- বইয়ের নামঃ বক্তৃতা শিখবেন কীভাবে
- লেখকের নামঃ ডেল কার্নেগি
- প্রকাশনাঃ মেমোরী পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
বক্তৃতা শিখবেন কীভাবে
০১. সাহস আত্মবিশ্বাসের বিকাশ
বক্তৃতা শিখবেন কীভাবে
ডেল কার্নেগি
‘স্নায়বিক দুর্বলতা কাটিয়ে আত্মবিশ্বাস অর্জন তেমন কঠিন কাজ নয়। সহজে এই ক্ষমতা অর্জন করা যায়। কতিপয় ব্যক্তির প্রতি এটি খোদার বিশেষ দান। চেষ্টা করলে সকলেই এই ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।’–ডেল কার্নেগি
‘আত্মবিশ্বাস, সাহস আর জ্ঞানই হচ্ছে বক্তার প্রধান শক্তি।’–তপন রুদ্র
.
প্রসঙ্গ-কথা
অনেক বছর ধরে প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভের সঙ্গে ডেল কার্নেগির নাম সমভাবে পরিচিত। নোবেল বহির্ভূত বইয়ের মধ্যে ডেল কার্নেগির লেখা ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’ বইটি সব চাইতে বেশি বিক্রি হয়েছে এবং এই বইটি তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে, কিন্তু ‘প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’ তাঁর প্রথম বই নয়।
১৯২৬ সালে ডেল কার্নেগি একটি বই লেখেন। বইটির নাম বক্তৃতা শিক্ষা’ এটা পাবলিক স্পিকিং বা বক্তৃতা শেখার পাঠ্য বই। এবং আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে বক্তৃতা শেখা ও জন সংযোগ বিষয়ে এটি স্বীকৃত পাঠ্যবই। এটি ওয়াই.এম.সি.এ. পাবলিক স্পিকিং ক্লাসেও পড়ানো হত। বিগত দশ বছরে এই বইটির ৬,০০,০০০ কপি বিক্রি হয়েছে এবং মোট বিক্রির সংখ্যা এক কোটি কপিরও বেশি। এটি ২০টিরও বেশি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে তবে সাধারণ পাঠকেরা এই বই সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন।
ডেল কার্নেগি কোর্সের দর্শন আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দশ লাখেরও বেশি লোক এই কোর্সে গ্রাজুয়েশন লাভ করেছে। এই কোর্সে জনগণকে অধিকতর সাহসী করে তোলে, তাদের সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ডেল কার্নেগি কোর্সের ছাত্ররা এ বই থেকে যে উপকার পেয়েছে নতুন পাঠকেরাও অনুরূপ উপকার পাবে আমার বিশ্বাস।
ডরোথি কার্নেগি
.
০১. সাহস আত্মবিশ্বাসের বিকাশ
১৯১২ সাল থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি নারী পুরুষ সাধারণ ভাষণ কোর্সে অংশ নিয়ে আমার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, তারা কেন এই প্রশিক্ষণে অংশ নেন এবং এটা হতে তারা কী পেতে চান। স্বাভাবিক ভাবে তাদের মতামত ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু এসব মতামতের মূল বিষয়, সংখ্যা গরিষ্ঠের মূল আকাক্ষা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় এক।”যখন আমাকে কোনো কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানানো হয় ব্যক্তির পর ব্যক্তি লিখেছেন, “আমি এত ভীত, আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ি যে কোনো কিছুই পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারি না, কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারি না, স্মরণ করতে পারি না আমি কী বলতে ইচ্ছুক। আমি আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে চাই, আমি চাই চিন্তার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভশীল হতে, সুস্থির হতে। আমি আমার সমস্ত চিন্তাকে যুক্তি সম্মত পদ্ধতিতে ধারাবাহিক ভাবে পেতে চাই আর আমি চাই ব্যবসায়ীদের সমাবেশ, ক্লাব সদস্যদের বৈঠক অথবা অন্য যে কোনো শ্ৰোতৃমণ্ডলীর সামনে আমার সমস্ত যুক্তি পরিষ্কার ও সুষ্ঠুভাবে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে তুলে ধরে শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে ও স্বমতে আনতে।” হাজার-হাজার লোকের মনের কথা এরূপ ভাবেই প্রতিধ্বনিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
একটি বাস্তব উদাহরণ উল্লেখ করছি; কয়েক বছর আগে মি. ডি. ডব্লিউ. গেস্ট নামে পরিচিত এক ব্যক্তি ফিলাডেলফিয়ায় আমার সাধারণ ভাষণ কোর্সে যোগদান করেন। উদ্বোধনীর স্বল্পকাল পর তিনি আমাকে ম্যানুফাঁকচারদের ক্লাবে তার সাথে মধ্যাহ্ন ভোজ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। তিনি ছিলেন মধ্যবয়সী ও কর্মব্যস্ত লোক। তিনি ছিলেন তার উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং গির্জাও সমাজসেবামূলক কাজের স্থানীয় নেতা। ঐ দিন আমরা খেতে বসলে তিনি ঝুঁকে পড়ে বলেন, “বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভায় আমার প্রতি বক্তৃতা করতে অনুরোধ জানানো হয়ে থাকে, কিন্তু কখনো আমি তা করতে পারি না। এরূপ আহ্বানে আমার মন শূন্য হয়ে যায়, আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি। তাই আমি জীবনে কখনো বক্তৃতা করতে পারি নি। কিন্তু আমি এখন একটা কলেজের স্ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। বোর্ডের সভায় আমাকে সভাপতিত্ব করতে হবে। সুতরাং আমাকে কিছু বলতেও হবে। আপনি কি মনে করেন, আমার জীবনের এ সময়ে আমার বক্তৃতা শেখা সম্ভব?”
“আমি তাই মনে করি, মি. গেস্ট।” আমি উত্তর দিলাম, “এটা আমার কল্পনা নয়। আমি জানি আপনি পারবেন এবং আমি বিশ্বাস করি, নির্দেশ সঠিক অনুসরণে কাজ করলে আপনি সফল হবেন।”
তিনি এ কথা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলেন। তবে তার কাছে এটা অতি বেশি আশা করা বলে মনে হল।”আপনি আমার প্রতি অত্যন্ত সদয়” বললেন তিনি, “তাই আপনি আমাকে উৎসাহিত করতে চাচ্ছেন?”
তাঁর প্রশিক্ষণ শেষ হবার পর কিছু কাল আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। পরে আমাদের দেখা হয় এবং আমরা ম্যানুফ্যাকচারার ক্লাবে মধ্যাহ্ন ভোজ গ্রহণ করি। প্রথম দিনের মতো সেদিনও আমরা এক কোণার একটি টেবিল দখল করে বসি। আমাদের পূর্ব কথোপকথনের উল্লেখ করে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার বিশ্বাস সত্য হয়েছে কিনা। তিনি তাঁর পকেট হতে লাল কভার দেওয়া একটি নোট বই বের করে তাতে বিভিন্ন সভায় তার বক্তৃতা করার তারিখ সহ একটা তালিকা দেখালেন। এ সব সভায় তাঁকে বক্তৃতা করতে হবে।”আমি এখন বক্তৃতা করার ক্ষমতা অর্জন করেছি” তিনি স্বীকার করলেন, “এটা করতে আমি আনন্দ পাই, সমাজ সেবামূলক কাজে অংশ নিতে পারি এবং এটা হচ্ছে আমার জীবনের বিশেষ কাজ।”
ঐ সময়ের কিছু আগে ওয়াশিংটনে নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী এই সম্মেলনে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হলে ফিলাডেলফিয়ার যাজক সম্প্রদায় ঐ শহরে একটি জনসভায় ভাষণ দিতে তার প্রতি আমন্ত্রণ জানান। এবং মি. গেস্ট আমাকে জানান, শহরের যাজকেরা ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁকে নির্বাচন করেন। এবং তিনি ঐ ব্যক্তি যিনি তিন বছরের কিছু কম সময় আগে একই টেবিলে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কখনো বক্তা হতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি কিনা।
তার বক্তৃতা করার দ্রুত এই ক্ষমতা লাভ কি অস্বাভাবিক? মোটেই না। এ ধরণের শত শত প্রমাণ আছে। উদাহরণ স্বরূপ-আরো একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। বহু বছর আগে ড. কার্টিস নামে ব্রুকলিনের একজন চিকিৎসক এক শীত মৌসুমে ফ্লোরিডায় গিয়েছিলেন। তার বাসস্থান ছিল ব্যাটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছে। তিনি ব্যাটবল এর একজন বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ফলে তিনি প্রায়ই যেতেন প্রশিক্ষণ দেখতে? নিয়মিত যাতায়াতের দরুণ তিনি হয়ে পড়েছিলেন সদস্যদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে তারা একদিন তাকে তাদের সম্মানে আয়াজিত এক ভোজে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানায়।
কফি ও বাদাম পরিবেশনের পর বহু সংখ্যক গণ্যমান্য অতিথির প্রতি কিছু বলার জন্য অনুরোধ জানান হয়। হঠাৎ শোনা গেল, সভাপতি বলছেন, আজ রাতে আমরা একজন চিকিৎসককে আমাদের মাঝে পেয়েছি। এবং আমি এখানে ডা. কার্টিসকে একজন ব্যাটবল খেলোয়াড়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু বলতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
তিনি কি প্রস্তুত ছিলেন? অবশ্যই তিনি স্বাস্থ্য বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন এবং প্রায় শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ সময় ধরে তার ডানে বায়ে বসা রোগীর কাছে তার বিষয়ে বক্তৃতা করতে পারেন, বলতে পারনে। কিন্তু দর্শকদের সামনে, সংখ্যা যত সীমিতই হোক, দাঁড়িয়ে একই বিষয়ে বলা অন্য জিনিস। এটা বোধ শক্তি রহিত করার মতো ঘটনা। এই ঘোষণার ফলে ডাক্তার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং হত্যন্ত্রের ক্রিয়া দ্রুততর হয়ে উঠে। তিনি জীবনে কখনো কোনো সভায় বক্তৃতা করেন নি! এ সময় তার মনে হতে লাগলো, তিনি যেন সব কিছু বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছেন, তার দেহে গজাচ্ছে পাখা।
উপস্থিত শ্রোতারা যত তালি দিয়ে এই ঘোষণাকে অভ্যর্থনা জানায়। সবাই তখন তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন তিনি কী করেন? তিনি মাথা নাড়েন। এটাকে সম্মতি মনে করে শ্রোতারা আনন্দিত হয়ে হাততালি দিতে থাকে। সবাই চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন। ”ডা. কার্টিস, বলুন, বলুন।”
তিনি অত্যন্ত বেকায়দায় পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন, তিনি কিছু বলতে চেষ্টা করলে ব্যর্থ হবেন। অর্ধডজন বাক্যও তিনি পুরোপুরি ব্যক্ত করতে পারবেন না। সুতরাং তিনি উঠে দাঁড়ান এবং একটি শব্দও উচ্চারণ না করে বন্ধুদের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হৃদয়ে ধীরে-ধীরে কক্ষ ত্যাগ করেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ব্রুকলিনে ফিরে তিনি সর্ব প্রথম সাধারণ ভাষণ কোর্সে ভর্তি হন। এটিই হয় তার প্রথম কাজ। দ্বিতীয় বার যাতে তাকে এরূপ ভাবে বোকা বনতে না হয় সে উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এই কোর্সে ভর্তি হন।
তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছাত্র হিসাবে শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি কথা বলতে শেখার জন্যই এই কোর্সে অংশ নেন এবং তার আগ্রহে কোনোরূপ কমতি ছিল না। তিনি নিয়মিতভাবে তার পাঠ শিখতেন, অভ্যাস করতেন এবং কখনো ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন না।
লেখা পড়ায় তিনি এতো অধিক অগ্রগতি সাধন করলেন যে তিনি নিজেও বিস্মিত হল, কেননা, তিনি তাঁর লক্ষ্যমাত্রাও অতিক্রম করে গেলেন। কয়েক সেসনের পর তার স্নায়ুবিক দুর্বলতা দূর হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস দ্রুত বাড়তে থাকে! দু’মাসেই মধ্যেই তিনি তার গ্রুপের শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়ে উঠেন। অতঃপর তিনি যত্রযত্র বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে শুরু করেন। বক্তৃতা করা তার কাছে প্রিয় কাজ হয়ে ওঠে, ফলে তিনি নতুন-নতুন বন্ধু পেতে থাকেন।
রিপাবলিকান পার্টির নিউইয়র্ক নগর কমিটির জনৈক সদস্য একবার তার বক্তৃতা শুনে দলীয় নির্বাচনী প্রচারণার কাজে অংশ নেয়ার জন্য ডা. কাটির্সের প্রতি আমন্ত্রণ জানান। মাত্র এক বছর আগে যে ব্যক্তি বক্তৃতা করতে ব্যর্থ হয়ে ভয়ে, দুঃখে ও লজ্জায় একটি ভোজ সভা ত্যাগ করেছিলেন তিনি এখন হয়ে পড়েন রাজনৈতিক বক্তা।
আত্মবিশ্বাস ও সাহস এবং জনসমক্ষে কথা বলার সময় শান্ত ও স্বচ্ছভাবে চিন্তা করার যোগ্যতা অর্জন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধারণা, এ ঘটনা প্রমাণ করে যে আসলে সে ধারণা স্বাভাবিক অবস্থা নয়। এটা শুধু মাত্র কতিপয় ব্যক্তির প্রতি স্বর্গীয় অবদান বা ভগবানের দান নয়। এটা গলফ খেলার মতো যোগ্যতা অর্জনের ব্যাপার। যে কোনো ব্যক্তিই ইচ্ছা করলে চর্চার মাধ্যমে এই যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম।
আপনি যখন বসে থাকেন তখন যে ভাবে চিন্তা করতে পারেন, ঠিক সেভাবে শ্রোতাদের সামনে দাঁড়িয়ে একই রূপ চিন্তা করতে না পারার কোনো কারণ আছে কি? নিশ্চয়ই আপনার জানা উচিত যে এ রূপ কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে আপনি যখন জনসমক্ষে দাঁড়ান তখন আপনার চিন্তাধারা আরো স্পষ্ট হওয়া উচিত। শ্রোতাদের উপস্থিতি আপনাকে করবে অনুপ্রাণিত উৎসাহিত। অধিকাংশ বক্তার মত হচ্ছে এই যে, শ্রোতামণ্ডলীর উপস্থিতিতে তাঁদের অনুপ্রাণিত করে এবং তাঁদের মস্তিস্ক অধিকতর পরিষ্কার ও স্পষ্ট ভাবে কাজ করে। হেনরি ওয়ার্ড বেসার বলেছেন, “ধূম উদগীরণের মতো এমন সব তত্ত্ব-তথ্য ঘটনা মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয় যা জানবার কথা বক্তা নিজেও কখনো কল্পনা করে নি।” এ সব কথা নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবেই বক্তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। আপনি যদি চর্চা করেন এবং ইচ্ছুক হন তা হলে আপনার পক্ষেও এরূপ যোগ্যতা অর্জন সম্ভব।
যা হোক আপনার সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, প্রশিক্ষণ চর্চা আপনার শ্রোতা ভীতি দূর করবে এবং আপনার মনে আত্মবিশ্বাস ও অদম্য সাহস যোগাবে।
বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে কষ্টকর বলে চিন্তা করবেন না। যে সব ব্যক্তি কালে খ্যাতনামা বক্তা হিসাবে পরিচিত হয়ে ছিলেন তারাও তাদের জীবনের প্রথম দিকে এই ভীতি ও আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে মুক্ত ছিলেন না।
খ্যাতনামা বক্তা উইলিয়াম জেনিং ব্লায়ান স্বীকার করছেন যে প্রথম দিন বক্তৃতা করার চেষ্টা করলে কম্পনের ফলে তাঁর হাটুদ্বয় জোড়া লেগে গিয়েছিল।
মার্ক টোয়েন প্রথম দিন বক্তৃতা করতে উঠে অনুভব করেন যে, তাঁর মুখ গহ্বর তুলা দিয়ে পরিপূর্ণ এবং তার নাড়ির স্পন্দন অস্বাভাবিক রূপে বেড়ে চলেছে।
বিসমার্ক ছিলেন তাঁর সময়ের একজন দক্ষ শ্রেষ্ঠতম সেনাপতি কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি যখন জন সমক্ষে বক্তৃতা করতে চেষ্টা করতেন তখন তিনি অত্যন্ত বেকাদায় পড়তেন।
জীন জুরিস ছিলেন তাঁর সময়ের ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক বক্তা। কিন্তু ডেপুটিদের চেম্বারে তিনি একটি বছর বোবার মতো বসে কাটিয়েছেন। অতঃপর তিনি চেষ্টা করেন মুখ খুলতে।
লয়েড জর্জ স্বীকার করেছেন, প্রথমদিন আমি যখন জন সমক্ষে বক্তৃতা করার চেষ্টা করি আমি অত্যন্ত দুঃখে পতিত হই। সত্যি কথা বলতে কী আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারি নি। কেননা আমার মুখ শুকিয়ে যায়, জিহ্বা মুখ গহ্বরের সাথে লেপটে যায় এবং কোনো শব্দই নিঃসৃত হয় না আমার মুখ থেকে।
গৃহযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের পক্ষ সমর্থক খ্যাতনামা ইংরেজ বক্তা জন ব্রাইট তাঁর প্রথম বক্তৃতা করেন একটি স্কুলে সমবেত একদল অশিক্ষিত জনতার সামনে যেখানে যাত্রা পথে এত ভীত, এত চিন্তিত এবং রুষ্ট হয়ে পড়েন সে সহগামীদের তিনি বলেন, ‘বক্তৃতাকালে আমি যখন অসুবিধায় পড়ব তখন আমি নির্দেশ দেখালে তোমরা হাততালি দিও–।’
খ্যাতনামা আইরিশ নেতা চালের্স স্টাটি পারলেন প্রথম জীবনে বক্তৃতা দান কালে এতই ভীত-সন্ত্রস্থ ও বিমুঢ় হয়ে পড়তেন যে, তিনি অনেক সময়, নখ দিয়ে চিমটি কেটে নিজের মাংস ছিঁড়ে রক্ত বের করে ফেলতেন। এই তথ্য প্রকাশ করেছেন তার ভাই।
ডিজরেলি স্বীকার করেছেন যে, হাউস অব কমন্সে প্রথম দিন বক্তৃতা কালে তার মনে হয়েছিল, বক্তৃতা করার চাইতে সৈন্য বাহিনী পরিচালনা করা অনেক সহজ। প্রথমদিন তিনি পারেন নি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে। এই অবস্থা হয়েছিল লেরিভনেরও।
ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বক্তাদের অনেকেই প্রথমদিন বক্তৃতা করতে গিয়ে হয়েছিলেন ব্যর্থ। আজকের পার্লামেন্টে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, তরুণের বক্তৃতাই তার ভবিষ্যৎ জীবনের পুর্বাভাস। সুতরাং বক্তৃতা শিখতে হলে বা বক্তা হতে হলে প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের? বহু সংখ্যক খ্যাতনামা বক্তার জীবনী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করে গ্রন্থকার এটা উপলব্ধি করেছেন যে, যে ছাত্র প্রথমে যত বেশি ঘাবড়ান তাঁর পক্ষে সাফল্য লাভ করা তত বেশি সহজতর।
শুধুমাত্র দু’ডজন লোকের সামনে পেশকরার উদ্দেশ্যে হলেও বক্তৃতা প্রণয়নে কতিপয় নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে চলা প্রয়োজন। কেননা বক্তব্য তৈরিতে বিশেষ চাপ ও বিশেষ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কারণ বক্তা যা কিছু বলবেন তা বলতে হবে তাকে সরাসরি ও সুষ্পষ্টভাবে। অমর সিত্ৰারো দু’হাজার বছর আগে বলে গেছেন, প্রকৃত অর্থবহ সকল সাধারণ বাচন ওদের মুখ দিয়েই নিঃসৃত হয়েছে, যারা কখনো স্নায়বিক দুর্বলতায় আক্রান্ত হন নি।
বেতারে কথিকা পেশকালেও বক্তারা প্রায় একই অনুভূতির স্বীকার হয়। এটাকে বলা হয় মাইক্রোফোন-ভীতি। চার্লি চাপলিন একদা লিখিত বক্তব্য নিয়ে বেতারে পেশ করতেন। এখন তিনি দর্শক, শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ নাইট-ইন এ মিউজিক হল খ্যাত ইংল্যান্ডের মঞ্চাভিনেতা তিনি এখন। এতদসত্ত্বেও নেতার ভাষণের সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করে তিনি তখন তলপেটে এরূপ যন্ত্রণা অনুভব করেন যে, সে রূপ যন্ত্রণা ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ঝড়ের সময় আটলান্টিক অতিক্রম কালে সাধারণত অনুভূত হয়।
খ্যাতনামা চলচ্ছিত্রাভিনেতা ও পরিচালক জেমস ঝিকউডও অনুরূপ অভিজ্ঞতার অধিকারী। মঞ্চ হতে তিনি জনশূন্য ময়দানের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে অভ্যস্ত, কিন্তু মঞ্চ হতে নেমে তিনি হয়ে পড়তেন বিচলিত। প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা করার চাইতে শক্ত কাজ আর নেই, তিনি মন্তব্য করেন।
কিছু লোক যারা সবসময় বকবক করেন, তাঁরা মনে করেন যে, তাঁরা জনসমক্ষে বক্তৃতা করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে বক্তৃতা করতে দিলে তারা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে যান।
এমনকি লিংকনও প্রথম কয়েক মুহূর্ত লজ্জানুভব করতেন। তাঁর কৌশলী বন্ধু হার্ডন বলেছেন, ‘প্রথমে তিনি হয়ে পড়তেন হতবুদ্ধি, মনে হত তিনি যেন কঠোর পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত! তবে তিনি চেষ্টার ফলে অবস্থা কাটিয়ে উঠতেন এবং বেঢপ অবস্থা হতে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন। আমি প্রায়ই এটা অবলোকন করতাম এবং আমার সহানুভূতি জাগত লিংকন এর প্রতি। যখন তিনি বক্তৃতা শুরু করতেন, তখন তার আওয়াজ অস্পষ্ট হতে স্পষ্ট হত, নিম্ন হতে উচ্চ পর্যায়ে উঠত। অপ্রতিভ ভাব আস্তে-আস্তে হত দুরীভূত। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা নিজের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হতেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর অপ্রতিভ ভাব সম্পূর্ণ দূর হয়ে যেত, এবং তিনি হয়ে পড়তেন একজন দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তি ও সুবক্তা।
আপনার অভিজ্ঞতাও তার মতো হতে পারে।
আপনি যদি একজন জনপ্রিয় বক্তা হতে চান, যদি চান দ্রুত একজন সুবক্তা হতে, তাহলে আপনাকে চারটি অতি প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে :
প্রথমত : অটল বাসনা নিয়ে দৃঢ়তার সাথে যাত্রা শুরু করুন।
আপনি যা অনুভব করেন এটা তার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো শিক্ষক আপনার মন ও হৃদয় পরীক্ষা করেন, তিনি আপনার আকাক্ষা সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে সক্ষম হন এবং এটা তাঁর পক্ষে পূর্বাহ্নেই বলে দেয়া সম্ভব। তা হলে সতোর সাথে আপনি সাফল্য অর্জন করতে পারতেন। যদি আপনার আকাক্ষা হয় নিস্ক্রীয় ও নির্জীব, তবে আপনার সাফল্যও হবে সে রূপ মন্থর। কিন্তু আপনি যদি অধ্যবসায়ের সাথে আপনার বিষয় অনুসরণ করেন, বুলডগ যেভাবে বিড়ালকে তাড়ায় ঠিক সেভাবে চল তা হলে কোনো বাধাই আপনাকে পরাভূত করতে পারবে না।
সুতরাং এই শিক্ষার জন্যে আত্মসচেতন হয়ে উঠুন। এর শুভফল গ্রহণ করুন। মানুষকে স্বমতে আনতে হলে বক্তব্য পেশে কিরূপ আত্মবিশ্বাস ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে সে সম্পর্কে চিন্তা করুন। ডলার ও সেন্টে এর কত মূল্য হতে পারে তা চিন্তা করুন। সামাজিক ভাবে এর মর্যাদা কী, বন্ধুদের কাছে এর দাম কী, ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তারের এর মূল্য কী, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এর থেকে আপনি কী পাবেন সে সম্পর্কে চিন্তা করুন। এটা আপনাকে আপনার চিন্তা কল্পনা হতে অধিকতর দ্রুত গতিতে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করবে।
চাউন্সে এস্ ডেপু বলেছেন, বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষকে স্বমতে আনার চাইতে বড় কোনো শক্তি, ব্যক্তির জীবন গঠনে তার ক্ষমতা সম্পর্কে স্বীকৃতি আদায়ে, সহায়ক হতে পারে না। কেননা এই শক্তিই যে কোনো ব্যক্তিকে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত করে।
লাখ লাখ লোকের হৃদয় জয় করার পর ফিলিপ ডি. আমায় বলেছেন, আমি বড় পুঁজিপতির চাইতেও বড় বক্তা।
প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তিই মনে-মনে বক্তৃতা করার ক্ষমতা অর্জনের আশা পোষণ করেন। ডেল কার্নেগীর মৃত্যুর পর প্রাপ্ত কাগজ পত্রের মধ্যে তার নিজস্ব জীবনের একটি পরিকল্পনা পাওয়া গিয়েছিল। এই পরিকল্পনাটি তিনি প্রণয়ন করেছিলেন তার ২৩ বছর বয়সে। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন আর দু’বছরের মধ্যে তার ব্যবসাকে এমন ভাবে সম্প্রসারিত করা হবে যাতে তার বার্ষিক আয় হয় ৫০ হাজার এবং ৩০ বছর বয়সে তিনি অবসর নিয়ে অক্সফোর্ডএ গিয়ে অধ্যয়ন করবেন, বিশেষ করে তিনি সাধারণ ভাষণ বা জনসমক্ষে বক্তৃতা করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবেন।
এই শক্তি অর্থাৎ বক্তৃতা দিয়ে মোহিত করার শক্তি কতটুকু সন্তুষ্ট করে এবং আনন্দ দান করে তা চিন্তা করার বিষয়। লেখক এই বিশ্বের প্রায় সব এলাকা সফর করেছেন এবং বহুমুখী অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ নিয়েছেন। কিন্তু যে অভিজ্ঞতা তাকে সব চাইতে বেশি সন্তোষ বিধান করেছে তা হচ্ছে বক্তৃতা করার শক্তি। আপনি বক্তৃতা করবেন আর শ্রোতারা আপনার বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করবে, চিন্তা করবে আপনার কথা। এই শক্তি আপনার মনকে দৃঢ় প্রত্যয়ী করবে আর আপনি হবেন ক্ষমতার অধিকারী। এই শক্তি অর্জনে সক্ষম হলে আপনি হবেন সমাজে গৌরবান্বিত ব্যক্তি আর আপনার মর্যাদা হবে সমসমাজের সবার উপরে। বই শক্তির মধ্যে যেন জাদু আছে যা আপনাকে সব সময় প্রাণচঞ্চল করে রাখবে। বক্তৃতা শুরু করার দুমিনিট আগে আমি, একজন বক্তা স্বীকার করেছেন “চিন্তা করে নিই গভীর ভাবে এবং শুরু করি সাবলীল ভাষায়, কিন্তু শেষ করার দু’মিনিট আগে আমি আস্তে-আস্তে গতি কমিয়ে দিই ও শেষ করি।”
যে কোনো কাজে যে ব্যক্তি মতি স্থির করতে পারে না সে অর্ধপথে পথ হারিয়ে ফেলে। সুতরাং যে কোনো কাজে সফল হতে লক্ষ্য স্থির করে যাত্রা শুরু করতে হবে এবং লক্ষ্যস্থল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে স্থির মস্তিষ্কে এগুতে হবে। গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ শুরু করলে বাধাবিপত্তি সত্বেও আপনি আপনার লক্ষ্যস্থলে উপনীত হতে সক্ষম হবেন। চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে আপনি পৌঁছবেন আপনার লক্ষ্যে। স্বল্প কথায় আপনার লক্ষ্য স্থলে পৌঁছতে হলে সে পথকে মনে করতে হবে সহজ। অর্থাৎ আপনি যা করেছেন তাই হচ্ছে সহজ কাজ, এ কথা মনে করলে সহজে এগুনো যাবে, পশ্চাদপসরণের প্রয়োজন হবে না।
জুলিয়াস কায়জার তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে গল প্রণালী অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে পৌঁছে কী করেন? কীভাবে তার বাহিনীর বিজয় নিশ্চিত করেন? তিনি অত্যন্ত চালাকীর কাজ করেন, তিনি তার বাহিনীকে ডোবার তীরে অবতরণ করিয়ে সমস্ত জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেন। সৈনিকেরা দেখতে পায় যে সব জাহাজে তারা এসেছিল সে সব জাহাজ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখান হতে দেশে ফিরে যাবার তাদের আর কোনো পথ নেই। শত্রুর দেশে বেঁচে থাকতে হলে তাদের এগিয়ে যেতে হবে, জয়লাভ করতে হবে। তারা অতঃপর সে কাজেই করে সাফল্যের সাথে।
জয়ের এরূপ আকাঙ্ক্ষাই ছিল কায়জারের মনে। শ্রোতা ভীতি দূর করার জন্য কেন আপনি অনুরূপ মনোভার গ্রহণ করবেন না।
দ্বিতীয়ত : আপনি যে বিষয়ে বলবেন সে বিষয়টি ভালোভাবে জেনে নিন। কোনো ব্যক্তি তার বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা ও পরিকল্পনা না করলে এবং তিনি কী বলবেন তা না জানলে শ্রোতাদের সামনে বক্তব্য পেশ কালে তিনি সহজ ও স্বাভাবিক হতে পারবেন না, তার কাজ হবে একজন অন্ধ কর্তৃক আর একজন অন্ধকে পরিচালনা করার মতো। এই অবস্থায় বক্তাকে হতে হবে আত্মসচেতন। নতুবা তাকে অনুতাপ করতে হবে, পড়তে হবে লজ্জায়।
”১৮৮১ সালের শেষের দিকে আমি আইন পরিষদে নির্বাচিত হই” টেড কেনেডী লিখেছেন তার আত্মজীবনীতে, “এবং আমি নিজেকে তখন পরিষদের সর্ব কনিষ্ট সদস্য রূপে দেখতে পাই। অন্যান্য সকল তরুণ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো আমি তখন বক্তৃতাতে বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হই। কিন্তু একজন গ্রাম্য বৃদ্ধ ব্যক্তি, যিনি অত্যন্ত সহজ ভাষায় কথা বলতেন, ওয়েলিংটনের মতো এক কথা বারবার বলে মনের ভাব প্রকাশ করতেন, তিনি আমাকে বলেন, তোমার কথা বলা প্রয়োজন এ কথা নিশ্চিত হবার আগে মুখ খুলো না। যখন কথা বলার প্রয়োজন হবে তখন চিন্তা করে নিও, তুমি যে সম্পর্কে বলবে তা তোমার জানা কিনা, যদি নিশ্চিত হও তখন তুমি তোমার বক্তব্য সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাবে পেশ করে বসে পড়বে।”
এই বৃদ্ধ গ্রাম্য লোকটি রুজভেল্টকেও তাঁর স্নায়ুবিক দুর্বলতা হতে মুক্ত হবার পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি আমাকে আরো বলেছিলেন, “শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা করার সময় যদি তুমি কিছু দেখাতে পার, ব্লাক বোর্ড বা অন্যত্র কোনো কিছু লিখতে পার, অথবা মানচিত্রে কোনো স্থান নির্দেশ করতে পার, বই পুস্তক, কাগজ পত্র নাড়া চাড়া করতে পার, হাত পা নেড়ে বক্তব্য বিষয় উপস্থাপন করতে পার, তবে তুমি ফাঁকে-ফাঁকে চিন্তা করার সময় পাবে। বক্তব্য সহজতর হবে এবং মনেও তুমি গৃহের পরিবেশ অনুভব করবে।”
এটা সত্য যে, বক্তৃতা কালে সব সময় এরূপ প্রদর্শনী বা অঙ্গ ভঙ্গির সুযোগ হয় না। কিন্তু কখনো কখনো এরূপ সুযোগ আসে। যদি সুযোগ পান এরূপ করবেন। তবে তা করবেন বক্তৃতার প্রাথমিক সময়ে। কেননা শিশু একবার হাঁটতে শিখলে আর সে কোনো কিছুকে অবলম্বন করে হাঁটে না। হাঁটতে চায় না।
তৃতীয়ত : দৃঢ় বিশ্বাস
আমেরিকার খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক উইলিয়ম জেমস লিখেছেন :
যে কোনো কাজের পর জাগে অনুভুতি। কিন্তু বাস্তবে কাজ ও অনুভুতি এক সাথেই চলে। ইচ্ছাশক্তি কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং তদ্বারা আমরা অনুভূতি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
সুতরাং মনে আনন্দ সৃষ্টির সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে এমন কাজ এবং এমনভাবে করা যাতে মনে আনন্দের আবেগ সৃষ্টি হয়, আনন্দ হয়। একবার চেষ্টায় মনে এ আনন্দ আনা না গেলে বারবার চেষ্টা করতে হবে।
অনুরূপ ভাবে, নিজেকে সাহসী বলে ভাবতে হলে যে কোনো কাজ সাহসিকতার সাথে করতে হবে। এই কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করুন, দেখবেন আস্তে-আস্তে ভয় দূরীভূত হয়ে গেছে, সাহস এসেছে মনে।
সাধারণ্যে বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে আপনি অধ্যাপক জেমস এর উপদেশ অনুসরণে কাজ করুন, ভাবুন এটি শ্রোতাদের সামনে আপনার প্রথম দিন নয়। অবশ্যই আপনি যদি প্রস্তুত না থাকেন তবে আপনি পুরোপুরি সফল হবেন না। আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে, শ্রোতাদের সামনে আপনি কী বলতে যাচ্ছেন। বক্তৃতা শুরু করার আগে আপনি দীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করুন। ফুসফুঁসে অধিক অম্লজান আপনাকে অধিক শক্তি জোগাবেও সাহস জোগাবে। জীন ডি রেস্কী সব সময় বলতেন, আপনি দীর্ঘশ্বাস নিন, তা হলে আপনার শক্তি ও সাহস বাড়বে।
সর্বযুগে, সকল দেশে, মানুষ সব সময় সাহসের প্রশংসা করেছে। সুতরাং মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনাকে এমনভাবে বক্তব্য পেশ করতে হবে যাতে শ্রোতারা মনে করে, আপনি যা করছেন তা করছেন দৃঢ় বিশ্বাস ও সাহসিকতার সাথে। প্রমাণ করতে হবে আপনি সাহসী।
শ্রোতাদের চোখে-চোখে সরাসরি তাকিয়ে আপনি এমনভাবে বক্তব্য পেশ করতে শুরু করুন, যেন সকল শ্রোতাই আপনার খাতক। তারা সবাই ঋণী, ধরে নিন যে ঋণের মেয়াদ বাড়াবার আবেদন জানাবার জন্যেই তারা আপনার সামনে সমবেত হয়েছে। এই মনস্তাত্বিক চিন্তার ফল আপনার জন্যে হবে কল্যাণকর।
কোনো অবস্থাতেই ঘাবড়াবেন না। যদি মনে ভীতির সঞ্চার হয়, মন চঞ্চল হয়ে উঠে, শরীরে জাগে কম্পন, তা হলে এটা শ্রোতাও দর্শকদের কাছে গোপন করার জন্যে, আপনার দুটি হাতকে পিছনে নিয়ে যান। একহাতে অন্য হাত ঘর্ষণ করুন, পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে মঞ্চে ঘর্ষণের চেষ্টা করুন, তা হলে শক্তি ফিরে পাবেন।
কোনো আসবারপত্রের পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে বক্তৃতা করা খারাপ। কিন্তু প্রথম দিকে এরূপভাবে বক্তৃতা করার চেষ্টা আপনাকে সাহস যোগাবে। আপনাকে বক্তৃতা করায় অভ্যস্ত করে তুলবে।
টেডী রুজভেল্ট কীভাবে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন? তিনি কি প্রকৃতি হতে বিশেষ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন? মোটেই না, “আমি ছিলাম রুগ্ণ ও দুর্বল,” তিনি তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন। যৌবনে আমি স্নায়বিক দৌর্বল্য হতে মুক্ত ছিলাম না। আমার সুস্থ, মন উৎফুল্ল করার জন্য আমাকে করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম।
সৌভাগ্যের বিষয় যে, তিনি কী পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন তা আমাদের বলেছেন। ”যখন বালক ছিলাম” তিনি লিখেছেন, মেরিয়টের বইতে আমি একটি নিবদ্ধ পাঠ করি, যা আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করতো। এই নিবন্ধে ব্রিটিশ নৌ বাহিনীর জনৈক সাহসী ক্যাপটেনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি কীভাবে তার বাহিনীকে সাহসী ও ভীতি মুক্ত করে তুলে ছিলেন। তিনি বলেছেন, কাজের প্রারম্ভে সকল মানুষই ভয় করে, ইতস্তত করে। কিন্তু কাজে সফল হতে হলে কর্তাকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন ভয় কাকে বলে তা তিনি জানেন না। এরূপ মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করলে সকল মানুষই ভীতিমুক্ত হতে পারে। কেননা ভয় অনুভব না করলে ভীতি দূর হয়ে যেতে বাধ্য হয়।
আমি এই তত্ত্বই অনুসরণ করেছি। প্রথমে আমি যে কোনো কাজেই ভয় পেতাম কিন্তু সেদিন হতে আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমি ভীত নই, ভীতি আমার মন হতে আস্তে-আস্তে দূর হয়ে গেল। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভীতি মুক্ত হওয়া সম্ভব।
ইচ্ছা করলে আপনিও এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। ‘যুদ্ধ’ বলেছেন মার্শাল ফেচ ”প্রতিরক্ষার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে আক্রমণ।” সুতরাং আপনার ভীতির বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করুন, প্রতিরোধের চেষ্টা করুন, সগ্রাম করুন, দৃঢ়তার সাথে তা জয় করার চেষ্টা করুন, সাফল্য অনিবার্য।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভীত হবেন না। বলতে যখন দাঁড়িয়েছেন, বলতে আপনাকে হবেই। আপনি বলবেন, সুতরাং এমনভাবে বলার চেষ্টা করুন যাতে শ্রোতারা বুঝতে না পারে, আপনি ঐ বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করুন। যা বলবেন তা দৃঢ়তার সাথে স্বচ্ছন্দ ভাষায় প্রকাশ করুন, তাহলে শ্রোতারা মুগ্ধ হবে, আপনি জয়ী হবেন।
চতুর্থত: অভ্যাস, অভ্যাস আর অভ্যাস :
এ ক্ষেত্রে আমরা সর্বশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করছি তা হচ্ছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এ পর্যন্ত আপনি যা পড়েছেন তা সম্পূর্ণ ভুলে গেলেও স্মরণ হবেই। বক্তৃতায় আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির উপায় হচ্ছে বলা, বলার অভ্যাস করা। এর অর্থ হচ্ছে যে কোনো কিছু সঠিক ভাবে করতে হলে প্রয়োজন অভ্যাস, অভ্যাস আর অভ্যাস। এটিই সাফল্যের পূর্ব শর্ত।
”যে কোনো প্রাথমিক শিক্ষার্থী জড়তায় আক্রান্ত হতে বাধ্য,“ বলেছেন রুজভেল্ট। এই জড়তা হচ্ছে স্নায়বিক দুর্বলতা প্রসূত। এই জড়তার আক্রমণে যে কোনো মানুষই বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে বিফল হতে পারে। শুধু প্রথম দিন নয়, এই জড়তা কাটাবার চেষ্টা না করলে বারবার এ অবস্থান সৃষ্টি হতে পারে। এই রূপ ক্ষেত্রে বক্তৃার যা প্রয়োজন তা হল সাহস নয়, স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং স্থির। মস্তিষ্কে চিন্তা করা। এটা করা অর্থাৎ স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ ও স্থির মস্কিষ্কে চিন্তা করা নির্ভর করছে প্রচেষ্টা ও অভ্যাসের উপরে। ইচ্ছা এবং চেষ্টা করলে যে কোনো ব্যক্তিই তাঁর স্নায়ুকে সম্পূর্ণ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। এটা হচ্ছে ইচ্ছা শক্তির বারবার প্রয়োগের ব্যাপার। মনোবল যদি দৃঢ় হয় স্নায়ু নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা যদি প্রবল হয়, তবে যে কোনো ব্যক্তির মনই দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হবে, তার ইচ্ছা শক্তির জয় হবে।
আপনি কি শ্রোতাভীতি থেকে মুক্ত হতে চান? এর কী কারণ আসুন আমরা তা জানার চেষ্টা করি।
“অজ্ঞতা ও অনিশ্চয়তাই ভীতির উৎস” বলেছেন অধ্যাপক রবিনসন্স, মনের জন্ম বইতে। অন্যভাবে এ কথা বলা যায়, আত্ম বিশ্বাসের অভাবেই ভীতি?
এর ফল কী হয়? আপনি কি করতে চান তা আপনি কি পারেন না? এবং অভিজ্ঞতার অভাবেই আপনি বুঝতে পারেন না, আপনি নিজেই জানতে করতে পারেন। আপনি বার বার সফল হলে আপনার ভীতি দূর হয়ে যাবে। জুলাই মাসের উজ্জ্বল সূর্যালোকের মতো সাফল্য জ্বলজ্বল করবে।
জলে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া সাঁতার শেখা যায় না, এটা সকলের কাছেই নিশ্চিত সত্য। আপনি দীর্ঘদিন হতে এই বই পড়ছেন, সুতরাং কেন চেষ্টা করে দেখছেন না, সাফল্য কতটুকু এল?
আপনি একটি বিষয় বেছে নিন, এমন বিষয় বেছে নিন, যা আপনি জানেন। ওটার ওপর তিন মিনিটের একটি কথিকা লিখুন। কয়েক বার তা নিজে-নিজে প্রকাশ করার চেষ্টা করুন। অতঃপর তা নিয়ে বন্ধুদের সামনে হাজির হোন। তাদের সামনে দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে প্রকাশ করুন। বক্তৃতার ভঙ্গিতে পেশ করুন।
(১) কয়েক হাজার ছাত্র এই গ্রন্থকারের কাছে লিখেছেন তারা কেন জনসমক্ষে বক্তৃতা পেশ শিখতে চান এবং শিক্ষা হতে তাঁরা কী পেতে চান। তাঁদের প্রায় সকলের বক্তব্য হচ্ছে যে কোনো সংখ্যক শ্রোতার সামনে দাঁড়াতে তাঁরা স্নায়বিক দুর্বলতা মুক্ত হতে চান, যা বলবেন সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাবে চিন্তা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজ বক্তব্য পেশ করে জয়ী হতে চান।
(২) এই রূপ যোগ্যতা অর্জন তেমন কষ্টকর নয়। এটা কতিপয় ব্যক্তির জন্য প্রকৃতির দান নয়। এটা গলফ খেলার যোগ্যতা অর্জনের মতো ব্যাপার। যে কোনো ব্যক্তি পুরুষ বা নারী ইচ্ছা করলে এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন।
(৩) বহু অভিজ্ঞ বক্তা শ্রোতাদের সামনে যেরূপ সহজ ও সাবলীলভাবে বক্তব্য পেশ করতে পারেন, ব্যক্তি বিশেষের সাথে কথোপকথনে সেরূপ সহজভাবে মনের কথা প্রকাশ করতে পারেন না, এরূপ ক্ষেত্রে বহু সংখ্যক ব্যক্তির উপস্থিতি বক্তাকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রাণিত করেন। আপনি যদি এই বই এ উপদেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করেন, একদিন দেখবেন, এই অভিজ্ঞতা আপনার ভাণ্ডারেও সঞ্চিত হয়েছে। আপনি সব সময় প্রস্তুত রয়েছেন জনসমক্ষে বক্তৃতা করতে, কেননা, এই বক্তৃতা আপনাকে আনন্দ দেয়।
(৪) যত বেশিই আপনি বক্তৃতা করুন না কেন, সব সময়ই দৃঢ় আত্ম প্রত্যয়ের সাথে বক্তব্য পেশ করার চেষ্টা করুন। তা হলে আপনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভীতি মুক্ত হতে পারেন।
০২. প্রস্তুতির মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস
।প্রতি বছর গড়ে ছয় হাজার বক্তৃতা শোনা ও তার সমালোচনা করা এই গ্রন্থকারের পেশাগত দায়িত্ব এবং আনন্দ। ১৯১২ সাল থেকেই তিনি এটা করে আসছেন। এ সব বক্তৃতা কলেজ ছাত্রদের নয়, বয়স্ক ব্যবসায়ী ও পেশাগত ব্যক্তিদের। সমালোচনা কালে তিনি এসব বক্তৃতার রচনা পদ্ধতি, সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার বক্তব্য, যে কথা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে, যাতে একটি বিষয় প্রকাশে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিকই অপ্রকাশিত না থাকে, তার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আপনার মনের ভাব ভাষা এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে শ্রোতার মন ও হৃদয় আপনার বক্তব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শ্রোতার মনের উপর প্রভাব সৃষ্টিই বক্তৃতার সাফল্য।
যখন কোনো বক্তা শ্রোতার মনে প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্য সামনে রেখে বক্তৃতা শুরু করেন, তখন তাঁকে এটা বুঝতে হবে যে, বক্তব্য হতে হবে তাৎপর্যবহ। সুপ্রস্তুত বক্তৃতার প্রস্তুতিতেই দেশের দশভাগের নয় ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়।
অধিকাংশ ব্যক্তি কেন এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে চায় তা প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আত্মবিশ্বাস, সাহস ও আত্মপ্রত্যয় লাভ। কথিকা বা বক্তব্য প্রস্তুত না করাই হচ্ছে বক্তৃতার জন্যে মৌলিক ভুল। ভেজা বারুদ ও খালি শেজ নিয়ে অথবা কোনোরূপ অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে সৈন্যদলের পক্ষে কি শত্রুর মোকাবেলা করা সম্ভব? একই ভাবে প্রস্তুতি না নিয়ে ভয় ভীতি ও স্নায়বিক দুর্বলতা জয় করা সম্ভব হতে পারে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, যখন শ্রোতাদের সামনে দাঁড়ান তখন তিনি আর নিজ বাড়িতে নন। “আমি বিশ্বাস করি” লিংকন হোয়াইট হাউসে বলেছেন “আমি কখনো সংশয় মুক্ত মনে সব কিছু বলে শেষ করতে পারবো না।”
আপনি যদি আত্মবিশ্বাস লাভ করতে চান তা হলে কেন এই আত্মবিশ্বাস লাভের কাজ করেন না? ”প্রকৃত ভালবাসা” লিখেছেন আপোসেল জন ”ভীতি বিতাড়িত করে।“ প্রকৃত প্রস্তুতিও একই কাজ করে। ওয়েরেনটার লিখেছেন তিনি যখন শ্রোতাদের সামনে যাবার কথা ভাবেন তখন তার মনে হয় তিনি অর্ধ উলঙ্গ ও অপ্রস্তুত হয়ে উঠেছেন।
কেন আমরা আমাদের বক্তব্য অধিকতর যত্নসহকার প্রস্তুত করি না? কেন? কেহ কেহ কী প্রস্তুত কীভাবে পরিষ্কার কি তা বুঝতে পারেন না এবং কীভাবে দক্ষতার সাথে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন তাও বুঝে না। অন্যরা সময়াভাবের কথা বলেন। সুতরাং অত্র অধ্যায়ে আমরা এই বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব।
প্রস্তুতির সঠিক পথ :
প্রস্তুতি কী? বই পড়া। এটি একটি পথ, তবে শ্রেষ্ঠতম পথ নয়। বই পড়া প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে, কিন্তু কোনো বক্তা যদি শুধু বই পড়ে, বইতে যাহা আছে সরাসরি বই এর ভাষায় তা পেশ করেন, তা হলে শ্রোতারা সন্তুষ্ট হয় না। সরাসরি বুঝতে না পারলেও তারা একটা কিছুর অভাব অনুভব করেন। বক্তার বক্তব্যে কিসের অভাব আছে স্পষ্টভাবে তারা তা না বুঝলে এই বক্তব্যে তাদের অনুপ্রাণিত করে না। কয়েক বছর আগে এই লেখক নিউইয়র্ক সিটি ব্যাঙ্কের কর্মকর্তাদের জন্য একটি সাধারণ কোর্স পরিচালনা করেন। অনেক বিষয় ছিল যেগুলি সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীরা অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। কেননা এত দিন নিজ-নিজ ব্যক্তিগত চিন্তাধারায় কাজ করেছেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে সব কিছুর বিচার করেছেন এবং তাদের কর্মপদ্ধিতে অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো কিছু ছিল না। এইভাবে তারা চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন। ফলে বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করা তাদের কারো পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
পাইন বিষলতার আচ্ছাদনের জন্য পর্বত তাদের দৃষ্টির অগোচরে পড়ে গেছে। এই গ্রুপ প্রতি শুক্রবার ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত ক্লাসে বসতেন। এক শুক্রবার এই গ্রুপে সাথে এক ভদ্রলোক, যাকে আমরা পরিচিতির জন্য মি. জ্যাকসন বলে অভিহিত করবো, অফিসে বসে ঘড়িতে সাড়ে চারটা বেজেছ দেখতে পেলেন। সেদিন তার বক্তৃতা করার কথা ছিল, কিন্তু তিনি অপ্রস্তুত। এখন তিনি কী করবেন? তিনি আস্তে-আস্তে তার অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন, স্টল থেকে ম্যাগাজিনের একটি কপি কেনেন, সংক্ষিপ্ত পথ হেঁটে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে আয়োজিত ক্লাসে উপস্থিত হন।”সাফল্য লাভে আপনার মাত্র ১০বছর সময় লাগবে।” শীর্ষক তিনি একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। তিনি এই বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এটি পাঠ করে নি, বরঞ্চ তাকে কিছু বলতে হবে এই জন্য তিনি এই নিবন্ধটি পাঠ করেন।
এক ঘণ্টা পর এই নিবন্ধটি ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ান।
এর ফল কী হল? পরিণতি কী হল, তিনি যা বলতে চাইছিলেন তা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারলেন না। শুধু স্পষ্টভাবে বললেন, আমি বলতে চাই যে, তিনি চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু তিনি নিজে বুঝেন নি, হৃদয়ঙ্গম করেন নি সুতরাং তিনি তা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি যে বিষয়টি বুঝেন নি শ্রোতারা সে বিষয় তার বক্তব্য হতে বুঝে নিবে কীভাবে? এই নিবন্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বারবার বললেন, লেখক এটা বলতে চেয়েছেন, ওটা বলতে চেয়েছে। এই বক্তব্য কিন্তু মি. জ্যাকসনের নয়। সুতরাং গ্রন্থকার বলেন, মি. জ্যাকসন, যে লেখক এই নিবন্ধটি লিখছেন তিনি এখানে উপস্থিত নেই। সুতরাং আমরা তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা আগ্রহী নই, কারণ আমরা তাঁকে দেখছি না কিন্তু আমরা আপনার চিন্তাধারা সম্পর্কে আগ্রহী। আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী চিন্তা করছেন বলুন, অন্যে কী বলেছেন তা বলার প্রয়োজন নেই। এখানে মি. জ্যাকসনের বক্তব্য অধিক প্রয়োজন।
যে বিষয়টি আজ পড়েছেন সেটি আগামী সপ্তাহের জন্য নির্ধারিত করুন। তখন নিবন্ধটি আবার পড় ন এবং নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করুন আপনি লেখকের সাথে একমত অথবা কতটুকু ভিন্নমত পোষণ করেন। তা করতে হলে লেখকের প্রবন্ধটি আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। যদি আপনি লেখকের সাথে একমত না হন তা হলে কারণ ব্যাখ্যা করুন। এই নিবন্ধের মূল বক্তব্য ধরে নিয়ে আপনার বক্তৃতা শুরু করুন।
মি. জ্যাকসন এই সুপারিশ গ্রহণ করে পুন পাঠ করেন এবং এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, লেখকের সাথে তিনি মোটেও একমত নন। এরপর তিনি পরবরর্তী বক্তৃতা প্রস্তুত করা জন্য তিনি নিজে নিজেই উদ্যোগী হন। এটা যেন তার একটা সন্তান। সন্তান যেভাবে আস্তে-আস্তে বড় হয়ে উঠে মি. জ্যাকসনের বক্তব্য দিন-দিন বড় হয়ে উঠতে থাকে। সংবাদ পত্রে একটি নিবন্ধ পাঠ করলে তিনি সে বিষয়টি নিয়ে এইরূপ গভীরভাবে চিন্তা করেন যে তার জ্ঞানের পরিধি দিন-দিন বাড়তে থাকে। এইভাবে তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চর্চা করতে শুরু করেন। এই বিষয় নিয়ে তিনি বন্ধুবান্ধবের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে থাকেন।
পরবর্তী সময় তিনি এমন এক বক্তব্য পেশ করেন যা তার নিজস্ব চিন্তাধারা হতে উদ্ভূত, যেন সেইটি তার নিজস্ব টাকশালে তৈরি মুদ্রা। তার বক্তব্য হয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার। লেখকের সাথে দ্বিমত পোষণ করার ফলে তার এই বক্তব্য হয় পরিপূর্ণ অর্থবহ।
এক পক্ষ কালের মধ্যেই তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রস্তুতি গ্রহণ করার ফলেই এই বক্তব্যে স্পষ্টতা আসে।
আমরা এই ক্ষেত্রে আর একটি উদাহরণ উল্লেখ করতে পারি। এক ভদ্রলোক যাকে আমরা মি. ফাইন বলে অভিহিত করব, ছিলেন ওয়াশিংটনে আয়োজিত সাধারণ বক্তৃতা কোর্সের ছাত্র। অপরাহ্নে তিনি রাজধানী সম্পর্কে আলোচনায় বললেন। তিনি একটি সংবাদ পত্রের নিবন্ধ অনুসরণে রাজধানী সম্পর্কে বলেন। তার বক্তব্য অসংলগ্ন, সূক্ষ, অর্থহীন বলে প্রতীয়মান হয় কারণ তিনি এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন নি এবং বিষয়টি তাকে আগ্রহী করে নি। বিষয়টি নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা না করায় তার প্রকাশ ভঙ্গিও-হয়ে উঠে নিতান্ত গতানুগতিক সাধারণ। সমস্ত বিষয়টি হয়ে উঠে অনাকর্ষণীয়।
যে বক্তব্য কখনো ব্যর্থ হয় না :
এক পক্ষ কাল পরে এমন একট ঘটনা ঘটলো যা মি. ফ্লাইনের অন্তরে দাগ কাটে। ঘটনাটি হচ্ছে একটি সরকারি গ্যারেজ হতে গাড়ি চুরি। গাড়িটি চুরি হওয়ার পর তিনি পুলিশের কাছে যান এবং উদ্ধারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। কিন্তু তার প্রস্তাব ব্যর্থ হয়। পুলিশ স্বীকার করে যে, তাদের পক্ষে অপরাধ প্রবণতা মোকাবিলা করা এবং গাড়ি উদ্ধার করা অসম্ভব। মাত্র এক সপ্তাহ আগে যে পুলিশ রাস্তায় ১৫ মিনিট অতিরিক্ত গাড়ি রাখার জন্যে মি. ফ্লাইনকে জরিমানা করেছিলেন সে পুলিশই সময়াভাবের প্রশ্ন তুলেন। পুলিশের সময়াভাবের কথা মি. ফ্লাইনকে ক্রোধান্বিত করে তুলে। তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি চিন্তা করেন, এখন তকে এমন কিছু বলতে হবে যা শুধু সংবাদ পত্র পুস্তিকায় উদ্ধৃত আছে এমন নয়, তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা প্রসূত। তিনি নিজে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং মনে করেন যে, পুলিশকে উত্তেজিত করা গেলে কাজ হতে পারে। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে ওয়াশিংটনের অপরাধের ইতিহাস এবং পুলিশের ব্যর্থতার কথা প্রকাশ করতে থাকেন। এই সময় তিনি এত উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে তিনি তাঁর পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে পঁড়িয়ে পড়েন এবং তার মুখ গহবর হতে পুলিশের বিরুদ্ধে এইরূপ গালাগলি বেরুতে থাকে যেন বিসুবিয়াসে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। এতে কাজ হয়। পুলিশ উত্তেজিত হয়ে অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। মি. ফ্লাইনের বক্তব্য সফল হয়। চিন্তা ও অভিজ্ঞতার ফলে জয় যুক্ত হন মি. ফ্লাইন।
প্রকৃত পক্ষে প্রস্তুতি কী?
একটা বক্তৃতা প্রস্তুতির অর্থ কি কতকগুলো নির্ভুল বাক্য লিখে নেয়া অথবা মুখস্থ করা? না। এর অর্থ কি কিছু-কিছু সাময়িক চিন্তা যা সব সময় আপনার মনে আসে না তার একত্র সন্নিবেশ? মোটেই না। এর অর্থ আপনার চিন্তা, আপনার আদর্শ, আপনার বিশ্বাস, আপনার আগ্রহের একত্র সন্নিবেশ এবং আপনার মধ্যে এরূপ চিন্তা এরূপ আগ্রহ আছে যেইগুলি আপনার প্রতিদিনের নিত্য সঙ্গী, আপনার স্বপ্নেও সহচর। আপনার অস্তিত্ব এই অনুভূতি ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। সমুদ্রতীরে পাথর যেভাবে স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকে এগুলোও অপনার সুপ্তমনে ঠিক সেভাবে সজ্জিত। প্রস্তুতি অর্থ চিন্তা করা, ধ্যান করা, পুনঃস্মরণ করা, যে বিষয়টি আপনার মনের দাগ কাটে তা নির্ধারণ করা। এ সবকে সাজানো। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এগুলোকে বিশেষভাবে সাজানো। এইগুলো কিন্তু তেমন কঠিন কর্মসূচি নয়।
এ গুলো কঠিন কী? না, কঠিন নয়। বিষয়টির প্রতি সামান্য মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করলেই এ কাজটি সুসম্পন্ন হয়। ডুইট, এল, মুড়ি কীভাবে তাঁর আধ্যত্মিক ইতিহাস সৃষ্টিকারী বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন? ”এতে গোপনীয় কিছু নেই,“ প্রশ্নের জবাবে তিনি এরূপ উত্তর দিতেন।
‘যখন আমি কোনো একটি বিষয় ঠিক করি তখন একটি বড় খামের বর্হিভাগে তাঁর নাম লিখে রাখি। আমার এই ধরণের বহু খাম আছে। কোনো বই পড়ার সময় আকর্ষণীয় কিছু দেখলে তা লিখে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের খামের মধ্যেই রেখেছি।
সব সময় আমরা সাথে একটি নোট বই থাকে এবং কোনো ধর্ম উপদেশ মূলক বক্তৃতায় নতুন কিছু শুনলে আমি তা নোট করি? অতঃপর তা আমি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের খামের মধ্যে রেখে দেই। এইভাবে এই সব কাগজ পত্র এক বছর অথবা আরো বেশি সময় পড়ে থাকে। যখন আমি ধর্ম উপদেশ মূলক বক্তৃতা দানের সিদ্ধান্ত করি তখন সংরক্ষিত সব কিছু হাতে নিই। এই সব কাগজ পত্রের তথ্য ও চিন্তা ধারা মিলিয়ে আমি আমার নতুন বক্তব্য ঠিক করি। এই বক্তব্য প্রচুর মাল-মসলায় পূর্ণ হয়। আমি সব সময় আমার ধর্ম উপদেশ মূলক বক্তৃতায় কোথাও কিছু যোগ করি। কোথাও বা কিছু বাদ দেই। ফলে আমরা বক্তব্য কখনো পুরোনো হয় না।
লিংকন কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন :
লিংকন কীভাবে তার বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন? সৌভাগ্যবশত আমরা তা জানি এবং এখানে আপনারা সে পদ্ধতি জানতে পারবেন। লিংকন এক শতাব্দীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ কাল কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। বক্তৃতা প্রস্তুতে তিনি যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন ডীন ব্রাইন তর বিভিন্ন ভাষণে তা ব্যক্ত করেছেন। লিংকনের একটি বিখ্যাত ভাষণে তিনি ভবিষ্যদ্বক্তার মতো বলে ছিলেন, আভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত কোনো ঘর টিকে থাকতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, অর্ধস্বাধীন ও অর্ধদাস কোনো সরকারও স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে না। এই বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে তাঁর মন হতেই উৎসারিত হয়েছিল। কেননা তিনি তার স্বাভাবিক কাজে, পানাহারের সময়, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় গোদোহন কালে দোকনে কেনা কাটার সময়, বাজারে ঘোরার সময় ছোট ছেলেটিকে নিয়ে বসে থাকার সময়, পিতার সাথে আলোচনার সময় দেশ সম্পর্কে, সরকার সম্পর্কে, দেশের অবস্থা সম্পর্কে ভাবতেন, চিন্তা করতেন, সকলের সাথে আলাপ করতেন মত বিনিময় করতেন, এবং এরই ফলশ্রুতিতে তার পক্ষে এই ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব হয়েছিল। তবে এই বক্তব্য পেশ কালে লিংকন সম্পূর্ণরূপে নিজের চিন্তাকে নিজের ভাষাতেই প্রকাশ করেন, ফলে ঐটি হয় হৃদয়গ্রাহী।
সব সময় তিনি যা চিন্তা করতেন মনে যা আসত তা হাতের কাছে পাওয়া টুকরো কাগজ, খাম, ভেঁড়া খামের অংশ ইত্যাদিতে লিখে রাখতেন, কখনো লিখতেন পুরো বাক্য কখনে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। অতঃপর এ সব কগজের টুকরো তিনি সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং সময় ও সুযোগে মতো বসে এগুলোকে সঠিক ভাবে সাজিয়ে নিতেন, লিখতেন, সংশোধন করতেন, সংযোজন করতেন, সম্প্রসারণ করে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন, প্রকাশনার জন্যে উপযোগী করে নিতেন।
১৮৫৮ সালের যৌথ বিতর্ক কালে সিনেটর ডগলাস সর্বত্র একই বক্তব্য পেশ করতে শুরু করেন। কিন্তু লিংকনের নীতি ছিল, নতুন কথা বলা। এক সভায় যা বলেছেন অন্যত্র তার পুনরাবৃত্তি না করা। তাই তিনি সব সময় তার বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করতেন, তাই তার পক্ষে নতুন নতুন বক্তব্য পেশ করা সহজতর হত। এই নতুন বক্তব্য শ্রোতাদের কাছে হত অনেক সহজ ও গ্রহণযোগ্য।
হোয়াইট হাউসে প্রবেশের স্বল্প কাল আগে তিন শাসনতন্ত্রের একটি অনুলিপি নেন। অতঃপর তিনি ঐটি নিয়ে স্প্রিংফিল্ড এর একটি কক্ষে প্রবেশ করেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শাসনতন্ত্রের উদ্ধৃতি নিয়ে তিনটি বক্তৃতা প্রস্তুত করেন। এভাবেই তিনি হোয়াইট হাউসের উদ্বোধনী বক্তৃতা প্রস্তুত করেন।
লিংকন কীভাবে তার গেটিসবার্গের বিশ্ব বিখ্যাত বক্তৃতা তৈরি করেছিলেন? দুর্ভাগ্য বশত এই ভাষণটি তৈরি করা সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচারিত আছে। কিন্তু এর সত্য ঘটনা হচ্ছে নিম্নরূপ :
গোটিসবার্গ গোরস্থান পরিচালনা কমিশন আনুষ্ঠানিক উৎসর্গানুষ্ঠান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এডওয়ার্ড এভারেটকে বক্তৃতাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। মি. এভারেট বোস্টমেন মন্ত্রী, হারভার্ড এর প্রেসিডেন্ট, নিউইয়র্কের গভর্নর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এবং মন্ত্রী হিসাবে আমেরিকায় বিশেষভাবে পরিচিত, খ্যাতনামা বক্তা। প্রথমে ১৮৬৩ সালের ২৩শে অক্টোবর এই অনুষ্ঠানের তারিখ নির্দিষ্ট করে তাকে আমন্ত্রণ জানান হয়। কিন্তু এভারেট জানান যে এত অল্প সময়ের মধ্যে তার পক্ষে বক্তৃতা প্রস্তুত করা সম্ভব হবে না। সুতরাং তাকে বক্তৃতা প্রস্তুতির সময় দেয়ার নিমিত্তে এই অনুষ্ঠান ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় এক মাস কাল স্থগিত রাখা হয়। মি. এভারেট অনুষ্ঠানের তিনদিন আগে গেটিসবার্গ গমন করে, যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে, যুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করেন। ফলে যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার প্রস্তুতি হয় সম্পূর্ণ।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে কংগ্রেসের সকল সদস্য, প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রীসভার সদস্যদের কাছে আমন্ত্রণ পত্র পঠানো হয়। অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত হতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট লিংকন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবেন জানালে কমিটি বিস্মিত হয়। তারা কি প্রেসিডেন্টকে ভাষণ দেবার জন্যে অনুরোধ জানাবেন? তাদের এরূপ কোনো ইচ্ছা ছিল না। আপত্তিও উত্থাপিত হয়। তিনি প্রস্তুতির সময় পাবেন না। অধিকিন্তু সময় পেলেও এরূপ বক্তৃতা প্রণয়নের যোগ্যতা তার আছে কি? দাসতু অথবা শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে বিতর্কে তিনি যক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশে সক্ষম হলেও তাঁকে উৎসর্গমূলক বক্তৃতা প্রদান করতে কেহ কখনো দেখে নি। এটি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তাঁরা কি করিবেন তা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হলেন। তাঁরা কি তাকে বক্তৃতা করতে অনুরোধ জানাবেন? তারা শুধু বারবার ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। কিন্তু এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, যে ব্যক্তির যোগ্যতা সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জেগেছিল সেই ব্যক্তিরই সেদিনকার ভাষণটি আজ সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ বলে বিবেচিত ও পরিচিত, কোনো জীবন্ত মানুষের বক্তৃতার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠতম বক্তৃতা বলে গণ্য।
পরিশেষে তারা অনুষ্ঠানের মাত্র এক পক্ষকাল আগে প্রেসিডেন্টের প্রতি যথাযোগ্য মন্তব্য করার বিলম্বিত আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আমন্ত্রণের বিষয়টি ছিল ”যথাযোগ্য মন্তব্য” যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতি এই অমন্ত্রণ।
আমন্ত্রণ প্রাপ্তির পর লিংকন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি এডওয়ার্ড এভারেস্ট কে লিখে তিনি যে বক্তৃতা পেশ করবেন তার একটা অনুলিপি সংগ্রহ করেন। এর দুই একদিন পর ফটো তোলার জন্য একটি স্টুডিওতে গমন করেন। তথায় অবস্থান কালে প্রাপ্ত অবসর সময়ে তিনি এভারেটের বক্তৃতার অনুলিপি পড়ে ফেলেন, অতঃপর তিনি কয়েক দিন ধরে তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা করেন।
হোয়াইট হাউস ও যুদ্ধ অফিসে গমন কালে চিন্তা করেন এই বক্তৃতা সম্পর্কে, চিন্তা করেন যুদ্ধ অফিসের কৌচে বসে গভীরভাবে। অফিসে সর্বশেষ তারবার্তার জন্য অপেক্ষা কালে তিনি চিন্তা করেন ধ্যান মগ্ন হয়ে। তিনি তার চিন্তা লিপিবদ্ধ করেন একটি ফুলস্কেপ কাগজের একটি টুকরায়, এটি রাখেন তার উঁচু টুপির মধ্যে। তিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই বিষয়টির ওপর চিন্তা করতে থাকেন, ফলে নতুন নতুন পয়েন্ট তার মনে আসতে থাকে। নির্দিষ্ট তারিখের পূর্ববর্তী রোববার তিনি নোয়া ব্রকসকে বলেন”এটা সঠিকভাবে লেখা হয় নি। এটা এখনো শেষ করাও যায় নি। আমি এটি দু’তিন বারের বেশি লিখেছি, তবে এটা সম্পর্কে আমি নিজে আজো সন্তুষ্ট হতে পারি নি, তাই এখানেনা এটা সম্পর্কে ভাবছি, ভাবছি আত্মসন্তুষ্টির জন্য।
অনুষ্ঠানের আগের রাত্রে প্রেসিডেন্ট লিংকন গেটিসবার্গ পৌঁছেন। ক্ষুদ্র শহরটি তখন জনসমাগমে পূর্ণ। মাত্র তের শো লোকের শহরে তখন ১৪ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছে। নারী পুরুষের উপস্থিতিতে সারা শহর গগম্ করছে। লোকের ভিড়ে রাস্তায় চলাচল অসম্ভব। চারিদিকে ব্যান্ড বাজছে, জনতা ‘জন ব্রাউনের, নামের গান গাইছে। মি. উইলসের বাড়িতে লিংকন আতিথ্য গ্রহণ করেন। জনতা তথায় ভিড় করে তাকে কিছু বলতে অনুরোধ জানান! প্রত্যুত্তরে তিনি নিতান্ত সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন। তার এই বক্তব্য হতে এটা স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে তিনি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের আগে মুখ খুলতে চান না। শেষ রাতেও তিনি তাঁর বক্তব্যটি সংশোধন, সংযোজন করেন, যেন লেহন করেন। নিকটবর্তী যে ঘরে পররাষ্ট্র সচিব সিওয়ার্ড অবস্থান করেছিলেন, সে গৃহে গিয়ে তিনি তার বক্তব্য তার কাছে পেশ করে সমালোচনা করতে বলেন। পরদিন সকালে প্রাতভোজের পরও তিনি বক্তব্যটি পাঠ করতে থাকেন, যতক্ষণ না তাঁকে জানানো হয় যে শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে এবং তাতে তার অংশ নেয়ার সময় সমুপস্থিত। প্রেসিডেন্টকে অনুসরণকারী কর্নেল কার বলেছেন, শোভাযাত্রায় প্রেসিডেন্ট ঘোড়ায় চড়ে অংশ নেন এবং বাহিনী চলার দিকে লক্ষ্য রাখেন। কিন্তু শোভাযাত্রা চলতে শুরু করলে দেখা যায় যে, তার শরীর সামনের দিকে ঝুঁকেছে বাহু শিথিল হয়ে পড়েছে এবং মস্তক অবনত হয়ে গেছে, মনে হল, তিনি তন্ময় হয়ে কিছু ভাবছেন?
