- বইয়ের নামঃ দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবন
- লেখকের নামঃ ডেল কার্নেগি
- প্রকাশনাঃ মেমোরী পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, আত্মজীবনী,
দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবন
০০. ভূমিকা – দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবন
ভূমিকা
নিউইয়র্কে, পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমিই ছিলাম সবচেয়ে দুখী ছেলে । জীবিকার জন্য আমি মোটর ট্রাক বিক্রি করতাম। মোটর ট্রাক কীভাবে চলে আমি জানতাম না, জানার ইচ্ছেও ছিল না। আমার কাজকে আমি ঘৃণা করতাম। আরশোলায় ভরা ওয়েস্ট ফিফটি সিক্সথ স্ট্রিটের একটা সস্তা কামরায় বাস করতেও আমার ঘৃণা হত। আমার মনে পড়ছে একদিন দেয়ালে টাঙানো একটা টাই নিতেই একগাদা আরশোলা ছড়িয়ে পড়েছিল। নোংরা সব রেস্তোরাঁয় খাবার খেতেও আমার ঘৃণা হতো। সেখানেও আরশোলা ছড়িয়ে থাকত।
প্রতিদিন রাত্তিরে দারুণ যন্ত্রণা নিয়ে ঘরে এসে পৌঁছতাম–হতাশ, চিন্তা, তিক্ততা আর বিদ্রোহের চিন্তায় সেই মাথার যন্ত্রণা! বিদ্রোহের কথা জাগতো আমার কলেজের সেই স্বপ্নের কথা ভেবে। ভবিষ্যৎ জীবনের কত স্বপ্নময় ছবিই না সে সময় আঁকতাম–আজ সেসব হয়ে উঠেছে দুঃস্বপ্ন। এটাই কি জীবন? যে স্বপ্নবিষ্ট ভবিষ্যতের কথা ভেবেছি এটা কি তাই? এটাই কি আমার কাছে জীবনের অর্থ–যে কাজ পছন্দ করি না তাই করা, আরশোলাময় ঘরে থাকা, নোংরা খাবার খাওয়া–আর ভবিষ্যতের কোন আশা না রাখা? …আমি শুধু চাইতাম পড়তে আর কলেজ জীবনে যে বই লেখার স্বপ্ন দেখতাম আমি লিখতে।
আমি জানতাম যে কাজ পছন্দ করি না সেটা ছেড়ে দিলে লোকসানের বদলে আমার লাভই হবে। আমার কাড়ি কাড়ি টাকা চাই না, আমি চাইতাম ভালোভাবে বাঁচতে। ছোট্ট করে বললে আমি একটা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছিলাম–এমন অবস্থা নতুন জীবন শুরু করতে যাওয়া সব তরুণ তরুণীর জীবনেই একসময় আসে। অতএব আমি আমার মনস্থির করে ফেললাম–আর সেই সিদ্ধান্ত আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল । সেই থেকে গত পঁয়ত্রিশ বছর আমি জীবনে যে সুখ আর সমৃদ্ধির স্বাদ পেয়েছি তা আকাশকুসুম উচ্চাশারও বাইরে।
আমি যা ঠিক করলাম তা এই : যে কাজে ঘেন্না হয় সেটা আমি ছেড়ে দেব, আর যেহেতু মিসৌরির ওয়ারেনসবুর্গের স্টেট টিচার্স কলেজে চার বছর পড়াশুনা করেছি, তাই রাত্রে বয়স্কদের শিক্ষাদান করে আমার জীবিকা অর্জন করব। এরপর আমি সারাদিন বই পড়ার সময় পাবো, শিক্ষাক্রম তৈরি করব, উপন্যাস আর ছোট গল্প লিখব। আমি চাই লেখার জন্য বাঁচতে, আর লিখে বাঁচতে।
বয়স্কদের রাত্রিবেলায় কী বিষয় শেখাব? আমার কলেজজীবনের কথা চিন্তা করতেই মনে পড়ল আমি জনগণের সামনে বক্তৃতা দেয়ার যে শিক্ষা পেয়েছি আর অভিজ্ঞতা হয়েছে সে আমার কলেজ আর অন্যান্য শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি। কেন? কারণ ওই শিক্ষার ফলেই মানুষের সঙ্গে মেলামেশার পক্ষে আমি সাহস আর নিশ্চিন্ততা অর্জন করেছি, আমার ভীরুতা আর আত্মবিশ্বাসের অভাব দূর হয়ে গেছে।
