি কিছুটা জানি। তা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
মহিলা বন্দরের দিকে তাকাল, ভুরু সামান্য কুঁচকে রয়েছে। তারপর ফিরে কেইনের দিকে ঠাণ্ডা ধুসর চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার স্বামীকে খুঁজে বের করুন। এ কাজের জন্য যত টাকা লাগে আমি দিতে রাজি আছি।’
কেইন একটা সিগারেট বের করে ধীরে ধীরে ধরাল। কত টাকা দেবেন?
মহিলা কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “এখন পাঁচ হাজার ডলার আর যদি তাকে খুঁজে পান, তখন আরো পাঁচ হাজার।
কয়েক মুহূর্ত ওরা দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর কেইন একটা লম্বা শ্বাস নিল। চলুন একটা কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমি একটা ভাল জায়গা চিনি। তারপর সে মহিলার বাহু ধরে দুজনে জেটি থেকে সামনে এগোলো।
০৫. হোটেলে যাওয়ার পথে
০৫.
হোটেলে যাওয়ার পথে ওদের মাঝে খুব একটা কথা হলো না। রুথ ক্যানিংহাম সানগ্লাস খুলে আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখতে থাকল, এই ফাঁকে কেইন মহিলাটি সম্পর্কে ভাবতে লাগল।
জেটি পার হয়ে ওয়াটারফ্রন্ট ধরে যখন ওরা হাঁটতে আরম্ভ করল, তখন কেইনের মনে হলো স্কিরোজ ভুল বলেছিল। মহিলা শুধু যে সুন্দরী তাই নয়–তিনি অসাধারণ সুন্দরী। সাধারণ একটা সুতির পোশাকেও হাঁটার ছন্দে তার হালকা পাতলা গড়নের সৌন্দর্য ফুটে উঠছিল। অনেক দিন পর কেইন এমন একজন মহিলার সাথে কথা বলল–অর্থাৎ তার নিজের পছন্দের।
উঁচু হোটেলটির সামনে একটা সরু প্রবেশ পথ রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে। ভেতরে এই শ্বাসরুদ্ধকর গরমে পুরনো একটা ফ্যান আস্তে আস্তে ঘুরছে। কেইন প্রবেশ ঘরটি পার হয়ে বারের দিকে পথ দেখিয়ে চলল।
ভেতরে কেউ নেই, কেবল সাগর থেকে বয়ে আসা মৃদু মন্দ বাতাসে ফ্রেন্চ উইন্ডোগুলো হালকা শব্দ করছে। রুথ কানিংহাম সানগ্লাস খুলে একটু ভ্রু কুঁচকালো।
‘এই জায়গায় কি কোন সার্ভিস পাওয়া যাবে না?
কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিল। এই এলাকায় খুব একটা কাজকর্ম নেই। বেশিরভাগ মানুষ বিকেলে ঘুমিয়ে কাটায়। তাদের ধারণা এই প্রচণ্ড গরমে আর কিছু করার নেই।’
রুথ মৃদু হাসল। হু, তাই বলা হয়, ভ্রমণে অনেক কিছু জানা যায়।
কেইন বারের পিছনে গিয়ে বলল, “আপনি বরং বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসুন, আমি ড্রিংকস নিয়ে আসছি। সাগর থেকে আসা হাওয়ায় ওখানে একটু ঠাণ্ডা পাওয়া যাবে।’
সে মাথা নেড়ে ফ্রেন্চ উইন্ডো দিয়ে বাইরে গিয়ে একটা রঙ্গিন ছাতার নিচে একটা বড় বেতের চেয়ারে বসল। কেইন বারের নিচে থেকে পুরনো আইসবক্স খুলে বড় দুই বোতল লেজার বিয়ার নিল। বোতলদুটো এত ঠাণ্ডা যে বাইরের দিকে আদ্রতা জমে ফোঁটা ফোঁটা বরফ হয়ে গিয়েছে। সে বারের গায়ে ঠেকিয়ে এক টানে বোতলের ক্যাপ খুলে দুটো লম্বা পাতলা গ্লাসে ঠাণ্ডা বিয়ার ঢেলে নিয়ে বাইরে বারান্দায় গেল।
গ্লাসটা রুথের হাতে তুলে দিতেই সে কৃতজ্ঞ চিত্তে তার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি গ্লাসে একটা চুমুক দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে এত ঠাণ্ডা কোন কিছু আছে। এই জায়গাটা একটা চুল্লির মতো। সত্যি বলতে কি, আমি ভাবতেই পারিনা যে কেউ এখানে ইচ্ছা করে থাকছে।’
‘কেইন একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “ই, আপনার কথায় কিছু যুক্তি আছে অবশ্য।
রুথ একটু মৃদু হাসল, মনে হয় তা আমার নজর এড়িয়ে গেছে। চেয়ারের রঙ চটা কুশনে হেলান দিয়ে সে বলল, “মি. এন্ড্রুজ বলেছেন আপনি নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্বের প্রভাষক ছিলেন।
সে মাথা নাড়ল। সে তো অনেক দিন আগের কথা।’
রুথ বলল, আচ্ছা আপনি কি বিবাহিত?
সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল, ‘ডিভোর্স হয়েছে। আমার স্ত্রী আর আমার মধ্যে কখনো মেলে নি।
রুথ ক্যানিংহাম একটু লজ্জিত হল, আমি দুঃখিত এই বিষয়টা এভাবে টেনে আনার জন্য। আপনি মনে কিছু করেননি তো?
‘ঠিক উল্টোটা,’ সে বলল। আমরা সবাই ভুল করি। আমার স্ত্রীর ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ভালই উপার্জন করে।
আর আপনার মনে কী ছিল?
‘আমার মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে আমি হয়তো একাডেমিক জীবনে সন্তুষ্ট থাকতে পারব। শুধু লিলিয়ানের জন্যই আমি সেখানে লেগে ছিলাম। একদিক দিয়ে বলতে গেলে সে আমাকে মুক্ত করেছে।
তারপর আপনি প্রাচ্যে চলে এলেন?
না প্রথমে তা নয়। বিমান বাহিনী এক বছরের জন্য একটা ফুল টাইম চাইং কোর্স দিয়েছিল, তারপর চার বছর রিজার্ভে। আমি সেটা নিয়ে নিলাম। রেগুলার পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নিলাম। এরপর চলে এলাম এখানে। ছয় বছর আগে একটা আমেরিকান অভিযানে জর্ডানে ছিলাম, তারপর কিছুদিন মিশরীয় সরকারের অধীনে কাজ করলাম, তবে সেটা বেশি দিন টিকলো না। এরপর একজন জার্মান ভূতত্ত্ববিদের সাথে দাহরান চলে এলাম। তিনি আরবি জানা একজন লোক খুঁজছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি এখানেই রয়ে গেলাম।
কখনো দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না?
সে বলল, “কি করব গিয়ে? একজন সহকারি অধ্যাপকের চাকরি যে প্রাচীন ইতিহাস পড়াবে, যা ছাত্ররা জানতে চায় না?
‘দাহরানে এর চেয়ে ভাল কিছু অফার পাননি?”
সে মাথা নাড়ল। এই জায়গার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আপনার মজ্জার মধ্যে ঢুকে যায়। এককালে এটি ছিল এরাবিয়া ফেলিক্স–সুখী আরব। প্রাচীন জগতে এ জায়গাটি ছিল সম্পদশালী দেশগুলোর মাঝে অন্যতম। তখনকার সময়ে ভারত থেকে মশলার রুটটা এখান দিয়েই ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এখন তা একটা শূন্য মরুভূমি। তবে ঐ পাহাড় আর উত্তরে ইয়েমনে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য বিশাল এক গুপ্ত ধনের ভান্ডার। শহরের পর শহর, কিছু কিছু ধ্বংস্তূপের মাঝে প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়–যেমন মারিব, যেখানে সম্ভবত শেবার রানি রাজত্ব করেছিলেন। অন্যগুলো শত শত বছর ধরে বালুর নিচে চাপা পড়ে আছে।’
‘তাহলে প্রত্নতত্ত্ব হচ্ছে আপনার প্রথম প্রেম, রুথ বলল।
‘অবশ্যই তাই। কিন্তু এখানে আমার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আমরা আসিনি মিসেস কানিংহাম। এখন কি আপনার সময় হয়নি স্বামীর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার?
রুথ তার পার্স থেকে একটা পাতলা সোনার সিগারেট কেস বের করে একটা সিগারেট হাতে নিয়ে বলল, কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। সে একটা দুঃখের হাসি হাসল। আমার ধারণা আমি জীবনের শুরু থেকেই একটু বখে গিয়েছিলাম।’
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। এটা হতেই পারে। আর আপনার স্বামীর বিষয়টা কি?
রুথ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘জন কানিংহামের সাথে আমার দেশেই কোন এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। লন্ডন স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডি থেকে পাশ করা একজন ইংরেজ। বছরে একবার হার্ভার্ডে লেকচার দিতে যেত। তারপর আমরা বিয়ে করলাম।’
কেইন ভ্রূ উপরের দিকে তুলল, ব্যস এই?’
রুথ মাথা নাড়ল। সে ছিল একজন দীর্ঘদেহী বিশিষ্ট ইংলিশম্যান। তার মতো এমন শান্ত প্রকৃতির মানুষ আমি কখনো দেখিনি।
সমস্যাটা কখন শুরু হল?’
রুথ একটু মৃদু হাসল। আপনার উপলব্ধির ক্ষমতা খুব বেশি, ক্যাপ্টেন কেইন।’ তারপর কয়েক মুহূর্ত সে হাতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকল। সত্যি বলতে কি প্রায় সাথে সাথেই শুরু হল। আমি খুব শিগগিরই আবিষ্কার করলাম, অত্যন্ত নীতিবান একজন মানুষকে আমি বিয়ে করেছি, যে কেবল তার নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকাতেই বিশ্বাস করে।
“সে তো ভালই মনে হচ্ছে।
রুথ মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু আমার বাবার কাছে নয়। তিনি চাচ্ছিলেন সে তার ফার্মে যোগ দিক, কিন্তু জন সে কথা শুনতেই চাচ্ছিল না।
কেইন দাঁত বের করে হাসল। ব্যস, জনের খেলা শুরু হয়ে গেল। তারপর কি হল?
রুথ চেয়ারে হেলান দিল, আমরা লন্ডনে থাকতাম। জন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করতো। অবশ্য বেতন খুব বেশি ছিল না। তবে আমার বাবা আমাকে বেশ ভাল অংকের হাত খরচ দিতেন।
মানে যে স্টাইলে আপনি জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন তার খরচ পোষাতে? কেইন বলল। তার কণ্ঠস্বরে খানিকটা সন্দেহপূর্ণ কৌতুকের আভাস পাওয়া গেল।
রুথ মাথা নিচু করে বলল, অনেকটা সে রকমই।
“আর আপনার স্বামী সেটা পছন্দ করতেন না?
বুথ উঠে দাঁড়াল। হেঁটে একটু সামনে এগিয়ে সাগরের দিকে তাকাল। না, সে মোটেও তা পছন্দ করতো না। একঘেয়ে–কণ্ঠস্বরে সে বলল, তারপর ঘুরে যখন কেইনের মুখোমুখি হল, তখন সে টের পেল রুথের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও সে এটা মেনে নিয়েছিল, কেননা সে আমাকে ভালোবাসতো।
তারপর সে ফিরে এসে চেয়ারে বসল। কেইন আলতোভাবে রুথের হাতের উপর হাত রাখল। আরেকটা ড্রিংক দেব?’ সে মাথা নেড়ে মানা করল। কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।
রুথ মুখের সামনে থেকে একগুচ্ছ চুল হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল, দেখুন আমার বাবা নিজের চেষ্টায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একজন মানুষ। জীবনের প্রতিটা ইঞ্চি তাকে যুদ্ধ করে এগোতে হয়েছে। তিনি জনকে সাদামাটাভাবে বলেছিলেন তিনি তার কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করেন না।
‘আর এতে আপনার স্বামীর কী প্রতিক্রিয়া হল?’
রুথ বলল, আমি যেরকম জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলাম সে রকমভাবে চলার জন্য জোর খাটালাম। আর এতে আমার নিজের টাকা থেকে দিতে হতো। কাজেই জন নিজেকে অযোগ্য মনে করতে লাগল। ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিল নিজেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে আরো বেশি সময় কাটাতে লাগল। আমার মনে হয় সে একজন পাগলের মতো ভাবছিল যে এতে তার সুনাম হবে।
কেইন একটা লম্বা শ্বাস নিল। বুঝলাম, তারপর সে আপনাকে ছেড়ে চলে গেল, তাইতো?’
রুথ মাথা নেড়ে সায় দিল। এক রাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে আর ফিরে এল না। আমার জন্য তার অফিসে একটা চিঠি রেখে গেল। আমাকে বলল কোন চিন্তা না করতে। খুব জরুরি একটা ব্যাপারে তাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য দূরে যেতে হচ্ছে।’
‘এতে কিন্তু এখনও বোঝা যাচ্ছে না কেন আপনি দাহরানে আপনার স্বামীর খোঁজে এসেছেন?’
‘সে কথাতেই আসছি এখন,’ সে বলল। চারদিন আগে এডেনের ব্রিটিশ কনসালের কাছ থেকে আমার কাছে একটা প্যাকেট আসে। তাতে কিছু কাগজপত্র আর জনের একটা চিঠি ছিল। তাতে লেখা সে উপকুলীয় স্টিমারে দাহরান যাচ্ছে। সেখান থেকে আরো ভেতরের দিকে শাবওয়া যাবে। প্যাকেটটা কনসালের হাতে দিয়ে কঠোর নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল, যদি দু’সপ্তাহের মধ্যে সে নিজে এসে সেটা দাবী না করে, তাহলে যেন ওটা আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কেইন অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। কিন্তু শাবওয়া তো মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। সে বলল। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় একটা মরুভূমি শাবআল-খালি–শূন্য এলাকার ঠিক কিনারায়। সেখানে তিনি কি করতে গেছেন?
একটা মুহূর্ত রুথ একটু ইতস্তত করল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, আপনি কখনো অ্যাসথারের কথা শুনেছেন, ক্যাপ্টেন কেইন?
সে একটু ভ্রু কুঁচকে বলল। এক প্রাচীন আরবি দেবী ভেনাসের সমতুল্য। শেবার আমলে তার পুজা হতো।
রুথ মাথা নেড়ে সায় দিল। ঠিক বলেছেন। শেবার রানিও এই গোষ্ঠির একজন উচ্চ পুরোহিত ছিলেন। ওদের মাঝে এক মুহূর্তের নিরবতা নেমে এল। এরপর সে আবার বলতে শুরু করল। আমার স্বামী কোন কারণে বিশ্বাস করতেন ঐ শূন্য এলাকার কোথাও শেবার তৈরি করা অ্যাসথার দেবীর একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে।
আবার কিছুক্ষণের জন্য নিরবতা নেমে এল, তারপর কেইন হতবাক হয়ে তার তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়তে লাগল। না, মিসেস কানিংহাম, আপনার স্বামী যদি সেই জিনিস খুঁজতে গিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে অবাক হওয়ার কোন কারণ নেই–কেন আপনার স্বামী আর যোগাযোগ করেন নি। ঐ জায়গায় কেবল বালু, গরম আর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছু নেই।
‘কিন্তু আমার স্বামী অন্য উপায়ে কিছু জেনেছিলেন। দেখুন কয়েকমাস আগে তিনি একটি অত্যাশ্চর্য বিষয় আবিষ্কার করেছিলেন। তার গবেষণার কাজের অংশ হিসেবে তাকে প্রাচীন আরবি পান্ডুলিপি আর ভুর্জপত্র অনুবাদ করতে হয়েছিল। এর বেশিরভাগ সিনাই পর্বত এলাকার সেইন্ট ক্যাথারিন মঠ থেকে এসেছিল। এগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করলেন এর একটি ইতোপূর্বে ব্যবহার করা হয়েছে। ঐ পুরনো হস্তলিপির কিছু অংশ মুছে গেছে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত যন্ত্র ব্যবহার করে মূল লেখাটার একটা অনুলিপি তৈরি করলেন।
এবার কেইনের আগ্রহ বাড়তে লাগল। সেটিও কি আরবিতে ছিল?
সে মাথা নেড়ে বলল। সেটা ছিল গ্রিক ভাষায়। আলেক্সিয়াস নামে একজন গ্রিক অভিযাত্রির একটি বিশেষ অভিযানের বর্ণনা। তিনি রোমান সেনাবাহিনীর দশম লিজিয়নে একজন সেঞ্চুরিয়ান ছিলেন। রুথ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। আপনি এলিয়াস গ্যালাস নামে একজন রোমান জেনারেলের নাম শুনেছেন?’
কেইন দ্রুত মাথা নাড়ল। খ্রিষ্টপূর্ব ২৪ শতকে তিনি দক্ষিণ আরব বিজয়ের চেষ্টা করেছিলেন। দক্ষিণে শেবা পর্যন্ত গিয়ে মারিব শহর দখল করেন। ফেরার পথে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখিন হন। মরুভূমিতে তার সৈনিকদের বেশির ভাগই হারিয়ে যায়।’
রুথ মাথা নেড়ে সায় দিল। আলেক্সিয়াসের বর্ণনা অনুযায়ী তারা আরো দক্ষিণে এগিয়ে টিমনা পর্যন্ত এগোন। তারপর শাওয়ার দিকে মার্চ করতে থাকেন। সেখানে পৌঁছে এলিয়াস গ্যালাস শেবার মন্দিরের কথা শোনেন। এর অবস্থান হওয়ার কথা শাবওয়া আর মারিবের মাঝে প্রাচীন মশলার রুটের কাছে। পথটা মরুভূমির এক কোন দিয়ে অতিক্রম করেছে। সেই জায়গার সম্পদ সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। আলেক্সিয়াসের প্রতি নির্দেশ ছিল একদল অশ্বারোহী নিয়ে মরুভূমিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পরবর্তীতে মারিবে মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়া।’
রুথ একটু বিরতি দিতেই কেইন বলল, বলে যান। সে কি তা খুঁজে পেয়েছিল না পায়নি?
রুথ মৃদু হাসল। হ্যাঁ, সে অবশ্যই তা খুঁজে পেয়েছিল। মরুভূমির মাঝে সাতটি পাথরের স্তম্ভ দিয়ে পথটি চিহ্নিত ছিল আর মন্দিরটি ছিল শাবওয়া থেকে আশি নব্বই মাইল দূরে। একটি গিরিখাতের মাঝে এক বিশাল পাথরের ভ্রুপের মাঝে এটি অবস্থিত ছিল আর আলেক্সিয়াসের বর্ণনানুযায়ী অপ্রত্যাশিত ভাবে এটি বালিয়াড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছিল। যখন তারা সেখানে পৌঁছাল তখন মন্দিরটি শূন্য ছিল কেবল একজন পুরোহিত–বৃদ্ধা রমণী উঁচু বেদিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসেছিল। প্রথমে যারা ঢুকেছিল তারা কোন ধনরত্ন না দেখতে পেয়ে এত নিরাশ হয়ে গিয়েছিল যে তারা ঐ বৃদ্ধা রমণীটিকে নির্যাতন শুরু করল, কথা বলতে। আলেক্সিয়াস অনেক দেরিতে আসায় ওদের থামাতে পারল না। ততক্ষণে ওদেরকে অভিসম্পাত করতে করতে বৃদ্ধা মারা গেল।
তারপর নিরবতা নেমে এল। কেইন হঠাৎ এক ধরনের শিহরন অনুভব করল। সে বলল, ওরা কি মন্দিরের গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছিল?
রুথ মাথা নাড়ল। এটা খুব গোপনে সংরক্ষিত ছিল। দুটো দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সফল হলো না। তারপর ওরা শাবওয়ার দিকে ফিরে চলল। ফেরার পথে খোলা প্রান্তরে প্রথম রাতে ওরা ভয়ংকর বালু ঝড়ের কবলে পড়ল। একদিনের বেশি চলল এই ঝড়। কয়েকটা ঘোড়া হারিয়ে ওরা একটা ঘোড়ার পিঠে দুজন করে চলতে লাগল। এরপর পানির প্রথম কুপটির কাছে পৌঁছে দেখল তাতে বিষ মেশানো হয়েছে।’ রুথ কাঁধ খানিকটা উঁচু করে ঝাঁকি দিল। বাদবাকি ঝঞ্ঝাটপূর্ণ বিবরণ বাদ দিলে এটুকু বলতে হয় যে, একমাত্র আলেক্সিয়াস মরুভুমি থেকে পায়ে হেঁটে জীবিত ফিরে এসেছিলেন।
কেইন বলল, তিনি সত্যিকার একজন মানুষ ছিলেন বটে।
সে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমি আপনাকে পান্ডুলিপির অনুবাদটা পড়তে দেব। আপনি নিজেই বিবেচনা করতে পারবেন। তিনি ব্যাখ্যা করেননি কেম করে মূল সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়েছিলেন, তবে যে করেই হোক কি তা পেরেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি প্যালেস্টাইনে বার-শেবা দূর্গের অধিনে ছিলেন।
কেইন উঠে সামনে এগিয়ে প্যারাপেটের কিনারায় এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি চলে গেল এডেন উপসাগরের দিকে।
ক্যাটালিনা বন্দরে পানি ছড়িয়ে শহর পার হয়ে যাচ্ছে। একটা পণ্যবাহী জাহাজ দিগন্ত দিয়ে ধীরে ধীরে ভারত উপমহাসাগরের দিকে যাচ্ছে। আর তিনটা ধাও বড় বড় পাখির মতো বন্দরের দিকে এগিয়ে আসছে।
সে এসব কিছুই দেখেনি। তার চোখের সামনে তখন শূন্য এলাকা রাব আল-খালি ভেসে রয়েছে, যার মাঝে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে শেবার মন্দির।
যখন সে সিগারেট ধরাল তখন তার হাত কাঁপছিল আর সারা শরীর অজানা উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের অভিজ্ঞতা ইতোপূর্বে তার জীবনে কেবল দুবার ঘটেছিল। দুবারই সে একটি অভিযাত্রী দলের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কোন আবিষ্কারের সন্ধিক্ষণে ছিল।
কিন্তু এটি সম্পূর্ণ আলাদা। এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়–যা সারা জীবনে কেবল একবারই পাওয়া যায়। এমন একটি বিষয় যা নসোস কিংবা ভ্যালি অফ দি কিংএ তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের সাথে তুলনীয় হতে পারে।
যখন সে ফিরে রুথের মুখোমুখি হল, তখন সে নিজের স্থির কণ্ঠস্বর দেখে অবাক হল। আপনার কি কোন ধারণা আছে আপনি এখন আমাকে যা বলেছেন তা যদি সত্য হয় তবে এর গুরুত্ব কতটুকু?
রুথ ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি কি গুপ্তধনের কথা বলছেন?
রাখুন আপনার গুপ্তধন!’ সে টেবিলে ফিরে এসে চেয়ারে বসল। শেবার সম্পর্কে যা কিছু আমরা জানি তা কেবল বাইবেলে আছে। তার নাম উল্লেখ করে কোথাও কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি, এমনকি মারিবেও নেই। যে জায়গাকে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ তার রাজধানী ছিল মনে করেন। এরকম একটা আবিষ্কার শুধু একাডেমিক জগতেই নয়, সারা দুনিয়ায় আলোড়ন তুলবে।
আচ্ছা! তাই নাকি? রুথ ধীরে ধীরে বলল, ‘এতে বোঝা যায় কেন আমার স্বামী এই আবিষ্কার নিজের কাছে রেখেছিলেন।
কেইন নাক টেনে বলল, তিনি একজন বোকা লোক। এ ধরনের বিষয় সফলভাবে সামলাতে পারে কেবল মাত্র পুরোপুরি সুসজ্জিত একটা অভিযাত্রী দল।
‘কিন্তু আপনি বুঝতে পারলেন না? রুথ বলল। সে আমার সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল এটা হবে কেবল তার নিজের একার, কোন সাহায্য ছাড়া একটি আবিষ্কার। যদি সে বিখ্যাত হতো সেটা হতো কোন মানুষের সাহায্য ছাড়া নিজের চেষ্টায় অর্জিত খ্যাতি।
কেইন অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হাসল। যদি তিনি রাব আল-খালিতে একা যাবার চেষ্টা করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি একজন বোকা মানুষ। পানির তৃষ্ণায় মরে না গেলেও সম্ভবত গলা কাটা অবস্থায় বালুতে কোথাও উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।’
রুথের চোখে গভীর বেদনার আভাস দেখা দিল, সে নার্ভাস হয়ে বার বার হাত মুঠো করতে লাগল। আপনি বলেছেন শাবওয়া নিরাপদ জায়গা নয়, ক্যাপ্টেন কেইন। এটা বলতে আপনি ঠিক কি বুঝাতে চেয়েছেন?
সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। এডেন একটি সংরক্ষিত এলাকা আর ওমানের সাথে সউদী আরবের সীমান্ত বিরোধ আছে। বছরকে বছর ধরে সর্বদা গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ লেগেই আছে। এই জায়গার সামরিক নিরাপত্তা দেখার ভার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে। তবে বিশ্বাস করুন এমনিতেই ওরা কর্মব্যস্ত। তাছাড়া সব জায়গায় সাথে সাথে পৌঁছাতে পারে না বলে সেই সব জায়গাকে ওরা ব্যান্ড সিকিউরিটি এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ কেউ যদি বোকার মতো সেসব এলাকায় যায় তবে তাদের কিছু হলে ব্রিটিশরা কোন দায় নেবে না।’
এরপর রুথ অস্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে শাবওয়া সে রকমই একটা এলাকা?
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। অবশ্যই তাই। তারপরও লোকজন সেখানে যায়। যেমন এই মুহূর্তে জর্ডন নামে একজন আমেরিকান ভুতত্ত্ববিদ সেখানে তেল অনুসন্ধান করছে। সেখানে সে টিকে থাকতে পারছে চারদিকে মুড়ির মতো রুপার মারিয়া থেরেসা ডলার মুদ্রা ছড়িয়ে আর নিজের চারপাশে একদল বাছাই করা গলাকাটা ডাকাত জড়ো করে। এরা নিজেদের স্বার্থে নিশ্চিত করবে যেন সে জীবিত থাকে।
‘আপনি কখনও সেখানে গিয়েছেন?
কেইন মাথা নাড়ল কয়েকবার, তবে সেখানকার স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর মাঝে আমি সুপরিচিত। এরা বেশিরভাগই মুসাবেইন আর একবার আপনাকে পছন্দ করলে ওরা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। তবে মুশকিল হলো শূন্য এলাকার সীমানায় দস্যুদের আবাস। যে সব লোকদেরকে বিভিন্ন অপ্রীতিকর কাজের জন্য তাদের গোত্র থেকে বের করে দেওয়া হয় তারাই সেখানে আড্ডা গেড়ে থাকে। যদি ওরা আপনাকে বাগে পায় তাহলে জ্যান্ত ছাল ছিঁড়ে রোদে টাঙিয়ে রাখে। কেমন লোক ওরা বুঝতেই পারছেন।
রুথের পুরো চেহারায় আতংক ভরে উঠল। আপনি মনে করেন সেরকম কিছু একটা আমার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেছে?
কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিল। কিছুই বলা যায় না, নাও হতে পারে, তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। রুথ প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে কাঁপতে দুহাতে মুখ ঢাকলো কেইন উঠে তার পাশে এসে দাঁড়াল। এক হাত তার কাঁধে রাখল। বিশ্বাস করুন, মিসেস কানিংহাম, আমি কেবল আপনাকে সত্য কথাটাই বলার চেষ্টা করছি। তবে তার যে কোন কিছু হতে পারে।’
রুথ উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে কেইনের বাহু আঁকড়ে ধরে তার দিকে তাকাল। কিন্তু জীবিতও তো থাকতে পারেন? এটা কি সম্ভব নয়?’
একটা মুহূর্ত সে প্রায় বলে ফেলতে যাচ্ছিল যে, এর আশা খুব কম। তারপর মৃদু হেসে তার হাতে আলতো করে চাপড় মেরে বলল, অবশ্যই এটা সম্ভব হতে পারে।
রুথ কাঁদতে শুরু করল। কেইন এক হাত দিয়ে তার কাধ ধরে তাকে। বারের দিকে নিয়ে চলল। আমার মনে হয় এখন আপনি আপনার কামরায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিন। আমি কয়েক জায়গায় খোঁজ নেবো। হয়তো কিছু একটা জানতে পারব। যদি আপনার স্বামী দুমাস আগে দাহরানে এসেই থাকেন তাহলে কেউ না কেউ তাকে অবশ্যই দেখেছে।
রুথ একথা শুনে ঘাড় কাত করল। তারপর ওরা হল পার হয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। কামরার দরজায় পৌঁছার পর রুথ পার্স থেকে চাবি বের করে তালা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। কেইন ধীরভাবে তার হাত থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে তার পেছন পেছন কামরায় ঢুকল।
খালি কামরাটার এক কোণে কয়েকটা সুটকেস দাঁড় করানো রয়েছে। রুথ এগিয়ে উপরের সুটকেসটা খুলল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটা ভারী এনভেলাপ নিয়ে ফিরে এল। এটি হল পান্ডুলিপিটার অনুবাদ, আমার মনে হয় এটা আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হবে।
সে খামটা পকেটে ভরে মৃদু হাসল। আমি সন্ধ্যা সাতটার দিকে আপনার সাথে দেখা করব। তখন হয়তো আপনার জন্য কিছু খবর নিয়ে আসতে পারি।’
রুথও মৃদু হাসল–”আমি অপেক্ষায় থাকব, ইতোমধ্যে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করব।
তার হাসির প্রত্যুত্তরে কেইনও মৃদু হেসে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
.
০৬.
করিডোর দিয়ে হেঁটে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছতেই পেছনে একটা দরজা খোলার ক্লিক শব্দ হল। একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এত তাড়াতাড়ি তোমার আর মিসেস কানিংহামের মধ্যে বোঝাঁপড়া হয়ে গেলো?
স্কিরোজ তার প্রাইভেট কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, দাঁতের ফাঁকে শক্ত করে একটা চুরুট কামড়ে ধরে রেখেছে, মুখে মৃদু হাসির আভা। কেইন ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। ভাবলাম খুঁজে দেখি তিনি আসলে কিসের পেছনে ছুটছেন।
গ্রিক লোকটি মুখ থেকে চুরুট সরিয়ে বলে উঠল, ‘বাপরে বাপ, কি গরম পড়েছে। ভেতরে এসে আমার সাথে একটা ড্রিংকস নেবে?
একটা মুহূর্ত কেইন ভাবছিল তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করবে। তারপর কি ভেবে মত বদলালো। দাহরানে খুব কম ব্যাপারই স্কিরোজের নজর এড়িয়ে ঘটে। সে সায় দিয়ে সামনে এগোল। ঠিক আছে, যদি তুমি বেশ লম্বা আর ঠাণ্ডা একটা ড্রিংকস বানাও তবে আমি রাজি আছি আসতে।’
স্কিরোজ কামরায় ঢুকল রুমালে মুখ মুছতে মুছতে। জানালার পাশে একটা বড় বেতের চেয়ারে ধপাশ করে বসে পড়ল। টেবিলে রাখা কয়েকটা বোতল আর একটা বড় জগে বরফজলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, তুমি বরং ড্রিংকসটা বরফ জল দিয়ে মেশাও, বন্ধু। আমার আর বোতল তোলার শক্তি নেই।’
কেইন দরজা বন্ধ করে টেবিলের কাছে এগোল। সে তাড়াতাড়ি দুটো বড় জিন-স্লিং তৈরি করে একটা গ্লাস স্কিরোজের হাতে তুলে দিল। সে এক ঢোকে। অর্ধেকটা গিলে ঘোঁতঘোঁত করে উঠল। ক্রিস্ট, ওহ, আরাম পেলাম। প্রত্যেক বছরের শুরুতে আমি ভাবি এটাই হবে এই অভিশপ্ত জায়গায় আমার শেষ বছর। আমি আমার মায়ের কবরের নামে শপথ নেই যে আমি গ্রিসে আমার বাড়িতে ফিরে যাবো, কিন্তু…’ তারপর সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার দুকাঁধ ঝুলে পড়ল।
‘কেন যাও না? কেইন বলল।
স্কিরোজ এক সারি ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসল।
কারণ আমি লোভী। এখানে আমি খুব সহজেই অনেক টাকা কামাতে পারি।’ গ্লাসে আরেক চুমুক দিয়ে বলে চলল, কিন্তু আমি তোমাকেও একই কথা জিজ্ঞেস করতে পারি। তোমার মত একজন মানুষের জন্য দাহরানে কি আকর্ষণ থাকতে পারে? সে আবার দেতো হাসি দিতেই তার চোখ জোড়া জুল জ্বল করে উঠল। এটা কি সেই চমৎকার মাদমোয়াজেল পেরেট হতে পারে না?’
কেইন শান্তভাবে কাঁধে ঝাঁকি দিল। নারী আমার কাছে তেমন কিছু নয় স্কিরোজ। আমিও তোমার মত একই কারণে দাহরানে আছি। আমি এখানে টাকা কামাতে পারি–অতি সহজে আর কোন ট্যাক্স না দিয়ে। আজকাল তেমন জায়গা খুব বেশি একটা নেই, যেখানে মানুষ এ কাজ করতে পারে।’
স্কিরোজ মুখ টিপে হাসল। আর ইউরোপকে এড়ানো, যুদ্ধকে এড়ানো।
‘তুমি কি মনে কর এটা ঘটবে? কেইন জিজ্ঞেস করল।
‘অবশ্যই ঘটবে। হিটলার যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। পোলান্ড কি আলাদা কিছু?
‘সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। কেইন বলল।
‘আমারও নয়, স্কিরোজ গ্লাসটা শেষ করল। আর এই সুন্দরী মিসেস কানিংহামের বিষয়টা কি? রোজ রোজ দাহরানে এত সুন্দর অতিথি কিন্তু আমরা তেমন পাই না।’
কেইন টেবিলের একটা হাতির দাঁতের বাক্স থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। কেন উনি তোমাকে বলেন নি কেন এসেছেন এখানে?
স্কিরোজ মাথা নেড়ে জানাল, তিনি জাহাজ থেকে সরাসরি হোটেলে চলে আসেন। কামরা বুকিং করার পরপরই তোমার খোঁজ করেন। তবে তার কোন কারণ বলেননি। প্রথমে আমি ভাবলাম তোমরা হয়তো পুরোনো বন্ধু। সত্যি বলতে কি আমি ভেবেছিলাম তোমার অতীত হয়তো ফিরে এসেছে।
কেইন হেঁটে জানালার কাছে গেল। বন্দরের দিকে তাকিয়ে পেছন না ফিরেই সে বলল, তিনি তার স্বামীকে খুঁজতে এসেছেন। আপাত মনে হয় তিনি তাকে ছেড়ে চলে এসেছেন। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী তিনি জানতে পেরেছেন ভদ্রলোক এদিকেই রওয়ানা দিয়েছিলেন।
স্কিরোজ অবাক হয়ে ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠল–”কিন্তু এখানে কেন আসবে?
কেইন এবার ফিরে তার মুখোমুখি হয়ে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। তিনি ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতুবিদ্যার প্রভাষক। সম্ভবত শাবওয়া এলাকায় ধ্বংসাবশেষগুলো দেখতে এসেছেন।
স্কিরোজ ভ্রু কুঁচকালো। কিন্তু সেখানে তো সেই পাগল আমেরিকান জর্ডন ছাড়া আর কেউ টিকতে পারেনি।’
কেইন ঘাড় কাত করে বলল, ‘সেটা সত্যি। কিন্তু প্রফেসর মুলার? তিনি তো কয়েকমাস ধরে সেই এলাকায় পাথরের উপর খোদাই করা লিপি খুঁজে বেড়াচ্ছন। তিনিওতো সেখানে টিকে রয়েছেন।’
স্কিরোজ নাক টানল। “ওহ সেই জার্মান কুকুরটা।’ সে মাটিতে এক দলা থুথু ফেলে জুতার ডগা দিয়ে কার্পেটে ঘসলো। তাকে পাহারা দিচ্ছে স্বয়ং শয়তান। তবে একদিন সে খুব বেশি দূর যাবে। তারপর একদিন তাকে পাওয়া যাবে মাথায় একটা বুলেট নিয়ে পড়ে আছে।
কেইন বলল, সে কি এখন শহরে আছে?
স্কিরোজ মাথা নেড়ে বলল। হ্যাঁ, গত রাতে সে বাই-রোড এসেছে। ঠিক রাত এগারোটার সময় হোটেলের পাশ কাটিয়ে গেল যখন আমি এক ব্যাটাকে লাথি মেরে ভাগাচ্ছিলাম।
কেইন টেবিলের পাশে গিয়ে আরেকটা ড্রিংক নিল। তাহলে তুমি এই কানিংহাম নামে লোকটার সম্পর্কে কিছুই জানো না?’
স্কিরোজ তার বিশাল কাঁধে ঝাঁকি মেরে বলল, না। তার আসার কথা ছিল কবে? যখন কেইন তাকে তারিখটা জানাল তখন সে এক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে তারপর মাথা নেড়ে বলল, না তেমন কিছু মনে পড়ছে না।
কেইন ড্রিংকস শেষ করে হেঁটে দরজার কাছে গেল। আমার মনে হয় একবার মুলারের সাথে দেখা করি। তার সাথে হয়তো কানিংহামের দেখা হয়ে থাকতে পারে।
সে দরজা খুলতেই স্কিরোজ বলল, কিন্তু বন্ধু, তুমি এত ঝামেলা পোহাতে যাচ্ছো কেন? আমি কিন্তু সত্যি বলছি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
কেইন ঘুরে দাঁত বের করে হাসল। সে একটা হাত তুলে অপর হাতের তালুতে বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা ঘসা দিল, যেটা বিশ্বের সব জায়গায় একটি বিশ্বজনীন ভাষা হিসেবে সহজেই বোঝা যায়। টাকার জন্য।’ সে বলল, আর কি?
হোটেল থেকে বের হয়ে দেখল চারদিক নিরব, জনশুন্য। কিন্তু কড়া রোদ তাকে এমনভাবে ঢেকে ফেলল যে শরীরের প্রত্যেকটা ছিদ্র থেকে ঘাম বের হয়ে শার্ট আর প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। সে ধীরে ধীরে রাস্তার ছায়াময় পাশ দিয়ে হেঁটে মুলারের বাসার দিকে চলল। স্কিরোজের সাথে তার আলোচনাটা সে আবার বিবেচনা করে একটু ভ্রু কুঁচকালো।
যদি কানিংহাম দাহরান এসেই থাকে, এটা আশ্চর্য যে স্কিরোজ তা জানে না। এই ছোট্ট শহরে কোন কিছুই তার নজর এড়ায় না। সম্ভবত কানিংহাম আদৌ দাহরান আসেনি। হয়তো সে তার মত বদলেছিল? শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে লেখা চিঠিতেই এ জায়গার কথা লেখা ছিল। আবার অন্যভাবে ভাবলে এটা থোপে টিকে না। সে মেইল বোটে চড়ে এডেন ত্যাগ করেছিল, ব্রিটিশ কনসাল তা নিশ্চিত করেছে। তাহলে সে অবশ্যই দাহরানে পা রেখেছিল। হয়তো সে আগে থেকেই আপ-কান্ট্রির দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিল আর সেজন্যই হোটেলে কামরা বুক করেনি। তার স্ত্রী যতটুকু বলেছেন, তাতে বোঝা যায় তার হাতে তেমন টাকা ছিল না।
মুলারের বাড়ির অবস্থান বন্দরের উত্তরে একটা সরু গলির মাঝে। প্রবেশদ্বারটা একটা উঁচু দেয়ালের মধ্যে লাগানো। কেইন পুরনো বেল চেইনটা কয়েকবার টানল। উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে সে জার্মান লোকটির কথা ভাবলো। মুলার প্রথমবার প্রায় এক বছর আগে দাহরান এসেছিল। সে কঠিন আদব-কায়দা দুরস্ত আপাদমস্তক একজন প্রুশিয়ান। তার আগ্রহ গ্রাফিটির প্রতি-পাহাড়ের গায়ে কঠিন পাথরে আঁকা যেসব প্রাচীন শিলালিপি পাওয়া যেত সে সবের প্রতি। সব সময় ট্রাকে চড়ে সে তার অভিযান চালাতে। সীমান্তের অনেক ভিতরে অনেক বন্য এলাকায় চলে যেত। কখনো দুই কি তিনজনের বেশি আরবীয় লোক সাথে নিত না। কোন অস্ত্রও বহন করতো না। মুসাবেইনরা তাকে একজন পাগল মানুষ মনে করতো। আর সম্ভবত সে কারণেই এতদিন সে টিকে থাকতে পেরেছে।
দরজা খুলে গেল আর কেইন ভেতরে ঢুকতেই পরিষ্কার সাদা আলখাল্লা পরা একজন আরব পরিচারক এক পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল। ওরা একটা চমৎকার উঠানে এসে ঢুকল, যার মাঝখানে একটা ঝর্ণা রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। মাথার উপরে দোতলার জানালা থেকে বেরিয়ে আসা বেলকনি দেখা গেল। মুলার সেখানে উদয় হয়ে তার দিকে তাকাল। তার মুখে খুশির হাসি দেখা গেল, সে হাত তুলে ইশারা করল। আহ কেইন, আমার প্রিয় বন্ধু। ঠিক লোকটি এসেছে। উপরে এসো। এখুনি উপরে চলে এসো!’
কেইন পরিচারকের পিছু পিছু ঘরের ভেতরে ঢুকল। সিঁড়ি বেয়ে একটা সরু করিডোরে পৌঁছে পরিচারক একটা দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে কেইনকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করল।
হাফহাতা শার্ট পরা মুলার একটা বিরাট টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথা নুইয়ে অভিবাদন করার সময় সে প্রায় দুপা ঠুকে মৃদু হেসে বলল। ‘আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যা তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করবে। শাবওয়ার কাছে একটা গিরিখাত থেকে একটা শিলালিপির ল্যাটেক্স ছাপ তুলে এনেছি। এটা দেখে তোমার মতামত দাও।
কেইন লম্বা রাবারের টুকরাটা পরীক্ষা করল। শিলালিপির ছাপ তুলতে প্রফেসার একটা নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। রাবারের একটা দ্রবণ পাথরের উপর ঘসে লাগানো হতো। সূর্যের তাপে এটা খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে শক্ত হলে লম্বা ফালিটা টেনে ভোলা হতো একটা নিখুঁত অনুলিপি সহ।
কেইন বেশ আগ্রহ নিয়ে পাথরে খোদাই করা শব্দগুলো পরীক্ষা করল। এক মুহূর্ত পর মুখ তুলে বলল, ‘কুতাবানিয়ান, তাই না?
মুলার মাথা নেড়ে সায় দিল–হ্যাঁ। এটা আমি প্রাচীন উটে চলার পথ থেকে সামান্য দূরে একটা পাথরের গায়ে পেয়েছি। সঠিক অনুবাদ করার সময় পাই নি, তবে মনে হচ্ছে খ্রিষ্ট পূর্ব ৭ অব্দে শেবার রাজ্যের সাথে একটা যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে এখানে।
কেইন টেবিলের কিনারায় বসল। তুমি জানো, আমার জানা মতে গত চার মাসের মধ্যে এই নিয়ে তৃতীয়বার তুমি শাবওয়া এলাকায় গিয়েছ। তোমার কি মনে হয় না এতে তুমি নিজের বিপদ ডেকে আনছো?”
মুলার নাক টেনে বলল, দেশ চালায় কে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, যতক্ষণ না আমাকে একাকী আমার কাজ করতে দেয়। উপজাতীয়রা এটা জানে, তাই তারা আমাকে বিরক্ত করে না।
কেইন কাঁধ ঝাঁকি দিল, “ঠিক আছে। পরে এটা বলো না যে আমি তোমাকে সাবধান করিনি। আচ্ছা বল তো গত দুই মাসে তুমি শাবওয়া এলাকায় কোন ইউরোপীয় মানুষের দেখা পেয়েছ?
মুলার অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল–’কেবল জর্ডন। তোমার দেশি সেই পাগল লোকটা। একথা জিজ্ঞেস করছো কেন?
কেইন তাকে জানাল, শহরে একজন মহিলা তার স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কানিংহাম নামে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, তার দুমাস আগে শাবওয়ার দিকে যাওয়ার কথা। তারপর থেকে কেউ তার কোন হদিশ পাচ্ছে না।
মুলার পেছনে মাথা হেলিয়ে কর্কশভাবে হেসে উঠল ‘পাওয়ার কথাও নয়, যদি তিনি এক গিয়ে থাকেন। কিন্তু ঐ ভদ্রলোক শাবওয়ায় কি খুঁজছিলেন?
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। আমার মনে হয় তিনি তোমার মতো গ্রাফিটি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
ধন্যবাদ,আমার কোন প্রতিযোগিতার প্রয়োজন নেই। মুলার উঠে জানালার কাছে গেল, তার ভ্রু কুচকে রয়েছে। না, আমি এই লোকের দেখা পাই নি। সে মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আরেকজন ইউরোপিয়ান এই পাহাড়ে এলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম।
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। হ্যাঁ, এই ব্যাপারটাই আমি বুঝতে পারছি না। এমনকি স্কিরোজও তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর এর মানেই কিছু একটা রহস্য আছে।
মুলার কাঁধ ঝকানি দিয়ে বলল, “দুঃখিত, আমি কোন সাহায্য করতে পারলাম না।’
কেইন বলল, “ঠিক আছে। আমি এখন ভাবতে শুরু করেছি হয়তো এই ভদ্রলোক আদৌ এখানে আসেন নি।’
জার্মান লোকটি বলল, ঠিক সে রকমই মনে হচ্ছে।
কেইন নিচে নেমে এল। সাথে সাথে পেছনের অন্ধকার করিডোর থেকে পরিচারক এগিয়ে এসে তাকে পথ দেখিয়ে দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেল। বাইরে বের হওয়ার পর তার পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর সে প্রচণ্ড গরমে পথে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত ভাবতে লাগল তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। সত্যি বলতে কি এই মুহূর্তে কেবল একটি কাজই করা বাকি আছে। ক্যাপ্টেন গনজালেসের কাছে গিয়ে খোঁজ করতে পারে। তার অবশ্যই মনে থাকার কথা যদি গত দুই মাসের মধ্যে কানিংহাম নামে কোন ইউরোপীয় মেইল বোট থেকে এখানে নেমে থাকে।
সে একই পথ দিয়ে শহরের দিকে ফিরে চলল। হোটেল পার হয়ে ওয়াটার ফ্রন্ট হয়ে উত্তরের জেটির দিকে চলতে লাগল। এই স্পেনিয় লোকটির বাড়ি এই জেটির ঠিক পাশে সাগর সৈকতের দিকে মুখ করে তৈরি। কেইন দরজায় করাঘাত করার সাথে সাথেই লম্বা বোরখা পরিহিত একজন মহিলা দরজা খুলল।
মহিলাটি তাকে পথ দেখিয়ে ভেতরের একটা উঠানের দিকে নিয়ে চলল। সেখানে সে দেখল গনজালেস আরাম করে একটা ডিভানে শুয়ে এক হাতে একটা বিয়ারের ক্যান থেকে লম্বা গ্লাসে বিয়ার ঢালছে।
সে মুখ তুলে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে উঠল, “দেখলেতো তুমি আমাকে হাতেনাতে ধরে ফেললে। ইতোমধ্যেই আমি আমেরিকান অভ্যাসের দাস হয়ে পড়েছি। চলবে নাকি?”
কেইন মাথা নাড়ল। না এবার না করব না, অবশ্য যদি তুমি কিছু মনে না করো।’
মাথার টুপিটা পেছনে ঠেলে দিয়ে সে ডিভানের শেষ মাথায় বসল। গনজালেস বলল। তুমি কিন্তু অকারণে আমার বাসায় পদধূলি দাও না। সম্ভবত তোমার কোন সাহায্য দরকার।’
কেইন দাঁত বের করে হাসল। সত্যি বলতে কি সে জন্যই এবার এসেছি।’
স্পেনিয় লোকটি আত্মপ্রসাদের ভাব নিয়ে কুশনে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। হুঁ, আগে হোক পরে হোক সবাই আমার কাছে আসে। আমার বিশ্বাস তুমি নিশ্চয়ই আমাকে দোষারোপ করবে না যে, আমি গর্ব করছি এই বলে যে দাহরানে খুব কম ঘটনাই ঘটে যা শীঘ্রই হোক, দেরিতেই হোক আমি জানতে পারি না।’
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। সে আমি জানি আর সেজন্যই আমি এখানে এসেছি। মিসেস কানিংহাম নামে একজন মহিলা এই শহরে এসেছেন।’
গনজালেস সায় দিল। এই তো। তিনি আজকেই এডেন থেকে আসা মেইল বোট থেকে নেমেছেন।’
‘তিনি তার স্বামীকে খুঁজছেন। দুইমাস আগে তিনি তার স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, তিনি দাহরান আসছেন। তার উদ্দেশ্যে ছিল শাবওয়ার দিকে যাওয়া। সেই থেকে মহিলা তার স্বামীর খোঁজ পাননি।
গনজালেস ভ্রূ কুঁচকালো। লোকটার নাম কী বললে–কানিংহাম, তাই? সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। আমার মনে হয় তিনি ভূল করছেন। এই নামে কোন লোক দাহরান আসেনি।
‘তুমি কি এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত? কেইন জানতে চাইল।
গনজালেস কাঁধ ঝাঁকাল। কি করে আমার ভূল হবে? আমি কি রোজ প্রত্যেকটা জাহাজ দেখি না?’
একটা মুহূর্ত কেইন ভাবলো বিষয়টা নিয়ে তর্ক করবে কিনা। কিন্তু পরে ভাবলো এতে কোন লাভ নেই। দাহরানের সবাই জানে যত জাহাজ এখানে আসে তার অর্ধেকও এই স্পেনিশ লোকটা চেক করে না। এটা নিয়ে তর্ক করে সত্যি প্রতিষ্ঠা করা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। সে মাথার ক্যাপটা টেনে নিচে নামিয়ে বলল, যাই হোক তোমাকে ধন্যবাদ। সম্ভবত মিসেস কানিংহাম কোন একটা ভুল করেছেন।
গনজালেস বিজ্ঞের মতো বলল, এটা সব মহিলারাই করে থাকে।
পেছনে দরজা বন্ধ হতেই কেইন বাড়ির বাইরে এসে সামনে বন্দরের মাঝে তার লঞ্চের দিকে তাকাল। দেখল পিরু সামনের ডেকে আসন পেতে বসে আছে। সে জানে পিরুও তার দিকে চেয়ে রয়েছে।
হঠাৎ সে খুবই ক্লান্ত বোধ করল। হিপ পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুথ কানিংহাম তাকে যে খামটা দিয়েছিল, সেটা বের করল। কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, তারপর হঠাৎ একটা সিদ্ধান্তে এল। দাহরানে আরেকজন মাত্র মানুষ আছে যে এই জুন কানিংহাম সম্পর্কে কোন কিছু জানতে পারে। সেটি হল মেরি পেরেট। তার সাথেই দেখা করতে হবে। তবে সন্ধ্যায় একটু ঠাণ্ডা পড়লে তারপর যাবে।
সে হেঁটে জেটির শেষ মাথায় গেল। পিরু তাকে দেখেই লঞ্চের পেছন দিক থেকে এক লাফে নিচে ডিঙ্গিতে নেমে পড়ল, তারপর দ্রুত বৈঠা বেয়ে তার দিকে এগোতে শুরু করল। কেইন ধপ করে ডিঙির মাঝখানে বসে পড়তেই পিরু লঞ্চের দিকে ডিঙিটা ফিরিয়ে নিয়ে চলল। আমি যখন বাইরে ছিলাম তখন কি কেউ এসেছিল?
পিরু মাথা নাড়ল। সব একদম চুপচাপ, সাহেব। এই গরমে কোন বোকা লোক ছাড়া কে আর বাইরে বের হবে।’
কেইন দাঁত বের করে হাসতেই পিরুর মুখ হতাশায় কালো হয়ে গেল। ‘আমি দুঃখিত সাহেব।’ সে বলল। আমি বোকার মতো কথা বলে ফেলেছি।
কেইন মাথা নেড়ে রেইল টপকে লঞ্চে উঠল। না, পিরু তুমি একদম সঠিক কথাটি বলেছে। আমি খুব টায়ার্ড হয়ে গেছি। নিচে যাচ্ছি ঘুমুতে। আটটার দিকে তুলে দিও, ঠিক আছে?