এটা হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তখন তার মাত্র দশটি বাক্যের অবিস্মরণীয় বক্তব্য নিয়ে ভাবছিলেন অর্থাৎ শেষ বারের মতো তিনি তার বক্তব্য চেটে নিচ্ছেলেন।
আধ্যাত্মিক বিষয়ে লিংকন প্রদত্ত অনেক বক্তব্যই ব্যর্থ বলে প্রমাণিত, কিন্তু দাসত্ব এবং রাষ্ট্রনীতি তার সকল বক্তব্যই অবিস্মরণীয়। এ সব বিষয়ে বক্তৃতা প্রদানে তার ক্ষমতা অতুলনীয়। কেন? কারণ তিনি সব সময় এসব বিষয় নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করতেন এবং এগুলি গভীর ভাবে অনুভব করতেন। ইলিয়েসের একটি কক্ষে জনৈক বন্ধু রাতে তার সাথে ঘুমান, পরদিন সকালে তিনি জেগে ওঠে দেখতে পান যে লিংকন দেওয়ালের দিকে মুখ করে বিছানায় বসে গভীর চিন্তার সাথে বলেছেন, “অর্ধ দাস অর্ধ মুক্ত এই সরকার দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।”
যিশুখ্রিস্ট কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন? তিনি নিজেকে জনতা হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতেন, চিন্তা করতেন, ধ্যানমগ্ন হতেন। ভাবতেন, তিনি একাকী নির্জন স্থানে চলে যেতেন, ধ্যান করতেন এবং চল্লিশদিন চলিশ রাত ধরে উপবাহ্রত পালন করতেন।” এই সময়ের পর, বলেছেন সেন্টম্যাথু, যিশু ধর্মপ্রচার শুরু করেন। এই ঘটনার অনতিকাল পরে তিনি একটি বক্তৃতা করেন যা বিশ্ব ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই বক্তৃতা ”সারমন অন দি মাউন্ট” নামে পরিচিত।
‘আমার এই বক্তব্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় তবুও আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন কিন্তু অমর বক্তা হবার কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। আমি সময়-সময় জনকল্যাণমূলক কিছু বক্তব্য আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই।’
আপনি কী চান তা আমরা উপলব্ধি করি। আপনাদের সে আকাঙ্ক্ষা এবং আপনার মতে যারা চিন্তা করছেন তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যেই এই বই। অতীতে খ্যাতনামা বক্তারা যে-ভাবে বক্তৃতা শিখেছেন, বক্তৃতা অভ্যাস করেছেন সে পথ অনুরসণ করে আপনিও উপকৃত হতে পারেন।
কীভাবে আপনার বক্তৃতা প্রস্তুত করবেন :
কী বিষয় নিয়ে আপনি প্রস্তুতি শুরু করবেন? যে কোনো বিষয় যার প্রতি আপনার আগ্রহ জন্মে। একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বেশি সংখ্যক গুরুত্ব পূর্ণ পয়েন্ট আলোচনা করবেন। শুধুমাত্র একটি বা দুটি পয়েন্ট নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় এক বা দুটি পয়েন্ট সঠিকভাবে ও খোলাখুলি ব্যাখ্যা করা সম্ভব ও সহজতর। শ্রোতাও তা বুঝতে পারে, আকৃষ্ট হয়।
আপনার বক্তব্য বিষয় আগেই ঠিক করুন। তা হলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে নিতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে সাতদিন চিন্তা করুন, সাতবার স্বপ্ন দেখুন। ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম নেয়ার সময়ে বিষয়টি ভেবে নিন। সকালে দাড়ি গোঁফ কাটবার সময়, স্নান করার সময়, শহরে চলার পথে কোথাও অপেক্ষা করার সময়, মধ্যাহ্ন ভোজ গ্রহণ কালে, কোনো নির্দিষ্ট স্থান গমন কালে, নৈশ ভোজ প্রস্তুত বা রান্না কালেও বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন। ঐটাকে আলোচনার বিষয়বস্তু করে নিন।
বিষয়টি নিয়ে যত প্রশ্ন আপনার মনে আসে তা আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। মনে করুন আপনার বিষয় হচ্ছে বিবাহ-বিচ্ছেদ। আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ কী এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ফলাফল কী। এই সৎ কাজ কীভাবে বন্ধ করা যায়? আবার কি একই রূপ বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন প্রয়োজন? কেন? অথবা আমরা কি কোনো রূপ বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন অনুসরণ করি? বিবাহ-বিচ্ছেদ কি অসম্ভব করে তোলা উচিত? অধিকতর বিধি নিষেধ প্রয়োজন? সহজ করা উচিত?
মনে করুন, আপনি কেন বক্তৃতা শিখছেন এই বিষয়টির ওপর বলবেন। তা হলে আপনি আপনাকে নিম্নরূপ প্রশ্ন করবেন : বক্তৃতা করতে আমার বাধা কী? বক্তৃতা আমি কেন শিখতে চাই? এর দ্বারা আমার কী উপকার হবে? এর ফল কী হয়েছে? একজন ব্যবসায়ীর জন্যে বক্তৃতা শেখা প্রয়োজন বলে কেন আমি মনে করি? যে সব নারী পুরুষ ব্যবসা বাণিজ্যে অথবা রাজনীতিতে উন্নতি করেছে তারা আত্মবিশ্বাসী এবং তাদের বক্তব্য আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য বলে কি আমি বিশ্বাস করি? আমি কি মনে করি যাদের এসব গুণ নেই তারা ব্যবসা বাণিজ্য অথবা রাজনীতি ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারছে না? এটা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভবে বলতে হবে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের নামোল্লেখ না করে তাদের সাফল্য ব্যর্থতার কাহিনী বলতে হবে; প্রকাশ করতে হবে।
এভাবে একটি বিষয়ে পরিষ্কার চিন্তা ও স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে বক্তৃতা শুরু করলে দুতিন মিনিট বলার পর সব পয়েন্ট একে একে আপনার মুখ দিয়ে এসে যাবে। একটি দুটি বক্তৃতার পর আপনার বক্তৃতা অরো পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কেন আপনি বক্তৃতা শিখছেন এ সম্পর্কে বলা অত্যন্ত সহজ হবে। এই বিষয়টি নিয়ে আপনি যদি সামান্য চিন্তা করেন এবং পয়েন্ট গুলি মনে-মনে সাজিয়ে নেন, তা হলে পুরে বিষয়টি আপনার মনে থাকবে এবং বক্তৃতা কালে অপনি স্বচ্ছন্দে আপনার আকাঙ্ক্ষা, আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সহজ ও সরল ভাষায় আপনার বক্তব্য পেশ করতে পারবেন।
অপরদিকে, মনে করুন, আপনি আপনার ব্যবসা অথবা পেশা সম্পর্কে বলবেন। তা হলে কীভাবে আপনি এ ধরনের বক্তৃতা তৈরি করবেন? আপনি জানেন। সুতরাং সেগুলি একের পর এক সাজান। সবগুলো তিন মিনিটের মধ্যে বলে শেষ করার চেষ্টা করবেন না। এটা সম্ভব নয়। এ ধরণের চেষ্টা পরিপক্ক বুদ্ধির পরিচায়ক নয়। একটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করুন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করুন। উদাহরণ স্বরূপ কেন আপনি বিশেষ ব্যবসা বা পেশা গ্রহণ করবেন সে সম্পর্কে বলুন। এটা কি আকস্মিক অথবা আপনার মনের ইচ্ছা? প্রথম দিনে আপনার অসুবিধা, ব্যর্থতা সাফল্য ও আশার কথা প্রকাশ করুন। আপনার অভিজ্ঞতার বর্ণনা এমনভাবে দিন যাতে তা হৃদয়গ্রাহী হয়। কারো জীবন কাহিনী সঠিকভাবে, হৃদয়গ্রাহীরূপে বর্ণনা করা হলে তা হয় আকর্ষণীয়। এধরণের বক্তব্য হয় ফলপ্রসূ, সুফলদায়ক। অথবা আপনার ব্যবসাকে অন্য দিক থেকে তুলে ধরুন। এর সমস্যাগুলো প্রকাশ করুন, যে তরুণ এই ব্যবসায়ে আসতে চাইছে, নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে কিছু উপদেশ দিন।
অথবা ব্যবসা সূত্রে আপনি যে সব লোকের সংস্পর্শে এসেছেন তাদের কথা বলুন। তাদের সতোর কথা বলুন, বলুন অসৎদের কথা, বলুন আপনার সমস্যার কথা। এই কাজের ভেতর দিয়ে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে অপনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। যে শিক্ষা পেয়েছেন, তা কী মনের প্রকৃতি। আপনি আপনার পেশার খুঁটিনাটি দিক ব্যাখ্যা করতে চান, তাহলে শ্রোতারা বিরক্ত হবে; কেননা তারা তা বুঝবে না, রস পাবে না। কিন্তু চিন্তাশীল কোনো ব্যক্তিই বক্তৃতা কালে এরূপ ভুল বিষয় নিয়ে শুরু করেন না।
সর্বোপরি আপনার বক্তব্য বিষয়টিকে শুধুমাত্র শুষ্ক প্রচারে পরিণত করবেন না। তা করলে তা বিরক্তি উৎপাদন করবে। আপনার বক্তব্য উদাহরণ ও উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করুন, যে সব ঘটনা আপনি জানেন তা ব্যক্ত করুন, যা আপনি শিখেছেন তা ব্যাখ্যা করুন। নিজেও উপলব্ধি করুন যে এসব বিশেষ ঘটনা মনে রাখা অত্যন্ত সহজ। প্রকাশ করাও সহজতর তা হলে আপনার বক্তব্যও হবে সহজতর ও হৃদয়গ্রাহী।
এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। ব্যবসা মালিকের ক্ষমতা অধিস্তনদের কাছে হস্তান্তর সম্পর্কে বি. এ. ফরবেস একটি নিবন্ধ লিখেছেন, তাতে তিনি বলেছেন :
আমাদের সময়ের অধিকাংশ বড় বড় প্রতিষ্ঠান এক সময় এক ব্যক্তি পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ছিল। এগুলো নিতান্ত ক্ষুদ্র হতেই বৃহতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি যত মেধাসম্পন্নই হোক না কেন অন্যদের সাহায্য সহযোগিতা নিলে সে মেধার শক্তি বাড়ে। এই উপলব্ধি বোধ থেকেই এক ব্যক্তি পরিচালিত ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান আজকের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। সহকারীদের সাহায্য সহযোগিতার এটি ফল।
উলওয়ার্থ একদা আমাকে বলেছিলেন যে, তার ব্যবসাটি সুদীর্ঘকাল ধরে এক ব্যক্তিরই ব্যবসা ছিল। দীর্ঘদিন একা কাজ করার ফলে তাঁর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তাঁকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে হাসপাতলে পড়ে থাকতে হয়। তিনি এই উপলব্ধি করেন যে, তার ব্যবসাটিকে যদি তিনি সম্প্রসারিত করতেন, লোক নিয়োগ করতেন, তা হলে তাকে এরূপ পরিশ্রম করতে হত না, তিনি এরূপ গুরুতর অসুস্থ হতেন না এবং ব্যবসায়েরও দ্রুপ ক্ষতি হত না।
বেথেল হাম স্টিল দীর্ঘকাল একজনের পরিচালিত সম্পত্তি ছিল। চার্লস এম. স্কোয়ার একাই পরিচালনা করতেন। এই সময়ে ইউনিজ জি. গ্রেস, স্কোয়ারের চাইতে অনেক বেশি দক্ষ ও কর্মঠ স্টিল ম্যানে পরিণত হন। কেননা, তার ব্যবসা একব্যক্তি পরিচালিত ছিল না।
ইস্টম্যান কোডাক প্রাথমিক অবস্থায় জর্জ ইস্টম্যান পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু বুদ্ধিমান ছিলেন বিধায় বহুদিন আগেই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক আকারে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিকাগোর সকল প্যাকিং হাউসই একই রূপ অভিজ্ঞতার অধিকারি। স্টান্ডার্ড ওয়েল কখনো একজন প্রতিষ্ঠানের ছিল না। ফলে ঐটি এক্ষণে এত বেশি বড় হতে পেরেছে।
জি. পি. মর্গান ব্যক্তি স্বার্থে অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নিজ ব্যবসায়ে দক্ষ ব্যক্তিদেরই অংশিদার করেছিলেন, এবং ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বও তাঁদেরকে ভাগ করে দিয়েছিলেন।
আরো বহু সংখ্যাক ব্যবসায়ী আছেন, যারা কখনো নিজ ব্যবসা পরিচলনার দায়িত্ব অন্যদের দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু প্রতিযোগিতার ফলে তারা ব্যবসা সম্প্রসারণের স্বার্থে তা করতে অর্থাৎ পরিচালনার দায়িত্ব ভাগ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
কিছু লোক তাদের ব্যবসা সম্পর্কে বলতে গেলে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থের কথাই বলেন, শ্রোতাদের স্বার্থ সম্পর্কে কিছু বলেন না। ফলে শ্রোতারা বিরক্ত হয়। বক্তারা বক্তব্য দ্বারা, শ্রোতারাও উপকৃত হোক, আগ্রহী হোক এটা কি বক্তার লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়? তাঁদের স্বার্থের কথা বলা কি উচিত নয়, আগুন কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, তার কথা বলা? যদি তিনি ব্যাংকার হন তবে তার উচিত নয় গ্রাহকদের বিনিয়োগ সম্পর্কে উৎসাহিত করা। যদি বক্তা একটি মহিলা সংগঠনের জাতীয় নেত্রী হন তাহলে কি তার উচিৎ নয় কীভাবে মহিলারা স্থানীয় কর্মসূচির ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন তার কথা বলা?
বক্তৃতা প্রস্তুতি কালে আপনারা শ্রোতাদের কথা স্মরণ রাখবেন। তাদের অভাবের কথা ইচ্ছার কথা, আকাক্ষার কথা ভাবুন। এটা করলেই আপনার বক্তব্যের অর্ধেক সহজেই বুঝতে পারবেন।
কোনো বিষয়ে বক্তব্য প্রস্তুত কালে সে বিষয়টির ওপর লিখিত রচনা পাঠ করুন, তা হলে বিষয়টি নিয়ে অন্যেরা কী চিন্তা করেছে, কী বলেছে তা জানতে পারবেন। তবে বিষয়টি নিয়ে নিজে চিন্তা করার আগে পড়বেন না। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করবেন। এরপর পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে বিষয়টির ওপর আপনি অধ্যয়ন করুন। যে বিষয়ের ওপর বক্তৃতা প্রস্তুত করতে চাচ্ছেন তার কথা বলেই বই সংগ্রহ করুন। সেখানে সাহায্য কামনা করুন। আপনি যদি গবেষক না হন, তা হলে দেখতে পাবেন যে, লাইব্রেরি কর্মচারী আপনাকে যে সাহায্য করছে তা আপনার জন্য বিশেষ ফলপ্রসু হচ্ছে। সম্ভবত তাদের কাছ থেকে আপনি আপনার বিষয়ের কাঠামো ভিত্তি মূলতথ্য বিষয়টির ভালো ও খারাপ দিক, জনতার মনের প্রশ্ন, প্রয়োজনীয় তথ্য, ইতিহাস সবকিছুই পেয়ে যাবেন। ডজন ডজন বই পাবেন যা হতে আপনি সংগ্রহ করতে পারবেন ব্যাপক তথ্য ও তত্ত্ব। এগুলিকে আপনি ঝালাই করে নিয়ে আপনার ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করতে পারবেন। আপনার বক্তব্য হবে তখন অত্যন্ত সুস্পষ্ট, উদ্দীপনাময় ও তথ্য বহুল, যা করবে শ্রোতাদের মুগ্ধ, বিমোহিত।
গোপন শক্তির উৎস :
লুথার বুরবাক তার মৃত্যুর স্বল্প আগে বলেছিলেন “আমি লাখ লাখ বক্তৃতা প্রস্তুত করেছি, কিন্তু তার মধ্যে নিতান্ত স্বল্প সংখ্যকই হয়েছে হৃদয়গ্রাহী। ফলে আমি বাকিগুলো নিজেই নষ্ট করে দিয়েছি।” এই ধরণের আকাক্ষা নিয়ে, উদ্যম নিয়ে যে কোনো বিষয়ের ওপর বক্তৃতা প্রস্তুত করা উচিত। একশটি চিন্তা করুন নব্বইটি নষ্ট করে দিয়ে দশটি রাখুন।
অধিকতর বিষয়ে তথ্য সংগ্রত করুন, অতঃপর তা সাজাবার চেষ্টা করুন। ফলে আপনি যা প্রস্তুত করবেন তা হবে তথ্য সমৃদ্ধ। এটা নিয়ে আরো ভাবুন, ফলে আপনার বক্তব্য হবে হৃদয় উৎসারিত, এটা হচ্ছে প্রস্তুতির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এতৎসত্ত্বেও বহু বক্তা এই তথ্যকে অবহেলা করে, ফলে তাদের বক্তব্য হয় রসকষহীন।
“আমি শত শত সেলসম্যান ও সেলসওম্যান এবং ক্যানভাসার ও ডেমোনেস্ট্রেটরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি” বলেছেন আর্থার ডান এবং আমি তাদের মধ্যে যে মূল দুর্বলতা দেখেছি তা হচ্ছে তারা তাদের দ্রব্য যা অন্যের কাছে বিক্রি করতে চান, সে দ্রব্যটি সম্পর্কে সূক্ষ্মরূপে জানেন না এবং জানার প্রয়োজনও বোধ করেন না, জানার আগেই তা-বিক্রি করার জন্য ছোটেন।
বহু বিক্রয় প্রতিনিধি আমার দপ্তরে এসেছেন এবং জিনিস সম্পর্কে সামান্য বিবরণ দিয়ে, বিক্রির কথা বলে, বিক্রি করার চেষ্টা করে তারা চলে যেতে চেয়েছেন। এ ধরনের বিক্রির প্রতিনিধিদের অনেকে এক সপ্তাহ এবং এমনকি কেহ ৪৮ ঘণ্টার বেশি চাকুরি করার উপযোগী বলে আমার মনে হয় নি। ক্যানভাসার ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের, বিশেষ করে খাদ্য সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ করে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করি এবং আমি তাদের সেভাবেই শিক্ষার ব্যবস্থা করি। আমি তাদের মার্কিন কৃষি দপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত খাদ্য তালিকা অধ্যয়ন করতে বাধ্য করি। কারণ এতে কোনো খাদ্যে কী পরিমাণ পানি, দেহসার, অঙ্গার, অম্লজান চর্বি এবং ক্র্যাশ আছে তার বর্ণনা আছে। যে সব উপাদান দিয়ে তাদের বিক্রি যোগ্য পণ্য তৈরি তা সম্পর্কে জানতে আমি তাদের বাধ্য করি। আমি তাদের বাধ্য করি এসব দ্রব্য সম্পর্কে জানাত, স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা পাশ করে আসতে। আমি তাদের বাধ্য করি এসব দ্রব্য অন্যান্য বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে বিক্রি করতে। শ্রেষ্ঠ বিক্রয় প্রতিনিধিকে আমি পুরস্কৃত করি।
আমি অনেক সময় দেখেছি, অনেক বিক্রয় প্রতিনিধি প্রথমদিকে পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে অধৈর্য হয়ে পড়তেন। তাঁরা বলেছেন”একজন খুচরা মুদি দোকানদারের কাছে এসবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার সময় পাই না। কারণ সে বিক্রির কাজে নিতান্ত ব্যস্ত থাকে। আমি তার কছে দেহসার ও অঙ্গার অম্লজানের কথা বললে সে শোনে না এবং শুনলেও আমি কী বলি তা বুঝতে চায় না।” আমি উত্তর দেই ক্রেতার উপকারের জন্যে আপনার এসবের বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নেই, কিন্তু আপনার নিজ প্রয়োজনে এসব জানা দরকার। আপনি আপনার পণ্যের এ হতে জেড অর্থাৎ আগাগোড়া জানলে আপনার মনে যে ভাবের উদয় হবে তা বর্ণনা করা অসম্ভব। ফলে আপনি এরূপ দৃঢ় মনোভাবের অধিকারী হবেন, আপনার মনোবল এত শক্ত হবে যে, আপনি বিক্রি কাজে কখনো ব্যর্থ হবেন না, পেশায় বিফল হবেন না।
স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির খ্যাতনামী ইতিহাস লেখিকা মিস ইদা, এম, তারবেল এই গ্রন্থকারকে বলেছেন, বেশ কয়েক বছর আগে তার প্যারিস অবস্থান কালে ম্যাককুরস ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা মি. এস, ম্যকাকুর আটলান্টিক ক্যাবল সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখার জন্যে তার কাছে তারবার্তা পাঠান। তারবার্তা পেয়ে তিতি লন্ডন গমন পূর্বক কোম্পানির ইউরোপীয় ম্যানেজারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকার হতে তার নিবন্ধের প্রয়োজনীয় মালমশল্লা ও তথ্যাদি তিনি সগ্রহ করতে সক্ষম হন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তথায় থেমে থাকেন নি। তিনি ক্যাবল সম্পর্কে আরো অধিক তথ্য জানতে আগ্রহী হন। তিনি বৃটিশ জাদুঘরে গিয়ে ক্যাবল পরিদর্শন করেন, ক্যাবলের ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করেন এবং লন্ডনের প্রান্তে গিয়ে ক্যাবল উৎপাদিত কারখানায় উৎপাদন পদ্ধতি পরিদর্শন করেন।
তার ব্যবহারে প্রয়োজন থেকে দশগুণ বেশি তথ্য তিনি কেন সংগ্রহ করেন? তিনি মনে করেন, অতিরিক্ত তথ্য তাকে সংরক্ষিত শক্তি প্রদান করবে তাই তিনি তা সংগ্রহ করেন। কারণ তিনি বুঝতে পারেন যে, সংগৃহীত তথ্য প্রকাশ না করলেও তা একদিন তার কাজে লাগবে, ঐটা হবে সংরক্ষিত জ্ঞান।
এডউইন জেমস কার্টেল আনুমানিক তিন কোটি লোকের সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। এতৎসত্ত্বেও তিনি আমাকে বলেছেন যে, বক্তৃতা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি তার বক্তৃতা নিয়ে যখন চিন্তা করেন তখন দেখতে পান যে অনেক কিছু অব্যক্ত রয়ে গেছে, তখন তার মনে হয় তার বক্তব্যই রয়ে গেছে অসম্পূর্ণ। কেন? যখন দীর্ঘ অভিজ্ঞতা হতে তিনি এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, সুবক্তব্য হচ্ছে ঐটি যে বক্তব্যে থাকে বহু মূল্যবান গোপন তথ্য যা আগে কখনো প্রকাশিত হয় নি, থাকে সংরক্ষিত তথ্য যা বক্তাই আগে কখনো প্রকাশ করতে পারে নি।
সংক্ষিপ্তসার :
(১) যখন কোনো বক্তা মনে প্রাণে কোনো বিষয় বলার জন্যে প্রস্তুত হন তখন তিনি তা প্রকাশের আকাক্ষা অনুভব করেন। এরূপ আকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য হয় ফলপ্রসু। কোনো সুপ্রস্তুত ভাষণ প্রস্তুতিতেই দশ ভাগের নয় ভাগ সুসম্পন্ন হয়ে যায়।
(২) প্রস্তুতি কী? কোনো কাগজে কতিপয় বাক্য লিখে নেয়া? কতিপয় প্রবচন মুখস্থ করা? মোটেই, প্রকৃত প্রস্তুতি হচ্ছে নিজের মন থেকে কিছু ভেবে নেয়া, চিন্তা ধারাকে সুমার্জিত করা, নিজস্ব চিন্তাকে সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে নিয়ে নিজের ভাবকে, চিন্তাকে, সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়াই হচ্ছে প্রকৃত প্রস্তুতি। অন্যের ভাব নিয়ে শুরু করলে সাফল্যের পরিবর্তে আসে ব্যর্থতা। উদাহরণ স্বরূপ নিউইয়র্কের মি. জেকসনের কথা ধরা যেতে পারে। তিনি ফররেস ম্যাগাজিনের নিবন্ধ দিয়ে শুরু করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে নিবন্ধকেই শুরু হিসাবে ধরে নিয়ে যখন নিজের মনের চিন্তা প্রকাশ করেন বক্তৃতায়, তখন তিনি অর্জন করেন সাফল্য।
(৩) বসে বসে শুধুমাত্র ত্রিশ মিনিট সময়ে কোনো বক্তৃতা তৈরি করার চেষ্টা করবেন না। বক্তৃতা মাংস বা মাছের ফালির মতো রন্ধন করার সামগ্রী নয়, এটা তৈরি করতে হবে। সপ্তাহের প্রথম দিকে আপনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করুন, অতঃপর সকল মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করুন, ভাবুন, ধ্যান করুন, ঘুমে স্বপ্ন দেখুন। বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন।এটাকে আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত করুন। এটা সম্পর্কে যত প্রশ্ন মনে জাগে মনে-মনে তার উত্তরও অনুসন্ধান করুন। আপনার মনে যত প্রশ্ন জাগবে এবং আপনি যত প্রশ্নের উত্তর পাবেন তা কাগজে নোট করে নিন। স্নানাহার কালে, পথ চলতে, খাবার টেবিলে অপেক্ষাকালে অর্থাৎ সকল মুহূর্তে আপনার মনে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে যত ভাব আসবে, সুপারিশ বা উদাহরণ পড়বে তা লিখে রাখুন। এটা ছিল লিংকনের পদ্ধতি; এবং এটা অধিকাংশ সফল বক্তার বক্তৃতার প্রস্তুতির অনুসৃত পন্থা।
(৪) কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে অধ্যায়ন করার পর আপনি লাইব্রেরিতে গিয়ে সেই বিষয়টি সম্পর্কে অধ্যয়ন করুন। গ্রন্থাগারিককে আপনার প্রয়োজনের কথা বলুন। আপনার নির্দিষ্ট বিষয়ে সে আপনাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন। মুক্তমনে স্বাধীন চিন্তার পর অধ্যয়ন হতে প্রাপ্ত তথ্য ভিত্তিক প্রণীত ভাষণ হৃদয়গ্রাহী হয়।
(৫) আপনি যে তথ্য ব্যবহার করতে ইচ্ছুক তার চাইতে বেশি তথ্য সংগ্রহ করুন, লুবার বুরবাকের কথা স্মরণ করুন। তিনি লাইলাক চারা জন্মাতেন, যার মধ্যে দু একটি হত অত্যন্ত ভালো। এক শত চিন্তা একত্রিত করুন, নব্বইটি হেঁটে ফেলে দশটি রাখুন।
(৬) সংরক্ষিত শক্তি অর্জনের উপায় হচ্ছে প্রয়োজনাতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ এবং এসব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জেনে রাখা। বক্তৃতা প্রস্তুত কালে আর্থার জন যে পদ্ধতিতে তার বিক্রয় প্রতিনিধিদের খাদ্যবস্তু সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন সে পদ্ধতি অনুরসণ করুন। আটলান্টিক ক্যাবল সম্পর্কে নিবন্ধ রচনায় ইহা তারবেল যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন না অনুরসণ করুন।
০৩. খ্যাতনামা বক্তাগণ কীভাবে তাঁদের ভাষণ প্রস্তুত করতেন
আমি একদা নিউইয়র্ক রোটারি ক্লাবের একটি মধ্যাহ্ন ভোজে উপস্থিত ছিলাম, যেখানে প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তার সরকারি পদ তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল এবং আমরা আনন্দের সথে তার বক্তব্য শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। তিনি আমাদের তার নিজস্ব বিভাগ সম্পর্কে বলার প্রতিশ্রুতি দেন এবং নিউইয়র্কের সকল ব্যবসায়ীই এই বিভাগ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন।
তিনি তার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানতেন। তিনি যে কাজ করতেন, জানতেন তার চাইতে বেশি। কিন্তু তিনি তার বক্তৃতা সম্পর্কে কোনো পরিকল্পনা করেন নি। তিনি তার বক্তব্য কীভাবে পেশ করবেন তাও ঠিক করেন নি। তার বক্তব্যের মূল পয়েন্টগুলোও তিনি সাজিয়ে নেন নি। অধিকন্তু অনভ্যাস ও অনভিজ্ঞতা হেতু তিনি সেদিন অন্ধভাবেই বক্তৃতা করতে শুরু করেন। তিনি জানতেন না কোথায় গিয়ে তার বক্তব্য শেষ হবে। তবু তিনি শুরু করেন।
স্বল্প কথায় বলতে গেলে, তখন তার মনে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলো বিধায় তিনি যা বলেন তা আমাদের কাছে হয় খিচুড়ি-সদৃশ্য। তিনি প্রথমে পরিবেশন করেন আইসক্রিম। অতঃপর পরিবেশন করে সুপ! এর পর আসে মাছ ও ও বাদাম। পরিশেষে আসে সুপ ও আইসক্রিমের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ মিক্সচার এবং লবণাক্ত মাছ। আমি কখনো কোথাও অথবা কোনো সময়ে কোনো বক্তাকে এরূপ পুরোপুরি বিভ্রান্ত হতে দেখি নি।
তিনি তখন যেমন তেমন ভাবে কিছু বলে আমাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হওয়ায় তিনি পকেট থেকে এক তাড়া চিঠি বের করেন এবং বলেন যে, তার সেক্রেটারি তার জন্যে এগুলি তৈরি করেছেন। তবে তার বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে কেহ কোনো প্রশ্ন করে নি। চিঠিগুলোও এমন এলোমেলো ছিল যে, এগুলো যেন একটি ফ্লাট গাড়িতে ছড়িয়ে রাখা লোহার টুকরো। তিনি এগুলো অসহায়ভাবে হাতড়িয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা দেখে গভীর অরণ্যানী হতে কিছু উদ্ধার করে নিজেকে শক্ত করে নিজেকে কিছু বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার বক্তব্য হয়ে পড়ে সামঞ্জস্যহীন, অর্থহীন অরণ্যেরোদন সদৃশ্য। তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কিছু বলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি ক্ষমা চেয়ে পানি চান, কম্পিত হাতে গ্লাস নিয়ে সামান্য পানি পান করে আবার কয়েকিট অসংলগ্ন বাক্য বলে তার চিঠির জঙ্গলের মাঝে মনোনিবেশ করেন। মুহূর্তের পর মুহূর্তে তিনি আরো অধিকতর অসহায় পড়ে পড়তে থাকেন, হতাশ হতে থাকেন, হতবুদ্ধি হতে থাকেন এবং হন অধিকতর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তার কপালে দেখা দেয় ফোঁটা ফোঁটা স্বেদ বিন্দু যা মুছে তার রুমাল হয়ে যায় পূর্ণসিক্ত, যেন চোখের জলে তা ভিজে গেছে। দর্শকের আসনে বসে আমরা তার জন্যে পরম করুণা,অনুভব করতে থাকি, তার প্রতি জাগে আমাদের অন্তরের সহানুভূতি। আমরা নিজেরাও তখন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও বক্তা বেশরম ও লোচ্চার মতো তার চিঠি দেখে এলোমেলো বক্তৃতা করতে থাকেন। ক্ষমা চেয়ে ও পানি পান করে পেশ করতে থাকেন অর্থহীন বক্তব্য। তিনি ছাড়া সকলেই দেখতে পান যে, চোখ হতে তার চশমা পড়ে যাচ্ছে। চশমা পড়ে ভেঙ্গে গেলে তিনি বসে পড়েন, আমরা অর্থহীন বক্তব্য শোনা থেকে লাভ করি অব্যাহতি। সেদিন আমি হয়ে ছিলাম সবচেয়ে দুর্ভাগ্য শ্রোতা এবং আমি জীবনে কখনো এরূপ লজ্জাহীন হতবুদ্ধি বক্তার সাক্ষাৎ পাই নি। রুশোর মতো দৃঢ় মনোভাব নিয়ে দাঁড়ালেও কী বলতে চান তা তিনি নিজে জানতেন না এবং কী বলে শেষ করেছেন অথবা তিনি কী বলেছেন তাও তিনি নিজেই জানেন না। এই গল্পের নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে এই যখন কোনো মানুষের জ্ঞান যথোপযুক্ত ভাবে সঞ্চিত থাকে না, বলেছেন হারবার্ড স্পেন্সর, “অধিক জ্ঞানী হলেও তার চিন্তা ধারা দ্বিধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।“
কোনো বিবেকবান লোকই পরিকল্পনা ছাড়া গৃহ নির্মাণ শুরু করেন না, কিন্তু এই লোকটি কেন কোনোরূপ রুপরেখা ছাড়া বা পরিকল্পনা ছাড়া বক্তৃতা শুরু করেছিলেন।
বক্তৃতা হচ্ছে একটি উদ্দেশ্যমূলক সমুদ্র যাত্রা যার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। যে ব্যক্তির শুরুর ঠিক থাকে না তার সমাপ্তির ঠিকানাও পাওয়া যায় না।
আমরা ইচ্ছা যে, আমি নেপোলিয়নের একটি সুবিখ্যাত উক্তিকে বিশ্বের সর্বত্র বক্তৃতা শেখার সকল প্রতিষ্ঠানের দেয়াল-গাত্রে বড় বড় হরফে লাল অক্ষরে খোদিত করে রাখি। নেপোলিয়নের সেই প্রখ্যাত উক্তি হচ্ছে”যুদ্ধ কৌশল হচ্ছে একটি বিজ্ঞান, সুচিন্তিত পদ্ধতিতে যথাযথ হিসাব প্রণয়ন করা না গেলে এতে জয়লাভ অসম্ভব।”
বক্তব্য শিক্ষা সম্পর্কেও এই বক্তব্য সত্য। কিন্তু বক্তারা কি এটা উপলেিব্ধ করেন অথবা যা চিন্তা করেন, তারা কি সব সময় সে ভাবে কাজ করেন? তাঁরা তা করেন না। তারা তা প্রয়োজন মনে করেন না। কেহ কেহ এই সম্পর্কে বহু পরিকল্পনা করেন, কিন্তু তাতে সফলতার নিশ্চয়তা নেই।
কোনো আদর্শ প্রচারের ফলপ্রসু, গ্রহণযোগ্য ও সর্বোত্তম পন্থা কী এ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণের আগে কেহই তা বলতে পারেন না। এটা সব সময়ে নতুন সমস্যা। বক্তার মনে জাগে নতুন-নতুন প্রশ্ন। খুঁজে পান নতুন-নতুন জবাব। বক্তার বিষয় সাজানো সম্পর্কে প্রচলিত কোনো নিয়ম বা আইন কানুন নেই। বক্তা নিজেই ইচ্ছানুযায়ী তা সাজিয়ে নিতে পারেন, প্রকাশ করতে পারেন।
একটি পুরস্কার বিজয়ী বক্তৃতা কীভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিলো?
এখানে কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব রিয়েল স্ট্রেট বোর্ড সমীপে প্রদত্ত একটি ভাষণের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ভাষণটি অপর ২০টি শহর সম্পর্কে প্রদত্ত ভাষণের মধ্যে প্রথম পুরস্কার লাভ করে। এবং আজো এটি সেরূপ মূল্যবান। এই ভাষণটি ছিল তথ্য বহুল, সুচিন্তিত। পরিষ্কার ভাবে, সংক্ষিপ্ত আকারে কিন্তু আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে পেশকৃত ভাষণ। এটি ছিল উদ্দীপনাময়, সাবলীল। এটা পাঠ ও অধ্যয়ণের জন্যে খুবই আকর্ষণীয়।
মি. চেয়ারম্যান ও বন্ধুগণ–
আজ হতে ১৪৪ বছর আগে আমার নগর ফিলাডেলফিয়ার এই মহান জাতি, আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম। সুতরাং এরূপ একটি মহান জাতির জন্মদানের ঐতিহাসিক রেকর্ডের অধিকারী শহরের প্রাণ শক্তি ও সেই মহান জাতির মতো উদ্দীপনাময় ও শক্তিশালী। আমার শহরে আজ শুধুমাত্র আমেরিকার একটি শিল্প সমৃদ্ধ শহর নয়। সারা বিশ্বের সুন্দরতম শহরগুলোর অন্যতম।
ফিলাডেলফিয়ার জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় বিশলাখ এবং আমাদের এই শহরের আয়তন হচ্ছে মিলোকী ও বোস্টান, প্যারিস ও বার্লিনের যোগফলের সমান। আমাদের এই শহরে ১৩০ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ৮.০০০ একর উর্বর ভূমি পার্ক স্কোয়ারও উদ্যান পথ নির্মাণের জন্য আমরা ছেড়ে দিয়েছি। সুতরাং আমাদের জনগণ অবসর বিনোদনের জন্যে উপযুক্ত উদ্যান ও বাগান পাচ্ছে, পাচ্ছে বিশুদ্ধ বাতাস, স্বচ্ছ ও সাবলীল আবহাওয়া। প্রত্যেকটি আমেরিকানই এই অধিকারে অধিকারী।
বন্ধুগণ। ফিলাডেলফিয়ার শুধুমাত্র একটি পরিষ্কার ও সুন্দর শহর নয়। একটি বিশ্বের বৃহত্তম কারখানা বলেও পরিচিত। এই শহরের ৯২০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৪ লাখ লোক কর্মরত, তাই এটি আজ বিশ্বের করখানায় একশত হাজার ডলার মূল্যের ব্যবহার্য পণ্যাদি উৎপাদিত হয়। একজন খ্যাতনামা সংখ্যাতাত্বিকের হিসেব মতে ফিলাডেলফিয়া ছাড়া এই দেশের অন্য কোনো শহরে সমপরিমাণ উলের দ্রব্য, বস্ত্র, বয়ন শিল্প, ফেল্টহ্যাট, লৌহজাত দ্রব্য, টুলস, স্টোরেজ, ব্যাটারি, ইস্পাতের জাহাজ এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি উৎপাদিত হয় না। রাতদিনের প্রতি দু’ঘণ্টায় আমরা একটি করে রেলের লোকোমোটিব ইঞ্জিন তৈরি করি, এবং এই দেশের জনতার অর্ধাংশের বেশি যে সব গাড়িতে চড়েন তা এই ফিলাডেলফিয়া শহরে নির্মিত। প্রতিমিনিটে আমরা হাজার-হাজার শ্লিপার উৎপাদন করি, গতবছর আমরা আমাদের ১১৫টি, হোসিয়ারী কারখানায় দেশের প্রতিটি পুরুষ, শিশুর জন্যে দু’জোড়া করে মোজা তৈরি করছি। আমাদের তৈরি কার্পেট ও কম্বলের পরিমাণ হচ্ছে গ্রেটব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডে উৎপাদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি এবং আমাদের মোট বাণিজ্যিক ও শিল্প লেনদেন এত বেশি যে, গত বছর ব্যাঙ্ক সমূহে ৩৭ শত কোটি ডলার লেনদেন হয়েছে।
কিন্তু বন্ধুগণ, আমরা যেমন আমাদের শিল্প সমৃদ্ধির জন্যে গৌরবানুভব করি, তেমনি আমরা গৌরব বোধ করি আমাদের শহরটি চিকিৎসা, সাহিত্য ও শিক্ষা কেন্দ্র বলে। কিন্তু আমাদের সব চাইতে বেশি গৌরবের বিষয় হচ্ছে আমাদের শহরের গৃহসংস্থান ব্যবস্থা। আমাদের ফিলাডেলফিয়া শহরে তিন লাখ ১৭ হাজার আলাদা বাড়ি রয়েছে এবং এই বাড়িগুলোকে গড়ে ২৫ ফুট ধরে পাশাপাশি এক সারিতে দাঁড় করালে কানসাস শহরের এই সম্মেলন হল অতিক্রম করে ১৮১ মাইল দূরে অবস্থিত ডেনভার শহর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে।
কিন্তু যে বিষয়টির প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই সেটি হচ্ছে এই শহরে হাজার হাজার ঘরের মালিক শ্রমিক শ্রেণী। সুতরাং তারা সমাজতন্ত্র বা বলশেভিজমের মতো আমাদানি করা রোগে আক্রান্ত নয় এবং কখনো আক্রান্ত হবে না।
ফিলাডেলফিয়া ইউরোপীয় নৈরাজ্যের উপযুক্ত স্থান নয়। কেননা, আমাদের গৃহ, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রকৃত আমেরিকান উদ্দীপনার কেন্দ্রস্থল; কারণ এই শহরেই এই জাতির জন্ম এবং অমরা সেই আমেরিকানদেরই উত্তরাধিকারি। ফিলাডেলফিয়া এই মহান দেশের আমেরিকান স্বাধীনতার ঝর্ণা এই শহর হতেই প্রবাহিত। এটি সে শহর যে শহরে প্রথম তৈরি হয় মার্কিন পতাকা, এটি সেই শহর যে শহরে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এটি সেই শহর যেখান হতে উত্থিত হয়েছিল প্রথম স্বাধীনতার ধ্বনি, বেজেছিল স্বাধীনতার ঘণ্টা যা আজো লাখো লাখো জনতাকে, আমেরিকার পুরুষ নারী শিশু আবালবৃদ্ধবনিতাকে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের মিশন হচ্ছে পবিত্র মিশন, যা শুধুমাত্র কল্প পূজা নয়, আমেরিকান মূলনীতি প্রচার এবং স্বাধীনতার বাতি প্রজ্বলিত রাখা যাতে ওয়াশিংটন, লিংকন ও থিওডর রুজভেল্টর সরকার সকল মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু মানব সমাজকে করতে পারে অনুপ্রাণিত।
আসুন আমরা এই বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি, আসুন আমরা দেখি কীভাবে এটি প্রণীত হয়েছিল। শ্রোতাদের উপর এটা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিল।
প্রথমে আমরা দেখবো শুরু এবং শেষ? এটি এমনভাবে শুরু করা হয় এবং শেষ করা হয় যা অন্যরা সহজে চিন্তা করতে পারে নি? বন্য হাঁস যেভাবে পাখায় ভর করে উড়ে চলে এবং আবহাওয়া পরিবর্তনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সাবলীল গতিতে উড়ে যায় এই বক্তৃতাটাও ঠিক সেভাবে শেষ করা হয়েছে, এতে কোথাও বাধা আসে নি।
এই বক্তব্যে নতুনত্ব আছে, ব্যক্তিত্ব আছে, তাঁর নিজ শহর সম্পর্কে কিছু বলেই বক্তৃতা শুরু করেন। যা অন্যান্য বক্তারা পারেন নি, তিনি বলেন যে, তাঁর শহরই সমগ্র জাতির জন্মস্থান।
তিনি বলেন যে, এটা সারা বিশ্বের বৃহত্তম এবং সুরন্দরতম শহরগুলোর একটি। কিন্তু এই দাবি সাধারণ, গতানুগতিক। সুতরাং এই বক্তব্যে অন্যের মন আকর্ষণ করে না, অন্যেকে প্রভাবিত করে না, বক্তা এটা জানতেন তাই তিনি শ্রোতাদের প্রভাবিত করার জন্যে ফিলাডেলফিয়ার আকার বর্ণনা কালে বলেন এই শহরটি মিলাউঁকি, রোস্টার, প্যারিস ও বার্লিনের সম্মিলিত আকারের সমান। এটি একটি বিশিষ্ট উদাহরণ, এটি আকর্ষণীয়। একটি বিশেষ উল্লেখ্য বিষয়। পৃষ্ঠাব্যাপী সংখ্যাতত্ত্ব যা করতে পারতো না, এই একটি বাক্য শ্রোতাদের প্রভাবিত করে।
পরবর্তী বিষয়টি হচ্ছে বক্তার ঘোষণা। তিনি বলেন ফিলাডেলফিয়া বিশ্বের কারখানা বলে সর্বত্র পরিচিত ”এতে অতিকথন আছে, তাই নয় কি?” এটা প্রপাগান্ডার মতো, তার সাথে তিনি পরবর্তী পয়েন্ট যোগ না করলে কোনো শ্রোতার মনেই প্রত্যয় জন্মাত না। সুতরাং তিনি ফিলাডেলফিয়ার উৎপাদিত পণ্যের হিসাব পেশ করেন। তিনি বলেন, উলের দ্রব্য, চামড়া জাত দ্রব্য, বস্ত্র, বয়ন শিল্প, ফেন্টহ্যাট, লৌহজাতদ্রব্য, টুলস, স্টোরেজ, ব্যাটারি, ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণে ফিলাডেলফিয়া বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
পরবর্তী বিষয়গুলোও কি প্রপাগান্ডা? প্রচারণা? দিন রাতের প্রতি দুঘণ্টায় ফিলাডেলফিয়ায় একটি করে লোকামোটিভ ইঞ্জিন তৈরি হয় এবং প্রতি দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এই শহরে তৈরি গাড়িতে চড়ে।
“এই তথ্য আমাদের জানা ছিল না, আমরা ভাবি, “গতকাল আমি যে গাড়িতে চড়েছি সেটিও সম্ভবত এই শহরে তৈরি, আমি কাল অনুসন্ধান করব, আমরা শহরে যে সব গাড়ি চলে সেগুলো কোথাকার তৈরি।”
“প্রতি মিনিটে হাজার সিগার।–এই দেশের প্রত্যেক পুরুষ, নারী শিশুর জন্যে দু’জোড়া করে মোজা।
এর দ্বারা আমরা আরো অভিভূত হই–আমার প্রিয় সিগার হয়তো ফিলাডেলফিয়ার প্রস্তুত আমার পায়ের মোজা হয়তো সেই শহরে তৈরি।
এরপর বক্তা কী করলেন। তিনি ফিলডেলফিয়ার সাইজ সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছিলেন সেই সাইজ বর্ণনায় ভুলে যাওয়া পয়েন্ট নিয়ে কী পুনরায় আলোচনা শুরু করলেন? না মোটেও না।
তিনি তার বক্তব্য পেশ কালে কোনো পয়েন্ট ফেলে গেলে পরবর্তী পয়েন্ট বলে আবার পূর্ববর্তী পয়েন্টে যাবেন, ভুলে যাওয়া বিষয় পুনরাবৃত্তি করবেন, তেমন বক্তা তিনি নন। এ জন্য আমরা এমন বক্তার কাছে কৃতজ্ঞ। যে বক্তা একটি বিষয় বলতে গিয়ে আর একটি বিষয় বলেন, বক্তব্য পেশকালে এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে কোনো বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করেন তিনি কখনো কি সহজ ভাবে শ্রোতা মন জয় করতে পারবেন? না পারেন না। তবুও বহু বক্তা এরূপ পুনরাবৃত্তি করেন। তার বলার পয়েন্টকে১,২,৩,৫ এভাবে বলে শেষ না করে ২৭, ৩৪, ১৯, ২ এভাবে এগিয়ে নেন, এটা ভালো বক্তব্য বা বক্তৃতা নয়। তার বক্তব্য হয় ২৭, ৩২,২৭, ১১, ২, ৩৪, ১৭,এইভাবে এলোমেলো যা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করে না, মোহিত শ্রোতা হয় না উদ্দীপ্ত।
কিন্তু এই বক্তা নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট গতিতে তার বক্তব্য পেশ করেন, কখনো পুনরাবৃত্তি করেন না, থামেন না, ডানে বা বামে হেলেন না। লোকোমোটিভের মতো সোজা পথেই তিনি বলে চলেন তার কথা।
তবে তাঁর বক্তৃতায় একটি দুর্বলতম পয়েন্ট প্রকাশ হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ফিলাডেলফিয়া এই দেশে একটি বৃহত্তম চিকিৎসা, সাহিত্য, ও শিক্ষাকেন্দ্র এটা বলে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান, মাত্র বারোটি শব্দে একথাটি বলেন, কিন্তু ব্যাখ্যা করেন না। ৬৫টি বাক্যের মধ্যে মাত্র বারোটি বাক্য। সুতরাং এটি অস্পষ্ট। এর দ্বারা তার বক্তব্য প্রমাণিত হয় না। কেননা মানুষ এটার দ্বারা এই দাবির যৌক্তিকতা বুঝতে পারে না। তিনি এটির উপর এত অল্প সময় দেন যে, মনে হয়, তিনি নিজেও বিষয়ে নিঃসন্দেহ নন, সুতরাং তার এই কথায় কেহই প্রভাবিত হয় না, অনুপ্রণিত হয় না। অতঃপর তিনি কী করেন? ফিলাডেলফিয়া বিশ্বের কারখানা একথা প্রমাণ করার জন্যে তিনি যে যুক্ত দেখিয়েছেন সেরূপ যুক্তি দিলে তিনি এটা প্রমাণ করতে পারতেন। তিনি তা জানতেন। তিনি আরো জানতে যে, এই প্রতিযোগিতায় তার হাতে আর মাত্র পাঁচমিনিট সময় আছে। এর এক সেকেন্ডও বেশি নেই। সুতরাং তাকে হয়তো এই পয়েন্ট অস্পষ্ট রাখতে হবে নতুবা অন্য পয়েন্ট বাদ দিতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য শহর হতে ফিলাডেলফিয়ার ব্যক্তি মালিকানায় বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি, তিনি বলেন। তিনি কীভাবে তাঁর এই বক্তব্যকে যুক্তি গ্রাহ্য করেন? প্রথমত তিনি এর সংখ্যা বলেন ৩,৯৭,০০০, দ্বিতীয়ত তিনি বলেন, “এই ঘরগুলির প্রত্যেকটিকে ২৫ ফিট ধরে একটি এককে পর পর সাজালে তা ফিলাডেলফিয়া হতে এই কানসাস শহরের সম্মেলন কক্ষ অতিক্রম করে ১৮১ মাইল দূরে অবস্থিত ডেনভার শহরে পৌঁছবে।
তার শ্রোতারা সম্ভবত এই বাক্য শেষ হবার আগে তার দেয়া ঘরের সংখ্যা ভুলে গিয়েছিলেন। ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়! সুতরাং তারা চিন্তা করছিলেন তাঁর শেষ বাক্য যা তাদের মনকে করেছিল মোহিত।
তাঁর বক্তব্য কখনো-কখনো অর্থহীন হয়ে পড়লেও তিনি আবার উস্কানিতে পরিণত করতে সক্ষম ছিলেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকেরাই এ সব বাড়ির মালিক, তারা ”আমদানি করা সমাজতন্ত্র বা বোলশেভিজমের শিকার নয়,“ “ফিলাডেলফিয়াই হচ্ছে আমেরিকার স্বাধীনতার প্রশ্রবণ” “স্বাধীনতা। ম্যাজিকের মতো শব্দ এটি। এই শব্দ উচ্চারিত হলে সকল মানুষই হয় উদ্দীপ্ত। উক্তিটা এমন একটি শব্দ, এমন একটি অনুভূতি, যার জন্যে প্রাণ দিয়েছে লাখোলাখো লোক। এই স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পুনরুল্লেখ করে তিনি যখন বলেন, “এটি সেই শহর যেখানে আমেরিকার পতাকা প্রথম নির্মিত হয়; এটি সেই শহর যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এটি সেই শহর যেখানে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র স্বাক্ষরিত হয়। মুক্তি ঘন্টা, পবিত্র মিশন, আমেরিকার মূলমন্ত্র প্রচার, স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগ্রত রাখা, ওয়াশিংটন, লিংকন, থিওডোর রুজভেল্টের সরকারের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা জনমনে করতে হবে সঞ্চারিত, এটা তখন চরমে পৌঁছে, শ্রোতারা হন বিমোহিত, উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত।
বক্তা তাঁর এই বক্তব্যটি আপনার মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রণয়ন করেছিলেন এবং শ্রোতা সমীপে পেশকালেও তিনি তাতে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। এই কারণেই তার এই বক্তৃতা শ্রোতাদের কাছে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়। এতে অনেক দুর্বল পয়েন্ট, দুর্বল দিক থাকা সত্ত্বেও বক্তার বক্তৃতা পেশের কৌশল এটাকে একটি শ্রেষ্ঠ বক্তৃতায় পরিণত করে। এই বক্তৃতা শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করতে, অনুপ্রাণিত করতে, তন্ময় করতে, বিমোহিত করতে সক্ষম হয়। ফলে এই বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়, শিকাগো কাপ পুরস্কার লাভ করে।
ডক্টর কনওয়েল যেভাবে বক্তৃতা তৈরি করতেন :
বক্তৃতা প্রণয়নের কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম কানুন প্রচলিত নেই, তা আমি আগে বলেছি। এর কোনো ডিজাইন বা স্কীম অথবা চার্ট নেই বা বক্তারা অনুসরণ করতে পারেন। তবু বিভিন্ন বক্তা যে সব নিয়ম অনুসরণ করেছেন তা অনুকরণ করলে কিছুটা উপকার হতে পারে।
খ্যাতনামা লেখক প্রয়াত ডক্টর রাসেল এইচ, কনওয়েল বক্তৃতা প্রণয়নে যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন এ প্রসঙ্গে তা বলছি। একদা তিনি আমাকে তার খ্যাতনামা বক্তৃতা প্রণয়নের রূপরেখা বলেন। তা নিম্নরূপ–
(১) তথ্য প্রকাশ করা।
(২) এর ভিত্তিতে যুক্তি প্রদর্শন।
(৩) অতঃপর কাজের জন্য আহ্বান জানানো।
বহুলোক এই পরিকল্পনাকে নিজেদের জীবনে অত্যন্ত ফলপ্রসু ও উপকারী বলে বর্ণনা করেছেন।
(১) যেটা ভুল সেটা প্রকাশ কর।
(২) এর প্রতিকারের পথ বল।
(৩) প্রতিকারে সহযোগিতা কামনা কর।
অথবা এটিকে অন্যভাবে বলা যায় :
(১) বর্তমানে এই অবস্থা বিদ্যমান যার প্রতিকার প্রয়োজন।
(২) আমরা এই বিষয়ে এই করতে চাই।
(৩) সুতরাং যেই কাজে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এই কাঠামোকে নিম্নলিখিতভাবে গ্রহণ করা যায় :
(১) শ্রোতাদের নিজের বক্তব্যের প্রতি আকর্ষিত করুন।
(২) তাদের আস্থা অর্জন করুন।
(৩) তথ্য প্রকাশ করুন, আপনার প্রস্তাব সম্পর্কে তাদের অবহিত করুন।
(৪) তাদের প্রতি কাজের বা সহযোগিতার আবেদন করুন।
খ্যাতনামা ব্যক্তিরা কীভাবে বক্তৃতা তৈরি করতেন :
প্রাক্তন সিনেটর আলবাট জে, বেভারিজ ‘দি আর্ট অব পাবলিক স্পিকিং’ নামে একটি ক্ষুদ্র বই লিখেছেন। বইটি ছোট হলেও বক্তৃতা শেখার ব্যাপারে অত্যন্ত ফলপ্রসু। ”বক্তাকে তার বিষয়ে মাস্টার হতে হবে, বলেছেন এই খ্যাতনামা রাজনীতিক।“ এর অর্থ হচ্ছে এই যে সকল তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সাজাতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে, হজম করতে হবে, শুধুমাত্র একদিকের তথ্য নহে বিষয়টির ভালোমন্দ সকল দিকের তথ্য নিয়েই এরূপ করতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে যে, যা সংগ্রহ করা হয়েছে তা বাস্তব তথ্য, ধারণা প্রসূত তথ্য নয়, অথবা শোনা ঘটনা নয়। সত্যতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে হবে।
সুতরাং প্রতিটি আইটেম চেক করতে হবে। পরীক্ষা করে নিতে হবে। এর-অর্থ নিশ্চিত হবার জন্যে কষ্টকর গবেষণা কাজ চালাতে হবে। তা হলে এর থেকে কী পাওয়া যাবে? আপনি কী জনগণকে তথ্য প্রদান, নির্দেশ দান এবং উপদেশ দিতে যাচ্ছেন না? আপনি কী নিজেকে একজন কর্তৃপক্ষ বলে তাদের সামনে পেশ করতে চাচ্ছেন না?
