মন্দিরের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে নিজের চোখগুলোকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে লিসা। ও খেয়াল করে দেখল, কাঠের গায়ে এবং দেয়ালে আঁকা চিত্রে এমন কিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছে যেগুলো দেখতে খুব একটা ভাল লাগছে না। মোমবাতির অল্প আলোতে পৈশাচিক লাগছে ওগুলোকে। উপরের দিকে তাকাল ও। কাঠের খুঁটি দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। ওপর থেকে ঝুলে থাকা এক গুচ্ছ বাতিকে ধরে রেখেছে ওগুলো। তবে বাতিগুলো জ্বলছে না। সব বন্ধ ও ঠাণ্ডা।
আবার হাঁক ছাড়লেন আং গেলু।
ওদের মাথার উপরে কোনো এক স্থানে কিছু একটা শব্দ করে উঠল।
হঠাৎ শব্দ হওয়ায় ভড়কে গেল ওরা। সৈনিক একটা ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। লাইটের আলো আর তার পাশে ছায়া ছাড়া আর কোনোকিছু চোখে পড়ল না।
কাঠের ওপর আবার শব্দ হলো। ওপরের তলায় কে যেন নড়াচড়া করছে। কেউ বেঁচে আছে এরকম সংকেত পাওয়া সত্ত্বেও ভয়ে লিসার রোম দাঁড়িয়ে গেল।
মুখ খুললেন আং গেলু। ‘মন্দিরের দেখাশোনা করার জন্য একটা ব্যক্তিগত মেডিটেশন রুম আছে। সিঁড়ি পেছন দিকে। আমি যাচ্ছি। আপনি থাকুন।
লিসা তার কথা মেনে নিতে চাচ্ছিল কিন্তু মেডিক্যাল ব্যাকপ্যাক আর দায়িত্ব, দুটোর প্রয়োজনীয় উপলব্ধি করল ও। গবাদি পশুগুলোর মৃত্যুর জন্য মানুষ দায়ী নয়। সেটা লিসা বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছে। যদি কেউ এখনও বেঁচে থাকে তাহলে সে হয়তো বলতে পারবে, এখানে আসলে কী ঘটেছিল। আর এ-কাজে লিসা-ই সবচেয়ে উপযুক্ত।
নিজের ব্যাকপ্যাকটাকে আরও ভাল করে কাঁধে রাখল লিসা। ‘আমি আসছি।’
কথাটা জোর গলায় বললেও আং গেলু’র পেছনেই রইল ও।
বুদ্ধ মূর্তির পেছনে গেলেন সন্ন্যাসী। ওদিকে একটা দরজা আছে। স্বর্ণখচিত পর্দা পেরিয়ে এগোলেন তিনি। একটা ছোট হলওয়ে ভবনের আরও গভীরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিল। বন্ধ জানালাগুলোর ফাঁক-ফোকর দিয়ে অল্প করে রুপোলি আলো ভেতরে আসছে। ভেতরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, ধূলিময়। সাদা চুনকাম করা দেয়ালের দিকে আলো ফেলল ওরা। টকটকে লাল রক্ত আর নোনতা গন্ধেই যা বোঝার বোঝা গেল। আরও কাছে গিয়ে পরীক্ষা না করলেও চলবে।
রক্ত।
এক জোড়া নির্জীব নিথর পা হলের মাঝখানের একটা দরজার সামনে পড়ে রয়েছে। আং গেলু লিসাকে মন্দিরে ফিরে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। মাথা নাড়ল লিসা, সন্ন্যাসীকে পেরিয়ে এগোল। যে পড়ে আছে তাকে বাঁচানোর কোনো আশা নেই, এটা লিসা জানে। কিন্তু অভ্যাসবশত এগোচ্ছে সে। পাঁচবার লম্বা লম্বা পা ফেলে লাশের কাছে পৌঁছে গেল লিসা।
দৃশ্য দেখে বুক ছলকে উঠল ওর। পিছিয়ে এলো।