পিরু মাথা নেড়ে সায় দিতেই কেইন নিচে তার শীতল কেবিনে নেমে গেল। একটা ড্রিংক তৈরি করে পোশাক খুলল। তারপর বাংকে শুয়ে রুথ কানিংহাম তাকে যে খামটা দিয়েছিল সেটা হাতে নিল।
পান্ডুলিপির টাইপ করা অনুবাদটা পড়তে শুরু করল। এক ঘণ্টা ধরে নিবিষ্ট মনে পুরোটা পড়ে শেষ করল। তারপর কিছুক্ষণ কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে আলেক্সিয়াসের কথা ভাবলো। পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো থেকে উঠে এসে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একজন মানুষের সুনির্দিষ্ট অবয়ব। অদম্য দুঃসাহসী, শক্তিশালী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং স্বভাবজাত নেতৃত্বের অধিকারী একজন মানুষ। একজন স্বপ্নদর্শী পুরুষ। পান্ডুলিপির সেই অংশটুকু কেইন আবার পড়ল, যেখানে আলেক্সিয়াস মরুভূমির মাঝে মন্দিরটি খুঁজতে গিয়ে তার অনুভূতি তুলে ধরেছে। তার কথার আলোকে লোকটির চরিত্রের দৃঢ়তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। একজন জন্মগত অভিযাত্রীক, সর্বদা অস্থির, সবসময় পাহাড়ের ওপারে তার দৃষ্টি প্রসারিত। কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে সবসময় কিন্তু কখনো তা পায়নি।
সে কি শুধু শেবার মন্দির অনুসন্ধান করছিল না অন্য কিছুরও অনুসন্ধান করছিল? সে কী নিজ সত্ত্বার অনুসন্ধানে ছিল? যা অধিকাংশ মানুষ সারা জীবন খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কখনও তা পায় না। সে পান্ডুলিপির শেষ পাতায় গিয়ে শেষ বাক্যটুকু আবার পড়ল।
… আমি, আলেক্সিয়াস, ১০ম লিজিয়নের সিনিয়র সেঞ্চুরিয়ান, বার—-শেবার অধিনায়ক এখানেই এই বিবরণ সমাপ্ত করছি। যদি কেউ শেবার মন্দিরের খোঁজে সাতটি স্তম্ভের পথ ধরে অনুসন্ধান করতে চায়, তাদের জন্য এটি একটি সতর্ক বার্তা। কেননা ঐ সাতটি স্তম্ভ তাদের কেবল মৃতু্যর পথেই এগিয়ে নিয়ে যাবে।
কেইন উপরে ছাদের দিকে তাকাল। তার মাথার উপরে পোর্টহোল দিয়ে ভেতরে আসা রোদের আলোয় যে ধুলির নৃত্য দেখা যাচ্ছিল সেদিকে সে তাকিয়ে ভাবতে লাগল সেই গ্রিক সৈনিকের কথা। একটি ইথিওপিয় প্রবাদ বাক্যে বলা হয়েছে নরকের পথে সাতটি স্তম্ভ রয়েছে। আর ইথিওপিয়রাই একবার স্বল্প সময়ের জন্য দক্ষিণ আরব জয় করেছিল। একটা মুহূর্ত সে ভাবলো এ দুয়ের মাঝে কোন যোগসুত্র আছে কিনা। তারপর ধারণাটিকে অসম্ভব বলে বাতিল করল। ইথিওপিয়রা অনেক পড়ে এটি বিজয় করেছিল। এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই সে অন্ধকারে চোখ মেলল। অবচেতন মনের অতল থেকে একটি বিশেষ অনুভূতি তাকে একটি বিপদ সংকেত দিতে লাগল। বাংকে শুয়ে হাতের আঙুলগুলো বাঁকা করল, ঠিক যেমনটি কোন শিকারীর উপস্থিতি কাছে টের পেলে কোন বন্য প্রাণী করে থাকে।
প্রথমে একটা গন্ধ টের পেলবাসি আর হালকা পঁচা গন্ধ। অলিভ অয়েল কিংবা কোন ধরনের গ্রিজের গন্ধ। তারপর কারো নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল আর হঠাৎ টেবিলের গায়ে ধাক্কা লেগে কারো মৃদু শাপান্ত করার শব্দ। সে দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। পোর্টাল দিয়ে ভেতরে আসা উজ্জল চাঁদের আলোয় চোখের পাতা অর্ধেকটা খুলে সে দেখতে লাগল।
তারপর নিঃশ্বাসের শব্দ খুব কাছে আসতেই উঁচু করা একটা ছুরির ফলা চাঁদের আলোয় দীপ্তিমান হলো। সে একটা মোচড় দিয়ে দ্রুত গতিতে তার হাঁটুটা একপাশে উঁচু করল। আততায়ীর পেটে ওর হাঁটু জোরে আঘাত করতেই চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। ডান হাত দিয়ে কেইন লোকটার কব্জি ধরে জোরে একটা মোচড় দিল। একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর ছুরিটা মেঝেতে পড়ে গেল।
কেইন বাংকে উঠে আততায়ীকে ধরার জন্য হাত বাড়াল, কিন্তু লোকটার সারা শরীরে তেল মাখানো ছিল। ফলে সে হাত দিয়ে তাকে শক্তভাবে জাপটে ধরতে পারলো না। বাইন মাছের মতো শরীর মুচড়ে তার হাত থেকে পিছলে দরজার দিকে ছুটে গেল। ডেকে উঠতেই পিরুও লাফ দিয়ে তাকে ধরতে চেষ্টা করল। দুজনের দেহের মাঝে সংঘর্ষ হতেই পিরু যন্ত্রণায় কাতরে উঠল। আততায়ী লোকটা তার হাতের নিচ দিয়ে ছুটে রেইল টপকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কেইন কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল, কিন্তু কোন শব্দ শোনা গেল না। সে ধীরে ধীরে ঘুরে বলল, তুমি ঠিক আছে তো?
পিরু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, সাহেব, আমাকে মাপ করুন। আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন লোকটা জাহাজে উঠে আপনার উপর আক্রমণ চালিয়ে আপনাকে প্রায় মেরে ফেলছিল।’
কেইন তার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘দূর বোকা। এতে লজ্জিত হওয়ার কী আছে। লোকটা সম্ভবত পেশাদার খুনি। এরাই কেবল মাত্র কোন কাজে যাবার আগে সারা শরীরে তেল মেখে নেয়। এটা নিয়ে চিন্তা করো না। যাও ডিঙ্গিটা রেডি করো। আমরা এখন সেলিম সাহেবের ওখানে যাবো।
সে নিচে গিয়ে দ্রুত পোশাক পরে নিল। জ্যাকেটের পকেটে কোল্ট অটোমেটিকটা নিয়ে উপরের ডেকে ফিরে এল। সে ভাবলো এবার সেলিমকে একটু শিক্ষা দেবার সময় এসেছে। মাছ ধরার নৌকাগুলোর মধ্য দিয়ে ওরা ফারাহর দিকে যেতে লাগল। ওদের ডিঙ্গিটা বিশাল ধাউটার গায়ে ঘসা খেতেই সে পিরুকে অপেক্ষা করতে বলল। তারপর একটা দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে রেইল টপকালো। ডেকে কেউ নেই। স্টার্ণ–ডেকের নিচে ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজাটা দেখা গেল। সে সাবধানে এগোতে লাগল। একমুহূর্ত বাইরে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল, তারপর কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে এক লাথিতে দরজা খুলে ডান হাতে কোল্ট অটোমেটিকটা নিয়ে ভেতরে ঢুকল।
দুজন আরব পা ভাঁজ করে বসে আছে একটু নিচু টেবিলের পাশে। একটা কফি পট আর ছোট ছোট কয়েকটা কাপ সাজানো রয়েছে টেবিলের উপর। লোকদুটো আতংকিত হয়ে কেইনের দিকে তাকাতেই সে রিভলবারটা ওদের দিকে তাক করল।
‘সেলিম কোথায়? সে আরবিতে জিজ্ঞেস করল
একজন কাঁধ ঝাঁকাল, ‘সে দুপুরেই চলে গেছে। আমার মনে হয় সে অনেক দূরে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে।’
কেইন একটা মুহূর্ত ওদের দিকে সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকাল। কোল্ট নিচু করে চলে যেতে উদ্যত হতেই, একটা পরিচিত গন্ধ তার নাকে এল। এটা সেই বাসি, পঁচা অলিভ অয়েলের গন্ধটা।
সে ধীরে ধীরে ঘুরে ওদের মুখোমুখি হল। তোমাদের আলখাল্লা খোলো! ওরা ভীত হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল। আর যে লোকটা এর আগে কথা বলেছিল সে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল। কেইন দ্রুত সামনে এগিয়ে চেহারায় হিংস্রভাবে নিয়ে বলল। যা বলছি তাই কর।
যে লোকটা কথা বলেছিল সে কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে তার আলখাল্লা খুলতে শুরু করল। কিন্তু অন্য লোকটা হঠাৎ দরজার দিকে ছুটে গেল। কেইন একটা পা বাড়িয়ে ল্যাং মেরে তাকে ফেলে দিল। লোকটা উঠে দাঁড়াতেই কেইন লিভলবারের বাঁট দিয়ে তার মুখে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। রিভলবারের ভারী বাটের আঘাতে তার গাল কেটে গেল, সে ডেকে পড়ে গিয়ে কাতরাতে শুরু করল।
কেইন কোল্টটা পকেটে ভরে দরজার দিকে এগোল। সেখানে একটু থেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য লোকটিকে বলল, ‘সেলিমকে বলো তার জন্য ভাল হবে যদি সে দাহরান ছেড়ে চলে যায়।
দরজা বন্ধ করে ডেক পেরিয়ে সে ডিঙ্গিতে নামল। পিরু জিজ্ঞেস করল, ‘সব ঠিক আছে তো, সাহেব?’
কেইন মাথা নেড়ে বলল, তা সেরকমই বলতে পারো। এখন তুমি আমাকে জেটির দিকে নিয়ে যাও। আমি শহরে যাবো।
জেটিতে দাঁড়িয়ে কেইন অন্ধকারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, পিরুর ডিঙি নিয়ে ফিরে যাওয়ার শব্দ শুনলো, তারপর রুথ কানিংহামের সাথে দেখা করার জন্য ওয়াটারফ্রন্ট ধরে হোটেলের দিকে এগিয়ে চলল।
.
০৭.
আলোয় ঝলমলে হোটেলের প্রবেশ পথে প্রচুর লোকজনের ভিড়। কেইন ভিড় ঠেলে ক্যাসিনোর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। স্কিরোজ জানালার ধারে একটা টেবিলে বসে রয়েছে। তার দুই চোখ এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘুরছে, আর যখনই ডিলাররা সবুজ টেবিল কভারের উপর দিয়ে চিপসগুলো নিজেদের কাছে টেনে নিচ্ছে তখনই তার চেহারায় সন্তুষ্টির ভাব দেখা যাচ্ছে।
কেইনকে দেখে সে মৃদু হেসে হাত নেড়ে ইশারা করল। কেইনও একটু মাথা নেড়ে ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল।
বারে জমজমাট ব্যবসা চলছে, ক্যাটলিনার ক্রু-রোমেরো, নোভাল আর কোন্ডে ফ্লাইং জ্যাকেট পরে সেখানে বসে রয়েছে। রোমেরো হাত উঠিয়ে ওর দিকে ইশারা করতেই কেইন তাদের সাথে যোগ দিল।
‘ভাল কোন কার্গো আনানেওয়া করেছে ইদানিং?’ রোমেরো জিজ্ঞেস করল।
‘পাতিল বলছে কেটলি তুমি কালো কেন,’ কেইন বলল। “গুপ্ত জানাল তোমরা আর একটা পর্তুগিজ কার্গো জাহাজ ত্রিশ মাইল ভেতরে মাল খালাস করছে।
রোমেরো মৃদু হাসল। বন্ধু, আমাদের সবাইকে কিছু করে খেতে হয়।
‘সাবধানে থেকো,’ কেইন বলল। যদি সে তোমাকে দেখে থাকে, তাহলে অন্য কেউও দেখতে পারে।
তারপর সে চলে গেল। নোভাল বলল, “সে ঠিক বলছে।’
রোমেরো কাঁধ ঝাঁকাল। নো প্রবলেম। আর কয়েকটা দিন তারপর তো সব শেষ হয়ে যাবে। চল আরেকটা ড্রিংক নেওয়া যাক।
করিডোর একদম নিস্তব্ধ। আর এখান থেকে নিচের কোলাহলের শব্দ আশ্চর্যরকম কেমন চাপা আর অবাস্তব শোনাচ্ছে, যেন অন্য কোন জগত থেকে শব্দটা আসছে।
রুথের কামরার দরজার উপরের স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছিল। সে আস্তে দরজায় টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে গেল আর রুথ মুখ বের করে তাকাল।
তার পরনে ভারী সিল্ক ব্রোকেডের হাইসকোট। কোমরে লাল রঙের স্যাস দিয়ে বাঁধা। খোলা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মুখ একটু ফ্যাকাসে আর একটু ঝুলে রয়েছে, মনে হচ্ছে রাতে ভাল ঘুম হয়নি। একট মৃদু হেসে একপাশে সরে দাঁড়াল।
কেইন ঢুকতেই রুথ দরজা বন্ধ করে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কেইনের মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত পরে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, এখন পর্যন্ত আমার জন্য কোন খবর আনতে পারেন নি, তাই না?
এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ ইতস্তত করে কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। দুঃখিত পাই নি।’
জানালার ধারে রাখা একটা বেতের চেয়ারের কাছে গিয়ে রুথ বসল। তার চেহারায় একটু অধৈর্য ভাব দেখা গেল। অবশ্যই আপনি কিছু একটা জেনেছেন। এটা একটা ছোট শহর, কেউ না কেউ তাকে দেখেছে।’
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। পুরো ব্যাপারটায় এটাই একটা আজব বিষয়। মনে হচ্ছে কেউই আপনার স্বামীর সম্পর্কে কিছুই জানে না। সবশেষে আমি কাস্টমস চিফের সাথে কথা বলেছি। সে শপথ নিয়ে বলেছে গত দুই মাসে আপনার স্বামী দাহরানে নামেন নি।
‘কিন্তু তা অসম্ভব, সে বলল। আমরা জানি তিনি এসেছিলেন।’
কেইন মাথা নাড়ল। আমরা জানি আসতে চেয়েছিলেন। আমরা জানি তিনি এডেন থেকে জাহাজে উঠেছিলেন। তারপর হয়তো তিনি অন্য কোন বন্দরে নেমেছেন–যেমন মুকাল্লা।’
আপনার কি মনে হয়, তা সম্ভব?
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। অনেক কিছুই হতে পারে। অবশ্য আমি এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হই নি যে আপনার স্বামী দাহরান নামেন নি। ক্যাপ্টেন গনজালেসের দায়িত্ব অবহেলা করার অভ্যাস আছে। এখানে যত জাহাজ নামে তার অর্ধেকও যদি সে চেক করে থাকে তাহলে খুবই ভাল, কিন্তু সে তা কখনো স্বীকার করবে না।’
রুথ তার দিকে আগ্রহভরে তাকাল। তার মানে আপনি মনে করেন আমার স্বামী এখানে এসেছিলেন?’
কেইন মাথা নাড়ল। যদি তিনি জাহাজ থেকে নেমে একই দিন সরাসরি আপ কান্ট্রিতে চলে গিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে কেন কেউ তাকে দেখেনি।
রুখের চেহারায় স্বস্তির ভাব ফিরে এল। সে কুশনে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। আমি নিশ্চিত তাই হয়তো ঘটেছে। একটু দুর্বলভাবে হাসল। এরপর আমাদের পদক্ষেপ কি হবে?
কেইন জানালার কাছে গিয়ে নিচে রাস্তায় লোকজনের ভিড়ের দিকে তাকাল। আরেকজন মানুষের সাথে দেখা করা বাকি আছে,’ সে বলল। মেরি পেরেট।’
রুথ অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, “একজন মহিলা? কিন্তু সে কীভাবে সাহায্য করবে?
কেইন মৃদু হেসে বলল, তিনি সাধারণ কোন নারী নন। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। মেরি পেরেট আধা ফ্রেঞ্চ আধা আরব। জাঞ্জিবার থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ছড়ানো এক বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান তিনি। অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী একজন নারী। প্রত্যেকদিন তার ট্রাক যায় শাবওয়া এলাকায়। যদি আপনার স্বামীর ঐ এলাকায় যাওয়ার তাড়া থেকে থাকে তাহলে সে উপায়েই তার যাবার কথা।
কেইনের মুখের দিকে তাকিয়ে রুথ এবার একটু অন্যরকম হাসল। তিনি কি আপনার বন্ধু?
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। আমি তাকে চিনি। সে বলল। তিনি যা জানেন তা আমি জানতে চাইলে জানাবেন। তারপর সে দরজার দিকে এগোল। রাতে ফিরতে খুব দেরি না হলে আমি আবার আসবো।’
রুথ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল ঘুরে এলো। আমি এডেনে কনসালকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছি যে আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে হেসে উঠল। তিনি আমাকে লিখে জানাতে বলেছিলেন। তবে আমি নিজে এখানে আসাতে খুব একটা খুশি হন নি।
কেইন চিঠিটা নিয়ে পকেটে ভরে দাঁত বের করে হাসল। তার কথায় হয়তো কোন যুক্তি আছে। ঠিক আছে, পরে দেখা হবে।’
সে নিচে গেল, প্যাসেজ পার হয়ে ক্যাসিনোতে ঢুকলো। স্কিরোজ তখনো জানালার ধারে বসে রয়েছে, দাঁতের ফাঁকে একটা চুরুট আর হাতে একটা গ্লাস।
কেইন তার উল্টোদিকের চেয়ারে বসলো। মনে হচ্ছে ভাল একটা রাত পেয়েছে।
স্কিরোজ মৃদু হাসল। আমার কোন অভিযোগ নেই। সৌভাগ্যবশত এই জগত বোকা মানুষে পরিপূর্ণ, যারা বুঝে না যে হাউস সব সময় জিতে। মিসেস কানিংহামের স্বামীর খবর কি? কোন হদিশ পেলে?
কেইন মাথা নাড়ল। গনজালেস বলেছে তিনি এখানে আসেন নি। তবে তুমিতো জানোই তার কথায় কতটুকু ভরসা করা যায়। আমি এখন যাচ্ছি মেরি পেরেটের সাথে দেখা করতে। সে হয়তো কিছু জানতে পারে।’
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সে পকেট থেকে রুথ কানিংহামের চিঠিটা বের করে টেবিলে রাখল। এটা আমার হয়ে মেইল ব্যাগে দিয়ে দিও। বেশ জরুরি।’
স্কিরোজ মাথা নোয়ালো আর আঙ্গুলে তুড়ি মেরে একজন ওয়েটারকে ডাকল। তুমি ঠিক সময়ে এসেছে। আমি একজন ছেলেকে এখুনি জেটিতে পাঠাচ্ছি। দশটার জোয়ারের সময় মেইল বোট ছেড়ে যাওয়ার কথা।
সে ওয়েটারের হাতে চিঠিটা দিয়ে সংক্ষেপে নির্দেশ দিল। একটা ড্রিংকের সময় হবে তোমার?
কেইন মাথা নাড়ল। অন্য সময় স্কিরোজ। পরে আবার হয়তো মিসেস কানিংহামের সাথে দেখা করার জন্য আসতে পারি।’
স্কিরোজ মৃদু হাসল। আমি বিশ্বাস করি তুমি নিশ্চয়ই মনে রাখবে এটা ব্যবসা। তিনি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একজন মহিলা।
কেইন উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। সে ঘুরে ভিড় ঠেলে ফয়ার পার হয়ে বাইরে চলে গেল।
সরু পথের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে স্কিরোজের সর্বশেষ মন্তব্য নিয়ে ভাবলো। এটা অস্বীকার করা বোকামি হবে যে মিসেস কানিংহাম একজন আকর্ষণীয় মহিলা। তবে সেই প্রথম জেটিতে দেখা হওয়ার সময় যে সাময়িক উত্তেজনা আর অস্বস্তি সে অনুভব করেছিল, তারপর আর সে তার সম্পর্কে দৈহিক কোন ধরনের আকর্ষণ অনুভব করেনি
অনেক বছর পর এই প্রথম সে তার মনমতো একজন নারীর দেখা : পেয়েছে। তারপরও তার কোন অনুভূতি নেই। তবে যে কোন নারীর ব্যাপারে সে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে থাকে। বিয়ের আগে প্রথম কয়েক মাস লিলিয়ানকে চমৎকার মেয়ে মনে হয়েছিল। এরপর যা ঘটেছিল তা মনে করে সে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করল এই ভেবে যে, এখন লিলিয়ান আর তার জীবনের অংশ নয়। এরপর সে পথের এক পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
এটিই দিনের সবচেয়ে ভাল সময়। শান্তির সময়–স্থানীয়রা বলে। বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর আলো পানিতে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে। আর কাছের একটা ক্যাফে থেকে কারও বিয়ের উৎসবের গানবাজনা আর হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বিভিন্ন রঙের আলখাল্লা পরে আরবরা রাস্তার পাশে টেবিলে বসে ছোট ছোট কাপ থেকে কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। রাস্তায় রাতের বাজারে বিভিন্ন পণ্যের সমারোহ। হাতে তৈরি পিতলের জিনিস থেকে শুরু করে রান্না করা নানা খাবার বিক্রি হচ্ছে।
চারপাশের হৈ হুল্লোর আর আনন্দ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ভিড় ঠেলে সে এগিয়ে চলল।
আরো এগোতেই ক্রমশ রাস্তার লোকজন কমে এল, তারপর সে রাস্তা ছেড়ে একটা গলির মধ্যে চলে এল, যেখান থেকে খোয়া বাধানো পথ চলে গেছে সৈকতের বাঁকা অংশের দিকে।
শৈলান্তরীপের একদম শেষ মাথায় সাগরের দিকে মুখ করে মেরি পেরেটের বাড়িটির অবস্থান। চারপাশে উঁচু দেয়াল ঘেরা, এক একর বাগানের মাঝে সমতল ছাদের একটা দোতালা দালান।
কেইন লোহার মজবুত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেল চেইন ধরে টান দিল। একটু পর অন্যপাশে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেল, তারপর দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল।
দরজায় দাঁড়ানো লোকটির দৈহিক গঠন অত্যন্ত অসাধারণ। সোমালি বংশোদ্ভূত লোকটির আবলুস কাঠের মতো কালো মুখ আর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা ঢেউ খেলানো কালো চুল। ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা আর সেই অনুপাতে চওড়া লোকটির পরনে সাদা আলখাল্লা।
দাঁত বের করে হেসে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে সে কেইকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করল। কেইন মৃদু হেসে আরবিতে বলল, “তোমার মিসট্রেস বাড়িতে আছেন, জামাল?’
সোমালি লোকটি দরজা থেকে সরে গিয়ে মাথা নোয়ালো। ইয়েমনের বিশেষ কয়েকটি এলাকার রীতি অনুযায়ী তার কপালের মাঝখানে একটা ছাপ মারা রয়েছে। সে তার প্রভুর কাছ থেকে পালাতে চেষ্টা করেছিল তারপর ধরা পড়ার পর উক্ত বাজারে তার জিহ্বা কেটে নেওয়া হয় অন্যদের সাবধান করার জন্য।
এর পরের বার অবশ্য পালাতে গিয়ে সে সফল হয়। মরুভুমিতে পানির তেষ্টায় যখন সে মৃতপ্রায়, তখন মেরি পেরেট তাকে খুঁজে পায়। সেবা শুশ্রূষা করে তাকে বাঁচিয়ে তুলে। সেই থেকে সে ছায়ার মতোই তার সাথে রয়েছে।
সারি সারি ডুমুর গাছের মাঝখান দিয়ে খোয়া ছড়ানো পথ দিয়ে সে কেইনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল একটা ঢাকা বারান্দার দিকে। একটা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে ঘরের ভিতরে অদৃশ্য হলো।
কেইন বাগানের সুঘ্রাণ নিঃশাসে টেনে নিল। চারপাশে বিভিন্ন রঙের সমারোহ, রাতের বাতাস ফুলের সুঘ্রাণে ভারী হয়ে আছে। কয়েকটা পাম গাছ। দেয়াল ছাড়িয়ে উপরে উঠে মৃদু বাতাসে দুলছে। পাতাগুলো রাতের আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে। গাছের মাঝখানে একটা ফোয়ারা থেকে পানি ছড়িয়ে পড়ছে একটা মাছের চৌবাচ্চায়। পেছনে হালকা পায়ের শব্দ পেতেই সে তাড়াতাড়ি ঘুরল আর মেরি পেরেট বারান্দায় আসতেই সে উঠে দাঁড়াল।
ছোটখাট গড়নের পঁচিশ বছর বয়সি সুন্দর একটি মেয়ে। যোধপুর প্যান্ট আর খাকি বুশ শার্টে তাকে অপূর্ব লাগছিল। আরব মায়ের কাছ থেকে সে উত্তরাধিকার সূত্রে কালো চুল পেয়েছে,আর বড় বড় পটলচেরা চোখ আর পুরুষ্ট ঠোঁট।
বাদবাকি সব বিশুদ্ধ ফরাসি। সে মৃদু হেসে একটা চেয়ারে বসল। কেমন আছো গ্যাভিন? কী সুন্দর রাত। আমি এখুনি কিছুক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে এলাম।
কেইন দাঁত বের করে হেসে তাকে একটা সিগারেট অফার করল। লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে নেবার পর সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। ‘মুকাল্লাতে সব কিছু ঠিকঠাক ছিল তো?
কেইন পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিল। দুঃখিত, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। গতকালই আমি তোমার এজেন্টের সাথে দেখা করেছি। সে এটা দিল তোমার জন্য।’
চিঠিটা পড়ার সময়ে কেইন তার দিকে লক্ষ করে তার পরিবর্তিত মুখভাব দেখে অবাক হলো–শীতল, ব্যবসায়ী সুলভ আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যখন তার বিশ বছর বয়স, তখন তার বাবা মারা যান, আর সে থেকেই সে লৌহ কঠিন হাতে পেরেট এন্ড কোম্পানির কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে। লোহিত সাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত তার নাম একটি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। অত্যন্ত সৎ তবে যে কোন বাজারের ব্যবসায়ীর চেয়েও সে সুচতুর।
মেরি একটু ভ্রুকুটি করে ডেকে উঠল, ‘আহমেদ, একটু এদিকে আসবেন এক মিনিট!
শক্তিশালী গড়নের পাকাঁচলের অধিকারী একজন আরব বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ইউরাপীয় পোশাক পরা লোকটির হাতে একট কলম ধরা, যেন তার কোন জরুরি কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। তিনি এই ফার্মের জেনারেল ম্যানেজার আর, মেরির বাবার একজন পুরোনো ও বিশ্বস্ত বন্ধু।
তিনি কেইনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা নোয়ালেন। মেরি চিঠিটা তার হাতে দিল। এটা একটু পড়ে দেখবেন? গ্যাভিন এটা মুকাল্লা থেকে এনেছে। লাভাল বলছে সে তিল তেল যা পায় তাই নেবে। একটু তাড়াতাড়ি চেষ্টা করলে আমরা সমস্ত স্টক কিনে নিতে পারব।’
আহমেদ মাথা নেড়ে ভেতরে ফিরে যেতে উদ্যত হতেই কেইন বলে উঠল। এক মিনিট আহমেদ। আপনি হয়তো আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন।
আহমেদ ঘুরে একটু মৃদু হাসলেন, তারপর পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, “কি ব্যাপার গ্যাভিন?’
মিসেস কানিংহাম নামে একজন মহিলা এখন দাহরান শহরে আছেন। তিনি তার স্বামীকে খুঁজছেন। তার সম্পর্কে সব শেষের খবর জানা গেছে তিনি দাহরান এসেছেন। কিন্তু কেউ তার সম্পর্ক কিছু বলতে পারছে না।
আহমেদ ভ্রূকুঁচকে এক মুহূর্ত পর মাথা নাড়লেন। কানিংহাম–জন কানিংহাম। হা মনে পড়েছে। তিনি আপ-কান্ট্রিতে শাবওয়া যেতে চাচ্ছিলেন।
‘কখন সেটা? কেইন জানতে চাইল।
তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন। প্রায় দুই মাস আগে। তারপর মেরির দিকে ফিরে বললেন। এটা ঘটেছে যখন তুমি বোম্বে গিয়েছিলে। ইংরেজ লোকটি বোট থেকে বন্দরে নেমে আমার সাথে অফিসে দেখা করলেন। তিনি শাবওয়া যেতে চাচ্ছিলেন। আমি তাকে সেখানকার বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা বলে সাবধান করলাম, কিন্তু কোন কথা শুনতে রাজি নন তিনি। জর্ডনের কাছে যন্ত্রপাতি পৌঁছাতে আমাদের চারটা ট্রাকের একটা কনভয় যাচ্ছিল সেদিকে। আমি তাকে ওদের সাথে যেতে দিলাম।’
তারপর কখন সে ফিরে আসে?’ মেরি বলল।
আহমেদ কাধ ঝাঁকালেন। সে ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমার যতদুর মনে পড়ে তিনি শাবওয়ার সবচেয়ে কাছের গ্রাম-বার আল মাদানি পর্যন্ত ভাড়া দিয়েছিলেন। তারপর তার কি হয়েছে আমি বলতে পারব না।’
সে কেইনের দিকে ফিরে বলল। দুঃখিত গ্যাভিন, এর চেয়ে আর বেশি কিছু সাহায্য করতে পারলাম না।
কেইন মাথা নাড়ল। আপনি অনেক সাহায্য করেছেন। অন্তত এটুকু জানা গেল যে ভদ্রলোক বার আল-মাদানি পর্যন্ত গিয়েছেন। এর আগে আমি এটা নিশ্চিত হতে পারিনি যে তিনি আদৌ দাহরান এসেছেন।
আহমেদ মৃদু হাসলেন। ঠিক আছে। এখন যদি আপনি কিছু মনে না। করেন, তাহলে আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে।’
তিনি বাড়ির ভেতরে চলে যাওয়ার পর মেরি বলল, এই কানিংহাম লোকটি শাবওয়া এলাকায় কি করছিল?
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। তিনি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। সম্ভবত পাথরে খোদাই করা লিপি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
‘একা একা?’ সে অবিশ্বাসী স্বরে বলল। হতেই পারে না। শুধু মাত্র একজন বোকা লোক ছাড়া কেউ সেখানে একা যেতে চেষ্টা করবে না।’
‘কিংবা একজন মানুষ, যে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুসন্ধান করছিল।
কথাগুলো তার মুখ থেকে বের হতেই সে অনুতপ্ত হলো, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেরি ভ্রু কুঁচকে একটু সামনে ঝুঁকল। তারপর বলল, তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো, তাই না? পুরো ব্যাপারটা খুলে বললে ভাল হয় না?
কেইন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। মনে হয় আমি তাই করেছি। একটি কারণ হলো তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আর অন্যটি হচ্ছে যেহেতু তুমি একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছো, কাজেই আমার কাছ থেকে আসল কথাটা বের না করা পর্যন্ত তুমি ক্ষান্ত হবে না।’
মেরি একটু মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। ডিয়ার গ্যাভিন, এতদিনে নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ভাল করে জেনেছো। চল বাগানে হাঁটতে হাঁটতে সব কথা খুলে বলবে।
ওরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গাছের সারির মাঝ দিয়ে হাঁটতে লাগল। মেরি এক হাতে কেইনের বাহু জড়িয়ে ধরল। সে মেরির দেহের সুঘ্রাণ বুক ভরে টেনে নিল। অনেক দিন হল এ রকম অভিজ্ঞতা তার হয়নি।
কেইন বলতে শুরু করল, রুথ কানিংহামের আসা থেকে শুরু করে আলেক্সিয়াস আর তার মরুভূমিতে অভিযানের একটি বর্ণনা দিয়ে শেষ করল।
কেইনের বলা শেষ হলে ওরা দুজনে পানির ফোয়ারার ধারে একটা আসনে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। দূরে কোথাও একটা পাখি ডেকে উঠল আর মেরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এটা সত্যি একটা আশ্চর্য কাহিনী!
‘তুমি বিশ্বাস করো না?’ কেইন বলল।
মেরি কাধ ঝাঁকাল। কানিংহাম যা করেছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন কি করতে চাও তুমি?
কেইন বলল, আমি শাবওয়া পর্যন্ত যাবো। বার আল-মাদানিতে গোত্রপ্রধানকে জিজ্ঞেস করে জানবো কানিংহামের কি হয়েছে।
মেরি উঠে দাঁড়াল, তারপর ওরা পেছনে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।
‘আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তুমি কিংবা আর কেউ কখনো জন কানিংহামকে দেখতে পাবে না।’
কেইন মাথা নোয়ালো। সম্ভবত তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু তার স্ত্রী নিশ্চিতভাবে না জানা পর্যন্ত হাল ছাড়বেন না।’
মেরি বারান্দার নিচু রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। আমি তোমার সাথে একমত। যাহোক, ব্যাপারটার দ্রুত নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারবো। কাল সকালে আমি প্লেন নিয়ে জর্ডনের সাথে দেখা করতে বার আল মাদানি যাচ্ছি। তার কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়েছে, সে বিষয়ে আলাপ করতে। সেখান থেকে পনেরো মাইল দূরে সে একটা পরীক্ষামুলক খনন কাজ চালাতে যাচ্ছে। সে তার লোকজনের সাহায্যে আমার জন্য মোটামুটি একটা এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে। আমি শুধু জামালকে সাথে নিচ্ছি। তোমার আর মিসেস কানিংহামের জন্য জায়গা হয়ে যাবে, যদি তোমরা যেতে চাও।
কেইন খুব খুশি হলো। তাহলেতো খুবই ভাল হয়।
‘জর্ডন ট্রাকে করে আমাকে তার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি সকালেই সেখানে পৌঁছাতে চাই। তখন তুমি আমার প্লেনটা নিতে পারো। ঐ এলাকায় দ্রুত একবার সার্ভে করতে তিন ঘণ্টা সময়ই যথেষ্ট।
‘এতে ট্রাকে করে যাওয়ার কষ্ট থেকে মিসেস কানিংহাম বেঁচে যাবেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। আমার মনে হয় না এই ধরনের যাত্রার জন্য তার অভ্যাস আছে।’
‘তিনি কি দেখতে সুন্দরী?’ মেরি বলল।
সে কাঁধ ঝাঁকাল। স্কিরোজ অবশ্য তাই মনে করে।
কিন্তু তোমার বেশি আগ্রহ তার টাকার দিকে, তাই না?
তার স্বামীকে খুঁজে বের করার জন্য তিনি যে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন তা বেশ আকর্ষণীয়। তবে মন্দিরের কাহিনীতে আমার আগ্রহ আরো বেশি।’
মেরি হালকাভাবে হাসল। সেই চিরকালের অনুসন্ধানকারী। তুমি কি কোনদিন পাহাড়ের এই পাশে যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না, গ্যাভিন?’
‘সম্ভবত নয়, সে বলল। আমার মনে হয় সে জন্যই আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই প্রত্নতত্ত্ব আমাকে অনেক আকর্ষণ করতো। সে জন্যই আমি এখানে রয়ে গেছি, অথচ প্রত্যেক বছর প্রতিজ্ঞা করি এবছরই চলে যাবো। এখানে কত কিছু করার আছে–অবশ্য যদি টাকা থাকে। তার মানে মাঝে মধ্যে স্কিরোজের জন্য কাজ করা। তবে ভিক্ষার চাল কাড়া-আকাড়া। সে দাঁত বের করে হাসল।
সে কথা যখন উঠলই, তুমিই বা এখানে থাকছো কেন? তুমি তো অতি সহজেই আরো সুবিধাজনক জায়গায় তোমার হেডকোয়ার্টার করতে পারো। যেমন ধরো বোম্বেতে।
মেরি কাঁধ ঝাঁকাল। এটি একটি প্রাচীন জায়গা। আর আমার মা একটি প্রাচীন গোষ্ঠী থেকে এসেছেন। আমার ধারণা, এটা আমার রক্তে আছে।
সে মেরির দুই কাঁধে দুই হাত রাখল। তুমি একটি চমৎকার মেয়ে।
সে হঠাৎ তার পাতলা শার্টের মধ্য দিয়ে মেরির দেহের উষ্ণতা সম্পর্কে সচেতন হল। কয়েক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে একই ভাবে তাকিয়ে রইল। কেইন তাকে নিজের দিকে টানতেই সে কোন ধরনের বাধা দিল না।
কেইনের মনের মধ্যে যে তোলপাড় চলছে তা টের পেয়ে মেরি মৃদু হাসল। ‘বেচারি গ্যাভিন, তোমার এতদিনের ব্রম্মচারি-জীবনের ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমি কি নিয়ম ভঙ্গ করেছি? তবে নারী হল ডেভিল, এটা এতদিনে তোমার জানার কথা।
‘আমি সে সত্য ভালভাবে জানি।’ সে বলল।
‘একটা ড্রিংক চলবে?
অনেক কষ্ট করে সেই লোভটি সে সামাল দিতে সফল হল। আমার মনে হয় না তা ঠিক হবে।’
মেরি তার হাত ধরল, তারপর তারা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাগান পেরিয়ে গেটের দিকে হেঁটে চলল। দরজা খুলে তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। ঠিক সাতটায় এয়ার স্ট্রিপে, দেরি করো না। আমি সকালেই যাত্রা করতে চাই।’
কেইন চাঁদের আলোয় দেখল, এক অপূর্ব সুন্দর মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘দ্যাখো, যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।
মেরি এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু আমি নই। তারপর সে তাকে দরজা থেকে বাইরে ঠেলে দিল।
কেইন, সেখানে অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পিছন ফিরে শহরের দিকে রওয়ানা হলো।
.
হোটেলে পৌঁছার পর সে রুথ কানিংহামের কামরায় গিয়ে দরজায় টোকা দিল। কোন সাড়া নেই। আর একবার চেষ্টা করে দরজা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে দেখল কেউ নেই।
নিচ তলায় নেমে সে বারে গেল। স্কিরোজ জানালার পাশে সামনে এক গ্লাস ড্রিংক নিয়ে বসে আছে। সোজা তাকিয়ে রয়েছে রাতের অন্ধকারের দিকে। কেইন তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
সে উপরের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। কোন কিছু পেলে?
কেইন মাথা নাড়ল। এবার আল মাদানি পর্যন্ত যাওয়ার তথ্য জানতে পেরেছি। সে মেরি পেরেটের একটা কনভয়ের সাথে সেখানে গিয়েছিল
স্কিরোজ অবাক হয়ে বলল, তাহলে আসলেই সে দাহরান নেমেছিল। আমি সত্যি অবাক হচ্ছি। এখন তুমি কি করবে?
‘আমরা কাল সকালেই মেরির সাথে প্লেনে সেখানে যাচ্ছি,’ আমি মিসেস কানিংহামকে খবরটা দেবার জন্য তার কামরায় গিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি সেখানে নেই।
স্কিরোজ অন্ধকারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, কয়েক মিনিট আগে তিনি এখান দিয়ে গেছেন। আমার মনে হয় তুমি তাকে সৈকতে পাবে।’
কেইন তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বারান্দায় এল। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা আর মৃদু হাওয়ার সাথে সাগরের নোনা পানির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে বালুতে নেমে এল। তারপর সামনে সাগরের সাদা ফেনা লক্ষ করে হাঁটতে শুরু করল। চন্দ্রালোকিত সৈকতে সে রুথকে খুঁজতে লাগল।
একটু হতাশ হয়ে থামল, তখন বাম দিকে পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা গেল। ‘এই যে আমি এদিকে।
রুথ একটা মাছ ধরা নৌকার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেইন এগোতেই সে বলল, কোন খবর আছে আমার জন্য?’
কেইন একটা সিগারেট ধরাল, তারপর মাথা নুইয়ে বলল—
‘হ্যাঁ, আমার মনে হয় সব কিছু এখন ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনার স্বামীর খোঁজ পেয়েছি শাবওয়া থেকে দশ মাইল দূরে একটা আরব গ্রামে। আমরা সকালেই মেরি পেরেটের সাথে সেখানে প্লেনে যাচ্ছি। সেখানে আমি গ্রামের গোত্রপ্রধানের কাছ থেকে আরো সঠিক তথ্য যোগাড় করতে পারব।’
রুথ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কেইনের গায়ে হাত রেখে বলল, ‘মাই গড়, এতো খুবই চমৎকার।
রুথ নরম বালুতে বসে পড়ল। কেইন তার পাশে বসে একটা সিগারেট বের করে রুথের হাতে দিল। ম্যাচ জ্বালতেই রুথের চিবুকের একপাশ আলোকিত হয়ে উঠল, তার দু’চোখ পানিতে টলমল করছে।
কেইন তার হাত ধরে শান্তভাবে বলল, দেখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ঘাড় কাত করল। ‘আপনি এ পর্যন্ত যা করেছেন, জানি না তার ঋণ কীভাবে শোধ করব।
‘তার জন্য আপনার কোন কষ্ট করতে হবে না, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। সে দাঁত বের করে হেসে উঠে দাঁড়াল। আর এখন আমার মনে হয় আপনার একটু ঘুমানো উচিত, মিসেস কানিংহাম। কাল ভোরেই আমাদের রওয়ানা দিতে হবে।’
রুথ আর কোন কথা না বাড়িয়ে কেইনকে হোটেলের বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। পরদিন ভোর ছটায় তাকে হোটেল থেকে তুলে নেবার ব্যাপারে কথা বলে সে জেটির দিকে এগিয়ে চলল।
পিরু একটা পাথরের উপর আসন গেড়ে বসে টুলছিল। কেইনকে দেখেই তাড়াতাড়ি সজাগ হয়ে মৃদু হাসল। অন্ধকারে তার দাঁতগুলো চক চক করে উঠল।
নৌকা বেয়ে লঞ্চের দিকে যেতে যেতে কেইন তাকে পরদিন বার আল মাদানিতে যাওয়ার কথা জানাল। সবকিছু তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’ রেইল টপকে লঞ্চের ডেকে উঠতে উঠতে সে বলল। কোন দিকে থেকে কোন বিপদ আসে কিনা সেদিকে নজর রাখবে। বিশেষত সেলিমের কাছ থেকে।
পিরুকে ডিঙ্গিটা বেঁধে রাখতে বলে সে নিচে কেবিনে গেল। ভেতরে অন্ধকার নিরবতা। কেবল চাঁদের আলো পোর্নহোলের ফাঁক দিয়ে এসে ভৌতিক আঙুল দিয়ে তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে।
সে বাংকে শুয়ে উপরে কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে মেরির কথা ভাবতে লাগল। একটা মুহূর্ত অন্ধকারে তার উপস্থিতির ছোঁয়া পেল আর মনে হলো সে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। ধীরে ধীরে সে ঘুমে তলিয়ে গেল।
.
০৮.
কেইন জেটি পার হয়ে ওয়াটার ফ্রন্ট ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেল মাছ ধরা নৌকাগুলো বন্দরের প্রবেশ পথ দিয়ে উপসাগরের দিকে চলে যাচ্ছে। দিনের প্রথম সিগারেট ধরাল সে। সিগারেটের ধোঁয়া গলার পেছনে আটকাতেই কাশতে শুরু করল। একটু ক্লান্ত লাগছে আর ডান চোখের পেছনে একটু ব্যথা মনে হচ্ছে। এক মুহূর্ত থেমে সে ভোরের আলোয় মাছ ধরা নৌকাগুলোর সাদা পালগুলোর পত পত করে ওড়া দেখল তারপর ঘুরে হোটেলের পথ ধরল।
তার পরনে খাকি শার্ট প্যান্ট আর বহুল ব্যবহৃত একটা বুশ হ্যাট। কি মনে করে সে লঞ্চ ছাড়ার আগে কোল্ট অটোমেটিকটা হিপ পকেটে ভরে নিয়েছিল। শাবওয়া এলাকার উপজাতিদের মধ্যে তার অনেক বন্ধু থাকলেও বলাতো যায় না কখন কি ঘটে।
হোটেলে পৌঁছেই রুথ কানিংহামকে দেখতে পেল সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো। একটা গলা খোলা সাদা ব্লাউজ আর ক্রিম রঙের হুইপ কর্ডের প্যান্ট পরে রয়েছেন। চুল বাঁধা রয়েছে সেই একই নীল স্কার্ফ দিয়ে যেটা পরেছিলেন প্রথম দিন। কেইনকে দেখে মৃদু হাসতেই অত্যন্ত আকর্ষণীয় দেখাল তাকে।
‘আমার এই পোশাকে চলবে তো?’ দুদিকে হাত ছড়িয়ে সে বলল।
কেইন মাথা নুইয়ে বলল, “বেশ সাজসজ্জা তবে কাজ চলবে। সে হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। আমাদের জলদি পা চালাতে হবে। আমি মেরিকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে চাই না।’
সরু অলিগলির গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে চলার সময় তাদের মাঝে,তেমন কোন কথা হলো না। শেষ পর্যন্ত ওরা শহরের শেষ মাথায় পৌঁছাল। রুথের চোখের নিচে কালো কালির ছাপ, মনে হলো রাতে ভাল ঘুম হয়নি। এছাড়া তার চেহারায় বেশ উদ্বিগ্ন ভাব দেখা যাচ্ছে। এটা কেইনের খুব একটা ভাল মনে হলো না।
কোয়ার্টার মাইল দীর্ঘ বিমানক্ষেত্রটা দাহরানের বাইরে একটা গিরিপথের মুখের কাছে। গিরিপথটা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। এটা প্রধান প্রধান এয়ারলাইনসের বিমান অবতরনের জন্য অফিসিয়াল বিমানক্ষেত্র নয়। স্পেনিশ বিমান বাহিনী তাদের বিমান জরুরি অবতরণের জন্য এটা তৈরি করেছিল।
শুধু একটা হ্যাঙ্গার রয়েছে, উপরে করোগেটেড ছাদওয়ালা একটা পড়েপড়ো আর জরাজীর্ণ কংক্রিটের বিল্ডিং। ওরা বেশ দূর থেকে দেখতে পেল প্লেনটা রানওয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে–লাল আর রুপালি রং করা একটা ডি হ্যাঁভিল্যান্ড ব্যাপিড। ওরা এগোতেই দেখল এর টুইন ইঞ্জিন ইতোমধ্যেই টিক টিক করতে শুরু করেছে।
জামাল পেছনের একটা সিটে বসা ছিল। মেরি লাফ দিয়ে প্লেন থেকে মাটিতে নামল কেইনের সাথে দেখা করার জন্য। কেইন পরিচয় করিয়ে দেবার পর দুই মহিলা হাত মেলালো।
‘আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ রুথ কানিংহাম বলল।
মেরি কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল, “এটা তেমন কিছু নয়, মিসেস কানিংহাম। আমিতো এমনিতেই ব্যবসার কারণে বার আল-মাদানি যাচ্ছিলাম। তারপর সে কেইনের দিকে ফিরে তাকাল, ঠোঁটে মৃদু হাসি আর চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। আশা করি রাতে ভাল ঘুম হয়েছে গ্যাভিন। একটু তাড়াহুড়া করছি বলে দুঃখিত, কিন্তু জর্ডনকে কথা দিয়েছি সাড়ে সাতটার মধ্যে সেখানে পৌঁছাবো।
রুথ কানিংহাম প্লেনে উঠে জামালের পাশের সিটে বসল। সে সরাসরি সামনে তাকিয়ে রইল রুথকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। মেরি পাইলটের আসনে বসল তারপর কেইনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি প্লেনটা চালাবে?
সে সম্মতি জানাতেই মেরি পাইলটের আসন ছেড়ে পাশের সিটে সরে বসল। কেইন ধীরে ধীরে ট্যাক্সি করে প্লেনটাকে বাতাসের অনুকুলে ফেরালো। এক মুহূর্ত পরেই রানওয়ের শেষ মাথা তাদের দিকে দ্রুত ধেয়ে এল। সে ধীরে ধীরে কলামটা পেছনের দিকে টানতেই র্যাপিড প্লেনটা গিরিপথের মধ্য দিয়ে উপরে উঠল। দুপাশের পাথুরে দেয়াল দ্রুত পেছনের দিকে ধেয়ে চলল।
গিরিপথ থেকে বের হতেই প্লেনটা ঝাঁকুনি খেতে শুরু করল। কেননা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বাতাস বইছিল ৪০ নটিকেল মাইল গতিতে। ওরা গরম কুয়াশার মধ্য দিয়ে উঠতে থাকল, কুয়াশা চারপাশ অস্পষ্ট করে তুলেছে। ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে আসার পর লেভেল হল উপসাগর রেঞ্জ অতিক্রম করার জন্য।
পাহাড়ের পরই উজ্জ্বল নীল আকাশ। আধ ঘন্টার মধ্যে দূরে আসল মরুভূমি নজরে এল। মরুভূমির রং সোনালি আর গাঢ় লালের মাঝে খেলা করছিল।
তারপর হঠাৎ একটা উঁচু তেলের খনন-স্তম্ভ আর তার চারপাশ ঘিরে থাকা অনেকগুলো তাঁবু আর মোটর গাড়ির উপর দিয়ে ওরা উড়তে লাগল। রুথ কানিংহাম হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “ঐ যে দেখুন নিচে একটা ট্রাক দেখা যাচ্ছে!
কেইন জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে ওদের দিকেই ছুটে আসছে। একটু পরেই দুরে কাল ছোপ ছোপ নজরে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেগুলো বড় হয়ে একগুচ্ছ সবুজ পাম গাছ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরি করা সমতল ছাদের কতগুলো বাড়ি হয়ে গেল।
বিমান অবতরন ক্ষেত্রটা ছিল দুটো বালিয়াড়ির মাঝখানে একটা সরু পথ। এর এক মাথায় বাতাসের গতি নির্দেশের জন্য একটা লম্বা খুঁটির উপর উইন্ডসক ওড়ানো রয়েছে। কেইন উপরে একটা চক্কর দিয়ে নিখুঁতভাবে দুই সারি ড্রামের মাঝে অবতরণ করার জন্য বাতাসের অনুকুলে পজিশন নিল। টেক্সিং করে রানওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছাতেই ট্রাকটি বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে ওদের দিকে এগিয়ে এল।
কেইন ইঞ্জিনের সুইচ বন্ধ করে দরজা খুলে এক লাফে মাটিতে নামল। তারপর ঘুরে একের পর এক দুইজন মহিলাকেই হাত ধরে নিচে নামাল। ট্রাকটা কয়েকফুট দূরে এসে ব্রেক কষে থামল এবং একজন লোক স্টিয়ারিং হুইল ছেড়ে নিচে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে এল।
তামাটে মুখ বেপরোয়া চেহারার একজন যুবা পুরুষ, সাদা চুল ছোট করে ছাঁটা। পরনে রোদে ঝলসে যাওয়া খাকি পোশাক আর ডানদিকে কোমরে কালো চামড়ার খাপে একটা রিভলবার ঝুলছে। বুদ্ধিদীপ্ত হাসিতে তার দাঁত ঝিক করে উঠল। সে চেঁচিয়ে উঠল। আরে এতো খোদ শয়তান নিজেই হাজির। তুমি এখানে কী করে এলে?
কেইন দাঁত বের করে হেসে তার কাঁধে একটা ঘুসি মারল। আমি আশা করছিলাম তুমি হয়তো আমাদের সাহায্য করতে পারবে জর্ডন। একটু ঘুরে রুথ কানিংহামকে দেখিয়ে বলল। ইনি মিসেস কানিংহাম, স্বামীকে খুঁজতে এখানে এসেছেন। আমরা জানতে পেরেছি তিনি দুই মাস আগে বার আল মাদানিতে এসেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল কয়েকদিনের জন্য শাবওয়া যাওয়ার। কিন্তু এর পর থেকে ইনি তার স্বামীর কোন খবর পাচ্ছেন না।
জর্ডন রুথের হাত ধরল, তার মুখ গম্ভীর। আমি দুঃখিত মিসেস কানিংহাম। সে এক মুহূর্ত ভ্রু কুঁচকে রইল। তারপর বলল–না আমি আপনার স্বামীর সম্পর্কে কোন কিছু শুনিনি। হয়তো গ্রামের গোত্র প্রধান কোন কিছু বলতে পারবে।
রুথ কেইনের দিকে ফিরতেই কেইন মাথা নাড়ল। আমি এখানকার গোত্রপ্রধান–ওমর বিন নাসেরকে চিনি। কোন কিছু জানা থাকলে সে আমাদের জানাবে।
জর্ডন ওদেরকে ফোর্ড পিকআপ ট্রাকটির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। সে হাত ধরে রুথকে গাড়িতে উঠিয়ে দিল। তাহলে এ কথাই রইল কেইন, আমি তোমাকে আর মিসেস কানিংহামকে গ্রামে নামিয়ে দেব। বিকালে আমরা আবার দেখা করব। মেরির সাথে আমাকে অনেক বিষয়ে আলাপ করতে হবে।’
মেরি সামনের সিটে রুথ কানিংহামের পাশে চাপাচাপি করে বসল। কেইন আর জামাল ক্যানভাস ছাউনি দেওয়া পেছনের সিটে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করতেই কেইন এমনি পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল লালচে বাদামি রঙের আলখাল্লা আর মাথায় লাল আবায়া পরা একজন আরব বালিয়াড়ির পেছন থেকে উটে চড়ে রানওয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে। প্লেনের কাছে এসে সে উটের পিঠ থেকে নেমে প্লেনের পাশেই দাঁড়াল।
কেইন জর্ডনের কাঁধে একটা টোকা দিয়ে বলল। এক মিনিট থামবে জর্ডন?’
জর্ডন ট্রাক থামাল, তারপর সবাই ঘুরে পেছন দিকে তাকাল। আরব লোকটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্লেনটা দেখছিল, তারপর মুখ তুলে ওদের দিকে তাকাল।
কেইন ট্রাক থেকে নেমে পড়ল। আমি দেখে আসি লোকটা কি চায়। হয়তো এমনিই কৌতূহল, তবুও বেদুঈনদের ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না।
সে প্লেনের দিকে এগোতেই আরব লোকটিও তার সাথে দেখা করার জন্য এগোল। তার একহাত অলসভাবে বাকা জামবিয়ার রুপালি হাতলে রাখা। কেইন লোকটি থেকে কয়েক ফুট দুরে থেমে আরবিতে জিজ্ঞেস করল। তুমি এখানে কি চাও? কাউকে খুঁজছো?’
আরব লোকটির মুখ রেখাঙ্কিত আর চোয়াল নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। চোখের মনি বিন্দুর মতো আর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লালা ঝরছিল। সে বলল, ‘কেইন নামে একজনের জন্য আমার কাছে একটা চিঠি আছে।
কেইন এক হাত দিয়ে কোল্টের বট ধরে রেখে বলল, “আমিই সে লোক। কোথায় চিঠি, দেখি?