যে কোনো সমস্যার তথ্যাদি নিয়ে পর-পর সাজান, এগুলো নিয়ে নিজে নিজে চিন্তা করে সমাধান বের করুন। তাহলে আপনার বক্তব্যে স্বকীয়তা থাকবে, শক্তি থাকবে। নিজস্ব চিন্তায় আপনার মনে যা উদয় হবে তাই সাজিয়ে লিখে নিন, এই স্বকীয় বক্তব্য হবে শক্তিশালী আকর্ষণীয় বক্তৃতা।
অন্য কথায়, উভয় দিকের তথ্য তুলে ধরুন। অতঃপর সমস্যাদির সমাধান সম্পর্কে নিজ চিন্তা প্রসূত বক্তব্য পেশ করুন।
‘আমি শুরু করি’, বলেছেন উড্র উইলসন, তার অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে, কতগুলো বিষয়ের তালিকা নিয়ে, সেগুলো সম্পর্কে আমি বলতে চাই, এবং আমি সেগুলোকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুযায়ী আমার মনের মধ্যে পর-পর সাজিয়ে নিই। অর্থাৎ আমি বিষয়গুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে নিই যাতে একটার সাথে অন্যটার বিষয়বস্তুগুলোর অমিল বা বৈসাদৃশ্য না হয়। অতঃপর আমি সেগুলো সঁট লিপিতে চিট করে নেই। আমি সঁট লিপিতে চিট করতে অভ্যস্ত। কেননা এতে সময়ের অপচয় হয় না। অতঃপর আমি এগুলো টাইপ করে নেই। প্রবচন বদলাই, বাক্য শুদ্ধ করি, চিন্তা করে করে নতুন নতুন বিষয় যোগ করি।
থিওডর রুজভেন্ট রুজভেলিটান পদ্ধতিতেই তার বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। তিনি সকল তথ্য সংগ্রহ করতেন, অতঃপর তা পর্যালোচনা করতেন, পর্যবেক্ষণ করতেন, ব্যাখ্যা করতেন, পরিশেষে তিনি বিষয়টি নিয়ে উপসংহারে উপনীত হতেন, চূড়ান্তভাবে বিষয়টির মীমাংসা করে নিতেন।
অতঃপর চিট সমূহ সামনে নিয়ে বসে তিনি তাঁর বক্তৃতার ডিকটেশান এত দ্রুত দিতেন যে, তিনি মনে করতেন ডিকটেশন দ্রুত হলে তার বক্তব্য হবে স্বতঃস্ফুর্ত ও জীবন্ত।
অতঃপর তিনি টাইপ কপি নিয়ে তা সংশোধন সংযোজন করতেন, কখনো নতুন শব্দ বাক্য যোগ করতেন, বাদ দিতেন। পেন্সিলের দাগে পৃষ্ঠা পূর্ণ হয়ে গেলে তিনি আবার তা ডিকটেট করতেন। কঠোর পরিশ্রম ছাড়া আমি কখনো কিছু লাভ করি নি, বলেছেন থিওডর রুজভেন্ট, ‘পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বক্তৃতা প্রণয়ন সব কাজেই আমি সব সময় কঠোর পরিশ্রম করি। তা অনেক আগে থেকেই আমি কাজ শুরু করি।”
অনেক সময় তিনি সমালোচকদের ডেকে পাঠাতেন এবং তারে কাছে তাঁর বক্তব্য পাঠ করতেন, কিন্তু তার সম্পর্কে কোনোরূপ বিতর্কে অংশ নিতেন না।
কারণ তিনি তাঁর বক্তব্য সম্পন্ধে মন স্থির করে নিয়েছেন, তিনি কী বলবেন সে সম্পর্কে কোনো পরামর্শ চাইতেন না, কীভাবে বলবেন সে সম্পর্কেই পরামর্শ চাইতেন। টাইপ করা অনুলিপি তিনি বার বার পড়তেন, কাটতেন, শুদ্ধ করতেন, উন্নত করতেন, এই বক্তব্য সংবাদপত্রে ছাপা হত। অবশ্য তিনি তার এই বক্তব্য মুখস্থ করতেন না। তিনি মৌখিকভাবেই বক্তৃতা করতেন। সুতরাং তিনি যে বক্তৃতা দিতেন যা সংবাদ পত্রের প্রকাশিত হত সময়-সময় তার মধ্যে তারতম্য দেখা দিত। কিন্তু ডিক্টেট করা ও সংশোধন করার মধ্যে যে প্রস্তুতি চলতো তা উত্তম প্রস্তুতি। এর ফলে বিষয়বস্তু তার কাছে পরিচিত হয়ে যেত, তার প্রতিটি পয়েন্ট পর পর তিনি স্মরণ রাখতে পারেন। এরই ফলে তিনি তার বক্তব্য সহজে সচ্ছল গতিতে প্রকাশ করতে সক্ষম হতেন।
স্যার অলিভার লজ আমাকে বলেছেন যে, তাঁর বক্তব্য ডিক্টেট করে দ্রুতগতিতে যেভাবে তিনি জনসমক্ষে ভাষণ দেন ঠিক সে পদ্ধতিতে অর্থাৎ সেরূপ স্বরে ডিক্টেট করে তিনি উপলব্ধি করেছেন এটাই হচ্ছে বক্তৃতা প্রস্তুতি অভ্যাসের সর্বোত্তম পন্থা।
বক্তৃতা কোর্সে বহু সংখ্যক ছাত্র ডিক্টাফোনে তাদের বক্তৃতা ডিক্টেট করাকে উজ্জ্বলতম পন্থা বলে উপলব্ধি করে, কেননা এর ফলে তারা তাদের বক্তৃতা আবার নিজেরা শুনতে পায়। সংশোধন করে নিতে পারে। সুতরাং এই পদ্ধতিকে আমিও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি মনে করি।
আপনি যা বলতে চান তা লিখতে বসলে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি চিন্তা করতে বাধ্য হবেন। ফলে আপনার ধারণা আরো পরিষ্কার হবে, স্মরণ থাকবে। আপনার মনের অস্থিরতা কমবে, আপনার চিন্তা ও বলার শক্তি বাড়বে।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার আত্মজীবনীতে কীভাবে তিনি তার রচনাশৈলী, শব্দচয়ন এবং চিন্তাধারাকে সুসজ্জিত সুবিন্যস্ত করতেন তার ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর জীবনের এই কাহিনী পাণ্ডিত্য সাহিত্যপূর্ণ যা অন্যান্য প্রাচীন পাণ্ডিত্যপূর্ণ সাহিত্য কর্মের মতোই সুখপাঠ্য উপভোগ্য। তার এই লেখা অত্যন্ত উন্নতমানের ভাষা ও শব্দ সমৃদ্ধ। যে কোনো হবু লেখক ও বক্তা এটা পড়ে আনন্দ পাবেন, উপকৃত হবেন। আমার মনে হয়, আপনি এটি পড়তে আগ্রহী হবেন, এটি হচ্ছে :
এই সময়ে প্রাচীন পুঁথি স্পেকটেটরের একটি অদ্ভুত খণ্ড আমার হাতে পড়ে। এটি ছিল তৃতীয় খণ্ড। আমি এর আগে বইটির কোনো সংখ্যা দেখি নি। আমি এটি ক্রয় করি এবং বার-বার পড়ে আনন্দ পাই। এর ভাষা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, আমি ভাষার সাথে নিজেকে পরিচিত করতে আগ্রহী হই। এই উদ্দেশ্যে আমি কাগজপত্র নিই, এই বইতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বাক্য সম্পর্কে চিট করতে শুরু করি, কয়েকদিন পর আমি বইটি থেকে নিজের ভাষায় বইটিতে ব্যবহৃত ভাব প্রকাশ করি। এই রচনায় আমার কলমে আনা সব শব্দ আমি ব্যবহার করি। অতঃপর আমি আমার লেখা মূল রচনার সাথে মিলিয়ে নিই, কতিপয় স্থানে আমার ভুল ধরা পড়লে আমি তা সংশোধন করি। এই কাজ করতে গিয়ে কতিপয় নতুন শব্দের সাথে আমার পরিচয় হয় যা আমি স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতে সক্ষম হই। এই আগে আমি কোনো কিছু রচনার কাজে হাত দিলে অবশ্যই আমি এ ধরনের নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হতে পারতাম, কিন্তু এক বই অনুসরণ ছাড়া অন্য কিছু রচনা করলে এভাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এই ঘটনার পর আমি বইটি হতে কতিপয় গল্প সংগ্রহ করি। একই পদ্ধতিতে সেগুলি সম্পর্কে নোট করি। অতঃপর তা নিজের ভাষায় রচনা করি, মূল গল্পের সাথে মিলিয়ে সংশোধন করি। এর ফলে আমি আমার চিন্তাকে স্বচ্ছন্দ গতিতে সাজাবার কৌশল শিখতে পারি। এই পদ্ধতি কিছুদিন অব্যাহতভাবে অনুসরণ করার ফলে আমার ভাষাজ্ঞান উন্নত হয়। আমার ভাষা হয় স্বচ্ছন্দ সাবলীল। ফলে আমি ইংরেজি ভাষার একজন উঁচুদরের না হলেও গ্রহণযোগ্য লেখক হয়ে উঠি এবং আকাঙ্ক্ষা ছিল একজন লেখক হওয়া। ধৈর্যের সাথে নিজের নোট পরীক্ষা করুন : আগের পরিচ্ছেদ আপনাকে নোট করতে উপশে দেয়া হয়েছে। আপনার বিভিন্নমুখী ধ্যান ধারণা নোট করার পর সেসব নোট একত্রিত করে ধৈর্যের সাথে তা পরীক্ষা করুন। বিভিন্ন নোটের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি পরপর সাজান। একটি বিষয়ে আপনার মনের যে সব চিন্তা আপনি নোট করেছেন, পারস্পরিক সম্পর্কে যুক্ত পয়েন্টগুলি আপনি পর-পর সাজান, অতঃপর সেগুলি আবার ছোট-ছোট করে নিন, কিছু বাদ দিন, চিন্তা করুন, ফলে আরো কিছু আপনি যোগ করতে পারবেন, যত চিন্তা করবেন তত আপনার মনে নতুন ধারণা আসবে তা নোট করুন, পূর্ণ নোটের সাথে মিলিয়ে তা লিপিবদ্ধ করুন, ফলে আপনার রচনা প্রস্তুত হয়ে যাবে, আপনার বক্তৃতা তৈরি হয়ে যাবে।
একজন বক্তাকে জনসমক্ষে তার বক্তৃতা দেয়ার আগপর্যন্ত এরূপভাবে চিন্তা করতে হবে, নোট করতে হবে, নোট ভিত্তিতে বহু রচনা তৈরি করতে হবে, রচনা তৈরির কালে সংশোধন সংযোজন করতে হবে, ফলে বক্তব্য হবে অর্থবহ, বাক্য হবে সরস, ভাষা হবে প্রাঞ্জল, বলার গতি হবে সাবলীল, প্রকাশ ভঙ্গি হবে অবাধ।
একজন ভালো বক্তা বা সুবক্তা তাঁর বক্তব্য পেশের পর বক্তব্যের চারটি অর্থ বা চারটি দিক খুঁজে পান। সেগুলো হচ্ছে-(১) যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন (২) যা জনসমক্ষে বলেছেন (৩) সংবাদপত্রে যা প্রকাশিত হয়েছে এবং (৪) বক্তৃতা শেষে তিনি তার বক্তৃতার অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বা ভাবছেন এবং মনে করেছেন যে তার আরো কিছু বলার ছিল। সুতরাং একই বিষয়ে বক্তৃতা করতে হলে সুবক্তার বক্তব্য দ্বিতীয় বারে আরো ভালো হয়।
বক্তব্য পেশকালে আমি কি চিট ব্যবহার করব?
উপস্থিত বক্তৃতা সক্ষম একজন সুবক্তা হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট লিংকন হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর কখনো পূর্ব প্রস্তুতি, যথাযথ নোট ও লেখা ছাড়া কোনো ভাষণ দান করেন নি। এবং এমনকি মন্ত্রী সভায় ঘরোয়াভাবে কোনো আলোচনায়ও অংশ নেন নি। তবে অবশ্য তিনি তার উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন প্রস্তুতি ছাড়া। কিন্তু এর আগে ইলিয়নয়সে বক্তৃতা প্রদানকালে তিনি কখনো তেমন প্রস্তুতি নিতেন না, সাহায্য নিতেন না টিট এর। এ পদ্ধতি শ্রোতাকে সব সময় শ্রান্ত করে, কখনো বা বিভ্রান্ত করে; একদা তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
নোট করুন। প্রস্তুতিকালে এই নোট বক্তব্যকে সঠিক করবে, পুর্ণাঙ্গ করবে। আপনার পকেটে নোট থাকলে শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য পেশকালে কোনো পয়েন্ট বিস্মৃত হলেও আপনি বিমূঢ় হবেন না, তবে একেবারে বিপদে পতিত না হলে, অবর্ণনীয় দুর্দশায় পতিত না হলে, সম্পূর্ণরূপে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে এগুলো বের করবেন না। হাতুড়, করাতি, কুড়াল প্রভৃতি অস্ত্র মানুষ ব্যবহার করে নিতান্ত প্রয়োজনে এবং আপনিও এ সব নোট জরুরি অবস্থায় সাহায্যের জন্যে পকেটে রাখবেন। স্মরণ রাখবেন, এগুলি জরুরি অবস্থার জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্র।
যা হোক, নোট সম্পর্কে যত কিছুই বলা হোক না কেন, নোট ব্যবহার পদ্ধতি নির্ভর করছে আপনার জ্ঞানের ওপর। কিছু বক্তা এমন আছেন যারা পূর্ণ প্রস্তুতি সত্ত্বেও বক্তৃতার প্রারম্ভে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েন, বক্তব্য বিষয় ভুলে যান, ফলে তাঁর শেখা বিষয় ছেড়ে বক্তৃতা শুরু করে আবোল তাবোল বলতে শুরু করেন এসব বক্তার জন্যে পকেটে কিছু নোট রাখা অবশ্য প্রয়োজন। শিশু প্রথম হাঁটতে শিখলে কোনো কিছু ধরে হাঁটে, কিছুদিনপর তাকে আর কিছুর সাহায্য নিতে হয় না, স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারে। এমন বক্তা প্রথম অবস্থায় নোটের সাহায্য নিলে পরে সাধারণভাবে বক্তৃতা করতে সক্ষম হন।
জেনারেল গ্রান্টের বিমূঢ়তা :
লি যখন জেনারেল গ্রান্টকে আত্মসমর্পণের দলিল লেখার অনুরোধ জানান তখন ইউনিয়ন বাহিনী প্রধান জেনারেল পার্কারের কাছে গিয়ে লেখার বিষয় জানতে চান। জেনারেল গ্রান্ট তাঁর স্মৃতিতে লিখেছেন, “কাগজে আমি কলম বসাই, কিন্তু আত্মসমর্পণের শর্ত আমার থাকলেও প্রথমে কী শব্দ ব্যবহার করতে হবে তা আমার জানা ছিল না। আমার মনে যা ছিল আমি শুধু তাই জানতাম এবং তা প্রকাশ করাও আমার পক্ষে সহজ ছিল।”
জেনারেল গ্রান্ট, আপনার জন্যে প্রথম কিছু জানার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আপনার বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা ছিল, বিশ্বাস ছিল, আপনি কী বলতে চান তা আপনার মনে পরিষ্কার ছিল। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ সম্পর্কে আপনার মনে যে ধারণা ছিল, বিশ্বাস ছিল তা আপনি স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে সক্ষম ছিলেন শুধু মাত্র প্রথম শব্দটি ব্যবহার ছাড়া। এটা যে কোনো লোকের জন্যই শুভ লক্ষণ। আপনি যদি এতে সন্দেহ করেন, তা হলে যে কোনো লোককে লাথি মেরে ফেলে দিন, দেখবেন সে উঠতে পারলে আপনাকে কিছু বলতে পারবে না, ভাষা আসবে না। প্রথম শব্দ ব্যবহার করতে না পারাও অনুরূপ ঘটনা।
দুই হাজার বছর আগে হোরাম লিখেছেন,
শব্দ নয়, অনুসন্ধান করা তথ্যও যুক্তি
চিন্তা স্বচ্ছ হলে শব্দ পাবে স্বাভাবিক মুক্তি।
আপনার মনে আপনার ধারণা বদ্ধমূল হলে আপনি আপনার বক্তৃতা প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত মহলা দিন। নীরবে করুন নিভৃতে করুন, মনে করুন পানাহারকালে, রাস্তায় চলাফেরার সময়, কোনো ব্যক্তির জন্যে অপেক্ষা করার সময় নীরবে নিভৃতে মহলা দিন। অতঃপর কোনো একটি নির্জন ঘরে একাকী বসে, কাজ করে, এই মহলা দিন। এতে শক্তি প্রয়োগ করুন, বক্তব্য পেশকালে যেরূপ অনুভব করবেন তার মহলা দিন। ক্যান্টার নগরে ক্যানন নক্স লিটল বলতেন, একজন ধর্মপ্রচারক যে ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা দেন জনসমক্ষে প্রচারের আগে তিনি তা নিজে অন্তত, অর্ধ ডজন বার মহলা না দিলে তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। আপনার বক্তব্য আপনি বার-বার নিজে মহলা না দিয়ে জনসমক্ষে পেশ করলে হৃদয়গ্রাহী এবং গ্রহণযোগ্য হবে বলে কি আপনি মনে করেন? অভ্যাস কালে, মহলা কালে আপনি মনে করুন আপনার সামনে শ্রোতা আছে। এরূপ কল্পনা করলে মহলা সঠিকভাবে হবে এবং পরবর্তীকালেও কোনো অসুবিধা হবে না।
জোতদারেরা লিংকনকে ‘অলস’ মনে করতেন কেন?
আপনি এভাবে আপনার বক্তৃতা অভ্যাস করলে আপনার দ্বারা খ্যাতনামা বক্তাদের অনুসৃত পথ অনুসরণ করা হবে। লয়েড জর্জ যখন তাঁর নিজ শহর ওলেস্ এর একটি বিতর্ক ক্লাবের সদস্য ছিলেন তখন তিনি অনেক সময় রাস্তায় গিয়ে গাছপালার সামনে গিয়ে বক্তৃতা করে বক্তৃতার মহলা দিতেন।
লিংকন তাঁর প্রথম ব্রেকেন রিজের মতো খ্যাতনামা বক্তাদের বক্তৃতা শোনার জন্যে ৩০ অথবা ৪০ মাইল দূরে চলে যেতেন। বক্তৃতা শুনে এত অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজ কর্মস্থলে ফিরে আসতেন যে, মাঠে তিনি অন্যান্য শ্রমিকদের ডেকে তাদের সামনে বক্তৃতা দিতে শুরু করতেন। ভবিষ্যতে একজন সুবক্তা হবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি মাঠে-মাঠে বক্তৃতা করতেন, গল্প বলতেন। এতে তার প্রভু তাঁর উপর সাংঘাতিক অসন্তুষ্ট হতেন এবং বলতেন যে, লিংকন অসম্ভব অলস। তাই সে বক্তৃতা করে বেড়াতে চায় এবং এর ফলে অন্যান্য শ্রমিকেরাও অলস হয়ে পড়ছে।
আসকুইথ প্রথমে অক্সফোর্ডের একটি বিতর্ক ক্লাবে যোগ দেন। এর পরে তিনি নিজেও একটি বিতর্ক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। উড্র উইলসন একটি বিতর্ক ক্লাবে বক্তৃতা শেখেন। হেনরী ওয়ার্ড বেকারও অনুরূপভাবে বক্তৃতা শিখেছিলেন। সুবক্তা বার্ক ও একইভাবে বক্তৃতা শিখেছিলেন। একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন এ্যান্টানিটা ব্লাকয়েল ও লুস স্টোন। ইলিহুরুট বক্তৃতা শিখেছিলেন নিউইয়র্কের ২৩শতম সড়কের ওয়াই এস সি এর সাহিত্য সমিতিতে।
খ্যাতনামা বক্তাদের জীবনী আলোচনা করুন, একটি বিষয় আপনি সবার মধ্যে সাধারণ দেখবেন। সেটা হচ্ছে, বক্তৃতা শেখা, অভ্যাস করা, মহলা দেয়া। যারা যত বেশি অভ্যাস করেছেন তাঁরা তত তাড়াতাড়ি সাফল্য অর্জন করেছেন।
এর জন্যে কি কোনো সময় প্রয়োজন হয়? জোসেফ সোয়াটে কী পদ্ধতি অনুসরণ করতেন? তিনি সকাল বেলায় একটি সংবাদপত্র কিনতেন। কাজের অবসরে তার একটি নির্দিষ্ট খবর ঠিক করে নিতেন। অতঃপর কাজ শেষ করে সেই বিষয়টি নির্ভর করে বক্তৃতা তৈরি করতেন।
চাউন্সে এম. ডেপু ছিলেন শ্রমিক নেতা এবং মার্কিন সিনেটর। তিনি প্রতি রাতেই একটি করে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। ”আমি কাউকে আমার কাজে হস্তক্ষেপ করতে দিই না,“ বলেছেন তিনি। ”আমার কর্মশেষে আমি অফিস হতে ঘরে ফিরি এবং রাতে বক্তৃতা প্রস্তুত করি।”
প্রতিদিন আমরা আমাদের নিজেরদের হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় পাই, সে সময়টি আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজে লাগাতে পারি। শরীর রোগা ছিল বলে ডারউইন ঠিক এভাবে কাজ করতেন। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র তিন ঘণ্টা করে কাজ করে তিনি এত খ্যাত হয়েছেন।
থিউডর রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রতিদিন পূর্বাহ্নে তিনি হোয়াইট হাউসে বসে পাঁচ মিনিট করে সাক্ষাৎকার দিতেন। এই সময়েও তার সাথে বই থাকতো। একব্যক্তি বা দল নিষ্ক্রান্ত হলে অপর ব্যক্তি বা দল আসতে যে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে তাও যাতে ব্যর্থ না হয় এই উদ্দেশ্যে তিনি বই রাখতেন।
আপনি যদি ব্যস্ত ব্যক্তি হন এবং আপনার অপচয় করার মতো যদি সময় না থাকে তাহলে আপনি অর্কনেড ব্যানেট এর লেখা বই ”দিনের ২৪টি ঘন্টা কাটানোর উপায়” পড়ুন। আপনি কাজের ফাঁকে যে কয়েকটি মুহূর্ত সময় পাবেন সে মুহূর্তগুলিতে তা পড়ুন। এইভাবে মাত্র ছ’দিনে আমি বইটি পড়ে শেষ করেছি। তা হলে আপনি বুঝতে পারবেন, কীভাবে সময় বাঁচানো যায়। কীভাবে অবসর সময় কাজে লাগিয়ে আরো লাভবান হওয়া যায়।
আপনি ব্যস্ত ব্যক্তি। কাজ থাকলেও আপনার অবসর প্রয়োজন। এই অবসর সময়ে ঘরে বসে আপনি আপনার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বললেও অনেক কিছু শিখতে পারবেন, যা আপনাকে আপনার বক্তৃতা প্রস্তুতিতে সাহায্য করতে পারে, আপনার বক্তব্যের সহায়ক হতে পারে।
সংক্ষিপ্তসার :
১। ”যুদ্ধের কৌশল”, বলেছেন নেপোলিয়ন, “একটি বিজ্ঞান, সুচিন্তিতভাবে হিসাব করে না-গেলে তাতে সফল হওয়া যায় না”। শিকার করার ক্ষেত্রেও এটি অনুরপ সত্য। বক্তৃতা একটি সমুদ্র যাত্রা বিশেষ সুতরাং এটি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। যে বক্তৃতার শুরুর ঠিক থাকে না, সাধারণত তার সমাপ্তিরও কোনো ঠিকানা পাওয়া যায় না।
২। মনের ধ্যান ধারণাকে সঠিকভাবে সাজানো এবং বক্তৃতা প্রণয়ন করার প্রচলিত কোনো আইন কানুন বা বিধি নেই। প্রতিটি বক্তৃতায় থাকে আলাদা-আলাদা সমস্যা।
৩। একজন যখন বক্তৃতা করেন তখন তাঁর বক্তব্যের বিশেষ একটি পয়েন্ট একবারেই ব্যাখ্যা করা উচিত। বক্তৃতাকালে দ্বিতীয় দফে এটির পুনরুল্লেখ ঠিক নয়। এই প্রসঙ্গে ফিলাডেলফিয়ার সংক্ষিপ্ত ভাষণটি উল্লেখ করা যায়। কোনো বক্তৃতায় কোনো বিশেষ পয়েন্টের পুনরুক্তি এবং একবার সামনে একবার পেছনে যাওয়া উচিত নয়।
৪। মৃত ডা. কনওয়ের্ক নিম্ন পরিকল্পনা ভিত্তিতে ভাষণ প্রস্তুত করতেন;
ক। তথ্য প্রকাশ করা।
খ। এর উপর বিতর্ক।
গ। কাজের জন্য আবেদন করুন।
৫। নিম্ন পরিকল্পনা আপনার জন্যে সহায়ক হতে পারে।
ক। ভুল দিকটি তুলে ধরুন।
খ। কীভাবে সংশোধন করা যায় তা বলুন।
গ। কাজের জন্যে আবেদন করুন।
৬। নিম্নটি হচ্ছে একটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা :
ক। শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন।
খ। আস্থা অর্জন করুন।
গ। আপনার তথ্য বর্ণনা করুন।
ঘ। অতঃপর তাদের প্রতি কাজের আহ্বান জানান।
৭। ”আপনার বিষয়ের উভয় দিকের তথ্যাদি বলেছেন প্রাক্তন সিনেটর আলবার্ট জে বেভারিজ, “সংগ্রহ করতে হবে, সাজাতে হবে পর্যালোচনা করতে হবে, হজম করতে হবে। নিশ্চিত হোন যে এসব তথ্য সত্য। অতঃপর এগুলোর উপর চিন্তা করে সমাধানের চেষ্টা করুন।”
৮। বক্তৃতা করার আগেই উপসংহার সম্পর্কে লিংকন যে চিন্তা করে নিতেন তা হত গণিতের হিসাব। চল্লিশ বছর বয়সে যখন তিনি কংগ্রেস সদস্য হন তখন তিনি এই উপসংহার সঠিকভাবে নির্ধারণের জন্যে ইউক্সীড় অধ্যয়ন করেন।
৯। থিউডর রুজভেল্ট যখন কোনো বক্তব্য প্রস্তুত করতেন তখন তিনি চিট ভিত্তিতে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তা ডিক্টেট করতেন, টাইপ অনুলিপি আবার সংকলন সংযোজন করে আবার ডিক্টেট করে নিতেন।
১০। সম্ভব হলে আপনার বক্তব্য পিক্টাফোনে ডিক্টেট করুন এবং নিজে শুনে নিন।
১১। নোট অনেক সময় বক্তৃতা শেখার আগ্রহ নষ্ট করে দেয়। সুতরাং আপনার প্রবণতা যদি সব সময় নোট দেখে বলার প্রতি ঝুঁকে থাকে তা হলে নোট করা পরিত্যাগ করুন। লিখিত বক্তৃতার প্রতি শ্রোতা তেমন আকর্ষিত হয় না সুতরাং যথা সম্ভব লিখিত বক্তৃতা পরিহার করে চলুন।
০৪. স্মরণশক্তির উৎকর্ষ সাধন
“প্রায় লোক,“ বলেছেন খ্যাতনামা মনস্তত্ত্ববিদ অধ্যাপক কার্ল সিসোর তার স্মরণ শক্তি সম্পর্কে, “উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গুণের দশ ভাগও কাজে লাগান না। স্মরণ রাখার স্বাভাবিক নিয়ম লংঘন করে তারা শতকরা ১০ ভাগ ক্ষমতা অপব্যবহার করেন।”
আপনিই কি এই গড় মানুষের একজন? যদি তাই হয়, তাহলে আপনাকে এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে সগ্রাম করতে হবে, আপনি এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন, পুনঃপুনঃ পড়ুন, উপকৃত হবেন সামাজিকভাবে, বাণিজ্যিকভাবে। এতে স্মরণ রাখার স্বাভাবিক নিয়ম কানুন সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ব্যবসা, সামাজিক কথোপকথন এবং বক্তৃতায় কীভাবে এই নিয়ম পালন করা যায়।
এই সব”স্মরণ রাখার নিয়ম” অত্যন্ত সহজ নিয়ম হচ্ছে মাত্র তিনটি। এই তিনটি নিয়ম বা শব্দ হচ্ছে প্রভাবিত করা, পুনরাবৃত্তি ও সহযোগিতা।
প্রথম বিষয়টি হচ্ছে-আপনি যে বিষয়টি জানতে চান, বুঝতে চান, শিখতে চান তার গভীরে প্রবেশ করুন। এটা করতে হলে আপনার মনোসংযোগ করতে হবে। থিওডর রুজভেল্টের স্মরণ শক্তি সকলকেই অভিভূত করতো। তিনি অভ্যাসের দ্বারাই যে কোনো বিষয়ে গভীরভাবে মনোনিবেশ করার অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন? ১৯১২ সালের শিকাগোর বুলমুস কনভেনশনের সময় তার সদর দপ্তর ছিল কংগ্রেস হোটেলে। হোটেলের পাদদেশে, সমগ্র জনপদে তখন নেমেছিল মানুষের ঢল। তাদের হাতে ছিল ব্যানার, কণ্ঠে ছিল চিৎকার আর শ্লোগান, “আমরা টেডি চাই। আমরা টেডি চাই। জনতার চিৎকার, বাজনার শব্দ, রাজনীতিকদের আনাগোনা, অব্যাহত সম্মেলন, আলোচনা, সাধারণ মানুষকে করে তুলেছিল পরিশ্রান্ত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও রুজভেল্ট তার কক্ষে একটি ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসে নিশ্চিন্ত মনে গ্রিক বীর হিরোডোটাসের কাহিনী পাঠ করেন, গভীর অভিনিবেশ সহকারে ব্রাজিলের বন্যপথে চলার সময় একদিন বিকেলে তিনি এক নির্জন স্থানে শিবির সন্নিবেশ করেন। তথায় বৃহৎ বৃক্ষাদির নিচে ছায়াতলে একটা শুষ্কস্থান দেখে তিনি তথায় একটি টুলে বসে গীবনের লেখা ”রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন” পড়তে শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে এমনভাবে ডুবে যান যে শিবিরের শব্দ জনগণের হই চই, কোনো কিছুই তার ধ্যান ভাঙতে পারে না। নিরবচ্ছিন্ন মনে তিনি বইটি পাঠ করতে থাকেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি যা তখন পাঠ করেন তা হুবহু তার মনে থাকে, যেন তিনি তা মুখস্থ করে নিয়েছেন।
মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা নিয়ে সারাদিনের পাঠের চাইতে গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঁচ মিনিটের পাঠের ফল অনেক বেশি ফলপ্রসু, কল্যাণকর”গভীর আবেগপূর্ণ একটি ঘণ্টা, লিখেছেন হেনরী ওয়ার্ড বিসার, “স্বপ্নময় বছরের চেয়ে মূল্যবান।”“যে বিষয়টি আমি শিখেছি তা অন্য যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে মূল্যবান”, বলেছেন ইউজিন গ্রেস, যিনি বেথেলহেম ষ্টিল কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দশ লক্ষাধিক ডলার হতে বেশি উপার্জন করতেন, এবং যে কোনো পরিস্থিতি ও অবস্থায় আমি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যে কাজ করি তা হচ্ছে আমার হাতের কাজের প্রতি গভীর মনোযোগ দান।
এটাই হচ্ছে শক্তি, বিশেষ করে স্মরণ শক্তির গোপন উৎস।
তারা একটি চেরি গাছ দেখে নি :
টমাস ইডিসন দেখতে পান যে তাঁর নিউ জার্সির ম্যানলো পার্কের ন্যামন ফ্যাক্টরিতে কর্মরত ২৭ জন শ্রমিক প্রতিদিন ফ্যাক্টরি থেকে আসা যাওয়ার একটি পথ ব্যবহার করে। তারপর ছয়মাস ধরে এই পথ দিয়ে প্রতিদিন আসা যাওয়া করছিল। এই পথের ধারে একটি চেরি গাছ। নিয়মিত ব্যবহারে পথের চেরি গাছ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ২৭ জনের মধ্যে একজন শ্রমিকও এই গাছের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়।
‘গড়পড়তা মানুষের মস্তিষ্ক’ এডিসন দৃঢ়তার সাথে বলছেন, চোখে যা দেখে তার হাজার ভাগের একভাগও উপলব্ধি করে না। আমাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, প্রকৃত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কত কম এটাই তার প্রমাণ।
একজন সাধারণ মানুষের সাথে আপনার দুই বা তিনজন বন্ধুকে একসাথে পরিচয় করিয়ে দিন, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে মাত্র দুমিনিট পর জিজ্ঞেস করুন, তিনি কারো নাম বলতে পারবেন না। কেন? কারণ প্রথমে তিনি তাদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেন নি, তিনি সঠিকভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ করেন নি, দেখেন নি, তিনি হয়তো আপনাকে বলবেন তাঁর স্মরণ শক্তি অত্যন্ত দুর্বল। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি দুর্বল একথা ঠিক নয়। কুয়াশায় ছবি নিতে ব্যর্থ হলে তিনি একটি ক্যামেরাকে গালাগাল দেবেন না, তবে এধরণের অবস্থায় কোনো কিছু করা হতে তিনি তার মনকে বিরত রাখতেন। এটা করা উচিত নয়।
জোসেফ পুলিসটজার তাঁর সম্পাদকীয় দপ্তরের প্রতিটি কর্মকর্তার সামনে মাত্র তিনটি শব্দ রাখতেন :
সঠিক
সঠিক
সঠিক
আমার যা চাই তা হচ্ছে এই। এতে মানুষের সুনাম হয়। এর উপর জোর দিন। এটা পুনরাবৃত্তি করতে বলুন। এটা কীভাবে উচ্চারিত হয় তা অনুসন্ধান করুন। যার কাছে অনুসন্ধান করছেন তাঁকে তোষামোদ করা হচ্ছে বলে মনে করা হলেও আপনার গভীর মনোনিবেশের জন্য তার নাম আপনার স্মরণ থাকবে। ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে আপনি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করবেন।
লিংকন শব্দ করে পড়তেন কেন?
অল্প বয়সে লিংকন এমন একটি স্কুলে অধ্যয়ন করেছেন যে স্কুলের মেঝে কাগজ আঁটা। স্কুলে ছিল পাঠ্য বই এর মাত্র একটি কপি। শিক্ষকরা উচ্চস্বরে এটি পাঠ করতেন, ছাত্ররা চিৎকার করে তার পুনরাবৃত্তি করত। সকলে একসাথে কথা বলত! এর ফলে স্কুলে সবময় হই চই লেগে থাকত। প্রতিবেশীরা এটিকে বলত ”বক্ বক্ স্কুল।”
এই ”বক্ বক্ স্কুল।” লিংকনের এমন একটি অভ্যাস গড়ে ওঠে যা তিনি জীবনে ছাড়তে পারেন নি। যা কিছু তিনি স্মরণ করতে চাইতেন তিনি সব সময় তা শব্দ করে পড়তেন। প্রতিদিন সকালে তিনি স্পিং ফল্ডস্থ তার আইন অফিসে পৌঁছে একটি কৌচে ছড়িয়ে বসতেন, পাশের একটি চেয়ারে একটি পা তুলে দিতেন এবং শব্দ করে সংবাদপত্র পাঠ করতেন। তিনি আমার বিরক্তি উৎপাদন করতেন, “বলেছেন তার আইন অংশীদার,“ তাঁর ব্যবহার ছিল সহ্য-শক্তির বাইরে। ”একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কেন শব্দ করে পড়েন? তিনি বলেন, দুটি কারণে আমি শব্দ করে পড়ি। প্রথমত : আমি যা পড়ি তা দেখি, আমি তা শুনি, ফলে তা আমি সহজে স্মরণ রাখতে পারি।”
তার স্মরণ শক্তি ছিল বিস্ময়কর। ”আমার মন” তিনি বলেছেন, “ইস্পাত খণ্ডের মতো যাতে কিছু প্রবেশ করানো কঠিন, এমন কী অসম্ভব, কিন্তু একবার কিছু প্রবেশ করানো গেলে তা বের করাও অসম্ভব।”
মনে প্রবেশ করানোর জন্য যে সব পদ্ধতি তিনি অনুসরণ করতেন সে পদ্ধতিগুলি হচ্ছে নিম্নরূপ :
যে বিষয়টি স্মরণ রাখতে চান তা দেখা ও শোনা, স্পর্শকরা, ঘ্রাণ নেয়া এবং স্বাদ গ্রহণ করা।
সর্বোপরি বিষয়টি পরিষ্কারভাবে দেখা। আমরা কল্পনাপ্রবণ। সবকিছু আমার চোখে পড়ে, ফলে আমরা অনেকের নাম মনে রাখতে না পারলে তাদের চেহারা স্মরণ রাখতে পারি। আমাদের চোখ হতে মস্তিষ্কে যে সব শিরা-উপশিরা গিয়েছে তা কান হতে মস্তিষ্কে প্রবিষ্ট শিরা-উপশিরার চাইতে পঁচিশগুণ বেশি শক্তিশালী। চীনে একটি প্রবাদ আছে, তা হচ্ছে”একবার দেখা হাজার বার শোনার চাইতে উত্তম।”
যা আপনি স্মরণ রাখতে চান তার নাম টেলিফোন নম্বর এর বক্তব্যের রূপরেখা লিখে রাখুন, তা পাঠ করুন তার উপর দৃষ্টি রাখুন, তা দৃষ্টিলব্দ রাখার চেষ্টা করুন।
মার্ক টোয়েন নোট ছাড়া কীভাবে বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন :
কোনোরূপ নোটের সাহায্য ছাড়া মার্ক টোয়েন যে বক্তৃতা করতেন তা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। এসম্পর্কে হারপার ম্যাগাজিনের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন তা নিম্নরূপ :
তারিখগুলো স্মরণ রাখা সম্ভব না কারণ ওগুলো অংক বিশিষ্ট, অংক শুষ্ক এবং স্মরণ রাখা সহজ সাধ্য নয়। এতে কোনো ছবি নেই, ফলে এর প্রতি কারো দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয় না। ছবি থাকলে তা স্মরণ থাকে। এটা আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হতে জানি। ত্রিশ বছর আগের ঘটনা, আমি প্রতি রাতে একটি বক্তৃতা মুখস্থ করতাম এবং প্রতি রাতেই আমাকে নোট হতে সাহায্য নিতে হত, নোটে ছিল প্রথম বাক্যসহ এগারোটি বাক্য এবং তা ছিল নিম্নরূপ :
ঐ অসডলের আবহাওয়া ছিল—
এ সময় নিয়ম ছিল—
কিন্তু কালিফোর্নিয়ায় কখনো কেহ শোনে নি যে–
এরূপ এগারোটি। এই বাক্যগুলো আমাকে বক্তৃতা শুরু করার অনুপ্রেরণা যোগাতো এবং পথিমধ্যে অসাড় হয়ে পড়ে থাকা থেকে রক্ষা করত। কিন্তু সবগুলো বাক্য ছিল একাকার, এটা হতে কোনো ছবি ভেসে উঠতো না মনের পর্দায়, আমি শুধু স্মরণ রাখতাম, কিন্তু আমি কখনো এগুলো কোন্টার পর কী আছে তা নিশ্চিতভাবে মনে রাখতে পারতাম না, তাই আমাকে সবসময় চিট সাথে রাখতে হত এবং সুযোগ মতো সেগুলো দেখে নিতাম। একবার আমি এই চিট হারিয়ে ফেলেছিলাম, ফলে সেদিন আমি কীরূপ বিপদে পড়েছিলাম তা কেহ কল্পনা করতে পারবেন না। এর ফলে আমি বুঝতে পারি, আমাকে অন্য পথ অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং আমি এসব বাক্যাংশের প্রাথমিক শব্দ এ. বি. হিসাবে আমি মুখস্থ করি। পরদিন আমি আমার হাতের আঙুলের দশটি নখে দশটি চিহ্ন দিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে গমন করি। কিন্তু এদিনও আমার বক্তব্য পেশকালে আমি বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমি কিছুক্ষণ আঙুলের দিকে তাকাই। কিন্তু কোনো আঙুলের চিহ্ন আগে এবং কোনোটি পরে ব্যবহার করতে হবে তা নির্ধরণ করতে আমি ব্যর্থ হই। আমি বার-বার আঙুলের দিকে তাকাই, তবু আমি আমার বক্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ব্যর্থ হই। আঙুলের প্রতি আমাকে বার-বার দৃষ্টি দিতে দেখে শ্রোতাদের দৃষ্টি আমার প্রতি আবদ্ধ হয়। তারা আমার বিষয় বস্তু হতে আমার আঙুলে কী আছে তা জানতে অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরে দুএকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমার হাতে কী আছে।
অতঃপর আমার মনে এ ধারণা জন্মে যে, ছবি বাক্যের চেয়ে উপকারী হবে। আমি এই এগারোটি বাক্যকে ছয়টি ছবিতে গ্রথিত করি। এর ভিত্তিতে বক্তৃতা করা আমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ হয়ে পড়ে। বক্তৃতা শেষে আমি ছবিগুলি দুরে সরিয়ে রাখি। যে কোনো সময় চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলে আমি ছবিগুলি দেখতে পাই এবং তার ভিত্তিতে আমরা আরাধ্য বাক্য তৈরি করে নিতে পারি। প্রায় ২৫ বছর আগে ঘটেছিল এই ঘটনা, বক্তৃতাটি আমি ভুলে গিয়েছি, কিন্তু যখন চোখ বন্ধ করে চিন্তা করি তখন বাক্যগুলি আমার মনে উদয় হয় সুস্পষ্টভাবে।
একবার আমি স্মরণ শক্তি সম্পর্কে একটি বক্তৃতা করেছিলাম। এই অনুচ্ছেদে আমি বহু বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছি। উল্লেখ করেছি ছবির সাহায্যে পয়েন্ট মনে রাখার কথা, উল্লেখ করেছি জনতার চিৎকার গণ্ডগোলের মধ্যে রুজভেল্টের মনোযোগ দিয়ে ইতিহাস অধ্যয়নের কথা। টসাস এডিসনের চেরি গাছ দেখার কথা। লিংকনের শব্দ করে খবরের কাগজ পড়ার কথা। মার্কটোয়েনের আঙুলের নখে দাগ দিয়ে রাখার কথা।
আমি ছবিতে কীভাবে নম্বর সংযোজন করতাম। এক, দুই, তিন, চার হিসাবে? না, এটা করা হলে। পাঠোদ্ধার কষ্টকর হত। আমি সংখ্যাগুলোকেই ছবিতে রূপান্তরিত করি। অর্থাৎ আমি পয়েন্ট ভিত্তি করেই ছবি আঁকি। উদাহরণ স্বরূপ–এক নম্বরে আমি আঁকি দেড়ের ছবি। সুতরাং এতে আমি দেই একটি রেসের ঘোড়া। এই ছবিতে রুজভেল্টকে তার রুমে পড়ায় নিবিষ্ট দেখাই। দুল এই জন্য দুই উচ্চারণ হয় এ মতো একটি শব্দ বের করি, শব্দটি হচ্ছে ‘জু’। এই জুতে চেরি গাছ এবং তার দিকে এডিসন তাকিয়ে আছেন মর্মে ছবি আঁকি। তিনের জন্যে থ্রি এর মতো উচ্চারিত একটি শব্দটি গ্রহণ করি। গাছের মাথায় আমি লিংকনকে পত্রিকা পাঠরত দেখেছি। ফোর এর জন্যে আমি গ্রহণ করি ডোর শব্দ। খোলা দরজার পাশে মার্কে টোয়েনকে তার হাতের আঙুলের নখে কালি লাগাতে দেখাই।
আমি এটা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি যে অনেক পাঠক এটাকে অসম্ভব এবং হাস্যকর পদ্ধতি বলে মনে করবেন। এর পেছনেও কারণ আছে। এতৎসত্ত্বে এটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, এই পদ্ধতি অনুসরণে স্মরণ রাখা অসম্ভব সহজ। নম্বর ধরে পয়েন্ট মনে রাখার চেষ্টা করা হলে তাতে ভুল হয়, হতে পারে। তবে আমি যে পদ্ধতির কথা বলছি সে পদ্ধতিতে ভুল হতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ যখন আমি থার্ড পয়েন্টের কথা মনে করি, তখন আমাকে স্মরণ করতে হয় থ্রি শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত ট্রি এবং শীর্ষে কী আছে, সুতরাং আমি তথায় দেখি লিংকনকে। আমার বক্তব্য সহজে স্মরণ হয়।
এভাবে আমি আমার নিজের সুবিধার জন্যে আমার বক্তব্যকে বিশটি ছবিতে গ্রথিত করে নিই। শব্দগুলো গ্রহণ করি নম্বরের ধ্বনির সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এ সম্পর্কে আমি এখানে আলোচনা করছি। আপনি যদি এই নম্বর ও ছবিগুলো নিয়ে আধঘণ্টা পর্যালোচনা করেন, আমার মনে হয় আপনিও সহজে তা বুঝতে পারবেন। অতঃপর আপনি এগুলোর ভিত্তিতে, এইট, ফোরটিন, থ্রি এবং এভাবে সব নম্বর চিন্তা করুন, চিন্তা করুন ছবির কথা, তাহলে আপনার পক্ষে কোনো বিষয় ও বক্তব্য স্মরণ রাখা সহজতর হবে।
নিচে ছবির নম্বর উল্লেখ করছি। এগুলো পরীক্ষা করুন। আপনি আনন্দ পাবেন।
১। ওয়ান-রান। একটি রেস হর্স।
২। টু-জু। চিড়িয়াখানার ছবি দেখেন।
৩। থ্রি-ট্রি। ট্রির শীর্ষে কিছু আছে মর্মে ছবি আঁকুন।
৪। ফোর-ডোর। ফোর এর মতো উচ্চারিত হয় অনুরূপ কোনো প্রাণী বা বস্তুর ছবি নিন।
৫। ফাইভ-মৌচাকের ছবি নিন।
৬। সিক্স–সিক। রুগ ব্যক্তি বা রোগীর ছবি বা ডাক্তার নার্সের ছবি নিন।
৭। সেভেন-হেভেন। স্বর্গ পথে দেব-দৈত্যদের খেলা করার ছবি নিন।
৮। এইট-ভেইট। কটকের ছবি।
৯। নাইট-ওয়াইন। মদের বোতলের ছবি নিন।
১০। টেনডেন। গভীর বনে বন্য প্রাণীর আস্তানা।
১১। ইলেভেন। মাঠে ফুটবল দল বল নিয়ে খেলছে।
১২। টুয়েলভ-শেলফে কিছু রাখা হচ্ছে বা নেয়া হচ্ছে।
১৩। থার্টিন-হার্টিং। ক্ষত হতে রক্ত ঝরার ছবি।
১৪। ফোর্টিন-কোটিং। তরুণ তরুণীদের প্রেমালাপের দৃশ্য।
১৫। ফিফটিন–লিপটিং। শক্তিশালী লোক কোনো কিছু উত্তোলন করছেন।
১৬। সিক্সটিন-বিটিং। প্রহারের দৃশ্য।
১৭। সেভেনটিন–লিভেনিং। কারো গৃহত্যাগ করা।
১৮। এইটিন-ওয়েটিং। গৃহবধু দরজায় বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন।
১৯। নাইনটিন-পাইনিং। মহিলা রোদন করছেন বেদনায়।
২০। টুয়েনটি–প্লেনটি। ফলমুল কোনো কিছু প্রচুর।
এসব ছবির সাথে আপনার বক্তব্যের পয়েন্ট মিশিয়ে ছবি করে নিন বক্তব্য স্মরণ রাখা হবে নিতান্ত সহজতর।
আপনি যদি পরীক্ষা করতে চান, কয়েক মিনিট খরচ করে ছবির নম্বরগুলো মুখস্থ করে নিন। আপনি ইচ্ছা করলে নিজের ইচ্ছানুয়ায়ী ও ছবি এঁকে নিতে পারেন। যেমন টেন এর জন্যে হেন বা পেন এর ছবিও নিতে পারেন। তবে তা মূল পয়েন্ট এর উচ্চারণে সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলে স্মরণ রাখা হবে সহজতর। মনে করুন, আপনার দশম পয়েন্টটি হচ্ছে একটি মিল। কাজেই হেন এর পাশে বা পেনের পাশে কারখানা মিল দেখান। অতঃপর আপনি স্মরণ করতে চাইবেন আপনার পয়েন্ট কী, আপনি দেখেন পেন ও পাশে মিল। স্মরণ রাখবেন, অন্য লোকের স্মরণ শক্তি আপনার চেয়ে বেশি নয়। এভাবে চেষ্টা করলে, আপনি শুধু আপনার বক্তব্য বিষয় স্মরণ রাখতে পারবেন না, আপনি আনন্দ পাবেন।
একটি বই দীর্ঘকাল স্মরণ রাখা :
কায়রোর আল-আজহার হচ্ছে বিশ্বের একটি বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। এটি একটি মুসলিম প্রতিষ্ঠান যার ছাত্র সংখ্যা একুশ হাজার। ভর্তি পরীক্ষার প্রতিটি ছাত্রকে কোরান হতে মুখস্থ পাঠ করতে হয়। তিন দিন ধরে এই পরীক্ষা চলে।
চীনা ছাত্রগণকে কতিপয় ধর্মীয় পুস্তক এবং পুরাতন পুঁথি মুখস্থ করতে হয়।
আরব ও চীনা ছাত্ররা কীভাবে মুখস্থ করার মতো এই নিরস কাজটি সম্পন্ন করেন?
পুনঃপুনঃ পাঠ এবং দ্বিতীয়ত স্মরণ রাখার প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণ করে তারা মুখস্থ করেন, স্মরণ রাখেন।
আপনি বার-বার পাঠ করে যে কোনো পরিমাণ পাঠ মুখস্থ করতে পারবেন। যা আপনি মুখস্থ করতে চান তা পাঠ করুন। তা কাজে লাগান, ব্যবহার করুন। বিষয় সম্পর্কে আলোচনাকালে আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী নতুন শব্দ ব্যবহার করুন। স্মরণ রাখতে চাইলে কঠিন অংশটি বার-বার চিন্তা করুন, বক্তৃতায় আপনি যে পয়েন্টগুলি বলতে চান সেগুলোর ভিত্তিতে আলোচনা করুন। এভাবে সংগৃহীত জ্ঞান বিস্মৃত হবার নয়।
পুনরাবৃত্তিতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রযোজন :
কিন্তু কোনো একটি বিষয় অন্ধভাবে, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পুনরাবৃত্তি করা সঠিক পথ নয়। কতিপয় নিয়ম অনুসরণে, বুদ্ধিমত্তার সাথে পাঠে পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন। তাহলে মুখস্থ করা ও স্মরণ রাখা সহজতর হয়। উদাহরণ স্বরূপ, অধ্যাপক গোবিং হাউস তার ছাত্রদের কতিপয় অদ্ভুত বিষয় মুখস্থ করতে দেন। বিষয়গুলি ছাত্রদের মনঃপুত ছিল না। তিনি দেখতে পান যে ছাত্ররা তিন দিনে ৩৮ বার পুনরাবৃত্তি করে ঐগুলি মুখস্থ করছেন, কিন্তু এই সব ছাত্র ইতঃপূর্বে একই সমান বিষয় একদিনেই ৬৮ বার পুনরাবৃত্তি করতে সক্ষম ছিলেন। অন্যান্য মনস্তাত্বিক পরীক্ষার ফলাফল একইরূপ!
এটা আমাদের স্মরণ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এই অর্থ হচ্ছে এই যে, আমরা যে বিষয়টি বুঝে পড়ি তা মুখস্থ করতে যত সময় লাগে না বুঝে পড়লে লাগে তার দ্বিগুণ। বুঝে পড়লে তা মনে গেঁথে যায় বিধায় স্মরণও থাকে।
মনের এই অদ্ভুত গতির দুটি কারণ রয়েছে। তা হচ্ছে :
প্রথমত পুনরাবৃত্তির মাঝে-মাঝে আমারে অবচেতন মন বিষয়টি ভেবে নেয়। অধ্যাপক জেমস এই বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে, শীতকালে সাঁতার আর গরম কালে স্কি খেলার মতো।
দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি বুঝি না, যে বিষয়টির প্রতি মন আকর্ষিত হয় না। ”আরব্য উপন্যাসের অনুবাদক স্যার রিচার্ড বার্টন ২৭ ভাষায় নিজের মাতৃভাষার মতো কথা বলতে পারতেন। তবু তিনি বলেছেন যে, একসময়ে তিনি কোনো একটি ভাষা পনের মিনিটের বেশি অধ্যয়ন করতেন না। কেননা, পনের মিনিট পরেই মস্তিস্ক তার সজীবতা হারিয়ে ফেলে।”
এসব তথ্য ভিত্তিতে এখানে এটা নিশ্চিত করে বলা চলে যে, সাধারণ জ্ঞান বা বুদ্ধি সম্পর্কে গর্ব করেন অনুরূপ ব্যক্তিকেও বক্তৃতা করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রস্তুতি নিতে হয়। যদি না নেন তাহলে এটা নিশ্চিত যে, তিনি তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধির, দক্ষতার অর্ধেকই কাজে লাগান।
বিস্মৃত হওয়া বা ভুলে যাওয়া সম্পর্কে একটি মূল্যবান তথ্য আবিস্কৃত হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা বার-বার এটা প্রমাণ করেছে সে, আমরা নতুন যা কিছু শিখি তার যতটুকু প্রথম আট ঘন্টায়। আমরা ভুলি, পরবর্তী ত্রিশ দিনেও সমপরিমাণ ভুলি না। এই হিসেবটা বড় অদ্ভুত। সুতরাং আপনি কোনো সম্মেলন, সভা সেমিনার বৈঠকে বক্তৃতা করতে যাবার পুর্বমুহূর্তে আপনার তথ্য দেখে নিন, এবং আবার তা স্মরণ করার চেষ্টা করুন।
লিংকন এই ধরনের অভ্যাসের মূল্য বুঝতেন এবং তা কাজে লাগাতেন। গেটিসবার্গে খ্যাতনামা এডওয়ার্ড এভারেট প্রথম বক্তৃতা করলেন, লিংকন করলেন তার পর বক্তৃতা। লিংকনের পদমর্যাদা অনেক উর্ধ্বে। সুতরাং তিনি এভারেটের পর যে বক্তৃতা দেবেন তা মূল্যবান ও আকর্ষণীয় না হলে তার মর্যাদা রক্ষা হয় না। কিন্তু বক্তৃতাকালে বিমূঢ় হয়ে পড়া লিংকনের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এভারেটের দীর্ঘ বক্তৃতা যখন শেষ হয়ে আসে তখন লিংকন পকেট হতে তার খসড়া বের করে তা নীরবে পাঠ করেন এবং মনেমনে বক্তব্য বিষয় স্মরণ করে নেন।
স্মরণ শক্তির উৎস সম্পর্কে অধ্যাপক জেমসের ব্যাখ্যা :
স্মরণ রাখার প্রথম দুটি নিয়মই যথেষ্ট। তবে তৃতীয়টি অনুসঙ্গ, এটি পুনঃ স্মরণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। বস্তুতপক্ষে এটি হচ্ছে স্মরণ শক্তির ব্যাখ্যা। আমাদের মন হচ্ছে, “অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস বিজ্ঞতার সাথে বলেছেন” “একটি প্রয়োজনীয় অনুসন্ধী মাত্র…..মনে করুন আমি এক মুহূর্ত নীরব রইলাম, অতঃপর হুকুম দেয়ার মতো কণ্ঠস্বরে বললাম, পুনঃস্মরণ কর! পুনঃস্মরণ কর। আপনার মন কী এই আদেশ পালন করবে? আপনার অতীত সম্পর্কে কী আপনি কিছু প্রকাশ করবেন? নিশ্চয়ই না। আমার আদেশ ব্যর্থ হবে। বরঞ্চ আপনি মনে-মনে চিন্তা করবেন, আমার কী স্মরণ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, এর একটি সূত্র প্রয়োজন। কিন্তু যদি আমি বলি, আপনার জন্ম তারিখ স্মরণ করুন, অথবা প্রাতভোজে কী গ্রহণ করেছেন তা স্মরণ করুন, বা সঙ্গীতের কথা ও ছন্দ স্মরণ করুন, ফলে আপনার স্মরণ শক্তি জাগরিত হবে, আপনি উত্তর দিতে সক্ষম হবেন। সূত্র পেলে আপনার পক্ষে সঠিক উত্তর দেয়া সম্ভব হবে। এখন যদি আপনি চিন্তা করেন, এটা কীভাবে ঘটে, তাহলে আপনি দেখবেন যে, সূত্র জানা থাকায় আপনার পক্ষে এটা স্মরণ করা সহজ হচ্ছে। আমার জন্মদিন” এই অনুষ্ঠানের সাথে বিশেষ তারিখ মাস বছরের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। আজ সকালের প্রাতভোজ বললে কফি, ডিম প্রভৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর গানের কথা বললে স্মরণে আসবে সা-রে-গা-মা। তবে অনুসঙ্গের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, চিন্তাশক্তির উপর প্রভাব বিস্তার। মনে যা কিছু জাগবে, তা জাগবে অনুষঙ্গ ভিত্তিতে। আপনি যা কিছু স্মরণ করবেন তার ভিত্তিতে কিছু প্রকাশে সক্ষম হবেন।–স্মরণ শক্তিকে জাগরিত রাখার জন্য দুটি নিয়ম পালন করা দরকার। প্রথমত অধ্যবসায়, দ্বিতীয়ত সংখ্যা। স্মরণ শক্তির উৎস হচ্ছে ভিন্নমুখী অনুষঙ্গের একত্র সন্নিবেশ। কিন্তু এই অনুষঙ্গ ভিত্তি করে কোনো কিছু স্মরণ করতে হলে সমগ্র তথ্যটিই স্মরণ করতে হবে। একই অভিজ্ঞতার অধিকারী দুব্যক্তির কথা, যে ব্যক্তি নিজের অভিজ্ঞতার উপর বেশিভাবে নির্ভরশীল তিনি নিজের অভিজ্ঞতাকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের চেষ্টা করেন এবং অপর জনও স্মরণ শক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগান, ধারাবাহিকভাবে না হলেও, অভিজ্ঞতা এক হলেও চিন্তাধারা এক নয় বলে এরূপ বৈষম্য হয়।
আপনার চিন্তাকে কীভাবে একত্র সন্নিবেশ করবেন।
যা হোক, কীভাবে আমরা আমাদের চিন্তাধারাকে ধারাবহিকভাবে সন্নিবেশিত করব? এর উত্তর হচ্ছে, অর্থের ভিত্তিতে, অর্থগতভাবে একটির পর একটি সন্নিবেশিত করব। উদাহরণ স্বরূপ, নিম্নলিখিতভাবে চিন্তা করলে আমাদের তথ্য ধারাবাহিক ভাবে সাজানো সহজতর হবে :
(ক) কেন এটা এরূপ হয়?
(খ) কীভাবে এটা এরূপ হয়?
(গ) কখন এরূপ হয়?
(ঘ) কোথায় এরূপ হয়?
(ঙ) কে বলে এটা এরূপ হয়?
আমরা যদি কখনো কোনো অপরিচিত ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করি তখন তার নামকে আমাদের কোনো পরিচিত ব্যক্তির সাথে মিলাতে চাই। অপর দিকে আমরা যদি দেখি নামটি অস্বাভাবিক, তাহলে আমরা ওটা পরিচিত কারো সাথে মিলাতে পারি না। ফলে অপরিচিত ব্যক্তির নামটি পরিচিত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, এই অধ্যায় লেখা কালে আমাকে মিস নোটার-এর সাথে পরিচিত করে দেওয়া হয়। আমি তাঁকে নামটি উচ্চারণ করতে এবং অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে বলতে বলি। ”হ্যাঁ” সে বলে, “এটা সাধারণ নহে। এটা গ্রিক শব্দ এবং এর অর্থ রক্ষাকারী।” অতঃপর সে আমাকে তাঁর স্বামীর কথা বলে। তার স্বামী এথেন্সের লোক এবং সরকারের সে উচ্চ পদের অধিকারী। আমি কতিপয় লোকের সাথে আলাপ করে দেখেছি, তারা অপরিচিত এবং তাদের নাম অদ্ভুত হলেও আলাপের ফলে তাদের চালচলন বোঝা এবং নাম উচ্চারণ করা আমার জন্যে সহজ হয়ে পড়েছে?।
অপরিচিত ব্যক্তি দেখলে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর দেবেন। তাঁর চোখ ও চুলের রং স্মরণ রাখুন, দেখুন তার গতিবিধি। তার পোশাক দেখুন। সে কীভাবে কথা বলে তা দেখুন। তার চলাফেরা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানুন। সুস্পষ্ট ধারণা নিন। দ্বিতীয় বার যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দেখলে আপনি চিনতে পারবেন।
আপনার কী ধরনের অভিজ্ঞতা আছে যে কোনো ব্যক্তিকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার দেখলে আপনি তার পেশার কথা স্মরণ করতে পারেন কিন্তু তার নাম স্মরণ করতে পারেন না? এই স্মরণ হচ্ছে এই যে, কোনো ব্যক্তির নাম অদৃশ্য কিন্তু পেশা দৃশ্য। এটার একটা অর্থ আছে। নামটা বিস্মৃত হয়ে গেলেও তার পেশা তাই স্মরণ থাকে। সুতরাং কোনো ব্যক্তির নাম নিশ্চিত ভাবে স্মরণ রাখার প্রকৃত পন্থা হচ্ছে তার পেশা স্মরণ রাখা। এই পদ্ধতি যে সঠিক সে সম্পর্কে কোনোই সন্দেহ নেই। উদাহরণ স্বরূপ, ২০ জন পরস্পর অপরিচিত বক্তির মেধা ফিলাডেলফিয়ার প্যান এথেলেটিক ক্লাবে দেখা হয়। তখন প্রতিটি ব্যক্তি নিজের নাম ও পেশা সম্পর্কে আত্মপরিচয় দান করে। ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই একে অপরের নাম স্মরণ করতে এবং এক অপরকে নাম ধরে ডকতে সক্ষম হয়, তারা এরপর বহুদিন পরস্পরকে স্মরণ রাখতে সক্ষম হয়।
এখানে বর্ণমালা ভিত্তিতে তাদের কয়েক জনের নামোল্লেখ করছি। তাদের স্মরণ রাখার জন্যে প্রত্যেকের নামের সাথে তার ব্যবসা সম্পর্কে একটি করে প্রবাদ ব্যবহার করা হয়। প্রবাদ স্মরণ রাখার নাম স্মরণ থাকে সহজ ভাবে।
মি. জি. পি. অলব্রেখট (বালির ব্যবসা) বালি সব সময় উজ্জ্বল করে।
মি. জি. ডাব্লিউ. বেসেল (এ্যাসফল্ট এর ব্যবসা) –এ্যাসফল্ট ব্যবহার করে খরচ কমান।
মি. এইচ. এ. বিডল (উলের বস্ত্রের ব্যবসা) বিডল উলের ব্যবসাকে পিডল (তুচ্ছ) মনে করেন।
মি. গিডন বোরিক (খনি ব্যবসা) বোরিক সব সময় খনির কথা ভাবেন।
মি. টমাস ডেভারী (ছাপার কাজ) সকলের জন্যে ডেডারী প্রিন্টিং প্রয়োজন।
মি. ও. ডব্লিউ ডুলিটল (কার) –কার বিক্রিতে তেমন অসবিধা নেই।
মি. টমাস ভিশার (কয়লা) কয়লা ব্যবসা তাকে বাঁচিয়েছে।
মি. ফ্রাঙ্গ এইচ, গোল্ডে (কাট চেরাই) কাঠ চেরাই ব্যবসা বড় অর্থপূর্ণ।
মি. জে. এইচ, জানকক (সানডে ইভনিং পোস্ট) –জনহানকক সাটারডে পোস্টের কলামিস্ট।
কীভাবে তারিখ স্মরণ রাখা যায় :
যে সব ঐতিহাসিক বা স্মরণীয় ঘটনার দিন আপনার স্মরণ আছে তার কথা আপনার তারিখের সাথে মিলিয়ে নিন। এটা তেমন কঠিন কাজ নয়, উদাহরণ স্বরূপ, আমেরিকানদের পক্ষে ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল হয় একথা স্মরণ রাখার চাইতে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হবার চার বছর পর এ খাল দিয়ে জাহাজ চালু হয় একথা স্মরণ রাখা সহজতর। যদি একজন আমেরকিান স্মরণ রাখতে চান যে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম বসতি স্থাপিত হয় ১৭৮৮ সালে। কিন্তু গাড়ির নাট বল্ট পড়ে যাবার মতো এই তারিখ ও বিস্মৃত হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। তবে ১৭৬৬ সালের ৪ঠা জুলাই এর কথা স্মরণ রাখা সহজতর। সুতরাং আমেরিকান স্বাধীনতা ঘোষণার ১২ বছর পর অষ্ট্রেলিয়ায় প্রথম বসতি স্থাপিত হয়, একথা মনে রাখলে বছর স্মরণ রাখা সহজতর হয়।
একটি টেলিফোন নম্বর স্মরণ রাখার জন্যেও আপনি অনুরূপ একটি পদ্ধতি অনুসরণ করুন। উদাহরণ স্বরূপ, মনে করুন, লেখকের ফোন নং ১৭৭৬ এটা স্মরণ রাখা কারো পক্ষে কষ্টকর নয়। সুতরাং এই ধরনের স্মরণীয় ঘটনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নম্বর হলে সেটা সহজে স্মরণ রাখা যায়। এসব নম্বরের জন্যে কোনো ডাইরেক্টরি দেখার প্রয়োজন হয় না। আপনার ফোন নম্বর ২৪১২, একথা আপনা বন্ধু ভুলে গেলেও কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কথা সে ভুলে না, সুতরাং সে সহজেই আপনার নম্বর স্মরণ করতে পারেন, ভুলে গেলেও খুঁজে পাবে।
অনুরূপভাবে অস্ট্রেলিয়ান, নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী, কানাডীয়দের জন্যে ১৭৭৬, ১৮৬১, ১৮৬৫ বিশেষ অর্থপূর্ণ। এগুলো তারা কখনো বিস্মৃত হবে না।
এসব তারিখ স্মরণ রাখার সর্বোত্তম পন্থা কী?
(ক) ১৫৬৪–শেক্সপিয়ারের জন্ম।
(খ) ১৬০৬ –ইংরেজরা প্রথম আমেরিকায় বসতি স্থাপন করে।
(গ) ১৮১১ –রানী ভিক্টোরিয়ার জন্ম।
(ঘ) ১৮০৭ –রাবার্ট ইলীর জন্ম।
(ঙ) ১৭৮১ –বাস্তিল দুর্গের পতন।
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পুনরাবৃত্তি করে ইউনিয়নে যোগদানকারী মূল তেরটি রাজ্যের নাম মুখস্থ করা এবং ধারাবাহিকভাবে এগুলোর নাম বলা আপনার জন্যে খুবই কষ্টকর। বার বার চেষ্টা করলেও এগুলো সহজে মুখস্থ হবে না; এবং মুখস্থ হলেও বলার সময় কোনটা আগে, কোনটা পরে চলে যাবে। কিন্তু নিম্নবর্ণিত ব্যাপারটি আপনি কয়েক বার পড়লে ১৩টি নাম স্মরণ রাখা এবং ধারাবাহিক ভাবে স্মরণ রাখা আপনার জন্যে সহজ হয়ে পড়বে।
প্যারটি হচ্ছে :
এক শনিবার বিকেলে জনৈকা তরুণী ডেলাওয়ার হতে রেলযোগে প্যানসিলভিনিয়া গমনের জন্যে একটি টিকিট কেনেন। তিনি তাঁর সুটকেসে নিউজার্সির একটি সুয়েটার নেন এবং তার বন্ধু জর্জিয়ার সাথে কনেকটিকাটে দেখা করেন, পর দিন সকালে বন্ধুসহ তিনি মেরিল্যান্ডের মাস চার্চে উপস্থিত হন। অতঃপর তারা সাউথ কার যোগে বাড়ি গিয়ে একটি সদ্য ভাজা মুরগিসহ ভোজ গ্রহণ করেন। মুরগিটি ভার্জিনিয়ায় রোস্ট করা। এতে মশল্লা দেয়া হয়েছে নিউইয়র্কের। ভোজের পর তারা নর্থ কার যোগে দ্বীপে গমন করেন।
এটি পড়ে মুখস্থ করা সহজ এবং নামগুলো স্মরণ রাখাও সহজ।
আপনার বক্তৃতার পয়েন্টগুলো কীভাবে স্মরণ রাখবেন :
একটি বিষয়ের উপর আমরা দু’ভাবে চিন্তা করতে পারি। প্রথম-বাহিরের দিক স্মরণ করে, দ্বিতীয়, মনে যা আছে তা স্মরণ করা। নোট প্রভৃতির সাহায্যে আপনি আপনার বক্তৃতা বিষয় স্মরণ রাখতে পারেন। কিন্তু কোনো বক্তা নোটের সাহায্য নিয়েছেন এটা কী শ্রোতারা পছন্দ করেন? অন্য কিছুর সাথে মিলিয়ে আপনি আপনার বক্তব্য স্মরণ করতে পারেন। তবে সেগুলো এমন ভাবে সাজাতে হবে যে প্রথম পয়েন্ট এর পর দ্বিতীয় পয়েন্ট, অতঃপর তৃতীয় পয়েন্ট অর্থাৎ আপনি যেন এক ঘরে থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছেন। এভাবে যেন আপনার বক্তব্য প্রকাশ পায়।
কিন্তু নতুন বক্তা, যিনি সঠিক ভাবে কিছু চিন্তা করতে পারেন না তার জন্যে এই পদ্ধতি সহজ নয়। কেননা নতুন বলে তার মনে ভয়ও আছে। তার জন্যে পয়েন্ট মনে রাখার সহজ পদ্ধতি কী?
তার জন্যে সহজতর পদ্ধতি হচ্ছে কতিপয় প্রাণী, দ্রব্য, মানুষ প্রভৃতির নাম স্মরণ রাখা এবং এসব প্রাণী দ্রব্য প্রভৃতিকে তার পয়েন্ট বলে মনে রাখা। যেমন একটি বাক্য ‘গরু একটি সিগার পান করে, নেপোলিয়ানকে ধাক্কা দেয়ায় ঘরে আগুন লেগে সব কিছু ভস্ম হয়ে গেল।” এখন সে তার পয়েন্টগুলো গরু, সিগার, নেপোলিয়ন প্রভৃতির সাথে মিশিয়ে নিলে তার পক্ষে বক্তব্য মনে রাখা সহজতর হবে। অথচ বাক্যটি অর্থহীন।
এভাবে মিশিয়ে নিন। অতঃপর ভাবুন আপনার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম পয়েন্ট কী।
হ্যাঁ, এভাবে বক্তব্য স্মরণ রাখা সহজ হবে। এভাবে-বক্তব্যকে আস্তে-আস্তে আরো দীর্ঘায়িত করতে পারবেন।
এভাবে একবার অনুসরণ করার চেষ্টা করলে আপনার মনে নতুন-নতুন ভাব আসবে, আপনি সহজে বক্তৃতা শিখতে পারবেন।
সকল বিষয়ে আমরা আমাদের স্মরণ শক্তি সমান ভাবতে পারি না :
এই পরিচ্ছেদে আমি আমাদের ধারণা সৃষ্টি এবং আমাদের ধারণাকে ধারাবাহিকভাবে সাজানো সম্পর্কে বলেছি। আমাদের স্মরণশক্তি বাড়ানো প্রয়োজন একথা বলেছি, কিন্তু আমাদের স্মরণ শক্তি সম্পর্কে অধ্যাপক জেমস বলেছেন, “কতিপয় বিশেষ ব্যাপার আমরা স্মরণ রাখতে পারলেও সব বিষয় স্মরণ রাখার জন্যে আমাদের স্মরণ শক্তি সমান নয়।”
উদাহরণ স্বরূপ, যে ব্যক্তি শেক্সপিয়রের লেখা ভালবাসেন, পাঠ করেন, সাহিত্যসম্পর্কিত কোনো বিষয় আলোচনার উদ্ধৃতি দিয়ে তার পক্ষে বক্তৃতা করা সহজতর কিন্তু তিনি কাপড়ের ব্যবসা সম্পর্কে বক্তৃতা করলে হ্যাঁমলেট বা রোমিও জুলিয়েট থেকে তিনি কী উদ্ধৃতি দেবেন?
