বড় একটা দম নিয়ে দরজা খুললো। আর সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির উষ্ণতা বয়ে গেলো শরীর জুড়ে। ফ্যাকাশে মুখে বিধ্বস্ত এক নারী উশকো-খুশকো চুলে তার দরজায় দাঁড়িয়ে।
‘ও কমরেড,’ বলার ভঙ্গিতে বিগলিত ভাব ছড়িয়ে দিলেন, রিনরিনে কণ্ঠ, ‘তুমি এসেছো টের পেলাম, একটু কি আসবে নাকি। আমার রান্নাঘরের সিঙ্কটা না বন্ধ হয়ে গেছে-’
ইনি মিসেস পারসন্স। একই তলার প্রতিবেশীর স্ত্রী। (পার্টিতে মিসেস বলার চল নেই। বরং বারণ আছে। আপনাকে বলতে হবে ‘কমরেড’। কিন্তু কতিপয় নারীকে দেখলে ওই শব্দটি ঠিক আসে না।) এই নারীর বয়স বছর ত্রিশেক, কিন্তু দেখতে আরও বয়সী মনে হয়। তাকালে মনে হবে তার মুখমণ্ডলের ভাঁজে ভাঁজে ধুলোর আস্তর জমে আছে। উইনস্টন কথা না বাড়িয়ে ওর পিছু নিলো।
এই ফালতু সারাইয়ের কাজটি এখন মোটামুটি তার নিত্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভিক্টরি ম্যানশন্সের ফ্ল্যাটগুলো বেশ পুরোনো। ১৯৩০ কিংবা ওই সময়েরই তৈরি। আর এখন এর ছাদ-দেয়ালের পলেস্তারাগুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। একটু বেশি বরফ পড়লে পাইপ ফাটবেই। অর্থনীতির নীতির চাপে হিটিং সিস্টেম এখন বন্ধ। তবে যখন বন্ধ ছিলো না তখনও খুব যে ভালো কাজ করতো এমন নয়। সারাইয়ের কাজ নিজে নিজে করে নিতে পারলে ভালো তা না হলে কিছুই করার নেই। জানালার শার্সি ভাঙলেও তা সারাইয়ের দায়িত্ব যাদের তারা আসবে না। বছর দুই হয়ে গেলো এসবে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে।
‘টম বাড়িতে নেই তাই ডাকছি,’ অষ্ফুট স্বর মিসেস পারসন্সের।
পারসন্সদের ফ্ল্যাটটি উইনস্টনের ফ্লাটের চেয়ে বড় আর একটু বেশিই নোংরা। সবকিছু যেনো ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছড়িয়ে রয়েছে; যেনো কোনও অতিকায় হিংস্র জন্তু এইমাত্র গোটা ঘরটি দাবড়ে তছনছ করে গেছে। খেলার মালমাত্তা চারিদিকে- হকি-স্টিকস, বক্সিং গ্লাভস, ফেঁটে চুপসে যাওয়া ফুটবল, ঘামে জবজবে একটি শর্টস মেঝেতে উল্টো হয়ে পড়ে আছে। টেবিলে পড়ে আছে এঁটো থালা-বাসন আর একটা শরীরচর্চার বই। দেয়ালে ইয়ুথ লিগ ও স্পাইসের জ্বলজ্বলে ব্যানার আর বিগ ব্রাদারের প্রমাণ সাইজের একটি পোস্টার ঝুলছে। পুরো ভবন থেকেই সিদ্ধ বাঁধাকপির একটা গন্ধ সারাক্ষণই আসে। তার ওপর এই কক্ষে ছড়িয়ে আছে তীব্র ঘামের গন্ধ। প্রথম নিশ্বাসেই এই গন্ধ আপনার নাসিকা রন্দ্রে ধাক্কা দেবে। বোঝা দায়- একটি লোক যখন উপস্থিত নেই তখনও তার ঘামের তীব্র গন্ধটি কি করে গোটা কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। অপরকক্ষে কেউ একজন একটি চিরুনি আর একটুকরা টয়লেট পেপার হাতে টেলিস্ক্রিনের সামরিক বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে।