সাথে সাথে আরব লোকটি খাপ থেকে জামবিয়াটা টেনে বের করতেই এর ব্লেড রোদে ঝলকে উঠল। কেইন দ্রুত এক কদম পিছু হটে খাপ থেকে কোল্ট বের করতে চেষ্টা করল। কিন্তু পিস্তলের ডগা তার পকেটের লাইনিংয়ে আটকে গেল। সে ছোরার ব্লেড থেকে বাঁচার জন্য ঝট করে মাথা সরিয়ে আরব লোকটির গলা ধরতে চেষ্টা করল।
এক মুহূর্ত তারা জাপটাজাপটি করতে লাগল, কেইন লোকটির হাত থেকে অস্ত্রটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করল।
আরব লোকটি ভীষণ জোরে তার হাঁটু উপরের দিকে উঠিয়ে মারল।
কেইন ব্যাথায় কাতড়ে উঠল, দুজনে জাপটাজাপটি করতে করতে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল। কেইনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তারপরও সমস্ত কিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল। নোংরা লোকটার শরীরের তীব্র দুর্গন্ধ আর তার চোখের উন্মাদের মতো চাউনি সম্পর্কে সে সচেতন হলো।
দূরে নারী কণ্ঠের চিৎকার শোনা গেল আর তখনই সে অনুভব করল তীক্ষ্ণ কিছু একটা তার ডান নিতম্বে যন্ত্রণাময় খোঁচা দিচ্ছে। এটি কোল্ট রিভরবারটি, সে টেনেহিঁচড়ে পকেট থেকে সেটা বের করল। তারপরর কোল্টের ব্যারেল আরব লোকটির পেটে জোরে চেপে ধরল। লোকটা আঘাত হানার জন্য জাম্বিয়া উঁচু করতে সে দুবার ট্রিগার চাপলো।
এত কাছ থেকে গুলি করায় বুলেটের প্রচণ্ড শক্তি লোকটিকে পেছনের দিকে তুলে ফেলে দিল। কেইন উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার কানে প্রচণ্ড আওয়াজ হচ্ছে। কেউ তার নাম ধরে চিৎকার করে উঠল। সে এরোপ্লেনের ডানা ধরে কোনোমতে টেনে নিজেকে ওঠালো। তখন তার নজরে পড়ল আরেকজন আরব দৌড়ে তার দিকে এসে মাথার উপর জাম্বিয়া উঁচু করল।
কেইন কোল্টটা উঁচু করতে চেষ্টা করল, কিন্তু মনে হলো তার হাতে কোন শক্তি নেই। আর তখন জর্ডন সেখানে পৌঁছাল। ভুতত্ত্ববিদ এক হাঁটু গেড়ে তার পাশে মাটিতে বসল, তার ভারী রিভলবারের ব্যারেল বামহাতের বাহুর উপর রেখে অত্যন্ত দ্রুত চারবার গুলি করল, মনে হচ্ছিল,যেন একটি গুলির আওয়াজ অনেকক্ষণ ধরে চলেছে।
আরব লোকটি তখনও গুলির মুখে দৌড়ে আসছিল, বুলেটগুলো একের পর এক তার দেহে বিদ্ধ হতে লাগল। তারপর প্রায় তাদের গায়ের উপর এসে এক পাশে টলতে টলতে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল।
কয়েকটি মুহূর্ত নিঃশব্দে কাটলো, তারপর কেইন তার পেছনেই একটা চিৎকার শুনলো। এরোপ্লেনের ডানা ধরে নিজেকে সামলে সে ঘুরে দেখল মেরি তার দিকে ছুটে আসছে।
তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। সে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। “গ্যাভিন তুমি ঠিক আছে?
সে মেরির হাতে হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বলল, জর্ডনকে ধন্যবাদ দাও।’
ভুতত্তবিদ গুলিতে মৃত লোকটির উপর ঝুঁকেছিল, সে ফিরে অবাক হয়ে বলল, কী করে লোকটা গুলি খেতে খেতে ছুটে আসছিল? আমি তো একটা গুলিও মিস করিনি।
কেইন মৃতদেহটি চিৎ করল। লোকটির মুখ কুঁকড়ে আছে, ঠোঁটে লালা ঝরছে আর ঠোঁট বাইরের দিকে উল্টানো, দাগে ভরা দাঁত দেখা যাচ্ছে। এর আগে এরকম চেহারা হয়েছে সেরকম কাউকে তুমি দ্যাখোনি?
জর্ডন মাথা নাড়ল। তবে মেরি এগিয়ে এসে নিচে তাকাল। এই লোকটাকে কোয়াট খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করা হয়েছে। সে নিশ্চয়ই একজন ভাড়াটে খুনি।
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। আমারও সেরকম মনে হচ্ছে। যখন আমি প্রথম লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি চায় সে তখন সে আমাকে বলল কেইন নামে একজনের জন্য তার কাছে একটা চিঠি আছে।
‘কিন্তু কেউ তোমাকে কেন হত্যা করতে চাইবে?’ জর্ডন বলে উঠল। আর এই কোয়াট জিনিসটা কি?
কেইন একটা সিগারেট ধরাল। এটা হলো এ এলাকার এক ধরনের গুল্মলতার পাতা থেকে বানানো উত্তেজক নেশা দ্রব্য। এই পাতা চিবোলে মানুষটি অতিরিক্ত সচেতন আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে যায়। বার বার এটি চিবোলে ব্যবহারকারীর শারীরিক আকৃতির উপর একটা প্রভাব পড়ে।
জর্ডন ভ্রু কুঁচকালো। আর এই ভাড়াটে খুনির বিষয়টা কি বলো তো?”
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। আমি মনে করেছিলাম তুমি হয়তো ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে জেনেছ। তুমি যদি এদেশে কাউকে হত্যা করতে চাও তবে সেটা তুমি নিজে করবে না। একজন পেশাদার লোককে ভাড়া করবে।
প্রথম যে লোকটিকে কেইন মেরেছিল জামাল তার দেহ তল্লাশি করে হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে ওদের দিকে আসছিল। সেটা সে তার মিসট্রেসের হাতে দিল।
মেরি ভেতরে তাকিয়ে ব্যাগের মুখটা এমনভাবে খুলে ধরল যাতে বাকি সবাই দেখতে পারে কি আছে ভেতরে। ব্যাগ ভর্তি রূপার মুদ্রা।
জর্ডন শীস দিয়ে উঠল আর মেরি গম্ভীর কণ্ঠে বলল। এখানে কম করেও দুই থেকে তিন হাজার মারিয়া থেরেসা ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা আছে, গ্যাভিন। কেউ তোমাকে মৃত দেখতে চায় নিশ্চিত ভাবে।
কেইন শান্তভাবে মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, আমার মনে হয় আমি জানি কে তা চায়। গতকাল সেলিমের সাথে একটা বোঝাঁপড়া হয়েছিল। গতরাতে আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন তার একটা লোক একবার চেষ্টা চালিয়েছিল আমাকে হত্যা করার।
মেরি ভ্রু কুঁচকালো। কিন্তু সে কি করে জানল যে তুমি আজ সকালে বার আল মাদানিতে আসবে?
বিষয়টা নিয়ে কেইন একটু ভেবে মাথা নাড়ল। “তোমার কথায় যুক্তি আছে। যাই হোক ছাড়ো এসব। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি আর শুধু শুধু অনেকগুলো টাকা খরচ করল কেউ।’ সে যন্ত্রণায় কাতড়ে উঠে হাত দিয়ে মুখ মুছলো। এখন একটা ড্রিংক পেলে ভাল হতো।
ট্রাকে একটা ফ্লাস্ক আছে,’ জর্ডন তাকে জানাল। আমারও একটু দরকার জিনিসটা। সে দাঁত বের করে হেসে বলল। আমি শুধু শুধু ভাবছিলাম একজন ভূতাত্ত্বিক হলে জীবন হয়তো একঘেয়ে হয়ে যায়।
ওরা যখন ট্রাকের দিকে ফিরছিল তখন একদল উত্তেজিত জনতা ওদের পাশ কাটিয়ে মৃতদেহগুলোর দিকে যাচ্ছিল।
‘এরা অবার এল কোত্থেকে? জর্ডন বলল। কেউ দেখলে হয়তো মনে করবে ওরা আগে থেকে জানতো কিছু একটা এখানে ঘটবে।
‘সম্ভবত তারা তা জানতো,’ কেইন তাকে জানাল।
রুথ কানিংহামকে হঠাৎ দেখে অসুস্থ মনে হলো, তার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।
‘আপনি ঠিক আছেন তো? সে কেইনকে জিজ্ঞেস করল।
কেইন মাথা নাড়ল। দুঃখিত, আপনাকে এসব দেখতে হচ্ছে।
মনে হলো তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। সামনের সিটে গিয়ে কোনরকমে বসে নার্ভাস হয়ে হাতের মুঠো একবার বন্ধ করল আবার খুলতে লাগল।
প্রথম আততায়ীর দেহ তল্লাশি করে জামাল ব্যাগ ভর্তি যে মুদ্রা পেয়েছিল, জর্ডন সেগুলো পরীক্ষা করছিল। সেখান থেকে মুখ তুলে কেইনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এগুলো নিয়ে কী করা হবে?’
‘এখন তোমার কাছেই রেখে দাও, কেইন তাকে জানাল। পরে এক সময় নিশ্চয়ই এর ব্যবহার কীভাবে করা যায় তা জানা যাবে।
জর্ডন দাঁত বের করে হাসল। এই পরিস্থিতিতে বেশ ভাল টাকা পাওয়া গেল। ড্যাশবোর্ডের নিচে একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে সে একটা ব্রান্ডির ফ্লাস্ক বের করে লম্বা এক ঢোক খেয়ে ফ্লাস্কটা কেইনের হাতে দিল। কমপ্লিমেন্ট অফ দি হাউস।
কেইন ফ্লাস্কটা হাতে নিয়ে নিরবে তাকে টোস্ট করল। ব্রান্ডি গলা বেয়ে পেটে পড়তেই তার প্রায় শ্বাসরোধ হয়ে পড়ল। তারপর সে পেছনের সিটে গিয়ে বসল। তোমাকে এখনও ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। তুমি চমৎকার রিভলবার চালিয়েছ।
জর্ডন স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসে গ্রামের দিকে ড্রাইভ করে চলল। ‘আমি ওয়াইমিংয়ে একটা খামারে বড় হয়েছি।’
একটা বড় রাস্তায় ট্রাকটা ঘুরিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বড় বাড়িটার সামনে সে ব্রেক করল। এক পাল ছাগল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল।
কেইন গাড়ি থেকে নামতেই রুথ কানিংহামও তার পিছু পিছু নামল। “ওমরের সাথে কথা বলার পর আমরা শাবওয়া এলাকায় আকাশে প্লেন নিয়ে একটা চক্কর দেব।’ সে মেরিকে বলল।
সে মাথা কাত করল। সাবধানে থেকো গ্যাভিন, আর মরুভূমির খুব বেশি ভেতরে যেও না। ওড়ার জন্য জায়গটা ভাল নয়। সে তার হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। হয়তো–ভাগ্য ভাল হলে, আমরা দুপুরের আগেই এখানে ফিরে আসতে পারব।’
কেইন মৃদু হাসল। আমরাও সহজেই তার আগেই চলে আসতে পারব।’
গিয়ার বদলাবার শব্দ করে ধুলার মেঘ উড়িয়ে ট্রাকটা চলে গেল। রুথ কানিংহামের সাথে কথা বলার জন্য ঘুরতেই কেইন দেখল গ্রামের গোত্র প্রধান তার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে অভুর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছে।
‘তুমি আমার ঘরকে সম্মানিত করছে ক্যাপ্টেন কেইন, সে আরবিতে বলল।
কেইন মৃদু হাসল। সবসময় আমি কোন কিছুর দরকার পড়লে আসি, বন্ধু। ভেতরে চল। বাইরে খুব গরম আর গত আধ ঘণ্টার ঘটনার পর আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে একটু বসে আরাম করার।
ওমর ওদেরকে তার জানালাবিহীন কাদামাটির ইটের তৈরি বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। বাড়িটায় দুটো কামরা। একটাতে পরিবারের ছাগল আর মুরগির পাল আর অন্যটায় সবার জন্য থাকার জায়গা। রাতে ওমর তার পরিবার নিয়ে লম্বা গালিচায় ঘুমায়।
দরিদ্র এলাকা হলেও ওমর বিন নাসেরের মধ্যে স্থানীয় আরব রীতি অনুযায়ী শিষ্টাচার ও মর্যাদা বোধ ছিল। সে কেইন এবং রুথ কানিংহামকে দুটো কুশনের কাছে নিয়ে গিয়ে দুহাতে তালি দিল। এক মুহূর্তের মধ্যে একজন মহিলা কামরায় প্রবেশ করল। লম্বা কালো একটা বোরকা জাতীয় আলখাল্লা পরে রয়েছে, যা দিয়ে তার মুখও সম্পূর্ণ ঢাকা। মহিলাটির বাম হাতে একটা তামার পাত্র আর অন্য হাতে তিনটে কাপ।
স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী কেইন প্রথমে প্রত্যাখানের ভান করে একটা কাপ গ্রহণ করল, আর সেই সাথে রুথ কানিংহামকেও ইশারা করল তাকে অনুসরণ করতে। মহিলাটি কয়েকফোঁটা কাপে ঢেলে অপেক্ষা করতে লাগল মতামতের জন্য। এটি ছিল ইয়েমনি মোছা–পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কফি। কেইন মৃদু হেসে কাপটা তুলে ধরল। মহিলাটি সাথে সাথে কাপটা ভরে দিল।
ওমর হাতের ইশারায় মহিলাটিকে বিদায় করল। কেইন তাকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরতেই গোত্র প্রধান আগ্রহ ভরে সেটা গ্রহণ করল।
সিগারেট টেনে সন্তুষ্ট হওয়ার পর সে আরাম করে বসে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল। বল তোমার জন্য কী খেদমত করতে পারি?
কেইন রুথ কানিংহামকে দেখিয়ে বলল। আমি এই মহিলার স্বামীর অনুসন্ধান করছি। তিনি প্রায় দুমাস আগে এখানে এসেছেন। তার সম্পর্কে তুমি কিছু বলতে পারবে?
ওমরের চোখের তারা কৌতূহলে নেচে উঠল। সে রুথ কানিংহামের দিকে মাথা হেলিয়ে একটু মৃদু হেসে কেইনকে বলল। এই মহিলা সম্ভবত আরবি জানেন না?’ যখন কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল, তখন সে বলল। প্রায় দুই মাস আগে ঠিকই একজন লোক এখানে এসেছিল। সে একটা ট্রাকের কনভয়ের সাথে এসেছিল। ট্রাকটা আমেরিকান জর্ডনের ক্যাম্পে চলে গেল তবে লোকটি বার আল মাদানিতে রয়ে গেল।’
এখান থেকে তারপর সে কোথায় গেল? কেইন বলল।
ওমর কাঁধ ঝাঁকাল। কে জানে? লোকটা একটা পাগল-বদ্ধ উন্মাদ ছিল। সে শাবওয়া থেকে মারিব উটে চড়ে যেতে চেয়েছিল। সে জন্য গাইড খুঁজছিল।’
‘তুমি তাকে লোক দিয়েছিলে? কেইন বলল।
ওমর মাথা নাড়ল। আমি উট দিতে পেরেছিলাম। তবে পথপ্রদর্শক সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তুমিতো জানোই কেউ রাব আল খালিতে যেতে সাহস করে না, যদি না সে মাথার উপর মূল্য ধার্য করা একজন অপরাধি হয়ে থাকে।’
তারপর সে কী একাই গেল?
গোত্র প্রধান মাথা নাড়ল। সে সময়ে একজন পাগল বেদুঈন–একজন রশিদ এখান দিয়ে যাচ্ছিল। তুমি তো জানোই তারা কী ধরনের হয়ে থাকে। যে কোন এডভেঞ্চারপ্রিয়, গর্বিত, বেপরোয়া মানুষ। সে স্বেচ্ছায় ইংলিশ লোকটার সাথে গেল।
‘তারপর আর তাদের কোন খবর পেয়েছিলে?’ কেইন বলল।
ওমর হালকাভাবে মৃদু হেসে বলল। ক্যাপ্টেন কেইন, এই মুহূর্তে তাদের হাড় রোদে ঝলসাচ্ছে। যে সব বোকা মানুষ রাব আল খালিতে যাবার দুঃসাহস দেখায় তাদের শেষ পরিণতি সেটাই হয়।’
কিছুক্ষণ কেইন ভুরু কুঁচকে বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে রুথ কানিংহামের দিকে এক হাত বাড়াল। কিছু জানতে পারলেন?’ সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
সে ঘাড় কাত করল। অনেক কিছু। আপনার স্বামী এখানে এসেছিলেন। তিনি এখান থেকে উট আর রশিদ গোত্রের একজন বেদুঈনক সাথি হিসেবে পেয়েছিলেন। ওমরকে জানিয়েছিলেন যে তিনি শাবওয়া থেকে রাব আল খালি অতিক্রম করে মারিব যাবেন।
তার চোখে একটু ভীতি দেখা গেল। কেইন তার বাহুতে চাপড় দিয়ে আশ্বাস দিল। তারপর ওমরের দিকে ফিরে বলল। অশেষ ধন্যবাদ বন্ধু। তবে এখন আমাদের যেতে হবে। আমি এই মহিলাকে সাথে নিয়ে প্লেন নিয়ে উড়ে শাবওয়া যাবো তারপর আরেকটু ভেতরে মরুভূমিতে দেখবো। সম্ভবত কিছু একটা দেখা যেতে পারে।
ওমর সায় দিয়ে ওদের সাথে দরজা পর্যন্ত গেল। বাইরে রাস্তায় বেরুতেই ওরা দেখল গ্রামের কয়েকজন লোক মৃতদেহগুলো একটা ঠেলা জাতীয় কিছুতে করে নিয়ে গেল।
তাদের আলখাল্লা রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে আর মৃতদেহগুলোর উপর মাছি ভন ভন করছে। রুস্থ কানিংহাম থর থর করে কাঁপতে লাগল। ওমর বলল, তুমি জোর বাঁচা বেঁচে গেছ ক্যাপ্টেন কেইন, সে জন্য আমি আনন্দিত।’
কেইন অবাক বিস্ময়ে দ্রুত তার দিকে ফিরে তাকাল। তুমি জানতে যে ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল?
ওমর ঘাড় কাত করল। অবশ্যই জানতাম।’ সে শান্ত কণ্ঠে বলল।
‘আর জানা সত্ত্বেও তুমি তাদের বাধা দিলে না?
ওমরের চেহারায় দুঃখি ভাব দেখা দিল। আরেকজন মানুষের রক্তের দ্বন্দ্বে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না।’
কেইন হাসতে শুরু করল। ওমর এ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল আর কেইন হাসতে হাসতে রুথ কানিংহামের হাত ধরে সেখান থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
‘কী ব্যাপার বলবেন? সে জিজ্ঞেস করল। আপনাদের আরবিতে কথা বলা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
‘এ আপনি বুঝবেন না, সে তাকে জানাল। এটা এক ধরনের প্রাইভেট রসিকতা।
এয়ারস্ট্রিপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রুথ বলল, কফিটা খুবই চমৎকার ছিল। ঐ মহিলাটি কে ছিল–তার স্ত্রী?
কেইন মাথা নাড়লো। সে বাড়ির একজন ক্রীতদাসী।
‘আপনি রসিকতা করছেন, সে বললো।
কেইন মৃদু হাসল। আপনি জামালের কপালে গরম লোহার ছাপ দেখেন নি? সে ইয়েমনে একজন ক্রীতদাস ছিল। প্রথমবার পালাবার চেষ্টা করার সময় ওরা তার জিহ্বা কেটে নেয়। এখনও আরবের অনেক জায়গায় প্রচুর ক্রীতদাস রয়েছে।
রুথ কানিংহাম থর থর করে কাঁপতে লাগল। এরপর তারা নিরবে পথ চলতে লাগল। প্লেনের কাছে পৌঁছে ওরা দেখতে পেল সকালের লড়াইয়ের চিহ্ন হিসেবে রানওয়ের কয়েক জায়গায় বালু আর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে। কেইন তাকে ঠেলে কেবিনের ভেতরে ঢুকিয়ে বেশ কসরত করে নিজে ঢুকলো। এরপর আর কোন সময় নষ্ট করল না। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেনটা খাড়া হয়ে নীল আকাশের দিকে উঠতে শুরু করল।
দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যে ওরা শাবওয়া পৌঁছে গেল। রুথ। কানিংহাম নিচের দিকে তাকাল, তার চেহারায় হতাশা। আমি তো এর মধ্যে রোমাঞ্চকর তেমন কিছুই দেখছি না।’
কেইন মাথা কাত করল, ‘আমি স্বীকার করছি দেখতে তেমন বিস্ময়কর নয়। তবে এখানে বালুর নিচে ষাটটা মন্দির আছে, যার সম্পর্কে রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি লিখেছেন, ভবিষ্যৎ অভিযাত্রিদের জন্য এক বিশাল গুপ্তধনের ভান্ডার।
সে কম্পাস চেক করে র্যাপিডের নাক মরুভূমির দিকে ঘুরিয়ে নিল। ‘আমি মারিবের উদ্দেশ্যে গতিপথ ঠিক করে নিলাম। আলেক্সিয়াসের বর্ণনা অনুযায়ী শাবওয়া থেকে সোজা লাইন বরাবর এ জায়গার কোথাও একটা মন্দির থাকবার কথা। তিনি বলেছেন নব্বই মাইল হবে। আশা করি কিছু একটার দেখা পাওয়া যাবে।
সে বালিয়াড়ির উপরে প্লেনটাকে পাঁচ ছয়শো ফুট উচ্চতায় নামিয়ে আনল এই আশায় যে, কোন মানুষ এখান দিয়ে যাওয়ার কোন চিহ্ন হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। যতদূর চোখ যায় দেখা যাচ্ছে নিষ্ফলা, আদিম এবং অচিন্তনীয় নির্জন মরুভূমি চলে গেছে।
মিনিট পনেরো পর, রুথ কানিংহাম হঠাৎ তাকে একটা খোঁচা মারল। ওদের সামনেই সাত আটশো ফুট উঁচু এক বিশাল বালিয়াড়ি সোজা আকাশে উঠে গেছে। কেইন তাড়াতাড়ি কলামটা সামান্য পেছনের দিকে টানল। ইঞ্জিনটা কয়েকবার ফট ফট শব্দ করল আর দুবার মিস করল।
সে কলামটা ধরে খুব জোরে পেছনের দিকে টান দিতেই প্লেনটা বালিয়াড়ির মাত্র কয়েক ফুট উপর দিয়ে উপরের দিকে উঠল। তারপর ইঞ্জিনটা কয়েকবার খক খক শব্দ করল। তারপর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ সম্পূর্ণ নিরবতা আর মাঝে মাঝে প্লেনের পাখার সাথে বাতাসের সংঘর্ষের শন শন শব্দ। তারপর প্লেনটা নিচের দিকে নামাতে শুরু করতেই রুথ কানিংহাম চেঁচিয়ে উঠল।
কেইন নিয়ন্ত্রণ নেবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল। মরুভূমির পঞ্চাশ কি ষাট ফুট উচ্চতায় এসে সে প্লেনটাকে লেভেলে আনল আর তখনি আরেকটা বিশাল বালিয়ারি ওদের দিকে ছুটে আসতে দেখা গেল। শক্ত করে ধরে থাকুন!’ এই কথা বলে সে সর্বশক্তি দিয়ে কলামটা টেনে ধরল।
র্যাপিডটা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠল। একটা মুহূর্ত মনে হলো এটা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তারপর বামদিকের ডানার ডগা বালুতে গেঁথে গেল। প্লেনটা বৃত্তাকারে ঘুরে গেল আর শোনা গেল ধাতু ছিঁড়ে যাবার চড় চড় শব্দ। কেইন সতর্ক করে চিৎকার দিয়ে উঠল আর নরম বালুতে প্লেনটা থেমে যাবার ধাক্কা সামলাতে নিজেকে প্রস্তুত করল।
০৯. কেইন লম্বা একটা শ্বাস নিল
০৯.
কেইন লম্বা একটা শ্বাস নিল আর এক হাতের পিছন দিয়ে চোখের ঘাম মুছলো। ঘুরে রুথ কানিংহামের ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকাল-”আপনি ঠিক আছেন তো?
সে ঘাড় কাত করল।নিচে নামার সময় আমি শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম।
কেইন দরজা খুলে লাফ দিয়ে মাটিতে নামল। র্যাপিডের নাকটা নরম বালুতে অর্ধেক ডুবে রয়েছে আর বামদিকের ডানাটা বাঁকা হয়ে মুচড়ে অকার্যকর হয়ে গেছে।
‘আমি বুঝলাম না আগুন লাগে নি কেন, সে ভুরু কুঁচকে বলল, তারপর দরজার কাছে এসে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের দিকে তাকাল। আশ্চর্য তেলের ট্যাংকতো খালি।’
রুথ কেবিনের এপাশে এসে দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে বলল, এর মানে কী হতে পারে?
“ঠিক বলতে পারব না। ইঞ্জিন যেহেতু বন্ধ হলো, সেটা তেলের অভাবে হতে পারে, কিন্তু বুঝতে পারলাম না তা কেন হবে! এখন রেডিওর অবস্থা কি কে জানে।
সে রেডিও পরীক্ষা করবার জন্য কেবিনে উঠল। রুথ কানিংহাম বলল, সিগন্যাল শোনার মতো ধারে কাছে কেউ কি আছে?
কেইন মাথা নাড়ল, জর্ডনের ক্যাম্পে একটা শর্ট ওয়েভ রিসিভার আছে।’ রেডিও সেটটা চট করে পরীক্ষা করে সে মুখ বাঁকা করে বলল, এটাও গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কাজ করার উপযোগী করে এটা তৈরি করা হয় নি।
রুথ কানিংহাম হাত দিয়ে মুখ মুছে বলল, ‘এক গ্লাস পানি পেলে হতো।’
‘শিগগিরই এটা ঠিক করে ফেলব।’ এই কথা বলে সে পেছনের সিটে হাত বাড়াল পানির বড় একটা জেরি ক্যান আর প্লাস্টিক কাপের জন্য।
‘এটা ভর্তি আছে। কাজেই পানি নিয়ে আমাদের কোন সমস্যা হবে না।’
রুথকে পানি দিয়ে নিজেও পানি খেলো। তারপর এরোপ্লেনের ডানার ছায়ার নিচে বসে কোন কথা না বলে চুপচাপ সিগারেট টানতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর রুথ কেইনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে স্থির কণ্ঠে বলল, গ্যাভিন ঠিক করে বলুনতো কোন আশা আছে?
‘আপনি যা ভাবছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। আমার হিসাবে আমরা শাবওয়া থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল এসেছি। দিনের গরমে এই দূরত্ব পার হবার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। সবচেয়ে ভাল হবে এখানে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় রওয়ানা দেওয়া। রাতের ঠাণ্ডায় আমরা অনেক তাড়াতাড়ি যেতে পারব।’
আপনার কি মনে হয় তারা আমাদের খুঁজতে আসবে?’
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে মাথা নেড়ে সে বলল, অবশ্যই আসবে। মেরি আর জর্ডন বার আল-মাদানিতে যখন জানতে পারবে যে আমাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সাথে সাথে তারা একটা অনুসন্ধান দল পাঠাবে। তার ফোর্ড ট্রাকগুলো মরুভূমিতে কাজ করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।’
রুথ তার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজলো, তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার সাথে আছি বলে আমি আনন্দিত গ্যাভিন। অন্য কেউ হলে আমি ভয় পেতাম, সত্যি ভয় পেতাম।
সে মৃদু হেসে রুথকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল, এখানে ভয় পাবার কিছু নেই, কেবল কয়েক ঘণ্টা কষ্ট করতে হবে। পরে বছরের পর বছর ধরে এই ঘটনা নিয়ে আপনি গল্প করতে পারবেন। আর দিনের পর দিন ঘটনার বিবরণ বেড়ে যাবে।’
‘আপনার কথাই হয়তো ঠিক।’ তার কাঁধ ঝুলে পড়েছে আর বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
কেইন তাকে কেবিনের দিকে ঠেলে বলল, কয়েক ঘণ্টা ঘুমাতে চেষ্টা করুন। ভেতরে একটু ঠাণ্ডা পাবেন। আমি বিকালে জাগিয়ে দেব।
সে দরজা বন্ধ করে এরোপ্লেনের ডানার নিচের ছায়ায় এক হাতে মাথা : রেখে শুয়ে পড়ল।
সে আশা করছে যতটুকু নিশ্চয়তা সে দিতে চেষ্টা করেছে সে রকমই ভাবতে পারলে ভাল হতো। একা একা আর প্রচুর পানি নিয়ে রাতের বেলা জোর কদমে হাঁটলে শাবওয়া পৌঁছাবার ভাল চান্স আছে, কিন্তু সাথে একজন মহিলা থাকলে…!
একটা বিষয় নিশ্চিত, মেরি আর জর্ডন ওদেরকে অবশ্যই খুঁজতে আসবে। তবে সমস্যা হলো এই বিশাল মরুভুমিতে ঠিক কোন জায়গায় খুঁজবে।
সে নিরবতায় কান পেতে শুনতে থাকল আর অনুভব করল গরম প্রায় একটা দৈহিক শক্তির মতো তার উপর চেপে বসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ কোথাও একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল আর টের পেল শক্ত কিছু একটা তার চোয়ালে খোঁচা মারছে। চোখ খুলতেই লম্বা একটা বন্দুকের ব্যারেল তার নজরে পড়ল।
রঙিন পাগড়ি পরা একজন ইয়েমনি বন্দুক ধরে আছে। তার অর্ধনগ্ন শরীরে নীল দিয়ে লেপা। দুই কান কাটা–আর ডানদিকের গালে ছাপ মারা একজন চোরের চিহ্ন।
আরো দুই জন রুথ কানিংহামকে কেবিন থেকে টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছে। কেইন কোন মতে উঠে দাঁড়াতেই রুথের শার্ট ছিঁড়ে গেল, সে মাটিতে পড়ে গেল। একজন লোক হাসতে হাসতে তার চুল ধরে টেনে দাঁড় করাল।
লোকটির মুখের এক পাশ খেয়ে গেছে। চোখের পাশে চামড়া পোড়া আর নাকের জায়গায় কেবল দুটো ছিদ্র। রুথ কানিংহাম ভয়ংকর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে জ্ঞান হারালো।
কেইন রুথের দিকে এগোতেই তিন ইয়েমনি তার দিকে রাইফেল তাক করল। আর এগোলে ভাল হবে না। কান কাটা লোকটা আরবিতে কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল।
কেইন তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আমাদেরকে বার আল-মাদানি নিয়ে চলো, তোমাদের ভাল বকশিষ দেওয়া হবে।
বিভৎস মুখের লোকটা একটা গালি দিয়ে মাটিতে থুথু ফেলল। সে দ্রুত সামনে এক কদম এগোল তারপর রাইফেলটা উল্টো করে তার বাট দিয়ে কেইনের পেটে জোরে একটা গুতো মারল। আরেকজন তার হিপ পকেট থেকে কোল্ট অটোমেটিকটা বের করে নিল। কেইন মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকল আর অপেক্ষা করতে থাকল যন্ত্রণাটা চলে যাবার। ওরা কিছুক্ষণ তাকে এভাবে ফেলে রাখল।
লোক তিনটা যে ডাকাত তা বোঝাই যাচ্ছে। এখন ওদেরকে নিয়ে তারা কী করতে যাচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লোকগুলো কিছু একটা বিষয়ে তর্ক করছে। কেইন চোখ খুলল, তার নিশ্বাস এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ওদের কথা শুনতে চেষ্টা করল।
চামড়ার স্যান্ডেল পরা নোংরা বাদামি একটা পা তার মুখের সামনে এল একটা হাত তাকে টেনে তুলে বসালো। সে এখন দু’কান কাটা লোকটার মুখোমুখি।
সে কেইনের সামনে আসন পেতে বসল। হাতের রাইফেলের ঘোড়া টিপে ধরে দাঁত বের করে হাসল। এবার আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে।
‘আমাদেরকে বার আল-মাদানি নিয়ে চলো।’ কেইন অনুরোধ করল। ‘আমি কথা দিচ্ছি তোমাদেরকে প্রচুর পুরষ্কার দেওয়া হবে। পাঁচ হাজার মারিয়া থেরেসা ডলার।’
ইয়েমনি লোকটা দু’দিকে মাথা নাড়ল। সীমান্তের ওপারে আমি একজন মৃত লোক। সে রুথ কানিংহামকে দেখিয়ে বলল, এই মহিলাটিকে সানার দাস বাজারে বিক্রি করে আমরা অনেক টাকা পাবো।
কেইন বলল, দশ হাজার, কত চাও বল। এই মহিলা নিজের দেশে একজন ধনী মানুষ।
আরব লোকটি মাথা নাড়ল। কী করে আমি বুঝবো সে আমাকে ন্যায্য দাম দেবে? ইয়েমনে একজন শেতাঙ্গ নারীর অনেক দাম পাওয়া যায়।
‘আর আমার ব্যাপারে? কেইন বলল।
ইয়েমনি লোকটা কাঁধ ঝাঁকাল, আমার বন্ধুরা তোমার গলা কেটে ফেলতে চায়। কিন্তু আমি তাদের রাজি করিয়েছি অন্য কিছু করতে। তুমি বাঁচো কী মর সেটা তোমার নিজের ব্যাপার। একজন শক্তিশালী মানুষের জন্য শাবওয়া খুবই কম দুরত্ব।
কেইন ভুরু কুঁচকালো, তোমার কথা বুঝতে পারলাম না।
ইয়েমনি লোকটা দাঁত বের করে হাসলো, আমাকে চিনতে পারো নি?’ দু’বছর আগে বাল হারিস যখন শাবওয়ার কাছে তাঁবু গেড়েছিল? তখন একটা ঘোড়া চুরির ব্যাপার ঘটেছিল। ওরা আমাকে ধরতে পারলে প্রাণে মেরে ফেলতো। তুমি অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত আমাকে তোমার ট্রাকে লুকাতে অনুমতি দিয়েছিলে। আল্লাহর ইচ্ছা দেখো, কী আশ্চর্য।
সাথে সাথে কেইনের ঐ ঘটনার কথা মনে পড়ল, সে একটু ঝুঁকে গলা নামিয়ে বলল–আমাদেরকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে চল। আমি তোমাকে অনেক পুরষ্কার দেব। অন্তত এটুকু করার জন্য তুমি আমার কাছে ঋণী।
ইয়েমনি লোকটি মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল, ‘জানের বদলে জান। এখন তোমার কাছে আমার কোন ঋণ নেই। ব্যস শোধ বোধ হয়ে গেল। আমার বন্ধুরা কম করে হলেও তোমার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলতে চেয়েছিল। যদি তুমি বুদ্ধিমান হও তবে আমরা যাওয়া পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকবে।
তারপর সে তার সঙ্গীদের সাথে যোগ দিল। ওরা ততক্ষণে ওদের উটের পিঠে চড়ে বসেছে। একজন আরব রুথ কানিংহামের অচেতন দেহটা কাঠের জিনের উপর আড়াআড়ি ভাবে ঝুলিয়ে দিল। কেইন অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখল, যতক্ষণ না ওরা বালিয়াড়ির অপর দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সে ঘড়ির দিকে তাকাল। দুপুর পার হয়ে গেছে, তার মানে সে একটু বেশি সময় ঘুমিয়েছে। কয়েকটা মুহূর্ত সেখানে বসে একের পর সম্ভাব্য কর্তব্য ভাবলো আর বাতিল করল। কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পেল না, শুধু এটুকু আশা আছে যে হয়তো সে রেডিও ব্যবহার করে কিছু একটা করতে পারবে। কেবিনে ঢুকে সে কাজ শুরু করল।
প্রথম থেকেই তার চেষ্টা অসফল ছিল। তারপরও সে অবিরাম কাজ করে। যেতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর বোঝা গেল রেডিওর ক্ষতিটা মেরামতের অযোগ্য। যদি কোন ভাবে একটু খানি স্পার্ক ফিরে আসতে যাতে বহির্জগতে একটা মেসেজ পাঠাতে পারে, তাহলেই চলতো।
তার শরীর থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরতে লাগল। কেবিনের প্রচণ্ড তাপ, তার সারা শরীর এমনভাবে ঢেকে ফেলেছিল যে তাকে কয়েকবার বিশ্রাম নিতে আর পানি পান করতে হয়েছিল। তিনটার একটু পর সে পরাজয় স্বীকার করল। ক্লান্ত হয়ে সিটে বসে একটা সিগারেট ধরাল।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিঃস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসা একটা ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া গেল।
সে এক লাফে মাটিতে নেমে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে লাগল, হঠাৎ তার মনে ক্ষীণ আশা জেগে উঠল। শব্দটা কাছে, আরো কাছে চলে এলো। সে এক হাত চোখের উপর রেখে উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল প্রায় একশো গজ সামনে একটি ট্রাক একটা বালিয়াড়ির উপরে উঠল, তারপর তার দিকে এগিয়ে এল।
মেরি ট্রাক চালাচ্ছে, পাশে জামাল বসা। কেইন ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই সে ইঞ্জিন বন্ধ করল, তারপর ট্রাক থেকে নেমে ওর দিকে দৌড়ে এল, ‘তুমি ঠিক আছে তো গ্যাভিন?’ সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
সে মাথা নাড়ল, “আমি ঠিক আছি, কিন্তু বুঝতে পারলাম না তুমি এত তাড়াতাড়ি এখানে কি করে এলে?
‘সে এক লম্বা কাহিনী, মিসেস কানিংহাম কি প্লেনে আছেন?
কেইন মাথা নাড়ল, না নেই।
সে দ্রুত সব কিছু খুলে বলল। তার বলা শেষ হলে মেরিকে চিন্তিত দেখাল, সন্ধ্যার আগে যদি আমরা ওদের ধরতে না পারি, তাহলে জানার কোন উপায় নেই ওরা তার সাথে কি করতে পারে।
কেইন সায় দিল। তবে এখন রওয়ানা দিতে পারলে ওদেরকে খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হবে না।’
সে সামনের সিটে মেরির পাশে বসল, জামাল বসল পেছনে। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা তিনটি উটের পরিষ্কার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে চলতে শুরু করল।
বারোটা ফরওয়ার্ড গিয়ার আর ফোর হুইল ড্রাইভের কারণে ট্রাকটা বালিয়ারিতে চলার অত্যন্ত উপযোগী ছিল।
কেইন সিটে হেলান দিয়ে বসল। বার আল-মাদানিতে কি কি হয়েছে সব খুলে বল।
মেরি বলল, এগারোটার মধ্যে জর্ডনের সাথে আমার কাজ শেষ হয়ে যায়। তারপর সে তার ড্রাইভারকে দিয়ে জামাল আর আমাকে ট্রাকে করে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছে দেখলাম ওমর সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সে জানাল উপকুল এলাকা থেকে একজন আগন্তুক গ্রামে এসে বলে বেড়াচ্ছে তুমি আর ফিরে আসবে না।
কেইন বলল, ওমর এমনি এমনি নিজে থেকে তোমাকে খবরটা দিল?
সে মৃদু হাসল। আরবদের এই জটিল মনস্তত্ত তুমি কখনও বুঝতে পারবে না, গ্যাভিন। মুখোমুখি লড়ে একজন শত্রুকে মেরে ফেলা এক জিনিস, কিন্তু ছলচাতুরি করে এরোপ্লেনের ক্ষতি করাটা,’ সে কাঁধ ঝাঁকাল। ওমরের কাছে এ ধরনের কাজ সম্মানহানিকর।
কেইন বলল, মানলাম একথা। কিন্তু ঠিক কী ঘটেছে, সেটা তুমি কী করে নিশ্চিত হলে?
‘ওমর আমাদের সে লোকটিকে দেখিয়ে দেয়। আর জামাল তাকে একটা কুঁড়েঘরের পেছনে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। লোকটা খুবই একগুয়ে ছিল, কিন্তু ডান হাত ভাঙ্গার পর যখন তাকে বলা হলো বাম হাতেরও একই অবস্থা হবে, তখন সে হার মানল।’
কেইন অবাক হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল–’মাই গড, তুমি অর্ধেক কোন কিছুতে বিশ্বাস করো না, তাই না?
‘আমার মা ছিলেন একজন রশিদ, সে শান্ত স্বরে বলল। আমরা কঠিন মানুষ, বিশেষত যে জিনিসকে আমরা মূল্য দেই তার উপর কোন ধরনের আঘাত এলে আমরা ছেড়ে দেই না।
এ কথার পর আর কোন কিছু বলার দরকার পরে না। কেইন বলল, ‘আমার মনে হয় সে তেলের ট্যাংকে কিছু কারসাজি করেছে, তাই না?
‘গ্রামের লোকজন যখন দল বেঁধে আততায়ীদের লাশের চারদিকে জমায়েত হচ্ছিল, তখন সে সুযোগটা নেয়, ভিড়ের মধ্যে কেউ তাকে খেয়াল করেনি।
‘তুমি কী জানতে পেরেছো কে তাকে এই কাজ করার জন্য টাকা দিয়েছে?’
সে মাথা নাড়ল। তুমি যা ভেবেছিলে–সেলিম।
কেইন ভুরু কুচকালো। সে নিশ্চয়ই আমাকে এত ঘৃণা করে যে এতদূর পর্যন্ত এগোতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি প্লেনটা কীভাবে খুঁজে পেলে?
‘আমি জানতাম তুমি একটা ডাইরেক্ট লাইনে শাবওয়া থেকে মারিব উড়ে যাবে। আমি একটা বেয়ারিং নিলাম, কম্পাস ধরে ধরে এগোলাম আর বাকিটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম। সমস্ত বিষয় সম্পর্কে একটা নোট লিখে জর্ডনের ড্রাইভারকে তার কাছে পাঠিয়ে দিলাম।
কেইন দাঁত বের করে হাসল, ‘তুমি দ্রুত অপরিহার্য হয়ে যাচ্ছে।
কোন কথা না বলে সে এক মনে ড্রাইভ করতে লাগল। উটের আঁকাবাঁকা পায়ের ছাপ সহজেই অনুসরণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ওরা একটা চওড়া সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছলো। বালুর সাথে নুড়ি মেশানো পথটা বেশ দূরে চলে গেছে। সে টপ গিয়ার দিয়ে বোর্ডে পা চেপে ধরল।
ট্রাক ধুলির ঝড় তুলে সমতল ভূমির পথে ছুটে চলল। একটু পর তিনজনেরই আপাদমস্তক বালুতে মাখামাখি হয়ে গেল। কেইন মুখে পানির ঝাপটা দিল আর সারাক্ষণ দুরের কালো কালো বিন্দুর মতো আকৃতিগুলোর দিকে কিছু একটার আশায় চেয়ে থাকল।
ট্রাকের ছাদে দুটো রাইফেল ব্রাকেটে আটকানো ছিল। সেগুলো নামিয়ে একটা জামালকে দিল। বিশালাকৃতির সোমালি অত্যন্ত নিপুণতার সাথে রাইফেলটা পরীক্ষা করে কোলে নিয়ে বসল, একটা আঙুল ট্রিগার গার্ডে ধরে রাখল।
কেইন তার রাইফেলটা শক্ত হাতে ধরে ধুলোভরা চোখে উইন্ডশিল্ড দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। অপেক্ষা করতে করতে তার মন এতই শূন্য হয়ে গিয়েছিল যে মেরি যখন তার কানের কাছে চিৎকার করে উঠল তখন সে চমকে উঠল। দূরের কালো ফোঁটাগুলো দ্রুত ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
সে রাইফেলটা একটু উঁচু করে ধরে অপেক্ষা করতে লাগল। দ্রুত উট তিনটার কাছে পৌঁছাতেই সব শেষের লোকটা পেছন ফিরে ওদের দেখতে পেয়ে মুখ হাঁ করে চিৎকার করে উঠল। সে তার উটকে দ্রুত সামনে এগিয়ে নিয়ে চলল।
মেরি হুইল ঘুরিয়ে ট্রাকটা আরব লোকগুলোর সামনে এগিয়ে গেল। কেইন ওদেরকে সতর্ক করার জন্য রাইফেল তুলে মাথার উপর দিয়ে একটা গুলি করল। ট্রাকটা ওদের সামনে গিয়ে থামল।
মেরি ব্রেক কষে থামতেই ক্ষতবিক্ষত চেহারার লোকটা, যে তার উটের পিঠে রুথ কানিংহামকে বহন করছিল, সে তাকে ছেড়ে দিতেই রুথ মাটিতে পড়ে গেল। লোকটা এক হাতে রাইফেল তুলে নিতেই জামাল দ্রুত একটা গুলি করল। লোকটা গুলির ধাক্কায় উটের পিঠ থেকে নিচে পড়ে গেল।
মেরি ট্রাকটা সামনে চালিয়ে নিয়ে রুথ কানিংহামের পাশে থামাল। সে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কাঁদছিল। মেরি তাকে শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, তারা আপনার কোন ক্ষতি করেছে?
রুথ কানিংহাম কয়েকবার মাথা নেড়ে অনেক কষ্টে কথা বলতে পারল। ভয়ংকর চেহারার লোকটা অনবরত আমার গায়ে হাত দিচ্ছিল, কিন্তু ওদের মধ্যে যে লোকটা নেতা ছিল সে তাকে বাধ্য করল আমাকে ছেড়ে দিতে। কাঁদতে কাঁদতে সে মাটিতে বসে পড়ল। মেরি তাকে ধরে আস্তে আস্তে ট্রাকে নিয়ে একটা সিটে বসিয়ে দিল।
কেইন অন্য লোকদুটোর দিকে এগিয়ে গেল। জামালের উদ্যত কারবাইনের সামনে ওরা উটের পিঠে শান্ত হয়ে বসেছিল। কান কাটা লোকটা কেইনের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসল–”আল্লাহর ইচ্ছা কী বিচিত্র।
‘তুমি একেবারে সঠিক কথাটাই বলেছো, আসলেই তাই, কেইন বলল। ‘তোমার ভাগ্য ভাল যে তুমি তার কোন ক্ষতি করেনি। এখন এখান থেকে ভাগো।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে লোকদুটোর উট নিয়ে চলে যাওয়া দেখল, তারপর মৃত লোকটির জন্য একটা অগভীর কবর খোঁড়ার জন্য জামালকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল।
যখন ওরা ট্রাকে ফিরে এল তখনো রুথ কানিংহাম মেরির কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কোঁপাচ্ছিল। কেইন ভুরু উঁচু করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মেরি মাথা নাড়ল। কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, এখন কোন তাড়া নেই। ঘণ্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে তারপর ফিরতে শুরু করব।’
ট্রাকের পাশে পিঠ দিয়ে সে বালুতে বসল। বুশহ্যাটের কিনারা চোখের উপর টেনে নামাল। একটু পর মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে এলো আর সে ঝিমুতে শুরু করল।
মনে হলো যেন এক মিনিট মাত্র কেটেছে। ঠিক তখনই কাঁধে মৃদু ঠেলা খেয়ে সে জেগে উঠল। মেরি তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। এখন আমাদের যাওয়া দরকার গ্যাভিন, ছয়টা বেজে গেছে।
কেইন উঠে দাঁড়িয়ে ট্রাকের ভেতরে দেখল। রুথ কানিংহাম একটা প্যাসেঞ্জার সিটে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে রয়েছে। কেইন মেরির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল, তারপর ড্রাইভিং সিটে বসল। মেরি আর জামাল ঘুরে অন্য পাশে গিয়ে বসল। কেইন আস্তে ক্লাচ ছেড়ে ট্রাকটা এগিয়ে নিয়ে চলল।
গাড়ির ড্যাশবোর্ডে একটা কার কম্পাস ছিল। কেইন সিদ্ধান্ত নিল উটের রাস্তা ছেড়ে আরো সরাসরি পথ খুঁজে নিয়ে শাবওয়া যাবে।
একটু পর একটা বিরাট কমলা রঙের বলের মতো সূর্য দিগন্তে ডুবতে শুরু করল। দ্রুত রাত নেমে এলো, যে রকম হয়ে থাকে মরুভূমিতে। আকাশ পরিষ্কার। হিরের টুকরার মতো দিগন্ত জুড়ে তারার মালা ছড়িয়ে রয়েছে আর চাঁদের অপার্থিব সাদা আলো যেন মরুভূমিকে ধুয়ে রেখেছে।
কেইনের কাঁধে মাথা রেখে মেরি ঘুমে ঢুলছিল। সে সিটে হেলান দিয়ে স্টিয়ারিং হুইলে হাত স্থির রেখে সামনে রাতের অন্ধকারের দিকে সোজা চেয়ে রয়েছে।
হঠাৎ দৃশ্যটা দেখে সে এমন একটা ধাক্কা খেল যে সাথে সাথে সজোরে ব্রেকে পা চাপতেই ট্রাকটা এমন জোরে থামাল যে সবাই সিটের সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাদের ঘুম ভেঙে গেল।
কী হয়েছে গ্যাভিন? মেরি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল।
সে কোন কথা না বলে গাড়িটার ডান দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
সামনে একটা ঢিবির উপর সুন্দর একটা পাথরের স্তম্ভ। চাঁদের আলোয় বালুতে তার লম্বা ছায়া পড়েছে।
কেইন ট্রাক থেকে নামল। মেরিও নেমে তার পিছু পিছু স্তম্ভটার দিকে এগোল। কয়েক ফুট দূরত্বে পৌঁছার পর তার পায়ের সাথে ধাতব কিছু একটার ধাক্কা লাগল।
সে নিচু হয়ে কয়েকটা ক্যান তুললো হাতে। কনড বিফ আর স্যুপ। লোকটা যেই হোক আরব নয়, এটা নিশ্চিত।’
তারপর সে নিচু হয়ে আরেকটা বস্তু তুলে নিল। এমন সময় রুথ কানিংহাম আর জামালও ওদের সাথে যোগ দিল। প্রথমে বুঝা গেল না জিনিসটা কি। তারপর উল্টো করে ওদের দিকে তুলে ধরল–বেশ বড় একটা খালি এলুমিনিয়ামের পানির বোতল।
.
১০.
জামাল সযত্নে স্তম্ভটার গোড়া থেকে আলগা বালু পরিষ্কার করতে লাগল। আর কেইন তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একটা শক্তিশালী ইলেট্রিক টর্চ ধরে থাকল।
খানিকক্ষণ পর জামাল কাজ শেষ করে কেইনকে দেখাল। কেইন সামনে ঝুঁকে দেখল পরিষ্কার খোদাই করা একটি দীর্ঘ সঙ্কেতলিপি ফুটে উঠেছে। কয়েক মিনিট নিবিষ্টভাবে লিপিগুলো পড়ে দেখল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ট্রাকের দিকে হেঁটে গেল।
একটা স্পিরিট স্টোভ জ্বালানো হয়েছে। মেরি আর রুথ কানিংহাম একটা পাত্রে গরম পানিতে মটরশুটি গরম করছে। কেইন ওদের পাশে এসে বসতেই রুথ একটা টিনের মগে কফি ঢেলে তার হাতে দিল–আর কিছু পেলেন?
কেইন কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, একটা দীর্ঘ সাবেঈন শিলালিপি প্রাচীন শেবা রাজ্যের ভাষা। দুর্ভাগ্যবশত সাথে কোন বই নেই আর আমার স্মৃতিতেও একটু মরচে পড়েছে। মগটা আরো কফির জন্য সামনে এগিয়ে ধরল। দু’একটা সঙ্কেতলিপির অর্থোদ্ধার করতে পেরেছি। যেমন, অ্যাসথার আর দূরত্ব নিয়ে কিছু লেখা, যার সাথে আমি পরিচিত নই।’
মেরি এক হাতে চুল ঠেলে সরালো। স্পিরিট–স্টোভের আলো বাতাসে ভেসে এসে তার মুখের উপর নেচে বেড়াচ্ছিল। তুমি বলতে চাও এটা এক ধরনের মাইলস্টোন?
কেইন মাথা কাত করল। এটা সেই আলেক্সিয়াস কথিত সাতটি স্তম্ভের একটি।
সে বলল, “কিন্তু তা কি করে সম্ভব? রানি শেবার সময়ে যদি স্তম্ভটি প্রোথিত হয়ে থাকে, তাহলে তো এটা প্রায় তিন হাজার বছর পুরোনো।
কেইন বলল, মরুভুমির শুষ্ক তাপের কারণে তা অবশ্যই সম্ভব। আমি মারিবে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো শিলালিপি দেখেছি। সেগুলো দেখে এমন মনে হয়েছে যেন মাত্র গত কাল কোন রাজমিস্ত্রি সেগুলো খোদাই করেছে। আরেকটা বিষয়, তুমি তো জানোই কত ঘন ঘন এখানে বালুঝড় হয়ে থাকে। এগুলি হয়তো বালুর নিচে চাপা পড়েছিল, তারপর বাইরে উঠে এসেছে, বছরের পর বছর ধরে এরকম অনেকবার হয়েছে।’
‘আর ঐ পানির বোতল আর খালি ক্যানটা সম্পর্কে কী মনে করেন? কেইনের হাতে এক প্লেট মটরশুটি তুলে দিয়ে রুথ বলল।
‘আমার মনে হয় আপনার স্বামী এগুলো এখানে ফেলে রেখে গেছেন। এটা তো আমরা জানি তিনি শাবওয়া থেকে উটে চড়ে যাত্রা শুরু করেছেন। এরপর তার যাই হোক না কেন, বোঝা যাচ্ছে তিনি এ পর্যন্ত এসেছিলেন।’
রুথ বলল, কিন্তু ঐ তিন ডাকাত?’ এরকম ডাকাততো আরো থাকতে পারে।
সে মাথা নাড়ল–তাও সত্যি। সমস্ত মানুষ ওদের ধরতে চায় বলে ডাকাতগুলো এমন জায়গায় যায়, যেখানে অন্য কোন মানুষ যেতে সাহস করে না। কিন্তু কোন এক রীতি অনুযায়ী এখান পর্যন্ত ওরাও আসে না। ওরা মরুভুমির ধারে ঘুরে বেড়ায় আর যেখানে পানি পাওয়া যায় তার কাছাকাছি থাকে। যাইহোক শুধু ইউরোপিয়ানরাই এ ধরনের পানির বোতল ব্যবহার করে। বেদুঈনরা ছাগলের চামড়ার তৈরি মশক ব্যবহার করে।
একটু পর মেরি বলল, তাহলে সবই সত্যি–শেবা আর তার মন্দির। আলেক্সিয়াস আর তার রোমান অশ্বারোহী বাহিনী!