আমি আবারো বলছি এই পারিচ্ছেদে আলোচিত নীতি অনুরসণ করা হলে যে কোনো বিষয় মুখস্থ করা সহজতর হবে, আমাদের স্মরণ শক্তি বাড়বে। আমাদের মন হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ের অনুসঙ্গ। একটি পয়েন্ট আর একটি পয়েন্টের সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং সেভাবে চিন্তা করলে কোনো কিছু মুখস্থ করা স্মরণ করা সহজতর হবে।
সারাংশ :
১। ”গড় মানুষ”, বলেছেন খ্যাতনামা মনস্তত্ত্ববিদ অধ্যাপক কার্ল সিসোর ”স্মরণ শক্তি সম্পর্কিত শক্তির শতকরা দশ ভাগও কাজে লাগান না। স্মরণ রাখার প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণ না করে শতকরা ৯০ ভাগ শক্তি নষ্ট করেন।”
২। স্মরণ রাখার প্রাকৃতিক নিয়ম তিনটি –ধারণা সৃষ্টি, পুনরাবৃত্তি ও সহযোগিতা।
৩। যে বিষয়টি আপনি মুখস্থ করতে বা স্মরণ রাখতে চান সেটি ভালোভাবে জেনে নিন, বুঝে নিন। এবং তা করতে হলে :
(ক) মনোযোগ দিতে হবে। এটাই থিওডর রুজভেল্টের স্মরণ শক্তির উৎস।
(খ) নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করুন। সঠিক ধারণা নিন, ক্যামেরা কুয়াশার ছবি নেয় না। সুতরাং মনের ধারণা কুয়াশাচ্ছন্ন থাকা সঠিক নয়?
(গ) ধারণাকে বহুমুখী করুন। কানে শুনে এবং চোখে দেখে সহজে মুখস্থ করা এবং স্মরণ রাখার জন্যে লিংকন আওয়াজ করে পড়তেন।
(ঘ) সর্বোপরি চোখের ধারণা স্বচ্ছ করুন। কারণ কান থেকে মস্তিষ্কে যে সব শিরা উপশিরায় শক্তি অন্তত ২৫গুণ বেশি শক্তিশালী। নোট ব্যবহার কালে মার্কটোয়েন তাঁর বক্তব্যের রূপরেখা বলতে পারতেন না। কিন্তু তিনি নোট বাদ দিয়ে যখন ছবি ব্যবহার শুরু করেন তখন তিনি রূপরেখা বলতে সক্ষম হন। স্মরণ রাখা তাঁর পক্ষে সহজতর হয়ে পড়ে।
৪। স্মরণ রাখার দ্বিতীয় আইন হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। হাজার-হাজার মুসলমান ছাত্র মুখস্থ করে বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে। বার-বার পড়লে, পুনরাবৃত্তি করলে যে কোনো বিষয় মুখস্থ করা যায়। পুনরাবৃত্তি করার সময়ও স্মরণ রাখতে হবে :
(ক) কোনো বিষয় না বুঝে, অর্থ হৃদয়ঙ্গম না করে বারবার পাঠ করা, পুনরাবৃত্তি করা সঠিক পদ্ধতি নয়। এক সাথে বার-বার পড়বেন না। দুতিন বার পড় ন। তারপর বন্ধ করে দিন। সময় করে আবার পড় ন। তা হলে সহজে মুখস্থ করতে পারবেন স্বল্প সময়ে।
(খ) একটা বিষয় মুখস্থ করার আধঘণ্টার মধ্যে আমরা যতটুকু ভুলি, পরবর্তী ত্রিশ দিনেও সমপরিমাণ ভুলি না। সুতরাং বক্তৃতা শুরু করার আগে আপনার মুখস্থ বিষয়টির নোটটির নোট আবার দেখে নিন।
৫। স্মরণ শক্তির তৃতীয় আইন হচ্ছে সহযোগিতা। অন্য তথ্যের সাথে মিলানোই হচ্ছে মুখস্থ করার সহজতর পদ্ধতি। ”মনে যাই আসুক না কেন” বলেছেন, অধ্যাপক জেমস, তার প্রকাশ করা প্রয়োজন –যার স্মরণ শক্তি প্রখর তাঁর পক্ষে মিলিয়ে এটা প্রকাশ করা সহজতর।
৬। আপনি যখন আপনার মনের একটি চিন্তাকে অন্যটির সাথে মিলাতে চান, তখন সকল দৃষ্টি কোণ হতে তা বিচার করার চেষ্টা করুন। বিষয়টি সম্পর্কে এভাবে প্রশ্ন রাখুন কেন এরূপ হয়? কীভাবে এরূপ হয়? কখন এরূপ হয়? কোথায় এরূপ হয়? কে বলেছে এটার এরূপ?
৭। একজন অপরিচিতের নাম মনে রাখতে হলে নামের উচ্চারণ জিজ্ঞেস করুন এবং এ সম্পর্কে অন্যান্য প্রশ্ন করুন। তার নামকে চেহারার সাথে মিলাবার চেষ্টা করুন। তার পেশা জেনে নিয়ে কোনো প্রবাদ মিলাবার চেষ্টা করুন। এটা করা হয়েছিল প্যান এ্যাথলেটিক ক্লাবে, এরূপ করলে নাম স্মরণ রাখা সহজ হবে।
৮। কোনো তারিখ মনে রাখতে হলে কোনো স্মরণীয় তারিখের সাথে তা মিলান, উদাহরণ স্বরূপ, শেক্সপিয়রের জন্ম ত্রিশত বার্ষিকীতে গৃহযুদ্ধ হয়।
৯। আপনার বক্তব্যের পয়েন্ট স্মরণ রাখতে হলে সেগুলো এমনভাবে সাজান যেন প্রথমটার পর দ্বিতীয়টা আসে। এটার জন্যে অদ্ভুত বাক্য ও ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ —
‘গরু ধূমপান করে, নেপোলিয়নকে ধাক্কা দেয়ায় ঘরে আগুন লেগে সবকিছু ভষ্মে পরিণত হয়।” এক্ষেত্রে গরু সিগার, নেপোলিয়ন প্রভৃতি কোনটার জন্যে কী পয়েন্ট ধরেছেন তা স্মরণ করুন। তা হলে। পয়েন্টগুলো একটির পর একটি আসবে।
১০। পদ্ধতি ও সর্বপ্রকার সতর্কতা সত্ত্বেও আপনি যদি বক্তৃতা কালে বক্তৃতা ভুলে যান তা হলে আপনি কী করবেন? আপনার শেষ বাক্যের শেষ শব্দটির পুনরাবৃত্তি করে, তা ব্যাখ্যা করে, অবস্থা আপনার আয়ত্বে রাখতে পারেন। আপনার পরবর্তী পয়েন্ট মনে না আসা পর্যন্ত সেভাবে ব্যাখ্যা কাজ চালিয়ে যাবেন।
০৫. সকল বক্তৃতার প্রয়োজনীয় উপাদান
অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা :
যখন আমরা ফরাসি ভাষা অথবা গল্প অথবা জনসভায় বক্তৃতা করণ শেখার মতো নতুন কিছু শিখতে শুরু করি, আমরা কখনো একরূপ ভাবে এগুতে পারি না। আমাদের উন্নতিও ক্রমান্বয়ে হয় না। হঠাৎ কোনো ধাক্কায় আমরা এগিয়ে যাই। অতঃপর আমরা স্থির হয়ে বসি অথবা আমরা পিছিয়ে পড়ি এবং কখনো বা শেষ কোনো কিছু ভুলে যাই, বিস্মৃত হই। এই স্থির অথবা প্রত্যাগতিকাল সম্পর্কে সকল মনোবিজ্ঞানীই ওয়াকেবহাল এবং সচেতন এবং তাঁরা এই জন্যেই এই সময়টাকে ‘শিক্ষার বক্র অধিত্যকা’ বলে অভিহিত করেছেন। ভাষণ কোর্সের শিক্ষার্থীরাও কখনো-কখনো এই অধিত্যকায় আটকা পড়েন। কঠোর পরিশ্রম করেও তাদের পক্ষে এটা অতিক্রম করা সম্ভব হয় না। এই সময়েই দুর্বল ব্যক্তি হতাশ হয়ে পাঠ ছেড়ে দেন। কিন্তু যারা অধ্যবসায়ী, ধৈর্যশীর, তারা দেখতে পান যে, হঠাৎ রাতারাতি তাঁদের অগ্রগতি হয়ে গেছে অকল্পনীয় ভাবে। তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না কীভাবে এটা সম্ভব হল। তারা অধিত্যকা হতে বেরিয়ে আসেন বিমানের গতিতে হঠাৎ তারা বক্তৃতা করার এমন শক্তিলাভ করে বসে যা তারা নিজেরাও কখনো কল্পনা করেন নি। হঠাৎ তারা অনেক কিছু শিখে ফেলেন।
আমরা সর্বত্রই একটা কথা বলেছি যে, শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা করতে দাঁড়ালে প্রথম কয়েক মিনিট প্রত্যেকের মনেই ভীতে জাগে, স্নায়বিক দুর্বলতা জাগে, হৃৎকম্প উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি ধৈর্যশীল হন তাহলে ভীতি ছাড়া সব কিছুই আপনার মন হতে সহসা বিদূরিত হবে। কয়েকটি বাক্য বলার পরে আপনি নিজেই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। তখন আপনি আপনার বক্তব্য আনন্দ ও দৃঢ়তার সথে পেশ করতে পারবেন।
সবসময় অটুট থাকা অনড় থাকা :
আইন অধ্যয়নেচ্ছ একজন তরুণ লিংকনের উপদেশ প্রার্থনা করলে লিংকন লিখেন, আপনি যদি নিজেকে একজন আইনজীবী রূপে গড়ে তোলা দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে থাকেন তা হলে কাজটি অর্ধেকের বেশি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। সবসময় স্মরণ রাখবেন নিজের ইচ্ছাই সাফল্যের পথে অন্য যে কোনো কিছু হতে গুরুত্বপূর্ণ।
লিংকন জানতেন। ভালো ভাবেই জানতেন। তিনি তার সারা জীবনে এক বছরের বেশি সময় স্কুলে যাবার সুযোগ পান নি। আর বই? লিংকন একবার বলেছেন, তিনি যে কোনো বই ধার করার জন্যে তার বাড়ি হতে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত হেঁটে যেতেন। তাঁর ঘরে যারা রাতে কাঠ জ্বালাত এবং এই কঠের আলোতে তিনি পড়তেন। কখনো-কখনো পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়তেন, ঘুম থেকে জেগে, চোখ রগড়ে আবার বইটি টেনে নিয়ে পড়তেন, পড়তেন গভীর মনোযোগ দিয়ে।
কোনো বক্তার বক্তৃতা শোনার জন্যে তিনি বিশ ত্রিশ মাইল দূরে চলে যেতেন। বক্তৃতা শুনে ঘরে ফিরে যত্রতত্র-মাঠে, বনে, জেন্ট্রি বিলের মুদি দোকানে বক্তৃতা অভ্যাস করতেন। তিনি নিউসালেম ও স্প্রিংফিল্ডএর সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। এবং এখন আমরা যেমন যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলি আলোচনা করি, তিনি ঠিক সেভাবে সকল বিষয় নিয়ে বক্তৃতা করতেন।
তবে তার মধ্যে সব সময় হীনম্মন্যতা বিরাজ করত। এটা তাকে পীড়া দিত। মহিলাদের উপস্থিতিতে তিনি লজ্জা পেতেন বোবা হয়ে যেতেন। মেরি টটের সাথে প্রণয় কালেও তিনি লাজ নম্রভাবে একান্তে বসে নীরবে তার কথা শুনতেন, কোনো কথা বলতেন না। কিন্তু এই লাজুক নম্র ব্যক্তিই অভ্যাস এবং ঘরে লেখা পড়া করে নিজেকে এরূপ বক্তা হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন, যিনি সাফল্যের সাথে প্রতিযোগিতা করেছেন, তকালের মার্জিতরুচি বক্তা সিনেটর ডগলাসের সাথে। তিনিই সেই ব্যক্তি যার গ্যাটিসবার্গের ভাষণ এবং হোয়াইট হাউসের দ্বিতীয় উদ্বোধনী ভাষণ মানবেতিহাসে অলংকারপূর্ণ বাকপটুতার উজ্জ্বল নজির হয়ে রয়েছে।
এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, যার মন ছিল এরূপ ভারাক্রান্ত, লজ্জাপূর্ণ তিনি লিখেন, “আপনি যদি নিজেকে একজন আইনজীবী রূপে গড়ে তোলার দৃঢ় ইচ্ছা গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে কাজটির অর্ধেকের বেশি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।”
প্রেসিডেন্টের দপ্তরে আব্রাহাম লিংকনের একটি সুন্দর ছবি ছিল। ”যখন আমাকে কোনো শক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়” বলেছেন থিওডর রুজভেল্ট ”যে বিষয়টি কঠিন, যাতে অধিকারও স্বার্থের সংঘাত আছে, আমি লিংকনের দিকে তাকাই, তাঁকে আমার স্থানে কল্পনা করার চেষ্ট করি, ইে অবস্থায় তিনি কী করতেন তা বের করার চেষ্টা করি। এটা আপনার কাছে শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু একথা সত্য যে, এটা আমাকে বিপদ হতে উদ্ধার করে এবং আমি সঠিক সমাধানে উপনীত হতে সক্ষম হই।”
রুজভেল্টের পরিকল্পনা কেন পরীক্ষা করব না? আপনি যদি ভালো বক্তা হতে চান তাহলে কেন আপনি জানতে চেষ্টা করবেন না আপনার অবস্থায় পড়লে লিংকন কী করতেন? আপনি জানেন তিনি কী করতেন! সিনেটের নির্বাচনে সংস্কৃতিবান, মার্জিতরুচি স্টেপেন এ ডগলাসের কাছে পরাজিত হবার পর তিনি তাঁর অনুগামীদের উপদেশ দিয়েছিলেন, “একবার নয়, শতবার পরাজয়েও হতাশার কিছু নেই।”
আমি কী আশা করতে পারি যে, হারবার্ডের খ্যাতনামা মনস্তত্ববিদ অধ্যাপক উইরিয়াম জেমস এর নিম্নবর্ণিত কথাগুলো মুখস্থ করা পর্যন্ত এই বইটি প্রতিদিন আপনার প্রাতরাশের টেবিলে খোলা থাকবে।
কোনো তরুণের মনেই সে যে বিষয়েরই ছাত্র হোক না কেন, তার শিক্ষা সম্পর্কে কোনোরূপ দুশ্চিন্তা থাকা উচিৎ নয়। সে যদি তার লেখাপড়া নিয়ে প্রতিটি কাজের দিনে মনে প্রাণে ব্যস্ত থাকে সাফল্য তার নিশ্চিত। সে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে যে, তার জীবনে ব্যর্থতা আসবে না এবং সে হবে না কলঙ্কিত। মনে এরূপ দৃঢ় আস্থার জন্যে অবশ্যই তাকে কাজের দিনের প্রতিটি ঘণ্টা মনে প্রাণে কাজ করতে হবে।
অধ্যাপক জেমস এর এই বক্তব্য ব্যাখ্যা করে আমি এখন বলতে পারি যে, বক্তৃতা শেখায় আপনি যদি এই অভ্যাস দৃঢ়তা ও বিশ্বস্ততার সাথে অব্যাহত রাখেন, বুদ্ধিমত্তার সাথে বক্তৃতা চর্চা করেন, আপনি নিজ মনে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে পারেন যে, আপনি একদিন আপনার শহর অথবা সমাজের যোগ্য বক্তা হতে পারবেন।
আপনার কাছে শুনতে যেরূপ লাগুক না কেন, সাধারণ নীতি হিসাবে এটা সত্য অবশ্য এতে ব্যতিক্রমও আছে। নিম্নমানের মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন লোক, যার কোনো বিষয়েই তেমন জ্ঞান নেই, যে ডানিয়েল ওয়েব্রেস্টারের মতো বক্তা হবেন, না হতে পারবেন? এ প্রসঙ্গে আমি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি :
নিউজার্সির প্রাক্তন গভর্নর স্টোককে ট্রেনটনে আয়োজিত একটি বক্তৃতা শিক্ষা কোর্সের সমাপ্তি ভোজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ঐ সন্ধ্যায় শিক্ষানবিশ ছাত্ররা যে বক্তৃতা করেছিলেন সে ধরনের বক্তৃতা তিনি ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি সভা এবং সিনেটেই শুনছেন। কয়েক মাস আগে যে-সব ব্যবসায়ী শ্রোতা-ভীতিতে বোবা হয়ে যেতেন তারাই সেদিন বক্তৃতা করেছিলেন ট্রেনটনের ভোজে। তাদের মতো একই ধরনের ব্যবসায়ী আমেরিকার সকল শহরেই ছড়িয়ে রয়েছে। ব্যবসা জানলেও বক্তৃতা করা তাদের পক্ষে ছিল অকল্পনীয়, কিন্তু বক্তৃতা কোর্সে অংশ নিয়ে একদিন তাঁরা তাঁদের শহরে সক্ষম বক্তায় পরিণত হন।
বক্তা হিসাবে আপনার সাফল্য অর্জন দুটি জিনিসের ওপর নির্ভর করছে। তা হচ্ছে আপনার ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং বক্তৃতা শেখায় আপনার আগ্রহ ও সে আগ্রহের গভীরতা। প্রায় সকল বিষয়ে বলেছেন অধ্যাপক জেমস, “আপনার আগ্রহ আপনাকে জয়ী করবে। সুফল লাভ আপনার লক্ষ্য হলে আপনি নিশ্চিত ভাবেই তা লাভ করবেন। আপনি ধনী হতে চাইলে ধনী হবেন। জ্ঞানী হতে চাইলে জ্ঞানী হবেন, ভালো হতে চাইলে ভালো হবেন। তবে আপনাকে অবশ্যই তা হতে চাইতে হবে এবং হবার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে হবে, সাথে অন্য কোনো আকাক্ষা রেখে কাজ করলে চলবে না।” এবং অধ্যাপক জেমস সম গুরুত্বের সাথে সম্ভবত এটাও যোগ করতে পারেন, “আপনি যদি আত্মপ্রত্যয়ী সুবক্তা হতে চান তাহলে তা’হতে পারবেন,তবে আপনাকে অবশ্যই সে ইচ্ছা পোষণ করতে হবে।”
আমি এরূপ হাজার-হাজার পুরুষ ও মহিলাকে জানি যারা সত্যিই আত্মবিশ্বাস অর্জন ও সুবক্তা হবার জন্য চেষ্টা করছেন। এদের মধ্যে সামান্য সংখ্যকই অত্যন্ত মেধাবী। অন্যান্যরা আপনার শহরের সাধারণ মানুষের মতো। তাদের মধ্যে যারা বেশি চটপটে তাদেরই আমি ব্যর্থ হতে দেখেছি বেশি। কারণ তারা টাকা বানানোর কথা বেশি চিন্তা করে? বক্তৃতা শেখায় অখণ্ড মনোযোগ দেয় না। কিন্তু সাধারণদের মধ্যে যারা অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করে তারাই সাফল্য লাভ করে এবং তাদের স্থান হয় সকলের শীর্ষে।
তাই প্রকৃতগত এবং মানবিক, বাণিজ্য ও পেশার ক্ষেত্রেও কী আপনি সব সময় একই রূপ ঘটনা ঘটতে দেখেন না। রকফেলার বলেছিলেন যে, ব্যবসায়ে সাফল্য লাভের চাবিকাঠি হচ্ছে ধৈর্য। বক্তৃতা শেখার বেলাও এটি প্রথম প্রয়োজন।
মার্শাল ভচ বিশ্বের সর্ববৃহত্তম বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে বলেছিলেন, এই সাফল্যের কারণ হচ্ছে হতাশ না হওয়া।
১৯২৪ সালে ফ্রান্স যখন মার্নিতে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় তখন দু’লক্ষ সৈন্যের অধিনায়ক জেনারেল জোফরি তার অধীন জেনারেলদের প্রতি পশ্চাদপসরণ বন্ধ করে তীব্র আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ দেন। এর পর দুদিন স্থায়ী যে যুদ্ধ হয় তা বিশ্ব ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই নির্দেশের পর জেনারেল ফচ জেনারেল জোফরিকে একটি বাণীতে জানান, “আমার কেন্দ্রের সৈনিকেরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমার ভাগে শত্রু নেই। অবস্থা অত্যন্ত অনুকুল। সুতরাং আমি আক্রমণ পরিচালনা করছি।”
এই আক্রমণের ফলেই ফ্রান্স রক্ষা পায়।
সুতরাং যুদ্ধ তখন তীব্র আকার ধারণ করে, পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠে তখন নিজেকে বাঁচাতে হলে শত্রুতে তীব্রতর বেগে আক্রমণ-করতে হবে। প্রতিরোধ নয়, আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করতে হবে তাহলে নিজেকে রক্ষা করা, জয়লাভ করা সম্ভব।
ওয়াইলড কায়জার শৃঙ্গে আরোহণ :
কয়েক বৎসর আগের কথা, আমি অস্ট্রিস আল্পস পর্বতের ওয়াইল্ড কায়জার শৃঙ্গে আরোহণের চেষ্টা করি? বেডেকার বলেন যে, এটাতে আরোহণ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং শৌখিন আরোহণকারীর জন্য পথপ্রদর্শক প্রয়োজন। আমি ও আমার বন্ধু, আমার দুজন নিশ্চিতভাবেই শৌখিন আরোহণকারী এবং আমাদের কোনো পথপ্রদর্শকও ছিল না। তাই তৃতীয় দল আমাদের প্রশ্ন করে, আমরা সাফল্যলাভ করব বলে চিন্তা করি কী না।
‘নিশ্চয়ই’ আমরা উত্তর দেই।
“কী কারণে আপনারা এরূপ চিন্তা করেন?” তিনি জানতে চান। ”অন্যেরা কোনোরূপ পথ প্রদর্শক ছাড়া সফল হয়েছেন? আমি বলি, সুতরাং আমাদের সফল না হবার কোনো কারণ নেই এবং আমি কখনো পরাজিত হবার কথা চিন্তা করি না।”
আলফাইনা আরোহী হিসাবে আমি সম্পূর্ণ নবিশ কিন্তু আমার ছিল মানসিক প্রস্তুতি। আমি নিশ্চিত ছিলাম সাফল্য সম্পর্কে। সুতরাং বক্তৃতা শেখার সাফল্য অর্জনে এরূপ মানসিক প্রস্তুতি এবং মনোবল থাকলে এভারেস্ট আরোহণে সাফল্য অর্জনের মতো এ ও সহজ সাধ্য।
সাফল্যের কথা চিন্তা করুন। যথাযথ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনি জনসভায় বক্তৃতা করছেন বলে চিন্তা করুন।
এটা সম্পূর্ণরূপে আপনার শক্তির মধ্যে। সাফল্য সম্পর্কে মনে-মনে বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাস পোষণ করুন। এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিজয়লাভের জন্যে বা প্রয়োজনে ঠিক সেভাবে কাজ করুন।
এডমিরাল ডুপান্ট কেন তাঁর গানবোর্ট চার্লেনটন পোতাশ্রয়ে ভেড়ান নি তার পক্ষে আধাডজন গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি দেখিয়েছেন। এডমিরাল ফারাগুট গভীর মনোযোগ দিযে তা শোনেন। কিন্তু আরো একটি কারণ ছিল, তা আপনি উল্লেখ করেন নি? শোনার পর তিনি উত্তর দেন।
‘ওটা কি?’ এডমিরাল ডুপান্ট প্রশ্ন করেন। উত্তর আসে, আপনি তা করতে পারতেন সে বিশ্বাস আপনার ছিল না।
সাধারণ ভাষণ কোর্সে অংশ গ্রহণকারীরা সবাই যে মূল্যবান জিনিসটি প্রশিক্ষণকালে লাভ করেন তা হচ্ছে নিজেদের উপর আস্থা বৃদ্ধি, আত্মবিশ্বাস অর্জন। এবং যে কোনো ভাষায় যে কোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য এটি বিশেষ প্রয়োজন।
বিজয় লাভের ইচ্ছা :
এ ক্ষেত্রে আমি প্রয়াত এলবার্ট এর একটি বিজ্ঞ উপদেশ উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। সাধারণ মানুষ, নারী বা পুরুষ যদি তাদের নিজস্ব জ্ঞান সঠিকভাবে কাজে লাগান তা হলে সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত।
যখনি আপনি ঘর হতে বের হবেন তখন মনে-মনে গ্লানি রাখবেন না, দৃঢ় পদক্ষেপে চলবেন, বুক ফুলিয়ে হাঁটবেন, কোনো বন্ধুর দেখা পেলে তার সাথে হাসিমুখে কথা বলবেন। কোথাও কোনো কারণে ভীত হবেন না, কাকেও শত্রু মনে করে চিন্তায় সময় নষ্ট করবেন না। আপনি কী করতে চান তা মনে মনে ঠিক করে নেবার চেষ্টা করুন এবং অতঃপর সেই স্থির লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে চলুন। যে কাজটি আপনি চান তার উপর আপনার মন স্থির রাখুন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে, আপনি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন, আপনি সাফল্য লাভ করেছেন। সময় ও স্রোত আপনার লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয় নি, আপনি যা হতে চান তা কল্পনা করুন, কোনো একজনকে তা হবার আদর্শ হিসাবে কল্পনা করুন, মনে মনে তার ছবি এঁকে নিন। অতঃপর সফলতার লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করুন, সাফল্য আসবে। চিন্তা হচ্ছে বড় শক্তি। দৃঢ় মনোবল নিয়ে অটুট বিশ্বাস নিয়ে আপনার বিষয়টি চিন্তা করুন। এই চিন্তা আপনার মনকে করে তুলবে সৃজনশীল। ইচ্ছানুযায়ী কর্ম হয় এবং সব কর্মেরই ফলোদয় হয়। আমাদের মন যেরূপ আমরাও হই ঠিক সেরূপ। নিজের চিন্তা নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে মাথা উঁচু করে চলুন। সাফল্য আসবেই।
নেপোলিয়ন, ওয়েলিংটন, রী, গ্রান্ট, ফোচ–সকল বিখ্যাত সামরিক নেতা স্বীকার করেছেন যে একটি সামরিক বাহিনীর বিজয় অর্জনের ইচ্ছা এবং বিজয় অর্জনের যোগ্যতা সম্পর্কে তার আস্থা বিজয় নিশ্চিত করে।
“নব্বই হাজার বিজিত ব্যক্তি” বলেছেন মার্শাল ফোচ, “নব্বই হাজার বিজয়ী ব্যক্তির আগেই ঝিমিয়ে পড়েন। কেননা, তারা বিজয় লাভ সম্পর্কে হতাশ হন। এই হতাশা তাদের নৈতিক অথঃপতন ঘটায় এবং পরিশেষে তারা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। প্রতিরোধ করতে পারে না ঠেকাতে পারে না।”
অন্যথায়, পরাজিত নব্বই হাজার লোকের সকলেই বেত্রাঘাত প্রাপ্ত নয়। কিন্তু তারা মানসিক ভাবে বেত্রাঘাত প্রাপ্ত, তারা আত্মবিশ্বাস ও সাহস হারা, তাই হয় তারা পরাজিত। আত্মবিশ্বাস ও সাহস হারা বাহিনীর বিজয়ের কোনো পথ নেই। এ ধরনের কোনো মানুষেরও সাফল্যের কোনো আশা নেই।
মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন যাজক ফোজিয়ার প্রথম মহাযুদ্ধ কালে নৌবাহিনীতে যাজক হতে ইচ্ছুক বহু বক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। নৌ-বাহিনীর যাজকের সাফল্যের জন্যে কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন –চারটা জি। সেগুলো হচ্ছে গ্রেস, গ্রুমসান, গ্লিট ও গুর্টস অর্থাৎ দয়া, সাধারণ বুদ্ধি, চরিত্রের দৃঢ়তা ও সহন শক্তি।
বক্তৃতায় সাফল্যের জন্যেও এগুলো প্রয়োজন। এগুলোকে আপনার আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করুন। রবার্টের নিম্নপদ্যটিকে আপনারা সমর-সঙ্গীত রূপে গ্রহণ করুন।
আপনি যখন হারিয়ে যাবেন বনে
হবেন ভয়ে শিশুর মতো শংকিত–
চোখে মৃত্যুর ছায়া দেখে হবেন আতঙ্কিত
হবেন মর্ম যাতনায় দগ্ধ, নয় বা আকাঙ্ক্ষিত।
হতাশ হৃদয়ে বেষ্টিত হবেন আত্মহত্যায় —
কিন্তু মানব জীবনের নিয়ম–সগ্রাম সর্ব অবস্থায়;
আত্মবিশ্বাস নিষিদ্ধ, বেআইনী কাজ হয়ে —
ক্ষুধা এবং যন্ত্রণা, অবশ্যই সহ্য করা যায়,
প্রাতভোজে শক্ত রুটি। কী নিরূপায়। অসহায়,
খেলায় আপনি অনাসক্ত। কী লজ্জার বিষয়–
তরুণ, সাহসী উজ্জ্বলের তরে এমন হবার নয়।
আপনার মনোভাবে স্থিতি নেই এটা প্রকাশ না হয়,
উঠুন, আগুন, লড়ে যান সদা। অনন্ত হৃদয়–
অতঃপর হবে আপনার বিজয়।
হবেন না যন্ত্র হবেন না পশু, কোনোভাবে।
নিজের পায়ে দাঁড়ান, জয় আপনারই হবে।
মার খেয়ে কাদা, মৃত্যু, সে তো সহজ কাজ বড়–
বাগদা চিংড়ির মতো হামা দেয়া, জড় সড়।
কিন্তু হৃদয়ে হতাশা নয়, সংগ্রাম আর সংগ্রাম
বিজয়ের তরে চালাতেই হবে এই প্রোগ্রাম।
সকল ক্ষেত্রেই হবে তবে জয়–
ঝড় ঝঞ্ঝার নিশ্চিত হবে লয়।
মৃত্যুর আগে মরা সে তো অনেক সহজ কাজ–
বাঁচার মতো বেঁচে থাকাই তো ফরজ আজ।
সংক্ষিপ্ত সার :
(১) আস্তে-আস্তে বা ধাপে-ধাপে আমরা কোনো কিছু শিখি না, তা যে গলফ খেলা, ফরাসি ভাষা শেখা, বক্তৃতা শেখা যাই হোক। হঠাৎ শুরু করে এক ধাক্কায় আমরা এগিয়ে যাই। অতঃপর আমরা স্থির হয়ে বসি অথবা পিছিয়ে পড়ি এবং কখনো বা শেখা কোনো কিছু ভুলে যাই, বিস্মৃত হই। মনোবিজ্ঞানীরা এই স্থিতিকালকে বলেন, শিক্ষার বক্র অধিত্যকা। আমরা কঠোর পরিশ্রম করেও এই ‘অধিত্যকা’ হতে বের হয়ে আসতে পারি না, কখনো বা এগুতে পারলেও আবার পিছিয়ে পড়ি। কিছু লোক, আমাদের অগ্রগতির পদ্ধতি বুঝতে না পেরে অধিত্যকায় পড়ে হতাশ হয়ে চেষ্টা ছেড়ে দেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, তারা যদি চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন, অভ্যাস করতেন সতত, তা হলে তারা একদিন দেখতে পেতেন, হঠাৎ তারা বিমানের চাইতেও দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসছেন, রাতারাতি অকল্পনীয় অগ্রগতি ও সাফল্য লাভ করেছেন।
(২) বক্তৃতা শুরু করার প্রারম্ভে আপনি কখনো স্নায়বিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। কিন্তু আপনি যদি ধৈর্যশীল হন তাহলে শীঘ্রই আপনি প্রাথমিক ভয় ছাড়া সবকিছু কাটিয়ে উঠতে পারবেন এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা করার পর আপনার ভয় দূরীভূত হবে।
(৩) অধ্যাকি জেনম বলেছেন যে, কারো তার শিক্ষা সম্পর্কে কোনোরূপ উৎকণ্ঠা রাখা উচিৎ নয় এবং সত্যি যদি যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে একদিন যে তার সামসাময়িকদের মধ্যে দক্ষ ব্যক্তি হয়ে উঠবে, ক্ষেত্র বা বিষয় তার যাই হোক না কেন। এর মনস্তাত্ত্বিক সত্য আপনার ওপর এবং আপনার বক্তৃতা শেখার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করুন। আপনার সাফল্য আসবে প্রশ্নাতীত ভাবে। এভাবে যে লোক সফল হয় সে মাত্রাতিরিক্ত মেধার অধিকারী নয়, সাধারণ ধিশক্তিসম্পন্ন। ধৈর্যও দৃঢ় প্রত্যয়ই জয়ের কারণ দৃঢ়তার সাথে চেষ্টা করে সফল হন।
(৪) জনসভায় বক্তৃতা করে সাফল্যলাভের চিন্তা করুন। এই চিন্তা মনে থাকলে সাফল্য অর্জনের জন্যে যা করা প্রয়োজন তা আপনি করতে পারবেন।
(৫) আপনি যদি হতাশ হয়ে পড়েন তাহলে টেডি রুজভেল্টের পরিকল্পনা অনুসরণে লিংকনের ছবির দিকে তাকান এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার মতো অবস্থায় পড়লে তিনি কী করতেন।
(৬) প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মার্কিন নৌবাহিনীর জনৈক পদস্থ যাজক, যাজকের সাফল্যের কথায় বলেছেন চারটি শব্দ, চারটি জি, সেগুলো কী?
০৬. সুভাষণ প্রদানের গোপন তথ্য
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার অব্যবহিত পরে আমি লন্ডনে দু’ভাই স্যার রোক ও স্যার কেইথ স্মিথের সাক্ষাৎলাভ করি। তারা সদ্য লন্ডন হতে অস্ট্রেলিয়ায় বিমান সফর সমাপ্ত করেছেন, এই সাফল্যজনক সফরের জন্যে অস্ট্রেলিয়া চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে এবং তাঁরা নাইট উপাধি পেয়েছেন।
মনোরম দৃশ্যের খ্যাতনামা চিত্রগ্রাহক কেল্টিন হার্লি এই সফরকালে কিছু পথ তাদের সাথে ছিলেন এবং মুভি ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন। আমি তাঁদের এই সফর সম্পর্কে বক্তৃতা শেখাই এবং বক্তৃতা পরিবেশনের পদ্ধতি শিক্ষা দেই। লন্ডনের ফিলারমনিক হলে চার মাস ধরে দিনে দু’বার করে বক্তৃতা চলে। একজন বিকালে অপরজন রাতে বক্তৃতা করেন।
তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল একইরূপ, কেননা, তাঁরা পাশাপাশি বসেই বিশ্বের অর্ধেক ভ্রমণ করেছেন, তাঁদের বক্তৃতার বিষয়ও ছিল অভিন্ন এবং শব্দগত ভাবেও ছিল মিল এতৎসত্বেও বক্তৃতার ধারণা কিন্তু একইরূপ শোনাত না।
এই বক্তৃতার শব্দের সাথে আরো একটি জিনিস ছিল সেটি হচ্ছে বলার ধরন, প্রকাশ ভঙ্গি। ”আপনি কী বলবেন তার চাইতে কীভাবে বলবেন সেটা অধিক মূল্যবান।”
একবার এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে জনৈকা তরুণীর পাশে আমি বসেছিলাম। আমি দেখেছি, কাজুরকা বাজানোর সময় সে তরুণী বই পড়ছে, এর কারণ হচ্ছে সুর তার বোধগম্য হচ্ছিল না। অতঃপর শিল্পী যখন আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গিতে একটি সুর পরিবেশন করতে শুরু করে তরুণীটিও তখন বই বন্ধ করে মঞ্চের দিতে তাকায় নিবিষ্ট চিত্তে, শোনে সে সুর নিবিষ্ট চিত্তে, যদিও সে সুরের কোনো অর্থ তার মর্মে পশছিল না, সুর প্রকাশের ভঙ্গি, পরিবেশনের ভঙ্গি তরুণীটিকে জাগিয়ে তোলে, আকর্ষিত করে, না বুঝলেও তন্ময় হয়ে শোনে, তরুণী আনন্দ পায়।
খ্যাতনামা রুশ চিত্র শিল্পী ব্ৰলফ একবার তার এক ছাত্রের একটি চিত্র সংশোধন করেন। ছাত্রটি তার সংশোধিত চিত্রটির প্রতি দেখেন এবং বিস্মিত কণ্ঠে বলেন।”আপনার ক্ষুদ্র আঁচড়ের ফলে চিত্রটিই পরিচিত হয়ে গেছে।” ব্রুফ বলেন, “ক্ষুদ্র আঁচড়েই শিল্পের জন্ম।” শিল্পের মতো ভাষণ প্রদানের ক্ষেত্রেও এটি একইভাবে সত্য।
শব্দ চয়নের ক্ষেত্রেও এটি একইভাবে প্রযোজ্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি পুরাতন প্রবাদ আছে, কী বিষয়ে বলা হচ্ছে তা নয়, কীভাবে বলা হচ্ছে তার উপরই সাফল্য নির্ভর করে।
সুবাচন ভঙ্গি যে কোনো সামান্য বিষয়কেও গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয়, হৃদয় গ্রাহী করে তোলে। আমি সবসময় এটা লক্ষ্য করেছি যে, কলেজে বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় যেসব ছাত্র জয়লাভ করতো তাদের সবার জয় বিষয়বস্তুর জন্যে হত না, হত প্রকাশ ভঙ্গির জন্যে। যে বক্তা প্রাঞ্জল, আকর্ষণীয় ও সুললিত ভাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন, বিষয়টি যাই হোক না কেন তার ভাষণ হয় হৃদয়গ্রাহী।
”একটা ভাষণে তিনটি জিনিস থাকে,“ বলেছেন লর্ডমলে, সেগুলো হচ্ছে, কে বললেন, কীভাবে বললেন এবং এগুলোর মধ্যে শেষটির গুরুত্বও কম নয়। এটা কী বাড়িয়ে বলা? মোটে না। বাস্তব অনুসন্ধান করলে আপনি এর সত্যতার প্রমাণ পাবেন।
লর্ড এডমান্ডবার্ক লিখিত ভাষণগুলো এতো সুন্দর, যুক্তিপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ ও রসপূর্ণ হত যে তা আজো কথাসাহিত্যের ক্লাসিক হিসাবে পাঠ করা হয়। কিন্তু এটা সত্য যে বক্তা হিসবে বার্ক ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাঁর বক্তৃতা করার ক্ষমতা ছিল নড়বড়ে। বক্তব্যকে তিনি করতে পারতেন না আকর্ষণীয় ও জোরদার; এবং হাউস অব কমন্সে তাঁকে বলা হত ‘ডিনারবেল’। যখন তিনি কিছু বলতে দাঁড়াবেন তখন অন্যান্য সদস্যরা হাঁচি দিতেন, কাশি দিতেন, তালগোল পাকিয়ে দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে যেতেন।
আপনি আপনার সকল শক্তি দিয়ে যে কোনো ব্যক্তির উপর ইস্পাত জ্যাকেট বদ্ধ বুলেট নিক্ষেপ করতে পারেন, ঠিক মতো না লাগলে সে আঘাতে তার কাপড়ে আঁচড় পড়বে না। কিন্তু যদি কিছু পাউডার কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেন বা ছিটান তা হবে সামান্য কিছু হলেও তার গায়ে পড়বে। সুতরাং বক্তৃতায় ইস্পাত বর্মাচ্ছাদিত বুলেটের চাইতে পাউডার সদৃশ কাহিনী অনেক ভালো, ফলপ্রসু। সুতরাং বক্তৃতার কালে বক্তব্য হতে বাচনভঙ্গির উপর জোর দেয়া, গুরুত্ব দেয়া অনেক বেশি ভালো; ফলপ্রসূ।
সুভাষণের গোপন কথা :
বক্তৃতাদানের পদ্ধতি সম্পর্কে বহু অন্তহীন ও একঘেয়ে কথা লেখা হয়েছে। এর ওপর নিয়ম কানুনের বহু পর্দা যোগিয়ে এটিকে আরো গুপ্ত রহস্যপূর্ণ করে তোলা হয়েছে, পুরাতন ধরনের বাকপটুতা বিষয়টিকে আরো ঘৃণিত ও বিদ্রুপাত্মক করে তুলেছে। ব্যবসায়ীরা পুস্তকের দোকানে বক্তৃতা সম্পর্কে বই অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে সব বই পান সেগুলোর অধিকাংশই তাদের জন্যে অপ্রয়োজনীয়। সামাজিক অগ্রগতি সত্ত্বেও স্কুলে ছাত্রদের আজো ওয়েবেষ্টার এবং এনগারসোল পড়নো হয় যা কোনো অবস্থাতেই যুগোপযোগী নয়, যার স্টাইল হয়ে পড়েছে সেকেলে। মিসেস এগনার সেকে অথবা মিসেস ওয়েবেস্টার যে ধরনের টুপি পরতো আজ কেউ সে ধরনের টুপি পরলে হবেন উপহাস্যের পাত্র। তাঁদের স্টাইল অনুসরণও হবে ব্যঙ্গাত্মক।
গৃহযুদ্ধের পর বক্তৃতার ধরন এবং বক্তৃতাদান পদ্ধতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সময়ের সাথে সঙ্গতি রাখতে হলে, তাল মিলাতে হলে টেলিগ্রামের গতিতে পদ্ধতি বদলাতে হবে। অর্থহীন বাক্য, আজকের যুগে কোনো শ্রোতাই শুনবেন না, সহ্য করবেন না।
আধুনিক শ্রোতারা, তারা সংখ্যার পনেরো জন অথবা হাজার জন হতে পারেন, কামনা করেন যে, বক্তা যা বলবেন, সরাসরি বলবেন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শ্রোতারা, তারা সংখ্যার পনেরো জন অথবা হাজার জন হতে পারেন, কামনা করেন যে, বক্তা যা বলবেন, সরাসরি বলবেন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলবেন না, যা বলবেন সহজভাবে বলবেন, সাবলীল ভাবে বলবেন, যাতে শ্রোতারা সরাসরি তা বুঝতে পারে। এমন ভাবে বলবেন, ঠিক যে ভাবে তিনি কথাবার্তা বলেন।
সাধারণ কথোপকথনে তিনি যেভাবে কথা বলেন, সেভাবে বলবেন, তবে বক্তৃতা কালে জোর একটু বেশি দিতে হবে অর্থাৎ বড় করে বলতে হবে। এমনভাবে বলতে হবে যাতে শ্রোতারা শুনতে পায়। একজনের সাথে কথা যেভাবে বলেন চল্লিশ জনের সামনে বলতে ঠিক সেরূপ ধ্বনিতে বলা চলবে না, বড় করে শব্দ পরিষ্কার করে বলতে হবে যাতে শুনতে ও বুঝতে কারো অসুবিধা না হয়।
নাবাদার খনিতে মার্কটোয়েনকে একজন শ্রমিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি এখন যেভাবে বক্তৃতা করছেন এটাই কী আপনার স্বাভাবিক গলার বাকপটুতা?
শ্রোতারা চান বক্তার ‘স্বাভাবিক গলার বাকপটুতা’ নিম্নস্বরও নয়, গলাফাটা চিৎকারও নয়?
ঘরোয়া বৈঠকে বক্তৃতা আর প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা এক নয়, ঘরোয়া পরিবেশে অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রকাশ্য সভায় সফল হওয়া যায় না। বলেছেন জন হেনরী স্মিথ!
আমি একজন বিশিষ্ট উপন্যাসিকের বক্তৃতার কথা বর্ণনা করেছি। সে হলরুমে তিনি বক্তৃতা করেছেন। ঠিক সেই হলরুমে, কয়েক মাস পরে স্যার অলিভার লজ বক্তৃতা করেন। সেই বক্তৃতাটি শোনার সুযোগও আমার হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য বিষয়টি ছিল এ্যাটম ও বিশ্ব। অর্ধশতাব্দী তিনি এই বিষয়টির উপর অধ্যয়ন, গবেষণা, পরীক্ষা ও চিন্তা করেছেন। সুতরাং বিষয়টি তার মন হৃদয় মস্তিষ্ক ও জীবনের সাথে সংযুক্ত। বিষয়টির আগাগোড়া তাঁর নখদর্পণে। এতৎসত্ত্বেও বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে তিনি হঠাৎ বোবা হয়ে পড়েন। কারণ তিনি বক্তৃতা করতে অভ্যস্ত ছিলেন না। বিষয়টি তিনি জানতেন, ভালো ভাবেই জানতেন, কেহ প্রশ্ন করলে অত্যন্ত সহজ সরল ও সাবলীল ভাষায় তা বুঝিয়ে দিতে পারতেন,প্রশ্নকর্তাকে পরিতৃপ্তি দিতে পারতেন, সন্তুষ্ট করতে পারতেন। এ্যাটম বা অনুসম্পর্কে প্রশ্নকর্তাও তার সদুত্তর পেতেন। তিনি এমনভাবে বলতে পারতেন শুনে মনে হত তিনি যা দেখছেন ভাবছেন বুঝছেন অনুভব করছেন আমরা ঠিক তাই দেখছি ভাবছি বুঝছি অনুভব করছি। কিন্তু বক্তৃতা প্রদান তা নয়।
বিষয়টি জানা ছিল বলে তিনি অবস্থা কটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। এর ফল কী হয়? তিনি আকর্ষণীয় বক্তৃতা করেন। শ্রোতাদের বিমোহিত করেন। তিনি একজন শক্তিমান বক্তা বলে প্রমাণিত হন। কিন্তু আমি নিশ্চিত ভাবে জানি, তিনি নিজেকে তেমন ভাবেন না। আমি এটাও নিশ্চিত যে কিছু লোক বুঝতে পেরেছে তিনি মোটেই সুবক্তা নন।
এই বই পড়ে যদি আপনি বক্তৃতা করতে শুরু করেন শ্রোতারা আপনার বক্তৃতা শোনে তাহলে আমাকে কোনোরূপ কৃতিত্ব দেয়া প্রয়োজন নেই। কারণ শ্রোতারা শুনলেই বক্তা হওয়া যায় না বা বক্তৃতা হয় না, বক্তৃতা হবে সেটি যে বক্তৃতা আপনি শিখে গেলেও শ্রোতারা কোনো ভাবেই ধরতে পারবে না যে আপনি শিখা বক্তৃতা পেশ করেছেন। আপনার বক্তৃতায় সেরূপ স্বাভাবিকতা থাকতে হবে। যে বক্তা বক্তৃতাকারে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে পারেন, শ্রোতা তাকে সুবক্তা বলে মনে করেন, তাঁর বক্তৃতা করার ধরনও বা যাই হোক না। সুতরাং স্বাভাবিকতা রক্ষা করতে পারায় সুভাষণের একটি বিশেষ গুণ।
হেনরি ফোর্ডের উপদেশ :
“সকল ফোর্ডই প্রায় একরূপ” একটি প্রচলিত প্রবচন কিন্তু যে কোনো দু’ব্যক্তি ঠিক একরূপ হয় না। বিশ্বের প্রতিটি জীবই স্বতন্ত্র, এখানে নতুন যে আসে তার সাথে পুরাতনের হুবহু মিল থাকে না, পুরাতন একই রূপ নিয়ে আবার আসে না। একজন তরুণকে তার নিজের সম্পর্কে ঠিক এই ধারণা গ্রহণ করতে হবে, তাকে ঐরূপ ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে হবে যা তাকে অন্যান্য হতে স্বতন্ত্র করে এবং সে গুণই তার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। সমাজ ও শিক্ষালয় তার এরূপ গুণগত উৎকর্ষ সাধনে সাহায্য করতে পারে, আমাদিগকে একই রূপ করে তোলার প্রচেষ্টা ঠিক নয়? সুতরাং নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলার ক্ষেত্রে নিজেরও বিশেষ চেষ্টা অবশ্যই থাকতে হবে।
বক্তৃতা শেখার ব্যাপারে বিষয়টি আরো সত্য। এ বিশ্ব সংসারে আপনার মতো কোনো মানুষ নেই। লাখ-লাখ লোকের দুটি চোখ, নাক ও মুখ আছে, কিন্তু তাদের কারো চেহারাই আপনার সাথে মিলবে না, এবং তাদের মধ্যে কেহ-কেহ অবশ্য আপনি যে ভাবে বলেন ঠিক সেভাবে কথা বলতে সক্ষম হতে পারেন। অন্য কথায়, আপনার একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। বক্তা হিসাবে এটা আপনার বিশেষ মূল্যবান গুণ। দৃঢ়তার সাথে এগুলোর উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করুন। ফলে আপনার বক্তব্য জোরদার হবে, এভাবেই আপনি গুরুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
স্যার অলিভার লজ যে বক্তৃতা করতেন তা অন্যান্যদের থেকে স্বতন্ত্র হত, কারণ তিনি নিজেও ছিলেন। স্বতন্ত্র ব্যক্তি। মানুষের দাড়িগোঁফ ও চুলহীন মস্তিষ্ক যেমন একরূপ না ঠিক সেভাবে দুজনের বক্তৃতা একরূপ হয় না। যদি কেহ লয়েড জর্জকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুকরণ করতে চায় তাহলে সে ব্যর্থ হবে, হতে বাধ্য।
আমেরিকায় সবচাইতে প্রসিদ্ধি অর্জনকারী বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় সিনেটর স্টিফেন এ. ডগলাস আব্রাহাম লিংকনের মধ্যে, ১৮৫৮ সালে ইলিনয়েচ শহরে। লিংকন ছিলেন লম্বা ও ছিপছিপে, ডগলাস ছিলেন বেঁটে ও মোটা। শরীরের মতো এই দু ব্যক্তির চরিত্র, মনোভাব ব্যক্তিত্ব এবং স্বভাবও ছিল ভিন্ন ধরনের।
ডগলাস ছিলেন বিশ্বের সেরা সংস্কৃতিবান ব্যক্তি, লিংকন এসেছিলেন নিম্নস্তর হতে সম্মুখ ভাগে। ডগলাসের অঙ্গভঙ্গি ছিল মাধুর্যপূর্ণ। লিংকনের অঙ্গভঙ্গি ছিল এলোমেলো। ডগলাসের বক্তব্য হত ব্যঙ্গ কৌতুকপূর্ণ, লিংকন ছিলেন শ্রেষ্ঠতম গল্পকার। ডগলাসের ভাষা ছিল সহজতর। লিংকন উপমা ও উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন। ডগলাস ছিলেন গর্বিত ও কর্তৃত্ব প্রয়াশী। লিংকন ছিলেন নম্রও ক্ষমাশীল, ডগলাস চিন্তা করতে পারতেন দ্রুত। লিংকনের মানসিক ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত শ্লথ। ডগলাস ঘূর্ণিঝড়ের প্রেরণা ও গতি নিয়ে বক্তৃতা করতেন। লিংকন নির্ঞ্ঝাট ও বিবেচক।
এই দুজনেই ছিলেন সফল বক্তা, সুবক্তা। কারণ তারা দু’জনই ছিলেন সচেতনও সাহসী। তাঁদের মধ্যে কেহ যদি অন্যকে অনুসরণ করতে চাইতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হতেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের পথ অনুসরণ করেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সুতরাং তাদের অনুসরণ করুন।
এটা একটি সহজ নির্দেশ। কিন্তু এটা অনুসরণ করা কি সহজ? না তা নয়। মার্শাল ফেচ যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে বলেছেন, এটা বোঝা খুবই সহজ, কিন্তু কাজে লাগানো, বাস্তবায়িত করা অত্যন্ত কঠিন, এই নির্দেশের ক্ষেত্রে তা সত্য।
শ্রোতাদের সামনে স্বাভাবিক হতে হলে অভ্যাস প্রয়োজন। অভিনেতারা তা জানেন। চার বছরের একটি ছেলে বা মেয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কোনো কিছুই স্বাভাবিক ‘আবৃত্তি করতে পারে কিন্তু সে শিশুর বয়স এখন ২৪ অথবা ৪৫ বছর হয় তখন কি তার পক্ষে ঠিক সেভাবে আবৃত্তি করা সম্ভব? চার বছরের শিশুর বোধশক্তি ছিল না, তাই সে পেরেছিল স্বাভাবিক হতে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধির পর সেরূপ বোধশক্তি হীন হওয়া কি সম্ভব? এরূপ অনমনীয় শক্তি অর্জন করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য পেশ করবেন বলে আশা করা, ঘুঘু সদৃশ ব্যক্তিও করতে পারবে না।
কোনো ব্যক্তিকে বক্তৃতা দান শেখানো ও প্রশিক্ষণ দেয়া তার স্বাভাবিক শক্তির ওপর আর একটি বিশেষ কিছু চাপানো হয়, এটা শুধুমাত্র তার তোতলানি বন্ধ করা, তাকে স্বাভাবিক করা এবং কোনো ব্যক্তি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে পড়ে যাওয়া মানুষটি যেরূপ ভাবে কথা বলে সেরূপ কথা বলতে তাকে উপযুক্ত করে তোলা। শত-শত বার আমি বক্তাদের তাদের বক্তৃতাদান কালে থামিয়ে দিয়েছি এবং তাদের মানুষের মতো বলতে উৎসাহিত করেছি। শত-শত রাতে আমি মানুষকে স্বাভাবিক নিয়মে বক্তৃতা করাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরে ফিরেছি। বিশ্বাস করুন, আমি কথাকে যেভাবে বলে ফেলেছি, কাজটা কিন্তু তত সহজ নয়।
এবং আপনি এই ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা অর্জন করতে পারেন একমাত্র অভ্যাসের দ্বারা। আপনি অভ্যাস করলে দেখতে পারেন যে, আপনি অলঙ্কার পূর্ণ ভাষায় কথা বলতে পারছেন, স্বাভাবিক নিয়মে দ্রুততার সাথে কিছু প্রকাশ করতে পারছেন, “এখানে কি ভুল আছে, অনুসন্ধান করুন, সংশোধন করুন।” অতঃপর শ্রোতাদের মধ্যে থেকে এমন একজনকে বেছে নিন যাকে আপনি সবচাইতে বোকা মনে করেন। ভুলে যান সে সেখানে অন্য কোনো লোক আছে। তার সাথে কথা বলুন। কল্পনা করুন যে, সে আপনাকে কোনো প্রশ্ন করছে এবং আপনি তার উত্তর দিচ্ছেন। সে যদি দাঁড়ায় এবং কথা বলে এবং আপনাকে উত্তর দিতে হয়, তাহলে আপনার আলোচনা হয়ে পড়বে প্রশ্নোত্তর মূলক, স্বাভাবিক প্রত্যক্ষ। সুতরাং ঠিক এভাবে কল্পনা করে বক্তৃতা দান অভ্যাস করুন।
আপনার মন অতদূরে নিয়ে যান যেখানে প্রশ্ন করতে ও উত্তর দিতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আপনার বক্তব্য পেশকালে আপনি বলতে পারেন, “আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন আমার কাছে এর কি প্রমাণ আছে? আমার হাতে এর যথেষ্ট প্রমাণ আছে এবং তা হচ্ছে এই”অতঃপর কল্পিত প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকুন। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে করা যায়। এটা করলে বক্তৃতায় একঘেয়েমি দূর হয়। বক্তৃতা হয় অধিকতর প্রত্যক্ষ, আনন্দদায়ক কথোপকথন মূলক।
সরলতা, প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি আন্তরিক আগ্রহ আপনাকে সাহায্য করবে। যখন কোনো ব্যক্তি হয় তার অনুভূতির প্রভাবে প্রভাবিত, তার মনোভাব ঠিক সেভাবেই প্রকাশিত হয়। অনুভূতির প্রভাব তাকে দিয়ে কথা বলায়। সুতরাং যে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে কথা বলতে পারেন, কাজ করতে পারে এবং এই কাজ ও কথা হয় স্বাভাবিক।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে হয়, তা হচ্ছে আপনি যা বলবেন তাতে মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে, স্বচ্ছ গতিতে তা প্রকাশের চেষ্টা করুন?
“আপনি কখনো ভুলবেন না” ইয়েল ধর্মশাস্ত্র স্কুলে বক্তৃতা কালে বলেছিলেন ডিন ব্রাউন, “সে বর্ণনা, বা সেবা সম্পর্কে লন্ডন শহরে শোনা বক্তৃতায় পুনরাবৃত্তি করেছিলেন আমার এক বন্ধু। এই প্রচারের উদ্যোক্তা ছিলেন জর্জ ম্যাকডোনাল্ড। তিনি সেদিন সকালে সেবা সম্পর্কে একাদশ অধ্যায় পাঠ করেন। ধর্মশাস্ত্রের ওপর বক্তৃতা করার সময় বিশ্বাস কী তা আমি আপনাদের কাছে বলবার চেষ্টা করব না। তত্ত্বের অধ্যাপকেরা আছেন যারা এ বিষয়টি আপনাদের ভালো বোঝাতে পারবেন। আমি শুধু আপনাদের বিশ্বাস অর্জনে সাহায্য করবো। তিনি কথাগুলো এমন ভাবে বললেন যে, সকল শ্রোতার মনে একটা বিশ্বাসের জন্ম নিল। কেননা তার কাজের সাথে সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর হৃদয়ের। আর বক্তৃতা হয়েছিল প্রাঞ্জল, তা ছিল তার হৃদয় উৎসারিত বক্তব্য।”
তাঁর কাজের সাথে অন্তরের সমন্বয় বা সংযোগ ঘটেছিল, এটাই গোপন তথ্য। এতৎসত্ত্বেও আমি জানি যে, এই উপদেশ তেমন জনপ্রিয় নয়। সাধারণ ছাত্ররা আরো সাধারণ নিয়ম চান, নিশ্চিত কিছু চান। এমন কিছু চান যাতে তিনি হাত দিতে পারেন। গাড়ি চালানোর যেমন নিয়ম আছে, চান ঠিক তেমন নিয়ম।
এটাই তিনি চান, আমিও তাকে দিতে চাই। এটা তার জন্যে সহজ হবে, আমার জন্যেও সহজ হবে। এ ধরনের নিয়ম আছে, সেখানে শুধু সামান্য ত্রুটি আছে, যা অবশ্য ব্যবহার্য নয়। তাহলে বক্তৃতা স্বাভাবিক ভাবে মন দিয়ে রসকষপূর্ণ বক্তব্য পেশ করতে পারবেন। আমার যৌবনে আমি তাদের জন্যে বহু সময় নষ্ট করেছি; কিন্তু তাদের নাম এই পৃষ্ঠায় উল্লেখ করার উপযুক্ত হয় নি। জনবিলিং একদা বলেছিলেন, সংসারে এমন অনেক কিছু আছে যা সবার জন্য প্রয়োজনীয়।
জনসভায় বক্তৃতাকালে আপনি কি এই কাজগুলি করবেন?
জনসভায় বক্তৃতা বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার, আরো বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ করার জন্যে আমরা এক্ষেত্রে স্বাভাবিক বক্তব্যের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করব। এটা করতে গিয়ে আমার মনে দৌদুল্যমানতা এসেছিল। তবে আমি আমার সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, “আমার ওপর চাপ দিলে আমি সব কিছু ঠিক ভাবে বলতে পারি, কিন্তু আপনার বেলায় এটি সত্য নাও হতে পারে। চাপ দিলে হয়তো বা আপনি যা জানা আছে তাও ভুলে গিয়ে কাঠের ঘোড়ার মতো হয়ে যেতে পারেন।”
আপনি গতরাতে এসব নিয়ম পালন করেছেন অচেতন মনে। কেননা, নৈশ ভোজে আপনি বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। সুতরাং একমনে অচেতন মনের উপরই চাপ প্রয়োগে সুফল পাওয়া যায়। কিন্তু সচেতন মনে বক্তৃতা করতে হলে প্রয়োজন অভ্যাস।
প্রথমত : ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দের উপর জোর দিন অন্য শব্দকে সহযোগী হিসাবে গ্রহণ করুন :
আলাপ আলোচনাকালে আমরা শব্দের একটি সিল্যাবলের উপর বিশেষ জোর দেই, অন্য শব্দগুলোকে সাধারণ ভাবেই উচ্চারণ করি। যেমন-মাংসসুংলেটস, এট ট্রাক-শাস, এন-ভাই রনমেন্ট। বাক্যের ক্ষেত্রেও আমরা ঠিক একই কাজ করি। আমরা একটি বাক্যের একটি বা দুটি শব্দের উপর নিউইয়র্কের পঞ্চম এ্যাভিনিউস্থ এম্পায়ার স্ট্রেট-বিল্ডিং এর মতো জোর দেই।
এই পদ্ধতিটা কোথাও অপরিচিত পদ্ধতি নয়। আপনি যত্রতত্র এরূপ জোর দিয়ে উচ্চারণ করবেন। আপনি নিজেও সবসময় কোনো কোনো শব্দ উচ্চারণে শব্দাংশে জোর দেন, বাক্যে কোনো-কোনো শব্দে জোর দেন, ভবিষ্যতে দিবেন।
এখানে একটি উদাহরণ দেয়া হচ্ছে। নিম্নের বড় অক্ষরের লেখা শব্দগুলোর উপর জোর দিয়ে প্রশ্ন পড়ুন। ফলে কি বুঝতে পারছেন? ভেবে দেখবেন।
আমি যে কাজেই হাত দিই না কেন সফল হই, কেননা আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সে কাজে হাত দেই। মানব সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ গ্রহণে আমি ইতঃস্তত করি না–নেপোলিয়ন।
এই লাইনগুলো পাঠের পদ্ধতি একটি নয়। অন্য বক্তা এটিকে অন্য ভাবেও পাঠ করতে পারেন, জোর দেয়ার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এটা বক্তার উপরই নির্ভরশীল।
নিম্নপঙক্তিগুলো জোর দিয়ে পাঠ করার চেষ্টা করুন, অতঃপর এটার তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। আপনি কি কিছু শব্দের ওপর জোর দিয়ে অন্যগুলো দ্রুত উচ্চারণ করে শেষ করতে চান না?
যদি না থাকে সাহস নির্যাতন হবে না বন্ধ,
করা যাবে না, প্রতিরোধ, মোকাবেলা।
মনে যদি না থাকে নিশ্চিত বিশ্বাস।
বিজয় অসম্ভব, ব্যর্থ হবে ছলাকলা।
রণক্ষেত্র, কুসুম শয্যা নয়।
শক্তি আছে যার জয় তারই হয়।
আগে বা পরে এ ব্যক্তিরই হয় জয়,
আত্মবিশ্বাসে নেই যার কোনো সংশয়।–এ্যানন।
দৃঢ় প্রত্যয়ের চাইতে সম্ভবত আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নেই। যে বালক, কালে মহান ব্যক্তি হবে অথবা হবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি তাকে হাজার বাধা অতিক্রমের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে চলতে হবে, বাধা অতিক্রম করতে হবে। শত বাধা-বিপত্তিতে ও হতাশ না হয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপে–থিওডর রুজভেল্ট।
দ্বিতীয়ত : আপনার স্বর পরিবর্তন করুন :
কথোপকথনে আপনার শব্দের ধ্বনি বা স্বরের উত্থান-পতন হয় উঁচু-নিচু, যেন সমুদ্রের তরঙ্গ, মহা সাগরের ঊর্মি। কেন? কেহই জানেন না, এবং কেহই এটা ব্যাখ্যা করতে পারেন না। এর ফলাফল আনন্দদায়ক এবং এটাই প্রকৃতির নিয়ম, আমরা কখনো এটা করতে শিখি না, এটা আমাদের আয়ত্বে আসে, যেমন শিশু জন্মায়, কিন্তু শ্রোতাদের সামনে দাঁড়াতে গেলে আমাদের স্বর অনেক সময় হয়ে যায় অশ্রাব্য, যেন আমরা দাঁড়িয়েছি নেভাদা মরুতে।
যখন আপনি বক্তৃতা করার কোনো কিছু পাবেন না, বিশেষ করে আপনার স্বর এক ঘেয়ে মনে হবে তখনই আপনি একটু থামুন, নিজে-নিজে ভেবে নিন, “আমি একটি কাঠের যন্ত্রের মতো কথা বলছি, এসব লোকের সামনে কথা বলতে হলে নম্রভাবে বলতে হবে, স্বাভাবিক হতে হবে।”
এই ধরনের চিন্তা কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করবে? অবশ্যই কিছু সাহায্য করবে। সামান্য কিছুক্ষণের বিরতি আপনাকে সাহায্য করবে। অভ্যাস থাকলে আপনার সমস্যার সমাধান অবশ্যই আপনি করতে পারবেন।
অথচ স্বর নামিয়ে অথবা ভুলে আপনি প্রয়োজনীয় একটি প্রবাদ বাক্য বলতে পারেন। ব্রকলীনের কংগ্রেস দলীয় মন্ত্রী ডা: এস পার্কস ক্যাডম্যান প্রায়ই এরূপ করতেন, স্যার অলিভার জজ, ব্রাইস ও রুজভেল্ট এরূপ করতেন। খ্যাতনামা প্রায় সকল বক্তা এরূপ করতেন, অর্থাৎ এরূপ করে তারা কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করতেন।
নিম্নবর্ণিত বাক্যগুলোর পাঠে আপনার স্বাভাবিক স্বরকে নিচে নামান। দেখুন কি ফল লাভ করেন।
আমার একটি ছাড়া কোনো গুণ নেই এবং সে গুণটি হচ্ছে হতাশ না হওয়া। বলেছেন মার্শাল ফেচ।
শিক্ষার মূল লক্ষ্য জ্ঞান নয়, কর্ম। বলেছেন হার্বাট স্পেন্সার।
আমার ৮৬ বছরের জীবনকালে আমি বহু লোককে সাফল্য অর্জন করতে দেখেছি, দেখেছি শত-শত লোক একমাত্র বিশ্বাসের কারণেই সফল হয়েছে। বলেছেন, কার্ডিন্যাল গিবনস।
তৃতীয়ত:-বক্তৃতার ধারা পরিবর্তন করুন :
যখন কোনো শিশু কথা বলে অথবা যখন আমরা সাধারণ আলোচনায় অংশ নিই, আমরা আমাদের কথার ধারা পরিবর্তন করি অব্যাহত ভাবে। এটা আনন্দ ধারণাকে দৃঢ়ও বদ্ধ মূল করে প্রতিষ্ঠা করা চলে।
মিশৌরী ইতিহাস সমিতি প্রকাশিত ওয়াণ্টার ভি. স্ট্রিভেন্স, এর রিপোর্টারস লিংকন এ বলা হয়েছে যে, লিংকন নিম্নলিখিত ভাবে একটি পয়েন্টের ওপর জোর দিতেন :
তিনি দ্রুততালে বহু শব্দ বলে যেতেন, অতঃপর একটি শব্দ ও প্রবাদে এসে তার ওপর জোর দিতেন, বিশেষ জোর দিয়ে উচ্চস্বরে আওড়াতেন, পরিশেষে বিদ্যুৎ চমকের মতো দ্রুত গতিতে বাক্য সমাপ্ত করতেন।একটি বা দুটি শব্দের ওপর, যে গুলোর ওপর তিনি জোর দিতেন এত বেশি সময় ক্ষেপণ করতেন যে, পরবর্তী ডজন শব্দ বলতেও অতবেশি সময় প্রয়োজন হত না।
এই পদ্ধতি সহজে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষত আমি প্রায়ই সাধারণ ভাষণে কার্ডিন্যাল গিবনের একটি বিবৃতি উল্লেখ করতাম, অর্জিত সাহসের ধারণার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে চাইতাম। সুতরাং আমি কতিপয় শব্দের ওপর এত বেশি জোর দিতাম যেন ঐ শব্দ দ্বারা আমি অভিভূত। আপনি কি নিম্নবিষয়টি শব্দ করে পাঠ করে, একই পদ্ধতি অনুসরণে ফলাফল নোট করেন? বিবৃতির বড় শব্দগুলোর ওপর জোর দিন।
মৃত্যুর স্বল্পকালে আগে কার্ডিন্যাল গিবন বলেছেন, “আমার বয়স ছিয়াশি বছর। আমি বহুলোককে সাফল্য অর্জন করতে দেখেছি, যাদের মধ্যে শতশত ব্যক্তি সফল হয়েছেন বিশ্বাস গুণে এবং এটি বিশেষ গুরুতুপূর্ণ। সাহস হীন কোনো ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করতে পারে না।
এভাবে চেষ্টা করে বলুন ”তিনকোটি ডলার।” এটা এমন ভাবে দ্রুত বলুন যাতে এটা অত্যন্ত নগণ্য অর্থ বলে মনে হয়। এবার অত্যন্ত ধীর গতিতে বলুন, ‘তিন কোটি ডলার।” এমন গতানুগতিকভাবে বলুন যেন এটি অতবেশি অর্থাৎ তেমন গুরুত্ব লাভ না করে। তিন কোটি ডলারের চাইতে ত্রিশ হাজার ধ্বনির শব্দ কি বড় নয়?
