একটা মুহূর্ত বাংকের উপর বসে সে ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগল। তারপর বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা ‘৪৫ ক্যালিবার কোল্ট অটোমেটিক বের করে আনল। প্যান্টের কোমর বন্ধনিতে ওটা গুঁজে পিরুকে পাশ কাটিয়ে উপরে ডেকে চড়লো। •
একজন দীর্ঘদেহী আরব রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা ঢাকা কাপড়টা কালো সিল্কের কর্ড দিয়ে আটকানো। কালো মুখে ঠাণ্ডা চোখ জোড়া চক চক করছে। একটা পুরোনো ক্ষত মুখটাকে বাঁকা করে দাড়ির মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
কী চাও তুমি? কেইন প্রশ্ন করল।
সেলিম তার বেল্টে আটকানো বাঁকা জামবিয়া ছুরিটার রূপালি বাঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল, “স্কিরোজ আমাকে পাঠিয়েছে, সে বলল। আমি পুটলিটা নিতে এসেছি।’
‘তাহলে তুমি বরং স্কিরোজের কাছে ফিরে গিয়ে তাকে নিজে আসতে বলো।’ কেইন বলল। কে আমার লঞ্চে উঠতে পারবে না পারবে সে ব্যাপারে আমার নিজের পছন্দ অপছন্দ আছে।
সেলিম নরম স্বরে বলল, ‘একদিন তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলবে, সেদিন তোমাকে আমার মেরে ফেলতে হবে।’
‘আমি প্রাণ ভয়ে এখনই কাঁপছি।’
আরব লোকটি অতিকষ্টে তার রাগ সামলে বলল, ‘পুটলিটা।
কেইন কোমরবন্ধ থেকে কোল্টটা বের করে গুলি ছোঁড়ার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বলল। “আমার লঞ্চ থেকে নামো।’
হঠাৎ একটা বিপজ্জনক নিরবতা নেমে এল। সেলিম হাতের মুঠোয় জামবিয়ার হাতল শক্ত করে ধরল। কেইন দ্রুত কয়েক পা সামনে এগিয়ে এক পা তুলে নিচু রেইলের উপর দিয়ে তাকে একটা ধাক্কা মারল।
বৈঠার কাছে বসে থাকা দুজন আরব মাঝি তাড়াহুড়ো করে তাদের মালিককে পানি থেকে তুলল। সে পানিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়েছিল, কাশতে কাশতে মুখ থেকে সে পানি বের করল। তার আলখাল্লা পানিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে।
কেইন এক পা রেইলে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। কোল্টটা অলসভাবে এক হাতে ধরে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য সেলিম তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর আঙ্গুলে তুড়ি মারতেই দুই দাড়ি নৌকা নিয়ে লঞ্চের পাশ থেকে সরে গেল।
জেটিতে মরচে ধরা কার্গো জাহাজটার পাশে একটা বড় তিন মাস্তুলওয়ালা ধাও নোঙর করা রয়েছে। সেলিম চিনতে পারল ওটা সেলিমের ধাও ফারাহ। দাঁড়টানা নৌকাটা ধীরে ধীরে ওটার দিকে যাচ্ছিল। কয়েক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে সে রেইল থেকে ফিরল।
পিরু ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বেশ চিন্তিত। কাজটা ভাল হলো না সাহিব। সেলিম এটা ভুলবে না।’
কেইন কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “সে আমি ভাববো। ক্লান্তি আবার ভর করতেই সে অলসভাবে হাই তুলল। এখন একটু ঘুমানো দরকার। স্কিরোজ এলে আমাকে জানাবে।
পিরু মাথা নেড়ে রেইলে হেলান দিয়ে ডেকের উপর আসন পেতে বসল। কেইন নিচে চলে গেল।
কোল্টটা বালিশের নিচে ঠেলে দিয়ে একটা ড্রিংকস নিয়ে সিগারেট ধরাল, তারপর বাংকে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রেখে কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এয়ারকন্ডিশনারের হাওয়ায় নীল ধোয়ার মোচড় খাওয়া দেখতে দেখতে সেলিমের কথা ভাবলো।
লোহিত সাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত সমস্ত বন্দরে সে পরিচিত। যে কোন জিনিস–সোনা, অস্ত্র, এমনকি মানুষ, যাতেই লাভ পাওয়া যায় সে তা নিয়েই ব্যবসা করে। তবে তার কাজের এই অংশটুকু কেইন সহ্য করতে পারে না। এখনো আরব দেশগুলোতে ক্রীতদাস বিশেষত ক্রীতদাসীর বেশ চাহিদা আছে। সেলিম এই চাহিদা মেটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সে বিশেষ করে অল্পবয়সি মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করে।
কেইন মনে মনে চিন্তা করল, কোন এক অন্ধকার রাতে যদি ফারাহ কোন দুর্ঘটনায় পড়ে তখন সেলিম কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এটা অবশ্য সহজেই ঘটানো যায়। মুকাল্লাতে উদ্ধারকাজ করার সময় সে যে পানি নিরোধক বিস্ফোরক ব্যবহার করেছিল তার একটা দিয়ে কাজটা সারা যেতে পারে। এই ভাবনাটা তাকে বেশ স্বস্তি দিল।
চোখ বন্ধ করতেই অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরল।
.
ঘণ্টাখানেক ঘুমাতেই কাঁধে হালকা ঠেলা খেয়ে সে জেগে উঠল। পিরু বাংকের পাশে দাঁড়ানো।
কেইন কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হল। কী ব্যাপার, স্কিরোজ এসেছে?
পিরু মুখ গম্ভীর করে ঘাড় কাত করল। সে জেটিতে অপেক্ষা করছে, সাহিব।
কেইন মাটিতে দুপা নামিয়ে দাঁড়াল, তারপর দুহাত টান টান করল। ঠিক আছে তুমি বরং তাকে ডিঙ্গিতে করে এদিকে নিয়ে এস।’
পিরুকে পেছন পেছন নিয়ে সে উপরে ডেকে গেল। স্কিরোজ বড় একটা পানামা হ্যাট দিয়ে মুখ আড়াল করে জেটির কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ময়লা দাগলাগা সাদা লিনেন স্যুট।
পিরু পানিতে ডিঙ্গি নামিয়ে দ্রুত দাঁড় বেয়ে ওর দিকে এগোতেই গ্রিক লোকটি তার মালাক্কা বেতের লাঠিটা উঁচু করে উৎফুল্ল স্বরে বলল, আমার কি এখন আসাটা নিরাপদ হবে। সকালেই কিন্তু একবার গোসল করেছি।’
কেইন এক হাত উঠিয়ে বলল, “আমি তোমার জন্য একটা ড্রিংকস রেডি করে রাখবো।”
অনেক কসরত করে জেটির গায়ে লাগানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে অবশেষে সে ডিঙ্গিতে নামল। এ দৃশ্য দেখার পর কেইন কেবিনে গেল। দুই গ্লাস জিন স্লিং তৈরি করা শেষ করতেই ডিঙ্গিটা এসে লঞ্চের গায়ে ঠেকলো। একটু পরই স্কিরোজ ভারী পায়ে মচ মচ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে কেবিনে প্রবেশ করল।