‘হ্যাঁ, তারা হয়তো এই পথ দিয়েই গিয়েছিল। কেইন বলল।
তার কথার পর এক ধরনের ভূতুড়ে নিরবতা নেমে এল, মনে হল কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। আর একটা মুহূর্ত সে প্রায় আশা করে বসেছিল, যেন শুনতে পাবে দুরে ঘোড়ার রাশের টুং টাং শব্দ আর দেখতে পাবে বালিয়াড়ির উপরে রোমান অশ্বারোহী বাহিনী উপস্থিত হয়েছে। নেতৃত্বে আলেক্সিয়াস, তার বর্মের উপর চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে চিক চিক করছে। ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে তিনি সামনে মরুভুমির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
তারপর নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা গেল একটা নিচু লয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠা গুঞ্জন, শব্দটা বাড়তে বাড়তে কান ফাটিয়ে ফেলছে। রুথ কানিংহাম আতঙ্কে ফিরে তাকাল। মেরি তার হাতে হাত রেখে আস্বস্ত করল। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাপের পরিবর্তনের কারণে এটা হচ্ছে। বালুর একটা স্তর অন্য স্তরটির উপর উঠে যাচ্ছে।
কেইন মৃদুস্বরে বলল, ‘গান গাওয়া বালু, ভাবছি আলেক্সিয়াসও কি এটা শুনেছিলেন?
রুথ কানিংহাম বলল, তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, তিনি তেমন কাউকে পান নি যে তাকে এ বিষয়ের কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারতো।
‘একই কথা। আমার মনে হয় না তিনি এতে ভীত হতেন,’ কেইন শান্ত স্বরে বলল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে সে একটা দোমরানো সিগারেটের প্যাকেট বের করল। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এরপর আমরা কি করব।’
মেরি একটা সিগারেট নিয়ে স্পিরিট–স্টোভের আগুন থেকে ধরাল। যখন সে উঠে বসল, তখন তার মুখ দেখে মনে হল কিছু একটা ভাবছে সে। শাবওয়া থেকে এই মন্দিরটার অবস্থান আলেক্সিয়াস কতদূর বলেছিল?
‘প্রায় নব্বই মাইল, কেইন বলল।
‘আমরা এখন শাবওয়া থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল এসেছি, তাই না?
কেইন ঘাড় কাত করে সায় দিল। মেরি শুয়ে পড়ল, তার মুখ অর্ধেকটা ছায়ায় ঢেকে গেছে। একটু পর সে ধীরে ধীরে বলল, আমার মনে হয়, এখন আমাদের উচিত হবে ঘুরে গিয়ে মারিবের পথ খুঁজে বের করা। যদি অন্য স্তম্ভগুলো দাঁড়ানো অবস্থায় নাও পাই, তারপরও আমাদের উচিত আলেক্সিয়াসের বর্ণনা মাফিক ঐ মাটি খুঁড়ে গজিয়ে উঠা শিলাস্তূপটা খুঁজে বার করা।
রুথ কানিংহাম সাগ্রহে কেইনের দিকে তাকাল, আপনার কি মনে হয় আমরা তা পারব?
সে মাথা নাড়ল—না পারার তো কোন কারণ দেখি না। আমাদের হাতে যথেষ্ট তেল, পানি আছে। এখন রওয়ানা দিলে ভোরের মধ্যে সেখানে পৌঁছতে পারব। প্রচুর চাঁদের আলোয় দিনে চলার চেয়ে রাতে চলা অনেক আরামপ্রদ হবে।’
মেরি উঠে দাঁড়াল–তাহলে এ সিদ্ধান্তই হল। আমরা সবকিছু গোছগাছ। করে এখুনি রওয়ানা দেব। কেইন ঘুরতেই সে তার শার্টের হাতা ধরল। ‘তোমার একটু ঘুমানো দরকার গ্যাভিন। কয়েক ঘণ্টা আমি চালাই–তারপর আবার তুমি চালিও।
সে প্রত্যাখান করতে চাইছিল, কিন্তু ক্লান্তি তার কাঁধে ভারী একটা কম্বলের মতো চেপে বসায় আধা ঘণ্টা পর সে পেছনে মালপত্রের মাঝে সটান ঘুমিয়ে পড়ল।
মুখে একটা তিক্ত স্বাদ নিয়ে সে জেগে উঠল। কনকনে শীত, উঠে বসে সামনে ঝুঁকল। জামাল পাশেই ঢুলছে আর রুথ কানিংহাম ঘুমিয়ে রয়েছে, তার মাথা একটু পর পর পেছন দিকে হেলে পড়ছে।
সে সামনের সিটে এল। মেরি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেই সে লক্ষ করল তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। কেইনের মনের অন্তঃস্থলে এক অজানা আর তাৎক্ষণিক কোমলতা জেগে উঠল।
সে বলল, কয়টা বেজেছে?’
‘প্রায় সাড়ে তিনটা।’
সে অন্য পাশ থেকে স্টিয়ারিং হুইলটা তার হাতে নিল। তুমি সরো, আমি চালাবো। আরো এক ঘণ্টা আগেই তোমার উচিত ছিল আমাকে জাগানো।’
মেরি একটা সিগারেট ধরিয়ে কেইনের ঠোঁটে গুঁজে দিল। তারপর দুহাত ভাঁজ করে কেইনের কাঁধে মাথা রেখে তার গায়ে হেলান দিল। এখন আমি ক্লান্তি বোধ করছি।
কেইন সিগারেটে একটা টান দিয়ে মৃদু হাসল, আমার সৌভাগ্য।’
সে সন্তষ্ট হয়ে বলল, “এটা চমৎকার।
ওরা একটা সমতল এলাকা অতিক্রম করছিল। কেইন এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল আর অন্য হাত দিয়ে মেরির কাধ ধরে তাকে কাছে টেনে নিল। অনেক কিছুই তার বলার ছিল, কিন্তু কোন কিছু বলারও প্রয়োজন নেই।
একটু পর মেরি মুখ তুলে কেইনের গালে একটা চুমু খেলো। চোখে কৌতুক নিয়ে সে বলল, ‘বেচারি গ্যাভিন।’
সে বলল, “যাও তুমি! উচ্ছন্নে যাক সমস্ত নারী!
মেরি মৃদু হাসল-এটা নিয়ে আমরা এখন কি করব?
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–আর কি, যা সবাই করে তাই করব। মুকাল্লাতে ফাদার ও’ব্রায়ান আছে। তাকে দিয়ে তোমার কাজ চলবে?’
‘অবশ্যই–আমি ফাদার ও’ব্রায়ানকে পছন্দ করি,’ সে বলল। তারপর কি হবে?
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। এরপর ঘটনাপ্রবাহ আমাদের টেনে নিয়ে যাবে।’
এই ব্যাপারটা নিয়ে মেরি একটু তর্ক করতে চাচ্ছিল, তারপর সে কাঁধ ঝাঁকাল, যেন এই মুহূর্তে সে সন্তুষ্ট হয়েছে। “আচ্ছা সে দেখা যাবে।
একটু পর সে ঘুমিয়ে পড়ল আর কেইন তাকে এক হাতে ধরে রেখে উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলছিল, জীবন তাকে আবার ধরে ফেলছে। তবে ভেবে খুশি হলো যে এই পরিবর্তনে সে কিছু মনে করেনি। আগাছাভরা জমি শেষ হয়ে এলে সে ধীরে ধীরে মেরিকে এক কোনে শুইয়ে দিল। লো গিয়ারে বদল করে ট্রাকটা বালিয়াড়ির খাড়া দিক দিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল।
চাঁদ মলিন হয়ে এসেছে। পুব আকাশে ভোর ছুঁতেই দিগন্তের উপরে ছোট ছোট আলোর টুকরো দেখা দিল। অনিদ্রায় তার চোখ জুলছিল আর গত কয়েক ঘণ্টা অনবরত ট্রাক চালাবার কারণে দুই হাত ব্যথা করছিল।
একটা বালিয়াড়ির উপর এক মুহূর্ত থেমে ফিল্ড গ্লাস দিয়ে মরুভুমির চার পাশ খুঁজে দেখল। দিগন্তের উপর সুর্য উঠল, আকাশ আলোয় ভেসে যেতেই দূরে কিছু একটা চিক চিক করে উঠল। সে ফিল্ড গ্লাস ফোকাস করল। মরুভুমির ছয় সাত মাইল দূরে মাটি খুঁড়ে উঠে আসা লালচে রঙের বিশাল একটা শিলাস্তূপ দেখা গেল।
সে লো গিয়ার দিয়ে বালিয়াড়ির খাড়া ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। একদম নিচে পৌঁছার পর একটা ফাঁকের মাঝ দিয়ে ট্রাক চালিয়ে আরেকটা বালু ও আগাছায় ভরা সমতল জমিতে পৌঁছাল। এবার স্পিড বাড়িয়ে দূরের পাথরের পাহাড়টির দিকে ছুটে চলল।
টাকটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দ্রুত চলতেই সবাই জেগে উঠল। মেরি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?
সে দূরের দিকে মাথা কাত করে দেখাল–’আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি।’
রুথ কানিংহাম সামনে ঝুঁকল। সে দুহাত দিয়ে এত শক্ত করে সিটের প্রান্ত ধরে রেখেছে যে তার আঙ্গুলের গাঁটগুলো সাদা হয়ে গেছে।
শিলাস্তূপ বড় হতে হতে একটা পাহাড় সমান আকৃতি নিয়ে ওদের মাথার উপরে উঠে এসেছে, এরপর ওরা একটা গভীর গিরিখাতের মধ্যে প্রবেশ করল যা এঁকে বেঁকে এর অন্তঃস্থলে ঢুকে গেছে। কেইন ব্রেক কষে ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ করল। চারপাশ একদম নিস্তব্ধ, এক মুহূর্ত পর সে একটা রাইফেল হাতে নিয়ে মাটিতে পা রাখল—ট্রাকটা এখানে রেখে যাওয়া যেতে পারে। সামনে কি দেখতে পাবো আমরা জানি না।’
জামাল অন্য রাইফেলটা নিল, তারপর ওরা গিরিখাতের জমাট শিলাস্তরের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ রুথ কানিংহাম অবাক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উপরের দিকে দেখাল। পাথরের গায়ে ওটা কি একটা শিলালিপি নয়?
গিরিখাতের মধ্যে সূর্যকিরণ প্রবেশ করতেই পাথরের গায়ে উত্তীর্ণ শিলালিপিগুলো হঠাৎ ওদের চোখে পড়ল। কেইন কাছে গিয়ে উপরে তাকাল। এক মুহূর্ত পর সে মাথা নাড়ল। এগুলো সাবেঈন লিপি। আমরা ঠিক জায়গায়ই এসেছি।’
সে সামনে এগোল, অন্যরাও তার পিছু পিছু চলল। আরো কয়েকটা শিলালিপি ওরা পার হল। তারপর একটা পাথরের দেয়াল ঘুরে এসে থামল।
দুই পাশে স্তম্ভ শোভিত একটি প্রশস্ত পথ সামনে প্রসারিত হয়ে রয়েছে। কিছু কিছু স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছে, অন্যগুলো এখনও অক্ষত। পথের শেষ মাথায় দেখা গেল একটি বিশাল মন্দিরের প্রায় ভেঙে পড়া সম্মুখভাগ। মন্দিরটি গিরিখাতের মুখেই নির্মিত।
কেইনের মুখ শুকিয়ে গেল। এই রকম মুহূর্ত তার জীবনে কখনো আসেনি। সে দ্রুত সামনে এগোতে শুরু করল। অন্যরাও তার পিছু চলতে লাগল।
স্তম্ভশোভিত প্রশস্ত পথের শেষ মাথায়, মন্দিরের ঠিক সামনে একটি গভীর জলাধার। টলটলে পরিষ্কার পানি, কোন এক অদৃশ্য ঝর্না থেকে নেমে আসছে। সে এক লাফে জলাধারের পাশে নিচু হয়ে দুহাতে আঁজলা ভরে পানি পান করল।
পেছনে অন্যদের আসার শব্দ পেল। দুই মহিলা উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছিল। সে চেঁচিয়ে উঠল, এই পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা।
হঠাৎ তাদের কথা বলা থেমে গেল। আর কেইন মুখ তুলতেই পানিতে একটা প্রতিবিম্ব দেখে রাইফেলটা তুলতে গেল।
একটা বুলেট ছুটে এসে জলাধারের কিনারায় পাথরের টুকরো ভেঙে ফেলল। দুই হাত মাথার উপর তুলে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। জলাধারের অন্যপাশে জনাছয়েক অর্ধনগ্ন বেদুঈন দাঁড়িয়ে আছে, সবার হাতে অত্যাধুনিক লি এনফিল্ড রাইফেল। তাদের ঠিক সামনে বিদ্রুপাত্মক হাসি নিয়ে সেলিম দাঁড়িয়ে আছে।
প্লিজ বোকার মত কিছু করার চেষ্টা করো না, সে তার অতি সতর্ক কাটা কাটা ইংরেজিতে বলল।
বেদুঈনের দলটি দ্রুত জলাধার ঘুরে এপারে এল, তারপর দুভাগ হয়ে দ্রুততার সাথে কেইন আর তার সঙ্গীদের চারপাশে থেকে ঘিরে ফেলল। সেলিম ধীরে সুস্থে এগোল, এক হাত জাম্বিয়ার বাঁটে রেখে অন্য হাত দিয়ে ধীরে ধীরে দাড়ি টানতে লাগল। এক দুই ফুট দূরত্বে এসে থামতেই কেইন মৃদুস্বরে বলল-’পৃথিবীটা বেশ ছোট।
সেলিম মাথা কাত করে সায় দিল–”তোমাকে মারা বড়ই শক্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ডান হাতের মুঠো দিয়ে কেইনের মুখ বরাবর একটা ঘুসি চালালো।
কেইন কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে রইল। তারপর মাথা ঝাড়া দিতেই টের পেল কতগুলো রাইফেলের মাজল তার দিকে তাক করে রাখা হয়েছে। সে মুখ থেকে রক্ত মুছে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
সেলিম মৃদু হাসল–পুরনো একটা ঋণের ডাউন পেমেন্ট করা হলো। বাদবাকি পরে দেওয়া হবে। আমি কোন সময় ঋণ ভুলি না। সে বেদুঈনদের উদ্দেশ্যে দ্রুত কিছু নির্দেশ দিতেই ওরা গোল হয়ে কাছে এগোল। তারপর কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে বন্দিদের সামনে এগোতে বলল।
মন্দিরে ওঠার বিশাল সিঁড়ির ধাপগুলোর দিকে হোঁচট খেয়ে এগোতে এগোতে কেইন ঘটনাপ্রবাহের হঠাৎ এই পরিবর্তনের কথাটা ভাবলো। প্রথম থেকেই তার বোঝা উচিত ছিল, জন কানিংহাম হয়তো ঠিকই মরুভূমি অতিক্রম করতে পেরেছিল-তবে কোন মানুষ তার ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু এখানে সেলিম কেন? এর কোন অর্থ সে খুঁজে পেল না।
সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে পা রেখে যখন সে বারান্দা অতিক্রম করল, তখন একেবারে কাছ থেকে মন্দিরের দৃশ্য দেখার পর তার মন থেকে অন্যসব চিন্তাভাবনা দূর হয়ে গেল। মন্দিরটি পাহাড়ের মুখে তৈরি করা হয়েছে। দ্বারমন্ডপ ও পুরো প্রবেশ পথকে ঘিরে রাখা বিশাল স্তম্ভগুলো কমপক্ষে ষাট ফুট উঁচু।
মেরি ওর কাঁধের কাছে এসে হতবাক কণ্ঠে বলল–এরকম কোন কিছু আমি কখনো দেখিনি। পুরো আরবে এমন কিছু নেই যা একে স্পর্শ করতে পারে।’
কেইন ঘাড় কাত করে সায় দিল। আমার মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড মিশরীয় প্রভাব রয়েছে। একই রকম দ্বারমন্ডপ কারনাকের মন্দিরে দেখা যায়।
ভেতরে বেশ ঠাণ্ডা আর খুব নিস্তব্ধ পরিবেশ। ক্ষিণ আলোয় তার চোখ সয়ে এল। গোলাপি রঙের মার্বেল পাথরের মেঝে। সুদক্ষ মিস্ত্রির হাতে নিপুনভাবে কাটা চৌকোণ পাথরের স্তম্ভগুলো সোজা উঠে গেছে উপরে। জমকালো মূল অংশের অন্যপ্রান্তে এক বিশাল প্রতিমুর্তি অন্ধকার থেকে আবছা বেরিয়ে এসেছে।
সেলিম নির্দেশ দিতেই দলটি সেখানেই থামল। তিনজন প্রহরি ছাড়া বাদবাকি সব বেদুঈনদেরকে সে বাইরে থাকার নির্দেশ দিল। কেইনের দিকে ফিরে বলল, তোমরা সবাই এখানেই থাকবে। যদি কেউ পালাবার বা সন্দেজনক কোন কিছু করার চেষ্টা করো, প্রহরিদের নির্দেশ দেওয়া আছে সাথে সাথে গুলি করে মারবে।
কেইন বলল, “ঠিক আছে, তুমিইতো এখানে বস। তবে যাবার আগে একটা কথা আমাদের বলে যেতে পারো। মিসেস কানিংহামের স্বামীর কী হয়েছে? কেননা তার কারণেই আমাদের এখানে আসা।’
সেলিম কাঁধ ঝাঁকাল। সে জীবিত এবং সুস্থ আছে–অন্তত এই মুহূর্ত পর্যন্ত।
ক্লথ কানিংহাম সামনে এগোল। আমি কখন তাকে দেখতে পাবো? প্লিজ আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন।
তার গাল রক্তিম হলো। চোখ জ্বল জ্বল করছিল। সেলিম এমনভাবে তার দিকে তাকাল যেন এই প্রথম তাকে দেখছে। কয়েক মুহূর্ত পর সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল–এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। যদি ঠিক মত আচরণ করেন, তবে পরে তার দেখা পাবেন। এখন এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।
‘কেইন জানতে চাইল, ‘কিন্তু কেন?। ফায়ারিং স্কোয়াড, গলা কাটবে না নতুন কেউ আসবে?
সেলিম মৃদু হাসল। আমি এখানে প্রশ্নের উত্তর দিতে আসিনি। সে ঘুরে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। কেইন পকেট থেকে দোমড়ানো সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল। একটা মাত্র সিগারেট অবশিষ্ট ছিল। সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে সে মূর্তিটির দিকে তাকাল।
এরকম কোন কিছু ইতোপূর্বে সে কখনো দেখেনি। নিরেট পাথরের তৈরি। ইন্দ্রিয়পরায়ণ পুরুষ্টু ঠোঁট। উঁচু কপোলের উপরে উপরের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকানো চোখদুটো বন্ধ, যেন ঘুমিয়ে রয়েছে। হিন্দু দেবী কালী মূর্তির সাথে এর বেশ মিল রয়েছে। ইতোপূর্বে ভারতীয় বিভিন্ন মন্দিরে সে অনেকবার কালী মূর্তি দেখেছে। একটু ভুরু কুঁচকালো, এই সমস্যার একাডেমিক দিকটি নিয়ে তার মনে চিন্তা শুরু হলো। এরপর চোখে পড়ল উঁচু বেদিটা, লক্ষ করল আগুন জ্বালাবার বাঁকা ধুনচি। মনে পড়ল রোমান অশ্বারোহীদল আর সেই বৃদ্ধা পূজারিণীর কথা, যে বেদিতে আগুন জ্বালাতে রয়ে গিয়েছিল। মনে হলো সময়ের কোন অর্থ নেই। এটি একটি বৃত্ত, আপনা আপনি এর মাঝে অনন্তকাল ধরে ঘুরছে।
মেরি তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল, আমার একটা অদ্ভুত অনুভতি হচ্ছে এটা জেনে, যে সে–মানে আমি বলতে চাচ্ছি আলেক্সিয়াস হয়তো এখানেই দাঁড়িয়েছিল।’
কোন কথা না বলে কেইন ঘাড় কাত করে সায় দিল। এক মুহূর্ত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওরা একই কথা ভাবছিল। হঠাৎ দরজার কাছে একটা শব্দ শোনা গেল। কেইন ঘুরতেই দেখল ধুলিধুসরিত খাকি পোশাক পরা একজন লোক ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার মাথায় আরবি স্টাইলে কাপড় জড়ানো আর চোখ ঢাকা রয়েছে বালু নিরোধক গগলসে। কয়েক ফুট দূরত্বে থেমে সে নিশব্দে ওদেরকে লক্ষ করল,তারপর চোখ থেকে গগলস খুলল। ইনি হলেন প্রফেসর মুলার।
সে আড়ষ্টভাবে একটুখানি মাথা নোয়ালো। আশা করি ভদ্রমহিলাদের কোন ধরনের অসুবিধা হয় নি?
কেই এক পা এগোল, কিন্ত সে কিছু বলার আগেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। “আহা আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন কেইন। শেষ পর্যন্ত তুমি এখানে পৌঁছতে পারলে?’ স্কিরোজ অন্ধকার থেকে বের হয়ে এল।
.
১১.
প্রায় দুপুরবেলা দুজন প্রহরী কেইনকে নিয়ে যেতে মন্দিরে এল। ইতোপূর্বে সকালেই মেরি আর রুথ কানিংহামকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তার একটু পর জামালকেও নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রহরীদের সাথে মন্দিরে একা বসে কেইন একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বার বার ভাবছিল, কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। কোন অর্থই সে খুঁজে পেল না। যদি মুলার এই মন্দির হঠাৎ আবিষ্কার করেই থাকে, তবে সে কেন সারা বিশ্বকে এই আবিষ্কারের কথা জানাল না? এতে তো সে জগৎ বিখ্যাত হয়ে যেতো। আর স্কিরোজ আর সেলিমের ব্যাপারটাই বা কি? ওরা কীভাবে এখানে এল? সমস্যাগুলোর কোন সমাধান খুঁজে না পেয়ে অধৈর্য হয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিক এই সময়ে ওকে নিয়ে যেতে বেদুঈন দুটো ফিরে এল।
মন্দিরের ভেতরের শীতল আবছা আলো থেকে বের হয়ে প্রখর সূর্যের আলোয় তার চোখ মুহূর্তের জন্য ধাঁধিয়ে যেতেই সে সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে একটু থামল। একজন প্রহরী তাকে সামনে ঠেলতেই সে প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কয়েক ধাপ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
এই ঘটনায় লোকদুটো বেশ মজা পেল। কেইন অনেক চেষ্টা করে রাগ সামলে ওদের দুজনের মধ্য দিয়ে শান্তভাবে হেঁটে চলল। যেতে যেতে তীক্ষ্ণ দষ্টিতে সে উপত্যকার সবকিছুর দিকে নজর দিয়ে চলল।
পাথরের দেয়ালগুলোর উপর অনেক শিলালিপি খোদাই করা। কয়েক জায়গায় অন্ধকার গুহামুখ দেখতে পেল। হঠাৎ গিরিখাতের মেঝে সামান্য ঢালু হয়ে গেছে। এর নিচে একটি শূন্য গর্ভের মধ্যে একটি মরুদ্যানের সবুজ পাম গাছের কাছে কয়েকটি তাঁবু খাটানো হয়েছে দেখতে পেল।
নিচে ক্যাম্পের দিকে যেতে যেতে সে অবাক হলো লোকজন আর উটের সংখ্যা দেখে। সব দিকেই সূর্যের প্রচণ্ড তাপে ঘর্মাক্ত লোকজন ভারী ভারী বাক্স উটগুলোর পিঠে ওঠাচ্ছিল। যেন কোথাও যাবার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এখানে কয়টি গোত্রের লোক এসেছে সে গুণে শেষ করতে পারল না। রঙিন পাগড়ি পরা অর্ধনগ্ন ইয়েমনি, শরীরে উল্কি আঁকা আর নীলের ছোপ সারা গায়ে। রশিদ বেদুঈন, মুসাবেইন, বাল হারিস–সব গোত্রই রয়েছে সেখানে। দুই প্রহরী তাকে ভিড়ের মাঝ দিয়ে সামনে ঠেলতেই সবাই মাথা ঘুরিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল।
সবচেয়ে বড় তাবুটার সামনে থেমে ওরা কেইনকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করল। তাঁবুর ঝাঁপ সরিয়ে কেইন ভেতরে ঢুকল। ছোট একটা ফোল্ডিং টেবিলে বসে কফি পান করতে করতে মুলার ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভাঙ্গা মৃৎপাত্রের একটা টুকরা পরীক্ষা করছিল। সে মুখ তুলেই মৃদু হাসল, ‘আহ, কেইন এসো এসো! ভেতরে এসো!
কেইন উল্টোদিকে একটা ক্যাম্প টুলে বসল। মুলার কফির পট তুলে আবার মৃদু হাসল–কফি?’ কেইন সায় দিতেই একটা কাপ ভরে সামনে ঠেলে দিল।
কেইন সামনে ঝুঁকে টেবিলে দুহাত রেখে বলল–’মহিলা দুজনকে নিয়ে তোমরা কি করেছো?
মুলার ব্যথিত চেহারা নিয়ে বলল, “আমরা বর্বর নই। কাছেই একটা তাবুতে তাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে। মন্দিরের চেয়ে এখানে তারা আরামে থাকবেন।
‘অসীম দয়া তোমার, কেইন বলল। আর কানিংহামকে কি করেছো?’
‘এখন আমরা তার কাছেই যাচ্ছি, মুলার শান্ত স্বরে বলল। তবে প্রথমে স্কিরোজ তোমার সাথে দেখা করতে চায়।
কেইন বলল। আচ্ছা এখানে আসলে কি হচ্ছে বলো তো?
মুলার উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাট হাতে নিল। সে জন্যইতো আমি তোমাকে ডেকে আনতে বলেছি বন্ধু, এখনই সব জানতে পারবে।
সে তাঁবুর ঝাঁপ ঠেলে বেরুতেই কেইন তাকে অনুসরণ করল। মরুদ্যানের মধ্য দিয়ে ওরা সামনেই গিরিখাতের এক পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। দুই বেদুঈন ঠিক পেছনে পেছনে আসছে। ভারী ভারী বাক্স কাঁধে করে লোজন ওদের পাশ কাটিয়ে নিচের মরুদ্যানের দিকে যাচ্ছিল।
ওরা একটা সরু র্যাম্পের উপর উঠল, যেটা সম্ভবত নিরেট পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। উপরে একটা গুহায় ঢুকবার মুখ, পাশে প্রহরী দাঁড়ানো। কোমর পর্যন্ত খালি গায়ে অনেক মানুষ কাজ করছে। লোকগুলো আরো বাক্স টেনে এনে এখানে গাদা করে রাখছে। তারপর সেগুলো নিচে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুলার ওদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগোল আর কেইনও সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করে চলল।
গুহাটা বেশি বড় না হলেও চারপাশে বিভিন্ন ধরনের টেকনিকেল যন্ত্রপাতি সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। স্কিরোজ একটা জটিল শর্ট-ওয়েভ ট্রান্সমিটিং ও রিসিভিং সেটের সামনে বসে রয়েছে। ওরা ভেতরে ঢুকতেই সে মাথা থেকে ইয়ারফোন খুলে রিভলভিং টুলটা ঘুরিয়ে তাকাল। এই যে ক্যাপ্টেন কেইন। তুমি এসেছো তাহলে?
তার মুখে কৌতুকপূর্ণ মৃদু হাসি দেখা দিল, যেন কোন পার্টি চলছে আর কেইন বহু প্রতিক্ষিত একজন অতিথি।
কেইন বলল, তোমরা তো বেশ ভাল একটা সেটআপ গড়ে তুলেছো?’।
স্কিরোজ মাথা নেড়ে সায় দিল। এটি নিয়ে আমরা গর্বিত।’ বুক পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে সামনে ধরল–সিগারেট?
কেইন একটা সিগারেট নিয়ে বলল, “আচ্ছা তোমাদের কি এখনো সময় হয় নি এখানে কি চলছে সে সম্পর্কে আমাকে কিছু বলার?
স্কিরোজ মাথা নাড়ল। তাতে অবশ্যই। এখানে আর কি জন্য তোমাকে আনা হয়েছে?’ স্তূপীকৃত বাক্সগুলো দেখিয়ে সে বলল, “নিজেই খুলে দ্যাখো।’
ধাতুর তৈরি বাক্সগুলো হালকা ছাই রঙের। কেইন একটা বাক্স সামনে টেনে ঢাকনিটা খুলল। বাক্স ভর্তি সুন্দর করে সাজানো সদ্য ফ্যাক্টরি থেকে আনা নতুন, গ্রিজ মাখা চকচকে রাইফেল। পরের বাক্সটায় রয়েছে সাবমেশিন গান।
সে একটা তলে পরীক্ষা করল–জার্মানিতে তৈরি। সে ঘুরে কঠিন চোখে তাকাল। আমি তোমাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ দেশের বাইরে বেআইনীভাবে পাচার করছে, কিন্তু এই…’।
স্কিরোজ আত্মতুষ্টির হাসি দিল। হ্যাঁ। এটি সত্যি একটা বিশাল ব্যাপার, তাই না? আমরা সত্যি ভাগ্যবান যে, এরকম একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম। এ জন্য মুলারকে ধন্যবাদ।’
‘কানিংহাম আসা পর্যন্ত। এটা নিশ্চয়ই তোমাদেরকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল।’
স্কিরোজ মাথা নাড়ল। সামান্য একটু অসুবিধা হয়েছে। ব্যস আর কিছু না।’
কেইন আবার ঘুরে স্থূপীকৃত অস্ত্রশস্ত্রের বাক্সগুলোর দিকে ফিরে একটা বাক্সের গায়ে লাথি মারল। আমার মনে হয় এ কারণেই ওমান সীমান্তে বিভিন্ন উপজাতির সাথে ব্রিটিশদের এত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে?
স্কিরোজ মৃদু হাসল। আমরা আমাদের তরফ থেকে যথাসাধ্য করছি। তবে এই অস্ত্রগুলো আমাদের সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন গোত্রদের প্রতি পারিশ্রমিক বলতে পারো। এরপর এগুলো নিয়ে ওরা কি করে তা ওদের নিজেদের ব্যাপার।’
কেইন আবার বাক্সগুলোর দিকে তাকাল–ঐ সাবমেশিনগুলো জার্মানির তৈরি?
‘এম পি ৪০, সর্বশ্রেষ্ঠ।
‘তাহলে তুমি গ্রিক নও?
‘আমার মা ছিল গ্রিক, তার নাম ছিল স্কিরোজ। তবে আমি বলতে গর্ব বোধ করি যে আমার বাবা একজন জার্মান ছিলেন। তার নাম যাই হোক না কেন?’
কেইন ঘুরে মুলারের দিকে তাকাল। সে পাশেই নিরবে দাঁড়িয়েছিল। ‘এখানে মুলারের ভুমিকা কী?
‘অত্যন্ত পরিষ্কার। এই জায়গাটার অস্তিত্ব সে আবিষ্কার করেছে একজন বুড়ো বেদুঈনের কাছ থেকে। এক রাতে পিপাসায় মৃতপ্রায় অবস্থায় লোকটা শাবওয়ার কাছে ওর ক্যাম্পে এসে পড়ে।
কেইন বলল। ঈশ্বরের দোহাই লাগে মুলার, কী কারণে তুমি এরকম একটা শকুনের সাথে কারবার করতে পারলে? ইউরোপ আমেরিকার এক ডজন ফাউন্ডেশনের যে কোন একটি খুশি হয়ে তোমাকে আর্থিক সহায়তা দিত।
মুলারকে বিব্রত দেখাল–এর কিছু কারণ ছিল।’
‘অবশ্যই ছিল, স্কিরোজ হেসে উঠল। তুমি যেহেতু এখান থেকে কোথাও যেতে পারছে না, কাজেই সত্যি কথাটা তোমাকে না বলারতো কোন কারণ আমি দেখি না, প্রিয় বন্ধু। আমার মতো প্রফেসারও একজন জার্মান–একজন ভাল জার্মান। আমরা থার্ড রাইখ এবং আমাদের ফুয়েরার এডলফ হিটলারের সেবা করি।’
কেইন বলল, ‘মাই গড।’
‘আমি এবহোয়েরের হয়ে কাজ করি, তুমি জানো সেটা কি?
“জার্মান সামরিক গোয়েন্দা।
‘একদম ঠিক। আগামি যুদ্ধে আমরা জিতবো বন্ধু। আগামি পরশু পয়লা সেপ্টেম্বর। সেদিন আমরা পোলাভে অভিযান চালাচ্ছি।’
কেইন বলল, ‘পাগলামি, তোমরা সবাই একসাথে নরকে যাবে।
‘আমার তা মনে হয় না। দ্যাখো আমাদের বড় বড় ব্যাটালিয়ান আছে। আরো আছে ক্যাপ্টেন কার্লোস রোমেরো আর তার বন্ধুরা। এরা এস, এস, স্পেনিশ ভলান্টিয়ার। ওরা আগামিকাল ক্যাটালিনাতে এখানে পৌঁছাবে। তারপরের দিন ওরা সুয়েজ খালে ল্যান্ড করবে, সমস্ত খালে মাইন পুঁতবে তারপর সেটা উড়িয়ে দেবে। এ ঘটনার পর মিশরে আর লন্ডনে আমাদের ইংরেজ বন্ধুরা আঙুল চিবোবে।
কেইন অনেক চেষ্টা করল পুরো বিষয়টা বুঝতে। এটা আমার বিশ্বাস হয় না।’
‘তাতে আমার কিছু আসে যায় না।’
কেইন একটা লম্বা শ্বাস নিল–এখন কী হবে?
‘তোমার?’ স্কিরোজ কাঁধ ঝাঁকাল। দুই একদিন মুলার তোমার সহায়তা নেবে, তবে তারপর…’ তার কণ্ঠস্বর ভেসে গেল আর সে এমনভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেন সে খুবই দুঃখিত হয়েছে।
‘সেটা খুব একটা ভাল কাজ হবে না, কেইন বলল।
স্কিরোজ ভুরু একটুখানি উপরে তুলল। আমার মনে হয় এ কথা বলার পেছনে তোমার কোন কারণ আছে?
কেইন চেষ্টা করল নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ করতে। আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি, সেকথা জানিয়ে এডেনের আমেরিকান কনসালকে আমি একটা চিঠি পাঠিয়েছি। সে কাঁধ ঝাঁকাল। এটা স্বাভাবিক সতর্কতা–তুমিতো জানোই মরুভুমিতে যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে।
‘তুমি মিথ্যা বলছো।
কেইন মাথা নাড়ল। মনে পড়ে আমি তোমাকে চিঠিটা দিয়েছিলাম মেইল ব্যাগে ভরার জন্য?
‘তুমি খুব চালাক বন্ধু,’ স্কিরোজ বলল মৃদু কণ্ঠে।
মুলারের চেহারায় পুরোপুরি ভীতি ফুটে উঠেছে। সে গোলাবারুদের একটা বাক্সের উপর বসে পড়ল আর রুমাল দিয়ে মুখ আর ঘাড় থেকে ঘাম মুছলো। ‘আমাদের এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে। তার গলা কাঁপছিল।
‘এতো ঘাবড়িও না।’ স্কিরোজ একটা সিগারেট নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে প্যাকেটের উপর টোকা দিতে থাকল।
কেইন মৃদু হাসল। আমরা যদি একটা যুক্তিযুক্ত সময়ের মধ্যে ফিরে না যাই। তখন এডেনের আমেরিকান কনসাল নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তারা অবশ্যই আমাদের খুঁজতে আসবে।
স্কিরোজ মৃদু হাসল–একেবারে সঠিক। তুমি নিজেই পয়েন্টটা তুলে ধরেছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পার না হওয়া পর্যন্ত কনসাল কোন পদক্ষেপ নেবে না।’
কেইন মনে মনে নিজেকে অভিশাপ দিল কারণ স্কিরোজ ঠিকই বলেছে আর সেটা সে জানে। মুলারের চেহারা থেকে ভীতির ভাব চলে গেল। সে বলে উঠল। হায় ঈশ্বর, তুমিতো ঠিক বলেছো।
স্কিরোজ মাথা নাড়ল। অবশ্যই ঠিক বলেছি। কমপক্ষে এক মাসের আগে আমেরিকান কনসাল কোন পদক্ষেপ নেবে না। আর এদিকে আমরা দুদিনের মধ্যে চলে যাবো।
‘দুই দিন!’ মুলার বলল। এ কথা শুনে তাকে বেশ আহত মনে হলো। ‘তাহলেতো আমার হাতে বেশি সময় থাকবে না। আমি জানি না এর মধ্যে আমাদের কাজ সেরে ফেলতে পারব কি না।
‘সত্যি বলতে কী, মুলার। আমাদের চলে যাওয়ার আগে তোমার সেই জঘন্য সমাধি তুমি খুঁড়ে দেখতে পারো কী না তাতে আমার কোন আগ্রহ নেই।’
‘অন্য দুজনের সাথে আমি কেইনকে কাজে লাগাতে পারি না?’ মুলার জিজ্ঞেস করল।
স্কিরোজ কেইনের দিকে ফিরল। আমি নিশ্চিত এ বিষয়ে তোমার কোন আপত্তি নেই। কেননা এ ধরনের কাজের সাথে তোমার কাজের ধরনের মিল আছে।’
কেইন কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে সে হার মানল। ‘আমার মনে হয় এটা তোমার রাউন্ড।
স্কিরোজ সেঁতো হাসল। ঠিক তাই কেইন। বিষয়টা নিয়ে একজন দার্শনিকের মতোই ভাবো। তারপর তার চেহারা বদলে গিয়ে কঠোর হলো। ‘এখন তোমরা যাও। আমার অনেক কিছু করার বাকি আছে।
সে চেয়ারে ঘুরে বসে ইয়ারফোনটা তুলে নিল। মুলার কেইনের কাঁধে একটা টোকা দিয়ে তাকে বাইরে যাবার পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ডান দিক ঘুরে একটা চওড়া পথ দিয়ে এগিয়ে চলল। আরেকটা গুহার প্রবেশ মুখে দুজন সশস্ত্র প্রহরী আসন পেতে বসে রয়েছে। গুহাটার উচ্চতা চার ফুটের বেশি হবে না, কেইন নিচু হয়ে ভেতরে উঁকি দিল।
মুলার রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বিব্রতকরভাবে বলে উঠল–এ সবের জন্য আমি দুঃখিত, কেইন।
কেইন তাকে বলল, তোমার স্বীকারোক্তি শোনার মত আমার মেজাজ নেই। এখন কী করতে হবে সেটা বলো।
প্রবেশ পথের মুখেই একটা স্পট ল্যম্প ছিল। মুলার সেটা জ্বালিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল! গুহাটা দৈর্ঘ্যে ত্রিশ কিংবা চল্লিশ ফুট আর ছাদটা ওদের মাথা থেকে দুই ফুট উঁচু হবে। ল্যাম্পের শক্তিশালী আলো দেয়াল দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে তারপর হঠাৎ চমকে ওঠার মতো তীর ধনুক হাতে দুজন মানুষের অঙ্কিত চেহারা দেয়ালে ভেসে উঠল।
কেইন সামনে এগিয়ে আগ্রহের সাথে অঙ্কিত চিত্র দুটো পরীক্ষা করল। বহুবর্ণের ওয়াল পেইনটিঙ,’ অত্যন্ত যত্নের সাথে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে বলল। ‘খুব ভাল ভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।
এর কি তারিখ তুমি ধারণা করো?’ মুলার জিজ্ঞেস করল।
ক্ষণিকের জন্য শত্রুতা ভুলে গিয়ে কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। বলা শক্ত। একই ধরনের জিনিস আমি সাহারার হোগার্ট পাহাড়ে দেখেছি তবে দুটোর মাঝে তুলনা করা কঠিন। এটুকু অন্তত বলা যায় কমপক্ষে আট হাজার। বছর আগের, এরকম চিত্রকর্ম আর কি আছে?
মুলার বাতিটা ঘুরিয়ে পাথরের গায়ে কয়েকটা এচিং দেখাল। তারপর বাতির আলো এসে থামল গুহার শেষ মাথায় একটা সরু প্রবেশ পথের ধারে পাথরকুচির একটা স্তূপের উপর। আমার মনে হয় এটা তোমার কাছে আরো বেশি আকষণীয় মনে হবে।
কাজটা মানুষের করা তা বোঝাই যাচ্ছে আর রাজমিস্ত্রির হাতে তৈরি পাথরের ব্লক সরিয়ে একটা পথ করা হয়েছে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য।
তুমি কী মনে করো এটা একটা সমাধির প্রবেশ পথ?’ কেইন বলল।
‘আর কী হতে পারে?’ মুলার বলল। মন্দিরটা বেশি পুরোনো না হলেও সাবেঈন যুগের তো বটেই। যদি এই উপত্যকা একটা পবিত্র স্থান হয়ে থাকে, তাহলে স্বভাবতই ধরে নেওয়া যায় এখানে গোর দেওয়া হত।
গুহায় ঢোকার পর থেকেই কেইন একটা ক্ষিণ শব্দের আভাস পাচ্ছিল। এবার সে দেখল গুহাপথ দিয়ে একটা আলো এগিয়ে আসছে। জামাল আবির্ভুত হলো। ওর এক হাতে একটা বাতি আর অন্য হাত দিয়ে খোয়া ভর্তি একটা বিরাট ঝুড়ি টেনে আনছে। এক মুহূর্ত থেমে ওদের দিকে শান্তভাবে তাকাল। তার বিশাল শরীর ধুলা আর ঘামে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। ঝুড়িটা সেখানে খালি করে সে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
‘আমার ধারণা কানিংহামও সেখানে আছে, কেইন বলল।
মুলার মাথা নেড়ে সায় দিল। অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও তার সাহায্যে গত কয়েক সপ্তাহে আমাদের কাজ অনেকটা এগিয়েছে।
‘আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না, কেইন বলল। তোমাদের ক্যাম্পেতো অনেক বেদুঈন আছে। সেখান থেকে কয়েকজনকে নিয়েও তো শ্রমিকের কাজ করাতে পারতে?’
মুলার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রথম কথা, আমার কাজের প্রতি স্কিরোজের খুব একটা সহানুভূতি নেই আর সে অনুমতি দিতে রাজি হয় নি। তাছাড়া লোকগুলো ভীষণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাদের বিশ্বাস এই গুহাগুলোতে বদ আত্মারা যাতায়াত করে।
কেইন উত্তর দেবার আগেই পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল–যদি তুমি ছাদটা ভালভাবে পরীক্ষা করো তাহলে এখানে তাদের কাজ করতে না আসার ভাল একটা কারণ খুঁজে পাবে। কেউ একটা কাশি দেওয়া মাত্রই ছাদশুদ্ধ পুরো জিনিসটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।
গুহাপথ থেকে মাঝারি উচ্চতার একজন লোক বেরিয়ে এল, কোমর পর্যন্ত খালি গা আর সারা শরীর জামালের মতো আপাদমস্তক ধুলোয় মাখামাখি হয়ে রয়েছে।
মুলার মন্তব্যটি উপেক্ষা করল। কাজ কেমন এগোল আজ, কানিংহাম?
‘কাল কিংবা পরশুর চেয়ে ভাল নয়,’ কানিংহাম উত্তর দিল। আমার যদুর ধারণা, খুব তাড়াতাড়ি আমরা কোথাও পৌঁছাতে পারছি না। যদি তুমি এই কাজে কোথাও পৌঁছাতে চাও তাহলে একদল শ্রমিক আর নিউমেটিক ড্রিল মেশিন লাগবে।
‘তোমার সাথে আমি একমত বন্ধু, কিন্তু কি করব বলো?’ মুলার বলল। যাইহোক আজ নতুন একজনকে আনলাম। এধরনের কাজে কেইনের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। আমি নিশ্চিত তোমরা দুজনে মিলে কিছু একটা উপায় বের করতে পারবে।’
কেইন বলল, “আমি তোমাকে একটা কথা জানাতে চাই আমি কিন্তু অনেকক্ষণ না খেয়ে আছি।’
একটু পরেই, দুপুরবেলা আমি কিছু খাবার পাঠাবার ব্যবস্থা করছি, মূলার বলল। এর বদলে আমি অবশ্যই কিছু ফলাফল দেখতে আশা করি। তারপর সে ওদেরকে ফেলে চলে গেল।
কানিংহাম দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত দিয়ে মুখ মুছলো। আপনি আবার কে? আজ সকালে যে বিশালদেহি লোকটাকে ওরা এখানে রেখে গেল তার সাথে আপনার কোন সম্পর্ক আছে নাকি? ঐ লোকটার মুখ থেকে আমি একটা শব্দও বের করতে পারি নি।
‘এতে অবাক হবার কিছু নেই। তার জিহ্বা নেই। তবে সে ঠিকই শুনতে পাবে যদি আপনি সোমালি কিংবা আরবিতে কথা বলেন।
কানিংহাম হেসে উঠল–”আচ্ছা তাই বলুন। আমার আরবি অবশ্য খুব একটা খারাপ নয়। তবে সোমালির ব্যাপারে আমাকে ক্ষমা করতে হবে।’
কেইন হাত বাড়াল। আমার নাম কেইন, সে বলল। আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য আপনার স্ত্রী আমাকে নিযুক্ত করেছেন। এডেনের ব্রিটিশ কনসালের কাছে রেখে আসা আপনার চিঠিটা পাবার পরই তিনি আমার কাছে আসেন।
কানিংহাম সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার আভাস। রুথ পাঠিয়েছে আপনাকে? আপনি কি তাকে এর মধ্যে দেখেছেন?
‘মাত্র দুঘণ্টা আগেই তার সাথে আমার দেখা হয়েছে, কেইন তাকে জানাল। তিনি উপরেই আছেন মেরি পেরেট নামে আমার এক বন্ধুর সাথে। দুর্ভাগ্যবশত মুলার আর স্কিরোজ আমাদের সবাইকে আটকে রেখেছে।
কানিংহাম জানতে চাইল, কেমন আছে সে? ঠিক আছেতো?”
‘শেষ যখন তাকে আমি দেখি তখন তার মানসিক অবস্থা ভালই ছিল, তবে আপনার ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন।’
কানিংহাম জঞ্জালের স্তূপের উপর বসে পড়ল। পুরো ব্যাপারটা দয়া করে আমাকে খুলে বলুন।
কেইন দ্রুত তাকে সব কিছু খুলে বলল, সেই দাহরানের জেটিতে রুথ কানিংহামের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে আর একটু আগে স্কিরোজ যা বলেছে সবই জানাল।
তার বলা শেষ হলে কানিংহাম বলল, এ তো বিরাট এক কাহিনী।
কেইন মাথা নাড়ল–’আমিও তাই মনে করি। কিন্তু আপনার কি হয়েছিল?
কানিংহাম তিক্ত হাসি দিয়ে বলল, আমি একজন মহা বোকা, এখন অবশ্য তাই মনে হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে কারো সাহায্য ছাড়াই এই জায়গাটা আমি একাই আবিষ্কার করতে পারব। বার আল-মাদানিতে পৌঁছে বুঝতে পারলাম, মরুভুমির মাঝে একা প্রবেশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট সাহসী কিংবা যথেষ্ট বোকা রশিদ গোত্রের একজন বেদুঈনকে সঙ্গী হিসেবে খুঁজে পেলাম।’
‘আমার ধারণা আপনি বিরান এলাকার মধ্য দিয়ে শাবওয়া থেকে মারিব পর্যন্ত সরাসরি একটা পথ বেছে নিয়েছিলেন, তাই না?
কানিংহাম সায় দিয়ে বলল, ‘আশ্চর্যজনকভাবে এটা সহজ ছিল। আমাদের সাথে অতিরিক্ত একটা উট আর প্রচুর পানি ছিল। দ্বিতীয় দিনেই আমরা সেই স্তম্ভটা খুঁজে পেয়েছিলাম।
যার কাছে আমরা এলুমিনিয়ামের পানির বোতলটা পাই?
কানিংহাম মাথা নাড়ল, সে রাতে সেখানেই ক্যাম্প করেছিলাম। বোতলটা খালি ছিল আর আমরা ওজন কমাচ্ছিলাম। সত্যি বলতে কি আমি আর কোন স্তম্ভ অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাবো বলে আশা করিনি।’
‘কেবল সেটাই আমরা দেখেছিলাম, কেইন তাকে জানাল।
‘আমি অবশ্য আরেকটা খুঁজে পেয়েছিলাম, কানিংহাম বলল। মাটিতে অর্ধেক পোঁতা অবস্থায় সেটা এক পাশে কাত হয়ে পড়ে ছিল।
‘এখানে আসার পর কী হলো?
‘এটা একটা বিশ্রি ঘটনা বলতে পারেন। গিরিখাতে ঢুকতেই ওরা চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলল। আমার রশিদ বেদুঈনটা বেশ সাহসী ছিল। সে বাধা দিতে চেষ্টা করতেই ওরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলল। পরদিন স্কিরোজ আসা পর্যন্ত আমাকে একটা অব্যবহৃত কুয়ার নিচে ঠাণ্ডা গুদামঘরে আটকে রাখল। আপনি যে ক্যাটালিনার কথা বলছিলেন, আমি এখানে আসার পর সেটা গিরিখাতের বাইরে সমতল ভূমিতে দুবার ল্যান্ড করেছিল। আমার ধারণা স্কিরোজ আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু পরে মুলার এসে জানাল সে আমাকে তার কাজে ব্যবহার করতে পারবে। তখন স্কিরোজ তাকে তার মতো চলতে দিল।
‘আমার আশঙ্কা আপনি ভয়ঙ্কর দিনটা কেবল কিছু সময়ের জন্য স্থগিত করেছেন, কেইন তাকে বলল।
কানিংহাম কাঁধ ঝাঁকালো। আমার কি হবে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, আমার শুধু দুশ্চিন্তা রুথকে নিয়ে।
কেইন সায় দিল। বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। তবে এখনো আমাদের আশা আছে। একদম শেষ হয়ে যাই নি। কিছু একটা উপায় আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। রাতে ওরা আপনাদের কোথায় থাকতে দেয়?
কানিংহাম একটু হাসল–এক সপ্তাহ আগেও বেদুঈনদের পাহারায় একটা তাবুতে ঘুমাতাম। এক রাতে পালাতে চেষ্টা করে বেশি দূর এগোতে পারলাম না। তারপর থেকেই কুয়ার ভেতরে থাকতে হচ্ছে।’
‘খুব একটা আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে না, কেইন বলল।
কানিংহাম বলল। অন্তত এই কুয়াটা শুকনো। তবে আমার ধারণা এক দেড় হাজার বছর আগেও হয়তো এতে কোন পানি ছিল না। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে হাত পা লম্বা করে আড়মোড়া ভাঙল। চলুন আমরা বরং কাজে লেগে পড়ি। মুলার কিন্তু আশ্চর্য রকম খারাপ হতে পাওে, যদি সে মনে করে যথেষ্ট কাজ হয় নি।
সে স্পট ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে পথ দেখিয়ে এগোল। প্যাসেজটা সম্ভবত ষাট সত্তর ফুট লম্বা আর একটু ঢালু হয়ে নিচে চলে গেছে। একেবারে শেষ মাথায় জামাল একটা ঝুড়ি ভর্তি করছিল। তার গাইতির ফলা স্পটলাইটের আলোয় ঝলসে উঠছিল। দুজন মানুষ পাশাপাশি কাজ করার মতো যথেষ্ট জায়গা নেই। ওদের আসার শব্দে জামাল ঘুরে তাকাল। কেইন তার কাঁধে একটা চাপড় দিতেই সে আবার মাটি খোঁড়ার কাজে ফিরে গেল।
কানিংহাম বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়।
কেইন একটা বাতি হাতে নিয়ে খুব কাছে থেকে দেয়ালটা পরীক্ষা করল, তার ভুরু কুঁচকে উঠল। আমি শাবওয়া অঞ্চলের পাহাড়গুলোতে অনেক পাথুরে সমাধি খনন করেছি। কিন্তু এ ধরনের প্রবেশ পথ কখনো খুঁজে পাই নি।
কানিংহাম সায় দিল–”আমিও মনে করি মুলার ভুল করছে। এমনকি সে এটাও জানে না যে শেবার রানি বিলকিস এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু আমি জানি।
‘আজ সারা দিনে এটাই প্রথম মন ভালো করার মতো কথা শুনলাম, কেইন তাকে জানাল। কিন্তু আমি নিজেও জানতে চাই এই টানেলটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে।
‘তা জানার একটি মাত্র উপায় আছে, তার হাতে একটা বেলচা দিয়ে কানিংহাম বলল।
কেইন একটু থেমে কোমর পর্যন্ত পোশাক খুলে জামালের পাশে গিয়ে খুঁড়তে শুরু করল।
.
এদিকে বার্লিনে, টুরপিজ উফারে ক্যানারিস তার ডেস্কে কাজ করছিলেন, এমন সময় রিটার ঘরে ঢুকল। সে বলল, “আমি এখুনি স্কিরোজের কাছ থেকে খবর শুনে এলাম।
এডমিরাল সোজা হয়ে বসলেন—’সব কিছু সময় মেনে হচ্ছে তো?”
‘একদম ঠিক মতো।
ক্যাটালিনা ছেড়ে আসার পর রোমেরো আর তার সঙ্গীদের কী হবে?
‘আমাদের মিশরীয় ব্যুরোর একজন সদস্য ওদেরকে তুলে নিয়ে সোজা ড্রাইভ করে ইটালীয় এলাকায় নিয়ে যাবে।’
ক্যানারিস মৃদু হেসে বললেন, ‘চমৎকার। তাহলে আর বেশি দেরি নেই, হান্স।’
‘না, হের এডমিরাল।
‘তাহলে কাজ চালিয়ে যাও। ক্যানারিস বললেন। তারপর রিটার বের হয়ে গেল।
.