চতুর্থ : গুরুত্বপূর্ণ ধারণার আগে ও পরে বিরতি :
লিংকন বক্তৃতাকালে প্রায়ই হাসতেন। যখন কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে চাইতেন তখন তিনি সে পয়েন্টটি বলার আগে বক্তৃতা থামিয়ে শ্রোতাদের দিকে দৃষ্টি দিতেন, সরাসরি তাদের চোখে-চোখে তাকাতেন, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত কিছু বলতেন না। হঠাৎ এই থেমে পড়ার ফলও হত হঠাৎ গণ্ডগোলের মতো। এটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। এটার পরে কী আসছে তার প্রতি সকলকে মনোযোগী, সতর্ক ও সজাগ করে তুলত। উদাহরণ স্বরূপ ডগলাসের সাথে তাঁর প্রখ্যাত বিতর্ক যখন শেষ হয়ে আসছিল, তখন তার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল, তিনি নিজেও যখন হয়ে পড়েছিলেন হতাশ, তখন তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কাল অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণে নিজেকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
বক্তৃতার উপসংহার টানতে গিয়ে হঠাৎ তিনি থেমে যান এবং কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন, অর্ধ অমনোযোগী, অর্ধ বন্ধুরূপী মুখগুলোর প্রতি তাকান, দেখতে পান যে, তারা সকলেই যেন গভীর সমুদ্রে অবগাহন করার মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন, কারো-কারো চোখ সজল, হস্তদ্বয় তিনি বন্ধ করেন, যেন এগুলোও ক্লান্ত, অতঃপর তিনি তার অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলেন, “বন্ধুগণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে জর্জ ডগলাস অথবা আমি যেই নির্বাচিত হই না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু যেগুলো আজ আমরা আপনাদের সামনে পেশ করলাম। সেগুলো অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ, সে কোনোরূপ ব্যক্তি স্বার্থের বহু উর্ধ্বে এবং এগুলো যে কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক ভাগ্যের চাইতে অনেক বড়। এবং বন্ধুগণ, (এখানেও তিনি থামেন এবং দর্শক শ্রোতাদের চোখের দিকে তাকান) তাই এই প্রশ্নটি চির জাগরুক থাকবে। ডগলাস অথবা আমার কণ্ঠখানি স্তব্ধ হয়ে যাবে চিরতরে, যখন আমরা ঢলে পড়ব মৃত্যুর কোলে যখন আমরা মিশে যাব মাটিতে তখনো প্রশ্নটি থেকে যাবে। সুতরাং এগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করুন।”
“এই সাধারণ শব্দগুলো,“ লিখেছেন একজন জীবনীকার, “তাদের মনপ্রাণ আকর্ষণ করে।”
যে সব শব্দ বা প্রবচনের উপর জোর দিতেন লিংকন সে-সব শব্দের শেষেও থামতেন। ও সব শব্দের উপর বিশেষ জোর দিতেন বলে সেগুলোর অর্থও প্রকাশের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে যেতো, শ্রোতাদের হৃদয়ে পশতো।
স্যার অলিভার লজ বক্তৃতাকালে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রকাশের আগে পরে থামতেন, একটি বাক্যে তিন বা চার বারও থামতেন, কিন্তু তিনি তা করতেন নিতান্ত স্বাভাবিক নিয়মে ও গতিতে। আলিভারের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে সবার পক্ষে এটা বোঝা অত্যন্ত সহজ হবে।
“আপনার নীরবতা দ্বারা”, বলছেন কিপলিং ”আপনার বক্তব্য সুস্পষ্ট হয়।” বক্তৃতাকালে যথা সময়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে নীরবতা পালন করা গেলে তার ফল হয় সবচাইতে উত্তম। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, এতৎসত্ত্বেও কিন্তু নবীন বক্তারা তা উপেক্ষা করে থাকেন।
হলম্যান এর বক্তৃতা হতে অংশটি উদ্ধৃত করছি এবং এতে আমি নীরবতার জন্য কতিপয় স্থান নির্দিষ্ট করেছি। আমি বলি না যে, আমি নির্দিষ্ট করেছি শুধু তাই-ই নীরবতার কেন্দ্র হবে এবং উত্তম কেন্দ্র হবে। আমি শুধু বলি যে, এভাবে স্থান নির্দিষ্ট করা চলে। কোথায় থামতে হবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন নেই। এটা নির্ভর করে অর্থ এবং অনুভূতির উপর। একই বিষয়ে প্রদত্ত বক্তৃতায় আজ আপনি যে সব স্থানে থামলেন কাল সেসব স্থানে না থেমে; নীরব না থেকে অন্যত্র থামতে পারেন, নীরব থাকতে পারেন। নিম্ন উদ্ধৃত অংশটি কোনোরূপ নীরবতা ছাড়া একবার পাঠ করুন। অতঃপর আবার পাঠ করুন; থামুন যে-সব স্থানে আমি কমার চিহ্ন দিয়েছি, এই থামার ফলাফল কী?
“পণ্য বিক্রি একটি সংগ্রাম” (থামুন এবং সংগ্রাম শব্দের অর্থ অনুধাবন করুন) “এবং একমাত্র যোদ্ধারাই এতে জয় লাভ করতে পারেন।” (থামুন এবং পুরো তাৎপর্য অনুধাবন করুন।)”আমরা এই অবস্থা পছন্দ নাও করতে পারি কিন্তু আমরা এই অবস্থা সৃষ্টি করি নি এবং পরিবর্তনও করতে পারি না।” (থামুন) ”বিক্রি, ব্যবসায় নামার সময় পূর্ণ সাহস নিয়ে নামুন; (থামুন) ”যদি তা না করেন।” (থামুন এবং কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকুন,)” যতবার আপনি বিজয়ী হবার চেষ্টা করবেন তত বারই পরাজিত হবেন এবং পরিশেষে আপনি দেনাদার হয়ে পড়বেন, “(থামুন)”। “ভীত ব্যক্তি কখনো প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারে না (থামুন এবং অর্থ অনুধাবন করুন)”সব সময় এটা স্মরণ রাখুন” (থামুন এবং পুরো অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন), “যে খেলোয়াড় বলকে নিজের আয়ত্তে রেখে গোল মুখে এগিয়ে যায় সে সব সময়, যে খেলোয়াড় বল পেয়ে দূর থেকে তা গোলে ফেলার চেষ্টা করে, তার চাইতে ভালো,“ (থামুন এবং নীরবতা পালন।) “দৃঢ় হলে গোল দেয়া তার পক্ষেই সহজতর।”
নিম্ন উদ্ধৃতিটি শব্দ করে, জোর দিয়ে অর্থ বুঝে পড়ুন। কোথায় কোথায় থামবেন তা ঠিক করুন।
আমেরিকার বিশাল মরুভূমি ইদাহো নিউম্যাক্সিকো বা আরিজোনায় অবস্থিত নয়। এটা প্রায় আমেরিকানের টুপির নিচে-অবস্থিত, কারণ, বিশাল আমেরিকান মরুভূমি হচ্ছে বাস্তব মরুভূমি নয়, মস্তিষ্কের মরুভূমি। অর্থাৎ মস্তিষ্কের অনুর্বরতাই হচ্ছে মরুভূমি। জে. এন. কনক্স।
মানুষের সর্বরোগ হর কোনো মহৌষধ নেই, যা আছে তা হচ্ছে প্রচার। অধ্যাপক ফক্স ওয়েল।
দু’জনকে আমার সন্তুষ্ট করতে হবে। তারা হচ্ছেন ভগবান এবং গারফিল্ড। গারফিল্ডের সাথে আমাকে সংসারে চলতে হবে এবং সংসার ধর্ম শেষে যেতে হবে ভগবানের কাছে–জেমস, এ গারফিল্ড।
এই অধ্যায়ে আমি যে সব নির্দেশ দিয়েছি তা অনুসরণ করেও বক্তারা শতশত ভুল করতে পারেন। যে কোনো বক্তা সাধারণ ভাবে যে রূপ স্বরে কথা বলেন ঠিক সে স্বরে বক্তৃতা শুরু করতে পারেন। অতঃপর তিনি স্বরে পরিবর্তন আনতে পারেন, এতে সময় সময় ভুল করে অসুবিধা জনক পরিস্থিতিতেও পড়তে পারেন। যে কোনো লোকের দৈনন্দিন কথাবার্তা বলার পদ্ধতিতেও উন্নতি বিধান করা প্রয়োজন। আপনার স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার পদ্ধতি সঠিক করুন, অতঃপর সেভাবে বক্তৃতা করার চেষ্টা করুন।
সংক্ষিপ্ত সার :
১। বক্তৃতায় শব্দ ছাড়া আরো কিছু আছে। তা হচ্ছে কীভাবে বক্তৃতা দেয়া হল তা অর্থাৎ পদ্ধতি। “আপনি কি বলবেন তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কী ভাবে বললেন।”
২। বহু বক্তা শ্রোতাদের অবজ্ঞা করেন, তাদের মাথার ওপর দিয়ে অথবা মেঝের দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা করেন। তাদের বক্তৃতা হয় স্বগতোক্তি। এই বক্তব্য শ্রোতার মন আকর্ষণ করে না, বক্তা ও শ্রোতার সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এই ধরনের বক্তৃতা অর্থহীন ও ব্যর্থ হয়।
৩। সাধারণ বাচন ভঙ্গিতে প্রদত্ত সুভাষণ হয় ফলপ্রসু, ঘরোয়া পরিবেশে যেভাবে কথা বলা হয় ঠিক সেভাবে বক্তৃতা করার চেষ্টা করলে তার ফলও ভালো হয়। জন স্মিথ ঠিক এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন।
৪। প্রত্যেক লোকেরই কথা বলার ক্ষমতা আছে। এতে আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগলে নিজের মন থেকেই এর উত্তর পেতে পারেন। একজন লোককে, যাকে আপনি সব চাইতে নিরীহ ও নির্বোধ বলে মনে করেন, তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিন। সে ওঠে দাঁড়িয়ে যে কথা বলবে তা সুমধুর হবে না, তবু তাতে গতি থাকবে। আমরা চাই যে, আপনি বক্তৃতা মঞ্চে ধাক্কা খেয়ে জেগে উঠুন, এটা করতে হলে প্রয়োজন অভ্যাস। অন্যদের অনুকরণ করবেন না। আপনি অব্যাহত ভাবে কথা বলতে পারলে, নিজস্ব ভঙ্গিতে বক্তৃতা করতে পারলে বিশ্বেশ্রেষ্ঠ বক্তা হবেন। সুতরাং বক্তৃতায় আপনার ব্যক্তিত্ব, চরিত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করুন।
৫। শ্রোতাদের সামনে এমনভাবে বক্তৃতা করুন, যেন তারা আপনার বক্তৃতা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে এবং আপনার সাথে কথা বলছে, তারা যদি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে, তা হলে আপনার বক্তৃতা নিশ্চিতভাবেই উন্নত হবে এবং দ্রুত হবে। সুতরাং কল্পনা করুন যে, কেহ আপনাকে প্রশ্ন করছে এবং আপনি তার পুনরাবৃত্তি করছেন। উচ্চ শব্দে বলুন, “আপনি প্রশ্ন করতে পারেন আমি কীভাবে এটা জানলাম? আমি আপনাকে বলব। এটা নিতান্ত স্বাভাবিক দেখাবে। কিন্তু এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনার বক্তৃতার গতি বাড়বে, বক্তৃতা ভালো হবে।
৬। আপনার বক্তব্য বিষয়ের ওপর মনপ্রাণ ঢেলে দিন। আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করলে বক্তৃতা ভালো হবে।
৭। কথোপথনের সময় আমরা অবচেতন মনে চারটি কাজ করি। কিন্তু জনসভায় বক্তৃতা কালে আপনি তা কি করেন?
অধিকাংশ লোক তা করে না!
(ক) একটি বাক্যের গুরুত্বপূর্ণ শব্দের ওপর জোর দিয়ে অন্য শব্দকে কি সাধারণ ভাবে উচ্চারণ করেন? এবং, কিন্তু, প্রতিটি শব্দের পর আপনি কি সম-মনোযোগ দেন অথবা মাসা-সুসেটস বলতে সু-র ওপর যেভাবে জোর দেন ঠিক সেভাবে প্রত্যেক শব্দের কোনো না কোনো সিল্যাবলের ওপর জোর দেন?
(খ) ছোট শিশু কথা বলার সময় তার স্বরের যেভাবে উত্থান-পতন হয় আপনার কথা বলার সময়ও কি তা হয়?
(গ) কথা বলায় আপনার কি গতি পরিবর্তন হয়? আপনি কি সাধারণ শব্দের চাইতে যার ওপর গুরুত্ব বেশি দেন সে শব্দকে ঠিক সেরূপ জোর দিয়ে প্রকাশ করেন?
(ঘ) আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভাব প্রকাশের আগে ও পরে কি আপনি থামেন, নীরবতা পালন করেন?
০৭. মঞ্চারোহণ ও ব্যক্তিত্ব
কার্নেগী কারিগরী ইনস্টিটিউট একবার একশতজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ীর মেধা সম্পর্কে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। যুদ্ধকালে সৈনিকদের যেভাবে পরীক্ষা নেয়া হয় ঠিক সেভাবেই এই পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এই পরীক্ষার ভিত্তিতে ইনস্টিটিউট ঘোঘণা করে যে, ব্যবসায়ে মেধার চাইতে ব্যক্তিত্বের সাফল্য লাভ ঘটে অনেক বেশি। ..
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা, ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান, শিক্ষাবিদের জন্য মূল্যবান, মূল্যবান পেশাদার লেখকদের জন্য, বক্তাদের জন্য।
ব্যাক্তিত্ব–প্রস্তুতির কথা বাদ দিলে জনসভার বক্তৃতায় সাফল্যের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ”অলঙ্কার পূর্ণ বক্তৃতায়,“ বলেছেন এলবার্ট হুবার্ট, “শব্দ নয়, বক্তৃতাদান পদ্ধতিরই জয় হয়। অর্থাৎ ধারণার চাইতে, চিন্তার চাইতে প্রকাশভঙ্গিরই গুরুত্ব বেশি। কিন্তু ব্যক্তিত্ব হচ্ছে অস্পষ্ট ও ছলনাময় ব্যাপার, সেগুলি সৌরভের যেমন কোনো বিশ্লেষণ করা যায় না, ব্যক্তিত্বও ঠিক তেমনি অস্পষ্ট। এটা হচ্ছে একজন মানুষের শারীরিক, মানসিক, মনমেজাজ, ধ্যান-ধারণা, সাহস, অভিজ্ঞতা, অভিরুচি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, উদ্যোগ-উদ্দীপনা প্রভৃতির মিলিত নামের আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের মতো এটিও একটি জটিল বিষয়, যার সামান্যই বোঝা যায়।
উত্তরাধিকার ও পরিবেশের ভিত্তিতেই ব্যক্তিত্ব যাচাই করা হয় এবং এটা পরিবর্তন বা উন্নয়ন অসম্ভব। তবে এটাকে চেষ্টার মাধ্যমে সামান্য উন্নত করা যায়, গতিশীল ও আকর্ষণীয় করা যায়। সর্বতোভাবে চেষ্টা করলে অবশ্যই প্রকৃতি দত্ত এই শক্তির বিকাশ সম্ভব। বিষয়টি আমাদের সকলের কাছেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে উন্নয়নের সম্ভাবনা সীমিত হলেও এ ব্যাপারে চেষ্টা চালানো অবশ্যই প্রয়োজন।
আপনি যদি আপনার ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটাতে চান শ্রোতাদের সামনে ক্লান্ত দেহে যাবেন না। ক্লান্ত বক্তা কখনো দর্শকশ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয় না। সর্বশেষ মূহূর্ত পর্যন্তই আপনার প্রস্তুতিও পরিকল্পনা সম্পর্কে চিন্তা করবেন, যাতে কোনো ভুলত্রুটি হতে না পারে। এভাবে প্রস্তুতি নিলে সঠিকভাবেই বক্তব্য পেশ করা সহজতর হবে। তবে যে-সময় চলে গেছে; সে-সময়ের জন্য মনে চিন্তা রেখে প্রস্তুতি নিলে আপনি শারীরিক ও মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়বেন। যে সময় গেছে তা নয়, যে সময় হাতে আছে তাকে কাজে লাগাবার চিন্তা করুন, সেভাবে প্রস্তুতি গ্রহণই উত্তম পন্থা।
বিকেল ৪টায় যদি কোনো কমিটি বৈঠকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেয়ার কথা থাকে তাহলে হাল্কা মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণ করুন। অতঃপর বিশ্রাম নিন, শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের ফাঁকে বিষয়টি ভেবে নিন। সুভাষণের জন্যে, এই বিশ্রাম বিশেষ প্রয়োজন।
গেরান্ডিন ফার সাধারণত রাতে বন্ধুদের সামান্য কথোপকথনের পরই বিদায় সম্ভাষণ জানাতেন। তিনি তার বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা করার সময় এবং বিশ্রাম নেয়ার জন্য বন্ধুদের তার স্বামীর কাছে বসিয়ে নিজের কাজে চলে যেতেন। মাদাম নর্ডিকা বলেছেন যে, সুবক্তা হতে হলে অথবা সুভাষণ প্রস্তুত করতে হলে সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎকার, খাদ্য গ্রহণ প্রভৃতি সকল বিষয়েই সংযম পালন করা প্রয়োজন।
আপনি যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের কথা চিন্তা করবেন তখন আপনাকে ক্ষুধা সম্পর্কে অবশ্যই সাবধান হতে হবে। প্রয়োজন আছে, তাই সামান্য খাদ্য গ্রহণ করুন। হেনরী ওয়ার্ড বেচার রাতে বক্তৃতার প্রস্তুতি হিসাবে রোববার বিকেল পাঁচটায় হাল্কা খাবার গ্রহণ করতেন, এই খাবারে থাকতো সামান্য নাস্তা ও সামান্য দুধ। এর বেশি তিনি আর কোনো খাবার খেতেন না। মাদার মেলবা বলেছেন, যে রাতে আমি গান গাই সে রাতের আগে বিকেল পাঁচটায় আমি নৈশভোজ গ্রহণ করি। সে খাদ্যে থাকে সামান্য মাছ মুরগির মাংস, সামান্য রুটি এবং পানি অথবা মিষ্টি রুটিও আপেল। ফলে গান গাওয়ার সময় আমি নিজেকে অত্যন্ত হাল্কা অনুভব করি। রাতে অনুষ্ঠান শেষে অবশ্য আমি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি।”
একজন পেশাদার বক্তা হয়েও দৈনিক দুঘন্টা বক্তৃতাদানের অভ্যাস করার আগে পর্যন্ত আমি বুঝতে পারতাম না কেন মেলবা বেকার উপরোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা লাভ করে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, যেদিন আমি গুরুভোজন করে, কোনোরূপ বিশ্রাম না নিয়ে মঞ্চে দাঁড়াতাম সেদিন হয় শারীরিক বা মানসিক বা বক্তৃতার দিক দিয়ে আমি অসুবিধায় পড়তাম। মনে হত, আমার পেটের খাবার আমাকে বক্তৃতা করতে বাধা দিচ্ছে। আমার শরীর ভারী হয়ে আছে। পেডারেভস্কি, বলেছেন, কোনো কনসার্ট পার্টিতে অংশ গ্রহণের আগে তিনি যেদিন গুরুভোজন অর্থাৎ নিজের ইচ্ছানুযায়ী খাবার খেতেন সেদিন তাঁর শরীর ভারী হয়ে যেতো এবং মঞ্চে হাতের আঙুল চলত না ঠিক ভাবে মনে হত আঙুলগুলো ভারী হয়ে গেছে ভীষণভাবে। ফলে সেদিন তাঁর অনুষ্ঠান জমত না।
শ্রোতার আকর্ষণ বক্তা হতে বক্তায় ভিন্নতর হয় কেন?
আপনার স্মরণ শক্তি যেন ভোতা হয়ে না পড়ে। কারণ এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একজন বক্তা এবং বক্তৃতা শিক্ষকের যে সব প্রাথমিক গুণাবলি প্রয়োজন তা হচ্ছে চেতনা, সজীবতা ও উদ্যম। বন্য হাঁস যেভাবে বসন্তের শস্যক্ষেত্রে জমায়েত হয়, ঠিক সেভাবে প্রাণবন্ত বক্তার চতুর্দিকেও হয় শ্রোতার সমাবেশ।
লন্ডনের হাইড পার্কে আমি ঠিক এরূপ অবস্থা অবলোকন করেছি। মার্বেল তোরণের পাশে দাঁড়িয়ে যে কোনো জাতের ধর্মের, বর্ণের বা দেশের মানুষই বক্তৃতা করতে পারেন। রোবরাবের বিকেল যে কোনো একটা ক্যাথলিক ধর্মের বৈশিষ্ট্য, কার্ল মার্কসের অর্থনৈতিক দর্শন অথবা ভারতের মুসলমানদের দু’জন স্ত্রী রাখার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করতে পারেন। বক্তৃতা করতে পারেন যে কোনো বিষয়ে। আমি দেখেছি একজন বক্তাকে ঘিরে ধরেছেন শত-শত শ্রোতা, অপর বক্তা বক্তৃতা করছেন প্রায় শূন্য মাঠে। কেন? বক্তৃতায় বিষয় বস্তুর জন্যই কি এরূপ হয়? না। এর কারণ হচ্ছে বক্তা এবং বক্তৃতা। যে বক্তা বক্তব্য বিষয় যাই হোক না কেন, তা পেশ করতে পারেন আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে, সুললিত ও প্রাঞ্জল ভাষায়, সেই বক্তার প্রতি শ্রোতা আকর্ষিত হন বেশি। তাঁর চেতনা সজীবতা বক্তৃতাকে করে তোলে জীবন্ত, ফলে তা সকল শ্রোতাকে এত কাছে টেনে আনে। এক্ষেত্রে বিষয়ের গুরুত্ব এবং বৈশিষ্ট্য নয়, প্রকাশ ভঙ্গিরই প্রাধান্য।
জেনারেল লী-যখন তাঁর বাহিনীসহ আত্মসমর্পণ করতে আসেন তখন তার পরনে ছিল ধোপদুরস্থ নতুন, পোশাক এবং কোমরে ঝুলান ছিল মূল্যবান তরবারি। এ্যান্টের পরনে ছিল তখন শুধুমাত্র সাধারণ শার্ট ও পায়জামা, গায়ে ছিল না কোনো কোট। ”আমার পোশাক ছিল না অনুষ্ঠানের উপযোগী। তিনি লিখেছেন তাঁর জীবন স্মৃতিতে,“ অনুষ্ঠান উপযোগী পোশাক পরিহিত মানুষটির সামনে আমি মনে-মনে হয়ে পড়েছিলাম অপ্রস্তুত। এই ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনার জন্যে যে পোশাক দরকার সেদিন গ্রান্টের পোশাক সে ধরনের ছিল না, এটাই গ্রান্টের জীবনের একটি দুঃখজনক মুহূর্ত।
ওয়াশিংটনের কৃষি বিভাগ তার পরীক্ষামূলক খামারে হাজার-হাজার মৌমাছি পালন করে। প্রতিটি মৌচাক বিরাট আয়না দিয়ে ঢাকা। যে কোনো সময় বোতাম-টিপে আলো জ্বালিয়ে মৌচাকের মৌমাছি দেখা চলে। লক্ষ্য করা চলে ওদের গতিবিধি।-একজন বক্তাও ঠিক মৌচাকের মতো। সকল শ্রোতার দৃষ্টি তার ওপর পতিত। সকল শ্রোতাই তাকে দেখছে। বক্তার চেহারায় সামান্য অসন্তোষ বা দুঃখের চিহ্ন দেখা গেলে তা শ্রোতারা অতি সহজেই দেখতে পান, বুঝতে পারেন! বক্তৃতা করার আগেই আমরা অভিনন্দিত বা নিন্দিত হই : বেশ কয়েক বছর আগে আমি আমেরিকার একটি ম্যাগাজিনের জন্যে নিউইয়র্কের জনৈক ব্যাংকারের জীবনী সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। এই নিবন্ধের মাল-মশলা সংগ্রহ কালে আমি তাঁর জনৈক বন্ধুর কাছ থেকে তার সাফল্যের কারণ জানতে চেয়েছিলাম। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, হাসি। তার হাসি মানুষের হৃদয় জয় করে নিত বলে তিনি সফল হয়েছিলেন। প্রথমে আমি এটি বিশ্বাস করতে পারি নি। কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখলাম অভিজ্ঞতার সাথে এই গুণটি যোগ হওয়ায় তিনি সফল হয়েছিলেন। অন্যান্য অভিজ্ঞ ব্যক্তির এই গুণটি না থাকায় তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন নি। হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালে যে কোনো লোক খুশি হয়। যে ব্যক্তি হেসে অভ্যর্থনা জানাতে পারে সে অন্যদের সমর্থন পায়। এই সমর্থনই সাফল্যের চাবি কাঠি!
”যে ব্যক্তি হাসতে পারে না”, একটা চীনা প্রবাদ আছে, “তার ব্যবসা করা সাজে না।“ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তার পক্ষে হাসি মুখ করা কি শ্রোতাদের স্বাগত জানানো নয়? আমি এক্ষেত্রে ব্রকলিন বাণিজ্য সংস্থার পরিচালিত একটি কোর্সে অংশ গ্রহণকারী জনৈক ছাত্রের কথা উল্লেখ করব। সে ছাত্রটি সব সময় শ্রোতাদের সামনে হাসি মুখে দাঁড়াত। সে যে কাজ করত তা হাসি মুখেই করত। হাসি সব সময় তার ঠোঁটে লেগেই থাকত। ফলে সহসাই এই সদা হাস্য মুখ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বক্তা হিসাবে যে সফল বা সুবক্তা না হলেও সে যা বলত হাসি মুখে বলত বলে সবাই তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করত। অর্থাৎ বক্তৃতা করার আগেই সে শ্রোতাদের জয় করে নিত।
কিন্তু আমি এমনও দেখেছি, যে বক্তা অত্যন্ত গম্ভীর মনোভাব নিয়ে মঞ্চে দাঁড়ান, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ করে অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে, তিনি শ্রোতাদের মন জয় করতে ব্যর্থ হন। অর্থাৎ মঞ্চে তাকে দেখেই শ্রোতাদের মনে সৃষ্টি হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এই ধরনের মুখ কালো করা বক্তা বক্তৃতা শেষ করে ফেলুক এটাই শ্রোতারা কামনা করেন। ফলে তাদের বক্তৃতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও শ্রোতাদের মনে দাগ কাটে না।
আমরা যদি আমাদের শ্রোতাদের প্রতি আগ্রহী হই, বলেছেন অধ্যাপক ওভারস্ট্রীট, মানবচরিত্র, বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শ্রোতারাও আমাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। আমরা যদি শ্রোতাদের প্রতি কুটি করি, শ্রোতারাও প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে আমাদের প্রতি ভ্রুকুটি করব। আমরা তাদের যদি অবজ্ঞা করি, তারাও আমাদের প্রতি অবজ্ঞা করবে। আমরা যদি ধৃষ্টতা পূর্ণ ও দাম্ভিব হই শ্রোতাদের কাছ থেকে পাবো আমরা অনুরূপ ব্যবহার। সুতরাং বক্তৃতা করার আগেই আমরা অভিনন্দিত বা ধিকৃত হব। আমরা যেরূপ আচরণ করব জবাবও পাবো ঠিক অনুরূপ সুতরাং সদ্ব্যবহার পেতে হলে আমাদের ব্যবহারও হতে হবে সৎ।”
শ্রোতাদের একত্রিত করুন :
একজন সাধারণ বক্তা হিসাবে আমি বহু বিকেলে একটি হলে আগত বিক্ষিপ্ত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেছি এবং রাতে একই হলে একত্রিত বা দলবদ্ধ শ্রোতাদের উদ্দেশ্যেও বক্তৃতা করেছি। বিকেলের শ্রোতারা কোনো একটি কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসেছে, রাতের শ্রোতারা কিন্তু হাসে নি তবে মুচকি হাসির চিহ্ন তাদের চোখে মুখে ফুটেছে, বিকেলের শ্রোতারা সে ক্ষেত্রে মনোযোগী ছিল না, রাতের শ্রোতাদের ক্ষেত্রে গভীর মনোযোগী দেখেছি, কেন এমন হয়?
এর একটা কারণ এই যে, বিকেলে বয়স্ক মহিলা এবং শিশুরা আসে। এরা তেমন মনোযোগী হতে পারে না। রাতের শ্রোতাদের মধ্যে এদের সংখ্যা তেমন থাকে না, সুতরাং তারা হয় মনোযোগী, তবে এটা একটি আংশিক ব্যাখ্যা মাত্র।
তবে আসল তথ্য হচ্ছে এই যে শ্রোতারা বিচ্ছিন্নভাবে বসলে তাদের মনকে সহজে আকর্ষণ করা যায় না। তাদের মধ্যেকার শূন্যস্থান বা খালি চেয়ারগুলো যেন তাদের মনকেও শূন্য করে, খালি করে রাখে।
হেনরী ওয়ার্ড বেচার তার ইয়েল বক্তৃতায় বলেছেন, মানুষ প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, “ক্ষুদ্র জনতা হতে বহুতর সমাবেশে বক্তৃতা করা কি আপনার জন্যে অধিকতর প্রেরণাদায়ক হয় না? না। আমি উত্তর দেই। হাজার লোকের সামনে দাঁড়ালে আমার বক্তৃতা যেরূপ হয় মাত্র বারো জন লোকের সামনেও হয় ঠিক অনুরূপ। তবে এই বারো জনকে বসতে হবে ঘন হয়ে কাছাকাছি, কিন্তু হাজার জনও যদি বিস্তৃত খোলা মাঠে বিক্ষিপ্ত হয়ে দূরে-দূরে বসে তাহলে আমার বক্তব্য জমে না? জনতাকে একত্রিত করুন, নিকটতর করুন, তাহলেই বক্তব্য সুস্পষ্ট হবে।
যে কোনো বড় সমাবেশে উপস্থিত সকল ব্যক্তি নিজস্ব সত্ত্বা হারায়। বক্তৃতা শোনার সময় সে হয়ে পড়ে শ্রোতাদের একজন মাত্র। শ্রোতাদের হাসিতে সে যোগ দেয়, কিন্তু নিজে কোনো বিষয়ে হাসে না!
এই ধরনের সমাবেশে সকলকে এক সাথে উদ্বুদ্ধ করা সহজ, ব্যক্তি বিশেষকে নয়। যুদ্ধযাত্রীরা যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে, যে কোনোরূপ সংকটজনক ঘটনা ঘটাতে প্রস্তুত থাকে। কেননা, তারা যাত্রা করে একজন হয়ে। বিগত যুদ্ধকালে জার্মান সৈনিকেরা যুদ্ধ করেছিল বাহুতে বাহু মিলিয়ে এবং এটাই তাদের অগ্রগতির কারণ।
জনতা! জনতা! জনতা! এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যত আন্দোলনের জয় হয়েছে, হয়েছে সংস্কার, তা হয়েছে জনতার অংশ গ্রহণে। এ সম্পর্কে ডীন মার্টিনের লেখা জনতার আচরণ বইটি খুবই সুখপাঠ্য।
আমরা যদি ক্ষুদ্র সংখ্যক জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে চাই তাহলে আমাদের সমবেত হওয়া। উচিৎ একটি অতিক্ষুদ্র স্থানে। বিরাট হলে বিচ্ছিন্ন ভাবে বসার চাইতে ছোট জায়গায় দলবদ্ধ ভাবে বসা অনেক ভালো।
আপনার শ্রোতারা যদি বিচ্ছিন্ন ভাবে বসেন, তা হলে তাদের আপনার সামনে এসে বসতে অনুরোধ করুন। বক্তৃতা শুরু করার আগে এটার উপর জোর দিন।
শ্রোতার সংখ্যা যথেষ্ট না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কম সংখ্যক শ্রোতা নিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়াবেন না। স্বল্প শ্রোতার বিক্ষিপ্ত উপস্থিতিতে ভালো বক্তাও সুভাষণ প্রকাশ করতে পারেন না। তবে শ্রোতার সংখ্যা স্বল্প হলে তাদের কাছে এসে, পাশাপাশি বসতে বলুন। শ্রোতাদের সাথে মিশে তাদেরকে পরস্পরের কাছে এনে বসাবার ব্যবস্থা করুন। অতঃপর মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করুন। বক্তৃতা স্বচ্ছন্দ হবে।
মেজর পশু জানালা ভাঙতেন :
মুক্ত বায়ু প্রয়োজন। বক্তৃতা স্থানে অর্থাৎ জনসমাবেশে অম্লজান অত্যন্ত প্রয়োজন। এটা প্রয়োজন মানুসের অবাধ স্বাস-নিশ্বাসের জন্যে। জীবনের স্পন্দন অব্যাহত রাখার জন্যে। বায়ু দূষিত হলে একটি হলে দর্শক বেশিক্ষণ থাকে না, থাকতে পারে না। আলোচনা বা সঙ্গীতানুষ্ঠান যত আকর্ষণীয় হোক না কেন, শ্রোতারা চলে যান। সুতরাং যে কোনো সভার একাধিক সংখ্যক বক্তৃতার সাথে আমি উপস্থিত থাকলে বক্তৃতা শুরু করার আগে আমি জানালা খুলে ফেলার ব্যবস্থা করি এবং এই জানালা খোলা কালে আমি শ্রোতাদের প্রতি নির্মল বায়ু সেবন করে মুহূর্তকাল বিশ্রাম নেয়ার আবেদন জানিয়ে থাকি। মেজর জেমস বি. পশু প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে হেনরী ওয়ার্ড বেচারের ম্যানেজার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রও কানাডায় ঘুরেছেন। বেচারা তখন এসব স্থানে বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছিলেন। শ্রোতাদের উপস্থিতির আগেই মেজর পশু বক্তৃতার জন্যে নির্দিষ্ট হলে বা গির্জা অথবা থিয়েটার পরিদর্শন করে আসতেন। তিনি পরীক্ষা করতেন সেখানকার বসার ব্যবস্থা, আলোর ব্যবস্থা। পরীক্ষা করতেন তাপ ও আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। একজন পুরাতন সামরিক
অফিসার হিসাবে তিনি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে ভালবাসতেন। কোনো স্থানের তাপ তার পছন্দ না হলে, বায়ু। চলাচলের সুব্যবস্থা না দেখলে, জানালা খুলে দেয়ার চেষ্টা করতেন, জানালা খুলতে না পারলে তা ভেঙে দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, “অম্লজান (অক্সিজেন) হচ্ছে স্রষ্টার দান।” সুতরাং এটাকে নাগালের বাইরে রাখা অন্যায়।
আপনার চেহারা আলোকিত হোক :
আপনি যদি কোনো ভৌতিক কাণ্ড দেখাতে বা সৃষ্টি করতে চান তাহলে সমস্ত কক্ষটিকে আলোকে উদ্ভাসিত করে ফেলুন। যথাসম্ভব সকল বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আলোর বন্যা বইয়ে দিন। অর্ধালোকিত কক্ষে শ্রোতারা বক্তার প্রতি তেমন আকর্ষণ অনুভব করে না। কিন্তু আলোকোজ্জ্বল কক্ষে বক্তাদের মন এগিয়ে যায় বক্তার প্রতি। সুতরাং কক্ষটিকে থার্মোফ্লাক্সের ভিতরের অর্ধ অন্ধকারের মতো না রেখে আলোকিত করুন।
মঞ্চ সম্পর্কে ডেভিড বেলাশে লিখিত নিবন্ধ পড়ুন, আপনি বুঝতে পারবেন যে, সাধারণ বক্তারা এই আলোক মালার প্রভাব সম্পর্কে বা কক্ষ আলোকে উদ্ভাসিত করণের গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন।
আপনার মুখে আলো পড়তে দিন, কেননা, শ্রোতারা আপনাকে দেখতে চায়। এই আলো পতনে আপনার চেহারায় পরিবর্তন আসবে, সাথে-সাথে শ্রোতাদের দৃষ্টি নিবন্ধ হবে আপনার মুখে, ফলে আপনি প্রস্তুত হতে পারবেন বক্তব্য পেশে। সময়-সময় এই আলো আপনার বক্তব্যকে আরো পরিষ্কার ভাবে পেশ করতে সাহায্য করবে। আপনি যদি সরাসরি বাতির নিচে দাঁড়ান, আপনার মুখে ছায়া পড়তে পারে, কিন্তু কোনো বাতিকে সামনে করে দাঁড়ালে এই ছায়া পড়বে না। সুতরাং বক্তৃতা শুরু করার আগেই স্থান ঠিক করে দাঁড়ান, আলো-আঁধারি পরিবেশ অবশ্য আপনার বক্তব্য প্রকাশের সহায়ক হবে।
মঞ্চে কোনো অতিথি নয় :
একদা লন্ডনে আয়োজিত কানাডার প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তৃতা সভায় আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সভায় দারোয়ান বা দৌবারিককে একটি বৃহৎ দণ্ড হাতে এ জানালা হতে সে জানালায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখলাম। দেখলাম তাকে কক্ষটিতে বায়ু সঞ্চালনের চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত। অতঃপর কী হল? দেখলাম, শ্রোতাদের দৃষ্টি বক্তার প্রতি নয় দৌবারিকের প্রতি নিবন্ধ। তারা যেন মনে করেছেন, বক্তা নয়, দৌবারিকই একটা আশ্চর্য কিছু করেছে।
বক্তৃতা সভায় যখন শ্রোতারা মনোনিবেশ সহকারে কিছু শুনতে থাকে তখন সেখানে হঠাৎ ঘূর্ণীয়মান কিছু হলে তারই প্রতি শ্রোতা ও দর্শকদের দৃষ্টি ফিরে যায়। কোনো দর্শক বা শ্রোতাই আর তার দৃষ্টিকে মঞ্চের দিকে নিবন্ধ রাখতে পারে না। বক্তা যদি এই সত্যটা স্মরণ রাখেন তাহলে তার পক্ষে এই ধরনের পরিস্থিতি পরিহার করে চলা সম্ভব হয়। তা হলে বক্তাকে কী করতে হবে?
প্রথমত পরিহিত বস্ত্র, অঙ্গভঙ্গি, হস্তপদাদি সঞ্চালনে প্রতি যেন দর্শক শ্রোতাদের লক্ষ থাকে তার দিকে নজর দিতে হবে। নিউইয়র্কের এক বক্তৃতা সভায় আমি একা দেখেছি, একজন খ্যাতনামা বক্তা তার একখানা হাত বেঁধে এসেছিলেন। বক্তৃতা কালে আমি লক্ষ করেছি, সকল শ্রোতার দৃষ্টি ঐ হাতের প্রতি স্থির নিবন্ধ।
দ্বিতীয়ত বক্তা শ্রোতাদের বসার আসনের প্রতি লক্ষ রাখবেন। শ্রোতাদের এমনভাবে বসার ব্যবস্থা করবেন যাতে দেরিতে যারা আসে তাদের প্রবেশের কারণে শ্রোতাদের দৃষ্টি সেদিকে বিক্ষিপ্ত না হয়।
তৃতীয়ত মঞ্চে অতিথি রাখবেন না। কয়েক বছর আগে রেমন্ড রবিন ব্রুকলীনে বক্তৃতা মালায় অংশ নেন। একদিন অন্যান্য কয়েকজন সহ আমাকে মঞ্চে বসতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তখন মঞ্চে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলি যে, এটা বক্তার প্রতি সুবিচার হবে না। প্রথমত রাতে আমি লক্ষ করি তালিকাভুক্ত, অতিথিরা একবার মঞ্চে যান, একবার বের হয়ে আসেন। তাদের এই উঠানামার ফলে শ্রোতাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে বক্তা নয়, অতিথিদের গতিবিধির প্রতি। পরদিন আমি এর প্রতি মি. রবিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সে রাতে তিনি একাই মঞ্চে বসেন এবং তাঁর বক্তৃতা হয় স্বচ্ছ ও অবাধ।
ডেভিড বেলাস্কো মঞ্চে কোনোরূপ লালফুল রাখতে দিতেন না। কেননা, লাল জিনিস সহজে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একজন চঞ্চল মানুষকে শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে মঞ্চে বসতে দিলে কী হয়? শ্রোতাদের দৃষ্টি বক্তা হতে সরে গিয়ে তার উপর পড়ে। সুতরাং মঞ্চে বক্তা ছাড়া অন্যকোনো অতিথিকে বসতে দেওয়া উচিত নয়।
ভারসাম্য :
বক্তৃতা শুরু করার আগে শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে বসা কি বক্তার জন্যে ভালো নয়? আগে মঞ্চে না গিয়ে বক্তৃতা শুরু করার মুহূর্তেই মঞ্চে যাওয়া কি বক্তার জন্যে ভালো নয়?
কিন্তু যদি আগে গিয়ে মঞ্চে বসতে হয় তাহলে বসা সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। ওখান হতে দেখা যাবে শ্রোতারা হলে আসছেন, চেয়ার খুঁজছেন। চেয়ার বহু খালি থাকলেও একটা ভালো জায়গা খুঁজছেন, বসছেন, কেহ বা উঠে যাচ্ছেন।
এক জায়গায় বসে মনে হল আরাম পাচ্ছেন না তাই অন্যত্র সরে যাচ্ছেন। গিয়ে বসেছেন আর একটা চেয়ারে আরাম করে। আরামের জায়গা ছেড়ে যাচ্ছেন আরো আরামের সন্ধানে। এসব লক্ষ করলে বক্তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, সুতরাং বসতে হলে এমন ভাবে বসবেন,যাতে শ্রোতাদের এসব কাণ্ড লক্ষ করতে না হয় সরাসরি।
আগে আমরা বলেছি, আকর্ষণীয় পোশাক অথবা অলংকার পরে মঞ্চে যাবেন না। কেননা, এই পোশাক অথবা অংলকার শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আরো একটি কারণ আছে। এই পোশাক বা অলংকার আপনার দুর্বলতা বলে মনে হবে। শ্রোতাদের মনে জাগবে আপনার দুর্বলতার কথা। তারা মনে করবে দুর্বলতা ঢাকার জন্যেই আকর্ষণীয় পোশাক বা অলংকারের এই বহর। সুতরাং স্বাভাবিক পোশাকে মঞ্চে যান, ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করুন। ফলে আপনার দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত হবে। বক্তব্য পেশকালে ভারসাম্য রক্ষিত হবে।
বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বক্তৃতা শুরু করবেন না। দীর্ঘশ্বাস নিন এবং শ্রোতাদের প্রতি। দৃষ্টি বুলিয়ে নিন। হলে কোথাও কোনো গণ্ডগোল বা শব্দ হচ্ছে মনে হলে তা থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা। করুন।
বুক উঁচু করে দাঁড়ান। শুধুমাত্র বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে নয়, বাড়িতেও এরূপভাবে দাঁড়াতে অভ্যাস করুন। নিয়মিত এরূপ অভ্যাস করলে শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়াতে গেলে স্বাভাবিক নিয়মেই আপনার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে দৃঢ় মনোভাব ফুটে উঠবে।
লুথার এইচ, গুলিক তাঁর কর্মক্ষম জীবন” বইতে লিখেছেন, দশ জনের মধ্যে একজন লোক নিজের জীবনকে দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে না। ঘাড়কে দৃঢ় রাখলে তা কলারের সাথে ঝুলে পড়ে না তিনি দৈনিক অভ্যাসের জন্যে যে সুপারিশ করছেন তা হচ্ছে, আস্তে-আস্তে শ্বাস নিন। অতঃপর ঘাড়কে এমন দৃঢ় করুন যাতে এটা কলার হতে আগা থাকে। ঘাড় শক্ত করুন, এরূপ করলে কোনোভাবে কোনো ক্ষতি হয় না। ঘাড়কে এভাবে শক্ত করলে বুকও শক্ত হয়, দৃঢ় হয়।
এবং আপনার হাত দিয়ে কী করবেন? এগুলোর কথা ভুলে থাকুন। এগুলো যদি আপনার পাশে ঝুলে পড়ে, পড়তে দিন। ওগুলোকে কলার কাঁদির মতো ঝুলে থাকতে দিন। কেহ হাতের প্রতি লক্ষ করছে। একথা কল্পনাও করবেন না।
পাশে ঝুলে থাকলেই আরাম পাবেন। ঝুলে থাকলে তার প্রতি কারো তেমন দৃষ্টিও আকর্ষিত হবে। অতি সমালোচকও এই অবস্থার সমালোচনা করতে পারবেন না। কোনো বক্তৃতার সময় হাত গুলো নীরব থাকছে এবং প্রয়োজন ছাড়া ওঠনামা হচ্ছে না।
কিন্তু যদি ঘাবড়িয়ে যান তা হলে আপনি কী করবেন। আপনার হাত দুটিকে পেছনে নিয়ে যান, একটিতে অপরটি নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করুন অথবা পকেটে রাখুন, অথবা বক্তৃতার টেবিলে রাখুন। এরূপ করে, একটু চিন্তা করলে আপনার স্নায়বিক দুর্বলতা হ্রাস পাবে, মনে স্বস্তির, নতুন উদ্যমের সঞ্চার হবে। আমি এযুগের বহু সংখ্যক খ্যাতনামা বক্তার বক্তৃতা শুনেছি। সকলকে না হলে তাদের অনেককে আমি বক্তৃতা কালে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি। বাইরন এরূপ করতেন। চাউন্সে. এম. ডেপ এরূপ করতেন। টেডী রুজভেল্টও এরূপ করতেন। তবে কথা হচ্ছে আকাশ কখনো ভেঙে পড়ে না। এবং ঝড় বৃষ্টি বাদল হলেও আবার আকাশে সূর্যোদয় হয়। কোনো ব্যক্তি বক্তৃতা করতে গেলে বক্তৃতার বিষয়টিই হয় মুখ্য, তার হাত পা কি অবস্থায় আছে তা কোনো আলোচ্য বিষয়ই নয়। তাঁর মন মস্তিষ্ক ঠিক থাকলে হাত পা আপনা আপনিই ঠিক থাকতে বাধ্য। মূল কথা হচ্ছে বক্তৃতা, বক্তব্য বিষয়, বক্তার অঙ্গভঙ্গি বা হাত পা নয়।
অঙ্গভঙ্গি সম্পর্কে এই বইতে যা লেখা হয়েছে তার দশ ভাগের নয় ভাগই ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে এর কাজ ও কালি খরচও। অঙ্গভঙ্গি মন হতেই উৎসারিত হওয়া উচিত। আপনার হৃদয়, মন, ইচ্ছা ও আকাক্ষা অনুযায়ীই অঙ্গভঙ্গি হয়। তাই সাধারণ ও স্বাভাবিকতার ক্ষুদ্রতম একবিন্দু বিশাল বা টনের চাইতেও মূল্যবান।
অঙ্গভঙ্গি নৈশভোজের পোশাকের মতো কোনো কিছু নয়। এটা মনের অভিব্যক্তিরই বহিঃপ্রকাশ। মন খুশি ও হাস্যোজ্জ্বল অথবা যন্ত্রণা বা দুঃখপূর্ণ থাকলে অঙ্গভঙ্গিতেও তার প্রকাশ ঘটে।
এবং কোনো ব্যক্তির অঙ্গভঙ্গি তার ব্যবহৃত দাঁতের ব্রাসের মতো সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত ব্যাপার। এবং ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে পার্থক্য বিরাজমান বিধায় তাদের অঙ্গভঙ্গিতে পার্থক্য হবে, এটা স্বাভাবিক।
যে কোনো দু’ব্যক্তির অঙ্গভঙ্গি একরূপ হয় না, হতে পারে না। লিংকন কথা বলতেন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে, সুতরাং তাঁর অঙ্গভঙ্গিও হত দ্রুততর। কিন্তু ডগলাসের বেলায় সেরূপ হত না। এরূপ হলে বরং তা হত হাস্যকর।
“লিংকন,“ বলেছেন তাঁর জীবনী রচয়িতা ও আইন অংশীদার হারেনভন, “মস্তিষ্ক, যেভাবে নাড়তেন হাত সেভাবে নাড়তেন না। তিনি তাঁর বিবৃতিতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন তখন তিনি মস্তিষ্ক সঞ্চালন করতেন। কোনো-কোনো সময় তিনি মস্তিষ্কে এরূপ ঝকানি দিতেন যেন বিদ্যুৎখণ্ড বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বক্তৃতাকালে তিনি কখনো মঞ্চের দিকে তাকাতেন না, অন্যান্য সাধারণ বক্তার মতো বক্তৃতাকালে এদিক-ওদিক তাকাতেন না। বক্তৃতাকালে মঞ্চে কী অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে তা তিনি চিন্তা করতেন না। বক্তৃতাকালে তিনি আস্তে-আস্তে অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে পড়তেন, স্বাভাবিক সাধারণ মানুষের মতোই তিনি কথা বলতেন। তাঁর বক্তব্যে প্রকাশিত হয়ে পড়তো তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, শ্রোতারা বুঝতে পারতেন তার স্বাতন্ত্র্য। সময়-সময় তিনি ডান হাত তুলে শ্রোতাদের প্রতি এমন ভাবে নির্দেশ করতেন যে, শ্রোতাদের সামনে তখন তার বক্তব্যের অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে পড়ত। সময়-সময় আনন্দ বা সন্তোষ প্রকাশের জন্যে তিনি একসাথে দু’হাত উপরে তুলতেন। ফলে তার বক্তব্য স্পষ্ট হত। তার এই অঙ্গভঙ্গি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হত। অর্থাৎ এভাবে বক্তৃতার সাথে অঙ্গভঙ্গি যোগ হত বিধায় বক্তব্য হয়ে পড়ত পরিষ্কার। তিনি সব সময় আড়াআড়ি ভাবে পায়ের পাতার ওপর দাঁড়াতেন, তার পায়ের বুড়া আঙুল থাকত পাশাপাশি অর্থাৎ তার একপা অন্য পায়ের পিছনে থাকত না। তবে শক্ত হবার জন্যে, দৃঢ় হবার জন্যে তিনি কখনো মঞ্চে কিছু করতেন না। সময়-সময় অবশ্য তিনি তার পজিশন পরিবর্তন করতেন। এই পরিবর্তনের জন্যে কিন্তু তিনি সামনে বা পেছনে সরে দাঁড়াতেন না। মনকে দৃঢ় করার জন্যে তিনি সময়-সময় বাম হাত দিয়ে কোটের বুতাম ধরতেন না পকেটে হাত দিতেন, ডান হাতে নাড়াচাড়া করতেন। এতে তার বক্তব্য পেশের গতি হত সাবলীল।” শিকাগোর লিংকন পার্কে সেন্ট গউডেনের তৈরি তার যে মূর্তি রয়েছে তাতে এই অঙ্গভঙ্গিই রয়েছে।
এটাই ছিল লিংকনের পদ্ধতি। বক্তৃতকালে থিওডোর রুজভেল্ট-হয়ে পড়তেন অধিকতর, সজাগ, সচেতন, আবেগপূর্ণ, উত্তেজিত ও তেজোদীপ্ত। তাঁর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত একটা অদ্ভুত অনুভূতির ঔজ্জ্বল্য, মনে হত যেন তাঁর দেহটি একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এবং এই যন্ত্র হতে বেরুচ্ছে বক্তৃতার ধ্বনি। বাইরন সময়-সময় হস্ত প্রসারিত করতেন বক্তৃতা করার সময়। গ্লাডস্টোন বক্তৃতা করার সময় কখনো কখনো টেবিলে হাত রাখতেন টেবিল আঁকড়ে ধরতেন। কখনো বা মঞ্চে পা’দিয়ে আঘাত করতেন। লর্ড রোজবেরী বক্তৃতা করার সময় তাঁর ডান বাহু নাড়া-চাড়া করতেন ফলে তিনি যেন অধিকতর শক্তি পেতেন। বক্তার বক্তৃতায় গতি থাকলে, শক্তি থাকলে, চিন্তায় থাকলে স্বচ্ছতা, অঙ্গভঙ্গিতে আসে স্বাভাবিকতা, সাবলীলতা।
স্বাভাবিকতা-জীবন স্পন্দন-যে কোনো কর্মেরই প্রতিফলন। বার্ক অঙ্গভঙ্গি করণে ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থকাম। পীটের অঙ্গভঙ্গি হয়ে পড়ত সম্পূর্ণ অর্থহীন, যেন তিনি বাতাসে সঙ এর মতো হাত পা নাড়ছেন। স্যার হেনরী ইরভিং এর একটি পা ছিল খোঁড়া, তাই তার গতিবিধিও হত খোঁড়া। মঞ্চে লর্ড মেকলের অঙ্গভঙ্গি হত অর্থহীন। গ্লেটিনেরও হত তাই। পার্নেলের হত অনুরূপ। এর উত্তর হচ্ছে’ পার্লামেন্টারি বাকপটুতা সম্পর্কে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে লর্ড কার্জন বলেন, “সকল সুবক্তাই বক্তৃতাকালে নিজস্ব কায়দায় অঙ্গভঙ্গি বা অঙ্গ সঞ্চালন করেন। এবং এই অঙ্গভঙ্গি বক্তার বক্তব্যকে অর্থবহ করে তোলার সহায়ক হয়। তাঁর চেহারা যাই হোক না কেন, অঙ্গভঙ্গি তাঁর বক্তব্যকে আকর্ষণীয় করে তোলে।“
বহু বছর আগে আমি ভবঘুরে স্মিথের বক্তৃতা শুনেছিলাম। আমি তাঁর বাকপটুতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। বক্তৃতার সময় তিনি নানারূপ অঙ্গভঙ্গি করে ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি যতবার শ্বাস নিচ্ছেন ততবারই যেন অঙ্গ সঞ্চালন করছেন। এটা একটা আদর্শ পদ্ধতি।
আপনি যদি এই নীতির অর্থাৎ অঙ্গ সঞ্চালনের নীতি অনুসরণ করতে চান তা হলে এই নীতির কথা চিন্তা করে দেখতে পারেন। এ সম্পর্কে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, এটা নির্ভর করে বক্তার মন-মেজাজ ও মর্জির উপর। নির্ভর করে বক্তার প্রস্তুতি, আগ্রহ, ব্যক্তিত্ব, বক্তব্য বিষয়, শ্রোতা এবং কী উপলক্ষে বক্তৃতা করা হচ্ছে তার উপর।
এখানে সীমিত কিছু সুপারিশ করা হচ্ছে যা সহায়ক হতে পারে, ফলপ্রসূ হতে পারে। একটা অঙ্গভঙ্গির বার-বার পুনরাবৃত্তি করবেন না। করলে তা একঘেয়ে হয়ে পড়বে। মঞ্চে পায়চারি করবেন না। অর্থাৎ বক্তৃতাকালে মঞ্চে হেঁটে বেড়াবেন না। দ্রুততালে অঙ্গ সঞ্চালন করবেন না, কোনো কিছু বোঝাবার জন্য যদি আপনি অঙ্গুলি দিয়ে নির্দেশ করেন, বাক্য সমাপ্ত করা পর্যন্ত সেই অঙ্গুলি নির্দেশ স্থির রাখুন। এতে অন্যথা হলে আপনার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে এবং বক্তারা সাধারণত এই ভুলটা করে থাকে। এটা অত্যান্ত মারাত্মক ভুল। এটা যার উপর আপনি জোর দিতে চান তার উপর হতে অন্যত্র জোরটা সরিয়ে নেয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে হাল্কা এবং হাল্কা বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
আপনি দর্শকদের সামনে সত্যি-সত্যিই যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়াবেন, তখন ইচ্ছা করে কোনো অঙ্গভঙ্গি করবেন না, স্বাভাবিকভাবে যে অঙ্গভঙ্গি হয় তা হতে দিন। কিন্তু আপনি যখন বক্তৃতা অভ্যাস করবেন, শিখবেন, তখন আপনার বক্তব্যকে জোরদার করার জন্য অঙ্গভঙ্গি বা অঙ্গ সঞ্চালন করুন। এভাবে অভ্যাস করলে সহজে আপনি বক্তৃতা শিখতে পারবেন এবং দর্শক সম্মুখে বক্তৃতা কালে আপনার অঙ্গ সঞ্চালন হবে অজ্ঞাতসারে, স্বাভাবিক নিয়মে।
বই বন্ধ করুন। বই এর ছাপান পৃষ্ঠা দেখে অঙ্গ সঞ্চালন শেখা যায় না। বক্তৃতাকালে আপনার ধারণা আপনার চিন্তা, আপনার প্রকাশ ভঙ্গি যে কোনো শিক্ষকের শিক্ষা পদ্ধতি বা শিখানো নীতি হতে অনেক বেশি মূল্যবান ও ফলপ্রসূ হবে।
অঙ্গভঙ্গি এবং বক্তৃতা সম্পর্কে আমরা যা কিছু বলেছি তা যদি আপনি ভুলে যান তা হলে আপনি শুধু স্মরণ রাখুন, যদি কোনো লোক শ্রোতাকে অভিভূত করার জন্য মনে প্রাণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, শ্রোতাদের স্বমতে আনতে পারবে বলে দৃঢ়বিশ্বাসী হয়, তা হলে যে কোনো বিষয় নিয়ে শুরু করে সে সফল হতে পারবে এবং বক্তৃতার সাথে সাথে তার স্বভাবিক অঙ্গভঙ্গি হবে। তার বক্তৃতার বিষয় জানা না থাকলে এমন হবে যে তার সমালোচনা করা যাবে না, খুঁত ধরা যাবে না। অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস তাকে জয়ী করবে। আপনি যদি এটা বিশ্বাস না করবেন তবে যে কোনো লোককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিন। আপনি লক্ষ করবেন যে, লোকটি মঞ্চে উঠে যে কথা বলছেন তা অত্যান্ত তীব্র গতিতে বলছেন এবং তার ভাষা হচ্ছে অত্যন্ত দৃঢ় ও গতিশীল।
নিম্নে বক্তৃতা সম্পর্কে আমার গড়া এগারোটি শব্দ উল্লেখ করছি। এর মতো শক্তি আমি আর কোথাও পাই নি।
এক ধাক্কায় ছিপি খুলে
ব্যারেল পূর্ণ করে নিন,
অতঃপর তিড়িংবিড়িং নাচুন।
১। কার্নেগী কারিগরি ইনস্টিটিউট পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে যে, ব্যবসায়ে সাফল্যের ক্ষেত্রে জ্ঞানের চাইতে ব্যক্তিত্ব অনেক বড়। বক্তৃতার বেলায় এটি অনুরূপ ভাবে সত্য। ব্যক্তিত্ব এমন একটি জিনিস যার উৎকর্ষ সাধনের জন্যে কোনোরূপ সুপারিশ করা বা উপদেশ দেয়া সম্ভব নয়। এই পরিচ্ছেদে প্রদত্ত কিছু সুপারিশ বক্তার বক্তৃতা শেখায় সহায়ক হবে।
২। আপনি যখন ক্লান্ত তখন বক্তৃতা শুরু করবেন না। বিশ্রাম নিন, শক্তি সঞ্চয় করুন, অতঃপর বক্তৃতা করুন।
৩। বক্তৃতা করার আগে হাল্কা খাবার গ্রহণ করুন।
৪। জীবনী শক্তি ভোঁতা করে দেয় এমন কিছু করবেন না। শরতের শস্য ক্ষেত্রে বন্যহস যেভাবে নেমে আসে জীবনীশক্তি সম্পন্ন বক্তার পাশেও ঠিক সেভাবে শ্রোতার ভিড় জমে।
৫। পরিচ্ছন্ন আকর্ষণীয় পোশাক পরুন। পোশাক আপনার আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। অপরিচ্ছন্ন পাজামা, ছেঁড়া জুতো, অবিন্যস্ত চুল, কোটের পকেটে কলমের দৃষ্টিকটু অবস্থান অথবা অদ্ভুত ধরনের হাতব্যাগ নিয়ে বক্তা হিসাবে বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ালে সেই বক্তার প্রতি শ্রোতাদের শ্রদ্ধা জাগে না।
৬। হাসিমুখে মঞ্চে যান। শ্রোতারা যেন আপনার দিকে তাকিয়ে এটা উপলব্ধি করে যে, আপনি মঞ্চে গিয়ে অত্যন্ত উফুল্ল হয়েছেন। ”পছন্দ পছন্দ আনে”, বলেছেন অধ্যাপক ওভার স্টিট। ”আমরা যদি আমাদের শ্রোতাদের প্রতি আগ্রহী হই, শ্রোতারাও আমাদের প্রতি আগ্রহী হবেন। বক্তৃতা করার আগেই অনেক সময় আমরা অভিনন্দিত বা নিন্দিত হই। সুতরাং আমরা বক্তৃতা করে শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করতে চাই এরূপ মনোভাবই প্রকাশ করতে হবে।”
৭। শ্রোতাদের একত্রিত করুন। বিচ্ছিন্ন ভাবে বসা শ্রোতাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সহজতর নয়। বিচ্ছিন্নভাবে বসা যে কোনো শ্রোতা আপনার বক্তৃতা শুনে হাসতে পারে, বা নিন্দা করতে পারে বা অন্যমনস্ক হতে পারে, কিন্তু সকলে একত্রিত হয়ে বসলে বক্তৃতা না শুনে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা জুড়ে দিয়ে অন্যদের অসুবিধা করার অবকাশ থাকে না।
৮। যদি শ্রোতার সংখ্যা কম হয় তা হলে তাদের নিয়ে এক ক্ষুদ্র কক্ষে বসুন। মঞ্চে উঠবেন না, শ্রোতাদের সাথে নিয়ে বসুন। আপনার বক্তৃতা শুরু করুন সাধারণ কথোপকথনের নিয়মে, সাধারণ আলোচনার মতো করে।
৯। মুক্ত বায়ু চলাচল করতে দিন।
১০। হলকে আলোকিত করুন। আলোর বন্যা বইয়ে দিন। এমনভাবে দাঁড়ান যাতে আপনার মুখে আলো পড়ে এবং আপনাকে ভালোভাবে শ্রোতারা দেখতে পায়।
১১। আসবাবপত্রের পেছনে দাঁড়াবেন না। চেয়ার টেবিলকে মঞ্চের দিকে পাশে রাখুন। এমন ভাবে দাঁড়ান শ্রোতারা আপনাকে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পায়।
১২। মঞ্চে কোনো অতিথি রাখবেন না, রাখলে নড়াচড়া করবে এবং নড়াচড়া করলে তাদের প্রতিই শ্রোতাদের দৃষ্টি পতিত হবে। কোনো শ্রোতাই কোনো ব্যক্তি বা বস্তু বা পা, নড়তে দেখলে তার প্রতি তাকিয়ে পারবেন না। ফলে আপনার বক্তৃতার প্রতি শ্রোতাদের মনোযোগ থাকবে না।
০৮. কীভাবে বক্তৃতা শুরু করবেন
আমি একদা নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বক্তা হিসাবে আপনার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং বলুন, বক্তৃতার সফলতা অর্জনের মূল রহস্য কী?” এক মিনিট নীরব থেকে তিনি উত্তর দিলেন, আকর্ষণীয় ভাষায় বক্তৃতা শুরু, যা শ্রোতাদের দৃষ্টি এবং মনকে টেনে আনে। তিনি বক্তৃতা প্রস্তুতিতে বক্তৃতা শুরু এবং শেষের বাক্য ও শব্দ এমনভাবে চয়ন করতেন যা হত অত্যন্ত আকর্ষণীয়। জন ব্রাইট একই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন গ্লাডস্টোন, ওয়েবেস্টার, লিংকন। বস্তুত পক্ষে সকল জ্ঞানী বক্তাই এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
কিন্তু নবিশ বক্তারাও কি এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন? অবশ্যই না। পরিকল্পনার সময় প্রয়োজন, চিন্তা প্রয়োজন, ইচ্ছা শক্তি প্রয়োজন। মস্তিষ্ক সঞ্চালন একটি বেদনাদায়ক কাজ। এই বিষয়ে টমাস এডিসন তার কারখানার দেয়ালে স্যার জসুয়া রেমন্ডের নিম্নবর্ণিত উদ্ধৃতিটি খোদিত করে রেখেছেন।
এমন কৌশল নেই যাতে মানুষ শ্ৰম হতে মুক্ত থাকতে পারে এবং চিন্তা করাটা হচ্ছে আরো কঠিন শ্রম।
চিন্তার শ্রম হচ্ছে মৃত্তিকা গহ্বর,
চড়াই উতরাই পেরোনো যায় তরতর।
লর্ড নর্থ ক্লিক, যিনি সংবাদ পত্রের সাপ্তাহিক বেতনভূক্ত কর্মচারী হতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচাইতে ধনী ও প্রভাবশালী পত্রিকা মালিক হয়েছিলেন, তিনি বলেছেন যে, মাত্র পাঁচটি শব্দ তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করে পরিবর্তন এনেছে সে শব্দগুলো হচ্ছে :
ভবিষ্যতের কথা আগে হতে জেনে ফেলা। আপনার বক্তৃতা প্রস্তুতিকালে এটিও একটি উল্লেখযোগ্য আদর্শ হতে পারে। আপনি কীভাবে বক্তৃতা শুরু করবেন তা আগে থেকেই কল্পনার মাধ্যমে জেনে নিন। বুঝে নিন সুস্পষ্টভাবে আপনার বক্তৃতার কী ফল হবে অর্থাৎ আপনি কিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন শ্রোতাদের ওপর।
অ্যারিস্টটলের যুগ হতেই এই বিষয়ে লিখিত বইতে তিনটি ভাগ আছে, তা হচ্ছে, সূচনা-, মুল বক্তব্য এবং উপসংহার। এখনো এই পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। ভূমিকা দিয়ে বক্তা মূল বক্তব্য প্রকাশ করে শ্রোতাদের জানাচ্ছেন তিনি কী বলতে চান, এটা দ্বারা শ্রোতারা বিষয়টি কী উপলব্ধি করেছেন এবং বক্তা এটি দিয়ে তাদের মনে আনন্দও দিচ্ছেন। শত বছর আগে বক্তার দ্বারা যা হত আজ সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন; বেতার, টেলিভিশন, টেলিফোন ও মুভিথিয়েটার তাই করছে।
তবে অবস্থার সাংঘাতিক পরিবর্তন হয়েছে, বিশ্বে বিশেষ অগ্রগতি এসেছে, গত একশত বছরে আবিষ্কারের ফলে। মানুষ জীবন্ত বেলসেজার এবং নেবুসেডনেজার আমল হতে বহুগুণ সুসভ্য হয়ে পড়েছে। এই একশত বছরের মধ্যেই আমরা স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, উড়োজাহাজ, বেতার, টেলিভিশন পেয়েছি। সুতরাং আজকের বক্তাকেও সময়ের দ্রুত তালের সাথে পদ্ধতি রক্ষা করে চলতে হচ্ছে। সুতরাং আপনি যদি বক্তৃতার সূচনা বা ভূমিকা রাখতে চান তা হলে তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে দেয়ার চেষ্টা করুন। এটা হচ্ছে আজকের যুগের সকল শ্রোতার কাম্য। আপনি কি কিছু বলতে চান? ঠিক আছে, সংক্ষিপ্ত ভাবে তা বলুন। দীর্ঘ বক্তৃতার দরকার নেই। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো বলে শেষ করুন।
ডুবো জাহাজের অংশ গ্রহণ সম্পর্কে কংগ্রেসে বক্তৃতা কালে উড্রো উইলসন মাত্র একুশটি শব্দ প্রয়োগ করে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি শুরু করেছিলেন, দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমানে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যার কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরা আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিউইয়র্কের প্যান সিলভানিয়া সমিতিতে বক্তৃতা কালে চার্লস স্কোয়ার দ্বিতীয় বাক্যেই মূল বিষয়ে প্রবেশ করেন :
মর্কিন নাগরিকদের আজকের মূল প্রশ্ন হচ্ছে : ব্যবসায়ে বর্তমান মন্দার অর্থ এবং এর ভবিষ্যৎ কী? ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য আশাবাদী।
ন্যাশনাল ক্যাশ রেজিস্টার কোম্পানির সেলসম্যানেজার এভাবেই তার লোকদের সামনে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, মাত্র তিনটি বাক্যে বক্তৃতার ভূমিকা দিয়েছিলেন এবং বাক্যগুলো ছিল অত্যন্ত সহজ, ফলে শ্রোতাদের বোধগম্য হয়েছিল। উৎসাহব্যঞ্জক বাক্যগুলো ছিল :
আপনারা যারা কোম্পানির পণ্য বিক্রির অর্ডার সংগ্রহ করেন কারখানায় চিমনিতে ধূম্র অব্যাহত রাখা তাদের উপরই নির্ভর করছে। বিগত দুই গ্রীষ্মে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলার মতো প্রচুর নয়। এখন দুর্দিন কেটে গেছে এবং ব্যবসা পুনরারম্ভের সময় এসেছে বিধায় আমি আপনাদের জানাচ্ছি, যে, চিমনিতে আমরা অধিক পরিমাণ ধূম্র চাই।
কিন্তু অনভিজ্ঞ বক্তারা কী শুরুতে এরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেন? প্রশিক্ষণ হীন ও আদর্শ হীন বক্তাদের অধিকাংশই এমনভাবে বক্তৃতা শুরু করেন যে কোনো ক্রমেই ভালো পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয় না। এখানে আমরা সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
নবিশদের অনেকেই বক্তা হিসাবে নিজেরা হাস্যাস্পদ হবেন বলে ধারণা করেন, এটা দুঃখজনক। নবিশ একজন জ্ঞানী হলেও এবং তাঁর জ্ঞানের সীমা সশ্রদ্ধ ভয় উৎপাদক হলেও বক্তা হিসাবে নবিশ বিধায় মঞ্চে বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে মনে করেন, ধরে নেন অথবা তার মনে এরূপ ভাবের উদ্রেক হয় যে, মার্কটোয়েন যেন তার কাঁধে ভর করেছেন। সুতরাং তিনি কৌতুকপূর্ণ গল্প দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন, ভোজসভা হলে এরূপ গল্প বলা শ্রোতাদের তেমন অভিভূত করে না। অর্থাৎ তাঁর বক্তব্য হয়ে পড়ে শোনা কথা, তাই এই বক্তব্য শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। ফলপ্রসু হয় না।
একজন বিনোদনকারী যদি শ্রোতাদের সমক্ষে এরূপ বক্তব্য পেশ করেন, যে বক্তব্য শোনার জন্য শ্রোতারা টিকিট নিয়েছেন, সেরূপ ক্ষেত্রে শ্রোতারা হই চই করেন, শ্লোগান দেন। তবে সাধারণ শ্রোতারা বক্তার প্রতি থাকেন সহনশীল, সহানুভূতিশীল। সুতরাং বক্তার মনেও এরূপ চিন্তা রাখা উচিত, যেভাবেই হোক না কেন, শ্রোতাদের সন্তোষ বিধান করতে হবে। এরূপ চিন্তা মনে থাকলে বক্তা ব্যর্থ হন না। এরূপ চিন্তা মনে থাকলে খারাপ বক্তৃতার জন্যে বক্তা নিজেও অস্বস্তি অনুভব করেন। এরূপ ঘটনা কী আপনি কখানো অবলোকন করেন নি?