স্বভাবতই আমি কলম্বিয়া আর নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতের ক্লাসে বক্তৃতা দেয়া শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে শিক্ষকপদে নিয়োগের আবেদন করি। তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটি জানাল তারা আমার সাহায্য ছাড়াই চালাতে পারবে।
তখন সত্যিই সত্যিই হতাশ হয়েছিলাম–তবে এখন আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে তারা আমাকে প্রত্যাখ্যান করে খুব উপকার করেছিলেন। কারণ আমি ওয়াই.এম.সি.–এর রাতের স্কুলে পড়ানো আরম্ভ করি, সেখানে আমার শিক্ষকতার দ্রুত আর হাতে হাতে ফল দেখাতে হতো। সেটা একটা পরীক্ষা বটে! ওই বয়স্করা আমার ক্লাসে কলেজী শিক্ষা আর সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে আসতেন না। তারা একটা কারণেই আসতেন : তাদের সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা করতে। তারা চাইতেন যোগ্যতা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হতে, যাতে কোন ব্যবসা সংক্রান্ত সভায় ভয়ে জ্ঞান না হারিয়ে দুটো কথা বলতে পারেন। সেলসম্যানরা চাইতেন কড়া ধাতের ক্রেতাদের সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলার সাহস, এবং যাতে ঘাবড়ে গিয়ে ওই বাড়ির চারপাশে বার তিনেক চক্কর না দিয়ে হয়। তারা চাইতেন দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস । তারা ব্যবসায় উন্নতি চাইতেন আর–চাইতেন পরিবারের সুখ সমৃদ্ধির জন্য আরও বেশি টাকা রোজগার করতে। আমার ছাত্ররা যেহেতু কিস্তিতে তাদের মাইনে দিতেন–ফল না পেলেই সেটা দিতেন বন্ধ করে–আর আমারও নিয়মিত মাইনের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না, ছিল কেবল লাভের কিছু অংশ, অতএম বাঁচার জন্যে আমাকেও শিক্ষাদানের সময় বক্তৃতার ব্যবহারিক দিকটা নিয়ে সতর্ক থাকতে হত।
সে–সময় আমার মনে হত খুব অসুবিধে নিয়ে শিক্ষকতা করছি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সে সময় আমি কি অমূল্য শিক্ষাই না পেয়েছি। আমায় ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতে হত, তাদের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে হতো। প্রতিটি শিক্ষক্রমে আমাকে এমন অনুপ্রেরণা দিতে হতো যাতে তারা আবার আসে।
কাজটা বেশ উত্তেজনারই ছিলো, আমিও ভালোবাসতাম । আমি দেখে তাজ্জব হয়ে যাই, ওই ব্যবসাদার ছাত্ররা কি দ্রুত আত্মবিশ্বাস লাভ করে কেউ কেউ আবার পদোন্নতি আর বাড়তি মাইনেও পেয়ে যায়। আমার শিক্ষকতায় অতি আশাবাদী মনোভাবের চেয়ে ঢের বেশি সাফল্য এল। তিনটে শিক্ষাক্রমের মধ্যে যে ওয়াই.এম.সি.এ আমাকে প্রতি রাতে পাঁচ ডলারের বেশি দিতে চায় নি তারাই আমায় দিতে শুরু করলো ত্রিশ ডলার করে। প্রথমে আমি জনগণের সামনে বক্তৃতা দেওয়া শেখাতাম, পরে বুঝলাম ওই বয়স্কদের শেখা দরকার প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ কীভাবে করতে হয়। যেহেতু মানবিক সম্পর্কের বিষয়ে কোন বই পেলাম না সেহেতু আমি নিজেই একখানা বই লিখবো ঠিক করলাম। সেটা লেখাও হল–তবে যেভাবে লেখা হয় সেভাবে নয়। বইখানা বেড়ে উঠল এই বয়স্কদের ক্লাসে আমার সব অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে। আমি এই বইয়ের নাম দিলাম ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’।