১২.
মুলার যখন ওদেরকে নিচে ক্যাম্পে নামিয়ে দিয়ে গেল, তখন গিরিখাতের পাশ দিয়ে আকাশে চাঁদ ওঠার পর এর স্নিগ্ধ আলোয় উপত্যকা ভরে উঠল। গুহা থেকে বের হয়ে কেইন ক্লান্ত পেশীগুলোকে একটু আরাম দেবার জন্য একটা টানা দিল। তারপর চন্দ্রালোকিত মন্দিরটির দিকে তাকাল। এটা দেখতে অপুর্ব সুন্দর আর সম্ভ্রম জাগিয়ে তুলে, কিন্তু প্রহরীরা অন্য কিছু মনে করল। রাইফেলের বাট দিয়ে তার পেছনে জোরে একটা গুতা মেরে তাকে নিচে যেতে বাধ্য করল।
উপত্যকার চারধার নিরব হয়ে আছে। ছায়া আর একাকীত্ব মরুভূমি থেকে এসে ঢুকলো। ওরা তাঁবুগুলোর মধ্য দিয়ে গাছগুলোর মাঝে প্রবেশ করল। কোথাও একটা উট কেশে উঠল। একজন আরব জলাধারে হাঁটু পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গা ধুচ্ছিল। সে কৌতূহলী হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখল।
গাছগুলোর অন্যপাশে পৌঁছার পর ওরা ঘোড়ার খুড়ের আকৃতির একটা ছোট পাহাড়ের কাছে এসে থেমে দাঁড়াল। পাহাড়টা গোলাকার, কালো, প্রায় পাঁচ ফুট ব্যাসের একটা গর্তকে ঘিরে রয়েছে। কাছাকাছি একটা খেজুর গাছের সাথে একটা মোটা দড়ি বাঁধা রয়েছে। একজন প্রহরী দড়ির মুক্ত অংশটা তুলে নিয়ে নিচে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলল। প্রথমে কানিংহাম নামল। দুহাতে শক্ত করে দড়িটা ধরে গর্তের কিনারা দিয়ে দড়ি বেয়ে বেয়ে নামল। জামাল নামার পর মুলার কেইনের দিকে তাকিয়ে দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে এক বিশেষ ভঙ্গিতে বলল–এসবের জন্য আমি দুঃখিত বন্ধু, কিন্ত স্কিরোজ এ ব্যাপারে খুব জোর দিয়েছে। সে তোমাকে অত্যন্ত রিসোর্সফুল একজন লোক মনে করে।
“ঠিক আছে, আর বেশি বলার দরকার নাই, কেইন ঠাণ্ডা স্বরে বলল। সে দড়িটা তুলে নিয়ে আর একটা কথাও না বলে নামতে শুরু করল।
কঠিন শিলাস্তর কেটে খনি গহ্বরটা তৈরি করা হয়েছিল। সে সহজেই দেয়ালের গায়ে পা ঠেকিয়ে নামতে পারল। একবার একটু থেমে গোলাকার মুখ দিয়ে দেখতে পেল উপরে আকাশে তারাগুলো জুল জুল করছে আর তার পর পরই হঠাৎ মনে হলো তারাগুলো অনেক দূরের। নিচে হালকা নড়াচড়ার আভাস পেল।
গর্তটা দুপাশে একটু ছড়িয়ে যেতেই কয়েকটা হাত ওর পা ধরে নিচের দিকে নামাল। নরম বালুতে নেমে দাঁড়াতেই হতেই দড়িটা তার মুখে জোরে একটা ঘসা দিয়ে উপরে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। অপ্রীতিকর এই পরিস্থিতিতে সে হঠাৎ পেছনের দিকে একটু হটতেই কারও দেহের সাথে ধাক্কা লাগল।
কানিংহাম বলল, যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। ওরা এরপরই একটা ঝুড়ি ভর্তি খাবার নামাবে। এক মুহূর্ত পর সে সন্তুষ্টি নিয়ে বলল হ্যাঁ পেয়েছি!’ সে কেইনের কনুই ধরল। সাবধানে ছয় পা এগোলেই আপনি দেয়ালটা পাবেন।’
কেইন সামনে হাত বাড়িয়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে চলতে লাগল, যতক্ষণ না তার আঙুল পাথরে ঘসা খেল। সে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসল, পাশেই জামাল বসে ছিল। তারপর কানিংহাম মিলে সবাই খাবারগুলো ভাগাভাগি করে খেতে শুরু করল। খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর ওরা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বসল।
কেইন বলল, কখনো এখান থেকে বের হতে চেষ্টা করেছেন?’।
কানিংহাম উঠে দাঁড়াল। দিনে হলে আপনাকে দেখাতে পারতাম। আমাদের মাথার উপরে গুহাটা প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া। এত চওড়া না হলে হয়তো মূল গুহা বেয়ে ওঠা যেত। বাকি পথটা বেশ সরু আর দুপাশের দেয়াল এবড়ো থেবড়ো পাথর দিয়ে গাঁথা।
কেইন পকেট হাতড়ে একটা ম্যাচবুক বের করল। প্রথম কাঠিটা জ্বেলে সে মাথার উপরে তুলে ধরল। কানিংহামের কথাই ঠিক। খনিকূপের নিচের অংশটি বেশ চওড়া। দেশলাই কাঠিতে তার আঙুল পুড়তেই সে উহ্ করে কাঠিটা ফেলে দিল।
কানিংহামের দিকে ফিরল। আপনি বুঝতে পেরেছেন আমাদের হাতে সময় নেই?’ বড় জোর আর একটা দিন হাতে আছে। সত্যি বলতে কি আমাদের হাতে দুটো পথ রয়েছে। হয় এই গর্ত থেকে আমরা বের হবো আর নয়তো মরবো।’
কানিংহাম বলল, আমি আপনার সাথে আছি। কিন্তু কীভাবে কি করবেন?
কেইন জামালের কাছে গিয়ে ওর সামনে আসন গেড়ে বসল, তারপর ধীরে ধীরে পরিষ্কার আরবিতে তার সাথে কথা বলতে শুরু করল। তার কথা বলা শেষ হলে বিশালদেহী জামাল তার কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে ইঙ্গিত করল যে সে সব বুঝেছে। তারপর সে উঠে দাঁড়াল।
কেইন কানিংহামের দিকে ফিরল। জামাল অসাধারণ শক্তিশালী। সে হয়তো আমাকে উপরের দিকে ঠেলে তুলতে পারবে যাতে আমি উপরে সরু অংশের কোন জায়গার দেয়ালে হাত দিয়ে ধরতে পারি। আমি তার কাঁধে চড়বো আর আপনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমাকে স্থির হতে সাহায্য করবেন।
‘আমার মনে হয়, প্ল্যানটা ভালই,’ কানিংহাম বলল।
জামাল সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কেইন তার কাঁধে চড়লো। তারপর খুব সাবধানে নিজের দেহ সোজা করে মাথার উপরে দুহাত উঁচু করে ধরল।
‘এবার,’ সে আরবিতে বলার সাথে সাথে জামাল তার শক্তিশালী হাত কেইনের পায়ের নিচে দিয়ে তাকে সরাসরি উপরের দিকে উঠাতে শুরু করল।
কেইন আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল দুহাত দিয়ে কিছু একটা খামচে ধরার। জামালের হাত কাঁপা শুরু হতেই তার মনে আতঙ্ক জেগে উঠল। ঠিক তখনই দেয়ালে পাথরের গায়ে ভাঙ্গা একটা অংশে আঙ্গুলে ঠেকতেই সে তা আঁকড়ে ধরে দুলতে শুরু করল। এক মুহূর্ত পর সে গুহার গায়ে শরীর আটকাতে পারল। এক পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অন্য পাশের দেয়ালে পা ঠেকালো।
এভাবে সে দেয়াল বেয়ে সোজা উপরের দিকে ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল। একটু পর পর বিশ্রাম নিল। এবড়ো থেবড়ো পাথরগুলো তার পিঠে বিধতেই মাঝে মাঝে খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখ কামড়ে যন্ত্রণা সহ্য করে উপরের দিকে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কূপের মুখ আকারে বড় হলো। কূপের মুখের কাছে আসতেই সে এক ফুট নিচে পা রেখে একটু বিশ্রাম নিল। তারপর দ্রুত কুপের ভেতর থেকে বাইরে বের হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দড়িটার দিকে এগিয়ে চলল।
ঠিক সেই মুহূর্তে দুজন বেদুঈন পাম গাছগুলোর মধ্য থেকে বের হয়ে কূপের কয়েক ফুট দূরত্বে এসে এক ফালি চাঁদের আলোর মাঝে দাঁড়িয়ে অলসভাবে গল্প করতে লাগল।
প্রথম শব্দটা পেতেই কেইন লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। এবার বেশ সাবধানে এক ইঞ্চি ইঞ্চি করে হামাগুড়ি দিয়ে ছায়ার মধ্য দিয়ে পাম গাছগুলোর দিকে এগোতে লাগল। এ মুহূর্তে কানিংহাম আর জামালের জন্য তার কিছুই করার নেই। দুই বেদুঈনই সশস্ত্র আর একজন হাতে রাইফেল ধরে রেখেছে। দুজনকে কাবু করা অসম্ভব ব্যাপার।
সে উঠে দাঁড়িয়ে পাম গাছগুলোর মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে ক্যাম্পের দিকে হেঁটে চলল। কাছে পৌঁছতেই গানবাজনার আওয়াজ শোনা গেল। বেদুঈনরা এক তূপ আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে গোল হয়ে আসন গেড়ে বসেছিল। কয়েকজন দলবদ্ধভাবে নেচে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে। একজন একটি রাখালের বাঁশি বাজাচ্ছিল, আর একজন ছোট একটা চামড়ার ঢোলকে অনবরত একঘেয়ে তালে বাজিয়ে চলছিল। বাকিরা গোল হয়ে বসে গানের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে দুই হাতে তালি দিচ্ছিল আর সামনে পেছনে শরীর দোলাচ্ছিল। সে অগ্নিকুন্ডকে পাশ কাটিয়ে ছায়ার মধ্য দিয়ে তাঁবুগুলোর মাঝে চলতে শুরু করল। প্রথম দুটো তাবু খালি আর সবচেয়ে বড়টা সে এড়িয়ে গেল।
ক্যাম্প থেকে একটু দূরত্বে দুজন প্রহরী একটা তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়েছিল। সে ঘুরে তাবুটার পেছন দিকে গিয়ে তাঁবুর নিচে ছায়ার মধ্যে হামাগুড়ি দিতে লাগল। ভেতর থেকে নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। রুথ কানিংহাম মৃদু কণ্ঠে কিছু বলে উঠল আর মেরি উত্তর দিল। তবে ঠিক মতো বোঝা গেল না
কেইন খুব আস্তে তাঁবুর মোটা দড়িটা ঢিলা করে তাঁবুর নিচের প্রান্তটা কয়েক ইঞ্চি উঁচু করল। এবার মাটিতে চিৎ হয়ে সে ভেতরের দৃশ্য দেখতে পেল।
মেরি একটা স্লিপিং ব্যাগের উপর বসেছিল, তার পেছনটা কেইনের কাছ থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরত্বে। আর রুথ কানিংহাম রয়েছে তাঁবুর দরজার কাছে।
কেইন খুব নরম গলায় বলল,’মেরি পেছনে তাকিও না। রুথকে কথা চালিয়ে যেতে বলো।’
পাতলা শার্টের নিচে মেরির কাধ হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। সে সামনে ঝুঁকে রুখকে মদুস্বরে কিছু বলল। রুথ কানিংহাম প্রথমে আঁতকে উঠে মদুস্বরে কিছু একটা বলে উঠলেও, সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল। এরপর সে জোরে জোরে কথা চালিয়ে যেতে লাগল, কী কী হয়েছে আর ভবিষ্যতে ওদের কপালে আর কী আছে সে সব বলে যেতে লাগল।
মেরি সোজা চিৎ হয়ে স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে মাথা অর্ধেক ফেরাতেই সরাসরি কেইনের দিকে তাকাল। দুজনের মুখের মাঝে কেবল তিন চার ইঞ্চি ফাঁক।
‘এই মুহূর্তে আমি কিছুই করতে পারব না, আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই, সে বলল। ওরা তোমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করেছে?
‘এখন পর্যন্ত সবই ঠিক আছে, তবে সেলিম যে দৃষ্টিতে রুথের দিকে তাকাচ্ছিল সেটা আমার খুব একটা ভাল মনে হলো না। তাকে দেখে মনে হলো সে চরম খারাপ কোন কিছু করে ফেলতে পারে।’
কেইন ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলল। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের কিছু একটা করতে হবে। আমি এখন ওদের কাছে যাই। যাই হোক চিন্তা করো না। ভাগ্য ভাল হলে আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো, তোমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে।
সে চলে যাবার জন্য ঘুরতেই একটু থামল। রুথকে বলো তার স্বামী সুস্থ এবং ভাল আছেন।’
মেরি তাবুর নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে কেইনের মুখে আলতো করে বোলালো। তার চোখ কালো পানির মতো টলটলে, যেখানে রয়েছে ভয়ংকর স্রোত যা তাকে টেনে নিতে পারে। সে তাঁবুর মাথাটা আরেকটু উপরে তুলল, মেরি তার মুখ বাড়িয়ে দিতেই তার ঠোঁট স্পর্শ করল। এটা কোন আবেগের চুম্বন নয়–এটা ছিল একজন নারীর চুম্বন যে তার কোমল হৃদয়ের সমস্ত তন্ত্রী দিয়ে গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে। এক মুহূর্ত সে তার হাত দিয়ে মেরির হাত চেপে ধরল তারপর সেখান থেকে দ্রুত চলে এল।
সাবধানে গাছগুলোর মধ্য দিয়ে সে খনি-কুপটির দিকে এগোতে লাগল। হঠাৎ সামনে থেকে কারও আসার শব্দ পেয়ে একটা গাছের পেছনে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। একটা লোক তার এতো কাছ দিয়ে পাশ কাটালো যে কেইন অতি সহজেই তার আলখাল্লার প্রান্ত ছুঁতে পারতো।
গাছগুলো যেখানে শেষ হয়েছে সে পর্যন্ত পৌঁছে কেইন দেখতে পেল, অন্য বেদুঈনটা খনিকুপের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটার হাতে রাইফেল নেই। কেইন অপেক্ষা করতে লাগল, তারপর বেদুঈন লোকটা অন্ধকার উপত্যকার দিকে মুখ ফেরাতেই সে নিঃশব্দে বালুর উপর দিয়ে এগোল। লোকটা কোন সুযোগ পেল না। এক হাত দিয়ে সে তার গলা এমন শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল, যেন তার মুখ থেকে কোন শব্দ বের না হয়। তারপর ধীরে ধীরে চাপ দিতে থাকল। এক দুই মুহূর্ত লোকটা চেষ্টা করল বজ্রআঁটুনি ছাড়াতে তারপর তার দেহ শিথিল হয়ে পড়ল। কেইন দেহটা টেনে নিয়ে পেছনে গাছগুলোর আড়ালে ছায়ার মাঝে শুইয়ে রাখল।
দড়িটা তখনো সেই গাছের সাথে কুন্ডলী পাকানো অবস্থায় বেঁধে রাখা ছিল।
কেইন দড়িটা নিচে কূপের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলে মৃদু কণ্ঠে ডেকে উঠল, ‘যত জলদি পারেন উপরে উঠে আসুন।
সে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে ক্যাম্পের সামনের গাছগুলোর দিকে নযর রেখে অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে কানিংহাম তারপর জামাল তার পাশে এসে দাঁড়াল।
ওরা পাম গাছগুলোর দিকে এগিয়ে চলল, কেইন দ্রুত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলল।
‘মেয়ে দুজনকে পাহারা দিয়ে একটা তাবুতে রেখেছে। আমি যা বুঝতে পারছি, কোন অস্ত্ৰছাড়া ক্যাম্প আক্রমণ করে লাভ হবে না। তাই বলতে চাচ্ছি যে গুহাতে স্কিরোজ অস্ত্রশস্ত্র রেখেছে সেখানে বরং যাই। সেখানে একটা রেডিও আছে। মুকাল্লা কিংবা এডেন ধরতে না পারলেও অন্তত জর্ডনের সাথে যোগাযোগ করতে পারব।’
কানিংহাম বলল, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভাল উপায় মনে হচ্ছে।’
কেইন দ্রুত আরবিতে জামালকে সব বুঝিয়ে বলল। তারপর গাছের ফাঁক দিয়ে তাঁবুগুলোর দিকে এগিয়ে চলল। আগুনটা এড়িয়ে গেল, বেদুঈনরা তখন আগুনের চারপাশ ঘিরে নেচে চলছিল। এরপর ওরা মাটির উপর হামাগুড়ি দিয়ে ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল।
সবচেয়ে বড় ভাবুটার শেষ প্রান্ত পার হতেই রাতের বাতাসে পরিষ্কার মুলারের গলার শব্দ শোনা যেতেই কেইন একটু থামল। সে কানিংহামের এক কাঁধ আলতো করে ছুঁয়ে তাবুটার কাছে এগোল।
এবার স্কিরোজ কথা বলছিল, বেশ খুশি খুশি মনে হচ্ছিল তাকে। আমার খুব ভাল লাগছে হেডকোয়ার্টারের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করে, সে বলল, আমার সৌভাগ্য যে আমি রোমেরোর সাথেও যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। ওরা আজ রাতেই আসছে।
মুলার বলল, কিন্তু আমি এর কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।’
স্কিরোজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–”তুমি অসম্ভব একজন বোকা লোক, মুলার। এখানে আমাদের কাজ শেষ। কেইনকে যে রকম আমি এর আগে বলেছিলাম, অন্তত এক মাসের জন্য আমরা নিরাপদ, কিন্তু অনেক সময় মানুষের জীবনে অনেক অযৌক্তিক খেলা খেলে যায়। সেজন্য আমরা রোমেরোর সাথে ক্যাটালিনাতে চড়ে উড়ে যাওয়ার চমৎকার সুযোগটা নিতে যাচ্ছি, মুলার। আনন্দ করো। তুমি ইতিহাসের একটা অংশ হতে যাচ্ছো।’
‘বন্দিদের কি হবে? সেলিম মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল।
কেইনের চোখে ভেসে উঠল স্কিরোজের স্ফীত মুখের মদ হাসি। ‘পুরুষদের আমি তোমার জিম্মায় রেখে যাবো। মেয়েরা আমাদের সাথে ক্যাটালিনাতে যাবে।
কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলে কানিংহাম মেয়েটাকে আমার হাতে ছেড়ে দেবে, সেলিম রাগত স্বরে বলল।
‘আমি আমার মত বদলেছি এর পরেই, শীতল কণ্ঠে বলল স্কিরোজ। ‘এখানে কে বস সেটা ভুলে যেও না। তুমি অন্য কোন মেয়ে খুঁজে নিও।
‘ওদের কী হবে?’ মুলার জিজ্ঞেস করল।
স্কিরোজ তাকে বলল, ‘আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে পেরেট মেয়েটাকে আমি একটা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চাই। ওকে কাবু করতে অনেক মজা হবে।’
রাতের বাতাসে দুর থেকে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। স্কিরোজ উঠে দাঁড়াল। ‘ঐ যে ঠিক সময়ে প্লেন আসছে ভদ্রমহোদয়গণ। মেয়েদেরকে নিচে ট্রাকে নিয়ে যাও সেলিম। মুলার আর আমি একটু পরেই আসছি।’
কানিংহাম হঠাৎ নড়ে উঠল। কিন্তু কেইন তার কাধ শক্ত করে চেপে ধরে টেনে নামাল মাটিতে। বোকার মত কাজ করবেন না, সে তার কানে ফিস ফিস করে বলল।
হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুগুলোর মধ্য থেকে বেরিয়ে ওরা ছায়ার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেইন ওদেরকে পথ দেখিয়ে পাহাড় চূড়ার দিকে এগিয়ে চলল, তখন কানিংহাম বলল, এখন আমরা কী করব?
কেইন তাকে বলল, “এখন একটি মাত্র কাজ আমাদের করতে হবে। প্লেনটা থামাতে হবে। তবে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে।’
পাথরের র্যাম্প দিয়ে ওরা নিঃশব্দে হেঁটে চলল, তারপর অতি সাবধানে সেই গুহামুখটার কাছে এগোল যেখানে অস্ত্রের ভান্ডারটা রয়েছে। একজন মাত্র আরব পিঠে রাইফেল ঝুলিয়ে পাথরে বসে বসে দুলছিল আর আকাশের দিতে তাকিয়ে একঘেয়ে সুরে একটা বিষাদক্লিষ্ট রাখালি গান গেয়ে চলছিল।
কেইন জামালের কাঁধে চাপ দিল, বিশালকায় সোমালি নিঃশব্দে এগোল। উঁচু সুরে পৌঁছার পর গানটা হঠাৎ মাঝখানে থেমে গেল। তারপর হঠাৎ মট করে একটা শব্দ হলো, যেন কোন শুকনো ডাল ভেঙেছে। জামাল মৃতদেহটা মাটিতে নামিয়ে রাখল।
গুহার ভেতরে অন্ধকার, সামনে যেতে যেতে কেইন একটা ম্যাচ জ্বাললো। রেডিওর উপরে একটা বড় স্পট ল্যাম্প দেখা গেল। কেইন তাড়াতাড়ি বোতাম টিপে ল্যাম্পটা জ্বেলে অস্ত্রের বাক্সগুলোর দিকে ঘোরাল।
আর মাত্র কয়েকটা বাক্স অবশিষ্ট রয়েছে। প্রথম দুটো পরীক্ষা করে সে। দেখল গাদাগাদি করে রাইফেল রাখা আছে। তবে তৃতীয়টাতে সাবমেশিন গান রয়েছে। আরো খুঁজে এক বাক্স ভর্তি গোলাকার একশো রাউন্ড বুলেটের ক্লিপ পেল। কানিংহাম আর জামাল, দুজনকে কেইন দুটো করে ক্লিপ দিল।
কানিংহাম বলল, রেডিওর কী হবে?
মেশিনগানে গোলা ভরতে ভরতে কেইন মাথা নাড়ল–এখন আর তার সময় হবে না।
বাইরে বের হতেই একটা ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল, ওরা দেখল একটা ট্রাক মন্দির হয়ে বাইরে মরুভুমির দিকে যাওয়ার রাস্তার দিকে ছুটে চলেছে।
বেশিরভাগ বেদুঈন তখনো আগুনের চারপাশে বসে রয়েছে। কেইন দ্রুত ছায়ার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পের অন্যপাশে যেতে লাগল।
যে ট্রাকে চড়ে ওরা সকালে পৌঁছেছিল সেটা তখনো তাঁবুগুলোর পাশে উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। সে কানিংহামকে বলল, এটা এখন আমাদের। আপনি ড্রাইভ করব, এমন জোরে চালাবে যেন জীবনে কখনো তেমন জোরে চালান নি।
ওরা ছায়া থেকে বের হয়ে ট্রাকটায় চড়ে বসল। কানিংহাম স্টাট দিতেই পেছন থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল। কয়েকজন বেদুঈন দৌড়ে সামনে এগোতেই কেইন পেছনে ঘুরল। সাব-মেশিন গানটা তুলে দ্রুত এক রাউন্ড গুলি চালালো। লোকগুলো অন্ধকারে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক তখনই কানিংহাম প্রচণ্ড গতিতে ট্রাক ছুটিয়ে চলল।
মন্দিরের সামনের উঁচু টিলাটার উপরে উঠে ওরা গিরিপথে ঢোকার প্রবেশ পথের দিকে ছুটে চলল। ঠিক তখনই মাথার উপরে ক্যাটালিনার গর্জন শোনা গেল, চাকা আর ফ্ল্যাপ নামানো রয়েছে, বাইরে সমতল জায়গায় নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কেইন চেঁচিয়ে বলল, “যত জোরে পারেন ট্রাকটা চালাতে থাকুন। কানিংহাম সাথে সাথে তার পা পাদানিতে দাবিয়ে রাখল। উপত্যকার উঁচু নি পাথুরে ভুমির উপর দিয়ে ট্রাকটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে শুরু করল। সে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখল, তারপর একটু পরেই খোলা জায়গায় বের হয়ে প্লেনটার পিছু পিছু চলতে শুরু করল।
তাদের ঠিক ডান পাশে চাঁদের আলোয় অপর ট্রাকটিকে পরিষ্কার দেখা গেল। সামনে এগোতেই কেইন পরিষ্কার দেখতে পেল সেলিম পেছনে বসে আছে, স্কিরোজ আর মুলার সামনের সিটে।
স্কিরোজের মুখ রাগে মুচড়িয়ে রয়েছে, সে ঘাড় ফিরিয়ে চিৎকার করে পেছনে বসা সেলিমকে কিছু বলল। ট্রাক দুটো সমান সমান হতেই সেলিম একটা রাইফেল তুলে গুলি করল। স্কিরোজ অন্য ট্রাকটি ঘুরিয়ে ওদের কাছে যেতেই সেলিম আবার গুলি করল। গুলি লেগে উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হতেই কেইন মাথা নিচু করে নিজেকে বাঁচাল। কানিংহাম প্রাণপনে স্টিয়ারিং হুইলটা ঝাঁকি দিয়ে ট্রাকটা এক পাশে নিয়ে গেল, তারপর ট্রাকটা স্কিড করে পুরো এক চক্কর ঘুরল।
এই মুহূর্তে ওরা নিরাপদ এবং প্লেনটার দিকে তাদের মনোযোগ ফেরালো। প্লেনটা তখন নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রোমেরো ব্রেক চাপতেই রাতের আকাশে উপরের দিকে ধুলা-বালুর একটা বিরাট মেঘ সৃষ্টি হলো।
সেকেন্ড পাইলটের সিটে বসা নোভাল ঘুরে তাকিয়ে হঠাৎ রোমেরোর কাঁধ আঁকড়ে ধরল। পেছনে গোলাগুলি চলছে। চল আমরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি।’
‘ফর গড’স সেক একটা সুযোগতো নিতে দাও আমাকে,’ এ কথা বলে রোমেরো পাওয়ার বাড়িয়ে দিল।
কেইন পেছন ফিরে দেখল অপর ট্রাকটি দ্রুত ওদেরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কানিংহাম অর্ধচন্দ্রকারে হুইল ঘুরিয়ে ট্রাকটাকে বিশাল ধুলির মেঘের ঠিক মাঝখানে আনল যেদিক দিয়ে প্লেনটা আবার উড়বে।
কয়েকটা মুহূর্ত ওরা অন্ধের মতো চলতে লাগল। কাশতে কাশতে দম আটকে, মাথা নিচু করে সামনে থেকে উড়ে আসা ছোট ছোট পাথরের টুকরা সামলে ওরা চলতে লাগল। তারপর কানিংহাম হুইল ঘোরাতেই ওরা আবার চাঁদের আলোর মাঝে বেরিয়ে এল।
ক্যাটালিনাটা এখন ঘণ্টায় বিশ থেকে ত্রিশ মাইল গতিতে ট্যাক্সি করে উপত্যকার প্রবেশ পথের দিকে এগোচ্ছিল। কানিংহাম হুইলে আরেকটা ঝাঁকি মেরে ট্রাকটা ঘুরালো, তারপর এক মুহূর্ত পরেই ওরা সমান্তরাল পথে ছুটতে শুরু করল।
কানিংহাম ট্রাকটা কাছাকাছি আনতেই কেইন আর জামাল দাঁড়িয়ে প্লেনটা লক্ষ করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে একটানা গুলি বৃষ্টি করে চলল। কেইন রোমেরোকে দেখতে পেল প্লেনের উঁচু নাকের মধ্যে। ইট্রুমেন্ট প্যানেলের হালকা আলোয় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সে সাব মেশিনগানটা তুলে কেবিনের ভেতরে কয়েক রাউন্ড গুলি করল। রোমেরো মাথা নিচু করে অদৃশ্য হল তারপর প্লেনের লেজটা বিশাল এক বৃত্ত জুড়ে উল্টো দিকে ঘুরল। বাতাসে বালুর মেঘ উড়তে শুরু করল।
কানিংহাম হুইল ঘুরিয়ে প্লেনের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে ট্রাকটা সরিয়ে নিল। প্লেনটা বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে আবার মরুভূমির দিকে এগোতে লাগল। রোমেরো টেক অফ করার প্রস্তুতি নিতেই ইঞ্জিনের গর্জন বাড়তে লাগল।
তারপর পুরো প্লেনটা এক পাশ থেকে অন্য পাশে ভিষণভাবে কাঁপতে কাঁপতে বামদিকে ঘুরে গেল। একমুহূর্ত পর নাকটা সামনে গোত্তা খেল, তারপর জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার মতো সামনের দিকে প্রায় একশো গজ বালুর মাঝে ছুটে গিয়ে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো ধাতুর স্তূপে পরিণত হয়ে থামল। রাতের আকাশে কমলা রঙের আগুনের লকলকে শিখা উপরের দিকে লাফিয়ে উঠল।
প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হলো, তারপর পেট্রল ট্যাংকে আগুন লাগতেই আরেকটা বিস্ফোরণ হলো। আগুনের শিখা আর ধাতুর ছোট ছোট টুকরা বাতাসে উড়ে ওদের কাছে আসার আগেই কানিংহাম দ্রুত হুইল ঘুরিয়ে ট্রাকটা সরিয়ে নিল।
এদিকে অন্য ট্রাকটা দ্রুত গিরিখাতের দিকে ছুটছিল। ওরা ট্রাকটার পিছু নিল। মাটির উপর দিয়ে এমনভাবে ওরা ছুটছিল যেন জীবন্ত কিছু একটা ছুটছে। কেইন সাবমেশিন গান হাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এক পা রানিং বোর্ডে রেখে দাঁড়াল। তাকিয়ে রইল অন্য গাড়িটার টেইল লাইটের দিকে।
গিরিখাতের মধ্যে প্রবেশ করার সময় একটা উঁচু ঢিবি পার হতে গিয়ে ট্রাকটা হঠাৎ শূন্যে লাফিয়ে উঠল। কেইন একপাশে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তাল সামলাতে না পেরে সাব মেশিন গানটা তার হাত থেকে ছুটে মাটিতে পড়ে গেল আর সে নরম বালুতে পড়ে গড়াতে লাগল।
ত্রিশ চল্লিশ গজ এগিয়ে ট্রাকটা ব্রেক করে থামতেই ওদের উপর ভারী গোলাবর্ষণ শুরু হলো। কেইন দেখল কয়েকজন বেদুঈন এক জায়গায় পড়ে থাকা কিছু বোল্ডারের পেছন থেকে উদয় হলো।
ট্রাকের গায়ে গুলির ধুপ ধুপ শব্দ শুনতে পেয়ে সে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলকানিংহাম, এখান থেকে বেরিয়ে যাও। মেয়েদেরকে উদ্ধার কর!
সাথে সাথে ট্রাকটা চলে গেল আর কেইন নিচু হয়ে সাব-মেশিনগানটা হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল। দেখতে পেল ওটা এক টুকরা চাঁদের আলোর মাঝে মাটিতে পড়ে রয়েছে। সাথে সাথে দৌড়ে চলল ওটা নিতে। এক দুই মুহূর্ত সম্পূর্ণ নিরবতা, তারপর একটা পাথরের টুকরা গড়িয়ে পড়ার খট খট আওয়াজ পাওয়া গেল। সে রাতের আকাশে গুলি ছুঁড়লো। উল্টোদিক থেকে কয়েকটা গুলি তার মাথার উপর দিয়ে শন শন করে উড়ে পাহাড়ের গায়ে লেগে ঠিকরে পড়ল। গুলি থামতেই সে একলাফে একটা বোল্ডারের পেছনে চলে গেল। তারপর ছায়ার মাঝে থেকে উপত্যকা দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল।
ওদিকে পেছন থেকে ওরা তখনো অন্ধের মতো গুলি চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এ মুহূর্তে সে একা। মন্দিরের দিকে চলে যাওয়া চওড়া রাজপথ দিয়ে সে ছুটলো। তারপর মন্দির অতিক্রম করে মরুদ্যানের দিকে ছুটে চলল।
খালি জায়গাটার কিনারায় পৌঁছে সে একটু থামল, তারপর নিচে ক্যাম্পের দিকে তাকাল। কানিংহাম তাঁবুগুলো থেকে বিশ-ত্রিশ গজ দূরত্বে ট্রাকটা থামিয়েছে। সে আর জামাল এর পেছনে আশ্রয় নিয়েছে।
কয়েকজন বেদুঈন ডানদিক দিয়ে উঁচু ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে, যাতে উপর থেকে ওদের উপর গুলিবর্ষণ করতে পারে। কেইন সাবধান করার আগেই কানিংহাম উপরের দিকে তাকিয়ে বিপদটা টের পেল। সে জামালের কাঁধে একটা টোকা দিল, তারপর দুজনেই ছায়ার মাঝ থেকে ঘুরে ঢাল বেয়ে উপরে সেই গুহাটার দিকে উঠতে শুরু করল, যেখানে অস্ত্রভান্ডার রয়েছে।
তখনো ওদের দেখা যায় নি। আর স্কিরোজ বুঝে উঠতে পারেনি যে ওরা সেখান থেকে চলে গেছে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটলো, তারপর কেইন ঢাল বেয়ে কোণাকুণি উঠতে শুরু করল।
একটা বোল্ডারের পেছনে থেমে উপরের দিকে তাকাল। কানিংহাম আর জামাল পাহাড়ের সরু তাকটার কাছে পৌঁছাতেই দেখল কয়েকজন বেদুঈন ওদের আগেই বুকে হেঁটে ঢাল বেয়ে উঠে ওদের সামনের পথ বন্ধ করে ফেলেছে। কানিংহাম একটানা দীর্ঘ এক রাউন্ড গুলি চালিয়ে ওদের মাথা নিচু করে রাখতে বাধ্য করল। এই ফাঁকে সে আর জামাল দৌড়ে অন্য গুহাটার আশ্রয়ে চলে গেল। কেইন বোল্ডারের পেছন থেকে বের হয়ে ঢাল বেয়ে ওদের কাছে যেতে শুরু করল, আশা করল অন্ধকার ছায়া তাকে ঢেকে রাখবে।
নিচে উপত্যকা থেকে সেলিমের রাগি চিৎকার শোনা গেল, আর সাথে সাথে ভারী গুলি বর্ষণ শুরু হলো। কেইন দম নিতে নিতে এক হাতে সাব মেশিনগানটা বুকে চেপে ধরল আর অন্য হাত দিয়ে আলগা মাটি আঁকড়ে ধরল। সে পেছন থেকে অনুসরণরত লোকজনের গর্জনের শব্দ শুনতে পেল, তারপর মাথার উপরের দিক থেকে একটানা বন্দুকের গুলির আওয়াজ ভেসে এল। সে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল পাহাড়ের একটা তাকের কিনারায় কানিংহাম সাব-মেশিনগান কাঁধে নিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে আছে।
কেইন মুখ থুবড়ে সামনের দিকে পড়ে যেতেই জামাল শক্ত হাতে তাকে ধরে উপরে তুলল, তারপর টেনে গুহার ভেতরে নিয়ে গেল। তারা ভেতরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কানিংহাম গুহামুখের ধারে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। চাঁদের আলোয় তার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
বিপদটা বেশ ভয়ানক ছিল,’ একটু পর কেইন বলল।
কানিংহাম সায় দিল, মেয়েদের গায়ে গুলি লাগবে এই ভয়ে আমরা খুব জোড়ালো আক্রমণ চালাতে পারিনি।
কেইন সায় দিয়ে বলল, সেটাই ওর ট্রাম্প কার্ড আর স্কিরোজ সেটা জানে।’
কয়েকটা বুলেট শন শন করে গুহামুখ দিয়ে ছুটে এসে উল্টোদিকের দেয়ালে আছড়ে পড়ল। সে সাবধানে বাইরে তাকাল। পুরো উপত্যকা চাঁদের আলোয় ভেসে রয়েছে, আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে শত্রুরা এক বোল্ডার থেকে অন্য বোল্ডার পার হয়ে সামনে এগোচ্ছে।
‘ঢাল বেয়ে অর্ধেক আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর, তারপর আমি বলা মাত্রই গুলি শুরু করো, কেইন বলল।
ওরা নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল। স্কিরোজ ছিল একদম সামনে, সে উপরের দিকে তাকাতেই তার মুখে চাঁদের আলো এসে পড়ল। কেইন বলল, ‘বেজন্মা লোকটার সাহস আছে, বলতে হবে।’
চাঁদের আলোয় আলোকিত বড় যে বোল্ডারটাকে কেইন অর্ধেক পথের চিহ্ন হিসেবে ধরে নিয়েছিল, তার কাছে স্কিরোজ পৌঁছাতেই কেইন বলে উঠল, ‘এবার’ তারপর সে ট্রিগার চাপলো। তিনটে বন্দুক এক সাথে গর্জে উঠতেই নিচে থেকে চিৎকার আর আর্তনাদ ভেসে এল, কয়েকজন আরব ঢাল বেয়ে
গড়িয়ে নিচে উপত্যকার মাটিতে পড়ল।
বাকিরা দ্রুত পিছু হটতে শুরু করল, পিছন পিছন স্কিরোজও পিছুতে লাগল। সে জার্মান ভাষায় চিৎকার করে গালাগাল করতে লাগল।
তারপর একটু নিরব হলে কানিংহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যাক এই মুহূর্তের জন্য বাঁচা গেল।
কেইন মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, সে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। আমার মনে হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে সে আরো বিশ্রি কোন কিছু ঘটিয়ে বসতে পারে। একথা বলতেই, স্কিরোজ সামনে এগিয়ে এল–’কেইন, সে ডেকে উঠল। ‘আমি তোমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করব না। আমি তোমাকে দুহাত মাথার উপর তুলে নিচে আসার জন্য পনেরো মিনিট সময় দেব। আর যদি তা না কর, তবে মেয়েদের খারাপ কিছু ঘটবে। আমি জানি তুমি আর কানিংহাম নিশ্চয়ই তা চাও না।’
কেইন জামালের কাঁধ ছুঁলো, তারপর তিনজনেই প্রবেশ মুখ থেকে ওঠে পেছনের দিকে এল। সে আমাদের ফাঁদে ফেলেছে, কানিংহাম বলল।তাকে আমরা মেয়েদের ক্ষতি করতে দেব না।’
কেইন মাথা নাড়ল, তার মুখ গম্ভীর হলো। সে যদি সত্যিই ওদের ক্ষতি করতে চায় তবে সে তা করবে, আমরা যাই করি না কেন তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে মাথা নাড়ল। আমার মনে হয় সে সময় নিচ্ছে। সম্ভবত কোন ফন্দি আঁটছে।’
ঠিক সেই মুহূর্তে উপরে পাহাড়ের মুখে বাইরে নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল আর গুহা মুখের সামনে ছোট ছোট পাথরখন্ড ঝুরঝুর করে পড়তে শুরু করল।
‘আমি বললাম না ঐ বেজন্মাটা কোন একটা মতলব এঁটেছে, কেইন বলে উঠল। আর ঠিক তখনই একটা গ্রেনেড গুহা মুখ দিয়ে ভেতরে গড়িয়ে পড়ল। গ্রেনেডটা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল।
কেইন ঘুরে কানিংহাম আর জামালকে ভীষণ জোরে ধাক্কা দিয়ে সমাধির সরু প্রবেশ পথের দিকে ঠেলে দিল, তারপর সে নিজেও পেছনে ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল।
গ্রেনেডটা ফাটতেই গুহার মুখে পাথরের বৃষ্টি ঝরতে লাগল। পুরো পাহাড়টা মনে হলো কাঁপছে আর ছাদটা ভেতরের দিকে দেবে যেতে লাগল।
মুলার উপরের দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় পরিষ্কার ধুলার মেঘ দেখতে পেল। “ওহ মাই গড! এবার কী হবে?
স্কিরোজ বলল, ‘আমরা এখান থেকে চলে যাবো। সেলিমের ধাউয়ে চড়ে দাহরান ফিরে যাবো। বেজন্মা কেইন আর তার বন্ধুদের এবার ঠিক শাস্তি হয়েছে। আশা করি যেন মাটি চাপা পড়ে ওরা অনেক সময় নিয়ে মারা যায়।
‘কিন্ত বার্লিন, ফুয়েরার? আমাদের কী হবে এরপর?’
কিছু হবে না, বোকারাম। আমি সোজা রেডিওতে রিটারকে বলবো ক্যাটালিনা ক্র্যাশ করেছে। আমাদেরতো কোন দোষ নেই। কেবল এটাই তারা জানবে।
‘আর মেয়েদের কী হবে?
‘আপাতত তারা আমাদের সাথেই যাবে। এখন চল যাওয়ার ব্যবস্থা করি।’
সে ঘুরে নিচে ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা দিল। সেলিম আর অন্যান্য বেদুঈনদের ইশারা করল পিছু পিছু আসতে।
.
এদিকে বার্লিনে ক্যানারিস তার অফিসে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কোনিয়াক ব্রান্ডি পান করছিলেন। তখনই দরজায় একটা টোকা পড়ল আর রিটার ভেতরে ঢুকলো। তরুণ মেজরের চেহারা বিবর্ণ দেখাচ্ছে আর তাকে মনে হলো বেশ বিধ্বস্ত।
‘কোন খারাপ খবর, হান্স?’
‘অপারেশন শেবা, হের এডমিরাল। আমি স্কিরোজের কাছ থেকে একটা বিদঘুঁটে মেসেজ পেয়েছি। সে সব কিছু বন্ধ করে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েছে। কোন ধরনের সমস্যা হয়েছিল, ক্যাটালিনা ধ্বংস হয়েছে। রোমেরো আর তার লোকজন সবাই মারা গেছে।’
‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা, ক্যানারিস বললেন।
‘কিন্তু ফুয়েরার, হের এডমিরাল। তিনি কী বলবেন?
দ্যাখো হান্স সোমবারে কোন বিষয় নিয়ে আমাদের ফুয়েরারের অত্যন্ত উত্তেজিত হবার স্বভাব রয়েছে, যেটা উনি শুক্রবারের মধ্যে পুরোপুরি ভুলে বসেন। ক্যানারিস মৃদু হাসলেন। তাছাড়া তার হাতে এখনও পোলান্ড আছে।’
‘আপনি নিশ্চিত তিনি এভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখাবেন?’ রিটার বলল।
‘অবশ্যই। ফুয়েরারের মানসিক চিন্তাভাবনার গতির ধারণা নিয়ে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে হান্স।
ক্যানারিস উঠে গিয়ে আরেকটা গ্লাস নিলেন। নাও তুমি এক গ্লাস কোনিয়াক নাও। যতদিন তুমি এই খেলায় আছে আর যতদিন আমি আছি, ততদিন তুমি যে কোন কঠিন বিষয়কে সহজভাবে গ্রহণ করতে শেখো।
‘আপনি যা বলেন, হের এডমিরাল। হ্যাঁ আমি অবশ্যই তা বলছি। ক্যানারিস গ্লাস তুললেন। থার্ড রাইখের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ কর হান্স। আর হাজার বছর এটা টিকে থাকুক।’ তিনি হাসলেন। আর তা যদি তুমি বিশ্বাস কর, তাহলে যে কোন জিনিসে বিশ্বাস করতে পার।
১৩. গুহাটা সম্পূর্ণ অন্ধকার
১৩.
গুহাটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে গেল। কেইন ছোট ম্যাচ বুকটা বের করল যেটা সে এর আগে খাদে ব্যবহার করেছিল। আর তিনটে মাত্র কাঠি অবশিষ্ট আছে, সে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা কাঠি জ্বাললো।
ম্যাচের আগুনের শিখা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই অন্ধকার থেকে কানিংহামের ঘর্মাক্ত মুখ দেখা গেল। সে বিচলিত ভাবে হাসল। এখন কি হবে?’
‘পরিস্থিতিটা একটু বুঝে নিতে দিন, কেইন বলল। আমরা যখন কাজ শেষ করেছিলাম তখন আপনি যন্ত্রপাতিগুলো আর একটা স্পট-ল্যাম্প এই প্যাসেজের শেষ মাথায় রেখেছিলেন, তাই না?
ম্যাচের কাঠিটা জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে তার আঙ্গুলে আগুনের ছ্যাকা লাগতেই কেইন কাঠিটা ফেলে দিয়ে আরেকটা কাঠি জ্বাললো। উবু হয়ে বসে সে কাঠিশুদ্ধ হাতটা মেলে ধরল। তারপর কানিংহাম বললো, ‘পেয়েছি!’
এক মুহূর্ত পর শক্তিশালী সাদা আলোকরশ্মি গুহার অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। গুহাটার আকার অন্তত অর্ধেক কমে গেছে আর ঢালু হয়ে পড়া খোয়া আর পাথরের স্তূপ জমা হয়ে প্রবেশ মুখটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে ফেলেছে।
ভেতরে বেশ গরম আর বাতাস ভারী হয়ে আছে ধুলা ও বিস্ফোরকের তীব্র গন্ধে। এবার আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?’ কানিংহাম বলল।
কেইন পরনের শার্ট খুলতে শুরু করল। আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। যে এটাই স্বাভাবিক হতে পারতো। আমাদের অনেকদূর খুঁড়ে যেতে হবে। অন্তত, যন্ত্রপাতিগুলো আছে, এটাও কম নয়।
‘আর বাইরে আমাদের বন্ধুদের কী হবে?
তাদের এখন যদুর ধারণা আমরা মৃত, কেইন বলল। ওরা সম্ভবত ভেবেছে সম্পূর্ণ পাহাড়টা আমাদের চাপা দিয়েছে।’
‘খুব একটা ভুল কথা ভাবেনি ওরা,’ কানিংহাম তাকে বলল। সে ল্যাম্পটা উপরের দিকে তুলে ছাদ আর দেয়াল পরীক্ষা করল। পুরো জায়গাটা আমার কাছে দেখতে নড়বড়ে মনে হচ্ছে।
কেইন তার হাত থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে এমনভাবে মেঝেতে রাখল যাতে আলো সরাসরি পাথরচাপা প্রবেশ পথের দিকে পড়ে। এখন আমাদের শুধু একটা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা, সেটা হলো এই স্পট ল্যাম্পের ব্যাটারি। আপনি বরং প্রার্থনা করুন যেন অনেক বেশি সময় এটা কাজ করে।
কিন্তু দুশ্চিন্তার আরো অনেক বিষয় ছিল এবং রয়েছে। ওরা কোমর পর্যন্ত। খালি গায়ে সেই অদ্ভুত ধুলায় ভরা আলোর মাঝে পরিশ্রম করে যাচ্ছিল। ঘাম দর দর করে ওদের নগ্ন দেহ থেকে ঝরে পড়ছে।
জামাল এমন এক ব্যক্তি যার উপর নির্ভয়ে নির্ভর করা যায়। সে তার বিশাল হাত দিয়ে যে পাথরগুলো অবলীলায় তুলতে পারছিল সেগুলো কেইন আর কানিংহাম দুজনে মিলেও নড়াতে পারেনি। কাজ করতে করতে সময় সম্পর্কে ধারণা ওরা ভুলে গেছে। আঙুল কেটে ছড়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত জামাল আজব এক ধরনের জান্তব গোঙানি দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। সে কেইনের একটু সামনে কাজ করছিল।
কী ব্যাপার? কেইন আরবিতে জানতে চাইল।
জামাল ঘুরল, তার চোখের সাদা অংশ বাতির আলোয় জ্বলজ্বল করছে। সে আঙুল দিয়ে দেখাল আর কেইন হামাগুড়ি দিয়ে সামনে পাথর সরিয়ে সদ্য তৈরি করা সরু পথটা দিয়ে এগোল।
স্পট ল্যাম্পের আলোয় দেখা গেল তিন কিংবা চার টন ওজনের একটা বিশাল পাথরের স্লাব সামনের পথ জুড়ে রয়েছে। স্ল্যাবটা বিভিন্ন আকৃতির পাথরের সাথে শক্তভাবে আটকানো।
কানিংহাম তার কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে দেখল তারপর মৃদু শিস দিল। ‘মাই গড। ঐ জিনিসটা সরাবার কোন আশাই নেই।’
সে সত্য কথাই বলেছে, এর কোন উত্তরও নেই। ধীরে ধীরে পিছু হটে ওরা প্যাসেজের প্রবেশ পথের কাছেই দেয়ালে হেলান দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল।
কেইন একটা মুহূর্ত ল্যাম্পের আলোর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর সামনে ঝুঁকে ল্যাম্পের সুইচ অফ করে দিল। ব্যাটারি খরচ করার কোন মানে হয় না।
কানিংহাম হালকাভাবে হেসে উঠল, কেইন বুঝতে পারল সে প্রায় ভেঙে পড়েছে। ভীষণ গরম এখানে, একটা সিগারেট খেলে ভালো হতো।
কেউ কোন শব্দ উচ্চারণ করেনি, তারপরও এটা ওদের মাঝে একটা তরবারির মতো ঝুলে রয়েছে। অকথিত, অস্বীকার্য সত্যটি–যে ওরা একদম শেষ হয়ে গেছে। আর কোন আশা নেই।
অন্ধকার একটা ওজনহীন চাপের মতো ওদের উপর চেপে বসেছে। কিছু একটা ওজনহীন ঢেউয়ের মতো এর মধ্য দিয়ে নড়ছে আর গুহার দেয়ালে ফিসফিসানি প্রতিধ্বনিতু হচ্ছে। যেন কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর শব্দগুলো একটা পুকুরে ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো অন্তহীন ভেসে চলেছে।
কেইন শিউড়ে উঠল। অশুভ চিন্তাটা সে মন থেকে ঠেলে সরিয়ে দিল। এত তাড়াতাতি হাল ছেড়ে দেওয়া মোটেই কাজের কথা নয়। এখন তার মনকে সচল রাখতে হবে। এই অন্ধকার বাক্সের কথা ছাড়া তাকে অন্য কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।
সে পেছনের জীবনের কথা স্মরণ করতে শুরু করল, চিন্তাকে পেছনের দিকে ভাসিয়ে দিল। জীবনের প্রতিটা মাইলস্টোন, ভাল মন্দ সব কিছু নিয়ে। পরীক্ষা করতে লাগল।
এর আগে কেবল একবার সে এরকম নৈরাশ্যজনক অবস্থায় পড়েছিল-আর্মি এয়ার কোরে সেকেন্ড পাইলট হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার গুয়ামে ডিসি-৩ চালাবার সময়। যাত্রীসহ দশজন মানুষ আর একটা মাত্র লাইফ র্যাফট নিয়ে ওরা প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ে গিয়েছিল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অনেকগুলো শার্ক চারপাশে ঘুর ঘুর করতে শুরু করেছিল। তৃতীয় দিনে ওরা তিনজনে এসে দাঁড়ায়, সপ্তম দিনে কেবল দুজন রইল। আর ঠিক যখনই ভাবছিল সে মরতে চলেছে তখনই আকাশে গুঞ্জন শোনা গেল। সে উপরে তাকিয়ে দেখল একটা ক্যাটালিনা প্লেন পানিতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। তার জীবনে দুবার ক্যাটালিনা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। একটি তার জীবন বাঁচিয়েছে আর একটি সে ধ্বংস করেছে।
তারপর বাড়ি ফেরা। তার মনে পড়ল সেই প্রথম দিনটির কথা, লা গার্ডিয়া এয়ারপোর্টে পৌঁছে আবার নিউইয়র্ক দেখা। কিন্তু বাড়ি কোথায়? সেন্ট্রাল পার্কের দিকে মুখ করা এপার্টমেন্টটা? নাকি কানেকটিকাটে তার বাবার খামার? এর কোনটাই তার বাড়ি নয়। আসলে এর কোন অস্তিত্ব ছিল না, এটা ছিল তার মনে। সে অনেকদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এটা, কোন দিন পায় নি, এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে।
অন্ধকারে মেরির মুখটা তার সামনে একটা প্রদীপ শিখার মতো ভেসে উঠল। সে মৃদ হাসল। অন্তত একটা ভালো জিনিস এর মধ্য থেকে বের হয়ে এসেছে। সে এখন বুঝতে পেরেছে মেরি তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ জীবনের অন্য সব কিছু থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাবনা কেইনের মনে উষ্ণতা আর আনন্দ জাগিয়ে তুলল। অনেকটা তার ঠোঁটে যে চুম্বন সে এঁকে দিয়েছিল সেরকম। তবে এসব কথা সে আর তাকে জানাতে পারবে না।
সে উঠে দাঁড়াল হাত পায়ের খিল ছাড়াতে, ঠিক তখনই প্যাসেজ থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাস তার চামড়ায় আঙুল ছুঁইয়ে গেল। সে কেঁপে উঠল।
এ বিষয়টার সঠিক অর্থ তার মনে জাগতেই সে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে ল্যাম্পটা খুঁজতে লাগল। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ কুঁচকে কানিংহাম বলল, “কি ব্যাপার?
টানেলের দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ভেসে আসছে,’ কেইন তাকে জানাল।
কানিংহাম ভুরু কুঁচকে বলল, ‘অসম্ভব! কোত্থেকে আসবে বাতাস?