‘বাচ্চাদের কাজ,’ দরজায় মুখটি গলিয়ে দিয়ে আধা-উদ্বেগের অভিব্যক্তি ছড়িয়ে বললেন মিসেস পারসন্স। ‘আজ ওরা বাইরে যায়নি। আর বুঝতেই পারছেন…’
মাঝপথে কথা থামিয়ে দেওয়া মিসেস পারসন্সের অভ্যাস। রান্নাঘরের সিঙ্ক কানায় কানায় ভরে আছে সবুজ রঙের ঘিনঘিনে পানিতে, তাতে সিদ্ধ বাঁধাকপির চেয়েও নিকৃষ্ট গন্ধ। উইনস্টন নিচু হয়ে পাইপের সংযোগ পয়েন্টটি দেখে নিলো। হাত দিতে গা গুলিয়ে আসছিলো। নিচু হয়ে দেখতেই ঘৃণাবোধ হচ্ছিলো তার। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত কাশির ধমক উঠে যায়। মিসেস পারসন্স অবশ্য তখনও অসহায় মুখ করে তাকিয়ে।
‘টম বাড়িতে থাকলে চিন্তাই ছিলো না, ঠিক হাত দিয়ে পরিস্কার করে ফেলতো। এসবে হাত লাগাতে ওর একটুও খারাপ লাগে না।’
সত্য মন্ত্রণালয়ে উইনস্টনের সহকর্মী পারসন্স। মোটাসোটা, কিন্তু খাটুড়ে। হাঁদারাম গোছের, সবকিছুতেই বাড়তি আগ্রহ। কোন প্রশ্ন ছাড়াই যে দায়িত্বই দেয়া হোক কাজে লেগে পড়ে। থটপুলিশ নয়, আসলে এমন কিছু নিয়োজিত কর্মীর কারণেই পার্টি টিকে আছে।
পয়ত্রিশ বছর বয়সে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে ইয়ুথ লিগ থেকে বের হয়ে আসতে হয়। ইয়ুথ লিগের আগে বয়সের বাধা সত্ত্বেও ব্যবস্থা করে বছরখানেক স্পাইসেও কাটিয়েছেন। সত্য মন্ত্রণালয়ে তার কাজ নিচের দিকের একটি পদে। এমনই কাজ যাতে বুদ্ধির প্রয়োগ নেই বললেই চলে। তবে স্পোর্টস কমিটিতে তিনি কিন্তু হোমড়া-চোমড়াদের একজন। এছাড়াও কমিউনিটি চাঙ্গা করার কর্মসূচি, তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ কর্মসূচি, সঞ্চয় ক্যাম্পেইনের মতো স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি হলেও তাকে কমিটিতে রাখা হয়। তখন বেশ বুক ফুলিয়ে বিষয়টি সবাইকে জানান দিতে থাকেন পারসন্স। পাইপে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাব-ভঙ্গিমা দেখিয়ে ওসব বলবেন। গত চার বছরে কোনও সন্ধ্যায় কমিউনিটি সেন্টারে তাকে একটি বারের জন্য হলেও দেখা যায়নি, এমনটা ঘটেনি। আর জীবন সম্পর্কে তার উদাসীনতার প্রমাণ স্বরূপ ঘামের বিকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে তিনি যেখানে যান সেখানেই।
‘সংযোগ পয়েন্টের নাটটি মুছতে মুছতে উইনস্টন বললো, ‘আপনাদের ঘরে স্প্যানার আছে?’
‘স্প্যানার,’ বললেন মিসেস পারসন্স। পরে কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এলো, বললেন, ‘আমি ঠিক জানি না, নিশ্চিত নই। সম্ভবত বাচ্চারা…।’
বুটের ঠক ঠক শব্দ আর চিরুনি ছুঁড়ে মারার শব্দ ভেসে এলো লিভিং রুম থেকে। মিসেস পারসন্স একটি স্প্যানার এগিয়ে দিলেন। উইনস্টন ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে পাইপের সঙ্গে আটকে যাওয়া একদলা চুল ছাড়িয়ে আনলো। এরপর ট্যাপের ঠাণ্ডা পানিতেই ভালো করে আঙ্গুলগুলো সাফ করে পাশের রুমে গিয়ে দাঁড়ালো।
‘হাত তোলো’ ঝাঁঝালো একটি কণ্ঠ চিৎকার করে উঠলো।