বক্তৃতা প্রদানের সবচাইতে কঠিন বিষয় হচ্ছে শ্রোতাদের হাসানো। কৌতুককর বক্তৃতা দিয়ে কী শ্রোতাদের হাসানো যায়? এটা নির্ভর করে বক্তার নিজস্ব ব্যক্তিত্বের উপর।
লিংকন ও জব হেজের বক্তৃতা মালা অধ্যয়ন করলে আপনি এটা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, কতিপয় ক্ষেত্রে কৌতুকপূর্ণ গল্প দিয়ে শুরু করে সফল হয়ে ছিলেন। এডউইন জেমস ক্যাটল আমাকে বলেছেন যে, শোতাদের হাসানোর উদ্দেশ্যে তিনি কখনো কৌতুকপূর্ণ গল্প বলতেন না। তার গল্প হত বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং কোনো বিশেষ পয়েন্ট সহজ করে বোঝাবার জন্যই তিনি গল্পের অবতারণা করতেন। গল্প বলতেন তিনি কেক তৈরির মশল্লা হিসাবে; অর্থাৎ তার কৌতুক হত কেকের মশল্লা, কেক নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় রসিক বক্তা স্ট্রিকল্যান্ড গিলিল্যান, বক্তৃতার শুরুতে প্রথম তিনি মিষ্টি গল্পের অবতারণা করতেন না। এটা তিনি নিয়ম হিসাবে অনুসরণ করতেন। অতঃপর তিনি যখন উপলব্ধি করতেন গল্প বলা প্রয়োজন তখনই গল্প বলতেন।
এর ফলে তার বক্তব্য হত গুরুগম্ভীর, অর্থবহ ও উদ্দীপনাময়। যে কোনো বক্তৃতায় স্থানীয় কিছু সমস্যার উদ্ধৃতি দেয়া গেলে, অন্য কোনো বক্তার কোনো বক্তব্যের বিশ্লেষণ করা গেলে তা হয় অধিকতর আকর্ষণীয়। বেমানান কিছুকে অতিরঞ্জিত করবেন না। স্মরণ রাখবেন যে, রসিকতার চাইতে কৌতুক অনেক বেশি মূল্যবান।
নিজের সম্পর্কে রসিকাতা দিয়ে শুরু করা সবচাইতে সহজ পথ। মনে করুন যে, আপনি একটি অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়েছেন তা হলে আপনি কীভাবে কৌতুক করবেন? কেহ পা ভেঙে ফেললে এস্কিমোরা হাসে। ভবনের দ্বিতলের জানালা দিয়ে পড়ে কোনো কুকুর মরলেও চীনারা হাসে, মুখ টিপে হাসে। আমরা কিন্তু অত সহজে হাসি না, কিন্তু বাতাস কারো মাথায় টুপি উড়িয়ে নিলে অথবা কলার চামড়ায় পা পিছলে কেহ পড়ে গেলেও কি আমরা হাসি না।
যে কোনো বক্তাই অদ্ভুত কথা বলে শ্রোতাদের হাসাতে পারেন। যদি বলা হয়, একজন সংবাদ দাতা, “শিশুদের ঘৃণা করুন, ঘৃণা করেন ডেমোক্রেটদের।” এই বক্তব্য সংগতিহীন বিধায় শ্রোতারা হাসেন।
রুডিয়ার্ড কিপলিং ইংল্যান্ডে তার প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা কীভাবে শুরু করেছিলেন তা স্মরণ করুন। তিনি তার শুরুতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ঠিক এভাবে বলেছিলেন :
মাননীয় মহাশয়, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ। তরুণ বয়সে ভারতে অবস্থান কালে আমি বিভিন্ন সংবাদপত্রে অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাতাম। এটা আত্যন্ত আকর্ষণীয় কাজ। কেননা এটা আমাকে প্রতারক ও আত্মসাৎকারী, হত্যাকারী ও লুটেরাদের সাথে পরিচিত করে তুলেছিল, কখনো কখনো সংবাদপত্রে তাদের বিচারের খবর প্রকাশের পর আমি জেলে শাস্তি ভোগরত এসব ব্যক্তিদের সাথে দেখা করতে যেতাম। একজনের কথা আমি বিশেষ ভাবে স্মরণ করি, যাকে হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল! সে ছিল অত্যন্ত চালাক বিনয়ী ও সুবক্তা। তার জীবন কাহিনী সে আমাকে বলেছে। সে বলেছে, সংসারে চলার পথে মানুষ যখন বক্রপথ দেখে, যখন দেখে বাধা, তখন সে তার নিজ চলার পথকে সুগম করার জন্যে পথের বাধকে বাধ্য হয়ে অপসারিত করে এবং এভাবে বাধা অপসারণ করেই সে তার লক্ষ্য পথে এগিয়ে যায়। আমাদের মন্ত্রীসভার অবস্থাও বর্তমানে ঠিক অনুরূপ। তার এই বক্তব্যে সভায় ছিল হাসির রোল পড়ে।
মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানির তত্বাবধায়কদের বার্ষিক ভোজ সভায় উইলিয়াম হারবার্ড টাপ্টও ঠিক এরূপভাবে হাস্য কৌতুক করতেন? একই সময়ে হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে তিনি তার শ্রোতাদের কাজে প্রশংসাও করতেন। তিনি বলতেন, “এভাবে,
মি. প্রেসিডেন্ট এবং মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানির ভদ্রমহোদয়গণ :
নয়মাস আগে আমার বাড়িতে জনৈক ভদ্রলোকদের নৈশভোজ-বক্তৃতা শোনার পর আমি বের হয়েছি এবং এখানো বাড়ির বাইরে আছি। ভোজপর্ব শেষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের বক্তৃতার সুবোধ শ্রোতা হচ্ছেন তারাই যারা বুদ্ধিমান এবং সুশিক্ষিত কিন্তু অধোমদোন্মত্ত। (হাসি এবং করতালি) আজ আমি বলছি যে, আজকের শ্রোতারাও ঠিক সেরূপ অর্ধোন্মাদ এবং আমি আর কখনো এরূপ শ্রোতা পাই নি! আমাকে আজ একথা বলতে হচ্ছে যে, (শ্রোতাদের দেখে) মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানির এই শ্রোতারা আজ এই আসরে তাদের প্রকৃত স্বরূপ (অর্ধোমদোন্মত্ত) নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন (হাসি এবং দীর্ঘস্থায়ী করতালি)।
ক্ষমার মাধ্যমে শুরু করা হচ্ছে মারাত্মক ভুল পদ্ধতি। যদি বক্তা বলেন, আমি বক্তা নই। -বক্তৃতার জন্যে আমার প্রস্তুতি নেই।-আমার কিছু বলবার নেই।–
এটা ভুল পদ্ধতি। এটা করবেন না। কিপলিং তার একটি কবিতার প্রথম লাইনে লিখেছিলেন, এগিয়ে যাবার আর কোনো অর্থ হয় না। কোনো বক্তা ঠিক এভাবে শুরু করলে শ্রোতারা হয় বিপদগ্রস্ত!
যাই হোক, আপনার যদি প্রস্তুতি না থাকে, আমাদের মধ্যে কেহ তা বুঝতে পারবে আপনার সাহায্য ছাড়াই। অন্যরা বুঝবে না। যারা বুঝবে না তাদের কেন দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন? কেন প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। নি, চিন্তা করেন নি বলে আপনার শ্রোতাদের অপমানিত করবেন? না, না আমরা আপনার ক্ষমা প্রার্থনার কথা শুনতে চাই না। আমরা সমবেত হয়েছি জানতে ও শুনতে। সুতরাং আমাদের জানানো, শোনানো আপনার কর্তব্য একথা স্মরণ রাখবেন।
যে মুহূর্তেই আপনি মঞ্চে দাঁড়াবেন সেই মুহূর্তেই স্বাভাবিক নিয়মে এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে শ্রোতাদের দৃষ্টি আপনার উপর পড়বে। প্রথম পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টি না পড়লেও মিনিটের মধ্যে পড়তে বাধ্য একবার যদি আপনি এই আকর্ষণ ফিরিয়ে দেন, তবে তা পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন। সুতরাং আপনার প্রথম বাক্যটি আকর্ষণীয় কিছু দিয়ে শুরু করুন। দ্বিতীয় বাক্য নয় তৃতীয় বাক্যও নয়। প্রথম। প্রথম এবং প্রথম বাক্য আকর্ষণীয় করুন।
কীভাবে? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। এর জন্যে কষ্ট করতে হবে, তা আমি স্বীকার করি। এবং বক্তব্যকে যুক্তিপূর্ণ ও অর্থবহ করতে হলে, আপনার বক্তব্যকে সময় উপযোগী করতে হলে, বেছে নেয়া বিষয়টিকে সুললিত ও সাবলীল করতে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রম করলে শ্রোতারা কী চায় তাও স্মরণ রাখতে হবে। পরের দিকের আলোচনা এইরূপ বক্তৃতা প্রস্তুতির সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।
কৌতূহল সৃষ্টি করুন :
ফিলাডেলফিয়ার প্যান আটলান্টিক ক্লাবে মি. হাওয়েল হীলি প্রদত্ত একটি বক্তৃতার ভূমিকার এখানে দেয়া হচ্ছে। দেখুন আপনার এটা পছন্দ হয় কি? এটা আপনার আগ্রহ সৃষ্টি করে কি?
বিরাশি বছর আগে, বছরের ঠিক এমনি সময়ে লন্ডনে একটি ছোট বই প্রকাশিত হয়, গল্পটি বিশ্বে অমর হয়ে আছে। অনেকে এটাকে বিশ্বের সবচাইতে ক্ষুদ্রতম বই বলে অভিহিত করেন। এটা প্রথম প্রকাশিত হলে রাস্তায় অথবা পলমল-এ এক বন্ধুর সাথে আর বন্ধুর দেখা হলে একে অপরকে প্রশ্ন করতেন, “তুমি এটি পড়েছে কি? প্রায়ই উত্তর আসতো, হাঁ, ভগবান তাকে দীর্ঘজীবী করুন, আমি পড়েছি।“
প্রকাশের প্রথম দিনেই এই বইটির হাজার কপি বিক্রি হয়। একপক্ষ কালের মধ্যে বিক্রি হয় পনোরো হাজার কপি। অতঃপর বিশ্বের সকল ভাষায় অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে বইটির। কয়েক বছর আগে মি. জে. পি. মারগান বহুমূল্যে বইটির পাণ্ডুলিপি কিনেছেন এটা এখন তাঁর নিউইয়র্কস্থ আর্টগ্যালারিতে, যাকে তিনি বলেন লাইব্রেরি তাতে আছে অন্যান্য অমূল্য সম্পদের সাথে।
বিশ্ব বিখ্যাত এই বইটি কী? বইটি হচ্ছে ডিকেন্স এর বড়দিনের ভজন গান। এটাকে কী আপনি সফল শুরু বলে বিবেচনা করেন? এটা কী আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, আর আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম? করলে কেন করে? নিলম্বন (সাসপেন্স) হেতু কী আপনার এ আগ্রহ সৃষ্টি হয় নি?
কৌতূহল! কে এর প্রতি আগ্রহী নয়?
আমি বনে পাখি উড়তে দেখি। কৌতূহলবশে আমি অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের গতিবিধি অবলোকন করি, কিন্তু আমি জানি, যে শিকারী পাখি শিকারের জন্যে আলপস পর্বতে যায় সে পাখির গতিবিধি অবলোকন করতে উৎসুক নয়, সে উৎসুক শিকারে। কুকুর মানুষের মনে কৌতূহল জাগায়। কৌতূহল জাগায় অন্যান্য প্রাণীও, কৌতূহল উদ্রেক করে সকল জীব।
সুতরাং আপনার প্রথম বাক্য দিয়ে শ্রোতাদের কৌতূহলী করে তুলুন, তারা আপনার প্রতি আগ্রহী হবে।
লেখক কলেসটমাস লরেন্স এর আরব্য উপন্যাসের গল্পের মতো করে তারা বক্তৃতা শুরু করতেন :
লয়েড জর্জ বলেছেন, কর্নেল লরেন্স আধুনিক কালে একজন রোমান্টিক ও চিত্রবৎ চরিত্র।
এভাবে শুরু করার দুটি সুবিধা আছে, প্রথমত: খ্যতনামা কোনো লোকের কোনো বক্তব্য দিয়ে শুরু করা হলে তার প্রতি শ্রোতারা আকর্ষিত হয়। দ্বিতীয়ত এটা কৌতূহল সৃষ্টি করে। কেন, রোমান্টিক? কেন চিত্রবৎ? এই প্রশ্নগুলো মনে জাগে স্বাভাবিক ভাবে। আমি আগে কখনো তার কথা শুনি নি। তিনি কী করতেন?
লওয়েল টমাস কর্ণেল টমাস লরেন্সের নিম্ন বিবৃতি উদ্ধৃত করে তার বক্তৃতা শুরু করতেন :
একদা আমি জেরুজালেমের খ্রিস্টান পাড়ায় ঘুরছিলাম। এই সময় আমি মূল্যবান পোশাক ও অলঙ্কার সজ্জিত এক ব্যক্তিকে দেখতে পাই। তার কোমরে ঝুলছিল স্বর্ণনির্মিত তরবারি। এরূপ একমাত্র হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর অনুসারীরা ব্যবহার করেন। কিন্তু এই লোকটি আরব ছিলেন না। তার চেহারা আরবদের মতো নয়। চোখ নীল, কিন্তু আরবদের চোখ নীল নয়, কালো বা ব্রাউন।
এই বক্তব্য কী আপনার মনে কৌতূহল জাগায় না? নিশ্চয়ই আপনি লোকটা সম্পর্কে আরো জানাতে চান। সে কে? কেন সে আরবদের মতো চলতো? সে কী করত? তার কী হল?
যে ছাত্র নিম্ন প্রশ্ন দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করে :
আজকের বিশ্বের সতেরটি দেশে যে দাসত্ব প্রথা প্রচলিত তা কী তোমরা জান?
এটা শুধু কৌতুক জাগায় না, শ্রোতাদের মনেও আঘাত দেয়। দাসত্ব আজকের দিনে? সতেরটির দেশে? দেশগুলো নাম কী? কোথায় সে-সব দেশ। নানা প্রশ্ন জাগায়।
বক্তা তার বক্তৃতার মাধ্যমে শুধু কৌতূহল সৃষ্টি নয়, শ্রোতাদের শেষ কালের প্রতি আগ্রহী ও করে তুলতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ, একজন ছাত্র নিম্ন বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন :
আমাদের একটি আইন পরিষদের জনৈক সদস্য তার পরিষদের দাঁড়িয়ে যে কোনো স্কুল ভবনের দু’মাইল এলাকার মধ্যে ব্যাঙাচি হতে ব্যাঙ উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি আইন পাশ করার প্রস্তাব করেন।
আপনি হাসছেন। বক্তা কী কৌতূহল করছেন। কী অসম্ভব। এটা কি সত্যি করা হয়েছিল? হ্যাঁ, বক্তা ব্যাখ্যা করেন।
স্যাটারডে ইভিনিং পোষ্ট এ ”দুর্বৃত্তদল” শীর্ষক এক নিবন্ধ ঠিক এভাবে শুরু করা হয়েছে :
দুর্বৃত্তদল কী সত্যিই সংঘঠিত। নিয়মানুযায়ী তারা সংগঠিত হবার কথা কীভাবে?
মাত্র দশটি শব্দের লেখক তার বিষয় ঘোষণা করেছেন এবং দুর্বৃত্তদল সংঘঠিত কী না সে সম্পর্কে আপনার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন। এটা প্রশংসাযোগ্য। লেখকেরা যেভাবে পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টি করে বক্তাকেও ঠিক সেভাবে বক্তৃতার প্রতি শ্রোতার আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। ছাপানো বক্তৃতার চাইতে বক্তৃতা অভ্যাস করা কালে আপনি বেশি জানতে পারবেন, কীভাবে শুরু করা কল্যাণকর হবে।
গল্প দিয়ে শুরু করেন না কেন?
আমরা বক্তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনতেই সাধারণত অভ্যস্ত। রামেলোই কনওয়েল তাঁর বক্তৃতাকে অলঙ্কার পূর্ণ করে তুলতেন। তিনি ছয় হাজার বারেরও অধিক এরূপ বক্তৃতা করেছেন এবং হাজার-হাজার টাকা রোজগার করেছেন। তিনি কীভাবে তাঁর জনপ্রিয় বক্তৃতা শুরু করতেন?
১৮৭০ সালে আমরা টাইগ্রিস নদীতে ভ্রমণ করতে যাই। বাগদাদে আমরা একজন পথ প্রদর্শক ভাড়া করি। তাকে সরাসরি নিযুক্ত করি আমাদের পারমিপোলিশ, নাইনবে ও বেবিলন, দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।
এখানেই তিনি গল্প শেষ করেন। এই গদ্যাংশ সকলের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে। এই ধরনের সূচনা অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়। এরূপ সূচনা বা ভূমিকা কখনো ব্যর্থ হয় না। কারণ শ্রোতারা তখন জানতে চায় অতঃপর কী হল? কী ঘটল? অথবা এর পর কী হতে পারে?
এই বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে গল্প দিয়ে শুরু করার কথা বলা হয়েছে।
সাটারডে ইভিনিং পোস্টের একটি সংখ্যায় প্রকাশিত দুটি গল্পের সূচনা এখানে উল্লেক করা হচ্ছে :
(১) রিভলবারের তীব্র শব্দের আঘাতে সবকিছু স্তদ্ধ হয়ে গেল।
(২) জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ডেনভারের মন্টভিউ হোটেলে একটি মামুলি ঘটনা ঘটে। ঘটনাটা অত্যন্ত মামুলি বা তুচ্ছ হলেও আবাসিক ম্যানেজার গোয়েবলের কল্যাণে এটি ব্যাপকতা লাভ করে। তিনি হোটেল মালিক স্টেভিফারাডে এবং হোটেলের অন্যান্যদের ঘটনাটি জানান। কর্ণগোচর হওয়ায় স্টেভি সারা গ্রীষ্মকাল নিয়মিতভাবে হোটেল পরিদর্শনে আসতে থাকেন।
এই ধরনের সূচনা অর্থবহ। কারণ এটা শ্রোতার মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে। একথা শোনার পর আপনি আবার জানতে চান, বুঝতে চান অতঃপর কী হল, কী ঘটল।
একজন অদক্ষ বক্তাও যদি এরূপ দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন তবে তিনি শ্রোতাদের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করতে, প্রশ্ন জাগাতে সক্ষম হবেন। বিশেষ চিত্র দিয়ে শুরু করুন : দীর্ঘক্ষণ ধরে শুষ্ক বক্তৃতা শোনা, মন দিয়ে শোনা বা গভীর মনোনিবেশ সহকারে শোনা সাধারণ শ্রোতাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। চিত্র দিয়ে বোঝানো যেমন সহজ, শ্রোতাদের পক্ষে বোঝাও তেমনি সহজ, তা হলে চিত্র দিয়ে শুরু করেন না কেন? এটা বক্তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। আমি এটা জানি। আমি চেষ্টা করছি। সাধারণ বক্তারা মনে করেন যে, সাধারণ বিবৃতির মধ্যে সেই বক্তৃতা করা উচিত? চিত্র দিয়ে শুরু করে, শ্রোতাদের কৌতূহলী করে, আগ্রহী করে, সাধারণ বিবৃতি দিলে শ্রোতারা মনে দিয়ে শোনে, বুঝবার চেষ্টা করবে। এই প্রসংগে কোনো উদারহণ দিয়ে চাইলে চতুর্থ পরিচ্ছদের কথা স্মরণ করুন।
এক্ষেত্রে অত্র পরিচ্ছেদ শুরুতে কি কৌশল অবলম্বন করবেন?
কোনো কিছু প্রদর্শন করা :
কোনো কিছু দেখিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভবত সারা বিশ্বে প্রচলিত সহজতর পন্থা। বন্য বর্বর জাতি এবং এমনকি বানর অথবা রাস্তার কুকুরও কোনো কিছু দেখলে তার প্রতি দৃষ্টি দেয়। এটা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ, শ্রোতাদের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত ফলপ্রসূ। উদাহরণ স্বরূপ, ফিলাডেলফিয়ার মি. এম. এস. এলিস একবার তার বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর মধ্যে একটি মুদ্রা রেখে। দুটো আঙুলের মাঝে মুদ্রা রাখায় সবাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তখন তিনি জানাতে চান : ‘ফুটপাত দিয়ে চলার সময় আপনারা কেহ কী কখনো এরূপ মুদ্রা পেয়েছেন? যদি কেহ পেয়ে থাকেন তবে তা নিয়ে এগিয়ে আসুন, তা উন্নয়ন কাজে লাগানো যেতে পারে।–অতঃপর মি. এলিস এভাবে মুদ্রা সংগ্রহের প্রবণতার নিন্দা করেন।
প্রশ্ন করুন :
মি. এলিসের সূচনায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা হয়েছে, যে প্রশ্ন বক্তার সাথে শ্রোতাকেও ভাবিয়ে তুলেছে, তার সাথে সহযোগিতায় উদ্বুদ্ধ করেছে। উল্লেখ্য যে, সাটারডে ইভিনিং পোস্ট এ দুর্বৃত্তদল সম্পর্কে প্রকাশিত নিবন্ধের প্রথম তিনিট বাক্যে দুটি প্রশ্ন ছিল। দুর্বৃত্তরা কী সত্যিই সংঘটিত? কীভাবে? এই ধরনের প্রশ্ন পদ্ধতি শ্রোতা ও বক্তাকে সহজেই ভাবিয়ে তোলে, অন্য কোনো পদ্ধতি শ্রোতাকে এত সহজে চিন্তান্বিত করে তোলে না।
খ্যাতনামা কোনো ব্যক্তির প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন না কেন?
খ্যাতনামা ব্যক্তিদের কথা সাধারণের কাছে সব সময় বিশেষ মূল্য পেয়ে থাকে। সুতরাং আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা শুরু করাও সহজতর পন্থা হচ্ছে সঠিক প্রশ্ন উত্থাপন। ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত আলোচনা পছন্দ হয় কি?
“বিশ্বে একটি জিনিসের জন্যে অর্থও সম্মান পুরস্কার পাওয়া যায়,“ বলেছেন এলবাট হুয়াট এবং তা হচ্ছে উদ্যোগ। এবং উদ্যোগ কী তা হচ্ছে অন্যে বলে দেয়া ছাড়া সঠিক কাজ করা।
প্রারম্ভিক বাক্য হিসাবে এর আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বাক্য আমাদের মনে উৎসুক্য জাগায়, আমাদের আগ্রহী করে তোলে, আমরা কিছু জানাতে চাই। বক্তা যদি এলবাট হুবাট শব্দের পর দক্ষতার সাথে বিরতি দেন তা হলে তা অধিকতর উৎসুক্য সৃষ্টি করতে পারে ”বিশ্ব কী জিনিসের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেয়।“ আমরা জানাতে চাই, তাড়াতাড়ি বলুন। আমরা আপনার সাথে একমত নাও হতে পারি, তবুও আপনি আপনার মতামত দিন। দ্বিতীয় বাক্য আমাদের বিষয়টির অভ্যন্তরে নিয়ে যায়? তৃতীয় বাক্যটি একটি প্রশ্ন। এটা শ্রোতাদের প্রতি আলোচনায় অংশ নিতে আহ্বান জানায়, চিন্তা করতে অনুপ্রাণিতে করে। এবং শ্রোতারাও চিন্তা করতে শুরু করেন। চতুর্থ বাক্যে উদ্যোগ এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে?–এই সূচনা বা ভূমিকার পর বক্তা মানবিক স্বার্থ সম্পর্কিত গল্প বলতে পারেন, গল্প বলতে পারেন সুস্পষ্ট বিশেষণসহ।
এমনভাবে বলুন যাতে শ্রোতার মনে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হয় :
এমনভাবে শুরু করুন যাতে শ্রোতাদের মনে ব্যক্তিগত আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সেটাই হচ্ছে বক্তৃতা শুরু করার সর্বোত্তম পন্থা, এটা নিশ্চিত ভাবেই শ্রোতা মনে আগ্রহ জাগাবে। যা আমাদের হৃদয় আকৃষ্ট করে তা সম্পর্কে আমরা অবশ্যই আগ্রহী হব।
এটা সাধারণ জ্ঞানের কথা, তা নয় কি? অথচ এর ব্যবহার হচ্ছে অত্যন্ত বিরল? উদাহরণ স্বরূপ আমি একজন বক্তাকে সাময়িক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা শুরু করতে দেখছি। কীভাবে তিনি শুরু করেছিলেন? তিনি শুরু করেছিলেন জীবন সম্প্রসারণ ইনস্টিটিউটের ইতিহাস দিয়ে কীভাবে এটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং কীভাবে এর কাজ চলছে তা বলে ছিলেন তবে এটা সত্য যে কোথায় কোনো কোম্পানি কীভাবে গঠন করা হয়েছে এবং কীভাবে কোম্পানির কাজ চলছে সে সম্পর্কে আমাদের শ্রোতারা মোটেই আগ্রহী নয়। তারা নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কে আগ্রহী।
এই সত্যকে স্বীকার করে নেন না কেন? ঐ কোম্পানিকে তাদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট সেরূপ আগ্রহ তাদের জাগিয়ে তুলছেন না কেন? এরূপ কিছু দিয়ে শুরু করছেন না কেন? আপনি জানেন জীবন বীমার হিসাব অনুযায়ী আপনি কতখানি বেঁচে থাকবেন? জীবন বীমা কোম্পানির সংখ্যাতাত্ত্বিকদের হিসাব অনুযায়ী আপনার বর্তমান বয়সও আশি বছরের তিনভাগের দু’ভাগ সময় আপনি বাঁচবেন। উদাহরণ স্বরূপ, আপনার বয়স যদি বর্তমান পঁয়ত্রিশ বছর হয় আশি বছর হতে বাকি থাকে ৪৫ বছর, আপনি আশা করতে পারেন বাকি ৪৫ বছরের তিন ভাগের দুভাগ সময় অর্থাৎ ৩০ বছর আপনি বাঁচবেন।–এটাই কী যথেষ্ট? না, না, আমরা সকলেই অধিক দিন বেঁচে থাকতে চাই।
তবে এসব হিসাবে প্রণীত হয়েছে লাখো-লাখো রেকর্ডের ভিত্তিতে, আপনি এবং আমি এই রেকর্ড সময় অতিক্রম করার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা করতে পারি কি? হ্যাঁ, তবে তা করতে হলে যথাযথ প্রস্তুতি প্রয়োজন এবং এই প্রস্তুতির প্রথম পদক্ষেপ আমাদের শরীর পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
অতঃপর আমরা যদি ব্যাখ্যা করি সময়-সময় শরীর পরীক্ষা করানো প্রয়োজন কেন, তাহলে শ্রোতারা এই কাজের জন্যে গঠিত কোম্পানি সম্পর্কে জানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠবেন। তবে প্রথমেই কোম্পানি সম্পর্কে বলতে শুরু করা যথাযথ পদ্ধতি নয়, এটা ফলপ্রসূ হয় না, বরং শ্রোতাদের বিরক্তি উৎপাদন করে।
আর একটি উদাহরণ শুনুন। আমি একজন বক্তাকে আমাদের বনসম্পদ সংরক্ষণের প্রদান প্রয়োজনীয়তা দিয়ে বক্তৃতা শুরু করতে শুনেছি। তিনি এভাবে শুরু করেন, “আমরা আমেরিকানরা আমাদের প্রাকৃতিকে সম্পদের জন্যে গর্বানুভব করতে পারি।–” অতঃপর তিনি বলতে শুরু করেন, কীভাবে আমরা আমাদের বনজ সম্পদ নির্লজ্জ ভাবে অপচয় করছি। কিন্তু সূচনা ছিল খারাপ, অতি সাধারণ ও অর্থহীন। বক্তা তার বিষয় বস্তুটির প্রতি আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেন নি। কারণ তার বক্তব্য ছিল নিজের ব্যবসায়ের প্রতি সংশ্লিষ্ট এবং পরে এর দ্বারা ব্যাংকের ক্ষতি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু যদি তিনি এভাবে বলতেন, “যে বিষয়টি আলোচনা করছি সে বিষয়টি আপনার ব্যবসার ক্ষতি করবে, ক্ষতি করবে মি. আপেল বি-র ব্যবসা, ক্ষতিগ্রস্থ হবে মি. সউল। বস্তুত পক্ষে এই সম্পদ নষ্ট করার ফলে আমাদের অন্য সম্পদের দাম বাড়বে, ভাড়া বাড়াবে। সুতরাং আমাদের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ ব্যাহত হবে।“
এটা কী আমাদের বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছু বাড়িয়ে বলা? না, মনে করি না। ”ছবিকে বড় করে আঁকলে তার প্রতি শ্রোতার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়,“ বলে এলবার্ট হুবাড যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এটা তারই অনুসরণ মাত্র।
সংক্ষিপ্ত সার :
(১) বক্তৃতার সূচনা বড় কঠিন। শ্রোতার মনে আকর্ষণ সৃষ্টির জন্যে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও। সুতরাং এটা এমন সুচিন্তিতভাবে তৈরি করা প্রয়োজন যাতে শ্রোতাকে আকর্ষণ করা সহজ হয়।
(২) সূচনা বা ভূমিকা সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। এটা এক বা দুটি বাক্যে শেষ করা দরকার। সময় সময় এটাকে সংক্ষিপ্ততম করা প্রয়োজন? স্বল্পতম শব্দ দিয়ে আপনার মূল বিষয়টি প্রকাশ করুন। তাহলে কেহই বিরক্ত হবে না।
(৩) নবিশেরা মানবিক কাহিনী বলে অথবা ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে বক্তৃতা শুরু করতে চান। এই দুটি পদ্ধতিই অস্বাভাবিক ভুল। খুব কম সংখ্যক লোক, নগণ্যতম লোক মানবিক কাহিনী সাফল্যের সাথে ব্যক্ত করতে পারেন। এই ধরনের প্রচেষ্টা শ্রোতাদের প্রমোদ দানের পরিবর্তে বিরক্ত করে। গল্প বলতে হলে তা বিষয়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত হবে, শুধুমাত্র গল্পের জন্য গল্প বলা হয়। কৌতুক হতে হবে কেকের মসল্লা-স্বরূপ, কেক নয়।কখনো ক্ষমা প্রার্থনা নয়। এটা শ্রোতাদের অপমানিত করার সামিল, আপনি যা বলতে চান সরাসরি তাই বলুন এবং সংক্ষিপ্ত ভাবে বলে শেষ করুন।
(৪) একজন বক্তা সহজেই শ্রোতাদের মন আকর্ষণ করতে পারেন, যদি তিনি :
(ক) ঔৎসুক্য জাগাতে পারলে (উদাহরণ-ডিকেন্স এর বড়দিনের নীতি)।
(খ) মানবিক কাহিনী বলতে পারলে (উদাহরণ হীরা জহরতের কাহিনী)।
(গ) বিশেষ ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করলে (উদাহরণ-এই বইয়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)।
(ঘ) কোনো কিছু প্রদর্শন করে (উদাহরণ–মুদ্রা প্রদর্শন);
(ঙ) প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে (উদাহরণ পথ ভ্রমণে কেহ কি এধরণের মুদ্রা পেয়েছেন?
(চ) আকর্ষণীয় কোটেশন দিয়ে শুরু করে (এলবার্ট হুবার্ড এর উদ্যোগ সংক্রান্ত বক্তব্য)।
(ছ) বিষয়টি কীভাবে শ্রোতাদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট তা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে, (উদাহরণ–আপনার বর্তমান বয়সও ৮০ বছরের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তার তিনভাগের দু’ভাগ সময় আপনি বাঁচবেন বলে আশা করতে পারেন। তবে সময়-সময় শরীর পরীক্ষা করে সঠিক ভাবে চলে আপনি এই সময় বাড়াতে পারেন, প্রভৃতি)।
(জ) অতিখ্যাত তথ্য দিয়ে শুরু করে (উদাহরণ-আমেরিকানরা সভ্য বিশ্বের সবচাইতে জঘন্যতম দুর্বৃত্ত)।
(৫) সুচনায় কোনো কিছুকে অস্বাভাবিক প্রথাসিদ্ধ করার চেষ্টা করবেন না? সূচনাকে স্বাভাবিক গতিশীল ও অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুন। এটা করা যায় কোনো কিছু ঘটেছে বা বলা হয়েছে তার উদাহরণ দিয়ে (উদাহরণ, গত কাল এখান হতে বেশি দূরে নয়, এমন একটি শহরের পাশ দিয়ে যখন ট্রেন চলছিল তখন আমার স্মরণ হয়–)
০৯. বক্তব্য শেষ করবেন কীভাবে
আপনি কি জানতে চান বক্তব্যের কোনো-অংশে আপনি অনভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতা, অনুপযুক্ততা অথবা আকর্ষণ প্রকাশ করবেন? তা হচ্ছে সূচনা ও শেষ। থিয়েটারে নায়ক নায়িকাঁদের সম্পর্কে একটি অতি পুরাতন প্রবচন প্রচলিত আছে। তা হচ্ছে, “প্রবেশ ও প্রস্থান দিয়ে আমরা তাদের চিনি।”
শুরু ও শেষ। যে কোনো কাজে দক্ষতা প্রকাশ অত্যন্ত কঠিন কাজ। উদাহরণ স্বরূপ, সামাজিক অনুষ্ঠানে আকর্ষণীয় প্রবেশ এবং আকর্ষণীয় প্রস্থান কী উল্লেখযোগ্য কাজ নয়? ব্যবসায়িক আলোচনায় শ্রোতাকে নিজমতে আনা এবং সাফল্য অর্জন করা কী অত্যন্ত কঠিন কাজ নয়?
যে কোনো বক্তৃতায় সমাপ্তি হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক। বক্তা সব শেষে যা বলেন, যে সব শব্দ উচ্চারণ করেন তা শ্রোতাদের কানে অনুরণিত হয়, দীর্ঘ কাল জাগরুক থাকে, স্থায়ী হয়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা এর গুরুত্ব সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে তাদের সমাপ্তি হয়-রন্ধ্রযুক্ত, ত্রুটিপূর্ণ।
তাদের সাধারণ ভুল কী? এক্ষেত্রে আমরা তার কিছু আলোচনা করব এবং এর প্রতিবিধান অনুসন্ধান করব।
প্রথম, এরূপ বক্তাও আছেন যারা বলেন, “এটাই এই বিষয়ে আমার মোটামুটি বক্তব্য, সুতরাং আমার মনে হয় এখানে শেষ করা উচিত, তাই আমি শেষ করছি,“ এটা সুষ্ঠু সমাপ্তি নয়। এরূপ সমাপ্তি ভুল, এটা আনাড়ীপনা? এটা ক্ষমার অযোগ্য, এটাই যদি আপনার বক্তব্য হয় তবে কেন তা বলে শেষ করছেন এই অভিমত প্রকাশ না করে বক্তব্য শেষ করছেন না? এরূপ করলে আপনার বক্তব্য শেষ হয়েছে তা শ্রোতারা বুঝবে, এতে আপনার অভিরুচিতে তেমন খারাপ কিছু দেখা যাবে না। আপনার বক্তব্য শেষ হয়েছে, এটা বলে না দিয়ে শ্রোতাদের তা উপলব্ধি করতে দিন।
এ ধরনের বক্তাও আছেন যারা বলেন, আমার যা কিছু বলার ছিল আমি বললাম। অতঃপর তিনি শেষ করেন, কিন্তু কীভাবে শেষ করা দরকার তা তিনি জানেন না। জোস বিলিং জনগণকে এই মর্মে উপদেশ দিতেন যে, ষাঁড় সম্পর্কে বলতে হলে তার লেজ নিয়ে শুরু করুন, শিং দিয়ে নয়। আমার মতে, লেজ দিয়ে অর্থাৎ শেষের দিক থেকে শুরু করলে শিং সম্পর্কে অর্থাৎ আগা সম্পর্কে যথাযথ বলা সম্ভব হয় না। এই ধরনের বক্তারা ঘুরেফিরে এক কথা বলেন। ফলে আসল কথা তাদের বলা হয় না, শ্রোতারা তাদের বক্তৃতা হতে কিছু বুঝতে পারেন না। তাদের বক্তৃতা শ্রোতামনে খারাপ ধারনার সৃষ্টি করে।
প্রতিকার কী? বক্তৃতার শেষ টুকু অর্থাৎ সমাপ্তি বা উপসংহার পরিকল্পিত হওয়া উচিৎ নয় কি? যখন আপনি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বলছেন তখন বিষয়টি যাতে শ্রোতামনে দাগকাটে, শ্রোতাদের প্রভাবিত করে সেদিকে আপনার লক্ষ্য রাখা উচিৎ নয় কি? তা কী সুস্পষ্টভাবে শান্ত ভাবে বলার পরিকল্পনা আগে থেকেই করা প্রয়োজন নয়?
ওয়েবেস্টার, ব্রাইট গ্লাড-স্টোনের মতো খ্যাতনামা বক্তারা, ভাষার ওপর যাদের দখল ছিল প্রশ্নাতীত তারাও বক্তৃতা লিখে নিতেন এবং উপসংহারে ব্যবহার্য শব্দগুলো মুখস্থ করে নিতেন।
প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা এপথ অনুসরণ করলে ভুল করবেন। তাকে মুখস্থ রাখতে হবে তিনি কী বলতে চান তা সম্পূর্ণরূপে। সমাপ্তি অর্থাৎ উপসংহার তাকে বার-বার পুনরাবৃত্তি করতে হবে, প্রস্তুতি নিতে হবে, তবে প্রতিবারে একই শব্দ ব্যবহার না করলেও চলবে। কিন্তু চিন্তা ভাব ও ভাষা একই রাখতে হবে? মৌখিক বক্তৃতা করা কালে শ্রোতাদের মনোযোগ, মতিগতি, লক্ষ্য করে অনেক সময় পরিবর্তন করতে হয়, পরিবর্ধন করতে হয়। কখনো-কখনো বক্তব্যকে, ভাষাকে কঠিন করে প্রকাশ করতে হয়, কখনো বা হাস্যকৌতুক যোগ করতে হয়। সুতরাং যে কোনো বক্তৃতার দুটি বা তিনটি সমাপ্তি বা উপসংহার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। শ্রোতাদের আস্থা অর্থাৎ মনোযোগ ও মতি গতির সাথে সঙ্গতি পূর্ণ উপসংহার তাহলেই পেশ করা সম্ভব।
কিছু বক্তা কখনো উপসংহারে পৌঁছেন না? বক্তৃতার মাঝ পথেই তারা থেমে যান, শেষ করে ফেলেন। এই ধরনের বক্তার জন্যে অধিকতর প্রস্তুতি বার-বার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শিখে নেয়া, প্রস্তুতি নেয়া উচিৎ। বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে প্রস্তুতি না নিলে তাদের পক্ষে বক্তৃতা শেষ করা সম্ভব নয়।
অনেক শিক্ষানবিশ বক্তৃতাকালে অপ্রত্যাশিতভাবে বক্তব্য শেষ করে ফেলেন। তাদের সমাপ্তির পদ্ধতি বিধিনিয়মের আওতাভুক্ত নয়, সুন্দর নয়। সত্যিকথা বলতে গেলে তাদের বক্তৃতায় কোনোরূপ সমাপ্তি বা উপসংহার নেই, যা আছে তা হচ্ছে অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি। সুতরাং এইরূপ বক্তব্যের ফল কল্যাণকর হয় না। এটা একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে কোনো একজন বন্ধু কর্তৃক বিদায় জানিয়ে, স্বাগতিককে না বলে বিদায় নেয়ার মতো।
লিংকনের মতো বক্তাও তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতার প্রথম খসড়ায় এই ধরনের ভুল করেছিলেন। এই উদ্বোধনী বক্তৃতা তিনি করেছিলেন এক উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে। সারাদেশে তখন বইছিল ঘৃণার ঝড়। এই ঝড়ে আকাশ তখন মেঘাচ্ছন্ন। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। লিংকন দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের উদ্দেশ্যে উপসংহারে যা বলতে চেয়েছিলেন, মূল খসড়ায় তা ছিল নিম্নরূপ:
হে আমার অসন্তুষ্ট দেশবাসী, আপনাদের মনে দেখা দিয়েছে গৃহযুদ্ধের প্রশ্ন। সরকার আপনাদের প্রতিরোধ করবেন না। আপনারা আগ্রাসনকারী না হলে কোনোরূপ সংঘর্ষের সৃষ্টি করতে পারবেন না। আপনারা সরকারকে ধ্বংস করার কোনোরূপ আনুষ্ঠানিক প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন নি, কিন্তু আমি সরকারকে রক্ষা করার আনুষ্ঠানিক প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছি। আপনারা এই আক্রমণ হতে বিরত থাকতে পারেন। কিন্তু আমি প্রতিরোধ হতে বিরত থাকতে পারি না। আপনাদের জন্য, আমার জন্য নয়, বড় প্রশ্ন হচ্ছে ”শান্তি অথবা যুদ্ধ?”
তিনি এটি তাঁর সচিব মি. সুয়ার্ডকে দেখতে দেন। সুয়ার্ড অত্যন্ত সঠিক ভাবে দেখান যে, এর সমাপ্তি হয়েছে অত্যন্ত সুলবুদ্ধি সঙ্গতি, অপ্রত্যাশিত এবং প্ররোচনামুলক। সুতরাং এর স্থলে তিনি দুটি সমাপ্তি বা উপসংহার তৈরি করেন। তার একটি লিংকন সামান্য সংশোধনীসহ গ্রহণ করেন। শেষ তিনটি বাক্যের পরিবর্তেই এটি ব্যবহার করা হয়। ফলে তাঁর মূল বক্তব্যে যে প্ররোচনা ছিল স্কুলবুদ্ধির লক্ষণ ছিল তা বিদূরিত হয়। তদস্থলে বন্ধুত্বপুর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায়। সংশোধনীটি ছিল এই :
আমরা শত্রু নই, বরঞ্চ বন্ধু। আমরা একে অপরের শত্রু হব না। বাধা আসলেও তা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান স্নেহের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। ভুলবুঝাবুঝি হলেও এমন একদিন আসবে যখন সকলেই একই সুরে একই সাথে ইউনিয়নের জয়গান গাইবে, স্মরণ করবে তাদের যারা আত্মাহুতি দিয়েছে দেশের জন্য, জাতির জন্য, যেসব দেশপ্রেমিক শায়িত রয়েছে কবরগাহে। স্মরণ করবে তাদের যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে আর চিরশায়িত রয়েছে শুশানে।
একজন শিক্ষানবিশ কীভাবে তাঁর বক্তব্যের উপসংহার তৈরি করতে পারেন। এটা কি যান্ত্রিক নিয়মানুযায়ী করা সম্ভব?
না। সংস্কৃতির মতো এটিও অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ব্যাপার। সুতরাং এটা উপলব্ধি করতে হবে অনুভূতি দিয়ে। বক্তা যদি বুঝতে না পারেন যে তার বক্তব্য দক্ষতার সাথে শেষ করা উচিত, তখন কীভাবে তিনি তা করবেন?
তবে এই অবস্থাটা অভ্যাসের মাধ্যমে প্রচেষ্টার মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করা যায়। তা করতে হলে খ্যাতনামা বক্তাগণ যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তা অনুসরণ করতে হবে। টরেন্টের এম্পায়ার ক্লাবে তদানিন্তন প্রিন্স
অব ওয়েলস যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এক্ষেত্রে তাই উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করছিঃ
ভদ্র মহোদয়গণ আমার মনে হয় আমি মূল বিষয় হতে সরে গিয়ে নিজের সম্পর্কেই বেশি বলে ফেলছি। তবে আমি আপনাদের বলতে চাই যে, কানাডায় বৃহত্তম জনসমাবেশে বক্তৃতা করার আমি যে সুযোগ পেয়েছি সে সুযোগে আমি মনে কী অনুভব করছি এবং আমার দায়িত্ব সম্পর্কে কী ভাবছি। আমি আপনাদের নিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারি যে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি এবং আপনাদের বিশ্বাসে কোনোরূপ আঘাত হানছি না।
শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত অন্ধ ব্যক্তিও অনুভব করতে পারেন যে, বক্তব্য শেষ হয়েছে। কেননা, এটা সত্যি সত্যিই এভাবে শেষ হয়, তাই শেষ, অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি নয় মাঝপথে শেষ নয়।
লীগ অব নেশন্স এর ষষ্ঠ অধিবেশন উদ্বোধনীর পরের রোববার ড, হ্যারী এমারসন ফসডিক জেনেভার সেন্ট পীরের ক্যাথিড্রেলে এক বক্তৃতা করেন। তিনি বক্তৃতা শেষ করেন এই বাক্য দিয়ে, যারা তরবারি হাতে নেয় তরবারি হয়েই তারা শেষ হয়।” লক্ষ্য করুন তাঁর ধর্মোপদেশ সংক্রান্ত বক্তৃতা শেষে কথাটি।
আমরা যিশুখ্রিস্ট ও যুদ্ধের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা ভাবতেও পারি না। তাই আজ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সামনে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। যুদ্ধ হচ্ছে মানবতার বড় শত্রু। কেননা যুদ্ধ ধ্বংস করে মানবতা, মানব সভ্যতা। ইহা খ্রিস্টানদের আদর্শের পরিপন্থী। যিশু যা বলে গেছেন যুদ্ধ তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ভগবান সম্পর্কে খ্রিস্টানদের মনে যে বিশ্বাস আছে যুদ্ধ তারো বিরোধী। খ্রিস্টিয় গির্জার উচিত সরাসরি, সুস্পষ্ট ভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা করা। কেননা, আমাদের পিতৃপুরুষের সময় তার বর্তমান সময় এক নয়। বর্তমান সময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো অতীব প্রয়োজন।
আজ এখানে দাঁড়িয়ে একজন আমেরিকান হিসাবে আমি আমার সরকারের পক্ষে বলতে পারি না, কিন্তু একজন আমেরিকান ও একজন খ্রিস্টান হিসাবে আমি লাখ লাখ মানুষের পক্ষে কথা বলতে পারি, কামনা করতে পারি বিশ্ববাসীদের কল্যাণ। আমরা বিশ্ব শান্তির জন্য নানাভাবে কাজ করতে পারি। শান্তির পরিপন্থী যা তা মানবতার জন্যে বিপর্যয় স্বরূপ। শান্তি ছাড়া কোনো জাতির কল্যাণ হয় না, হতে পারে না। ”যারা তরবারি হাতে নেয় তরবারি দিয়েই তারা শেষ হয়।”
কিন্তু বক্তৃতার এই সমাপ্তি ও সর্বাঙ্গ সুন্দর সমাপ্তি নয়। এর সাথে লিংকনের দ্বিতীয় উদ্বোধনী বক্তৃতা সমাপ্তির সুর মিলিত হলে হতে পারে সুন্দরতম সমাপ্তি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন চ্যান্সেলর, আর্ল কার্জন একদা ঘোষণা করেছিলেন, এই নির্বাচন মানবতার, গৌরবও সম্পদ, মানুষের সর্বোত্তম বাকপটুতা, স্বর্গীয় বাকপটুতা।
আমরা মনে প্রাণে আশা করি, অন্তরের সাথে প্রার্থনা করি, যুদ্ধের অভিশাপ দূর হোক। কিন্তু ভগবান যদি ইচ্ছা করেন, সমস্ত সম্পদ নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে পারে। চলতে পারে শত-শত বছর ধরে চলতে পারে অস্ত্রধারীর শেষ রক্তবিন্দু শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এতৎসত্ত্বেও তিন হাজার বছরের পুরাতন কথার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।”খোদার বিচার সবসময় সঠিক ও খাঁটি।”
কারো প্রতি শত্রুতা নয় সকলের প্রতি সহানুভূতি, সত্যের প্রতি দৃঢ়তা রেখে আসুন আমরা আমাদের কর্তব্য সম্পন্ন করি। জাতির জন্যে যারা প্রাণ দিয়েছে, দিয়েছে আত্মাহুতি, তাদের বিধবা এবং সন্তানদের জন্যে শুধু কিছু করাই কর্তব্য নয় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠাই আসল কর্তব্য।
এতক্ষণ আপনি যা পড়লেন তা হচ্ছে আমার মতে জীবন্ত মানুষ প্রদত্ত বক্তৃতার সর্বশ্রেষ্ঠ সমাপ্তি।-আপনি কি আমার সাথে একমত? আপনি আর কোনো বক্তৃতায় এরূপ মানবতাবোধ, প্রেম এবং সহানুভূতি পাবেন?