‘একটিই উপায় আছে কেবল তা জানার, কেইন বলল।
সে জামালকে আরবিতে বিষয়টা বুঝিয়ে বলল তারপর কানিংহামের পিছু পিছু প্যাসেজ ধরে এগিয়ে চলল সেই জায়গায় যেখানে ওরা সেদিন এর আগে কাজ শেষ করেছিল। কানিংহাম খোয়া আর পাথর কুচির স্তূপের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল, আপনার কথাই সঠিক কেইন, আমি আমার শরীরে হাওয়া টের পাচ্ছি।
কেইন তার পাশেই বসে পড়ল আর সাথে সাথে সেও তার উদোম বুকে বাতাসের চাপ অনুভব করল। একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেল, সে বলল। ‘মুলার ভুল করেছে। এটা আর যাই হোক, অন্তত পাথরের সমাধির প্রবেশ পথ নয়।’
‘তাহলে কোথায় গেছে এটা?’ কানিংহাম জানতে চাইল।
কেইন দাঁত বের করে হাসল। এর চেয়ে ভালো কোন গর্তে হবে–এটা নিশ্চিত।
জামাল যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে ফিরে এল। কেইন আর কানিংহাম খুঁড়তে শুরু করল। জায়গাটা বেশ সংকীর্ণ, কিছুক্ষণ পর জামাল ওদের দুজনকে হটিয়ে বড় একটা পাথর দুহাতে ধরে সরালো। একটা ছিদ্র দেখা গেল, যেখান দিয়ে হঠাৎ বাতাসের ঝটকা ভেসে এলো। জামাল সাবধানে আরো কয়েকটা পাথর সরিয়ে ফাঁকটা আরো একটু বড় করে উপুড় হয়ে শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে লাগল। কেইন ল্যাম্পটা তুলে ধরল। তারপর ওরা লক্ষ করল জামালকে অদৃশ্য হয়ে যেতে।
একটু পরই তার মাথা উদয় হলো মুখ ভরা হাসি নিয়ে। সে ওদেরকে ইশারা করতেই কানিংহাম উপুড় হয়ে শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোলো, কেইনও তাকে অনুসরণ করল।
পাথরের দেয়ালের অন্য পাশে প্যাসেজটা পরিষ্কার। কিন্তু এখানে ছাদ খুব নিচু হওয়ায় ওদেরকে উবু হয়ে হাঁটতে হচ্ছিল। কেইন ল্যাম্পটা সামনে এগিয়ে ধরে কানিংহামকে অনুসরণ করছিল।
ওরা টানেলটার শেষ মাথায় এসে পৌঁছাল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে থাক থাক করে রাখা নরম শিলাস্তরের কাছে এসে পৌঁছাল। শিলাস্তরটা খাড়া হয়ে নিচে অন্ধকারে পঞ্চাশ কিংবা ষাট ফুট নেমে গেছে একটা কালো ছলছল করা নদীর পানিতে। নদীটা গুহার মূল থেকে উঠে এসে পাথরের মাঝে সরু একটা ফাঁকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। কেইন ল্যাম্পটা অর্ধবৃত্তাকারে ঘোরাল। ছাদটা অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে, তার মানে ছাদটা অ পাথরের দেয়ালগুলো কালো আর ভেজা ভেজা।
কানিংহাম হাঁটু গেড়ে বসল। আর কোন উপায় নেই, কী বলেন?’
‘অনেকটা সেরকমই, কেইন তাকে জানাল। আপনি এখানে অপেক্ষা করুন, আমি বন্দুকগুলো নিয়ে আসি।
সে ফিরে এসে দেখল জামাল আর কানিংহাম পানির কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেইন খাড়া পার বেয়ে সাবধানে নামল। জামাল ধীরে ধীরে নদীর মাঝে পিছুতে লাগল। কানিংহাম তার দুই হাত ধরে রয়েছে।
পানি কোমর পর্যন্ত উঠে থেমে পড়েছে। কেইন দুহাত সামনে বাড়িয়ে সাবধানে এগোলো। হাতের আঙ্গুলের ডগা উল্টোদিকের দেয়াল ছুঁতেই সে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে পেছন দিকে হেঁটে এলো। কানিংহাম উত্তেজিত হয়ে হেসে উঠল। মনে হচ্ছে ভাগ্যদেবী সদয় হতে শুরু করেছে।
‘আশা করি তাই যেন হয়, কেইন বলল।
সে সবার হাতে হাতে বন্দুকগুলো দিয়ে ল্যাম্পটা জামালের হাতে দিল। জামাল পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল আর কেইন আর কানিংহাম পানিতে নেমে তাকে অনুসরণ করতে লাগল।
কনকনে ঠাণ্ডা পানি, একটু পর পানির স্তর কেইনের বাহুমুল পর্যন্ত উঠে এলো। প্রথমে সে সাব-মেশিনগানটা মাথার উপরে উঁচু করে ধরে রেখেছিল, কিন্তু এভাবে ধরে রাখায় একটু পর হাত ব্যাথা করতেই সে বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল।
পানির স্রোতের শক্তি ক্রমশ বেড়ে উঠতে শুরু করল। কেননা যে পথ দিয়ে পানির স্রোতটা বয়ে যাচ্ছিল তা ক্রমশ সরু হয়ে এসেছে। কেইন কানিংহামের এক ফুট পেছনে ছিল আর জামালকে দেখতে পাচ্ছিল সামনে ল্যাম্পটা উঁচু করে ধরে রেখেছে।
ছাদটা মনে হলো নিচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে, সে বুঝতে পারল এটা মাথা থেকে দুই কি তিন ফুট উচ্চতায় রয়েছে। পানির প্রবল স্রোত তাকে উপরের দিকে উঠাতেই সে প্রাণপণে সামনের দিকে ঠেলে এগোতে লাগল। তারপর তার মনে হলো সে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, পানিতে তার মাথা ডুবে গেল।
পা মাটি ছুঁতেই সে নিচের দিকে লাথি দিয়ে আবার উপরে ভেসে উঠল। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল আর ঢালু হয়ে আসা নরম শিলার সাথে হাঁটুর ধাক্কা লাগল।
এক মুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করল, বুক যন্ত্রণায় উঠানামা করছে। একটু পর বুঝতে পারল কানিংহাম তার পাশেই শুয়ে রয়েছে। জামাল হাত বাড়িয়ে দুজনকে তুলে হাঁটু পানিতে দাঁড় করাল। কনকনে ঠাণ্ডায় ওরা কাঁপছিল।
নদীটা একটা বিশাল গোলাকার জলাধারে এসে পড়েছে। আর আপাত বহির্গমনের পথ হচ্ছে পাথরের মাঝে সরু একটা ফাঁক। পথটা পাথর সাজিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পানির উপরিভাগ থেকে তিন ফুট উঁচুতে এর অবস্থান।
দীর্ঘকাল ধরে এটা এখানে রয়েছে মনে হচ্ছে,’ কানিংহাম বলল।
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। কিন্তু কি কাজের জন্য এটা এখানে রয়েছে সেটাই প্রশ্ন।
সে জামালের কাছ থেকে স্পট ল্যাম্পটা নিয়ে উপরে উঠল। দেয়ালটা প্রায় দশ ফুট উঁচু আর এর অসংখ্য ফাটল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরে পড়ছে। তারপর দেয়ালটা বাঁকা হয়ে নিচের দিকে চলে গেছে। অন্ধকারে পানি পড়ার শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে।
‘এটা নিশ্চয়ই মূল নদীপথ ছিল, কেইন বলল। দেয়ালটা এখানে তৈরি করা হয়েছে এর গতিপথ বদলাবার জন্য।’
সে ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে নিচের গভীর খাড়ির কালো পানির দিকে আলোটা ফেলল। এর অর্থ হলো এই পানি বের হওয়ার জন্য ওরা একটা কৃত্রিম বহির্গমন পথ তৈরি করেছে।
‘কিন্তু কেন?’ কানিংহাম বলল।
ঈশ্বর জানেন? কারণটা এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জায়গা থেকে বের হবার পথ বের করাটাই আসল কাজ। কেইন তার সাব-মেশিনগানটা দেয়ালের উপর রেখে ল্যাম্পটা কানিংহামের হাতে দিল। আপনি আমাকে যতদূর সম্ভব আলো দেখান। আমি নিচে গিয়ে একবার দেখে আসি।’
সে পানিতে নামল, তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পানির নিচে গেল। জলাধারটা প্রায় দশ ফুট গভীর আর উপর থেকে ল্যাম্পের আলো পানির মধ্য দিয়ে তাকে সাথে সাথে দেখতে সহায়তা করল যা সে দেখতে চেয়েছিল। এটা একটা নিচু খিলানযুক্ত প্রায় চার ফুট উঁচু টানেলের প্রবেশ পথ।
সে ভেতরের দিকে এগোলো, তার আঙুল দুপাশের পিচ্ছিল ও মসৃন দেয়ালে ঘষা খেল। তারপর অন্ধকার-ঘুটঘুঁটে অন্ধকার দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে ঘুরল। তারপর পেছন দিকে সাঁতার কেটে ল্যাম্পের হালকা আলোর দিকে ফিরে উপরে ভেসে উঠে বাতাসের জন্য হাঁসফাস করতে লাগল।
‘কী দেখলেন?’ কানিংহাম জানতে চাইল।
কেইন পানির মধ্য থেকে হেঁটে বের হয়ে দেয়ালের পাশে নরম শিলা স্তরের উপরে দাঁড়াল। ব্লাডি মার্ডার, ওখানে খুব সরু একটা টানেল রয়েছে যার মধ্য দিয়ে কোনমতে হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া যায়। আমি কয়েক গজ সাঁতার কেটে এগিয়ে ছিলাম, কিন্তু কোথায় গিয়ে এটা পৌঁছেছে সেটা বোঝার উপায় নেই।
সে উপরে উঠে দেয়ালের উপরে বসল। কানিংহাম নিচের ফাঁকটার দিকে ল্যাম্পটা মেলে ধরল। মনে হয় আবার আমরা একটা গ্যাড়াকলে আটকা পড়লাম, আর কোন উপায় আছে?
নিচের দিকে নামতে কোন সমস্যা নেই। পাথরের ব্লকগুলো মাঝে মাঝে ক্ষয়ে যাওয়ায় গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে যথেষ্ট পা রাখার জায়গা হয়েছে। ফাটলগুলো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি অনবরত ঝরে চলেছে।
নিচের খাড়া ও বাঁকা হয়ে নেমে যাওয়া মেঝেটা পিচ্ছিল আর পা হড়কে যাওয়ার সম্ভাবনা সব সময় রয়েছে। কেইন সাবধানে পঞ্চাশ গজ এগোল। তারপর ছাদটা নিচু হয়ে নেমে এসেছে আর ওরা একটা নিকশ অন্ধকার পথের মুখোমুখি হলো।
এখানে পানি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নেমে এসেছে। কেইন ল্যাম্পটা এক পাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত ঘোরাল। মসৃণ দেয়ালে আলো পড়তেই হাজার হাজার ছোট ছোট গাইতির দাগ চোখে ভেসে উঠল।
‘নদীটা প্রথমে নিশ্চয়ই এই পথ দিয়েই গিয়েছিল, কানিংহাম মন্তব্য করল।তবে তার পর কেউ এর মধ্যে প্রচুর কাজ করেছে।
কেইন ধীরে ধীরে সামনে এগোল, তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা জেগে উঠেছে। নদীর শব্দ পেছনে মিলিয়ে গেছে,ওরা এখন একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক অন্ধকার ও রহস্যময় জগতে।
প্যাসেজটা এঁকেবেঁকে ঘুরে ঘুরে নিচের দিকে এগিয়ে চলেছে। পানির গভীরতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। একটা বাঁক ঘুরতেই ওরা এক পাশে একটা শাখার সামনে এল।
কানিংহাম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কেইনের দিকে তাকাল। দেখি কি আছে!
প্রায় দশ ফুট আয়তনের একটা চৌকোনা কামরায় ওরা প্রবেশ করল। দেয়ালগুলো রাজমিস্ত্রির হাতে তৈরি। দুই ধারে মানুষ সমান উঁচু বিশাল বিশাল রসদ রাখার পাত্র দাঁড়িয়ে আছে নিরব প্রহরীর মতো।
‘শস্য ভান্ডার,’ কেইন বলল।
সে ঘুরতেই ল্যাম্পের আলো অপর দিকের দেয়ালে পড়তেই পরিষ্কার রঙিন আঁকা ছবি ভেসে উঠল।
পেইনটিংগুলো প্রাচীন কোন যুদ্ধ বিজয়ের দৃশ্য তুলে ধরেছে। পায়ে শিকল বাঁধা বন্দিরা সারিবদ্ধভাবে চলছে, বেশিরভাগের মুখে ছোট কোকড়ানো দাড়ি। তাদের পিঠ বাঁকা হয়ে রয়েছে মাছের লেজের আকারের বর্ম আর শিরস্ত্রাণ পড়া সৈন্যদের চাবুকের আঘাতে।
‘মাই গড, কানিংহাম বলল। এরকম কোন কিছু এর আগে আর কোথাও দেখেছেন?
‘কেবল নীল নদীর উপত্যকায় দেখেছি, কেইন জানাল তাকে। আরবে অবশ্যই নয়।
ওরা বাইরে বের হয়ে প্যাসেজে ঢুকল। তারপর আরো কয়েকটা কামরা পার হয়ে শেষ পর্যন্ত দুপাশে চওড়া পিলারওয়ালা একটা প্যাসেজে এলো। এর দেয়ালগুলো চিত্রকলায় পরিপূর্ণ।
এক জায়গায় কেইন একটা কুলুঙ্গির পাশে এসে থামল। এতে দুপাশে রং করা কয়েকটা মাটির বয়াম রাখা আছে। সে একটা তুলে পরীক্ষা করতে লাগল। কানিংহাম উত্তেজিত হয়ে কাছে এগিয়ে এল। এগুলো ভস্মাধার, তাই না?
কেইন মাথা কাত করে সায় দিল। পুরো ব্যাপারটা এবার ঠিক ঠিক মিলতে শুরু করেছে। ঐ শস্য রাখার পাত্র আর এগুলো। নিরাপদ যাত্রার জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত বস্তু। আমরা নিশ্চয়ই একটা সমাধির কাছে এসে পড়েছি।’
সে বয়ামটার গোল ঢাকনিটা তুলে ভেতরে তাকালো। ভেতরে কিছু নেই।
‘সম্ভবত তেল, মশলা কিংবা এ জাতীয় কিছু একটা ছিল–এত বছরে এটা উবে গেছে।
কানিংহাম আরেকটা বয়াম নিয়ে দেখল সেটাও খালি। কেইন ঘুরতে যাবে, এমন সময় তার চোখে পড়ল একটা ছোট বয়াম কুলুঙ্গির পেছনে একটা ছোট তাকের উপর দাঁড় করানো রয়েছে। উপরে মাটির সীলমোহর করা।
সে ল্যাম্পটা মাটিতে রেখে অন্য হাত দিয়ে বয়ামটা তুলে আনল। এক পা পিছুতেই পাত্রটা তার আঙুল ফসকে পাথরের মেঝেতে পড়ে ভেঙে খান খান হয়ে গেল।
সে ল্যাম্পটা তুলে মেঝের কাছে আলো ফেলে দেখল ভাঙ্গা মাটির টুকরোগুলোর মাঝে সোনার মতো কিছু একটা চক চক করছে আর এক ঝলক সবুজ আগুনের মতো দেখা গেল।
সে হাঁটু গেড়ে বসে সাবধানে জিনিসটা তুলে ধরল। চমৎকার একটা সোনার নেকলেস আর একটা পেনডেন্ট।
সোনার নেকলেসের মধ্যে অত্যন্ত যত্ন সহকারে তিনটে নিখুঁত পান্না সেট করা হয়েছে। পাথরগুলো ল্যাম্পের আলোয় চমকাচ্ছিল।
কানিংহাম মৃদু শিস দিয়ে উঠল। এটার জন্য ব্রিটিশ মিউজিয়াম যে কোন মূল্য দিতে পারে।’
কেইন রুমাল বের করে নেকলেসটা এর মধ্যে রেখে রুমালের চার কোণে গিঁট দিয়ে পকেটে রাখল।
আবার ল্যাম্পটা তুলে নিল। আমার মনে হয় সামনে আরো আছে। অনেক বেশি আছে।’
সে দ্রুত এগোতে লাগল। তারপর কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটা ব্রোঞ্জের তৈরি দরজার সামনে এলো। এখানে পানি উরু পর্যন্ত উঠেছে। কানিংহাম পানি ঠেলে সামনে এগিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখার ডান্ডাটা উপরে তুলল, তারপর সে আর জামাল দুজনে মিলে ভারী দরজাটা ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঠেলে খুলল।
দরজার সুইং পিনগুলো কঠিন পাথরে ড্রিল করে ছিদ্রে আটকানো ছিল আর দরজাটা অতি সহজেই কোন ধরনের চেষ্টা ছাড়াই সামান্য ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল।
একটা মুহূর্ত কেইন সেখানে দাঁড়িয়ে রইল, তার মনের মধ্য দিয়ে এক ধরনের কালো ঢেউ বয়ে গেল, যেন ওরা সাংঘাতিক কোন কিছুর সামনে এসেছে। কিন্তু কানিংহাম অধৈর্য হয়ে তাকে সামনে ঠেলে দিল।
.
১৪.
ওরা একটার বড় চেম্বারে প্রবেশ করল। ভেতরে পানির গভীরতা প্রায় তিন ফুট। এছাড়া কামরাটা সম্পূর্ণ খালি, তবে দেয়ালগুলো পেইনটিংয়ে পরিপূর্ণ। কেইন ধীরে ধীরে আলোটা ঘুরিয়ে পেইনটিংগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর কিছু একটা যেন লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড শক্তিতে তাকে ধাক্কা মারল।
একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে একজন রাজা কয়েক ধাপ সিঁড়ির উপরে একটি সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার গলায় ঝুলে রয়েছে স্টার অফ ডেভিড়। তিনি দুহাত বাড়িয়ে স্বাগতম করছেন একজন নারীকে, যিনি তার দিকে এগিয়ে আসছেন। তার পোশাকের দীর্ঘ ঝুল বহন করছে বারোজন কুমারী।
এক মুহূর্ত মনে হলো এই নারী অন্ধকার থেকে ভেসে উঠেছেন কিন্তু সেটা আসলে আলোর একটা কারসাজি। যেন অনেক দূর থেকে রাজার দিকে তাকিয়ে আছেন তার সৌন্দর্য নিয়ে। তার সৌন্দর্য চিরন্তন। আর রাজাও তার দিকে চেয়ে রয়েছেন। পেইনটিংয়ের উপরে সাবেঈন ভাষায় কিছু লিপি উৎকীর্ণ করা রয়েছে। কেইন ধীরে ধীরে এর অর্থোদ্ধার করতে লাগল। যখন পুরো লিপির মর্মোদ্ধার শেষ হলো তখন মনে হলো যেন দেয়ালটা দুলছে, আর অজানা একটা নিঃশব্দের ফিসফিসানি কামরার মাঝে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। যেন সময়ের অন্য প্রান্ত থেকে সেই নারীর কণ্ঠ তাকে ডাকছে।
সে এক হাত সামনে বাড়িয়ে মাথা ঠেকালো ঠাণ্ডা পাথরের দেয়ালের গায়ে। কানিংহাম বলল, “এখানে কী বলছে?
কেইন সোজা হলো। এখানে সোলায়মান বাদশাহ বিলকিসকে স্বাগতম জানাচ্ছেন।”
কানিংহাম এক পাশে হেলে পড়তেই, জামাল দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে ধরল। ল্যাম্পের আলোয় দেখা গেল ইংরেজ লোকটির মুখ সাদা হয়ে ঝুলে পড়েছে, আর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
বিলকিস, সে ফিস ফিস করে বলল, ‘শেবার রানি।’
জামালের হাত ছাড়িয়ে সে সামনে এগোল তারপর আঙ্গুলের ডগা দিয়ে আঁকা চিত্রটি অত্যন্ত যত্ন সহকারে স্পর্শ করল। যখন সে মুখ খুলল তখন তার কণ্ঠে বিস্ময়। বাইবেলের একটি কাহিনীকে আমরা জীবন দিয়েছি।
কেইন পানি ঠেলে কামরার অন্য প্রান্তে হেঁটে গেল। ল্যাম্পের আলোয় সেখানে আরেকটা প্রবেশ পথ দেখা গেল, এর চারপাশে বাঁকা পিলার। দরজার বদলে এখানে পাথর সাজানো রয়েছে।
কানিংহাম তার পাশে এসে দাঁড়াল। আপনি কি মনে করেন? তার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক আর অন্যরকম মনে হচ্ছে।
‘আমি বলেছিলাম এখানে প্রচণ্ড রকম মিশরীয় প্রভাব রয়েছে, কেইন তাকে বলল। অপর পাশে একটা পাথরের সমাধি কক্ষ অবশ্যই থাকার কথা।
কানিংহামের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। সে একটা ঢোক গিলে বলল, ‘আপনার কি তাই মনে হয় এটা সেখানে আছে?
‘এসব বিষয়ে যে কোন কিছু সম্ভবপর’ কেইন বলল। এটা আমি যেমন জানি আপনিও তেমন জানেন।’
কানিংহাম মাথা নাড়ল, তারপর ঘুরে দেয়ালের পেইনটিংগুলোর দিকে তাকাল। তাদের চলাফেরার কারণে পানিতে যে ঢেউ সৃষ্টি হয়েছিল তা আছড়ে পড়ছিল দেয়ালের গায়ে। তার দাঁতের মাঝ দিয়ে হিশশ শব্দ করে নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এল।
সে কেইনের হাত থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে সামনে চলতে শুরু করল। পানি তার চারপাশে বুদবুদ সৃষ্টি করছে। সে সোলায়মান আর বিলিকিসের পেইনটিংয়ের নিচে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
সে ককিয়ে উঠল। পানি পেইনটিংটা নষ্ট করছে, কেইন। কিছু অংশ ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে।’
কেইন কোন কথা না বলে তার হাত থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে তাকে টেনে দাঁড় করাল।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমরা এটা আবিষ্কার করতে পেরেছি,’ কানিংহাম বলল। আর কয়েক বছর পর ঐ বাধটা ভেঙে গেলে নদী এখানে চলে আসতো। সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেতো।
কেইন শান্তভাবে বলল, আমি জানি,
কানিংহাম উন্মাদের মতো হেসে উঠল। “ফর গড’স সেক, তুমি কি বুঝতে পারছে না আমরা এখানে কি পেয়েছি? আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্তিক সম্পদ আবিষ্কার করেছি। আমরা জগত বিখ্যাত হয়ে যাবো।’
কেইন বলল, তার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না,’ ‘অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আপনি আর কখনো কাউকে এই ঘটনার কথা বলার সুযোগ পাবেন বলে মনে হয় না।’
সে কানিংহামের হঠাৎ মর্মাহত চেহারা থেকে মুখ ফিরিয়ে ল্যাম্পটা জামালের হাতে দিয়ে পানি ঠেলে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। কানিংহাম সেখানেই, কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল আর সে ওদের অনুসরণ করার আগেই ওরা প্যাসেজ দিয়ে পেছন দিকে ফিরে চলল।
নিচু প্রবেশ পথটা দিয়ে মাথা নিচু করে ফিরে গিয়ে ওরা জলাধারের জলবন্ধনের জন্য যে দেয়াল ছিল তার খাড়া পার বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। কানিংহাম পিছু পিছু গিয়ে কেইনের কাঁধ খামচে ধরল।
তার মুখ ফ্যাকাশে, ক্লান্ত আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে, কেইন। একটা পথ খুঁজে বের করতেই হবে।’
‘পথ একটা খুঁজে বের করা সহজ, কেইন বলল। সেটা আমি এখন বুঝছি। তবে সমস্যা হলো আপনি সে পথ গ্রহণ করতে রাজি আছেন কি না।
জামাল দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে হাত বাড়িয়ে একে একে দুজনকেই উপরে ওঠালো। কেইন ল্যাম্পটা নিয়ে পানির দিকে আলোটা ধরল। কানিংহাম বলল, “আপনি কি পানির নিচের টানেলের কথা বলছেন? কিন্তু আপনি নিজেই তো বলেছিলেন এ পথে যাওয়া অসম্ভব।’
‘অসম্ভব হবে না যদি সেখানে পানি না থাকে, কেইন বলল।
কানিংহাম ভ্রু কুঁচকালো। বুঝলাম না।
‘অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। আমরা নদীর উজানে গিয়ে গুহার যে জায়গায় যন্ত্রপাতিগুলো রেখেছি সেগুলো আনতে যাবো। দেয়ালটা ইতোমধ্যেই নড়বড়ে অবস্থায় আছে। এটা ভাঙ্গতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। তারপর জলাধারের পানি খালি করে নদীকে তার মূল গতিপথে ফিরিয়ে দেব।
কানিংহাম তখনো ভ্রু কুঁচকে রয়েছে। আপনি তামাসা করছেন। এতে পুরো প্যাসেজ আর মূল কামরা পানিতে ভেসে যাবে, এমনকি সমাধিতেও পানি ঢুকে যেতে পারে। ঐ পেইনটিংগুলো পানিতে একদিনও টিকবে না। ওগুলো চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে।’
‘আমি জানি, কেইন ধৈর্য সহকারে বলল। এছাড়া আমার হাতে আর কোন উপায়ও নেই। আমি মনে করি আপনার মনে এখনো আপনার স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে।’
কানিংহাম এমন প্রতিক্রিয়া দেখাল যেন তাকে শারীরিকভাবে কেউ একটা ধাক্কা দিয়েছে। সে অন্যদিকে মুখ ফেরালো। কেইন বলেই চলল-”আপনার আসার দরকার নেই। জামাল আর আমি সামলাতে পারব, তবে আলোটা আমাদের নিয়ে যেতে হবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো।
‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না, কানিংহাম বলল। আমি ঠিক থাকব।’
কেইন একটু ইতস্তত করল, সে ভাবলো এই ইংরেজ লোকটি হয়তো বোকার মতো কিছু একটা করে বসতে পারে। তারপর সে ঘুরে দ্রুত আরবিতে জামালকে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলল।
জামাল ল্যাম্পটা নিয়ে পিছন দিকে পথ দেখিয়ে চলল। ওরা পিছল পাথুরে ঢাল বেয়ে উল্টোদিকে টানেলের অন্ধকার মুখটার দিকে উঠতে শুরু করল, যে পথ দিয়ে নদীর পানি জলাধারে এসে পড়েছে। কেইন যেরকম ভেবেছিল, ফেরত যাত্রাটা সেরকম মন্দ হলো না। কেবল দুয়েক জায়গায় ফাঁকটা একটু সরু হওয়ায় পানির স্রোত ওদেরকে পেছন দিকে চাপ দিচ্ছিল।
নরম শিলার খাড়া পারের কাছে পৌঁছে ওরা হাঁচড়ে পাঁচড়ে উপরে টানেলের মুখে পৌঁছে গুহা থেকে মুক্ত হলো। এখন এক অদ্ভুত অপরিচিত অনুভূতি হচ্ছিল মনে, যেন এটি এমন এক জায়গা যেখানে ইতোপূর্বে বহু বছর আগে কেউ স্বল্প সময়ের জন্য এসেছিল, আর কখনো নয়।
কেইন গাইতি তিনটা তুলে নিল, জামাল হাতুড়ি আর ক্রোবারগুলো নিল। তারপর ওরা আবার নিচে পানির মাঝে প্রবেশ করল। ফিরতি যাত্রায় মনে হলো মাত্র কয়েক মিনিট লেগেছে আর জামাল সাবধানে পিছল ঢাল বেয়ে নিচে জলাধারে নামল। ল্যাম্প ঘুরিয়ে দেখল কানিংহামকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
ওরা যন্ত্রপাতিগুলো তাড়াতাড়ি মাটিতে রাখল আর কেইন ল্যাম্পটা নিয়ে ডেকে উঠল, কানিংহাম!’
তার কণ্ঠস্বর গুহার চার দেয়ালের মধ্য থেকে প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে ফিরে এল কিন্তু কোন উত্তর এলো না। সে আবার ডাকতে যাবে, এমন সময় নিচে পাথরের মেঝেতে বুটের শব্দ পাওয়া গেল। কেইন ল্যাম্পটা ফাঁকটার দিবে নামিয়ে ধরতেই দেখা গেল কানিংহাম খাড়া পথ দিয়ে উঠে আসছে।
সে শান্ত দৃষ্টিতে কেইনের দিকে তাকাল। চোখের সামনে হাত দিয়ে আলো ঢেকে বলল, “আপনারা বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন।
‘আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? কেইন জানতে চাইল।
কানিংহাম ঘুরে নিচে টানেলের প্রবেশ পথটার দিকে তাকাল। আমি আরেকবার দেখতে গিয়েছিলাম।’
‘আলো ছাড়া?’ কেইন হতবাক হয়ে বলল।
কানিংহাম মৃদু হাসল আর সাথে সাথে তার চেহারা থেকে যেন সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। আমি তাকে দেখতে পাইনি, কিন্তু জানতাম সে সেখানেই আছে। সে একটা গভীর শ্বাস নিল। এখানে এই গোড়া থেকে কাজটা শুরু করলে ভাল হবে। কিছু কিছু পাথর ক্ষয়ে গেছে।’
কেইন বলার মতো কিছু ভেবে পেল না। সে জামালের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে দেয়ালের কাছে গেল। জামাল যন্ত্রপাতিগুলো হাতে হাতে দিতেই ওরা কাজ শুরু করে দিল।
আধ ঘণ্টা লাগল প্রথম পাথরটা তুলতে, জামালের প্রচণ্ড শক্তি খুব কাজে দিল। শেষ কয়েক ইঞ্চি পানির চাপ পাথরটার গায়ে জোর ঠেলা দিল, বোতলের ছিপিতে যে রকম হয়। তারপর পানি ছিটকে বেরিয়ে ফেনা তুলে ফাঁকের মধ্য দিয়ে নিচে অন্ধকারে প্রবল বেগে পড়তে লাগল।
একটা ফাঁক তৈরি করার পর বাকি কাজটা বেশ সহজ হয়ে পড়ল। জামাল এগিয়ে গেল, পানি তার পিঠ বেয়ে নেমে চলেছে, সে পরের পাথরটা দুহাতে টেনে সরালো।
এক মিনিটের মধ্যে পানি হাঁটু পর্যন্ত নেমে এলো। কেইন কানিংহামের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলল। একবার যখন পথটা আমরা ভেঙেছি, কাজেই একটু পরেই পুরোটা ভেঙে পড়বে। চলুন কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি আমরা অন্য পাশে চলে যাই।
ওরা দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে নরম শিলাস্তর আর বালুর উপরে এসে দাঁড়াল। বছরের পর বছর ধরে দেয়াল আর গুহার কোণে বালুর স্তর জমা হয়েছিল। ধীরে ধীরে জলাধারের পানির স্তর নেমে যেতে লাগল।
এখন নদীর পানি ফাঁক থেকে বের হয়ে নতুন পথ খুঁজে পেয়ে সেখান দিয়ে বের হয়ে যেতে লাগল। এই ধাক্কায় দেয়ালটা কাঁপতে শুরু করল। প্রায় আধ ঘণ্টা পর এটি মাঝখানে ধ্বসে পড়ল, তারপর পানি জলপ্রপাতের মতো ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে চলতে লাগল।
ইতোমধ্যে টানেলের উপরিভাগ দষ্টিগোচর হলো আর দশ মিনিটের মধ্যে পানি দুই ফুটে নেমে এল। জামাল ল্যাম্পটা নিয়ে মাথা নিচু করে টানেলে ঢুকে পড়ল। আর কেইন সাব-মেশিনগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে তাকে অনুসরণ করল।
সামনে অন্ধকারে ঢুকতেই পানি তার হাঁটুর চারপাশে ঘুরতে শুরু করল। তার মনে পড়ল সেই লোকগুলোর কথা যারা বহু বছর আগে মাটির নিচে এই অন্ধকারে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরে কাজ করে চলেছিল এই আশায় যেন তাদের রানি মৃত্যুর পর একটি নিরাপদ বিশ্রামের জায়গা পায়।
নদীটা হঠাৎ একটি চওড়া লেকে এসে পড়ল। কেইন আবার সাঁতার কাটতে লাগল। জামাল আলো উঁচু করে ধরতেই দূর প্রান্তে কতগুলো কারুকাজ করা স্তম্ভ আর একটা নৌকার ঘাট দেখা গেল।
জামাল প্রথমে সেখানে পৌঁছে সহজেই উপরে উঠে পড়ল যদিও লেকের পানি কয়েক ফুট নেমে গেছে। তারপর সে নিচু হয়ে একের পর এক কেইন আর কানিংহামকে উপরে তুলল।
কেইন ল্যাম্পটা নিয়ে স্তম্ভগুলোর মধ্য দিয়ে সামনে এগোলো। তারপর একটা চওড়া প্যাসেজে ঢুকল। প্যাসেজটা একটু উপরের দিকে উঠে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পর ল্যাম্পের আলো গিয়ে পড়ল একটা খালি দেয়ালে।
কেইন হাঁটু গেড়ে বসে দেয়ালটা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করল। দেখে মনে হচ্ছে এই মাঝখানের ব্লকটাই ঘুরবে।’ সে কানিংহামকে বলল।
সে দ্রুত আরবিতে জামালকে কিছু বলল আর জামাল হাঁটু গেড়ে বসে সর্বশক্তি দিয়ে ঐ পাথরটা ঠেলতে শুরু করল। পাথরটা একচুলও নড়লো না। জামাল ঘোৎ করে একবার শব্দ করে উঠল, তার পিঠ বাকা হলো আর পেশিগুলো দড়ির মতো ফুলে উঠল। তারপরও পাথরটা তখনো নড়ছে না।
কেইন হাঁটু গেড়ে বসে কাঁধ দিয়ে ঠেলতে শুরু করল। আর কানিংহাম অন্য দিকে দিয়ে কাঁধ দিল। একটা মুহূর্ত মনে হলো ওরা পৃথিবীর সমস্ত শক্তির সামনে দাঁড়িয়েছে। যেন কোন এক অলৌকিক শক্তি বলে তারা দৃঢ় সংকল্পিত হয়েছে যে এখান থেকে সরবে না। তারপর একটা গোঙানি দিয়ে পাথরটা ঘুরল।
কেইন উঠে দাঁড়াল তারপর চারপাশে তাকাল। ওরা এখন মন্দিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর এই পাথরটা সেই উঁচু বেদির তলায় বসানো ছিল।
ওরা পাথরটা আবার আগের জায়গায় ঠেলে বসিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই ভোরের সূর্যের আলো তাদের চোখে পড়ল। ওদের সামনে গিরিপথটা স্থির আর শান্ত হয়ে আছে। কানিংহাম কুঁচকালো। ‘খুব বেশি নিরব মনে হচ্ছে।
বেশিরভাগ বেদুঈনই গতকাল বিকেলে তাদের কাফেলা নিয়ে চলে গেছে, কেইন বলল। বাদবাকি যারা ছিল তারা হয়তো আজ ভোরেই রওয়ানা দিয়েছে।’
সে সাবধানে যদূর সম্ভব আড়ালে থেকে তাঁবুগুলো যেখানে ছিল সেদিকে ওদের এগিয়ে নিয়ে চলল। গর্তটার কিনারার কাছে পৌঁছে সে পেটের উপর ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বাকি পথটা গেল।
অস্থায়ী ক্যাম্পটা আর নেই। তবু, ট্রাক–কিছুই নেই। এক মুহূর্ত সেখানে শুয়ে ভ্রু কুঁচকে সে ভাবলো। তারপর জামাল তার কাঁধে টোকা দিয়ে আঙুল নির্দেশ করে মরুদ্যানের বাইরে একটা জায়গা দেখাল–সকালের বাতাসে হালকা ধোঁয়া উড়ছে।
সাব-মেশিনগানটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কেইন ওদেরকে পেছনে নিয়ে আগে আগে গর্তে নামল। গাছগুলোর কাছে আসতেই একটা উট কেশে উঠল আর তার সাথে হাসির শব্দ শোনা গেল।
মরুদ্যানের অপর ধারে দুটি বেদুঈন তাঁবু তখনো দাঁড়িয়ে আছে, কাছেই অন্তত এক ডজন উটের দু’পা বেঁধে রাখা হয়েছে। একজন লোক আগুনের সামনে আসন পেতে বসে কিছু রান্না করছে। আর বাকি তিনজন ডোবার হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে গা ধুচ্ছে।
কেইন কানিংহামের দিকে ফিরে চুপিচুপি বলল, আপনি তাঁবুর পেছন দিক দিয়ে আসুন। জামাল ডেরাটার অন্য পাশ থেকে আর আমি এখান থেকে এগোবো।’
বাকি দুজন জায়গামতো পজিশন না নেওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করল। তারপর একটা গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে সে ধীরে ধীরে সামনে এগোলো। আগুনের একগজ দূরত্বে এসে সে থামল। বেদুঈন লোকটি হাঁড়িতে কিছু একটা নাড়ছিল। সে হেসে উঠে ডোবার পানিতে থাকা লোকগুলিকে ডাকার জন্য মুখ তুলতেই সামনে কেইনকে দেখতে পেল। তার হাসি থেমে গেল।
‘আমি যা করতে বলছি তা করলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না, কেইন আরবিতে বলল।
লোকটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। আমি অতো বোকা নাই।
কেইন প্রথমে যা ভেবেছিল, তার থেকে লোকটি বেশি বয়স্ক। চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, মুখ ভর্তি বলিরেখা আর কাঁচাপাকা দাড়ি। বাকি তিন সঙ্গী ডোবার পানি ঠেলে তার কাছে উঠে এল। জামাল আর কানিংহামও ওদের পেছনে এসে দাঁড়াল।
‘বাকি লোকজন কোথায়? কেইন জিজ্ঞেস করল।
‘সবাই মনে করেছিল তোমরা মরে গেছো,’ বৃদ্ধ লোকটি বলল।
‘সাহেব দুটো আর তাদের লোকজন ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ট্রাকে করে চলে গেছে। এরপর ইয়েমনিরা ভোরবেলায় চলে যায়।
‘তোমরা রয়ে গেলে কেন?
‘আমরা রশিদ,’ বৃদ্ধ সহজভাবে বলল। আমরা আমাদের আত্মীয়কে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। আমার জ্ঞাতি ভাই একটা তাঁবুতে শুয়ে আছে। গত রাতে তোমার বন্দুকের গুলি তার কাঁধে লেগেছিল। ঐ সাহেবদের একজন চলে যাওয়ার আগে গুলিটা বের করে দেয়।
‘আর মেয়েরা?’
বৃদ্ধ কাঁধে একটা ঝাঁকি দিল। ওরাও ট্রাকে আছে।
কেইন কানিংহামের দিকে তাকাল। আপনি বুঝতে পেরেছেন সব কথা?
সে ঘাড় কাত করল। এখন আমরা কি করব?
‘একমাত্র যে কাজটি আমরা করতে পারি, তা হলো ওদের পেছনে যাওয়া।’ কেইন বৃদ্ধ রশিদ গোত্রের লোকটির দিকে ঘুরল। তোমাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে।
অন্য তিন সঙ্গী বিড় বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ করল। আর বৃদ্ধ এক হাত উঠিয়ে ওদের থামাল। কেন সাহায্য করব আমরা? তোমরা আমাদের শত্রু।’
কারণ, এছাড়া তোমাদের আর কোন উপায় নেই, সাব-মেশিনগানটা উঁচু করে কেইন বলল। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর তোমার সবচেয়ে ভাল তিনটা উট বেছে দেবে। জেনে রাখ এই সোমালি লোকটি কিন্তু এ ব্যাপারে একজন ওস্তাদ।’
বৃদ্ধ রশিদ বলে উঠল, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন। তার তিন সঙ্গী পা ভাঁজ করে গোমরামুখে বসে রইল। আর বৃদ্ধ দুটো টিনের মগে কফি ঢেলে বিনয়ের সাথে কেইন আর কানিংহামকে দিল।
কেইন কৃতজ্ঞতার সাথে একটু কফি পান করল। কানিংহাম বলল, কিন্তু ওদেরকে ধরার তো কোন আশা নেই।’
কেইন সায় দিল। আমি জানি, তবে যদি আমরা অল্প সময়ের মধ্যে বার আল-মাদানিতে পৌঁছে জর্ডনের কাছ থেকে একটা ট্রাক নিতে পারি, তাহলে ওদের আগেই দাহরান পৌঁছার একটা আশা আছে।’
‘মাই গড, আমার মনে হয় আপনি ঠিক বলছেন, কানিংহাম ব্যগ্র হয়ে বলল। আমার যখনই রুথের কথা মনে পড়ে…’ তার গলা থেমে গেল। সে তাড়াতাড়ি এক ঢোক কফি খেল।
কেইন দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে বলতে চেষ্টা করল। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। স্কিরোজ খুব তাড়াতাড়ি দাহরান ছেড়ে যাবে না। তাড়াহুড়া করার তো কারণ নেই তার।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে খুব একটা নিশ্চিত ছিল না। স্কিরোজ নিশ্চয়ই খুব দুঃশ্চিন্তায় আছে। এছাড়া তার হঠাৎ করে চলে যাবার আর কী কারণ থাকতে পারে? হয়তো সে বুঝতে পেরেছে তার সুদিন শেষ হয়ে এসেছে। আর তাই একজন ভালো জুয়ারির মতো খেলায় এগিয়ে থাকতে থাকতে সে উঠে যাচ্ছে।
কেইন চোখ কুঁচকে নীল আকাশের দিকে তাকাল। দেখলো একটা বাজ পাখি বিরাট একটা বৃত্ত ঘুরে ঘুরে নিচের দিকে নামার আগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জীবনে কী হতে পারে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। এই দেশ যদি কিছু তাকে শিখিয়ে থাকে, সেটা এই।
.
১৫.
জামাল সবচেয়ে ভালো তিনটা উট বেছে নিল। তারপর ঘণ্টাখানেক পর ওরা রওয়ানা হলো। কেইন আর কানিংহাম বেদুঈনদের ঢিলাঢালা আলখাল্লা আর মাথায় আরবি স্টাইলে কাপড় জড়িয়ে নিল। জামাল পানি ভর্তি দুটো ছাগলের চামড়ার মশক নিয়ে তার উটের পিঠের গদির দুপাশে ঝুলিয়ে নিল। বৃদ্ধ রশিদ আর তার সঙ্গী বেদুঈনরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগুলো দিতে বাধ্য হলো।
কেইন একটা মদ্দা উটের পিঠে সওয়ার হয়েছিল। বিশাল, শক্তিশালী কালো উটটা অসম্ভব দ্রুত গতিতে গিরিখাতের বাইরের সমতল ভূমির উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল।
ক্যাটালিনা প্লেনটার টুকরো টুকরো দোমরানো মোড়ানো ধাতব অংশ আর ফিউজলেজটা বিরাট জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ পার হওয়ার সময় কেইন অবাক হয়ে তাকাল। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না কত সহজে ওরা এটা ধ্বংস করেছিল।
সমতল ভূমি পার হয়ে বালিয়াড়ির মাঝে ঢুকতেই প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে মুখ বাঁচাবার জন্য সে মাথার কাপড়ের একটা ভাজ তুলে মুখ ঢাকলো।
বিশাল বিশাল বালুর ঢেউ নিয়ে যতদূর চোখ যায় মরুভূমি গড়িয়ে চলেছে সামনে। সে উটের পিঠে কাঠের গদিতে আরো আরাম করে বসে উটটিকে চালিয়ে নিতে লাগল। গতিই একমাত্র জিনিস যা এখন তাদের সাহায্য করতে পারে। সেটা আর এই সত্যটা যে স্কিরোজ হয়তো আশা করবে না যে ওরা তার পিছু নেবে।
পেছন ফিরে দেখল জামাল কাছেই আছে আর তার পিছনে কানিংহাম অনুসরণ করছে। তাকে দেখে কানিংহাম হাত তুলে স্যালুট করল। কেইন মুখ ফিরিয়ে সামনের পদচিহ্নের দিকে মনোনিবেশ করল।
লম্বা লম্বা পা ফেলে চলার পথে উটটি একবারও হোঁচট খায়নি। বিশাল পা দিয়ে অক্লান্ত ভাবে মরুভূমি পার হয়ে চলেছে। কড়া রোদের তাপে কেইন চোখ অর্ধেক বন্ধ করে ধীরে ধীরে আধো ঘুম আধো জাগ্রত এমন একটা অবস্থায় চলে গেল।
সে ভাবছিল স্কিরোজের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে। সম্ভবত সে দাহরানের দিকে যেতে চেষ্টা করবে, কেননা সে নিশ্চিত ধরে নিয়েছে তাকে অনুসরণ করার মতো আর কেউ নেই। আমেরিকান কনসাল কোন ধরনের খোঁজ খবর নেওয়ার আগেই সেখানে কয়েকদিন থেকে সব কিছু গুছিয়ে নেবে, তারপর সেখান থেকে চলে যাবে।
মেয়েদেরকে নিয়ে কি করবে সেটা ভাবনার বিষয়। আগের রাতে তাবুর বাইরে থেকে যে আলোচনা শুনেছিল সে কথাগুলো স্মরণ করল। স্কিরোজ কি বলেছিল? সে মেরি পেরেটকে একটা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।
কথাটা ভাবতেই কেইন শিউরে উঠল। সেই সাথে এ চিন্তাটা মন থেকে ঠেলে সরালো। এখন তাকে বার আল-মাদানিতে পৌঁছার বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। সে আরো আরাম করে গদিতে বসে উটটিকে তাড়া দিল।
.
স্বপ্নের মতো সকালটা পেরিয়ে গেল, তারপর যেন একটা বিশাল জাহাজে চড়ে বালুর উপর ভাসতে ভাসতেই দুপুর গড়ালো। বেশ কয়েকবার ওদেরকে নিচে নেমে বড় বড় বালিয়াড়ির খাড়া দিক দিয়ে উটগুলোকে টেনে নিতে হয়েছিল। একবার থেমে শুকনো খেজুর আর পানি খেলো।
কানিংহামকে দেখে পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল। তার দুচোখে ক্ষত আর চারপাশ লাল হয়ে উঠেছে। পাতলা, সংবেদনশীল মুখ বালুতে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। কেইন অত্যন্ত কটু আর বিস্বাদ পানি একটু খানি গিলে সামান্য মুখ বিকৃত করল। তারপর কানিংহামের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। আপনি ঠিক আছেন তো?’
কানিংহাম ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে একটু হাসল। একটু ক্লান্ত বোধ করছি। তবে ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাবেন না এই পথ দিয়েই আমি উল্টো দিকে গিয়েছিলাম।’
ওরা আবার উটের পিঠে চড়ে চলতে শুরু করল। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপর। প্রচণ্ড তাপ আগুনের চাবুক দিয়ে যেন ওদের পিঠ চাবকাচ্ছে। কেইনের মাথা ঝুঁকে রয়েছে ওর বুকের কাছে, ওর উটটি নিজের ইচ্ছে মতো পথ চলছে। সে ক্লান্ত–খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। গত তিন চার দিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। একজন মানুষের পক্ষে যা অত্যন্ত বেশি।
সে ধারণা করল বিকেলের বাকি সময়টা সে উটের পিঠে অজ্ঞান অবস্থায় ছিল, কেননা হঠাৎ অনুভব করল সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুবে যাচ্ছে আর মৃদু বাতাস তার মুখে হুল ফোঁটাচ্ছে। জামাল তার উটের লাগাম হাতে নিয়ে পাশে পাশে চলছিল।
কেইন উটের পিঠ থেকে নেমে মাটিতে বসে পড়ল। এপাশ ওপাশ মাথা আঁকিয়ে জেগে উঠতে চেষ্টা করতে লাগল। তার মুখ শুকনো হয়ে রয়েছে আর মুখ ভর্তি বালু। কানিংহাম তার পাশে এসে ঢলে পড়তেই জামাল একটা ছাগলের চামড়ার পানির মশক নিয়ে ওদের হাতে দিল।
ওরা দুজনে দু’বার করে পানি খেতেই মশকটা খালি হয়ে গেল। জামাল খালি মশকটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার উটের কাছে গিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল।
কানিংহামের মুখ বসে পড়েছে। মুখের চামড়া চিবুকের হাড়ের উপর টাইট হয়ে লেগে রয়েছে। সে একজন বুড়ো মানুষের মতো কর্কশ গলায় বলে উঠল, ‘এখন আমরা কী করব–রাতেও কী চলবো?”
কেইন সায় দিল। “উটগুলো এখনও ভাল অবস্থায় আছে। ওদের আগেই আমরা পানির অভাব অনুভব করব। রাতের ঠাণ্ডায় আমাদের চলতে সুবিধা হবে।
‘আর স্কিরোজ কী করবে?
কেইন বলল, সেটা আরেক বিষয়। সেও হয়তো শীঘ্রই ক্যাম্প করবে।’
তারপর সে অনেক কষ্ট করে দুপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাতাসে বালু উডে এসে তার মুখে পড়ছে। এমন সময় জামাল ওর দিকে দ্রুত ছুটে এল চোখ বড় বড় করে।
সে ওর এক কানে হাত গোল করে ধরল, অর্থাৎ বোঝাতে চেষ্টা করল কিছু শুনতে। কেইন শুনলো। দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে মানুষের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর।
তার মাঝে উত্তেজনা জেগে উঠতেই সমস্ত ক্লান্তি তার কাঁধের উপর থেকে একটা পুরোনো আলখাল্লার মতো ঝরে পড়লো। আপনি শুনতে পেয়েছেন? সে কানিংহামকে জিজ্ঞেস করল।
কানিংহাম মাথা নাড়ল। কিছু একটা ঘটেছে, সেজন্য ওরা আগেভাগেই ক্যাম্প করেছে।’
‘কারণটা যাই হোক, ওদের জন্য একটা চমক অপেক্ষা করছে, কেইন বলল।
ওরা উটগুলোকে বেঁধে রেখে সাবধানে পায়ে হেঁটে সামনে এগোতে লাগল। গাড়ির চাকার দাগ একটা বড় বালিয়াড়ির গোড়া ঘিরে ঘুরে গেছে কেইন এক মুহূর্ত ইতস্তত করল, তারপর বালিয়াড়ির খাড়া দিক দিয়ে উঠতে শুরু করল। নরম বালুতে হাঁটু পর্যন্ত ওদের পা ডুবে যেতে লাগল।
চূড়ার শেষ কয়েক ফুট সে পেটে ভর দিয়ে বেয়ে উঠল তারপর সাবধানে মাথা তুলল। সত্তর কি আশি ফুট নিচে একটা শূন্য গর্ভে একটা তাঁবু খাটানো রয়েছে। তাবুর পাশে হুড উঠানো অবস্থায় একটা ট্রাক রয়েছে। একজন আরব ইঞ্জিনের মধ্যে কিছু মেরামতি কাজ করছে।
কানিংহাম যখন উপরে উঠে এলো, তখন দেখা গেল তাবুর পর্দা সরিয়ে রুথ কানিংহাম বের হলো। সেলিম তাকে পেছন থেকে ঠেলছে। মনে হলো রুথ সমস্ত আশা হারিয়ে পা টেনে টেনে সামনে একটা জ্বলন্ত স্পিরিট স্টোভের দিকে এগোচ্ছে। সে একটা পাত্র নিয়ে স্টোভের উপর বসালো। সেলিম তার কাছে দাঁড়িয়ে হাসছে।
কানিংহাম উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই কেইন তাকে টেনে বালিয়াড়ির চূড়ার প্রান্তের নিচে বসালো। বোকামি করবেন না। সেলিমকে আঘাত করতে গেলে রুথ আহত হতে পারে। আর যদি আপনি হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তবে অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই সে রাইফেল তাক করবে রুথের দিকে।
‘কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে, কানিংহাম মরিয়া হয়ে বলল। ‘অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারব না।’
কেইন চোখ সরু করে একটা সমাধানের পথ খুঁজতে লাগল। তারপর হঠাৎ একটা উত্তেজনায় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমার মনে হয়ে একটা উপায় পেয়েছি, তারপর সে দ্রুত প্ল্যানটা খুলে বলল।
তার বলা শেষ হওয়ার পর কানিংহাম উঠে বসল, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। প্ল্যানটা ভালই। অন্তত একটা সুযোগ নেওয়া যায়।
সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই কেইন তার শার্টের হাতা টেনে ধরল। ‘এটা আমি সামলাবো। আপনার অবস্থা দেখে খুব একটা ভাল মনে হচ্ছে না।’
চোয়াল শক্ত করে সে মাথা নাড়ল। সে আমার স্ত্রী, শুধু এ কথাটাই বলল, কাজেই এটা আমার কাজ।
কেইন তার সাথে আর তর্ক করার চেষ্টা করল না। কানিংহাম সাব মেশিনগানটি একবার পরীক্ষা করে আলখাল্লার নিচে লুকিয়ে এক হাতে ধরে রাখল। একবার মৃদু হেসে মাথার কাপড়টা পেছনের দিকে ঠেলে সরিয়ে বালিয়াড়ির চূড়ার উপর উঠে দাঁড়াল।
প্রথমে তারা ওকে দেখতে পায়নি, তারপর সে মুখ খুলে কর্কশ ও ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘পানি! পানি, ঈশ্বরের দোহাই আমাকে পানি দিন! সে ইচ্ছে করে হাতড়ে হাতড়ে এক পা এগোলো, তারপর হুড়মুড় করে বালুর উপর মাথা নিচু করে পড়ে গেল। গড়াতে গড়াতে নিচে শূন্য গর্ভের দিকে পড়তে লাগল।
প্রথম চিৎকারটা শুনেই সেলিম আর তার সঙ্গীরা বিপদাশঙ্কা করে সাথে সাথে রাইফেল হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলো। কানিংহাম গড়াতে গড়াতে বালিয়াড়ির নিচে এসে থামতেই কেইন সাবধানে সামনে এগিয়ে বালিয়াড়ির চূড়ার কিনারা দিয়ে নিচে উঁকি দিল। কানিংহাম কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকল, তারপর খুব কষ্ট করে পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পানি!’ সে গুঙিয়ে উঠল, তারপর মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল।
রুথ কানিংহাম লাফিয়ে উঠল। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে একটা মুহূর্ত সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল, তারপর সামনে এগোতে শুরু করল। সেলিম তার কাঁধ ধরে তাকে টেনে তাঁবুর দিকে নিয়ে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর ঘুরে তাকাল।
কানিংহাম এক হাঁটুর উপর ভর দিয়ে কাতর প্রার্থনার ভঙ্গীতে তার দিকে এক হাত বাড়াতেই সেলিম হেসে উঠল। সে তার সঙ্গীর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলে রাইফেলটা মাটিতে রেখে সামনে এগোল।
এবার কানিংহাম উঠে দাঁড়িয়ে সাব-মেশিনগানটা বের করতেই সেলিম ঘুরে দৌড়াতে শুরু করল। সাব-মেশিনগানের লম্বা একটানা গুলির সবগুলো তার পিঠে গিয়ে পড়ল। পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
অন্য লোকটি তখনও রাইফেল হাতে ট্রাকটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে রাইফেল উঠিয়ে লক্ষহীন ভাবে একটা শট ফায়ার করল। কানিংহাম তার দিকে ঘুরল, এক লাইনে গুলি বালু উড়িয়ে নিয়ে লোকটিকে পেছনের দিকে ঠেলে ট্রাকটার গায়ে ছুঁড়ে ফেলল।
তারপর সে গুলি করা থামাল। হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা সেলিমের উপরে এসে দাঁড়াল। তখনই তাঁবুর পর্দা সরিয়ে রুথ বেরিয়ে এসে কানিংহামের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কেইন বালিয়াড়ির চূড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকাল। বাতাসের ঝটকায় বালুকণা উড়িয়ে নিয়ে এসে ওর মুখে ঝাপটা মারল। সে টিলাটা বেয়ে নিচে নেমে পড়ল, জামালও তার সাথে সর সর করে ঢাল বেয়ে নামল।
কানিংহাম তার স্ত্রীকে শক্ত করে ধরে রাখল। আকস্মিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সে কাঁপতে শুরু করল। সব ঠিক হয়ে গেছে, সে বলল। সে আর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
সেলিম মারা গেছে, তার আঙুলগুলো বালু আঁকড়ে ধরে রয়েছে। কেইন তার দিকে তাকাল, তার মনে কোন অনুকম্পা জাগলো না। অন্য লোকটা ভয়ানকভাবে গোঙাচ্ছিল। জামাল তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার মাথা তুলল। কেইন এগোতেই লোকটার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মুখ থেকে রক্ত বের হতে লাগল। মাথা পেছনের দিকে হেলে পড়ল আর জামাল আস্তে করে তাকে মাটিতে শোয়াল।
কেইন জিজ্ঞেস করল, ‘লোকটা কি মরে গেছে?