পা দুটো ওখানে আছে কিন্তু কোনো শরীর নেই। শুধুই একজোড়া কাটা পা, উরুর কাছ থেকে কেটে নেয়া হয়েছে। সাহস করে রুমের ভেতরে তাকাল ও। কাঠের ডাল পালার মতো মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হাত-পা জড়ো করা রয়েছে রুমের মাঝখানে। এ যেন এক কসাইখানা।
শুধু তাই-ই নয়। কয়েকটা কাটা মুণ্ডুও আছে। দেয়াল ঘেঁষে সুন্দর করে সাজানো আছে ওগুলো। সব মুণ্ডুর চোখ খোলা অবস্থায় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ভয়ঙ্কর।
লিসার পাশে এলেন আং গেলু। এরকম দৃশ্য দেখে তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কী যেন বলতে শুরু করলেন বিড়বিড় করে। শুনে মনে হলো ওগুলোর অর্ধেক প্রার্থনা, অর্ধেক অভিশাপ।
তার আওয়াজ শুনেই বোধহয় রুমের ভেতরে কিছু একটা নড়ে উঠল। হাত-পা’র স্তূপ থেকে একটু দূরে একটা নগ্ন দেহ চোখে পড়ল। পুরো মাথা কামানো। সদ্যজাত শিশুর মতো সারা শরীরে রক্ত। ইনি মন্দিরের একজন সন্ন্যাসী।
নগ্ন দেহের কণ্ঠ থেকে হিস-হিস শব্দ ভেসে এলো পাগলের প্রলাপের মতো। তার চোখে অল্প আলোক রশ্মি প্রতিফলিত হচ্ছে, রাতের আঁধারে থাকা নেকড়ের মতো লাগছে তাকে।
নগ্ন দেহটা ওদের দিকে এগোতে শুরু করল। হাতে ধরে নিয়ে আনছে একটি তিন ফুটি ধারালো কাস্তে। কয়েক কদম পিছিয়ে গেল লিসা। আগন্তুককে থামানোর জন্য হাত তুলে আং গেলু নরম কণ্ঠে বললেন, ‘রেলু নাআ, রেলু নাআ।
লিসা বুঝতে পারল আং গেল এই পাগলকে চেনেন। এই মঠে আসার আগে থেকেই একে চিনতেন আং গেলু। হাত তুলে নাম ধরে ডাকার ফলে পাগল সন্ন্যাসীর পাগলামো থামল। কিন্তু এতে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।
বিকট চিৎকার জুড়ে দিয়ে পাগল সন্ন্যাসী ঝাঁপিয়ে পড়ল তার জ্ঞাতি ভাইয়ের ওপর। আং গেলু তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শরীরের সাথে সাথে পাগল সন্ন্যাসীর মানসিক অবনতিও ঘটেছে। তাকে জড়িয়ে ধরে দরজার কাঠামোর একপাশে বসালেন আং গেলু।
চটপট কাজে লেগে পড়ল লিসা। প্যাক নামিয়ে জিপার খুলল ও। মেটাল কেস বের করে খুলল ওটা।
ভেতরে এক সারি প্লাস্টিক সিরিঞ্জ আছে। আপদকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ওষুধ ভরা রয়েছে ওগুলোতে। যেমন : ব্যথার জন্য মরফিন, শ্বাসকষ্টের জন্য ইপিনিফিরিন, ফুসফুস সংক্রান্ত সমস্যার জন্য ল্যাসিক্স ইত্যাদি। প্রত্যেকটা সিরিঞ্জের গায়ে নাম লেখা থাকলেও লিসা ওগুলোর অবস্থান মুখস্থ করে রেখেছে। কারণ জরুরি মুহূর্তে প্রতিটি সেকেন্ড অনেক মূল্যবান। মেটাল কেসের ভেতরে থাকা সর্বশেষ সিরিঞ্জটা বের করল লিসা।
মিডাজোলেম। স্নায়বিক উত্তেজনা কমায়। এরকম উচ্চতায় পাগলামো ও দৃষ্টিভ্রম মোটামুটি সাধারণ ঘটনা। ওষুধের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।