আব্রাহাম লিংকনের জীবনীকার উইলিয়াম ই. বার্টান লিখেছেন, গেটিসবার্গের ভাষণ একটি মহৎ সৃষ্টি। এটা মন্ত্রের চাইতেও বড় কিছু। এটা আব্রাহাম লিংকন প্রদত্ত সকল বক্তৃতা হতে শ্রেষ্ঠতম। এতে বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্ত্বিক শক্তি পরিপূর্ণ ভাবে প্রকাশিত।
”এটা পবিত্র কাব্যের মতো,” লিখেছেন কাল স্কুর্জ। আমেরিকার আর কোনো প্রেসিডেন্ট আমেরিকার জনগণের প্রতি এরূপ কথা বলেন নি। আমেরিকার আর কোনো প্রেসিডেন্টের হৃদয় হতে এরূপ শব্দ উৎসারিত হয় নি।
কিন্তু আপনি ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্টের মতো অথবা অটোয়া বা ক্যানবেরার প্রধানমন্ত্রীর মতো কোনো অমর বক্তৃতা করতে যাচ্ছেন না। আপনার সমস্যা হচ্ছে, সম্ভবত একটা সামাজিক সমাবেশে কীভাবে আপনার বক্তৃতার উপসংহার টানবেন। আপনি কীভাবে বক্তৃতা শেষ করবেন? আসুন আমরা দেখি, দেখি এ সম্পর্কে কল্যাণকর কোনো সুপারিশ করা যায় কিনা।
আপনার পয়েন্ট সংক্ষিপ্ত করে নিন।
একজন বক্তা তিন বা পাঁচ মিনিটের একটি বক্তৃতায়ও এত বেশি পয়েন্ট আলোচনা করতে চান যে, শ্রোতারা তাঁর মূল বক্তব্য কী তাও বুঝতে ব্যর্থ হয়। তবে কিছু বক্তা এটা উপলদ্ধি করেন। তবে তাঁদের মনে এরূপ বদ্ধমূল ধারণা থাকে যে, সব পয়েন্ট তাদের মনে পরিস্কার হচ্ছে, শ্রোতারাও সে পয়েন্ট সহজে বুঝবে। এ ধারণা ঠিক নয়। বক্তা নিজে এগুলো জানলেও শ্রোতার কাছে এগুলো সম্পূর্ণ নতুন। কিছু তারা বুঝবেন, কিন্তু অধিকাংশ পয়েন্ট তাদের মনে দাগ কাটবে না কেননা, শ্রোতাদের অনেক পয়েন্ট শুনতে হয়, কিন্তু তাদের স্মরণ থাকে খুব সামান্যই।”
একজন খ্যাতনামা আইরিশ বক্তা বলেছিলেন, প্রথমে তাদের বলুন যে, বলা শেষ হয়েছে। এটা অবশ্য ভালো কথা যে, শ্রোতাদের বলে দেয়া যা বলার তা বলে দিয়েছেন, এই বক্তব্য হওয়া উচিৎ সংক্ষিপ্তসার স্বরূপ।
এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বক্তা শিকাগোর রেলওয়ের একজন ট্রাফিক ম্যানেজার।
ভদ্রমহোদয়গণ, সংক্ষেপে বলতে গেলে আমার বক্তব্য হচ্ছে পূর্ব পশ্চিম ও উত্তরে আমাদের রেলপথ চালু করা হয়েছে এবং অভিজ্ঞ পরিচালন ব্যবস্থার ফলে গত এত বছরে দুর্ঘটনা পরিহার করে আমরা যে অর্থ পেয়েছি তা দিয়ে দক্ষিণ পথে লাইন চালু করা যায়। সুতরাং আমি দক্ষিণের পথে লাইন চালু করার সুপারিশ করছি।
দেখুন তিনি কী করলেন। বাকী অংশ না শুনে ও আপনি বুঝতে পারছেন যে তাঁর বক্তব্য কী হতে পারে, তিনি অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে ৫০টি শব্দে সমস্ত বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
আপনি যদি মনে করেন যে, এই ধরণের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা ফলপ্রসূ হয়। যদি মনে করেন তবে. তা অভ্যাস করুন।
কাজের জন্য আবেদন করুন :
এই বক্তৃতার সমাপ্তি অত্যন্ত আবেদন মুলক। বক্তা চান কিছু করা হোক। তা হচ্ছে দক্ষিণ পথে রেল যোগাযোগ চালু করা, তিনি তা করতে বলছেন, দুর্ঘটনা পরিহারের ফলে সঞ্চিত অর্থ ব্যয়ে। বক্তা কাজে যাচ্ছেন, সাড়া চাচ্ছেন, সুতরাং সাড়া মিলছে। এই ধরনের বক্তৃতায় শ্রোতার যেমন সাড়া মেলে, কর্তৃপক্ষেরও অনুরূপ সাড়া পাওয়া যায়।
বাহুল্য বর্জিত আন্তরিক প্রশংসা :
নবযুগ সৃষ্টিতে প্যানসিলভ্যানিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ করা উচিত। প্যানসিলভানিয়া হচ্ছে আমাদের দেশের বৃহত্তম লৌহ ও ইস্পাত প্রস্তুতকারক, বিশ্বের বৃহত্তম রেল কোম্পানি এখানে উপস্থিত। এটা আমাদের তৃতীয় কৃষি রাজ্য, প্যানসিলভানিয়া আমাদের ব্যবসায়ের প্রাণ বিন্দু। সুতরাং দেশের নেতৃত্ব গ্রহণের সঠিক উপযুক্ততা আছে প্যানসিলভানিয়ার।
নিউইয়র্কের প্যানসিলভানিয়া সমিতিতে এই বলেই চার্লস স্কোয়ার তাঁর বক্তব্য শেষ করেন, এতে তাঁর শ্রোতারা আনন্দিত হয়, আশাবাদী হয়। এটা বক্তৃতা শেষ করার একটি প্রশংসনীয় পদ্ধতি। কিন্তু এটিকে আরো ফলপ্রসূগ্রাহী করতে হলে প্রশংসার সাথে-সাথে সত্যকেও তুলে ধরতে হবে। যা সত্য আছে তাও বলতে হবে, ত্রুটি-বিচ্যুতি যা আছে তাও প্রকাশ করতে হবে, তাহলেই বক্তব্য কল্যাণকর হবে, হবে সত্যিকার ফলপ্রসূ।
কৌতুকপূর্ণ সমাপ্তি :
“তাদের হাসিয়ে তুলুন” বলেছেন জর্জ কোহান, “যখন আপনি বক্তব্য শেষ করবেন।” এটা করার ক্ষমতা এবং বক্তব্য আপনার থাকলে খুবই ভালো হয়। কিন্তু কীভাবে? যেমন হেমলেট বলেছেন, প্রতিটি মানুষ তার কর্ম সম্পাদন করেন নিজস্ব পথে।
চরম ধর্মানুগত খ্রিস্টিয় নিয়মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সমক্ষে জন ওয়েসলির সমাধি সম্পর্কে বক্তৃতাকালে লয়েড জর্জ ও শ্রোতাদের হাসিয়ে তুলতেন। কীভাবে তিনি তা করতেন তা লক্ষ্যণীয়। কীভাবে তিনি তার বক্তব্য শেষ করতেন তাও লক্ষণীয়:
আপনারা এই সমাধিক্ষেত্র মেরামতের দায়িত্ব নিয়েছেন, এটা আনন্দের বিষয়। এটা প্রশংসার যোগ্য। তিনি ছিলেন এমন একজন মঠাধ্যক্ষ যিনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, অপরিচ্ছন্নতাকে ঘৃণা করতেন। আমার যতটুকু স্মরণ হয় তিনি বলতেন আমরা কাউকে অপরিচ্ছন্ন মর্মানুরাগী হিসাবে দেখতে চাই না। তার এই প্রচেষ্টার ফলেই আপনারা আজ অনুরূপ কাউকে দেখছেন না। সুতরাং তাঁর সমাধি ক্ষেত্রকে অপরিচ্ছন্ন করে রাখা তার স্মৃতির প্রতি অবজ্ঞা এবং অন্যায় কাজ। আপনাদের স্মরণ আছে কি, ময়লা পোশাক পরিহতা একজন তরুণী গির্জার দরজায় এসে যখন বললেন, ভগবান আপনার কল্যাণ করুন মি. ওয়েসলি, তখন তিনি কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ওহে তরুণী, আপনার মুখমণ্ডল এবং পোশাক পরিচ্ছন্ন হলে আপনার প্রার্থনা ও অধিকতর মূল্যবান হত। (হাসি) অপরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে এটাই ছিল তার অনুভূতি। সুতরাং তার সমাধি অপরিচ্ছন্ন রাখা উচিৎ নয়, রাখা হলে অন্যায় করা হবে। এদিকে লক্ষ রাখুন। এটা একটি পবিত্রস্থান, তীর্থস্থান, এর পবিত্রতা রক্ষা করা দরকার। (হর্ষধ্বনি)
চরম পরিণতি : ভাবারোহ পদ্ধতি হচ্ছে বক্তব্য সমাপনের জনপ্রিয় পদ্ধতি। সকল বক্তার পক্ষে এবং সকল বিষয়ে এরূপ সমাপ্তি নয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়, ফল ভালো হয়। এরূপ বক্তব্য বাক্যের পর বাক্য আকর্ষণীয় হয়। তৃতীয় অনুচ্ছেদের ফিলাডেলফিয়ার প্রদত্ত পুরস্কার অর্জনকারী বক্তৃতাটি এই বিষয়ের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
নায়াগ্রা জলপ্রপাত সম্পর্কে বক্তৃতা স্মরণকালে লিংকন তাঁর নোটে ভাবারোহ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। তিনি কলম্বাসের কাজের সাথে যিশুখ্রিস্ট, মুসা, আদম ও অন্যান্যদের সময় কালের তুলনা করেছিলেন:
প্রাচীন কালের কথা-কলম্বাস যখন এই মহাদেশ আবিষ্কার করেন, যিশু যখন ক্রুশবিদ্ধ হন, মুসা যখন লোহিত সাগর দিয়ে ইসরাইলীদের নেতৃত্ব দেন এবং এমনকি আদম যখন প্রথম সৃষ্টি হন তখনও এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত এখানে একই শব্দের পতিত হচ্ছিল। আমেরিকার তথা সকল আমেরিকানের অস্থিমজ্জায় নায়াগ্রার অস্তিত্ত্ব অনুভূত। এর শক্তি দশ হাজার বছর আগে যা ছিল আজো তাই আছে। অনন্তকাল ধরে এটি থাকবে, কখনো শুকাবে না, জমবে না, ঘুমাবে না, বিশ্রাম নেবে না। এর গতি অনাদি অনন্তকাল হতে যে, ভাবে চলে আসছে চলবে ঠিক সেভাবে।
টাউসেন্ট এল ওভারসার সম্পর্কে বক্তৃতাকালে ওয়েণ্ডেল ফিলিপ ও অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার সমাপ্তি উল্লেখ করা হচ্ছে। এটি বক্তৃতা সংক্রান্ত বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি দৃঢ় ও শক্তিশালী বক্তব্য। বর্তমান যুগের উপযোগী না হলেও এটি আকর্ষণীয়। এটি অর্ধশতাব্দী কাল আগে লেখা। ”এখন থেকে পঞ্চাশ বছর পরে সত্য প্রকাশিত হবে,“ যখন তিনি জন ব্রাউন ও টাউসেন্ট এল ওভার সার সম্পর্কে একথা বলেন তখন কী তা হাস্যকরও কৌতূহল উদ্দীপক হয় না? তার এই ভবিষ্যদ্বাণী কী সত্য? ইতিহাস সম্পর্কে বলা আর আগামী বছরের স্টক মার্কেট বা জমির দামের পূর্বাভাস প্রদান এক জিনিস নয়।
আমি নেপোলিয়নের কথা উল্লেখ করব। যদিও রক্তসাগরে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন নি, “প্রতিশোধ নয়” এটাই ছিল তার জীবনের নীতি, এটিই তিনি মেনে চলেছেন সারা জীবন। জীবন সায়াহ্নে স্বীয় পুত্রকে তিনি বলেছেন, ‘প্রিয় বৎস, একদিন তোমাকে সান্টো ডোকিঙ্গোতে ফিরে যেতে হবে, তখন ভুলে যেও যে, ফরাসিরা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে। আমার মনে পড়ে ক্রমওয়েলের কথা, যিনি একজন সাধারণ সৈনিক হয়েও একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে রাষ্ট্র শেষে মিশে গেছে তার কবরের সাথে। ওয়াশিংটনের কথা আমি উল্লেখ করব, দাসত্ব প্রথার বিরোধী হয়েও যিনি নিজ রাজ্যে দাসত্ব ব্যবসা চালু রাখতে দিয়েছিলেন।
ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে আপনি আমাকে গোড়া ভাবতে পারেন। কিন্তু একথা কী অস্বীকার করতে পারেন যে গ্রিক বীর পুলিয়ন রোমান বীর ব্রটাস, ইংল্যান্ডের হাসম্পডেন, ফ্রান্সের লাফায়েত এবং আমাদের ওয়াশিংটন বিশ্বসভ্যতার স্থপতি। আর জব্রাউন হচ্ছেন মধ্যাহ্ন সূর্যকালের সুপরিপক্ব ফল।
আঙুল লাগবে যখন :
একটা সুসমাপ্তি এবং ভালো প্রারম্ভ না পাওয়া পর্যন্ত অনুসন্ধান করুন, পরীক্ষা করুন। অতঃপর দুটোকে একত্রিত করুন।
যে বক্তা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বক্তৃতা করতে সক্ষম নয়, সে সুবক্তা নয় এবং তাকে কোথাও আমন্ত্রণও জানানো যায় না।
এক্ষেত্রে সেল্টসুলটার সুসও একজন ব্যর্থ বক্তা। কেননা তার বক্তৃতাকালে শ্রোতাদের মধ্যে ”উটিসুক নামে এক তরুণ” ঘুমিয়ে পড়েন এবং জানালা ভেঙে পড়ে গিয়ে ঘাড় ভেঙে ফেলা পর্যন্ত তিনি বক্তৃতা করছিলেন। এই ঘটনার পরও তার বক্তৃতা অব্যাহত ছিল। আমি একরাতে একজন ডাক্তারকে ব্রকলিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বক্তৃতা করতে দেখেছি। এটা ছিল একটি বড় ভোজসভা, বহু বক্তা বক্তৃতা করেন। সকাল দুটায় তিনি বক্তৃতা করতে ওঠেন। তিনি বুদ্ধিমান হলে ডজন খানেক বাক্য বলে শেষ করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি কী তা করেছিলেন? না তা করেন নি। কিন্তু তিনি বাণিজ্য সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তব্য শুরু করেন। শ্রোতারা তখন কামনা করতে থাকেন, উটিসমের মতো জানালা ভেঙে কেউ পড়ে যাক, কিছু ভাঙুক, নষ্ট হোক। তাঁর বক্তৃতা শেষ হোক।
সাটারডে ইভনিং পোস্টের সম্পাদক মি. লরিমার একদা আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি তার পত্রিকায় একটি বিষয় সম্পর্কে ধারাবাহিক নিবন্ধ প্রকাশ ঠিক তখনি বন্ধ করেছেন যখন বিষয়টি ভাবারোহে পৌঁছে এবং পাঠকেরা আরো জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কেন তখন বন্ধ করেন? কারণ, বলেছেন লরিমার, এর পরেই প্রবন্ধ শেষ হয়ে যাবে সহসা? ফলে জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে যাবে।
বক্তৃতার বেলায়ও এরূপ জ্ঞান এরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। যখন শ্রোতারা আপনার কাছ থেকে আরো কিছু শুনতে চায়, তখনই সমাপ্ত করুন।
যিশু খ্রিস্টের সারমন অন-দি মাউন্ট নামক শ্রেষ্ঠতম বক্তৃতা মাত্র পাঁচ মিনিটে শেষ করা যায়। লিংকনের গেটিস বার্গের বক্তৃতায় আছে মাত্র দশটি বাক্য। দৈনিকের পৃষ্ঠায়–প্রকাশিত একটি হত্যাকাণ্ডের কাহিনীর চাইতে কম সময়ে জীবনের জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করে শেষ করা যায়। প্রয়োজন সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা।
আফ্রিকার প্রাচীন মানুষ সম্পর্কে ড. জনসন একটি বই লিখেছেন। তিনি ৪১ বছর তাদের সাথে ছিলেন, তাদের পর্যবেক্ষণ করেছেন। একজন বক্তার গ্রাম্য সমাবেশে বক্তৃতা প্রদানেরও কম সময়ে তার এই বইটি শেষ করা যায়।
এবং সাধারণ শ্রোতারা সাধারণত দীর্ঘ বক্তৃতা পছন্দ করেন না। বক্তব্য বিষয় যাই হোক না কেন। পায়ে চলার পথে আঙুলে আঙুলে লাগতে যে সময় প্রয়োজন অর্থাৎ এক ফুটের সমান তোক বক্তব্য এটিই যেন সবার কাম্য।
অতএব হুঁশিয়ার হোন ভাগ্য সম্পর্কে—
শ্রোতার মনের কথা জানেন না যখন–
তাদের ইচ্ছানুযায়ী শেষ করুন বক্তব্য।
সংক্ষিপ্ত সার :
১। বক্তৃতার সুসমাপ্তি অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়। সব শেষে যা বলা হয় তা দীর্ঘকাল স্মরণ থাকে।
২। এই বিষয়ে আমি যা বলতে চাই তা বলা হল, সুতরাং আমার মনে হয় আমার শেষ করা উচিত তাই আমি শেষ করছি। এরূপ বলে শেষ করবে না, বক্তৃতা শেষ করুন কিন্তু শেষ করছেন বলবেন না।
৩। ওয়েবেস্টার, ব্রাইট ও গ্লাডস্টোন যেভাবে বক্তৃতার উপসংহারের পরিকল্পনা করতেন ঠিক সেভাবে আপনি পরিকল্পনা করুন। অভ্যাস করুন। এলোমেলো ভাবে শেষ করবেন না,
৪। সমাপ্তির ছয়টি পদ্ধতি :
ক। মূল বক্তব্য বিষয়টির সংক্ষিপ্ত সার প্রদান।
খ। কর্মের আবেদন জানানো।
গ। শ্রোতাদের প্রসংসা করা।
ঘ। শ্রোতাদের হাসানো।
ঙ। অর্থপূর্ণ কাব্যাংশ বলা।
চ। ভাবারোহ বা চরম পরিণতি প্রদান।
৫। সুসমাপ্তি ও ভালো সূচনার মধ্যে সমন্ধয় সাধন করুন। শ্রোতারা চাইবার আগেই বক্তব্য শেষ করে ফেলুন। শ্রোতাদের কাছে বক্তব্য শ্রুতিমধুর থাকতে শেষ করা হলে নিজেও সন্তোষ লাভ করবেন।
১০. আপনার বক্তব্য কীভাবে পরিষ্কার বোঝাবেন
একজন খ্যাতনামা ইংরেজ ধর্মযাজক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে আপটন শিবিরে একদল অশিক্ষিত সৈন্য সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন। তারা তখন যুদ্ধে যাচ্ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে অতি সামান্য কয়জনই, জানতেন তাঁদের কোথায় পাঠান হচ্ছে, এইসব সৈন্যদের সমাবেশে ধর্মযাজক ”আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব” এবং সার্ভিয়ার অধিকারের কথা বলেন। সৈন্যদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি জানত না সার্ভিয়া কোনো শহর অথবা রোগের নাম কিনা। এতৎসত্ত্বেও তিনি তাদের সামনে একটি অর্ধোন্মাদময় বক্তৃতা করেন। তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন হলের সব দরজায় রিভলবার হাতে সামরিক পুলিশ প্রহরারত ছিল, যাতে কোনো শ্রোতা হল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে না পারে।
আমি ধর্মযাজককে ছোট করতে চাই না। তবুও সত্যি কথা এই যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে বললে তার যে বক্তব্য ফলপ্রসূ হত, এসব সৈনিকদের কাছে তা ব্যর্থ হয়। সৈনিকরা বুঝতে পারেন না, তাদের কেন এসব কথা বলা হচ্ছে, আর বক্তাও বুঝতে পারেন না, কেন তিনি এসব বলছেন।
আমাদের মতে একটি বক্তৃতার অর্থ কী? যে কোনো বক্তৃতায় বক্তার মুলত চারটি লক্ষ্য থাকে। সে গুলো কী?
১। কোনো একটি বিষয় পরিষ্কার করা।
২। শ্রোতাদের স্বমতে আনা।
৩। উদ্দীপ্ত করা।
৪। আনন্দ দান।
কতিপয় বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যাক।
কারিগরি কাজের প্রতি লিংকন সব সময় আগ্রহী ছিলেন। একবার বালিতে আটকা পড়া নৌকা উদ্ধারের জন্যে তিনি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর আইন দপ্তরের সন্নিকটে অবস্থিত একটি কারিগরি কারখানায় বসে তিনি অনেক খেটে, পরিশ্রম করে তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের একটি মডেল তৈরি করেন। তাঁর এই পরিকল্পনা পরিশেষে ব্যর্থ হলেও তিনি ছিলেন এ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী। যখন বন্ধুরা তার কাছে আসতেন মডেল দেখতে, তিনি মডেল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে কখনো ক্লান্তি বোধ করতেন না। তার মূল লক্ষ্য ছিল সকলের কাছে তার ধারণা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা।
যখন তিনি তার গেটিসবার্গের অমর ভাষণ দান করেন, যখন তিনি তার প্রথম দ্বিতীয় উদ্বোধনী ভাষণ দান করেন এবং যখন তিনি হেনরী ক্লের মৃত্যুর পর তার জীবনী আলোচনা করে বক্তৃতা করেন, লিংকনের মূল লক্ষ্য ছিল নিজের বক্তব্য পরিষ্কার ভাবে বলে, শ্রোতাদের স্বমতে আনা। অবশ্য এসব বক্তৃতার বক্তব্য পরিষ্কার করে তুলে ধরার চাইতে শ্রোতাদের স্বমতে আনার উপরই জোর পড়েছিল বেশি।
জুরিদের সাথে আলোচনা কালে লিংকন তাদের স্বমতে আনতে চাইতেন। রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি নিজের পক্ষে ভোট প্রাপ্তির চেষ্টা চালাতেন। সুতরাং তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করা, কর্মমুখী করে তোলা।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার দু’বছর আগে লিংকন উদ্ভাবন (আবিষ্কার) সম্পর্কে একটি বক্তৃতা প্রস্তুত করেন। এই বক্তৃতা প্রস্তুতিতে তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের আনন্দ দান করা। অন্তত এই লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করেই তিনি বক্তৃতা প্রস্তুত করেছিলেন, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে তিনি সফল হতে পারেন নি। জনপ্রিয় হিসাবে তার জীবন এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। একটি শহরে একজন শ্রোতাও তার বক্তৃতা শুনতে আসে নি।
কিন্তু অন্যান্য বক্তৃতায় তিনি অব্যাহতভাবে সাফল্য লাভ করেছিলেন, যার কথা আমি উল্লেখ করেছি। কিন্তু কেন? কারণ এসব ক্ষেত্রে তিনি তার লক্ষ্যের কথা জানতেন এবং জানতেন কী ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। তিনি জানতেন কোথায় তিনি যাবেন এবং কীভাবে যাবেন। এবং বহু বক্তা এটা ঠিক ভাবে জানেন না বলে মাঝ পথে হাবুডুবু খান।
উদাহরণ স্বরূপ–আমি একদা যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের একজন সদস্যকে বক্তৃতা কালে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে নিউইয়র্কে হিপাড্রোম (ঘোড়া দৌড়ের মাঠ) ত্যাগ করে চলে যেতে দেখেছি। কারণ, তিনি যে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, তাতে তার লক্ষ্য ছিল শ্রোতাদের কাছে তা পরিষ্কার করে তোলা। লক্ষ্য নির্ধারণ ছিল তাঁর অবিবেচনা প্রসূত, তাই তিনি হন ব্যর্থ। এটা ছিল যুদ্ধের সময়। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শ্রোতারা যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো নির্দেশ শুনতে আগ্রহী ছিলেন না। তাদের লক্ষ্য ছিল আনন্দ লাভ। শ্রোতারা দশ মিনিট থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে তাঁর বক্তব্য শোনেন এবং আশা করেন যে এরপর আনন্দ দিয়ে তার বক্তব্য শেষ হবে। কিন্তু তা হয় না, বক্তা বার-বার যুদ্ধের প্রস্তুতি ব্যাখ্যা করতে থাকেন, শ্রোতারা আস্তে-আস্তে অধৈর্য হয়ে পড়েন, একে একে তারা চলে যেতে শুরু করেন? কেহ-কেহ স্বতস্ফূর্ত ভাবে ধ্বনিও প্রদান করতে শুরু করে একসাথে। বক্তা শ্রোতাদের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়ে বক্তৃতা অব্যাহত রাখেন। এর ফলে শ্রোতারা আরো বিরক্ত হয়। হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। তারা বক্তাকে থামিয়ে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। তাদের ধ্বনি উচ্চ থেকে উচ্চগ্রামে পৌঁছে। পরিশেষে এমন অবস্থা হয় যে বক্তার কথা নয়, শ্রোতার কথাই শুধু শোনা যেতে থাকে। সুতরাং বক্তা ব্যর্থ হয়ে, পরাজিত হয়ে অপমানিত হয়ে বক্তৃতা শেষ করেন।
এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিন। আপনার লক্ষ্যের কথা জানুন, বক্তৃতা প্রস্তুতের আগেই লক্ষ্যস্থল সঠিক ভাবে নির্ধারণ করে নিন। কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে তা ঠিক করে নিন। অতঃপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণে লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রস্তুতি নিন।
তুলনার মাধ্যমে বক্তব্য পরিষ্কার করুন :
কোনো বিষয় পরিষ্কার করার, বোধগম্য করার গুরুত্ব অথবা বাধাবিঘ্ন ছোট করে দেখা উচিৎ নয়। একদা আমি একজন আইরিশ কবিকে এক দিন বিকেলে তার নিজের লেখা থেকে পাঠ করে শোনাতে দেখেছি। শ্রোতাদের মধ্যে শতকরা দশজন তিনি কী বলতে চান তা বুঝতে পারেন নি।
বক্তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রকাশ্য সভায় অথবা ঘরোয়া পরিবেশে বক্তৃতায় এরূপ ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
একবার আমি স্যার অন্সিভারলজ-এর সাথে জনসভায় বক্তৃতার সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করি। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস এবং জনসভায় বক্তৃতা দানে ৪০ বছরের অভিজ্ঞ বক্তা। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি জানান যে বক্তৃতায় সাফল্য অর্জন করতে হলে প্রথম প্রয়োজন জ্ঞান এবং প্রস্তুতি এবং দ্বিতীয় প্রয়োজন হচ্ছে, বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্যে কষ্ট স্বীকার করা।
ফ্রাঙ্কো প্রসীয় যুদ্ধের প্রারম্ভে জেনারেল ভন মল্টকী তাঁর অফিসারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “ভদ্রমহোদয়গণ, স্মরণ রাখবেন, যে কোনো নির্দেশকে ভুল বলে গ্রহণ করা হলে তা ভুলই থাকবে।”
নেপোলিয়ন একই বিপদে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সচিবদের প্রতি তাঁর বহুল আলোচিত নির্দেশ ছিল, পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিন, পরিষ্কারভাবে বুঝে নিন।
এবং যখন আপনি এমন একটি বিষয়ে কথা বলবেন যা আপনার শ্রোতাদের কাছে পরিচিত নয় আপনি কীভাবে আশা করবেন যে তারা বুঝবে?
সুতরাং এই ধরনের ব্যাপারে আমরা কী করতে পারি? এই ধরনের অবস্থায় পড়লে আপনি কী করবেন? স্বাভাবিক পদ্ধতিতে এই সমস্ত সমাধানের সহজ পথ হচ্ছে, মানুষ চেনে না এই বিষয়টি চেনাতে হলে যে জিনিসটি চেনে তার সাথে তুলনা করে আপনার বক্তব্য পেশ করুন। স্বর্গরাজ্য। এটা কিরূপ? কীভাবে এই বিষয়টি মানুষের সামনে পরিষ্কার করে তুলে ধরা যায়? যিশুখ্রিস্ট মানুষের সামনে বস্তুর উদাহরণ দিয়ে স্বর্গরাজ্য সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন :
স্বর্গরাজ্য হচ্ছে তাই যেখানকার খাবার আমাদের চাইতে অনেক উপাদেয়, খমির মিশালে যা হয়ে ওঠে আরো উপাদেয়।
এবং স্বর্গরাজ্য হচ্ছে তাই যেখানে মূল্যবান মণিমুক্তার প্রাচুর্যের সীমা নেই।
এবং স্বর্গরাজ্যে হচ্ছে তাই যা সমুদ্রের জলের চাইতে বহুমূল্যবান জল দিয়ে ঘেরা।
প্রতিটি গৃহকর্ত্রী রুটি প্রস্তুতে রুটি ফোলানোর জন্যে খমির ব্যবহার করে। জেলেরা প্রতিদিন সমুদ্রে জাল ফেলে মাছ ধরে এবং ব্যবসায়ীরা মূল্যবান মণিমুক্তার সন্ধান রাখে। সুতরাং এরূপ বর্ণনা হৃদয়গ্রাহী ও বোধগম্য বর্ণনা।
এবং ডেভিড জেহোভাব দয়া সম্পর্কে কিরূপ বর্ণনা দিয়েছিলেন?
প্রভু আমাকে মেঘপালক বানালেন। তিনি আমাকে সবুজ ঘাসে ঘুরে বেড়াতে দিলেন। যেখানে পানির অভাব ছিল।
প্রায় একটি গাছপালাহীন দেশে সবুজ মাঠ সৃষ্টি করলেন।পানির অভাব থাকলেও আমার মেষেদের পানীয় জলের অভাব ছিল না সেখানে।
এটা একটা আনন্দদায়ক উদাহরণ। কেহ-কেহ আফ্রিকায় বসবাসকারীদের জীবনের সাথে তুলনা করে বাইবেলের ব্যাখ্যা করেন। তারা বলেন, “আপনার পাপ অত্যুজ্জ্বল লাল হলে তা বরফের মতো শুভ্র হয়ে যেতে পারে।” এটা কী ধরনের অনুবাদ। সাহিত্য অর্থে অর্থহীন। অবান্তর। আফ্রিকাবাসীরা বরফের সাথে তেমনভাবে পরিচিত নয়। তারা তুষার এবং কোলতারের তুলনা বোঝে না। কিন্তু তারা দীর্ঘ নারিকেল গাছে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্যে নারিকেল সংগ্রহ করতে অভ্যস্ত। সুতরাং মিশনারিরা বাইবেল সেখানে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “তোমাদের পাপ অত্যন্ত লাল হলেও তা নারিকেলের মাংসের মতো সাদা হয়ে যেতে পারে।”
এই পরিস্থিতিতে অবস্থার উন্নতি বিধান কষ্টসাধ্য, তা নয় কি?
মিশোরীর ওয়ারেনবুর্গের টিচার্স কলেজে আমি একবার আলাস্কা সম্পর্কে একটা বক্তৃতা শুনেছি। বক্তা এই ক্ষেত্রে তার বক্তব্য পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হন। তাঁর অবস্থাও হয় আফ্রিকান মিশনারিদের মতো। তিনি বলেন, আলাস্কা ৫,১০,৮০৪ বর্গ মাইল এলাকা নিয়ে গঠিত এবং জনসংখ্যা হচ্ছে ৬৪,৩৫৬ জন।
অর্ধমিলিয়ন বর্গ মাইল বললে মানুষের মনে কী কোনো দাগ কাটে। মোটেই না। এর দ্বারা বাস্তব কোনো ছবি ফুটে ওঠে নি। মেইন অথবা টেক্সাসের আকারও যে অর্ধমিলিয়ন বর্গমাইল বক্তা তা জানতেন না। যদি বক্তা বলতেন যে, আলাঙ্কার উপকূল দ্বীপসমুহের বিশ্বে সব চাইতে দীর্ঘ এবং এক এলাকা ভারমন্ট, নিউহ্যাম্পশায়ার মেইন মাসাসুসেটস, রোডে দ্বীপ; কনেটিকাট, নিউইয়র্ক নিউজার্সি, প্যানসিলভানিয়া, দেলাওয়ার, মেরীলা পশ্চিম ভার্জিনিয়া, উত্তর ক্যারোলিনা, দক্ষিণ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, ফ্লোরিডা, মিসিসিপি, এবং টেনেসীর সম্মিলিত এলাকার চাইতে বেশি, তা হলে তা হত আকর্ষণীয়। এরূপ বললে কি শ্রোতারা আলাস্কা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পেতেন না।–
তিনি বলেছিলেন যে জনসংখ্যা ৬৪,৩৫৩। কিন্তু দশজন শ্রোতাও পাঁচ মিনিট কি এক মিনিট কালও এই সংখ্যা স্মরণ রাখতে পারেন নি। কেন? কারণ চৌষট্টি হাজার তিনশত ছাপান্ন বাক্যটি শ্রোতামনে তেমন দাগ কাটতে পারে নি। সমুদ্রকূলের বালুতে পরিব্রাজকদের লেখা যেমন অন্যের মনে তেমন দাগ কাটে না। এই বাক্যও ঠিক তেমনি। এর প্রতি কারো অন্তদৃষ্টি পড়ে না। তুলনামূলক ভাবে সংখ্যার কথাটা প্রকাশ করলে কী তা আকর্ষণীয় হত না? উদাহরণ স্বরূপ, সেন্ট জোসেফ মিশোরীর এই ছোট শহরটি থেকে খুব দূরে নয়। আজকের শ্রোতাদের অনেকে সেন্ট জোসেফ পরিভ্রমণ করেছেন। আজকের আলাস্কার জনসংখ্যা হচ্ছে সেন্ট জোসেফ থেকে দশ হাজার কম। আরো সুস্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে, আপনি যে শহরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন সে শহরের সাথে আলাস্কার তুলনা করছেন না কেন? ”আলাস্কা নিশৌরীর চেয়ে আটগুণ বড়, কিন্তু এর জনসংখ্যা হচ্ছে উয়ারেনবুর্গ এর চাইতে তেরোগুণ বেশি। একথা বললে কি বক্তার বক্তব্য আরো সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার হতো না।–
নিম্নবর্ণিত উদাহরণ এটা আরো পরিষ্কার করে –
(ক) আমাদের সবচাইতে নিকটবর্তী তারকার দূরত্ব হচ্ছে ৩৫ ট্রিলিয়ন মাইল।
(খ) একটি রেলগাড়ি প্রতি মিনিটে এক মাইল করে চললে আমাদের নিকটবর্তী তারকার পৌঁছতে লাগবে ৪ কোটি ৮০ লাখ বছর। সেখান থেকে গান গাওয়া হলে তার ধ্বনি আমাদের কর্ণগোচর হতে লাগবে ত্রিশলাখ আটশত হাজার বছর? একটা মাকড়সার জাল সেখানে পৌঁছতে হলে তার ওজন হবে ৫০০ টন।
(গ) সেন্ট পিটারস হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গির্জা, যার দৈর্ঘ্য ৩৬৪ গজ ও প্রস্থ ২৩২ ফুট।
(ঘ) ওয়াশিংটনের দুটি ভবনের একটির ওপর অপরটি দাঁড় করালে যে সাইজ হবে এটির সাইজ তাই।
অণু সম্পর্কে বক্তৃতাকালে স্যার অলিভার লজ এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। ইউরোপীয় শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাকালে আমি তাকে বলতে শুনেছি, একবিন্দু পানিতে যত অণু আছে ভূমধ্য সাগরেও তত বিন্দু পানি আছে, তার শ্রোতাদের মধ্যে এরূপ অনেকে ছিলেন যারা জিব্রাল্টার থেকে সুয়েজখাল পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন, এতৎসত্ত্বেও বিষয়টি আরো পরিষ্কার করার জন্যে তিনি আরো বলেছিলেন, একবিন্দু পানিতে যত অণু আছে সমগ্র বিশ্বের বুকে ঘাসের পরিমাণ হবে তাই।
রিচার্ড হার্ডিং ডোভিস নিউইয়র্কের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাকালে বলেছিলেন, সেন্ট সোকিয়ার মসজিদের আকার হচ্ছে ৫ম অ্যাভিনিউ থিয়েটারের সমান, তিনি বলেন, নিকট থেকে দেখলে তাকে আপনার কাছে একটি দ্বীপ নগরী বলে ভ্রম হবে।
অতপর আপনার বক্তৃতায় এই নীতি অনুসরণ করুন। পিরামিড সম্পর্কে বলতে হলে প্রথমে বলুন, এটি ৪৫১ ফুট, অতঃপর তার উচ্চতা শ্রোতারা যে সব গৃহ প্রতিদিন দেখেছে তার সাথে তুলনা করে বোঝন। বলুন এটি নগরীর কতটুকু অংশ জুড়ে আছে। এত হাজার গ্যালন এটা অথবা অতশত হাজার ব্যারল সেটা বলে কিছু বর্ণনা করবেন না, বলবেন, এই তরল পদার্থ দিয়ে কতটা ঘর ভর্তি করা সম্ভব। ২৫ ফুট উচ্চ বলার চাইতে এই সিলিং হতে দেড়গুণ উঁচু বলা কি শ্রেয় নয়। মাইলে দূরত্ব বর্ণনা করার চাইতে নির্দিষ্ট স্থান হতে কতদূরে অথবা ঐ সড়ক হতে এত দূরে একথা বলা কি ভালো নয়? লিংকনের বক্তব্যের স্পষ্টতার রহস্য : লিংকনের শ্রোতাদের কাছে তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার করে তোলার জন্যে সাধারণত জনপ্রিয় ফ্রেইজ ব্যবহার করতেন। কংগ্রেসে প্রদত্ত তাঁর প্রথম ভাষণে তিনি ”চিনি আচ্ছাদিত” ফ্রেজ ব্যবহার করেন। খ্যাতনামা মুদ্রাকর ও লিংকনের ব্যক্তিগত বন্ধু মি. ডেফ্রিজ বলেছিলেন যে, এই ফ্রেজটি ইলিনয়েস এ জনসভার জন্যে এটি যথোপযুক্ত হলেও রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক রেকর্ডের জন্যে এটি উপযুক্ত নয়। প্রত্যুত্তরে মি. লিংকন বলেন, “তুমি যদি মনে কর এমন সময় আসবে যখন জনগণ ”চিনি আচ্ছাদিত” শব্দের অর্থ বুঝবে না, আমি তা ব্যবহার পরিত্যাগ করব, অন্যথা আমি এটি প্রয়োগ অব্যাহত রাখব।”
তিনি কীভাবে সহজ ভাষা শেখেন তা একবার কনক্স কলেজের প্রেসিডেন্ট ড. গ্যালিভারের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন :
আমার ছোট বেলায় কেহ আমরা সাথে কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে আমি বিষয়বস্তু বুঝতে না পারলে উত্তেজনা অনুভব করতাম। তবে আমি মোটে ক্রুদ্ধ হতাম না। তবে সময়-সময় তা আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাত। আমি যখন রাতে শুতে যেতাম তখন আমি সেদিন বিকেলে প্রতিবেশী যে বিষয়টি নিয়ে আমার পিতার সাথে আলোচনা করছেন তা ভাবতে-ভাবতে যেতাম। শুয়ে-শুয়ে ভাবতাম। অনেক সময় বিষয়টি ভাবতে-ভাবতে আমার ক্ষুদ্র কক্ষে পায়চারী করতাম। বিষয়টি বোঝার জন্যে, উপলব্ধি করার জন্যে অনেক সময় বিদ্রি রজনী যাপন করতাম। বিষয়টি বুঝতে পারলেও আমার মনে হত আমি যেন তা সঠিকভাবে বুঝি নি। তাই আবার চিন্তা করতাম।
আমি বিষয়টিকে প্রাঞ্জলও সরল ভাষায় রূপ দিতে না পারা পর্যন্ত শান্তি পেতাম না, এটাই ছিল আমার সেদিনের আবেগ প্রবণতা। এবং এই আবেগ প্রবণতা দিয়েই আমি একটি বিষয় বুঝতে পারতাম এবং এভাবেই আমি সহজ ভাষা আয়ত্ত্ব করি।
আসক্তি? হ্যাঁ এটা সেভাবেই বিবেচিত হওয়া উচিত। নিউসালেম এর স্কুল শিক্ষক মেন্টার গ্রাহাম বলেছেন, “আমি লিংকনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে লেখাপড়া করতে দেখেছি। তবে তার পাঠাভ্যাসের মূল লক্ষ্য ছিল কীভাবে সহজে তা প্রকাশ করা যায়।”
এই ক্ষেত্রে সাধারণ বক্তার ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, তারা যে বিষয়টি পরিষ্কার করে তুলে ধরতে চান সে বিষয়টি নিজেরাও বোঝে না। অস্পষ্ট ধারণা ভাসা-ভাসা জ্ঞান দিয়ে কোনো কিছু অন্যকে বোঝানো অসম্ভব। এর ফল কী হয়? কুয়াশায় ক্যামেরায় ছবি আসে না। এই রূপ ক্ষেত্রে বক্তার বক্তব্যও হয় কুয়াশাচ্ছন্ন। লিংকনের পদ্ধতি অনুসরণে বিষয় পরিষ্কার করা নিশ্চিতভাবে সহজ।
দৃশ্য বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত :
চতুর্থ পরিচ্ছেদে আমরা বলেছি, যে সব মাংসপেশী কান থেকে মাথায় গিয়েছে তার চাইতে চোখ থেকে মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত মাংসপেশী অনেক বেশি বড় এবং বিজ্ঞানের মতে আমরা কানে যা শুনি তার চাইতে চোখে যা দেখি তার প্রতি ২৫ গুণ বেশি দৃষ্টি দিই।
একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে, “একবার দেখা শতবার বলার চাইতে উত্তম।” সুতরাং আপনার বক্তব্য পরিষ্কার করতে চাইলে ছবিকে কেন্দ্র করে বক্তব্য প্রকাশ করুন। খ্যাতনামা ন্যাশনাল ক্যাশ রেজিস্টার কোম্পানির প্রেসিডেন্ট জন এইচ, প্যাটারসন এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। কর্মচারীদের প্রতি তার বক্তব্য সম্পর্কে একবার তিনি সিস্টেম ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লেখেন :
আমি বিশ্বাস করি কোনো ব্যক্তি শুধুমাত্র বক্তৃতা শুনে সবকিছু বুঝতে পারে না অথবা বক্তৃতা সকল শ্রোতারে দৃষ্টি একইভাবে আকর্ষণ করতে পারে না। এই ক্ষেত্রে বক্তৃতার সাথে একটি নাটকীয় বিকল্প প্রয়োজন। যে ক্ষেত্রে সম্ভব সে ক্ষেত্রে বক্তৃতার সাথে ছবি প্রদর্শন করা বাঞ্ছনীয়। শব্দের চাইতে নক্সার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় বেশি এবং নক্সার চাইতে ছবি অধিকতর আকর্ষণীয়। একটি বিষয়ের আদর্শ উপস্থাপন হচ্ছে বিষয়টি সম্পর্কে সামগ্রিক ছবি প্রদর্শন করে ছবিসমূহের সংযোগ বিধানের জন্যে শব্দ বা বাক্য ব্যবহার। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যে, আমার বক্তব্যের চাইতে প্রদর্শিত ছবি দেখে শ্রোতারা অনেক সহজে বিষয়টি বুঝতে পারেন।
অদ্ভুত নকশা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। –আমি সব বিষয়ে কাটুন বা চার্ট করে বোঝাবার চেষ্টা করি। ডলার চিহ্নিত একটি সার্কেলের অর্থ একটি টাকা আর ডলার অংকিত একটি থলের অর্থ কিছু টাকা। চন্দ্রমুখ অনেক সুফল প্রদানে সক্ষম। একটি সার্কেলে চোখ, নাক, মুখ, কান আঁকুন। নবীন এবং প্রবীণেরা নিজ-নিজ চিন্তাধারানুযায়ী তার অর্থ করবে। খ্যাতনামা কাটুনিস্ট এর হাতে আঁকানো হলে তার অর্থও হবে সেরূপটি। ব্যাগ একটি বড় ও একটি ছোট পাশাপাশি আঁকা হলে এটা কারো বুঝতে কষ্ট হবে
যে, একটিতে বেশি এবং অপরটিতে কম টাকা আছে। কথার সাথে-সাথে এসব ছবি প্রদর্শিত হলে শ্রোতা আপনার কথা সহজে বুঝবে আপনার পরবর্তী বক্তব্যের প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে? তবে অদ্ভুত ছবি মানুষকে আনন্দও দান করবে।
আমি আমার দোকানে পোশাদার শিল্পী দিয়ে ছবি এবং নক্সা অঙ্কন করাই। লোক এসব ছবি দেখে। কাগজ থেকে পর্দায় ছবি আঁকাই, পরে তা মুভি পিকচারে রূপান্তরিত হয়।
সব বিষয়ে ছবি করা, নক্সা করা সম্ভব নয়, তবে যেগুলো সম্ভব সেগুলো করা উচিৎ। এসব ছবিতে অন্যের দৃষ্টি পড়ে, আগ্রহ বাড়ায় অর্থ সহজে পরিষ্কার হয়?
মি. রকফেলার কলোরোডো জ্বালানী ও লৌহ কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সিস্টেম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি কীভাবে মুদ্রা প্রদর্শন করে অবস্থা বিশ্লেষণ করতেন তা ব্যাখ্যা করছেন :
আমি এটা উপলব্ধি করলাম যে, কলোরোডা জ্বালানী ও লৌহ কোম্পানির কর্মচারীরা মনে করেছেন যে, রকফেলার গোষ্ঠী তাদের (কর্মচারীদের) স্বার্থের বিনিময় প্রচুর অর্থ আয় করেছেন। সাধারণ লোকের ধারণাও তাই! আমি তাদের কাছে এটা প্রদান করছি যে, এই কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণের চৌদ্দ বছরের মধ্যে কোম্পানি তার ডিভিডেন্ড খাতে একটি সেন্টও জমা দেয় নি।
আমার একটি সভায় আমি কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করি। আমি টেবিলে কতিপয় মুদ্রা রাখি। অতঃপর বক্তৃতা কালে আমি কিছু মুদ্রা নিয়ে তা তাদের বেতন বলে দেখাই। অতঃপর আরো কিছু বেশি মুদ্রা নিয়ে তা অফিসারদের বেতন হিসাবে দেখাই। অবশিষ্ট অর্থ পরিচালকদের বেতন হিসাবে প্রদর্শন করি। এতে আমার সমস্ত মুদ্রা খরচ হয়ে যায়, স্টক হোল্ডারদের জন্যে আর কোনো মুদ্রাই পড়ে থাকে না। অতঃপর আমি প্রশ্ন করি আমারা কোম্পানির অংশীদার কর্মকর্তা এবং পরিচালক, সমস্ত আয়–আমরাই ভাগ করে নিই, চতুর্থের জন্যে কিছু থাকে কি?
যে কোনো বিষয়ের ওপর সুস্পষ্ট দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। ডুবন্ত সূর্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি যেভাবে নিবন্ধ হয় বিষয়টির প্রতি ঠিক সেরূপ নজর দিন। উদাহরণ স্বরূপ ”কুকুর” বললে মানুষের চোখের সামনে একটা বিশেষ জন্তুর ছবি ভেসে ওঠে। বুলডগ বললে আর একটি ছবি ভেসে ওঠে এবং দুটোর সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য সকলেই বোঝে। টাটু ঘোড়া আর ঘোড়ার তুলনাও অনুরূপ নয়। এমনিভাবে অপর দুটি পশুর তুলনা করলে কি অবস্থাটা আরো পরিষ্কার হয় না?
আপনার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করুন :
নেপোলিয়ন বলেছিলেন যে, কোনো কিছু সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে হলে পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন। তিনি জানতেন যে, তিনি যা কিছু বোঝেন তা অন্যেরাও একই ভাবে বুঝবে, এটা সঠিক নয়? তিনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, কোনো নূতন বিষয় বোঝাতে হলে মনের সামনে তা তুলে ধরা প্রয়োজন। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটা বিষয়ে বার-বার পুনরাবৃত্তি অবশ্যই প্রয়োজন। সব বারে একই ভাষায় পুনরাবৃত্তি নয়। একই ভাষায় পুনরাবৃত্তি করলে শ্রোতারা বিদ্রোহ করবে। কিন্তু ভাষার ভিন্নতা থাকলে, নতুন-নতুন শব্দ ও ফ্রেইজ প্রয়োগ করলে শ্রোতারা তা সহৃদয়তার সাথে গ্রহণ করবে।
এ সম্পর্কে একটা বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। মি. ব্রয়ান বলেছেন : আপনি কোনো একটা বিষয় নিজে না বুঝলে তা অন্যকে বোঝাতে পারবেন না। যে বিষয়টি আপনি ভালোভাবে বুঝেছেন সে বিষয়টি আপনি অন্যকেও ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হবেন।
শেষ বাক্যটি হচ্ছে প্রথম বাক্যের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু এটা বলার পর কেহ এটাকে পুনরাবৃত্তি বলে মনে করে না। এই বাক্য দ্বারা বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়।
আমি আমার ক্লাসে এই পুনরাবৃত্তি পদ্ধতি বার-বার অনুসরণ করেছি। এতে বিষয় সহজে পরিষ্কার হয়েছে। পুনরাবৃত্তি পদ্ধতি অনুসরণে সত্যিই বক্তব্য সহজতর ও স্বচ্ছ হয়ে পড়ে।
সাধারণ ব্যাখ্যা ও বিশেষ উদাহরণ :
কোনো একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার নিশ্চিত ও সহজতর পথ হচ্ছে সাধারণ ব্যাখ্যা ও বিশেষ উদাহরণ প্রদান। এ দুটির মধ্যে পার্থক্য কী? একটি হচ্ছে সাধারণ ও অপরটি হচ্ছে বিশেষ।
এক্ষেত্রে আমরা বিশেষ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। ”কর্মক্ষেত্রে এরূপ পুরুষ ও মহিলা আছেন যাদের আয় আশ্চর্যজনকভাবে অনেক বেশি।” এই বিবৃতিটিকে আমরা উদাহরণ রূপে গ্রহণ করি। না। এই বিবৃতিটি কি সবার কাছে পরিষ্কার? বক্তা এতে কী বলতে চেয়েছেন তা কি আপনি পরিষ্কার ভাবে বুঝেছেন। না। এবং বক্তাও এটা বুঝতে পারছেন না যে, এই বিবৃতি থেকে শ্রোতারা কি বুঝেছেন? এই বিবৃতির শ্রোতা দেশীয় ডাক্তার হলে ও জরাক পাহাড়ে কর্মরত চিকিৎসক হলে তিনি মনে করবেন বার্ষিক আয় পাঁচ হাজার ডলার, খনি ইঞ্জিনিয়ার হলে তিনি নিজের পেশার লোকের সাথে তুলনা করে বার্ষিক আয় বার্ষিক সাত হাজার ডলার মনে করবেন। সুতরাং এই বিবৃতিটি অত্যন্ত অস্পষ্ট। এটাকে স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বক্তা ”আশ্চর্যজনকভাবে বেশি” বলে কি বোঝাতে চেয়েছেন এবং কি পেশায় নিয়োজিতদের সম্পর্কে বলেছেন যে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
দেশে এমন আইনজীবী, গান লেখক, উপন্যাসিক, নাট্যকার,শিল্পী, নায়ক, গায়ক আছেন যাদের আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চাইতে বেশি।
এখানে বক্তার বক্তব্য বিষয়টি কি আরো স্পষ্ট হল না? তিনি কিন্তু এক্ষেত্রেও বিশেষ উদাহরণ দেন নি। তিনি সাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বিশেষ উদাহরণ দেন নি। তিনি ”গায়কের” কথা বলেছন কিন্তু গায়ক হিসাবে রোমা পানসেলা, কিরিস্টেন ফ্লাগস্টাড অথবা লিলি পনস এর নামোল্লেখ করেন নি।
সুতরাং এখনও বিবৃতিটি অনেকটা অস্পষ্ট রয়েছে, এটাকে আমরা বিশেষ বিষয় বা সৃষ্ট বিষয় রূপে উল্লেখ করতে পারি না। নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদে যেভাবে বিশেষ উদাহরণ দেয়া হয়েছে সেরূপ বিশেষ উদাহরণ দিলে কি অবস্থাটা আরো স্পষ্ট হত না?
খ্যাতনামা আইনজীবী স্যামুয়েল উটার মেয়ার ও শ্ৰাক্স স্টেওয়ার-এর বার্ষিক আয় দশ লাখ ডলারেরও বেশি। জেক ডেমসের বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ ডলারের বেশি। অশিক্ষিত নিগ্রো গায়ক জো লুইসের বয়স মাত্র ২২ বছর হলেও তার বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ ডলারের বেশি। বার্লিনের নায়ক ইভিং এর বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ ডলার। সিডনী কিংমলী তাঁর নাটকের জন্যে সপ্তাহে ১০ হাজার ডলার রয়েলটি পান। এইচ. জি, ওয়েলস তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, তিনি তার লেখনী থেকে অর্থাৎ প্রকাশিত বই থেকে ত্রিশ লাখ ডলার পেয়েছেন। দিয়োগো বাইভেরা তাঁর ছবি থেকে বার্ষিক পাঁচ লাখ ডলার আয় করতেন। কেথারিন কর্নেল কখনো সপ্তাহে পাঁচ হাজার ডলারে মঞ্চে অভিনয় করতে সম্মত হতেন না।
সুতরাং বক্তব্য হওয়া উচিত বিশেষ উদাহরণ মূলক। নির্দিষ্ট বিশেষ বিষয়ক। এরূপ হলে শ্রোতাদের কাছে তা শুধু স্পষ্ট হয় না, শ্রোতা তা পরিষ্কার বুঝতে পারেন, আগ্রহী হয়।
একেবারে অধিক পয়েন্ট বলবেন না :
শিক্ষকদের এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস একদা বলেছিলেন যে, একজন বক্তা একবার বক্তৃতায় শুধুমাত্র এক পয়েন্ট আলোচনা করতে পারেন এবং একটি পয়েন্ট ভিত্তিতে একঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করা সম্ভব। সম্প্রতি আমি একজন বক্তাকে দেখেছি যিনি স্টক ওয়াচ সম্পর্কে তিন মিনিট বলার পর বলেন যে তিনি আরো এগারোটি পয়েন্ট আলোচনা করবেন। এটা কোনো বুদ্ধিমান বক্তার জন্যে সঠিক বা যথোপযুক্ত নয়। এই ধরনের বক্তব্য হয় ভাসা-ভাসা। পাঁচক যে ভাবে মানুষকে প্যারিস দেখায় এটিও সেরূপ বক্তব্য। এটা আমেরিকার মানবিক ইতিহাসের জাদুঘর ত্রিশ মিনিট ধরে পরিভ্রমণের মতো। এতে সব কিছু পরিষ্কার হয় না, তেমন আনন্দও পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বক্তা অনেক কিছু বলতে চান বলে বক্তব্য পরিষ্কার হয় না। তিনি এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে সরে যান, কোনো পয়েন্টই ক্লিয়ার করতে পারেন না।
কাপড় অনুযায়ী কোট তৈরির মতো বক্তব্য সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত। উদাহরণ স্বরূপ আপনি যদি শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে বলতে চান তাহলে কীভাবে শ্রমিক ইউনিয়নের জন্ম হল, কীভাবে ইউনিয়ন কাজ করে, তারা কী ভালো করেছেন, কীভাবে খারাপ কাজ প্রতিরোধ করেছেন, কীভাবে শিল্পবিরোধ মীমাংসা করা যায় তার সব কিছু বলবেন না। আপনি যদি সেভাবে সব কিছু বলতে চান কেহই আপনার বক্তব্য পরিষ্কার বুঝবেন না। এরূপ বললে বিষয় পরিষ্কার না হয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে একটি পয়েন্ট বলে তা পরিষ্কার করার, শ্রোতাদের বোধগম্য করার চেষ্টা করা কি শ্রেয় নয়? হ্যাঁ, এটাই উত্তম পন্থা। এই ধরনের বক্তব্য শ্রোতাদের মনে প্রভাব বিস্তার করে। এধরণের বক্তব্য হয় আকর্ষণীয়, অর্থবহ এবং তা সহজে স্মরণ রাখা যায়।
যা হোক, আপনি যদি আপনার বক্তব্যে বহু পয়েন্ট ব্যাখ্যা করতে যান তবে তা পরিশেষে সংক্ষেপে বলুন, সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে অবশ্য শ্রোতাদের বুঝতে এবং মনে রাখতে কিছুটা সহজতর হতে পারে।
সংক্ষিপ্ত সার :
(১) কোনো বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল ও যিশুখ্রিস্ট বলেছিলেন যে, তাহাকে উদাহরণ দিয়ে বক্তব্য পেশ করতে হয়। কারণ, তাঁর শ্রোতারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না এবং বুঝেও বোঝে না।
(২) যিশুখ্রিস্ট দৃশ্য বিষয় উল্লেখ করে অদৃশ্য জিনিস সম্পর্কে বোঝাতেন। স্বর্গের কথা বোঝাতে তিনি বলতেন যে স্বর্গ রাজ্য হচ্ছে এমন স্থান যেখানে মূল্যবান সম্পদের কোনো অভাব নেই। আলাস্কার কথা বোঝাতে হলে তার আকার এবং জনসংখ্যার কথা না বলে যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি কথা বলছেন তার সাথে তুলনা করুন।
(৩) সাধারণ জনসমাবেশে বক্তৃতা কালে কারিগরি বিষয় পরিহার করুন। লিংকনের মতো সহজ সরল ভাষায় কথা বলুন যাতে যে কোনো ছেলে অথবা মেয়ে সহজে তা বুঝতে পারে।
(৪) যে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি বলবেন সে বিষয়টি আপনার মনে দিবালোকের মতো পরিষ্কার কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হোন?
(৫) সম্ভব ক্ষেত্রে ছবি, কার্টুন প্রভৃতি প্রদর্শন করুন। যা বলবেন তা নিশ্চিত ভাবে বলুন। শেয়ালের কথা বোঝাতে কুকুর এর কথা উল্লেখ করবেন না।
(৬) কোনো বিষয় পুনরুল্লেখ করবেন না, একটা ফ্রেজ দু’বার ব্যবহার করবেন না। তবে যা বলবেন তা গুরুত্ব দিয়ে বলুন।
(৭) উদাহরণ দিয়ে আপনার বক্তব্য পরিষ্কার করুন। এই ক্ষেত্রে বাস্তব ও দৃষ্টিগোচর উদাহরণ দিন।
(৮) বহু পয়েন্ট আলোচনা করবেন না। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় এক বা দুটি পয়েন্টের বেশি আলোচনা করা যায় না।
(৯) পরিশেষে আপনার আলোচনার সংক্ষিপ্ত সার উপস্থাপন করুন।
১১. শ্রোতাদের কীভাবে আগ্রহী করে তোলা যায়
এখন যে পৃষ্ঠা আপনি পড়ছেন, যে কাগজ আপনি দেখছেন, তা নিতান্ত সাধারণ, তা নয় কি? আপনি এরূপ অগণিত পৃষ্ঠা দেখেছেন। এটা অত্যন্ত সাধারণ এবং আকর্ষণহীন, কিন্তু আমি যদি এসম্পর্কে কোনো অদ্ভুত গল্প বলি তা হলে আপনি নিশ্চিতভাবেই আগ্রহী হবেন। এই পৃষ্ঠাটি এখন দেখতে নিতান্ত রসকষহীন দেখাচ্ছে। প্রকৃতি বিজ্ঞানী জানেন, এটা এটম দিয়ে তৈরি। এবং অণু কিরূপ ছোট? দশম পরিচ্ছেদে আমরা শিখেছি, একবিন্দু পানিতে যত অণু আছে ভূমধ্যসাগরে আছে ততবিন্দু পানি। সুতরাং যে অণু দিয়ে তৈরি এই কাগজ তা কি দিয়ে তৈরি? ক্ষুদ্র জিনিসকে বলে ইলেকট্রন। ইলেকট্রন দিয়ে ঘেরা, যেমনি পৃথিবী ঘেরা চন্দ্র দিয়ে। ইলেকট্রন প্রতি সেকেন্ডে ১০ হাজার মাইল চলতে পারে। সুতরাং আপনি পড়তে শুরু করলে এই ইলেকট্রন নিউইয়র্ক থেকে টোকিও পৌঁছতে পারে।
মাত্র দুমিনিট আগেও এই কাগজের টুকরাকে আপনি প্রাণহীন নিশ্চল বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়, এটি স্রষ্টার এক অদ্ভুত সৃষ্টি। এটা শক্তির এক সাইক্লোন।
এটা সম্পর্কে অদ্ভুত কথা শোনেছেন বলে আপনি এক্ষণে এর প্রতি আগ্রহী হবেন। এই অদ্ভুত বিষয়টিই আগ্রহ সৃষ্টির কারণ। এটা সত্য যে, আগ্রহ সৃষ্টি হলেই মানুষ সে বিষয়টি জানতে চাইবে। সম্পূর্ণ নূতন জিনিস আমাদের কাছে তেমন আকর্ষণীয় নয়, আবার সম্পূর্ণ পুরাতন জিনিস ও আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করে না। পুরাতন সম্পর্কে আপনারা নতুন কিছু শোনতে আগ্রহী। উদাহরণ স্বরূপ মোনালিসা সম্পর্কে কিছু বলে আপনি ইলিনয়স এর একজন কৃষকের বিষয় মনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারবেন না। এই বর্ণনা তার জন্যে হবে নতুন বিষয়। এটা তার পুরাতন আগ্রহের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। কিন্তু সমুদ্রসীমার নিচে অবস্থিত হল্যান্ডের কৃষক সম্পর্কে কিছু বলে সে আগ্রহী হবে। আপনি যখন বলবেন হল্যান্ডের কৃষকেরা শীতকালে বগবাদী পশুর সাথে একই ঘরে বাস করে, তখন ইলিনয়িসের কৃষক তা আগ্রহভরে শোনবে। শুধু শুনে যাবে না, সে তার বন্ধুদের কাছেও হল্যান্ডের কৃষকদের কাহিনী বলবে।
এক্ষেত্রে আরো একটি কাহিনী বলছি। দেখুন এটা আপনার আগ্রহ সৃষ্টি করে কিনা। যদি আগ্রহ সৃষ্টি করে তাহলে কেন?
আপনার উপর তরল সালফরিক এসিডের এ্যাফেক্ট কী :
অধিকাংশ তরল পদার্থ আমরা পাইন্ট, কোয়ার্ট, গ্যালন অথবা ব্যারেল হিসাবে পরিমাপ করি। আমরা সাধারণত মদের কোয়ার্ট, দুধের গ্যালন এবং গুড়ের ব্যারেলের কথা বলি। তেলের কথা আলোচনায় আমরা ব্যারেলের কথা বলি। তবে এমন তরল পদার্থও আছে যার পরিমাপ করি আমরা টনে। এই তরল পদার্থ হচ্ছে সালফরিক এসিড। বিভিন্নভাবে আপনার দৈনন্দিন জীবনের সাথে এটি সম্পর্কিত এটা কেরোসিনও গ্যাসোলিন পরিশোধনে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এটি না হলে আপনার গাড়ির চাকা অচল হয়ে যায়। যে বৈদ্যুতিক বাতি আপনার অফিস আলোকিত করে, ঘর আলোকিত করে, রাতে আপনাকে চলার পথ দেখায় এটি ছাড়া সেই বাতিও জ্বলবে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে হস্তমুখাদি প্রক্ষালনের জন্য আপনি যে পানি নেবেন তাও নির্গত হবে লৌহ ও নিকেল টিউব দিয়ে এবং এই টিউব তৈরিতেও এটি অপরিহার্য। এটা আপনার বালতি তৈরিতেও হয় ব্যবহৃত। আপনার নিত্য ব্যবহার্য সাবান তৈরিতে এই এসিড ব্যবহার করা হয়। আপনার চুলের ব্রাশ, সেলুলয়েডের চিরুনি, আপনার রেজার প্রভৃতি এই এসিডের সাহায্য ছাড়া তৈরি করা যায় না।
আপনি আন্ডার অয়ারের উপর প্যান্ট পরে তাতে বোতাম লাগান, প্যান্ট ইস্ত্রী করেন। বোম ও ইস্ত্রী তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। আপনার জুতা তৈরিতে এবং তা পালিশেও এই এসিড ব্যবহৃত হয়।
প্রাতভোজের কথায় আসুন। এই কাজে ব্যবহৃত বাসনকোসন এই এসিডের সাহায্য ছাড়া তৈরি হয় নি। চামচ, ছুরি, কাটা কোনো কিছুই তৈরি হতে পারে নি এটি ছাড়া।
আপনার জন্যে যে রুটি তৈরি হয়েছে সেই রুটির বেসিন তৈরিতেও এই সালফরিক এসিড ব্যবহৃত হয়েছে। আপনার কেক, সিরাপ প্রভৃতিও তৈরি হয়েছে এই এসিড ব্যবহারের মাধ্যমে।
সুতরাং আপনার দিনের প্রতিটি কাজে এই এসিডের প্রভাব অনস্বীকার্য। যেখানে যান না কেন, এর প্রভাব থেকে আপনি মুক্ত হতে পারবেন না। সাধারণ মানুষ এর খবর না রাখলেও মানব সভ্যতার জন্য এটি অপরিহার্য।
বিশ্বের তিনটি আকর্ষণীয় বস্তু :
বিশ্বের তিনটি আকর্ষণীয় বস্তু কী? সেক্স, সম্পদ ও ধর্ম। প্রথমটি দিয়ে আমরা জীবন সৃষ্টি করি, দ্বিতীয়টি জীবন রক্ষা এবং তৃতীয়টি দিয়ে অনাগত ভবিষ্যতে আমরা বেঁচে থাকতে চাই।
আমাদের সেক্স, আমাদের সম্পদ এবং আমাদের ধর্মের প্রতি আমরা আগ্রহী হই এবং এই আগ্রহ জন্মে আমাদের নিজেরদেরই স্বার্থে।
পেরু সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে আমরা তেমন আগ্রহী নই। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা শক্তি সম্পর্কে জানতে আমরা আগ্রহী। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল থাকলেও তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু যে ধর্ম আমাদের জন্য অনাগত বিশ্বে শান্তি আনবে বলে আমাদের বিশ্বাস সে ধর্ম সম্পর্কে আমরা জানতে আগ্রহী।
একদা প্রয়াত লর্ড নর্থক্লিফকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মানুষ কিসে আগ্রহী। তিনি এক শব্দে উত্তর দিয়েছিলেন নিজেদের সম্পর্কে। নর্থক্লিফ ছিলেন গ্রেট বৃটেনের সবচাইতে ধনী সংবাদপত্র মালিক।
আপনি কী ধরনের লোক তা কি আপনি জানতে চান? এটা একটা আকর্ষণীয় বিষয়। আমরা আপনার সম্পর্কে আলোচনা করছি। আমাদের আলোচনা আপনার সামনে দর্পণ হিসাবে কাজ করবে। এই আলোচনা সম্পর্কে অধ্যাপক জেমস হার্ভে রবিনসনের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, আলোচনায় মন-ই প্রতিফলিত।
আমরা যখন সজাগ থাকি তখন চিন্তা করি। ঘুমের মধ্যেও চিন্তা করি এবং ঘুম থেকে জেগেও চিন্তা করি। আমাদের চিন্তাকালে বাস্তব কিছু এলে তাকে ভিত্তি করেই আমাদের চিন্তা আবর্তিত হয়। এটাই আমাদের চিন্তার বাস্তব পথ। আমরা আমাদের চিন্তাকে নিজস্ব গতিতে আবর্তিত হতে দিই। ফলে এতে আমাদের পছন্দ অপছন্দ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভীতি, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ও ঘৃণা সবকিছুই আবর্তিত হয়। আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ছাড়া আর কোনো বিষয়ে এত অধিক আগ্রহী নই। অহংবোধ বা স্বার্থপরতার চাইতে বড় কিছু আমাদের নেই। আমরা প্রয়োজনে নিজেদের স্বার্থ সত্যকেও পরিহার করে চলি।
গোপন কথা, অব্যক্ত কথা আমাদের চরিত্রে প্রতিফলিত। এসব কথা এসব বেদনার প্রভাব আমাদের চরিত্রের অনস্বীকার্য।
সুতরাং স্মরণ রাখবেন যে, নির্দিষ্ট সময়ের কর্ম ব্যস্ততার পর প্রতিটি মানুষ শুধুমাত্র নিজের সম্পর্কে ভাবে, চিন্তা করে। স্মরণ রাখবেন যে, ইটালি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দেনা শোধ করল সে কথা ভাবার চাইতে কে ভালো পাঁচক সেই কথাটাই সাধারণ মানুষ ভাবে বেশি। দক্ষিণ আমেরিকার বিল্পবের চাইতে ধারহীন ব্লেডের প্রভাবই একজন সাধারণের ওপর বেশি। ভূমিকম্পে এশিয়ার পাঁচ লাখ লোক মরেছে একথা বললে, একজন মহিলা যত কষ্ট পাবে, নিজের দাঁতের ব্যথায় কষ্ট তার জন্যে তার চাইতে বেশি। ইতিহাসের দশজন খ্যাতনামা ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি যা বলবেন তা শোনার চাইতে নিজের সম্পর্কে আপনাকে কিছু শোনাতে সে অধিক আগ্রহী।
কীভাবে সদালাপী হওয়া যায় :
অধিকাংশ ব্যক্তি নিজেরা যে বিষয়ে আগ্রহী শুধু সে বিষয়ে বলে, তাই তারা সদালাপী হতে পারে না। এরূপ আলাপ শ্রোতাদের জন্যে হয় অনাকর্ষণীয় ক্লান্তিকর। শ্রোতার বিষয়, তার ব্যবসা তার গলফ খেলার পদ্ধতি তার সাফল্য অথবা কোনো মাতার সাথে আলোচনা কালে তার শিশুদের সম্পর্কে আলোচনা করুন, আলোচনা আকর্ষণীয় হবে। এই ধরণের আলোচনায় আপনি শ্রোতাকে আনন্দ দানে সক্ষম হবেন, ফলে আপনি একজন সদালাপী বলে পরিগণিত হবেন।
বক্তৃতা কোর্সের এক সমাপনী ভোজে ফিলাডেলফিয়ার মি. হ্যারল্ড ডুইট অত্যন্ত সাফল্যজনক একটি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন। তিনি কোর্স শুরু করার দিন থেকে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়, কার সাথে কীভাবে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে তা ব্যক্ত করেন। ব্যক্ত করেন প্রতিটি কথা রসাল করে, প্রাঞ্জল ভাষায়। তিনি বলেন কার সাথে কখন কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন, ফলে তাঁর বক্তৃতা হয় অত্যন্ত আকর্ষণীয়, সবাই এতে আনন্দ পায়, সন্তোষ লাভ করে। এই ধরনের বিষয় নিয়ে বক্তৃতা করলে কারো ব্যর্থ হবার কারণ ঘটে না! এটা অত্যন্ত আদর্শ নিয়ম। নিজের সম্পর্কে শোনার জন্যে প্রতিটি মানুষই আগ্রহী হয়। মি. ডুইট জানতেন, কীভাবে মানব চরিত্র মোচড়ানো যায়। তাই তিনি সেদিন উপস্থিত সকলের কথা বলে সাফল্য লাভ করেন।
যে-আদর্শ বিশ লাখ পাঠক আকর্ষণ করে :
কয়েক বছর আগে আমেরিকান ম্যাগাজিনের প্রচার সংখ্যা খুব বেড়েছিল। এতো বেড়েছিল যে, প্রকাশনা জগতে তা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এর গোপন রহস্য কী? এই রহস্য হচ্ছে প্রয়াত জন, এম, সিডাল এবং তাঁর আদর্শ। যখন আমার সাথে পরিচয় হয় তখন মি. সিডাল ছিলেন পত্রিকাটির”আকর্ষণীয় ব্যক্তি বিভাগের প্রধান। আমি তার জন্যে কতিপয় নিবন্ধ লিখি। একদিন তিনি আমার সাথে দীর্ঘ সময় আলোচনা করেন।
“জনগণ স্বার্থপর” তিনি বলেন, “তারা শুধুমাত্র তাদের সম্পর্কেই আগ্রহী। সরকার রেল রোডের মালিকানা নিবে কিনা সে সম্পর্কে তারা মোটেই আগ্রহী নয়, তারা আগ্রহী কীভাবে উচ্চ পদ পাওয়া যায়, বেশি টাকা রোজগার করা যায় এবং কীভাবে স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়। আমি যদি পত্রিকাটির সম্পাদক হতাম, তিনি বলেন, “আমি তাদের বলতাম কীভাবে দাঁতের যত্ন নিতে হয়। কীভাবে স্নান করতে হয়, কীভাবে গ্রীষ্মে ঠাণ্ডা থাকতে হয়, কীভাবে বাড়ি করা যায়, কীভাবে স্মরণ করা যায়, কীভাবে ব্যাকরণের ভুল পরিহার করা যায় এবং এরূপ অন্যান্য বিষয়। মানুষ সব সময় মানবিক কাহিনী শুনতে আগ্রহী। সুতরাং আমি ধনী হওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে ধনীব্যক্তি বর্ণিত কাহিনী প্রকাশ করতাম, খ্যাতনামা ব্যাংকারেরা কীভাবে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন সে সম্পর্কে আমি কাহিনী প্রকাশ করতাম।”
এর কিছুদিন পর সিডাল সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই সময় ম্যাগাজিনটির প্রচার সংখ্যা ছিল সীমিত। সম্পাদক হয়ে মি. সিডাল তার বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এর ফলে কী হয়? এর ফল অকল্পনীয়। প্রচার সংখ্যা দু’শ হাজার, তিনশ’ হাজার, পাঁচলাখ হয়ে যায় দ্রুত তালে। এতে জনগণ তাদের মনের খোরাক লাভ করে। এক মাসের মধ্যে ক্রেতার সংখ্যা হয় ১০ লাখ, পরে পনের লাখ এবং পরিশেষে বিশ লাখ। ওখানে এটি থেমে থাকে নি, বছরের পর বছর প্রচার সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে। সিডাল পাঠকের স্বার্থের কথা বলতে পেরেছিলেন বলেই এরূপ হয়েছিল।
যে বক্তব্য সব সময় দৃষ্টি আকর্ষণ করে :
আপনার বক্তব্য শুনে শ্রোতারা ক্লান্তি অনুভব করতে পারে, কিন্তু আপনি যদি শ্রোতাদের সম্পর্কে বলেন তা হলে তারা কখনো ক্লান্তি অনুভব করবে না বরং আকর্ষণ অনুভব করবে। চায়ের টেবিল বা ডিনার টেবিলে বসে ব্যক্তিত্বের কথা বলে কী রূপ হয়। যদি বলা হয় মি. এক্স এই করেছেন, মিস ওয়াই ওই করেছেন, মিসেস জেড এই করেছেন তাহলে কেহই ক্লান্ত বোধ করবে না।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বহু স্কুলে ছাত্র সমাবেশে আমি বক্তৃতা করেছি। অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করলে ছাত্ররা অমনোযোগী হয়ে পড়ে। কেহ কেহ নানাভাবে বিরক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু বক্তৃতা কালে আমি যখন গল্প বলি, গল্পচ্ছলে আমার বক্তব্য ব্যাখ্যা করি তখন সকলেই মনোযোগী হয়।
অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি যে বক্তৃতা কেহ শুনতে চায় না, শুনতে চায় গল্প, মানুষের গল্প, এইভাবে গল্পের ছলে বক্তৃতা করা গেলে তা হয় আকর্ষণীয়, অর্থবহ।
সুতরাং আমি ক্লাসে বক্তৃতা কালে বলতাম, আমরা কেউ বক্তৃতা শুনাতে চাই না। বক্তৃতায় আমাদের কোনো উপকার হয় না। আমরা সকলেই আনন্দ পেতে চাই সুতরাং আমাদের সবার আনন্দ পেতে হবে। স্মরণ রাখবেন যে, গল্প হচ্ছে বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ আনন্দ। সুতরাং যাক আমরা আমাদের পরিচিত দুজন লোকের গল্প বলি। আলোচনা করি কেন একজন সফল হল, আর জন হল ব্যর্থ। এর পরে শ্রোতারা আমরা কথা শুনতে বিশেষ আগ্রহী হল!