জামাল মাথা নেড়ে সায় দিল, তারপর ট্রাকের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখাল। ট্রাকের এক পাশের বডিতে পরিষ্কার এক লাইন বেঁধে বুলেটের ছিদ্র দেখা গেল। গাড়ির গায়ে ব্রাকেটে আটকানো পানির জেরি ক্যানগুলো সব খালি হয়ে গেছে। তারপর কেইন ইঞ্জিন পরীক্ষা করে দেখল এটা আর সারানো যাবে না।
সে কানিংহাম আর তার স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকাল। শেষের গুলিগুলো ট্রাকের গায়েও লেগেছে। এখন একমাত্র উটের উপর ভরসা করেই আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আপনার কী অবস্থা?
কানিংহামের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। তারপরও সে মৃদু হাসল। ‘যেহেতু রুথ এখন নিরাপদ, কাজেই আমি আগের চেয়ে ভাল আছি।’
বাতাসের গতি বেড়ে যাচ্ছিল। শূন্যগর্ভের মাঝে বালু উড়িয়ে নিয়ে ট্রাকটির চতুর্দিকে শোঁ শোঁ শব্দ করে ঘুরছিল। কেইন সাব-মেশিনগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, মনে হচ্ছে আমরা খারাপ আবহওয়ার মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। আপনারা দুজনে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়ুন, আমি জামালকে নিয়ে উঁটগুলোকে নিয়ে আসছি।’
সে আরবিতে জামালকে সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে বলল। তারপর ওরা দ্রুত পেছনের দিকে গিয়ে বালিয়াড়ির উপরে উঠতে শুরু করল। উপরে পৌঁছার পর বাতাস প্রচণ্ড বেগে বইতে শুরু করল। একটা বালুর পর্দা এসে সব কিছু মুছে ফেলল।
কেইন তার কেফায়ার কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে বালিয়াড়ির অন্যপাশ দিয়ে নামতে শুরু করল। ওদের পায়ের দাগ ইতোমধ্যেই মুছে গেছে আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা একা হয়ে গেল। ঘুর্ণিবায়ুর মতো একটা ঘন বালুর মেঘ ওদেরকে ঢেকে ফেলল।
কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে একটু থামল, আধো–অন্ধকার ভেদ করে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তারপর ঘুরতেই জামালের সাথে ধাক্কা খেল। সে আর জামাল শক্ত করে হাত ধরে আবার বালিয়াড়ির এই পাশ দিয়ে উপরে উঠার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। উপরে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব ছিল, অন্য পাশ দিয়ে ওরা গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে তাঁবুর কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
তাঁবুর গোড়ার চারপাশে ইতোমধ্যে বালু জমে গেছে। পর্দা সরিয়ে কেইন তাঁবুর ভেতরে ঢুকতেই রুথ কানিংহাম তার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাল। আর কতক্ষণ চলবে এরকম?’ সে জানতে চাইল।
কেইন মাথা থেকে কেফায়াটা খুলে নিরুদ্বেগ ভাব দেখাবার চেষ্টা করে বলল। এক কি দুইঘণ্টা। হয়তো আরো বেশিক্ষণ। শেষের দিকে বাতাস বালুগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
জামাল খুব সাবধানে তাবুর প্রবেশমুখের ফিতাগুলো শক্ত করে বেঁধে ওর উপর বসল। কানিংহাম এক হাত তার স্ত্রীর কাঁধের উপর দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। আপনি এখন কেমন আছেন? কেইন তাকে জিজ্ঞেস করল।
যখন সে কথা বলল, তার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক আর ক্লান্ত শোনালো। ‘আমি আশা করিনি যে আবার আপনাদের দেখা পাবো। গতরাতের সংঘষের পর স্কিরোজ আমাদের জানিয়েছিল আপনারা পাহাড়ের নিচে চাপা পড়েছেন।
কেইন বলল ‘পুরো ঘটনাটা আপনি খুলে বলুন,’। আজ সারাদিন কি কি ঘটেছে আর কেনইবা ওরা দুই দলে আলাদা হলো।
রুথ এক গুচ্ছ চুল এক হাতে সামনে থেকে পেছনে ঠেলে দিল। পুরো বিষয়টা ভয়াবহ বলা চলে। আমরা সকালে দুটো ট্রাকে করে গিরিখাত থেকে বের হই। সামনের ট্রাকে ছিল স্কিরোজ, মুলার আর মেরি; সেলিম তার লোকজন আর আমি ছিলাম অন্যটাতে।’
‘তুমি সেলিমের সাথে ছিলে কেন?’ তার স্বামী জিজ্ঞেস করল।
তার মুখ লাল হলো। সে একটু উত্তেজিত হলো। স্কিরোজ তার সাথে একধরনের চুক্তিতে এসেছিল। দাহরান পৌঁছাবার পর তার সেলিমের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। অবশ্য আমি জানি না সেটা কি, তবে তার জন্য মূল্য হিসেবে সেলিম আমাকে চেয়েছিল।
একটু খানি নিরবতা নেমে এল। কানিংহাম এক হাত তার স্ত্রীর কাঁধে রাখতেই কেইন আবার বলল, কিন্তু ওরা দু’দল আলাদা কেন হলো?
সে কাঁধ ঝাঁকাল। ট্রাকটার ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এটা সারাবার জন্য সেলিম এখানে থামল আর স্কিরোজ আর মুলার মেরিকে নিয়ে এগিয়ে গেল। ওদের মধ্যে কথা হয়েছিল বার আল-মাদানির কাছে হাজার নামে একটা জায়গায় ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
‘সেলিমের জন্য ওদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে, কানিংহাম বলল।
রুথ তার দুহাত কোলে রেখে নার্ভাস হয়ে বার বার মোচড়াচ্ছিল। সে বার বার আমাকে শোনাচ্ছিল রাতে ক্যাম্প করার পর আমার সাথে কি কি করবে। এমন জঘন্য ছিল লোকটা।’
কানিংহাম তাকে কাছে টেনে নিজেই সে তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করল। কান্নার দমকের সাথে সাথে তার পুরো দেহ ভিষণভাবে কাঁপতে শুরু করল।
বাইরে বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ঝড়ো বাতাস বালু উড়িয়ে নিয়ে প্রচণ্ডভাবে পলকা তাবুর গায়ে অনবরত আছড়াচ্ছিল। কেইন দু’হাটুর মাঝে মাথা গুজলো। অর্ধেক খোলা মুখে গভীর ভাবে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত পেশিগুলো শিথিল করল।
চারদিক ক্রমশ সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে গেল। আর বাতাসের বেগ এমন প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেল যে, জামাল আর তাকে তাবুর দুইপাশে দুটো খুঁটি শক্ত করে ধরে রাখতে হলো যাতে প্রবল বাতাসের তোড়ে তাবুটা ছিঁড়ে উড়ে না যায়।
চার ঘণ্টা পর যে রকম হঠাৎ ঝড়টা এসেছিল সে রকমই হঠাৎ চলে গেল। কেইন তাবুর পর্দার ফিতার জোড়গুলো খুলে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বের হলো। রাতের আকাশ পরিষ্কার আর কোটি কোটি তারা মোমবাতির মতো আকাশে জ্বলছে। পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলোয় গর্তটার সব জায়গা আলোকিত হয়ে উঠেছে।
তাবুর দুদিক বালুর ওজনে বসে গিয়েছিল আর ট্রাকটা বালুতে অর্ধেক ডেবে গিয়েছিল। কানিংহামও তাঁবুর নিচ দিয়ে বের হয়ে এল। এখন আমরা কী করব?
‘দেখি উটগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় কী না,’ কেইন বলল। আমি জামালকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘আপনাকে খুব একটা আশাবাদী মনে হচ্ছে না, কানিংহাম বলল।
‘ঝড়টা খুব খারাপ ছিল। আমরা ওদের পা বেঁধে রেখেছিলাম, কিন্তু একটা ভীত উটের আশ্চর্যরকম শক্তি আছে। কোন কারণে আতঙ্কিত হলে এরা লাথি মেরে বাঁধন মুক্ত হতে পারে।
সে জামালকে ডেকে নিয়ে ক্যাম্পের উল্টোদিকে বালিয়াড়ির খাড়া বেয়ে উঠতে শুরু করল। উপর থেকে চারদিকের দৃশ্যটা চমৎকার দেখাচ্ছিল। একের পর এক বালিয়াড়ি গড়িয়ে চলেছে দিগন্ত রেখা পর্যন্ত। এগুলোর মাঝখানের গর্তগুলো দেখতে অন্ধকার আর ভীতিপ্রদ মনে হচ্ছিল। তবে সাদা চাঁদের আলোয় মাটির উঁচু জায়গাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
ওরা বালিয়াড়ির অন্য পাশ দিয়ে নেমে যেখানে উটগুলো বেঁধে রেখেছিল। সেদিকে এগোল। ধুলিঝড়ে সমস্ত চিহ্ন মুছে গেছে, কেইনের মন ভেঙে গেল। সে থেমে কয়েকবার শিস দিল, রাতের শীতল বাতাসে শিসের শব্দটা তীক্ষ্ণ শোনালো। কিন্তু উত্তরে কোন চিৎকার শোনা গেল না।
দুজন আলাদা হয়ে, কেইন গেল একদিকে আর জামাল গেল অন্য দিকে। কিন্তু কোন লাভ হলো না। এক ঘণ্টা পর উট ছাড়াই ওরা ক্যাম্পে ফিরে এল।
কানিংহাম ক্যাম্পের বাইরে বসে ছিল। রাতের ঠাণ্ডা এড়াতে সে বেদুঈন আলখাল্লাটা তার পোশাকের উপর পরেছিল। ওদেরকে ফিরতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। তার স্ত্রীও তাবু থেকে বের হয়ে ওদের কাছে এল।
‘কপাল খারাপ,’ কেইন বলল। এতক্ষণে উটগুলো হয়তো কয়েক মাইল দূরে চলে গেছে। আর আমাদের পানির শেষ মশকটাও ওদের সাথে চলে গেছে।’
কানিংহাম এক হাতে তার স্ত্রীর কাধ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এখন কী হবে?
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। আর কোন উপায় নেই–চলুন আমরা হাঁটতে শুরু করি।’
‘কিন্তু সবচেয়ে কাছে পানি পাওয়া যাবে শাবওয়াতে আর সেটা অন্তত চল্লিশ মাইল দূরে, কানিংহাম বলল। এটা অসম্ভব, বিশেষ করে রুথের পক্ষে।’
কেইন ট্রাকের কাছে গিয়ে ভেতরে ঝুঁকে কেবিন থেকে কম্পাসটা খুলে ফেলল। যখন ঘুরল তখন তার মুখ কঠোর দেখাল। এ বিষয়ে কোন যদি বা কিন্তু নেই। আমরা হাঁটবো আর এখনই হাঁটা শুরু করতে হবে। ভাগ্য ভাল থাকলে ভোর হবার আগে আমরা বিশ থেকে পঁচিশ মাইল হেঁটে পার হতে পারব। আর যদি তা না পারি তবে আমরা শেষ হয়ে যায়।
কানিংহামের কাঁধ ঝুলে পড়ল। সে তার স্ত্রীর দিকে ফিরল। তোমাকে এ অবস্থায় আনার জন্য আমি দায়ী। এর জন্য আমি দুঃখিত।
রুথ আলতোভাবে তার মুখ ছুঁয়ে মৃদু হাসল। এ জায়গা ছাড়া আমি আর অন্য কোথাও থাকতে চাই না।’
ওরা দুজনে পরস্পরের চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, যেন আশেপাশে আর কেউ নেই কেবল ওরা দুজন ছাড়া। কেইন তাড়াতাড়ি ঘুরে জামালের সাথে কথা বলতে গেল।
১৬. প্রচুর খাবার পাওয়া গেল
১৬.
ক্যাম্পটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে প্রচুর খাবার পাওয়া গেল, তবে পানির এলুমিনিয়াম বোতল পাওয়া গেল মাত্র একটা। মধ্য রাতে যখন ওরা যাত্রা শুরু করল তখন কেইন বোতলটা এক কাঁধে ঝুলিয়ে নিল।
পানিটা চারভাগে ভাগ করলে এর কোন মূল্য নেই। আর কোন পথও নেই, তবে সে সিদ্ধান্ত নিল একেবারে শেষ মুহূর্তে বোতলটা ব্যবহার করবে।
সে বার বার কম্পাস দেখে দিক নির্ণয় করে দ্রুত পদক্ষেপে হেঁটে দলটাকে এগিয়ে নিয়ে চলল। কনকনে ঠাণ্ডায় সে বেশ সতেজ হয়ে দেহে পূর্ণ শক্তি পেল। অবশ্য ভাগ্যের কী পরিহাস, আর ছয় ঘণ্টা পরই মাথার উপর সূর্যের প্রখর রৌদ্রের তেজে ওরা ঝলসাবে। তারপর আর কতক্ষণ ওরা চলতে পারবে সেটা একটা ভাবনার বিষয়।
একমাত্র মহিলাটিকে নিয়ে সমস্যা হতে পারে। কেইন আবার থেমে কম্পাসটা পরীক্ষা করল, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। জামাল ওর কাছেই পিছু পিছু আসছে, আর কানিংহাম তার স্ত্রীকে নিয়ে ত্রিশ গজ পেছনে রয়েছে।
কেইন আবার সামনে চলতে শুরু করল, চেষ্টা করল বালিয়াড়ির মাঝের সহজ পথ দিয়ে চলতে। তবে কোন কোন জায়গায় এটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল, সেক্ষেত্রে তাকে কিছু কিছু বালুর পাহাড়ের খাড়া দিক বেয়ে পার হতে হচ্ছিল। প্রতিটা পদক্ষেপ কষ্ট করে এগোতে হচ্ছিল।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর ওরা বালিয়াড়িগুলো থেকে বের হয়ে এল, এরপর বিশাল এক সমতলভূমির উপর দিয়ে যেতে থাকল। শক্ত পোড়া মাটি আর নুড়ি পাথরে ছাওয়া সমতল ভূমিটা সামনে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। কম্পাস দেখে সঠিক অবস্থান আর দিক নির্ণয় করার জন্য কেইন আবার থামল, জামাল পেছন থেকে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে একটা টোকা দিল। কেইন ঘুরে তাকাতেই জামাল পেছন দিকে দেখাল।
কানিংহাম আর তার স্ত্রী প্রায় দুশো গজ পেছনে পড়ে রয়েছে। কেইন বালুতে বসে পড়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওরা কাছে এসে পৌঁছাতেই কেইন ওদের জন্য উঠে দাঁড়াল। রুথ কানিংহাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালুতে বসে পড়ল। আমার মনে হচ্ছে যেন বিশ মাইল হেঁটেছি।’
‘আমরা বড়জোর আট কী নয় মাইল হেঁটেছি,’ কেইন তাকে জানাল। সূর্য মাথার উপর পুরোপুরি তেজ ছড়াবার আগে আমাদের অন্তত পঁচিশ মাইল পেরোতে হবে, আর নয়তো কোন আশা নেই।
‘এটা আপনার জন্য ঠিক আছে, কানিংহাম বলল। কিন্তু রুথ তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। আপনি খুব দ্রুত হাঁটছেন।
রুথ সাথে সাথে ওর স্বামীর হাত ছুঁলো। গ্যাভিন কেবল সোজা কথাটা বলছে, জন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, আমি ঠিক থাকব।’
‘আমি জানি এটা খুবই কষ্টকর, কেইন বলল। কিন্তু এটা পারতেই হবে আমাদের।’
কানিংহাম উঠে দাঁড়াল, ‘তাহলে আর দেরি করছি কেন?
প্রায় তিন ঘণ্টা লাগল ওদের পোড়া-মাটির প্রান্তরটা পেরোতে। তবে শক্ত মাটির উপর ওরা বেশ দ্রুত চলতে পেরেছিল। রুথ কানিংহাম আগের চেয়ে দ্রুত চলছিল। ওরা সবাই কাছাকাছি থেকে পোড়া মাটির প্রান্তরের অপর দিকের বালিয়াড়িতে এসে পৌঁছাল।
কেইন মোটেই ক্লান্ত হয় নি। বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রমী জীবন যাপনের কারণে শক্তিশালী লম্বা লম্বা পা ফেলে সে অনায়াসেই হেঁটে চলল। তার চিন্তা বর্তমানে ছিল না, সে ভাবছিল সকালের কথা, কি হবে তখন। জোর করে মন থেকে এসব চিন্তা হটিয়ে দিয়ে সে অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করতে লাগল।
ঠিক তখনই তার মনে পড়ল আলেক্সিয়া এর আগে এই পথ দিয়েই গিয়েছিলেন আর তার কাছে কোন কম্পাস ছিল না। সে আবার সেই পাণ্ডুলিপিটা আরেকবার মনে মনে পড়তে শুরু করল। সেই প্রথমবার পড়ার পর লোকটির যে পরিষ্কার ছবি তার মনে ভেসে উঠেছিল তা আবার স্মরণ করার চেষ্টা করল।
তিনি যে কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দৃঢ় ও পাকানো দড়ির মতো শক্ত আর প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী একজন মানুষ। যিনি তার নিয়তি এবং সকল বাধা বিপত্তি জয় করার ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। তারপরও শুধু এগুলোই কি যথেষ্ট ছিল? নিশ্চয়ই আরো কিছু একটা কারণ ছিল। এমন কিছু যার কারণে কেবল পায়ে হেঁটে তিনি এই মরুভূমি অতিক্রম করতে পেরেছিলেন, যেখানে যে কোন যুক্তিতে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল। তাহলে কি একজন নারী তার জন্য তার দেশে অপেক্ষা করেছিল?
এটি এমন একটি প্রশ্ন, যার কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। সে একটু থেমে আবার অবস্থান পরীক্ষা করল। প্রায় পাঁচটা বেজেছে, সে মাটিতে বসে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোয় রুথ কানিংহামের চেহারা মলিন আর মুখ ঝুলে পড়েছে মনে হল। তার স্বামীকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। সে যত্ন করে তার স্ত্রীকে কেইনের পাশে মাটিতে বসালো। জামাল একটা ন্যাপস্যাক খুলে খেজুর আর সিদ্ধ ভাত বের করে সবার হাতে হাতে দিল।
রুথ কানিংহাম হাতের ইশারায় তার খাবারের অংশ সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু কেইন সেটা জামালের হাতে থেকে নিয়ে তার সামনে ধরল। ‘আপনাকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।’
রুথ ম্লান হেসে সামান্য সিদ্ধ ভাত মুখে দিল। কানিংহাম বলল, ‘আমরা কতদূর এসেছি বলে মনে হয়?
কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিল। “বিশ থেকে পঁচিশ মাইল হবে। সমতল ভূমিতে আমরা ভাল দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছি।’
কানিংহাম উপরে বিশাল আকাশের দিকে চেয়ে বলল। ফর্সা হয়ে আসছে মনে হয়।
‘এক ঘণ্টার মধ্যেই ভোর হবে,’ কেইন বলল। সূর্য ওঠার আগে আমরা আর সম্ভবত এক ঘণ্টা সময় পাবো তারপরই প্রচণ্ড রোদে সত্যিকার কষ্ট শুরু হবে।’
‘আর তারপর কী হবে?
কেইন কাধ ঝাঁকাল। সেটা সময় এলে দেখা যাবে।’
সে উঠে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল। একটা বালিয়াড়ির মাথায় উঠে পেছন ফিরে দেখল ওরা বেশ জোরে হেঁটে তার কাছাকাছি থেকে তাকে অনুসরণ করছে।
দিগন্তের কিনারায় সূর্য উদয় হওয়ার আগে ওরা আর সাত কি আট মাইল অতিক্রম করতে পেরেছে। শরীর থেকে রাতের ঠাণ্ডা দূর করে একটা রক্তলাল চাকতির মতো সূর্য ওদেরকে উষ্ণতায় ভরিয়ে দিল।
কেইন হাটার গতি বাড়িয়ে দিল। তার চোখ দিগন্ত রেখার দিকে, সূর্য উঠছে দেখে সে নিরাশ হয়ে পড়ল। প্রথমবারের মতো এবার তার মনে হলো কোন লাভ নেই, ওরা যা করার চেষ্টা করছে তা সম্পন্ন করা অসম্ভব। দুপুর পর্যন্ত যদি ওরা হাঁটতে পারে সেটা একটা অলৌকিক ঘটনা হবে।
সূর্য একটা কমলা রঙের অগ্নিগোলক। এর রশ্মি তাদের মাথার খুলি ভেদ করে পোড়াতে লাগল। সে কেফায়ার একপ্রান্ত টেনে মুখ ঢেকে ফেলল, শুধু চোখ খোলা রেখে। মৃদু বাতাসে মাটি থেকে ধুলো উড়ছিল।
ফুসফুসে টেনে নেবার মতো কোন বাতাস নেই। কেবল আগুনের মতো সূর্যের গরম হলকা গায়ের চামড়ায় হেঁকা দিচ্ছে। ঠোঁট ফেটে একাকার আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
পানির বোতলটার কথা মনে করতেই তার আঙুল চলে গেল বোতলের গায়ে। পা টেনে টেনে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বোতলটার দিকে তাকাল, কল্পনা করতে লাগল বোতলের ভেতরের পানির শীতলতা, এর আদ্রতা, তার জ্বলতে থাকা গলার মধ্য দিয়ে পানি টপটপ করে গড়িয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। সে বোতলটা ঠেলে পিঠের দিকে সরিয়ে দিল, যাতে আর চোখে না পড়ে। তারপর একটা বিরাট বালিয়াড়ির খাড়া গা বেয়ে ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল।
উপরে পৌঁছার পর এই প্রথম সে টের পেল তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে। দেহের প্রত্যেকটা লোমকুপ থেকে ঘাম বের হয়ে বেঁচে থাকার জন্য শরীরের প্রয়োজনীয় সমস্ত পানি শুষে নিচ্ছে।
সে চোখের উপর হাত দিয়ে আড়াল করে সামনে তাকাল আর হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে সূর্যের আলো পড়ে লাল রঙের কিছু একটা ঝিকমিক করে উঠল। ওটা সেই র্যাপিড প্লেনের ধ্বংসাবশেষ, যেটা চার দিন আগে সে আর রুথ চালিয়ে নিয়ে আসার সময় এখানে ক্র্যাশ করেছিল।
হঠাৎ তার মনে আশা জেগে উঠল। প্লেনটার মধ্যে পানি ভর্তি একটা জেরিক্যান ছিল। এই কয়দিনের প্রচণ্ড গরমের পরও আশা করা যায় যে কিছু পানি হয়তো এখনো অবশিষ্ট আছে।
তারপর হঠাৎ মনে পড়ল অনেকক্ষণ হলো সে তার সঙ্গীদের কোন খোঁজ খবর নেয় নি। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বালিয়াড়ির নিচে জামাল তার বিশাল হাতে রুথ কানিংহামকে কোলে করে নিয়েছে। কানিংহাম বালিয়াড়ির খাড়া গা বেয়ে উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ফোলা মুখে তার চোখ জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মতো জ্বলছিল।
সে কেইনের কয়েক ফুট কাছে এসে মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। আর ধীরে ধীরে এক হাত দিয়ে মুখ মুছলো। তারপর অতিকষ্টে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কথা বলতেই মনে হলো অনেক দূর থেকে বলছে, আমাদের একটু বিশ্রাম নিতে হবে।’
কেইন ফাটা ঠোঁট ভেজাবার চেষ্টা করে বলল, “আমাদের চলতেই হবে।’
কানিংহাম একগুয়েভাবে মাথা নেড়ে চলল। বিশ্রাম নিতে হবে।’
সে টলতে টলতে সামনে এক পা এগোতেই হাঁটু ভেঙে পড়ল। কেইন তাকে ধরতেই নরম বালুর মধ্যে তার পা ফসকে গেল। ওরা দুজনেই বালিয়াড়ির খাড়া গা বেয়ে নিচের দিকে গড়াতে গড়াতে এক রাশ বালু ছড়িয়ে মাটিতে পড়ল।
কানিংহাম হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। আর কেইন ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটুখানি পানি ঢোকাবার চেষ্টা করল। জামাল বালিয়াড়ির উপরে উঠল, তারপর নিচে ওদের কাছে এসে পৌঁছলো। সে রুথ কানিংহামকে তার স্বামীর পাশেই শোয়াল, তারপর কেইনের দিকে তাকাল।
কেইন প্লেনটার ব্যাপারে তাকে বুঝিয়ে বলল। তার চোখে আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। ঠিক সেই সময়েই কানিংহাম গুঙিয়ে উঠল, তারপর উঠে বসল। আমি কোথায়? কী হয়েছে?
তার কণ্ঠস্বর এতো দূর্বল আর নিস্তেজ শোনালো যে মনে হলো এটা তার কণ্ঠস্বর নয়।
কেইন তাকে ধরে দাঁড় করাল আর এক হাত দিয়ে তার কাঁধ পেচিয়ে ধরল। চিন্তা করবেন না, সে তাকে শান্ত করে বলল। এখন আমাদের আর বেশি দূর যেতে হবে না। খুব বেশি দূর নয়।’
সে ঘুরে জামালের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করল। জামাল আবার রুথ কানিংহামকে কোলে তুলে নিল। তারপর আবার ওরা হাঁটতে শুরু করল।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওরা প্লেনটার কাছে এসে পৌঁছালো। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই কানিংহাম কেইনের কাঁধে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াল। সে তাকে মাটিতে বসালো, তারপর টেনে নিয়ে গেল প্লেনটার ডানার নিচের ছায়ায়। প্লেনের গায়ে কানিংহামের পিঠ ঠেস দিয়ে বসালো। জামালকে বলল রুথকে দেখতে, তারপর সে প্লেনের কেবিনে উঠল।
একটু খুঁজতেই পানির জেরিক্যানটা গেয়ে গেল। এটা নিয়ে আসার সময় তার হাত কাঁপতে লাগল। ভেতরে কিছু একটা নড়ছে বুঝে তাড়াতাড়ি মেটাল স্টপারটা খুলে ক্যানটা মুখে নিল। একটু লোনা, গরম আর জঘন্য স্বাদ পানিটার, তারপরও সেটা পানি। চার পাঁচ পাইন্টের মতো অবশিষ্ট আছে।
সে প্লেনটার ডানার নিচে হামাগুড়ি দিয়ে রুথ কানিংহামের মুখে একটু পানি ছিটালো। সে গোঙানির মতো শব্দ করে আস্তে আস্তে চোখ মেলল। মুখের চামড়া শক্ত হয়ে রয়েছে আর ঠোঁট কয়েক জায়গায় ফেটে গেছে। কেইন আস্তে তার মাথা তুলে ধরে একটু পানি দিল তার মুখে।
রুথ কেশে উঠল, কিছু পানি তার চিবুক বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ল। তারপর মনে হলো সে জেগে উঠে হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটা তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা পান করল।
তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে হেলান দিয়ে বসল। এরপর কেইন কানিংহামের কাছে গেল, সে অবশ্য ইতোমধ্যে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। একটু দূর্বল হাসল। দূঃখিত আমি অনেক বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেছি। এখন কি করবেন?
কেইন জেরিক্যানটা দেখিয়ে বলল, এর মধ্যে চার পাইন্টের মতো পানি পাবেন, এই পানিতে আপনাদের সারাদিন চলে যাবে।
কানিংহাম একটু ভুরু কুঁচকালো। আপনার আর জামালের কি হবে?
কেইন বলল, ‘আমরা এগোতে থাকব, এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। আপনি আর আপনার স্ত্রী আর হাঁটতে পারবেন না। আমরা যদি আপনাদের সাথে এখানে থাকি তাহলে সবাই মরবো। যদি জামাল কিংবা আমি এ জায়গা থেকে বের হতে পারি, তাহলে শিগগির আপনাদের জন্য সাহায্য আনতে পারব।’
এক মুহূর্তের জন্য সবাই নিরব হলো, তারপর কানিংহাম একটু নিস্তেজ হাসল। আপনি যে রকম বলেছেন, আসলেই আর কোন পথ নেই।’ সে হাত বাড়াল। কেবল শুভ কামনা করা ছাড়া আর তো আমার কিছু বলার নেই। তাহলে আর অপেক্ষা করছেন কেন?’
একটু বেশিক্ষণ ওরা হাত ধরে থাকল তারপর কেইন জামালের দিকে ফিরল। পানির বোতলটা নিয়ে অর্ধেক পানি খেল। বাকিটা জামালের হাতে দিল, সে বাকি পানিটুকু শেষ করে খালি বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। এক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে তাকাল তারপর ওরা হাঁটতে শুরু করল। ছোট একটা টিলার উপর ওঠার পর কেইন একবার পেছন ফিরে তাকাল,তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে টিলাটার অপর পাশে নেমে গেল।
.
সূর্য যেন একটা জীবন্ত সত্তা, যা কোনভাবে তার একটা অংশে পরিণত হয়েছে। এখন ওরা দুজনে একটি সত্তা হয়ে হাঁটছে। এরোপ্লেনটা ছেড়ে আসার পর কত সময় পার হয়েছে তা নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা এখানে সময়ের কোন অস্তিত্ব নেই আর সময়ের কোন মানেও নেই।
বুকে আর হাটুতে বর্ম পরে একজন মানুষ হাঁটতে পারে না। এটা অসম্ভব। বরং এগুলো ফেলে দেয়াই ভাল। হেলমেটটা অনেক আগেই চলে গেছে, এখন শুধু রোমান সৈন্যরা ছোরার মতো যে রকম ছোট তরবারি ব্যবহার করে, সেটা একটা বোঝার মতো নিয়ে হাঁটছে। ঘোড়ায় চড়ার সময় পিঠে যে আলখাল্লাটা ব্যবহার করতো সেটা ভাঁজ করে মাথায় পেঁচিয়ে রেখেছে, সূর্যের প্রচণ্ড তাপ থেকে মগজ বাঁচাতে। তাকে যেতেই হবে, ফিরে গিয়ে সেনাপতির কাছে রিপোর্ট পৌঁছাতে হবে। দায়িত্ব কর্তব্য সবার আগে, যা একজন সৈন্যের বেলায় হয়ে থাকে, তবে আরো একটা কারণ ছিল। সেই মেয়েটি–কালো চুল, দুধ-সাদা হুক আর একটা শীতল কুয়ার মতো যার মুখ। এথেন্সে সেই পিরায়েসের কাছে সাগরের মতো শীতল। যেখানে সে ছোটকালে সাঁতার কাটতো, ঝাঁপিয়ে পড়তে সবুজ গভীরতায়। মাছগুলোর মাঝে একেবেকে সাঁতার কেটে বেড়াতো। ভয় পেয়ে মাছের দল বিশাল চকচকে মেঘের মতো দুরে পালিয়ে যেতো। তারপর সে আবার ধীরে ধীরে গোলাকার বুদবুদ ছড়িয়ে পানির উপরে ভেসে উঠতো।
সে সামনে মাটিতে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ হাঁটুর উপর উবু হয়ে বসে রইল, তারপর তাকে এক ঝটকা মেরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে একটা হাত তার মুখে থাপড় কষালো। জামাল তাকে শক্ত করে ধরে তার চোখের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। কেইন কথা বলতে চেষ্টা করে কিছুই বলতে পারল না। তারপর কয়েকবার মাথা নেড়ে সে আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল।
হাঁটার চেষ্টা করাটা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে নিদারুণ দৈহিক যন্ত্রণার মতো। সেই যন্ত্রণা পুরো দেহে ছড়িয়ে পড়েছে। তারপর মনে হলো এর আর অস্তিত্ব নেই। এখন তার ভেতরে কিছু একটা জ্বলছে, সেটা তাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মরে যেতে দিচ্ছে না।
বাতাসের ঝাপটায় মুখ ঢেকে রাখা কাপড়টা সরে যেতেই খোলা মুখের চামড়ায় জ্বলন্ত সূর্যের তেজ কেটে বসেছে। তারপর আবার সে মুখ থুবড়ে বালুতে পড়ে গেল, আবার জামাল তাকে টেনে তুলল। এবার সে জামালের চওড়া কাঁধে এলিয়ে পড়ল। সে ভ্রু কুঁচকে মাথা ঝাঁকাল, চেষ্টা করল পরিষ্কারভাবে সবকিছু ভাবতে, কিন্তু কোন কাজ হলো না। এখন আর কোন কিছুই ভাল নেই। সে অন্ধকার একটা তাপের শূন্যতার মাঝে সেঁধিয়ে একটু একটু করে তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলল।
তার মুখে বালু ঢুকেছে। সে তার হাতের আঙুল দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগল। কিন্তু এবার কোন শক্ত হাত তাকে ধরে টেনে তুলল না। এবার সে সম্পূর্ণ একা। জামাল চলে গেছে।
সে আর কখনো সেই মেয়েটির কাছে ফিরে যেতে পারবে না। ফর্সা হাত পা আর শীতল ঠোঁট যে মেয়েটির। যাকে সে সারা জীবন ধরে চেয়েছে, তার সাথে মিশে দুজনে এক সত্তা হয়ে বেঁচে থাকবে। দুজনে এক সাথে মিলে জীবনকে উপভোগ করবে পরিপূর্ণভাবে।
সে কি গ্যাভিন কেইন নাকি সে আলেক্সিয়াস, দ্য গ্রিক। দশম লিজিয়নের একশে সেনাদলের নেতা। আর সেই ফর্সা হাতপা আর শীতল ঠোঁটের মেয়েটি কে? এর কোন উত্তর নেই। অন্তত পৃথিবীর বুকে নেই।
পানির ঝাপটা তার মুখের উপর পড়তেই যেন একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে সে জেগে উঠল। কপাল থেকে পানি বেয়ে মুখে ঢুকতেই প্রচণ্ডভাবে কাশতে শুরু করল। একটা শক্ত হাত তাকে ধরে তুলল আর দাঁতের ফাঁকে ধাতব পানির বোতলের মুখ ঢুকিয়ে দিল। সে গপ গপ করে পানি গিলতেই বিষম খেলো।
লাল লাল ফোলা চোখ খুলে সে দেখল জর্ডন তাকে এক হাঁটুর উপর ঠেস দিয়ে ধরে রেখেছে। পেছনে একটা ট্রাক পার্ক করা রয়েছে।
কেইন মুখ খুলে কোন মতে এটুকু বলতে পারল-পেছনে মরুভূমিতে, সে কর্কশ কণ্ঠে বলল, তুমি ওদেরকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।
জর্ডন ওকে আশ্বস্ত করে মাথা নাড়ল। কোন কিছু নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। ওদের আনার ব্যাপারে বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমার অন্য ট্রাকটা নিয়ে তোমার সেই বিশালদেহী সোমালি লোকটা পথ দেখিয়ে আমার দুজন লোককে সাথে করে নিয়ে গেছে। সে হেসে বলল। জামাল সত্যি একটা মানুষ বটে।
কিন্তু কেইন আর কোন কিছু শুনতে পেল না। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে দুচোখ বুঝলো। সব কিছু তার সামনে অন্ধকার হয়ে গেল।
.
১৭.
সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। একটা মুহূর্ত তার মন সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়েছিল। সে একটি কনুইয়ে ভর দিয়ে বসল, আতঙ্কে তার মন ছেয়ে গেল। তারপর সব কিছু মনে পড়তেই একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আবার শুয়ে পড়ল।
সে একটা ক্যাম্প খাটে শুয়েছিল, মাথার উপর চারটে খুঁটির উপর ঝোলানো একটা নিচু ছাউনি। কাছেই দুটো ট্রাক পার্ক করা আর কয়েক গজ দূরে একটা তাঁবু খাটানো হয়েছে।
কেইন নড়ে উঠতেই খাটের পায়ের কাছে মাটিতে আসন গেড়ে বসে থাকা জামাল উঠে এসে তার উপর ঝুঁকে দৃষ্টি বুলালো। দুজনের মাঝে চোখাচোখি হতেই জামালের মুখ হাসিতে ভরে উঠল। কেইন নিঃশব্দে একটি হাত বাড়াল।
জামাল হাতটা ধরল, তারপর ধীরে ধীরে তার মুখ থেকে মৃদু হাসিটা চলে গেল। একটা মুহূর্ত তাদের মধ্যে এমন একটা অনুভূতির সৃষ্টি হলো যা এর আগে ছিল না। তারপর সে ঘুরে জর্ডনের দিকে এগোলো, সে তখন ক্যাম্পের মাঝখানে একটা স্পিরিট স্টোভের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল।
একহাতে একটা পট আর অন্য হাতে একটা প্লাস্টিক কাপ নিয়ে জর্ডন কেইনের কাছে এল। কফি?’ সে দাঁত বের করে হাসল।
কেইন মাটিতে পা নামিয়ে খাটের উপর বসল। তখনো তার মাঝে দুর্বলতা আর মাথা হালকা মনে হচ্ছিল। আর সবকিছু কেমন অবাস্তব আর আবছা আবছা মনে হচ্ছিল।
খানিকটা কফি গিলতেই গরম কফি গলা বেয়ে পেটে পড়তেই সে শিউড়ে উঠল। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আসলে আমার এখানে থাকার কথা নয়।’
জর্ডন বলল, কম করে বললে তাই ভাবতে পার।
কেইন ছাউনি থেকে উবু হয়ে বাইরে বের হল। ওরা পাহাড়ের পাদদেশেই তাঁবু গেড়েছে। সামনেই মরুভূমি চলে গেছে দূরে। আমরা এখন কোথায়?
‘শাবওয়া থেকে দশ বারো মাইল দূরে আছি,’ জর্ডন উত্তর দিল। ‘তাড়াহুড়া করে এখানে ক্যাম্প করেছি কারণ কানিংহাম আর তার স্ত্রীর অবস্থা কেমন তা বুঝে উঠতে পারিনি।’
‘এখন কেমন আছে ওরা?’ কেইন জিজ্ঞেস করল।
জর্ডন তাকে একটা সিগারেট দিয়ে বলল, সামান্য পানি শূন্যতায় ভূগছে, আর সব ঠিক আছে। আমি ওদের দুজনকেই ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। ওরা তাঁবুতেই ঘুমিয়ে আছে।
কেইন সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল। আমাদের ভাগ্য ভাল যে তুমি জামালের দেখা পেয়েছিলে। এত দূরে মরুভূমিতে তুমি কি করছিলে?’
‘গত তিন দিন ধরে আমি তোমাদের খুঁজছিলাম, জর্ডন বলল। মেরি যে ট্রাকটা নিয়ে গিয়েছিল সেটা নিয়ে ফিরে না আসায়, ট্রাকের ড্রাইভার– পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমার কাছে এসে খবরটা জানাল। গতকাল এরোপ্লেনটা পেয়েছি কিন্তু ট্রাকের কোন চিহ্ন নেই। আমি ভাবলাম হয়তো ফেরার পথে ট্রাকটা নষ্ট হয়ে কোথাও না কোথাও পড়ে রয়েছে। আমরা এরোপ্লেন আর এই জায়গার মাঝে খুঁজতে খুঁজতে জামালের দেখা পেলাম।
কেইন জামালের দিকে তাকাল। সে তখন স্পিরিট স্টোভের পাশে বসে একটা বোল থেকে ভাত খাচ্ছে। জর্ডনের লোকেরা তার দিকে চেয়ে রয়েছে। ‘আমি মনে করি আমাদের সবার জীবন রক্ষা পেয়েছে তার কারণে।
‘সেটা ঠিক বলেছো তুমি, জর্ডন বলল। এখন পুরো ব্যাপারটা খুলে বলো। প্লেনটা ক্র্যাশ করার পর তোমরা কোথায় ছিলে? আর মেরির কি হয়েছে?
যত সংক্ষেপে সম্ভব কেইন গত চারদিনের ঘটনার বিবরণ খুলে বলল। তার বলা শেষ হবার পর জর্ডন তার মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, স্কিরোজ একজন নাৎসি–এটা আশ্চর্য।
‘এটাই সত্যি, কেইন বলল। তবে আমি যেরির ব্যাপারে চিন্তিত। রুথ কানিংহাম বলেছে ওদের হাজার অপেক্ষা করার কথা।
জর্ডন কুঁচকালো। দু’সপ্তাহ আগে আমি ঐ জায়গাটা পার হয়ে এসেছি। ওখানে বাল হারিস নামে একটা বেদুঈন গোষ্ঠি ডেরা গেড়েছে। ওদের সর্দার মোহাম্মদ নামে পাকা দাড়িওয়ালা একজন অভিজ্ঞ বর্ষীয়ান ব্যক্তি।
কেইন মাথা নাড়ল। তুমি যার কথা বলছো তাকে আমি চিনি। অতীতে তার সাথে আমি ব্যবসা করেছি। তারপর সে চোখ সরু করে বলল, ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখো। আমি শুনেছিলাম মূলারের সাথে বাল হারিসের খুব মাখামাখি সম্পর্ক। হয়তো সে জানতো বাল হারিস এখন হাজারএ ক্যাম্প করেছে।’
জর্ডন দেঁতো হাসি দিল। এ ধরনের বন্ধুই স্কিরোজের এখন দরকার। যখনই আমি পাশ দিয়ে যাই ভয়ংকর চেহারার এই লোকগুলো তখনই দাঁত বের করে রাইফেলে আঙুল বোলায়। এক জোড়া গোঁজার জন্য ওরা তোমার গলা কাটতে পারে।
কেইন মাথা নাড়ল। মোহাম্মদ সে রকম মানুষ নয়। সে পুরোনো জমানার বেদুঈন সর্দার। সে তার সম্মান আর পুরোনো আদবকায়দা অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলে।
সে উঠে দাঁড়িয়ে ছাউনির বাইরে বের হল। মাথা আবার ঘুরে উঠতেই সে টলে উঠল। তাড়াতাড়ি নিজেকে সোজা করে দাঁড়াল। জর্ডন উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছে তো?’
‘স্কিরোজকে ধরতে পারলে আমি একদম ঠিক হয়ে যাবো, কেইন তাকে বলল। এখন তোমার একটা ট্রাক নিতে পারব?
জর্ডন মাথা নেড়ে বলল, কোন দরকার নাই। আমিও তোমার সাথে যাচ্ছি। আমি নিজেও মেরি পেরেটকে নিয়ে বেশ চিন্তিত আছি।
কানিংহাম আর তার স্ত্রীর কি হবে?
জর্ডন কাঁধ ঝাঁকাল। এখন ওরা বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমাবে। ওদের দেখাশুনা করার জন্য আমার লোক থাকবে।
কেইন আর তর্ক করল না। সে জামালকে ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে বলল। তারপর ওরা একটা ট্রাকে চড়ে জর্ডনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সে ওর লোকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে এল।
কয়েক মিনিট পর ট্রাক চলতে শুরু করল। জর্ডন চালকের আসনে আর কেইন দুচোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে বসল। গত কয়েকদিনের কর্মকান্ড আর চিন্তাভাবনা যেন তার শরীরের সমস্ত শক্তি নিংড়ে নিঃশেষ করে নিয়েছে। সামনে কি হবে না হবে সেসব নিয়ে সে আর ভাবলো না।
এক ঘণ্টার মধ্যেই ওরা হ্যাঁজারে পৌঁছে গেল। চওড়া উপত্যকার মাথায় জর্ডন ট্রাকের ব্রেক কষলো। নিচে বেদুঈনদের কালো তাবুগুলো দেখা যাচ্ছে।
যাই ঘটুক না কেন, কথা বলার ভার আমার উপর ছেড়ে দাও, কেইন বলল। আমি জানি ঠিক কীভাবে ওদেরকে সামলাতে হবে।
মরুদ্যানের পাম গাছের সারি উপত্যকার কয়েকশ গজ পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। পাতাগুলো একটা ছাদের মতো হয়ে সূর্য কিরণ থেকে মরুদ্যানকে ছায়া দিয়েছে। ওরা বেদুঈন বসতির দিকে ট্রাক চালিয়ে এগোতেই সামনে থেকে উট আর ছাগলগুলো চারপাশে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। বাচ্চারা ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করতে করতে তাঁবুর দিকে ছুটে গেল। দীর্ঘদেহী কালো দাড়িওয়ালা আলখাল্লা পরা লোকজন রাইফেল হাতে তাবুগুলো থেকে বের হয়ে এল।
বসতির মাঝখানে পৌঁছার পর কেইন সিটে সোজা হয়ে বসল। জামাল তার কাঁধে আলতো করে ‘লো। পঞ্চাশ ষাট গজ দুরে দুটো ট্রাক পার্ক করা রয়েছে।
জর্ডনও একই সাথে ট্রাকগুলো দেখল। মনে হচ্ছে আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি।’
সে সবচেয়ে বড় তাবুটার সামনে ব্রেক কষে ট্রাকটা থামাল। একজন সর্দার গোছের ব্যক্তি বাইরে বের হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
মাহমুদ অত্যন্ত বয়স্ক একজন মানুষ। তার লম্বা দাড়ি বেশিরভাগ রুপালি রঙের। গায়ের চামড়া অনেকটা পার্চমেন্ট কাগজের মতো হাড়ের সাথে লেগে রয়েছে। তার আলখাল্লা চকচকে উজ্জ্বল সাদা আর জাম্বিয়ার বাট খাঁটি সোনার।
গোত্রের লোকজন নিঃশব্দে এগিয়ে গাড়িসহ পালাবার পথ বন্ধ করে ওদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল। আর যাই হোক ওদেরকে বন্ধুসুলভ মনে হচ্ছে না।
জর্ডন বলল, ওদের রাইফেলগুলো দেখছ? সর্বাধুনিক। এবার বোঝা যাচ্ছে স্কিরোজ কেন অপেক্ষা করার জন্য এ জায়গা বেছে নিয়েছিল।
কেইন ট্রাক থেকে নেমে ধীরে ধীরে সামনে এগোলো, তারপর মোহাম্মদের কয়েক পা দূরে থামল। কয়েক মুহূর্ত দুজন দুজনের চোখের দিকে চেয়ে রইল, তারপর বর্ষীয়ান আরব লোকটি মৃদু হেসে হাত বাড়াল। এই যে আমার বন্ধু কেইন। সেই কবে আমরা এক সাথে বাজপাখি নিয়ে শিকার করেছি। অনেক দিন হয়ে গেল তাই না।’
কেইন বাড়ানো হাতটি ধরে মৃদু হাসল। সময় কিন্তু তোমাকে আরো ভাল করেছে, মাহমুদ। একেক বছর যায় আর তোমার বয়স যেন কমতে থাকে। সে জর্ডনের দিকে ফিরে বলল, “ইনি আমার একজন বন্ধু।
মাহমুদ মুখ বিকৃত করল। একে আমি চিনি। এই যুবক মাটি খুঁড়ে তার মেশিন দিয়ে বাতাস দুষিত করছে।’ জর্ডনের চেহারায় অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটি মৃদু হেসে এক হাত তুলে ভদ্রতাসূচক ইঙ্গিত করল। তবে এই যাত্রায় আমি আমার এক বন্ধুর খাতিরে তাকে স্বাগত জানাচ্ছি।’
সে ঘুরে নিচু দরজা দিয়ে শীতল তাঁবুতে ঢুকল, কেইন আর জর্ডনও তাকে অনুসরণ করল।
ওরা পা ভাজ করে নরম গালিচায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পর তাঁবুর পেছন দিক থেকে কালো বোরকায় ঢাকা একজন মহিলা একটা তামার ট্রেতে কফিপট, তিনটে কাপ আর এক বোল সিদ্ধ ভাত নিয়ে উপস্থিত হলো।
কেইন আর জর্ডন যথারীতি ভদ্রতা দেখিয়ে কফি খেলো আর মাহমুদের মতো আঙুল ডুবিয়ে একই বোল থেকে ভাত খেলো।
মহিলাটি একটা ভেজা কাপড় এগিয়ে দিতেই ওরা আঙুল মুছলো। কেইন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, তার সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। এখন যাই আলোচনা হোক না কেন, ওরা এখন নিরাপদ। কেননা ওরা গোত্রের মধ্যে থেকে মাহমুদের সাথে খাওয়াদাওয়া করেছে। এখন ওদের কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
একটু নিশ্চুপ থেকে মাহমুদ ভদ্রভাবে বলল, বন্ধু, তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছো?”
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিল। অনেক দূর থেকে খুব তাড়াতাড়ি এসেছি। আমি দুইজন মানুষকে খুঁজছি যারা আমার খুব ক্ষতি করেছে।
একজন মানুষের সম্মানই হলো তার জীবন, মাহমুদ গম্ভীর হয়ে বলল। ‘আল্লাহ তোমার সহায় হোন।
‘আল্লাহ ইতোমধ্যেই আমাকে অনুগ্রহ করেছেন, কেইন উত্তর দিল। ‘আমি যে লোকগুলোকে খুঁজছি তারা আপনার ক্যাম্পেই আছে। আমি তাদের ট্রাকদুটো দেখেছি।
মাহমুদের চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে শান্তভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার তাঁবুতে দুজন ইউরোপীয় আছে। আমার বন্ধু। প্রফেসার মূলার আর দাহরান থেকে আসা মোটা লোকটা। কীভাবে ওরা তোমার সম্মানহানি করেছে?
কেইন একইভাবে আবেগহীন কণ্ঠে বলল, ওরা আমার মেয়েমানুষকে হরণ করেছে।
একটু নিরবতা নামল আর বৃদ্ধ মানুষটি আস্তে আস্তে দাড়িতে আঙুল বোলাতে লাগল। এক মুহূর্ত পর সে বলল, “ওদের সাথে অবশ্য একজন মহিলা রয়েছে, মিশ্র রক্তের। এখানে পৌঁছার পর সে একবারও তাবু থেকে বের হয়নি।
‘ইনিই সেই মেয়েমানুষ,’ কেইন বলল।
মাহমুদ সহজভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু অপেক্ষা কর।’ এ কথা বলে সে বাইরে বের হয়ে গেল।
জর্ডন অস্থিরভাবে বলল, ‘এসবের অর্থ কী?
কেইন দ্রুত উত্তর দিল, এভাবেই আমরা স্কিরোজকে বের করে আনতে পারি। একজন নারী একজন বেদুঈনের ঘরের আসবাবের মতো হতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্তই, তারপর মিলটা এখানেই শেষ। কারও ঘরের নারীকে হরণ করা এদের মাঝে অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ মনে করা হয়।’
‘ঠিক আছে বুঝলাম সেটা, জর্ডন অধৈর্য হয়ে বলল। কিন্তু তারপরও আমি বুঝতে পারছি না এটা আমাদের কীভাবে সাহায্য করবে।
কেইন এ কথার কোন উত্তর দেবার আগেই, মাহমুদ তাঁবুতে ঢুকল, পেছন পেছন মুলার আর স্কিরোজকে নিয়ে।
কেইন আর জর্ডন দুজনেই উঠে দাঁড়াল, কেইন সামনে এক পা এগোলো। মুলারের চেহারায় হতাশার ভাব দেখে হাস্যকর মনে হচ্ছে, কিন্তু স্কিরোজের কোন ভাবান্তর নেই। আমরা তোমাদেরকে আসতে দেখেছি। মনে হচ্ছে। অলৌকিক ঘটনা এখনো ঘটে থাকে। সম্ভবত সেলিমের আসতে দেরি হয়েছে।’
‘আমার মনে হয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য, কেইন উত্তর দিল।
‘তোমরা পুরোনো বন্ধু মনে হচ্ছে, মাহমুদ মৃদুস্বরে বলল।
স্কিরোজ তাকে জানাল। মোটেই না,’ এই লোক আমার অনেক ক্ষতি করেছে। একদিক দিয়ে বলতে পার সে এমনকি তোমার আর তোমার গোত্রের লোকজনেরও ক্ষতি করেছে। তার কর্মকান্ডের কারণে মুলার আর আমাকে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। সীমান্তের উপজাতীয় গোষ্ঠীরা আর অস্ত্র পাবে না।
‘এটা সত্যি খুবই দুর্ভাগ্যজনক আর আমার গোত্রের লোকজন একথা শুনলে মোটেই খুশি হবে না,’ মাহমুদ বলল, “তবে কেন আমার তাবুতে একজন মেহমান, অতএব তার নিরাপত্তা রক্ষা করা আমার কর্তব্য, যেরকম তোমাদের নিরাপত্তা আমি দিয়েছি।’
স্কিরোজ কাঁধ ঝাঁকাল। সেটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার। তবে আমি মনে করি তোমাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত যে এই লোক তোমার শত্রু।
মাহমুদ কয়েক পা পায়চারি করল, তাকে গভীর চিন্তামগ্ন মনে হচ্ছে। “তোমাদের তাবুতে যে মেয়েটি আছে সেকি তোমাদের?
স্কিরোজের দেহ হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল আর মুলার কাঁপা কাঁপা হাতে মুখ থেকে ঘাম মুছলো।
‘এ বিষয়ের সাথে মেয়েটার কি সম্পর্ক?’ মুলার জিজ্ঞেস করল।
মাহমুদ কণ্ঠস্বর শান্ত রেখে বলল, কেইন বলেছে মেয়েটা তোমাদের নয়। তোমরা তাকে তার কাছ থেকে অপহরণ করেছ।
স্কিরোজ বলল, আমি এটাই আশা করেছিলাম যে, সে একথাই বলবে।’
“আচ্ছা তাই নাকি, মাহমুদ চিন্তাযুক্ত স্বরে বলল, একই বিষয়ের দু-ধরনের মতামত, দুটোই আলাদা ধরনের। তার মানে কেউ না কেউ সত্যি কথাটা লুকাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সত্য জানার কেবল একটি উপায় আছে।
সে হাততালি দিল, বাইরে কারও নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল। তারপর মেরি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। ভেতরের অন্ধকারে একটু চোখ পিট পিট করল, তারপর কেইনকে দেখতে পেল। সে প্রথমে অবাক হয়ে গেল তারপর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ছুটে গেল কেইনের দুবাহুর মাঝে।
সে তাকে শক্ত করে ধরে তার কালো চুলের উপর হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছো?’
‘আমি ঠিক আছি, সে ধীরভাবে তার মুখ ছুঁলো। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
মাহমুদ মেরির কাঁধে হাত রেখে তাকে তার মুখোমখি ফেরালো। তোমার নাম কি বাছা?’
সে মাহমুদের মুখোমুখি হয়ে চিবুক উঁচু করে বলল, ‘মেরি পেরেট।
সে মাথা নাড়ল। আমি তোমার কথা শুনেছি। তোমার মা রশিদ গোত্রের ছিল না?’ তারপর মাহমুদ এক পাশে একটু সরে দাঁড়াল, যাতে সবার মুখ পরিষ্কার দেখতে পারে। কেইন বলছে তুমি তার মেয়েমানুষ। স্কিরোজ তোমাকে তার কাছ থেকে অপহরণ করেছে, এটা সত্যি?
মেরি মাথা কাত করে সায় দিল। বর্ষীয়ান শেখ বলে চলল-তোমরা কি খ্রিষ্টানমতে বিবাহিত?
‘না, আমরা বিবাহিত নই,’ সে বলল।
‘তুমি কি তার সাথে মিশেছো?’ মাহমুদ দ্রভাবে বলল।
এক মুহূর্ত নিরবতা নেমে এল আর কেইন দম আটকে প্রার্থনা করতে লাগল, সে যেন সঠিক উত্তর দেয়। মেরি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, আমি এই লোকের সাথে মিশেছি।’
স্কিরোজ রাগে ফেটে পড়ল। এটা মিথ্যা। এটা কেইনের সাজানো গল্প। আমি তোমাকে বলেছি সে আমার শত্রু।
মাহমুদ এক হাতু উঁচু করে তাকে থামাল। বিনা কারণে কোন্ মেয়ে নিজেকে লজ্জায় ফেলবে? যদি সে তার সাথে মেলা মেশা করে থাকে তাহলে সে তার। সে আর কারও হতে পারে না। তার শরীরে আমাদের গোত্রের মানুষের রক্ত বইছে আর এটাই আমাদের আইন।
প্রচণ্ড রাগে স্কিারোজের চেহারা উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। সে অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিল। শক্ত হয়ে একবার মাথা ঝুঁকালো তারপর এক ঝটকায় তাবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল। মুলার তাকে অনুসরণ করল।
জর্ডন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কেইন মাহমুদের দিকে ফিরে বলল, এবার কি হবে?
বুড়ো শেখ মৃদু হাসল। আমার মনে হয় এটাই ভাল হবে, মেয়েটি এখন তাঁবুতে ফিরে যাক। আমার বন্ধুরা চলে যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই পাহারায় থাকুক।’
‘আমি ওর সাথে একটু কথা বলতে পারি?’ কেইন বলল।
মাহমুদ মাথা নাড়ল। বেশিক্ষণ নয় কিন্তু।
সে জর্ডনের কাধ স্পর্শ করল, তারপর দুজনে বাইরে গেল।
মেরি আবার কেইনের বাহুবন্ধনে আসতেই সে তাকে কিছুক্ষণ চেপে ধরে থাকল। তারপর ওরা বসল। কেইন হঠাৎ খুব ক্লান্তিবোধ করল। তোমার কাছে সিগারেট আছে?’ সে বলল।
মেরি তার শার্টের পকেট থেকে একটা দোমড়ানো প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট কেইনকে দিল। সে একটা তৃপ্তির টান দিয়ে বলল, “আহ! বেশ ভাল লাগছে।’
মেরি এগিয়ে হাত দিয়ে তার চুল সমান করল। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব খারাপ সময় কাটিয়েছ।
‘এক রকম তাই বলতে পার।’
‘খুলে বল।
সে তাকে সংক্ষেপে ঘটনার একটা বিবরণ দিল। তার বলা শেষ হলে মেরি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কানিংহামরা ঠিক আছে জেনে ভাল লাগছে। এখন তুমি স্কিরোজ আর মুলারের বিষয়ে কি করবে?
‘আমি কী করব বল? আমার ধারণা যদি ঠিক হয় তবে ওরা চলে যাবার পর মাহমুদ আমাদের এখানে আটকে রাখবে। ওরা যেহেতু এদেরকে বন্দুক সাপ্লাই করে এসেছে সেক্ষেত্রে এটুকু অন্তত মাহমুদ করবে। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝে উঠতে পারছি না স্কিরোজ এত তাড়াহুড়া করে কেন উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে। কী হয়েছে তার?
‘আমিও ঠিক জানিনা, সে বলল। সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর সে অনেকক্ষণ রেডিওতে কথা বলছিল। খুব রেগে ছিল তখন। সেলিমের সাথে অনেকক্ষণ তর্ক করল। তারপর সে জানাল আমরা ভোরেই রওয়ানা হবো।
‘সে সম্ভবত বার্লিনে তার উপরওয়ালাকে প্লেনটা ধ্বংস হওয়ার খবর জানাচ্ছিল, কেইন বলল। ওরা মনে হয় ভীত হয়ে পড়েছিল। কারণ যদি সে ধরা পড়ে আর তার প্রকৃত জাতীয়তা জানাজানি হয়ে যায় তবে মারাত্মক বিপদ হতে পারতো। হয়তো সেজন্যই ওরা তাকে বলেছে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বের হয়ে যেতে।’
‘ওর সাথে আর দেখা না হলেই ভাল, মেরি বলল।
কেইন ওর দুহাত বাড়াতেই মেরি তার দুহাতের মাঝে কেইনের হাত শক্ত করে চেপে ধরল।
‘এসব কিছু থেকে একটা ভাল জিনিস প্রকাশ পেয়েছে, আমি জানতে পারলাম কখন আমি জয়ী হয়েছি।’
সে আবার তার দুবাহুর মাঝে আসতেই ওরা দ্রুত একবার চুম্বন করল। এরপরপরই তাবুর পর্দা সরিয়ে মাহমুদ ঢুকল। সে একপাশে সরে দাঁড়াতেই মেরি তাকে পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে গেল।
বৃদ্ধ বেদুঈন মৃদু হাসল। তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এখন বরং একটা লম্বা ঘুম দাও। আমার লোক তোমাকে তোমার লোকজনের কাছে নিয়ে যাবে। পরে আবার কথা হবে।’
কেইন কড়া রোদে বের হতেই একজন লোক তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সবার চোখ তার দিকে ফিরছে আর বাচ্চারা তার সাথে সাথে দৌড়ে তার তাঁবু পর্যন্ত গেল। ভেতরে ঢুকে সে দেখল জর্ডন তাঁবুর মাঝখানে গালিচার উপর আসন পেতে বসে একটা ক্যান থেকে খাবার খাচ্ছে।
‘তোমার চেহারা জঘন্য দেখাচ্ছে, ভূবিজ্ঞানী উৎফুল্ল স্বরে বলল।
কেইন কোন রকমে হাসার চেষ্টা করল, তারপর তাবুর এক কোণে শোয়ার জন্য রাখা একটা খড়ের গাদির উপর শুয়ে পড়ল।
জর্ডন কথা বলেই চলল, কিন্তু তার কোন কথার অর্থ সে বুঝতে পারছিল না। একটু পড়েই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
ধীরে ধীরে ঘুম থেকে জেগে উঠে সে অন্ধকারে চেয়ে রইল। রাত হয়েছে, তার মাথার উপরে একটা খুঁটির উপর একটা তেলের বাতি ঝুলছে। এর আলোয় তাবুর মাঝখান থেকে ছায়াগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
জর্ডন কাছেই বসে তার রিভলবার পরিষ্কার করছে। কেইনকে নড়াচড়া করতে দেখে তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। এখন কেমন লাগছে?
‘মনে হচ্ছে যেন এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও রয়েছি,’ কোন রকমে বসে কেইন বলল।
জর্ডন ওর হাতে একটা বোল দিল। নাও, এটা খেয়ে নাও।
সে ভাত আর খাসির গোস্ত মুখে পুরতে লাগল, টের পেল তার বেশ খিদে পেয়েছিল।
‘আর কোন কিছু ঘটেছে?
জর্ডন মাথা নাড়ল। কবরস্থানের মতো একদম নিরব। তুমি প্রায় আট ঘণ্টা ঘুমিয়েছো?’
‘আমাদের বন্ধুরা কি চলে গেছে?
‘ওরা ক্যাম্পের অন্য পাশে ছিল। আমার ধারণা বুড়ো শেখ এভাবেই বন্দোবস্ত করেছে। প্রায় দু’ঘন্টা আগে আমি ওদের গাড়ি চালিয়ে যাবার শব্দ পেয়েছি। তোমার কী মনে হয়, এখন ওরা কোথায় যাবে?
কেইন কাঁধ ঝাঁকাল। সোজা দাহরান যাবে। আমরা কর্তৃপক্ষকে কিছু জানাবার আগেই কেটে পড়বে।’
‘তুমি কি ওদের থামাতে চেষ্টা করবে?
কেইন মাথা নাড়ল। মনে হয় না। ওরা চলে গেলেই আমি খুশি। এখানে ওদের কাজ কারবার শেষ। সে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলো। চল মাহমুদের সাথে দেখা করি।’
ওরা দেখল বুড়ো শেখ ওর তাঁবুতে আগুনের সামনে একটা ছাগলের চামড়ার আসনের উপর বসে টার্কিশ সিগারেট টানছে। চোখ আগুনের শিখার দিকে।
সে মৃদু হেসে ওদেরকে স্বাগত জানাল। তাহলে আমার বন্ধু সুস্থ হয়েছ? সে কেইনকে বলল।
কেইন তার পাশেই বসে পড়ল। তাহলে স্কিরোজ আর মুলার চলে গেছে?”
মাহমুদ মাথা কাত করল। আমি ওদেরকে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে এখানে একদিন ধরে রাখবো। এতটুকু ওদের জন্য আমার করার কথা।
‘স্কিরোজ একজন জার্মান, কেইন বলল। তার মতো একজন লোকের সাথে কাজকারবার করা কি বুদ্ধিমানের কাজ?
মাহমুদ মৃদু হাসল। তোমার বন্ধু একটা আমেরিকান তেল কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করছে? যদি সে তেল পায় তাহলে কতদিনে আমরা তথাকথিত আমেরিকান সাহায্য পাবো?
‘সেটা কি খুব একটা খারাপ হবে? জর্ডন বলল।
মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকাল। ওমানে ব্রিটিশরা আছে, ওরা ওদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। এখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করব। আর যদি জার্মানরা বোকার মতো আমাদের বিনা মূল্যে অস্ত্র দেয় সেটা আমরা নেবো।
কিন্তু সীমান্তের বেশিরভাগ উপজাতি গোষ্ঠি ঐ অস্ত্র দিয়ে ওমানে ব্রিটিশদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে, কেইন বলল। আর জার্মানরা এটাই দেখতে চায়।’
বুড়ো কাধ ঝাঁকাল। সেটা আমার দেখার বিষয় নয়।’
বোঝা গেল এই বিষয়ে আর কোন কথা বলে লাভ নেই। তাই কেইন বিষয় পরিবর্তন করল। আমি কি ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে পারি?
মাহমুদ মাথা নাড়ল। সে তাবুতে পাহারায় আছে। আমি নিজে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো। ওদেরকে নিয়ে তাবু থেকে বের হবার সময় সে বলল। ‘তুমি যদি একজন বৃদ্ধ লোকের উপদেশ শুনতে চাও, তবে আমি বলবো দাহরান যাবার পর সাবধানে থেকো। স্কিরোজ কখনো ভুলবে না তুমি তার যা করেছ।’
মেরি পেরেটের তাঁবুর সামনে পৌঁছে সে একটু থামল। দরজার পাশেই ছায়ায় প্রহরি পা ভাজ করে বসে রয়েছে। তার মাথা বুকের উপর ঝুলছে। মাহমুদ বিরক্ত হয়ে সামনে এগিয়ে এক পা দিয়ে লোকটার গায়ে খোঁচা দিল।
লোকটা ঘাড় কাত করে সামনে বালতে গড়িয়ে পড়ল। সে তখনো জীবিত, তবে বাম কানের কাছে ঘাড়ে রক্ত দেখা যাচ্ছে। ভারি আঘাতের চিহ্ন।
তাবুতে ঢুকে কেইন দেখল ভেতরে কোন ধরনের ধস্তাধস্তি বা সংঘর্ষের আলামত নেই, তবে মেরিও সেখানে নেই। সে মাহমুদের দিকে ফিরে বলল। ‘ওরা তাকে ওদের সাথে নিয়ে গেছে।’
‘কিন্তু কেন?’ জর্ডন বলল।
‘এ দেশ থেকে নিরাপদে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওকে জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করবে কিংবা আমার উপর একটা আঘাত দিল আর কি।’ কেইন কাঁধ ঝকাল। কারণটা জুরুরি নয়।’
মাহমুদ তার বাহু স্পর্শ করল, বুড়ো শেখের চোখে দুঃখের ছায়া ভেসে উঠল। আমি লজ্জিত যে এরকম একটা ঘটনা আমার ক্যাম্পে ঘটল। ওদেরকে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে একটা দিন আটকে রাখবো, এই ঘটনার পর এই প্রতিশ্রুতি থেকে আমি মুক্ত।
কেইন বলল, কারও দোষ নেই। তবে আমাদের এখুনি রওয়ানা হতে হবে। জামাল কোথায়?’
‘সে আমার দেহরক্ষীর সাথে ঘুমিয়েছিল, মাহমুদ বলল। আমি এখুনি তাকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি।’ সে তার তাঁবুর দিকে হাঁটতে শুরু করল। এদিকে কেইন আর জর্ডন তাড়াতাড়ি ওদের ট্রাকের দিকে এগোলো।
কানিংহামদের কী হবে? জর্ডন জিজ্ঞেস করল।
কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিল। আপাতত ওরা নিজেরাই নিজেদের সামলাবে। এ ব্যাপারটা বেশি জরুরি।’
সে একটা সিগারেট ধরিয়ে পরিস্থিতিটা নিয়ে ভাবতে শুরু করল, এদিকে জর্ডন সবকিছু চালু আছে কিনা দেখে নিল। মাটির রাস্তায় এখান থেকে দাহরানের দূরত্ব প্রায় একশো বিশ মাইল, আবার জায়গায় জায়গায় রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। স্কিরোজ আর মুলার দু’ঘন্টা আগে রওয়ানা দিয়েছে। যদি পথে কোথাও ওদের গাড়ি বিকল না হয়ে থাকে তাহলে দাহরানের আগে ওদেরকে ধরা অসম্ভব।
জামাল অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল, পিছু পিছু মাহমুদ তার কয়েকজন লোকসহ এল। জামাল পিছনের সিটে বসল আর জর্ডন চালকের আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
ইঞ্জিন গর্জে উঠতেই মাহমুদ একটু সামনে ঝুঁকে কেইনের হাত ধরল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা, বন্ধু।
পরে আবার দেখা হবে,’ কেইন বলল। জর্ডন গিয়ার বদল করতেই ট্রাকটা ধুলি উড়িয়ে এগিয়ে চলল।
প্রথম এক ঘণ্টা ওরা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটা পুরোনো উট চলার পথ দিয়ে চলল। জর্ডন অন্ধকারে সাবধানে নজর রেখে গাড়ি চালাচ্ছিল। অনেক সময় হেডলাইটের আলোয় কোন পাথর কিংবা অন্য কোন বাঁধা চোখে পড়তেই সাথে সাথে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে চলছিল।
কেইন পাশের সিটে হেলান দিয়ে রয়েছে, দাঁতের ফাঁকে জর্ডনের সিগারেট প্যাকেট থেকে নেওয়া একটা সিগারেট কামড়ে ধরে রয়েছে। অনেকক্ষণ ঘুমালেও সে তখনো ক্লান্ত ছিল, কিন্তু মনের ভেতরের কোন এক জায়গা থেকে সে গোপন কোন শক্তির উৎস খুঁজে পেয়েছে। রহস্যজনক কোন এক শক্তি–যা তাকে জাগ্রত রেখেছে তার কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য।
এক ঘণ্টা চলার পর সাগরের তীর থেকে বয়ে আসা জোর বাতাস পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এসে সামনের মেঘের পর্দাটা সরিয়ে দিল। পূর্ণিমার চাঁদ উদয় হল। চাঁদের আলোয় উপত্যকার মধ্য দিয়ে ওদের পথ আলোকিত হলো।
এবার সামনের পথ পরিষ্কার দেখা যাওয়ায় জর্ডন স্পিড বাড়িয়ে দিল। শুষ্ক উপত্যকার মাঝে শক্ত মাটির উপর দিয়ে বড় বড় বোল্ডার পাশ কাটিয়ে ওরা-গাড়ি ছুটিয়ে চলল।
ঘণ্টাখানেক পর ওরা মানুষের হাতে তৈরি একটা পথে এল। পাহাড়ের এক পাশ দিয়ে কেটে তৈরি করা এবড়ো থেবড়ো রাস্তাটায় ছোট ছোট খোয়া ছড়ানো।
জর্ডন গিয়ার বদল করে আরো স্পিড বাড়াতেই পেছন থেকে একটা বিকট আওয়াজ এল। আর ট্রাকটা বিপজ্জনকভাবে রাস্তার এক পাশে কাত হয়ে পড়ল।
জর্ডন ইঞ্জিন বন্ধ করে ধুত্তরি’ বলে উঠল। “চাকার হাওয়া গেছে। এই অভিশপ্ত রাস্তায় বেশ কয়েকবারই যাওয়ার কথা।
দশ মিনিটের মধ্যে ওরা চাকা বদলে আবার রওয়ানা দিল। তবে এবার কেইন চালকের আসনে বসল। ওর সামনে কী আছে তা ভাবার মতো অবস্থা এখন আর নেই। সে এখন পুরোপুরি মনোযোগ দিল রাস্তার দিকে। ট্রাক আর সামনে রাস্তা ছাড়া আর কোন কিছু এখন তার মনে নেই। পাহাড়ের পাশ দিয়ে একেবেঁকে ওরা নেমে চলেছে সমুদ্রতীরের দিকে।
এই মনোযোগ সে রাখতে পারবে কী পারবে না সে প্রশ্ন ওঠার কোন সুযোগ নেই। মাইলের পর মাইল সে হুইলের পেছনে বসে ট্রাক চালাচ্ছে। ওর হাতের ঘামে হুইল ভিজে গেছে। তিনঘণ্টা পর ওরা সেই বিশাল উপত্যকায় পৌঁছলো যা সাগরের দিকে চলে গেছে।
.
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেইন আর জর্ডন কোন কথা বলেনি। এবার দাহরান নজরে আসতেই কেইন বলল, ক’টা বেজেছে?
জর্ডন ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রায় ভোর চারটে। তুমি কেমন বোধ করছো?
কেইন বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা পরিষ্কার করল, তারপর ঘাড় কাত করল। আমি ঠিক আছি।’
‘এরপর আমরা কী করব? জর্ডন বলল।
কেইন ভুরু কুঁচকালো। আমার মনে হয় ওরা হোটেলে যাবে না। মুলারের বাড়িতে যাবে। বাড়িটা নিরব এলাকায়।
এরপর ট্রাকটা নিয়ে সে বিমানক্ষেত্রের পাশের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চলল। শহরতলির বাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে ওয়াটার ফ্রন্টের দিকে চলল। চারধার নিরব।
দাহরান পুরো অন্ধকার, সে হেডলাইট জ্বেলে সাবধানে আঁকাবাঁকা অলিগলির মাঝখান দিয়ে মুলারের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল। এরপরের পথটুকু হেঁটে যাওয়াই ভাল।
সাব-মেশিনগানটা হাতে নিয়ে সে সবাইকে সাবধানে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। দেয়ালের মাঝে একটা দরজার উপর একটা ল্যাম্প ঝুলছে। আলোর নিচে দেখা গেল একটা ট্রাক পার্ক করা।
জর্ডন এগিয়ে গাড়ির বনেটের উপরটা ছুঁয়ে দেখল। এটা তখনও গরম রয়েছে। বেশিক্ষণ হয়নি ওরা এসেছে।
কেইন মাথা নাড়ল। জানি, আমরা বেশ তাড়াতাড়ি এসেছি।’
দরজা তালাবন্ধ। এক মুহর্ত সে ইতস্তত করল। তারপর জামাল তার কাঁধ চুলো।
কেইন ঘুরে দেখল জামাল দেয়ালে হেলান দিয়ে দুপা ফাঁক করে মাটিতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেইন মেশিন-গানটা কাঁধে ঝুলিয়ে জামালের পিঠে চড়লো। জামালের কাঁধে চড়তেই সে কেইনের দুই পায়ের গোড়ালির বাট ধরে তাকে উপরের দিকে ঠেলে তুলল।
কেইন দেয়ালের উপর ওঠে লাফ দিয়ে ভেতরে বাগানে নেমে পড়ল। বাড়ির ভেতরে আলো দেখা যাচ্ছে। সে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে উপরে জানালার দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে দরজার তালা খুলল। এক মুহূর্ত পর জামাল আর জর্ডন ওর পাশে এসে দাঁড়াল।
কেইন দরজার তালা বন্ধ করে চাবিটা পকেটে ভরলো। তারপর ওরা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে বাড়িটার দিকে এগোলো।
.
১৮.
বাগান নিস্তব্ধ। সামনের দরজা থেকে কয়েকগজ দূরে একটা ঝোঁপের পেছনে কেইন হামাগুড়ি দিয়ে বসল। তারপর জর্ডন আর জামালকে পেছনে নিয়ে ছায়া থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল।
সামান্য ছোঁয়াতেই দরজা খুলে গেল, কেইন সাব-মেশিনগান রেডি করে ভেতরে ঢুকল। আলো জ্বলছে আর দোতলা থেকে অস্পষ্ট নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
সে ঘুরে জর্ডনের সাথে কথা বলতে যাবে এমন সময় হলের এক প্রান্তে ক্লিক করে একটা দরজা খুলে গেল। একটা সুটকেস হাতে সাদা আলখাল্লা পরা একজন আরব পরিচারক ঘরে ঢুকল। ওদের দেখার সাথে সাথে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে কোন চিৎকার করার আগেই জামাল তড়িৎ গতিতে সামনে এগিয়ে লোকটার চোয়ালে প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারল। টু শব্দ না করে লোকটার। দেহ মাটিতে ঢলে পড়ল। সুটকেসটা হাত থেকে খসে পড়ল।
উপর থেকে চিৎকার শোনা গেল। মুলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে হাজির হলো। ‘জলদি কর!’ সে চেঁচিয়ে উঠল আর তখনই কেইনকে দেখতে পেল।
পকেট থেকে একটা লুগার রিভলবার বের করে সে আন্দাজে একটা গুলি ছুঁড়লো। গুলিটা দেয়ালে লেগে ছিটকে পড়ল। সাথে সাথে ওরা সবাই মাথা বাঁচাতে বসে পড়ল। মুলার পেছন ফিরে ওর স্টাডিতে ঢুকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
কেইন সাবধানে পা টিপে টিপে ল্যান্ডিংয়ে উঠে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। তারপর দ্রুত এগিয়ে দরজাটা খুলতে চেষ্টা করল। তালাবন্ধ। জামাল আর জর্ডন এসে অন্যপাশে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, কিন্তু মুলারের কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
কেইন জামালের দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করল। জামাল নিঃশব্দে এগিয়ে দরজার তালার উপর এক রাউন্ড গুলি ছুঁড়লো। দরজার তালা ছিন্নভিন্ন। হয়ে যেতেই সে এক লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেলল। তারপর একলাফ দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিল। কিন্তু তবুও মুলারের কোন সাড়া নেই। এক মুহূর্ত পর কেইন কামরার চারপাশে উঁকি দিল। সব খালি আর দূরের দেয়ালে একটা দরজা হা করে খোলা।
এদিক দিয়ে পেছনের একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। কেইন সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল, সাবধানে নিচে অন্ধকারে নামল। নিচের দরজাটা বন্ধ। ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল, ওরা বাগানে এসেছে।
‘তোমার কি মনে হয় সে এখনো সেখানে আছে?’ জর্ডন ফিসফিস করল।
কেইন মাথা নাড়ল। থাকতেই হবে। আমি তালা বন্ধ করেছি। আর সে এতো বেঁটে যে কারও সাহায্য ছাড়া দেয়াল টপকাতে পারবে না।’
ঝোঁপের মধ্য থেকে একটা বুলেট শই শাই করে এসে ওদের কয়েক ফুট দূরে দেয়ালে ধাক্কা মারল। ওরা নিচু হলো, জামালও ওদের পাশে এলো।
‘বোকার মতো কাজ করো না মুলার,’ কেইন বলে উঠল। আমরা এখানে তিনজন আছি আর সবার হাতে বন্দুক আছে। তুমি কিছুই করতে পারবে না।’
অযাচিত শব্দে বিরক্ত হয়ে কোথাও একটা পাখি ঝোঁপের মাঝ থেকে উড়ে গেল। আর ছাদের কিনারায় রোজ রাতে যে কবুতরগুলো থাকতে আসে সেগুলো ঝটাপটি করে উঠল।
‘আমরা বরং দুদিকে চলে যাই,’ কেইন মৃদু কণ্ঠে জর্ডনকে বলল। এভাবে বসে থেকে কোন কাজ হবে না। আর দোহাই লাগে উল্টোপাল্টা গুলি ছুঁড়তে যেয়োনা। হয়তো মুলারের বদলে আমাকেই মেরে বসবে।’
জর্ডন দাঁত বের করে হাসল।ঠিক আছে, আমি সাবধান থাকব।’
জামাল ডানদিকে এগোলোলা আর কেইন সামনের দিকে ক্রল করে এগোতে শুরু করল। শিশির পড়ে মাটি ভেজা ছিল। সে একটা ডুমুর গাছের ছায়ার মাঝে উঠে দাঁড়াল। কান পেতে কোন শব্দ শুনতে চেষ্টা করল। তারপর আবার একটা বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ পাওয়া গেল আর জর্ডন চেঁচিয়ে উঠল। সে গেটের দিকে যাচ্ছে কেইন! ওকে আটকাও!
কেইন দ্রুত সামনে এগিয়ে পথের উপর এসে দাঁড়াল। মুলার ওর বিশ কি ত্রিশ ফুট দূরে এসে হাজির হল। সে দৌড়ে গেটের কাছে গিয়ে গেটটা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। এদিকে জর্ডনও বের হয়ে কেইনের পাশে দাঁড়াল।
মুলার ওদের দিকে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। তার চেহারায় হতাশা ফুটে উঠেছে। সে তার ডান উরুর সাথে লুগারটা চেপে ধরে রেখেছে। কেইন সাব মেশিনগানটা তুলে ধরল। কোন বোকামি করো না।
কিন্তু মুলার লুগারটা উঠিয়েই গুলি ছুড়লো। জর্ডন দম বন্ধ করে এক পাশে কেইনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মুলার আবার লুগারটা উঁচু করতেই জামাল ঝোঁপের মধ্য থেকে বের হয়ে সাব-মেশিনগান থেকে এক রাউন্ড গুলি ছুড়লো। গুলির ধাক্কায় মুলার গেটের গা ঘেষে পড়ে গেল।
যন্ত্রণায় জর্ডনের মুখ কুঁচকে রয়েছে আর কেইন ওকে ধরে বসাতেই জর্ডনের ক্ষত থেকে ওর হাতে রক্ত চুঁইয়ে পড়ল। সে জামালকে ডাকল। জামাল জর্ডনকে পাঁজাকোলে করে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।
কেইনও পিছু পিছু যাবে, এমন সময় মুলারের গোঙানি শোনা গেল। একটু ইতস্তত করে সে গেটের কাছে গিয়ে মুলারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। মুলারের চোখ খোলা, সে যন্ত্রণায় কাতড়াচ্ছে। বুকটা গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেছে।
কেইন নিচু হয়ে ওকে বলল, ‘মুলার শুনতে পাচ্ছো? আর সবাই কোথায়?
সে বৃথা সময় নষ্ট করল। মুলারের চোখ উল্টে গেল আর মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে এল। মাথা এক পাশে হেলে পড়ল, তারপর সে স্থির হয়ে গেল।
কেইন এক মুহূর্ত একটু চিন্তা করল, তারপর মৃতদেহটা পথ থেকে সরিয়ে ঝোঁপের মাঝে টেনে নিয়ে গেল। তারপর গেটের তালা খুলে আবার বাড়ির দিকে ফিরে চলল।
জামাল জর্ডনের শার্ট খুলে ফেলেছিল। বুলেট তার বুকের নিচে বামদিকে জখম করেছে। তবে পরীক্ষা করে বোঝা গেল বুলেটটা পাজরের একটা হাড়ে লেগে সরে গেছে। মাংসে একটা গভীর ফুটো হয়ে সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। এছাড়া বিপজ্জনক আর কিছু হয়নি।
জামাল শার্টটা ফালি ফালি করে ছিঁড়ে দ্রুত ক্ষতটায় একটা ব্যান্ডেজ বাঁধল। জর্ডন তখন চোখ মেলল। আমার জন্য চিন্তা করো না,’ সে বলল। ‘তোমরা স্কিরোজের পেছনে যাও।’
‘আগে তোমাকে ডাক্তারের কাছে দিয়ে তারপর যাবো, কেইন বলল।
জামাল তাকে কোলে তুলে নিতেই ভূতত্ত্ববিদ জ্ঞান হারালো। কেইন পথ দেখিয়ে বাগান পেরিয়ে ট্রাকের কাছে পৌঁছলো।
যেতে যেতে ওরা দেখল আশেপাশের সব বাড়িঘর নিরব, তখন কেইন ভাবলো ভাগ্য ভালো যে দাহরানে রাতের বেলা বন্দুকের গুলির শব্দ এমন কিছু নয় যে মানুষ জেগে উঠবে।
সে হোটেলের সামনে এসে থামল আর জামাল ওর পিছু পিছু জর্ডনকে কোলে তুলে নিয়ে এল। বারান্দায় কেউ নেই, শুধু একজন ভারতীয় কেরানি ডেস্কের পেছনে বসে দুলছে। কেইন তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জাগাল।
‘স্কিরোজ কোথায়?
লোকটা দুদিকে দুহাত ছড়ালো। উনি দূরে গেছেন সাহেব। কয়েকদিন ধরে তিনি বাইরে আছেন।’
কেইন বুঝতে পারল লোকটা মিথ্যা বলছে। তবে এ মুহূর্তে ছেড়ে দিল। ‘ডাক্তার হামিদ কি এখনো এখানে থাকেন?
কেরানি মাথা নাড়তেই কেইন বলল, দোতলার একটা কামরার চাবি দাও আর ডাক্তারকে ঘুম থেকে তোল। তাকে বল খুব জরুরি দরকার।’
কেরানি ডেস্ক ঘুরে এসে তার হাতে একটা চাবি দিল তারপর ওদের আগে আগে উপর তলায় চলে গেল। কেইন চাবির নম্বরটা দেখে কামরাটা খুঁজে বের করে দরজা খুলল।
জামাল জর্ডনকে অত্যন্ত যত্নসহকারে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। জর্ডনের সারা মুখ ঘামে ভিজে গেছে, কেইন উদ্বিগ্ন হয়ে ওর দিকে তাকাতেই দরজা খুলে গেল। লম্বাটে মুখের একজন আরব ভেতরে ঢুকল। তার পরনে ড্রেসিং গাউন আর হাতে একটা কালো ব্যাগ। সে কেইনের দিকে একবার মাথা নেড়ে তাকে সরিয়ে জর্ডনের দিকে ঝুঁকে তাকাল।
তারপর সোজা হয়ে তার ব্যাগটা খুলল। দেখতে যত খারাপ মনে হচ্ছে সেরকম নয়, পরিষ্কার ইংরেজিতে সে বলল। যদিও তার ভাগ্য ভাল বলতে হবে।
‘আমি তাকে আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি, কেইন বলল। পরে এসে দেখবো সে কেমন আছে।’
ডাক্তার হামিদ অধৈর্য হয়ে মাথা নেড়ে তার কাজে লেগে পড়লেন। কেইন আর জামাল কামরা থেকে বের হয়ে গেল।
নিচে নেমে ওরা দেখল কেরানি ডেস্কের পেছনে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছে। কেইন সামনে এগিয়ে ডেস্কে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
লোকটা খবরের কাগজের উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে অনিশ্চয়তা নিয়ে মৃদু হাসল। আপনার জন্য আর কিছু করতে পারি, সাহিব?’
‘তুমি বলতে পারো স্কিরোজ কোথায় আছে, কেইন বলল।
সে কাঁধ ঝাঁকাল। আমিতো আপনাকে আগেই বলেছি সাহিব, মিস্টার স্কিরোজকে আমি কয়েকদিন ধরে দেখিনি।
‘সাধারণত আমি একজন ধৈর্যশীল মানুষ, কেইন বলল। “তুমি আমাকে এমন এক রাতে ধরেছো যখন আমি কাজের মধ্যে নেই। এখন হয় তুমি আমাকে বল স্কিরোজ কোথায় আর নয়তো আমি আমার বন্ধুকে বলব তোমার হাত ভেঙে দিতে।
কেরানি জামালের দিকে তাকাল তারপর ব্যথায় কুঁচকে উঠল। তার কোন দরকার হবে না সাহিব। সব কিছুরই একটা সীমা আছে–এমনকি বিশ্বস্ততারও। মিষ্টার স্কিরোজ এক ঘণ্টা আগে এখানে ছিলেন। তিনি তার অফিস থেকে অনেক কাগজপত্র আর সেফ থেকে অনেক টাকা নেন। আমাকে বলেন কিছুদিনের জন্য দূরে যাচ্ছেন। কেউ জিজ্ঞস করলে আমি যেন বলি আমি কিছুই জানি না।’
‘মেরি পেরেট কি তার সাথে ছিলেন?
কেরানি মাথা নাড়ল। তিনি দুটো টেলিফোন করলেন, ব্যস এই।’
কেইন সুইচবোর্ডের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হাসল। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ তিনি কোথায় কথা বলেছেন।
কেরানি কাঁধ ঝাঁকাল। প্রথমটা ছিল প্রফেসর মুলারকে। মিষ্টার স্কিরোজ তাকে তাড়াতাড়ি করতে বললেন। তিনি জানালেন সব কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘আর দ্বিতীয়টা?
দ্বিতীয়টা ছিল কাস্টম চিফ, ক্যাপ্টেন গনজালেসকে। মিষ্টার স্কিরোজ তাকে বললেন খুব দ্রুত তার কাছে আসতে, আর তার কাছে যত টাকা আছে। সব নিয়ে আসতে।
‘তিনি কি এসেছিলেন?
‘তিনি বিশ মিনিট পরেই আসেন। খুব রেগেছিলেন, সাহিব। কিন্তু মিষ্টার স্কিরোজ তাকে ভয় দেখালেন।
“কি ব্যাপারে?’ কেইন বলল।
কেরানি মাথা নাড়ল। আমি ঠিক নিশ্চিত নই, সাহিব। তবে কথা শুনে মনে হচ্ছিল ওরা দুজন কোন ব্যবসায় অংশীদার ছিলেন।
কেইন এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল, তার ভুরু কুঁচকে উঠল। তারপর জামালের দিকে মাথা কাত করে হল পেরিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে চলে গেল।
ওয়াটারফ্রন্ট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক কিছুই তার মনে পরিষ্কার হলো। কানিংহামের এখানে আসার ব্যাপারে স্কিরোজ যে জানে, সেটা তার অস্বীকার করাটা বোধগম্য, তবে গনজালেস তাকে দেখেনি সে কথাটা সহজে বোঝা যায়নি। কাস্টম চিফ অলস আর দায়িত্বে অবহেলা করলেও, এ শহরের প্রতিটা ভিখারি তার স্পাই। এখানে খুব কম ঘটনাই ঘটে যা সে জানে না।
আর এতো দিন যে কেইন স্কিরোজের জন্য দাহরানে কারেন্সি বয়ে এনেছিল? গনজালেস একবারও তার বোট পরীক্ষা করেনি। স্বভাবতই স্কিরোজ তার সাথে বন্দোবস্ত করে রেখেছিল, তাই তারা কেইনকে আস্থায় নেওয়াটা প্রয়োজন মনে করে নি।
ওরা কাষ্টম চিফের বাসায় পৌঁছাল। কেইন খুব জোরে বেলের চেইন ধরে টানল। কিছুক্ষণ পর ওপাশে নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল। গনজালেস গ্রিলের মধ্য দিয়ে তাকাল।
সে বলল, কে ওখানে?
কেইন বলল, “আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। খুব জরুরি।’
গজগজ করে গনজালেস দরজার চেইন খুলল। একটুখানি খুলতেই জামাল এক লাথিতে দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগালো।
কেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল গনজালেস মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে। সে রেগে বলল, এর মানে কী?
কেইন তাকে টেনে তুলে দাঁড় করাল, তারপর কাছে টানল। স্কিরোজ কোথায়?
তার মুখে ভয়ের ছায়া দেখা গেল। তারপরও শাসানির ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘তার আমি কি জানি?
কেইন তাকে এক হাতে ধরে জামালের দিকে ফিরল। সে পরিষ্কার আরবিতে বলল, এই কুকুর জানে কোথায় মিস পেরেটকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। ওকে জানাতে বল।
জামাল তার বিশাল হাত বাড়িয়ে গনজালেসের কাঁধের চারপাশে শক্ত করে দুই হাত বাঁধল। এক সেকেন্ড পর তার বিশাল হাঁটুর উপর গনজালেসের পিঠ বাকা করে শোয়াল। সে একবার চিৎকার করে উঠতেই কেইন সামনে এগিয়ে জামালের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
জামাল হাতের চাপ কমাতেই, গনজালেস এক হাত সোজা করে কেইনের দিকে চেয়ে অনুরোধ করল, “এই কালো শয়তানকে বল আমাকে ছেড়ে দিতে।’
কেইন কর্কশ কণ্ঠে বলল, যতক্ষণ না তুমি আমাকে জানাও, যা আমি জানতে চাই, তার আগে নয়।’
গনজালেস বলল, “স্কিরোজ আর মেয়েটা সেলিমের ধাউ ফারাহ’তে আছে। ওরা ভোরের জোয়ারের সময় চলে যাবে।
কেইন জামালকে ইশারা করতেই সে কাষ্টমস চিফকে মাটিতে ফেলে দিল। সে মাটিতে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল।
.
কেইন দ্রুত ওয়াটারফ্রন্ট ধরে এগিয়ে জেটির দিকে মোড় ঘুরল। বেশ কয়েকটা ধাউ তীরে বাঁধা রয়েছে, কিন্তু ফারাহকে দেখা যাচ্ছে না। এক মুহূর্ত তার মনে আতংক ভর করল। আর ঠিক তখনই জামাল তার কাঁধ ছুঁয়ে সাগরের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। ফারাহ বন্দরের মাঝখানে নোঙর করা রয়েছে। আশে পাশে আর কোন নৌকা নোঙর করা নেই। চাঁদের আলোয় সাগরের পানি রূপালি রং ধারণ করেছে।
বোটে করে এগোলে কারো না কারো চোখে পড়ার সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। ওরা নিচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে জেটির শেষ মাথার দিকে এগোলো। হালকা একটা শব্দ শুনে কেইন থামল।
জেটির কিনারায় এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল অন্ধকার ছায়ায় দুটো ধাউয়ের মাঝে একটা ডিঙি নৌকার উপর একজন আরব বসে আছে। সাহিব এসেছেন নাকি? আরবটা মৃদু স্বরে ডাকল।
কেইন বুঝলো লোকটা ভুল করে তাকেই মূলার মনে করেছে। সে পেছন ফিরে লোহার সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে খুব চাপা স্বরে বলল, তোমার হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে নামতে সাহায্য করো।
লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সে অর্ধেক ঘুরে তার তলপেটে একটা লাথি কষালো। লোকটা গুঙিয়ে নৌকার মাঝখানে পড়ে গেল। আর কেইন তার পাশে নামল।
সে দ্রুত শার্ট খুলে ফেলল। ডেজার্ট বুটের ফিতা খুলতে খুলতেই জামাল তার পাশে নামল। জামাল তার পাশে আসন পেতে বসতেই কেইন দ্রুত তাকে প্ল্যানটা বুঝিয়ে বলল। তার বলা শেষ হতেই জামালের চেহারায় উদ্বিগ্ন ভাব দেখা গেল, তারপরও সে অনিচ্ছা নিয়ে ঘাড় কাত করল।
কেইনের পরনে এখন শুধু খাকি প্যান্ট। সে আরব মাঝির বেল্ট থেকে ছুরিটা নিয়ে নিজের কোমরে গুজলো। তারপর পানিতে নামল। নিঃশব্দে শক্তিশালী বেষ্ট স্ট্রোক দিয়ে সাগরে সাঁতার কেটে চলল।
নোঙর করা ধাউগুলোর ছায়া থেকে বের হয়ে চাঁদের আলোয় আলোকিত রূপালি পানির মাঝে পৌঁছার পর তার নিজেকে নগ্ন আর একা মনে হলো। সৌভাগ্যবশত সাগর থেকে বয়ে আসা মৃদু বাতাসে সাগরের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ সৃষ্টি হয়ে তাকে লুকোতে সাহায্য করল।
ফারাহর কাছে এগোতেই সে দেখল কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে একজন নাবিক জাহাজের ডেকের মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেইন নিঃশব্দে পালের দড়ি বাঁধার খুঁটির নিচ দিয়ে সাঁতার কেটে এগিয়ে নোঙরের দড়ি শক্ত করে ধরে একটু বিশ্রাম নিল।
এক মুহূর্ত পর সে এক হাতের উপর অন্য হাত রেখে উপরে উঠতে শুরু করল। পাহারারত নাবিকটা ডেকের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে জেটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেইন রেইল টপকে নিঃশব্দ পায়ে এগোলো।
এক হাতের কানা দিয়ে সে লোকটার ঘাড়ে কারাতের কোপ মারল। টু শব্দটি না করে আরব লোকটা ডেকে লুটিয়ে পড়ল। কেইন রাইফেলটা তুলে পরীক্ষা করল, তারপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে জাহাজের নিচের দিকে নামল। ছায়ায় একটু থামল।
জাহাজের নাবিকরা হোল্ডের এক ধারে রয়েছে, সে হ্যাঁচের মধ্যে উঁকি দিল। নিচে হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে আর কিছু রান্নার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে রাইফেলটা নামিয়ে রাখল, তারপর ভারী স্টর্ম কভারটা হ্যাঁচের উপর রেখে ধাতব ব্রাকেটগুলো লাগিয়ে দিল।
রাইফেলের দিকে হাত বাড়িয়ে উঠে দাঁড়াবে, এমন সময় পেছনে মৃদু শব্দ হলো। একটা রিভলবারের ঠাণ্ডা নল আস্তে তার ঘাড় ছুঁলো, স্কিরোজ বলে উঠল। খুব চমৎকার বন্ধু। প্রায় সেরে ফেলেছিলে কাজটা।’
কেইন আস্তে আস্তে ঘুরল, জার্মান স্কিরোজ মৃদু হাসল। তাহলে বুড়ো মাহমুদ তোমাকে আটকে রাখবে বলে যে কথা দিয়েছিল, সে কথা রাখেনি।
কেইন বলল, যখন সে জানতে পারল তুমি মেরিকে নিয়ে গেছ, তখন তুমি তার আরব সম্মানে আঘাত করেছ।’
তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি মূলারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মনে হয় সে আর আসবে না।
কেইন বলল, না সে আর আসবে না।
স্কিরোজ আবার মৃদু হাসল। এক দিক দিয়ে তুমি আমার উপকার করেছ। সে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারতো। তুমি আমার আশা পূর্ণ করেছ।’
কেইন শুকনো কণ্ঠে বলল, তা আমি বিশ্বাস করি।
স্কিরোজ হ্যচের দিকে নির্দেশ করল। এখন তুমি আবার ওটা খুলে দাও। আমাদের যাত্রা দেরি করার আর কোন কারণ নেই।
কেইন যথাসম্ভব ধীরে ধাতব ব্রাকেটগুলো খুলল। হ্যাঁচের ঢাকনিটা উপরে তুলতেই স্কিরোজ ডেকে উঠল, ‘সবাই ডেকে উঠে এসো!’
নিচে থেকে আরব নাবিকগুলো উঠে এলো, তারা দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলতে লাগল আর কেইনের দিকে শত্রুভাবাপন্ন দষ্টিতে তাকাল। স্কিরোজ ওদের মধ্য থেকে মেটকে সামনে আসতে বলল এবং তাকে জাহাজ ছাড়ার নির্দেশ দিল। তারপর কেইনকে ঠেলতে ঠেলতে সে জাহাজের পেছন দিকে নিয়ে চলল।
পুপ-ডেকের নিচে ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজা খুলে সে কেইনকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢোকালো। সেই রাতে এখানে আসার কথা কেইনের মনে পড়ল, যে রাতে সেলিমের লোক ওর উপর আক্রমণ করেছিল। কেবিনটা একইরকম দেখাচ্ছে। একটা নিচু পিতলের টেবিলের চারধারে মাদুর আর কুশন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। আর বিশাল স্টার্ণ জানালার নিচে একটা শোয়ার কাউচ সদ্য পেতে রাখা হয়েছে।
স্কিরোজ টেবিলের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–যদি আমি আর তুমি পরস্পরের বন্ধু হতাম।’
কেইন বলল, তার কোন আশা নেই। তুমি শেষ হয়ে গেছ। কোন ব্যু হলো না, সুয়েজ খাল এখনো খোলা। এখন তোমার ফুয়েরার কী বলবে?
তার মনে এখন অন্য চিন্তা চলছে। প্যানজার ডিভিশন গতকালই এগিয়েছে, বন্ধু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে পোলান্ড শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।’
কেইন বলল, “আমি জানতাম সেই যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় হয়েছিল।
স্কিরোজ রুষ্ট চেহারা নিয়ে বলল, “তবে এবার নয়।’
‘আমি জানি, এরপর সারা পৃথিবী জানবে। মেরিকে কী করেছ?
স্কিরোজ তার সেই তেলতেলে কালো রঙের একটা চুরুট বের করে বেশ কসরত করে এক হাতে ধরাল। চুরুটের ধোয়া গলার ভেতরে ঢুকতেই খুক খুক করে কেশে উঠল। সত্যি এ ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ মজার মনে হচ্ছে। আমি কখনো ভাবিনি যে তুমি ভালোবাসা, রোমান্স এ ধরনের ব্যাপারে বিশ্বাস কর।
সে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে সামনে একটা ছোট দরজার দিকে এগোলো। তারপর দরজার তালা খুলে এক পাশে দাঁড়াল। মেরি বের হয়ে কামরায় ঢুকল।
এক মুহূর্ত সে সেখানে হতবুদ্ধি আর বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কেইনকে দেখেই সোজা তার দিকে ছুটে গেল।
“সে তোমার কোন ক্ষতি করেছে? কেইন বলল।
সে দুদিকে মাথা নাড়ল–না, কিন্তু তার কথাবার্তা তার মতোই জঘন্য।’
স্কিরোজ হাসতে লাগল, তার বিশাল শরীরের সমস্ত মাংশপেশি নাচতে শুরু করল। আমি ভাবছি যখন তোমার এই বন্ধু উপসাগরের শার্কের খাবার হবে তখন তুমি কীভাবে কথা বলবে।’ সে রিভলবারের ঘোড়া বুড়ো আঙুল দিয়ে পেছনে টেনে কেইনের পেটের মাঝ বরাবর তাক করল।
কেইন স্কিরোজের পেছনে তাকাল। খোলা জানালা দিয়ে নোঙরের মোটা দড়ির গোছাটার দিকে তার দৃষ্টি পড়ল। হঠাৎ সে লক্ষ করল কিছু একটা সেখানে নড়ছে, তারপর দুটো হাত জানালার দু’পাশে উদয় হলো। এক মুহূর্ত পর জামাল সাবধানে মাথা উঁচু করে কেবিনের ভেতরে উঁকি দিল।
কেইন সর্বপ্রকারে চেষ্টা করল যাতে স্কিরোজ কথা চালিয়ে যায়। সে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে গিট দেওয়া রুমালটা বের করল যার মধ্যে ছিল সেই নেকলেসটা, যেটা সে শেবার সমাধির পথে পেয়েছিল।
রুমালের পুটুলিটা সে পিতলের কফি-টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলল। তারপর শান্তস্বরে বলল, আমাকে মেরে ফেললে, তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবে।’
জার্মান স্কিরোজ ককভাবে হেসে উঠল–”ওসব চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। এসব বলে তুমি নিজেকে বাঁচাতে পারবে না।
কেইন রুমালটা তুলে গিটগুলো খুলতে শুরু করল। নিজ চোখে দ্যাখো। এটা শুধু একটা নমুনা। শেবার নেকলেস। আমরা এটা ঐ মন্দিরে পেয়েছি।’
সে নেকলেসটা আলোয় মেলে ধরল। পান্নার দূতি সবুজ আগুনের মতো ফুটে উঠল।
স্কিরোজের চোয়াল ঝুলে গেল আর তার চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল-হলি মাদার অফ গড, এরকম রত্ন আমি জীবনে কখনো দেখিনি।’
সে কেইনের হাত থেকে নেকলেসটা কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। এক মুহূর্ত পর মুখ তুলে তাকাল। তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। ঠিক জায়গামতো এর আকাশচুম্বি দাম পাওয়া যাবে। তোমাকে ধন্যবাদ।
এই পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল তার শেষ কথা। সে হাসতে শুরু করল, তার আঙুল রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসতে শুরু করেছে। আর তখনই জামাল দুহাত বাড়িয়ে শোয়ার কৌচটা পার হয়ে এল।
এক হাতে সে জার্মান লোকটার মুখ চেপে ধরল আর অন্য হাতে রিভলবারটা তার মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিল। স্কিরোজ ছাড়া পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জামাল এক হাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরল। তারপর তার এক হাঁটুর উপর স্কিরোজকে পেছন দিকে বাঁকা করে চেপে ধরল।
স্কিরোজের চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল, সে পাগলের মতো দুই পা ছুঁড়তে শুরু করল। শুকনো গাছের ডাল ভাঙ্গার মতো মট করে একটা শব্দ হলো, তারপর তার দেহ স্থির হয়ে গেল।
আতঙ্কে মেরির দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হলো যখন জামাল তাকে মাটিতে শুইয়ে রাখল। কেইন মাটি থেকে নেকলেসটা তুলে নিল। এমন সময় জাহাজের পেছনের নোঙরটা জানালা অতিক্রম করে উপরের দিকে উঠে গেল আর বিশাল পালে বাতাস লাগতেই ধাউটা সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
কেইন জানালার দিকে ইঙ্গিত করে জামালকে সামনে ঠেলা দিল–’জলদি কর, আর সময় নষ্ট করা যাবে না।
জামাল প্রথমে তার পা বের করে জানালা গলে অদৃশ্য হলো। ধাউয়ের গতি ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে আর এটা বন্দরের প্রবেশ মুখের দিকে চলতে শুরু করেছে। কেইন মেরিকে জানালা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিল।
তারপর সে পেছনে একবার জার্মান লোকটার পড়ে থাকা দেহের দিকে তাকাল। মুখ এদিকে ফেরানো আর চোখ খোলা। তারপর কেইন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিল।
পানি থেকে ভেসে উঠে সে দেখল ধাউটা দূরে চলে গেছে। সে মেরির দিকে সাঁতার কেটে এগিয়ে চলল। চাঁদের আলোয় তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
মেরি পানিতে পা চালিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কাছে আসতেই সে কেইনের হাত ধরল, তারপর তারা কিছুক্ষণ সেভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল।
ধাউটা তখন খোলা সাগরে অনেক দূরে ভেসে গেছে। সাগরের বাতাস পেয়ে পালটা ফুলে উঠেছে। আর কেইন মেরির দিকে তাকাল, তারপর কোন কারণ ছাড়াই ওরা হাসতে শুরু করল।
সে বেশ শক্ত করে তার হাত ধরল, তারপর ওরা ঘুরে একসাথে ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে সৈকতের দিকে চলল।