একবার বক্তৃতা কোর্সে একজন ছাত্র নিজের বিষয় এবং শ্রোতাদের জন্য বিষয় নির্বাচনে ভয়ঙ্কর অসুবিধা অনুভব করল। বিষয়টি তিনি তার দুজন সহপাঠীর সাথে আলোচনা করল। তাদের মধ্যে একজন ছিল ইঞ্জিনিয়ার? সে নিজের পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে এবং নিজের শিক্ষা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিল, নিজেকে সে নিজের বাস্তব অবস্থার চাইতে বড় বলে ভাবত, সুতরাং সে গোড়া থেকে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত ছিল না। সে কোনো কিছুতে সন্তুষ্ট হত না। পরে দেখা গেল যে, যে অবস্থায় তার উন্নতি লাভ করার প্রয়োজন ছিল সে অবস্থা বা পদমর্যাদাও সে পায় নি। অপর জন কিন্তু যে কোনো অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকত।
চিন্তা করে বক্তা পথ খুঁজে পান। তার এ দু’জন সহপাঠীকে কেন্দ্র করে এবং পরবর্তীকালে প্রথম ব্যক্তির চাইতে অনেক বেশি উন্নতিলাভ করেন। পরে তিনি লক্ষপতি হন।
বক্তা কী বললেন আমরা কি এখানে তার একটা রূপরেখা মাত্র দিচ্ছি। বক্তা তার নিজস্ব ভাষা এবং মানসিক কাহিনী দিয়ে তা আকর্ষণীয় করে তুলবেন। এভাবে চেষ্টা করলে যে ব্যক্তি তিন মিনিট বক্তৃতা করতে সক্ষম নন, তিনি একঘণ্টাও বক্তৃতা করতে পারেন যদি বিষয়টি তিনি নিজে বোঝেন। একঘণ্টা বক্তৃতা করার পরও, ভাষা যদি প্রাঞ্জল হয়, আকর্ষণীয় হয়, সুললিত হয়, শিক্ষনীয় হয়, শ্রোতারা মনে করবেন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল?
এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সবাই লাভবান হতে পারেন। মানবিক কাহিনী হলে সকল বক্তৃতাই হয় আকর্ষণীয়। এই ধরনের বক্তৃতা কখনো ব্যর্থ হয় না।
সংগ্রামে ব্যর্থতাও বিজয়ের কাহিনী সকলে পছন্দ করে। সুতরাং ব্যর্থতা ও বিজয়ের কাহিনী সম্পর্কে বক্তৃতা শ্রোতার মনে আকর্ষণ করতে পারে।
ব্যবসায়ের কোনো ব্যক্তি কীভাবে সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়েছে তা বললে শ্রোতার দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। একদা এক ম্যাগাজিন সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন, সকল ব্যক্তির জীবনের অজানা কাহিনী অত্যন্ত আনন্দদায়ক। সঠিকভাবে তা প্রকাশ করা গেলে তা শ্রোতার মন জয় করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাস্তব হোন : একবার এক বক্তৃতা শিক্ষা কোর্সের ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হন। তিনি তার প্রথম জীবন কাটিয়েছেন নৌবাহিনীতে। অতঃপর তিনি পড়াশোনা করে ডক্টরেট ডিগ্রী নিয়ে অধ্যাপক হন। অপর একজন ক্ষুদ্র দোকানি, রাস্তার পাশের চলন্ত গাড়িতে ছিল যার দোকন, তিনিও এই কোর্সে অংশ নেন। কোর্স চলাকালে দেখা যায় যে, দোকানি জ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও তার বক্তৃতায় ডক্টরেট চাইতে অনেক বেশি মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। ডক্টর অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় বক্তৃতা করেন। তাঁর বক্তৃতায় সংস্কৃতিবান মনের প্রতিফলন হয়, বক্তৃতায় যুক্তি থাকে। স্পষ্টতা থাকে। কিন্তু অশিক্ষিত দোকানির বক্তৃতার ভাষা সরল সুন্দর না হলেও তিনি যা বলেন তা উদাহরণ সহ বলেন, অর্থাৎ তার বক্তৃতা হয় বাস্তব। তাই দোকানির বক্তৃতা পণ্ডিতের বক্তৃতার চাইতে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়। তাই দোকানি সহজে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
আমি এই উদাহরণটা তুলে ধরছি এই জন্য যে, আকর্ষণীয় বক্তৃতা করার জন্য উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজন হয় না, তা বোঝানোর জন্য যে ব্যক্তির বক্তৃতার বাস্তব উদাহরণ থাকে তার বক্তৃতার ভাষা উন্নতমানের না হলেও আকর্ষণীয় হয়।
এই নীতি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিধায় আমরা এই ক্ষেত্রে কতিপয় ব্যাখ্যা উল্লেখ করছি। আমরা আশা করব আপনারা কখনো তা ভুলবেন না, বিস্মৃত হবেন না।
বালক কালে মার্টিন লুথার অত্যন্ত একগুয়ে ও অবাধ্য ছিলেন। তাঁর শিক্ষকেরা বারবার চেষ্টা করেও চাবুক দিয়ে তাঁকে সংশোধন করতে না পেরে নিজেরাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়তেন?
এখানে ব্যবহৃত ‘একগুয়ে ও অবাধ্য’ কারো দৃষ্টি তেমন আকর্ষণ করে না তবে বেত্রদণ্ড বা প্রহার শব্দ শুনলে সবাই একটু চঞ্চল হয়।
জীবনী লেখার পুরাতন পদ্ধতি এবং নতুন পদ্ধতি এক নয়। পুরাতন পদ্ধতির লেখক লেখেন, জন ডোর জন্ম হয় গরিব কিন্তু সৎ পরিবারে। নতুন পদ্ধতির লেখকের ভাষা হয়, জন ডোর পিতা পুত্রকে নরম জুতো কিনে দিতে পারেন না বিধায় শীতকালে পা গরম রাখার জন্যে তিনি ছালা দিয়ে জুতা মোড়ান, দারিদ্র্য সত্ত্বেও তিনি কিন্তু দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করেন না। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তার পিতামাতা ‘গরিব কিন্তু সৎ।‘ তা নয় কি? দ্বিতীয় পদ্ধতি কি প্রথম পদ্ধতির চাইতে বেশি আকর্ষণীয় নয়?
আধুনিক জীবনীকারদের এই পদ্ধতি আধুনিক বক্তারাও অনুসরণ করতে পারেন।
আরো ব্যাখ্যা দিচ্ছি। মনে করুন, আপনি বলতে চান যে নায়াগ্রায় প্রতিদিন যে সম্পদ নষ্ট হয় তা আতঙ্ক জনক। অতঃপর আপনি বলেন, এই সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে অনেক লোকের উপকার হত দেশের কল্যাণ হত, এই ধরনের বক্তব্য কি শ্রোতার আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং আকর্ষণীয় হয়? না, না ‘ডেইলী সায়েন্স নিউজ বুলেটিনে এডুইন এস, সোলোমেন যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তা কি অধিক আকর্ষণীয় নয়? সোলোমেন লিখেছেন :
আমাদিগকে বলা হয়েছে যে, এই দেশে লাখ-লাখ লোক দারিদ্র পীড়িত এবং অপুষ্টিতে ভুগছে, একই সময় প্রতিঘণ্টায় নায়াগ্রায় আড়াই লাখ করে রুটি নষ্ট হচ্ছে, মনশ্চক্ষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রতি ঘন্টায় উঁচু গিরিচূড়ায় ছয় লাখ ডিম পড়ছে এবং ঘূর্ণিস্রোত তা দিয়ে বিরাটকায় ওমলেট তৈরি করছে। এই ঘূর্ণিস্রোত যে কোনো সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম, সুতরাং জলপ্রপাতের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করা প্রয়োজন।
ছবি সৃষ্টিকারী শব্দ :
যে শব্দ বললে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছবি তা স্মরণ রাখা সহজতর। সাধারণ বক্তারা তা জানেন না, যে বক্তা শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রোতার চোখের সামনে ছবি সৃষ্টি করতে পারবেন সে বক্তার বক্তব্য সহজে মনে থাকবে।
ছবি, ছবি, ছবি। এমনভাবে কথা বলুন যাতে শ্রোতা আপনার কথাকে ছবির সাথে মেলাতে পারে। তাতে আপনার বক্তব্য হবে আকর্ষণীয়, সহজ এবং তা মনে রাখা যাবে অত্যন্ত সহজে।
এই ক্ষেত্রে নায়াগ্রা সম্পর্কে ডেইলি সায়ন্স নিউজ বুলেটিন থেকে উদাহরণ দিচ্ছি। নায়াগ্রার উঁচু গিরিচূড়ায় প্রতি ঘণ্টায় পতিত ৬ লাখ ডিম ঘূর্ণিস্রোতে বিশালাকার ওমলেট তৈরি করছে। এটা বললে সবার চোখের সামনেই একটা ছবি ভেসে ওঠে।
ফলে এর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। যেন –এটি একটি ঘূর্ণীয়মান ছবি।
‘স্টাইলের দর্শন’ শীর্ষক এক নিবন্ধে হারবার্ট স্পেনসার লিখেছেন :
“আমরা চিন্তা করি না,“ বলেছেন তিনি, “সাধারণ ভাবে, কিন্তু চিন্তা করি বিশেষ বা নির্দিষ্ট বিষয়ে।”
“যে জাতি যত বর্বর সে জাতির দণ্ডবিধি তত বেশি কঠোর।”
এটাকে আমরা এভাবে সাজাতে পারি, বর্বর জাতি অপরাধের সাজা দেন ফাঁসি দিয়ে, পুড়িয়ে মেরে।
বাইবেলে এবং শেক্সপিয়ারের লেখায় ছবি সৃষ্টিকারী শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। শেক্সপিয়ার তাই শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে অদৃশ্যকে দৃষ্টি গোচর করেছেন।
গিলটি করা স্বর্ণকে তিনি খাঁটি সোনা করেছেন। তিনি বলেছেন, চকচক করলেই সোনা হয় না।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সে সব প্রবাদ বাক্য চলে আসছে তার কি প্রভাব নেই জন মনে? যেমন, হাতের একটি পাখি বনের দুটির চেয়ে মূল্যবান, সময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু, অসারের তর্জন গর্জনই সার, আগে তো ঘর তবে তো পর, আত্মবৎ মান্যতে জগৎ, অথবা সে রামও নাই, সে অযোধ্যা নাই। এসবের অবশ্যই স্থায়ী প্রভাব আছে।
লিংকন সাধারণত এসব প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করতেন। কোনো নথি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে হোয়াইট হাউসে তার টেবিল এলে তিনি তাতে এসব প্রবাদ বাক্য প্রয়োগ করে নোট দিতেন, তাঁর ভাষা এরূপ জীবন্ত হত, ভাষা পাঠে চোখের সামনে ছবি ভেসে উঠত, তাই তা সব সময় স্মরণ থাকত। ”আমি যখন কোনো লোককে ঘোড়া কিনতে পাঠাই,“ তিনি বলেন, “আমি তখন জানতে চাই না ঘোড়াটির লেজে কয়টি চুল আছে। আমি একটি আস্ত ঘোড়াই চাই।”
বৈশাদৃশ্যের প্রতি আকর্ষণ :
মেকলে চার্লস -১এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। বৈসাদৃশ্য পূর্ণ দৃশ্য ছবি, বা শব্দ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই মেকলে তা ব্যবহার করেছেন।
মেকলে বলেন, আমরা তার বিরুদ্ধে সিংহাসনে আরোহণ কালে যে শপথ গ্রহণ করেছেন তা ভঙ্গ করার অভিযোগ আনলে আমাদের জানানো হয় যে, তিনি তাঁর বিবাহের শপথ রক্ষা করেছেন। জনগণের প্রতি অবজ্ঞা ও নিষ্ঠুরতার অভিযোগ আনলে আমাদের বলা হয় যে, তিনি তার শিশু সন্তানকে হাঁটুর ওপর রেখে চুমু দিচ্ছেন। জনগণের অধিকার লংঘনের অভিযোগ আনলে জানানো হয় যে, সকাল ৬টায় তিনি এসব অভিযোগ শ্রবণ করেন। তবে তাঁর সুন্দর চেহারা ও সুন্দর দাড়ির জন্যে অতঃপর আমরা ক্রুদ্ধ হতে পারি না।
সংক্রামকের প্রতি আকর্ষণ :
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এমন সব দ্রব্যের কথা আলোচনা করেছি যার প্রতি শ্রোতাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। যে কেহ এসব উপদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে পারেন, তা হলেও কিন্তু সব সময় সফল হবেন না। মানুষের মন আকর্ষণ অত্যন্ত সূক্ষ ব্যাপার। এটা অনুভূতি নির্ভর। এটা যান্ত্রিক ইঞ্জিন চালনা নয়। এটার জন্যে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বলা যায় না। আগ্রহ সৃষ্টি হলে তা স্মরণীয় হয়।
একদা বাল্টিমোরে আয়োজিত বক্তৃতা শেখার একটি ক্লাসে জনৈক ছাত্র একদিন হঠাৎ দাঁড়িয়ে চেপাসেক উপসাগরে রক মাছ ধরা বন্ধ করার দাবি জানান। তিনি বলেন যে, বর্তমান পদ্ধতিতে এই মাছ। ধরা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মাছটি বিশ্বের বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই উপসাগরের মাছ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না, আমি এটা জানতে আগ্রহীও ছিলাম না, কিন্তু আমার ছাত্রের বক্তব্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমি এবং অন্যান্য সকল শ্রোতা এই মাছটির বংশ রক্ষার জন্যে আগ্রহী হয়ে পড়ি এবং আমরা সম্মিলিত স্বাক্ষরে এটা রক্ষা করার দাবি পেশ করি কর্তৃপক্ষের। কাছে।
ইতালিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. রিচার্ড ওয়াশবর্ন চাইল্ডকে আমি একদা সাহিত্য ক্ষেত্রে তার সাফল্যের কারণ জিজ্ঞেস করি। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, জীবন সম্পর্কে আমি এত বেশি উত্তেজিত যে আমি তা অন্যের কাছে প্রকাশ না করে পারি না। সুতরাং আমি জনগণের কাছে তা প্রকাশ করি। একজন বক্তাও সেরূপ হলে সাফল্য নিশ্চিত।
একদা এক বক্তৃতা শুনে খ্যাতনামা বৃটিশ ঔপন্যাসিক মি. ই এফ বেনসন বলেছিলেন, বক্তৃতার শেষ অংশ তাঁর কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় হয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বক্তা নিজেও শেষ অংশ সম্পর্কে বেশি আগ্রহী।
এটা সকলের স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
সংক্ষিপ্ত সার :
১। সাধারণ বিষয়ের বিশেষ তথ্য সম্পর্কে আমরা আগ্রহী।
২। আমাদের প্রধান আগ্রহ আমাদের নিজেদের সম্পর্কে।
৩। যে ব্যক্তি অন্যদের সম্পর্কে কথা বলে তাদেরকে আগ্রহী করে তুলতে পারেন তিনিই ভালো কথক।
৪। মানবিক কাহিনী সব সময় আকর্ষণীয় হয়। বক্তা সীমিত পয়েন্ট আলোচনা করবেন, তবে তাতে মানবিক কাহিনী যোগ করলে আকর্ষণীয় হবে।
৫। যা বলবেন সুস্পষ্ট ভাবে বলবেন, নির্দিষ্ট করে বলবেন। দরিদ্র কিন্তু সৎ না বলে ইতঃপূর্বে উল্লেখিত মার্টিন লুথারের কাহিনী স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করুন।
৬। এমন শব্দ প্রয়োগ করুন যা শ্রোতার মনে ছবির সৃষ্টি করে।
৭। বৈসাদৃশ্যমূলক ধারণা তুলে ধরে কোন বিষয় প্রকাশের চেষ্টা করুন।
৮। বক্তা যার প্রতি আগ্রহী শ্রোতাও তার প্রতি আগ্রহী হবে। তবে এর জন্যে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম কানুন নেই।
১২. উন্নত শব্দ নির্বাচন
একবার একজন ইংরেজ ফিলাডেলফিয়ায় চাকুরির সন্ধান করছিলেন। আর্থিক সংকটে পড়ে তিনি চাকুরির সন্ধানে একদিন ওই শহরের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী মি. পল গিবসনের অফিসে গিয়ে উপস্থিত হন এবং তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করেন। মি. গিবসন দূর থেকে আগন্তুককে লক্ষ্য করেন? আগন্তুকের চেহারা ছিল আকর্ষণীয়। পোশাক পরিচ্ছেদ ছিল নিতান্ত অপরিচ্ছন্ন এবং সর্বোপরি তার চলায় ফুটে ওঠেছিল চরম দারিদ্র। কিছুটা উৎসুক্য এবং কিছুটা দয়া পরবশ হয়ে মি. গিবসন আগন্তুককে সাক্ষাৎ দান করতে সম্মত হন। প্রথমে তিনি এক মুহূর্তকাল তার কথা শুনতে চান, অতঃপর মুহূর্ত হয় মিনিট এবং মিনিট হয় ঘণ্টা, তবু আলোচনা অব্যাহত থাকে, অতঃপর মি. রোল্যান্ড টেলরকে টেলিফোন করেন। ফিলাডেলফিয়ার নেতৃস্থানীয় ধনী ব্যক্তি মি. টেলর এই আগন্তুককে মধ্যাহ্ন ভোজে আমন্ত্রণ জানান এবং তার জন্যে একটি মর্যাদাপূর্ণ চাকুরির ব্যবস্থা করেন। অনাকর্ষণীয় চেহারা ও অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে কীভাবে এই আগন্তুক অল্প সময়ের মধ্যে সমাজের উঁচুস্তরের ব্যক্তিদের মন জয় করেন?
তাঁর এই সাফল্যের গুরুত্ব হচ্ছে ইংরেজি ভাষার উপর দখল। আগন্তুক ছিলেন অক্সফোর্ডের লোক, এই শহরে এসেছিলেন এক ব্যবসা মিশনে। মিশন ব্যর্থ হলে অর্থহীন ও বন্ধুহীন অবস্থায় তিনি ফিলাডেলফিয়ায় আটকা পড়েন। কিন্তু তিনি এত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতেন যে শ্রোতা মুহূর্তে তার ছেঁড়া জুতো, ময়লা কোটও খোঁচাখোঁচা দাড়িপূর্ণ চেহারার কথা বিস্মৃত হয়ে যেতেন। তাঁর বাচন ভঙ্গি ও শব্দ নির্বাচন অর্থাৎ সুবচন তাকে ব্যবসায়ী মহলে পরিচিত করে দেয়, এটা ব্যবসা মহলে প্রবেশের ছাড়পত্র হয়ে যায়।
এই লোকটির কাহিনী একটি অসাধারণ ঘটনা, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে, আমরা প্রতিদিনই আমাদের বক্তব্য দ্বারা পরিচিতি লাভ করছি। আমাদের শব্দ প্রয়োগ ও ভাষা শুনে শ্রোতারা আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জ্ঞানের কথা উপলব্ধি করতে পারছেন।
চারটি জিনিস দিয়ে আমাদের বিচার করা হয়। আমরা কী করি, কীভাবে তাকাই, কী বলি এবং কীভাবে বলি তা দিয়েই হয় আমাদের বিচার। বহুলোক আছেন, যারা স্কুল ছাড়ার পর আর কোনো নতুন শব্দ শেখেন না, যা শিখেছেন তা দিয়েই কাজ চালিয়ে যান! অপ্রচলিত শব্দই তিনি সাধারণত ব্যবহার করেন। এবং বার-বার ব্যবহার করেন? আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি অনেক সময় ব্যাকরণের নিয়ম কানুন ও লংঘন করেন, এমন ভাষা ব্যবহার করেন যা সাধারণের বোধগম্য হয় না, আকর্ষণীয় হয় না। আমি অনেক স্নাতককে ভুল শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি। এই ধরনের শিক্ষিত লোক যদি ভাষা প্রয়োগে ভুল করেন তবে যে সব ব্যক্তি অর্থনৈতিক চাপে পড়ে শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন তারা কী করবেন?
কয়েক বছর আগে একজন ইংরেজের সাথে হঠাৎ আমার পরিচয় হয়। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যেই আমি দেখতে পাই যে তিনি ভুল ইংরেজি বলছেন, সকালে তিনি পালিশ করা জুতা পায়ে দেন, ইস্ত্রি করা কাপড় পড়েন। নিজেকে এমন নিখুঁতভাবে সাজান যাতে অন্যের দৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তিনি যেন সম্মান পেতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁর ভাষাকে নিখুঁত করার চেষ্টা করে না। কথা বলার সময় কোনো মহিলা টুপি হাতে না নিলে তিনি তাকে লজ্জা দেন, কিন্তু ভুল ভাষা প্রয়োগের জন্যে নিজে লজ্জানুভব করেন না, তাঁর ভাষা প্রয়োগ দেখে শ্রোতারা এটা বুঝতে পারে যে, পোশাকে দুরস্ত হলেও তিনি সংস্কৃতিবান লোক নন।
এক শতাব্দীর তিনভাগের এক ভাগ সময় হারবার্ড -এর সভাপতি থাকার পর ড. চার্লস ডব্লিউ, ইলিয়ট একবার বলেছিলেন, অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটা বুঝেছি যে, মাতৃভাষা যথাযথ ভাবে শেখাই হচ্ছে যে কোনো ভদ্রলোক বা মহিলার জন্যে প্রকৃত শিক্ষা। এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু কীভাবে আমরা শব্দকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করে সুন্দর ও যথাযথ বাক্য প্রকাশ করব, এতে অবশ্য কোনো গোপন তথ্য নেই। পদ্ধতিটা ওপেন সিক্রেট। লিংকন সাফল্যের সাথে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অন্য কোনো আমেরিকানই এত সুন্দর ভাবে ভাষা প্রয়োগ করতে পারেন নি। কারো প্রতি শত্রুতা নয় সকলে প্রতি বদান্যতা। লিংকন, যাঁর পিতা ছিলেন একজন অশিক্ষিত সুতার এবং মাতা ছিলেন একজন অপরিজ্ঞাত মহিলা, প্রকৃতির অফুরন্ত দানে কি তিনি এরূপ শব্দ ভাণ্ডারের অধিকারী হয়েছিলেন? এই ধারণার পক্ষে সমর্থক কোনো প্রমাণ নেই। কংগ্রেসে নির্বাচিত হবার পর তিনি নিজের শিক্ষা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “ত্রুটিপূর্ণ” এই বিশেষণ লিখে। এই রেকর্ড আছে ওয়াশিংটনে। সমগ্র জীবনে তিনি বার মাসেরও কম সময় স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। তবে তাঁর জীবন গঠন করেন কে। কেন্টারকীর জাসারিয়া বার্বি ও কালের হ্যাঁজেল ইন্ডিয়ানার আজেল ডোরসে, আন্ড ক্রফোর্ড এবং পিজিয়ন ক্রিক এর অসম্ভব প্রভাব তাঁর ওপর। তবে তিনি সবচাইতে বড় শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতি থেকে পরিবেশ থেকে।
ইলিওনয়েসের কৃষক ও ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও মক্কেলদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তিনি প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। লিংকন কখনো তার চাইতে কম বিদ্যার লোকদের সাথে সময় কাটাতেন না। বিদ্বান, শিক্ষিত ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথেই তিনি চলাফেরা করতেন। বার্নস বাইরন ও ব্রাউনের সমগ্র রচনা তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। বার্নস এর উপর তিনি একটি বক্তৃতা লিখেছিলেন, বাইরনের কবিতার একটি কপি তাঁর অফিসে এবং অপর একটি কপি তার বাড়িতে সব সময় মজুদ ছিল। এটা এত বেশি ব্যবহার করতেন যে, অফিসের কপিটি সব সময় খোলাই থাকত। হোয়াইট হাউসে থাকা কালে এবং গৃহযুদ্ধের তীব্র সংকট কালেও তিনি বিশ্রামকালে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে হুডস এর কবিতা পড়তেন। কখনো কখনো রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে গেলে তিনি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়তেন। কখনো-কখনো তিনি নৈশ পোশাক নিয়ে চটি পায়ে ওঠে পড়তেন, পায়চারী করতেন এবং সেক্রেটারি ঘুম থেকে উঠলে তাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। হোয়াইট হাউসে বসে তিনি শেক্সপিয়ার মুখস্থ করতেন, নায়কদের চরিত্র সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতামত লিখতেন। আমি শেক্সপিয়ারের কতিপয় নাটক পড়েছি, নায়ক হ্যাঁক্টেকে তিনি লিখেছিলেন, তবে আমার পেশা পাঠ নয়। আমি লীয়ার, রিচার্ড -৩, হেনরী –৮, হ্যাঁমলেট পড়েছি। আমার মনে হয় ম্যাকবেথের সাথে কোনোটি তুলনীয় নয়। এটা আশ্চর্য সৃষ্টি।
লিংকন সব সময় রচনাকর্মে লিপ্ত থাকতেন, কবিতা লিখতেন। তিনি শুধুমাত্র কোনো বিষয় মুখস্থ করতেন না, নিজে-নিজে ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রকাশ্যে আবৃত্তি করতেন, লিখতেন। বোনের বিয়ের সময় তিনি স্বরচিত একটি দীর্ঘ কবিতা পড়েছিলেন। মধ্যরাতে তিনি কবিতা লিখে দীর্ঘ একটি নোট বই পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু নিজের লেখা সম্পর্কে তিনি এতবেশি লাজুক ছিলেন যে নিকটতম বন্ধুকেও তা পড়তে দিতেন না। ”পণ্ডিত ব্যক্তি লিংকন” বইতে রবিনসন লিখেছেন, “এই স্বশিক্ষিত লোকটির মন ছিল অত্যন্ত সংস্কৃতিবান, এটাকে প্রতিভা অথবা মেধা যা-ই বলুন না কেন,” অধ্যাপক এবারটন তার সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি স্কুলে যান নি, অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষালাভ করেছেন। নিজস্ব উদ্যোগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শিক্ষালাভের এরূপ উদাহরণ নিতান্ত বিরল।”
নিজের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফলে, কোনোরূপ শিক্ষকের সাহায্য ও সহায়তা ছাড়া তিনি শুধুমাত্র শিক্ষিত হন নি, একজন খ্যাতনামা বক্তাও হয়েছিলেন, কঠোর পরিশ্রম তাকে এই সুযোগ এনে দিয়েছিল। তাঁর বক্তৃতায় শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে গেটিসবার্গের ভাষণ, একটি জীবন্ত কোনো ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। যুদ্ধেলিপ্ত একশত ৭০ হাজার লোকের মধ্যে সাত হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। চার্লেস সামার লিংকনের মৃত্যুর অব্যবহিত পর বলেছেন, যুদ্ধের স্মৃতি মানুষ ভুলে গেলেও লিংকনের বক্তৃতা ভুলবে না। এবং এই বক্তৃতার জন্য মানুষ একদিন স্মরণ করবে এই যুদ্ধের কথা। এই ভবিষ্যৎ বাণীর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কেহ কোনোরূপ সন্দেহ করতে পারেন?
এডওয়ার্ড এভারেট গেটিসবার্গে দু’ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করেছিলেন, তার বক্তৃতা মানুষ বহুদিন আগে ভুলে গেছে। লিংকন বক্তৃতা করেছেন দু’মিনিটেরও কম সময়। একজন ফটোগ্রাফার বক্তৃতাকালে লিংকনের ফটো তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তার ক্যামেরা ঠিক করার আগেই লিংকন তার বক্তৃতা শেষ করে ফেলেন।
কিন্তু লিংকনের বক্তৃতার ভাষা অত্যন্ত উন্নত ছিল বিধায় ইংরাজি ভাষার আদর্শ হিসাবে তার অনুলিপি অক্সফোর্ডের একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। বক্তৃতা কোর্সের সকল ছাত্রই এই বক্তৃতাটি মুখস্থ করেন।
আজ থেকে ৮৭ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই মহাদেশে এমন একটি স্বাধীন জাতির জন্ম দেন যে জাতি বিশ্বাস করতেন যে জন্মসূত্রে প্রত্যেকটি মানুষ স্বাধীন ও সমান। আমরা এক ব্যাপক গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। এই গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এই জাতি বা অন্য কোনো জাতি দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে কিনা, আমরা, এই বিরাট যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের এক কবরগাহে আজ সমবেত হয়েছি, জাতির ভবিষ্যতের জন্য যারা আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের কবর এখানে। আমাদের কর্তব্য হিসাবে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি আত্মাহুতিদানকারীদের স্মরণ করে এই কবরগাহকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারছি না। জীবিত ও মৃত সাহসী যোদ্ধারা যারা এখানে যুদ্ধ করছেন তারাই এটিকে পবিত্র স্থান পরিণত করছেন, আমাদের ক্ষুদ্র শক্তি তাতে নতুন কিছুই যোগ করতে পারে না। আমরা আজ এখানে কী বলছি তা দীর্ঘদিন কারো স্মরণ থাকবে না। কিন্তু বীরেরা এখানে কী করেছিল তা কেহ কোনোদিন ভুলবে না। সুতরাং এক্ষণে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আত্মাহুতিদানকারী বীর যোদ্ধাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য আত্মনিয়োগ করা আমাদের কর্তব্য যাতে তাদের আত্মদান বৃথা যেতে না পারে। কারণ এই জাতি স্বাধীনতার নব অর্থদান করেছে। তাদের দ্বারা গঠিত সরকার হচ্ছে জনগণের সরকার, যা জনগণের দ্বারা জনগণের জন্যে গঠিত। আমাদের চেষ্টা করতে হবে এর অর্থ যেন বিকৃত না হয়।
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এই বক্তৃতার সমাপ্তিতে লিংকন যে ফ্রেজ প্রয়োগ করেছেন তা তার নিজেরই সৃষ্টি। কিন্তু এটা কি সত্যি? তাঁর আইন অংশীদার হেরনডন বেশ কয়েক বছর আগে লিংকনকে থিওডর পারকারের বক্তৃতা মালার একটি অনুলিপি দিয়েছিলেন। লিংকন এটি পাঠ করেন এবং এই বই এর, “গণতন্ত্র হচ্ছে সকল জনগণের স্বশাসিত সরকার বা সকল জনগণ কর্তৃক সকল জনগণের জন্যে গঠিত” এই অংশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। থিওডর পারকার সম্ভবত এটি ওয়েবেস্টার থেকে ধার করেছিলেন, কেননা, ওয়েবেস্টার আরো চার বছর আগে হেইনের কাছে প্রদত্ত তাঁর বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন, “জনগণের সরকার হচ্ছে তা যা জনগণের জন্যে গঠিত, জনগণের দ্বারা গঠিত এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করার যোগ্য।” ওয়েবেষ্টার এটি সংগ্রহ করেছিলেন সম্ভবত প্রেসিডেন্ট জেমস মনরের কাছ থেকে। কেননা মনরো এক তৃতীয়াংশ শতাব্দী আগে সরকার সম্পর্কে ঠিক এরূপ মনোভাবই প্রকাশ করেছিলেন এবং কার কাছে জেমস মনরো ঋণী? মনরোর জন্মের পাঁচ সাত বছর আগে ওয়াইক্লিফ তার ধর্মশাস্ত্র বই এর ভূমিকায় লিখেছেন, “এই বাইবেল হচ্ছে জনগণের সরকার জনগণের দ্বারা গঠিত ও জনগণের জন্য।” এবং ওয়াই ক্লিফের জন্মের ও বহু বছর আগে, খ্রিস্টের জন্মের ৪০০ বছরেরও আগে এথেন্স এর জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে ক্লিওন”জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে এক শাসকের কথা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কোন প্রাচীন সূত্র থেকে ক্লিওন এই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তা বিস্তৃতির অতল তলে তলিয়ে আছে।
তা হলে এটা কীভাবে নতুন হতে পারে। সুবক্তাগণ খ্যাতনামা বক্তা এবং তাদের রচনা পাঠের জন্যে কতটুকু ঋণী।
বই! এটিই হচ্ছে গোপন তথ্য। যে ব্যক্তি শব্দ ভাণ্ডার বাড়াতে পারেন সে ব্যক্তিই সাহিত্য ও সাহিত্য জগতে উত্তরণে সক্ষম হন।”কোনো গ্রন্থাগারে উপস্থিত হলে সব সময় আমার যে কথাটা মনে পড়ে, বুলেছেন জব্রাইট, “তা হচ্ছে জীবন এত সংক্ষিপ্ত যে আমার সামনে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ আমার নেই।’ ব্রাইট পনের বছর বয়সে স্কুল ত্যাগ করে কাপড় কলে চাকুরি নেন, এবং এর পর তিনি আর কখনো স্কুলে ফেরার সুযোগ পান নি। এতৎসত্ত্বেও তিনি তার সময়ের একজন খ্যাতনামা বক্তা হতে পেরেছিলেন, তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন, “ইংরেজি ভাষার উপর ব্যাপক দখলের জন্যে। তিনি পড়তেন, লিখতেন, নোট বুকে কপি করতেন এবং বাইরন, মিলটন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হুইটার, শেক্সপিয়ার ও শেলীর দীর্ঘ কবিতা পড়তেন এবং মুখস্থ করতেন। শব্দ ভাণ্ডার বৃদ্ধির জন্যে তিনি বার-বার, প্রতি বছর প্যারাডাইস পড়তেন।
নিজের স্টাইল উন্নত করার জন্যে চার্লস জেম ফক্স উচ্চস্বরে শেক্সপীয়র পাঠ করতেন। গ্লাডস্টোন তাঁর পড়ার ঘরকে ”শান্তির মন্দির” বলতেন এবং এতে তিনি ১৫,০০০ বই সংগ্রহ করেছিলেন। সেইন্ট অগাস্টাইন, বিশপ বাটলার, দান্তে, অ্যারিস্টোটল ও হোমারের লেখা তাঁকে বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত করত বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। ইলিয়ড ওডেসী তাকে যেন দাসত্বে আবদ্ধ করেছিল। হোমারের কবিতা ও হোমারের সময় সম্পর্কে তিনি ছয়টি বই লিখেছিলেন।
পিটের অভ্যাস ছিল গ্রিক বা ল্যাটিন ভাষা বইয়ের এক বা দুটি পৃষ্ঠা পড়া এবং নিজস্ব ভাষায় তা অনুবাদ করা। দশ বছর ধরে দৈনিক তিনি এ কাজ এবং ”অতুলনীয় পদ্ধতিতে নিজস্ব চিন্তা ধারাকে সাবলীল ভাষা ও স্বচ্ছন্দ শব্দে প্রকাশ করার অদ্ভুত শক্তিলাভ করেন।”
ডেমোস্থেনিস থুসিডিভেস এর ইতিহাস আট বার নিজের হাতে নকল করেছিলেন। এই খ্যাতনামা ঐতিহাসিকের ব্যবহৃত পদ্ধতি শেখার জন্যে তিনি তা করেছিলেন। এর ফল কী হয়েছিল? দু’হাজার বছর পরে নিজস্ব স্টাইল উন্নয়নের জন্যে উড্রো উইলসন ডেমোস থেনিসের লেখা পাঠ করেছিলেন। মি. আসকুইথ বিশপ বারকেলের লেখা পাঠে সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন।
টেনিস প্রতিদিনই বাইবেল পাঠ করতেন। টলস্টয় মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত খ্রিস্টের জীবনী বার-বার পড়তেন। রাস্কিনের মতো প্রতিদিনই তার সন্তানকে বাইবেলের দীর্ঘ প্যাসেজ মুখস্থ করতে এবং প্রতি বছর পূর্ণ বাইবেল শব্দ করে পাঠ করতে “প্রতিটি সিলেবল, রহস্যোৎঘাটন পূর্ব পর্যন্ত তাকে পাঠ করতে হত।” এই ভাবে শৃঙ্খলা অনুসরণের ফলে রাস্কিন তার সাহিত্যে উন্নত মানের স্টাইল প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন।
রবার্ট লুই স্টিভেনসন ইংরেজি সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা লেখক ছিলেন, তিনি ছিলেন লেখদের লেখক, যে স্টাইল তাঁকে খ্যাতি দিয়েছিল তা তিনি কীভাবে অর্জন করেছিলেন? সে কাহিনী তিনি নিজেই আমাদের বলেছেন। যখন আমি কোনো বই বা রচনা পাঠ করি এবং যা পড়তে আমি আনন্দ লাভ করি, যা আমরা মনেক আকর্ষণ করে, যাতে আমি নতুন আইন দেখতে পাই, আমি তা অনুকরণে সেরূপ গুণ অর্জনের জন্যে তা অনুসরণ করি। আমি ব্যর্থ হই, আবারো চেষ্টা করি, ব্যর্থ হই, আবারো চেষ্টা করি, বার-বার চেষ্টা ও ব্যর্থতার ফলে আমি স্টাইল পুরোপুরি অনুসরণ করতে না পারলেও নতুন শব্দ বুঝতে পারি, শিখতে পারি, প্রয়োগ বা ব্যবহার করতে সক্ষম হই।
তাই আমি হেজলিট, ল্যাম্ব, ওয়ার্ডওয়ার্থ, স্যার টমাস ব্রাউন, ডেফো, হাওর্টনও মন্টেইগনির ব্যবহৃত বহু শব্দ, বহু বাক্য, বহু ছন্দ সাফল্যের সাথে ব্যবহার করতে পারি, ব্যবহার করি।
এবং এটা হচ্ছে লেখা শেখার পদ্ধতি। এর দ্বারা লাভবান হোন বা না হোন, এই পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। কীটস এই পদ্ধতিই অনুসরণ করে ছিলেন এবং তার সৃষ্ট সাহিত্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পদ।
এই পদ্ধতি অনুসরণ কষ্টকর। এতে ব্যর্থতা আসতে পারে? তবে এটা সত্য যে ব্যর্থতাই সাফল্যের চাবিকাঠি।
আইনজীবী হতে আকাঙ্ক্ষী একজন তরুণকে লিংকন লিখেছিলেন : ‘বই সংগ্রহ কর, তা পাঠ কর এবং যত্ন সহকারে তা অধ্যয়ন কর। কাজ, কাজ এবং কাজই হচ্ছে প্রধান বিষয়।”
কী বই? আর্নল্ড ব্যানেট-এর ‘দিনের চব্বিশ ঘণ্টা কীভাবে কাটাবেন’ বই দিয়ে শুরু করুন। এই বই পড়ে আপনি প্রয়োজনীয় সকল বিষয় জানতে পারবেন। এটা পড়ে জানতে পারবেন, প্রতিদিন কতটুকু সময় আপনি নষ্ট করেছেন, কীভাবে অপচয় বন্ধ করা যায় এবং কীভাবে সময়ের ব্যবহার সম্ভব।
সমগ্র বইটি ১০৩ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট। একসপ্তাহে সহজে আপনি এটা শেষ করতে পারবেন। প্রতিদিন সকালে ২০ পৃষ্ঠা কেটে নিয়ে পেছনের পকেটে রাখুন। প্রতিদিন সকালে আপনি যে ২০ বা ৩০ মিনিট কাল সংবাদ পত্র পাঠ করেন তা হতে কিছু সময় কেটে দিয়ে বইটি পাঠ করুন, সহজে পাঠ পর্ব শেষ হবে।
“টেসিটাস ও থুসি ডিভেস এবং নিউটন ও ইউক্লিড পাঠের জন্যে আমি সংবাদ পত্র পাঠ ছেড়ে দিয়েছিলাম।” লিখেছেন থমাস জেফারসন, “এবং আমি অত্যন্ত আনন্দ লাভ করি?” আপনি কী বিশ্বাস করেন যে, সংবাদপত্র পাঠের সময় কমিয়ে উন্নত মানের বই পড়ে আপনি এক মাসের মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেন? আপনি এভাবে একমাস চেষ্টা চালান, বাসের জন্যে অপেক্ষা কালে, খাবার টেবিলে বসে খাবার আসার জন্যে অপেক্ষা কালে আপনি পড়েন না কেন?
এভাবে ২০ পৃষ্ঠা শেষ করার পর আরো ২০ পৃষ্ঠা এইভাবে কেটে নিন। এভাবে সমস্ত বই শেষ করার পর খোলা পৃষ্ঠাগুলোকে আবার বাঁধাই করে নিন। অতঃপর মনে মনে বইয়ের সমগ্র বিষয়টি আলোচনা করুন এবং বইটি বুক শেলফ-এ রেখে দিন।
‘দিনের ২৪ ঘন্টা কীভাবে কাটানো যায়’ পাঠ করার পর আপনি একই লেখকের মানব যন্ত্র বই সম্পর্কে আগ্রহী হতে পারেন। এটা পাঠ করাও প্রয়োজন। এই বইতে কী বলা হয়েছে তা দেখার জন্যে এটি পড়তে বলা হচ্ছে না। বরঞ্চ কীভাবে বলা হয়েছে তা দেখার জন্যই এটি পাঠের সুপারশি করা হচ্ছে। এটা পাঠে আপনার ভাষা জ্ঞান নিশ্চিত ভাবেই উন্নত হবে।
আরো কতিপয় প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকা দেয়া হচ্ছে : ফ্রাঙ্ক মরিসের লেখা ”দি অকটোপাস” ‘ও ”দি পিট।” এ দুটি হচ্ছে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। প্রথমটিতে কালিফোর্নিয়ার গম ক্ষেতে মানব জীবনের যে বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছিল তা বিবৃত হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে শিকাগো বাণিজ্য বোর্ডের সগ্রামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। টমাস হার্ডির লেখা ‘টেল অব দ্য ডি উরবার ভিলস’ হচ্ছে একটি শ্রেষ্ঠ গল্প। নেওয়েল ডুইট হিলির, সমাজে মানুষের মূল্য এবং প্রফেসর উইলিয়াম জেমস এর ‘শিক্ষকদের প্রতি আচরণ’ বই দুটি পাঠের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। আপনার পাঠ্য তালিকায় আন্দ্রে মরিসের লেখা শেলীর জীবনী, বায়রনের শিশুদের তীর্থ যাত্রা এবং রবার্ট লুই স্টিফেনসনের ‘বানর নিয়ে ভ্রমণ’ রাখতে পারেন।
রালফ ওয়ারডো এমারসনকে আপনার নিত্যসঙ্গী করুন। তাঁর ‘আত্মপ্রত্যয়’ লেখাটি পাঠ করুন। এটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। এটিতে লেখা হয়েছে :
যা কিছু শিখবেন তা পরিষ্কার ভাবে, স্বচ্ছভাবে-শিখুন। মুসা, প্লেটো ও মিল্টনের জ্ঞান সম্পর্কে সবাই ওয়াকেবহাল, তাঁদের জ্ঞান সম্পর্কে মানুষ কি বলেন তা বড় কথা নয়, মূল কথা হচ্ছে মানুষ কী চিন্তা করেন। যে আলো মানুষের অন্তরকে স্বচ্ছ করে, হৃদয় উজ্জ্বল করে, সেই আলো সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ প্রয়োজন, আমরা যে চিন্তা পরিহার করি সে চিন্তা বার-বার আমাদের মনে ফিরে ফিরে-আসে। এটা আমাদের এই শিক্ষাদান করে যে, কোনো কিছুই ফেলনা নয়, সব কিছুরই একটা প্রভাব মানব জীবন আছে। কোনো সময় কোনো আগন্তুকের অর্থহীন কোনো বাক্যও আমাদের মনকে প্রভাবিত করতে পারে, এবং তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে।
মানুষের শিক্ষা জীবনে এমন এক সময় অসে যখন সে এটা বুঝতে পারে যে অজ্ঞানতা শত্রুতার জন্ম দেয়, অনুকরণ আত্মহত্যার সামিল এবং ভালো মন্দ সকল অবস্থার মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে। প্রকৃষ্ট পন্থা। পাঠকের মনে যে ধারণা আছে তা সে নিজে ছাড়া আর কেহ উপলব্ধি করতে পারে না?
স্যার হেনরী ইরভিং একশতটি শ্রেষ্ঠ বই এর নাম লিখতে বললে তিনি উত্তর দেন, ‘একশত বই এর আগে বাইবেল ও শেক্সপীয়র পাঠ করুন।‘ স্যার হেনরীর উত্তর অত্যন্ত সঠিক। ইংরেজি সাহিত্যের এ দুটি প্রশ্নবাণ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
এভাবে এগুলে কি পুরষ্কার পাবেন? আস্তে-আস্তে আপনার ভাষাজ্ঞান, শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে? কী পড়ছেন তা আমাকে বলুন, বলেছেন গ্যেটে, এবং আমি বলব আপনি কী।
আমি যে পাঠ্য সূচি দিলাম তা দীর্ঘ হলেও তা অনুসরণে আপনার সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার হবে। আপনি ইচ্ছা করলে ইমারসনের লেখা ও শেক্সপিয়রের নাটকের পকেট কপি কিনতে পারেন।
মার্ক টোয়েন পদ্ধতির গূঢ়তত্ত্ব :
কীভাবে মার্ক টোয়েন তাঁর শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন? তরুণ বয়সে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে মিশৌরী থেকে নেভার্দা পর্যন্ত সমস্ত জায়গা ভ্রমণ করেছিলেন। এই গাড়িতে যাত্রী এবং ঘোড়া উভয়েরই খাবার এবং এমনকি পানীয়জলও পরিবহন করতে হত। কাজেই যাত্রীর সাথে লটবহর নেয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। এতৎসত্ত্বেও মার্কটোয়েন তার সাথে ওয়েবেস্টারের অভিধান রাখতেন। পার্বত্য পথের চড়াই উতরাই পেরোবার ক্লান্তিকর পরিস্থিতি অথবা মরুভূমি অতিক্রমের অস্বস্তিকর পরিবেশে তিনি গভীর অভিনিবেশ সহকারে অভিধান পাঠ করতেন, নতুন-নতুন শব্দ শিখতেন। এভাবে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি তার জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছিলেন, শব্দ সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়েছিল তার মস্তিষ্ক।
পীট ও লর্ড চাহাম উভয়েই অভিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি শব্দ দুবার করে পড়তেন। ব্রাউনিং প্রতিদিনই অভিধান পাঠ করতেন। ‘লিংকন নক্ষত্রালোকে বসতেন’ লিখেন তাঁর জীবনীকার নিকোলে এবং হে, এবং অভিধান পড়তেন যতক্ষণ পর্যন্ত লেখা তাঁর দৃষ্টিগোচর হত। প্রত্যেক খ্যাতনামা লেখক ও বক্তা ঠিক এরূপ পদ্ধতিই অনুসরণ করেন।
উড্রো উইলসন নিশ্চিতভাবেই–একজন জ্ঞানী ইংরেজি ভাষাবিদ। জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা সহ তাঁর কতিপয় লেখা নিশ্চিত ভাবেই বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ। তিনি কীভাবে শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন তা নিম্নে দেয়া হল।
আমার পিতা আমাদের পরিবারের কোনো সভ্য ভুল কথা বলুক তা সহ্য করতেন না। কোনো শিশু ভুল কিছু বললে সাথে-সাথে তা শুদ্ধ করে দেয়া হত। কোনো নতুন শব্দ পাওয়া গেলে তা আমাদের কাছে বার-বার ব্যাখ্যা করা হত, বিভিন্ন বাক্যে তার ব্যবহার শিখিয়ে দেয়া হত। ফলে আমরা সকলেই নতুন নতুন শব্দ শিখতে সক্ষম হতাম।
নিউইয়র্কের একজন বক্তা সারাদিন পরিশ্রম করে বক্তৃতা তৈরি করতেন, রাতে বিশ্রামের আগে অভিধান দেখে শব্দ বদলাতেন। ফলে তাঁর বক্তৃতার ভাষা হয়ে উঠত প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী? যেদিন তিনি বক্তৃতা তৈরি করতেন না সেদিন তিনি ফারনডলস এর সমর্থক শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ, পদান্বয়ী অব্যয় নির্বাচন করতেন, প্রতিটি শব্দের অর্থ লিখতেন, ব্যবহার লক্ষ্য করতেন, ফলে প্রতিদিনই তিনি নতুন শব্দ শিখতে এবং তা ব্যবহার করতে সক্ষম হতেন। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রতিদিন একটি শব্দ শিখলেও বছরে শব্দ ভাণ্ডারে যোগ হয় ৩৬৫টি নতুন শব্দ। তিনি এসব অর্থ সহ পকেট নোটবুকে লিখে রাখতেন এবং অবসর সময়ে তা পাঠ করতেন। ফলে কোনো শব্দই তিনি কখনো ভুলতেন না। কারণ তিনবার ব্যবহার করার পর কোনো শব্দই সহজে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় না।
আপনার ব্যবহৃত শব্দের পশ্চাতে রোমান্টিক কাহিনী :
শুধুমাত্র শব্দের অর্থের জন্যে নয়, উৎপত্তি জানার জন্যে অভিধান ব্যবহার করেন। সংজ্ঞার পরে প্রদত্ত ব্রাকেটে সাধারণত শব্দের ইতিহাস উৎপত্তি প্রভৃতি আলোচিত হয়। কখনো এটা মনে করবেন না যে, আপনি প্রতিদিন যে-সব শব্দ ব্যবহার করেন তা অর্থহীন ধ্বনি মাত্র। তাদের রং আছে, তারা জীবন্ত এবং রোমান্টিক। চিনির জন্যে গ্রাসারকে টেলিফোন করুন এটা ব্যবহারেই শব্দ প্রয়োেগ শেষ নয়। আমরা সাধারণত যে সব শব্দ ব্যবহার করি সে সব শব্দে বিভিন্ন ভাষা ও সভ্যতা থেকে সংগৃহীত শব্দ আছে। টেলি অর্থ দূর এবং ফোন অর্থ ধ্বনি–এই দুটি গ্রিক শব্দ সংযোজনে টেলিফোন শব্দের জন্ম। পুরাতন ফরাসি শব্দ গ্রোসিয়ার থেকে গ্রেসার শব্দের উৎপত্তি এবং ফরাসি গ্রোসিয়ার শব্দটি এসেছে ল্যাতিন গ্রোসারিয়াস থেকে। এর অর্থ হচ্ছে যিনি পাইকারী বা গ্রস হিসাবে বিক্রি করেন। সুগার শব্দটি এসেছে ফরাসি থেকে। ফরাসিতে এটা এসেছে স্পেনিস থেকে, স্পেনিস এটা নিয়েছে আরবি থেকে। আরবিতে এসেছে পার্শি থেকে, আর ফার্শিতে শাকের শব্দ এসেছে সংস্কৃত কারকারা অর্থাৎ আখ থেকে।
আপনি একটি কোম্পানিতে কাজ করেন অথবা কোম্পানির মালিক। পুরাতন ফরাসি শব্দ কম্পানিয়ান থেকে কোম্পানি শব্দের জন্ম। কম্পানিয়ন শব্দের সাহিত্যগত অর্থ হচ্ছে কম উইথ এন্ড পেনিস ব্রেড। অর্থাৎ আপনার কম্পানিয়ন হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যার সাথে আপনি রুটি খান। সুতরাং কোম্পানি শব্দের অর্থ হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তির সমিতি যারা একসাথে নিজেদের সকলের রুটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। আপনার বেতনের অর্থ হচ্ছে আপনার লবণের মূল্য প্রদান। রোমান সৈন্যরা লবণের জন্য নির্দিষ্ট হারে একটা ভাতা পেতেন। আপনার হাতে যে বইটি আছে তার সাহিত্যিক অর্থ হচ্ছে বহুদিন আগে ইক্ষু সেক্সসনেরা বিচ গাছ এবং বিচ কাঠে তাদের শব্দ খোদাই করে রেখেছিল। আপনার পকেটে ডলার নামে যে মুদ্রা আছে সে ডলার প্রথম ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ব্যবহার করা হয় এবং তার উল্লেখ দেখা যায় সেন্ট জোয়াসিম এর থালার বা ডেল-এ।
জেনিটর এবং জানুয়ারি-এই শব্দ দুটির উৎপত্তি রোমে বসবাসকারী এটুসকান কামার এর দরজার জন্যে তৈরি থালা ও বন্ট্র থেকে। মৃত্যুর পর তাঁকে দেবতার মতো সম্মান দেয়া হয়। কেননা তিনিই প্রথম মানুষকে দরজা খুলতে ও বন্ধ করতে শিখান। তারই স্মরণে একটি বছরের শেষে নতুন বছরের প্রারম্ভের মাসকে বলা হয় জানুয়ারি। সুতরাং যখনই আমরা জানুয়ারি বলি তখন আমরা এমন একজন লোকের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাই যিনি খ্রিস্ট জন্মের হাজার-হাজার বছর আগে এই বিশ্বে এসেছিলেন এবং যার স্ত্রীর নাম ছিল জেন।
ইংরেজি বছরের সপ্তম মাস জুলাই নাম হয়েছে জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে। সম্রাট আগাস্টাসের নামানুসারে হয়েছে আগস্ট মাস। এই সময় অষ্টম মাস ছিল ত্রিশ দিনে? কিন্তু আগাস্টাস তাঁর নামানুসারে মাস আগস্ট জুলিয়াস থেকে ছোট হোক এটা মানতে রাজি ছিলেন না, সুতরাং ফেব্রুয়ারি থেকে একটি দিন নিয়ে এই মাস অর্থাৎ আগস্টের সাথে যোগ করা হয়। প্রতিটি শব্দের ইতিহাসও ঠিক এইরূপ।
অতএব বিভিন্ন শব্দের ইতিহাস, উৎপত্তি এবং তাৎপর্য জানার জন্য বৃহৎ অভিধানের সাহায্য নিন। এসবের কাহিনী জানুন। আপনার শুধু জ্ঞান বাড়বে না, জানার জন্যে আগ্রহ বাড়বে। আপনি নতুন শব্দ ব্যবহার করতে পেরে আনন্দ পাবেন।
একটি বাক্য একশত চার বার পুনর্লিখন :
আপনি যা বলতে চান তা সংক্ষেপে স্পষ্টভাবে বলতে চেষ্টা করুন। এটা সব সময় তেমন সহজ নয়-অভিজ্ঞ লেখকের জন্যেও এটা সহজ নয়। কেনী হাস্ট আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি সময়-সময় তাঁর বাক্যসমূহকে ভাব থেকে একশত বার পর্যন্ত লিখেন। তিনি বলেন, আমার সাথে আলাপের কয়েকদিন আগে তিনি একটি বাক্য একশত চার বার লিখেছেন? মার্বেল উরনার বলেছেন যে, তিনি সময়-সময় দীর্ঘ একটি অপরাহ্নে সংবাদপত্রের একটি মাত্র বাক্য শিখেন।
সঠিক শব্দ চয়নের জন্যে রিচার্ড হার্ডিং ডেভিস কীভাবে চেষ্টা চালাতেন তা মরিস ব্যক্ত করেছেন :
বহু ফ্রেজ নিয়ে তিনি বাক্য বাঁধনের চেষ্টা করতেন এবং সর্বশেষ যেটি তাঁর কাছে অর্থবহ বলে মনে হত সেটিই ব্যবহার করতেন। ফ্রেজ অধ্যায় পৃষ্ঠাটি এবং এমনকি সমগ্র গল্পটি তিনি বারবার লিখতেন। স্মরণ রাখার লক্ষ্য সামনে রেখে তিনি লিখতেন। ফটকের কাছ দিয়ে যে যান বাহনটি চলে গেল তার সম্পর্কে লিখতে গেলে তিনি শুধু সেই যানবাহনটির আকার, রং আকৃতির কথা লিখতেন না, যানবাহনের ইতিহাস লিখতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না পাঠকদের সামনে যানবাহনটির ছবি স্পষ্ট করে তুলতে পারতেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি লিখতেন। এখন কি ছবিটি স্বচ্ছ? তিনি প্রশ্ন করতেন। এতেও স্পষ্ট না হলে তিনি আবারো লিখতেন, নতুন ভাবে নতুন-নতুন শব্দ ব্যবহার করে। ফলে পাঠক তাঁর লেখা পাঠ করে যানবাহন সম্পর্কে সহজে সঠিকভাবে জানতে সক্ষম হত।
আমাদের মধ্যে অনেকেই নতুন-নতুন শব্দ চয়নের সময় দিতে পারি না অথবা তেমন আগ্রহীও হই। উদাহরণগুলো উল্লেখ করে এটা দেখান হল যে নামী লেখকগণ কীভাবে সঠিক শব্দ চয়ন ও তা প্রয়োগ করেন। এটা ছাত্রদের ভাষা শুদ্ধভাবে শিখতে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা যায়। তবে বক্তৃতা করার সময় আগে চিন্তা না করে নতুন-নতুন শব্দ ব্যবহারের চিন্তা সুস্থতার লক্ষণ নয়। নতুন শব্দ প্রয়োগ করতে বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ানোর আগে সে সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। এটা কি সব বক্তা করেন? না, করেন না, করা সম্ভব হয় না।
মিল্টন আট হাজার শব্দ ব্যবহার করেছেন, শেক্সপীয়র ব্যবহার করেছেন পনের হাজার শব্দ। একটি স্টান্ডার্ড অভিধানে আছে ৫০ হাজার শব্দ। সাধারণ হিসাবে প্রতিটি মানুষ গড়ে দুহাজার শব্দ মুখস্থ রাখেন। এর মধ্যে কিছু আছে ক্রিয়াপদ, কিছু সংযোগরক্ষাকারী শব্দ, কিছু বিশেষ্য আর কিছু বিশেষণ। আমি কিছুকাল কলরেডোতে অতিবাহিত করেছি। এই সময়টার কথা আমি কখনো ভুলবো না। একদিন আমি দেখলাম যে একজন মহিলা কুকুরের জন্যে যে বিশষণ ব্যবহার করছেন কনসার্ট পার্টিকেও সেই বিশেষণে ভূষিত করছেন। এর কারণ সীমিত শব্দ ভাণ্ডার। সীমিত শব্দ ভাণ্ডারের জন্যে তিনি কুকুরকেও বলছেন বিউটিফুল, ক্লনসার্ট পার্টিকেও বলছেন বিউটিফুল!
তার শব্দ ভাণ্ডার যদি সীমিত না হত তাহলে তিনি বিউটিফুল এর স্থলে কি শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন? তিনি ব্যবহার করতে পারেন বিউটিয়াস, হ্যাঁন্ডসাম, প্রেটি, লাভলী, গ্রেসফুল, এরিজেন্ট, একসকুইজিট, ডেলিকেট, ডেইনটি প্রভৃতি বিশেষণ।
শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হলে ঠিক একই অর্থের বিভিন্ন বিশেষণ স্থল ও ক্ষেত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যবহার করা যায়।
এ প্রসঙ্গে আমি রোগেট এর ‘ট্রেজারী অব ওয়ার্ডস’ বই এর কথা বলব। আমি কাজ করার সময় অভিধান যেভাবে ব্যবহার করি এটিও ঠিক সমভাবে ব্যবহার করি।
এটি গ্রন্থাগারের বা পাঠাগারের বুক শেলফ এ ফেলে রাখার মতো বই-নয়। এটা অভিধানের মতো সব সময় ব্যবহার যোগ্য বই? আপনার বক্তৃতা প্রস্তুতি কালে অভিধান ব্যবহার করুন। যে কোনো প্রতিবেদন রচনা কালেও ব্যবহার করুন অভিধান, দৈনিক ব্যবহার করুন, ফরে আপনার শব্দ ভাণ্ডার সহজে বেড়ে যাবে।
জীর্ণ বাগবৈশিষ্ট্য পরিহার :
শুধুমাত্র সঠিক নয়, মূল ব্যবহারের চেষ্টা করুন, যা দেখবেন তা বলার সাহস রাখুন। উদাহরণ স্বরূপ বন্যার পর কতিপয় ব্যক্তি বন্যার ঠাণ্ডাকে শশার সাথে তুলনা করেন। এটা নিতান্ত তাজা বাক্য বিধায় এটা গ্রহণ যোগ্য ও আকর্ষণীয়।
ঠাণ্ডা সম্পর্কে কতিপয় উদাহরণ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে। এগুলো কি সহজে গ্রহণযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী নয়?
ব্যাঙের মতো ঠাণ্ডা।
সকালের হট ওয়াটার ব্যাগের মতো ঠাণ্ডা।
ভেড়ার মতো ঠাণ্ডা।
মন্দিরের মতো ঠাণ্ডা।
গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলা পাহাড়ের মতো ঠাণ্ডা।
ক্লারিজের মতো ঠাণ্ডা।
লবণের মতো ঠাণ্ডা।
কেঁচোর মতো ঠাণ্ডা।
প্রত্যুষের মতো ঠাণ্ডা।
শরতের বৃষ্টির মতো ঠাণ্ডা।
সুতরাং এভাবে চিন্তা করে ঠাণ্ডা সম্পর্কে আরো বহু অর্থবহ আকর্ষণীয় উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
স্টাইল সম্পর্কে একদা আমি কেথেলিন মরিসকে প্রশ্ন করতে তিনি উত্তর দেন ”খ্যাতনামা লেখকদের গদ্য পাঠ এবং তাতে ব্যবহৃত ফ্রেজ কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা দেখে নিজের বাক্যের উন্নয়নই প্রকৃষ্ট পন্থা।”
একজন ম্যাগাজিন সম্পাদক একবার আমাকে বলেছিলেন যে, কোনো লেখক তার কাছে প্রকাশের জন্যে কিছু পাঠালে তাতে একাধিক উদ্ধৃতি দেখলে তা তিনি লেখকের কাছেই ফেরত পাঠাতেন। কারণ তিনি মনে করেন যে প্রকাশের যার মৌলিকত্ত্ব নেই চিন্তারও তার মৌলিকত্ত্ব থাকতে পারে না।
সংক্ষিপ্ত সার :
(১) আমাদের জীবনের চারটি জিনিস বিচার্য। তা হচ্ছে আমরা কী করি, আমরা কীভাবে তাকাই, আমরা কী বলি এবং আমরা কীভাবে করি, বলি। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট চার্লস ডব্লিউ ইলিয়ট একবার বলেছিলেন, “অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটা বুঝেছি যে, যে কোনো ভদ্র মহিলা বা ভদ্রমহোদয়ের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে নিজ মাতৃভাষা সঠিকভাবে জানা।”
(২) আপনার ভাষা আপনার সাথীদের প্রভাবিত করবে। সুতরাং লিংকনের আদর্শ অনুসরণে খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের লেখা পড় ন। তাঁর মতো প্রতিদিন বিকেলে শেক্সপিয়ার ও অন্যান্য খ্যাতনামা কবি ও লেখকদের লেখা পাঠ করুন। নিয়মিত ভাবে এটা করলে আপনার ভাষা নিশ্চিত ভাবেই উন্নত হবে এবং আপনার সে ভাষা সাথীদের অবশ্যই প্রভাবিত করবে।
(৩) ”টেলিটাস ও ঠুসি ডিডাস এবং নিউটন ও উইক্লিড পাঠের জন্যে আমি সংবাদ পাঠ ছেড়ে দিয়েছি।” লিখেছেন টমাস জেফারসন, “এবং এতে আমি অধিক আনন্দ লাভ করছি।” কেন এই উদাহরণ অনুসরণ করছেন না। সংবাদ পত্র পাঠ একেবারে ছেড়ে দেবেন না, তবে সংবাদপত্র পাঠে এখন যে সময় ব্যয় করেন, তার কিছু অংশ বই পাঠের জন্যে নিয়ে নিতে পারেন। কোনো বই এর ২০/৩০ পৃষ্ঠা কেটে নিয়ে তা পকেটে রাখুন, দিনের অবসর কালে তা পাঠ করুন।
(৪) আপনার পাশে একটা অভিধান রাখুন। অপরিচিত শব্দ দেখুন। এটার প্রয়োগ লক্ষ করুন, তা হলে সহজে আপনি নতুন শব্দ মনে রাখতে পারেন।
(৫) আপনি যে শব্দ ব্যবহার করছেন তার শুধু অর্থ নয়, ইতিহাসও জানুন। উদাহরণ স্বরূপ সেলারি শব্দের সঠিক অর্থ সল্ট মানি। রোমান সৈন্যদের সল্ট কেনার জন্য একটা ভাতা দেয়া হত। এ থেকে অর্থাৎ সল্ট মানি থেকে সেলারির উদ্ভব।
(৬) দ্ব্যর্থ বোধক শব্দ নয়, অর্থবহ শব্দ ব্যবহার করুন। আপনার ডেস্কে রোজেটের ‘ট্রেজারী অব ওয়ার্ডস’ বইটি রাখুন। চোখে যা দেখছেন তার সব কিছুকে শুধু ”বিউটিফুল” বলবেন না। একই অর্থের অর্থ-একাধিক শব্দ ব্যবহার করলে আপনার বাক্য হবে আরো আকর্ষণীয় এবং অর্থবহ।
(৭) ঠাণ্ডাকে শুধু মাত্র শশার সাথে তুলনা করবেন না। নিজে চিন্তা করে ঠাণ্ডাকে কিসের সঙ্গে তুলনা করলে সহজ অর্থ পাওয়া যায় তা বের করুন।
সুস্পষ্টভাবে সবকিছু প্রকাশ করুন।